Bangla - রহস্য গল্প

জাদুর লণ্ঠন

Spread the love

সুব্রত ভট্টাচার্য


অধ্যায় ১: লাল মাটির ছায়া

বাঁকুড়ার শেষ প্রান্তে পাহাড়পুর যেন একটা ঘুমন্ত ছবি—যেখানে সময়ের গতি থেমে গেছে। লালমাটির আঁকাবাঁকা পথ, থমথমে গাছপালা আর দিনের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধতা যেন দখল নেয় চারপাশ। গ্রামের ঠিক মাঝখানে, এক পুরনো পাকাঘর—মাটির দেওয়াল কাঁচা, চালের উপর শুকনো ধানখড় আর ধোঁয়াটে ছাপ। এখানেই থাকেন শশাঙ্ক দাস, এক সময়কার ইতিহাসের শিক্ষক, এখন গ্রামের প্রবীণতম মুখ। দিনের আলোয় তিনি মাটির উঠোনে বসে পুরনো কাগজ ঝাড়েন, আর সন্ধ্যেবেলা কুপি জ্বালিয়ে গল্প বলেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের। এই গ্রামটা কেবল মানুষ নিয়ে গঠিত নয়, তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অলক্ষ্য ছায়া—গাছের খোলে, মাটির নিচে, বাতাসের গন্ধে। সেদিন সন্ধেয়, যখন রক্তরঙ আকাশের নিচে পালকি গাছগুলোর ছায়া লম্বা হতে হতে গ্রামকে ঢেকে ফেলেছিল, তখন শশাঙ্ক হঠাৎ শুনলেন বটতলার পথ দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় ছিল—পথে কোনো চাকা চলার শব্দ নেই, ঘোড়ার খুরের ছন্দ নেই, কেবল বাতাসের ভেতর কেমন যেন চাপা একটা হাহাকার। তিনি দাঁড়িয়ে দেখেন—একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে, হাতে এক পুরনো কাঠের লণ্ঠন, যার আলো নড়ছে না, কাঁপছে না, নিঃশব্দে জ্বলছে। শশাঙ্ক চোখ কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু লোকটা যেন হাঁটতে হাঁটতেই হাওয়ায় গলে যায়। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর জোর করে নিজেকে বোঝান—এটা নিশ্চয় চোখের ভুল, হয়তো বয়সের দোষ।

পরদিন সকালে, হরিপদ মালাকারের বাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। হরিপদ, পঞ্চান্ন বছরের কামার, যার হাতের লোহা বাঁকাতে পারলেও ভাগ্যকে নয়। স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছে বছর কুড়ি আগে, আর একমাত্র ছেলে সজল কাজের খোঁজে বাঁকুড়া শহরে যায়-আসে। সেদিন রাতে হরিপদ প্রচুর মদ খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে যখন তার জ্ঞান ফেরে, তখন দেখে দরজার পাশে একটা কাঠের লণ্ঠন রাখা—একেবারে পুরনো আমলের, পিতলের হাতল, কাঁচের ঢাকনি, আর কাঠের গায়ে একটা ছোট মুখ আঁকা, যার চোখ দুটি ফাঁকা গহ্বর। লণ্ঠনটা সে দেখেছে জীবনে প্রথমবার, আর তার সামনে তখনো নিঃশব্দে জ্বলছিল আলো। মদhangover থেকে যখন সে কিছুটা বেরোয়, তখন দেখে পাশের ঘরে সজল নিথর হয়ে পড়ে আছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। তার চিৎকারে জড়ো হয় পুরো গ্রাম। কেউ বলে—সজল হয়তো রাতেই পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছে, আবার কেউ ফিসফিস করে—এটা লণ্ঠনের কাজ, ‘ওইটা যারে ধরে, তারে মারে’। শশাঙ্ক দাস শুনে কাঁপা গলায় বলেন, “আমি ওকে দেখেছি, কাল সন্ধেয়, চলেছে… হাতে সেই আলো।” অথচ কেউ তখনো জানে না, এটা কোনো কাকতাল নয়—এটা কিছু বড়ো কিছুর শুরু।

পিয়ালী ঘোষ তখন সদ্য গ্রামে এসেছে, কলকাতার এক সাময়িকপত্রের ফিচার জার্নালিস্ট। লোকবিশ্বাস, লোককথা আর অলৌকিকতার ওপর তার গবেষণার বিষয়, আর পাহাড়পুরে তার আগমন একবারেই কাকতালীয় নয়—বরং পূর্ব-পরিকল্পিত। হরিপদের বাড়ির ঘটনার খবর সে পায় এবং সোজা চলে যায় সেখানে। তার প্রথম নজরে আসে লণ্ঠনটি—চুপচাপ এক কোণে রাখা, যেন কোনো কথার অপেক্ষায়। পিয়ালী, যিনি বিশ্বাস করেন যুক্তি ও প্রমাণে, সে-ও এই পুরনো গ্রাম্য নিস্তব্ধতায় অদ্ভুত কিছু অনুভব করে। সে শশাঙ্ক দাসের সঙ্গে কথা বলে, আর ধীরে ধীরে জানতে পারে—এই লণ্ঠন মাঝে মাঝেই কারো না কারো বাড়িতে আসে, প্রতিবারই কেউ না কেউ স্বপ্ন দেখে, যেটা কোনো প্রাচীন গোপন সত্য ফাঁস করে। আর ঠিক তারপরে—ঘটে এক মৃত্যু। পিয়ালী ভাবতে শুরু করে, এটা কি কেবল কাকতাল? নাকি এ লণ্ঠন কোন অতিপ্রাকৃত স্মৃতির বাহক? তাকে ঘিরে আছে অদেখা এক বিচারব্যবস্থা, যার নিয়ম জানে না কেউ—শুধু অনুভব করতে পারে। পাহাড়পুরের এই নির্জন রাতে, লাল মাটির ছায়ায়, সেই রহস্য ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।

অধ্যায় ২: মৃত স্বপ্নের আলোরেখা

পাহাড়পুরের দক্ষিণপ্রান্তে একটা পোড়োবাড়ি আছে—ছাদ ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালের খোলে গজিয়ে উঠেছে বুনো গাছ, আর খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো ঢোকে না, কেবল মাটির গন্ধ আর মৃতপ্রায় বাতাস। সেখানেই থাকে রঞ্জা—এক নিঃসঙ্গ মূক কিশোরী, যার কণ্ঠ নেই, কিন্তু চোখে এক নিস্তব্ধ ভাষা। তাকে কেউ ভালো করে চেনে না, কেউ আদর করে ডাকে না, যেন সে এই গ্রামেরই কেউ নয়, বরং কোনো অজানা অস্তিত্ব, যাকে সময় ভুল করে ফেলে গেছে। গ্রামের মহিলারা তাকে ডাকে ‘বোকা মেয়ে’, ছেলেরা টিপ্পনী কাটে, আর পুরুষেরা তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু রঞ্জা প্রতিদিন সেই পোড়োবাড়ির সামনে একটা কাঠের তক্তায় বসে ছবি আঁকে—মাটি, ছায়া, আগুন, গাছ আর চোখ। সে কোনোদিন স্কুলে যায়নি, কিন্তু তার হাতে জন্মগত দক্ষতা আছে—যেন দেখা না-দেখা জগতের ছবি আঁকতে পারে সে। হরিপদের মৃত্যুর দিন সন্ধেয়, যখন গ্রামে হাহাকার, সেই সময় রঞ্জা সেই পোড়োবাড়িতে একা, আর তার ঘরের দরজার সামনে রাখা সেই রহস্যময় কাঠের লণ্ঠন। আলোটা যেন জ্বলছে না, বরং নিশব্দে নিশ্বাস নিচ্ছে। রঞ্জা সেটা দেখে চমকে ওঠে, কিন্তু ভয় পায় না। সে লণ্ঠনের সামনে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।

রাত্রি গভীর হলে রঞ্জা স্বপ্ন দেখে—না, শুধু দেখে না, যেন সে সেই স্বপ্নের ভেতর হাঁটছে, স্পর্শ করছে, কাঁপছে। এক পুরনো গৃহদ্বার, কাদা ও ধানের আঁটি মিশে তৈরি মেঝে, আর এক নারী—আঁচলে আগুন লেগে গেছে, সে ছুটছে, কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে আসছে না। আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুরুষ—তাদের মুখ অন্ধকারে ঢাকা, শুধু একটা হাত থেকে ছিঁড়ে পড়ছে লাল চুড়ি। হঠাৎ করেই আগুনের আলো নিভে যায়, আর রঞ্জা চোখ মেলে দেখে, ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে লণ্ঠনটা আবার জ্বলছে। সকালে, ঘুম ভেঙে, সে খাতায় ছবি আঁকে—একজন জ্বলন্ত নারী, চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুখহীন মানুষ আর মাটির গায়ে আঁকা একটা অদ্ভুত শাঁখচূড় ফুল। ওই ছবি দেখেই গ্রামের কয়েকজন চমকে ওঠে—পুরোনো এক কাহিনির কথা মনে পড়ে যায় তাদের। বহু বছর আগে, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে, এই গ্রামে এক গৃহপরিচারিকা আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। কেউ বলে দুর্ঘটনা, কেউ বলে ইচ্ছাকৃত। কিন্তু রঞ্জা এসব জানে না, কারো মুখ থেকে শোনেনি, শুধু স্বপ্নের আলোয় দেখেছে। এটা কি তার মনের কল্পনা? নাকি সেই মৃত আত্মার কথা, যা এখন লণ্ঠনের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে?

পিয়ালী ঘোষ সেই ছবি দেখে স্তব্ধ। সে ছবিটা তুলে নেয়, আর নিয়ে যায় শশাঙ্ক দাসের কাছে। শশাঙ্ক অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, তারপর বলেন, “আমি তখন কিশোর, কিন্তু মনে আছে—এক গরিব মেয়ে, যাকে জমিদারের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল, তার মৃত্যুটা কেমন যেন গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল। কেউ জানত না নাম, শুধু বলত—চুপ কর, না হলে তার মতো আগুনে পোড়বি।” পিয়ালী বুঝতে পারে, রঞ্জার স্বপ্ন কাকতাল নয়, বরং ইতিহাসের একটা গোপন দরজা খুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন এখন? কেন এই লণ্ঠন এখন আবার ফিরে এসেছে? কে ঠিক করছে এই স্বপ্নগুলো কার ঘরে যাবে? আর এর শেষ কোথায়? রঞ্জা নির্বাক, কিন্তু তার চোখে এখন অন্যরকম ভাষা ফুটে উঠছে—যেন সে নিজেই বুঝতে শুরু করেছে, তার ভিতরে কী জেগে উঠছে। সেই রাতে পোড়োবাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যায়, কাঠের লণ্ঠন আবার নিঃশব্দে আলো ছড়াচ্ছে, আর দূরে কোথাও বনের ভেতর হাওয়ার শব্দে যেন কারো কান্না মিশে আছে। পাহাড়পুর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে, সত্যের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তার সঙ্গে মৃত্যু এসে জড়িয়েই থাকে—আর সেই আলোর পথেই এখন হাঁটছে এক নীরব মেয়ে, যার স্বপ্নে লুকিয়ে আছে মৃতদের মর্মভেদী কান্না।

WhatsApp-Image-2025-06-28-at-2.54.13-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *