প্রকাশ মাহাতো
১
পুরুলিয়ার ঘন জঙ্গলের ভেতরে সকালের কুয়াশা তখনও পুরোপুরি কাটেনি, সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে এসে ঝিলমিল ছায়া তৈরি করছিল মাটির ওপর। চারপাশে শুধু শাল, সেগুন আর মহুয়ার বন, যেখানে পাখির ডাক মিলেমিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছিল। গ্রামের শ্রমিকরা দল বেঁধে এসেছিল কাঠ কাটতে, হাতে কুড়াল, কাঁধে দড়ির বোঝা, কারও কোমরে বাঁধা পুরনো কাপড়, যাতে পরে কাঠ বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়। এই দলটার মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ ছিল শিবলাল মাহাতো, বয়সে পঁয়তাল্লিশ ছুঁইছুঁই, রোদে পোড়া চেহারা আর চোখে গাঢ় দুশ্চিন্তার ছায়া। সে বহুবার এ জঙ্গলে ঢুকেছে, কিন্তু প্রত্যেকবারই মনে হয়েছে এই জঙ্গলের বুকের ভেতর যেন কোনও লুকোনো গোপন রহস্য ঘাপটি মেরে বসে আছে। আজও সে চুপচাপ দলটার সামনে হাঁটছিল, মাঝে মাঝে থেমে চারপাশে তাকাচ্ছিল। অন্যদিকে জগন্নাথ সর্দার, যাকে সবাই নেতা মানত, গলার স্বর উঁচু করে বলছিল, “এই বনে ভূত-টুত কিছু নেই, শুধু গাছ আর পশু। বেশি কাজ করো, বেশি কাঠ কেটো, তাহলেই বেশি টাকা পাবো।” তার কথায় শ্রমিকদের মনে সাহস জন্মালেও কোথাও যেন এক অদ্ভুত অস্বস্তি ঘিরে ছিল সবাইকে। গৌরী, যে আসলে রান্নার কাজে তাদের সঙ্গে এসেছে, পা টিপে টিপে হাঁটছিল আর চারপাশে তাকাচ্ছিল ভয়ে, কারণ এ জঙ্গলের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তার ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনি।
দুপুর গড়িয়ে আসতে শ্রমিকরা একসাথে কুড়াল চালানো শুরু করল। গাছের গায়ে কুড়ালের আঘাত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে “ঠক ঠক” শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগল চারদিকে, আর সেই শব্দে ভেসে আসতে লাগল বুনো পাখির ডাক। হঠাৎই একসময় চারদিক অদ্ভুতভাবে চুপচাপ হয়ে গেল—যেন জঙ্গল এক মুহূর্তে নিঃশব্দ হয়ে গেছে। সবাই কাজ থামিয়ে অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। তারপরই শোনা গেল সেই অদ্ভুত বাঁশির সুর—মোলায়েম, টানটান, যেন কারও বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। দূরে কোথাও গভীর জঙ্গলের বুক থেকে ভেসে আসছিল সেই সুর, কখনও হালকা, কখনও তীব্র। শ্রমিকদের কেউ কেউ মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, কেউ ফিসফিস করে বলল, “ওটা হাওয়ার খেলা। বাঁশঝাড়ে বাতাস ঢুকলে এরকম হয়।” কিন্তু আরেকজন চুপচাপ বলল, “না, না, এটা কোনও অশরীরী ডাক। আমার ঠাকুমা বলত, এই জঙ্গলে বাঁশিওয়ালা ঘোরে। তার সুরে যারা মুগ্ধ হয়, তারা আর ফেরে না।” কথাটা শোনার পর হঠাৎ করেই শ্রমিকদের গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। ছোট ছেলে ধনঞ্জয়, যে এই প্রথম এসেছে কাজ করতে, সে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে কি সত্যিই ভূত আছে?” জগন্নাথ হেসে উঠল জোরে, “সব ফালতু কথা। চলো, কাজে মন দাও।”
কিন্তু বাঁশির সুর থামল না। বরং মনে হলো, সুরটা যেন ধীরে ধীরে কাছে আসছে, গাছের পাতার ফাঁক গলে এগিয়ে আসছে মানুষের দিকে। শিবলাল একেবারে কুঁকড়ে গেল ভয়ে, তার চোখে স্পষ্ট আতঙ্ক। সে হঠাৎ কুড়ালটা নামিয়ে রেখে বলল, “আমি বলেছিলাম না? যদি বাঁশির ডাক শোনো, সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যেও। এটা অশরীরীর খেলা।” কিন্তু তখনও জগন্নাথের মুখে অবিশ্বাসের ছাপ, সে জোরে চিৎকার করে উঠল, “ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমি কাউকে বাড়ি ফিরতে দেব না। এত কাঠ কেটে আনতে হবে, না হলে কারও হাত খালি যাবে না।” গৌরীর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল, ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার রাতটা যেন হঠাৎ আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল—সেদিনও এইরকম বাঁশির সুর ভেসে এসেছিল। শ্রমিকদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হল, কেউ কেউ কাঁপতে কাঁপতে কাজ থামিয়ে দিল, কেউ আবার দু’পা পিছিয়ে এল। ধনঞ্জয়ের চোখ তখন অদ্ভুত ঝাপসা হয়ে উঠেছে, যেন অদৃশ্য কারও ডাকে সে সাড়া দিচ্ছে। বাঁশির সুর একবার দূরে সরে যায়, আবার কাছে আসে, ঠিক যেমন ঢেউ কখনও তীরে লাগে, কখনও সরে যায়। সেই অদ্ভুত সুরের ভেতর দাঁড়িয়ে সবাই বুঝতে পারল—পুরুলিয়ার জঙ্গলের বুক আসলে নিঃশব্দ নয়, বরং সেখানে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় ডাক, যাকে এড়িয়ে যাওয়া এত সহজ নয়।
২
জঙ্গলের ভেতরে তখন অদ্ভুত এক নীরবতা নেমে এসেছে। শালগাছের উঁচু ডালপালা থেকে আলো এসে পড়ছিল নিচের মাটিতে, কিন্তু সেই আলোয় যেন ঘন কুয়াশার ধোঁয়া গাঢ় হয়ে ছিল। শ্রমিকরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে অস্বস্তি লুকোতে চাইছিল, কিন্তু বাঁশির সুরের অদ্ভুত টান সবার বুকের ভেতরে কাঁপন ধরাচ্ছিল। শিবলাল সেই ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ গলায় বলল, “তোরা শোন, আমি এতবার বলেছি—এই জঙ্গলের ডাক সহজ কিছু নয়। আমার বাপ-ঠাকুরদারাও বলেছে, এই ডাক শুনে কেউ যদি জঙ্গলের গভীরে যায়, সে আর বাড়ি ফেরে না।” তার গলায় আতঙ্কের সাথে অভিজ্ঞতার ভারি ছাপ ছিল। গৌরী থমকে দাঁড়িয়ে শুনছিল, তার মুখে ভয় আর প্রশ্নের ছায়া। ছোট্ট ধনঞ্জয় পায়ের কাঁপুনি সামলাতে পারছিল না, সে ফিসফিস করে বলল, “কাকা, তাহলে এখন কী করব?” শিবলাল তাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল, “সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি। তোদের জান বাঁচানোই এখন কাজ।” কিন্তু সেই মুহূর্তেই জগন্নাথ সর্দার জোরে হেসে উঠল, তার চোখে বিদ্রূপের ঝিলিক, “এসব পুরোনো দিনের ভুতুড়ে গল্প শুনে কি মানুষ কাজ ছেড়ে দেবে? কাঠ কেটে নিয়ে গেলে বাজারে কত দাম পাওয়া যাবে জানো? ভয় পেয়ে তোদের ঘরে ভাত আসবে না। হাওয়া বইছে, তাই বাঁশঝাড়ে শব্দ হচ্ছে। কাকুতি-মিনতি করে ভয় দেখিয়ে লাভ নেই, শিবলাল।” এই কথা বলার পরই কয়েকজন শ্রমিক গলা চুলকোল, কেউ মাটির দিকে তাকাল, যেন তারা জগন্নাথের যুক্তির কাছে অসহায়। কিন্তু শিবলালের চোখ তখনও লাল হয়ে উঠেছে রাগ আর ভয়ের মিশ্রণে।
জঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকা দলটার মধ্যে মতভেদ তৈরি হয়ে গেল। কেউ বলছিল, “শিবলাল ঠিকই তো বলছে, এত মানুষ হারিয়ে গেছে বছরের পর বছর ধরে, তার কোনও খোঁজ মেলেনি।” আবার অন্যরা বলছিল, “জগন্নাথ নেতা, তার কথা না শুনে পারা যায়?” এমন সময় আবার সেই বাঁশির সুর ভেসে এল—মোলায়েম, মায়াময়, অথচ শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দেওয়া। সবার শরীরে শিরশিরে ঠান্ডা নেমে এল। ধনঞ্জয় হঠাৎ ফ্যালফ্যাল করে শূন্যে তাকাতে লাগল, তার চোখ যেন কুয়াশার ভেতরে কোথাও আবদ্ধ। শিবলাল এগিয়ে গিয়ে তার গলা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “চোখ নামা! সুর শুনে তাকাস না! যদি তাকাস, তুইও চলে যাবি।” ধনঞ্জয় কেঁপে উঠল, কিন্তু যেন অদৃশ্য শক্তি তার শরীর টানছিল। গৌরী তার হাত ধরে কাঁপা গলায় বলল, “শিবলাল কাকা, আমার ভাইও একদিন এভাবেই গিয়েছিল। প্রথমে ওর মুখে বলার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছিল, তারপর বাঁশির টানে কোথায় হারাল, আর ফিরল না।” কথাগুলো শুনে মুহূর্তেই শ্রমিকদের বুক কেঁপে উঠল। কিন্তু জগন্নাথ আবারও হাত নেড়ে বলল, “সব কুসংস্কার। ভয় দেখাতে চাইছ। যত ভয় দেখাও, আমি কাউকে বেরোতে দেব না। কাজ শেষ না করে কেউ যাবে না।”
এই টানাপোড়েনের মধ্যে বন হঠাৎ যেন আরও অন্ধকার হয়ে উঠল। বাতাসের গতি থেমে গেল, পাতারা নড়ল না, কিন্তু বাঁশির সুর যেন আরও কাছে চলে এল। একেকজন শ্রমিক ঘেমে উঠল, কারও কাঁপুনি শুরু হল। শিবলাল তখন দাঁড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তোরা বুঝিস না! এটা সুর নয়, এটা ফাঁদ। এ ডাক শোনার মানে হল তোর আত্মাকে কে যেন ডেকে নিচ্ছে।” তার কথায় এক মুহূর্তের জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এল। দূরে কোথাও শিয়ালের হুক্কাহুয়া আর বাঁশির মিশ্রণে ভয়াল আবহ তৈরি হল। গৌরী শিবলালের দিকে তাকিয়ে আস্তে বলল, “আমাদের কি ফিরতে হবে এখনই?” শিবলাল মাথা নেড়ে সায় দিল, কিন্তু তার আগেই জগন্নাথ গর্জে উঠল, “যে যাবে সে কাপুরুষ। এখানে আসার আগে আমি বলেছিলাম, আমরা কাঠ কেটে ফিরব, নয়তো ফিরবই না। তোমরা ভয় পেলে আমি একাই কাঠ কাটব।” তার কণ্ঠে এমন এক দম্ভ ভেসে উঠল যে কয়েকজন শ্রমিক লজ্জায় চুপ করে গেল। কিন্তু তাদের মনের ভেতরে ভয় থামল না, বরং সুরের টানে কারও কারও মনে অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করতে লাগল। শিবলাল দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “জগন্নাথ, তুই লোভের জন্য তোদের মরতে দিচ্ছিস। মনে রাখিস, জঙ্গলের ডাক একবার যদি ধরে, ফেরার পথ আর থাকে না।” কথাটা আকাশে ঝুলে রইল, আর তার পরেই বাঁশির সুর থেমে গিয়ে আবার হঠাৎ জোরে বাজল, যেন কোনও অদৃশ্য সত্তা কাছে চলে এসেছে। শ্রমিকদের বুক ধকধক করতে লাগল, আর জঙ্গলের বুক যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে সেই মুহূর্তটিকে আরও ভয়ানক করে তুলল।
৩
গৌরীর বুকের ভেতর যেন এক অদ্ভুত ঢেউ উঠতে লাগল—ভয় আর কৌতূহলের মিশ্র এক অস্বস্তিকর অনুভূতি। বাঁশির সুর যেভাবে চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল, মনে হচ্ছিল সেটি যেন তাকে ডাকছে, যেন ঠিক তার কানে কানে কেউ ফিসফিস করছে, “এসো, এসো…”। তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠছিল ভাইয়ের মুখ। ছোটবেলায় কতবার একসঙ্গে এই জঙ্গলের পাশে খেলেছে তারা। আর সেই শেষ রাত—যখন ভাই বেরিয়েছিল কাঠ কাটতে, আর ফেরেনি। চারপাশের সবাই বলেছিল, “ও বাঁশির ডাকে গেছে, আর ফিরবে না।” তখন গৌরী বিশ্বাস করতে পারেনি, ভেবেছিল হয়তো বাঘ-ভালুক বা ডাকাতের হাতে পড়েছে। কিন্তু আজ, এই বাঁশির সুর শুনে তার মনে হচ্ছিল, ভাই সত্যিই সেই অদৃশ্য সত্তার টানে অচেনা পথে হারিয়ে গিয়েছিল। জগন্নাথ যতই বলুক এটা হাওয়ার খেলা, গৌরীর অন্তর তাকে বলছিল—না, এখানে কিছু আছে, কিছু অলৌকিক, কিছু ভয়ঙ্কর। সবার ভিড় থেকে সে একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কুয়াশার দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছিল, কোনও অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিচ্ছে সেই গভীর অন্ধকার বনের দিকে।
তার শরীর শিউরে উঠছিল, কিন্তু চোখে ভাসছিল ভাইয়ের শেষ হাসি। গৌরীর মনে হল, যদি সে এই রহস্যের উৎস খুঁজে পায়, হয়তো হারানো ভাইকে ফিরে পাওয়া যাবে, অথবা অন্তত জানা যাবে কী হয়েছিল সেদিন। তার বুক কেঁপে উঠছিল আতঙ্কে, তবু কৌতূহল যেন ভয়কে গ্রাস করছিল ধীরে ধীরে। পিছন থেকে শিবলাল তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোকে ভয় পেতে হবে না, কিন্তু মনে রাখিস, এই ডাক মানুষকে গ্রাস করে।” গৌরী চমকে তাকাল তার দিকে, তারপর আস্তে বলল, “কাকা, যদি আমার ভাইও ওই ডাকে গিয়েছিল, তবে কি সত্যিই তার আর ফেরা নেই?” শিবলাল চোখ নামিয়ে নীরব হয়ে রইল। সেই নীরবতাই যেন উত্তর হয়ে গৌরীর হৃদয়ে গভীর দাগ কাটল। দূরে কোথাও শেয়ালের ডাক ভেসে এলো, তার সাথে মিশে আবারও বাঁশির সুর। সবার মুখে ভয় ছাপিয়ে উঠলেও গৌরীর মনে হলো—সুরটা যেন তাকে চেনে, যেন বিশেষভাবে তাকেই ডেকে আনছে।
এই দ্বন্দ্বে গৌরীর মন একেবারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। একদিকে আতঙ্ক—যদি সত্যিই এ ডাকে গেলে আর ফেরার পথ না থাকে, তবে তার জীবনও নিঃশেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে প্রবল আকর্ষণ—যদি রহস্য উন্মোচন করা যায়, তবে হয়তো বহু বছরের অভিশাপ ভাঙবে। তার ভেতরে চলতে থাকা এই টানাপোড়েন যেন মুখে কিছুই প্রকাশ পাচ্ছিল না, তবে চোখে ঝলসে উঠছিল দৃঢ়তা। শ্রমিকরা আবার কাজ শুরু করার চেষ্টা করছিল, জগন্নাথ জোরে জোরে সবাইকে তাড়াচ্ছিল, কিন্তু গৌরীর কান তখন বাঁশির সুরের পেছনে। প্রতিবার সুরটা শোনার সময় মনে হচ্ছিল, ভাইয়ের ডাক শুনছে সে—“দিদি, আমি আছি, আমাকে খুঁজে নাও।” হঠাৎ কুয়াশার ভেতরে এক ঝলক ছায়া চোখে পড়তেই গৌরীর বুক কেঁপে উঠল। সে জানত না সেটা বাস্তব, নাকি তার কল্পনা, কিন্তু মনে হল যেন ভাই দূর থেকে হাত নেড়ে ডাকছে। আতঙ্কে শরীর কেঁপে গেলেও সে চোখ সরাল না। মনে হচ্ছিল, যতক্ষণ না সে সত্যিটা জানবে, ততক্ষণ শান্তি নেই। আর এই ভয়ংকর জঙ্গলের বুকেই লুকিয়ে আছে সেই সত্য—বাঁশির ডাক, হারিয়ে যাওয়া মানুষ আর এক অভিশপ্ত রহস্যের অদৃশ্য ছায়া।
৪
ধনঞ্জয় গ্রামের নতুন শ্রমিক। সে খুব বেশি কথা বলত না, তবে কাজে হাত লাগাতে তার জুড়ি ছিল না। গৌরীর বাবার কারখানায় দিনমজুর হিসেবে কয়েক সপ্তাহ হলো যোগ দিয়েছে। প্রথমদিকে সবাই ভেবেছিল সে সাধারণ মানুষ, অল্পস্বল্প রাগী স্বভাবের হলেও পরিশ্রমী। কিন্তু গ্রামের ভেতর আসার পর থেকেই তার চোখে সবসময় একটা অদ্ভুত শূন্যতা ধরা পড়ত, যেন অতীত থেকে পালিয়ে এসেছে। গৌরীর মনে পড়ত, একদিন আড়ালে বসে সে দেখেছিল ধনঞ্জয় গাছতলায় বসে হাওয়ায় তাকিয়ে ফিসফিস করে বলছে, “শুনতে পাচ্ছিস না? ওই বাঁশির সুরটা?” অথচ আশেপাশে কেউ কিছু শুনতে পায়নি। তার অস্থির চাহনি, হঠাৎ অকারণে কেঁপে ওঠা শরীর আর কখনো ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে গৌরীর বুকের ভেতর শঙ্কা জেগেছিল। ধনঞ্জয় যেন অদৃশ্য কোনো শক্তির ডাক শুনত, সেই ডাকের কাছে সে নিজেকে আটকে রাখতে পারত না।
এক রাতে, যখন পুরো গ্রাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন হঠাৎ করেই দূর থেকে ভেসে এলো এক অচেনা বাঁশির সুর। সুরটা এত গভীর আর অদ্ভুত ছিল যে মনে হচ্ছিল অন্ধকার রাতের বুক চিরে কোনো অজানা যন্ত্রণার কণ্ঠস্বর উঠে আসছে। ধনঞ্জয়, যে তখন খুপরি ঘরে একা শুয়ে ছিল, আচমকা উঠে বসে চোখ মেলে। তার চোখ যেন লালচে অন্ধকারে ভরে উঠল, শরীরটা কেঁপে উঠল অজানা স্পন্দনে। পাশের শ্রমিকরা বলেছিল পরে, তারা শুনেছিল ধনঞ্জয় অদ্ভুত গলায় গুনগুন করতে করতে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কেউ থামাতে গেলে সে ভয়ঙ্কর চোখে তাকিয়ে বলে, “আমাকে যেতে হবে… ওরা ডাকছে।” তার কণ্ঠে এমন এক শীতলতা ছিল যে সাহস করে কেউ কাছে আসতে পারেনি। ধীরে ধীরে ধনঞ্জয় অন্ধকার রাতের জঙ্গলের দিকে এগিয়ে গেল, যেন বাঁশির সুরের দিকেই তার টান। মশাল জ্বালানো লোকেরা কিছুদূর পেছনে গিয়েছিল, কিন্তু হঠাৎ এক মুহূর্তেই ধনঞ্জয়ের শরীর ঘন অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। কেউ দেখল না সে পড়ে গেল নাকি অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু সুরটা বাজছিল আরও তীব্র, তারপর হঠাৎ করেই থেমে গেল।
পরের দিন সকালে গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। শ্রমিকরা ভয়ে ফিসফিস করে বলল, “বাঁশির অভিশাপ আবার শুরু হয়েছে।” গৌরীর বুক কেঁপে উঠল—সে বুঝল এটাই প্রথম অন্তর্ধান। তার মনে হলো, ধনঞ্জয়ের চোখে যে শূন্যতা ছিল, তা হয়তো বাঁশির টানে হারিয়ে যাওয়ারই পূর্বাভাস। গৌরীর ভাইয়ের স্মৃতিভ্রংশ আর এই রহস্যময় বাঁশি—দুটো ঘটনা যেন একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে। গ্রামজুড়ে ভয় ছড়িয়ে পড়লেও, গৌরীর কৌতূহল আরও তীব্র হলো। সে জানল, ধনঞ্জয়ের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া কেবল এক শুরু, এই অভিশপ্ত বাঁশির সুরের মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও ভয়ানক রহস্য। রাতের পর রাত সেই সুর আবার বাজবে কি না, আর কতজনকে টেনে নিয়ে যাবে জঙ্গলের গভীরে—এই প্রশ্নই তাকে ভেতরে ভেতরে কাঁপিয়ে তুলল, তবে তার মনের গভীরে গড়ে উঠল এক অদম্য সংকল্প—এই রহস্য সে ভেদ করবেই।
৫
গ্রামের মাটির উঠোনে, এক চাঁদহীন রাতে, কুয়াশার চাদরে ঢেকে থাকা গাঢ় নীরবতার মাঝখানে জ্বলে উঠেছিল একটা আগুনের গোলক। চারপাশে বসেছিল কয়েকজন বয়স্ক মানুষ—চোখের কোণে কুঁচকানো রেখা, মুখে সময়ের চিহ্ন, আর গলায় ভরাট অথচ ক্লান্ত স্বর। গ্রামের তরুণরা, যারা দিনভর ধান কেটেছে বা জঙ্গল থেকে কাঠ বয়ে এনেছে, তারা চুপচাপ বসেছিল, কেবল আগুনের উষ্ণতায় হাত মেলে। সেই নীরব ভিড়ের মধ্যে হঠাৎই এক বৃদ্ধ কাশি চেপে বলল—“তোরা জানিস, এই বাঁশির সুরের রহস্য কোথা থেকে শুরু?” সবার চোখ যেন আগুনের আঁচ ছাড়িয়ে তার দিকে ঝুঁকে পড়ল। বৃদ্ধের কণ্ঠে ভারী ছন্দ, যেন সময়ের গর্ভ থেকে গল্প উঠে আসছে। তিনি বলতে লাগলেন—“অনেক বছর আগে, এই জঙ্গলের ভেতর থাকত এক শিকারি। লোকটা ছিল দুর্ধর্ষ, পাষাণ, আর লোভে অন্ধ। সে মানুষকে নয়, আত্মাকে শিকার করত।” কথা শুনে উপস্থিত সবাই কেঁপে উঠল, যদিও কেউই মুখ খোলেনি। আগুনের লেলিহান শিখা যেন আরও উঁচু হয়ে উঠল, গল্পের অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরে।
বৃদ্ধ শিকারির কাহিনি এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তিনি বললেন, শিকারির হাতে ছিল এক অভিশপ্ত বাঁশি, যা তাকে উপহার দিয়েছিল এক অচেনা সন্ন্যাসী। বলা হয়, সেই সন্ন্যাসী মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে তাকে বলেছিল—“এই বাঁশির সুরে প্রাণ ডাকা যায়, আবার প্রাণ কেড়েও নেওয়া যায়। কিন্তু সাবধান, প্রতিটি সুরের বিনিময়ে তোমার আত্মা ধীরে ধীরে কালো হয়ে যাবে।” শিকারি সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে বাঁশি বাজাতে শুরু করে। জঙ্গলের হরিণ, শালুক, বুনো শূকর—সব প্রাণী সেই সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াত, আর সে বিনা দ্বিধায় তাদের হত্যা করত। একদিন তার লোভ এতটাই বেড়ে গেল যে সে মানুষকেও ফাঁদে ফেলতে শুরু করে। বাঁশির সুর শুনে বহু যুবক-যুবতী জঙ্গলের গভীরে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। শিকারি তাদের প্রাণ কেড়ে বাঁশির ভেতর বন্দি করত, আর প্রতিটি রাত শেষে বাঁশি আরও ভয়ঙ্কর সুর তুলত। গ্রামজুড়ে ভয়ের বাতাস ছড়িয়ে পড়ে, লোকেরা রাতে বেরোতে সাহস পেত না। অবশেষে, এক ঝড়ো রাতে, শিকারি নিজেই বাঁশির সুরে হারিয়ে যায়, তার দেহ আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। শুধু শোনা যেত—জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে সেই অভিশপ্ত বাঁশির কান্না, যেন বন্দি আত্মারা মুক্তির জন্য হাহাকার করছে।
বৃদ্ধের গলা থেমে গেলে, চারপাশে মৃত্যু-নিরবতা নেমে এল। আগুনের শিখা কেবল টুকরো টুকরো হয়ে ছাইয়ের উপর নাচছিল। তরুণদের কারও গলায় কাঁটা বেঁধে গেল, কেউবা চুপচাপ কাঁধে হাত রাখল পাশের জনের। তারা জানত না গল্পটা কেবল পুরনো কাহিনি, নাকি বাস্তবের পুনরাবৃত্তি। কারণ মাত্র কয়েক রাত আগেই ধনঞ্জয়, নতুন শ্রমিকটি, হঠাৎ বাঁশির সুর শুনে অদ্ভুত আচরণ করে জঙ্গলে হারিয়ে গেছে। বৃদ্ধরা চোখ নামিয়ে বলল—“ওটা কেবল গল্প নয়, ওটা অভিশাপ। যতদিন এই জঙ্গলে বাঁশির প্রতিধ্বনি বাজবে, ততদিন মানুষ অদৃশ্য হয়ে যাবে।” সেই মুহূর্তে সবাই অনুভব করল, জঙ্গল যেন তাদের দিকে চেয়ে আছে অদৃশ্য চোখে, আর আগুনের আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে আসছে। বাঁশির কাহিনি তাদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত আতঙ্ক গেঁথে দিল, যেন রাতের অন্ধকার নিজেই শিকারির মতো ফাঁদ পেতে বসে আছে, অপেক্ষা করছে নতুন আত্মাদের বন্দি করার জন্য।
৬
শ্রমিকদের রাতের শ্রম যেন এক অনন্ত ক্লান্তির নদী হয়ে উঠেছিল। দিনের বেলা পাহাড়ের গায়ে কেটে নেওয়া পাথরের কাজ, কাঠ টানা, আর গ্রামের গলিপথে ছোটাছুটি—সব মিলিয়ে রাত নামতেই তাদের শরীর ভেঙে যেত। অথচ সেই রাতে তাদের চোখে ঘুম আসছিল না। কারণটা সহজ—বনের ভেতর যেন অচেনা এক স্রোত বইছিল, অচেনা এক সুর গুঞ্জরিত হচ্ছিল। প্রথমে তারা ভেবেছিল, হয়তো কোনো বাদ্যকার গ্রাম মেলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। কিন্তু যখন অন্ধকারের গভীরে সেই সুর ক্রমশ ঘন হয়ে উঠল, আর কুয়াশার চাদর তাদের চারপাশে নেমে এলো, তখন তারা নিশ্চিত হয়ে গেল—এই সুর মানুষের নয়, এ যেন আত্মার কোনো ডাকে ভেসে আসা সঙ্গীত। এক শ্রমিক কাঁপা গলায় বলল, “ভাইরা, কারও কি মনে হচ্ছে, আমরা একা নই? আমাদের পেছনে যেন কেউ হাঁটছে।” বাকিরা চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারা সকলেই অনুভব করছিল, হ্যাঁ, পিছনে কিছু আছে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে বাতাস বইছিল, কিন্তু পায়ের শব্দ যেন মানুষের মতো। অন্ধকারে শিউরে উঠল তাদের হৃদয়।
কুয়াশার বুক ফুঁড়ে হঠাৎ দেখা গেল—এক ছায়া। প্রথমে অস্পষ্ট, যেন কুয়াশার তৈরি অবয়ব, পরে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। তার লম্বা দেহ, কুঁজো হয়ে হাঁটা, আর হাতে কিছু একটা—হয়তো বাঁশি, হয়তো অন্য কোনো অচেনা অস্ত্র। শ্রমিকদের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল, তারা বুঝল এই ছায়া কোনো সাধারণ মানুষের নয়। তার পদক্ষেপে মাটি নড়ে না, তবু সেই পদক্ষেপের শব্দ শোনা যায়, যেন মৃতের কণ্ঠস্বর দিয়ে মাটিকে দাগ কেটে যাচ্ছে। একজন শ্রমিক দৌড়ে পালাতে চাইল, কিন্তু তার পা যেন কুয়াশার জালে আটকে গেল, আরেকজন তাকে টেনে ধরল—“না, দৌড়াবি না, এরা দৌড়ের শব্দেই পিছু নেয়।” এ কথা শোনামাত্রই চারপাশে যেন আরও গভীর অন্ধকার নেমে এলো। ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কোনো চোখ নেই, কোনো মুখ নেই, শুধু ফাঁকা এক অবয়ব। অথচ তারা স্পষ্ট অনুভব করল, সেই মুখহীন ছায়া তাদের প্রত্যেককে এক এক করে লক্ষ্য করছে। আর তখনই আবার বাজল সেই বাঁশির সুর, অদ্ভুতভাবে মায়াময়, অথচ ভীষণ ভয়ের। মনে হলো, কে যেন তাদের আত্মাকে কুয়াশার ভেতর থেকে ডেকে আনছে।
এক এক করে শ্রমিকদের বুকের ভেতর আতঙ্ক জমে উঠল। কারও ঠোঁট শুকিয়ে গেল, কারও হাত কাঁপতে লাগল, আবার কেউ ফিসফিস করে নামজপ করতে শুরু করল। বাঁশির সুরের সঙ্গে সঙ্গে তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল ভীতিকর দৃশ্য—কোনো এক বৃদ্ধ শিকারির ছায়া, যার গলায় অদ্ভুত তাবিজ ঝুলছে, আবার কখনও দেখা গেল শিকারে ধরা হরিণের রক্ত ঝরে পড়ছে তার হাতে। এইসব বিভ্রমে তারা প্রায় জ্ঞান হারাতে বসেছিল। হঠাৎ ছায়ামূর্তিটি তাদের থেকে কয়েক হাত দূরে থেমে দাঁড়াল, বাঁশি ঠোঁটে তুলে শেষবারের মতো বাজাল এক দীর্ঘ সুর—এমন এক সুর, যেটা যেন জীবিত মানুষকে ডেকে মৃত্যুতে নিয়ে যায়। কিন্তু ঠিক তখনই গ্রামের এক প্রবীণ বৃদ্ধ, যিনি দূর থেকে সব দেখছিলেন, এসে উচ্চস্বরে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। মুহূর্তে কুয়াশার গায়ে তরঙ্গ খেলে গেল, ছায়ামূর্তিটি যেন ক্রোধে কেঁপে উঠল, আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল কুয়াশার ভেতরে। শ্রমিকরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল, কিন্তু জানল—এই অভিশপ্ত ছায়ার সঙ্গে তাদের লড়াই এখানেই শেষ হয়নি। বাঁশির সুর আবার ফিরবেই, আবার ডাকবে তাদের আত্মাকে। তাদের বুকের গভীরে চিরস্থায়ী এক আতঙ্ক চেপে বসল।
৭
জগন্নাথের চোখে তখন শুধু কাঠের হিসাব, টাকার লোভ আর নিজের দম্ভ। শ্রমিকরা আতঙ্কিত মুখে বারবার বলছিল, “দাদা, এখানে কিছু অস্বাভাবিক হচ্ছে। কুয়াশার ভেতর থেকে বাঁশির আওয়াজ আসছে, মানুষও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।” কিন্তু জগন্নাথ ধমক দিয়ে বলল, “ভূত-টুত বলে কিছু নেই, এসব তোমাদের ভয়ে পাওয়া বিভ্রম। যত বেশি কাঠ কেটে বাড়ি নেব, তত বেশি লাভ হবে।” তার কথায় কেউ কেউ বাধ্য হয়ে কুড়াল চালালেও, বেশিরভাগ শ্রমিকের হাত কাঁপছিল। বনের গাঢ় নীরবতা আর বাঁশির সুর যেন তাদের বুকের ভেতর ঢুকে যাচ্ছিল। তবু জগন্নাথের কড়া গলায় ভর করে তারা আবার কাঠ কাটতে শুরু করল। কিন্তু যতবার তারা গাছ কাটছিল, ততবার কুয়াশা আরও ঘন হয়ে উঠছিল। অচেনা ছায়াগুলো দূর থেকে নজর রাখছিল যেন।
একসময় হঠাৎ এক শ্রমিক চিৎকার করে উঠল। বাকিরা ছুটে গিয়ে দেখল, লোকটা নেই—শুধু কুড়ালটা মাটিতে পড়ে আছে, যেন কোনও অদৃশ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে গেছে। সবাই ভয় পেয়ে কাজ ফেলে পালাতে চাইলো। কিন্তু জগন্নাথ চেঁচিয়ে উঠল, “কেউ কোথাও যাবে না! যে পালাবে, তাকে মজুরি দেওয়া হবে না। বুঝলে? এখানে ভূত নেই, এ সব ভাঁওতা। কাজ করো, আর চুপচাপ থাকো।” তার চোখে লোভের আগুন এতটাই প্রবল ছিল যে মানুষের নিখোঁজ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার কাছে তুচ্ছ লাগছিল। যারা বাকি ছিল তারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবার গাছ কাটতে শুরু করল। বাঁশির সুর তখন আরও তীব্র হয়ে উঠল, যেন প্রতিটি আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় বনের ভেতর থেকে এক অদৃশ্য সত্তা জেগে উঠছিল। একে একে আরও দু’জন শ্রমিক নিখোঁজ হয়ে গেল, আর বাকি সবাই শিউরে উঠে নিজেদের কপালে হাত ঠেকালো।
কিন্তু জগন্নাথের জেদ অটল। সে গর্জে উঠল, “যত কাঠ সম্ভব কেটে নাও! ভয় পেলে পেট ভরবে না, টাকা আসবে না। এই গাছগুলো আমাদের জীবনের রসদ।” তার কণ্ঠে ছিল অমানবিক লোভ, যা ধীরে ধীরে তাকে অন্ধ করে দিচ্ছিল। শ্রমিকরা আর সাহস পাচ্ছিল না কিছু বলার; কেউ কেউ কাঁদছিল, কেউ গুনগুন করে ঈশ্বরের নাম নিচ্ছিল, আর কেউ অকারণে চারপাশে তাকাচ্ছিল। কুয়াশার ভেতর থেকে তখন অস্পষ্ট এক ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল—দীর্ঘদেহী, চোখদুটি লাল, আর হাতে যেন কোনও অদৃশ্য বাঁশি। শ্রমিকরা হাহাকার করে উঠল, কিন্তু জগন্নাথের কানে যেন কিছুই গেল না। তার দৃষ্টি কেবল গাছের দিকে, তার কানে কেবল কয়েনের টুংটাং শব্দ। কিন্তু সেই লোভই তাদের সর্বনাশের পথ খুলে দিল। কুয়াশা হঠাৎ দমকা হাওয়ার মতো ছড়িয়ে পড়ল, আর একে একে শ্রমিকদের অস্তিত্ব যেন অদৃশ্য অন্ধকারে গিলে ফেলতে শুরু করল, জগন্নাথের বেপরোয়া জেদ তাদের রক্ষা করতে পারল না—বরং আরও গভীর বিপদের দিকে ঠেলে দিল।
৮
গৌরীর বুকের ভেতরটা তখন জ্বলছিল দপদপে আগুনের মতো। দিনের পর দিন শ্রমিকেরা হারিয়ে যাচ্ছে, গ্রামের লোকেরা ভয়ে কাঁপছে, আর তার ভাইও সেই অদ্ভুত বাঁশিওয়ালার সুরের টানে জঙ্গলের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। পাড়ার বয়স্করা সবাই বলছিল, “ওই পথ আর ধরিস না, ওখানে মৃত্যু ছাড়া কিছু নেই।” কিন্তু গৌরী বুঝতে পারছিল, এভাবে থেমে গেলে তার ভাই হয়তো আর কখনও ফিরবে না। রাতের পর রাত সে শুনতে পেত সেই বাঁশির সুর—কখনও কাছ থেকে, কখনও দূর থেকে—যেন তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে অজানা এক গহ্বরে। একসময় তার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল। নিজের জীবনের ভয়কে দূরে সরিয়ে রেখে সে স্থির করল, সে নিজেই সেই রহস্য উদঘাটন করবে। গৌরীর মনের ভেতর একটা অদ্ভুত শক্তি কাজ করছিল, একদিকে ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, অন্যদিকে অজানাকে জানার দুঃসাহস—এই দুই শক্তির মেলবন্ধন তাকে এক অদম্য শক্তি এনে দিল। সে জানল, এই যুদ্ধ কেবল বাঁশিওয়ালার সঙ্গে নয়, গ্রামের মানুষের ভেতরের ভয়ের সঙ্গেও।
যখন গৌরী তার ইচ্ছে গ্রামের লোকদের সামনে প্রকাশ করল, সবাই তেড়ে এল তাকে থামাতে। কেউ বলল, “তুই মরবি গৌরী, ওইখানে যাওয়া মানেই মৃত্যু।” কেউ আবার ভয়ার্ত চোখে কেঁদে ফেলল, যেন সে এখনই অদৃশ্য হয়ে যাবে। কিন্তু গৌরীর চোখের দৃষ্টিতে এমন দৃঢ়তা ছিল, যা তাদের কথার প্রাচীর ভেদ করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন শিবলাল এগিয়ে এল। শিবলাল ছিল গ্রামেরই এক যুবক, যে ছোট থেকেই গৌরীর পাশে থেকেছে। সে গম্ভীর গলায় বলল, “গৌরী একা যাবে না। আমি তার সঙ্গে যাব।” লোকেরা চমকে তাকাল। শিবলালকে সবাই চিনত সাহসী ছেলে হিসেবে, কিন্তু তার চোখে তখন যে আগুন ছিল, তা অন্যরকম। গৌরী তার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসল, যেন মনে মনে জানত সে একাই নয়। দু’জনের মধ্যে অদ্ভুত এক বোঝাপড়া ছিল, তারা দুজনেই বুঝল—এ লড়াইটা তাদের দুজনের। সেই মুহূর্তে গ্রামের শোরগোল যেন দূরে সরে গেল, শুধু শোনা গেল বাঁশির সুর, যা আবারও গভীর জঙ্গল থেকে ভেসে আসছিল, ভৌতিক আর টানটান এক আহ্বান নিয়ে।
পরের দিন সূর্য উঠতেই গৌরী আর শিবলাল রওনা দিল জঙ্গলের দিকে। তাদের হাতে ছিল শুধু কিছু শুকনো খাবার আর একটি পুরোনো কেরোসিন লণ্ঠন। পথ যত গভীরে গেল, গাছপালার অন্ধকার তত ঘনীভূত হতে লাগল। গৌরীর কানে বারবার বাজতে লাগল সেই বাঁশির সুর, যেন অদৃশ্য হাত ধরে তাদের আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। শিবলাল বারবার তাকে সাবধান করছিল, “পেছনে তাকাস না, গৌরী। যতই ডাক শুনিস, যতই টান অনুভব করিস—সামনে হাঁটবি।” গৌরী ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল। হঠাৎ তাদের সামনে দেখা গেল ভাঙাচোরা একটা মন্দির, গাছের শেকড়ে আংশিক ডুবে আছে। মনে হচ্ছিল, শতাব্দীর পর শতাব্দী কেউ এ জায়গায় পা রাখেনি। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, মন্দিরের ভেতর থেকে তখনও শোনা যাচ্ছিল সেই বাঁশির সুর—কখনও মায়াবী, কখনও ভৌতিক। গৌরীর বুকের ভেতর ধকধক করছিল, কিন্তু তার পা থামল না। শিবলাল তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে গৌরীর মনে হল—হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে সব রহস্য, এখানেই লুকিয়ে আছে তার ভাইয়ের হারিয়ে যাওয়ার উত্তর। আর এই যাত্রায় তার আর ফেরার পথ নেই।
৯
কুয়াশায় মোড়া জঙ্গল যেন কোনো অজানা স্বপ্নের ভেতর গৌরীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তার চারপাশে গাছের ডালপালা কেবল ফিসফিস করে উঠছিল, বাতাসে অদ্ভুত ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল, আর সেই ভয়ানক অথচ মধুর বাঁশির সুর ক্রমে আরও কাছে আসছিল। গৌরীর চোখ যেন স্থির হয়ে গেল, তার হাঁটা যেন নিজের ইচ্ছায় নয়, সেই সুরের টানে। ধীরে ধীরে কুয়াশার ভেতরে, অন্ধকারের পর্দার আড়াল থেকে এক ছায়ামূর্তি ফুটে উঠতে লাগল। গৌরীর বুক ধকধক করছিল, কিন্তু তার পা থামল না। যখন অবশেষে বাঁশিওয়ালা স্পষ্ট হলো, গৌরীর মনে হল সে স্বপ্নের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে। সে ছিল অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ছায়া, যেন কেবল দেহের একাংশ আলোতে স্পষ্ট, বাকিটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে। তার চোখ ছিল গভীর কুয়াশার মতো ফ্যাকাসে, আর ঠোঁটে বাঁশি, যেখান থেকে বেরোচ্ছিল এক সুর, যা ভয়ে এবং মোহে মিশ্রিত। গৌরীর ভেতরটা কেঁপে উঠল, তার সমস্ত ভয় যেন মুহূর্তে মিলিয়ে গেল, শুধু সেই সুর তাকে বেঁধে রাখল। গৌরী দাঁড়িয়ে রইল, যেন সময় থেমে গেছে, আর তার মস্তিষ্ক কেবল বাঁশির সুরে আবদ্ধ।
এদিকে শিবলাল, যে গৌরীর পিছু পিছু এসেছিল, কুয়াশার ভেতর এই দৃশ্য দেখে শিউরে উঠল। তার বুক কেঁপে উঠল আতঙ্কে, কিন্তু সে জানত, যদি কিছু না করে তবে গৌরী চিরকালের জন্য এই রহস্যময় বাঁশিওয়ালার টানে হারিয়ে যাবে। শিবলাল চিৎকার করে ডাকল—“গৌরী! ওখানে দাঁড়াস না, ফিরিয়ে আ!”—কিন্তু তার কণ্ঠস্বর যেন কুয়াশায় মিলিয়ে গেল, গৌরীর কানে পৌঁছল না। বাঁশিওয়ালা তখনও সুর তুলছিল, তার দেহ কখনো মানুষ, কখনো ছায়া হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল। শিবলাল মরিয়া হয়ে এগিয়ে গেল, আর সেই অদ্ভুত সত্তার চোখের দিকে তাকাতেই তার ভেতরে হিমশীতল স্রোত বইল। মনে হল যেন শত শত মৃত মানুষের ফিসফিসানি তাকে ঘিরে ধরেছে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, তবু শিবলাল হাত বাড়িয়ে গৌরীর হাত চেপে ধরল। গৌরী তখনও সুরে বিভোর, তার ঠোঁট আধখোলা, চোখ অর্ধনিমীলিত। শিবলাল মরিয়া হয়ে তার নাম ধরে টানতে লাগল, আর প্রতিবারেই মনে হচ্ছিল যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে দিচ্ছে। বাঁশিওয়ালার ঠোঁটে অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল, সেই হাসি ছিল না মানুষের, না সম্পূর্ণ ছায়ার, বরং মধ্যবর্তী এক ভয়ের সীমান্তে দাঁড়িয়ে।
গৌরীর হাত টানতে টানতে শিবলাল নিজের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করল। হঠাৎ বাঁশিওয়ালার সুর বদলে গেল, সুরের ভেতরে একরকম ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠল। কুয়াশা ঘূর্ণি তুলল, গাছের ডালপালা কেঁপে উঠল, মাটির নিচ থেকে যেন অচেনা শব্দ উঠতে লাগল। গৌরীর শরীর কেঁপে উঠল, তার চোখে আবার আলো ফিরল। সে দেখল শিবলাল মরিয়া হয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে, আর বাঁশিওয়ালা যেন ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ছায়া মিলেমিশে আবার কুয়াশার অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখে শেষ মুহূর্তে যে দৃষ্টি ফুটে উঠল, তা গৌরীর বুক কাঁপিয়ে দিল—সেই দৃষ্টিতে ছিল অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা, ছিল চিরন্তন অভিশাপের এক নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা। বাঁশির শেষ টানটান সুর থেমে যেতেই সব শান্ত হয়ে গেল, শুধু কুয়াশা ধীরে ধীরে সরে যেতে লাগল। গৌরী হাঁপাতে হাঁপাতে শিবলালের বুকে আশ্রয় নিল, আর শিবলাল নিজের বুকের ভেতরে জমে থাকা আতঙ্ক সামলাতে সামলাতে ভাবল—এটা কি সত্যিই শেষ? নাকি বাঁশিওয়ালা আবারও ফিরে আসবে, আরও ভয়ঙ্কর রূপে?
১০
শেষ অধ্যায়ে রাতের জঙ্গল যেন নিজের অদৃশ্য নিশ্বাস টেনে নিয়েছিল। অন্ধকারে গাছপালার ফাঁকে বাতাস থমকে ছিল, পাতা নড়ছিল না, পাখির ডাক থেমে গিয়েছিল, শুধু এক অদৃশ্য চাহনি চারপাশ ঘিরে ছিল। গৌরী শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে, হাতে লণ্ঠন, চোখ ভিজে উঠেছিল উদ্বেগে। তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ভাই—কিন্তু যেন পুরোপুরি তার ভাই নয়। চোখ দুটো নিস্প্রভ, ঠোঁটে চাপা কাঁপুনি, যেন কারো শিকলে বাঁধা। গৌরী জানত, এ লড়াই শুধু অভিশপ্ত বাঁশিওয়ালার সঙ্গে নয়, বরং সেই ভয়ানক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে যা মানুষকে নিজের অধীন করে নেয়। বাঁশিওয়ালা দূরে দাঁড়িয়ে বাঁশি ঠোঁটে তুলতেই হঠাৎ বাতাস কেঁপে উঠল, বাঁশির সুর ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে, গাছের ফাঁকে ফিসফিস আওয়াজ, পুকুরের জলে ঢেউয়ের মতো প্রতিধ্বনি। গৌরীর বুক ধকধক করতে লাগল—এ সুর তার ভাইকে টেনে নিয়ে যাবে, হয়তো তাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে। কিন্তু সে ভেঙে পড়ল না। মাটিতে পড়ে থাকা লোহার ছুরি তুলে নিয়ে সে এগিয়ে গেল, কণ্ঠে উচ্চারণ করল মায়ের শেখানো মন্ত্র, চোখে দৃঢ়তা—“তুই আমার ভাইকে নেবি না, তুই অভিশপ্ত হবি না, তুই যদি সত্যিই বনদেবতার প্রহরী হোস, তবে আমাকে শক্তি দে!” মন্ত্রের সাথে সাথে হঠাৎ চারপাশের বাতাসে এক অদ্ভুত আলো ঝলমল করে উঠল, গাছপালার ফাঁক দিয়ে যেন চাঁদের আলো হঠাৎ ভেঙে পড়ল মাটিতে। বাঁশিওয়ালার চোখে তখন এক ঝলক বিস্ময়, তার সুর কেঁপে উঠল, আর সেই মুহূর্তেই গৌরীর ভাই হাঁটু গেড়ে পড়ে গেল, যেন বাঁধনটা কিছুটা শিথিল হলো।
কিন্তু এই লড়াই এখানেই শেষ হয়নি। বাঁশিওয়ালা তার বাঁশি ফেলে দিয়ে এক পা এক পা করে গৌরীর দিকে এগিয়ে এলো। মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে আগুনের মতো দপদপে দৃষ্টি। গৌরী পিছিয়ে যায়নি। তার বুকের ভেতর ভয় দাউদাউ করে জ্বলছিল, কিন্তু ভেতরে কোথা থেকে যেন সাহসের স্রোত জেগে উঠেছিল। সে বুঝেছিল, এ আত্মা যদি সত্যিই অভিশপ্ত হয়, তবে মুক্তি পেতে চায়। আর যদি সে বনদেবতার প্রহরী হয়, তবে সে কেবল পরীক্ষা নিচ্ছে। বাঁশিওয়ালা ধীরে ধীরে তার সামনে এসে দাঁড়াতেই গৌরী হাতের ছুরি মাটিতে ফেলে দিল, দু’হাত জোড় করে মাথা নোয়াল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু শব্দ ভেঙে এল—“আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও। আমি লড়াই করব না, যদি তুই সত্যিই রক্ষক হোস।” এক অদ্ভুত নীরবতা ছড়িয়ে পড়ল। বাঁশিওয়ালা স্থির হয়ে তাকিয়ে রইল, তারপর আস্তে আস্তে সে চোখ বন্ধ করল। বাতাসে হঠাৎ শীতলতার বদলে উষ্ণতার স্পর্শ এলো, যেন গাছপালার বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। গৌরীর ভাই মাটিতে পড়ে হাপাতে লাগল, কিন্তু তার চোখে আলো ফিরে আসছিল। বাঁশিওয়ালার শরীর তখন যেন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যেতে লাগল, এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ তার মুখে। বাঁশি মাটিতে পড়ে রইল, কিন্তু তাতে আর কোনো সুর বেরোল না। গৌরী বুঝল, সে হয়তো সত্যিই বনদেবতার এক প্রহরী, শতাব্দীর অভিশাপে বন্দি হয়ে থেকে গেছে, আর আজ তার মুক্তি হলো। কিন্তু মুক্তি মানে কি শেষ? নাকি নতুন কোনো অভিশাপের শুরু?
গভীর রাতে সব শান্ত হয়ে এলো। গৌরী ভাইকে কাঁধে তুলে নিল, চোখে অশ্রু, কিন্তু মনে এক অদ্ভুত শূন্যতা। পাখিরা ধীরে ধীরে ডাকতে শুরু করল, পাতার ফাঁকে হাওয়া বয়ে গেল, যেন বন আবার প্রাণ ফিরে পেল। তবুও অদ্ভুত এক রহস্য রয়ে গেল অমীমাংসিত। বাঁশি মাটিতে পড়ে থাকলেও, জঙ্গলের বুক যেন এক গোপন সত্য লুকিয়ে রাখল। গৌরী যখন ভাইকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, তখন সে স্পষ্ট শুনল—দূরের অন্ধকারের ভেতর থেকে আবার ভেসে আসছে বাঁশির ডাক। খুব ক্ষীণ, খুব দূরে, কিন্তু নিঃসন্দেহে সেই একই সুর। গৌরীর বুক কেঁপে উঠল। সে ফিরে তাকাল, কিন্তু চারপাশে নিস্তব্ধতা। এটা কি তার কল্পনা? নাকি সত্যিই কোনো আত্মা এখনও জেগে আছে, নতুন কোনো রহস্যের আভাস দিয়ে? শেষ লড়াইয়ের পরেও জঙ্গল তার বুকের ভেতরে রেখে দিল এক খোলা প্রশ্ন, যার উত্তর গৌরীর কাছে নেই। সে শুধু জানে, লড়াই শেষ হলেও, জঙ্গলের ডাক চিরকাল থেকে যাবে—মানুষের ভয়, বিশ্বাস আর ভক্তির গভীরে প্রতিধ্বনিত হয়ে। বাঁশিওয়ালার আত্মা কি মুক্তি পেল, নাকি সে এখনও বনদেবতার এক প্রহরী হয়ে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কেউ জানে না। শুধু জঙ্গল, যে প্রতিটি নিশ্বাসে ফিসফিস করে, প্রতিটি ছায়ায় লুকিয়ে রাখে অমোঘ ডাক। আর গৌরী, যে আজীবন মনে রাখবে—নীরব রাতের বুকেও একদিন আবার বাজতে পারে বাঁশির সুর।
শেষ




