সুব্রত ভট্টাচার্য
অধ্যায় ১: লাল মাটির ছায়া
বাঁকুড়ার শেষ প্রান্তে পাহাড়পুর যেন একটা ঘুমন্ত ছবি—যেখানে সময়ের গতি থেমে গেছে। লালমাটির আঁকাবাঁকা পথ, থমথমে গাছপালা আর দিনের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধতা যেন দখল নেয় চারপাশ। গ্রামের ঠিক মাঝখানে, এক পুরনো পাকাঘর—মাটির দেওয়াল কাঁচা, চালের উপর শুকনো ধানখড় আর ধোঁয়াটে ছাপ। এখানেই থাকেন শশাঙ্ক দাস, এক সময়কার ইতিহাসের শিক্ষক, এখন গ্রামের প্রবীণতম মুখ। দিনের আলোয় তিনি মাটির উঠোনে বসে পুরনো কাগজ ঝাড়েন, আর সন্ধ্যেবেলা কুপি জ্বালিয়ে গল্প বলেন গ্রামের ছেলেমেয়েদের। এই গ্রামটা কেবল মানুষ নিয়ে গঠিত নয়, তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে আছে অলক্ষ্য ছায়া—গাছের খোলে, মাটির নিচে, বাতাসের গন্ধে। সেদিন সন্ধেয়, যখন রক্তরঙ আকাশের নিচে পালকি গাছগুলোর ছায়া লম্বা হতে হতে গ্রামকে ঢেকে ফেলেছিল, তখন শশাঙ্ক হঠাৎ শুনলেন বটতলার পথ দিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করা বিষয় ছিল—পথে কোনো চাকা চলার শব্দ নেই, ঘোড়ার খুরের ছন্দ নেই, কেবল বাতাসের ভেতর কেমন যেন চাপা একটা হাহাকার। তিনি দাঁড়িয়ে দেখেন—একজন লোক হেঁটে যাচ্ছে, হাতে এক পুরনো কাঠের লণ্ঠন, যার আলো নড়ছে না, কাঁপছে না, নিঃশব্দে জ্বলছে। শশাঙ্ক চোখ কুঁচকে দেখতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু লোকটা যেন হাঁটতে হাঁটতেই হাওয়ায় গলে যায়। তিনি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর জোর করে নিজেকে বোঝান—এটা নিশ্চয় চোখের ভুল, হয়তো বয়সের দোষ।
পরদিন সকালে, হরিপদ মালাকারের বাড়িতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। হরিপদ, পঞ্চান্ন বছরের কামার, যার হাতের লোহা বাঁকাতে পারলেও ভাগ্যকে নয়। স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছে বছর কুড়ি আগে, আর একমাত্র ছেলে সজল কাজের খোঁজে বাঁকুড়া শহরে যায়-আসে। সেদিন রাতে হরিপদ প্রচুর মদ খেয়ে এসে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে যখন তার জ্ঞান ফেরে, তখন দেখে দরজার পাশে একটা কাঠের লণ্ঠন রাখা—একেবারে পুরনো আমলের, পিতলের হাতল, কাঁচের ঢাকনি, আর কাঠের গায়ে একটা ছোট মুখ আঁকা, যার চোখ দুটি ফাঁকা গহ্বর। লণ্ঠনটা সে দেখেছে জীবনে প্রথমবার, আর তার সামনে তখনো নিঃশব্দে জ্বলছিল আলো। মদhangover থেকে যখন সে কিছুটা বেরোয়, তখন দেখে পাশের ঘরে সজল নিথর হয়ে পড়ে আছে, মাথা থেকে রক্ত ঝরছে। তার চিৎকারে জড়ো হয় পুরো গ্রাম। কেউ বলে—সজল হয়তো রাতেই পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছে, আবার কেউ ফিসফিস করে—এটা লণ্ঠনের কাজ, ‘ওইটা যারে ধরে, তারে মারে’। শশাঙ্ক দাস শুনে কাঁপা গলায় বলেন, “আমি ওকে দেখেছি, কাল সন্ধেয়, চলেছে… হাতে সেই আলো।” অথচ কেউ তখনো জানে না, এটা কোনো কাকতাল নয়—এটা কিছু বড়ো কিছুর শুরু।
পিয়ালী ঘোষ তখন সদ্য গ্রামে এসেছে, কলকাতার এক সাময়িকপত্রের ফিচার জার্নালিস্ট। লোকবিশ্বাস, লোককথা আর অলৌকিকতার ওপর তার গবেষণার বিষয়, আর পাহাড়পুরে তার আগমন একবারেই কাকতালীয় নয়—বরং পূর্ব-পরিকল্পিত। হরিপদের বাড়ির ঘটনার খবর সে পায় এবং সোজা চলে যায় সেখানে। তার প্রথম নজরে আসে লণ্ঠনটি—চুপচাপ এক কোণে রাখা, যেন কোনো কথার অপেক্ষায়। পিয়ালী, যিনি বিশ্বাস করেন যুক্তি ও প্রমাণে, সে-ও এই পুরনো গ্রাম্য নিস্তব্ধতায় অদ্ভুত কিছু অনুভব করে। সে শশাঙ্ক দাসের সঙ্গে কথা বলে, আর ধীরে ধীরে জানতে পারে—এই লণ্ঠন মাঝে মাঝেই কারো না কারো বাড়িতে আসে, প্রতিবারই কেউ না কেউ স্বপ্ন দেখে, যেটা কোনো প্রাচীন গোপন সত্য ফাঁস করে। আর ঠিক তারপরে—ঘটে এক মৃত্যু। পিয়ালী ভাবতে শুরু করে, এটা কি কেবল কাকতাল? নাকি এ লণ্ঠন কোন অতিপ্রাকৃত স্মৃতির বাহক? তাকে ঘিরে আছে অদেখা এক বিচারব্যবস্থা, যার নিয়ম জানে না কেউ—শুধু অনুভব করতে পারে। পাহাড়পুরের এই নির্জন রাতে, লাল মাটির ছায়ায়, সেই রহস্য ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
অধ্যায় ২: মৃত স্বপ্নের আলোরেখা
পাহাড়পুরের দক্ষিণপ্রান্তে একটা পোড়োবাড়ি আছে—ছাদ ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালের খোলে গজিয়ে উঠেছে বুনো গাছ, আর খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো ঢোকে না, কেবল মাটির গন্ধ আর মৃতপ্রায় বাতাস। সেখানেই থাকে রঞ্জা—এক নিঃসঙ্গ মূক কিশোরী, যার কণ্ঠ নেই, কিন্তু চোখে এক নিস্তব্ধ ভাষা। তাকে কেউ ভালো করে চেনে না, কেউ আদর করে ডাকে না, যেন সে এই গ্রামেরই কেউ নয়, বরং কোনো অজানা অস্তিত্ব, যাকে সময় ভুল করে ফেলে গেছে। গ্রামের মহিলারা তাকে ডাকে ‘বোকা মেয়ে’, ছেলেরা টিপ্পনী কাটে, আর পুরুষেরা তাকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু রঞ্জা প্রতিদিন সেই পোড়োবাড়ির সামনে একটা কাঠের তক্তায় বসে ছবি আঁকে—মাটি, ছায়া, আগুন, গাছ আর চোখ। সে কোনোদিন স্কুলে যায়নি, কিন্তু তার হাতে জন্মগত দক্ষতা আছে—যেন দেখা না-দেখা জগতের ছবি আঁকতে পারে সে। হরিপদের মৃত্যুর দিন সন্ধেয়, যখন গ্রামে হাহাকার, সেই সময় রঞ্জা সেই পোড়োবাড়িতে একা, আর তার ঘরের দরজার সামনে রাখা সেই রহস্যময় কাঠের লণ্ঠন। আলোটা যেন জ্বলছে না, বরং নিশব্দে নিশ্বাস নিচ্ছে। রঞ্জা সেটা দেখে চমকে ওঠে, কিন্তু ভয় পায় না। সে লণ্ঠনের সামনে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।
রাত্রি গভীর হলে রঞ্জা স্বপ্ন দেখে—না, শুধু দেখে না, যেন সে সেই স্বপ্নের ভেতর হাঁটছে, স্পর্শ করছে, কাঁপছে। এক পুরনো গৃহদ্বার, কাদা ও ধানের আঁটি মিশে তৈরি মেঝে, আর এক নারী—আঁচলে আগুন লেগে গেছে, সে ছুটছে, কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে আসছে না। আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন পুরুষ—তাদের মুখ অন্ধকারে ঢাকা, শুধু একটা হাত থেকে ছিঁড়ে পড়ছে লাল চুড়ি। হঠাৎ করেই আগুনের আলো নিভে যায়, আর রঞ্জা চোখ মেলে দেখে, ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে লণ্ঠনটা আবার জ্বলছে। সকালে, ঘুম ভেঙে, সে খাতায় ছবি আঁকে—একজন জ্বলন্ত নারী, চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুখহীন মানুষ আর মাটির গায়ে আঁকা একটা অদ্ভুত শাঁখচূড় ফুল। ওই ছবি দেখেই গ্রামের কয়েকজন চমকে ওঠে—পুরোনো এক কাহিনির কথা মনে পড়ে যায় তাদের। বহু বছর আগে, ব্রিটিশ আমলের শেষের দিকে, এই গ্রামে এক গৃহপরিচারিকা আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। কেউ বলে দুর্ঘটনা, কেউ বলে ইচ্ছাকৃত। কিন্তু রঞ্জা এসব জানে না, কারো মুখ থেকে শোনেনি, শুধু স্বপ্নের আলোয় দেখেছে। এটা কি তার মনের কল্পনা? নাকি সেই মৃত আত্মার কথা, যা এখন লণ্ঠনের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে?
পিয়ালী ঘোষ সেই ছবি দেখে স্তব্ধ। সে ছবিটা তুলে নেয়, আর নিয়ে যায় শশাঙ্ক দাসের কাছে। শশাঙ্ক অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে, তারপর বলেন, “আমি তখন কিশোর, কিন্তু মনে আছে—এক গরিব মেয়ে, যাকে জমিদারের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল, তার মৃত্যুটা কেমন যেন গায়েব করে দেওয়া হয়েছিল। কেউ জানত না নাম, শুধু বলত—চুপ কর, না হলে তার মতো আগুনে পোড়বি।” পিয়ালী বুঝতে পারে, রঞ্জার স্বপ্ন কাকতাল নয়, বরং ইতিহাসের একটা গোপন দরজা খুলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কেন এখন? কেন এই লণ্ঠন এখন আবার ফিরে এসেছে? কে ঠিক করছে এই স্বপ্নগুলো কার ঘরে যাবে? আর এর শেষ কোথায়? রঞ্জা নির্বাক, কিন্তু তার চোখে এখন অন্যরকম ভাষা ফুটে উঠছে—যেন সে নিজেই বুঝতে শুরু করেছে, তার ভিতরে কী জেগে উঠছে। সেই রাতে পোড়োবাড়ির জানালা দিয়ে দেখা যায়, কাঠের লণ্ঠন আবার নিঃশব্দে আলো ছড়াচ্ছে, আর দূরে কোথাও বনের ভেতর হাওয়ার শব্দে যেন কারো কান্না মিশে আছে। পাহাড়পুর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে, সত্যের আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তার সঙ্গে মৃত্যু এসে জড়িয়েই থাকে—আর সেই আলোর পথেই এখন হাঁটছে এক নীরব মেয়ে, যার স্বপ্নে লুকিয়ে আছে মৃতদের মর্মভেদী কান্না।
অধ্যায় ৩: পাহাড়পুর ডায়েরি
পিয়ালী ঘোষ পরদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে গ্রামের পুরনো লাইব্রেরির দিকে যায়, যেখানে বহু বছর ধরে ধুলো জমে থাকা কাগজ আর পোকায় কাটা দলিল-ডায়েরি এক কোণে গুছিয়ে রাখা। শশাঙ্ক দাস তাকে বলেন, “ওখানে কিছু পুরোনো জমিদারি কাগজ আর নীল বিদ্রোহের সময়কার মামলা নথি রয়েছে, যদি খুঁজতে পারো।” পিয়ালী নিজের ক্যামেরা আর খাতা নিয়ে ভিতরে ঢোকে, দরজা ঠেলেই ধুলোর ঝাঁঝালো গন্ধে হেঁচকি তোলে। আলো আসে কেবল জানালার ফাঁক গলে, বাকিটা অন্ধকারের দখলে। মাটির ওপর কাঠের তাকগুলো ঝুঁকে পড়েছে, যেন অতীতের ওজন আর বইয়ের ভারে ক্লান্ত। পিয়ালী একটি মোটা নথিপত্রের গাঁট খুলতেই চোখে পড়ে এক পুরনো রেজিস্টার—কিন্তু এটা জমির নয়, বরং ১৯৩১ থেকে শুরু হওয়া এক অদ্ভুত মৃত্যুর তালিকা। “অজানা কারণে মৃত্যু”, “অগ্নিদগ্ধ”, “ঘুমের মধ্যে শ্বাসরোধ”—এই জাতীয় নোটেশন। আর প্রতিটি মৃত্যুর তারিখের আশেপাশে হাতের লেখায় ছোট করে লেখা—“আলো ছিল না”, “অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা গিয়েছিল”, “লণ্ঠন পাওয়া যায়নি।” পিয়ালী গভীরভাবে ভাবতে শুরু করে—এটা কি কেবল কাকতালীয় ঘটনা? না কি পাহাড়পুরে সত্যিই এমন কিছু ঘটেছে, যা বহু প্রজন্ম ধরে চলেছে, আর গ্রামের মানুষজন সেটিকে কুসংস্কার বলে এড়িয়ে চলেছে?
গ্রামের নিকটবর্তী হাটের পাশে এক বয়স্ক লোক পিয়ালীকে জানায়, “এই লণ্ঠন এক সময় ব্রিটিশ কনস্টেবলের ঘরে ছিল, যেদিন সে নিখোঁজ হয়, তার আগের রাতে স্বপ্নে নাকি সে দেখেছিল—কোনো একটা গোপন দলিল পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, আর শোনা যাচ্ছিল কোনো নারীর কান্নার শব্দ।” পিয়ালী এরপর একে একে কয়েকজন প্রবীণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে, এবং সকলেই লণ্ঠনের আগমনের সময় কোনো না কোনো অস্বাভাবিক স্বপ্নের উল্লেখ করে—কেউ মৃত মানুষকে দেখে, কেউ আবার নিজেরই মৃত্যুর ভবিষ্যৎ। তবে আশ্চর্যের বিষয়, প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মৃত্যু—যদিও সে মৃত্যু কখনো নেহাত দুর্ঘটনা বলে চালানো হয়, কখনো আত্মহত্যা, কখনো নিখোঁজ। পিয়ালী সব কিছু লিখতে থাকে, যেন এক এক করে ইতিহাসের ধুলোমাখা পাতা নতুন করে খুলে যাচ্ছে। শশাঙ্ক দাস তাকে বলেন, “এই লণ্ঠন হয়তো কোনো যন্ত্র নয়, এটা হয়তো একটা স্মৃতি-ধারক, অতীতের গোপন সত্য নিয়ে ঘোরে। কিন্তু তার একটা নিয়ম আছে—প্রত্যেক সত্য ফাঁসের জন্য একটা মূল্য দিতে হয়।” রাত্রে ফিরে এসে পিয়ালী নিজের ঘরে বসে সমস্ত তথ্য গুছিয়ে লেখে, আর বুঝতে পারে, গ্রামের নীরবতা যতই গভীর হোক না কেন, তার ভিতরে শব্দ আছে—জমে থাকা কান্না, চিৎকার, আর না বলা স্বীকারোক্তি।
সেই রাতেই, পিয়ালীর ঘরের জানালার পাশে আচমকা দেখা যায় সেই কাঠের লণ্ঠন—জ্বলন্ত নয়, বরং নিভে থাকা অবস্থায় রাখা। সে খানিকক্ষণ দোলাচলে থাকে, ছোঁবে কি ছোঁবে না। শেষে সাহস করে হাতে তুলে নেয়। অবাক করে, লণ্ঠনটা হালকা, অথচ তার কাঠের গায়ে যেমন টান অনুভব করে সে, মনে হয় যেন শত শত হাত তাকে ধরে রেখেছে। ঘরে রাখা পুরোনো রেকর্ডার নিয়ে সে বসে পড়ে, লণ্ঠনের পাশে। হঠাৎ ঘরের বাতি টিমটিম করতে থাকে, দরজা আপনা থেকেই খুলে যায়, আর কাঁচের জানালার ওপাশে যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে কেউ তাকিয়ে আছে। পিয়ালী সেই রাতে ঘুমাতে পারে না, বরং জেগে থাকে সজাগ দৃষ্টিতে—যেন এই নিস্তব্ধতা ভেদ করে কখনও যদি কোনো কান্না আসে, সে তা শুনতে না মিস করে। কিন্তু যখন সে চোখ বন্ধ করে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঢলে পড়ে, তখন তার ভিতরে ঘোরে এক দৃশ্য—এক মহিলা, চোখে আতঙ্ক, বুক ঢেকে ধরে আছে, আর এক ইংরেজ অফিসার তার সামনে দাঁড়িয়ে—কিছু বলছে, কিন্তু শব্দ শোনা যাচ্ছে না। দৃশ্য ঝাপসা হয়ে যায়, আর সে চমকে জেগে ওঠে—লণ্ঠন নিখোঁজ। কিন্তু সেই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে, এই গল্প শুধু অতীতের নয়, বরং বর্তমানের বুকে শিকড় ছড়িয়ে আছে। পাহাড়পুরের এই নিরীহ চেহারার পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এক মৃত আত্মার দল, যারা সত্যের ন্যায়ের আশায় অপেক্ষায় আছে—আর সেই ন্যায় এনে দিতে এসেছে এই কাঠের লণ্ঠন, এক নিঃশব্দ আলো, যা সত্যের বিনিময়ে চায় রক্তের খরচ।
অধ্যায় ৪: ধোঁয়ার ভিতর মুখ
পাহাড়পুরের প্রাচীন মন্দিরঘেঁষা গলিপথে জ্যোৎস্না ফোটে না, কেবল হালকা ছায়া নেমে আসে; আর সেই অন্ধকারের মাঝেই রাতের এক নিস্তব্ধ মুহূর্তে লণ্ঠনটি গিয়ে পৌঁছায় ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের বারান্দায়। পুরোহিত ধনঞ্জয়—এক কঠোর মুখ, যার কপালে বরাবর ধূসর চন্দনের রেখা, চোখে ধৈর্যের ঘন ছায়া, এবং কণ্ঠে শতাব্দীর পুরাতন মন্ত্র। সারা গ্রামে কেউ তাকে প্রশ্ন করে না, কেউ তার কথা ভুল প্রমাণ করতে চায় না, এমনকি শশাঙ্ক দাসও তার সামনে কথা বলার সময় কণ্ঠ নামিয়ে ফেলে। তিনি নিঃসন্তান, একা থাকেন, এবং তার অতীত নিয়ে বহু কানাঘুষো চললেও, কেউই চোখে চোখ রেখে কিছু বলে না। লণ্ঠন যখন তার দোতলার ঘরে রাখার জায়গায় নিজের অবস্থান নেয়, তিনি প্রথমে চমকে উঠলেও পরে তেমন কিছু ভাবেন না। “আলো তো জ্বলে না, তার মানে শক্তি নেই,” মনে মনে বলেন। কিন্তু গভীর রাতে, ধূপের ধোঁয়া আর মন্ত্রোচ্চারণের মাঝখানে, হঠাৎ করেই তার ঘরের আলো নিভে যায়। চারপাশে গা ছমছমে নীরবতা। সেই নীরবতার ভেতর তিনি শুনতে পান ঘরজোড়া কান্না—একটা বালকস্বর, কাতরস্বরে বলে ওঠে, “ওরা আমায় কেন পুঁতে রাখল?” আর সেই শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ধনঞ্জয় আবিষ্কার করেন নিজেকে একটা পুরোনো যজ্ঞস্থলে, যেখানে তার চারপাশে বসে থাকা কয়েকজন পুরোহিত ও শিক্ষার্থী মন্ত্র পড়ছে, আর মাঝখানে বসে আছে দশ বছরের এক ছেলে, কাঁদতে কাঁদতে তাকিয়ে আছে তার চোখে।
পরদিন ধনঞ্জয় নিঃশব্দে উঠে মন্দিরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই, মনে আতঙ্ক। বহু বছর পর তিনি অনুভব করেন, ভেতরে জমে থাকা এক পুরোনো গিল্টি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। তার মনে পড়ে সেই দিনটি—যখন তিনি ছিলেন এক নবীন ব্রাহ্মণ, গুরু দক্ষিণায় পাণ্ডিত্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় ডুবে। তার গুরু, এক কড়া সাধক, বিশ্বাস করতেন—“আধ্যাত্মিক শক্তি চাইলে উৎসর্গ দিতে হয়, রক্ত ছাড়া সিদ্ধি হয় না।” সেদিন, এক বালক শিষ্য—মেধাবী, অথচ দুর্বল মনস্ক, তারাই মিলেই যজ্ঞের নামে তাকে বলি দিয়েছিল, তাও কোনো পশু নয়—বরং সে-ই ছিল যজ্ঞের পবিত্র উৎসর্গ। বছর পেরিয়ে গেছে, ধনঞ্জয় হয়ে উঠেছেন পুরোহিত, লোকে মানে, ভয় পায়। কিন্তু সেই রাতে স্বপ্নে সেই বালক ফিরে এসে শুধু একটিই কথা বলে—“আমার শরীর তোমার পবিত্র মাটির নিচে পুঁতে রাখা হলো, কিন্তু আমার আত্মা আজও আলো চায়।” পিয়ালী যখন এই ঘটনার কথা জানতে চায়, ধনঞ্জয় মুখ বন্ধ রাখেন, কেবল বলেন—“লণ্ঠন জিনিসটা সরাও, এটা কোনো দেবতা নয়, এটা রক্ত চায়।” কিন্তু শশাঙ্ক বলেন, “রক্ত নয়, এটা চাইছে স্বীকৃতি। কোনো সত্য যদি চেপে রাখা হয়, তবে তার ওজন মরার পরেও টানে।” রঞ্জা, যে প্রতিদিন কিছু না কিছু আঁকে, এবার এঁকে ফেলে এক মন্দির, যজ্ঞ, আর মাঝখানে বসে থাকা বালক—চোখে জল, কপালে টিপ, আর শরীর কুয়াশার মধ্যে অর্ধেক ঢাকা।
লণ্ঠনের জ্বালানি শেষ হয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু ধনঞ্জয়ের ঘরে রাখা অবস্থাতেও তা জ্বলতে থাকে—অথচ সেখানে না আছে কেরোসিন, না আছে বাতাসের টান। এটা দেখে ধনঞ্জয় রাতের শেষে নিঃশব্দে চলে যান গ্রামের নদীর ধারে, একটা প্রাচীন শ্মশানের পেছনে, যেখানে নাকি বহু বছর আগে এক বলিপ্রথার স্থল ছিল। তিনি পুঁতে রাখা সেই বালকের জায়গায় প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন, মাথা নত করেন, আর বলেন—“তুই এবার চলে যা। আমি মানছি, আমি ভুল করেছি।” কিন্তু সেই রাতেই, গ্রামের মন্দিরে ঘটে এক ভয়ংকর ঘটনা—ধনঞ্জয় চুপচাপ নিখোঁজ হয়ে যান। তার খোঁজ পাওয়া যায় না, শুধু তার ঘরের দরজার সামনে রাখা থাকে সেই কাঠের লণ্ঠন—এবার নিভে যাওয়া, তার গায়ে লেখা ছোটো করে এক লালচে অক্ষর—“স্বীকারোক্তি সম্পন্ন।” পিয়ালী বুঝতে পারে, এটি কেবল অতীত উদ্ঘাটনের একটি ধাপ ছিল, আর ধনঞ্জয় সেই যাত্রার এক অপরিহার্য বিন্দু। তবে এক ভয়াবহ প্রশ্ন থেকে যায়—এই যাত্রা কি এখানেই শেষ? নাকি লণ্ঠনের পথ এখনো চলছে—আর কার ঘরে আলো ফোটাতে চলেছে সে? শশাঙ্ক এক কোণে বসে বলেন, “এই আলো নিভে গেলে কিছু সময়ের জন্য শান্তি থাকে, কিন্তু যতক্ষণ না সব সত্য একে একে ফাঁস হয়, ততক্ষণ এই লণ্ঠন ঘুরে বেড়াবে। কারণ যে মাটির নিচে মিথ্যা পোঁতা, সেখানে আলো এসে দাঁড়াবেই।”
অধ্যায় ৫: ছায়ার বাহক
পাহাড়পুরের উত্তরে, শ্মশানঘাট পেরিয়ে যেখানে বাঁশঝাড়ের সারি গিয়ে মিশেছে পুরনো ঘাটের ধারে, সেখানে সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। শিশুরা বলল, তারা একজন লম্বা, কালো চাদরে ঢাকা লোককে দেখেছে—হাতে সেই কাঠের লণ্ঠন, চোখে লালচে দীপ্তি। সে কারও সঙ্গে কথা বলে না, কারও দিকে চায় না, কেবল চলতে থাকে নীরব গতিতে, যেন হাওয়ার সঙ্গে ভেসে বেড়ানো এক ছায়া। নাম হয় “আভি”—কারণ সে আসে, আবার মিলিয়ে যায়, ঠিক যেমন করে ভোরের কুয়াশা। কিন্তু গ্রামের কিছু বয়স্ক মানুষের কাছে এই আভি নতুন নয়। তারা বলে, এই চেহারার মতো এক লোক অনেক বছর আগেও দেখা গিয়েছিল, যখন গ্রামের জমিদার রায়বাহাদুর সিংহ মারা যান তার নিজের ঘরে, হঠাৎ নিঃশব্দে, অথচ চোখে ছিল তীব্র আতঙ্ক। তখনও সেই মৃত্যুর আগের রাতে গ্রামের শেষ মাথায় কেউ একজন লণ্ঠন হাতে হেঁটে যেতে দেখা গিয়েছিল। এবার পিয়ালী আভিকে নিজের চোখে দেখার সিদ্ধান্ত নেয়। সে তার ক্যামেরা হাতে নির্জন রাতে অপেক্ষা করে ঘাটের কাছে, কিন্তু ক্যামেরা অন করলেই তা বন্ধ হয়ে যায়, ব্যাটারি শুকিয়ে যায়—যেন কোনো শক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে তা ব্যাহত করছে। চোখে দেখতে পায় সে এক মানুষকে—না, ঠিক মানুষ নয়, যেন সময়ের বাইরে দাঁড়ানো এক চেহারা, যার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, আর চোখ দুটি যেন খালি, অথচ অনুভব করিয়ে দেয় হাজার বছরের গ্লানি।
রঞ্জা, যে আগের অধ্যায়গুলিতে শুধু নীরব সাক্ষী ছিল, এবার আচমকা লণ্ঠনের খসখসে শব্দ শুনে দরজা খুলে দাঁড়ায়। তার চোখ দুটো চৌকস, শান্ত, যেন সেই ছায়ার চলাফেরা আগেই সে জানত। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সেই লণ্ঠনের সামনে দাঁড়ায়। আভি তাকে দেখে না, কিছু বলে না, শুধু লণ্ঠনটি মাটিতে রেখে পেছন ফিরে চলে যায়। রঞ্জা তখন হঠাৎ করে আঁচলের কোণে বাঁধা একটা পুরনো ছবি খুলে আনে—সেই ছবিতে আঁকা আছে একজন মেয়ে, আগুনের মধ্যে, আর তার পেছনে সেই একই লণ্ঠন। পিয়ালী অবাক হয়, কারণ সে ছবিটি আগেও দেখেছে, কিন্তু এবার রঞ্জার আঁকার মধ্যে আরও কিছু রহস্য থাকে—ছবির বাঁ দিকে একটা দরজা আঁকা, যার ওপর লাল কালি দিয়ে লেখা—“দ্বার খোলো, সত্য বেরোতে চায়।” শশাঙ্ক দাস এই ছবি দেখে বলেন, “এই ছায়া—আভি—হয়তো আসলে সেই অতীতের অভিশপ্তদের প্রতিনিধি, যে লণ্ঠনের ধারক, যাকে বলা যায় ‘স্মৃতির বাহক’। সে নিজের কথা বলে না, কিন্তু অন্যদের ভিতর দিয়ে বলে, যাদের বাড়িতে সে আলো রাখে, তারা নিজের অজান্তেই স্বীকারোক্তির পথ খোলে।” এর পরের রাতে গ্রামের পূজার ঘরেও আভিকে দেখা যায়, সেখানে থাকা পুরাতন কলস ভেঙে পরে, আর তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে এক পুরনো দলিল—সেখানে লেখা ছিল, এক ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার কথা, অথচ মামলাটি চাপা পড়ে যায়। এটা সেই একই বালকের কথা, যাকে ধনঞ্জয় স্বপ্নে দেখেছিলেন।
পিয়ালী এবার নিজেই প্রশ্নের মুখে পড়ে—এই রহস্য কি কেবল অতীত খোঁজার খেলা? না কি এটা আসলে সময়ের বিরুদ্ধে এক প্রতিশোধ? সে গ্রামের চারপাশে খোঁজ করতে শুরু করে, যেসব বাড়িতে লণ্ঠন গেছে তাদের তালিকা তৈরি করে—তার খেয়াল হয়, প্রত্যেকটি মৃত্যু বা স্বপ্ন-ঘটনা কিছু না কিছু আড়াল করা সত্য ফাঁস করে দিচ্ছে। আভি যেন শুধু এক বাহক নয়, বরং এক নীরব বিচারক, যে ঠিক সময়ে ঠিক লোককে টার্গেট করছে। প্রশ্ন উঠছে—কে ঠিক করছে এই নিয়ম? কেন রঞ্জা বারবার আঁকছে এমন ছবি, যা আগে সে কখনো দেখেনি? আর লণ্ঠনের অজানা আলো কি শুধুই স্মৃতি জ্বালায়, নাকি সামনে মৃত্যুর ছায়াও আনে? সেই রাতে, পিয়ালী তার রেকর্ডার অন করে লণ্ঠনের পাশে বসে, কিন্তু কোনো শব্দ ধরা পড়ে না—শুধু একসময় খুব হালকা করে একটি শব্দ হয়, যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে—“শেষ সত্যের দরজা খোলো না, সে তোমাকেও পুড়িয়ে দেবে।” তখন সে বুঝে যায়, এই যাত্রা এখন ব্যক্তিগত হয়ে উঠছে। পাহাড়পুরের নিঃশব্দ রাতের ছায়ায় আভি হেঁটে চলেছে, আর লণ্ঠনের আলো অনন্ত এক অন্ধকারের দ্বার খুলে দিচ্ছে, যেখানে প্রতিটি সত্য নিজেকে মুক্ত করতে চায়, কিন্তু তার মুল্য দিতে হয় কারও না কারও নিঃশ্বাস।
অধ্যায় ৬: লণ্ঠনের কণ্ঠস্বর
পাহাড়পুরের প্রত্যেকটি গলিপথ, প্রতিটি পোড়োবাড়ি, এমনকি ঝড়ে পড়ে যাওয়া শালগাছের নিচেও এখন যেন আলো পড়ে থাকে ভিন্নভাবে—একটা নিরব আতঙ্ক ভাসে বাতাসে, আর সবাই কান পাতলে শুনতে পায় কিছু না বলা কথা, যেন মৃতদের শ্বাসে মিশে থাকা শব্দ। এই অবস্থার মধ্যেই রঞ্জার আচরণ বদলাতে শুরু করে। সে আগের মতো নিঃশব্দ নেই, বরং তার চোখে এক চঞ্চল উত্তাপ, হাতে কাগজ আর রঙ। সে প্রতিদিন নতুন ছবি আঁকে—মাটির তলায় চাপা শরীর, চোখের পাতা খোলা মুখ, আগুনের ধোঁয়ায় ডুবে যাওয়া ছায়া। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, সে এখন স্বপ্নের মধ্যে কথা বলে—যদিও জেগে থাকলে এখনও বাকরুদ্ধ, কিন্তু ঘুমের ঘোরে, ঠিক মধ্যরাতে সে স্পষ্ট উচ্চারণে বলে—“তারা এখনো কথা বলতে চায়… শোনো তাদের, যারা আর বেঁচে নেই।” প্রথমে পরিবারের লোকজন ভেবেছিল কোনো অসুস্থতা, কেউ কেউ বলেছিল—“ওর ভিতরে কিছু ঢুকেছে।” কিন্তু পিয়ালী ঠিক তখনই বুঝতে পারে—লণ্ঠন এখন আর কেবল আলো নয়, তার ভিতর থেকে কেউ বা কিছু কথা বলছে, আর রঞ্জা তার মাধ্যম। এক রাতে সে রঞ্জার কাছে বসে রেকর্ডার চালু করে, লণ্ঠনের পাশে রাখে। ঠিক রাত বারোটার পর রঞ্জা বসে উঠে বলে—“সে মিথ্যে বলেছিল, বলির আগুন পবিত্র ছিল না। কুয়াশার মধ্যে পুড়ে যাওয়া শরীর আজও খোঁজে তার গলা ফাটানো স্বীকারোক্তি।”
পিয়ালী সেই রেকর্ড শোনার পর শিউরে ওঠে। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আত্মহত্যার আগের দিন সে যে চিঠি লিখেছিল, সেখানে ছিল ঠিক এই কথা—এক বালককে বলির আগুনে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল, আর সেই যজ্ঞ ছিল আধ্যাত্মিকতার নামে এক ভয়ঙ্কর প্রতারণা। পিয়ালী উপলব্ধি করে, রঞ্জা যা বলছে, তা শুধুই ‘স্বপ্ন’ নয়—এ যেন মৃত আত্মার মুখপাত্র হয়ে উঠছে সে। শশাঙ্ক দাস বলেন, “প্রত্যেক যুগে কেউ কেউ জন্মায়, যারা কথা না বলেও সব শুনতে পায়। হয়তো রঞ্জা সেই একজন। এখন সে কেবল ছবি আঁকে না, বরং প্রাচীন আত্মার ভাষা বুঝে ফেলে।” গ্রামের এক বৃদ্ধা জানায়, রঞ্জার জন্ম হয়েছিল পূর্ণিমা রাতে, যখন নাকি মন্দিরের ঘন্টার শব্দ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ, আর কুকুরেরা একসঙ্গে চিৎকার করেছিল রাতভর। কেউ কেউ বলে, সেই রাতেই নাকি শ্মশানের পেছন থেকে কুয়াশার মতো কিছু ঢুকে পড়েছিল রঞ্জার দেহে। কিন্তু এসব এখন আর গল্প নয়—পিয়ালী অনুভব করে, সময়ের স্তব্ধ ঘরগুলো খুলে যাচ্ছে একে একে, আর রঞ্জা হয়ে উঠেছে সেই দরজার চাবি, যার প্রতিটি ঘূর্ণনে ফাঁস হচ্ছে এক একটি চাপা সত্য। সে যেসব কথা বলছে ঘুমের ঘোরে, সেগুলো ঠিক যেন প্রাচীন আত্মার ডায়েরির পাতা—কখনও নারীর কান্না, কখনও শিশুর আর্তনাদ, আবার কখনও নিঃশব্দে বলা একটি নাম—যা আজ কেউ উচ্চারণ করে না।
সেই রাতে আবার দেখা যায় আভিকে—লণ্ঠন হাতে, গ্রামের মধ্যিখানে, এক পুরোনো পুকুরের ধারে, যেখানে নাকি এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছিল বছর পঁচিশ আগে। তার পরিবার আজও নাম নেয় না, গ্রামের রেজিস্টারে মৃত্যুর কারণ লেখা—“জলবায়ুজনিত দুর্বলতা।” কিন্তু সেই পুকুরের পাশে আভিকে দেখার পরদিন সকালেই, রঞ্জা আঁকে ঠিক সেই কিশোরীর মুখ, যার চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে অর্ধেক বলা নাম। তার পাশে, আঁকা একটি মুখ—যার কপালে ব্রাহ্মণিক টিপ, আর হাতে বেলপাতা। পিয়ালী বুঝে যায়, এই মৃত্যু, এই চাপা গল্প—সব কিছুই লণ্ঠনের জাল। আর সেই জালে রঞ্জা শুধুই শিকার নয়, বরং সেই মধ্যস্থতাকারী, যার মাধ্যমে মৃতরা কথা বলছে। “এটা আর কুসংস্কার নয়,” পিয়ালী লেখে তার খাতায়, “এটা এক অলৌকিক স্মৃতিচক্র, যেখানে প্রত্যেক সত্যের জন্য একটা স্বর তৈরি হচ্ছে, আর লণ্ঠন হচ্ছে তার মাইক। প্রতিটি স্বীকারোক্তি যত গভীর, তত জোরে বাজছে রঞ্জার কণ্ঠে।” শশাঙ্ক দাস বলেন, “লণ্ঠনের আলো নিভে গেলেও কণ্ঠ থেকে যাবে। যে সত্য একবার মুখ ফুটেছে, সে আর কবরের নিচে যাবে না।” আর সেই রাতে রঞ্জা আবার বলে ওঠে, এবার ঘুমের মধ্যেও নয়—জেগে বসে, সরাসরি পিয়ালীর দিকে তাকিয়ে: “তোমার বাবার নাম ছিল অর্জুন ঘোষ… না?” পিয়ালীর মুখ সাদা হয়ে যায়, কারণ এটাই সেই সত্য, যা সে কোনোদিন প্রকাশ করেনি। লণ্ঠনের কণ্ঠ এখন তার দিকেই ফিরেছে।
অধ্যায় ৭: সত্যের ছায়া পড়ে নিজ ঘরে
রাত্রি নেমে এসেছে পাহাড়পুরে, কিন্তু এই রাতে তার অন্ধকার যেন একটু বেশি ভারী, বাতাস কিছুটা গা-জ্বালানো, আর কুকুরগুলোও ঘেউ ঘেউ না করে কেমন নিঃশব্দে পেছনপেছন ছুটে বেড়াচ্ছে—যেন কেউ তাদেরও টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক অজানা পথের দিকে। পিয়ালী ঘোষ ঘরে ফিরে আসে অনেকটা হতবিহ্বল অবস্থায়, কারণ রঞ্জার বলা শেষ কথাটি যেন তার নিজের ভিতরের দেয়াল ভেঙে দেয়। “তোমার বাবার নাম ছিল অর্জুন ঘোষ… না?”—এই প্রশ্নটা সহজ মনে হলেও এর ভিতর ছিল এক অজানা ঝড়। কারণ পিয়ালী আজ অবধি জানত, তার বাবা অরবিন্দ ঘোষ, এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। কিন্তু “অর্জুন ঘোষ”? এই নাম সে ছোটবেলায় কেবল একবার শুনেছিল, যখন মা ঝগড়ার সময় চিৎকার করে বলেছিলেন, “তুই জানিস না, তোর আসল বাবা কে ছিল।” তখন সে ভেবেছিল এ শুধুই রাগের কথা। কিন্তু আজ, এতদিন পর এক মূক কিশোরীর মুখে যখন সেই চাপা নাম ভেসে উঠল, তখন তার শরীরের ভিতর দিয়ে যেন শীতল একটা ধাক্কা বয়ে গেল। সে ফোন করে মাকে, আর জিজ্ঞেস করে—“মা, বাবা কি সত্যিই অরবিন্দ ঘোষ?” ফোনের ওপাশে নিঃশব্দতা। তারপর মায়ের গলা কাঁপতে কাঁপতে বলে ওঠে, “তুই আজ এত বছর পর জানতে চাস কেন?” পিয়ালী উত্তর দেয় না, শুধু শোনে মায়ের হালকা কাঁপা গলা, “হ্যাঁ… অর্জুন ঘোষ তোর আসল বাবা, কিন্তু সে একটা ভুল ছিল। এক রাতের ভুল। আমি ভেবেছিলাম তুই কোনোদিন জানবি না। অরবিন্দ তোর ভালোর জন্য সব ঢেকে দিয়েছিল।” পিয়ালী কথা না বলে ফোন রেখে দেয়। সে জানে, এবার তার ঘরেই লণ্ঠনের আলো পড়েছে—এবার আর অন্যদের সত্য নয়, এবার তার নিজের পালা।
ঘরে ফিরে পিয়ালী দেখে, তার ডেস্কের ওপর রাখা আছে সেই কাঠের লণ্ঠন—কেউ রেখে গেছে নিঃশব্দে। জানালার পর্দা হাওয়ায় দুলছে, বাইরে ঘন কুয়াশার মধ্যে কিছু একটা নড়ছে যেন। সে লণ্ঠনের দিকে তাকায়, আর তার ভিতরের আলো যেন নড়ে উঠছে এক আশ্চর্য রাগে—কখনো গাঢ় লাল, কখনো নিঃশব্দ নীল। সে ধীরে ধীরে তা স্পর্শ করে, আর সেই মুহূর্তে একটি দৃশ্য ভেসে ওঠে তার চোখের সামনে—এক ছোট্ট ঘর, পুরোনো ফ্যানের নিচে বিছানায় বসে এক তরুণী, মুখে আতঙ্ক, কপালে জল, আর তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পুরুষ—সেই অর্জুন ঘোষ। মুখে হাসি, কিন্তু চোখে ভয়, আর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একটি শিশু—হাত দু’টি জানালার রেলিংয়ে রাখা, ঠোঁটে শব্দ নেই, কেবল তাকিয়ে থাকা। এই দৃশ্য যেন তার স্মৃতির কোনো ভ্রান্ত প্রতিচ্ছবি, কিন্তু সে বুঝতে পারে—এটা তার জন্মরাতের ছবি। সে জন্মেছিল একটি ভুল সম্পর্কের ফসল হয়ে, অথচ বড় হয়ে সত্যি খুঁজতে গিয়ে এখন নিজেই সেই সম্পর্কের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। লণ্ঠনের আলো নিভে যায় হঠাৎ, কিন্তু ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, আর জানালার বাইরে থেকে শোনা যায় সেই চিরচেনা ফিসফিসানি—“তুমি কি সত্য প্রকাশ করবে, নাকি এটাও চাপা দেবে?” পিয়ালী বুঝতে পারে, এবার সে শুধু পর্যবেক্ষক নয়, বরং সেই চক্রের এক সক্রিয় অংশ, যেখানে প্রত্যেকটি সত্যের দাম দিতে হয় আত্মা দিয়ে।
শশাঙ্ক দাস যখন পরদিন পিয়ালীর বাড়ি আসে, সে তার চোখে দেখে এক অদ্ভুত শান্তি—যেমন একজন লোক দীর্ঘ সময় পরে বোঝে, নিজের ভিতরের ভূতের সঙ্গে লড়াই করে সে আজ মুক্ত। পিয়ালী বলে, “আমি বুঝতে পেরেছি, সত্য শুধু অন্যের বাড়ি ভাঙে না, নিজের ভিতরেও ঘর ফাটিয়ে দেয়।” শশাঙ্ক বলেন, “এই লণ্ঠনের আলো তার নিজের নিয়মে চলে। তুমি লিখছো, ছবি আঁকা হচ্ছে, আর মৃতরা কথা বলছে—এ তো আসলে এক প্রাচীন সত্যের প্রতিচ্ছবি, যা যুগের পর যুগ জমে থাকে, আর তারপর একদিন হঠাৎ এসে বলে—এই গল্পটা শোনো।” রঞ্জা এসে বসে পিয়ালীর পাশে, এবার কথা না বলে তার হাত ধরে রাখে—তাদের দুজনের চোখে একই রকম গ্লানি, আর সেই গ্লানির ছায়ায় এক নীরব আত্মপ্রকাশ। সেই রাত, আবার নিঃশব্দ, আবার জ্যোৎস্নার মাঝে ঘুরে বেড়ায় সেই ছায়াচিহ্নিত ‘আভি’, আর তার পেছনে ঘুরতে থাকে কাঠের লণ্ঠন, এবার যেন একটু বেশি ভারী আলো নিয়ে। পাহাড়পুরের সব ঘরে এখন আলো নিভে গেছে, কিন্তু সত্যের ছায়া পড়ে গেছে প্রত্যেকটি দেয়ালে—আর এই ছায়া যতবার পাল্টে যাবে, ততবার উঠে আসবে একেকটি মুখ, একেকটি কান্না, আর একেকটি স্বীকারোক্তি, যা কোনোদিন মুছে ফেলা যাবে না।
অধ্যায় ৮: মাটির নীচে মুখ
পাহাড়পুরের যে ছোট পাঁকপথটা বয়ে গিয়ে মিশেছে উত্তর-পশ্চিম দিকের পাথুরে উঁচু জমিতে, সেখানে একটা প্রাচীন তালগাছ দাঁড়িয়ে আছে—গোড়ার দিকটা সাদা মাখা ক্যালসিয়ামের দাগে ঢাকা, আর গায়ে ছোপ ছোপ লাল রঙের ছিটে, যাকে কেউ কেউ বলে “শ্রাদ্ধের দাগ”। এই গাছটার নিচে একসময় লোক জমত, কেউ বলত আত্মা দেখা যায় এখানে, কেউ বলত এই গাছের গোড়ায় মৃতের হাড় আছে। এতদিন ধরে সবই কাহিনি ছিল, কিন্তু আজ সেই তালগাছটার নিচেই শুরু হলো খনন। পিয়ালী, শশাঙ্ক দাস, আর স্থানীয় কিছু তরুণ মিলে সিদ্ধান্ত নেয়—রঞ্জার আঁকা ছবির সূত্র ধরে এখানে খোঁড়াখুঁড়ি হবে। কারণ রঞ্জা কিছুদিন ধরে এমন এক ছবি আঁকছে, যাতে একটা তালগাছ, তার নিচে অর্ধেক মাটিচাপা মুখ, আর সেই মুখের ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা একটা ছোট কাঠের লণ্ঠন দেখা যাচ্ছে। প্রথমে লোক হাসাহাসি করেছিল, “ছবির মেয়ে আঁকছে, মানে ভূতের গল্প,” বলেছিল কেউ। কিন্তু পিয়ালী নিশ্চিত ছিল—লণ্ঠনের ইতিহাসের সূত্র এখানেই। খনন শুরু হতেই, তৃতীয় দিন দুপুরবেলা, গন্ধটা আগে আসে—পচা মাটির, ভেজা চামড়ার, আর পুরনো কাঠের গন্ধ। তারপর এক এক করে উঠে আসে কাঠের বাক্স, তার ভিতরে পুরোনো কাপড়ে মোড়া একটা মানুষের মাথার খুলি—আর ঠিক তার পাশেই কাঠের তৈরি একটি ছোট লণ্ঠন, সেই একই নকশার, যেটা এখন রাত্রে ঘুরে বেড়ায়। গ্রাম স্তব্ধ হয়ে যায়। চিৎকার নয়, শুধুই হিম নীরবতা। মানুষজন প্রথমে পালিয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে জড়ো হয়।
শশাঙ্ক দাস সেই মুহূর্তে হাত দিয়ে খুলি ছুঁয়ে বলেন, “এই মাথাটাই প্রথম মুখ, যে লণ্ঠনের দায়িত্ব পেয়েছিল। কিন্তু কে ছিল সে?” তখন রঞ্জা পিয়ালীর ডায়েরির পেছনের পৃষ্ঠায় আঁকে এক মুখ—চোখ দুটো ঢুলে পড়া, কপালে একটা ছোট দাগ, আর গালভর্তি কাটা দাগ, যেন কেউ ছুরি দিয়ে চিরে দিয়েছিল মুখ। পিয়ালী এই ছবি নিয়ে ছুটে যায় লাইব্রেরিতে, পুরোনো জমিদারি তালিকায় চোখ বুলিয়ে দেখে, ১৮৯৭ সালের একটি নথিতে লেখা—”শশী ভট্টাচার্য, এক নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ, জমিদারের দাস, হঠাৎ নিখোঁজ; চুরি ও গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে গ্রাম থেকে বহিষ্কৃত।” কেউ জানত না, সে কোথায় গেল। আর আজ, তালগাছের নিচে সেই মাথা উঠে এল, লণ্ঠনের পাশে, যেন দেড় শতাব্দী পরেও সেই আলো রয়ে গেছে তার প্রহরায়। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয় হলো—লণ্ঠনের কাঠ এখনও মজবুত, তার গায়ে একটা কাটা দাগে লেখা “মুখ খুলিস না”, যেটা কেউ তখনি খেয়াল করে না। রাতে রঞ্জা ঘুমিয়ে পড়ে, আবার স্বপ্নে সেই লণ্ঠনের পাশে শুয়ে থাকা মুখটার দিকে তাকায়—আর সেই মুখ বলে ওঠে, “তারা সবাই বলেছিল—তুই মুখ খোললে মরে যাবি, আর আমি মুখ খুলে চিরজীবনের জন্য মাটির নিচে গেছি। এবার তুই লিখে ফেল, বল—তাদের নাম নে।” ঘুম ভেঙে রঞ্জা উঠে পড়ে, আলো নিভিয়ে দেয়, আর আঁকা শুরু করে—একটা বড় তালিকাভর্তি নাম, ঘিরে থাকে আগুনের রেখা।
পরদিন সেই ছবির প্রতিটি নাম মেলাতে গিয়ে দেখা যায়, এগুলো সেই পুরনো পরিবারের লোকজন, যারা তখন জমিদারদের অনুগত ছিল, কেউ ছিল পুরোহিত, কেউ আইনরক্ষক, কেউ মধ্যস্থতাকারী—যারা সবাই মিলে শশী ভট্টাচার্যের গলায় দড়ি বেঁধে তাকে পাথরের বাক্সে ভরে জীবন্ত পুঁতে দিয়েছিল। কারণ সে জেনে গিয়েছিল, জমিদার বংশের এক অবৈধ সম্পর্ক, আর সেই সন্তান হত্যার আদেশ। আর শশী মুখ খুলতে চাইছিল, তাই তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল—চিরতরে। কিন্তু তার লণ্ঠন রয়ে গিয়েছিল, আর সেই লণ্ঠনের ভেতর বন্দি হয়ে যায় প্রতিটি ফাঁস না হওয়া স্বীকারোক্তি। পিয়ালী লেখে তার রিপোর্টে, “এই কাঠের লণ্ঠন কোনো অলৌকিক বস্তু নয়, এটি এক জীবন্ত দলিল—যা সময়ের মুখ খুলে দেয়, আর সেই সত্যকে তুলে ধরে রক্তের বিনিময়ে।” সেদিন সন্ধ্যে থেকে পাহাড়পুরে অন্ধকার নামে আগের চেয়ে ঘন, কারণ এবার কেউ জানে না—লণ্ঠনের আলো এবার কার দরজায় থামবে, কে হবে পরবর্তী বাহক। রঞ্জা আর পিয়ালী, দুজনেই জানে—এবার কেবল ইতিহাস নয়, বরং সময় নিজেই তাদের ভেতর দিয়ে এক ভয়ঙ্কর সত্য প্রকাশ করতে চাইছে, যাকে এড়ানো আর সম্ভব নয়। আর সেই রাতের শেষ প্রহরে, তালগাছের নিচে নিঃশব্দে দেখা যায় আভিকে—হাতে সেই পুরোনো কাঠের লণ্ঠন, চোখে এক স্থির দৃষ্টি, আর তার পেছনে ভেসে ওঠে অসংখ্য মুখ, যেন শত শত মৃত মুখে শুধু একটিই কথা—“এই আলো নিভতে দিও না।”
অধ্যায় ৯: আত্মার নামহীন রোশনি
পাহাড়পুরের আকাশ আজ যেন ভারী, রোদ নেই, অথচ বর্ষা নয়, কুয়াশা নেই, অথচ বাতাস কাঁপছে—এই অদ্ভুত আবহে গ্রামের মানুষজন চুপচাপ, যেন কেউ না কেউ কিছু একটা শুনেছে, দেখেছে, আর বাকিরা ঠিক জানে না সেটা কী, শুধু বোঝে—এবার যেন সবকিছু একটা কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। সকালবেলায় পিয়ালী ও শশাঙ্ক পৌঁছায় গ্রাম থেকে খানিক দূরের ভাঙা মিশন চার্চে, যেটি এখন ধ্বংসপ্রাপ্ত, ভেতরে অজস্র চুন-ধুলো, আর মাটির ভাঙা স্তম্ভ। শোনা যায়, ব্রিটিশদের সময় এখানেই একবার এক পাদ্রি খুন হয়েছিল—অথচ তার খুনি ধরা পড়েনি। পিয়ালী সেই ইতিহাস জানে না, কিন্তু রঞ্জা আগের দিন হঠাৎ এক ছবি আঁকে—এক অন্ধ পাদ্রি, যার গলায় ক্রুশ, কিন্তু মুখ ঢাকা কালো কাপড়ে। সেই ছবির নিচে সে এক লাইন লিখে—“সে শুনতে পায়নি, তাই তাকে নিঃশব্দেই শেষ করা হয়।” মিশন চার্চের গম্বুজের নিচে পিয়ালী সেই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অনুভব করে, আশপাশে হঠাৎ হিমশীতল কিছু একটা ঘুরছে—কোনো স্পর্শ নয়, কিন্তু অনুভূত। হঠাৎই তার ফোন বেজে ওঠে—শশাঙ্ক বলে, “আমাদের ফিরতে হবে। রঞ্জা নেই।” সেই একটিমাত্র বাক্যে যেন মাটি সরে যায় তার পায়ের তলা থেকে। সে দৌড়ে বেরিয়ে পড়ে, আর তখনই, দূরে তালগাছের পিছন থেকে আবার দেখা যায় সেই পরিচিত ছায়া—আভি, এবারও নিঃশব্দ, চোখে আগুনের রেখা, আর হাতে সেই কাঠের লণ্ঠন।
রাত্রে গ্রামে খোঁজ শুরু হয়—রঞ্জার ছবি, তার খাতা, তার আঁকা প্রতিটি পৃষ্ঠা তন্ন তন্ন করে দেখা হয়, আর ঠিক তখন পিয়ালী তার এক পৃষ্ঠায় দেখে একটি নতুন আঁকা—একটা মন্দির, যার সিঁড়ির নিচে বসে আছে রঞ্জা, তার কপাল ছুঁয়ে আছে সেই আলো, আর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আভি। পিয়ালী বুঝে যায়, এবার রঞ্জা এক নতুন স্তরে চলে গেছে—সে শুধু ‘মাধ্যম’ নয়, সে হয়তো নিজেই হয়ে উঠেছে সেই অনন্ত রোশনি, যাকে ঘিরে ছিল পুরো লণ্ঠনের ইতিহাস। গভীর রাতে তালগাছের নিচে আবার খোঁজ শুরু হয়, আর তখনই মাটির ভেতর থেকে উঠে আসে একটি কাঠের বাক্স, ভিতরে নেই দেহ, নেই হাড়—শুধু কিছু কাগজ, যেগুলোতে লেখা রঞ্জার হাতে আঁকা বাক্য, কিন্তু প্রতিটি কথার পেছনে এক একটি নাম। নামগুলো সেই সকল মৃতদের, যাদের মৃত্যুর কোনো দলিল ছিল না, যাদের আত্মারা এতদিন ধরে মুখ খুলতে পারেনি। শশাঙ্ক বলেন, “রঞ্জা হয়তো নিজেকে উৎসর্গ করেছে—সে জানত, সত্য প্রকাশ করতে গেলে তাকে সেই মুখগুলোর ভাষা হতে হবে। সে তাদের হয়ে কথা বলেছে, আর এবার সে নিজেই সেই আলো।” তালগাছের নিচে তখন বাতাস থমকে যায়, আর এক মুহূর্তে সেই কাঠের লণ্ঠনের শিখা নিজে থেকে জ্বলে ওঠে, প্রথমবারের মতো উজ্জ্বল লাল আলোয়।
এই আলো কারও চোখে পড়ে না, কেউ তার উত্তাপ টের পায় না, কেবল পিয়ালী অনুভব করে—তার ভেতরটা যেন আগুনে দগ্ধ হচ্ছে, কিন্তু ভয় নেই, কেবল গভীর এক শান্তি। সে বুঝতে পারে, রঞ্জা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার ভিতরে রেখে গেছে এক অদৃশ্য পাণ্ডুলিপি, যেখানে শুধু আত্মার ভাষা, মৃতের সাক্ষ্য আর চাপা সত্যের স্বীকারোক্তি। সে লিখতে শুরু করে—এবার আর রিপোর্ট নয়, এবার সে লিখছে এক ‘প্রণামপত্র’ তাদের জন্য, যারা ইতিহাসে নাম পায়নি, অথচ সত্যের কাঠামো গড়েছিল। সে জানে, আভি এখন আর একা নেই, আভির ভিতর এখন রঞ্জাও আছে—আর সেই মিলনেই তৈরি হয়েছে এক অদৃশ্য ন্যায়বিচারকের রূপ, যার হাতে লণ্ঠন আর চোখে শেষ আলো। পাহাড়পুরের মানুষরা একে একে দরজা খুলে দেয়, কেউ ছবি রাখে দাওয়ায়, কেউ মৃত আত্মার নাম করে মোমবাতি জ্বালে। শশাঙ্ক বলেন, “এই হলো মুক্তি। সত্য কেবল প্রকাশ নয়, গ্রহণও।” আর সেই রাতে, শেষবারের মতো দেখা যায় আভিকে, পাহাড়পুরের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে, পেছনে লম্বা ছায়া, মুখে চিরপরিচিত স্তব্ধতা, আর হাতে সেই কাঠের লণ্ঠন—এবার তাতে লেখা এক নতুন লাইন: “সব মুখ এখন বলা হয়েছে।”
অধ্যায় ১০: যেখান থেকে আলো ফিরে আসে
পাহাড়পুর আজ অনেকটাই পাল্টে গেছে, অথচ কেউ বুঝতে পারছে না ঠিক কোন দিক দিয়ে—কুয়াশা যেমন আগের মতোই নামে, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক যেমন রাতে বাজে, তালগাছের ছায়া যেমন নেমে আসে মাঠে—তবু যেন চারপাশে কিছু একটার ভারমুক্তি আছে, ঠিক যেমন বহু বছরের পুরোনো বাক্স থেকে কাপড় সরালে তার নিচে লুকানো রোদ এসে পড়ে। লণ্ঠনের আলো অনেকদিন হলো আর দেখা যায় না রাত্রে—না কারও জানালায়, না কোনো গলিপথে, না তালগাছের গোড়ায়। রঞ্জা নিখোঁজ, পিয়ালীর রিপোর্ট শেষ, শশাঙ্ক দাস এখন আবার দোকানে বসে পেন কিনে খাতায় কবিতা লেখে, আর গ্রামের লোকজন এখন বিশ্বাস করে, কিছু কিছু মৃত্যু আসলে দরজা খোলে, দেয়াল গড়ে না। পিয়ালী আবার শহরে ফিরেছে, তার রিপোর্ট ছাপা হয়েছে দেশের বহু পত্রিকায়—“The Lantern of Truth: A Forgotten Village’s Buried Voices” নামে। কিন্তু তাতে যা ছাপা হয়নি, তা হলো—লণ্ঠন শুধু সত্য ফাঁস করেনি, আত্মার গভীরতায় পৌঁছে পিয়ালীকেও পাল্টে দিয়েছে। শহরের ব্যস্ত অফিসে বসে থেকেও সে মাঝে মাঝে বুঝে যায়, তালগাছের পাশে বাতাসে কেমন গন্ধ ছিল, আর আভির চোখে যে ছায়া নেমে আসত তা আজও তার স্বপ্নে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত হলো—রঞ্জার একটা খাতা, যে খাতা সে কখনো খোলেনি, পিয়ালীর ব্যাগের ভেতর একদিন হঠাৎ পাওয়া যায়। সেখানে আঁকা ছবি, লেখা অদ্ভুত ভাষায়—যা অনেকটা তার নিজের তৈরি লিপি, কিন্তু এক পৃষ্ঠায় স্পষ্ট বাংলায় লেখা: “যখন কেউ মুখ খুলতে পারবে না, তখন আলো আবার ফিরবে।”
সেই বাক্যটা পিয়ালীর মাথায় গেঁথে যায়। শহরে একদিন সে খবর পায়, একটি শিশুর গলা কাটা দেহ পাওয়া গেছে পুরোনো একটি হাসপাতালের ধ্বংসাবশেষে, আর পাশে রাখা ছিল একটি কাঠের লণ্ঠন। সেদিন রাতেই তার ফোনে একটি ছবি আসে—কোনো নম্বর নেই, কেবল একটি চিত্র: এক খোলা জানালা, তাতে রাখা সেই কাঠের লণ্ঠন, আর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে—মাথা নিচু, চোখ অন্ধকারে ঢাকা। পিয়ালী বুঝে যায়, রঞ্জা হয়তো নিখোঁজ নয়, বরং এখন সেই পথের যাত্রী—একটি যাত্রা যা একেক জনের দুঃস্বপ্নে ফিরে আসে, যে সত্য মুখে আনতে পারেনি, তাদের ঘরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানতে চায়, এটা কি অভিশাপ, নাকি আশীর্বাদ? শহরে এখন মৃতদের নিঃশ্বাস নিয়ে কেউ কথা বলে না, তারা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপন ছাপে, কিন্তু পিয়ালী জানে, যে লণ্ঠন একদিন পাহাড়পুরে আলো ছড়িয়েছিল, সে এখন শহরের এই ইঁটপাথরের জঙ্গলে ঢুকে গেছে, আর হয়তো একদিন সেই তারাই আবার হবে মুখ খুলতে বাধ্য। সে এখন লিখতে শুরু করেছে এক উপন্যাস—না, শুধু রিপোর্ট নয়, এবার সে লিখছে “আভির ডায়েরি” নামে, যেখানে সে সবকিছু তুলে ধরছে—একটা নামহীন ইতিহাস, যেখানে লণ্ঠনের আলো মাটির নিচে শুয়ে থাকা মুখগুলোকে টেনে নিয়ে এসেছিল পৃথিবীর আলোয়।
পাহাড়পুরে এখন আর কেউ আতঙ্কে কাঁপে না, বরং প্রতি পূর্ণিমা রাতে গ্রামের ছোট ছেলেমেয়েরা তালগাছের নিচে মোমবাতি জ্বালায়—একটা ছোট্ট ঘর তৈরি হয়েছে সেখানে, নাম দেওয়া হয়েছে “শ্রদ্ধার থানে”, যেখানে কেউ কিছু বললে কেউ থামায় না, কেউ সত্য উচ্চারণ করলে তার গলা টিপে ধরা হয় না। শশাঙ্ক দাস বলেন, “যে সত্যকে বলা যায়, সে আর বিষ নয়।” সেই জায়গায় গ্রামের এক ছেলেমেয়ে একসঙ্গে ছবি আঁকে, কেউ লেখে, কেউ চুপচাপ বসে থাকে—কিন্তু কেউ আর মুখ বন্ধ রাখে না। পিয়ালী বুঝতে পারে, এটা কেবল গ্রামের গল্প নয়, এটা একটা চিরন্তন চক্রের রূপ—যেখানে কোনো এক নামহীন মুখ, কোনো এক নিরব আত্মা, কোনো এক ভুলে যাওয়া সত্য—ফিরে আসে। আর সেই ফেরার সঙ্গী হয়ে থাকে একটি কাঠের লণ্ঠন, যেটা কোনোদিন নিজের ভাষা বলে না, শুধু অন্যের ভিতরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে নিঃশব্দে চলে যায়। শেষ দৃশ্য: পিয়ালী একটি ট্রেনে বসে, জানালার পাশে মাথা হেলিয়ে, তার পাশে রাখা ব্যাগে দেখা যায় একটি পুরোনো কাঠের জিনিস—মোড়া কাপড়ে, কেবল এক কোণ দেখা যাচ্ছে, আর তাতে হালকা জ্বলছে লালচে ছোপ। ট্রেন ছুটে চলে—সত্য এবার অন্য কারো দরজায়।
শেষ