সমীরণ সেনগুপ্ত
এক
রাত বারোটার কিছু পর। কলকাতার বুক জুড়ে যেন নিঃশব্দ এক বিষণ্নতা নেমে এসেছে। গলির পর গলি পেরিয়ে ডঃ অভিজিৎ ধর এসে দাঁড়ালেন জাফরান রোডের মোড়টায়—বামদিকে একটি পুরনো, ভাঙাচোরা বাড়ির পাশে লাগোয়া সংকীর্ণ দেওয়াল, যার গায়ে ছায়ার মতো কিছু একটার টলোমলো প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হচ্ছে। চারদিক ফাঁকা, তবে বাতাস ভারী। এক অদ্ভুত চুলকানির মতো অনুভব হচ্ছে তার মস্তিষ্কের ভেতর—এমন যেন কোনও অজানা কম্পন, অতি নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে মগজকে ঘিরে ধরেছে। এই জায়গাটায় বহু বছর আগে এসেছিলেন তিনি, শেষবার স্ত্রী রীণার হাত ধরে, তখনও জানতেন না—এই নির্জন গলি একদিন তার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। গলির শেষপ্রান্তে একটা হলদে আলো টিমটিম করছিল, যেন কারও নিঃশেষ নিঃশ্বাস। তাঁর চোখ বারবার ঘড়ির দিকে যাচ্ছিল—১২টা বাজতে চলেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, যেন এক দৃশ্যের পর্দা সরে গেল। বাড়ির দেওয়ালে ফুটে উঠল একটি ছায়াময় গঠন, যা একটি দরজার মতো, কিন্তু কোনও স্পষ্ট কাঠামো নেই—আলো-অন্ধকারের মধ্যেকার ক্ষীণ রেখাচিত্র যেন নিজেই নিজেকে নির্মাণ করছে।
পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল—বৃদ্ধ এক মহিলা, হয়তো ভবঘুরে, তার গায়ে পুরনো নীল শাড়ি, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। “এইটা আপনার জন্য খুলছে, মশাই… ও তো আপনাকেই খুঁজছে।” চমকে পিছনে তাকালেন অভিজিৎ, কিন্তু মহিলা ততক্ষণে অদৃশ্য। হঠাৎ কনকনে বাতাস বইল, আশেপাশের কুকুরগুলো চেঁচিয়ে উঠল—আর দরজার ছায়া ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। অভিজিতের বুকের ভিতর চাপ চাপ ব্যথা—এই ‘দরজা’টা কী? কোথা থেকে আসে? কে বা কারা নিয়ন্ত্রণ করে? তিনি ফিরে গেলেন নিজের বাড়িতে, গলির সেই দৃশ্য বারবার মাথায় ঘুরতে লাগল। সে রাতে ঘুমোতে পারেননি। সকাল হতেই পুরনো ট্রাঙ্ক খুলে স্ত্রীর রেখে যাওয়া কিছু কাগজ বের করলেন। তার ভেতরেই একটা খাম—‘যদি আমি না ফিরি, তবে খুলবে।’ খামের ভিতরে শুধু একটি ছোট চিঠি—“আমি ওখানে যাচ্ছি, অভি। আমার বিশ্বাস, কিছু সত্য ওখানেই লুকিয়ে আছে। হয়তো সময়ের বাইরেই আমরা নিজেদের খুঁজে পাব। তোমায় ভালোবাসি।” সেই সাথে ছিল একটি স্কেচ—অদ্ভুত এক রেখাচিত্র, ত্রিমাত্রিক গঠন, যেন কিউবের মধ্যে কিউব, যার গায়ে মেটা-সংকেত। সেই স্কেচ আর জাফরান রোডের ছায়া ছিল অবিকল এক।
দুই দিন পর অভিজিৎ দেখা করলেন পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে—প্রাক্তন পুলিশ অফিসার, যিনি একসময় তাঁর স্ত্রীর নিখোঁজ মামলায় যুক্ত ছিলেন। পার্থ তাকে দেখালেন ১৯৭৮, 1993 এবং 2011 সালের তিনটি নিখোঁজের রেকর্ড—সবগুলিই জাফরান রোড সংলগ্ন। “এই গলিটা… এটা ফাঁদ, ডক্টর। কিছু মানুষ ঢোকে, আর কেউ ফেরে না। আপনি যদি যাচ্ছেন, তবে দয়া করে আমাকে জানিয়ে যাবেন।” পার্থের চোখে অভিজিৎ প্রথমবার দেখলেন সেই আতঙ্ক—যেটা যুক্তিবাদে ব্যাখ্যা করা যায় না। রাত বাড়ছিল। বাইরে ঝিরঝিরে বৃষ্টি, আর অজানা এক ইঙ্গিত যেন প্রতিটি ছাদের কার্নিশে কাঁপতে কাঁপতে বলছে—“এই শহরের গলিগুলো সবসময় শুধু পথ নয়, কিছু কিছু গলি সময়কে বাঁকিয়ে ফেলে।” আর সেই বাঁকানো সময়ের প্রবেশদ্বার হয়তো—জাফরান রোডের অদৃশ্য দরজা।
দুই
পূর্বাভিমুখী জানালার পাশে বসে অভিজিৎ চিঠিটা বারবার পড়ছিলেন। একটাই বাক্য, কিন্তু প্রতিবার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছিল তার অর্থ। “আমি ওখানে যাচ্ছি”—মানে কী? রীণা কি জানতেন, সেই দরজা কোথায় যায়? নাকি তার মনোজগতেরই একটা ভ্রম? কিন্তু না—চিঠির সঙ্গে যে স্কেচটা ছিল, সেটা কোনও কল্পনা নয়। ওই জ্যামিতিক গঠনটা—নির্ভুল, গাণিতিক, অসম্ভব জটিল। অভিজিৎ বুঝলেন, এটা নিছক ছবি নয়, এটা একটা গেটওয়ের ম্যাপ। টপোলজিক্যাল ম্যাপ—একটি স্থান থেকে আরেকটি মাত্রায় যাওয়ার সম্ভাব্য বিন্যাস। যারা কোয়ান্টাম লুপ থিওরি নিয়ে গবেষণা করেছে, তারা জানে, এমন গঠন দিয়ে সময় ও স্থানকে নতুনভাবে ‘নেভিগেট’ করা যায়। কিন্তু সেটার বাস্তব প্রয়োগ? রীণা তো কখনও তাকে বলেনি এমন কিছু নিয়ে কাজ করছে! না কি বলেছিল—তিনি শুনতে চাননি?
চিঠির নিচে একটি তারিখ—৯ মে। আর রীণা নিখোঁজ হন ১০ মে রাতে। সেদিন তারা ঝগড়া করেছিলেন, তুচ্ছ এক বিষয়ে। অভিজিৎ সবকিছু ভুলে গিয়েছিলেন, শুধু রীণার নিখোঁজ হওয়ার সেই ভয়াবহ রাত ছাড়া। কিন্তু আজ, এক বছর পর, চিঠিটা যেন এক পোর্টাল খুলে দিল তার নিজের স্মৃতির ভিতরেও। সেই রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল, ঠিক যেমন গতকাল। রীণা শেষবার বের হওয়ার সময় বলেছিল, “আমি একটু হাঁটতে যাচ্ছি, দরজা বন্ধ করে দিও না।” তারপর সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যেন কিছু কানে এসেছিল তার—“যদি সময়ের বাইরের একটা জায়গা থাকত, যেখানে আমরা আবার দেখা করতে পারি…” অভিজিৎ এখন নিশ্চিত—সে শুধু হাঁটতে যায়নি, সেই রাতেই সে ইচ্ছাকৃতভাবে সেই ‘দরজা’র পথ বেছে নিয়েছিল। কিন্তু কীভাবে? কী সূত্রে?
পরদিন সকালে অভিজিৎ পার্থর কাছে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন। পার্থ মন দিয়ে শোনেন, তারপর বলেন, “আপনি জানেন, এরকম কয়েকটা চিঠি আমরা আগেও পেয়েছি, কিন্তু সবই অপ্রমাণিত থেকে গেছে।” এরপর পার্থ তাকে নিয়ে যায় তার ব্যক্তিগত আর্কাইভে—একটি পুরনো চামড়ার ডায়েরি, যেখানে তিনি গত কুড়ি বছরে জাফরান রোডের অদৃশ্যতা সংক্রান্ত সমস্ত ঘটনা লিখে রেখেছেন। সেখানে কয়েকটি নাম—যারা সব একই প্যাটার্নে নিখোঁজ: একই বয়সসীমা, একই মানসিক প্রবণতা, একই গলিতে শেষবার দেখা গিয়েছে। পার্থ বলে, “এরা সবাই কিছু খুঁজছিল—কেউ বিশ্বাস করত ‘মেটা-রিয়ালিটি’-তে, কেউ মনে করত তাদের প্রেমিক বা স্বজন কোথাও আটকে আছে… কেউবা বলত তারা বার্তা পেয়েছে, দরজা ডেকেছে।” কথাগুলো শুনে অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে যান। তাঁর বুকের ভিতর যেন কেউ ধাক্কা মেরে বলে ওঠে—“তাহলে রীণাও কি সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিল?” তিনি এবার সিদ্ধান্ত নেন, বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরে গিয়ে হলেও, এই দরজা তাঁকে খুঁজতেই হবে। দরজার ধাঁধার সমাধান করতে হবে—অথবা অন্তত সেখানে পৌঁছে জানতে হবে, রীণা আদৌ ফিরতে পারবে কি না।
তিন
কলকাতার ক্যানিং স্ট্রিটের এক পুরনো অফিস ভবনের পঞ্চম তলার শেষ কক্ষ—এটাই পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত আর্কাইভ। বাইরের তালাবন্ধ কাঁচের জানালায় ধুলো জমেছে, অথচ ভিতরে ছড়িয়ে আছে সময়। টিনের আলমারিতে সারি সারি পুরনো নথি, পাণ্ডুলিপি, পুলিশের রিপোর্ট, ম্যাপের রোল। অভিজিৎ চমৎকৃত হয়ে তাকিয়ে থাকেন—এ যেন শহরের গোপন ইতিহাসের লাইব্রেরি। পার্থ একটা মোটা ফোল্ডার নামিয়ে দেয় টেবিলের ওপর। “নিন, এখানেই আছে সব। আমি যাদের জাফরান রোড থেকে হারিয়ে যেতে দেখেছি, তাদের প্রতিটি রিপোর্ট, প্রত্যক্ষদর্শীর বিবৃতি, এমনকি ঘটনার পরের আবহাওয়ার তথ্য পর্যন্ত সংগ্রহ করেছি।” অভিজিৎ খুলে দেখেন—একটি সাদাকালো ছবিতে একটি ছেলেকে দেখা যাচ্ছে, গলির মুখে দাঁড়িয়ে, চোখে কাঁচের মতো দৃষ্টি, তার নীচে লেখা: ‘শেষবার দেখা গিয়েছিল ১৯৯৩ সালের ১০ নভেম্বর’। পাশে আরেকটি ছবি—এক নারী, ক্লাসিক ঘরানার চশমা পরে, ভীত চোখে তাকিয়ে, নাম লেখা: ‘নন্দিতা মৈত্র, ২০০৮’। প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে: “হঠাৎ অদৃশ্য”—কোনও স্ক্র্যাচ, কোনও চিৎকার, কিছুই পাওয়া যায়নি।
“তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা,” পার্থ বলে, “হল আমার নিজের ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়া। ১৯৮6 সালের জানুয়ারিতে, ওর বয়স ছিল মাত্র ১৭। বলেছিল সে রাতে সে কিছু ‘দেখেছে’—দরজা, যেটা বাতাসের মতো নড়ে উঠছিল। আমি বিশ্বাস করিনি। পরদিন সকালবেলা সে ঘরেই ছিল না।” পার্থর গলা খানিক কাঁপে, কিন্তু সে নিজেকে সামলায়। “আমি খুঁজেছি, বহু বছর। তখনই বুঝলাম, এই দরজাটা সময় ও বাস্তবতার এক ধরণের ফাঁক। হয়তো এটা একটা গেট, যার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। কিন্তু কেউ বা কিছু তো এর গার্ডিয়ান আছে… ঠিক যেমন আমাদের সীমান্ত পাহারা দেয় সেনা, তেমনি হয়তো এই বাস্তবতার সীমানা পাহারা দেয় ‘ওরা’।” এই ‘ওরা’ কে? পার্থ নিজেও জানে না, তবে বহু প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছে—দরজার আশেপাশে একটি চাপা ঘূর্ণি, সঙ্গে অদ্ভুত কম্পন, এবং হালকা ভোঁতা গলার আওয়াজ শোনা যায়—যেটা মানুষের নয়।
অভিজিৎ তার নিজের রিসার্চে ফিরে যান। জাফরান রোডের পুরনো ম্যাপ, যা পার্থ তাকে দেয়, তাতে দেখা যায়—ব্রিটিশ আমলে এখানে ছিল এক ‘এস্ট্রোনমিক্যাল ওয়াচ টাওয়ার’, যা পরবর্তীকালে ধ্বংস হয়। ঠিক সেই স্থানে এখন যে পুরনো বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটার ভিত্তি রেখেই সেই দরজা দেখা যায়। তাঁর মাথায় আসে এক সম্ভাবনা—বহুদিন আগে এখানেই হয়তো একধরনের পরীক্ষামূলক নির্মাণ হয়েছিল, যা বহু পরেও স্থানের কাঠামো বদলে দিয়েছে। পার্থ তখন হঠাৎ বলে, “আরেকটা কথা—এই সব দরজা রাত ১২টা ১৩ মিনিটে সবচেয়ে স্থির থাকে। সব ঘটনার টাইমলাইন এই একটাই সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে।” সেই সময়, সেই দরজা, সেই ছায়াময় রেখা—সব মিলে যাচ্ছে রীণার চিঠির মধ্যে বর্ণিত ‘সিংগুলার পলস’-এর ব্যাখ্যার সঙ্গে। অভিজিৎ এবার ঠিক করেন—এই পূর্ণিমার রাতেই, আবার তিনি যাবেন সেই গলিতে, দরজার সামনে। পার্থ বলেন, “তাহলে আমিও চলব। কিন্তু এইবার, আমরা কিছু ফিরিয়ে আনব। না হলে… অন্তত সত্যটাকে খুঁজে বের করব।”
চার
যখন বিজ্ঞানের সব সূত্র ব্যর্থ হয়, মানুষ ফিরেও চায় ইতিহাসের দিকে, লোককথার দিকে। পার্থ একদিন ফোন করে বললেন, “একজনকে পাওয়া গেছে, যিনি জাফরান রোড নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন, তবে ওঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটু অন্যরকম। ওনার নাম আয়েশা খাতুন।” শ্যামবাজারের এক পুরনো গলির মাঝামাঝি, কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে ছোট এক চেম্বারে দেখা হয় অভিজিৎ ও পার্থর সঙ্গে আয়েশার। বয়স পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি, চোখে গাঢ় কালো চশমা, কণ্ঠস্বর স্থির—একটা প্রাচীন ভূগোল বইয়ের মতো। তিনি বলেন, “কলকাতা একটি বহুস্তরীয় শহর, শুধু ভৌগোলিক নয়—সমস্ত বাস্তবতার ক্ষেত্রেও। কিছু কিছু এলাকা আছে, যেগুলো একাধিক মাত্রার স্পর্শে গঠিত। জাফরান রোড ঠিক তেমন জায়গা—এখানে সময় সোজা পথে চলে না।” তিনি সামনে আনেন একটি হাতের আঁকা ম্যাপ—১৮৬৪ সালের ‘কালকাটা এনোমেলি চার্ট’। সেই ম্যাপে জাফরান রোডের আশেপাশে লাল কালি দিয়ে গোল দাগ কাটা, যার পাশে লেখা—”Unstable Node – Type III Anomaly”।
আয়েশা ব্যাখ্যা করেন, ব্রিটিশরা তাদের এক গোপন প্রকল্পে কলকাতার কয়েকটি জায়গায় স্পেস-টাইম ডিস্টরশন চিহ্নিত করেছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, এই শহরের কিছু অঞ্চল “Maps Beyond Maps” ধারণ করে—মানে, এমন কিছু পথ যেগুলো সাধারণ মানচিত্রে থাকে না, কিন্তু চিরকাল অস্তিত্বে থাকে, গোপনে, ধুলোর আড়ালে। “আমি বিশ্বাস করি,” আয়েশা বলেন, “এই দরজা তার মধ্যেই একটি—এবং এমন দরজা সাধারণত সক্রিয় হয় কেবল তখনই, যখন কোনো ‘সংবেদনশীল চেতনা’ তাকে ডাকে।” অভিজিৎ বলেন, “আপনার কথায় কি বোঝাতে চাইছেন যে আমার স্ত্রী… নিজের ইচ্ছায় দরজাকে আহ্বান করেছে?” আয়েশা মাথা হেঁট করে বলেন, “হয়তো… তার চেতনা এমন স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল, যেখানে বাস্তবতাও নতিস্বীকার করে।” তার এই বক্তব্যে বৈজ্ঞানিক যুক্তির জগৎ যেন আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে, কিন্তু পার্থ হাল ছাড়ে না। সে চায় আয়েশা সেই প্রাচীন ম্যাপ অনুযায়ী দেখিয়ে দিক, ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে দরজার ছায়া দৃশ্যমান হয় এবং কতক্ষণ থাকে।
তাদের তিনজনের অভিযানে এবার নতুন মাত্রা যোগ হয়। আয়েশা হাতে নেয় তার ডিজিটাল ম্যাপিং ডিভাইস, যেটা স্থানিক ঘনত্ব ও চৌম্বকীয় বিচ্যুতি পরিমাপ করতে পারে। তারা ফের যায় জাফরান রোডে, রাত ১২টার আগেই। ঠিক ১২টা ১৩-তে, সেই ছায়াদরজার রেখা আবার ফুটে ওঠে। কিন্তু এবার তারা শুধুই পর্যবেক্ষণ করে না—আয়েশা ফোটোস্পেকট্রাল স্ক্যানার দিয়ে একটি ইনফ্রারেড ছাপ ধরেন দরজার চারপাশে। আশ্চর্যভাবে সেই স্ক্যানে দেখা যায়—একটি গঠন দাঁড়িয়ে আছে দরজার ভেতর, মানুষের মতো, কিন্তু অবয়ব অস্পষ্ট। “এটা কি কেউ পাহারা দিচ্ছে?” পার্থ ফিসফিস করে। আয়েশা বলেন, “এদের বলা হয় Gatewatchers। বহু সংস্কৃতিতে এইরকম রক্ষাকর্তার বর্ণনা পাওয়া যায়—যারা পথ চায়, পথ দেয় না।” অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মনে পড়ে, রীণা একবার বলেছিলেন—“সব দরজা মানুষকে চায় না, কিছু দরজা শুধু তাকিয়ে থাকে।” সেই রাতে অভিজিৎ এক নতুন উপলব্ধিতে পৌঁছায়—এ শুধু একটি বিজ্ঞান বা ইতিহাসের ধাঁধা নয়, এটা এক অস্তিত্বের অন্বেষণ, যেখানে মানুষ নিজেই দরজা খুলতে পারে যদি তার মন সেই ভাষা জানে। পরের পূর্ণিমায় সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে চেষ্টা করবে… দরজার ওপারে একবার পা রাখতে।
পাঁচ
কলকাতার পুরনো অলিগলি অনেক সময়েই শহরের বাইরে নয়, সময়ের বাইরেও বাস করে। উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদে বসে ছিল রোহান দত্ত—চৌদ্দ বছরের একটি ছেলেমানুষ, কিন্তু তার চোখে যেন আঠারো শতকের ইতিহাসও হালকা দাগ কেটে যায়। সে ইদানীং রাতে ঘুমাতে পারে না, বিশেষ করে পূর্ণিমার আগের দিনগুলোয়। ছাদ থেকে সে দেখতে পায়—সেই অদ্ভুত গলি, যেখানে মাঝেমাঝেই হালকা আলোর রেখা দেখা যায়, আবার মিলিয়ে যায়। তার মা বলে, “ওটা ভূতেদের রাস্তা, তাকিয়ে থাকিস না।” কিন্তু রোহান ভয় পায় না, বরং মোবাইল ফোনটা হাতে নেয়, লেন্স অন করে অপেক্ষা করে। ১২টা ১০ বাজে। বাতাস থমকে যায়। কুকুরগুলো হঠাৎ চুপ হয়ে পড়ে। তার ঠিক তিন মিনিট পর, জাফরান রোডের সেই পুরনো দেয়ালে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে সেই পরিচিত ছায়াচিত্র—একটা দরজার রেখা, যেটা বাস্তবে নেই, অথচ চোখে পরিষ্কার।
রোহান ক্যামেরা চালু রেখেই দেখতে পায়, সেই দরজার ছায়ার ভেতর দিয়ে একটা কিছু নড়ে ওঠে। প্রথমে ভেবেছিল বিড়াল বা কুকুর হবে, কিন্তু যখন সেই ছায়াটি একটু এগিয়ে এসে স্পষ্ট আকৃতি নেয়—সে চমকে ওঠে। মানুষের অবয়ব, কিন্তু আবছা, যেন অনেক দূর থেকে আসছে, অথচ অনেক কাছেও। সেই অবয়ব থেমে যায় ঠিক দরজার মাঝখানে, তারপর যেন হঠাৎ হাওয়া হয়ে যায়। মুহূর্তটা ক্যামেরায় ধরে রাখতে পারলেও, রোহানের মনে হয় কেউ বা কিছু তার দিকে তাকিয়েছিল—তীব্র, নিরেট, অথচ শব্দহীন এক দৃষ্টি। ভয়ে সে ছুটে যায় নিচে, কিন্তু তারপর হঠাৎ থেমে দাঁড়ায়। তার কৌতূহল ভয়কে অতিক্রম করে যায়। সে ভাবে, “এই জিনিস যদি সত্যিই ঘটে থাকে, তাহলে সবাইকে জানান দরকার।” পরদিন সকালে সে তার বাবা-মার অজান্তে ভিডিওটি আপলোড করে এক প্রাইভেট গ্রুপে—‘কলকাতা অল্টারনেট সিগন্যালস’ নামে একটি গোপন অনলাইন কমিউনিটিতে, যেখানে কিছু বিজ্ঞানী, কিছু ইতিহাসবিদ আর কিছু ‘অবিশ্বাসী’ একসাথে জড়ো হয়।
রোহানের ভিডিও দুদিনের মধ্যে পৌঁছে যায় পার্থের কাছে। পার্থ প্রথমে অবাক হয়ে দেখে—ভিডিওতে যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, সেটি ক্যামেরার গ্লিচ নয়, বরং ইনফ্রারেড ও নাইট-ভিশনে পর্যবেক্ষণযোগ্য স্পষ্ট গঠন। সে সঙ্গে সঙ্গে অভিজিৎকে ডাকে। ভিডিও চালিয়ে তারা লক্ষ্য করে, ১২টা ১৩ মিনিটে ছায়া শুরু হয়, এবং ১২টা ১৯ মিনিটে মিলিয়ে যায়—মানে ছয় মিনিটের জন্য দরজা সক্রিয় থাকে। এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোহানকেও তারা খুঁজে বের করে, ছেলেটি প্রথমে ভয় পেলেও, তার উত্তেজনা চোখে পড়ে যায়। “আমি আবার দেখব,” সে বলে, “কিন্তু আপনি আমাকে বলবেন, এই দরজা কোথায় নিয়ে যায়?” অভিজিৎ চুপ করে থাকে। আয়েশা পরে বলেন, “এই ছেলেটা আমাদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে—সাক্ষ্য এনে দিয়েছে। হয়তো এটাই দরজার ভাষা—যারা সত্যিই জানতে চায়, কেবল তাদেরই কিছু দেখায়।” সেই রাতেই ঠিক হয়, তারা পরবর্তী পূর্ণিমায়, এই নির্ধারিত ছয় মিনিটের মধ্যেই দরজার দিকে এগোবে। অভিজিৎ প্রথমবার স্পষ্ট করে মনে করে—রীণা কি সেই ছয় মিনিটেই হারিয়ে গিয়েছিল? আর এবার, যদি তিনিও যান… তবে কি তিনিও আর ফিরে আসতে পারবেন না?
ছয়
পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কৃতিতে কিছু ‘পথ’ থাকে, যেগুলো কেবল বাহির নয়—অন্তরের দিকেও খোলে। সেই রাত, পূর্ণিমার নিঃসাড় রুপোলি আলোয় জাফরান রোড যেন একটা জীবন্ত ছায়া হয়ে উঠেছিল। অভিজিৎ, পার্থ এবং আয়েশা—তিনজনের চোখে স্পষ্ট ছিল প্রত্যাশা ও আতঙ্কের মিশেল। ঠিক ১২টা ১১ বাজে, তারা গলির শুরুতে পৌঁছায়। আয়েশার হাতে ছিল তার ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রিডার, পার্থের কোমরে ছোট টর্চ এবং পকেটে তার ভাইয়ের পুরনো ছবি। অভিজিতের বুকপকেটে ছিল রীণার চিঠি। ঠিক ১২:১৩ বাজতেই সেই পুরনো বাড়ির দেয়ালে ধীরে ধীরে আবির্ভূত হল সেই ছায়া—একটা দরজার মতো গঠন, অথচ ধোঁয়ার মতো, জলছবির মতো।
তারা একে একে দরজার সামনে দাঁড়াল। অভিজিৎ এক পা এগিয়ে নিয়ে গায়ের কাছে বাতাসে যেন অদৃশ্য চাপ অনুভব করলেন—একটা অজানা তরঙ্গ, যেন সময় নিজেই তার গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তারপর আচমকা—দরজার রেখা থেকে ঠিক সামনের বাতাস একটু ঘূর্ণায়মান হয়ে উঠল, তারপর একটি আলো, নিঃশব্দ, স্পন্দিত। “এটাই তো সেই মুহূর্ত,” আয়েশা কাঁপা গলায় বলল। অভিজিৎ বললেন, “চলো।” দরজা পার হতেই যেন কেউ চিৎকার করে উঠল না-শব্দে—আকাশ নেই, মাটি নেই, কেবল অস্পষ্ট এক ব্যপ্তি, যেখানে ভবনের রেখা গলে পড়ছে, কাঁচের টুকরোর মতো শূন্যে ঝুলছে সময়ের অংশ।
তারা বুঝতে পারে—এটি এক বিকৃত বাস্তবতা, এক লুপে আটকে থাকা অঞ্চল—একধরনের “Temporal Fracture Zone।” এখানে সময় এক জায়গায় আটকে আছে, কিছু জিনিস ধ্বংস হচ্ছে আবার নিজে থেকে গঠিত হচ্ছে। অভিজিৎ দেখেন—একটি ছায়া প্রতিনিয়ত তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে, আবার হারিয়ে যাচ্ছে। রীণা? না কি তার স্মৃতি? ঠিক তখনই তারা অনুভব করে, কেউ বা কিছু তাদের লক্ষ্য করছে। গাঢ় ছায়ার মতো দুটি অবয়ব একত্রে ভেসে আসে, রঙহীন চোখ, রূপহীন মুখ—তারা যেন প্রশ্ন করছে, ‘তুমি কেন এসেছো?’ আয়েশা বলে ওঠে, “এরা Gatewatchers। এদের অনুমতি ছাড়া কেউ কোথাও যেতে পারে না।” হঠাৎ এক চিত্রলিপি ভেসে ওঠে বাতাসে, অদ্ভুত এক চিহ্ন—রীণার স্কেচের মতো।
এটা একটা সংকেত—রীণা এখানে ছিল, এবং কিছু রেখে গিয়েছে। তার চেতনা হয়তো এই চক্রে আটকে, কিংবা এই Gatewatchers-দের মধ্যে মিশে গেছে। পার্থ তখন বলে, “আমরা এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না… সময় আর শরীর একসঙ্গে ভেঙে পড়বে।” চারদিকে এখনো কিছু দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে—অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা রীণা, এক কিশোরের চিৎকার, একটি দরজার পিছনে কেউ কাঁদছে। এইসব সবই হয়তো সময়ের ছেঁড়া অংশ, অথবা কারও স্মৃতির প্রতিফলন। দরজা আবার ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে। অভিজিৎ একবার শেষবারের মতো ছায়ার দিকে এগিয়ে বলেন, “রীণা… আমি এসেছিলাম।” কোনও উত্তর আসে না। Gatewatchers শুধু তাকিয়ে থাকে। অবশেষে, সময় ফুরায়—তারা ফিরে আসে। দরজা পিছনে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অভিজিতের হাতে তখন একজোড়া কাগজ—রীণার হাতে লেখা নতুন কিছু বার্তা… যা এই মাত্রার ভেতরেই রয়ে গিয়েছিল।
সাত
ঘরে ফিরে আসার পর অভিজিৎ যেন নিজের মধ্যেই আটকে গিয়েছিলেন। দরজার ওপারের সেই জগৎ বাস্তব ছিল না, অথচ কল্পনাও নয়। তার হাতে ধরা কাগজ দুটি কোনো সাধারণ কাগজ নয়—একটিতে ছাপা ছিল রীণার হাতের লেখা, আরেকটি ছিল অদ্ভুত এক রৈখিক গঠন—মনে হয় একটা অনন্ত গহ্বরের ছক, যেটা নিজেই নিজেকে চিহ্নিত করে বারবার। চিঠির লেখাগুলো অস্পষ্ট ছিল, কিন্তু প্রতিটি অক্ষর যেন তার হৃদয়ে একেকটা শব্দ হয়ে ফুটে উঠছিল:
“আমি এখানে আছি, অভি। সময় এখানে সোজা চলে না। আমি ভুল করেছিলাম—এটা জানার জায়গা নয়, এটা ফাঁদের মতো। কিন্তু আমি এখনও আছি—তুমি যদি এই রেখাটা ধরতে পারো, হয়তো আমার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে পারো। তবে তুমি পারলে থেকো না… ফিরে যেও। আমি চাই না তুমি এখানেও আটকে যাও।”
চিঠির নিচে একটি সময়চক্রের চিত্র—এটা একটি “Reality Feedback Loop”-এর গঠন। অভিজিৎ বুঝতে পারেন, রীণা যা বলছে, তা হচ্ছে একটি টেম্পোরাল রিপল—মানে, সময়ের একটি আলগা স্রোতে সে আটকে আছে। এই অবস্থায় তার চেতনা পুরোপুরি বিলীন হয়নি, বরং সে ওই জায়গার ভেতরে নিজের অস্তিত্বের কিছু অংশ রেখে গেছে—একটা বার্তা, একটা ছাপ। কিন্তু সেখান থেকে কাউকে ফেরত আনতে হলে দরজাকে জোর করে খুলে রাখতে হবে—যা এ পর্যন্ত কেউ করতে পারেনি। পার্থ জানায়, ১৯৮৩ সালে এক বিজ্ঞানী এই চেষ্টায় গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরলেন না। আয়েশা তখন বলে, “এই দরজাগুলো কেবল চলাচলের পথ নয়, এরা আদান-প্রদানের নিয়মে চলে। কেউ এলে, কেউ যেতে হয়।” এই শর্তে অভিজিতের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে এক ভয়ানক দোটানা—সে যদি রীণাকে ফেরাতে চায়, তবে তাকে কিছু দিতে হবে… সম্ভবত নিজেকেই।
এক রাত, অভিজিৎ একা বসে থাকে তার পুরনো ল্যাবরেটরিতে। সে রীণার সব নোট একত্র করে—তার গবেষণার কাগজ, হাতে লেখা সূত্র, হাইপারস্ট্রিং থিওরির প্যারা-মডেল—সব। তারপর সে তৈরি করে এক বিশেষ যন্ত্র—একটা কোয়ান্টাম কনভার্জেন্স এম্প্লিফায়ার—যেটা দরজার খোলা থাকা সময়সীমা বাড়াতে পারে। আয়েশা এতে সাহায্য করে তার ম্যাপিং সফটওয়্যারে। পার্থ বাধা দিতে চায়, কিন্তু শেষে মাথা নোয়ায়। সে জানে, অভিজিৎ যাচ্ছেন নিজেকে উৎসর্গ করতে—একটি অস্তিত্বের বিনিময়ে আরেকটি অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে। “তুমি জানো, হয়তো তুমি আর ফিরবে না,” পার্থ বলে। অভিজিৎ শান্ত গলায় বলে, “জানি। কিন্তু জানো… রীণার চিঠির শেষে একটা বাক্য ছিল—‘আমার সুর এখানে আটকে আছে, কিন্তু আমার গান এখনও অপূর্ণ নয়।’ আমি ওর গানটা শেষ করতে চাই।”
পরের পূর্ণিমার অপেক্ষা শুরু হয়—এইবার আর শুধুই অনুসন্ধান নয়, এইবার এক প্রকার আত্মদানের প্রস্তুতি।
আট
শেষ রাতের আকাশে পূর্ণিমার আলো যেন রুপোর দড়ির মতো গলির মাথায় ঝুলে আছে। জাফরান রোড নিঃশব্দ, অথচ বুকের গভীরে যেন দুলছে এক অনন্ত সুরের প্রতিধ্বনি। অভিজিৎ এবার একা নয়, তার সাথে আয়েশা ও পার্থ দাঁড়িয়ে—কিন্তু তারা জানে, এই যাত্রা একমুখী। হাতে বানানো কনভার্জেন্স এম্প্লিফায়ার চালু করা হয়েছে, তার ভিতর দিয়ে দরজার অদৃশ্য রেখাকে স্থিতিশীল করা হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা ১২টা ১৩তে পৌঁছাতেই সেই চেনা ছায়া ফুটে ওঠে—একটা দরজা, এবার একটু বেশি স্পষ্ট, যেন জানে আজকের রাত আলাদা। দরজার মধ্যে আলো জ্বলে উঠল—ধীর, টানাটানা, নিঃশব্দ ডাকের মতো। অভিজিৎ একবার পেছনে তাকায়—পার্থ বলে, “তুমি গেলে আমি দেখব, যদি কিছু ফিরে আসে।” আয়েশা শুধু বলে, “শব্দ নয়, সুরটাই দরজা খোলে।”
অভিজিৎ রীণার সেই শেষ চিঠি বুকপকেটে রেখে দরজার ভিতর পা রাখল। প্রথম ধাপে পা রাখতেই চারপাশ বদলে যায়—রঙহীন এক বাস্তবতা, বিকৃত সময়ের খন্ডাংশ ভাসছে বাতাসে। কাঁচ ভাঙা ঘড়ির মতো মুখে মুখে ঘুরছে শব্দ, আলো আর ছায়া। হঠাৎ এক জায়গায় স্থিরতা—একটা বৃত্তাকার ঘর, যার মাঝে রীণা দাঁড়িয়ে, ধূসর শাড়ি পরে, চোখে দৃষ্টি নেই, অথচ মুখে সেই চেনা শান্তি। “তুমি এলে?” তার কণ্ঠস্বর আসে বাতাসে ভেসে, আর অভিজিৎ তার হাত ধরতে এগোয়। কিন্তু ঠিক তখনই ঘরের চারপাশে চারটি Gatewatcher ভেসে ওঠে—তারা একযোগে মাথা নাড়ে। একটিবারে পুরো বাস্তবতা থেমে যায়। সময়ের কণিকাগুলো যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এদের ভাষা মৌখিক নয়, অনুভবের—তারা জানিয়ে দেয় এক শর্ত:
“তুমি যদি তাকে নিয়ে যেতে চাও, তবে তোমার জায়গা তার হতে হবে।”
রীণা কাঁদতে থাকে, “না অভি, এটা ঠিক নয়। ফিরে যাও, প্লিজ।”
কিন্তু অভিজিৎ এক পা এগিয়ে আসে। “তোমাকে ছাড়া ফিরে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই।”
তারপর সে আস্তে রীণার কপালে চুমু খায়। Gatewatchers একত্রে মাথা নত করে। একটা আলো ছড়িয়ে পড়ে, আর ঠিক তখনই বাস্তবতা ফেটে গিয়ে সব গলে যায়—এক মুহূর্তের জন্য সব আলো নিঃশেষ, এক চিৎকারহীন বিস্ফোরণ।
গলির বাইরে, পার্থ আর আয়েশা অপেক্ষা করছিল। ঠিক ১২টা ১৯-এ দরজা থেকে হালকা সোনালি আলো ছিটকে পড়ে, আর একটি অবয়ব হাঁপাতে হাঁপাতে বেরিয়ে আসে—রীণা। তার চুল এলোমেলো, চোখ জ্বলজ্বলে, আর ঠোঁটে কাঁপতে থাকা একটি মাত্র শব্দ—“অভি…”
পার্থ ছুটে গিয়ে তাকে ধরে, আর আয়েশা ফিসফিস করে, “ও ফিরেছে।”
কিন্তু দরজা ফুরিয়ে যায়, মিলিয়ে যায় বাতাসে। অভিজিৎ আর ফেরেনি।
এরপর কেটে যায় মাস। রীণা ধীরে ধীরে ফিরে আসে বাস্তবতায়, তার চেতনা আবার গাঁথা হয় এই জগতে। সে মাঝে মাঝে বসে থাকে অভিজিতের ডেস্কে—তার খাতায়, তার লেখায়, তার কণ্ঠে ফিরে আসে সেই সুর, যে সুর একদিন দরজাকে খুলেছিল। সে জানে, অভিজিৎ আজও আছেন—কিন্তু অন্যদিকে। এক সন্ধ্যায়, রীণা একা হাঁটতে যায় জাফরান রোডে। গলির মাথায় দাঁড়িয়ে সে শুনতে পায় বাতাসে ফিসফিসে সুর—
“তুমি যেই গানটা শুরু করেছিলে, আমি সেটা শেষ করব।”
আর সেই সময়, গলির মাথায়, ভাঙা বাড়ির দেয়ালে আবার একটিবারের জন্য ভেসে ওঠে সেই ছায়া।
Gatewatcher দাঁড়িয়ে আছে—চুপচাপ, ছায়ার মতো, সময়ের প্রহরায়। যেন নতুন কারও অপেক্ষায়।
শেষ