মানিক সরকার
১
কলকাতার দক্ষিণে একটি পুরনো ফ্ল্যাটবাড়ির দ্বিতীয় তলায় যেন ছায়া জমেছে পরিবারজীবনের আকাশে। সঞ্জয় দত্ত, কর্পোরেট কনসালটেন্ট, সকাল ছ’টা বাজতেই নীল টাই পরা মুখে টেবিলে ব্রিফকেস নামিয়ে দিলেন। মুখে কোনও কথা নেই, চোখে ক্লান্তি। অন্যদিকে মৃণালিনী, তাঁর স্ত্রী, এক হাতে দুধ গরম করছেন আরেক হাতে ঐশীর টিফিন প্যাক করছেন, মুখে সেই একই বাক্য— “ঐশী, তাড়াতাড়ি করো না হলে স্কুল বাস মিস করবে।” ঐশী, ক্লাস নাইনের ছাত্রী, চোখ নামিয়ে ফোনে স্ক্রল করে যাচ্ছে। সকাল আটটা বাজতেই রূপক, নয় বছরের ছেলে, স্কুল ব্যাগ নিয়ে টিভির সামনে দাঁড়িয়ে, খবরের চ্যানেল দেখে গম্ভীর মুখে বলে, “আজ উত্তরবঙ্গে আবার বন্যা।” কেউ তার কথার গুরুত্ব দেয় না। রান্নাঘরের বেসিনে একটানা কলের শব্দ, বারান্দার বাইরে ডাস্টবিন ট্রাকের কাঁচ ভাঙা আওয়াজ—এই নিয়মমাফিক শহুরে জীবনচক্রে কারও হাসি নেই, কারও অভিমান নেই, শুধু ঘড়ির কাঁটা ঘোরে আর ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জীবনের রঙহীন দিনগুলো। সংসারে কোনো নাটক নেই, নেই তেমন ঝগড়াও—তবে একটা অদৃশ্য দেয়াল যেন জমে উঠছে, যেটা ছোঁয়া যায় না, কিন্তু সবাই টের পায়।
সন্ধ্যে নামলে এই দেয়াল আরও পুরু হয়ে ওঠে। সঞ্জয় অফিস থেকে ফিরেই সোফায় বসে খবরের কাগজে মুখ গুঁজে থাকেন। মৃণালিনী খেতে দেন, তারপর নিজেই নিঃশব্দে নিজের বইয়ের তাকে বসে পড়ে থাকেন। ঐশী তখন ফোনে ইনস্টাগ্রামে নতুন রিল বানানো শেখে, রূপক গল্পের বই পড়ে—বিশেষ করে প্রাণীদের নিয়ে তার অদ্ভুত আকর্ষণ। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে চোখাচোখি করে না, জিজ্ঞাসা করে না কেমন আছো? মনে হয় যেন এক বাড়িতে চারটে ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা একসঙ্গে থাকে। এক সন্ধ্যায়, চা খেতে খেতে মৃণালিনী বললেন, “ছুটিটা কাজে লাগিয়ে কোথাও গেলে কেমন হয়?” সঞ্জয় প্রথমে বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন, “তোমাদের যাও, আমি কাজ সামলাব।” কিন্তু পরদিন রাতে হঠাৎই বললেন, “জলদাপাড়া যাব আমরা।” চারটে মুখে একইসঙ্গে অবাক হয়ে প্রশ্ন ওঠে, “জলদাপাড়া?” গুগল ঘেঁটে ছবি বের করে ঐশী বলে, “খালি গাছ আর হাতি, নো নেটওয়ার্ক!” রূপক লাফ দিয়ে ওঠে, “সত্যি হাতি দেখা যাবে?” সঞ্জয় একবার হাসেন, অনেকদিন পর। পরদিন থেকেই শুরু হয় ব্যাগ গোছানোর প্রস্তুতি। রূপক তার বাইনোকুলার আর বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত বই গুছিয়ে রাখে, ঐশী ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও তিনটা জিন্স আর ফোন চার্জার ব্যাগে ফেলে। মৃণালিনী তাঁর পুরনো ডায়েরিটা বের করেন—যেটায় কখনও কবিতা লিখতেন। আর সঞ্জয়? সে শুধুই দেখে—এই ছোট প্রস্তুতির মধ্যেই যেন একটু একটু করে দাম্পত্যের ফাটলে নরম আলো পড়ছে।
যাত্রার দিন আসে। সকালবেলা শিয়ালদহ স্টেশন। ট্রেন ছাড়ে শিলিগুড়ির দিকে, জানালা দিয়ে দেখতে দেখতে যায়—কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি, পুকুরের ধারে গরু চরাচ্ছে এক বালক, আর দূরে দূরে জলভরা খেত। ঐশী প্রথমে মোবাইল দেখে, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তার নেটওয়ার্ক চলে গেলে সে এক রকম বিরক্ত হয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। রূপক মুখ গুঁজে বই পড়ছে—“সেভ দ্য এলিফ্যান্টস।” মৃণালিনী চুপচাপ বসে থাকেন, মাঝেমধ্যে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের পুরনো সঞ্জয়কে খোঁজেন। সঞ্জয় কাজের ফোন ধরছেন না, এই বিরল মুহূর্তে তিনি শুধু নিজের পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। দুপুরে রূপক একগাল হেসে বলে, “তোমরা জানো, জলদাপাড়ায় ‘হাতির করিডোর’ আছে? সেখানে হাতির দল মাইগ্রেট করে।” ঐশী হেসে বলে, “তোর তো হাতি দেখেই গলায় প্রেম।” রূপক জবাব দেয়, “প্রেম না, শ্রদ্ধা।” ঐ কথায় সবাই হেসে ওঠে। এতদিন পর প্রথমবার তারা একসঙ্গে হাসে, তাও কোনও বড় ঘটনার জন্য নয়—শুধু একটুকরো সহজ কথোপকথনে। ট্রেন চলতে থাকে, বাইরে ঘন সবুজ হয়ে আসে দৃশ্য, আর চারটি শহুরে প্রাণ একটু একটু করে ঢুকে পড়ে প্রকৃতির কোলে—এক নতুন ছবি আঁকার শুরুতে। এক জলছবির সূচনা।
২
ট্রেন উত্তরের দিকে ছুটছে, আর জানালার বাইরে দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। শহরের ধুলো-মাখা ইমারত, ব্যস্ত বাসস্ট্যান্ড, ফ্লাইওভারের নীচের দোকানপাট একে একে হারিয়ে যাচ্ছে। বদলে আসছে বিস্তৃত সবুজ ধানখেত, মাঝে মাঝে নারকেল গাছের সারি, দূরে নীলচে পাহাড়ের রেখা। ঐশী প্রথমে মুখ ভার করে বসে ছিল, ফোনে সিগন্যাল না থাকায় বিরক্ত হয়ে একবার পেছনে হেলান দিয়ে ছিল, কিন্তু ঘন্টাখানেক পর ধীরে ধীরে তার চোখ জানালার বাইরের দিকেই বেশি যেতে থাকে। সে চুপচাপ দেখে—এক বৃদ্ধা মাঠে ধান কাটছেন, দুই ছেলেমেয়ে নলকূপে গোসল করছে, একপাটি পাখি একসঙ্গে উড়ে গেল দূরের বাঁশঝাড় পেরিয়ে। ঐশীর অভ্যস্ত চোখ, এতদিন শুধু স্ক্রিনেই যেটুকু ছবি দেখেছে, আজ প্রথম প্রকৃতির পর্দায় এমন কিছু দেখে। পাশে বসে থাকা রূপক তখনও একটা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণমূলক বই পড়ছে, মাঝে মাঝে মাথা তুলে জানালার দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখলে ঐ পাহাড়টার নাম সম্ভবত ছোটো নীলগিরি।” কেউ তার জ্ঞানের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলে না, বরং সবাই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শিখছে ওর কৌতূহলকে। সঞ্জয় ট্রেনের টেবিলের ওপর কফির কাপ রেখে একটু চুপচাপ বসে আছেন, ফোন সাইলেন্টে, মুখে শান্ত একটা রেখা। এতদিন পর যেন তাঁর চারপাশের শব্দ, দৃশ্য, এবং নিঃশব্দতা—সবই জীবন্ত মনে হচ্ছে। মৃণালিনী জানালার ধারে বসে ডায়েরির পাতায় দু-একটা কথা লেখেন, বাতাসে চুল উড়ে আসে, চোখে একটা অপার প্রশান্তি।
দুপুর নাগাদ ট্রেন মালবাজার স্টেশনের কাছাকাছি পৌঁছলে চারদিকে ঘন বনভূমির আভাস স্পষ্ট হয়। রেললাইনের দুই পাশে শাল, সেগুন, মহুয়া আর বটগাছের সারি যেন হাত বাড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। এক জায়গায় ট্রেনের গতি কমে এলে রূপক হঠাৎ বলে ওঠে, “ঐ দেখো! একটা ময়ূর!” সবাই চমকে জানালার দিকে তাকায়—হ্যাঁ, সত্যিই, ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল ময়ূর, নীল পালক রোদে ঝিলমিল করছে। ঐশী, বিস্মিত চোখে দেখে, শব্দ না করেই হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় সেই দৃশ্যকে। কোনও ছবি তোলা হয় না, কোনও ভিডিও রেকর্ড হয় না—শুধু একটি মুহূর্তের জন্য প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে এক অনবদ্য সংযোগ তৈরি হয়। সঞ্জয় নিজেই বলেন, “আমরা তো কত কিছু মিস করি… ফোনের খোঁজে থাকতে থাকতে এইসব তো দেখি না কখনও।” মৃণালিনী সায় দিয়ে বলেন, “এইরকম একটা মুহূর্তের জন্যই না আসা উচিত?” ঐশী কিছু বলে না, কিন্তু তার চোখে যে বিস্ময়ের আলো জ্বলে উঠেছে, তা বলে দেয়—সে বুঝতে শুরু করেছে। ট্রেন আবার গতি পায়, জঙ্গলের ছায়া পেরিয়ে এক নতুন আলোয় ভেসে যায় জানালার কাঁচ। আর এই ভ্রমণের মধ্যেই যেন প্রতিটি সদস্যের ভিতরে ভিতরে শুরু হয়ে যায় এক অদৃশ্য পরিবর্তনের সূচনা—কোনও বড় ঘোষণা নয়, শুধু নিঃশব্দ এক সঞ্চার।
বিকেলের দিকে ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশনে পৌঁছলে নেমে পড়ে তারা। ছোট্ট, সাজানো স্টেশন, পেছনে পাহাড়ের ছায়া, বাতাসে জংলি ঘ্রাণ। স্টেশন চত্বরের বাইরেই তাদের জন্য অপেক্ষা করছে এক জিপ—যা নিয়ে যাবে জলদাপাড়া বন বাংলোর দিকে। শহরের ট্রাফিক, কংক্রিট আর কোলাহলের বাইরে এসে তারা যেন ধীরে ধীরে এক নতুন ছন্দে ঢুকছে। ঐশী, যিনি এখনো আধা অনিচ্ছায় এসেছেন, চোখের সামনে দূরের নরম আলোয় ভেজা পাহাড় দেখে চুপ করে থাকেন। রূপক জিপের জানালা দিয়ে মাথা বের করে হাত তুলছে বাতাসে। মৃণালিনী হালকা হেসে বলেন, “দেখো, কারোর হাসি আটকায় না এখানে।” সঞ্জয় জিপের পেছনের আসনে বসে স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে তাকিয়ে নিজের মধ্যে এক অপরিচিত প্রশান্তি অনুভব করেন—এই মুহূর্তে কোনও মিটিং নেই, কোনও ক্লায়েন্ট কল নেই, শুধু চারপাশে নিঃশব্দ বন আর মাঝখানে চারজন মানুষ, যারা একে অপরের হয়ে উঠছে নতুন করে। জিপ এগোয়, দূরে হাতির করিডোরের সাইনবোর্ড দেখা যায়। বাঁদিকে শুরু হয় ঘন অরণ্য। ঠিক তখনই রূপক বলে ওঠে, “জানো, হাতিরা ঠিক রাস্তা মনে রাখে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক পাথর দেখে তারা চিনে নেয় পথ।” ঐশী একবার তাকিয়ে বলে, “ওরা যদি পারে, আমরা তো আরও পারি… হয়তো।” জিপ চলে যায় বনের দিকে, সূর্য ঝুঁকে পড়ে শালগাছের মাথায়, আর তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় এক জলছবির ফ্রেমে—যার রঙ কেবল শুরু হয়েছে।
৩
বনবাংলোটি একেবারে অরণ্যের গহীন কোণে, চারপাশে সন্ন্যাসী শান্তি। কাঠের দালান, বড় বড় জানালা, আর লম্বা বারান্দা—মনে হয় যেন শতাব্দী প্রাচীন। এখানে কোনো শহরের অশান্তি নেই, শুধু প্রকৃতির গান, পাখির ডাক আর পাতার ফিসফিস। প্রথম রাতটা এখানেই কাটানোর প্রস্তুতি। সঞ্জয় আর মৃণালিনী একটু হতাশ, বনবাংলোটি অতি প্রাথমিক, টয়লেটও বাইরে, কিন্তু তারা জানে, প্রকৃতির কাছে এটাই যথেষ্ট। জানালার বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে, আর রাতের নিস্তব্ধতায় বনজীবনের কথা শোনা যাচ্ছে। রূপক উত্তেজিত, বারবার বারান্দায় বেরিয়ে আসছে, পাখির আওয়াজ শুনছে, ঝিঁঝিঁ পোকা আর কচ্ছপের মতো পশুদের চলাচল দেখে ভীষণ উচ্ছ্বসিত। ঐশী, যার মন পুরোপুরি শহরের যান্ত্রিক জীবনেই নিবদ্ধ, একটু বিরক্ত হয়ে মোবাইল নিয়ে বসে, কিন্তু কিছুতেই নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। সে প্রথমে বিরক্তি প্রকাশ করে, “এটা কী, একটা পুরনো যুগের গুহা?” তবে কিছু সময় পরই জানালার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে যায়। অনেকদিন পর প্রকৃতি এমন নীরব এবং গভীরভাবে তাকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
রাত্রির প্রথম খাবারটাও এখানে কিছুটা আলাদা। বনবাংলোর হালকা সাদা মাটির প্লেটে স্থানীয় মশলা দিয়ে তৈরি ভাত, তরকারি আর রুটি পরিবেশন করা হয়। সবাই একসাথে বসে খেতে খেতে একটু অবাক হয়, এতটাই সুস্বাদু যে তারা বুঝতে পারেনি কখন দুপুরের খাবারের ক্লান্তি ভেসে গেছে। সঞ্জয় মৃণালিনীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “প্রথমবার বনবাংলোতে এত ভালো খাবার খাচ্ছি!” মৃণালিনী স্বাভাবিকভাবে হাসেন, কিন্তু মনে মনে বুঝতে পারেন, খাবারের মধ্যে প্রকৃতির চিরন্তন উপহার রয়েছে—সবকিছু খোলামেলা, সরল, কিন্তু তাতে একটা নতুন অনুভূতি লুকিয়ে আছে। খাওয়া শেষে সবাই একত্রে বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সূর্য ডুবেছে, এবং দূরে সাগরপাড়ের পাহাড় থেকে রাতের হাওয়া এসে ঠাণ্ডা করে দেয়। রূপক কৌতূহল নিয়ে বলে ওঠে, “এখানে কি কিছু অদ্ভুত প্রাণী থাকে?” সুনীল দা, যিনি বন বাংলোর গাইড, হাসি হাসি বলেন, “এখানে কি জানো, রাত্রে জঙ্গলের ভিতর থেকে এমন কিছু আওয়াজ শোনা যায়, যেগুলো মনে হয়, বনের আত্মা কথা বলছে।” তাঁর এই কথায় চারপাশের নিঃশব্দতা যেন আরও গভীর হয়ে ওঠে। রাতের অন্ধকারে জঙ্গলের শব্দ, পাখির ডাক, প্রাণীর শব্দ—সব কিছু যেন এক মন্ত্রের মতো কাজ করতে থাকে। এক অজানা অনুভূতির মধ্যে সবাই নিজেদের হারিয়ে ফেলে।
রাত যত গভীর হতে থাকে, অরণ্যের চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি বিরাজমান। সঞ্জয় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলেন, “আমরা শহরের মানুষ… এতো দিন প্রকৃতিকে দেখিনি, অনুভব করিনি।” মৃণালিনী হালকা মাথা নেড়ে বলেন, “এটা আমাদের পেছনে ফেলা জীবন, এখন সামনে আসছে প্রকৃতির অমিত ভালোবাসা, শান্তি।” রূপক উত্তেজিত হয়ে বলে, “আজ রাতে যদি হাতি দেখি!” ঐশী, যিনি এখনো পুরোপুরি মোবাইলের আচ্ছন্ন, সবে বলে ওঠে, “তবে কি আমাদের হাতে কিছু ছবি তোলা হবে?” সঞ্জয় হেসে বলেন, “আজকের রাতটা শুধু আমাদের জন্য, ছবি তোলা কি ঠিক হবে?” এই রাতে, এই নিরব মুহূর্তে, তারা উপলব্ধি করে, জীবনের সত্যিকারের ছবি তোলার জন্য স্ক্রিনের চেয়ে প্রকৃতির গভীরতা বেশি জরুরি। রাত যখন আরও ঘন হয়ে আসে, তারা সবাই নিজের নিজের বিছানায় গা ঢালতে যায়, কিন্তু রাতে অরণ্য থেকে কিছু অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে। সঞ্জয় একটু চমকে ওঠেন, কিন্তু সেই শব্দে রহস্যের মতো কোনও ভয় কাজ করে না—এটা যেন জীবনের আসল সুরের অংশ, যা তার চারপাশে মিশে গেছে। মৃণালিনী চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রকৃতির বুকে সমর্পণ করেন, আর রূপক ঘুমাতে যেতে যেতে মনে মনে ভাবেন, “হাতি নিশ্চয়ই আসে।”
যত রাত গভীর হয়, ততই বনবাংলোতে অদ্ভুত এক শান্তির ছোঁয়া আসে। সঞ্জয় জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে। দূরে গভীর জঙ্গলের অন্ধকার, কিছু পাখির ঠান্ডা ডাক, আর হালকা বাতাসের শ্বাস—এ যেন এক আলাদা পৃথিবী। এই পৃথিবী, যা কেবল প্রকৃতির কোলে নয়, সম্পর্কের টানও গভীর করে দেয়। বনবাংলোতে তাদের প্রথম রাতটা যেন এক অনন্ত সময়ের শুরু। সেই রাতেই তারা বুঝতে পারে, একদিন এই অভিজ্ঞতা স্মৃতির পাতায় স্থান পাবে, আর সেই স্মৃতি তাদের জীবনের হারানো মুহূর্তগুলো ফিরিয়ে আনবে।
৪
পরদিন খুব সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে রূপকের। সে জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়—বাইরে সূর্যের হালকা আলো গাছের পাতায় পড়ে ঝিলমিল করছে, আর কোথাও একটা টিকটিকি ডাকছে বিরামহীন। অন্য ঘর থেকে ঐশীর বিরক্ত গলা শোনা যায়, “রাতের পর ঘুমটুকুও ঠিকমতো হল না!” কিন্তু মৃণালিনী ততক্ষণে হালকা কফির কাপ হাতে বারান্দায় বসে পড়েছেন। সঞ্জয় অ্যালার্ম ছাড়াই জেগে গেছেন আজ। সকালটা যেন অন্যরকম। ঠিক আটটার সময়, কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধাপে ধাপে উঠে আসে একজন মাঝবয়সী মানুষ, পরনে হালকা খাকি জামা-প্যান্ট, পিঠে একটা পুরনো ঝোলা, মুখে রোদে পোড়া তামাটে গাম্ভীর্য, চোখে এক ধরনের প্রাচীন শান্তি। তিনিই সুনীল দা—জলদাপাড়ার অভিজ্ঞ গাইড এবং বনকর্মী। তাকে দেখে প্রথমেই রূপক ছুটে যায়, “আপনি কি হাতি দেখাতে পারবেন?” তিনি হেসে বলেন, “হাতি দেখাবে বন, আমি শুধু পথ দেখাব।” সেই প্রথম কথাতেই পুরো পরিবার বোঝে—এই মানুষটির সঙ্গে পথ চলা শুধু গাইডিং-এ সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে যুক্ত আছে অভিজ্ঞতা, আত্মিকতা এবং প্রকৃতির নির্ভেজাল ভালবাসা।
নাশতা সেরে সবাই সুনীল দা-র নেতৃত্বে হাঁটতে শুরু করে। জলদাপাড়ার অরণ্য যেন জাগ্রত হয়েছে—দূরে দূরে বাঁশঝাড়ের ফাঁকে হরিণদের দেখা যায়, গাছে বসে আছে রাঙা টিয়া, আর পায়ের নিচে পড়ে থাকে শুকনো পাতা। সুনীল দা চলতে চলতে বলেন, “এই অরণ্য আমার স্কুল… আমি এখানেই পড়েছি, এখানেই শিখেছি, হাতি দেখেছি আর ভালোবাসতে শিখেছি।” রূপক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, আর ঐশী প্রথমবার মোবাইল না ছুঁয়ে তার কথা শুনছে। হেঁটে হেঁটে পৌঁছানো হয় একটি বড় পুকুরঘাটে, যেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে বুনো হাতির পায়ের ছাপ। সুনীল দা বলেন, “রাতের বেলায় এখানেই আসে বাহাদুরের দল। চেনা হাতির নাম বাহাদুর, সে এখন আর দল নিয়ে চলে না, একা থাকে।” ঐশী এবার প্রশ্ন করে, “একটা হাতি একা থাকে? কেন?” সুনীল দা একটু থেমে বলেন, “বহু বছর আগে তার মাকে শিকারিরা মেরে ফেলে। তারপর থেকে সে শুধু বনরক্ষীদের চেনে, বাকি কারও কাছে আসে না।” কথাটা বলার সময় তার গলার কম্পন স্পষ্ট—প্রাণীর গল্প যেন একটা নিখুঁত মানবিক ট্র্যাজেডি। রূপক গভীর মনোযোগে শোনে, সে যেন প্রথমবার বুঝতে শুরু করেছে প্রকৃতির ভেতরের দুঃখকথা। ঐশী চুপ করে মাথা নিচু করে—এই গল্প তাকে স্পর্শ করেছে।
চলতে চলতে তারা আরও গভীরে যায়। সুনীল দা মাঝে মাঝে গাছ ছুঁয়ে বলেন, “এই শালগাছ পাঁচশো বছরের পুরোনো, একে ছুঁয়ে কিছু চাইলে, বনভূমি শুনতে পায়।” কথাগুলো শোনার পর মৃণালিনী নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকা কিছু অনুভূতি অনুভব করেন—যেন এই গাছ তার অব্যক্ত কথা শুনতে পাচ্ছে। সঞ্জয় তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, “আজকাল সব কিছুতেই দাম থাকে, কিন্তু এই গাছ, এই অরণ্য তো আমাদের কিছু না নিয়েই দিয়ে যাচ্ছে শান্তি।” ঐশী বলল, “শান্তি… হ্যাঁ, এটা কিছুটা সেইরকম।” সে নিজেই অবাক হয় এমন কথা বেরিয়ে এসেছে দেখে। হঠাৎ একটা ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে তারা দেখে, দূরে এক বড় বুনো মহিষ দলছুট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুনীল দা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, “চুপ… প্রকৃতি কখনো হইচই পছন্দ করে না।” সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সেই নিরবতার মধ্যে বনের নিঃশ্বাস শোনা যায়, পাখার ঝাপটানি, দূরের হরিণের ছোট দৌড়। ঐশী ধীরে মোবাইল তুলে ক্যামেরা অন করে, কিন্তু হঠাৎ নিজের ইচ্ছেতে সেটি অফ করে ফেলে। সে বুঝে গেছে, কিছু দৃশ্য শুধু চোখ দিয়ে দেখার, হৃদয় দিয়ে রাখার। রূপক আস্তে বলে, “এই মুহূর্তটা আমি কোথাও লিখে রাখব।” সুনীল দা মুচকি হেসে বলেন, “তোমরা ধীরে ধীরে বনকে ভালোবাসতে শিখছো, আর বন কখনো কারও ভালোবাসা ফেরায় না।” এই একটা দিনের হাঁটা, কিছু শব্দ, কিছু নীরবতা—তাদের পরিবারের ভিতর অনেক কিছুকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। আর তারা বুঝতে পারে, এই ভ্রমণ শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়—এ এক জীবনবোধ শেখার পথ।
৫
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙে সবার। আজ তাদের প্রথম জিপ সাফারি। বাইরে রোদ ওঠার আগেই হালকা কুয়াশার চাদরে মোড়ানো বন যেন ঘুমন্ত দৈত্যের মতো বিশাল আর গম্ভীর। জিপ প্রস্তুত, চালকের পাশে বসেছেন সুনীল দা, আর পেছনে সারিবদ্ধভাবে বসে পড়েছেন সঞ্জয়, মৃণালিনী, রূপক ও ঐশী। গাড়ির ইঞ্জিনের হালকা গর্জন ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। বন যেন নিঃশব্দতা পেয়ে ভেতরে ভেতরে কথা বলছে। জিপের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা ঘাস আর গাছের ফাঁক দিয়ে আলো পড়তে শুরু করে। প্রথমেই চোখে পড়ে একজোড়া হরিণ—মাথা তুলে সোজা তাকিয়ে আছে তাদের দিকে, তারপর নিঃশব্দে পালিয়ে যায়। রূপক উত্তেজিত গলায় বলে ওঠে, “চিতা থাকবে আজ?” সুনীল দা হেসে বলেন, “চিতা যদি তোমাকে দেখতে চায়, তবেই তুমি দেখতে পাবে।” এই গভীর কথাটা ঐশীকে কিছুটা থমকে দেয়—এখন তার মনেও যেন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, শুধু দেখার লোভ নয়, প্রকৃতিকে অনুভব করাটাই আসল।
জিপ গভীর অরণ্যে প্রবেশ করলে সূর্যের আলো পাতার ফাঁকে ফাঁকে এসে পড়ে। চারপাশে শাল আর সেগুনের ঘন জঙ্গল, কোথাও কোথাও বাঁশঝাড়ের মাঝে একটা চওড়া পথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। হঠাৎ করেই ডান দিকে দেখা যায় একটা ময়ূর তার পেখম মেলে নেচে উঠেছে। ঐশী, যার অভ্যাস ছিল মোবাইল তুলে ভিডিও করা, এখন নিজের চোখ দিয়েই পুরো দৃশ্যটা গিলে নিতে চায়। সে বলে না, ছবি তোলে না—শুধু চুপচাপ দেখে যায়। রূপকের চোখে বিস্ময়, সে বাবা-মায়ের হাত চেপে ধরে বলে, “এটা স্বপ্নের মতো।” সঞ্জয় ও মৃণালিনী প্রথমবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসেন, যেন বহুদিন পর কিছু ভাগ করে নেওয়ার মতো অনুভূতি ফিরে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে গাড়ি হঠাৎ থামে—চালক হাত তুলে সিগন্যাল দেন। একটু দূরে জঙ্গলের মধ্যে, পাথুরে পথের ঠিক পাশে, দেখা যায় এক বিশাল গৌর। বিশালাকার, কৃষ্ণবর্ণ দেহ, আর তীক্ষ্ণ শিং। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে। গৌরটা একবার গাড়ির দিকে তাকায়, তারপর ঘাসে মুখ গুঁজে চলে যায় অন্য দিকে। এই মুহূর্তটা তাদের সকলের মনে স্থায়ী হয়ে থাকে—শুধু বন্যপ্রাণী দেখার উত্তেজনা নয়, বরং সেই প্রাণীর স্বাভাবিক উপস্থিতিতে নিজেদের ক্ষুদ্রতা অনুভব করার এক অদ্ভুত ধাক্কা।
এরপর জিপ ফের জঙ্গলের ভেতরে এগোতে থাকে। এবার পথ কিছুটা দুর্গম, কাঁদা, পাথর, আর মাঝে মাঝে জল জমে থাকা খাদের মতো খাদ। হঠাৎই গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় হাতির পায়ের ছাপ। সুনীল দা বলেন, “সতর্ক থাকো, এখানে দল চলেছে কাল রাতে। সামনে যদি দেখা যায়, বেশি আওয়াজ কোরো না।” সবাই নিঃশব্দে সম্মতি জানায়। রূপক নিজের নোটবুকে পেন্সিল চালিয়ে ছাপ আঁকছে, ঐশী শুধু চেয়ে আছে—তার মনে হচ্ছে এই অরণ্য তার চেনা জগৎ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু অদ্ভুতভাবে আপন। হঠাৎই বাঁদিকের গাছের আড়াল থেকে দেখা যায় তিনটি হাতি—এক মা, এক কিশোর, আর এক ছোট ছানা। মা হাতিটি সতর্ক চোখে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু জিপ না থামায় সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ছোট ছানাটি একবার তাদের দিকে তাকিয়ে কৌতূহলে শুঁড় তুলে নাড়ে। ঐশী ফিসফিস করে বলে, “ও বুঝি বাহাদুর?” রূপক হেসে বলে, “হয়তো নয়, হয়তো হ্যাঁ, কিন্তু একদম যেমন সুনীল দা বলেছিলেন।” পুরো দৃশ্যটা এতটাই নীরব, এতটাই সংবেদনশীল যে সঞ্জয়ের চোখে জল জমে আসে—কেউ দেখতে পায় না, তবে সে অনুভব করে, জীবনের এত বছরের ক্লান্তি যেন এই মুহূর্তে কোথাও গলে যাচ্ছে। মৃণালিনী একবার নিঃশব্দে হাত রাখেন সঞ্জয়ের কাঁধে। এই সফর শুধু বন্যপ্রাণীদের দেখা নয়, এই সফর একে অপরের ভেতরে হারানো অনুভবের খোঁজ—যা শহরের ব্যস্ততা, যন্ত্র আর মেকি হাসিতে চাপা পড়ে ছিল এতদিন।
৬
সেদিন বিকেলে বনবাংলো ফিরে এসে চারজনেই যেন চুপচাপ। দিনের অভিজ্ঞতা এতটাই গভীর ছিল যে কেউ সেভাবে কথা বলছে না, অথচ নিঃশব্দতার মধ্যেও একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে, যা শুধু চোখের ভাষায় প্রকাশ পাচ্ছে। রূপক নিজের খাতায় হাতির ছানাটির ছবি আঁকছে, মাথার উপর বড় কান, খুদে শুঁড় আর ছোট্ট চোখ—সব মিলিয়ে যেন একটা জীবন্ত অনুভব। ঐশী বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁচের জানালায় নিজের প্রতিবিম্বে তাকিয়ে থাকে, আর বারবার সেই শুঁড় নাড়া দেওয়া মুহূর্তটার কথা মনে পড়ে। তার মোবাইলে ছবি নেই, কিন্তু স্মৃতিতে সেই দৃশ্যের প্রতিটি পল ঠিকঠাক জমে গেছে। সঞ্জয় কফির কাপ হাতে বারান্দায় বসে, অনেকদিন পর তার চোখে ছুটির দিনে ক্লায়েন্ট কলের তাড়া নেই। মৃণালিনী সেদিকে তাকিয়ে চুপচাপ হেসে বলেন, “কিছু মনে পড়ছে?” সঞ্জয় একবার তাকিয়ে বলেন, “আমরা কি কোনোদিন এমন নিঃশব্দ দুপুর একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম?” তিনি উত্তর খোঁজেন না, শুধু তার শব্দটুকুই জানিয়ে দেয় কতটা বদল এসেছে এই বনজঙ্গলে এসে। হঠাৎই বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক থেমে যায়, আর সেই নিঃশব্দতায় ভেসে আসে কিছু পাতার কচমচ শব্দ। রূপক ছুটে আসে, “কেউ আসছে?” সুনীল দা দ্রুত উঠে বলেন, “চলো, আজ সন্ধ্যায় চুপিচুপি একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে হয়তো সে আসে—বাহাদুর।”
পাহাড়ি গলিপথে খানিক হেঁটে, অরণ্যের মাঝখানে একটি ছোট খোলা জমিতে এসে দাঁড়ায় তারা। ঘাসে ঢাকা এলাকা, মাঝখানে একটা ছোট জলাশয়, আর চারপাশে খয়েরি গাছের সারি। সন্ধ্যার আলো ক্রমশ হালকা হচ্ছে, সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। সুনীল দা বলেন, “এই জায়গাটা সে খুব চেনে, বিশেষ করে শীতের সময় জল খেতে আসে। আজকে যদি সৌভাগ্য হয়…” বাকিটা তার কথায় ঝুলে থাকে। মিনিট দশেক নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। ঐশী মোবাইলটা পকেটে রেখে দেয়, রূপক চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ খসখস শব্দে গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে আসে সে—একটা একলা হাতির ছানা। তার শরীর কাদায় ভেজা, পেছনের একটি পা খানিক খুঁড়িয়ে হাঁটে। কিন্তু চোখে আছে অভিমানী বুদ্ধিমত্তা। সুনীল দা ফিসফিস করে বলেন, “ওই তো… বাহাদুর।” মুহূর্তটা যেন দাঁড়িয়ে যায়। বাহাদুর ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জলাশয়ের ধারে, শুঁড় নামিয়ে জল স্পর্শ করে। তারপর শুঁড় তুলে একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকে—একটা দীর্ঘ, মৃদু, কিন্তু করুণ আওয়াজ। এই একটি ডাক চারজনের হৃদয়ে এমনভাবে নাড়া দেয় যেন তারা বুঝতে পারে, সে কেবল জল খেতে নয়, কথা বলতে এসেছে।
ঐশী নিজের ভিতরে এক অদ্ভুত কম্পন অনুভব করে। কোনও ক্যামেরা নেই, কিন্তু এই মুহূর্তটা মনে গেঁথে যায়। রূপক কাঁধে হাত রেখে বলে, “ও আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল… না?” বাহাদুর ধীরে ধীরে চোখ তুলে কিছুক্ষণ তাদের দিকে চায়, তারপর ফিরে যেতে শুরু করে। সঞ্জয়ের চোখে জল জমে যায়, তিনি নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে বলেন, “এই ছানাটার মধ্যে যেন আমরা সবাই আছি… একা, কিন্তু খোঁজে আছি কিছু।” মৃণালিনী বলেন, “হয়তো আমাদের চারজনের এতদিনের আলাদা আলাদা নিঃসঙ্গতা আজ এসে এক হয়ে গেছে।” বাহাদুর চলে যায়, আবার ঝোপের আড়ালে মিলিয়ে যায় সে, কিন্তু তার উপস্থিতি থেকে যায় চারজনের ভেতরে—সেই চোখে, সেই ডাকে, সেই ভঙ্গিমায়। এই একটা সন্ধ্যায়, বন আর প্রাণী শুধু দেখা বা বোঝার বিষয় থাকে না—এটা এক অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, যা তাদের সম্পর্ককেই নতুনভাবে নির্মাণ করে। তারা জানে না এই অনুভব কীভাবে ভাষায় প্রকাশ করতে হয়, শুধু এটুকু বোঝে—আজকের সন্ধ্যায় তারা সবাই বদলে গেছে, এক নিরীহ হাতির ছানার নিরবতায়।
৭
সকালে ঘুম ভাঙতেই বাইরে মেঘলা আকাশ। জঙ্গলের পাখিরা ডাকছে আগের মতোই, কিন্তু আজ যেন তাদের সুরে এক ধরনের আর্দ্রতা, অপেক্ষা আর ধৈর্য মিশে আছে। রূপক বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুনীল দা বলেন, “আজ বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে, তবে তাতে চিন্তা নেই—বৃষ্টির জল এই জঙ্গলের জন্য আশীর্বাদ।” সঞ্জয় একটা কাপে চা নিয়ে বসে বলেন, “জীবনে কিছু কিছু বৃষ্টি শুধু আকাশ থেকে নামে না, নামে ভিতরেও।” কথাটা শুনে মৃণালিনী হালকা হেসে বলেন, “তুমি আগের মতো কবিতা বলো না এখন, কিন্তু আজ বললে।” ঐশী তখন বারান্দার রেলিংয়ে হাত রেখে বসে, তার মাথার মধ্যে এখনও ঘুরছে বাহাদুরের সেই শুঁড় তুলে ডাকা মুহূর্তটি। এক ফোঁটা জল হঠাৎ করেই তার গালে পড়ে—প্রথম বৃষ্টি। সঙ্গে সঙ্গে পাতার ফাঁক দিয়ে মাটিতে টুপটাপ শব্দ পড়তে থাকে, জঙ্গল যেন ধুয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। সেই মুহূর্তে সবাই একসঙ্গে উঠে দাঁড়ায়, যেন এই বৃষ্টি শুধু প্রকৃতির নয়, তাদের সবার ভিতরে জমে থাকা বহুদিনের অব্যক্ত কথা, ক্লান্তি আর ভুল বোঝাবুঝিকে ধুয়ে দিচ্ছে।
বৃষ্টির জল প্রথমে পাতায়, তারপর গাছের গায়ে, তারপর মাটিতে এসে পড়ে। বনবাংলোর চারপাশে এক অনবদ্য গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—ভেজা মাটির, পত্রবাহিত স্মৃতির, আর দীর্ঘদিনের আটকে থাকা নিঃশ্বাসের গন্ধ। রূপক বাইরে ছুটে যায়, দুই হাত মেলে দাঁড়ায়। ঐশী প্রথমে কিছু না বলে চেয়ে থাকে, তারপর আস্তে করে জুতো খুলে, পায়ে জল মেখে দাঁড়িয়ে যায় ভাইয়ের পাশে। মৃণালিনী সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, “চলো না, ভিজি একটু?” সঞ্জয় অবাক হন, কারণ এত বছর পর এমন সরল প্রস্তাব শোনেন। তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে এগিয়ে যান স্ত্রীর সঙ্গে। এই চারজন—একটি পরিবার, এতদিন যারা চুপচাপ ছিল, দূরে দূরে ছিল, তারা আজ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের বৃষ্টিতে ভিজে। তারা কারও কথা শোনে না, শুধু প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দেয়। ঐশী একবার বলে ওঠে, “বৃষ্টি তো শহরেও হয়, কিন্তু এটা কেন যেন অন্যরকম।” রূপক উত্তর দেয়, “কারণ এখানে গন্ধ আছে, প্রাণ আছে।” সেই মুহূর্তে কেউ কাউকে ব্যাখ্যা দিতে চায় না—সবাই বুঝে গেছে, কিছু অনুভব শুধু নীরবতায় জন্ম নেয়।
বিকেলে বৃষ্টি থেমে গেলে সুনীল দা তাঁদের নিয়ে যান ছোট একটি টিলা বরাবর। সেখানে দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখা যায় মেঘে ঢাকা জঙ্গল, পাখিদের উড়ে যাওয়া আর দূরে দূরে পাহাড়ি রেখা। রূপক বলে, “এই জায়গাটা যেন পৃথিবীর ছাদ।” সঞ্জয় বলেন, “আমরা তো এতদিন কেবল নিচেই ছিলাম—নিজেদের ভিতরটা না দেখেই কাটিয়ে দিচ্ছিলাম।” ঐশী, যার ফোন এখনও পকেটে আছে, আজ সে নিজের হাতে একটা পাথরে বসে এক পাতায় লিখে রাখে—“আজ আমি নিজের সঙ্গে কথা বলেছি।” মৃণালিনী বলেন, “এটা ভ্রমণ না, এ এক নতুন দেখা—নিজেদের সঙ্গে, একে অপরের সঙ্গে।” সুনীল দা কিছু বলেন না, শুধু হাসেন। কারণ তিনি জানেন, এই বন শুধু প্রাণীদের অভয়ারণ্য নয়, মানুষের মনেও স্থান করে নিতে পারে। এই বৃষ্টি, এই হাওয়া, এই নিঃশব্দতা—সব মিলিয়ে এক জলছবির মতো মুহূর্ত তৈরি করে দেয়, যা কোনো ছবিতে আঁকা যায় না, কোনো ক্যামেরা ধরতে পারে না। তাদের পরিবার যেন এই টিলা চূড়ো থেকে নিজেদের অতীত ভুলে নতুন করে নেমে আসে—জন্ম নেয় এক আত্মিক বন্ধনের।
৮
বৃষ্টির পরদিন সকালে জঙ্গলের মাটি আরও নরম, পাখির ডাক আরও স্বচ্ছ, আর বাতাসে একটা শালপাতার হালকা সোঁদা গন্ধ। বনবাংলোর বারান্দায় চারজনেই একসঙ্গে বসে, কেউ কারও দিকে কিছু না বললেও মাঝখানে জমে থাকা দূরত্ব আর নেই। সঞ্জয় আজও ফোনে কোনও মেইল চেক করেন না। ঐশী তার পুরনো ক্লাসমেটদের গ্রুপে একটা মেসেজ টাইপ করে আবার মুছে ফেলে—কারণ সে বুঝে গেছে, এখানে সে নিজের সঙ্গে যেমন সংযোগে এসেছে, তেমন শহরে কেউ তাকে বুঝবে না। রূপক সকাল থেকে তার খাতায় লিখে চলেছে, বাহাদুরের গল্প, হাতির শুঁড়, ময়ূরের নাচ, আর বনবাংলোর কুয়াশার বর্ণনা। মৃণালিনী চুপচাপ বসে পুরনো ডায়েরিটা আবার খুলেছেন, একের পর এক বাক্য জেগে উঠছে। সকালটা আজ এমন যে কেউ যেন নিরুত্তাপ ছুটি কাটাচ্ছে না, বরং সকলে নিজেদের মধ্যে এমন কিছু খুঁজে নিচ্ছে যা বহুদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি—কোনো শব্দহীন আত্মিক বন্ধন, যা সময়ের মতোই চুপচাপ। হঠাৎ সঞ্জয় বলেন, “এই বনটা শুধু গাছ আর পশুদের নিয়ে নয়, এটা একটা শিক্ষা, একটা আয়না।” বাকিরা কোনও উত্তর না দিলেও তাদের চোখেই ছিল সম্মতি—একটা অভিজ্ঞতা, যা সম্পর্কের শালবন হয়ে উঠেছে।
সেই দিন সুনীল দা তাদের নিয়ে যান শালবনের ভিতর দিয়ে হাঁটার জন্য—এই শালগাছদের মধ্যে দিয়ে একটা সরু কাঁচা রাস্তা চলে গেছে এক অজানা পাহাড়ের দিকে। হাঁটার পথে চারপাশে এক ধরনের শান্তি, যেখানে শুধু পাখির ডাক আর শুকনো পাতার শব্দ শোনা যায়। মাঝে মাঝে হরিণের দল দূরে দেখা যায়, আর একবার এক ছোট্ট বনবিড়াল ঝোপের ভিতর ঢুকে যায়। কিন্তু আজ চারজনের দৃষ্টি প্রাণীদের দিকে নয়, বরং একে অপরের দিকে—আজ তাদের চারটি হাত একসঙ্গে চলেছে, তাদের পদক্ষেপে আর ছায়ায় মিলেছে এক অদৃশ্য বন্ধন। হাঁটার মাঝখানে রূপক হঠাৎ দাঁড়িয়ে বলে, “বাবা, আমরা যখন ফিরব, তখনও কি তুমি এইরকম থাকবে?” সঞ্জয় থমকে যান। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, “আমি চেষ্টা করব, রূপ… শুধু আমি না, আমরা সবাই।” ঐশী সোজা হয়ে বলে, “আর আমরা যদি না পারি?” মৃণালিনী কোমল গলায় বলেন, “তাহলে আবার এখানে ফিরে আসব।” সেই এক বাক্যে যেন সব কথা শেষ হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে চারজন একই পথের যাত্রী, শুধু বন নয়, নিজেদের সম্পর্কের ভিতর দিয়ে হাঁটছে। এই শালগাছ, এই নরম আলো, আর পায়ের নিচে পাতার কচমচ শব্দ—সব মিলিয়ে এমন এক অনুভব তৈরি করে যা কারও ভাষায় আটকায় না।
শেষ বিকেলে তারা আবার সেই পাহাড়ি টিলায় দাঁড়ায়, যেখান থেকে পুরো জলদাপাড়া দেখা যায়। নিচে জঙ্গল, দূরে তিস্তা নদী চিকচিক করছে, আর আকাশ ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে। সুনীল দা বলেন, “এই দৃশ্যটা রেখে দাও মনে, কারণ ছবি ভুলে গেলেও অনুভব থাকে।” সবাই চুপ করে থাকে। ঐশী, যিনি আগে ক্যামেরা ছাড়া কিছু কল্পনাই করতে পারতেন না, আজ পাথরের উপর বসে বলে, “এটাই আমার জীবনের প্রথম স্মৃতি, যেটা ফোনে নেই, কিন্তু মনে আছে।” রূপক বলে, “আমিও ফিরলে একটা ছোট বই বানাবো—‘বাহাদুরের চোখে জল’ নামে।” সঞ্জয়, যিনি এতদিন কর্পোরেট সাফল্যের সিঁড়িতে জীবন কাটিয়েছেন, বলেন, “জীবনের আসল জয় এইরকম নিঃশব্দ মুহূর্তেই হয়, যেটা কাউকে দেখাতে হয় না, কেবল অনুভব করতে হয়।” মৃণালিনী আস্তে বলেন, “জলছবির মতো।” চারজনের মাথার উপর আকাশে সূর্য ঢলে পড়ছে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে তারা যেন বুঝতে পারে—জীবনের ছবি যতই অস্পষ্ট হোক, সম্পর্কের জলছবি কখনোই ফিকে হয় না। তারা ফিরে যাবে শহরে, কিন্তু জলদাপাড়ার এই দিনের মতো কিছু অনুভব তাদের ভিতরে চিরকাল জেগে থাকবে।
৯
সকালে ঘুম ভাঙতেই জলদাপাড়ার আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। পাখিরা আরও যেন কণ্ঠ উঁচু করে ডাকছে, গাছেরা যেন দোল খাচ্ছে হালকা বাতাসে বিদায়ের মতো। বনবাংলোর দরজায় পায়ের শব্দ, ভেতরে প্যাকিং শুরু হয়ে গেছে। মৃণালিনী একবার ঘরটিকে শেষবারের মতো চোখ বুলিয়ে নেন—তাঁর চোখে ধরা পড়ে, এই কয়েক দিনে জায়গাটি যেন তাঁদের পরিবারের এক অতিনিকট আত্মীয় হয়ে উঠেছে। সঞ্জয় ব্যাগ গুছিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বলেন, “এই জানালাটা তো শুধু বাইরে দেখানোর জন্য ছিল না, নিজের ভেতরটাও দেখতে শেখাল।” ঐশী বিছানার পাশের দেয়ালে হাত রেখে বলে, “এই ঘরটার ভিতর আমি প্রথমবার কারও কথা না শুনে শুধু বনের কথা শুনেছি।” রূপক, যাকে সবার থেকে ছোট মনে হলেও, তার চোখে ছিল এক বিস্ময় আর গভীর উপলব্ধি—সে তার হাতের খাতাটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রাখে যেন এক অমূল্য বই। প্যাকিং শেষ হলে সবাই একসঙ্গে নেমে আসে বাংলোর বারান্দায়, যেখানে অপেক্ষা করছে সেই জিপ—যে এসেছিল তাদের আনতে, এবার নিয়ে যাবে ফিরিয়ে। কিন্তু এই ফিরে যাওয়া যেন কোনও শেষ নয়, বরং শুরু।
রাস্তায় জিপ চলতে শুরু করতেই সবাই চুপচাপ। বন দুচোখ ভরে দেখছে যেন—শেষ দেখা বলে। পেছনে ফেলে আসা সেই ঘন শালবন, সেই চেনা জলাশয়, বাহাদুরের ছায়াপথ, সব কিছুই এক ফ্রেমের মতো মনে পড়ছে। হঠাৎ এক জায়গায় এসে সুনীল দা বলেন, “এই বাঁকটার ঠিক পরে যেদিন বাহাদুর এসেছিল, মনে আছে তো?” ঐশী মাথা নাড়ে, চোখে জল চলে আসে অজান্তেই। রূপক বলে, “ও কি আজও আসবে?” সুনীল দা বলেন, “হয়তো আসবে, হয়তো নয়… কিন্তু যে একবার দেখে গেছে, সে আর আগের মতো থাকে না।” সঞ্জয় হঠাৎ বলে ওঠেন, “আমরা তো নিজেদের অনেক কিছু ভুলে গেছিলাম… বাহাদুর আমাদের মনে করিয়ে দিল।” সেই কথায় এমন কিছু ছিল যা ঐশী ও মৃণালিনীর চোখে একসাথে জল এনে দেয়। এই কয়েক দিনের ভ্রমণ যেন বছরের অনুভব ফিরিয়ে দিয়েছে—তারা সবাই বোঝে, এই বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে, তারা নিজেদের ভেতরের বনকেও খুঁজে পেয়েছে, যেখানে সম্পর্কের শিকড় ফের গাঁথা হয়েছে গভীরে।
স্টেশনে পৌঁছালে ট্রেন আসার কিছুক্ষণ আগে তারা সবাই একসাথে প্ল্যাটফর্মে বসে। সূর্য তখন চড়ে উঠছে, কিন্তু বাতাস এখনও ঠাণ্ডা। রূপক চুপ করে নিজের খাতা মেলে, আর একটা নতুন পৃষ্ঠায় লিখে—“আজ আমরা শুধু জঙ্গল থেকে ফিরছি না, ফিরছি এক নতুন সম্পর্ক নিয়ে।” ঐশী তার পিঠের ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে, তবু চালায় না—সে শুধু সেটি হাতে রেখে জানে, সব ছবি আজ শুধু মনে আছে। সঞ্জয় বলেন, “আমার অফিসে এখন হয়তো অনেক মেইল জমে আছে, কিন্তু আজকে একটাও পড়বো না।” মৃণালিনী বলেন, “কারণ আজকের দিনটা এখনও শেষ হয়নি, এটা আরও কিছু শিখিয়ে দেবে।” ট্রেন এসে দাঁড়ায়, তারা ওঠে, জানালার পাশে বসে, আর ধীরে ধীরে জলদাপাড়া সরে যায় পিছনে। কিন্তু সেই বন, সেই বাহাদুর, সেই সম্পর্কের নীরবতা—সবটাই থেকে যায় চুপচাপ, হৃদয়ের এক নিখুঁত জলছবিতে আঁকা হয়ে।
১০
ট্রেন ছাড়ার পর শহরের দিকে ফিরতে ফিরতে চারপাশ বদলাতে শুরু করে। কাঁচের জানালার বাইরে সবুজের রাজত্ব কমতে থাকে, তার জায়গায় আসে দালান-কাঠামো, বিজ্ঞাপন বোর্ড, ব্যস্ততা। অথচ চারজনেই যেন একইরকম নিরব। রূপক কেবল মাঝে মাঝে খাতায় কিছু টুকে চলেছে, মাঝেমধ্যে খাতা বন্ধ করে বাহিরে তাকিয়ে। ঐশী সবার অজান্তেই ফোনে বাহাদুরের নাম লিখে সার্চ করে, কিন্তু কিছু খুঁজে না পেয়ে নিজেই মুচকি হেসে তা ডিলিট করে দেয়—কারণ সে বুঝেছে, বাহাদুরের কোনো ছবি বা তথ্য নেই কোথাও, আছে কেবল তার মনে। সঞ্জয় জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন, ট্রেনের জানালায় ভেসে উঠছে সেই শালগাছের সারি, সেই জিপে বসে থাকা মূহূর্তগুলো। মৃণালিনী হঠাৎ বলেন, “ফেরার পথে কিছুই যেন আগের মতো লাগছে না।” সঞ্জয় সম্মত হন, “কারণ আমরা আর আগের মতো নই। আমরা কোথাও যেন ভেতর থেকে বদলে গেছি।” এই ভ্রমণটি আর কেবল ছুটি কাটানোর নয়—এ ছিল আত্মার শোধন, সম্পর্কের পুনর্জন্ম।
বাড়িতে ফিরে পুরনো জীবন আবার ফিরে আসে—সকালবেলা অফিস, পড়াশোনা, ক্লাস, কিচেনের কাজ, ট্রাফিক, সময়মতো ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে দৌড়। কিন্তু তবুও কিছু বদল থেকে যায়। সঞ্জয় এখন প্রতি সন্ধ্যায় বারান্দায় বসেন, আর অফিসের মেইলের ফাঁকে একটু চুপচাপ আকাশ দেখেন—শুধু নিজের জন্য। মৃণালিনী পুরনো রেসিপি বইয়ের পাতায় লেখেন, ‘জলদাপাড়ার চা, বৃষ্টির দিনে।’ ঐশী যেভাবে আগে ছবি ছাড়া কিছু ভাবতে পারত না, এখন মাঝে মাঝে ডায়েরি লেখে—আর মাঝে মাঝে বাহাদুরের নামটা নিজের মনেই বলে। রূপক স্কুলে এক রচনা প্রতিযোগিতায় ‘আমার দেখা সত্যিকারের নায়ক’ নাম দিয়ে লিখে বাহাদুরের গল্প—যে একা থেকেও কাউকে ভয় পায় না, যে কথা না বলেও হৃদয় জয় করে ফেলে। তাদের প্রত্যেকের জীবনে এক সূক্ষ্ম পরিবর্তন এসে পড়েছে, শব্দের উপরে নয়, অনুভবের মধ্যে। আর সেই পরিবর্তনের কেন্দ্রস্থলে রয়ে গেছে জলদাপাড়া, তার অরণ্য, তার প্রাণী আর নিঃশব্দতা।
একদিন, অনেক পরে, পুরনো ফটো অ্যালবাম ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঐশী বলে ওঠে, “আমরা তো জলদাপাড়ায় একটা ছবিও তুলিনি সবাই মিলে!” রূপক হাসে, “তাই তো… একটা-ও না!” মৃণালিনী বলেন, “কারণ ছবির দরকার হয় যখন মন কিছু রাখতে পারে না। কিন্তু এই জলছবি… মনেই আঁকা হয়েছে।” সঞ্জয় হেসে বলেন, “জীবনের সবচেয়ে সত্যিকারের স্মৃতিগুলোই তো ছবি ছাড়াই সবচেয়ে স্পষ্ট থাকে।” তারপর চারজন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বাহিরে তখন সন্ধ্যার আলো পড়ছে, বাতাসে শালপাতার গন্ধ নেই, কিন্তু তাদের মনে বাজছে সেই পাখির ডাক, সেই বৃষ্টির ধারা, আর সেই নিঃশব্দতার সুর। তারা জানে, হয়তো তারা আর কখনও ফিরবে না সেই বনবাংলোয়, কিন্তু যেখানেই থাকুক না কেন, জলদাপাড়ার সেই অভিজ্ঞতা একটা জলছবির মতো তাদের মধ্যে আঁকা থেকে যাবে—অবিচল, জীবন্ত।
সমাপ্ত




