রজত মিত্র
অধ্যায় ১ –
অর্ণব সেনের স্টুডিওটা যেন এক অন্যরকম জগৎ। শহরের ব্যস্ততার ভিড় থেকে কিছুটা দূরে, উত্তর কলকাতার এক পুরনো দোতলা বাড়ির ছাদের ঘরটিকে সে নিজের সৃজনশীল আশ্রয় বানিয়েছে। ঘরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে নানা রঙের টিউব, তুলি, পুরনো ক্যানভাস আর অর্ধেক আঁকা ছবির স্তূপ। জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে, ধুলো জমা কাঠের মেঝেতে আলোর রেখা ছড়িয়ে পড়ছে, আর বাতাসে মিশে আছে টারপেনটাইন আর জলরঙের ঘ্রাণ। অর্ণবের জীবন মূলত এই চার দেয়ালের ভেতরেই আবদ্ধ। বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগ প্রায় নেই, কেবল মাঝে মাঝে চিত্রপ্রদর্শনীতে হাজির হয়ে কিছু চেনাজানা মুখকে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তাকে পাওয়া যায় ক্যানভাসের সামনে বসে, দুচোখ একাগ্র, হাতে জলভেজা তুলি, আর মনের গভীর থেকে উঠে আসা অদ্ভুত অচেনা আঁচড়। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। সকালের নিস্তব্ধতায়, জানলার বাইরে থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক আর দূরের ট্রামের ঘণ্টাধ্বনি মিশে এক অচেনা আবেশ তৈরি করছিল, আর সেই আবেশেই অর্ণব নিজের ছবির দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। প্রথমে কিছু ছায়া, তারপর এক জটিল মুখাবয়বের রেখা ফুটে উঠল—তবু অর্ণব বুঝতে পারছিল না, ঠিক কী আঁকছে সে।
আঁচড়ের পর আঁচড়ে ছবিটি যখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল, অর্ণবের বুকের ভেতর হঠাৎ এক চাপা কাঁপুনি বয়ে গেল। সে আঁকছিল এক মেয়ের মুখ—অচেনা অথচ ভীষণ পরিচিত লাগছিল। মেয়েটির চোখ দুটি গভীর, যেন সেখান থেকে নীরব আর্তি ভেসে আসছে। ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক শূন্যতা, ভ্রু সামান্য কুঁচকে আছে, যেন কোনো অজানা বিপদের ভয়ে কেঁপে উঠছে। অর্ণব আঁকা থামিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ছবির দিকে। সে ঠিক মনে করতে পারল না এই মুখ কোথাও আগে দেখেছে কিনা, অথচ তার ভিতরটা ভরে উঠল এক অদ্ভুত অস্বস্তিতে। তুলি নামাতে চাইছিল, কিন্তু হাত যেন অবচেতন শক্তির টানে আবারও ক্যানভাসে চলে যাচ্ছিল। গাঢ় নীল রঙ দিয়ে সে মেয়েটির চোখে গভীর ছায়া টেনে দিল, আর সবুজের মিশ্রণে মুখের চারপাশে ঝাপসা আলো আঁকতে লাগল। শেষ আঁচড়টা পড়তেই অর্ণবের বুকের ভেতর যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ছবির মেয়েটির চোখের দৃষ্টি এতটাই জীবন্ত হয়ে উঠল যে, মনে হচ্ছিল সে অর্ণবকে নিরবে ডাকছে, সাহায্যের হাত বাড়াতে অনুরোধ করছে। অর্ণব তুলি ফেলে দিল, চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কয়েক পা পিছিয়ে এল, কিন্তু দৃষ্টি সরাতে পারল না।
ঘরের বাতাস তখন ভারী হয়ে উঠেছে। বাইরে তখন সূর্যের আলো আরও উজ্জ্বল, অথচ স্টুডিওর ভেতরটা অদ্ভুত এক ছায়ায় ঢাকা। অর্ণব বুক চেপে গভীর শ্বাস নিতে চেষ্টা করল, কিন্তু মনে হচ্ছিল ছবির মেয়েটির চোখ তাকে শ্বাস নিতে দিচ্ছে না। সে ফিসফিস করে বলল, “কে তুমি?” অথচ কোনো উত্তর নেই, শুধু ক্যানভাস থেকে নিঃশব্দ চোখদুটি তার দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ শরীরের ভেতর কাঁপুনি শুরু হলো, ঘাম জমল কপালে, আর আঙুলগুলো কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছিল, ক্যানভাসের ভেতর থেকে অচেনা মুখটা বেরিয়ে আসতে চাইছে। নিজের ভেতরের এই অদ্ভুত আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে অর্ণব জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, বাইরে তাকাল—রাস্তায় তখন লোকজনের ভিড় জমছে, দোকান খোলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, জীবন ছন্দময় হয়ে উঠছে। অথচ তার স্টুডিওর চার দেয়ালের ভেতর সময় যেন থমকে গেছে, আটকে গেছে সেই আঁকা মুখের ভেতর। আবার ক্যানভাসের দিকে ফিরে তাকাতেই সে অনুভব করল, মেয়েটির চোখের গভীরতায় যেন সাহায্যের আবেদন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—যেন সে বাঁচতে চাইছে, মুক্তি চাইছে। অর্ণব কাঁপতে কাঁপতে বুঝতে পারল, এই ছবিটা কেবল আঁকা নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন এক সত্য, যা সে নিজেও জানে না। এবং সেদিনের আঁচড়েই শুরু হলো তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অধ্যায়।
অধ্যায় ২ –
পরদিন সকালে অর্ণবের দিন শুরু হয় এক অদ্ভুত অস্থিরতায়। রাতের ঘুম তার চোখে আসেনি—বারবার মনে পড়ছিল ক্যানভাসে ফুটে ওঠা সেই অচেনা মুখ। চোখ দুটি যেন ঘুমের ভেতরেও তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সকালের আলোয় জানলা দিয়ে ঢুকে পড়া সূর্যের তেজস্বী আভা সত্ত্বেও ঘরে তার অস্বস্তি কাটছিল না। অর্ণব সাধারণত দিনের শুরুতে এক কাপ কালো কফি বানায়, কিছু সিগারেট টেনে মাথাকে হালকা করে নেয়, তারপরই কাজে বসে যায়। কিন্তু আজ তার হাত-পা যেন জমে গিয়েছিল। হঠাৎই সে লক্ষ্য করল, দরজার ফাঁক দিয়ে ভাঁজ করা একটি পত্রিকা ভেতরে গড়িয়ে পড়েছে। সে এক ঝটকায় কাগজটা তুলে নিয়ে খুলল—প্রথম পাতাতেই শিরোনাম বড় অক্ষরে চোখে পড়ল: “কলেজছাত্রী ইরা ঘোষ নিখোঁজ—দুই দিন ধরে খোঁজ নেই।” নিচে মেয়েটির ছবি ছাপা হয়েছে। অর্ণবের বুক ধক করে উঠল। তার চোখ আটকে গেল সেই ছবির ওপর, আর কপালে ঠান্ডা ঘাম জমল। ছবিতে যে মেয়ের মুখ দেখানো হয়েছে, সেটি হুবহু মিলে যাচ্ছে তার আঁকা ক্যানভাসের মেয়ের সঙ্গে। চোখের দৃষ্টি, মুখের ভাঁজ, এমনকি সামান্য চুলের ঝরে পড়া ঢঙ—সবকিছু যেন ছবির সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে।
অর্ণব হতভম্ব হয়ে চেয়ারের উপর বসে পড়ল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন তার বুকের ভেতরে মুষ্টিবদ্ধ আঙুল দিয়ে চাপ দিচ্ছে। সে বারবার কাগজের ছবি আর নিজের আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে যাচ্ছিল, আর প্রতিবারই আতঙ্ক আরও বাড়ছিল। তার মনে হলো, হয়তো কোনো কাকতালীয় ব্যাপার। অনেক সময় শিল্পীরা অবচেতন মনে এমন মুখ আঁকে যা বাস্তবে কারও সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কিন্তু এতটা মিল কি কখনও সম্ভব? সে ক্যানভাস তুলে এনে আবারও মিলিয়ে দেখল। সংবাদপত্রের ছবিতে ইরা ঘোষের চোখে যেন অজানা ভয় আর আতঙ্কের ছাপ, আর তার আঁকা ছবিতেও একই আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। মনে হচ্ছিল, ছবির মেয়েটি যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে—কোনো গোপন তথ্য, কোনো লুকোনো ব্যথা, কিংবা সাহায্যের আর্তি। অর্ণবের মাথার ভেতর যেন একসাথে হাজারো প্রশ্ন বেজে উঠল: সে কি আগে কোথাও ইরাকে দেখেছে? কেন সে মেয়েটির মুখ আঁকল, অথচ মনে করতে পারছে না? নাকি এ তার অবচেতনের কোনো প্রতারণা? আর যদি প্রতারণা না হয়, তবে কি তার আঁকার মধ্যে লুকিয়ে আছে সত্যিকারের কোনো রহস্য, যা সে নিজেই বুঝতে পারছে না?
অর্ণব ভয়ে ও দ্বিধায় কাগজটা ভাঁজ করে একপাশে রেখে দিল, কিন্তু মন থেকে কিছুতেই সরাতে পারল না। তার মনে হলো, এই খবরটা হয়তো তাকে নিয়েই লেখা, যদিও তার নাম সেখানে নেই। বাইরে পাখির ডাক আর গাড়ির হর্ন শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু তার কাছে সবকিছু নিঃশব্দ, ঘন কুয়াশার মতো মনে হচ্ছিল। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ভেসে এল প্রতিবেশীর কণ্ঠস্বর—“ইরা ঘোষের খবরটা পড়েছিস? মেয়েটা তো আমাদেরই পাড়ার, আশেপাশের সবাই আতঙ্কে।” অর্ণব চমকে উঠল। অর্থাৎ যে মুখ সে আঁকেছে, সেই মেয়েটি শুধু নিখোঁজই নয়, তার আশপাশের মানুষও তাকে চিনে! সে নিজের অজান্তে এক বিপজ্জনক ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। বুকের ভেতর ধকধক করতে লাগল, আঙুল কাঁপতে লাগল। তার মনে হচ্ছিল, যদি পুলিশ জানতে পারে সে মেয়েটির মুখ আগেই এঁকেছে, তবে কি তারা তাকে সন্দেহ করবে? তার নির্জন, নিভৃত জীবন কি হঠাৎ করে পুলিশের প্রশ্নে ভরে যাবে? আর সত্যিই যদি তার আঁকার মধ্যে কোনো ইঙ্গিত লুকানো থাকে, তবে কি সে নিজেই সেই রহস্যের সূত্র ধরে ফেলেছে? অর্ণব বুঝতে পারছিল না, সে ভুক্তভোগী না সাক্ষী, না কি অপরাধের সঙ্গে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে পড়া একজন। তার চোখ আবার ক্যানভাসের দিকে চলে গেল, আর সেখান থেকে ভেসে এলো সেই একই নীরব দৃষ্টি—যেন তাকে বলছে, “তুমি ছাড়া আর কেউ আমাকে খুঁজে পাবে না।” এই ভাবনার ভারে অর্ণবের শরীর অবশ হয়ে এলো, কিন্তু একই সঙ্গে মনে জন্ম নিল এক ভয়ঙ্কর কৌতূহল, যা তাকে সত্যের মুখোমুখি না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না।
অধ্যায় ৩ –
শহরের ভেতর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নতুন নয়, কিন্তু ইরা ঘোষের কেসটা যেন ভিন্ন ধরনের আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। কারণ ইরা কেবল সাধারণ ছাত্রী নয়, বরং আর্টস কলেজের মেধাবী ছাত্রী হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যমে যথেষ্ট সাড়া ফেলে, আর পরিবারের কান্না-মাখা আবেদন মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে দায়িত্ব এসে পড়ে ইন্সপেক্টর রূপা মুখার্জির কাঁধে। রূপা শহরের ক্রাইম ব্রাঞ্চে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন, ঠাণ্ডা মাথায় জটিলতম কেসের সমাধান করার জন্য তিনি পরিচিত। তার চোখ তীক্ষ্ণ, মনের দৃষ্টি সবসময় সন্দেহপ্রবণ, আর আবেগের জায়গায় তার কাছে বেশি মূল্যবান সত্য ও প্রমাণ। কেস হাতে পাওয়ার পর প্রথম দিনই তিনি ইরার বাড়িতে যান, পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন, কলেজে খোঁজখবর নেন, এমনকি মেয়েটির ফোন রেকর্ডও সংগ্রহের ব্যবস্থা করেন। সবকিছু যেন নিছক তদন্তের অংশই ছিল, কিন্তু তারপর ঘটনাপ্রবাহ হঠাৎ বাঁক নেয়।
ইরার নিখোঁজ হওয়ার খবর ছাপা হওয়ার দিন দু’দিনের মাথায় এক স্থানীয় আর্ট ক্রিটিকের হাত ধরে পুলিশের কাছে পৌঁছায় অদ্ভুত তথ্য। ক্রিটিক অভিষেক বসু পুলিশের কাছে জানান যে, একজন শিল্পীর আঁকা ছবিতে ইরার মুখ তিনি দেখেছেন। প্রথমে রূপা বিষয়টাকে হালকা করে নেন, ভেবেছিলেন হয়তো নিছক মিল বা গুজব। কিন্তু ছবিটি হাতে আসতেই তিনি স্তম্ভিত হয়ে যান। ক্যানভাসে জলরঙের আঁচড়ে আঁকা মুখের সঙ্গে সংবাদপত্রে ছাপা ইরার ছবির অবিকল মিল—চোখের দৃষ্টি থেকে শুরু করে ঠোঁটের বাঁক পর্যন্ত। রূপা ছবিটা বেশ কয়েকবার ঘুরিয়ে দেখলেন, আলো-ছায়া পরীক্ষা করলেন, এবং মনে মনে বললেন—“এটা কাকতালীয় নয়।” সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ছবির শিল্পী অর্ণব সেনের ঠিকানা সংগ্রহ করলেন। ফাইলগুলো ঘেঁটে বেরোল, অর্ণব কোনো পরিচিত অপরাধী নন, বরং একাকী জীবনযাপনকারী এক চিত্রশিল্পী। কিন্তু তার আঁকা ছবির সঙ্গে নিখোঁজ মেয়ের এমন হুবহু মিল তদন্তের পথকে ভিন্ন খাতে নিয়ে গেল।
রূপা যখন প্রথম অর্ণবের স্টুডিওতে পৌঁছান, তখন তিনি তার সেই স্বভাবসিদ্ধ শীতল ভঙ্গিতে প্রবেশ করেন। ঘরে রঙের গন্ধ, ছড়ানো তুলি, আর চারদিকে ঝোলানো ছবি—এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করেছিল। অর্ণব তখন চুপচাপ এক কোণে বসে ছিল, চোখের নিচে কালচে দাগ, মুখে অস্থিরতার ছাপ। রূপা তাকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন—“এই মেয়েটিকে আপনি চেনেন?” তিনি কাগজ থেকে ইরার ছবি এগিয়ে দিলেন, তারপর সেই ছবির পাশেই রাখলেন অর্ণবের আঁকা ক্যানভাস। দুই ছবির মিল অস্বীকার করার উপায় ছিল না। অর্ণব কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলল, “আমি ওকে কোনোদিন দেখিনি… আমি শুধু আঁকছিলাম।” কিন্তু রূপা সন্দেহে ভরপুর চোখে তাকিয়ে রইলেন—“যে মুখ আপনি কখনো দেখেননি, সেটা কীভাবে এত নিখুঁতভাবে আঁকলেন?” তার কণ্ঠে অবিশ্বাস স্পষ্ট। রূপার মনে হচ্ছিল, অর্ণব হয়তো মিথ্যে বলছে, হয়তো ইরাকে সে আগে থেকেই চিনত, এমনকি মেয়েটির নিখোঁজ হওয়ার সঙ্গে তার কোনো গোপন সম্পর্কও থাকতে পারে। অর্ণবের কাঁপা আঙুল, দৃষ্টি এড়ানোর চেষ্টা—সবকিছুই তাকে আরও সন্দেহজনক করে তুলছিল। রূপা সিদ্ধান্ত নিলেন, যতক্ষণ না তিনি সত্যটা বের করছেন, ততক্ষণ অর্ণবকে ছাড়বেন না। এবং সেই মুহূর্ত থেকেই অর্ণবের নির্জন, শান্ত জীবন পুলিশের নজরে এক ভয়ঙ্কর তদন্তের ভেতরে প্রবেশ করল।
অধ্যায় ৪ –
অর্ণবকে থানায় আনা হলো এক শীতল বিকেলের সময়। ঘরের ভেতর আলো-ছায়ার মিশেল, দেয়ালে ঝুলছে কড়া সাদা টিউবলাইট, আর সিগারেটের ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। রূপা মুখার্জি টেবিলের একপাশে বসে আছেন, সামনের ফাইলে ইতিমধ্যেই ইরার ছবি, অর্ণবের আঁকা ক্যানভাসের কপি এবং কিছু প্রাথমিক তথ্য সাজানো রয়েছে। পাশে সুব্রত দত্ত, চুপচাপ কিন্তু সতর্ক দৃষ্টিতে অর্ণবকে লক্ষ্য করছে। অর্ণবের মুখ ফ্যাকাশে, চোখের তলায় ক্লান্তির রেখা গভীর হয়ে উঠেছে। তার মনে হচ্ছে, সে যেন এমন এক ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে যেখান থেকে বেরোনোর উপায় নেই। রূপা প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন—“আপনি ইরাকে চিনতেন?” অর্ণব কেঁপে ওঠা গলায় বলল, “না… আমি তাকে কোনোদিন দেখিনি।” রূপার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হলো। “তাহলে কীভাবে তার মুখ আপনি আঁকলেন? এতটা নিখুঁত মিল কি কেবল কাকতালীয়?” অর্ণব স্তব্ধ হয়ে গেল, ঠোঁট শুকিয়ে এলো। সে জবাব দিতে পারছিল না, অথচ জানত কিছু না বললেও সন্দেহ আরও বাড়বে। অবশেষে বলল, “আমি জানি না। মাঝে মাঝে আমার মাথায় এমন কিছু মুখ ভেসে ওঠে, যাদের আমি চিনিই না। আমি শুধু আঁকি… যেন কেউ আমাকে বাধ্য করছে।”
সুব্রত তখন একটু ঝুঁকে এসে বলল, “আপনি বলছেন, আপনি অচেনা মুখ দেখেন? সেটা কীভাবে? স্বপ্নে?” অর্ণব চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে উত্তর দিল, “হ্যাঁ, স্বপ্নে… কখনো ঘুমের মধ্যে, কখনো জেগে থেকেও। যেন হঠাৎ ক্যানভাসে তুলি চালাতে চালাতে সেই মুখ ফুটে ওঠে। আমি চাইলেও সেটা আটকাতে পারি না।” রূপা টেবিলে হাত চাপড়ে বললেন, “এই ব্যাখ্যা কোনো সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়, মিস্টার সেন। আপনি হয়তো ওকে আগে থেকেই চিনতেন, হয়তো তার সঙ্গে আপনার কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল।” তার গলায় চাপা অভিযোগ স্পষ্ট। অর্ণব হতাশ দৃষ্টিতে মাথা নাড়ল, “না ম্যাডাম, আমি সত্যিই ওকে কখনো দেখিনি। আমি শুধু ছবিতে দেখেছি, আঁকার সময় যেন মুখটা আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।” রূপার কপাল ভাঁজ পড়ল। তিনি জানতেন, অপরাধীরা প্রায়ই গল্প বানিয়ে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করতে চায়। কিন্তু অর্ণবের কথার ভঙ্গিতে এক ধরনের অসহায় সততা আছে, যা তাকে দ্বিধায় ফেলল। তবু তিনি সহজে বিশ্বাস করতে পারলেন না।
প্রশ্নোত্তর চলতেই থাকল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। কখনো রূপা কড়া গলায় হুমকি দিলেন, কখনো সুব্রত মৃদু স্বরে তথ্য টেনে আনতে চাইলেন। তারা জানতে চাইলেন অর্ণব কি আগে ইরার কলেজে গিয়েছিল, কোনো প্রদর্শনীতে মেয়েটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কিনা। অর্ণব প্রতিবারই একই উত্তর দিল—না। তার একমাত্র পরিচয় ক্যানভাস আর রঙ। কিন্তু যতই সে নিজের নির্দোষত্ব বোঝাতে চেষ্টা করল, ততই তার বক্তব্য আরও অবিশ্বাস্য শোনাল। অবশেষে রূপা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিলেন। তিনি ভেতরে ভেতরে স্বীকার করলেন, ঘটনাটা নিছক অপরাধের যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন। একজন মানুষ যদি বারবার স্বপ্নে অচেনা মুখ দেখে এবং সেটি পরে বাস্তবে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির সঙ্গে মিলে যায়, তবে এর মানে কি? এটা কি কেবল কাকতালীয়, নাকি সত্যিই অর্ণব কোনো অদ্ভুত শক্তির প্রভাবে আছেন? সেই প্রশ্নের উত্তর রূপার কাছে ছিল না। কিন্তু তিনি জানতেন, এই রহস্য ভেদ না হওয়া পর্যন্ত অর্ণবকে চোখের আড়াল করা যাবে না। তার চোখে তখন একসঙ্গে সন্দেহ, কৌতূহল আর অজানা ভয়ের ছায়া ফুটে উঠল—এক ঝড়ের মতো, যা শুধু অর্ণবকেই নয়, রূপাকেও টেনে নিয়ে যাবে অজানা অন্ধকারে।
অধ্যায় ৫ –
অর্ণবের ঘরজুড়ে গাঢ় নীরবতা নেমে এসেছে। জানালার বাইরে বৃষ্টি পড়ছে টুপটাপ শব্দে, আর তার সামনে অদ্ভুতভাবে অচেনা ক্যানভাসে সেই মেয়ে—ইরা ঘোষের মুখ তাকিয়ে আছে। রাতভর অনিদ্রা কাটানোর পর ভোরবেলা রান্নাঘরে ঢুকতেই অঞ্জনা সেন, অর্ণবের মা, তাকে দেখে বললেন, “তোর আঁচড়ে ঈশ্বরের কথা লুকানো আছে।” তাঁর চোখে ছিল একরকম আতঙ্ক মিশ্রিত বিশ্বাস। অঞ্জনা দীর্ঘদিন ধরে ছেলের কাজ দেখেছেন, কিন্তু এই ঘটনার পর মনে হচ্ছে ছেলের শিল্পকর্ম কোনো সাধারণ আঁকা নয়—কোনো অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিত। অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, “মা, আমি জানি না কেন এই মুখগুলো আসে। আমি তো শুধু আঁকতে চাই।” কিন্তু মনের ভেতর কেমন অস্বস্তি জমতে থাকল। যখন সে নিজের চোখের সামনে সংবাদপত্রে নিখোঁজ মেয়ের ছবি দেখে তার আঁকা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে ফেলল, তখন থেকে ভেতরে ভেতরে বুঝতে পারল—এই শিল্প শুধু রঙের খেলা নয়, এর মধ্যে আরও গভীর কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে।
এমন সময় ডক্টর সমরেশ পাল, খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী, এসে হাজির হলেন। রূপার পরামর্শেই তাঁকে ডাকা হয়েছে। সমরেশ শান্ত গলায় অর্ণবকে প্রশ্ন করলেন—“তুমি কি কখনো মেয়েটিকে চিনতে?” অর্ণব মাথা নাড়ল। তারপর তিনি নরমভাবে বললেন, “কখনও কখনও অবচেতন মন এমন কিছু ছবি জমা করে রাখে, যা আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। তুমি হয়তো এমন কোনো সূত্র, এমন কোনো দৃশ্য এক ঝলক কোথাও দেখেছ, যা তোমার মনে লেগে আছে, আর তা-ই ক্যানভাসে ফুটে উঠছে।” তিনি কাগজে কয়েকটি নকশা আঁকিয়ে পরীক্ষা করতে চাইলেন, অর্ণবের প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য। কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় হলো, প্রতিটি আঁকায় অর্ণব এমন সব ছায়া ও প্রতীক টেনে আনল, যা নিখোঁজ কেসের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। সমরেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন, তারপর চুপচাপ বললেন, “এটা কেবল শিল্প নয়। তুমি হয়তো অবচেতনভাবে ভবিষ্যৎ বা অজানা ঘটনার কিছু টুকরো ধরে ফেলছ।” তাঁর কথায় উপস্থিত সকলে চুপ হয়ে যায়।
অর্ণবের ভেতরে দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠল। একদিকে সে চিত্রশিল্পী, রঙ আর রেখার ভেতরে ডুবে থাকা একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। অন্যদিকে, হঠাৎ যেন সে হয়ে উঠছে এক অদ্ভুত ভবিষ্যৎদ্রষ্টা, যার কাজের ভেতরে লুকিয়ে আছে জীবনের ভয়ংকর ইঙ্গিত। মা তাকে আশ্বস্ত করলেন, “তোর হাতে ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে, ভয় পাবি না।” কিন্তু অর্ণব জানত—এটা আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ, বলা মুশকিল। সমরেশ তাকে বুঝিয়ে বললেন, “ভয় পেও না। তুমি যা আঁকছো, সেটা শুধু কাকতালীয় নয়, আবার হয়তো পুরোপুরি অতিপ্রাকৃতও নয়। এটা মানবমনের সীমা ছুঁয়ে যাওয়া এক রহস্য।” কিন্তু তবুও রূপার চোখে প্রশ্ন ঘুরছিল—যদি অর্ণবের ভেতরে কোনো গোপন সত্য লুকানো থাকে? যদি সে নিজেই না জানে, কোথা থেকে এই মুখ আসে? সেই রাতে আবারও ক্যানভাসের সামনে বসে অর্ণব দেখল, তার তুলি নিজের ইচ্ছেতে চলতে শুরু করেছে, আর সেখানে ভেসে উঠছে অচেনা গলিপথ, অন্ধকার, আর এক মেয়ের চাহনি—যেন আরেকটি আসন্ন ঘটনার পূর্বাভাস।
অধ্যায় ৬ –
অর্ণবের আঁকা ছবি নিয়ে পুলিশের সন্দেহ যেমন প্রতিদিন ঘনীভূত হচ্ছিল, তেমনই ক্রমশ তার শিল্পকর্মগুলোও এক অদ্ভুত রহস্যের আভায় ঘিরে উঠছিল। সেই সন্ধ্যায় সুব্রত দত্ত যখন অর্ণবের স্টুডিওতে গিয়ে পুরনো ক্যানভাসগুলো উল্টেপাল্টে দেখছিল, তখন তার চোখ থেমে গেল কয়েকটি ছবির ওপর। ক্যানভাসগুলোতে অদ্ভুতভাবে ফুটে উঠেছিল এমন কিছু মুখ, যেগুলো স্পষ্টতই কোনো না কোনো মানুষের বাস্তব রূপ। কিন্তু চেনা মানুষের মুখ নয়, বরং একেবারে অচেনা অথচ জীবন্ত অভিব্যক্তি ভরা চেহারা। সুব্রত কাগজ-কলম বের করে দ্রুত নোট নিতে শুরু করল, প্রতিটি ছবির মুখের বর্ণনা লিখে রাখল। তার মনে হচ্ছিল—এগুলো নিছক শিল্পকর্ম নয়, এর ভেতরে এমন কোনো দাগ বা সূত্র লুকিয়ে আছে, যা পুলিশের অমীমাংসিত কেসগুলোর সঙ্গে মিলে যেতে পারে। কৌতূহলী হয়ে সে অর্ণবকে জিজ্ঞেস করল—“তুমি এসব মুখ কোথায় দেখেছ? এরা কারা?” অর্ণব বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বলল—“আমি কাউকে চিনি না সুব্রতবাবু। এরা শুধু আসে আমার আঁচড়ে… যেন অন্ধকারের ভেতর থেকে কেউ আমাকে দেখছে, আর আমি অবচেতনেই আঁকছি।” অর্ণবের কণ্ঠে স্পষ্ট আতঙ্ক ধরা পড়ল, যেন সে নিজেও নিজের আঁচড়কে ভয় পাচ্ছে।
সেই রাতেই সুব্রত সব নোট নিয়ে থানায় ফিরে গিয়ে পুরনো ফাইল ঘাঁটতে শুরু করল। কলকাতার হারিয়ে যাওয়া মানুষদের অমীমাংসিত কেসগুলোর ছবি, রিপোর্ট, এবং বর্ণনা মিলিয়ে দেখছিল সে। আশ্চর্য হয়ে সে লক্ষ্য করল—অর্ণবের আঁকা মুখগুলোর সঙ্গে অন্তত চারটি কেসের নিখোঁজ মানুষ হুবহু মিলে যাচ্ছে। কোনো ছাত্রীর শূন্যদৃষ্টি, কোনো বৃদ্ধের কুঁচকানো মুখ, কোনো চাকরিজীবী মহিলার স্নিগ্ধ হাসি—সবই মিলে যাচ্ছে পুলিশ ফাইলের ছবির সঙ্গে। সুব্রতের শরীর কেঁপে উঠল। এতগুলো আলাদা কেসের সঙ্গে এক অচেনা শিল্পীর ছবি কীভাবে এত নিখুঁতভাবে মিলে যেতে পারে? সে একে কাকতালীয় ভাবতে পারল না। তৎক্ষণাৎ রূপা মুখার্জিকে খবর দিল। রূপা এসে ছবিগুলো একে একে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। অর্ণব হয়তো মনের অসুখে ভুগছে, হয়তো সে সত্যিই কিছু জানে না—কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছবিগুলো হারানো মুখের নিখুঁত প্রতিরূপ। রূপার চোখে ভেসে উঠল সন্দেহ ও কৌতূহল—এটা কি নিছক কোনো শিল্পীর কল্পনা, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে অদৃশ্য কোনো শক্তির ছাপ?
অর্ণবের আঁকাগুলো পুলিশের হাতে আসতেই কেসের মোড় ঘুরে গেল। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ল—এক তরুণ চিত্রশিল্পীর ক্যানভাসে ফুটে উঠছে হারানো মানুষদের মুখ। শহরের সাধারণ মানুষের চোখে অর্ণব হয়ে উঠল এক রহস্যময় চরিত্র। কেউ তাকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলল, কেউ বা কালো যাদুর সঙ্গে যুক্ত সন্দেহ করল। অর্ণব নিজে গভীর বিভ্রান্তিতে ডুবে গেল। সে ভাবতে লাগল—সে কি অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো অশুভ শক্তির খেলার পুতুল হয়ে যাচ্ছে? নাকি সত্যিই ঈশ্বর তাকে অদ্ভুত এক ক্ষমতা দিয়েছেন, যা মানুষের লুকানো কাহিনি আঁচড়ে আনে? অন্যদিকে, পুলিশি তদন্ত তীব্রতর হলো। প্রতিটি ক্যানভাস এখন একেকটি প্রমাণ, একেকটি সূত্র। কিন্তু সেই সূত্র কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ জানে না। সুব্রতর মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ক্রমশ দানা বাঁধতে লাগল—যদি অর্ণবের আঁকা মুখগুলো শুধু হারানো মানুষ নয়, ভবিষ্যতের হারানোরও ইঙ্গিত হয়? তবে কি আরও কেউ হারিয়ে যেতে চলেছে? রূপা ও সুব্রত বুঝতে পারছিল, এই রহস্যের গভীরতা কেবল শুরু হয়েছে—এখনো অনেক অন্ধকার পথ পাড়ি দিতে হবে।
অধ্যায় ৭ –
অর্ণব সেনের জীবনে যেন একের পর এক অজানা কুয়াশা ঘনিয়ে আসছিল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল না, তার ক্যানভাসে যে মুখগুলো ভেসে ওঠে, সেগুলো কেবল কল্পনা নাকি অদ্ভুত কোনো অদৃশ্য শক্তির হাতছানি। ইরা ঘোষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় পুলিশ এখনো কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি। কিন্তু এক অচেনা সূত্র হঠাৎ অর্ণবকে নতুন এক অন্ধকার পথে টেনে নিয়ে গেল। ইরার কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলার সময় অর্ণব জানতে পারল, মেয়েটি নিয়মিত এক আর্ট ক্রিটিকের সঙ্গে গোপনে দেখা করত। নাম—অভিষেক বসু। নামটা শোনার পর অর্ণবের বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন একটা অজানা শীতলতা নেমে এলো। শিল্প জগতে অভিষেক বসু খুব নামকরা নন, তবে রহস্যময়ভাবে বেশ কিছু সমালোচনার জন্য পরিচিত। লোকটা সাধারণত আলোচনার বাইরে থাকলেও, তার চারপাশে একধরনের অস্বাভাবিক অন্ধকার ছায়া ঘুরপাক খায় বলে গুঞ্জন আছে। অর্ণব যখন প্রথমে এই তথ্য জানতে পারে, তখন সে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে ইরা তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যখন কিছু নির্দিষ্ট সময় ও জায়গার উল্লেখ আসে, তখন ধীরে ধীরে সন্দেহ ভর করে। সে ভাবে—যদি ইরার অন্তর্ধানের রহস্য এই অদ্ভুত লোকটার ভেতরেই লুকিয়ে থাকে?
অভিষেক বসুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎটা ঘটল এক স্যাঁতসেঁতে সন্ধ্যায়। কলকাতার এক পুরনো কফি হাউজে, যেখানে দেওয়ালে ধূসর রঙের দাগ, আর বাতাসে ভাসছে ধোঁয়া আর পুরোনো দিনের আলাপের গন্ধ। অভিষেক টেবিলের কোণে বসে ছিল, হাতে এক কাপ কফি, চোখে রহস্যময় দৃষ্টি। অর্ণব নিজেকে সামলে নিয়ে তার সামনে বসতেই অভিষেক ধীরে ধীরে হাসল, কিন্তু সেই হাসির ভেতর ছিল অস্বস্তির শীতলতা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অভিষেক নিজেই বলল, “তুমি অর্ণব সেন, তাই না? তোমার ছবিগুলো আমি দেখেছি… আর বিশ্বাস করো, ওগুলো সাধারণ আঁচড় নয়। তুমি জানো না, কিন্তু তোমার ক্যানভাসে এমন সত্য ফুটে ওঠে যা মানুষকে কাঁপিয়ে দিতে পারে।” অর্ণব বিস্মিত হয়ে তাকাল। অভিষেক থেমে আবার বলল, “ইরা আমাকে বলেছিল, তোমার আঁকা দেখে তার বুকের ভেতর অজানা ভয়ের ঢেউ ওঠে। সে বলেছিল, তোমার ছবিতে সে নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে।” অর্ণবের শরীর হঠাৎ ঠান্ডা হয়ে গেল। তার মনে হলো, যেন কারও অদৃশ্য হাত তার গলা চেপে ধরেছে। সে তো ইরাকে কখনো চিনতই না, তাহলে কিভাবে তার ছবি মেয়েটির জীবনের সঙ্গে এমনভাবে মিলে গেল?
কথোপকথনের শেষে অভিষেক বসু অর্ণবকে আরও বিভ্রান্ত করে দিল। সে বলল, “শিল্প শুধু শিল্প নয়। কখনো কখনো ক্যানভাস হয়ে ওঠে আয়না, যেখানে মানুষের অদেখা সত্য প্রতিফলিত হয়। তুমি হয়তো বুঝতে পারছ না, কিন্তু তোমার ভেতরে একটা শক্তি আছে—যেটা তোমাকে আলাদা করে দিয়েছে। আর সেই শক্তিই এখন ইরার অন্তর্ধানের রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।” অভিষেকের চোখে তখন এক অদ্ভুত ঝলক দেখা যাচ্ছিল, যা অর্ণবের বুক কাঁপিয়ে তুলছিল। সেই চোখে যেন কেবল সমালোচকের দৃষ্টি ছিল না—ছিল ষড়যন্ত্র, ছিল এমন এক অন্ধকারের ছাপ যা মানুষকে গ্রাস করতে পারে। অর্ণব বেরিয়ে আসার পর মনে হলো, সে যেন গভীর জঙ্গলের ভেতর হেঁটে এসেছে, যেখানে চারদিক অচেনা শব্দে ভরা। তার মনে বারবার বাজতে থাকল অভিষেকের সেই কথা—“তোমার আঁচড়ের ভেতরে ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে।” অথচ সেই আঁচড়ই কি তাকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিয়ে যাবে? ইরার রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে অর্ণব যেন আরও গভীর এক অন্ধকারের গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ল, যেখান থেকে বেরোনোর রাস্তা হয়তো আর সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
অধ্যায় ৮ –
রূপা মুখার্জি নিজের অফিসের টেবিলে বসে ইরার কেসের ফাইলগুলো একের পর এক উল্টে-পাল্টে দেখতে লাগলেন। প্রতিটি পাতার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে কোনো না কোনো সূত্র, কিন্তু কোনোটা স্পষ্ট নয়, সবকিছু যেন অস্পষ্ট কুয়াশায় ঢাকা। অর্ণবের আঁকা ছবিগুলো তিনি আবারও গভীরভাবে দেখলেন। তার প্রশিক্ষিত চোখ বলছে—এই ছবিগুলো নিছক শিল্পীর কল্পনা নয়, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু যা অর্ণব নিজেও পুরোপুরি বুঝতে পারছে না। হয়তো কোনো অবচেতনের ছবি, হয়তো বাস্তব কোনো ঘটনার ছায়া। রূপা ভাবলেন—”এতগুলো হারিয়ে যাওয়া মানুষ, আর তাদের মুখ অর্ণবের ক্যানভাসে ফুটে ওঠা—এটা নিছক কাকতালীয় হতে পারে না।” সন্দেহ ও বিস্ময়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—অর্ণবকে আপাতত মুক্ত রাখা হলেও পুলিশি নজরদারির বাইরে রাখা যাবে না। তবে একইসঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন, শুধুমাত্র অর্ণবকে সন্দেহ করেই আসল রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব নয়; ইরার ব্যক্তিগত জীবনের ভেতরে ঢুকতে হবে।
তদন্ত এগোতে শুরু করল অন্য পথে। রূপা ইরার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করলেন। একেকজন একেক রকম কথা বলছে। কেউ বলছে ইরা খুব হাসিখুশি, কারও মতে সে চুপচাপ, অন্তর্মুখী। তবে একটা বিষয়ে মিল পাওয়া গেল—শেষ কয়েক মাসে ইরা বেশ অস্থির ছিল। তার ফোনে আসত অচেনা কিছু কল, যেগুলো সে লুকিয়ে কথা বলত। অনেক সময় কল কেটে দিত হঠাৎ। তার হোস্টেলের ঘর থেকে উদ্ধার হওয়া কিছু পুরোনো খামও পুলিশের হাতে এলো। সেখানে অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা কিছু চিঠি—সংক্ষিপ্ত বাক্য, অদ্ভুত কিছু প্রতীক, আর একাধিকবার একটি সতর্কবার্তা: “তুমি পালাতে পারবে না।” এই চিঠিগুলো রূপার মনে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করল। কারা এই চিঠি লিখেছিল? আর ইরার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী? আরও আশ্চর্যের বিষয়, ইরার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু দাবি করল, ইরা প্রায়ই বলত কেউ তাকে অনুসরণ করছে, আর অর্ণবের আঁকা ছবিগুলো দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। সেই আতঙ্ক কি সত্যিই তাকে কোথাও ঠেলে দিয়েছিল? নাকি সে এমন কিছু জানত যা তাকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল?
এই প্রশ্নগুলো মাথায় নিয়ে রূপা রাত গভীর পর্যন্ত নোট তৈরি করলেন। ঘর অন্ধকার হয়ে এলে বাইরের লাইটপোস্টের হলদে আলো এসে তার টেবিলে পড়ছিল। তিনি জানতেন এই কেস নিছক কোনো নিখোঁজের মামলা নয়। এখানে ছায়ার মতো এক অদৃশ্য খেলা চলছে। হয়তো কোনো গোপন সংঘ, হয়তো কোনো প্রভাবশালী মহল, আবার হয়তো অজানা কোনো ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব—সবই সম্ভব। কিন্তু সবচেয়ে বড় অদ্ভুত ব্যাপার অর্ণব। সে কি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে, নাকি অবচেতনে এমন কিছু আঁকছে যা অপরাধীদের মুখোশ ফাঁস করে দিচ্ছে? এই ভাবনা তাকে আরও বিভ্রান্ত করছিল। তবে একটা ব্যাপার তিনি স্পষ্ট বুঝলেন—ইরার জীবন ও অর্ণবের শিল্পকর্ম যেন একই সুতায় বাঁধা, আর সেই সুতোর জট ছাড়াতে গেলে হয়তো এমন কিছু সত্যি সামনে আসবে যা কারও কল্পনারও বাইরে। তিনি নিঃশব্দে নিজের মনে বললেন—“এই ছায়ার খেলা যত গভীরই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখাবেই।”
অধ্যায় ৯ –
অর্ণবের আঁকা ছবিগুলো একের পর এক টেবিলে সাজানো হলো, যেন এক বিস্ময়কর ধাঁধার খণ্ডচিত্র। ইন্সপেক্টর রূপা, সুব্রত দত্ত আর ডক্টর সমরেশ পাল একসঙ্গে বসে প্রতিটি আঁকায় চোখ বোলাতে লাগলেন। প্রথমদিকে ছবিগুলোতে শুধু অচেনা মুখ দেখা যেত, কিন্তু যখন ছবিগুলো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হলো, তখন ধীরে ধীরে খোলা পড়তে লাগল আরেকটি সত্য। মুখের চারপাশে আঁকা ছায়া, অস্পষ্ট রেখা, এবং অদ্ভুতভাবে এঁকে যাওয়া ভবনগুলোর খুঁটিনাটি মিলতে শুরু করল কলকাতার কিছু পুরনো গলির সঙ্গে। কোথাও অচেনা অলি, কোথাও বা সেতুর এক ঝলক, আবার কোথাও ভেঙে পড়া বাড়ির ভগ্নাংশ—সবকিছু একসঙ্গে মিলিয়ে একটি মানচিত্রের আকার নিচ্ছিল। অর্ণব প্রথমে নিজেই আঁতকে উঠল, কারণ সে কখনো জেনেশুনে এসব আঁকেনি। তার হাতের রেখাগুলো যেন নিজেরাই শহরের অন্ধকার কোণগুলো প্রকাশ করে দিয়েছে। এই আবিষ্কার রূপাকে আরও ভেতরে টেনে নিল কেসে—সে বুঝতে পারছিল, হয়তো হারিয়ে যাওয়া মানুষদের শেষ অবস্থান কোথায় ছিল, তার সূত্র লুকিয়ে আছে এই ছবিগুলোর মধ্যে। অর্ণব যখন ছবিগুলো একসঙ্গে রাখল, তখন তৈরি হলো এক অদ্ভুত কোলাজ, যেন শহরের ভেতরে গোপন এক মানচিত্র, যার প্রতিটি বিন্দু হয়তো একেকটা নিখোঁজ হওয়ার সাক্ষী।
রূপা সেই মানচিত্র হাতে নিয়ে যখন শহরের গলিপথের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শুরু করল, তখন বাস্তবতার সঙ্গে ছবির সংযোগ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ছবির মধ্যে একটি জায়গায় ধূসর দেয়াল আর নিচে আঁকা ছোট্ট একটি প্রতীক খুঁজে পেল সুব্রত—যা হুবহু মিলে যায় উত্তর কলকাতার এক পুরনো প্রাসাদের ভগ্নদ্বারের সঙ্গে। আরেকটি ছবিতে অর্ণবের আঁকা ছায়াঘেরা সেতু মিলে গেল হাওড়ার এক প্রান্তের অচেনা ঘাটের সঙ্গে। একে একে যত ছবি মিলিয়ে দেখা হচ্ছিল, ততই স্পষ্ট হচ্ছিল—এই মানচিত্র নিখোঁজ মানুষদের শেষ দেখা পাওয়া জায়গাগুলোর রূপরেখা। ডক্টর সমরেশ পাল বললেন, “অর্ণবের অবচেতন হয়তো এমন কিছু ধারণ করছে, যা তার নিজের চোখে দেখা হয়নি, কিন্তু অজান্তেই তার মস্তিষ্কে প্রবেশ করেছে। হয়তো কোনো অদ্ভুত সংবেদন বা অন্তর্দৃষ্টি থেকে এই তথ্য বেরিয়ে আসছে।” কিন্তু রূপার কাছে এটি শুধু মানসিক তত্ত্ব ছিল না—এটি ছিল সম্ভাব্য তদন্তের দিক। সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল প্রতিটি জায়গায় খোঁজ চালানো হবে। তবে এক নতুন প্রশ্নও মাথাচাড়া দিল—অর্ণবের হাত দিয়ে কীভাবে বেরিয়ে আসছে এই সূত্র? সে কি শুধু এক অদ্ভুত মাধ্যম, নাকি এর পেছনে আরও কোনো রহস্যময় শক্তি কাজ করছে?
তদন্ত এগোতে শুরু করতেই দেখা দিল আরও ভয়ানক দিক। মানচিত্রে চিহ্নিত জায়গাগুলোর মধ্যে কয়েকটি স্থানে ইতিমধ্যেই হারানো মানুষদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, অথচ পুলিশ এতদিন সেগুলিকে আলাদা আলাদা কেস হিসেবে দেখছিল। ছবির সূত্র একত্রিত করতেই বোঝা গেল—সব ঘটনাই আসলে একসঙ্গে বাঁধা। এই আবিষ্কার শুধু মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিল না, অর্ণবকে আরও বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলে দিল। যদি ছবির মাধ্যমে সত্যিই ভবিষ্যতের বা লুকোনো ঘটনার সূত্র ফাঁস হয়ে যায়, তবে খুনি বা যে চক্র এই নিখোঁজের জন্য দায়ী, তারা কি অর্ণবকে ছাড়বে? রূপা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল—অর্ণব এখন কেবল একজন শিল্পী নয়, এই রহস্যের এক কেন্দ্রবিন্দু। ছবির ভেতরের মানচিত্র পুলিশকে নতুন আলো দেখালেও, একইসঙ্গে অন্ধকারও গভীর হয়ে উঠল। কারণ, প্রতিটি ছবিতে শুধু হারানো মানুষের মুখই নয়, পেছনে যেন অপেক্ষা করছে মৃত্যুর ছায়া, যা অর্ণবকেও ঘিরে ধরছে অজান্তে। সেই মুহূর্তে রূপা অনুভব করল—এই কেস আর শুধু অপরাধ তদন্ত নয়, বরং এক ভয়ংকর খেলা, যেখানে অর্ণবের শিল্পই হয়তো একমাত্র চাবিকাঠি, আবার সেই চাবিকাঠিই তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।
অধ্যায় ১০ –
রূপা সারারাত অর্ণবের আঁকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখেছিল। প্রতিটি আঁচড়ে যেন লুকোনো কোনো গল্প, কোনো সংকেত। ছবির ভেতর থেকে পাওয়া গলিপথ আর পুরোনো বিল্ডিংয়ের সূত্র ধরে পুলিশ ইরার খোঁজ শুরু করে। দীর্ঘ সময় ধরে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার নেটওয়ার্কের জাল আস্তে আস্তে সামনে এসে যায়। রূপা বুঝতে পারে, এ শুধু সাধারণ নিখোঁজ ঘটনা নয়, বরং একটি ভয়ঙ্কর চক্রের অংশ, যারা মেয়েদের পাচার করছিল দেশের বাইরে। গোপন আস্তানা থেকে উদ্ধার হয় ইরা ঘোষ, আতঙ্কে কাঁপতে থাকা শরীরে তার চোখে তখনো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। অপরাধচক্রের কয়েকজনকে পুলিশ হাতে নাতে ধরে ফেলে, কেউ আবার অন্ধকারের আড়ালে পালিয়ে যায়। শহরের অলিগলির আঁধারে এতদিন ধরে চলতে থাকা এই ভয়ঙ্কর খেলাটির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে অর্ণবের আঁচড় হয়ে ওঠে অদ্ভুত এক আলোকবর্তিকা। তবু এই সাফল্যের মাঝেও রূপার মনের ভেতর তীব্র প্রশ্ন ঘুরপাক খায়—অর্ণব কীভাবে এসব জানত? কোনো অজানা শক্তি কি তাকে পরিচালনা করছে, নাকি অবচেতনে জমে থাকা কোনো অসাধারণ ক্ষমতা ফুটে উঠছে ক্যানভাসে?
কেস মিটে গেলেও ধোঁয়াশা থেকে যায়। সুব্রত দত্ত একদিকে খুশি অপরাধচক্র ভেঙে পড়েছে বলে, অন্যদিকে দ্বিধায় ভুগছে। পুলিশের কাছে এটি নিছক তদন্তের ফল হলেও, রূপা ভালোভাবেই জানে সত্যি তার থেকেও ভিন্ন কিছু। ইরার বয়ান থেকে স্পষ্ট হয়, সে বহুদিন ধরে অচেনা কিছু ফোনকল পাচ্ছিল, আর হঠাৎ করেই অর্ণবের আঁচড় যেন সেই আতঙ্ককে চিত্ররূপে ফুটিয়ে তুলছিল। রূপার চোখে ভেসে ওঠে অর্ণবের মুখ—ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, তবু যেন গভীরভাবে কিছু জানে যা মুখে প্রকাশ করতে পারে না। ডক্টর সমরেশ পালও বিস্মিত; তিনি বলেন, “এটা অবচেতন মনের এক অদ্ভুত ক্ষমতা, যা আমরা পুরোপুরি বোঝার মতো অবস্থায় নেই।” তবু তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না এই সত্য যে, অর্ণবের ছবিগুলো বারবার অপরাধের সঠিক দিক নির্দেশ করেছে। প্রশ্ন ওঠে—এ কি নিছক কাকতালীয়, নাকি কোনো অজানা শক্তির খেলা? রহস্য যেন শেষ হলেও আসলে আরো বড় কোনো গোলকধাঁধার দরজা খুলে যায়।
শেষ দৃশ্যে অর্ণব তার ঘরে বসে নতুন ক্যানভাসে রঙ মাখছে। আলো-আঁধারি ঘরের কোণে মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় তার চোখ স্থির, হাতে কাঁপা নেই, অথচ চারপাশে যেন অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এসেছে। ধীরে ধীরে ব্রাশের আঁচড়ে ফুটে ওঠে এক নতুন মুখ—অচেনা, অনির্দিষ্ট, তবু ভয়ংকরভাবে জীবন্ত। রূপা ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভেতর অস্বস্তি জমে ওঠে। এক মুহূর্তে মনে হয়, হয়তো আরেকটি ঘটনা ঘটতে চলেছে, আর অর্ণব তার আগাম ইঙ্গিত দিয়ে দিচ্ছে। ছবির মধ্যে আবার ভেসে ওঠে কিছু অস্পষ্ট রাস্তা, ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা একটি ভবনের আকার। রহস্য শেষ হয় না—বরং আরও গভীর অন্ধকারে ঢেকে যায়। রূপার মনে হয়, এই রহস্যের শেষ আঁচড় আসলে কখনো টানা যাবে না, কারণ প্রতিটি ক্যানভাস নতুন এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, আর প্রতিটি মুখ যেন অজানা ভবিষ্যতের ছায়া হয়ে দাঁড়ায়। পাঠকের মনে তখনো অনুরণিত হতে থাকে এক অদ্ভুত প্রশ্ন—অর্ণব কি কেবল একজন শিল্পী, নাকি ভাগ্যের আঁচড় তার হাতে অদৃশ্যভাবে পথ দেখায়?
***




