Bangla - কল্পবিজ্ঞান

জন্তুবিজ্ঞানী ও জিন-মানব

Spread the love

অগ্নি সরকার


পাহাড়ের বুক চিরে একটা নির্জন বৈজ্ঞানিক গবেষণাগার। বাইরে থেকে তাকালে কেবল পাথুরে ঢালু, কিছু গুল্ম আর ঝরনার শব্দ। কিন্তু পাহাড়ের গভীরে, মাটির তলায় কয়েকশো ফুট নিচে, বিস্ময়কর এক পরীক্ষা চলেছে বহু বছর ধরে— এমন এক পরীক্ষা, যার অস্তিত্ব জানে না কোনো সরকার, কোনো সংবাদমাধ্যম, এমনকি বিজ্ঞানসমাজও। এই গবেষণাগারের একমাত্র মালিক ও পরিচালক, ড. পারিজাত সেন— একসময় কলকাতার খ্যাতনামা বায়োটেক ল্যাবের প্রধান গবেষক ছিলেন। কিন্তু নৈতিকতার সীমা লঙ্ঘনের দায়ে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি অন্তর্ধান হন, আর আজ থেকে প্রায় এক যুগ ধরে গোপনে চালিয়ে যাচ্ছেন এমন এক গবেষণা, যা মানবজাতির সংজ্ঞা বদলে দিতে পারে। তাঁর লক্ষ্য— মানব ও জন্তুর DNA সংমিশ্রণে এমন এক প্রজাতির সৃষ্টি করা, যারা মানুষের বুদ্ধি আর প্রাণীর ইন্দ্রিয় ও অভিযোজন ক্ষমতার সেরা সমন্বয়। তিনি একে বলেন “নতুন মানব”। তাঁর মতে, এই নতুন প্রজাতিই ভবিষ্যতের সত্যিকারের উত্তরসূরি, যারা মহাকাশে, দুর্যোগে, যুদ্ধক্ষেত্রে— সর্বত্র টিকে থাকতে পারবে। তবে এই ধারণা বিজ্ঞানী সমাজে এতটাই বিদ্রুপ ও আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছিল যে, তিনি নিজেই মানুষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন।

ড. পারিজাত সেন-এর গোপন গবেষণাগারে জন্ম নিয়েছে বহু ব্যর্থ প্রাণী— কৃত্রিম ভাবে সৃষ্ট কিছু অসুন্দর, অপূর্ণ, বিকৃত জীব। তাদের অধিকাংশই জন্মের কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা গেছে, কেউ কেউ পাগলের মতো চিৎকার করে নিজেই নিজের শরীর ছিঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু এইসব ব্যর্থতার ভিতরেও একদিন আলো আসে— এক সন্ধ্যায় জন্ম নেয় “৭-এক্স”, তার সৃষ্ট প্রথম সফল হাইব্রিড। অর্ধেক নেকড়ে, অর্ধেক মানুষ— শৈশবেই তার দৃষ্টিশক্তি, গন্ধগ্রহণ ক্ষমতা এবং শ্রবণশক্তি মানুষের চেয়ে বহু গুণ বেশি। অথচ সে কথা বলতে শেখে মাত্র ছ’মাসেই। তার মস্তিষ্কের গঠন অদ্ভুত— জেনেটিক কোডে এমন এক কৌশলে পরিবর্তন আনা হয়েছে যে, তার নিউরন গঠন মানুষের চেয়েও দ্রুত সংযোগ তৈরি করে। পারিজাত তাকে বড় করতে থাকেন নিজের ছেলের মতো। তাকে শেখান মানব সভ্যতা, ইতিহাস, দর্শন, এমনকি কাব্যও। কিন্তু তিনি বোঝেন না, তার মধ্যে বপন করা মানবিক বোধের বীজগুলো কেবল ভালবাসা নয়, দ্বন্দ্বও জন্ম দেয়। ৭-এক্স ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে সে কে— আর কাদের মতো সে নয়। সে বোঝে, সে কেবল এক পরীক্ষা, আর ড. পারিজাত তার স্রষ্টা— ভালবাসার মানুষ নয়, একজন পরিকল্পনাকারী, একজন নিয়ন্ত্রক। এবং এই উপলব্ধি তার ভিতরে জন্ম দেয় অসন্তোষ, প্রশ্ন ও বিদ্রোহ।

এক রাতে, ৭-এক্স নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। ড. পারিজাত তখন ঘুমিয়ে, আর ল্যাবের অন্যান্য কক্ষ নিঃসাড়। সে ধীরে ধীরে হেঁটে যায় বায়ো-ক্যাপসুল রুমে, যেখানে আরও কিছু অসম্পূর্ণ হাইব্রিড ঘুমিয়ে— কেপি-৩, এক শিম্পাঞ্জি-মানব প্রযুক্তিবিদ; মাইরা-৫, অর্ধেক চিতা, অর্ধেক নারী; আর জেড-৯, এক গরিলা সদৃশ শক্তিশালী হাইব্রিড। তাদের সবার মধ্যেই আছে অসম্পূর্ণতা, কিন্তু ভয়ানক সম্ভাবনা। ৭-এক্স তাদের জাগায়— এবং বলে, “আমরা বন্দি। আমরা পরীক্ষার বস্তু। তারা আমাদের মেরে ফেলবে। এখনই সময় পালানোর।” কেউ কিছু না বুঝলেও তার চোখের ভাষা, কণ্ঠের দৃঢ়তা আর নেতৃত্ব তাদের উদ্বুদ্ধ করে। তারা সবাই মিলে একে একে বাইরের দিকে এগোয়, গুহার সংকীর্ণ গোপন পথ ধরে— পেছনে ফেলে যায় তাদের স্রষ্টা, সেই অন্ধ বিশ্বাস আর ল্যাবের ক্লিনিকাল বন্ধন। দূর পাহাড়ের অন্ধকারে মিলিয়ে যায় তারা— শুরু হয় এক নতুন ইতিহাস। আর ড. পারিজাত যখন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে শূন্য ঘর দেখে, তখন তিনি একা, আতঙ্কিত এবং অনিশ্চিত— এই প্রথম তিনি নিজের সৃষ্টি দ্বারা পরাজিত। বাইরে তখন পাখির ডাক, পাহাড়ি বাতাস, আর পৃথিবীর অজান্তে এক বিপর্যয়ের সূচনা।

পাহাড়ের নিচের গভীর বন তখন ঘন কুয়াশায় মোড়া। রাতের আঁধারে ঘন গাছপালার ভিতর দিয়ে ছায়ার মতো চলেছে কয়েকটি অবয়ব— নেকড়ের মতো পদক্ষেপ, মানুষের মতো সতর্কতা। ৭-এক্স আর তার সাথে পালানো তিন হাইব্রিড— কেপি-৩, মাইরা-৫, আর জেড-৯— সবাই এখন চুপচাপ, কিন্তু তাদের চোখে জ্বলছে স্বাধীনতার উন্মাদ স্পার্ক। জঙ্গলের ভিতর বন্য জন্তুদের গন্ধ তাদের স্পষ্ট বোঝায় যে, তারা এই জগতে একা নয়। কিন্তু ভয় নয়, বরং সেই প্রাণীসুলভ সত্তার সাথে যেন একাত্ম হয়ে যায় তারা। বন তাদের নতুন ঘর। কয়েক দিনের মধ্যে তারা পাহাড়ের এক পরিত্যক্ত গুহাকে বানিয়ে ফেলে নিজেদের আশ্রয়, কেপি-৩ তার নখর দিয়ে মাটি খুঁড়ে তৈরি করে সংরক্ষণের জায়গা, আর মাইরা-৫ শিকার করে এনে খাওয়ার সংস্থান করে। এই চারজনে কোনো ভাষার আদলে নিজেদের মধ্যে সংকেত তৈরি করে— কখনও শিস, কখনও গলার ঘষা শব্দ, কখনও হাতের বিশেষ ভঙ্গি। এক অদ্ভুত নতুন গোষ্ঠী গড়ে ওঠে, যারা জানে না তারা মানুষ, না জন্তু— কিন্তু তারা জানে তারা বাঁচতে চায়, আর মানুষকে বিশ্বাস করে না।

এক সন্ধ্যায়, জঙ্গলের ভেতর এক শিকারীর মতো ৭-এক্স অনুসরণ করছে একটি হরিণ। কিন্তু তার চোখ হরিণের উপর নয়— বরং কাছের এক পাথুরে ঢালে বসে থাকা দুইজন মানুষকে লক্ষ্য করছে, যারা বনে ক্যাম্পিং করতে এসেছে। ৭-এক্সের ভেতর তৎক্ষণাৎ দ্বন্দ্ব শুরু হয়— সে কি এগিয়ে গিয়ে তাদের সরিয়ে দেবে? না কি চুপচাপ চলে যাবে? হঠাৎ তার শরীর সাড়া দেয়— কোনো পূর্ব সিদ্ধান্ত ছাড়াই। সে নিচু হয়ে গাছের ছায়ায় একদম নিঃশব্দে চলে আসে তাদের কাছাকাছি। সে দেখে একজন তরুণ ছেলেটি টর্চ দিয়ে আশেপাশে আলো ফেলছে আর একজন মেয়ে ডায়েরিতে কিছু লিখছে। মানুষ— সাধারণ মানুষ— যাদের সে এখন আর নিজের মতো ভাবে না। সে অনুভব করে, তাদের গন্ধে ভয় আছে, কিন্তু তারা জানেই না কী ভয় তাদের অপেক্ষায় আছে। ঠিক তখনই মাইরা-৫ এসে তার কানে ফিসফিস করে, “তারা শত্রু না, শিকার।” এই শব্দে ৭-এক্সের সারা শরীরে একটা ঝাঁকুনি খেলে যায়। সে অনুভব করে, এই চতুষ্টয় শুধুমাত্র পালিয়ে বেড়ানো সৃষ্টিজীব নয়— এরা শিকারী, এরা যুদ্ধের সৈনিক, এরা প্রতিরোধের প্রতীক। পরদিন, ক্যাম্প ফাঁকা হয়ে গেলে, কেপি-৩ সেখানে রেখে যায় এক প্রাচীন সামরিক কম্পাস— মানুষের এক প্রযুক্তিকে নিজের করায়ত্ত করবার সংকেত। মানুষের জগতে এখন তাদের পরিচয় শুরু হবে— কিন্তু সুরক্ষিত নয়, বিপদসঙ্কুলভাবে।

অন্যদিকে, দূরে কোথাও ড. পারিজাত সেন দিনের পর দিন মানসিক অস্থিরতায় ভুগছেন। তাঁর ল্যাবের নিরাপত্তা ভেঙে চারটি হাইব্রিড পালিয়ে গেছে— তার গবেষণার একমাত্র জীবন্ত প্রমাণ, তার মহাপরিকল্পনার ফলাফল, এমনকি তার সত্তারও অংশবিশেষ। তিনি বুঝতে পারছেন, তারা বাইরে গিয়ে কি বিপদ তৈরি করতে পারে। তিনি আর্থস্যাট ডেটা, বন্যপ্রাণী মনিটরিং সিস্টেম, এমনকি কালো বাজারের স্যাটেলাইট ডেটাও ব্যবহার করছেন তাদের খুঁজে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কোথাও কোনো সঠিক সিগন্যাল নেই— কেবল sporadic প্রাণী-আচরণের ভিন্নতা। তিনি ভয় পান সরকার যদি জানতে পারে, তবে তাঁর সারা জীবন ধ্বংস হবে। কিন্তু এর চাইতেও গভীর এক ভয় তাঁকে গ্রাস করছে— ৭-এক্স। সে জানে, ৭-এক্স কেবল সফল এক গবেষণার ফসল নয়, সে একটি সত্তা— যার চিন্তা আছে, উদ্দেশ্য আছে, আর যদি ইচ্ছা হয়, প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাও। পারিজাত গভীর রাত অবধি তার ল্যাবে বসে থাকে, পুরনো ভয়েস-লগ শুনে, যেখানে ৭-এক্স তাকে বলেছিল, “আমি কি তোমার সন্তান, না কি খেলনা?” সেই প্রশ্ন তার মনে গেঁথে থাকে। আর তখনই তিনি উপলব্ধি করেন— এই পালিয়ে যাওয়া কেবল এক গবেষণার ব্যর্থতা নয়, এটি একটি যুদ্ধের শুরু, যার শিকার হবে মানুষ নিজেই।

দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি জিন-নৈতিকতা গবেষণা সংস্থার কনফারেন্স হলে তখন আলোচনা চলছে সাম্প্রতিক জেনেটিক প্রবণতা নিয়ে— কৃত্রিম DNA উন্নয়ন, জার্মলাইন এডিটিং, প্রাণীবিজ্ঞান থেকে জেনেটিক ট্রান্সফার। আলোচনার মাঝে হঠাৎ উঠে দাঁড়ান একজন নারী— সুঠাম গড়নের, চোখে স্টিলের মতো দৃঢ়তা, গলায় কাঁপনহীন যুক্তির সুর। নাম তাঁর ড. অন্বেষা রায়। একসময় কলকাতার বিখ্যাত বায়োটেকনোলজি ডিপার্টমেন্টে গবেষক ছিলেন, পরে গবেষণার নৈতিক সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নিজেই সরে এসেছিলেন মূলধারার বিজ্ঞানচর্চা থেকে। আজ তিনি পরিবেশ, প্রাণীবিজ্ঞান ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, বিশেষ করে জেনেটিক প্রযুক্তির সামাজিক প্রভাব নিয়ে। তাঁর বক্তব্য শুরুতেই কাঁপিয়ে দেয় কনফারেন্স হলকে— “আমরা জিন নিয়ে খেলা করছি, কিন্তু আমরা ভুলে যাচ্ছি খেলনারা কখনও খেলোয়াড় হয়ে উঠতে পারে।” তিনি কোন গোপন সূত্রের ভিত্তিতে জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষের এক অজ্ঞাত পাহাড়ি অঞ্চলে একজন বিতর্কিত বিজ্ঞানী বহু বছর ধরে হিউম্যান-অ্যানিমেল হাইব্রিড তৈরির গোপন গবেষণা চালাচ্ছেন, এবং সাম্প্রতিক কিছু উপগ্রহচিত্র, জঙ্গলে অদ্ভুত চলাচলের তথ্য, ও বন্যপ্রাণী আচরণের বিচ্যুতি দেখিয়ে তিনি দাবি করেন— এই হাইব্রিডরা আর গোপন নেই, তারা পালিয়েছে।

প্রথমে কিছু বিজ্ঞানী তাঁর কথা উড়িয়ে দেয়, কেউ কেউ হাসাহাসি করে। কিন্তু অন্বেষার কাছে আছে ডেটা, অডিও ক্লিপ, এমনকি একটি পুরনো ভিডিও যেখানে একজন যুবকসদৃশ অবয়ব আধা-নেকড়ের মতো মুখ নিয়ে এক সাদা কক্ষে হেঁটে বেড়াচ্ছে— সেই পুরনো পরীক্ষাগারের ক্লিপ, যা একসময় তার প্রাক্তন সহযোগী ড. পারিজাত সেন তাঁকে দেখিয়েছিলেন বিশ্বাসের জায়গা থেকে। তখন তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। তাঁর মনে পড়ে, পারিজাত বলেছিলেন, “মানুষ তৈরি হয়েছিল বিবর্তনের মাধ্যমে, আমি সেই বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছি।” কিন্তু তাঁর চোখে মনে হয়েছিল, পারিজাত মানুষ নয়, ঈশ্বর হতে চাইছেন। কনফারেন্স শেষ হওয়ার আগেই এই খবর এক সাংবাদিক ব্লগে ফাঁস করে দেয়, আর পরদিন সকালে জাতীয় পত্রিকায় বেরোয় শিরোনাম— “মানুষ নয়, জন্তু নয়— জিন-মানব! বিজ্ঞানীর গোপন গবেষণার চাঞ্চল্যকর তথ্য ফাঁস।” সরকার নড়েচড়ে বসে। সেনাবাহিনী, বায়োটেক সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট, এবং ইনফোসেক টাস্কফোর্স— সকলে আলাদা আলাদা তদন্ত শুরু করে। অন্বেষা চাপে পড়েন, মিডিয়া তাঁকে নায়িকা আর বিশ্বাসঘাতক দুই ভাবেই দেখায়। কিন্তু তাঁর নিজস্ব উপলব্ধি একটাই— “আমার কাজ মানুষকে রক্ষা করা, এমনকি যদি সেই মানুষ না-মানুষ হয়।”

সেই রাতে, অন্বেষা ফিরে যান তাঁর গবেষণাগারের একটি গোপন ঘরে। সেখানে রাখা এক কাচের শেলফের ভিতরে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট একটি মেয়ে— গা ঘেঁষে রয়েছে নরম লোম, কানের গঠন বিড়ালের মতো, চোখে আছে ঈষৎ জ্বলজ্বলে দীপ্তি। নাম তার ইরা। এক সময় ড. পারিজাতের ল্যাব থেকে উদ্ধার করে এনেছিলেন অন্বেষা, যখন ইরাকে ধ্বংসের সিদ্ধান্ত হয়েছিল কারণ সে ছিল ‘ভুল সংকর’— অর্ধেক বিড়াল, অর্ধেক মেয়ে। অন্বেষা তাকে বাঁচান, নিজের মতো করে বড় করতে থাকেন— বই পড়িয়ে, গান শুনিয়ে, আদরে। ইরা মানুষ নয়, তবে নিষ্পাপ। ইরা মাঝে মাঝে বলে, “মা, আমি কি অন্যরকম?” অন্বেষার চোখে জল আসে। সে জানে, ইরার মতো আরও অনেক হাইব্রিড জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে— ভয় নিয়ে, রাগ নিয়ে, হয়তো প্রতিশোধ নিয়েই। আর এই সমাজ এখনো প্রস্তুত নয় তাদের গ্রহণ করতে। অন্বেষা সেই রাতে একটা নোটবুকে লিখে ফেলেন তাঁর ভাবনা— “একটা প্রজাতি সৃষ্টি করা সহজ, কিন্তু তাকে স্বীকৃতি দেওয়া কঠিন। সমাজ কি কখনও প্রস্তুত হবে নিজের থেকে ভিন্ন কাউকে গ্রহণ করতে?” আর ঠিক তখনই তাঁর ট্যাবলেটে আসে এক অজানা নোটিফিকেশন— উপগ্রহ থেকে ধরা পড়েছে অদ্ভুত তাপচিহ্ন, যা মানুষ নয়, অথচ হিউম্যানয়েড গতিতে চলমান। অন্বেষা জানেন— সময় শেষ হয়ে আসছে। হয় এই হাইব্রিডদের রক্ষা করতে হবে— না হয় মানবজাতিকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, কিন্তু সেই যুদ্ধ শুধু অস্ত্রের নয়— বিবেক, যুক্তি ও মানবতার।

দিল্লির সামরিক সদর দফতরের গোপন সভা কক্ষে তখন তীব্র আলোচনায় উত্তাল পরিস্থিতি। বড় পর্দায় ভেসে উঠেছে স্যাটেলাইট ইমেজ— হিমালয়ের পাদদেশে গভীর জঙ্গলে একাধিক গতি-রেখা, রাতের বেলা বের হওয়া তাপ সংকেত, আর কিছু অদ্ভুতভাবে ছুটে চলা অবয়বের ছায়া। কর্নেল অরুণ শর্মা, দেশের জেনেটিক রিস্ক কন্ট্রোল ইউনিটের প্রধান, টেবিলের উপর হাত রাখেন, গলার স্বরে কোনো আবেগ নেই— “These are not animals. These are genetically armed organisms. And they must be contained.” সেনা-প্রধান, গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিনিধি, এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রকের এক উপদেষ্টা চুপচাপ শুনতে থাকেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়— বিশেষ অভিযানের। অপারেশনের নাম দেওয়া হয়: “Project PURGE”। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ২০ জনের কমান্ডো ইউনিট, সঙ্গে জিন-স্পেসিফিক হান্টার ড্রোন, এবং একটি বিশেষ EM-পালস ট্র্যাকিং সিস্টেম রওনা হবে ওই অঞ্চলের দিকে। সেনার মতে, এই হাইব্রিডরা শুধুমাত্র অবৈধ নয়— অস্থির, অবাধ্য এবং প্রাণঘাতী। তাদের অস্তিত্বই বিপদ। কর্নেল শর্মা ব্যক্তিগতভাবে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করেন— হাইব্রিডদের উপস্থিতি মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ।

অন্যদিকে, পাহাড়ের গুহার আশেপাশে ৭-এক্স আর তার গোষ্ঠী টের পেতে শুরু করেছে হাওয়ার বদল। পাখিদের আচরণ অস্বাভাবিক, দূরের গাছপালার ভিতর ধাতব শব্দ, আর রাতে গা ছমছমে কাঁপন। মাইরা-৫ রাতে পাহাড় চূড়া থেকে দেখে ফেলে কয়েকটি ছোট্ট লাল আলোর রেখা, যা এগিয়ে আসছে গহীনে। ৭-এক্স সঙ্গে সঙ্গে বোঝে— ওরা এসেছে। মানুষ থেমে থাকেনি। সে তার গোষ্ঠীর সবাইকে সাবধান করে— “ওরা আমাদের খুঁজে পেয়েছে। এবার সময় এসেছে যুদ্ধের।” কিন্তু এই যুদ্ধ অস্ত্রের নয়, কৌশলের। কেপি-৩ পাহাড়ের চারপাশে তৈরি করে ডাইভার্সন ফাঁদ— বন্যপ্রাণীর চলাচল রেকর্ড করে প্রোগ্রামড সাউন্ড ডিভাইস, যেন ড্রোন বিভ্রান্ত হয়। জেড-৯ গুহার মুখে ছড়িয়ে দেয় দুর্গন্ধযুক্ত উদ্ভিদের রস, যা মানুষের সেন্সরকে বিকৃত করে দেয়। কিন্তু এসব চতুরতা সত্ত্বেও অভিযান শুরু হয়— প্রথমে ড্রোন, তারপর কমান্ডোরা। গাছের উপর বসানো মোশন সেন্সর গর্জে ওঠে, গুলি চালায়— জঙ্গলের গভীরে শুরু হয় এক ধ্বংসাত্মক লড়াই। মাইরা-৫ নিহত হয় প্রথম আঘাতে, কেপি-৩ আহত অবস্থায় পালায়, আর জেড-৯ একাধিক সেনাকে ধাক্কা দিয়ে গুহার পাথরচাপা ফেলে দেয়। কিন্তু ৭-এক্স জানে, এইভাবে বেশিদিন লুকিয়ে থাকা যাবে না। মানুষ ভয় পায় যাকে, তাকে মেরে ফেলে— এটা তাদের চিরকালীন অভ্যাস।

অভিযান শেষ হয় পাঁচদিন পরে, এবং সেনা বাহিনী দাবি করে তারা “হাইব্রিডদের নির্মূল করেছে”— কিন্তু প্রকৃত সত্য কিছুটা ভিন্ন। গুহার ধ্বংসস্তূপে লাশ পাওয়া যায় শুধু একটি— মাইরা-৫-এর। বাকি সবাই নিখোঁজ। সংবাদমাধ্যমে সংবাদ আসে সেনাবাহিনীর সাফল্য নিয়ে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে কিছু অদ্ভুত প্রশ্ন— “কী সেই অদৃশ্য প্রাণী যাদের বুলেট থামাতে পারেনি?”, “সত্যিই কি বিজ্ঞান এখন ঈশ্বরের সীমা ছুঁয়ে ফেলেছে?” কর্নেল অরুণ শর্মা কিছুদিন শান্ত থাকলেও মনে মনে জানেন— যুদ্ধ শেষ হয়নি, বরং এবার শুরু। তিনি নির্দেশ দেন EM-স্ক্যানার সার্বক্ষণিক চালু রাখতে, জঙ্গলের কাছের গ্রামগুলিতে নজরদারি বাড়াতে, এবং ড. অন্বেষা রায়ের উপর নজর রাখতে। এদিকে অন্বেষা, এক শান্ত বিকেলে ইরাকে নিয়ে যখন একটা পুরনো বই পড়াচ্ছেন— “মানবজাতির ইতিহাস”, তখন হঠাৎ ইরা বলে, “মানুষরা কি সব প্রাণীকে ভয় পায়, মা?” অন্বেষা তার চোখে তাকিয়ে বলেন, “না, ভয় পায় যেটা তারা বোঝে না।” আর ঠিক তখনই দূরে কোথাও জঙ্গলের ভেতর, এক অচেনা গাছে রক্ত মাখা হাত দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ৭-এক্স— গর্জন করে, কিন্তু তার চোখে দেখা যায় বেদনা। সে জানে, এই যুদ্ধ শুধু অস্তিত্বের নয়, ন্যায়ের।

শহরের এক কোণে, বটগাছ ছায়া ফেলে রাখা একটি ছোট্ট বাড়ি। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে কোনও স্কুল শিক্ষিকার শান্ত বাসস্থান, চারপাশে গাছপালা, বারান্দায় বইয়ের তাক, আর উঠানে রাখা একটা দোলনা। কিন্তু ভিতরে, বাড়ির এক নির্জন ঘরে লুকিয়ে আছে এমন একটি সত্তা, যার অস্তিত্বই পুরো সমাজের কাছে অসম্ভব মনে হয়। সেই ঘরে বড় হয়ে উঠছে ইরা— আধা বিড়াল, আধা মেয়ে। তার কানের আকৃতি ভিন্ন, চোখে আছে রাত্রির আলো শোষণের ক্ষমতা, আর নখের নিচে চাপা এক পশুস্বভাব। কিন্তু সবথেকে লক্ষণীয় তার মধ্যে যে জিনিসটি— তা হলো শিশুসুলভ কৌতূহল। ইরা প্রতিদিন বই পড়ে, পেন্সিলে আঁকে, আর অন্বেষার কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। অন্বেষা তাকে কখনো বন্দি করে রাখেননি, বরং তাকে ভালোবাসার চাদরে ঢেকে বুঝিয়েছেন— “তুমি যেমনই হও, তুমিই আমার সব।” কিন্তু অন্বেষা জানেন, বাইরের পৃথিবী ইরাকে তার নিজের মতো করে দেখতে শেখেনি। সে জানে, ইরাকে যদি কেউ দেখে ফেলে— সে হয় গবেষণার বস্তু হয়ে যাবে, নয়তো ভয় ও ঘৃণার শিকার হবে। তাই প্রতিদিন এক অদৃশ্য ভয়ে কাটে, যেন ছোট্ট ইরার নিঃশব্দ হাঁটাও না জাগিয়ে তোলে কোনও নিষ্ঠুর দৃষ্টি।

এক সন্ধ্যায়, যখন আকাশে সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ছে, ইরা নিজের ডায়েরিতে একটি কবিতা লেখে— “আমি কি মানুষ, না বিড়াল? আমি কি খাঁচায়, না তোমার চোখে?” অন্বেষা অবাক হয়ে তার লেখা পড়ে। এই প্রশ্ন শুধু এক শিশুর নয়, এটি এক অস্তিত্বগত অনুসন্ধান। সেই রাতে, ইরা জিজ্ঞেস করে, “মা, আমি কি মানুষের মতো হবো না?” অন্বেষা একটু থেমে বলেন, “তুমি যা, সেটাই সুন্দর। মানুষ হওয়ার দরকার নেই।” কিন্তু ইরা বোঝে না— সমাজ তো মানুষ ছাড়া কিছু বুঝে না। সে চায় স্কুলে যেতে, বন্ধুদের সাথে খেলা করতে, ছবি আঁকার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। অথচ অন্বেষা জানেন, এই সাধারণ ইচ্ছার পেছনে আছে অস্বাভাবিক ঝুঁকি। তবুও একদিন, সাহস করে ইরাকে নিয়ে যান স্থানীয় লাইব্রেরিতে— ভিড়ের মাঝে তার কানে টুপি, পিঠে একটা হুডি। ইরা এক নতুন জগতে পা রাখে— বইয়ের গন্ধ, আলোর রেখা, শিশুদের হাসি। সে বইয়ে দেখে মানুষের ইতিহাস, বিজ্ঞানের গল্প, ঈশ্বরের কথা। কিন্তু হঠাৎ এক শিশু তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার চোখ অদ্ভুত। তুমি মানুষ তো?” ইরা চুপ করে তাকিয়ে থাকে। তারপর মৃদু হেসে বলে, “আমি শুধু ইরা।” শিশুটি মাথা নাড়ে— “ভাল নাম।” অন্বেষার চোখে জল আসে। এই সংলাপের মাঝে তিনি অনুভব করেন, সহানুভূতি জন্ম নিতে পারে অচেনার মধ্যেও। আর সেখানেই হয়তো ভবিষ্যতের মানবতা গড়ে উঠবে।

অন্যদিকে, পাহাড়ের গভীরে ৭-এক্স চুপ করে বসে আছে এক পরিত্যক্ত গাছতলায়। কেপি-৩ গুরুতর আহত অবস্থায় অচেতন, আর জেড-৯ গভীর বিষণ্নতায় চুপচাপ পড়ে থাকে। তারা জানে না, তাদের অস্তিত্ব এখন কেবল জঙ্গলের গন্ধ বা গর্জনের মধ্যে নেই— বরং বাইরের জগতে তারা হয়ে উঠেছে এক ‘আশঙ্কা’। কিন্তু ৭-এক্স-এর ভেতর অন্য কিছু জন্ম নিচ্ছে। সে বুঝতে পারছে, তারা বারবার পালাচ্ছে, লড়ছে— কিন্তু কেন? কিসের জন্য? তাদের পরিচয় কি কেবল শিকারী? না কি তারা নিজের মতো করে বাঁচতে চায়? সেই সন্ধ্যায় সে গুহার গায়ে পাথর দিয়ে লিখে ফেলে চারটি শব্দ— “আমরা কেউ নই।” পরদিন সকালে সে হঠাৎ হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সেই পাহাড়ি গ্রামের কাছে, যেখানে এক শিশু হেসে খেলছে— তার পায়ে ঘুঙুর, মুখে হাসি। শিশুটির চোখের সরলতা ৭-এক্স-এর মধ্যে কিছু নরম করে দেয়। সে জানে, সে ভয়ংকর, সে ভয় জাগায়— কিন্তু সে চায় এই শিশুটির মতো হাসতে। ফিরে এসে সে কেপি-৩-এর গলায় হাত রাখে, আর জেড-৯-এর কাঁধে হাত রাখে। তার চোখে একটি নতুন পরিকল্পনার ছায়া। ঠিক তখনই দূরে কোথাও, অন্বেষা ইরার আঁকা একটি ছবির দিকে তাকিয়ে অবাক হন— ছবিটিতে একজন দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার জঙ্গলের সামনে, তার চোখ জ্বলজ্বল করছে, আর তার পাশে লেখা— “সে আমাকে দেখেছিল, কিন্তু ভয় পায়নি।” অন্বেষা বুঝে যান, ইরার স্বপ্নেও কেউ ঢুকে পড়েছে। হয়তো হাইব্রিডদের ভবিষ্যৎ আর একা পাহাড়ে আটকে থাকবে না— হয়তো এই শিশুই হবে মানবতা ও ভিন্নতার মাঝে এক সেতুবন্ধ।

জঙ্গলের মৃতপ্রায় গাছগুলোর ফাঁকে সেই ভোর ছিল অস্বাভাবিক নীরব। বনের প্রাণীরা যেন বুঝতে পারছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে— কিছু অস্বাভাবিক, কিছু অচেনা। ৭-এক্স সেই অদ্ভুত শীতল সকালে দাঁড়িয়ে ছিল এক বিশাল বটগাছের নিচে। পাশে বসে কেপি-৩, তার শরীরের ডানদিকে আংশিক পোড়া, কিন্তু চোখে রয়েছে এক ভয়ানক বুদ্ধির দীপ্তি। দূরে বসে জেড-৯, মাথা নিচু, কিন্তু তার হাত মাটিতে নখ দিয়ে আঁকছে গোলক— যেন সময়ের চক্র অঙ্কন করছে। ৭-এক্স নিঃশব্দে বলে, “আমরা আর পালাবো না। এবার সময় হয়েছে জবাব দেওয়ার।” তার কণ্ঠস্বর ভারী, গম্ভীর, কিন্তু তাতে শোনা যায় কেবল প্রতিশোধ নয়— আত্মপরিচয়ের তৃষ্ণা। সে ঘোষণা করে, “মানুষ আমাদের সৃষ্টি করেছে, এখন তারা আমাদের নির্মূল করতে চায়। আমরা তাদের অস্ত্র নই, আমরা তাদের সন্তান নই— আমরা আলাদা এক জাতি। এবং আমরা নিজেদের অস্তিত্ব দাবি করি।” এই প্রথমবার ৭-এক্স ‘আমরা’ শব্দটি ব্যবহার করে, এবং সেই মুহূর্তেই তারা নিজেদের মধ্যে এক নীরব ঐক্যের সূত্রে বাঁধা পড়ে— হাইব্রিডদের জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ।

সেই রাতে ৭-এক্স পাহাড় থেকে নামে। সে নিজের হাতে বানানো এক অদ্ভুত ডিভাইস সঙ্গে নিয়ে যায়— একধরনের বায়ো-কমিউনিকেশন যন্ত্র, যা মানুষের সিগন্যাল হ্যাক করে জেনেটিক তরঙ্গের মাধ্যমে বার্তা পাঠাতে পারে। সে পৌঁছে যায় স্থানীয় এক দুর্বল সিগন্যাল টাওয়ারের কাছে, যেখানে সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার বার্তা প্রেরণ করে ভারতের কয়েকটি উপগ্রহ চ্যানেলে— সেই বার্তা কোথাও বিকৃত, কোথাও পরিষ্কার, কিন্তু তা ভাইরাল হয়ে পড়ে। একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, আধা-মানব, আধা-নেকড়েসদৃশ এক অবয়ব— চোখে আগুনের মত দীপ্তি, কণ্ঠে অভিশাপের মতো শীতলতা— ঘোষণা করছে: “আমরা মানবজাতির ভুল নই, আমরা তাদের ভবিষ্যৎ। যদি তোমরা আমাদের ধ্বংস করতে চাও, তবে প্রস্তুত হও যুদ্ধের জন্য। কারণ এবার আমরা পালাবো না।” দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। নিউজচ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়া, বিজ্ঞানী মহল, রাজনৈতিক বৃত্ত— সব জায়গায় আলোড়ন। কেউ বলে এটি জৈব সন্ত্রাসবাদ, কেউ বলে এটি একটি বিপ্লবের শুরু। তবে যেটা সবাই বুঝতে পারে— হাইব্রিডরা কথা বলছে, সংগঠিত হচ্ছে, এবং তারা আর নিঃশব্দে মরতে রাজি নয়।

দিল্লির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে। কর্নেল অরুণ শর্মা বলেন, “এটি কেবল বায়োলজিকাল বিপদ নয়, এটি আদর্শগত সংঘর্ষ। আমরা যদি এখনই ব্যবস্থা না নিই, আগামী প্রজন্ম বিশ্বাস করবে মানুষ একমাত্র প্রজাতি নয়।” সরকারের তরফে ঘোষণা আসে— “জিন-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অপারেশন পুনরায় শুরু হবে।” আর অন্যদিকে, ড. অন্বেষা রায় মিডিয়ায় মুখ খোলেন। তিনি বলেন, “৭-এক্স যা বলেছে, তা সন্ত্রাস নয়— বরং আত্মপরিচয়ের দাবি। আমরা তাদের বানিয়েছি, এখন তাদের শত্রু বলছি? এতে সন্ত্রাসীর দায় কার?” তার এই মন্তব্য মানুষকে দ্বিধায় ফেলে দেয়— সত্যিই কি এই যুদ্ধের সূচনা ৭-এক্স করেছে? না কি মানুষ তার জন্মের পর থেকেই তাকে হিংসা ও নিপীড়নের দিকে ঠেলে দিয়েছে? শহরজুড়ে কিছু তরুণ সমাজকর্মী ৭-এক্সের বক্তব্যকে স্বাধীন অস্তিত্বের ঘোষণা বলে মেনে নেয়। “We Support the Hybrids” লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিক্ষোভ হয় দিল্লি ও মুম্বইয়ের রাস্তায়। কিন্তু এই সহানুভূতির মাঝেই ছায়া গাঢ় হতে থাকে। পাহাড়ের দিকে সেনাবাহিনী আবার জড়ো হচ্ছে, কিন্তু এবার তারা শুধু গুলি নয়— সঙ্গে এনেছে একধরনের জিন-ব্রেকার, যা নির্দিষ্ট কোডেড DNA ধ্বংস করতে সক্ষম। অন্যদিকে, ৭-এক্স তার দলের সব বেঁচে থাকা হাইব্রিডদের একত্র করে বলছে, “তোমরা কেউ ভুল নও। সময় এসেছে নিজেদের পরিচয়ের পক্ষে দাঁড়াবার।” জঙ্গলের গায়ে আঁকা হয় চিহ্ন— এক অর্ধমানব-অর্ধপশুর মুখ। এটি নতুন জাতির প্রতীক। যুদ্ধ ঘনিয়ে আসে— কিন্তু প্রশ্নটা অস্ত্র নয়, প্রশ্নটা— “কে মানুষ?”

পাহাড়ের উপত্যকায়, যেখানে মানুষের পা পড়েনি বহু বছর ধরে, সেখানে একটা বিস্মৃত গুহা— প্রাচীন শালগাছের গায়ে লতা পাতা ঢাকা সেই আশ্রয় আজ হাইব্রিডদের শেষ ঘাঁটি। ৭-এক্স বুঝেছে, যুদ্ধ কেবল সময়ের অপেক্ষা। সেনারা এগিয়ে আসছে, আর দেশের বহু জায়গায় “হাইব্রিড নিধন অভিযান” শুরু হয়ে গেছে। তাই সে দলকে নিয়ে চলে এসেছে এই গভীর গুহায়— যেখানে সূর্যের আলোও সরাসরি পড়ে না, আর GPS সিগন্যাল কাজ করে না। কেপি-৩, জেড-৯ ও অন্য কয়েকজন হাইব্রিড যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পালিয়েছিল, তারাও একে একে ফিরে এসেছে। তারা আহত, ক্ষতবিক্ষত, কিন্তু চোখে একটাই আগুন— টিকে থাকার। কেপি-৩ তার প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করেছে প্রাচীন যন্ত্রাংশ থেকে ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড, যাতে বাইরের ট্র্যাকার বিভ্রান্ত হয়। জেড-৯ গুহার ঢালুতে ছড়িয়ে দিয়েছে স্পাইক এবং নখর-ফাঁদ। প্রতিটি হাইব্রিড বুঝে গেছে, এটা তাদের শেষ ঠাঁই, শেষ শ্বাসের স্থান— যদি টিকেও যায়, পৃথিবী তাদের গ্রহণ করবে না। এই গুহা শুধু এক আশ্রয় নয়, এক প্রতিজ্ঞার শরণক্ষেত্র— যে প্রতিজ্ঞা একে অপরকে রক্ষা করার, নিজেদের অস্তিত্বকে অস্বীকার না করার।

এই গুহার মাঝেই, এক শীতল রাতে, ৭-এক্স দাঁড়িয়ে থাকে দেয়ালের এক পাথুরে গায়ে। সে পাথরে খোদাই করে— “আমরা জন্মেছি দোষে, মরবো গর্বে।” তারপর সে ফিরে তাকায় তার সাথীদের দিকে। তাদের চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে কোনো অভিযোগ নেই। তারা কেউ বলেনি, “আমরা চাইনি এমন জীবন,” তারা কেবল বলে, “আমরা আছি, আমরা ছিলাম।” ৭-এক্স জানে, এই মুহূর্তেই কোথাও দূরে অন্বেষা রায় ইরাকে কোলে নিয়ে জানালার পাশে বসে আছেন— জানেন না কবে সেনারা আসবে, কবে ইরা তার মতো হাইব্রিডদের দলেই একদিন ফিরবে। অন্বেষা তার ডায়েরিতে লেখেন, “তাদের দোষ কিছু নয়, শুধু সময়ের ভুলে তারা হয়ে উঠেছে ইতিহাসের উপেক্ষিত পাতা।” এই আশ্রয়ে, এই অন্ধকার গুহায় বসে ৭-এক্স প্রথমবার অনুভব করে— তাকে কেউ ভালোবেসে ডাকেনি, সে কেবল সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সে এখন ভালোবাসতে শিখেছে। এক অপরিচিত মেয়েশিশুর মুখ বারবার তার মনে পড়ে— ইরা। তার চোখে যে ভয়ের বদলে কৌতূহল ছিল, বিদ্বেষ নয়, স্বীকৃতি। ৭-এক্স ভাবে— এই পৃথিবীতে কি কোথাও এমন জায়গা আছে, যেখানে তারা ‘অন্য’ নয়?

সেই রাতে, জঙ্গলের পাশে এক পাহাড়ি গ্রামের আলো নিভে যায়— EM-স্পার্কে ব্যর্থ হয় বিদ্যুৎ। সেনাবাহিনীর ট্রান্সপোর্ট শাটল পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে, আর তার সঙ্গে কয়েকটি রোবট-ডগ এবং বায়ো-সেন্সর ইউনিট। শেষ যুদ্ধের জন্য সব প্রস্তুত। কিন্তু ঠিক তখনই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে— গ্রামের কয়েকজন মানুষ যারা গোপনে হাইব্রিডদের খাবার দিয়ে সাহায্য করেছিল, তারা পাহাড়ি পথে দাঁড়িয়ে গিয়ে সেনার সামনে প্রতিবাদ জানায়। তারা বলে, “ওরা আমাদের মতোই। ওদের যদি মারেন, আমাদেরও মারুন।” কর্নেল অরুণ শর্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন— তারপর হুকুম দেন, “পথ পরিষ্কার করো।” কিন্তু কিছুটা সংকোচ তাঁর কণ্ঠেও। এদিকে গুহার ভিতরে ৭-এক্স শেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার হাতে ধরা একধরনের পাম-ড্রোন, যা সে বানিয়েছে কেপি-৩-এর সঙ্গে মিলে— কোনো সরাসরি আক্রমণ নয়, বরং শেষবারের মতো পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়ার বার্তা: “আমরা অস্তিত্ব চাই, ক্ষমা নয়।” সেই বার্তা রেকর্ড করা শেষ হয়, এবং ইরা একরকম অলৌকিকভাবে ঘুমের মধ্যে উচ্চারণ করে সেই কথাগুলো— যেন দূর পাহাড়ে থাকা অর্ধেক ভাইয়ের মনের কথা শুনতে পাচ্ছে। অন্বেষা বিস্ময়ে কাঁপে— তার হৃদয় বুঝে নেয়, যুদ্ধ শুধু এক এলাকা নয়, এক অস্তিত্বের সম্মানের লড়াই। আর এই শেষ আশ্রয়, হয়তো নতুন ইতিহাসের ভিত্তিপ্রস্তর।

ভোরের প্রথম আলো যখন পাহাড়ের গায়ে পড়ে, তখন জঙ্গল নিস্তব্ধ। গুহার ভিতরে ৭-এক্স তার সঙ্গীদের দিকে তাকায়। কেপি-৩ তার ডান হাত ধরে আছে— যেটা আর পুরোপুরি কাজ করে না, কিন্তু তার চোখে তীক্ষ্ণ মনোযোগ। জেড-৯ চোখ বন্ধ করে নিচুস্বরে গুনগুন করছে— পুরনো কালের কোনও গান, যার ভাষা কেউ বোঝে না। ৭-এক্স বোঝে, এই মুহূর্তটাই চূড়ান্ত— হয় তারা শেষ হবে, নয়তো ইতিহাসে এক নতুন পৃষ্ঠা রচনা করবে। গুহার মুখে বসানো হয় তাদের বানানো বায়ো-কমিউনিকেশন ডিভাইস— একটি জেনেটিক তরঙ্গ যা স্যাটেলাইট সিগন্যালের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারবে একটি একমাত্র বার্তা: “আমরা মানুষ না, আমরা দানব না। আমরা জিনজাতি। আমরা শান্তি চাই, স্বীকৃতি চাই, জীবন চাই।” এই বার্তা পাঠানো হয় এমন এক মুহূর্তে, যখন সেনাবাহিনীর যুদ্ধরথ পাহাড় বেয়ে উঠে আসছে, আর তাদের ড্রোন মাথার ওপর ঘুরছে— EM স্ক্যানার, স্নাইপার রেঞ্জার, জিন-ব্রেকার গান সব প্রস্তুত। ৭-এক্স জানে, বার্তা পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, এই যুদ্ধ আজই শেষ হবে।

সেনা পৌঁছায় গুহার মুখে, আর শুরু হয় সংঘর্ষ— গুলির আওয়াজ, বিস্ফোরণ, গাছপালা পোড়ে, পাথর ভেঙে পড়ে। কেপি-৩, জেড-৯ এবং বাকি হাইব্রিডরা অসাধারণ কৌশলে প্রতিরোধ করে— কিন্তু তাদের অস্ত্র, প্রযুক্তি, রক্ত— কিছুই মানুষের জিনোম বানানো আগ্রাসনের সামনে টিকতে পারে না। একে একে তারা পড়ে, কেউ রক্তাক্ত হয়ে নিস্তব্ধ, কেউ পাহাড়ের নিচে গড়িয়ে যায়। ৭-এক্স শেষবারের মতো দাঁড়িয়ে থাকে গুহার চূড়ায়, তার গায়ে গুলি লাগা, কিন্তু সে একটুও কাঁপে না। সে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেনাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমরা আমাদের সৃষ্টি করেছ, আমাদের ধ্বংসও করছ। কিন্তু তুমি যাকে সৃষ্টি করো, তাকে শেষ করতে পারো না— কারণ তার স্মৃতি বেঁচে থাকে।” তারপর সে একটি বিস্ফোরণ ঘটায়— কিন্তু আত্মঘাতী নয়। সেই বিস্ফোরণ একটি তথ্য-ড্রোন আকাশে পাঠিয়ে দেয়, যা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর হাজারো সার্ভারে। তার আগে শেষবার সে চেয়ে দেখে সূর্যের দিকে— চোখে ছিল না ঘৃণা, ছিল আক্ষেপ। তারপর সে পড়ে যায়— ধুলোয়, রক্তে, পাথরে।

তিন দিন পর, মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে একসাথে ভাইরাল হয় একটি রহস্যময় ভিডিও। সেটি ৭-এক্সের বক্তব্য— মুখাবয়বে পশুর ছায়া, চোখে এক শিশুর মত সরলতা, কণ্ঠে ইতিহাসের রক্তক্ষরণ। সে বলে, “আমরা সৃষ্টি হয়েছি বিকৃতির মধ্যে, কিন্তু আমরা ভালোবাসতে চেয়েছি। আমরা খুঁজেছি আশ্রয়, স্বীকৃতি, সহানুভূতি। আমাদের গলা টিপে ধরার আগে, একবার আমাদের চোখে তাকাও। তুমি বুঝতে পারো— আমাদের মধ্যে মানুষ ছিল, শুধু রক্ত ছিল না তোমার মতো।” এই ভিডিও দেখে মানুষ স্তব্ধ হয়ে যায়। কিছু শিশু হাইব্রিডের আঁকা ছবি দিয়ে পোস্ট করে “Ira is my friend”, কেউ লিখে “Not monsters, not mistakes— just others.” অন্বেষা রায় জাতিসংঘের একটি ফোরামে বক্তৃতা দেন— “মানবসভ্যতার পরবর্তী অধ্যায় তখনই শুরু হয়, যখন আমরা নিজেদের বাইরে তাকাতে শিখি।” ইরার ছবি ছড়িয়ে পড়ে, সে হয় হাইব্রিড শিশুদের প্রতীক। বিশ্বজুড়ে শুরু হয় বিতর্ক, আইন প্রণয়ন, মানবাধিকার রদবদল। আর একদিন— বহু বছর পরে— একটি নতুন রাষ্ট্রীয় দল গঠন হয়, নাম “জিনজাতি সম্মেলন”, যারা শুধু হাইব্রিড নয়, সব প্রান্তিক সত্তার অধিকারের কথা বলে। ইতিহাসের বইতে একটি অধ্যায় যোগ হয়— “Species Reconciliation Era”। আর কেউ কেউ আজও জঙ্গলে খুঁজে ফেরে সেই বটগাছের নিচে খোদাই করা লাইনটা—
“আমরা জন্মেছি দোষে, মরবো গর্বে।”

___

1000040397.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *