সাম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১
রঞ্জনের সকালগুলো ছিল শব্দহীন কিন্তু জীবন্ত, এক টুকরো জলছবির মতো। ঘুম ভাঙতো কাদামাটির বাড়ির চালা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রোদের ছায়া গায়ে মেখে। দূরে মন্দার নদী তখনো ঘুমিয়ে, শুধু কচুরিপানার মাঝখানে গুটিকয়েক হাঁস দুলে বেড়ায়, আর বাতাসে ভেসে আসে মাছ ধরার জালের গন্ধ। মা তখন রান্নাঘরে চাল বেছে, পেছনে একটা লাঙল-ধোয়া পুকুরঘাট থেকে ভেসে আসে সুর করে গাওয়া কোনো বাউল গান। রঞ্জন দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ায়—পায়ে কাদা, কাঁধে একটা ছেঁড়া তোয়ালে, হাতে বাবার দেয়া পুরনো জাল। তার দিন শুরু হয় এই নদী, ঘাস, গন্ধ, আর ছেঁড়া আকাশ নিয়ে। স্কুলে যাওয়ার আগে রঞ্জনের পছন্দ ছিল নদীর পাড়ে হাঁটা, যেখানে বাঁশঝাড় আর শালিকের ডাক মিলেমিশে একধরনের গোপন গান গাইত। সে জানত না তখনও, এই যে প্রতিদিনের চেনা দৃশ্য, এর প্রতিটা রঙ, প্রতিটা ঘ্রাণ—সব একদিন হারিয়ে যাবে।
সে বছর বর্ষা যেন আগের চেয়ে আগ্রাসী হয়ে এসেছিল। বৈশাখের শেষ সপ্তাহ থেকেই আকাশ কালো হয়ে আসত সন্ধ্যার আগেই, আর মেঘ গর্জে উঠত যেন কোনো অদৃশ্য দৈত্য নদীকে চাগিয়ে তুলছে। বিজন হালদার, রঞ্জনের বাবা, কয়েক রাত ধরে নৌকা বেঁধে রাখার দড়ি আরও শক্ত করছিলেন, মা মাটির হাঁড়ি পলিথিনে মুড়ে রাখছিলেন রান্নাঘরের এক কোণে। আর রঞ্জন শুধু দেখতে পেত, কীভাবে নদীটা প্রতিদিন একটু করে এগিয়ে আসছে তাদের উঠোনের দিকে। তারপর এক রাতে, সেই শব্দহীন সকালে জন্ম নেওয়া শান্ত গ্রামটিকে গ্রাস করল এক নিঃশব্দ রুদ্রতা। নদীর বাঁধ ভেঙে ঢুকে পড়ল জল, ভাসিয়ে নিল রঞ্জনের স্কুলঘর, মাঠের মাঝের আমগাছ, এমনকি পাশের গোমস্তার খেঁজুরগাছটাও। রঞ্জন তখন মায়ের কাঁধে, কাঁধে পেছনে বাঁধা একটা পুঁটলি আর বুকের ভেতরে একটা শব্দহীন চিৎকার। সবকিছু যেন পেছনে ফেলে একটা ঘোলা জলের ঢেউ তাদের ঠেলে নিয়ে গেল দূরের দিকে। সকালের হাঁসেরা আর ভেসে এল না পরদিন।
তিন দিন পর জল নামল, কিন্তু গ্রামটা আর আগের মতো রইল না। কাদা জমে গেল উঠোনে, দেয়ালের চাল ভেঙে পড়ে থাকল, আর খোঁজ মেলেনি রঞ্জনের প্রিয় সাথী কুট্টুর—একটা বাদামী কুকুর, যে প্রতিদিন তার সঙ্গে নদী ঘাট অব্দি আসত। বিজন হালদার চোখ নামিয়ে চুপ করে বসে ছিলেন সেই ভোরে, যখন পঞ্চায়েতের লোক এসে বলল—“এবার ঘর সরাও, নদী আর ছাড়বে না।” মা সেই রাতে মুখে তুলে দিলেন পান্তা ভাত, কিন্তু রঞ্জনের মুখে কেবল কাদার স্বাদ। পরদিন সকালে তারা উঠে পড়ল বাঁশের তৈরি ছোট নৌকায়, সঙ্গে দুটো পুঁটলি, একটা তোশক, একটা ছবির খাতা। রঞ্জন শেষবারের মতো পেছনে তাকিয়ে দেখল তার ঘরটাকে—একটুকরো ছেঁড়া কুঁড়েঘর, যেখানে ছিল তার প্রথম আঁকা নদীর ছবি, দেওয়ালের গায়ে। সেই ছবি, সেই ঘর, আর সেই নদী—সব মিলিয়ে যে জগৎটা রঞ্জনের ছিল, সে বুঝে গেল—এই শিকড় হারানোর গল্প তার জীবনের প্রথম, কিন্তু শেষ নয়।
২
ঘর ছাড়ার পরের দিনগুলো ছিল রঞ্জনের জীবনে সবচেয়ে অনির্বচনীয় ও দুঃসহ অধ্যায়—নয়টি রাত তারা কাটিয়েছিল এক বাঁধের ধারে বাঁশ-তাঁবুতে, কাদায় বসে, প্লাস্টিকের শীটে জল চুঁইয়ে পড়া গুনে গুনে। মা আর বাবা ভিজে কাঁথা জড়িয়ে বসে থাকতেন, আর রঞ্জন নদীর দিকেই চেয়ে থাকত—সে জানত না কেন, হয়তো সে খুঁজছিল তার ছোট্ট কুকুর কুট্টুকে, হয়তো তার ভাঙা স্কুলঘরকে, অথবা সেই পাখির ঝাঁক যারা প্রতিদিন তাদের উঠোনে নামত। সরকারি লোকেরা একদিন এসে চাল-ডাল, একটা দুধের প্যাকেট দিয়ে গেল, আর বলল, “এখানে বেশিদিন থাকা যাবে না, ওদিকে জল বাড়ছে।” বাবা তখন একবার চুপ করে নদীর পাড়ে গিয়ে বসেছিলেন, অনেকক্ষণ। রঞ্জন জানে, বাবা কাঁদেন না, কিন্তু সেই দিন তার চোখের পাতা কাঁপছিল। মা রাতে বলেছিলেন, “এই বৃষ্টি কেবল আকাশে পড়ছে না রে রঞ্জু, আমাদের বুকেও পড়ছে।”
তারপর শুরু হলো আরেক রকমের যাত্রা—বাঁধ থেকে তারা পৌঁছল জেলা শহরের এক ত্রাণ শিবিরে। সেখানে ঘরঘরের দেয়াল ছিল প্লাস্টিকের, ছাদ ছিল টিনের, আর পায়ের নিচে ছিল কাদার চেয়েও বেশি অনিশ্চয়তা। অনেক পরিবারের সঙ্গে মিলে মিশে থাকা, একসঙ্গে বসে মুড়ি-চানাচুর খাওয়া, অসুস্থ শিশুর কান্না, মা-বোনদের সংকোচ, পুরুষদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির ভেতর দিয়ে কাটতে লাগল কয়েক সপ্তাহ। কিন্তু রঞ্জন দেখতে পেত, কিছু শিশু সেখানে খেলতে চেষ্টা করত। কেউ কাগজে ঘুড়ি বানাত, কেউ কাদায় ছবি আঁকত কাঠির মাথায়। সে নিজেও একদিন একটা ভাঙা ইট দিয়ে মাটিতে এঁকে ফেলল তাদের হারানো ঘরটা—একচালা কুঁড়েঘর, পেছনে একটা আমগাছ, আর ডানদিকে একটা নদী। পাশ থেকে একটা মেয়ে বলেছিল, “তুই খুব ভালো আঁকিস।” রঞ্জনের ভিতরে কোথাও যেন প্রথমবারের মতো কিছু নড়ে উঠেছিল—যেন শিকড় কাটা এই জীবনের ভেতরে তার একটা কিছু এখনো আছে, যা হারায়নি।
শিবিরে থাকা অবস্থায় একদিন বিজন হালদার জানিয়ে দিলেন, “এভাবে তো চলবে না, শহর যেতে হবে। কাজকাম না করলে পেট চলবে না।” মা কিছু বললেন না, শুধু পুঁটলি গুছিয়ে ফেললেন চুপচাপ। রঞ্জন তখনো বুঝে উঠতে পারেনি—“শহর” মানে ঠিক কী? তাদের মতো বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য শহর কি সত্যিই আশ্রয় নাকি আরেকটা অনিশ্চয়তা? ট্রেনের ধাতব গর্জনের ভিতরে দাঁড়িয়ে সে প্রথম অনুভব করল, তার ছোট নদী, তার গাছ, তার মাঠ—all are fading—ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে জানালার বাইরে। কোলে রাখা ছবি আঁকার খাতা শক্ত করে চেপে ধরেছিল সে—যেন তাতেই লুকিয়ে আছে তার ফেলে আসা জীবনের শেষ রঙের চিহ্ন। যাত্রা ছিল মাত্র কয়েক ঘণ্টার, কিন্তু রঞ্জনের জন্য সেটা যেন কয়েক শতাব্দীর সমান দীর্ঘ—এক শিকড়ছেঁড়া জীবনের সূচনা যার নাম “শহর”।
৩
ট্রেনের কামরায় রঞ্জনের চোখ দুটো কখনও জানালার বাইরে, কখনও মা-বাবার মুখে ঘোরাফেরা করছিল। চারপাশে গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষেরা—কেউ বস্তায় বসে, কেউ দরজার ধারে দাঁড়িয়ে, কেউবা ছোট শিশুদের কোল জড়িয়ে গভীর ঘুমে—সবাই যেন কোন অদৃশ্য নদীর টানে ভেসে যাচ্ছে এক অভিন্ন গন্তব্যে। মাঝে মাঝে ঝাঁকি খেয়ে ট্রেন কাঁপলে একটানা ঝিঁঝিঁ শব্দের মতো উঠে আসত অস্থিরতা। মা চুপ করে বসে আছেন, কোলে একটা ছোট পুঁটলি আর এক হাতে রঞ্জনের কাঁধ আঁকড়ে। বাবার মুখ পাথরের মতো—কোনো অনুভব নেই সেখানে, না অভিমান, না আশ্বাস। রঞ্জন শুধু ভাবছিল, এই যাত্রা কি আসলে কোনও বাড়ির দিকে, না কি আরও দূরের এক অনামা শূন্যতার খোঁজে?
ট্রেন ছুটে চলছিল শূন্য প্রান্তর পেরিয়ে, মাঝেমাঝে ছাউনি ঢাকা ছোট ছোট স্টেশন আসে, কিছু লোক নেমে যায়, কিছু উঠে আসে। এক বৃদ্ধ বলছিলেন, “পূর্বে জল উঠেছে গলার সমান, চারদিকে শুধু কাদা, এবার আর ফেরা হবে না।” এক তরুণ বলছিল, “ওই শহরে কাজ মিলবে, সিমেন্টের বিল্ডিং উঠে উঠছে এখনো।” কথাগুলো রঞ্জনের কানে আসছিল, কিন্তু হৃদয়ে ঢুকছিল না। সে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল চেনা পৃথিবী বদলে যাচ্ছে—ধানক্ষেতের বদলে কংক্রিটের ফ্ল্যাট, কলসির বদলে ট্যাংকের পানির গাড়ি, আর আকাশের বদলে কেবল গম্বুজের মতো ঢেকে থাকা ধোঁয়া-ছাওয়া রেখা। একটা সময়, মা বললেন, “শুনছিস রে? শহরের নাম নৈহাটি, ওখানেই আছে রায়হান কাকু।” রঞ্জন কিছু না বলে মাথা নাড়ল। তার দৃষ্টিতে তখনো ঘুরছিল তাদের পুরনো ঘরটার জানালা, যার বাইরেই ছিল একটা পেয়ারা গাছ—যেখানে বসে সে তার প্রথম জলছবিটা এঁকেছিল।
স্টেশনে নেমে ভীড়ের স্রোতে তারা গা ভাসিয়ে দিল। রায়হান কাকু এলেন একটা ভাঙাচোরা সাইকেলে করে, মুখে চেনা হাসি, চোখে একরাশ ক্লান্তি। “আয়, আমার সঙ্গেই আয়, সামনের বস্তিতে জায়গা হয়েছে, ছোট বটে কিন্তু চাল আছে, দেয়াল আছে, মাটির ওপর তো আর শুতে হবে না।” পথে যেতে যেতে রঞ্জন দেখছিল মানুষ, দোকান, ইলেকট্রিক লাইন, ছোট চা-দোকান—সবই অচেনা, অস্থির, ভিড়ের ভেতরে যেন কোথাও একটা গর্জন লুকিয়ে আছে। তাদের নতুন ঘরটি ছিল জোড়াতালি দেওয়া টিনের ছাউনি আর কাঠের বেড়া ঘেরা এক কামরা, যেখানে ছোট খাট, একটা বালতি, আর একটা সাদা রঙের ফুটন্ত গরমে পুড়ে যাওয়া কুকুর কুঁড়ে ছিল এক কোণে। কিন্তু মায়ের মুখে একরকমের আরাম ফুটে উঠল, যেন মাটির ছোঁয়া ফিরে পেয়ে তিনি হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। রঞ্জন তখনো দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে ছিল ঘরের বাইরের একটা দেয়ালে—যেখানে কেউ যেন চুন দিয়ে একটা অর্ধেক নদী এঁকেছিল, যার বাকি অংশ বাতাসে মিলিয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে, রঞ্জন বুঝল, তার নতুন জীবনের শুরু হয়েছে—শহরের বুকে এক অপূর্ণ জলছবির খোঁজে।
৪
নৈহাটির উপকণ্ঠে রায়হান কাকুর বস্তিটা ছিল শহরের সীমান্তে এক ধূসর টুকরো—যেখানে ছাই আর কাদার মাঝখানে গজিয়ে উঠেছে ছেঁড়া তার, সস্তা টিন আর কাঠের ত্রিভুজে টিকে থাকা হাজারো ঘর। রঞ্জনের পরিবারের ঠাঁই হয় বস্তির সবচেয়ে পিছনের গলিতে—যেখানে ডানদিকে ড্রেনের পঁচা গন্ধ, বামে একটা খোলা জায়গায় ছেলেরা টায়ার জ্বালিয়ে রাতের তাপ জোগায়। এই ঘরে আসার পর প্রথম রাতে রঞ্জন ঘুমোতে পারেনি। ছাদের টিনে যখন রাতভর বৃষ্টির শব্দ পড়ে, তখন তার কানে শোনা যায় সেই নদীর কলধ্বনি, সেই হারানো কুকুর কুট্টুর ঘেউ ঘেউ, আর স্কুলের ঘণ্টাধ্বনি—সবকিছু যেন শহরের কংক্রিটে চাপা পড়ে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। মা ছোট্ট চুল্লিতে রান্না করতে বসেন, বাবার কাজ জোটে এক নির্মাণ সাইটে, যেখানে ভোরবেলা ঘুম ভেঙেই ছুটতে হয়। রঞ্জন দিনের একটা বড় সময় কাটাত রায়হান কাকুর আশপাশে, যে কিনা নিজে একসময় ভাটিরচরের বাসিন্দা ছিল—নদী গিলে খেয়েছে তার মাটির ভিটে, পানের বরজ, বউয়ের ঘর। এখন সে এই শহরের পুরনো মানুষ, জানে কোন দোকানে দাম কম, কোন রাস্তায় পুলিশ কম টানাহ্যাঁচড়া করে।
রঞ্জন একদিন কাকুকে জিজ্ঞেস করেছিল, “আপনি কি শহরটা পছন্দ করেন?” রায়হান কাকু মুচকি হেসে বলেছিলেন, “শহর কি ভালোবাসা যায় রে বাপ? এটা তো দরকারের জায়গা, ভালোবাসা তো ফেলে এসেছি সেই বানের জলে।” এই কথাগুলো রঞ্জনের মনে গেঁথে যায়। সে বুঝতে পারে, বস্তিতে থাকা মানুষেরা কেউই শহরের নাগরিক নয়, তারা যেন ‘অতিথি’—যাদের থাকার কথা নেই, কিন্তু চলে যাওয়ার জায়গাও আর নেই। সে দেখে তার মতো ছেলেরা স্কুলে যায় না, কাগজ কুড়ায়, সিগারেটের দোকানে কাজ করে, কেউবা প্লাস্টিক বোতল জোগাড় করে বিক্রি করে। মা তাকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য দুইবার সরকারি অফিসে গিয়েছেন, একটা ফর্ম, একগাদা কাগজ, আর এক ক্লান্ত মুখ নিয়ে ফিরে এসেছেন। এরপর একদিন রায়হান কাকু নিজের পরিচিত এক NGO-র মাধ্যমে রঞ্জনের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন—স্থানীয় একটি সরকারি স্কুল, যেখানে ফ্ল্যাটপ্যান্ট পড়া ছেলে-মেয়েরা থাকে, আর ভীড় করে বাস ধরে আসে এক-একটা ক্লাসে।
স্কুলের প্রথম দিনেই রঞ্জন টের পায়, শহরের শিশুরাও শেকড় হারাতে জানে, কিন্তু তারা সেটা লুকিয়ে রাখে জামার ভাঁজে, স্মার্টফোনের আলোয়, আর ইংরেজি উচ্চারণে। “এই যে, নতুন মাড বয় এসেছে”—বলেই এক ছেলে তার দিকে চেয়ে হেসে ওঠে। তারা জানে না, রঞ্জনের হাতে আঁকা একটা পুরনো জলছবি এখনো বেঁচে আছে তার স্কুলব্যাগের ভাঁজে। বাংলা ক্লাসে তনিমা সরকার মিস রঞ্জনকে লেখার জন্য বলে, “তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা নিয়ে রচনা লেখো।” রঞ্জন লেখে—“নদী ছিল একসময় আমার মা।” সে লেখে কীভাবে নদী তাকে গান শোনাত, কীভাবে তার শৈশবের প্রতিটি দুপুর ছিল কাদা, ঢেউ আর সোনার রোদের খেলা। তনিমা মিস পড়ে চুপ করে থাকেন, তারপর তার খাতা বন্ধ করে বলেন, “তোমার চোখে নদী মরে যায়নি, তুমি শুধু ঠিকমতো বলতে শিখোনি এখনো।” সেই দিন রঞ্জনের মনে হয়, শহরের মধ্যেও হয়তো কোথাও একটা নদী লুকিয়ে আছে, যে তাকে আবার খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। সেই রাতেই সে ঘরের দেয়ালে কালি-চুনে আঁকে—একটা নদী, যার দুই পাড়ে আছে ঘর, স্কুল, আর এক পাশে একটা কুকুর ছুটে যাচ্ছে স্রোতের দিকে। শিকড় হয়তো কেটে গেছে, কিন্তু জলছবি এখনো আঁকা যায়—এই বিশ্বাসে রঞ্জন প্রথমবারের মতো শহরটাকে নিজের করে দেখতে শেখে।
৫
রঞ্জনের স্কুলজীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয় এক বর্ষণমুখর সকালে। বস্তির পেছনের সরু রাস্তায় পা ভিজিয়ে সে হাঁটছিল মায়ের হাত ধরে—হাতে ভাঙা ছাতা, পিঠে ছোট ব্যাগ আর বুকের মধ্যে একরাশ অজানা আতঙ্ক। স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সে প্রথমবার দেখে শহরের স্কুল: উঁচু পাঁচিল ঘেরা, রঙচটা বিল্ডিং, ভেতরে ঢুকলেই চক-ধূলো আর গরমে ভরা ক্লাসঘর, আর তার চেয়েও বেশি ছিল মানুষের চাহনি। ক্লাসে ঢোকার পর সবাই একসাথে তার দিকে ঘুরে তাকায়—নতুন ছেলের গায়ে কাদার ছিটে, মুখে লজ্জা, আর চোখে কৌতূহল। কেউ কেউ ফিসফিস করে বলে, “বস্তির ছেলে,” কেউ ডাকে “মাড বয়।” রঞ্জন যেন নিজেই বুঝতে পারে না, সে এখানে সত্যিই আছে কিনা, নাকি এখনো তার গায়ে লেগে আছে নদীর গন্ধ। শিক্ষিকা এসে রোলকল নেন, শেষে বলেন, “নতুন ছেলেটার নাম রঞ্জন, সবাই বন্ধুর মতো থাকো।” কিন্তু বন্ধুত্বের ছায়া সেই ক্লাসে কেবল দেওয়ালের গায়েই আঁকা ছিল, বাস্তবে নয়।
মধ্যাহ্নভোজের সময়ে সে এক কোণায় বসে থাকে। অন্যরা নিজেদের খাবার বের করে, ভাগ করে খায়, অথচ রঞ্জনের গামছা মোড়ানো কাঁসার হাঁড়িতে ছিল কেবল লবণভাত। কেউ পাশে বসে না, যেন তার গা থেকে কোনও অপরিচ্ছন্নতার ভয় ছড়াচ্ছে। সেই সময়েই তনিমা সরকার, বাংলা ক্লাসের শিক্ষিকা, এসে বসেন পাশে। তিনি বলেন, “তুমি একা বসে আছো কেন?” রঞ্জন লজ্জায় কিছু বলে না, শুধু চোখ নামিয়ে রাখে। “তুমি কি ছবি আঁকতে ভালোবাসো?” প্রশ্নটা শুনে সে চমকে ওঠে—কেউ তার ছবি আঁকার কথা জানে কী করে? সে মাথা নাড়ে, আর ব্যাগ থেকে বের করে দেয় একটা খাতা, যেখানে আঁকা ছিল নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার পুরনো ঘর, পাশে কুকুরটা, আর ওপরে ছোট্ট করে লেখা—‘ধনীরচর, আমার গ্রাম’। তনিমা মিস চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপর বলেন, “তোমার ছবি কথা বলে রঞ্জন। তুমি শুধু আঁকো, বাকি কাজ আমি করব।” সেই দিন, শহরের প্রথম নিঃসঙ্গ দুপুরে, রঞ্জন বুঝে যায়—শহরের সব মুখই শত্রু নয়, কারো চোখে হয়তো এখনো জেগে আছে নদীর মতো মায়া।
দিন যেতে থাকে। তনিমা মিস রঞ্জনকে রচনার জন্য উৎসাহ দেন। একদিন রঞ্জন ক্লাসে পড়ে শোনায় নিজের লেখা—“নদী ছিল একসময় আমার মা।” সে লেখে, কেমন করে নদী তাকে গান শোনাত, কেমন করে সে শুয়ে থাকত বিকেলের রোদে, নদীর ঢেউয়ের শব্দে ঘুমিয়ে পড়ত। সে লেখে, কীভাবে নদী একদিন সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল, শুধু তাকে রেখে গেল একা। গোটা ক্লাস নিঃশব্দ হয়ে যায়। কেউ কেউ হাসি থামিয়ে শুনতে থাকে। কেউ হয়তো প্রথমবার বুঝতে পারে, রঞ্জন কোনো ‘মাড বয়’ নয়, বরং এমন একজন, যার বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে এখনো, যার চোখে এখনো নদীর জল থরথর করে। সেই দিন সন্ধ্যায়, স্কুল শেষে রঞ্জন ঘরে ফিরে এসে দেয়ালে প্রথমবার শহরের জলছবি আঁকে—দুইপাশে উঁচু বিল্ডিং, মাঝখানে নদী, আর নদীর ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক ছেলে, যার পিঠে ব্যাগ, হাতে খাতা, আর মুখে একরাশ স্বপ্ন।
৬
বস্তির জীবনের প্রতিটি দিন ছিল রঞ্জনের কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা, এক অজানা পরীক্ষার খাতা—যেখানে প্রশ্ন ছিল, কিন্তু উত্তর খুঁজতে হতো নিজের মতো করে। মায়ের রান্না করা মুড়ি, ছোলা আর ছেঁড়া শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দোকান দোকান ঘুরে বিক্রি করা, বাবার কনস্ট্রাকশনের কাজ থেকে ফিরে আসা শরীরভর্তি সিমেন্টের গন্ধ—সবকিছু মিলিয়ে এই ঘরটা যেন সত্যিই কাঁচা, কিন্তু ভেতরে তৈরি হচ্ছিল কিছু একটার পাকা ভিত। রঞ্জন স্কুল থেকে ফিরে ছাদে বসে আকাশ দেখত। দূরে রেললাইন, তার ওপাশে বহুতল ফ্ল্যাটের সারি—যেন এক পৃথিবী, যেখানে সে থাকতে পারে না, কিন্তু যেটা তাকে প্রতিনিয়ত ডাকে। এক সন্ধ্যায় সে চুন-সাবান দিয়ে তাদের ঘরের বাইরের দেয়ালে আঁকে তার পুরনো গ্রামের ছবি—পেছনে নীল নদী, সামনে খেজুর গাছ, আর মাঝখানে ছোট কুঁড়েঘর। ছবি দেখে পাশের ছেলেটি—চন্দন—বলেছিল, “তুই জানিস, তুই পেন্টারে পরিণত হবি একদিন।” রঞ্জন হেসে বলেছিল, “তুই জানিস, আমার ঘরটা এখনো ওই ছবিতেই দাঁড়িয়ে আছে।”
চন্দন ছিল বস্তিতে রঞ্জনের একমাত্র বন্ধু—চঞ্চল, মুখরা, কিন্তু দারুণ রকমের ভেতরের দুনিয়া নিয়ে থাকা এক ছেলে। সে কখনো স্কুলে যায়নি, সকালে কাগজ বিলি করে, দুপুরে তার বাবার সঙ্গে পুরোনো লোহা কুড়িয়ে ফেরে। কিন্তু সে গভীরভাবে দেখে রঞ্জনের আঁকা, প্রশ্ন করে, “তোর নদীটা কি সত্যি ছিল নাকি মনগড়া?” রঞ্জন বলে, “ছিল, এখনো আছে… কেবল আমার গায়ে লেগে।” একদিন চন্দন তার জন্য রঙের ছোট বাক্স নিয়ে আসে—বাজার থেকে একটা পুরোনো বক্স কিনে, যার সবগুলো রং ভাঙা হলেও ভেতরে একরাশ উজ্জ্বলতা জমা ছিল। “তোকে আমি একদিন শহরের দেওয়ালে তুলে দেব,” চন্দন বলেছিল মজা করে, কিন্তু সেই কথাগুলো রঞ্জনের কানে ছিল প্রার্থনার মতো। সে বুঝে যায়, শহরের মাঝেও কিছু স্বপ্ন জন্মায়—যদিও ঘর কাঁচা, কিন্তু স্বপ্নগুলো গাছের ডালের মতো দৃঢ়।
এক বিকেলে, তনিমা মিস স্কুলে ঘোষণা করলেন—“শহরের দেয়ালচিত্র প্রতিযোগিতা হবে। যার ছবি বাছা হবে, তাকে সরকারি শিশু কেন্দ্রের আর্ট ক্যাম্পে পাঠানো হবে।” রঞ্জনের ভেতরটা ধ্বনি তুলল। সে সারা রাত ছবি আঁকল—ছবি একটিই, কিন্তু তার ভেতরে ছিল শত শত গল্প: নদীর পাড়ে দাঁড়ানো ঘর, ভাঙা চাকার নৌকা, আর তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোর, যার এক হাতে রঙের বাক্স, আর অন্য হাতে শিকড়ের গন্ধ। ছবি জমা দেওয়ার দিন সকালে মা তার জামাটায় হাত বুলিয়ে বললেন, “রঙ দিয়ে যদি ঘর ফেরত পাওয়া যেত, তাহলে তুই হয়তো আমাদের পুরনো উঠোনটাই আবার এঁকে আনতে পারিস।” সেই দিন রঞ্জন প্রথমবার শহরকে বিশ্বাস করতে শুরু করল—যে শহর একদিন তার ছবি বুঝবে, তার গল্প শুনবে, আর হয়তো তাকে একটা স্থায়ী ছায়া দেবে, যেখানে সে তার নদীটাকে আবার আঁকতে পারবে বাস্তবের ক্যানভাসে।
৭
দেয়ালচিত্র প্রতিযোগিতার দিন সকালেই রঞ্জন উঠে পড়ে, চোখে একরাশ আলো আর বুকের ভেতর ঢেউয়ের মতো কাঁপুনি। স্কুল থেকে দশজনকে বাছা হয়েছে—তাদের ছবি দেওয়ালের গায়ে আঁকা হবে শহরের পুরনো পুরসভার পাঁচিলজুড়ে। সবার সামনে দেওয়া হয়েছে একটা করে ক্যানভাস, রঙ, ব্রাশ আর বিষয়—“আমার শহর, আমার স্বপ্ন।” বাকিরা আঁকছিল চেনা শহরের দৃশ্য—বাস, উড়ালপুল, ট্রাফিক, বহুতল ভবন। কিন্তু রঞ্জনের ছবিতে শহরটা ছিল অন্যরকম—তার জলছবির শহর ছিল এক নদীর দুই পাড়ে গড়ে ওঠা দুটি পৃথিবীর সংযোগ। এক পাশে গ্রাম—ধানের খেত, খেজুরগাছ, নৌকা আর চৌচালা ঘর; অন্য পাশে শহর—ফ্ল্যাট, সিগন্যাল, মোবাইল টাওয়ার। মাঝখানে ছিল একটিই নদী, যার জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল উভয় দুনিয়ার ছায়া। নদীর ওপর দিয়ে হাঁটছিল এক কিশোর, যার চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়—সে কোথাও পৌঁছায়নি, কিন্তু চলতে শিখেছে।
চারপাশের শিক্ষকদের মুখে বিস্ময়। তনিমা মিস ছবির দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলেন অনেকক্ষণ, তারপর বলেছিলেন, “তুমি তোমার শহরটাকে নিজের মতো করে চিনেছ রঞ্জন, এটাই শিল্প।” প্রতিযোগিতা শেষে যখন ফলাফল ঘোষণা হলো, রঞ্জনের নাম উঠল প্রথম স্থানে। শহরের মেয়র, এক বিশিষ্ট চিত্রকর আর একটি NGO-র প্রতিনিধি এসে তার ছবিটা দেখে বলেছিলেন, “এই ছেলেটি আমাদের শেখাচ্ছে, কীভাবে স্মৃতি আর স্বপ্ন মিলেমিশে এক শহর তৈরি করতে পারে।” রঞ্জনের হাতে তুলে দেওয়া হয় একটি সনদ, কিছু রঙ, আর শিশু-শিল্প ক্যাম্পে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ। কিন্তু তার চোখ শুধু খুঁজছিল চন্দনকে, যে দাঁড়িয়ে ছিল ভিড়ের পেছনে, মুখে সেই চিরচেনা হাসি, চোখে একটুকরো গর্ব।
সে দিন বিকেলে রায়হান কাকু এসে বলেছিলেন, “দেখছ রে রঞ্জু, শহরের দেয়ালে যদি তোদের নদী আঁকা যায়, তাহলে তোদের গল্পও কেউ একদিন শুনবে।” মা চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে রঞ্জনের হাতে সনদ দেখে বলেছিলেন, “আমার ছেলে শহরটাকে জিতিয়ে দিল।” রঞ্জন সেই রাতে ঘরে ফিরে আবার আঁকল একটি ছবি—এইবার নদীটা আর মাঝখানে নেই, বরং শহর ও গ্রামের মাঝখানে একটা ছোট পুল, যার ওপর দিয়ে হাঁটছে শত শত শিশু, হাতে ছবি, মুখে আশা। তার জলছবির শহর কেবল ইট-কাঠে গড়া নয়, বরং স্মৃতির আঁচড়ে তৈরি এক নতুন ঠিকানা, যেখানে প্রতিটি আঁকা রেখা তাকে নিজের হারিয়ে যাওয়া শিকড়ের কাছাকাছি টেনে নিয়ে যায়। সেই রাতে টিনের ছাউনির নিচে, বস্তির কাঁপা ঘরে ঘুমোতে ঘুমোতে রঞ্জন মনে মনে বলেছিল—এই শহরটা একদিন আমার হবে, একেবারে আমার নিজের মতো করে আঁকা।
৮
বস্তির রাতে হঠাৎ আগুন লাগা কোনো নাটকের দৃশ্য ছিল না—তা ছিল দগ্ধ বাস্তবের দুঃস্বপ্ন, যা এক নিমেষে ছাই করে দিল রঞ্জনের নতুন জীবনের আড়াআড়ি আঁকা জলছবিকে। সেদিন সন্ধ্যায়, রায়হান কাকু দোকান থেকে ফিরে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “ওই দক্ষিণ দিকের ঘরে আগুন! সবাই জল নে, ছুট!” মুহূর্তে মানুষ ছুটে গেল বালতি, কলসি, শাড়ি ভিজিয়ে আগুন থামাতে। কিন্তু আগুন থেমে যাওয়ার আগেই শহরের সেই ছোট্ট টিনের কাঁচা স্বপ্নভবন—রঞ্জনের ঘর, মায়ের হাঁড়ি, বাবার ভাঙা মগ, আর দেয়ালের জলছবি—সব ছাই হয়ে গেল। রঞ্জন শুধু বসে দেখেছিল, পলিথিনে মুড়ে রাখা তার আঁকার খাতাটা কীভাবে আগুনের লেলিহান জিভে গিলে গেল। তনিমা মিসের দেয়া রঙ, চন্দনের আনা ব্রাশ, আর তার নিজের আঁকা সেই প্রতীকী নদী—সব পুড়ে ধোঁয়া হয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল। মা তখন অজ্ঞান, বাবা চুপচাপ, আর চন্দন পেছনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, “এই শহর তোকে বারবার ফিরিয়ে দিচ্ছে রে রঞ্জু, কিন্তু তুই কি তোর আঁকাটা ফেরাতে পারিস?”
পরদিন ভোরে, দগ্ধ ধোঁয়ার গন্ধের মাঝেও রঞ্জন দেখল বস্তিতে কেউ কেউ ফিরে এসেছে—কেউ ভাঙা চাল ঠিক করছে, কেউ আবার দেওয়ালের ছাই ঘষে মুছছে। তনিমা মিস এসেছিলেন রায়হান কাকুর সঙ্গে, সঙ্গে এনেছিলেন একজন NGO কর্মী—সুবর্ণা দিদি, যিনি শিশুদের নিয়ে কাজ করেন। রঞ্জনের অবস্থাটা জেনে তিনি বলেছিলেন, “এই বাচ্চাটা নিজের ঘর পুড়লেও স্বপ্নটা পুড়তে দেয়নি। ওর থাকার ব্যবস্থা আমরা করব।” সেই রাতেই তারা একটা অস্থায়ী শেল্টারে ওঠে—প্লাস্টিক আর বাঁশ দিয়ে তৈরি হলেও অন্তত মাথার ওপর একটা ছাদ ছিল, আর পাশেই ছোট লাইব্রেরি, কিছু কাগজ, কিছু রঙ। মা বলেছিলেন, “ঘর মানে তো মাথার ছাদ নয় রে রঞ্জু, ঘর মানে হলো যেখানে কেউ তোকে দেখে ভালোবাসা দেয়। এই জায়গাটাও একদিন তোর ঘর হয়ে যাবে।” সেই রাতে রঞ্জন আবার কাগজে আঁকল—না, কোনো দৃশ্য নয়, কেবল আঁকল একটা গর্ত, যার মাঝে ফুটে উঠছে একটা গাছ, গাছটার মাথায় ঝুঁকে আছে একটা নদী। সে জানত, তার ঘর এখন মাটি নয়, ইট-কাঠ নয়, সে নিজেই এখন নিজের ঘরের ভিতর বাস করে।
এরপর শুরু হয় আরেক নতুন অধ্যায়। শিশু-কেন্দ্রের আর্ট-ক্যাম্পে রঞ্জন প্রতিদিন ছবি আঁকে, অন্য ছেলেমেয়েদের শেখায়—কীভাবে নিজের হারিয়ে যাওয়া ঘরকে রঙে, রেখায় ফিরিয়ে আনা যায়। সে শেখায়, কেমন করে নদীকে বন্দি করতে হয় না—বরং নদীকে বয়ে নিয়ে যেতে হয় নিজের ভিতরে। মিডিয়াতে খবর ছাপা হয়—“বস্তির আগুনেও পুড়তে পারেনি এই কিশোরের স্বপ্ন।” একদিন তার ছবিগুলো দেখে এক বড়ো চিত্রকর বলেন, “এই ছেলেটির ছবি শুধু শিল্প নয়, সে শহর আর গ্রামকে জোড়ার সেতু হয়ে উঠছে।” রঞ্জন এখন প্রতিদিন শহরের রাস্তার পাঁশে দাঁড়িয়ে নিজের ভিতরের জলছবির টুকরো আঁকে—দেয়ালে, কাগজে, মনোজগতে। সে জানে, ঘর হয়তো বারবার ভাঙবে, কিন্তু তার শিকড়গুলো এবার অন্য কোথাও গাঁথা—রঙের দাগে, ছবির রেখায়, আর তার বিশ্বাসে। শহর হয়তো তার নিজের মতো করে তাঁকে গৃহহীন করেছে, কিন্তু রঞ্জন এবার শিখেছে—ঘর মানে কেবল ইট আর কাঠের গঠন নয়, ঘর মানে একটা জায়গা, যেখানে সে আবার শুরু করতে পারে, যতবার প্রয়োজন হয় ততবার।
৯
নৈহাটির পুরনো রেলস্টেশনের পাশ ঘেঁষে শহরের একটা ধুলো ধরা, প্যাঁচালো রাস্তা চলে গেছে চৌরাস্তার দিকে—সেই পথে হাঁটতে হাঁটতেই একদিন রঞ্জন থেমে যায়। এখানে কোনোদিন ঝাঁ-চকচকে হোর্ডিং উঠে না, রাস্তার ধারে উল্টে রাখা কনস্ট্রাকশন প্লেটগুলোতে চুনকাম হয় না, কিন্তু সেই পুরোনো মোচড়ের দেওয়ালে লেখা ছিল লালচে অক্ষরে—“নদী মরে গেলে মানুষ গৃহহীন হয়।” নিচে ছোট্ট করে লেখা: Ranjan, Child Artist, Displaced by River Floods. রঞ্জনের আঁকা জলছবি এবার কেবল স্কুল বা ক্যাম্পেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে শহরের দেয়ালে-দেয়ালে—একটা নদী, যার এক পাড়ে তার হারিয়ে যাওয়া গ্রাম, অন্য পাড়ে তার নতুন জন্ম নেওয়া জীবন। শিশুশিল্পী হিসেবে তার নাম ছাপা হয় পত্রিকায়, স্থানীয় সরকারি প্রদর্শনীর জন্য আমন্ত্রণ আসে। তনিমা মিস বলেন, “তুই এবার শুধু ছবি আঁকছিস না রে রঞ্জু, তুই একটা ভাষা তৈরি করছিস—যা শোনে তারা, যাদের ঘর কেবল ঠিকানার গায়ে লেখা থাকে, মাটির ভিতরে নয়।”
এইসময় চন্দন তাকে নিয়ে যায় শহরের এক ছোট্ট কমিউনিটি সেন্টারে, যেখানে কিছু স্বেচ্ছাসেবক পড়াশোনা শেখান, গান শেখান, আর্ট শেখান বস্তির ছেলেমেয়েদের। সেখানে রঞ্জন প্রথমবার একজন প্রশিক্ষকের মতো ছবি শেখায়—কিন্তু সে বলে না, “সূর্য আঁকো, নদী আঁকো।” সে শুধু বলে, “তোমরা যা হারিয়েছ, সেটাই আঁকো।” এক মেয়ে আঁকে ভাঙা একটা সেতু, আরেকজন আঁকে একটা দাঁড়ানো ছাতা—সবাই যেন অজান্তেই নিজের ঘর হারানো দৃশ্যগুলো ক্যানভাসে ফিরিয়ে আনছে। এই কেন্দ্রেই সে একদিন চন্দনকে দেখে, মাথায় ক্যাপ পরে মোবাইল ঘাঁটছে। রঞ্জন হেসে বলে, “তুই তো ফোটোগ্রাফার হয়ে যাচ্ছিস দেখছি!” চন্দন বলে, “তোর ছবিগুলো এত বিখ্যাত হয়ে গেছে, ভাবছি ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও তোলাই ভালো!” তারা দুজন বুঝে যায়—এই শহর ভাঙে, পুড়িয়ে দেয়, কিন্তু আবার বানাতে শেখায় অন্যভাবে।
এদিকে, একটি বড়ো এনজিওর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী সুবর্ণা দিদি রঞ্জনের পরিবারকে জানান—শহরের বাইরে এক হাউজিং প্রকল্পে সরকারি সহযোগিতায় তাদের জন্য একটি দুই-কামরার ছোট ফ্ল্যাট বরাদ্দ হয়েছে। জলপাই রঙের দেয়াল, পাকা রান্নাঘর আর সামনের বারান্দায় আলো ঢোকে সকালবেলা। মা বলেন, “এবার মনে হয় ফের একটা উঠোন পাওয়া যাবে রে, শুধু পায়ে কাদা নেই।” বিজন হালদার রাতে চুপচাপ জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকেন—এখন তার ছেলের ছবি দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছে, আর তিনিও আবার ধীরে ধীরে মানুষ হয়ে উঠছেন। রঞ্জন সেই নতুন ঘরের এক দেয়ালে প্রথম যে ছবিটি আঁকে, তাতে একটি নদী ঘুরে এসে জলের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে এক শহর। নদীর মাঝে কুঁড়েঘরের ছায়া, কিন্তু তার পেছনে বিশাল শহুরে পটভূমি—আলো, জানালা, মানুষ।
এইসবের মধ্যেও রঞ্জন এখনো প্রতিদিন হাঁটে সেই পুরোনো রাস্তায়, যেখানে তার প্রথম দেয়ালচিত্র ছিল। সেখানে এখন মাঝে মাঝেই লোকজন থামে, ছবি তোলে, কৌতূহল প্রকাশ করে। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করে, “তুমি রঞ্জন না?” সে মাথা না নেড়ে বলে, “আমি এক নদীর ছেলে, যে এখনো বয়ে চলেছে শহরের বুক বেয়ে।” সেই সন্ধ্যায়, যখন শহরের আলো ছায়া হয়ে নামে রেললাইনের ওপরে, রঞ্জন বোঝে—সে এখন নিজেই একটা নদী হয়ে গেছে। হারানোর মধ্যে দিয়েই সে পেয়েছে নির্মাণের ভাষা, ভাঙনের ভিতর দিয়েই শিখেছে আবার গড়ে তোলা যায়। ঘর আর শিকড়ের সংজ্ঞা বদলে গেছে—এখন ঘর মানে শুধুই চারটে দেয়াল নয়, ঘর মানে যার ভেতর স্বপ্ন নিরাপদে থাকে, ঠিক যেমন শহরের দেয়ালে এখন লেখা—“আমরা যারা ভেসে গেছি, তারা জানে, নদী কখনো সত্যিই মরে না।”
১০
দু’বছর পর। রঞ্জনের চেহারায় এখন একটা স্থিরতা এসেছে—যা তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিণত, অনেকটা নদীর মতো—যে জানে কোথা দিয়ে প্রবাহিত হতে হয়, কোথায় ক্ষয়, কোথায় সঞ্চয়। সে এখন শহরের একজন পরিচিত মুখ—“ছবি-ছেলে” নামে পরিচিত। তার ছবি এখন শুধু NGO-র প্রদর্শনীতে নয়, শহরের মিউনিসিপ্যাল হল, আর্ট গ্যালারি, এমনকি বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়েও জায়গা পেয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতির মাঝেও তার চোখে একটিই প্রশ্ন ঘুরে বেড়ায়—“ঘর কি সত্যিই ফিরে পাওয়া যায়?” এই প্রশ্নের উত্তর সে খুঁজে ফেরে না কোনো ক্যামেরায়, না কোনো মাইক্রোফোনে। সে খোঁজে তার কাগজের ভিতর, আঁকার রেখায়, প্রতিটি ঢেউ-তোলা রঙে, যেখানে লুকিয়ে থাকে তার হারিয়ে যাওয়া গ্রামের ছায়া।
তনিমা মিস একদিন ডাকে তাকে—“রঞ্জন, এবার তোমার পুরনো স্কুলে একটা গ্যালারি হচ্ছে ‘Displaced Dreams’ নামে। আমরা চাই তুমি উদ্বোধন করো।” সেই দিন রঞ্জন একটা সাদা কাগজে আঁকে তার জীবনের সবচেয়ে নিঃশব্দ ছবি—একটা ভাঙা ঘর, ভেতরে কিছু শিশুর মুখ, বাইরে একটা পাথরের ওপর বসে থাকা ছেলে—তাদের দিকে তাকিয়ে, হাতে রঙের বাক্স। উদ্বোধনের দিন সেই ছবিটিই প্রধান কেন্দ্রে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে ছবি দেখে চুপ করে যায়। কেউ চোখ মোছে। কেউ বলে, “এটা তো রঞ্জনের নিজের গল্প।” কিন্তু রঞ্জন কিছু বলে না। সে শুধু বাইরে দাঁড়িয়ে, দেখে কেমন করে মানুষ হারানো ঘরের গল্প পড়ে কান্না পায়, মনে পড়ে নিজস্ব কোনও স্মৃতি।
সেই রাতেই মা এসে বলে, “তোর মেজপিসি চিঠি পাঠিয়েছে—বলেছে, তোর গ্রামের জমিটার ধারের মাটি আবার শক্ত হয়েছে, কিছু মানুষ ফিরে যাচ্ছে।” কথাটা শুনেই রঞ্জনের ভেতরে পুরনো এক সুর বেজে ওঠে। সে ঠিক করে, বহু বছর পর, গ্রামে একবার ফিরবে। ফিরে যায় ধনীরচরে—সবকিছু বদলে গেছে, নদী এখনো পাশেই বইছে, তবে শান্ত। অনেক ঘর নতুন করে উঠেছে, অনেক গাছ নেই, কিন্তু কোথাও একটা বাতাসে সেই পুরনো গন্ধ লেগে আছে। কুট্টু নেই, পেয়ারা গাছ নেই, কিন্তু মাঠের ওপরে দাঁড়িয়ে রঞ্জন দেখে, তার ফেলে আসা শৈশব এখনো এখানে ঘুরে বেড়ায়, ঠিক যেন একটি অসমাপ্ত জলছবি। সে একটা খাতা বের করে আবার আঁকতে থাকে—এইবার গ্রামটা, নদীটা, আর তার ছোটবেলাটা। পাশে দাঁড়ানো এক বৃদ্ধ বলে, “তুই সেই রঞ্জন না? যারে নদী ভাসায়ে দিছিল?” সে হেসে বলে, “ভাসিয়েছিল, কিন্তু থামায় নাই।”
শহরে ফিরে এসে রঞ্জন তার সবচেয়ে বড় ছবি আঁকে—একটা লম্বা ক্যানভাসে, যেখানে নদীটা নেই, নেই ঘরও। কেবল আঁকা আছে এক ছেলের চোখ, যার চাউনি দেখে বোঝা যায়—সে কোনো কিছুকে হারায়নি, বরং যা হারিয়েছে, তাকেই নিজের করে নিয়েছে। সেই ছবির নাম দেয়—“ঘরের খোঁজে জলছবি”। সেই ছবি এখন ঝুলে আছে শহরের কেন্দ্রীয় আর্ট গ্যালারিতে, নিচে একটা লাইন খোদাই করা:
“যে ভেসে গিয়েও আঁকে, সে ঘর হারায় না—সে ঘর সৃষ্টি করে।”
এভাবেই জলছবি শহরের গল্প শেষ হয় না, বরং নদীর মতো বয়ে চলে—প্রত্যেক বাস্তুচ্যুত, প্রত্যেক স্বপ্নভাঙা শিশুর ভিতর দিয়ে, যারা হয়তো নিজের ঘর খুঁজে না পেলেও নিজের জন্য একখানা ক্যানভাস খুঁজে পায়। রঞ্জনের জলছবি এখন কেবল তার নয়, শহরের, গ্রামের, আর সেই সব নদীর—যারা আজও বয়ে চলে, হারায়, আবার ফিরে আসে।
সমাপ্ত