Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

জলচুম্বী

Spread the love

তানিয়া রায়


অধ্যায় ১: জলাধারের স্নান

অঞ্জলী ঘোষ, জলাধার বিশ্লেষক হিসেবে কর্মরত একজন নারী, অনেক বছর ধরেই নদীর জল পরীক্ষা করে চলেছে। তার পেশার মধ্যে ছিল নদী, নালার পানি এবং অন্যান্য জলধারার উপাদান বিশ্লেষণ করা, যাতে করে মানুষ আগে থেকে বিপদ বুঝে নিতে পারে বা পরিবেশের স্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। যে কোনো জলপ্রবাহের বিশ্লেষণ ছিল তার কাছে একটি গম্ভীর প্রক্রিয়া, যেখানে তার মাথায় চলত একাধিক রাসায়নিক, শারীরিক গুণাবলী এবং পরিবেশগত প্রভাবের হিসাব। এমনকি এই সেবাটি তার নিজের কাছে কিছুটা ধর্মীয় রীতির মতোই ছিল। অঞ্জলীর জীবন ছিল একরকম নিয়মতান্ত্রিক—প্রতিদিন সকালে নির্দিষ্ট সময় পর নদীর তীরে গিয়ে তার পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করত। নদীর জল সংগ্রহ করত, তার বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করত, যেন কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়। নদীর জল যদি ভারী বা অস্বাভাবিক কোনো উপাদান ধারণ করে, তবে তার কাজ ছিল আশেপাশের এলাকায় সতর্কতা পাঠানো। মানুষজনকে জানানো, যাতে তারা বিপদ এড়াতে পারে। একদিন, অঞ্জলী যেমন নিয়মিত নদী পরীক্ষার কাজে বেরিয়েছিল, ঠিক তেমনিই এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, যখন সে জলকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করছিল, তার চোখ চমকিত হয়ে ওঠে। জলটি ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তার মধ্যে কিছু অদ্ভুত প্রতিফলন তৈরি হতে শুরু করেছিল। প্রথমে, সে কিছুই বুঝতে পারেনি, তবে জলটিতে এমন কিছু ছিল, যা যেন তাকে দেখতে বাধ্য করছিল। কোন এক অজ্ঞাত শক্তি তাকে বারবার আকর্ষণ করছিল। নদীটি যেন শান্ত ছিল, কিন্তু অঞ্জলীর মনে হয়েছিল, সে কিছু অন্যরকম দেখতে পাচ্ছে, যা কখনো সে দেখেনি। জল শুধুমাত্র একটি জীবন্ত উপাদান নয়, বরং এটি তার আত্মার এক প্রতিবিম্বের মতো তার সামনে হাজির হচ্ছিল। চোখের সামনে ভেসে ওঠা ছবিগুলি অঞ্জলীর জীবনের একেবারে ব্যক্তিগত দিকগুলো, তার স্মৃতির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। একে একে তার অতীতের ছবিগুলো জলপৃষ্ঠে ভেসে উঠতে লাগল। এই প্রতিফলন শুধু তার চোখে নয়, তার মনে এবং হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না যে, এটাই বাস্তব। কি কারণে এমন কিছু ঘটছে? এই জল কেন তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠছে? এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর সে তখনই খুঁজছিল, যখন সেই রাতের জলপ্রবাহে এক অদ্ভুত পরিবর্তন দেখতে পায়। জল তার নীরবতার মধ্যে যেন আরো কিছু বলে দিতে চায়, কিছু এমন যে, যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। তার মনের অজান্তেই জলের দিকে এক গভীর টান অনুভব করছিল, যেন সে নিজেই এক অদৃশ্য শক্তির মাঝে আটকে গেছে। কিন্তু কী সেটা? জল কি সত্যিই তার জীবনের কোনো বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতে যাচ্ছে?

অঞ্জলী কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। নদীর জল তার চারপাশে ছিল, কিন্তু তাকে এমন কিছু বলছিল, যা সে পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করছিল। তার মনোজগতের সবই যেন এক জটিল আঁকবাঁকা পথে চলছিল, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ এক অদৃশ্য সংকেতের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। সে সুমিতের কথা ভাবল, যাকে তার এই রহস্যময় অভিজ্ঞতা জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সুমিত ছিল একজন দক্ষ জলবিদ্যাবিদ, অঞ্জলীর সহকর্মী, এবং একমাত্র বন্ধু, যার সঙ্গে সে প্রায়ই এই ধরনের বিষয় নিয়ে আলোচনা করত। তবে, সে জানত যে সুমিত এমন কিছুর প্রতি খুব কম আগ্রহ প্রকাশ করবে যা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে। সুমিত হয়তো মনে করবে, এটি শুধুই অঞ্জলীর মনের বিভ্রম। কিন্তু অঞ্জলী এই রহস্যের গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছিল, সে জানত যে এই জল তার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ দিক খুলে দিতে পারে। সে নদীটিকে গভীরভাবে দেখল এবং ভাবতে থাকল, “এটা কি শুধুই এক জলের প্রতিফলন? নাকি কিছু অদৃশ্য সত্তা আমার জীবনের অন্ধকার কোণগুলোকে প্রকাশ করতে চায়?” সে বুঝতে পারল যে জল থেকে যে প্রতিফলন সে দেখতে পাচ্ছে, তা শুধুমাত্র তার নিজের ভেতরের একটি প্রতিচ্ছবি নয়, বরং কিছু এমন যা তার ভবিষ্যতকেও পেরিয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে? জল কি শুধু একটি উপাদান, নাকি এটি তার জীবনকে নতুনভাবে গড়তে চাচ্ছে? অঞ্জলী অবাক হয়ে ভাবছিল, কীভাবে এই নদীর জল তাকে এক নতুন পথ দেখাতে পারে। তার মন ছিল অস্থির, কিন্তু গভীরভাবে বিশ্বাস করছিল, যে এই জল তার জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে যাচ্ছে। সুতরাং, অঞ্জলী নদীর দিকে এক দীর্ঘ দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল, এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, যে সে এই রহস্যের গভীরে যাবে, যতটা সম্ভব গভীরে।

অঞ্জলীর জীবন এই জল দ্বারা এক নতুন মোড় নিতে যাচ্ছিল, তবে সে জানত না, যে তার সামনের পথটি কতটা অন্ধকার ও বিপদজনক হতে পারে।

অধ্যায় ২: প্রতিফলনের মায়া

অঞ্জলী সেই রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিল, কিন্তু তার মন ও শরীর পুরোপুরি নিঃসাড় হয়ে গিয়েছিল। নদীর জল যে অদ্ভুত প্রতিফলন তাকে দেখিয়েছিল, তার অর্থ সে বুঝতে পারছিল না। সেই অভিজ্ঞতা যেন তার ভেতরে এক অদৃশ্য প্রভাব ফেলেছিল, যা সে নিজের সঙ্গে নিয়ে ফিরেছিল। সুমিতের কথা মনে পড়ল। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি তার এই অনুভূতিগুলোর মূল্য দিতে পারেন। কিন্তু সে জানত, সুমিত তার ওপর সন্দেহের চোখে তাকাবে। সে যে কাজের মানুষ, তা আর বলতে হবে না। তার কাছে এমন কিছু গ্রহণযোগ্য নয়, যা প্রকৃতির নিয়মের বাইরে হয়।

অঞ্জলী তাকে ফোন করল। কিছু সময় পরে সুমিত ফোন ধরল, “হ্যালো, অঞ্জলী, কী খবর? সব ঠিক তো?” সুমিতের মিষ্টি কণ্ঠে অঞ্জলীর মন কিছুটা স্বস্তি পায়। “হ্যাঁ, সব ঠিক আছে। তবে আমাকে তাড়াতাড়ি তোমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। কিছু গম্ভীর ব্যাপার ঘটেছে,” অঞ্জলী বলল, তার কণ্ঠে উদ্বেগ ছিল। সুমিত কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “কী ব্যাপার? তুমি তো এমন কিছু আগে কখনো বলেনি।” অঞ্জলী এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। কিছু বলার আগে সে নিজের ভেতরের অস্থিরতা থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মনে হল, এই রহস্য সবার কাছে উন্মোচন করা দরকার। “তুমি কি কখনো বুঝেছ, নদী বা জল শুধুই রাসায়নিক উপাদান নয়? তারা কি আমাদের জীবনের কিছু অংশ হতে পারে?” অঞ্জলী কথাটি বলতেই তার কণ্ঠ যেন একটু যেন অস্বাভাবিক শোনাল। সুমিত কিছু সময় নীরব রইল, তারপর বলল, “অঞ্জলী, আমি জানি তুমি খুব গভীরভাবে কাজ করো, কিন্তু জল তো আমাদের আশেপাশের এক স্বাভাবিক উপাদান। এর সঙ্গে কিসের সম্পর্ক?” অঞ্জলী ধীর কণ্ঠে উত্তর দিল, “তবে, আজ নদীর জল আমাকে এমন কিছু দেখিয়েছে, যা আমি পুরোপুরি বোঝার চেষ্টা করছি। জলটি যেন আমার জীবনের প্রতিফলন হয়ে উঠেছে।”

সুমিত কিছুটা অস্থির হয়ে পড়ল, তবে তার কণ্ঠে চিন্তার ছাপ ছিল, “তুমি কী বলছ? তোমার মানে কি যে, জল কোনোভাবে তোমার জীবনকে প্রদর্শন করছে?” অঞ্জলী মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি এটা অদ্ভুত শোনাচ্ছে, কিন্তু আমি যদি তোমাকে সব বলি, তাহলে তুমি বিশ্বাস করবে?” সুমিত এক মুহূর্ত চুপ ছিল। তারপর বলল, “ঠিক আছে, আমি আসছি, তুমি কোথায়?” অঞ্জলী ঠিক করল, তারা রাতের আঁধারে নদীর তীরে চলে যাবে, যেখানে সে প্রথম তার এই অনুভূতি অনুভব করেছিল।

পরের দিন সন্ধ্যায় সুমিত অঞ্জলীর সঙ্গে নদীর তীরে পৌঁছাল। নদীর শান্ত স্রোত ছিল, কিন্তু অঞ্জলীর চোখে আর সেই শান্তি ছিল না। সুমিত একটু অবাক হয়ে নদীটিকে লক্ষ্য করল। “কী দেখেছ তুমি?” সুমিত অবশেষে জিজ্ঞেস করল। অঞ্জলী গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “আমার অতীত, আমার স্মৃতি, আমার মা—সব কিছুই আমি এখানে দেখতে পেয়েছি।” সে নদীর দিকে তাকিয়ে সুমিতকে বলল, “এটি যেন আমার জীবনের ছবিগুলি প্রতিফলিত করছে, কিন্তু সেই ছবিগুলি অতীতের নয়, ভবিষ্যতেরও হতে পারে।” সুমিত কিছুটা বিরক্ত হলেও তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল যে, অঞ্জলী কোনো গল্প বলছে না। তার এই অনুভূতি তার মনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছে।

অঞ্জলী যখন সুমিতকে তার অনুভূতির কথা বলছিল, তখন নদীর জল তার চোখের সামনে আবার কিছু প্রতিফলিত করতে শুরু করে। সুমিত তা দেখল, কিন্তু সে তেমন কিছু বিশেষ দেখেনি। জল কেবল শান্ত ছিল, কিন্তু অঞ্জলীর মনে এক অদ্ভুত চিন্তা উঁকি মারছিল। “এই জল আমাদের জীবনের একটি অংশ হতে পারে, সুমিত। আমি জানি এটা শোনার মতো কিছু নয়, কিন্তু আমাদের একে অপরকে বুঝতে হবে।” সুমিত বিরক্ত হয়ে বলল, “অঞ্জলী, তুমি কি আমার উপর আস্থা রেখেছ? তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার, কিন্তু এই ধারণা অনেক বেশি পরাবাস্তব।”

অঞ্জলী কিছু না বলেই নদীর দিকে আবার তাকাল। এক মুহূর্তে, জল থেকে আবার সেই প্রতিফলন উঠে আসতে থাকে—তার মা, সেই পুরনো স্মৃতি, তার ছোটবেলা, এবং আরও অনেক কিছু। যেন নদী তার অতীতের সব অঙ্গ ও বর্ণনা খুলে দিচ্ছিল। সুমিত দেখতে পায়, অঞ্জলী এক গভীর শ্বাস নিয়ে গাঢ় চিন্তায় ডুবে গেছে। তার চোখে কোনো কষ্ট ছিল না, তবে তার ভিতরের অস্থিরতা স্পষ্ট ছিল। “অঞ্জলী, তুমি কি ঠিক আছো?” সুমিত তার কাঁধে হাত রেখে বলল। কিন্তু অঞ্জলী শুধু নীরবে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল, যেন তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সে এখানেই খুঁজে পাচ্ছিল।

সুমিত আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তারপর চুপ হয়ে গেল। সে জানত যে, এখন অঞ্জলীকে বুঝানো সহজ নয়। সে হয়তো এক রহস্যময় যাত্রার শুরুতেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সেই যাত্রায় তাকে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাই সুমিত নদীর পাড়ে সোজা দাঁড়িয়ে থাকল, আর অঞ্জলীকে শুধু তার পথে যেতে দিল।

অধ্যায় ৩: জল এবং অতীতের স্পর্শ

অঞ্জলী সুমিতের সঙ্গেই নদীর ধারে বসে ছিল, কিন্তু তার মনে এক গভীর অনুরণন বাজছিল। সুমিত যতই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করুক, অঞ্জলীর মন একটানা একের পর এক অনুভূতি আর স্মৃতিতে ডুবে যাচ্ছিল। আজকের আগে কখনোই এমন কিছু অনুভব করেনি সে—নদীর জল যেন তার জীবনের অতীতের এক অস্পষ্ট অংশের প্রতিফলন হয়ে উঠেছে। সুমিত তাকে যে জিজ্ঞাসা করেছিল, “এটা তো কেবল জল, তুমি কী দেখছো?” অঞ্জলী জানত, সে যা দেখছে, তা ঠিক জল নয়। তার চোখের সামনে যা ভেসে উঠছে, তা যেন এক গোপন ইঙ্গিত, এক অদৃশ্য বার্তা—যা নদী তার কাছে পাঠাচ্ছে। নদী তো কেবল পানির স্রোত নয়, এটি তার জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে, এক প্রতিবিম্বের মতো। অঞ্জলী তার পুরনো বাড়ির কথা ভাবল, যেখানে সে ছোট ছিল। তার মা, বাবা, দাদা, দাদি—সবই তো নদীর পাশে ছিল। তার মা’র কথাগুলো মনে পড়ে, যে বলেছিল, “নদী যেন জীবনের আদান-প্রদান, এর মধ্যে সব কিছুই মিলেমিশে যায়। জীবন যেমন স্রোতের মতো বয়ে চলে, তেমনি এই জলেও আছে চিরন্তন সত্য।”

আজকাল সেসব কথা অঞ্জলীর মনে আসত না, তবে নদী তাকে সেই কথাগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল। কখনো কখনো তার মা তাকে বলত, “তুমি যখন বড় হবে, তখন নদীর স্রোত তোমাকে সেই সত্য জানিয়ে দেবে যা তুমি বুঝবে না, কিন্তু একদিন অনুভব করবে।” আজ, এই জল তাকে তার মা’র প্রতিচ্ছবি দেখাচ্ছিল—মায়ের হালকা হাসি, তার স্নেহভরা হাত, তার গল্প, যেগুলো অঞ্জলী মাঝে মাঝে ভুলে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু জল আজ তাদের সব ফিরিয়ে আনছে, যেন অতীতের প্রতিটি মুহূর্ত তাকে চিহ্নিত করছে। জল আসলে তার জীবনের সেই গোপন সুরক্ষা, যা সে নিজে জানত না, কিন্তু নদী জানত।

অঞ্জলী চোখ বন্ধ করে সে দৃশ্যগুলো মনের মধ্যে গেঁথে রাখল। নদী তাকে আবার তার পুরনো বাড়ির স্মৃতিতে নিয়ে গেল। সে তখন ছোট, মা-বাবার সঙ্গে নদীর পাড়ে হাঁটত। সেই সময়ে তার জীবনের সবটুকু সময় নদীই ছিল তার সঙ্গী। তার মা প্রায়ই বলতেন, “নদী আমাদের আশীর্বাদ, আমাদের রহস্যময় বন্ধু। এটি শুধু জল নয়, এটি আমাদের জন্য এমন একটি পথ, যা অমোঘ ভাবে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।” মা’র কথা মনে আসতেই অঞ্জলী অনুভব করল, নদী তাকে তার মায়ের কাছ থেকে কিছু বার্তা পাঠাচ্ছে। তার মা বহুদিন আগে মারা গেছেন, তবে আজ তার মৃত্যুর পরও মায়ের শৈল্পিক অঙ্গীকার তার জীবনে কোনো এক অদ্ভুত ভাবে ভেসে উঠেছিল।

এত দিন ধরে অঞ্জলী হয়তো বুঝতে পারেনি যে, মা যে জলকে এত ভালোবাসতেন, সেটি কেবল পানির স্রোত ছিল না, বরং তার জীবনের এক অতিপ্রাকৃত অংশ, যা অনবরত তাকে ঘিরে রেখেছে। জল তো কিছুই বলেনি, তবে তার প্রতিফলনে ছিল এক রহস্যময় প্রেম, যেটি অঞ্জলী আজ বুঝতে পারছিল। সে ভাবছিল, “নদী যদি আমাদের জীবনকে শিখিয়ে দেয়, তাহলে কি এটি সেই শিক্ষা আমার মাকে দিয়েছিল?” এবং আবার, সুমিতের কথাগুলি মনে পড়ে—”তুমি যখন অতীতকে ভুলে যাও, তখন কিছু হারিয়ে যায়, কিন্তু যদি তুমি সেগুলো গ্রহণ করো, তখন তোমার জীবনে নতুন পথ খুলে যায়।”

নদীর জল এখন শুধু তার অতীতের প্রতিফলন ছিল না, বরং তার আত্মার এক গভীরতা হয়ে উঠছিল। অঞ্জলী বুঝতে পারল, সে যদি নিজের অতীতকে সবসময়ই এক জায়গায় আটকে রাখে, তাহলে কখনোই জীবনের পরিপূর্ণতা উপলব্ধি করতে পারবে না। মায়ের মৃত্যুর পর, সে কখনোই মাকে পুরোপুরি বোঝেনি, তবে এখন তার মৃত্যুর পরও জল তাকে মায়ের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং সম্পর্কের এক নতুন অর্থে পৌঁছাতে সাহায্য করছে।

অঞ্জলী নদীর দিকে তাকিয়ে আরও একবার মনে করল, “যদি আমি সত্যিই মায়ের কথাগুলি বুঝি, তবে এই জল কি আমাকে তার পরবর্তী নির্দেশনা দিতে পারে?” এ সময়, সুমিত তার পাশে বসে ছিল, কিন্তু অঞ্জলী তাকে অনুভব করছিল না। সে শুধু নদীর স্রোতের মাঝে ডুবে ছিল, যেখানে প্রতিটি ঢেউ তার মনে নতুন কিছু জানিয়ে দিচ্ছিল। নদী যেন তার মায়ের উপস্থিতি ছিল, যেন সে আবার তাকে কিছু শিখিয়ে দিতে চাচ্ছিল। অঞ্জলী তার মায়ের গলার সুর শুনতে পাচ্ছিল, “তুমি যদি সত্যিকারের শান্তি খুঁজে পাও, তবে তোমার হৃদয়ের গভীরে প্রবাহিত নদীকে উপলব্ধি করতে হবে।”

অঞ্জলী শ্বাস টেনে আবার সুমিতের দিকে তাকাল। সুমিত তাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিল, কিন্তু তার চোখে কোনো সন্দেহ বা প্রশ্ন ছিল না। সুমিত বুঝতে পেরেছিল যে, আজ অঞ্জলী কেবল কোনো সাধারণ কাজ করছে না, সে নিজের জীবনের এক অদ্ভুত রূপরেখা খুঁজে পাচ্ছে। সে জানত, আজ থেকে অঞ্জলী আর আগের মতো থাকবেনা। নদী তাকে সেই সত্যটি শিখিয়ে দিয়েছে, যা হয়তো একদিন পুরো পৃথিবীকে তার সামনে খুলে দেবে।

এখন অঞ্জলীর মনে শুধু একটিই প্রশ্ন ছিল—কী করতে হবে তাকে? নদী কি তাকে আসল পথ দেখাচ্ছে?

অধ্যায় ৪: মায়ের অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি

অঞ্জলী কয়েকদিন ধরে নদীর কাছে ফিরে যেতে শুরু করেছিল। সুমিত তার অভিজ্ঞতা শুনে অবাক হলেও, তার মনের অস্থিরতা দেখে সেও সিদ্ধান্ত নিল যে অঞ্জলীর পাশে থাকতে হবে। সে জানত, নদী তার জীবনে শুধু জল নয়, এক গভীর প্রভাব ফেলছে। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় নদীর তীরে বসে অঞ্জলী নিজের ভাবনা নিয়ে ডুবে থাকত। সে প্রতিদিন নতুন কিছু অনুভব করত, নতুন কিছু শিখত। সুমিত একদিন তার কাছে এসে বলল, “তুমি কি জানো, আমরা যখন এককভাবে কিছু অনুভব করি, তখন তার অর্থ আমাদের মনের গভীরতা থেকে আসে। নদী তোমার জীবনে যা ঘটাচ্ছে, তা কিছুই নয়, বরং তোমার নিজের আত্মার প্রতিচ্ছবি।”

অঞ্জলী কিছুক্ষণের জন্য চুপ ছিল, তারপর বলল, “তুমি কি মনে করো, নদী শুধু একটা প্রাকৃতিক উপাদান? না, সুমিত, এটা এমন কিছু যা আমার জীবনের সব স্তরের সঙ্গে সংযুক্ত। আমি যখন নদীর দিকে তাকাই, তখন আমি শুধু জল দেখি না, আমি দেখি আমার মা, আমার অতীত, আমার সেই স্মৃতির প্রতিফলন, যা আজও আমার ভেতরে জীবন্ত।” সুমিত তাকে শান্তভাবে বলল, “তুমি যা বলছ, তা সত্যি, কিন্তু তুমি কি মনে করো, এই জল থেকে কিছু পরামর্শ পাওয়া যেতে পারে?”

অঞ্জলী এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, “আমি জানি না। আমি ভাবছি, নদী কি আমার মায়ের কোন বার্তা আমাকে দিতে চাচ্ছে? মায়ের মৃত্যু অনেক বছর আগে হয়ে গেছে, কিন্তু আমি এখন বুঝতে পারছি, নদী তার কাছ থেকে শিখেছিল যে, জীবনের অনেক কিছুই আমাদের শিখিয়ে যায়, যখন আমরা প্রস্তুত হই।”

সুমিত তার পাশে বসে বলল, “মা যে কিছু বলত, তোমার মনে পড়ে তো?” অঞ্জলী গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মা বলতেন, ‘নদী যেভাবে স্রোত বয়ে নিয়ে চলে, তেমনি জীবনের অভ্যন্তরীণ স্রোতও আমাদের নিয়ে চলে। তুমি যদি সত্যিই জীবনের প্রকৃত অর্থ বুঝতে চাও, তবে নদীর মতই নিজের স্রোতকে অনুসরণ করতে হবে।'”

অঞ্জলী মাথা নেড়ে বলল, “এখন আমি বুঝতে পারি। মা জানত, নদী শুধু এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে না, বরং এক দীর্ঘ যাত্রা। আর এই যাত্রা আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকে, আমাদের পথের কাঁটা বা আনন্দের সঙ্গীও। মায়ের এই কথাগুলি আজও আমার মনের গভীরে প্রোথিত রয়েছে।”

নদীর জল তাকে এক নতুন দৃষ্টিতে তার মায়ের কথাগুলি মনে করিয়ে দিচ্ছিল। অঞ্জলী ভেবেছিল, নদী যা কিছু দেখাচ্ছে, তা হয়তো তার মায়ের কাছ থেকে একটা অসমাপ্ত বার্তা। সে জানত, মা নদীকে এমনভাবে দেখত, যেন সেটি জীবন, পরিণতি, শুরুর এবং শেষের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মায়ের মৃত্যু তাকে শূন্যতা দিয়েছে, কিন্তু নদী তাকে কিছু দিক নির্দেশনা দিচ্ছিল, যা সে এতদিন উপেক্ষা করেছিল।

একদিন নদীর পাড়ে বসে, অঞ্জলী কিছুটা সময় নিজেকে একান্তভাবে খুঁজে পেতে লাগল। সুমিত তার পাশে চুপচাপ বসে ছিল। সে অঞ্জলীর পরিবর্তন লক্ষ্য করছিল, কিন্তু কিছুই বলছিল না। একসময় অঞ্জলী সুমিতের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী জানো, সুমিত? আমি মনে করি নদী আসলে আমাকে শিখাচ্ছে, আমার মায়ের জীবন কীভাবে জীবন্ত হতে পারে। আমি মাকে কখনো পুরোপুরি বুঝতে পারিনি, কিন্তু নদী এখন আমাকে সেই বোঝাপড়ার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে।”

সুমিত কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল, “তুমি বলেছ নদী যেন তোমার মায়ের অংশ। আমি কি ভুল বুঝলাম, না নদী তোমাকে বাস্তবে মায়ের কাছ থেকে কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে?” অঞ্জলী মৃদু হাসল, “হ্যাঁ, এইটা শুধু একটা প্রতীক নয়, সুমিত। নদী আমার জীবনের প্রতিফলন। যখন আমি মায়ের কথাগুলো ভাবি, তখন সেই স্মৃতির ঝলক আমি নদীর জলেই দেখতে পাই।”

অঞ্জলী বুঝতে পারছিল, যে কিছুটা পরিবর্তন তার জীবনকে ছুঁয়ে গেছে। মায়ের মৃত্যুর পর এত বছর ধরে তার মনে যে শূন্যতা ছিল, নদী তাকে সেই শূন্যতা ভরিয়ে দিতে শুরু করেছে। নদী হয়তো তার মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, যা অঞ্জলীর মনে বেঁচে থাকার শক্তি যোগাচ্ছে। কখনো কখনো তিনি তার মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছিলেন, যেন মা তাকে কিছু শিখিয়ে যেতে চাইছেন, এমনকি তার মৃত্যুর পরও।

অঞ্জলী সেদিন নদীর স্রোতের দিকে এক নতুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। এখন সে জানত, নদী কেবল একটি জলপ্রবাহ নয়, এটি তার জীবন, তার অতীত, এবং তার স্মৃতির সংযোগ। যে জল তাকে তার মায়ের কথা মনে করাচ্ছিল, সেই জল তাকে এক নতুন পথের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সে মনে করল, “মা যদি জানতেন, আমি এইভাবে বুঝব, তাহলে হয়তো তিনি আমাকে আরও কিছু কথা বলতেন, কিছু পরামর্শ দিতেন।”

মা চলে গেছেন, কিন্তু নদী তাকে তার মায়ের সবচেয়ে বড় উপহার—আত্মবিশ্বাস এবং গভীরতা—এবং জীবনকে গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়। এখন অঞ্জলী বুঝতে পারছিল, যে তার মায়ের স্মৃতিতে বেঁচে থাকার শক্তি, তার জীবনের সত্যিকারের স্রোত।

অধ্যায় ৫: সংকেতের রূপ

অঞ্জলী এখন নদীর কাছে প্রতিদিন আসত, তবে তার মন আর আগের মতো স্থির ছিল না। নদীর জল তার জীবনে এতটাই প্রবাহিত হয়ে উঠেছিল যে, তার অস্তিত্ব এবং অনুভূতিগুলি এখন একে অপরের সাথে অদৃশ্যভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। সে জানত, নদী তার মায়ের কাছ থেকে কিছু বার্তা পাচ্ছে, কিন্তু প্রতিটি বার্তা আরও গভীর হয়ে উঠছিল, যেন একটি গোপন সংকেত ছিল যা তার জীবনে নতুন মোড় আনতে চাচ্ছিল। মায়ের মৃত্যুর পর, সে তার নিজস্ব জীবন ও অতীতকে অবহেলা করেছিল। কিন্তু আজ, নদী তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসছিল তার জীবনের সমস্ত ভুল, অনুশোচনা এবং আশাগুলিকে চিহ্নিত করতে।

একদিন, সন্ধ্যা হয়ে আসছিল, যখন অঞ্জলী নদীর তীরে বসে ছিল। সুমিত তার পাশেই ছিল, কিন্তু তার একাগ্র মনোযোগ সব সময় নদীর স্রোতের দিকে ছিল। আজ নদীর জল আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল। এর স্রোত ছিল একটু বেশি দ্রুত, আর তার গাঢ় শাঁসও ছিল অদ্ভুতভাবে ঝলমলে। সুমিতও সেদিন এক অদ্ভুত কিছু অনুভব করেছিল, যদিও সে প্রকাশ করেনি। সে অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কেমন অনুভব করছো আজ?” অঞ্জলী একটিবার ভাবল, তারপর বলল, “এটা আর আগের মতো নয়, সুমিত। এটা যেন কিছু বলছে, কিছু যা আমি এখনও ধরতে পারিনি।”

সুমিত কিছুটা অবাক হয়ে বলল, “বলে তো কিছু না, তবে তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, আজ কিছু অন্যরকম। তুমি যদি মনে করো, নদী তোমাকে কিছু বলছে, তাহলে কি তুমি সেই বার্তাটা শুনে কী করবে?” অঞ্জলী কিছু সময় চুপ ছিল, তারপর বলল, “আমি জানি না, সুমিত। আমি বুঝতে পারছি, যে নদী আমাকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু জানাতে চাচ্ছে। কিন্তু, কী জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি না।”

সুমিত তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “অঞ্জলী, তুমি যদি মনে করো যে নদী কিছু বলছে, তাহলে তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। তুমি মাকে খুঁজে পাচ্ছো এখানে, এবং তুমি জানো যে এই বার্তাটি শুধু তোমার জন্যই।” অঞ্জলী কিছুক্ষণ চুপচাপ ছিল, তারপর সে তার চোখ বন্ধ করে নদীর দিকে তাকিয়ে ভাবল, “এটা আসলে কী? এটা কি আমার জীবনের রূপরেখা? নদী কি আমাকে আমার শূন্যতা, আমার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব সম্পর্কে কিছু শিখিয়ে দিচ্ছে?”

সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। জল কি সত্যিই তার মধ্যে কোন গভীর পরিবর্তন আনতে চাচ্ছিল? তার মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছিল, কিন্তু নদীর জল শান্তভাবে স্রোত বহমান ছিল, একে একে প্রতিটি ঢেউ তাকে আরও গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। সে ভাবছিল, “এটা যদি শুধু মায়ের কণ্ঠ হতে পারে, তবে সেই কণ্ঠের আড়ালে কি আরও কোনো রহস্য লুকানো আছে? মায়ের শিখানো বিষয়গুলো আজ আমাকে সঠিক পথে নিতে পারবে?”

অঞ্জলী এক মুহূর্তের জন্য নদী থেকে চোখ সরাল এবং সুমিতকে দেখতে লাগল। সুমিত এবার তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, চুপচাপ। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে অঞ্জলী কোন এক রহস্যের মাঝে ডুবে আছে, কিন্তু সেই রহস্য সমাধান করতে তাকে আরও গভীরভাবে নিজেকে খুঁজে বের করতে হবে। “তুমি যদি এই নদীকে বুঝে নিতে চাও, তবে তোমাকে তার মধ্যে এক ধরনের স্নেহ অনুভব করতে হবে,” সুমিত বলল। “নদী কখনোই আমাদের মনে কোনো ভয় বা বিভ্রান্তি তৈরি করতে চায় না। বরং, এটি আমাদের জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে যায়, আমাদের মনের অন্ধকারে আলো ছড়িয়ে দেয়।”

অঞ্জলী সুমিতের কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি পেল, কিন্তু তার মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি ঘুরছিল—যেন সে কোনও এক অজানা পথে হাঁটছে, যেখানে অনেক কিছু তার জন্য অজানা। মায়ের প্রতিচ্ছবি এখন তার সামনে যেন ধীরে ধীরে উন্মোচিত হচ্ছিল। সে অনুভব করছিল, নদী তাকে এমন কিছু শিখাচ্ছে যা সে কখনো ভাবতে পারেনি, এবং তার স্রোতের মধ্যে কোনো একটি শক্তি কাজ করছে, যা তাকে নতুনভাবে জীবনকে উপলব্ধি করতে শিখাচ্ছে।

তারপর নদীর স্রোত থেমে গিয়ে কিছুর জন্য এক ধরনের বিশ্রাম নিল। যেন নদী বলছিল, “এখন সময় এসেছে, তোমার আত্মার মধ্যে নতুন কিছু খোঁজার।” অঞ্জলী কাঁধে হাত রেখে নদীর তীরে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার মনে তখন এক স্বপ্নিল চিন্তা হচ্ছিল—যে নদী তাকে এত কিছু শিখিয়ে আসছে, সেই নদীই তার জীবনের পরবর্তী পাঠ নিতে চাইছে। অঞ্জলী এক শ্বাস নিয়ে বলল, “এখন আমি জানি, নদী কেবল জল নয়, এটি আমার জীবন।”

সুমিত তার পাশ থেকে মৃদু হাসল, “তুমি যদি জীবনকে নদীর মতো গ্রহণ করতে পার, তাহলে তুমি যে পথে চলবে, সে পথটি তোমার জন্যই সবচেয়ে সঠিক হবে।”

অঞ্জলী নদীকে এক দৃষ্টি দিয়ে শেষবারের মতো দেখে ভাবল, “তুমি সত্যিই আমাকে শিখিয়ে চলেছো, নদী। আমার মায়ের প্রতিচ্ছবি হয়ে তুমি আমাকে নতুন পথ দেখাচ্ছো।”

তার চোখে তখন এক নতুন আলোকঝলক ছিল—নদী তাকে যে বার্তাটি দিয়েছে, তার মধ্যে এক শক্তি ছিল। এক শক্তি যা তাকে তার নিজের জীবনকে নতুনভাবে গ্রহণ করতে শিখাচ্ছিল।

Top of Form

অধ্যায় ৬: সংকেতের শব্দ

অঞ্জলী আজও নদীর তীরে বসেছিল, কিন্তু আজ তার অনুভূতি আগের মতো একরকম ছিল না। নদী যেন তাকে আরো গভীরে টানছিল, তাকে এক অনন্য পথে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে শুধুমাত্র জলই নয়, অন্য কোনো শক্তি তার সঙ্গে ছিল। আজ তার মন ভীষণ অস্থির ছিল, যেন নদী তাকে শুধু অতীতের স্মৃতিই নয়, তার ভবিষ্যতের একটি দিকও দেখাতে চাইছে। আজ থেকে কিছুদিন আগে সুমিত তাকে বলেছিল, “তুমি যদি নদীর স্রোতকে ভালোভাবে শুনো, তাহলে তুমি বুঝতে পারবে, নদী শুধুমাত্র তার গতিপথ বদলায় না, বরং আমাদের জীবনকে নতুনভাবে গঠন করতে চায়।”

সুমিতের কথা মনে পড়তেই অঞ্জলীর মুখে এক দারুণ হাসি ফুটল। আজ সে নদীর স্রোতকে একদম আলাদা দৃষ্টিতে দেখছিল। প্রতিটি ঢেউ যেন তার জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চাইছিল, তাকে একটা নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছিল। গত কয়েকদিন ধরে সে একে একে তার অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে সমস্ত বৈষম্য মুছে ফেলেছে, কিন্তু আজ নদী তাকে আরো কিছু জানতে দিতে চাচ্ছিল—সে কি সত্যিই প্রস্তুত ছিল?

অঞ্জলী নদীর দিকে তাকিয়ে হালকা এক শ্বাস ছাড়ল। তার মাথায় কিছু একটা পরিষ্কার হতে শুরু করেছিল, যেন সে নদীকে তার জীবনের এক অঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করতে পারছিল। জল যেভাবে স্রোত পরিবর্তন করে, ঠিক সেভাবেই তার জীবনও এখন পরিবর্তন হতে চলেছে। এই পরিবর্তন তার অজান্তেই আসছে, কিন্তু তার হৃদয় এই পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিল। নদী তাকে তার পথ দেখাচ্ছিল—অথবা, সে যে জীবন কাটাচ্ছিল, সে পথটা ছেড়ে দিয়ে একটি নতুন দিশায় প্রবাহিত হতে যাচ্ছিল।

অঞ্জলী আবার নদীর দিকে তাকাল। এখন সে জানত, নদী কেবল তার অতীত ও বর্তমানের প্রতিচ্ছবি নয়, এটি তার ভবিষ্যতের দিশাও দিতে শুরু করেছে। তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠল—একটি জায়গা, যেখানে নদীর স্রোত বদলে যায়, যেখানে স্রোত তাকে এক নতুন জীবনে প্রবাহিত করে নিয়ে যায়। সেখানে ছিল না কোনো সংকীর্ণতা, কোনো সীমাবদ্ধতা, শুধুমাত্র একটি নতুন উন্মুক্ত পথ, যেখানে সে নিজের সত্তাকে আবিষ্কার করতে পারবে।

সে বুঝতে পারছিল, নদী তাকে সেই পথের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, যেখানে সে তার আত্মা এবং জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারবে। “আমি কি প্রস্তুত?” অঞ্জলী নিজের সঙ্গে প্রশ্ন করছিল। “আমি কি সেই স্রোতের সাথে একাত্ম হতে পারবো যা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে একটি অজানা, নতুন গন্তব্যে?” তার মনে ছিল একটা অদ্ভুত সাহস, একটা অজানা শক্তি যা তাকে এই পথে এগিয়ে নিতে চাইছিল।

সুমিত কিছু সময় আগে বলেছিল, “তুমি যদি জীবনকে নদীর মতো গ্রহণ করতে পার, তবে জীবনের সমস্ত সংকীর্ণতা ভেদ করে তুমি এক বিশাল মহাকাশে প্রবাহিত হবে।” সে এখন বুঝতে পারছিল—সুমিত যা বলেছিল, তা শুধু একটা উপদেশ ছিল না, বরং জীবনযাত্রার এক চিরন্তন সত্য। নদী তাকে এই সত্যই শিখাচ্ছিল।

অঞ্জলী নদীর শান্ত স্রোতের দিকে তাকিয়ে থাকল, এবং তখন একদম নিশ্চুপে তার মন খোলার চেষ্টা করল। সে জানত, সে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই যাত্রার গন্তব্যটা সে জানতো না। এই যাত্রায় সে মায়ের কাছ থেকে শিখেছে, যেভাবে নদী আমাদের অজান্তেই এগিয়ে নিয়ে যায়, সেভাবেই জীবনও আমাদের নিজেদের অজানা গন্তব্যের দিকে নিয়ে যায়।

এক মুহূর্তে, নদীর জল যেন এক সুরে বাজতে শুরু করল, যেন এক গোপন সঙ্গীত যা তার মনের অন্ধকার কোণগুলোতে পৌঁছে যাচ্ছিল। অঞ্জলী যেন শুনতে পেল, এই জল থেকে একটি সুর উঠে আসছে—একটি গানের মতো, যার প্রতিটি শব্দ তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের প্রারম্ভ ছিল। জল কেবল স্রোত নয়, বরং সেই সুর ছিল, যা তাকে জীবনের অজানা সঙ্গীতে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই সুরে ছিল এক শান্তি, এক অজানা শক্তি, যা তাকে আরও গভীরে ঢুকতে উৎসাহিত করছিল।

অঞ্জলী এখন নিশ্চিত ছিল, নদী তাকে একটি নতুন জীবনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে শুধুমাত্র নদী নয়, তার নিজের আত্মা, তার অতীতের স্মৃতি, তার মায়ের প্রতিচ্ছবি—সব কিছু একসঙ্গে সুর মিলিয়ে, নতুন এক জীবনের সুর তৈরি করছে। “আমি যদি এই স্রোতকে অনুসরণ করি,” অঞ্জলী নিজের সাথে বলল, “তাহলে আমার জীবন সেই পথে এগিয়ে যাবে, যেখানে আমি নিজেকে আর অন্যদের প্রতি সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারবো।”

সে নদীর দিকে আবার গভীরভাবে তাকিয়ে থাকল, আর অনুভব করল—এই জল, এই স্রোত, এখন শুধু তার নয়। এটি যেন এক বৃহত্তর স্রোত, যা তাকে তার আত্মার গভীরে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তার জীবনের সমস্ত বাঁধন ভেঙে পড়বে, এবং সে এক নতুন জীবন শুরু করবে।

আজ, অঞ্জলী জানতো, নদী তাকে শুধু অতীত এবং বর্তমানের কিছু নতুন বার্তা দেয়নি, বরং সে তাকে তার জীবন এবং পরিণতির পুরো অর্থ জানিয়ে দিয়েছে।

অধ্যায় ৭: নতুন স্রোতে যাত্রা

অঞ্জলী আজ আর নদীর তীরে বসে না, বরং নদীর স্রোতের মতো সে নিজে একটি পথ তৈরি করতে চলেছে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তার জন্য নতুন, অজানা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে অনুভূতি তাকে প্রতিদিনই আকর্ষণ করেছিল, আজ সেই অনুভূতিকে বাস্তবে পরিণত করার সিদ্ধান্ত সে নিয়ে ফেলেছে। আজ সে নদীর ধার ছেড়ে এক নতুন গন্তব্যে যাত্রা শুরু করবে, যেখানে প্রতিটি ধাপ তাকে আরও গভীরে, আরও নতুন কিছু শিখিয়ে নিয়ে যাবে। তার মায়ের গলার স্বর এখনো কানে বাজছিল—”তুমি যদি নদীকে নিজের জীবনের স্রোত হিসেবে গ্রহণ করো, তাহলে জানবে, জীবন কখনো থামে না।”

সুমিত এখনও তার পাশে ছিল, কিন্তু আজ অঞ্জলী যেন কিছুটা আলাদা হয়ে গেছে। সুমিতের কাছে এটা স্পষ্ট ছিল যে, অঞ্জলী তার জীবনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চলেছে। সে জানত, নদী শুধু তার অতীতের গোপন স্মৃতি ফিরিয়ে দেয়নি, বরং তাকে প্রস্তুত করে তুলেছে একটি নতুন পথের জন্য—একটি পথ, যা তাকে সত্যিকারের আত্ম উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাবে।

আজ, নদীর স্রোতও যেন কিছু বলছিল। প্রথমে, সুমিত কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, কিন্তু অঞ্জলী তখন বলেছিল, “সুমিত, আমি বুঝতে পারছি—জীবন যদি এক নদী হয়, তাহলে আমাদের কখনও থেমে না গিয়ে, তার স্রোতের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। আমি জানি, মায়ের স্মৃতি আমাকে ফিরিয়ে নিতে আসেনি, বরং সে আমাকে একটি পথ দেখাচ্ছে।”

সে নিজেই মনে করল, “এখন বুঝি, জীবনটা শুধুই ভয়ের জায়গা নয়। এটি সাহসী হওয়া, সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এক অদ্ভুত যাত্রা।” নদী তাকে সত্যিই সাহসী করে তুলেছিল, কেননা এই নদীই তাকে তার মায়ের সাহসিকতার গল্প শোনাতে শিখিয়েছিল, যে গল্প তাকে কখনো শোনানো হয়নি। মায়ের মৃত্যুর পর, অঞ্জলী ভাবেছিল, তার সবকিছু শূন্য হয়ে গেছে, কিন্তু নদী বুঝিয়ে দিল যে, মৃত্যু কেবল একটি শেষ নয়, বরং একটি নতুন শুরু।

অঞ্জলী নদীকে এক শেষ দৃষ্টি দিয়ে বলল, “তুমি আমাকে শুধু অতীতের কথা মনে করিয়েছো না, তুমি আমাকে নতুনভাবে জীবনকে গ্রহণ করতে শিখিয়েছো। তোমার স্রোতের মতো আমার জীবন এখন প্রবাহিত হবে, যেখানে কোনও বাঁধা নেই, শুধুই এক মুক্তি, এক অবিরাম যাত্রা।” সুমিত তার পাশে দাঁড়িয়ে তা শুনে চুপ ছিল। সে জানত, অঞ্জলী আজ সত্যিই কোনো এক গভীর দিককে অনুভব করছে।

অঞ্জলী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নদীর মতো নিজের জীবনকেও বাঁধা থেকে মুক্ত করে, মুক্তির পথে চলবে। তার জীবনেও যেমন, নদীও যেন একটা উন্মুক্ততা নিয়ে আসছিল। “এখন সময় এসেছে, সুমিত,” অঞ্জলী বলল, “আমার অতীত আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য নয়, বরং সামনে যাওয়ার জন্য আছে।”

“তুমি যদি প্রস্তুত থাকো,” সুমিত বলল, “তবে পৃথিবী তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

অঞ্জলী তখন নদীর দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে হেসে বলল, “তুমি যদি সত্যিই বুঝতে চাও, সুমিত, তাহলে নদীই আমাকে শিখিয়েছে, জীবন কখনো থামে না, এটি কখনো এক জায়গায় আটকে থাকে না।”

তারপর, অঞ্জলী নদীর তীরে হেঁটে চলল। তার মনে এক অদ্ভুত শক্তি অনুভব হচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপে সে যেমন নদীর স্রোতের ছোঁয়া পেত, তেমনি তার নিজের জীবনের অদৃশ্য স্রোতও তাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সে জানত, তার জন্য এক নতুন পথ তৈরি হতে চলেছে—একটি পথ যা তার আত্মার সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত।

নদী তাকে তার মায়ের কাছ থেকে একটি শক্তিশালী শিক্ষা দিয়েছে: “যতই জীবনের সংকট আসুক, তুমি যদি নিজের সত্যিকারের পথ অনুসরণ করো, তাহলে জীবন কখনোই বাধাগ্রস্ত হবে না।”

অঞ্জলী নদীর পাড় ছেড়ে এক নতুন দিগন্তে পদার্পণ করল, আর সেই পথে, যেখানে শুধু অন্ধকার ছিল, সেখানে সে এক নতুন আলো দেখতে পেত। নদী তাকে তার প্রকৃত জীবন দেখিয়েছে, যেখানে হারানোর কিছু নেই, শুধুমাত্র এক নিরন্তর যাত্রা এবং এক নতুন সূচনা।

অধ্যায় ৮: জল অন্ধকারের সংযোগ

অঞ্জলী যখন নদী থেকে এক নতুন জীবন শুরু করেছিল, তখন সে জানত, তার যাত্রার স্রোত এখন এক অজানা দিকের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নতুন পথটি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা, কিন্তু সেই পথে সেসব প্রতিকূলতা ছিল না যা সে কখনো ভাবেনি। সে জানত, জীবনে কিছু জিনিস কাটিয়ে আসার পর, কিছু পুরনো অংশ থেকেই যায়, যা কখনো কখনো ফিরে আসে, আর সেই ফিরে আসা তাকে আরও গভীর থেকে জীবনকে অনুভব করতে শেখায়।

আজ, অঞ্জলী নদীর কাছে এসে দাঁড়াল, কিন্তু আজকের নদীটি আগের মতো শান্ত ছিল না। তার জল যেন কিছুটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল, স্রোতের মধ্যে গতি ছিল কিছুটা তীব্র। অঞ্জলী নদীর দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে শ্বাস ফেলল। “আজ কিছু একটা ঘটবে,” সে মনে মনে বলল। সুমিত তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু তার মুখে কোনো কথা ছিল না। সে বুঝতে পারছিল, অঞ্জলী আজও এক রহস্যের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু সেই রহস্যকে জানার জন্য তাকে আরও বেশি সাহসী হতে হবে।

অঞ্জলী নদীর কাছে গিয়ে বসে, মনের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করছিল। “এটা কি শুধু জল?” সে নিজেকে প্রশ্ন করছিল। “নাকি, এই জল আমাকে একটা নতুন দিক দেখাচ্ছে, যেখানে অন্ধকারের সঙ্গে এক ধরনের সংযোগ তৈরি হবে?” নদীর তীব্র স্রোত তাকে এক নতুন অনুরণন দিচ্ছিল। আজকের নদী যেন কোনো অজানা শক্তি নিয়ে তার সামনে হাজির হয়েছিল।

সুমিত তার পাশেই বসে ছিল। “তুমি কি কিছু অনুভব করছো?” সুমিত জিজ্ঞেস করল। অঞ্জলী মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “হ্যাঁ, আমি জানি, কিছু অদ্ভুত কিছু হচ্ছে, যা আমি আগে কখনো অনুভব করিনি। নদী আজ আমাকে কিছু একভাবে দেখাচ্ছে, যা আমি কখনো ভাবতে পারিনি।”

নদীর স্রোতের মধ্যে এক নতুন ধরনের শব্দ ভেসে আসছিল, যেন কোনো অতিপ্রাকৃত সঙ্গীত, যা শুধুমাত্র অঞ্জলীই শুনতে পাচ্ছিল। সেই শব্দে ছিল এক অদ্ভুত সুর, এক গভীর অনুরণন, যা তাকে তার মায়ের স্মৃতির অতীত, নিজের ভয় এবং সন্দেহের মধ্যে ডুবিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অঞ্জলী চোখ বন্ধ করে সে সুর শোনার চেষ্টা করছিল, যেন সেটা তার জীবনের অবচেতন অংশ হয়ে উঠছিল।

“সুমিত, জানো,” অঞ্জলী বলল, “আমি ভাবছিলাম, আমাদের জীবনে যে অন্ধকার থাকে, সেটা আসলে আমাদের পথের অঙ্গ। নদী এই অন্ধকারকে কীভাবে গ্রহণ করেছে, আমরা কি সেইভাবে গ্রহণ করতে পারি?”

সুমিত তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি বলতে চাও, নদী আমাদের জীবনের অন্ধকারগুলোকে নিজেদের মধ্যে একত্রিত করে নেয়?”

“হ্যাঁ, সুমিত,” অঞ্জলী বলল, “এটি সত্যি। নদী আমাদের পথের আলো এবং অন্ধকারের মিলন। জীবন কখনো শুধুই ভালো বা খারাপ নয়, আমাদের ভেতর সব কিছু মিশে যায়—অন্ধকার, আলো, ভালোবাসা, ভয়, আনন্দ, কষ্ট—সবই এক সাথে চলতে থাকে। নদী যেভাবে স্রোত পরিবর্তন করে, তেমনি আমাদের জীবনেও সব কিছু একটি ধারায় চলে আসে।”

এখন অঞ্জলী বুঝতে পারছিল, নদী তাকে শুধু তার অতীতের স্মৃতি বা ভবিষ্যতের বার্তা দেয়নি, বরং তাকে সেই অন্ধকারের মধ্যে প্রবাহিত করতে শিখিয়েছে, যেখানে সে কখনো ঢুকতে চায়নি। জীবনকে গ্রহণ করা মানে শুধু সুখের মধ্যে থাকা নয়, বরং সেই অন্ধকারটিকেও বুঝে নেয়া, যে অন্ধকারের মধ্য দিয়েই সত্যিকারের মুক্তি আসতে পারে।

সুমিত চুপচাপ নদীর দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখে কিছু এক অবাক দৃষ্টি ছিল। সে জানত, অঞ্জলী আজ সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে দেখছে। সে জানত, আজ তার এই যাত্রা হয়তো একটি শেষ নয়, বরং এটি এক নতুন সূচনার শুরু।

অঞ্জলী নদীর দিকে তাকিয়ে এক গভীর দৃষ্টি দিয়েছিল। আজ সে জানত, নদী কেবল একটি জলপ্রবাহ নয়, এটি তার জীবনের শক্তি, তার আত্মার প্রতিচ্ছবি। জীবন যখন থেমে যায়, তখনও নদী চলতে থাকে, তা যেন এক নিঃশব্দ চেতনা। অঞ্জলী জানতো, স্রোতের সাথে চলতে চলতে, সে একদিন নিজেকে খুঁজে পাবে—একটি নতুন জীবনে, যেখানে তার সকল অন্ধকার আর আলোর মিলন হবে।

আজ, নদী তাকে শিখিয়েছিল, জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি একসাথে অন্ধকার এবং আলোকের সমন্বয়ে নিহিত।

***

WhatsApp-Image-2025-07-03-at-3.47.40-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *