Bangla - ভূতের গল্প

জলমহলের ডাক

Spread the love

ঈশা দত্ত ট্রেনে দীর্ঘ যাত্রার পর যখন সুন্দরবনের ভেতরের ছোট্ট জনপদের ধুলোমাখা স্টেশনে নেমে এলো, তখন তার মনে হচ্ছিল যেন শৈশবের স্বপ্ন আর ভয় দুটো একসাথে হাত ধরে হাঁটছে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে স্টেশন থেকে বেরোনোর সময় চারপাশের গন্ধটা প্রথমেই তাকে আঘাত করল—আধভেজা কাদা, নোনা বাতাস, গাছের পাতা, আর নদীর জলে লবণাক্ততার মিশ্র গন্ধ। এ সবকিছুর ভেতরে সে যেন শুনতে পাচ্ছিল অজস্র গল্পের প্রতিধ্বনি, যেগুলো ছোটবেলায় শোনানো হয়েছিল তাকে দাদার ঠোঁট থেকে। সেই জলমহল—এক ভগ্নপ্রায় জমিদারবাড়ি, নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা অর্ধেক ডুবে যাওয়া প্রাসাদ—যেটাকে নিয়ে লোকজন বলে অসংখ্য অদ্ভুত কথা। ঈশার মনে পড়ে গেল শৈশবের সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে থাকা, হাতে খাতা-পেনসিল, আর দাদা মৃদু আলোয় বলতে শুরু করেছে—“জোয়ারের রাতে মহলের দোতলায় আলো জ্বলে ওঠে, আর যে কৌতূহলী হয়ে কাছে যায়, সে আর কোনোদিন ফেরে না।” ছোটবেলার ভয়ে চোখ কুঁচকে শোনার সেই মুহূর্তই আসলে আজ তাকে এখানে টেনে এনেছে। এখন সে গবেষক, ফটোগ্রাফার, এবং লোককথার অনুসন্ধানী। কিন্তু সত্যি বলতে কি, মনের গভীরে এখনও কাঁপুনি থাকে—যদি এইসব শুধু কল্পনা না হয়ে বাস্তব হয়ে ওঠে?

স্টেশন থেকে বেরিয়ে গ্রামের ছোট্ট বাজারে আসতেই সেই অস্বস্তির অনুভূতি আরও গাঢ় হয়ে উঠল। বাজার বলতে টিনের চালের নিচে কিছু দোকান, মাটির উপর ছড়িয়ে থাকা শাকসবজি, শুকনো মাছ, আর ঘন ধোঁয়ায় মোড়ানো চায়ের দোকান। লোকজন তাকে কৌতূহল নিয়ে দেখছে, যেন শহরের কেউ হঠাৎ অচেনা এক জগতে এসে ঢুকেছে। ঈশা চায়ের দোকানে গিয়ে বসতেই দোকানদার হেসে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা, বাইরে থেকে এসেছেন? কী কাজ এখানে?” ঈশা হাসিমুখে বলল, “আমি গবেষণা করতে এসেছি—লোককথা আর প্রকৃতি নিয়ে।” কথাটা শুনতেই পাশের কয়েকজন চুপ হয়ে গেল, আরেকজন ফিসফিস করে বলে উঠল, “ও বুঝি জলমহলের কথা শুনে এসেছে!” হঠাৎই চারদিকে নীরবতা নেমে এলো, যেন সবাই একসাথে ভয়ের ছায়া গিলে ফেলল। দোকানদার গম্ভীর গলায় বলল, “ওখানে যাওয়া ঠিক না। জোয়ারের রাতে আলো জ্বলে ওঠে দোতলায়। কত মানুষ গেছে, আর ফেরেনি। আমরা জানি না আলোটা কার, কিন্তু আমরা জানি—সেটা ডাক, মানুষ টেনে নেওয়ার ডাক।” ঈশা ঠোঁট কামড়াল, নোটবই খুলে কিছু লিখে নিল। চোখে তার কৌতূহলের ঝিলিক, কিন্তু শরীরের ভেতরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি। শৈশবের শোনা ভয়াবহতা, এখন সরাসরি গ্রামবাসীর মুখ থেকে শুনছে, সেটাই যেন কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের সেতুবন্ধন ঘটাল।

বাজার থেকে বেরিয়ে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতেই সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল। গাছের গুঁড়ি, আঁকাবাঁকা নদীর শাখা, আর কাদার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা শেকড়গুলো যেন কোনো প্রাচীন প্রাণীর দেহ হয়ে আকাশে হাত ছুঁইতে চাইছে। নদীর ওপারে ঝাপসা অন্ধকারে কোথাও যেন একটি ছায়া দাঁড়িয়ে আছে—সে জানে সেটাই জলমহল, যদিও এ দূরত্ব থেকে কেবল ভগ্ন গম্বুজের আভাস ছাড়া কিছু বোঝা যায় না। চারদিকে ডাঙার নীরবতা, কেবল নদীর টলমল ধ্বনি আর বনের পাখিদের ডাক। ঈশা ক্যামেরা বের করল, লেন্স সেট করে দূরে তাকাল। ফ্রেমে এসে পড়ল কুয়াশার ফাঁকে মহলের অস্পষ্ট রূপ। হঠাৎ মনে হলো—একটা ক্ষণস্থায়ী আলোকরেখা যেন দেখা দিল মহলের দোতলার জানালায়। চোখ মেলল, আবার তাকাল—কিছুই নেই। বুকের ভেতর দ্রুততর ঢোল বাজতে লাগল। শৈশব থেকে গল্প শুনেছে, আজ নিজের চোখে সামান্য হলেও যেন তার ছাপ পেল। ঈশা জানে, এখানেই শুরু হবে তার যাত্রা—গবেষণার আড়ালে ভয়কে ছুঁয়ে দেখা, লোককথার আড়ালে লুকানো বাস্তবকে ধরতে চাওয়া। কিন্তু সে হয়তো এখনও বোঝেনি, এই লোককথার ছায়া কেবল কাগজে লেখার মতো বিষয় নয়, বরং এমন এক অন্ধকারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে তাকে, যেখান থেকে অনেকেই আর কোনোদিন ফেরেনি।

সকালের আলো সুন্দরবনের নদীপথকে যেন এক অন্য জগতে রূপান্তরিত করেছিল। হালকা কুয়াশার ফাঁকে সবুজ গাছপালার গাঢ় ছায়া, জলকাদায় ঢাকা তীর, আর মাঝেমধ্যে কুমিরের চোখের মতো চকচকে পানির ঢেউ—সবকিছুই যেন ঈশাকে এক রহস্যময় মঞ্চে নিয়ে এলো। সে মহেন্দ্র মন্ডলের ছোট নৌকায় চড়ে বসেছিল, তার সঙ্গে ক্যামেরা, নোটবই, আর কয়েকটা ব্যাগ। মহেন্দ্র বয়সে প্রায় মাঝবয়সী, কিন্তু মুখের ভাঁজ, চামড়ার রোদেপোড়া রঙ, আর চোখের গভীরতা বলে দেয়—সে নদীর সন্তান, প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিদিনের লড়াই করে বেঁচে থাকা এক মানুষ। বৈঠা হাতে মহেন্দ্র জলের উপর তাল মেলাচ্ছিল, আর ঈশা চারদিকে তাকাচ্ছিল মুগ্ধ চোখে। “এই নদীই আমাদের মা,” হঠাৎ মহেন্দ্র বলল, “কিন্তু মা যেমন রক্ষা করে, তেমনি রাগ করলে কেড়ে নেয়।” ঈশা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, “আপনি বলতে চাইছেন কুমির বা বাঘের কথা?” মহেন্দ্র হালকা হেসে মাথা নাড়ল, “ওসব তো আছে-ই। কিন্তু আমি বলছি ওখানকার কথা।” সে বৈঠা থামিয়ে আঙুল দেখাল—নদীর বুকে দূরে কোথাও অস্পষ্ট ভগ্নপ্রাসাদের আভাস। সেই দিকেই তাকাতেই ঈশার শরীরের ভেতর ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল।

মহেন্দ্র আবার বৈঠা চালাতে চালাতে গম্ভীর গলায় বলতে লাগল, “ওই মহল… আমরা তাকে জলমহল বলি। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনতাম, জমিদাররা নদীর দেবীর মন্দির ভেঙে এই মহল বানিয়েছিল। দেবী অভিশাপ দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের গৃহ নদীর জলে গ্রাস হবে, আর তোমাদের বংশ বিলীন হয়ে যাবে।’ কথাটা লোককথা কিনা জানি না, কিন্তু আমি জানি, যতবার লোকজন কৌতূহল নিয়ে ওইখানে ঢুকেছে, কেউ আর ফিরে আসেনি। শুধু নদী থেকে ভেসে এসেছে তাদের ছেঁড়া কাপড় বা গহনার টুকরো।” ঈশা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল, তার কলম খাতায় দ্রুত লিখছিল প্রতিটি শব্দ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে মনে হচ্ছিল—এই সতর্কবাণীগুলো একদিকে ভয় জাগালেও, অন্যদিকে তাকে অদ্ভুতভাবে টেনে নিচ্ছে। তার মনে হলো, মহেন্দ্র যেন এক জীবন্ত ইতিহাসের ভাণ্ডার, যার প্রতিটি কথা নদীর জলের মতো প্রবাহিত হয়ে এক অদ্ভুত সুর সৃষ্টি করছে। ঈশা হেসে বলল, “কিন্তু মহেন্দ্রদা, এসব তো কেবল গল্প হতে পারে, না? আমি তো খুঁজতে চাই সত্যিটা। আলো কোথা থেকে আসে, কেন মানুষ ফেরে না—তার বৈজ্ঞানিক কারণ তো নিশ্চয়ই আছে।” মহেন্দ্র বৈঠা চালিয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, “বিজ্ঞান হয়তো সব বোঝে, কিন্তু নদীর মনের খবর কেউ বোঝে না। মা যখন ডাকে, তখন কেউ ফেরে না।”

নৌকা এগোতে থাকল গভীর নদীপথে, চারপাশের বনের নীরবতা যেন আরও ঘন হয়ে উঠল। মাঝেমধ্যে বকের ঝাঁক উড়ে গেল, আর পানির নিচ থেকে বুদবুদ উঠে আসতে লাগল। হঠাৎ একসময় নৌকাটা কেঁপে উঠল, ঈশা চমকে মহেন্দ্রর দিকে তাকাল। মহেন্দ্র নির্লিপ্তভাবে বলল, “জোয়ারের সময় নদী বদলায়। হঠাৎ করে গভীর স্রোত এসে নৌকা উল্টে দিতে পারে। তাই আমরা কখনো ওই মহলের কাছে যাই না।” ঈশা তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে লেন্স সেট করল। দূরে মহলের ভগ্নপ্রায় চূড়া আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে, অর্ধেকটা গাছগাছালির আড়ালে ঢাকা, বাকিটা যেন জলের সঙ্গে মিশে গেছে। সে ক্যামেরায় ফোকাস করতে করতে মনে মনে ভাবল, সত্যিই কি কেবল অভিশাপ আর ভয়েই এই জায়গাটা ঢাকা? নাকি এর আড়ালে লুকানো আছে কোনো অজানা বৈজ্ঞানিক রহস্য? মহেন্দ্রর সতর্কবাণী তার কানে বাজছিল, কিন্তু কৌতূহলের আগুন যেন আরও উসকে উঠছিল। তার চোখে ছিল এক দৃঢ়তা—যদি জলমহল ডাক দেয়, তবে সেই ডাকে সাড়া দিতেই হবে। কিন্তু সে হয়তো তখনও বোঝেনি, মহেন্দ্রর সতর্কতা কেবল নদী বা প্রাসাদ নয়, বরং এক অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিত, যা যুগ যুগ ধরে অগণিত প্রাণ টেনে নিয়েছে অন্ধকারের ভেতর।

গ্রামের কাঁচা রাস্তায় হেঁটে যেতে যেতে ঈশা বুঝতে পারছিল, তার উপস্থিতি নিয়ে গ্রামবাসীর ভেতরে কেমন একটা কৌতূহল আর সন্দেহ একসাথে কাজ করছে। যারা মাঠ থেকে ফিরছে বা বাজারে বসে আছে, তারা হালকা কণ্ঠে কথা থামিয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। এই নিরীক্ষণ থেকে মুক্তি না পেয়ে সে গ্রামবাংলার একমাত্র হাটবাজারের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে চা অর্ডার করল। দোকানের বেঞ্চে বসে নোটবই খুলে কিছু লিখছিল, তখনই পাশে এক কর্কশ অথচ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠ শোনা গেল—“আপনিও বুঝি জলমহলের খোঁজে এসেছেন?” ঈশা মাথা ঘুরিয়ে দেখল, একজন তরুণ, গায়ে ঢিলেঢালা শার্ট, হাতে কলম আর ছোট্ট নোটবুক। চোখে তীক্ষ্ণতা, মুখে শহুরে দাপট। লোকটা তার দিকে তাকিয়ে হালকা হেসে বলল, “আমি রূপম সেন। কলকাতা থেকে এসেছি। সাংবাদিকতা করি। শুনেছি এখানে নাকি নৌকাভর্তি মানুষ উধাও হয়ে যায়, মহলের জানালায় আলো জ্বলে ওঠে। আমি এসেছি এসব কুসংস্কারের পেছনে আসল সত্যটা খুঁজতে।” ঈশা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রূপমের ভঙ্গি একেবারেই বিপরীত তার নিজের অনুভূতির থেকে—যেখানে সে শৈশব থেকে গল্প শুনে ভয়ের সঙ্গে কৌতূহল মিশিয়ে চলেছে, সেখানে রূপম নিছক যুক্তির জোরে প্রমাণ করতে চাইছে যে সবই ভাঁওতা।

কথা বাড়তে থাকল চায়ের দোকানে বসেই। ঈশা বলল, “আপনি কি মনে করেন এতো বছর ধরে এতো মানুষ নিখোঁজ হওয়ার সবটাই কাকতালীয়?” রূপম হেসে মাথা নেড়ে উত্তর দিল, “কাকতালীয় নয়, বরং মানুষের বোকামি। রাতের বেলা নদীতে যাওয়া মানে স্রোতে ভেসে যাওয়া, কুমিরে খাওয়া, বা গাছগাছালির ফাঁদে আটকে মারা যাওয়া। এগুলোকে মানুষ ভূতপ্রেতের গল্পে ঢেকে দিয়েছে, কারণ সত্যিটা তাদের কাছে নিষ্প্রভ। সাংবাদিকতার কাজ হচ্ছে এই নিষ্প্রভ সত্যকে আলোয় আনা।” ঈশা খাতার উপর আঙুল বুলিয়ে বলল, “কিন্তু গ্রামের লোকেদের ভয়কে অস্বীকার করা যায় না। তারা বারবার একই ঘটনা বলছে। বিজ্ঞান দিয়ে সব ব্যাখ্যা করা যায় না।” রূপম সঙ্গে সঙ্গে পাল্টা দিল, “এটা আপনার দুর্বলতা। আপনি একজন গবেষক, আপনাকে নিরপেক্ষ থাকতে হবে। অথচ আপনি লোকেদের ভয়ের ভেতরেই সত্য খুঁজতে চাইছেন। আমি এসেছি উল্টোটা প্রমাণ করতে—সবকিছু অন্ধবিশ্বাস ছাড়া কিছুই নয়।” দুইজনের কথোপকথনে দোকানের ভেতরের অন্য মানুষরা নীরবে কান পেতে রইল, কেউ কেউ চুপিসারে ফিসফিস করতে লাগল। গ্রামের মানুষজনের কাছে এই দুই শহুরে মানুষ যেন দুই বিপরীত মেরু—একজন বিশ্বাস আর ভয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে, অন্যজন সেগুলোকে ভাঙতে চাইছে।

ঈশা আর রূপম সেইদিন বিকেলে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। আকাশে হালকা অন্ধকার নেমেছে, জোয়ারের পানির ঢেউ ঘন হতে শুরু করেছে। দূরে মহলের ভগ্নপ্রায় চূড়া অন্ধকারের আড়ালে আভাস দিয়ে উঠছে। দুজনের ভেতরে টানাপোড়েন যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। ঈশা ক্যামেরা হাতে নিয়ে বলল, “আমি বিশ্বাস করি কিছু না কিছু আছে ওখানে, যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু প্রমাণ আছে। আলো, ফিসফিসানি, মানুষের নিখোঁজ হওয়া—সবই একই সূত্রে বাঁধা।” রূপম ঠাণ্ডা গলায় উত্তর দিল, “আমি বিশ্বাস করি সবকিছুতেই যুক্তি আছে, আর আমি সেটা খুঁজে বের করব। এই মহল হয়তো নদীর প্রতিফলন, হয়তো গ্যাসের প্রভাব, কিংবা স্থানীয় দুষ্কৃতীরা গুজব ছড়াচ্ছে নিজেদের স্বার্থে। আমি সেটা প্রমাণ করব।” কথাগুলো বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। নদীর জল তাদের পায়ের কাছে এসে ধাক্কা মারছিল, আর আকাশের মেঘ গাঢ় হয়ে উঠছিল। দুজনেই বুঝছিল, এই প্রথমবারের মতো তাদের যাত্রা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত তাদের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে একই অন্ধকারের সামনে। হয়তো যুক্তি জয়ী হবে, হয়তো লোককথা সত্য হয়ে উঠবে, কিন্তু নিশ্চিত হলো—জলমহল যে-ই হোক, সে তাদের দুজনকেই ডাকছে, এবং সেই ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই।

সরু গলিপথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে ঈশা ও রূপম পৌঁছে যায় গ্রামটির এক কোণে, যেখানে ছোট্ট খড়ের ছাউনি দেওয়া একটি কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, মনে হচ্ছে কেউ চুলোর ওপর কড়াই বসিয়েছে। এটাই সরস্বতীর বাড়ি—গ্রামজোড়া পরিচিত নাম, যাকে সবাই মান্য করে আবার ভয়ও পায়। বয়স আশি পেরিয়েছে, কিন্তু তার চোখে এমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যে, সামনে দাঁড়ালে মনে হয় সে যেন ভেতর পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে। ঈশা প্রথমেই নিজের পরিচয় দেয়, তারপর গ্রামের মহল আর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার কথা বলে। রূপম যদিও পাশে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হাসে—তার কাছে এসবই লোকগাথা, গ্রামবাসীর ভয়-ভীতি থেকে তৈরি কল্পনা। কিন্তু সরস্বতীর মুখে এমন শান্ত অথচ রহস্যময় অভিব্যক্তি ছিল যে, অস্বীকার করা সহজ নয়। বৃদ্ধা ধীরে ধীরে বললেন, “তোমরা যে মহলের খোঁজ করছো, ওটা কেবল ইট-পাথরের প্রাসাদ নয়। ওখানে ডাক আছে। সে ডাক শোনার পর মানুষ আর ফেরে না। আমিও সেই ডাকে আমার স্বামীকে হারিয়েছি।” এই কথায় মুহূর্তেই ভেতরে এক শীতলতা নেমে আসে। ঈশা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, যেন এই শব্দগুলো খুঁটিয়ে শুনতে চায়। রূপম সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে, “এ তো স্রেফ কুসংস্কার। ডাক আবার কিসের? যদি সত্যিই কিছু থাকে, আমি নিজে গিয়ে প্রমাণ করে আসব।” কিন্তু সরস্বতী তখন চোখ বুজে বসে, যেন দূরের কোনো স্মৃতি থেকে কথা টেনে আনছে।

তিনি বলতে শুরু করেন—অনেক বছর আগে, যখন তিনি নববধূ হয়ে এ গ্রামে এসেছিলেন, মহল তখনও অক্ষত, জমিদার পরিবারের আভিজাত্যের ছাপ চারপাশে। কিন্তু ধীরে ধীরে মহলটি নিস্তব্ধ হয়ে যায়, রাজপরিবারের উত্তরাধিকারীরা একে একে শহরে চলে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে—সেই ফাঁকা মহল রাতের আঁধারে নিশ্বাস নেয়, কেউ কাছে গেলে যেন ভেতর থেকে গলা টেনে নেয়। সরস্বতীর স্বামী ছিলেন চাষা মানুষ, গরু-হাল নিয়ে জমিতে কাজ করতেন। একদিন গভীর রাতে মাঠে কাজ শেষে বাড়ি ফেরেননি। সবাই খুঁজতে খুঁজতে শেষে মহলের ফটকে এসে দাঁড়ায়, আর সেখানে কেবল তার চটি পাওয়া যায়, মানুষটি আর কখনও ফেরেনি। সেই থেকে তিনি বিশ্বাস করেন—মহল শুধু প্রাসাদ নয়, সে এক গলা, যে টেনে নেয়, গিলে ফেলে। কথা বলতে বলতে সরস্বতীর কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, চোখে জল টলমল করে ওঠে। ঈশা সেই দৃশ্য দেখে গম্ভীর হয়ে পড়ে, কারণ এ কেবল গুজব নয়—এখানে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের বাস্তব কাহিনি, যেটা তার গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়। রূপম অবশ্য মুখে হাসি ধরে রাখলেও তার ভেতরে অস্বস্তির ঢেউ বয়ে যায়, কারণ বৃদ্ধার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তা নিছক বানানো মনে হওয়ার নয়।

সরস্বতী শেষ পর্যন্ত ঈশার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি সাহসী মেয়ে, দেখছি। কিন্তু সাবধান—মহলকে অগ্রাহ্য কোরো না। ও ডাক দিলে সাড়া দিও না, নইলে তোমাকেও টেনে নেবে।” এই সতর্কবাণী শুনে ঈশার মনে কাঁপন ধরলেও সে কিছু বলে না। তার চোখে কৌতূহল ও ভয়ের মিশ্র ছাপ স্পষ্ট। রূপম তখন বিদ্রূপভরে বলে ওঠে, “এই ধরনের গল্পই গ্রামের মানুষকে অশিক্ষার আঁধারে আটকে রাখে। ভয় দেখিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তির নাম।” কিন্তু সরস্বতী হালকা হাসলেন, যেন বুঝিয়ে দিলেন, যুক্তি সব সময় সত্যকে অস্বীকার করতে পারে না। “তুমি না চাইলেও সত্য তোমাকে খুঁজে নেবে, বাবু,” তিনি বললেন। বাইরে তখন হাওয়ার ঝাপটা বইছে, নারকেল গাছের পাতা ঝিরঝির শব্দ করছে, আর ভেতরের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। ঈশা চুপচাপ বৃদ্ধাকে প্রণাম করে, আর রূপম অর্ধেক মনেই মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসে। কিন্তু দুজনের মনেই সেই কথা গেঁথে থাকে—“মহলের ভেতর ডাক আছে।” এ যেন এক অভিশাপ, এক অদৃশ্য শক্তি, যাকে উপেক্ষা করা মানে বিপদকে নিমন্ত্রণ করা। এই কথাগুলো পরবর্তী সময়ে তাদের তদন্তের প্রতিটি পদক্ষেপকে প্রভাবিত করবে, যদিও দুজনের গ্রহণ করার ধরণ ভিন্ন—ঈশার কাছে এটা এক ধরনের ইতিহাসের প্রমাণ, আর রূপমের কাছে এটা কেবল যুক্তি দিয়ে ভুল প্রমাণ করার চ্যালেঞ্জ।

সেদিন ছিল পূর্ণিমার আগের রাত, আর সমুদ্র যেন পাগল হয়ে উঠেছিল। ঢেউগুলো অদ্ভুত এক ছন্দে তটে আছড়ে পড়ছিল, হাওয়া বইছিল এমনভাবে যেন কারও শ্বাসকষ্টময় দীর্ঘশ্বাস বাতাসে ভেসে আছে। ঈশা ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সমুদ্রতটের কিনারে, চোখ স্থির মহলের দিকে। সেই প্রাসাদ—যা একসময় গৌরবের প্রতীক ছিল, এখন পরিত্যক্ত, জীর্ণ, অথচ তার ভেতর থেকে যে এক অদৃশ্য স্রোত বেরিয়ে আসে, সেটা প্রতিটি রাত্রিতে তাকে ভেতরে টেনে নেয়। হঠাৎ করেই ঈশার বুক ধক করে উঠল। সে স্পষ্ট দেখল—মহলের দোতলার একটি জানালা আলোকিত হয়ে উঠেছে। আলোটা ছিল খুব ক্ষীণ, তবুও এক রহস্যময় জ্যোতি, যেন অনেক পুরনো প্রদীপ কিংবা লণ্ঠন জ্বলে উঠেছে। চোখ মুছে আবার তাকাল ঈশা, আলো এবার আরও স্পষ্ট—স্থির, কম্পিত, অদ্ভুত রকমের উষ্ণতা ছড়ানো। রূপম সেই মুহূর্তে পাশে ছিল না, সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মোবাইলে সিগন্যাল খুঁজছিল। ঈশার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে গেল, যেন হঠাৎ এক বরফের হাওয়া শরীর ভেদ করে চলে গেল। তাড়াহুড়ো করে সে ক্যামেরাটা তুলল চোখের সামনে, শাটার ক্লিক করল কয়েকবার, পরপর ছবি তুলতে লাগল, যেন প্রমাণটা হাতে রাখতে পারে। ক্যামেরার ডিসপ্লে খুলেই দেখল ছবিগুলো—কিন্তু সেখানে কিছুই নেই। না, কেবল অদ্ভুত ঝাপসা, এক ধরনের ধোঁয়াটে ছায়া, যেন আলোটা ফ্রেমে ধরা পড়তেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। ঈশার হাত কেঁপে উঠল। কপালে ঠান্ডা ঘাম জমল, মনে হল সত্যিই কি সে দেখল আলোটা, নাকি তার মনের ভিতরেই এই সব কল্পনা তৈরি হচ্ছে?

এই সময় রূপম ফিরে এসে ঈশার অস্থির মুখটা লক্ষ্য করল। সে অবাক হয়ে বলল, “কি হলো, এমন কেমন করে তাকিয়ে আছিস?” ঈশা কাঁপা গলায় জানাল, “ওই দোতলায় আলো জ্বলছে রূপম! আমি স্পষ্ট দেখেছি।” রূপম চোখ কুঁচকে মহলের দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা, শুধু ঢেউয়ের শব্দ আর দূরে শোঁ শোঁ বাতাস। কোথাও কোনো আলো নেই। চারদিক অন্ধকার, যেন মহলটা কালো সমুদ্রের বুক থেকে আরও গভীর অন্ধকার টেনে নিচ্ছে। রূপম হাসল হালকা অবিশ্বাসের সুরে। “তুই প্রতিফলন দেখেছিস হয়তো। সমুদ্রের ঢেউ, চাঁদের আলো, ভাঙা কাচ—সব মিলিয়ে চোখে প্রতারণা হতে পারে।” ঈশা তার চোখের সামনে আবার ক্যামেরার ছবিগুলো রূপমকে দেখাল। কিন্তু ছবিগুলোতে সত্যিই কিছু নেই—কেবল অস্পষ্ট ছায়ার মতো দাগ, কিছু বিকৃত রেখা, যেন ছবির ভেতর কেউ হাত বুলিয়ে দিয়েছে। রূপম মাথা নেড়ে হেসে বলল, “দেখলি তো! এইসবই প্রতিফলন। তোর মন অতিরিক্ত কিছু ভাবছে। মহলের ভেতর আলো জ্বলে উঠতে পারে না, ও তো বহু বছর ধরে ফাঁকা।” ঈশার ঠোঁট শুকিয়ে গেল। সে হালকা গলায় বলল, “কিন্তু আমি অনুভব করেছি রূপম, ওটা প্রতিফলন ছিল না। ও আলোটা যেন আমাকে ডাকছিল। ঠিক সেই কথাটাই তো সরস্বতী কাকিমা বলেছিল—মহল শুধু প্রাসাদ নয়, এক গলা, যে টেনে নেয়।” রূপম একটু অস্থির হয়ে চারদিকে তাকাল, তারপর বিরক্ত সুরে বলল, “তুই এসব কথায় কান দিস না। এ সবই কুসংস্কার।” কিন্তু তার চোখে অনিশ্চয়তার এক ঝলক ফুটে উঠেছিল, যদিও সে সেটা লুকাতে চেয়েছিল।

তবে ঈশা আর নিজেকে থামাতে পারল না। সেই আলোটা যেন তাকে এক অদ্ভুত টান দিয়ে টেনে নিচ্ছিল, এক অচেনা ভয় ও আকর্ষণের মিশ্রণে তার মন কাঁপছিল। রাতের অন্ধকারে, তীব্র জোয়ারের শব্দের মাঝে, তার কাছে মনে হচ্ছিল যে আলোটা কেবল একটা আলোকস्रोत নয়—এ যেন অতীতের কণ্ঠ, কোনো হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি, কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি, যা মহলের ভেতরেই আটকে আছে। “আমি জানি আমি কি দেখেছি,” ফিসফিস করে বলল ঈশা, চোখ মহলের জানালায় নিবদ্ধ রেখে। “ও আলোটা সত্যিই জ্বলছিল।” রূপম আর কিছু বলল না, কেবল চুপচাপ সমুদ্রের দিকে তাকাল। তার মুখে ব্যঙ্গ ছিল, কিন্তু চোখে ভয়ের ছায়া লুকোতে পারল না। যেন সেও বুঝে ফেলেছে—সবকিছু হয়তো প্রতিফলন নয়। ক্যামেরায় ধরা না পড়লেও, আলোটা বাস্তবেই জ্বলেছিল। আর সেই আলো হয়তো ছিল এক সংকেত—অতল অন্ধকারের ভেতর থেকে প্রথম আলো, যে আলো শুধু দৃষ্টি নয়, আত্মাকেও জড়িয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে। সেই রাতের পর থেকে ঈশা আর শান্তিতে ঘুমোতে পারল না। প্রতিটি ঢেউয়ের শব্দ, প্রতিটি বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে তার মনে হত, মহল থেকে সেই আলো আবার ডাকছে তাকে—আর হয়তো পরেরবার শুধু দেখা নয়, তাকে টেনে নিয়েই যাবে ভেতরে।

রাতের নদীকে যেভাবে মানুষ দূর থেকে শান্ত ও অনমনীয় মনে করে, কাছাকাছি এলেই বোঝা যায় তার ভেতরে কী ভয়ঙ্কর স্রোত লুকিয়ে আছে। ঈশা আর রূপম এবার মহেন্দ্র মাঝিকে নিয়ে নদীপথে মহলের দিকে এগোচ্ছিল, চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল বৈঠার শব্দ আর দূরের ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছিল। চাঁদের আলো নদীর বুক জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে, যেন রুপোলি পর্দার ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে তাদের নৌকা। কিন্তু যতই তারা মহলের কাছাকাছি আসতে থাকে, পরিবেশে একটা অস্বস্তিকর পরিবর্তন ধরা দিতে শুরু করে। নদীর জল হঠাৎ যেন অকারণে ঘোলা হয়ে ওঠে, বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়, আর দূরে মহলের অন্ধকার সিলুয়েট যেন ক্রমেই বিশাল হয়ে উঠতে থাকে। ঈশার বুকের ভেতর কেমন একটা চাপা শঙ্কা তৈরি হয়—এ কি কেবল কল্পনা, নাকি সত্যিই মহল তাদের অদৃশ্য হাত দিয়ে ডাকছে কিংবা তাড়িয়ে দিচ্ছে? সে বারবার চারপাশে তাকাতে থাকে, অদ্ভুত ছায়া যেন জলের ওপর ভেসে চলেছে, কিন্তু রূপম তাকে বাস্তববাদী যুক্তি দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। তবে মহেন্দ্র মাঝির চোখে ভয়ের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তার হাত কাঁপছে, বৈঠা চালানোর ভঙ্গিতে একরকম অস্থিরতা।

নৌকা যত এগোয়, ততই নদীর জল অদ্ভুত আচরণ করতে শুরু করে। প্রথমে হালকা ঢেউ, তারপর হঠাৎ যেন চারপাশে স্রোত জমাট বাঁধে, আর মুহূর্তের মধ্যে নৌকার চারপাশে ঘূর্ণি তৈরি হয়। নদীর মাঝখানে এই আচরণ একেবারেই অস্বাভাবিক—না কোনো ঝড়, না কোনো তীব্র বাতাস, অথচ নদী যেন এক অদৃশ্য শক্তির নির্দেশে উত্তাল হয়ে উঠেছে। মহেন্দ্র ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে ওঠে, “বাবা, এই নদী সহজে কাউকে ওই দিক যেতে দেয় না… অনেকে চেয়েছিল, কিন্তু ফেরেনি।” তার কথায় ঈশার গা শিউরে ওঠে, বুকের ভেতর অদ্ভুত আতঙ্ক জমে ওঠে। রূপম শুরুতে এসবকে কুসংস্কার ভেবে উড়িয়ে দিলেও, সেও টের পায় নদীর টান ক্রমশ নৌকাকে মহলের দিক থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে, যেন জলের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে কেউ তাদের ঠেলে দিচ্ছে। হঠাৎ একটা প্রবল ঢেউ এসে নৌকার একপাশে আছড়ে পড়ে, নৌকাটা কেঁপে ওঠে, আর ঈশা সামলে না নিতে পারলে হয়তো পানিতে পড়ে যেত। চারপাশের অন্ধকার আরও ঘন হয়ে ওঠে, জোয়ার যেন চাঁদের আলোও গ্রাস করে নিচ্ছে, আর দূরে মহল অদৃশ্য হয়ে কেবল একটা কালো ছায়ায় পরিণত হচ্ছে।

মহেন্দ্র তখন প্রার্থনার মতো কিছু বিড়বিড় করতে করতে বৈঠা চালাতে থাকে, আর আতঙ্কে কপালে ঘাম জমে ওঠে। ঈশা হঠাৎ দেখতে পায়, জলের মধ্যে মহলের প্রতিচ্ছবি ভেঙে পড়ছে, আর সেই ভাঙা প্রতিচ্ছবির ভেতর থেকে চোখের মতো দুটি আলোর দাগ ফুটে উঠছে—সে জানে না এটা কল্পনা নাকি বাস্তব, কিন্তু তার শরীর কেঁপে ওঠে। রূপমও এবার চুপ হয়ে যায়, যুক্তির ব্যাখ্যা যেন আর খুঁজে পায় না। মুহূর্তের মধ্যে তারা অনুভব করে নৌকা যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, নদীর স্রোতই তাকে টেনে নিয়ে চলেছে, কখনও মহলের দিকে, আবার হঠাৎ জোর করে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। এই দ্বন্দ্বপূর্ণ শক্তির মধ্যে নৌকাটা দুলতে থাকে, আর প্রতিটি মুহূর্তে মনে হতে থাকে, যেকোনো সময় তা উল্টে যাবে। অবশেষে মহেন্দ্র মরিয়া হয়ে বৈঠা চালিয়ে নদীর ভেতরের অদৃশ্য বাঁধাকে উপেক্ষা করে কোনো রকমে নৌকাটাকে খানিকটা নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসে। তখনই স্রোত ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে, নদী আবার তার স্বাভাবিক রূপ ফিরে পায়, যেন কিছুই হয়নি। ঈশা আর রূপম নিঃশ্বাস ফেলার সময় পায়, কিন্তু মহেন্দ্রের কণ্ঠে শীতল সতর্কবাণী—“বাবা, ওই মহল ডাকলেও যেও না, নদীই তার প্রহরী। যতবার ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করবা, ততবার এ নদী তোমাদের গিলে নিতে চাইবে।” সেই রাতে তারা আর এগোয় না, নদীর বুক জুড়ে এক শূন্যতার নীরবতা ভেসে থাকে, আর ঈশার মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে—কী এমন গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে যে এমনকি নদীও তার পথ রুখে দেয়?

সেদিন রাতটা যেন অন্য সব রাতের চেয়ে বেশি অন্ধকারে ঢাকা পড়েছিল, নদীর ওপারে ভগ্নপ্রায় মহলটা দাঁড়িয়ে ছিল একেবারে নীরব অথচ ভয়ার্ত জ্যোৎস্নার আলোয় আবৃত হয়ে। দীর্ঘদিনের দ্বিধা আর ভয়কে সরিয়ে রেখে অবশেষে ঈশা ও রূপম সিদ্ধান্ত নেয় আজ রাতেই তারা ভেতরে প্রবেশ করবে। হাতে ছোট্ট টর্চলাইট, ব্যাগে কয়েকটা দেশলাই আর এক ফালি মোমবাতি, বুকের ভেতর ধুকপুক করা হৃদস্পন্দন—সব মিলিয়ে যেন দুঃসাহসিক এক অভিযাত্রার শুরু। নৌকো বেঁধে তারা যখন পায়ের আঙুল টিপে সিঁড়ির প্রথম ধাপে ওঠে, তখনই চারপাশ থেকে ভাঙা দেওয়ালের ভেতর লুকানো বাদুড়েরা একযোগে উড়ে ওঠে, হঠাৎ ডানার শব্দে বাতাস কেঁপে ওঠে। ঈশা আঁকড়ে ধরে রূপমের হাত, আর রূপম দাঁত চেপে বলে ওঠে—“পিছু হটার উপায় নেই।” তারা ধীরে ধীরে ভগ্নপ্রায় সিঁড়ির দিক ধরে ওপরে উঠতে থাকে, প্রতিটি ধাপে ধুলো উড়ে চোখ-মুখে লাগে, আর সেই ধুলোর ভেতর থেকে যেন ভেসে আসে ক্ষীণ কণ্ঠস্বর—মিহি, টানা ফিসফিসানি, এক অদ্ভুত আমন্ত্রণ, যেন অচেনা কেউ ভেতর থেকে ডাকছে, “এসো…”। কণ্ঠটা এতটা বাস্তব মনে হয় যে ঈশার মনে হয় হাত বাড়ালেই হয়তো তাকে স্পর্শ করা যাবে, অথচ চারপাশে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই।

মহলের ভেতরে প্রবেশ করতেই তাদের নাকে লাগে তীব্র এক গন্ধ, যা স্পষ্টতই নদীর গন্ধ হলেও কোনোভাবে অস্বাভাবিক—পচা শেওলা, দীর্ঘদিন ভেজা কাঠে জমে থাকা স্যাঁতসেঁতে কুৎসিত দুর্গন্ধ, যার ভেতরে আবার মিশে আছে অদ্ভুত এক ধাতব গন্ধ, যেন পুরোনো রক্ত শুকিয়ে বহুদিন ধরে থেকে গেছে। দেওয়ালের রং খসে পড়েছে, ছাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে দীর্ঘ ছায়া তৈরি করেছে মেঝেতে। সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে তাদের মনে হতে থাকে যেন দেয়ালগুলো নড়ছে, আর ফিসফিসানি বাড়ছে ক্রমশ। ঈশা হঠাৎ পা থামিয়ে বলে ওঠে—“শোনো, মনে হচ্ছে কেউ হাঁটছে।” রূপম টর্চের আলো ঘুরিয়ে দেখায়, কিন্তু চোখে পড়ে শুধু ছিন্নপত্রে ঢাকা মেঝে আর ফেটে যাওয়া জানালা দিয়ে ভেতরে আসা বাতাস। কিন্তু হাওয়ার ঝাপটায় জানালার পর্দা দুলতেই তাতে যে ছায়া তৈরি হয়, তা দেখে মনে হয় যেন কোনো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, কিন্তু অদম্য কৌতূহল তাদের টেনে নিয়ে যায় আরও গভীরে। এক কক্ষ থেকে আরেক কক্ষে পা বাড়াতে বাড়াতে তারা বুঝতে পারে এই মহল যেন জীবন্ত—প্রতিটি ইট, প্রতিটি স্তম্ভে জমে আছে অদ্ভুত এক কম্পন, যেন জায়গাটা নিজেই নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

ভেতরে আরও এগোতেই দেখা যায় বিশাল এক হলঘর, যেখানে হয়তো একসময় রাজকীয় ভোজসভা বসত। এখন সেটি ধ্বংসস্তূপ, মেঝেতে জমে থাকা পলেস্তারা, ভাঙা মূর্তি, আর স্যাঁতসেঁতে জলকাদা। তবুও এই ঘরেই সবচেয়ে বেশি শোনা যায় সেই অদ্ভুত ডাক—“এসো…”। ডাকের সঙ্গে যেন মিশে আছে সুরেলা গুঞ্জন, যা একদিকে টানে আবার অন্যদিকে আতঙ্কে কাঁপিয়ে তোলে। হঠাৎই ঈশা টর্চের আলো ফেলে দেয় এক প্রাচীন আয়নার দিকে, যেটা অর্ধেক ভেঙে গেছে, তবুও বাকি অংশে স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। তাদের দু’জনের প্রতিচ্ছবি সেখানে ভেসে ওঠে, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়—আয়নায় যে দুই প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে, তাদের চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত শূন্য, যেন তারা ঈশা-রূপম নয়, বরং এই মহলেরই অন্য কোনো বাসিন্দা। আতঙ্কে ঈশা চিৎকার করে ওঠে, কিন্তু তার গলা যেন মহলের দেয়ালে আটকে গিয়ে প্রতিধ্বনিত হয়—অসংখ্য ঈশার কণ্ঠ মিলে ভেসে আসে একসঙ্গে। রূপম শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে, “ভয় পেও না, আমাদের সত্য জানতে হবে।” দু’জনেই বুঝতে পারে, এই ভগ্নপ্রায় মহল নিছক ইট-পাথরের সমাহার নয়—এ যেন এক জীবন্ত সত্তা, যে তাদের ডাকছে নিজের ইতিহাস, নিজের গোপন রহস্যের ভেতরে। আর তারা যখন সিঁড়ি বেয়ে আরও ওপরে উঠতে থাকে, ফিসফিসানি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—কেবল ডাক নয়, এখন যেন কেউ নিঃশ্বাস ফেলে, হাঁটছে, তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। মহলটা তখন সত্যিই যেন এক দানবীয় দেহ, যার ভেতরে প্রবেশ করে তারা আর ফিরতে পারবে কি না, তা তারা নিজেরাও জানে না।

পুরনো মহলের অন্ধকারচাপা করিডোরে ঈশা যখন টর্চের আলো ফেলছিল, তখন হঠাৎ তার চোখ পড়ে এক দাগধরা দেয়ালের দিকে। চুন-সুরকির আবরণ ভেঙে গিয়েছে, আর সেই ফাঁকফোকর থেকে বেরিয়ে এসেছে লালচে রঙের দাগ, যা অনেকটা রক্তের মতো শুকিয়ে গেছে। কৌতূহলবশত সে আরও কাছে এগিয়ে যায়, আঙুল বুলিয়ে দেখে সেই দাগ আসলে এক জটিল চিত্রের অংশ। টর্চের আলোতে ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে এক ভাঙাচোরা অঙ্কন—দেবীর মূর্তি, পাশে নদী, আর তার ওপরে দাঁড়িয়ে জমিদার পরিবারের পুরুষেরা। ঈশার বুকের ভেতর যেন ঠাণ্ডা কাঁপুনি নেমে আসে। সে বুঝতে পারে এটি স্রেফ অলঙ্করণ নয়, বরং কোনো লুকোনো কাহিনির সাক্ষ্য। আঁকায় দেখা যায় দেবীর মন্দিরকে ভেঙে ফেলা হচ্ছে, তার জায়গায় মহলের ভিত্তি দাঁড় করানো হচ্ছে। আশ্চর্যজনকভাবে মাটির গভীর থেকে আঁকা লাল রেখা ধীরে ধীরে উপরে উঠেছে, যেন রক্তক্ষরণ হয়ে ইতিহাস নিজের ভাষায় ফুঁটে উঠছে। ঈশার মনে পড়ল গ্রামবাসীদের কথিত পুরোনো অভিশাপের কথা—“এই মহল নদীর রক্তে দাঁড়িয়ে আছে, আর নদীর দেবী কাউকে ক্ষমা করেন না।” সেই মুহূর্তে ঈশা অনুভব করে দেয়ালের ভেতর থেকে যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে তাকিয়ে আছে, তাকে সাক্ষী রাখছে এই লুকোনো অপরাধের।

তারপর ধীরে ধীরে দেয়ালের গায়ে জমে থাকা রঙিন দাগের ভেতর থেকে আরেকটি দৃশ্য স্পষ্ট হয়। দেখা যায়, জমিদার পরিবারের পুরোনো কর্তা নদীর তীরে বসে আছেন, আর তার চারপাশে গ্রামবাসীদের কাতর মুখ। তারা দেবীর মন্দির ভাঙা আটকাতে চাইছে, কিন্তু লাঠিয়াল বাহিনী তাদের পিষে দিচ্ছে। চিত্রের রক্তরেখাগুলো শুধু শিল্পীর রঙ নয়, বরং বাস্তব ঘটনার স্মৃতি—সেই সময়ে অনেকে প্রাণ দিয়েছিল দেবীর মন্দির বাঁচাতে। জমিদার নির্মমভাবে নির্দেশ দিয়েছিলেন নদীর দেবীর প্রতিমা ভেঙে মহলের নিচে চাপা দিতে, যেন তার নতুন স্থাপত্যের ভিত্তি হয় সেই ভাঙা দেবীমূর্তি। ঈশা এই দৃশ্য দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে, কারণ এমন অপবিত্র কাজে দেবীর অভিশাপ নামতেই পারে। টর্চের কাঁপা আলোয় মনে হচ্ছিল ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠছে—চোখে আগুন, মুখে ক্রোধ, আর নদীর ঢেউ আঁকড়ে থাকা ভাঙা প্রতিমার অংশ। হঠাৎই মনে হলো বাতাস ভারী হয়ে উঠল, যেন ঘরের প্রতিটি দেয়াল ফিসফিস করে সেই ইতিহাস শোনাচ্ছে। ঈশার বুক ধড়ফড় করতে থাকে, কারণ এখন সে নিশ্চিত—এই অভিশাপ কেবল কাহিনি নয়, বরং এক প্রবাহমান বাস্তব শক্তি, যা এখনও এই মহলকে আঁকড়ে আছে।

শেষে ঈশা লক্ষ্য করল দেয়ালের চিত্রের শেষ প্রান্তে এক ভীতিকর দৃশ্য—মহলের বিশাল খিলান গুঁড়িয়ে পড়ছে, আর তার নিচে আটকা পড়ছে মানুষ। মুখগুলো বিকৃত, তারা যেন আর্তনাদ করছে। রক্তের মতো লাল রেখা ছড়িয়ে গেছে চারপাশে, নদীর ঢেউ তাতে মিশে গিয়ে গাঢ় দাগ হয়ে গেছে। ছবির পাশে অদ্ভুত লিপিতে কিছু লেখা ছিল, যেটা ঈশা ঠিকমতো পড়তে পারছিল না, কিন্তু শব্দগুলোতে যেন একটা অশুভ শক্তি জমে ছিল। সে শুধু একটি শব্দ আলাদা করতে পারল—“বন্ধন।” এর মানে কি মহলের ভেতরে ঢুকলে আত্মা এখানে চিরতরে আটকে যায়? ঈশার মনে হলো এই মুহূর্তে সে নিজেও সেই ফাঁদের এক অংশ হয়ে পড়েছে। টর্চের আলো নিভে যাওয়ার মতো কেঁপে উঠল, আর হাওয়ার শব্দে যেন কান্না শোনা গেল। হঠাৎ করিডোরের ভেতর দিয়ে শীতল হাওয়া বয়ে গেল, দেয়ালের ছবিগুলো ঝাপসা হয়ে আবার যেন গাঢ় হয়ে উঠল, যেন সেগুলো তাকে তাড়া করছে। ঈশা পিছিয়ে গেলেও তার চোখে সেই রক্তছাপের চিত্র গেঁথে রইল। সে বুঝে গেল এই মহল ভাঙন ও মৃত্যুতে জন্মেছিল, আর নদীর দেবী প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—যে এখানে আসবে, তার আত্মাও আর মুক্তি পাবে না। ঈশার হৃদয় ভারী হয়ে এল, কারণ এখন তার সামনে কেবল একটাই প্রশ্ন দাঁড়াল—এই অভিশাপ থেকে সে আর তার সঙ্গীরা আদৌ কোনোদিন বাঁচতে পারবে কি না।

রাতটা ছিল ঘন অন্ধকারে মোড়া, যেন আকাশ থেকে চাঁদ-তারা সব উধাও হয়ে গেছে। কেবল ভাঙা জানালা দিয়ে আসা বাতাসের শব্দ আর মহলের ভেতরের ভারী নীরবতা মিলেমিশে এক অদ্ভুত ভয় তৈরি করছিল। ঈশা টের পাচ্ছিল—মহলের দেয়ালগুলো যেন নিঃশ্বাস ফেলছে, ভেতরে জমে থাকা শত বছরের অভিশাপ তাদের বুক ভরে রেখেছে। সে আর রূপম একসাথে দক্ষিণ দিকের করিডোরে এগোচ্ছিল, যেখানে দেয়ালের পুরনো খোদাই আর কালো রঙের দাগ এখনো টিকে আছে। রূপম মৃদু হেসে বলেছিল—“এইসব শুধু কুসংস্কার, ভূত বলে কিছু নেই।” কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল না সাহসের দৃঢ়তা, বরং ভয় ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা। হঠাৎ করেই অদ্ভুত এক শীতলতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল, বাতাস যেন জমে গেল। আর তারপরই এক ভয়ঙ্কর শব্দ—যেন কেউ গভীর কূপের ভিতর থেকে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে। রূপম চোখ পিটপিট করে এক ঝলক অদৃশ্য ছায়ার দিকে তাকাল, এবং মুহূর্তের মধ্যে ঈশার সামনে থেকে মিলিয়ে গেল। ঈশার চোখের সামনে কেবল তার প্রসারিত হাত আর আতঙ্কভরা মুখ ভেসে উঠল, সাথে ছিল এক করুণ চিৎকার, যা যেন দেয়াল ভেদ করে বহু পুরনো সময় থেকে ফিরে আসছে। সে চিৎকার থেমে যেতেই নেমে এল এক অভিশপ্ত নীরবতা, যেন মহলটা আবার নিজের গোপন ভেতরে তাকে গিলে নিল। ঈশা চিৎকার করলেও তার কণ্ঠ কেউ শোনেনি, কেবল শীতল অন্ধকার আর ভাঙা দরজার বাইরে লুকিয়ে থাকা ছায়ারা যেন তাকে ব্যঙ্গ করছিল।

হতবাক ঈশা মাটিতে বসে পড়ে, তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সে বুঝতে পারছিল না রূপম কোথায় হারাল, কেমন করে এক মুহূর্তের মধ্যে মানুষের শরীর এইভাবে শূন্যে মিলিয়ে যেতে পারে। তার চারপাশে যেন অদৃশ্য চোখ ঘুরছিল, কেউ যেন ফিসফিস করে বলছিল—“সে ডাকের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।” তখনই বৃদ্ধা সরস্বতীর কণ্ঠ শোনা গেল, নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভারী, নির্লিপ্ত সুরে—“তুমি যা শুনলে, তা মিথ্যে নয়। মহলের ভেতরে যারা আসে, তারা সবাই সেই ডাকের কাছে আত্মসমর্পণ করে। রূপমও সেই ডাকেই চলে গেছে।” ঈশার চোখ ছলছল করতে লাগল, কিন্তু সরস্বতীর দৃষ্টিতে কোনো সহানুভূতি ছিল না, বরং অদ্ভুত এক কঠোর বাস্তবতা। “এই মহল শুধু দেয়াল নয়, এটা এক অভিশপ্ত ফাঁদ। যারা অহংকার করে ভেতরে প্রবেশ করে, তাদের আত্মা এখানকার অতৃপ্ত আত্মাদের খোরাক হয়। তোমার বন্ধু আর নেই, ওর শরীরের অস্তিত্ব মুছে গেছে, শুধু চিৎকারটা রয়ে গেছে এই ভাঙা দেওয়ালের ভেতর।” ঈশা অনুভব করছিল, সরস্বতীর প্রতিটি শব্দ যেন তার বুক চেপে ধরছে। তার মনে হচ্ছিল—এটা কোনো স্বপ্ন নয়, রূপম সত্যিই এই মহলের অন্ধকারে বন্দি হয়ে গেছে।

মহেন্দ্র, যিনি এতক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব দেখছিলেন, হঠাৎ ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন—“আমি আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে চাই না। এটা পাগলামি! আমরা বাঁচব না যদি এখান থেকে না যাই।” তার চোখে আতঙ্ক স্পষ্ট, হাত কাঁপছে, যেন মুহূর্তে দৌড়ে পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঈশা দাঁড়িয়ে গেল দৃঢ়ভাবে। তার চোখে অশ্রু ঝলমল করলেও সেখানে ভয়ের চেয়ে বড় ছিল এক অদ্ভুত সংকল্প। সে বলল—“না, আমি পালাব না। আমি জানি, রূপম এই মহলের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে, কিন্তু আমি তাকে ফেলে যেতে পারব না। এত সহজে কাউকে আত্মা গ্রাস করতে দিতে পারি না।” মহেন্দ্র বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাল, যেন ঈশা এখন আর সাধারণ মেয়ে নয়, বরং এক যোদ্ধা, যে অভিশপ্ত অন্ধকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তৈরি। সরস্বতী মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললেন—“সত্য জানতে চাইলে তোমাকে সব হারাতে হবে। ভয় পেলে বাঁচবে না, কিন্তু সত্য খুঁজলে তুমি হয়তো এমন কিছু দেখতে পাবে, যা মানুষের চোখে দেখা উচিত নয়।” ঈশা উত্তর দিল না। তার হৃদয়ে এখন কেবল একটাই জেদ—অন্ধকারকে ভেদ করে রূপমকে ফিরিয়ে আনার। বাইরে বাতাসে গাছ কাঁপছিল, রাতের শীতলতা আরও ঘন হচ্ছিল, আর সেই সাথে মহলটা যেন নতুন করে তার ভেতরের রহস্য উন্মোচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঈশা জানত—এখন আর ফিরে আসা সম্ভব নয়, কারণ রূপমের চিৎকার এখনো তার কানে বাজছে। সেই চিৎকারই তাকে অন্ধকারের গভীরে নামতে ডাক দিচ্ছে।

১০

পূর্ণিমার আলোয় নদীর বুক জোয়ারের উচ্ছ্বাসে ভরে উঠেছিল, যেন আকাশের সমস্ত আলো একসাথে নেমে এসেছে জলে। সেই রাতে ঈশার বুকের ভিতরও এক অদ্ভুত আলোড়ন ছিল, ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে এক অদম্য টান। মহলটির দিকে তাকিয়ে সে অনুভব করছিল, যেন তার নাম ধরে কেউ ডাকছে—শুধু শোনা যায় না এমন ডাক, কিন্তু হাড়ের গভীরে বেজে ওঠে। নৌকার ওপর দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল, মহলের প্রতিটি খোদাই করা দেওয়াল আর ভাঙা বারান্দা রুপোলি আলোয় ঝলমল করছে, অথচ সেই সৌন্দর্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক চিরন্তন অন্ধকার। জলের ভিতরে মহলের প্রতিবিম্ব যেন আরও জীবন্ত, আরও অস্থির। মহেন্দ্র মাঝি তখন আর কথা বলছিল না, তার চোখ ভয়ে স্থির হয়ে ছিল নদীর ঢেউয়ের দিকে, যেখানে অদ্ভুত ঘূর্ণি তৈরি হচ্ছিল। ঈশা জানত, তাকে ভেতরে যেতেই হবে—যেন তার ভাগ্যই এভাবে লেখা ছিল। নৌকার গা ঘেঁষে নদী কেঁপে উঠল, আর ঈশা ধীরে ধীরে ভেতরে পা রাখল, মনের গভীরে টের পেল—এটাই শেষ রাত, এ ডাক এড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব।

ভেতরে ঢুকতেই সময় যেন অন্যভাবে বয়ে যেতে লাগল। মহলের অন্ধকার করিডরগুলো একে একে আলোকিত হতে থাকল, অথচ আলোটা আসছিল না প্রদীপ থেকে, বরং জল থেকেই। ফোঁটা ফোঁটা করে দেয়ালের গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল, আর সেই জলের ভিতরে ভেসে উঠছিল মুখ—অগণিত মুখ, যাদের চোখে শূন্যতা। হঠাৎ ঈশা দেখল, তার চোখের সামনে রূপম দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সে আর আগের মতো নয়; তার শরীর আধা স্বচ্ছ, যেন কেবল প্রতিচ্ছবি, জলে গড়া এক ছায়া। রূপম হাত বাড়াল, ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কোনো শব্দ বেরোল না। ঈশা বুঝল, সে আর মুক্ত নয়—সে বন্দী এই অভিশপ্ত মহলের জলে। তার পেছনে ধীরে ধীরে আরও মুখ ভেসে উঠল—যারা হারিয়ে গিয়েছিল, যাদের আর কোনোদিন খোঁজ মেলেনি। তাদের সবার ছায়া বন্দী হয়ে আছে এই জলমহলের বুকের ভেতর, যেন জীবিত আর মৃতের মাঝামাঝি এক দমবন্ধ করা অবস্থায়। ঈশার বুক কেঁপে উঠল, কিন্তু একই সঙ্গে তার মনে হলো—এই সত্যি প্রকাশ পাওয়া খুব দরকার, যাতে কেউ আর অকারণে এই অভিশপ্ত প্রাসাদের টানে না আসে। নদী তখন বাইরে গর্জন করছে, যেন সে-ও জানে ভেতরে কী ঘটছে।

ঈশার চোখে তখন মহলটা আর প্রাসাদ মনে হচ্ছিল না; সে যেন এক বিশাল জীবন্ত দেহ—দেওয়ালগুলো তার হাড়, করিডরগুলো শিরা-উপশিরা, আর প্রতিটি কক্ষ একেকটা বদ্ধ অঙ্গ যেখানে বন্দী আত্মারা শ্বাস নিতে চায়। পূর্ণিমার আলোয় পুরো প্রাসাদ এক শ্বাস নিচ্ছে, আর প্রতিটি ঢেউ তার ডাক বয়ে আনছে। ঈশা বুঝতে পারল, মহল কেবল স্থাপত্য নয়—এ এক অভিশপ্ত সত্তা, যার ক্ষুধা হলো মানুষ, যার বেঁচে থাকার শক্তি হলো তাদের ভয় আর স্মৃতি। সে চেষ্টা করল রূপমকে ছুঁতে, কিন্তু আঙুলের ডগা কেবল জল ছুঁয়ে গেল। রূপমের চোখে এক গভীর অনুনয় ছিল, যেন বলছে—এই ডাক থেকে বাঁচো, নইলে তোমাকেও বন্দী করে ফেলবে। ঈশার চোখে জল নেমে এলো, তবু সে দৃঢ়ভাবে চারপাশের দৃশ্য মনে গেঁথে নিল। সে জানল, মহলের ডাক এড়ানো যায় না, কিন্তু সত্যকে বলা যায়। নৌকার দিকে ফিরে যেতে যেতে সে অনুভব করল, মহল তাকে টেনে নিতে চাইছে, প্রতিটি ঢেউ তার শরীর জড়িয়ে ধরছে। কিন্তু ঠিক শেষ মুহূর্তে, পূর্ণিমার আলোয় নদীর বুক যেন বিদীর্ণ হলো, আর ঈশা মুক্ত হয়ে ফিরে এলো—এক ভগ্ন, তবু জীবন্ত সাক্ষী হয়ে, যে জানে জলমহল একদিন আবার ডাক দেবে, আর কেউ না কেউ সেই ডাকে সাড়া দেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *