সৌম্য বসাক
১
বর্ষার প্রথম বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে আকাশের বুক ফুঁড়ে যখন জলধারা নেমে আসে, তখনই পুরো গ্রাম যেন কেঁপে ওঠে সেই আওয়াজে। চারিদিকে গাছের পাতার ফাঁকে জমে থাকা ফোঁটা ঝরে পড়তে থাকে, কাদামাটি ভিজে যায় আর ছোট ছোট খালবিলগুলো ফুলে ওঠে। ঠিক তখনই, গ্রামের প্রাচীনতম স্থান—শিবতলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মা মহামায়ার মন্দিরটিকে ঘিরে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। মন্দিরের গর্ভগৃহ, যেখানে বছরের পর বছর দেবীর কালো পাথরের মূর্তি স্থাপিত আছে, বর্ষার প্রথম দিকেই জলে ভেসে যায়। মন্দিরের চৌহদ্দিতে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন দেখে—গর্ভগৃহের পাটাতন পর্যন্ত জলে ডুবে যাচ্ছে, আর জ্যোৎস্নার মতো দীপশিখা ম্লান হয়ে উঠছে সেই স্যাঁতসেঁতে আবছায়ায়। গ্রামের প্রবীণরা একে অশুভ সংকেত মনে করতে থাকে, কেউ কেউ তো সরাসরি বলে ওঠে—“দেবী কাঁদছেন, তিনি দুঃখিত।” অচিরেই এই কথা গুজবের মতো ছড়িয়ে পড়ে, এবং বৃষ্টিভেজা রাতটিকে আরও রহস্যময় আর ভয়ের করে তোলে।
পুরোহিত গোপাল চক্রবর্তী সেই মুহূর্তে মন্দিরে বসে আছেন, গায়ে ভেজা গামছা জড়িয়ে, হাতে ম্লান প্রদীপের আলো। বয়স তার প্রায় ষাট পেরিয়েছে, চোখে-মুখে অভিজ্ঞতার রেখা, তবু আজকের রাত যেন তাকে গভীর চিন্তার ভাঁজে ডুবিয়ে দিয়েছে। তিনি জানেন, এ ঘটনা নতুন নয়—প্রায় প্রতি বছর বর্ষার শুরুতেই গর্ভগৃহ জলে ভরে ওঠে, আর গ্রামবাসীরা আতঙ্কে গুজব ছড়িয়ে দেয়। কিন্তু এ বছর যেন কথার ছন্দ আরও ভিন্ন, আরও তীব্র। চারপাশের কিশোর-যুবকেরা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, কেউ বলে দেবী নাকি রুষ্ট হয়েছেন, আবার কেউ বলে—মূর্তির চোখ থেকে সত্যিই টলটলে জল গড়িয়ে পড়ছে। গোপাল নিজে সেই দৃশ্য দেখেননি, কিন্তু মানুষের মুখে মুখে শোনা কথা তার বুকের ভেতর কাঁপন ধরাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে দেবীর সেবায় তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন, আর আজ সেই দেবীই যদি সত্যিই কেঁদে ওঠেন, তবে তার ভক্তির অর্থ কী? তিনি নিঃশব্দে প্রদীপের সলতে ঠিক করতে করতে ভাবেন—এ কেবল প্রাকৃতিক ঘটনা, না কি এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো অলৌকিক শক্তি?
মন্দিরের বাইরের আঙিনা তখন বৃষ্টির জলে কর্দমাক্ত, আর মাটির গন্ধে ভিজে যাচ্ছে বাতাস। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে মিশে যাচ্ছে ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝিঁর গুঞ্জন, আর দূরের বজ্রপাতের কর্কশ গর্জন। কিন্তু এর মাঝেই গ্রামবাসীর চোখে-মুখে এক অজানা ভয়। নারীরা প্রদীপ জ্বালিয়ে, কপালে সিঁদুর মেখে মন্ত্রপাঠ করছে, শিশুদের বুক ধড়ফড় করছে—তারা মায়ের কাছে সুরক্ষা চাইছে। বৃদ্ধরা দোতলার বারান্দা থেকে তাকিয়ে থাকে, যেন শ্বাস আটকে রেখেছে। গোপালের বুকেও সেই আতঙ্ক ঢুকে পড়ে—কোনো এক গভীর প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়, “এ কি দেবীর অশ্রু? নাকি মানুষের কল্পনার খেলা?” চারদিকের রহস্যময় আলোছায়া, জলে ভেসে ওঠা প্রদীপের শিখা, আর ভয়ের গুঞ্জনে ভরা গ্রাম—সব মিলে সেই বর্ষার রাত হয়ে ওঠে এক চিরস্মরণীয় অন্ধকারের শুরু, যা গ্রামবাসীর জীবনে নতুন এক রহস্যের দরজা খুলে দেয়।
২
রাত তখন গভীর, চারিদিক নিস্তব্ধতায় আচ্ছন্ন। বাইরে বৃষ্টির ফোঁটা ছাদের টিনে টুপটাপ শব্দ তুলে চলেছে, মাঝে মাঝে বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানি আকাশ ছিঁড়ে ফেলছে। মন্দিরের ভেতর প্রদীপের আলো ম্লান হয়ে আসছে, গর্ভগৃহে ঘন অন্ধকার, অথচ সেই অন্ধকারেই যেন এক অদৃশ্য শক্তি প্রবাহিত হচ্ছে। পূজা শেষ হওয়ার পর অন্য সবাই বাড়ি ফিরে গেছে, কিন্তু হরনাথ তখনো মন্দিরে বসে আছে। যুবক বয়স, শরীরে শক্তি আছে, কিন্তু মনে কেমন এক টান তাকে আটকে রেখেছে। প্রতিদিন পূজা শেষ হলে সে প্রদীপ নিভিয়ে দেয়, দরজা বন্ধ করে চলে যায়, কিন্তু আজ কেন যেন বুকের ভেতর একটা অজানা কৌতূহল তাকে বেঁধে ফেলেছে। তার মনে হচ্ছে—কোনো এক রহস্য আজ তার সামনে খুলে যাবে। গর্ভগৃহে দেবীর মূর্তির সামনে বসে সে তাকিয়ে থাকে অন্ধকারে, চোখ জ্বলজ্বল করছে প্রদীপের আলোয়। দেবীর মুখের গাম্ভীর্য তাকে এক অচেনা ভয়ে গ্রাস করে, আর সেই ভয়ের সঙ্গে মিশে যায় এক অদ্ভুত ভক্তি। বাইরে বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তার বুকের ধুকপুকানি যেন মিলেমিশে যায়, আর সময় থমকে দাঁড়ায়।
ঠিক তখনই হরনাথ দেখতে পায়—দেবীর চোখের কোণে কিছু যেন ঝিলমিল করছে। প্রথমে ভাবে হয়তো প্রদীপের আলো, কিন্তু না, ওটা নিছক আলো নয়। ধীরে ধীরে একটা টলটলে ফোঁটা গড়িয়ে নামতে দেখে সে। ফোঁটা নিচে পড়তেই তার শরীর কেঁপে ওঠে—মূর্তির চোখ থেকে কি সত্যিই জল বেরোল? সে বিস্ময়ে, আতঙ্কে চেয়ে থাকে, আর দেখে—একটির পর একটি বিন্দু গড়িয়ে পড়ছে দেবীর গাল বেয়ে। মুহূর্তে তার ভেতর ভয়ের ঝড় বইতে থাকে। মনে হয়—এ কি দেবীর কান্না? সত্যিই কি মা মহামায়া ভক্তদের দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছেন? না কি এ কেবল কোনো প্রাকৃতিক ছল? তার মস্তিষ্ক দ্বিধায় ভরে ওঠে, তবু চোখ ফেরাতে পারে না। বুকের ভেতর ভক্তির ঢেউ, হাত জোড় করে প্রণাম করে ফেলে, কিন্তু শরীরের ভেতর ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। তার মনে হয়—আজ সে কোনো অলৌকিক ঘটনার সাক্ষী। মন্দিরের চারিদিকের নিস্তব্ধতায় তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্পষ্ট শোনা যায়, আর দেবীর মূর্তির সেই অশ্রুবিন্দু যেন নীরবে ভিজিয়ে দেয় হরনাথের হৃদয়। সে বুঝতে পারে—এই ঘটনা শুধু তার মনে রাখার মতো নয়, গ্রামবাসীর কাছে জানানো জরুরি।
ভোর হতে না হতেই হরনাথ গ্রামে গিয়ে সবাইকে ডেকে পাঠায়। তখনো আকাশ মেঘে ঢাকা, চারিদিকে বৃষ্টির ছিটে, কিন্তু গ্রামবাসীরা তার গলা শুনে ছুটে আসে। সে হন্তদন্ত হয়ে কাঁপা গলায় সবটা বর্ণনা করে—কীভাবে রাতের নিস্তব্ধতায় সে দেবীর চোখ থেকে টলটলে অশ্রু ঝরতে দেখেছে। কথা শেষ হতে না হতেই হৈচৈ পড়ে যায়। কেউ হা করে শোনে, কেউ অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে দেয়, আবার কারো চোখে-মুখে আতঙ্ক ফুটে ওঠে। বিনোদী বালা কেঁদে ফেলে—“আমি জানতাম, মা আমাদের দুঃখে কাঁদেন।” কৃষ্ণপদ হালদার অবশ্য বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে—“এ সব ভ্রম, অন্ধকারে আলোর ছলেই হরনাথ ভুল দেখেছে।” কিন্তু গ্রামবাসীর অধিকাংশই বিশ্বাস করতে শুরু করে—মা মহামায়া রুষ্ট হয়েছেন বা দুঃখে কেঁদে উঠেছেন। তারা ভিড় জমিয়ে মন্দিরে ছুটে যায়, কেউ প্রদীপ জ্বালে, কেউ ফুল ছড়ায়, আবার কেউ বলি দেওয়ার প্রস্তাব তোলে। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো গ্রাম গুঞ্জনে ভরে ওঠে—“দেবী কাঁদছেন, আমাদের বাঁচাতে হবে তাঁকে।” গোপাল চক্রবর্তী এই সব শোনার পর দ্বিধায় পড়ে যান, তাঁর দীর্ঘ পুরোহিত জীবনে এমন ঘটনা আগে শোনেননি, আর আজ প্রথমবার গ্রামবাসীর মধ্যে ভয়, ভক্তি ও কুসংস্কারের স্রোত একসঙ্গে বয়ে চলেছে। সেই বর্ষার সকালে, ভিজে কাদামাটির রাস্তায় দাঁড়িয়ে গ্রাম যেন এক নতুন রহস্যের জালে আটকা পড়ে যায়, আর হরনাথ হয়ে ওঠে সেই ভয়ের প্রথম সাক্ষী, যে তার নিজের চোখে দেখেছে দেবীর প্রথম কান্না।
৩
সকালের আলো যখন মেঘে ঢাকা আকাশ ভেদ করে মৃদু সোনালি রঙ ছড়িয়ে দিল, তখনই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে দেবীর কান্নার খবর ছড়িয়ে পড়ল। বৃষ্টিভেজা উঠোনে দাঁড়িয়ে, কাদামাটির গন্ধে ভরা পরিবেশে গ্রামবাসীরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা শুরু করল। কেউ বলল—“এ যে মহাদুর্যোগের সংকেত, দেবী কেঁদে উঠেছেন মানেই গ্রামে বিপদ আসছে।” অন্যেরা বিশ্বাস করল—দেবী ভক্তদের দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছেন, তাই তিনি অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন। এই বিশ্বাসে তারা আরও বেশি করে প্রদীপ জ্বালাতে লাগল, ফুল ছড়াতে লাগল, আর গর্ভগৃহের সামনে মাথা ঠেকিয়ে প্রার্থনা করতে থাকল। নারীরা উলুধ্বনি দিয়ে মন্দির ভরিয়ে তুলল, বৃদ্ধরা কপালে সিঁদুর মেখে দেবীর নাম জপ করতে লাগল। কিন্তু ঠিক এই বিশ্বাসের বিপরীতে, গ্রামের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণপদ হালদার তর্ক তুলল। গলায় দৃঢ়তা এনে সে বলল—“এ সব কুসংস্কার। দেবী কাঁদেন না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো প্রাকৃতিক কারণ আছে। জল জমছে, ফোঁটা পড়ছে, আলো-অন্ধকারে মানুষ ভুল দেখছে। ভয়ের কিছু নেই।” তার যুক্তি কেউ মেনে নিল, কেউ আবার বিদ্রুপ করে বলল—“তুমি টাকা-পয়সায় বড়লোক হয়েছ, তাই বিশ্বাস নেই দেবীর শক্তিতে।” এভাবেই গ্রাম দু’ভাগে বিভক্ত হতে শুরু করল—বিশ্বাসীরা একদিকে, আর সন্দেহীরা অন্যদিকে।
বিনোদী বালা, যিনি দীর্ঘদিন ধরে মন্দিরে দিন কাটান, তিনি কিন্তু পুরোপুরি ভক্তির আবেগে ডুবে গেলেন। নিজের জীবনযন্ত্রণা, বিধবার নিঃসঙ্গতা, আর অনন্ত দুঃখকষ্টের মাঝেই তিনি দেবীর অশ্রুকে নিজের সান্ত্বনা হিসেবে দেখলেন। ভিজে শাড়িতে কাঁপতে কাঁপতে তিনি মূর্তির সামনে বসে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন—“মা, তুমি আমাদের কষ্ট বুঝতে পারছ, তাই কাঁদছ।” তাঁর চোখের জল মিশে গেল দেবীর চোখ থেকে ঝরা টলটলে ফোঁটার সঙ্গে। তাঁর কান্না দেখে আশেপাশের নারীরাও ভেঙে পড়ল আবেগে, তারা আরও বেশি করে পূজা করতে লাগল, দুধ, মধু, কলা, ফুল নিয়ে আসতে লাগল। অন্যদিকে কৃষ্ণপদ দাঁড়িয়ে রইল মন্দিরের বারান্দায়, চোখে কড়া দৃষ্টি, যেন বলতে চাইছে—“এইসব নাটকের কোনো মানে নেই।” তার কথায় অনেক তরুণ প্রভাবিত হলেও, অধিকাংশ মানুষ আবেগে ভেসে যাচ্ছিল বিনোদীর পাশে। গোপাল চক্রবর্তী মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন, দু’পক্ষের কথা শুনে তিনি নিজের ভেতরে দ্বিধার ঝড় অনুভব করলেন। পুরোহিত হিসেবে তিনি দেবীর অলৌকিক শক্তিকে অস্বীকার করতে পারেন না, আবার যুক্তিবাদী কৃষ্ণপদের কথাও অগ্রাহ্য করতে পারছেন না।
ক্রমে ক্রমে এই বিভাজন গ্রামজীবনে এক অস্থিরতা ছড়িয়ে দিল। বাজারে, চায়ের দোকানে, ধানের খেতে—যেখানেই মানুষ জড়ো হচ্ছিল, সেখানেই দেবীর কান্না নিয়ে বিতর্ক শুরু হচ্ছিল। অনেকে বলছিল—“এবার বন্যা আসবে, দেবী তাই আগাম সতর্ক করেছেন।” কেউ বলছিল—“না, মা আমাদের রক্ষা করবেন, এ তাঁর আশীর্বাদ।” আবার কেউ কেউ কৃষ্ণপদের মতো বলছিল—“এ কেবল পাথরের ফাটল, জলের চুঁইয়ে পড়া, এর বেশি কিছু নয়।” কিন্তু গ্রামবাসীর আবেগ, ভয় আর বিশ্বাস এতটাই তীব্র হয়ে উঠল যে যুক্তির কণ্ঠস্বর ম্লান হয়ে গেল। ছোট ছোট শিশুরা ভয় পেয়ে রাতে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরত, যুবকেরা অকারণ আতঙ্কে অস্ত্র মজুত করতে লাগল, আর নারীরা প্রতিদিন আরও দীর্ঘ সময় মন্দিরে প্রার্থনা করত। বিভাজনের এই আগুন যেন গোটা গ্রামকে ঘিরে ফেলল, যেখানে বিশ্বাস আর সন্দেহ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। আর গোপাল চক্রবর্তী, মন্দিরের পুরোহিত, রাতের আঁধারে নিঃশব্দে প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে ভাবতে লাগলেন—এই বিভক্তির মধ্যে দিয়ে কি সত্যিই দেবীর কোনো গোপন ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে? নাকি এটি মানুষের নিজের মন থেকে জন্ম নেওয়া ভয়ের প্রতিফলন মাত্র? উত্তর অজানা থেকে গেল, কিন্তু বর্ষার সেই দিনে গ্রামবাসী আর আগের মতো একসূত্রে বাঁধা রইল না—তারা বিভক্ত হয়ে পড়ল, আর সেই বিভাজনের রেখা তাদের জীবনকে রহস্যের দিকে ঠেলে দিল।
৪
গোপাল চক্রবর্তী সেদিন রাতে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে ছিলেন, হাতে ধূপের ছাই লেগে থাকা আঙুলে অকারণে শাঁখফুল ঘুরছিল। তিনি নিজ চোখে মূর্তির চোখ থেকে অশ্রু ঝরতে দেখেননি, তবুও গ্রামের উত্তেজনা তাঁর মনে ঝড় তুলেছিল। পূজারীর দায়িত্ব মানে শুধু প্রতিদিন নিয়মমাফিক আরতি আর নৈবেদ্য দেওয়া নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রজন্মের বিশ্বাস, পূর্বপুরুষদের আস্থা। ছোটবেলায় তাঁর দাদু তাঁকে বলেছিলেন—“দেবী কেবল পাথর নন, তিনি মানুষের ভাবনা, ভক্তির রূপ।” সেই কথাই কি আজ সত্যি হয়ে উঠছে? নাকি মানুষের কল্পনাই দেবীর চোখে জল দেখছে? গ্রামে কৃষ্ণপদ হালদারের মতো লোকেরা একেবারেই যুক্তিবাদী হয়ে বলছে—“এ সবই প্রাকৃতিক ঘটনা, হয়তো মূর্তির ভিতরে আর্দ্রতা জমেছে।” কিন্তু বিনোদী বালা আর মহিলারা একেবারে কেঁদে ফেলছেন—“দেখেছ, দেবী আমাদের দুঃখ ভাগ করে নিচ্ছেন।” গোপালের বুক কেঁপে ওঠে। ভক্তির সঙ্গে যুক্তির লড়াই চলতে থাকে তাঁর ভেতরে। একদিকে মনে হয়—দেবী যদি সত্যিই মানুষের কান্না বোঝেন, তবে এই ঘটনার মধ্যে কোনো অলৌকিক রহস্য আছে। আরেকদিকে আবার মনে হয়—একজন পূজারী হয়ে তিনি যদি অন্ধবিশ্বাস ছড়ান, তবে গ্রামের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে। এই টানাপোড়েনেই তাঁর চোখ লাল হয়ে যায়, কপালে ঘাম জমে ওঠে, আর অন্তরের গভীরে তিনি অনুভব করেন, তাঁকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
সেই রাতে গোপাল স্থির করলেন—এ রহস্যের মূলে যেতেই হবে। মন্দিরে একা থেকে তিনি শাঁখ বাজালেন, প্রদীপ জ্বালালেন, আর তারপর শান্ত হয়ে সিঁড়ির কোণে বসে রইলেন। বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, দূরে শেয়ালের হুক্কাহুয়া, আর বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ মিশে যাচ্ছিল। গ্রামের পুরুষরা বেশিরভাগই ঘুমিয়ে পড়েছে, কেবল কয়েকজন যুবক উৎসুক হয়ে দূর থেকে মন্দির চেয়ে দেখছে। গোপাল মনে মনে প্রার্থনা করলেন—“দেবী, তুমি যদি সত্যিই কাঁদো, তবে আমাকেই প্রমাণ দাও। আমি যদি ভুল করি, তবে প্রজন্মের পাপ হবে।” তাঁর বুকের ভেতরে দুরুদুরু কাঁপুনি, কিন্তু চোখে ছিল এক অদম্য সাহস। তিনি ঠিক করলেন—আজ রাত থেকে মন্দিরে প্রহরী বসানো হবে। হয়তো কোনো দুর্বৃত্ত লুকিয়ে এসে এই কান্নার নাটক সাজিয়েছে। হয়তো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে, যেমন মূর্তির ফাটলে জমে থাকা জল টপটপ করে ঝরে পড়ছে। কিন্তু তিনি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন না চোখে না দেখা পর্যন্ত। তাই গ্রামের দু’জন তরুণ, হরনাথ আর শ্যামলকে ডাকলেন প্রহরী হিসেবে। “রাতভর চোখ খোলা রাখবে, যদি কিছু দেখো সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাবে,” বললেন তিনি দৃঢ় কণ্ঠে। এই কথা শুনে হরনাথের চোখে আবার ভয়ের ঝিলিক দেখা গেল, কারণ সেদিন তো তিনিই প্রথম অশ্রু দেখেছিলেন।
রাত যত গভীর হতে লাগল, গোপালের ভেতরে দ্বন্দ্বও তত বাড়তে লাগল। প্রদীপের মৃদু আলোয় মূর্তির চোখদুটো যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠছিল। তিনি ভেবে পেলেন না—এ কি ভক্তির ছলনায় নিজের কল্পনাকে তিনি ভয় দেখাচ্ছেন, নাকি সত্যিই দেবীর দৃষ্টি তাঁকে বিদ্ধ করছে? মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল মূর্তির চোখ নড়ছে, আবার মুহূর্তেই তিনি বুঝতে পারছেন—এ কেবলই ক্লান্ত চোখের বিভ্রম। কিন্তু এই বিভ্রমই তো মানুষের বিশ্বাস গড়ে তোলে। তিনি জানতেন, যদি প্রমাণ মেলে যে দেবী সত্যিই কাঁদছেন, তবে গ্রামবাসীর ভক্তি হাজার গুণ বেড়ে যাবে, কিন্তু যুক্তিবাদীরা তাঁকে ভণ্ড বলে দোষারোপ করবে। আর যদি প্রমাণ মেলে সবই কুসংস্কার, তবে গ্রামবাসীর একাংশ তাঁকে দেবীর অবমাননাকারী ভাববে। এই দোটানাই যেন তাঁর বুক চেপে ধরছিল। তবু তিনি স্থির সংকল্পে দৃঢ় হয়ে বসে থাকলেন। বাইরে কুয়াশা নামছে, বাতাস ঠান্ডা হয়ে আসছে, আর সেই অন্ধকারে মূর্তির চোখে মাঝে মাঝে প্রদীপের আলো পড়ে সোনালি ঝিলিক দিচ্ছে—যেন রহস্যের গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গোপাল জানতেন, এখন থেকে তাঁর জীবন আর আগের মতো সরল থাকবে না। তিনি অজান্তেই এক অদ্ভুত পথে পা বাড়িয়েছেন, যেখানে ভক্তি, ভয় আর যুক্তি একসাথে হাত ধরে তাঁকে অন্ধকারে টেনে নিচ্ছে। এই রাত হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত হয়ে থাকবে।
৫
পরের রাতেই আবার মন্দিরের ভিতরে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। গোপাল চক্রবর্তী, হরনাথ আর শ্যামল মিলে প্রহরার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রদীপের ম্লান আলোয় সবাই চুপচাপ বসে ছিল। মাঝরাত পেরোতেই শ্যামলের গলা শুকিয়ে আসে, হরনাথ বারবার কপালে হাত বুলিয়ে ঘাম মুছতে থাকে। আর তখনই হঠাৎ দেখা গেল—মূর্তির চোখের কোণে টলটলে ফোঁটা জমছে, আর ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে নীচের গালে। গোপাল থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, বুকের ভেতরে কাঁপুনি, কিন্তু চোখ ফিরিয়ে নিলেন না। এবার তিনি নিজে স্পষ্ট দেখলেন জল ঝরছে। তাঁর মাথায় বজ্রপাতের মতো শব্দ হল—এ তো সত্যিই ঘটছে! সকাল হতেই এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। “দেবী কাঁদছেন!”—এই কথাটা যেন আতঙ্কের শাঁখ বাজিয়ে দিল। সকলে দলে দলে মন্দিরে ছুটে আসতে লাগল। কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না, কেউ আবার অশ্রুসিক্ত চোখে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে শুরু করল। গ্রামজুড়ে যেন হঠাৎ এক অজানা ভয়ের ছায়া নেমে এলো।
এই ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষজনের স্বাভাবিক জীবন একেবারেই বদলে গেল। মাঠে চাষ বন্ধ হয়ে গেল, কারও মনে কাজ করার ইচ্ছে রইল না। ভোরের আলো ফোটার আগেই মহিলারা ভিড় জমাতে লাগলেন মন্দিরে—কেউ হাতে দুধ, কেউ ফল, কেউবা নিজের সংসারের সামান্য চাল কিংবা সবজি নিয়ে আসছে নৈবেদ্য হিসেবে। পুরুষেরা হঠাৎ করেই ভয়ভক্তিতে বলি দেওয়া শুরু করল—কোথাও ছাগল, কোথাও মুরগি, কেউ আবার খাসি পর্যন্ত নিয়ে আসছে। গোপাল দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর হৃদয়ের এক অংশ বলছে—এইসব অন্ধবিশ্বাস ছড়ানো উচিত নয়, দেবীকে বলি দেওয়া তাঁর নিজের কাছে অশুচি কাজ। কিন্তু অপর অংশ আবার ফিসফিস করে বলছে—যদি সত্যিই দেবী রুষ্ট হন? যদি এই বলি দিয়েই মানুষের সর্বনাশ ঠেকানো যায়? তিনি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু গ্রামের জনতার আবেগ এত প্রবল যে তাঁর কথায় কেউ কান দিল না। বরং তাঁকেই অনেকে বলল—“তুমি পূজারী, তুমি যদি দেবীর ইচ্ছা অমান্য করো তবে বিপদ আরও বাড়বে।” কৃষ্ণপদ হালদার যুক্তির স্বরে বোঝানোর চেষ্টা করল—“এই সবই গুজব, মানুষের কল্পনা।” কিন্তু তার কথায় মানুষ চেঁচিয়ে উঠল—“তুমি নাস্তিক! দেবীর শক্তি নিয়ে ঠাট্টা করছ।” ফলে গ্রামে যুক্তিবাদীরা একেবারেই কোণঠাসা হয়ে গেল।
দিন গড়াতে না গড়াতেই গ্রামজুড়ে আতঙ্ক অগ্নিকুণ্ডের মতো ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেক ঘরে ঘরে আলো জ্বলে থাকল সারা রাত—লণ্ঠন, প্রদীপ, মোমবাতি, যা পাওয়া যায় তাই। শিশুরা ভয় পেয়ে মায়ের আঁচল আঁকড়ে ধরছে, বয়স্করা ফিসফিস করে বলছে—“নিশ্চয়ই বড় কোনো বিপদ আসছে। হয়তো মহামারী, হয়তো অকালমৃত্যু।” চাষের জমি খালি পড়ে থাকল, খালে-বিলে কেউ নামতে সাহস পেল না। গ্রামের পুকুরে মাছ ধরা বন্ধ হয়ে গেল, যেন জলও অশুভ হয়ে উঠেছে। মহিলারা দেবীর কাছে গীত গাইতে শুরু করলেন—কেউ কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমাদের সন্তানদের বাঁচিয়ে দাও মা।” এদিকে গ্রামের কিছু ধুরন্ধর লোক আবার সুযোগ নিতে শুরু করল। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলল—“দেবীকে শান্ত করতে হলে আরও নৈবেদ্য, আরও প্রদীপ, আরও বলি দরকার।” মানুষজন ভয়ে ভরে তাদের হাতে সামান্য যা ছিল তাই তুলে দিল। গ্রামের আবহাওয়া ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠল, আর সেই অস্থিরতার মাঝখানে গোপাল নিজেকে বন্দি বোধ করতে লাগলেন। তিনি জানলেন, এখন আর কেবল পূজারী নন—এখন তিনি এক ভয়ের কেন্দ্রবিন্দু, যার একেকটা সিদ্ধান্ত গ্রামের ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করবে। কিন্তু তিনি নিজেই জানতেন না, এই ভয়ের বিস্তারের মধ্যে সত্যি কোথায়, আর ভ্রম কোথায়।
৬
পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছিল। মন্দিরের গর্ভগৃহে দেবীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ার ঘটনাটি যেন এক অদৃশ্য শিকলে গ্রামকে বেঁধে ফেলেছিল। মানুষ আর মাঠে নামছিল না, ঘরে ঘরে আতঙ্কের পরিবেশ। কেউ বলছে মহামারী আসছে, কেউ বলছে খরা, আবার কেউ ফিসফিস করে ভবিষ্যদ্বাণী করছে—“গ্রামে বড় রক্তপাত হবে।” এই অচলাবস্থা দেখে কৃষ্ণপদ হালদার আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে গ্রামে সবচেয়ে যুক্তিবাদী মানুষ, পাটের ব্যবসা করে, শহরে ঘোরাফেরা করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। নিজের চোখে সে বহু মন্দির, বহু অলৌকিক গুজব দেখেছে—তার বিশ্বাস, সব কিছুরই কোনো না কোনো ব্যাখ্যা আছে। তাই এক সন্ধ্যায় পৈঠাঘরে গ্রামের কয়েকজনকে ডেকে বলল, “আমরা অন্ধকারে আছি কারণ বিজ্ঞানকে মানতে চাই না। আমি কালই পাশের শহর থেকে আমার এক পরিচিত ডাক্তারকে নিয়ে আসব। নাম অনির্বাণ দত্ত—শহরের বড় চিকিৎসক, বিজ্ঞানের আলোয় পড়াশোনা করেছেন। তিনি এলে হয়তো আসল কারণটা জানা যাবে।” অনেকে প্রতিবাদ করল—“ডাক্তার এসে দেবীর রহস্য বুঝবে নাকি? দেবী কি পরীক্ষাগারে ধরা পড়েন?” আবার কেউ কেউ নিঃশব্দে রাজি হয়ে গেল, অন্তত একটা চেষ্টা করা যাক। কৃষ্ণপদ পরদিন ভোরেই রওনা দিল শহরের দিকে।
দুদিন পর কৃষ্ণপদ গ্রামে ফিরল ডাক্তার অনির্বাণকে নিয়ে। লম্বাটে চেহারা, গায়ে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা, চোখে চশমা, হাতে ছোট্ট ব্যাগ। তাঁর মধ্যে শহুরে ভদ্রতার সঙ্গে একরকম দৃঢ়তা ছিল। গোপাল চক্রবর্তী প্রথমে একটু কুণ্ঠিত হয়ে এগিয়ে এলেন, কপালে প্রণাম নিয়ে বললেন—“ডাক্তারবাবু, আমরা তো দিশেহারা হয়ে আছি। যদি সত্যিই কোনো কারণ বোঝাতে পারেন তবে গ্রাম বাঁচে।” অনির্বাণ শান্ত স্বরে বললেন, “আমি চিকিৎসক, তবে বিজ্ঞানের ছাত্রও। কোনো কিছুই অকারণে ঘটে না, সব কিছুর পেছনে যুক্তি আছে। আমি চেষ্টা করব বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করতে। তবে আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস নাও হতে পারে—আমি দেবী বা অলৌকিকতায় বিশ্বাস করি না, আমি কেবল সত্যিটা খুঁজতে চাই।” তাঁর কথায় সঙ্গে সঙ্গে কোলাহল উঠল। গ্রামের মহিলারা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকল, কেউ কেউ বিড়বিড় করে বলল—“দেবীর অস্তিত্ব মানে না, এ মানুষটা বিপদ ডেকে আনবে।” বিনোদী বালা গলা উঁচিয়ে বলে উঠল—“এই ডাক্তার এলে দেবী আরও রুষ্ট হবেন। অশ্রু ঝরানো যে মায়ের শক্তি, তাকে বিজ্ঞানের চোখে দেখা মানে অপমান করা।” চারিদিকে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। কৃষ্ণপদ চেষ্টা করল বোঝাতে—“তোমরা ভয় পেয়ো না, সত্যিই যদি দেবী কাঁদেন তবে ডাক্তার কিছুই করতে পারবেন না, তবে যদি অন্য কারণ থাকে তবে তা জানা উচিত।” কিন্তু গ্রামবাসীর চোখে অনির্বাণ হয়ে উঠলেন এক অচেনা, সন্দেহজনক মানুষ।
সেই রাতেই অনির্বাণ মন্দিরে ঢুকে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলেন। হাতে টর্চলাইট, একখানা নোটবুক, আর কিছু কাঁচের শিশি ও কাপড়। তিনি মূর্তির চারপাশে হাঁটাহাঁটি করে দেখলেন, কোথাও ফাটল আছে কি না, গর্ভগৃহে জল ঢোকার কোনো রাস্তা আছে কি না। তাঁর চোখ ছিল সূক্ষ্ম, কোনো কিছুই এড়িয়ে যাচ্ছিল না। গোপাল, কৃষ্ণপদ, হরনাথ সহ আরও কয়েকজন নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু দূরে ভিড় করা সাধারণ মানুষ ক্রমেই উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছিল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলছিল—“এই ডাক্তার মূর্তিকে ছুঁলেই সর্বনাশ হবে।” হঠাৎ এক প্রবল বাতাস উঠল, প্রদীপের আলো দপদপ করে নিভে যাওয়ার উপক্রম হল। অনেকেই ভয়ে পিছু হটল। কিন্তু অনির্বাণ নির্বিকার মুখে টর্চের আলো মূর্তির চোখে ফেললেন, গামছা দিয়ে মুছলেন, তারপর কাপড়ে মুছে নিলেন ফোঁটাগুলো। তিনি ধীরস্বরে নোটবুকে কিছু লিখে নিলেন। তাঁর এই কাজ দেখে গ্রামবাসী আরও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠল। বিনোদী বালা দাঁত কিঁচিয়ে বলল—“এই লোক দেবীর চোখের জল মুছে ফেলছে! এটা মহাপাপ।” লোকজন গর্জন শুরু করল, কিন্তু অনির্বাণ নির্বিকার রইলেন। তিনি শুধু শান্ত স্বরে বললেন, “আমি এখনই কিছু বলতে পারব না। কয়েক রাত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তবে ভয় পাবেন না, সত্যিই যদি দেবী অশ্রু বিসর্জন করেন, তবে বিজ্ঞানও তাঁর শক্তিকে অস্বীকার করতে পারবে না।” তাঁর ঠান্ডা নিশ্চুপ ভঙ্গি মানুষের মনে আরও দ্বন্দ্ব তৈরি করল—কেউ হয়তো মনে মনে আশার আলো দেখল, আবার কেউ নিশ্চিত হল, এ মানুষই সর্বনাশ ডেকে আনবে। সেই রাতে গ্রামের আকাশে বাজ পড়ল, মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠল চারদিক, আর মন্দিরের গর্ভগৃহে আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলেন ডাক্তার অনির্বাণ—অলৌকিক আর যুক্তির মাঝখানে।
৭
ডাক্তার অনির্বাণ দত্ত গ্রামের মানুষের কৌতূহল ও সন্দেহের মাঝেই এক অচেনা উপস্থিতি হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি মন্দিরে ঢুকতেন, হাতে নোটবুক ও টর্চলাইট, আর নিঃশব্দে পর্যবেক্ষণ চালাতেন। গ্রামের মানুষ দূরে দাঁড়িয়ে দেখত, কেউ ভক্তিভরে প্রণাম করত, আবার কেউ ভয়ে পিছু হটত। সেই রাতেই তিনি লক্ষ্য করলেন, মন্দিরের দেয়ালে ও মূর্তির পেছনে অদ্ভুত স্যাঁতসেঁতে দাগ রয়েছে। টর্চের আলো ফেলতেই ঝকঝকে আর্দ্রতা দেখা গেল, যেন ভেতর থেকে জল বেরিয়ে আসছে। তিনি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখলেন, আঙুল ভিজে গেল, আর মাটির গন্ধমাখা একধরনের শীতলতা অনুভব করলেন। তখন তাঁর মনে হল, হয়তো গর্ভগৃহের ভেতরে লুকোনো কোনো ফাটল আছে, যার মধ্যে দিয়ে বাইরে থেকে বৃষ্টির জল ঢুকে জমা হচ্ছে, আর সেই জল কোনোভাবে মূর্তির মাথার ভেতর বা চোখের কাছে পৌঁছে বাইরে গড়িয়ে পড়ছে। যুক্তি অনুসারে ব্যাখ্যাটা সম্ভবপর মনে হল। তিনি নোটবুকে লিখলেন—“বৃষ্টির জল, ভেতরের ফাটল, স্যাঁতসেঁতে দাগ।” কিন্তু তাঁর ভেতরে আবারও এক অদ্ভুত দ্বিধা জেগে উঠল। যেটা তাঁর চোখে ধরা পড়েছে, সেটা সত্যি হলেও, গ্রামবাসীর চোখে দেখা অলৌকিকতা মুছে যাচ্ছে না। বিশেষ করে হরনাথের মতো সরল ভক্ত যেভাবে কেঁদে কেঁদে শপথ করে বলছে, সে নিজের চোখে মূর্তির চোখ থেকে জল পড়তে দেখেছে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
হরনাথের মুখশ্রীতে সেই রাতের ভয়ের ছাপ এখনও স্পষ্ট। মন্দিরের আঙিনায় বসে সে বলল, “আমি মিথ্যা বলছি না ডাক্তারবাবু, আমি একেবারে কাছ থেকে দেখেছি। প্রদীপের আলোয় দেখলাম—মায়ের চোখে জল জমেছে, তারপর সেটা গড়িয়ে নেমে এল গালে।” অনির্বাণ শান্তভাবে তার কথা শুনলেন, চোখ মেলে তাকালেন সেই কিশোর-যুবকের মুখে। হরনাথের চোখ দুটো ভিজে উঠছিল, সে বিশ্বাস করেছিল নিঃস্বার্থভাবে, সন্দেহের কোনো স্থান নেই। অনির্বাণ বুঝলেন, বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে হয়তো এই ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে, কিন্তু মানুষের ভক্তির গভীরতাকে এভাবে খারিজ করা সম্ভব নয়। তখন তাঁর মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি হল—সম্ভবত দুই সত্যিই একসাথে বিদ্যমান। হয়তো মন্দিরের ভেতরে ফাটল দিয়ে জল ঢুকছে, আবার সেই জলের প্রবাহই মূর্তির চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, যেন অলৌকিকতার আবরণে বিজ্ঞানের ছায়া লুকিয়ে আছে। কিন্তু এই চিন্তাধারা প্রকাশ করলেই গ্রামের মানুষ বুঝবে না, বরং আরও রুষ্ট হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে বিনোদী বালা, আরও কয়েকজন মহিলা তাঁকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। তারা মনে করত, ডাক্তার দেবীর অশ্রু নিয়ে ঠাট্টা করছেন, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা আসলে দেবীর অবমাননা।
এই দ্বন্দ্বময় পরিবেশে মন্দির যেন এক ভয়াল রহস্যের কেন্দ্র হয়ে উঠল। প্রতি রাতে মূর্তির চারপাশে আলো-অন্ধকারে দাগ দেখা যেত, টলটলে ফোঁটা জমত, আর গুজব রটত গ্রামের প্রতিটি ঘরে। শিশুরা কেঁদে উঠত, বৃদ্ধরা প্রার্থনা করত, যুবকেরা একদিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে থাকত, আবার অন্যদিকে অজানা ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ত। অনির্বাণ যতই স্যাঁতসেঁতে দাগ আর ফাটলের যুক্তি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন, গ্রামবাসী ততই তাঁকে অবিশ্বাস করতে শুরু করল। তাদের চোখে হরনাথের শপথই বড় সত্যি—কারণ সে ভক্তির সঙ্গে দেখেছে, বৈজ্ঞানিক চোখে নয়। এভাবেই গ্রামের ভেতরে দুই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল। একদিকে বিজ্ঞান আর যুক্তির আলো, অন্যদিকে অলৌকিকতায় মোড়া মানুষের আস্থা। মন্দিরের চারপাশে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আলো জ্বলে উঠত, প্রদীপে ভরে যেত চত্বর, আবার সেই প্রদীপের আলোতেই অদ্ভুত ছায়া নাচতে থাকত। সেই ছায়ার ভেতরে যেন অচেনা এক রহস্য হাতছানি দিত, আর ডাক্তার অনির্বাণ দাঁড়িয়ে থাকতেন—নিজের চোখের বিশ্বাস আর গ্রামের বিশ্বাসের মাঝখানে টানাপোড়েনে জর্জরিত। তাঁর মনে হচ্ছিল, হয়তো এই রহস্য কেবল বিজ্ঞান দিয়ে মাপা যাবে না, এখানে মানুষের ভক্তি, ভয় আর ইতিহাস মিলেমিশে তৈরি করেছে এমন এক আবরণ, যাকে উন্মোচন করা সহজ নয়।
৮
গোপাল চক্রবর্তী সেই রাতে ঘুমোতে পারলেন না। মন্দিরের বারান্দায় বসে তিনি চারদিকে তাকাচ্ছিলেন—আলো-আঁধারির খেলা, বৃষ্টির ফোঁটা টুপটাপ শব্দ করছে, দূরে কোথাও ব্যাঙ ডাকছে। অথচ তাঁর মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—এই কান্নার রহস্য কি সত্যিই দেবীর অলৌকিক শক্তি, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো অচেনা ইতিহাস? মনে পড়ল, তাঁর দাদামশাই প্রায়ই বলতেন—“এই মন্দিরের মূর্তির সঙ্গে রক্ত-অশ্রুর কাহিনি জড়িয়ে আছে।” কিন্তু কখনও তিনি খুঁটিয়ে জানতে চাননি। এবার সবকিছু গুছিয়ে বুঝতে চাইলেন। ভোরের আলো ফুটতেই তিনি বাড়ির এক কোণে লুকানো পুরোনো কাঠের সিন্দুক খুলে বসলেন। ভেতরে ছিল দলিল-দস্তাবেজ, মলিন কাগজ, আর ভাঙা-চোরা খাতা। সেখানে ধুলো জমে থাকা এক মোটা খাতা উল্টাতে গিয়ে তিনি খুঁজে পেলেন এক অদ্ভুত বিবরণ—যা লেখা হয়েছিল প্রায় একশো বছর আগে। চোখ কচলাতে কচলাতে তিনি পড়তে লাগলেন, আর প্রতিটি লাইন যেন তাঁর বুক কাঁপিয়ে তুলছিল। দলিলে লেখা ছিল—এই মন্দিরের দেবীমূর্তি গড়তে গিয়ে এক শিল্পী তাঁর প্রাণ-প্রিয় কন্যাকে হারিয়েছিলেন। মূর্তির গর্ভগৃহ খনন করার সময়, বর্ষার দিনে মেয়েটি হঠাৎ পুকুরে পড়ে যায়, আর তাকে আর উদ্ধার করা যায়নি। সেই দিন থেকেই শিল্পীর পরিবার বিশ্বাস করতে শুরু করে—দেবী নাকি তাঁদের বেদনা নিজের মধ্যে ধারণ করেছেন।
গোপাল দলিলটি আরও খুঁটিয়ে পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা ছিল, মূর্তি নির্মাণ শেষে প্রথম বর্ষার রাতে শিল্পী নিজেই নাকি দেখেছিলেন—মূর্তির চোখে অশ্রুবিন্দু জমে উঠছে। গ্রামে তখনই গুজব ছড়িয়ে পড়ে, দেবী কাঁদছেন শিল্পীর কন্যার জন্য। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই ঘটনা লোকমুখে কাহিনিতে পরিণত হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করতে শুরু করে—বর্ষার প্রথম জল পড়লেই দেবী কেঁদে ওঠেন, কারণ সেই জলই তাঁকে মনে করিয়ে দেয় ডুবে যাওয়া শিশুটির অকালমৃত্যুর কথা। গোপাল পড়ে শিউরে উঠলেন। এ কাহিনি তো কখনও তিনি কারও কাছে শোনেননি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, হয়তো এটাই সেই রহস্যের উৎস। গ্রামবাসীর ভক্তি, ভয়, আর কান্না সবকিছু মিলেমিশে শতবর্ষ ধরে এই কাহিনিকে অমর করে তুলেছে। তিনি মনের ভেতরে অনুভব করলেন, হয়তো বিজ্ঞান দিয়ে জল ঝরার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস আর ইতিহাসের ভার এত সহজে অস্বীকার করা যাবে না। তিনি টের পেলেন, তাঁর প্রজন্মের দায়িত্ব শুধু পূজা করা নয়, গ্রামবাসীর মন বোঝা, আর দেবীকে ঘিরে থাকা অচেনা কাহিনির সত্যি প্রকাশ করা।
কিন্তু এই কাহিনি প্রকাশ করলে কী হবে? গোপাল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। একদিকে ডাক্তার অনির্বাণ যুক্তির আলো নিয়ে রহস্য উন্মোচন করতে চাইছেন, অন্যদিকে গ্রামের মানুষ অলৌকিকতায় আঁকড়ে ধরে আছে। আর এই পুরোনো কাহিনি যদি শোনা যায়, তবে মানুষ আরও বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে উঠবে। কেউ বলবে, দেবী আসলেই কাঁদেন, আবার কেউ ভাববে, শিল্পীর কন্যার আত্মা মূর্তির ভেতরে বন্দি হয়ে আছে। গোপাল বুঝলেন, অতীত আর বর্তমান এখানে মিলেমিশে গেছে, এমন এক ছায়ায় ঢেকে গেছে গ্রাম যে সত্যি আর ভ্রম আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। তিনি রাতভর ভাবলেন—এই ইতিহাস তিনি কি ডাক্তার অনির্বাণকে জানাবেন, যাতে যুক্তির সঙ্গে লোককাহিনির সেতুবন্ধন তৈরি হয়? নাকি তিনি এটিকে গোপন রাখবেন, কারণ সত্যি প্রকাশ করলে গ্রামবাসীর ভয় আরও বেড়ে যেতে পারে? ভোরের আলোয় তাঁর চোখ লাল হয়ে উঠল, ক্লান্তি আর দ্বিধার ভারে দেহ ঝুঁকে পড়ল। তিনি বুঝলেন, “জলমগ্ন দেবী” কেবল মন্দিরের রহস্য নয়, বরং এক পরিবারের বেদনা, এক শিল্পীর আর্তনাদ, আর শতবর্ষের মানুষের বিশ্বাসের সমষ্টি। আর সেই গোপন কাহিনি এখন আবার বর্তমানের ঘটনার সঙ্গে মিলেমিশে যেন নতুন করে গ্রামবাসীর জীবনে ছায়া ফেলে দিচ্ছে।
৯
গ্রামের মন্দিরে অস্থিরতা তখন চরমে। মানুষজন দেবীর সামনে প্রদীপ জ্বালাচ্ছে, পাঁঠা বলি দিচ্ছে, মহিলারা কপালে সিঁদুর মেখে শপথ করছে—দেবীকে খুশি না করলে সর্বনাশ আসবে। এর মধ্যেই ডাক্তার অনির্বাণ দত্ত তাঁর অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দিনের পর দিন তিনি মন্দিরের ভেতরে, চারপাশে, ছাদে ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন। গ্রামবাসীর বিরক্তি বাড়ছিল, কিন্তু কৃষ্ণপদ তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন। অবশেষে এক ঝড়ো বৃষ্টির রাতে, যখন বাইরে বজ্রপাত হচ্ছে, অনির্বাণ তাঁর টর্চের আলোয় মূর্তির চোখের ভেতর তাকিয়ে হঠাৎ খুঁজে পান সূক্ষ্ম, প্রায় অদৃশ্য ফাটল। সেটি মূর্তির শিলার ভেতরে লুকোনো এক সরু ছিদ্র, যার ভেতর দিয়ে জল টপটপ করে গড়িয়ে নামছে। তিনি তৎক্ষণাৎ বুঝলেন—এটি কোনো অলৌকিক কান্না নয়, বরং প্রকৃতির এক নিখুঁত খেলা। মন্দিরের ছাদের পুরোনো ভাঙা অংশ দিয়ে জল ভেতরে ঢুকে সেই ছিদ্র দিয়ে বেরিয়ে আসছে। অনির্বাণ কাগজে-কলমে নকশা এঁকে পুরো প্রক্রিয়াটা ব্যাখ্যা করে ফেললেন। তাঁর চোখেমুখে তখন স্পষ্ট উজ্জ্বলতা—বছরের পর বছর যে কুসংস্কার মানুষকে অন্ধকারে রেখেছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তিনি হাতে পেয়েছেন।
কিন্তু এই সত্য উচ্চারণ করাটাই সবচেয়ে কঠিন ছিল। ভোরবেলা তিনি গোপাল চক্রবর্তী, কৃষ্ণপদ এবং মন্দিরের প্রহরীদের একত্রিত করে তাঁর আবিষ্কার জানালেন। প্রথমে গোপাল বিস্মিত হয়ে শুনলেন, তারপর মুখ ভার করে বললেন—“কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমি তো নিজ চোখে দেখেছি দেবীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। এটা কি তবে মিথ্যে?” অনির্বাণ ধৈর্য ধরে ব্যাখ্যা করলেন—“আপনি যা দেখেছেন, তা সত্যি। জল গড়িয়েই পড়ছে। কিন্তু উৎস দেবীর চোখ নয়, বরং ভেতরে জমে থাকা বৃষ্টির জল। প্রকৃতির নিয়মেই এই প্রবাহ ঘটছে।” গোপাল দ্বিধায় পড়লেন, কারণ এতদিন ধরে তিনি বিশ্বাস করতেন দেবী দুঃখে কাঁদছেন। কৃষ্ণপদ অনির্বাণকে সমর্থন করে বলল—“আমি তো দেখেছি, মন্দিরের দেওয়ালে কত ফাটল ধরেছে। হয়তো সেই পথেই জল ঢুকে।” প্রহরীরা কিন্তু এত সহজে মানতে চাইল না। তারা বলল—“আমাদের পূর্বপুরুষরা তো বলেছে দেবী বর্ষায় কেঁদে ওঠেন। এ কি তবে সব মিথ্যে?” অনির্বাণ স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন—“মিথ্যে নয়, বরং ভুল বোঝাবুঝি। প্রকৃতিকে দেবী রূপে কল্পনা করা আমাদের বিশ্বাসের অংশ, কিন্তু তার পেছনের কারণকে বিজ্ঞানের চোখে দেখলে ভয়ের কোনো স্থান থাকে না।” গোপাল মাটির দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন শতাব্দীর ভর কাঁধ থেকে নামাতে চাইছেন।
দিন গড়াতেই অনির্বাণের আবিষ্কারের খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে মানুষজন অবিশ্বাস করল, বলল—“ডাক্তার লোকটা দেবীকে অপমান করছে।” কেউ কেউ রাগে গর্জে উঠল—“দেবীর শক্তিকে অস্বীকার করলে সর্বনাশ আসবে।” কিন্তু ধীরে ধীরে কৃষ্ণপদ আর গোপালের বোঝানোর পর গ্রামবাসীরা মন্দিরে গিয়ে নিজে চোখে দেখল। অনির্বাণ সবার সামনে প্রদর্শন করলেন—ছাদ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টির জল তিনি একটি পাতলা নল দিয়ে মূর্তির চোখের ছিদ্র পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে দেখালেন, কেমন করে তা গড়িয়ে নিচে নেমে আসে। মুহূর্তেই সবার চোখ কপালে উঠল। তখন অনেকেই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, কেউ কেউ ঠোঁট কামড়ে বলল—“তাহলে দেবী সত্যিই কাঁদেন না?” অনির্বাণ শান্ত গলায় বললেন—“দেবী আমাদের বিশ্বাসে আছেন, তিনি আমাদের শক্তি দেন, আশীর্বাদ দেন। কিন্তু তিনি জলকণায় কাঁদেন না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলে।” সেই মুহূর্তে গ্রামের আকাশ যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন বজ্রপাত থেমে গিয়ে আলো ছড়িয়ে দিল। গ্রামবাসীরা বুঝতে শুরু করল—ভয় নয়, যুক্তিই মুক্তির পথ। গোপাল চক্রবর্তী মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে বললেন—“হয়তো এই-ই দেবীর আসল লীলা—আমাদের অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসা।” আর অনির্বাণ দত্ত দাঁড়িয়ে রইলেন নিশ্চুপ, জানতেন—আজকের দিনটি শুধু একটি রহস্য উন্মোচনের নয়, বরং বিশ্বাস আর বিজ্ঞানের দ্বন্দ্বে নতুন এক সমন্বয়ের সূচনা।
১০
গ্রামে সত্য উদ্ঘাটনের পরের দিনগুলো এক অদ্ভুত নীরবতায় ভরে ওঠে। এতদিন যে দেবীর চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলকে অলৌকিক কান্না বলে ভয় পেত, সেই রহস্যের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর অনেকের মনে ভাঙন দেখা দেয়। মহিলারা যাঁরা দেবীর সামনে কাঁদতেন, মনে করতেন দেবী তাঁদের দুঃখ বুঝছেন, তাঁদের চোখে জল আসে হতাশায়—“তাহলে আমরা কি ভুল বিশ্বাসে বেঁচে ছিলাম?” বয়স্ক মানুষরা মাথা নেড়ে বলেন—“আমাদের পূর্বপুরুষরা যা বলে গেছে, তাই ভেবেছিলাম সত্যি।” তরুণরা আবার হাসাহাসি করে বলে—“দেখলেন তো? দেবী নাকি কাঁদছিলেন! আসলে তো ভাঙা ছাদ দিয়ে জল ঢুকছিল।” কিন্তু এই বিভ্রান্তির মাঝেই গোপাল চক্রবর্তী নিজের ভেতরে ভীষণ এক দ্বন্দ্ব অনুভব করেন। তিনি জানতেন, অনির্বাণ যা বলেছেন তা সত্যি—তবু এই সত্যি কি তাঁদের ভক্তিকে মুছে দিতে পারে? তিনি গভীর চিন্তায় ডুবে মন্দিরে রাত কাটাতে শুরু করলেন। একদিন ভোরে গ্রামের মানুষদের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি শান্ত গলায় বললেন—“দেবীর কান্না যদি প্রকৃতির নিয়মও হয়, তবে কি তাঁর মধ্যে আমাদের অনুভূতি মেশে না? আমরা কেঁদেছি বলেই তো দেবীর চোখের জলে ভয়ের রঙ খুঁজে পেয়েছি। অলৌকিক হোক বা না হোক, দেবীর সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের যোগটাই আসল।”
গোপালের এই কথাগুলো গ্রামবাসীর মনে অন্যরকম সাড়া জাগায়। যারা হতাশ হয়েছিল, তারা ভাবতে শুরু করে—হ্যাঁ, দেবী হয়তো জল ফেলেননি, কিন্তু সেই জল তো তাঁদের মনের দুঃখকে প্রতিফলিত করেছে। নারীরা বলেন—“আমাদের চোখের কান্না যদি দেবীর চোখে প্রতিচ্ছবি হয়ে ফিরে আসে, তাতেই তো বিশ্বাসের শক্তি।” কৃষকরা বলে—“আমরা তো দেবীর কাছে শান্তি চাই, ফসল চাই, বৃষ্টির আশীর্বাদ চাই। যদি দেবী আমাদের মনে শক্তি দেন, তাহলেই তো যথেষ্ট।” ধীরে ধীরে ভয় আর হতাশার জায়গা দখল করে নেয় নতুন এক আলো। অনির্বাণও এই পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। তিনি ভাবেন—বিজ্ঞান রহস্য ভাঙতে পারে, কিন্তু মানুষের বিশ্বাসকে ধ্বংস করতে নয়, বরং তাকে নতুনভাবে দেখতে শেখাতে। তাই তিনি গ্রামের লোকদের বোঝাতে থাকেন—“প্রকৃতির নিয়ম বোঝার মধ্যেই দেবীর মহিমা আছে। তিনি আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন, যুক্তি দিয়েছেন—এটাই তাঁর আশীর্বাদ।” গোপাল পাশে দাঁড়িয়ে বলেন—“দেবীর সত্য কান্না হলো ভক্তির শক্তি, যা আমাদের একত্র করে।” তাঁর কথায় যেন গ্রামবাসীর মন থেকে ভয় সরে যায়।
কিছুদিনের মধ্যে গ্রামে এক নতুন পরিবেশ গড়ে ওঠে। মন্দিরে আর আতঙ্কে নয়, ভক্তিতে প্রদীপ জ্বলে। মানুষ আর বলি দেয় না, বরং ফুল আর প্রসাদে দেবীকে পূজা করে। নারীরা এসে মনের কথা বলেন, পুরুষেরা প্রতিজ্ঞা করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়বে। কৃষ্ণপদ খুশি হয়ে বলে—“দেবী আমাদের ভয় দেখাতে আসেননি, তিনি আমাদের যুক্তি আর ভালোবাসায় পথ দেখাচ্ছেন।” ছোটরা খিলখিল করে হাসতে হাসতে মন্দিরে খেলতে শুরু করে, আর প্রবীণরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে—“এই তো আসল শান্তি।” গোপাল মনে মনে উপলব্ধি করেন, দেবীর আসল শক্তি অলৌকিক কান্নায় নয়, বরং ভক্তির মিলনে, সাহসে, আর নতুন আলোয়। তিনি অনির্বাণকে ধন্যবাদ দেন—“তুমি আমাদের ভয় সরিয়ে জ্ঞানের আলো দেখিয়েছ।” অনির্বাণ মৃদু হেসে বলেন—“আমি শুধু পথটা দেখিয়েছি, কিন্তু পথ চলা আপনাদেরই।” ধীরে ধীরে গ্রাম আবার প্রাণ ফিরে পায়, আতঙ্কের জায়গায় ভর করে শান্তির ছায়া। দেবী যেন আর ভয়ঙ্কর নন, বরং মানুষের মনের গভীরের স্নেহময়ী প্রতিচ্ছবি। আর সেদিন সন্ধ্যায় মন্দিরের প্রদীপের আলোয়, গোপালের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় সেই চূড়ান্ত সত্য—“অলৌকিক হোক বা না হোক, ভক্তির শক্তিই দেবীর সত্য কান্না।” গ্রামের মানুষজন তখন মাথা নোয়ায়, আর তাঁদের চোখে জ্বলে ওঠে বিশ্বাসের নতুন আলো।
****




