Bangla - ভূতের গল্প

জলঢোঁড়ার ডাক

Spread the love

অভ্রজ্যোতি সেন


সকালবেলা কলকাতার হাওড়া ঘাটে জমে উঠেছিল এক অদ্ভুত রকম উত্তেজনা। পা ছুঁয়ে চলা কুয়াশার ফাঁক দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল একটি বড় ট্রলার, যার মাথায় লটকে থাকা লাল কাপড় বাতাসে কেঁপে উঠছিল। রুদ্র সেনগুপ্ত, ক্যামেরা ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, চোখে ছিল অদ্ভুত এক আলোকছায়ার খেলা। তার চোখে যেন শুধুই দ্বীপ, শুধু রহস্য। এই ডকুমেন্টারি তার জন্য শুধু পেশাদার প্রজেক্ট নয়, বরং এক অদ্ভুত টান—অজানা কিছুর ভিতরে পা ফেলার খিদে। তার সঙ্গেই ছিল ক্যামেরাপার্সন মৃণালিনী পাল—সবাই মিরা বলে ডাকে। চোয়াল শক্ত, চোখে নির্ভীকতা, যেন জঙ্গলও তাকে ভয় পায়। অর্কদীপ সাহা, যাকে সবাই অর্ক নামে জানে, সদা চঞ্চল, সাউন্ড রেকর্ডারের সঙ্গে যেন তার আত্মিক যোগাযোগ। আর ছিল সায়নী ধর—গবেষক, চুপচাপ, কিন্তু চোখে ছিল একরাশ অতীত খোঁজার আগ্রহ। পাঁচজনের দলটিকে সুন্দরবনের রাস্তায় পথ দেখাতে এসেছে কালীচরণ মণ্ডল—পঞ্চাশোর্ধ এক মাঝি, যার মুখে বারে বারে ছায়া নামে, আবার আলো ফিরে আসে। ট্রলার নদীর বুক চিরে এগোতে থাকে, চারপাশে কেওড়ার বন মাথা নোয়ায়, আর অর্ক মাঝে মাঝেই বলে ওঠে—”দেখো, যেন সব গাছ কানে কান পাতছে!” সবাই হেসে ওঠে, শুধু কালীচরণ মুখ ফেরায়, জলে চোখ রাখে। দিন গড়িয়ে যায়, দুপুরের রোদে নদী চকচক করে ওঠে, আর একসময় দেখা মেলে সেই দ্বীপের—জংলা, সবুজে ঢাকা, আর আশ্চর্যভাবে কোনো শব্দ নেই।

দ্বীপে নোঙর ফেলতেই একটা গা ছমছমে অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে। নামমাত্র একটা ঘাট, যা অনেক আগে কেউ কাঠ দিয়ে বানিয়েছিল, এখন তা ভেঙে ভেঙে পড়েছে। কালীচরণ ধীরে নামতে নামতে বলে ওঠে—”এই দ্বীপের নাম কেউ নেয় না। লোকালরা বলে এ জায়গা হারিয়ে গেছে। কেউ বলত ‘চাঁদারচর’, কেউ বলত ‘মরণদীপ’—কিন্তু আসল নাম কেউ জানে না।” রুদ্র ক্যামেরা অন করে বলে, “ঠিক এই জন্যই তো আমরা এসেছি, কালীদা। হারিয়ে যাওয়া নাম খুঁজতেই।” সবাই হেসে ওঠে, শুধু মিরার মুখে একটা অস্বস্তি। সে বলে, “অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, না? যেন পাখিও ডাকে না এখানে।” সত্যিই, দ্বীপে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারী বাতাস ঘিরে ধরে। কাঁচা মাটির পথে পড়ে থাকা পচা পাতাগুলোর ফাঁকে ছোট ছোট ফোসফরেসেন্ট কীটসদৃশ আলো দেখা যায়, যেন রাতও এখানে আগে আসে। তাঁবু খাটাতে খাটাতে অর্ক একটা হাসির ছলে বলে ওঠে, “এতই ভয়ের জায়গা হলে কেউ গল্প বানাত না, কালীদা!” কিন্তু কালীচরণ থমকে দাঁড়িয়ে বলে, “বাবু, সন্ধের পর এখানে জলও ডাক দেয়। কারও গলা শুনলে ফিরে তাকিও না। জল কখন কাকে নিয়ে যায়, কেউ জানে না।” কয়েক মুহূর্তের নীরবতা ভেদ করে সায়নী বলে, “এটা কি শুধু কুসংস্কার? নাকি কারও হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা আছে?” কালীচরণ শুধু বলে, “গল্পেরা কখনো শুধু গল্প হয় না।” সূর্য অস্ত যায়, আকাশে কমলা ছায়া লেগে থাকে, আর বনভূমির ওপারে কুয়াশা নামে ধীরে ধীরে।

রাত গাঢ় হতে থাকে। তাঁবু খাটানো শেষ, ক্যামেরা ও রেকর্ডার বসানো হয়। টিমের মধ্যে একধরনের উত্তেজনা, যেন কিছু পাওয়ার অপেক্ষা। রান্না করা হয়েছে শুকনো খাবার ও কিছু ডাবের জল। অর্ক হালকা গলায় গান ধরেছে, সায়নী তার খাতায় কিছু টোকা দিচ্ছে—পুরোনো লোককথার সম্ভাব্য মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা। রুদ্র ক্যামেরা তাক করে বলছে, “এটা হোক সেই ডকুমেন্টারি, যা বাকি পৃথিবীকে এই দ্বীপের সত্যি চেহারা দেখাবে।” কিন্তু মিরা তখন বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে, ঘন বনভূমির ভেতরে কিছু একটার শব্দ পেয়েছে যেন। কালীচরণ চুপ করে বসে আছে একটা গাছের গুঁড়িতে, মুখ ঘোরানো, চোখে চিন্তার রেখা। হঠাৎ বাতাস এক ঝটকায় জোরে বয়ে যায়, তাঁবুর কাপড় কেঁপে ওঠে, অর্ক চমকে বলে, “এত রাতে ঝড় আসছে নাকি?” কালীচরণ ধীরে বলে, “ও ঝড় নয় বাপু… ও এ জায়গার নিশ্বাস।” একটু দূরে জলের ধারে, কেওড়ার শিকড়ের ফাঁকে, একটা ঢেউ খেলে যায়। সে ঢেউ জলের স্বাভাবিক নয়, যেন কোনও কিছু ভেতর থেকে উপরে উঠে আসছে। এবং ঠিক তখন, অর্কের রেকর্ডারে এক মুহূর্তের জন্য একটা ফিসফিসে শব্দ ধরা পড়ে—নারীকণ্ঠ, দূর থেকে কেউ যেন বলছে, “এসো…” শব্দটা এত ক্ষীণ যে কেউ টের পায় না। কিন্তু বাতাস হঠাৎ ভারী হয়ে ওঠে। এবং সেই মুহূর্তে, কালীচরণ নিচু গলায় বলে, “ডাক শুরু হয়েছে… ফিরে তাকিও না।” বাইরে তখন চাঁদের আলো কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে, আর জলের নিচ থেকে যেন সত্যিই কেউ ধীরে ধীরে উঠছে—নীরব, অথচ ডেকে যাচ্ছে। “জলঢোঁড়ার দ্বীপে ঢুকেছি আমরা,” রুদ্র মনে মনে বলে, কিন্তু বুঝতে পারে না, এই ডকুমেন্টারিটি সত্যিই তার জীবনের শেষ গল্প হতে চলেছে কিনা।

রাতের নিস্তব্ধতা যেন দ্বীপটাকে একটা আলাদা জগতে টেনে নিয়ে গিয়েছে। দিনের আলোয় যে গাছপালা ছিল শুধুই প্রকৃতির অংশ, রাতে তারা হয়ে উঠেছে ছায়ামূর্তি, নীরব, অথচ চাহনিতে ভরা। তাঁবুর ভেতরে সবাই খাওয়াদাওয়া সেরে বিশ্রামে গেলেও অর্কের চোখে ঘুম নেই। তার রেকর্ডিং গিয়ার ছড়িয়ে রয়েছে তাঁবুর বাইরে একটা গাছতলায়। কানের হেডফোনে ধীরে ধীরে ভেসে আসছে পাতা নড়ার শব্দ, দূরের কাঁকড়ার চলাচল, মাঝে মাঝে জলের হালকা ছলাৎছল। এগুলো তার চেনা—প্রকৃতির ভাষা। কিন্তু হঠাৎ এক মুহূর্তে সব শব্দ স্তব্ধ হয়ে গেল, যেন কেউ চারপাশ থেকে নিঃশব্দ টেনে নিল। তারপর ভেসে এল এক অদ্ভুত শব্দ—খুব নিচু ভলিউমে, অথচ গভীর, এক নারীকণ্ঠ। খুব স্পষ্ট নয়, বরং ভিজে, সোঁদা কাদার গন্ধ মিশে থাকা গলা—”এসো…” অর্ক মুহূর্তে হেডফোন খুলে নেয়, চারপাশে তাকায়। কেউ নেই। জঙ্গলের ভিতর তখনও জোনাকির আলো জ্বলছে, কিন্তু বাতাস থমকে গেছে। সে আবার হেডফোন পরে, শব্দ রিওয়াইন্ড করে শুনতে চায়, কিন্তু এবার আর কিছু নেই। অথচ ঠিক সেই সময় তার মনে হয়, পেছনে যেন কেউ নিঃশ্বাস নিচ্ছে—খুব ধীরে, কিন্তু ভারি, ঠান্ডা। সে দ্রুত ঘুরে তাকায়—শুধু গাছ আর অন্ধকার।

এদিকে মিরা তখন ক্যামেরা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। দ্বীপের রাত তার কৌতূহল জাগিয়েছে। সে জলের ধারে গিয়ে নীরব শট নিতে চায়—চাঁদের আলোয় ভেসে থাকা জলের ওপর হালকা কুয়াশা জমেছে, পেছনে কেওড়ার ছায়া ধীরে ধীরে দুলছে। ক্যামেরা অন করে রেকর্ডিং শুরু করে সে। তার চোখে পড়ে—একটা ছায়া যেন অদ্ভুতভাবে ঝুঁকে আছে পেছনের ঝোপের দিকে। ক্যামেরার স্ক্রিনে শ্যাডো ফ্লিকার হয়, অথচ সামনের আলোতে কিছুই নেই। সে কয়েক কদম এগোয়, ক্যামেরায় জুম করে। কিন্তু ঠিক তখন, ক্যামেরা আচমকা অফ হয়ে যায়। ব্যাটারি ছিল পূর্ণ, তবু হঠাৎ বন্ধ। সে বিরক্ত হয়ে আবার চালু করতে যায়, কিন্তু পেছনে কিছু একটা শব্দ হয়—চুলে বাতাস লেগেছে কি না বোঝার আগেই যেন কারো হাঁটার মতো নরম শব্দ শোনা যায় কাদা মাটিতে। মিরা পিছন ফিরে তাকায়, কিন্তু কিছু নেই। কেবল অন্ধকার আর ঝোপের ফাঁকে একটা হালকা আলো, যেন জোনাকি নয়—বরং চোখের মত দুটি ছোট দীপ্তি। সে ধীরে পেছাতে থাকে, ক্যামেরাটা আবার অন হয়, এবং মিরা নিজের চোখে দেখে, ক্যামেরার স্ক্রিনে তার ঠিক পেছনে একটা দীর্ঘ, কুয়াশার মত গঠন দাঁড়িয়ে আছে। স্পষ্ট নয়, ছায়ার থেকেও আবছা, অথচ দাঁড়িয়ে যেন দেখছে। সে পিছনে ফিরতেই সেটি মিলিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তার গলা শুকিয়ে আসে। সে ছুটে ফিরে যায় তাঁবুর দিকে।

তাঁবুর কাছে তখন কালীচরণ আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল, চোখে চিন্তার রেখা। রুদ্র ও সায়নী ঘুমিয়ে পড়েছে, অর্ক ভিতরে গিয়েও চুপচাপ বসে, মুখে একটা অস্বস্তির ছাপ। মিরা এসে বসতেই কালীচরণ বলে ওঠে—”দেখেছো, না?” মিরা কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ে। কালীচরণ ধীরে বলে, “ডাক তো ওর শুরু হয়েই গেছে… জলঢোঁড়ার গলা। যার কানে একবার সেই ডাক পড়ে, তার আর ফিরে আসা হয় না।” অর্ক ধীরে হেডফোন খুলে জানায়, “আমি কিছু শুনেছিলাম… মেয়েলি গলা… একবার মাত্র… পরে আর নেই।” কালীচরণ গম্ভীর হয়। সে বলে, “এরা সবসময় একবারই ডাকে প্রথমে। দ্বিতীয়বার ডাকে না—দ্বিতীয়বার টেনে নেয়।” সায়নী সেই শব্দ সম্পর্কে কিছু বিশ্লেষণ করতে চায়, কিন্তু কালীচরণ বলে, “আপনারা এভাবে বুঝতে পারবেন না, বেটা। ও ডাক যখন নামে, তখন প্রাণের ভিতরও ভিজে ওঠে।” ক্যামেরা পরীক্ষা করতে গিয়ে মিরা দেখে, তার শটে কিছু ডিস্টরশন রয়ে গেছে, ফ্রেমের মধ্যে শূন্য জাগায় হঠাৎ করে ফ্ল্যাশ লাইটের মত কিছু জ্বলে উঠে মিলিয়ে গেছে, যেন ছায়া নিজেই ক্যামেরায় কথা বলে উঠেছিল। রুদ্র এসবের মধ্যেও যুক্তির ব্যাখ্যা খোঁজে, বলে, “হয়ত ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ইন্টারফিয়ারেন্স।” কিন্তু সবার মনেই তখন একটা কথা ঘুরে ফিরে বাজছে—এই দ্বীপ শুধু গাছপালা আর জল নিয়ে গঠিত নয়। এখানে কারা যেন আছে, যাদের না দেখেও বোঝা যায়, যাদের ডাক শুনলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। তারা জলের নিচ থেকে বলে ওঠে—ভিজে গলায়, আবছা আওয়াজে—“এসো…”

সকালের রোদ ধীরে ধীরে কেওড়ার পাতা ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল দ্বীপের জঙ্গলের ফাঁকে। আগের রাতের ঘটনার রেশ এখনও টিমের মধ্যে গা ছমছমে ভাব ছড়িয়ে রেখেছে। মিরার মুখে আতঙ্কের ছাপ, অর্ক নিঃশব্দে রেকর্ডিং চেক করছে বারবার, যেন কিছু হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সায়নীর মনে অন্য এক চিন্তা ঘোরাফেরা করছিল। সে লোককাহিনি ও বাংলার হারিয়ে যাওয়া মিথ নিয়ে পড়াশোনা করেছে বহুদিন, অথচ এমন ‘জলঢোঁড়া’র গল্প সে আগে শোনেনি কোথাও। দ্বীপের এমন নিস্তব্ধতা আর ভয় যেন তাকে টানছিল আরও গভীরে—সে জানত, কোনো গল্প হঠাৎ করে জন্মায় না, তার শিকড় থাকে মাটির তলায়, ইতিহাসের পাতা কিংবা জনশ্রুতির রন্ধ্রে। তাই সে একা বেরিয়ে পড়ল দ্বীপের ভেতরের দিকে—জঙ্গলের গায়ে লেগে থাকা কোনো পুরনো কাঠামো, ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির বা পাথরের ফলক খুঁজে পেতে। তার হাতে ছিল শুধু একটা ছোট খাতা, টর্চ আর পেনসিল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে যাওয়ার পর সে জঙ্গলের এক ঘন ছায়া মোড়া জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে গাছপালার ভিড়ে অদ্ভুতভাবে একটা খোলা জায়গা তৈরি হয়েছে। আর সেই ফাঁকা জায়গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি ভাঙা শিবমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ—ছাদের অর্ধেক ভেঙে পড়েছে, দেওয়ালের খোদাই গায়ে কালো শ্যাওলা জমেছে। সায়নী ধীরে ধীরে কাছে গিয়ে দেখে মাটির কাছ ঘেঁষে একটা পাথরের ফলক দাঁড়িয়ে আছে, সামান্য ফাটল ধরা, অর্ধেক ঢাকা মাটি আর পাতায়। সে হাত দিয়ে পাতা সরিয়ে দেখে ফলকে খোদাই করে লেখা আছে: “জলহরিণীর অভিশাপ।” লেখাগুলো প্রাচীন শৈলীতে, সম্ভবত মধ্যযুগীয় কোনো গ্রাম্য চিহ্ন-ভাষায়। তার চোখ চকচক করে ওঠে। মন্দিরের গায়ে আরও কিছু দৃশ্য খোদাই করা ছিল—এক নারীমূর্তি, হাতে পদ্ম, মাথায় জলবিন্দুর মত চিহ্ন, আর পায়ের কাছে জলধারায় তলিয়ে যাওয়া কেউ। চিত্রগুলো দেখে তার মনে হয়, এ যেন এক নদীর দেবী এবং তাঁর সামনে নিবেদিত কোনো মানবকন্যা। হঠাৎ তার মাথায় বাজে—এ কি সেই ‘বলির প্রথা’? সে আরও কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করে মন্দিরের ভেতরে গিয়ে একটি ভাঙা ধাতব থালা, কিছু কাঁচের চুড়ি ও মাটিতে কাঁচা রক্তের পুরোনো দাগের মত রঙিন দাগ খুঁজে পায়—যদিও সময়ের সাথে মিলিয়ে গিয়েছে তাদের রং। কিন্তু বাতাস যেন ভারি হয়ে যায়, কেমন এক চাপা কান্নার মতো শব্দ ভেসে আসে দূর থেকে, যদিও আশপাশে কেউ নেই।

সায়নী ফিরে এসে সেই রাতেই খাতায় লেখে: “জলহরিণীর অভিশাপ—এই দ্বীপে একসময় নদীর দেবীর পূজা হত। জনশ্রুতি অনুসারে, খরায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর জল ফিরে পেতে দেবীর কাছে বলি দেওয়া হত। একবার, গ্রামের এক ধনী জমিদার তার নিজের কন্যাকে বলি দেয় এই রীতি মেনে। মেয়েটির নাম ছিল হরিণী—শান্ত, সৌম্য, প্রকৃতিপ্রেমী এক মেয়ে। সে দেবীর নামে নিবেদিত হয়, নদীর ধারে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে, লোকজন তার সাদা শাড়ি পরিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু সে অভিশাপ দেয়—’যারা জলের নামে হত্যা করে, তারা জলে ডুবে যাবে। আমি ফিরব।’ এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই সেই দ্বীপে একে একে মারা যায় সব পুরুষ, মেয়ে ও শিশুদের মুখে একটাই কথা—’জল ডাকছে, মা, জল ডাকছে।’ সেই থেকেই মেয়েটির আত্মা জলে ফিরে আসে ‘জলহরিণী’ রূপে। কিন্তু বছর কেটে গেলে তার নাম বিকৃত হয়ে যায়, হয়ে ওঠে ‘জলঢোঁড়া’—যে জল থেকে ফিসফিসিয়ে ডাকে, আর মানুষ জলে পা দিলেই টেনে নেয় নিচে। তার গলা নরম, যেন কাঁদে, কিন্তু চোখ—নির্বাক প্রতিশোধের আগুন।” সায়নী এই কাহিনি পড়ে শিউরে ওঠে। সে বুঝতে পারে, এই দ্বীপ নিছক ভূতুড়ে নয়—এখানে নারী বলির ভয়াবহ ঐতিহাসিক স্মৃতি চাপা পড়ে আছে প্রকৃতির স্তরে স্তরে। সেদিন রাতেই সায়নী দলকে সব জানায়, কিন্তু রুদ্র বলে ওঠে, “এই কাহিনি তো আমাদের ডকুমেন্টারির মূল! ভাবো, এমন একটা লোকগল্প, এমন পাথুরে প্রমাণ—এটা হিট হবে!” অথচ কালীচরণ মুখ নিচু করে বসে থাকে, চোখ সরিয়ে, আর ধীরে বলে, “বলি হলে আত্মা শান্তি পায় না। আর হরিণীর কান্না যে শুনেছে, সে কোনোদিন আর আপন ডাক চিনতে পারে না। জল তার নিজের গলা দিয়ে ফেরায় ডাক, যতক্ষণ না সে ফিরে আসে…” আর সবার মনে সেই মুহূর্তে একটাই প্রশ্ন জেগে ওঠে—জল কি কেবল জলই? নাকি সে কোনো অপূর্ণ আত্মার প্রতিধ্বনি, যা আজও ডাকে… ‘এসো…’

রাতের গভীরতা যখন নিঃশব্দ হয়ে ওঠে, তখন দ্বীপের গায়ে যেন অন্য এক সত্তা জেগে ওঠে—একটা নীরবতা যা নিছক নিস্তব্ধতা নয়, বরং অপেক্ষা। সেই রাতে চাঁদের আলো ছিল ফ্যাকাশে, ছায়া আরও ছায়া লাগছিল। তাঁবুর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও মিরার চোখে ঘুম আসেনি। তার মনে বারবার ফিরে আসছিল আগের রাতের সেই অদ্ভুত ছায়া, ক্যামেরায় ধরা পড়া অদৃশ্য ফিগার, আর সেই অস্বস্তিকর অনুভব—পেছনে কেউ আছে। সে সিদ্ধান্ত নেয় আরও কিছু শট নেওয়ার, হয়তো সেই রহস্যময় উপস্থিতিকে আবার ধরতে পারবে। হেডল্যাম্প চোখে লাগিয়ে, ক্যামেরা হাতে সে বেরিয়ে পড়ে। চারপাশে জোনাকির ঝিলিক, বাতাসে কেওড়া পাতার মৃদু ঝিঁঝিঁ ধ্বনি। সে দ্বীপের দক্ষিণ দিক ধরে হাঁটতে থাকে, যেখানে জলের ধারে পাথর ও কাদা মেশানো একটা সরু ঘাট আছে। সেখানেই সে দেখে এক নারীমূর্তি—ঝোপের ফাঁকে, জলের ঠিক ধারে দাঁড়িয়ে, মাথা নিচু, ভেজা চুল কাঁধ ছুঁয়ে ঝুলে পড়েছে। মিরার চোখে বিস্ময়, শরীরে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে যায়, কিন্তু ক্যামেরা চালু করে সে ধীরে ধীরে এগোয়, প্রতিটি পদক্ষেপ ভারী হয়ে ওঠে।

ক্যামেরা ফ্রেমে সেই নারী ক্রমেই আবছা হয়ে যাচ্ছে, যেন জল ও কুয়াশার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনো বাস্তবতা নয়, বরং কোনো স্মৃতি। হেডল্যাম্পের আলোতে মেয়েটির শাড়ির আভাস পাওয়া যায়—পুরোনো, সাদা, কাদায় ভেজা। মিরা কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা শুকিয়ে আসে। হঠাৎ সেই নারীমূর্তি মাটিতে বসে পড়ে, মাথা আরও নিচু করে, যেন কাঁদছে। মিরার মনে হয়, সে কাউকে ডেকে বলছে—“আমি একা…” এই মুহূর্তে ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা হয়ে যায়, বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, আর ঠিক তখনই নারীটি ধীরে ধীরে জলের মধ্যে ঢুকে যেতে শুরু করে—না, হাঁটছে না, যেন জলই তাকে টেনে নিচ্ছে। মিরা দৌড়ে এগোয়, চিৎকার করে—”কে? দাঁড়াও!” কিন্তু সে পা ফেলে যেখানে পৌঁছায়, সেখানে শুধু জল, ছলাৎ ছলাৎ সাড়া। ক্যামেরা তখনও চলছে, মিরা পেছনে ঘুরে দাঁড়ায়, যেন কাউকে খুঁজছে। হেডল্যাম্পের আলো তার চোখে পড়ে, সেখানে স্পষ্ট আতঙ্ক নেই—বরং এক ধরনের অচেনা প্রশান্তি। ঠিক সেই সময়, মিরা ধীরে ধীরে পা রাখে জলের ভিতর, যেন কারও ডাকের জবাবে সে চলে যাচ্ছে। তার মুখে নিঃশব্দ উচ্চারণ—“আমি আসছি…” তারপর সে হেঁটে যায় কেওড়ার শিকড় ছুঁয়ে, কাদায় ডুবে, জলে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

পরদিন সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর মিরাকে পাওয়া যায় না। রুদ্র, অর্ক ও সায়নী চারদিকে খোঁজাখুঁজি করে, দ্বীপের প্রতিটি কোণা চষে ফেলে। কালীচরণ কাঠের ঘাটে গিয়ে বলে, “জল ফের কাউকে নিয়ে গেল বাপু…” কাদার পাশে মিরার চিহ্ন পাওয়া যায়—পায়ের ছাপ, ক্যামেরার ব্যাগ, আর কিছু চুড়ির ভাঙা টুকরো। একটামাত্র জিনিস বেঁচে ছিল—ক্যামেরাটি, যেটা আধেক কাদায় ডুবে ছিল কিন্তু এখনো চলছে। রুদ্র সেটি হাতে নেয়, মুছে ফেলে এবং ভিডিও দেখতে শুরু করে। প্রথমে শুধু চলার দৃশ্য, তারপর সেই নারী মূর্তির ছায়া, অদ্ভুতভাবে জলময় হয়ে যাওয়া শট, আর শেষে মিরার পেছনে ঘুরে তাকানো ও ধীরে ধীরে জলে ঢুকে যাওয়া। ভিডিওর শেষে শুধু শোনা যায় একটা মৃদু ফিসফিসানি—“এসো, এসো হরিণী… বাড়ি চলো…” সায়নী ভিডিও বন্ধ করে নিঃশব্দে বলে ওঠে, “হরিণী—সে কি জলহরিণীর সত্তা মিরার ভেতরে কিছু জাগিয়ে দিল?” সবাই চুপ করে থাকে। বাতাসে যেন আবার সেই সোঁদা গন্ধ ভেসে আসে—ভিজে মৃত পাতার, আর সেই জল যা কেবল খেলে না, টেনে নেয়। “জল শুধুই জল নয়,” অর্ক বলে, গলার কাঁপা নিয়ন্ত্রণ করে, “এখানে কেউ আছে… কেউ ডাকছে… আর আমরা শুনে ফেলেছি।” তারপর কেউ আর কিছু বলে না। শুধু মিরার জায়গাটা খালি থেকে যায়—জলরেখার ধারে, ডুবন্ত চোখের মত নিঃশব্দ।

তাঁবুতে সেই দিনটির সকালের আলো যেন ঘোলাটে ছিল—একটা অসম্পূর্ণ ঘুমের মত। মিরার অনুপস্থিতি শোকের মত ছায়া ফেলেছিল পুরো ক্যাম্পে, কিন্তু অর্ক বসে ছিল তার ল্যাপটপ আর অডিও এনালাইসিস সফটওয়্যারের সামনে। ক্যামেরা থেকে উদ্ধার করা ভিডিওর সঙ্গে ছিল কিছু অডিও রেকর্ডিং, যেগুলো মিরার রেকর্ডার থেকে পাওয়া গেছে। অর্ক সে ফাইলগুলো ধীরে ধীরে শোনে—প্রথমে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, তারপর হালকা কদমপাতার মচমচানি, মাঝেমাঝে জলের ধ্বনি, আর তারপরে এক অদ্ভুত কম্পন, এক “হামিং” বা দীর্ঘ সঙ্গীতীয় গুঞ্জন, যেটা মানুষের কণ্ঠে নয়, কিন্তু মানুষের মত শোনায়। অর্ক দ্রুত সেই অডিও ওয়েভফর্মকে বিশ্লেষণ করে দেখতে পায় সেখানে একটা “হারমোনিক প্যাটার্ন” লুকিয়ে আছে—একটা সুনির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সি যেটা সাধারণ কথার মধ্যে থাকে না, কিন্তু এটার উপস্থিতি কাউকে এক ধরনের ঘোরে ফেলতে পারে, একটা হ্যালুসিনেটরি ট্রান্স-এ। সে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে রুদ্র আর সায়নীকে ডাকে—”এটা শুধুই অলৌকিক নয়, এটা একটা নির্দিষ্ট তরঙ্গ, একটা ভয় তৈরি করে এমন ফ্রিকোয়েন্সি!” রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বলে—“তুমি বলছো মিরা এই শব্দের কারণে ঘোরে চলে গেছিল?” অর্ক মাথা নাড়ে, “না শুধু তাই নয়, ও শুনেছিল এমন কিছু যা ওকে নিজের ইচ্ছায় জলে নামতে বাধ্য করেছিল। এই তরঙ্গ ওর মস্তিষ্কে একটা চিত্র তৈরি করেছে। এটা একটা প্রোগ্রামড ভয়, বা নিছক হ্যালুসিনেশন নয়—বরং এক ধরনের ‘sonic lure’—ডাকে, ভুলিয়ে, টানে।”

রুদ্র তখনও চুপ করে ছিল। সে টেবিলে রাখা সেই অডিও স্পেকট্রোগ্রাম দেখছিল। “এই সব প্রযুক্তি দিয়ে যা বোঝার চেষ্টা করছ, ওটা হয়তো একটা প্রাকৃতিক শব্দ,” সে বলে, “জঙ্গলের গাছের ঘর্ষণ, অথবা কোনো পাখির সাউন্ড।” কিন্তু সায়নী একদৃষ্টে অর্কের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “তুমি ওকে দেখোনি রুদ্র, ওর চোখে শান্তি ছিল, ভয় নয়—যেন কারো কাছে ফিরে যাচ্ছে, এমন কারো কাছে যার কথা আমাদের মনে নেই কিন্তু আত্মা চেনে।” তার গলা কেঁপে ওঠে। “এই ডাক প্রযুক্তি দিয়ে বোঝা যাবে না। এটা আত্মার ভাষা।” অর্ক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। সে আবার সেই ফাইল প্লে করে—সেই একই ধ্বনি, কিন্তু এবার তাদের সবাইকে কেমন একটা ঠাণ্ডা শিরশিরে লাগতে থাকে। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ যেন বুকের মধ্যে ঢুকে পড়ে, এক মুহূর্তের জন্য কেউ কারও দিকে তাকায় না। কালীচরণ তখনই তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার চোখ স্থির, কাঁধের ঝোলা শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে। “এই ডাক আগে শুনেছি,” সে ফিসফিস করে, “আমার বাবাও বলত এই আওয়াজ শোনার পরই তার বন্ধুদের কয়েকজন জলে গেছিল—বিনা কারণ, বিনা ব্যাখ্যায়।” সে পেছন ফিরে তাকায়, “আমি থাকব না। আমি বলেছিলাম, এই দ্বীপ বাঁচিয়ে রাখে না কাউকে।” সে তখনই তার জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলতে শুরু করে।

কালীচরণের পালানোর সিদ্ধান্তে একটা অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। অর্ক চায় না কেউ এখন দ্বীপ ছেড়ে যাক, কারণ তার ধারণা যদি সত্যি হয়, তবে এই হারমোনিক প্যাটার্ন আরও বেশি করে সক্রিয় হচ্ছে মিরার ঘটনার পর। সে বিশ্বাস করতে চায় যে এটা কোনো প্রাকৃতিক, ব্যাখ্যাযোগ্য সাইকো-অ্যাকোস্টিক ফেনোমেনা, যেটা ভয় তৈরি করে। কিন্তু সায়নীর চোখে আতঙ্ক নয়, বরং যেন এক পুরোনো গল্পের স্মৃতি। সে বলে, “এই ডাক তারাদের নিচে আসে, কেওড়ার ফাঁকে—যেন বহু বছর আগের কোনো কান্না যা এখনও থামেনি।” অর্ক বিরক্ত হয়ে ওঠে, “এই কবিতা বা অতিভৌতিক ব্যাখ্যা দিয়ে কিছু হবে না! আমরা এখানে ব্যাখ্যা খুঁজতে এসেছি। বিশ্বাস নয়, প্রমাণ চাই।” রুদ্র তখন বলে ওঠে, “তবে একটা কথা স্বীকার করতে হবে—এই শব্দের কথা কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে আমি পাইনি, আর হারমোনিক প্যাটার্নগুলোও কেমন যেন ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিখুঁত’। এটা কি সত্যিই প্রকৃতি তৈরি করেছে?” সবাই চুপ করে যায়। বাতাসে আবার সেই চাপা গুঞ্জন শোনা যায়—মৃদু, একটানা, যেন সমুদ্ররেখার ঠিক নিচে কেউ গাইছে। কালীচরণ তখনো হেঁটে চলেছে দূরের বোটঘাটের দিকে, আর পেছনে একটা কথা ছুঁড়ে দেয়—“জল ফের ডাকছে। এইবার কেউ রক্ষা পাবে না।” আর তার পদধ্বনি মিলিয়ে যায় ভেজা মাটির শব্দে। তাঁবুর ভেতর এখন শুধু সেই রেকর্ডারের গুঞ্জন—ভয়ের শব্দ, যা শব্দ নয়, এক ডাকে পরিণত হয়।

অরণ্যের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই রুদ্র যেন অনুভব করল বাতাস বদলে গেছে। দ্বীপের প্রকৃতিতে এমন এক নিরব, শ্বাসরুদ্ধকর ঘনত্ব ছিল যা কলকাতার কোলাহল থেকে আসা মানুষেরা সহজে বুঝে উঠতে পারে না। সকালবেলা হলেও আলো ছিল ম্লান, যেন সূর্য নিজেই দ্বীপটিকে এড়িয়ে চলে। চারপাশে গাছপালা আর জলাভূমির মাঝে হঠাৎ করেই বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল এক অদ্ভুত গন্ধ—কাদার মত, কিন্তু তাতে এমন কিছু ছিল যা চেনা নয়। তা ছিল ভারী, আদ্র, আর ঘিনঘিনে। সায়নী প্রথম বলল, “এই গন্ধটা কেমন যেন পচা পায়রার খাঁচার মতো!” অর্ক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “সায়েন্স বলছে, এইটা হয়তো কোনো অ্যালগি বা সালফারিক ফিউমস।” কিন্তু কালীচরণ কাঁধে গামছা রেখে নিচু গলায় বলল, “এটা সেই গন্ধ… যখন নদী কাউকে নিয়ে নেয়, আর সে ফিরে আসে না।” কথাটা বলেই সে পিছন ফিরে তাকিয়ে নৌকার দিকে হেঁটে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য সীমানা পার করে ফেলেছে তারা। পাখিরা, যেগুলো এতক্ষণ কিচিরমিচির করছিল, হঠাৎ থেমে গেছে। গাছে কোনো পোকামাকড়ের আওয়াজ নেই, যেন দ্বীপটাই নিঃশব্দ হয়ে উঠেছে। এক ভয়ানক স্থবিরতা, যেন প্রকৃতিও কিছু গোপন করছে।

সায়নী আর রুদ্র যখন ঝোপের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল একটি জলার ধারে, তারা দেখতে পেল সাদা রঙের কিছু কাপড় কাদায় অর্ধেক ডুবে আছে। একটু কাছে যেতেই চোখে পড়ে কিছু চুড়ির ভাঙা টুকরো, কিছু রাঙা সুতোর অংশ, যেন কোনো নারীর পোশাক ও অলঙ্কারের টুকরো কাদা ও পানির সাথে মিশে গেছে। সায়নী দমবন্ধ গলায় বলল, “এগুলো তো… নতুন! কাদা শুকায়নি এখনো।” অর্ক সেই জায়গার ছবি তুলতে গেল, কিন্তু তার লেন্স ধোঁয়াটে হয়ে যায়। “কী ঝামেলা হচ্ছে ক্যামেরার?” — সে রেগে উঠল। রুদ্র চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তার মাথায় হঠাৎ এক শৈশবের স্মৃতি উঁকি দিল—এক বিকেলবেলা, তার মা ছাদে বসে চুলে তেল দিচ্ছিল, আর বলেছিল, “জলও কথা বলে, বাবা। শুধু আমরা শুনতে পাই না সবসময়। কিন্তু যদি একবার সে ডাকে, তার উত্তর না দিয়ে পারা যায় না।” তখন রুদ্র হেসে বলেছিল, “মা, জল কী করে কথা বলে!” কিন্তু আজ, এই দ্বীপে, সেই কথাগুলো যেন হাড়ের ভিতরে ঢুকে কেঁপে উঠল। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া তার মনে হল, সে এখানে কোনো উদ্দেশ্যে এসেছে, যা তার শৈশব থেকে শুরু হয়ে আজ এই দ্বীপ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই দ্বীপ, এই গন্ধ, এই চুড়ির টুকরো—সব যেন তার মনের ভেতরে পুরোনো কোনো কাহিনি তুলে ধরছে, যা সে অনেক আগে ভুলে গিয়েছিল। হঠাৎই বাতাসে যেন কেউ হুঁশ করে নিঃশ্বাস ছাড়ল। রুদ্র ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কেউ নেই। অথচ সে অনুভব করল, কেউ তার নাম ধরে ডাকল—‘রু…দ্র…’ – কানে কানে, কিন্তু দূর থেকে। সে আবার শৈশবের সেই কথাটা মনে করল—“জলের ডাক ফেরানো যায় না।”

সন্ধে ঘনিয়ে এলে, কালীচরণ উঠে এসে জানায়, সে আর দ্বীপে থাকছে না। “আমি নৌকার কাছে থাকব। তোমরা যা খুশি করো, বাবু। আমি তো বলেইছিলাম—এই দ্বীপ অভিশপ্ত।” তার ভয় যেন চোখে মুখে লেখা। সায়নী কিছু বলার আগেই কালীচরণ পেছন ঘুরে চলে যায়। তখন হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এল, আর সেই পুরোনো গন্ধ—অদ্ভুত, ভিজে, মৃত মানুষের মিশ্রিত কাদা—আরও তীব্র হয়ে উঠল। অর্ক আর রুদ্র মাস্ক পরল, কিন্তু তাও সে গন্ধ যেন তাদের চামড়ার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। ক্যাম্পের মধ্যে রাতে আলো জ্বললেও, পাখিদের নিঃস্তব্ধতা আর অদৃশ্য পায়ের আওয়াজ, হাওয়ার দোলায় গাছের পাতার অতিরিক্ত শব্দ, সব মিলে চারপাশে এক চাপা আতঙ্ক। সায়নী তখন পুরোনো ফলকের ছবিগুলো দেখছিল, সেখানে ‘জলহরিণী’র গল্প আবার চোখে পড়ে—যাকে বলি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে নিজেই আজ ফিরেছে, জলঢোঁড়ার রূপে। রুদ্র তখন চুপচাপ ডায়েরি খুলে লিখতে শুরু করল—“এই দ্বীপে শুধু প্রকৃতি নয়, অতীতও শ্বাস নেয়। আর আমি জানি না, সে অতীত আমারই কোনো অংশ কিনা।”

রাতটা ছিল কুয়াশায় মোড়া, গা ছমছমে। তাঁবুর বাইরের বাতাসে তখনও সেই অদ্ভুত কাদা-মেশানো গন্ধ, যা যেন ক্রমেই গা-সওয়া হয়ে উঠছে, অথচ তার প্রকৃতি কিছুতেই বোধগম্য নয়। সায়নী ঘুম ভেঙে বসে পড়েছিল, কারণ তাকে মনে হয়েছিল কেউ তাঁবুর বাইরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রথমে সে ভেবেছিল কালীচরণ হবে, হয়তো রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। কিন্তু তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই তার চোখ স্থির হয়ে গেল। কুয়াশার মধ্যে, ক্যাম্পফায়ারের ক্ষীণ আলোয়, জলাশয়ের ধারে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল—রুদ্র। সে একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে আছে, একেবারে নিষ্পলক, যেন কোনো গভীর ডাকে সাড়া দিচ্ছে, যা অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না। সায়নী ফিসফিস করে বলল, “রুদ্র?” কিন্তু কোনো সাড়া নেই। সেই নিঃশব্দ মূর্তি হঠাৎ যেন একটু ঝুঁকে গেল জলের দিকে। আতঙ্কে সায়নী দৌড়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল, আর যখন ছুটে গিয়ে সেই জায়গায় পৌঁছাল, তখন সেখানে কেউ ছিল না। কুয়াশার ভেতর শুধু কাঁপা-কাঁপা গাছের ছায়া, আর নীরবতার মধ্যে এক গা ছমছমে শূন্যতা। সায়নী ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে তাঁবুতে ফিরে এসে দেখে, রুদ্র তখনও ঘুমোচ্ছে—নিতান্ত স্বাভাবিকভাবে, যেন কিছুই হয়নি। সে একটুও নড়েনি, ঘামেও ভিজে নেই, বরং এমন গভীর ঘুমে আছে যেন সারা শরীর নিস্তেজ। সায়নী কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তার দিকে, আর ভাবতে লাগল, তবে সে যা দেখল, সেটা কি স্বপ্ন ছিল? নাকি কুয়াশার প্রতিচ্ছায়া? কিন্তু তার বুকের মধ্যে একটা অস্বস্তি ঘুরপাক খাচ্ছিল—যেন কিছু একটা ভীষণ অনুচিত ঘটতে চলেছে, কিংবা ইতিমধ্যেই ঘটে গেছে।

সকালের আলো যখন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ল দ্বীপজুড়ে, তখন চারপাশে যেন অস্বাভাবিক এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। পাখিরা নেই, হাওয়া নেই, গাছের পাতাও যেন স্থির হয়ে আছে। কালীচরণ সেই ভোরে নৌকার দিকে চলে গেছিল, আর বলে গেছিল—”আজ আমি রই না বাবু, দ্বীপের ছায়া গা ঘেঁষে উঠেছে। তোমরা সাবধানে থাকো।” সায়নী আর রুদ্র চুপচাপ তাঁবু গোছাতে শুরু করল, কিন্তু লক্ষ্য করল অর্ক এখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পেয়ে তাঁরা যখন তাঁবুর দরজা খুলে দেখল—অর্ক সেখানে নেই। ব্যাগ, ক্যামেরা, নোটবই সব জায়গায়, কিন্তু মানুষটা নেই। রুদ্রর মুখ কঠিন হয়ে উঠল, আর সায়নী নিঃশব্দে জলাশয়ের দিকে এগিয়ে গেল। কুয়াশা তখনও ছিল, কিন্তু তার মধ্যে দিয়ে একটি অশুভ দৃশ্য যেন ক্রমে পরিষ্কার হয়ে উঠছিল—জলের ধারে অর্কের দেহ মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। তার মাথা আধা ডোবা জলে, চোখ খোলা, ফাঁকা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, অথচ কিছুই দেখছে না। শরীর নিথর, ঠান্ডা। তার কানে গোঁজা হেডফোন থেকে খুব মৃদু শব্দ আসছিল, কিন্তু সেই শব্দ যেন কাঁটার মতো কানে ঢুকে যাচ্ছিল—একটাই বাক্য বারবার ঘুরে আসছে, একই ভয়াবহ কণ্ঠে, “ফিরে আয়… রুদ্র… ফিরে আয়… রুদ্র…” রুদ্র দৌড়ে গিয়ে হেডফোন খুলে ফেলল, কিন্তু শব্দটা যেন তখনও বাতাসে গুঞ্জন তুলছিল। সায়নী পেছনে সরে গেল, মুখে হাত চেপে ধরা, চোখে অশ্রু আর অবিশ্বাস। “এটা… এটা কী করে সম্ভব?” তার কণ্ঠ কাঁপছিল। রুদ্র হেডফোন আর রেকর্ডার হাতে নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইল অর্কের দেহের দিকে। সেই ফাঁকা চোখ, যেন মৃত্যুর সময়ও কিছু শুনছিল, কিছু দেখছিল, যা অন্য কেউ বোঝে না। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সে হয়তো কিছু অনুভব করেছিল—কোনো ডাক, কোনো ছায়া, যা তাকে নিজের দিকেই টেনে নিয়েছে।

সন্ধের আলো নেমে এলে তাঁরা অর্কের দেহ নৌকার কাছে এনে রাখল, আর কালীচরণকে ডেকে জানানো হলো সবকিছু। কালীচরণ দেখে শুধু বলল, “জলও নেয়, বাবু… জলও রাখে। আবার ফিরিয়ে দেয় তার নিজের মতো।” সেই রাতে তাঁবুতে আলো জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল, কিন্তু কেউ আর কথা বলছিল না। সায়নী স্তব্ধ, রুদ্র যেন কোন দূরের জগতের মানুষ হয়ে গেছে—চোখে ঘোর, মুখে কোন এক দুঃস্বপ্নের ছায়া। সে নিজের খাতায় কিছু লিখছিল চুপচাপ, আর মাঝে মাঝে হঠাৎ থেমে বাতাসে তাকিয়ে থাকত, যেন কারো নিঃশব্দ উপস্থিতি অনুভব করছে। রেকর্ডারে এখনো সেই ভয়ানক বার্তাটি রয়ে গেছে, আর রুদ্র সেটা বারবার শুনছিল—প্রথমে কৌতূহল নিয়ে, পরে বিস্ময়ে, তারপর একপ্রকার আত্মসমর্পণে। “ফিরে আয়… রুদ্র…”—এই কথাগুলো যেন তার নিজের শৈশবের কোনো পরিত্যক্ত কোণ থেকে উঠে এসেছে, কোনো অলিখিত অতীত যা তাকে টেনে এনেছে এই দ্বীপে। সায়নী তখন নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল রুদ্রর দিকে, আর ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল, যাকে সে জানে, সেই রুদ্র হয়তো আর নেই। এই দ্বীপ তাকে বদলে দিচ্ছে, ধীরে ধীরে গিলে ফেলছে—ভয়ের ছায়ার নিচে সে আর আগের মানুষ থাকছে না। সমস্ত দ্বীপ জুড়ে সেই ছায়া, ভয়, আর জলের নিঃশব্দ আহ্বান ছড়িয়ে পড়েছে—যে ডাক কেউ উপেক্ষা করতে পারে না, আর কেউ ফিরেও আসতে পারে না আগের জায়গায়।

দ্বীপটা যেন হঠাৎ করে প্রাণ পেয়েছে। আগে যা ছিল কেবল নিস্তব্ধতা আর পরিত্যক্ত ইতিহাসের ছায়া, এখন তা নিঃশব্দে ঘুরপাক খাচ্ছে কিছুর গভীর হাহাকারে। চারপাশের গাছপালাগুলো অকারণে দুলছে, পাতা ঝরে পড়ছে নিঃশব্দে, যেন কারও ফিসফিসানি শুনে থমকে দাঁড়াচ্ছে বাতাস। জলের ধারে হাঁটলে এখন আর নরম কাদার ছোঁয়া নয়, বরং অনুভব করা যায় এক অদৃশ্য শীতলতা—যা হাড়ের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দেয়। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা যায়, দ্বীপের জলের মুখে একধরনের সাদা কুয়াশা ভেসে বেড়াচ্ছে, যা শুধু নির্দিষ্ট কিছু ঘন্টায় জেগে ওঠে, এবং তার মধ্যে থেকে ভেসে আসে দূরবর্তী রিনরিনে গলার শব্দ—মৃদু, ভিজে, অথচ স্পষ্ট। কালীচরণ এবার আর কোনোকিছু বোঝাতে চায় না, সে নীরব। তার চোখে একরাশ আতঙ্ক। তিনি বলেননি কিছু, তবুও তার চেহারায় স্পষ্ট—সে দ্বীপকে আর চেনে না, যেন এই ভূখণ্ড বদলে গেছে।

সায়নী একা বেরিয়ে পড়ে দ্বীপের পূর্বদিকে, যেখানে বনঘেরা এক ঢিবির নিচে পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সে দেখতে পায় এক অদ্ভুত গুহামুখ। ছোট্ট খাঁজ, শিকড়ের আড়ালে চাপা পড়া প্রবেশপথ, যেটা কেউ কখনো খুঁজেও পায়নি। ভিতরে ঢুকতেই তার সামনে খোলে এক রহস্যময় কক্ষ, যার দেওয়াল জুড়ে খোদাই চিহ্ন—মানুষের বলির ছবি, নারীমূর্তি যার মুখ ঘোরানো, হাতে শঙ্খ, আর পায়ের নিচে গহ্বর। সে কক্ষের মেঝেতে পড়ে থাকা পোড়া মাটির পাত্রে জমে থাকা সুগন্ধি তেল, বালির স্তূপের নিচে ভাঙা চুড়ি ও কাঁচের টুকরো—সব কিছু বলছিল এক ইতিহাসের কথা। সায়নী অনুভব করল, এই আত্মা, এই জলঢোঁড়া—কেবল কোনো যন্ত্রণা নয়, সে এক সময়কার অন্যায় বিচারহীনতার প্রতিশোধ। নদী এক নারীর কবর হয়েছিল, আর এখন সেই কবরই হয়ে উঠেছে প্রতিশোধের নদী। তার শ্বাস ভারী হয়ে আসে, সে বুঝতে পারে—এ দ্বীপে তারা শুধু এক ইতিহাসের নথি করতে আসেনি, তারা হয়ে উঠেছে সেই ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রুদ্র এদিকে আর স্বাভাবিক নেই। তার চেহারায় নেমে এসেছে ঘোরতর ধন্দ আর ক্লান্তি। সে রাতে শোনা সেই আওয়াজগুলো এখন শুধু রাতে নয়, দিনের আলোতেও তার কানে বাজে—”রুদ্র… বাবু… ফিরে আয়…” কণ্ঠটা তার মায়ের, যাকে সে শৈশবে হারিয়েছিল এক জলের দূর্ঘটনায়। সে বারবার বলছে, সে ঠিক শুনতে পাচ্ছে তার মা তাকে ডাকছে। সায়নী তাকে বোঝাতে চায় যে এটা তার অবচেতনের খেলা, কিন্তু রুদ্রের চোখে এখন আর যুক্তির চিহ্ন নেই—তবে একরাশ আবেশ, একরাশ কান্না। সে হেঁটে চলে যায় নদীর পাড়ের দিকে, পায়ের নিচে কাদা, চোখে কুয়াশা। দূরে জল ঢেউ খাচ্ছে না, বরং কেমন থমথমে, স্তব্ধ। অদ্ভুতভাবে দ্বীপের জঙ্গল যেন তার চলার পথ থেকে সরে যায়, কুয়াশা খোলে, আর মাঝখানে এক গাঢ় সবুজজলের ঝিলিকের মধ্যে কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে—ছায়ামূর্তি, যার ঠোঁটে সেই চেনা ডাক। এই মুহূর্তে দ্বীপ, জঙ্গল, সময়—সব যেন অপেক্ষা করছে কোনো চূড়ান্ত মিলনের, যেখানে মানুষ আর আত্মা, অপরাধ আর প্রতিশোধ, সত্য আর অলৌকিক—সব একাকার হয়ে যায় মৃত্যু নদীর বুকে।

রাত গভীর হতে না হতেই দ্বীপে আবার কুয়াশা নামে, আর সেই কুয়াশার ভারে যেন নিঃশব্দে মুছে যেতে থাকে উপস্থিত মানুষদের চিহ্ন। শিবিরে সকলে গভীর আতঙ্কে থাকলেও বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ করেই তারা আবিষ্কার করে—কালীচরণ নিখোঁজ। তার চাদর পড়ে আছে তাবুর এক কোণে, যেন কেউ তা সরিয়ে রেখে নিঃশব্দে উঠে গেছে। সায়নী বারবার বলে, এমন কিছু সে অনুমান করেছিল, কারণ কালীচরণের মুখে আগের দিন রাতে এক অদ্ভুত আতঙ্ক জমেছিল, সে বারবার বলছিল, “জলডাঙা বেঁচে আছে… ওর ডাকে কেউ না কেউ সাড়া দেবেই…” এখন, সে নিজেই সেই ডাকে সাড়া দিয়েছে। চারদিক খুঁজে কোনো হদিস না মেলায় রুদ্র একবারের জন্য বলে, “আমি যাব… শেষবার ক্যামেরা নিয়ে ঘাটটা ঘুরে দেখে আসি… মিরার যেখানে অদৃশ্য হওয়ার কথা বলেছিল কালীচরণ… হয়ত কিছু থেকে গেছে…”। সায়নী চায় না সে একা যাক, কিন্তু রুদ্রের চোখে তখন এক অদ্ভুত স্থিরতা, যেন সে বুঝে গেছে নিজের ভূমিকা কী, যেন তার ভিতর থেকে কেউ ডেকেছে—জলের নিচ থেকে, অতীত থেকে।

ঘাটে এসে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই রুদ্র টের পায়, বাতাসের শব্দ থেমে গেছে, কুয়াশা জমাট বেঁধে এক আবরণ তৈরি করেছে চারপাশে। সে ক্যামেরা অন করে, ফ্রেমে ধরতে চায় সেই জলের শান্ত অথচ ভয়াল চেহারা, যেটা এখন যেন তার নিজেরই ছায়া গিলে খেতে উদ্যত। কিন্তু হঠাৎ, ক্যামেরার স্ক্রিনে সে যা দেখে তা তাকে স্থবির করে দেয়—জলের ওপরে ভেসে আছে একটা মুখ। প্রথমে মনে হয়, হয়ত কালীচরণ, হয়ত মিরা… কিন্তু না, সেটা তার নিজেরই মুখ। নিজের চোখ, নিজের ঠোঁট, নিজের চেহারা—তবে অনেক স্থির, নিঃশ্বাসহীন, জলের ছায়ার মতো যেন মৃত। রুদ্র শিউরে ওঠে, স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে জলের দিকে তাকায়, আর তখনই দেখে জলের নিচে যেন কেউ হাত বাড়িয়ে ডাকছে—তার মা, তার শিশুকালের শোকাবহ মুখ, মিরা যার চুল ভেসে যাচ্ছে ঢেউয়ে, অর্ক যার চোখে এখনও ভয় জমে আছে, আর শেষের সারিতে কালীচরণ—চোখে এক অদ্ভুত শান্তি। সেই মুহূর্তে রুদ্র বোঝে, সে আর পিছোতে পারবে না। এই ডাক তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সেখানে, যেখানে মৃত্যু নেই—আছে শুধুই আত্মার অপেক্ষা।

সায়নী ছুটে আসে যখন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তার চিৎকার, তার কান্না কেবল বাতাস কাঁপায়—জল নয়। রুদ্রের জুতো পড়ে আছে ঘাটের কিনারে, ক্যামেরাটা বালির মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়া, কিন্তু মানুষটিকে আর কোথাও দেখা যায় না। সায়নী হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, দেখে, ক্যামেরায় শেষ রেকর্ড হওয়া ফুটেজে সেই মুহূর্ত ধরা আছে—জলের উপর রুদ্রের প্রতিচ্ছবি, তার চোখের দৃষ্টিতে একরাশ প্রশান্তি আর প্রতীক্ষা। এবং ভিডিওর শেষ মুহূর্তে জলের নিচ থেকে উঠে আসে একাধিক মুখ, নিঃশব্দে ডাকে, তারপর আবার মিলিয়ে যায়। দ্বীপ এখন আবার চুপ, যেন কিছুই ঘটেনি। কুয়াশা ধীরে ধীরে পাতলা হয়, জঙ্গল আবার স্তব্ধ। কিন্তু এই নৈঃশব্দ্য এখন শুধু প্রাকৃতিক নয়, বরং ইতিহাসের, আত্মার, প্রতিশোধের। সায়নী জানে—এ কেবল ডকুমেন্টারির গল্প ছিল না, এ ছিল এক অসমাপ্ত আত্মার ইতিহাস, যার ডাকে কেউ না কেউ সাড়া দেয়… সবসময়।

১০

সকালটা যেন অস্বাভাবিকভাবে নিস্তব্ধ। দ্বীপের ওপরে সূর্য উঠেছে ঠিকই, কিন্তু তার আলোয় কোনো উষ্ণতা নেই—বরং চারপাশে ছড়িয়ে আছে শোক, শূন্যতা আর ভয়। সায়নী একা দাঁড়িয়ে থাকে ঘাটের ধারে, যেখানে জল থমকে আছে নিঃশব্দ। আগের রাতের সমস্ত ভয়াবহতা, চিৎকার, হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা যেন শুষে নিয়েছে চারপাশের প্রকৃতি। রুদ্র আর নেই। অর্ক, কালীচরণ, মিরা—সবাই চলে গেছে এক অদৃশ্য জগতের দিকে, যেখানে একবার গেলে আর ফিরে আসা যায় না। কেবল সায়নীই রয়ে গেছে, হয়ত শুধু এই সত্যি দুনিয়াকে প্রমাণ করার দায়ে, কিংবা হয়ত জলঢোঁড়ার মতো সেই অতৃপ্ত আত্মারা তাকে বেছে নিয়েছে তাদের সাক্ষ্য বহন করার জন্য। সে বোঝে, জীবনে ফিরতে হবে, কলকাতায় ফিরে যেতে হবে, কিন্তু এই দ্বীপের স্মৃতি, এই জলের নিচের কাহিনি, তার ভিতর থেকে কোনোদিন মুছে যাবে না। সে প্যাক করে রুদ্রের ক্যামেরা, রেকর্ডার, সমস্ত নথি—যেন এগুলোই এখন তার কাছে জীবনের একমাত্র চিহ্ন।

কলকাতায় ফিরে আসা যেন একটা অসম্ভব অভিজ্ঞতা। রোদেলা শহরের মুখোশের নিচে যে ভয় লুকিয়ে আছে, সায়নী তা এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারে। সে থানায় যায়, ডায়েরি করে, রুদ্র ও বাকিদের খোঁজে সাহায্য চায়, ক্যামেরা ফুটেজ, রেকর্ডার সব দেয় তদন্তকারীদের হাতে—কিন্তু তারা তা হাস্যকর গল্প বলে উড়িয়ে দেয়। কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে একটি দ্বীপে আত্মারা বাস করে, যে জল প্রতিশোধ নেয়, যে অতীতের অন্যায় আজও মানুষের ওপর চেপে বসে আছে। এক পুলিশ অফিসার হেসে বলে, “আপনি তো সিনেমার লোক, হয়ত নতুন কোনও হরর ফিল্ম বানাতে যাচ্ছেন…”। সায়নী হতাশ হয়, রেগে যায় না, কেবল একটা বিষণ্নতা নিয়ে ফিরে আসে—এখন তার লড়াই কেবল সত্য প্রকাশের নয়, বরং স্মৃতিকে রক্ষা করার। সে বসে পড়ে রুদ্রের তোলা সমস্ত ভিডিও, অর্কের রেকর্ড, কালীচরণের গলায় শোনা পুরোনো লোকগাথা—সবকিছু জুড়ে এক অদ্ভুত টানটান চিত্রনাট্য তৈরি করে, যেটা সে বিশ্বাস করে সারা পৃথিবীর সামনে পৌঁছানো দরকার। দিনরাত এক করে সে বানায় এক ভিন্নধর্মী ডকুমেন্টারি—“জলঢোঁড়ার ডাক”।

ডকুমেন্টারির শেষ দৃশ্যটি হয় রুদ্রর সেই মুহূর্তের ক্লিপ দিয়ে—যখন সে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চোখে ভয় নয়, বরং এক অদ্ভুত শান্তি, আর পেছনে জল উঠছে ধীরে ধীরে তার কানে, মাথায়। সেই দৃশ্য দিয়ে সিনেমা শেষ হলেও দর্শকদের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে শুরু করে। প্রথম প্রিমিয়ারে কিছু দর্শক বলে, তারা সিনেমা চলার সময় নিজের কানে এক ফিসফিস শব্দ শুনেছে, যেন কেউ বলছে, “ফিরে আয়… ফিরে আয়…”। কেউ কেউ হল থেকে বেরিয়ে এসে বলে, জলের শব্দটা বাস্তবের চেয়েও গভীর ছিল, যেন তারা সেই দ্বীপেই চলে গিয়েছিল কয়েক মুহূর্তের জন্য। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে অভিজ্ঞতা—“এই সিনেমা শুধু দেখা যায় না, এটা শোনা যায়… ভিতর দিয়ে… আত্মা দিয়ে…”। কেউ কেউ রাতের বেলায় হেডফোনে দেখে আবার সেই ফিসফিসে ডাক শুনে, কেউ ঘুম ভেঙে উঠে দেখে চোখের কোনায় জল। সায়নী চুপ থাকে, কিছু বোঝায় না, কারণ সে জানে, জল কেবল এক প্রাকৃতিক উপাদান নয়—জল স্মৃতি, জল প্রতিশোধ, জল ডাক। জল এক নিঃশব্দ কান্না, যা কেবল সেইসব মানুষ শুনতে পায়, যারা সত্যকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে। আর তাই, সায়নীর নির্মিত “জলঢোঁড়ার ডাক” হয়ত কেবল একটি সিনেমা নয়—এ এক আত্মার বহিঃপ্রকাশ, এক অসমাপ্ত ইতিহাসের আর্তনাদ, যেখানে শেষ পর্যন্ত শুধু জল থাকে… চুপচাপ, অথচ সমস্ত কিছু বলে যায়।

****

1000050748.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *