প্রিয়া সরকার
গ্রামের মাঝে যখন একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উঠলো, তখন তা সাধারণত গ্রামবাসীদের মধ্যে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হিসেবে ভাবা হয়। সেতু হবে দুই গ্রামের মধ্যে, একটি ছোট গ্রাম, অপরটি বড়। দুটো গ্রামের মানুষদের মাঝে দূরত্ব ছিল শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকও। গ্রামগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং একে অপরকে প্রায় কখনোই বুঝতে পারত না। আফতাব রহমান, এক তরুণ নেতা, জানত এই সেতুর মাধ্যমে শুধু দূরত্বের অভাবই পূর্ণ হবে না, বরং দুই গ্রামের মধ্যে এক শক্তিশালী সামাজিক ঐক্যও প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু, গ্রামবাসীরা জানত না যে, তাদের মধ্যে এক দীর্ঘকাল ধরে থাকা বিভেদ, সমাজের ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদ এমন এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করবে যা এই সেতু নির্মাণের পথে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আফতাব সে প্রস্তাব নিয়ে প্রথমবার গ্রামে আসেন, কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রতিক্রিয়া খুবই মিশ্র ছিল। কেউ আনন্দিত, কেউ আবার ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অপর্ণা সিং, গ্রামের এক প্রখ্যাত মহিলা, যিনি অনেকটা সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতীক, তিনি একেবারে এই সেতুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। তার মতে, সেতু শুধু শারীরিকভাবে না, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে গ্রামগুলোর মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে, তা আরো গভীর করবে। তিনি জানতেন, যে ঐতিহ্য ও সমাজের শ্রেণীভেদ রক্ষা করার জন্য তাদের কঠিন সংগ্রাম করতে হবে, যাতে সেতু তাদের ন্যায্যতা ও ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ না করে। তবে, আফতাব কোনোভাবেই হাল ছাড়তে চাননি। তার বিশ্বাস ছিল যে, সেতু নির্মাণ গ্রামগুলোর মধ্যে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি আনবে, যা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হবে না, বরং এক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করবে।
গ্রামের মধ্যে এই সেতু নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আফতাব সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “এই সেতু শুধু রাস্তা নয়, এটি একটি নতুন পথ দেখাবে, যেখানে আমরা একে অপরকে বুঝবো, সম্মান করবো এবং একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারবো।” কিন্তু অপর্ণা সিংয়ের মতো রক্ষণশীলদের মুখে কোনো হাসি ছিল না। তিনি মনে করেন, সেতুর মাধ্যমে শুধু গ্রামগুলোর একাত্মতাই হবে না, বরং তা হবে পুরনো সমাজের নিয়মের জন্য এক বড় ধাক্কা। তিনি এবং তার সমর্থকরা চিন্তা করছিলেন যে, সেতু গ্রামগুলোর মধ্যে যে পিতৃপুরাণের আধিপত্য রয়েছে, তা ধ্বংস করতে পারে। তাদের ধারণা ছিল যে, যদি দুই গ্রাম একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, তবে তা তাদের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলবে। অপর্ণার কথায়, “সেতু আমাদের ঐতিহ্যকে বিপর্যস্ত করবে। এই বিভাজন এবং শ্রেণীভেদ তো আমাদের সামাজিক কাঠামোরই অঙ্গ, তার প্রতি আঘাত হবে এটি।” একদিকে গ্রামে সংঘর্ষের সম্ভাবনা, অন্যদিকে আফতাবের প্রতিশ্রুতি—এই দুই মেরু গ্রামবাসীকে বিভক্ত করে রাখে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আফতাবের পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু অনেকেই অপর্ণার দিকে চলে যায়। এই অবস্থা দেখে জীবন্তী মিশ্র, যে একজন মধ্যবয়সী মহিলা, সেতুর পক্ষে হলেও মনে মনে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি জানতেন যে, কিছু কিছু গ্রামবাসী এখনও পুরনো নিয়মের প্রতি ভালোবাসা রাখতে চান এবং তারা সামাজিক পরিবর্তন মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু, জীবন্তী আফতাবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, পরিবর্তন আসবেই, এবং সেতু সেই পরিবর্তনের সূচনা।
সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রামে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে, তবে কিছু গ্রামবাসী এখনও এই প্রস্তাব নিয়ে সন্দিহান ছিল। রাজু দাস, গ্রামের একজন কৃষক, তার মনে দ্বিধা পোষণ করেন। রাজু জানতেন, সেতু নির্মাণ তার জন্য আর্থিক এবং সামাজিক সুবিধা নিয়ে আসবে, তবে তার ভয় ছিল—এই পরিবর্তন তাকে এবং তার গ্রামের মানুষদের খুব দ্রুত বড় কোনো ঝামেলায় ফেলতে পারে। তিনি জানতেন, গ্রামের কিছু মানুষ পুরনো নিয়মের প্রতি খুবই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তাদের পক্ষে এধরনের আধুনিক উদ্যোগ মেনে নেয়া কঠিন হবে। তবুও, রাজু আফতাবের প্রতি নিজের আস্থা হারাননি, কিন্তু তার মনে কিছুটা আশঙ্কাও ছিল। গ্রামে তখন শুধু সামাজিক সংঘর্ষ নয়, একটি একান্ত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে গিয়েছিল। একদিকে, এই সেতুর মাধ্যমে গ্রামগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে, অন্যদিকে, এই যোগাযোগের মাধ্যমে পুরনো প্রথা এবং শৃঙ্খলাও ভেঙে যেতে পারে। জীবনযাত্রার মধ্যে যদি এই পরিবর্তন আসে, তবে তা কী গ্রামবাসীদের মনোবলে আঘাত হানবে না? এই প্রশ্ন তার মনের মধ্যে চলছিল, কিন্তু তবুও তিনি আশা করতেন, সেতু নির্মাণের ফলে সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে, গ্রামে এখনো একটি অস্থিরতা বিরাজমান ছিল, যা সেতু নির্মাণের আসন্ন শুরুতে আরো তীব্র হয়ে উঠবে।
আফতাব রহমান একদিন গ্রামে এসে ঘোষণা দেন, ‘‘আমরা একটা নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এই সেতু শুধু আমাদের যাতায়াতকে সহজ করবে না, এটি হবে আমাদের সমাজের নতুন একটি সূচনা।’’ তাঁর কথা শুনে অনেকেই আশাবাদী হয়ে ওঠে, কিন্তু একদল গ্রামবাসী এখনও অন্ধকারে আঁটকে থাকে, যারা বিশ্বাস করত না যে একটি সেতু নির্মাণ তাদের জীবনে কোন পরিবর্তন আনবে। আফতাবের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, এই সেতু শুধু শারীরিক সংযোগ নয়, বরং সামাজিক একতা ও সহযোগিতার প্রতীক হবে। তিনি জানতেন যে, দুটি গ্রামকে একত্রিত করার জন্য শুধু রাস্তা নয়, একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমাজের প্রতি নতুন মনোভাব প্রয়োজন। কিন্তু তার এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে শক্তিশালী বাধা আসতে শুরু করে, বিশেষ করে গ্রামে অপর্ণা সিংয়ের মতো প্রবীণ সমাজের নেত্রীর। অপর্ণা জানতেন, গ্রামে বিভিন্ন জাতির মধ্যে তীব্র বিভেদ রয়েছে এবং এই সেতু শুধু বিভাজন বাড়াবে। তিনি প্রথম থেকেই আফতাবের বিপক্ষে ছিলেন এবং তার ধারণা ছিল, এই সেতু শুধু যে সমাজের ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদকে চ্যালেঞ্জ করবে, তা নয়, গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করবে, যা তারা কখনোই মেনে নিতে পারবে না।
আফতাব, তবে, এই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সে জানত, এমন একটা উদ্যোগ শুধু প্রশাসনিক ইস্যু নয়, বরং এটি গ্রামগুলোর সামাজিক জীবনের অঙ্গীকার। আফতাব গ্রামে সবার কাছে গিয়ে, গ্রামবাসীদের বুঝিয়ে বলে, ‘‘এই সেতু আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং সম্পর্কের উন্নতি ঘটাবে। আমাদের সমাজের শক্তিশালী ভিত্তি হচ্ছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহযোগিতা।’’ কিন্তু গ্রামবাসীরা, বিশেষত পুরনো চিন্তাধারার মানুষরা, এসব কথা খুব সহজে মেনে নিল না। রাজু দাস, গ্রামের একজন কৃষক, যিনি সাধারণত আফতাবের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতেন, কিন্তু এবার কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তার মনে ছিল এক ধরনের ভয়ের ভাবনা—এটা কি সত্যিই তাদের জন্য ভালো হবে? তিনি জানতেন যে, সেতু নির্মাণের ফলে তার জীবনযাত্রার অনেক সুবিধা হবে, কিন্তু একই সঙ্গে তার সামাজিক অবস্থানও পরিবর্তিত হতে পারে। ‘‘আমরা তো এখনো একই পরিপার্শ্বে আছি, আমাদের ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধের সাথে জড়িত থাকতে হবে,’’ এই ভাবনায় রাজু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।
গ্রামবাসীদের মধ্যে এই বিভক্তি আরও স্পষ্ট হতে থাকে যখন আফতাব সেতুর প্রস্তাব নিয়ে প্রথমবার একটি সাধারণ সভা আয়োজন করেন। সভায় উপস্থিত ছিল নানা বয়সের মানুষ—কৃষক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, শ্রমিক—সবাই। কিছু মানুষ আফতাবের সাপোর্টে ছিল, তারা বিশ্বাস করেছিল যে, এই সেতু তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে এবং তাদের মধ্যে এক নতুন বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। কিন্তু অন্য দিকে, অপর্ণা সিং এবং তার সমর্থকরা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় করেন। অপর্ণা সিং সভায় উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘‘এই সেতু আমাদের ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ করবে। এটি গ্রামে বিভাজন এবং শ্রেণীভেদ বাড়াবে, এবং আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানবে।’’ তার এই মন্তব্য গ্রামে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। অপর্ণার মতো আরো কিছু প্রবীণ গ্রামবাসী মনে করেন, সেতু নির্মাণের ফলে তাদের পুরনো সামাজিক কাঠামো ধ্বংস হয়ে যাবে, যা একসময় তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের শক্তি ছিল। ‘‘আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য এবং নিয়ম-নীতি রক্ষা করা উচিত, তা না হলে আমাদের সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে,’’ তাদের মতে। অপর্ণার সমর্থকরা বিশ্বাস করত, সেতু নির্মাণ শুধুমাত্র একটি শারীরিক কাঠামো নয়, বরং এটি গ্রামগুলোর মধ্যে এক গভীর সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আনবে।
এদিকে, জীবন্তী মিশ্র, একজন মধ্যবয়সী মহিলা, যিনি কমবেশি আধুনিক চিন্তা-ভাবনা করেন, তিনি আফতাবের প্রতি সমর্থন জানান, তবে কিছুটা সতর্ক থাকতেও বলেন। তিনি জানতেন যে, সমাজে পরিবর্তন আনাটা সহজ নয়, বিশেষ করে যখন এটি পুরনো ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে আসে। জীবন্তী আফতাবকে বলেন, ‘‘আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে একে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে হবে, যাতে গ্রামের মধ্যে কোন রকম সংঘর্ষ সৃষ্টি না হয়।’’ তিনি বলেন, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হবে, তবে তিনি মনে করেন, সময়ের সাথে সাথে মানুষকে এই পরিবর্তন মেনে নিতে হবে।
অপর্ণা সিং এবং তার সমর্থকরা তাদের অবস্থান থেকে একটুও সরেননি। তারা মনে করতেন, এই সেতু নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামে যে ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদ বহন করছে তা একেবারে অস্বীকার করা হবে, এবং গ্রামবাসীদের এক অজানা পথে ধাবিত করা হবে। তারা এই চিন্তা করতে থাকে যে, সেতু গ্রামগুলোর মধ্যে যে সংযোগ তৈরি করবে, তা শুধু শারীরিক নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি করবে, যা তারা কখনোই মেনে নিতে পারবে না। আর এই সংকট, একদিকে আফতাবের প্রতি তাদের সমর্থন, অন্যদিকে অপর্ণা সিংয়ের মতো রক্ষণশীলদের বিরোধিতা, গ্রামকে এক নতুন বাস্তবতায় ঠেলে দেয়।
এভাবে, সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা এক বড় সামাজিক পরীক্ষায় পরিণত হয়। গ্রামবাসীরা নিজেদের ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাচ্ছিল না। একদিকে উন্নতির আশা, অন্যদিকে পুরনো সমাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখার চাপ। কিন্তু, একমাত্র সত্য যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা হলো—এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি, সেতু হবে কিনা, তবে গ্রামবাসীর মধ্যে এক কঠিন সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।
সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা যত এগিয়ে যাচ্ছিল, ততই গ্রামে উত্তেজনা বাড়ছিল। প্রতিদিনই গ্রামে নতুন আলোচনা, বিতর্ক এবং সভা অনুষ্ঠিত হতে লাগল। আফতাবের মতো উদীয়মান নেতা এবং অপর্ণা সিংয়ের মতো প্রবীণ সমাজের নেত্রীদের মধ্যে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়েছে। আফতাব জানত, গ্রামগুলোর মধ্যে সেতু নির্মাণের মাধ্যমে কেবল যোগাযোগের রাস্তা তৈরি হবে না, বরং এটি হবে এক নতুন সমাজের সূচনা, যেখানে সবাই একে অপরকে বোঝার চেষ্টা করবে, শ্রদ্ধা করবে। তার কাছে এই সেতু ছিল একটি স্থিতি পরিবর্তনকারী উদ্যোগ, যা শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে দিতে পারে। তবে, অপর্ণা সিং মনে করতেন, এই সেতু শুধু দুই গ্রামের মধ্যে শারীরিক সংযোগ তৈরি করবে না, বরং পুরনো সমাজের যেসব মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্য রয়েছে, তা ভেঙে ফেলবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই পরিবর্তন তাদের জন্য খুবই বিপজ্জনক, কারণ সমাজের মূল কাঠামো ও শ্রেণীভেদ যদি ভেঙে যায়, তবে গ্রামগুলোর ঐতিহ্য এবং নিয়ম-নীতি স্থিতিশীল থাকবে না। গ্রামবাসীদের মধ্যে বিশ্বাস ছিল, এই সেতু তৈরি করলে তারা একে অপরের সঙ্গে আরও মিশে যাবে, যার ফলে পুরনো বিভেদ আরও জটিল হয়ে উঠবে।
আফতাব, তবে, একে শুধুমাত্র একটি রাস্তা হিসেবে নয়, একটি সংযোগ হিসেবে দেখছিল। তার মতে, সেতু শুধু শারীরিক নয়, একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ হবে। তিনি তার পরিকল্পনার প্রতিটি দিক নিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘এটি কেবল একটি সেতু নয়, এটি আমাদের মধ্যে সমঝোতা এবং শান্তির প্রতীক। আমরা যেভাবে একে অপরকে ভয় পাই, একে অপরকে না বোঝার কারণে আমরা কখনো একে অপরের সত্যিকারের বন্ধু হতে পারিনি। এই সেতু আমাদের সেই অসম্পূর্ণতা পূর্ণ করবে।’’ আফতাব জানত, সেতুর মাধ্যমে দুটি গ্রামের মধ্যে যোগাযোগের একটি নতুন পথ খুলে যাবে, যা শুধু যাতায়াতই সহজ করবে না, বরং দুটো সমাজকে একসাথে মেলবন্ধন করবে। তবে, তার প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন যে ছিল, তা খুবই সীমিত ছিল। জীবন্তী মিশ্রের মতো কিছু মানুষ আফতাবের সঙ্গে একমত হলেও, তারা জানতেন যে পুরনো সংস্কৃতি ও সামাজিক নিয়ম ভাঙা খুবই কঠিন। জীবন্তী একদিন আফতাবের কাছে এসে বললেন, ‘‘আমি তোমার সঙ্গে আছি, কিন্তু এই পরিবর্তনকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করতে হবে। তুমি হয়তো ভালোবাসার কথা বলো, কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এই পরিবর্তন সহজভাবে মেনে নেবে না। তাদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধকে সম্মান করে ধীরে ধীরে এগোতে হবে।’’
অপর্ণা সিংয়ের মনোভাব ছিল একেবারে বিপরীত। তিনি কেবল আফতাবের সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করছিলেন না, বরং তিনি বিশ্বাস করতেন যে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে তারা গ্রামবাসীদের সমাজ এবং ঐতিহ্যের মূল কাঠামোকে ধ্বংস করবে। তিনি এবং তার সমর্থকরা বারবার এটিই বলে আসছিলেন, ‘‘সেতু আমাদের বিভেদ বাড়াবে, আমাদের সমাজকে একাকার করে দেবে। এভাবে যদি সবাই এক হয়ে যায়, তবে কোথায় থাকবে আমাদের পরিচয়, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের শ্রেণীভেদ? আমাদের সবার স্থান যদি এক হয়ে যায়, তাহলে কী হবে?’’ অপর্ণার মতে, দুই গ্রামের মধ্যে যে বৈষম্য এবং বিভেদ রয়েছে, তা যেন এক ধরনের সামাজিক শৃঙ্খলা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদ আমাদের সমাজের শক্তির প্রতীক। তিনি বলতেন, ‘‘এটা যদি ভেঙে যায়, তবে আমাদের সমাজ থাকবে না।’’ তার কথা ছিল, একটি সেতু একে অপরকে সম্মান জানানো নয়, বরং সাংস্কৃতিক সমন্বয় তৈরি না করেই মানুষকে একে অপরের সাথে মিশিয়ে ফেলার প্রস্তাব।
এই বিতর্কের মধ্যে, রাজু দাস যেমন আফতাবের পক্ষে ছিল, তেমনি তার মনে কিছু প্রশ্নও ছিল। রাজু জানত যে, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তার জীবনে অনেক সুবিধা আসবে—যাতায়াত সহজ হবে, পণ্য আদান-প্রদান দ্রুত হবে, এবং তিনি নিজের কৃষি কাজও আরও ভালোভাবে করতে পারবেন। তবে, তার মনে এক ধরনের দ্বিধা ছিল। ‘‘এটা কি আমাদের জন্য সত্যিই ভালো হবে?’’ এই প্রশ্নটি তার মনের মধ্যে কাঁটারের মতো ঘুরছিল। রাজু কখনোই চায়নি তার গ্রাম এবং সমাজের ঐতিহ্য ভেঙে যাক, তবে সে জানত, সেতু নির্মাণের ফলে তাদের জীবনযাত্রা সহজ হবে। সে আফতাবের পক্ষেও ছিল, তবে তার শঙ্কা ছিল এই পরিবর্তন আনতে গিয়ে তারা সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে কিনা। একদিকে, রাজু আফতাবের পক্ষে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু অন্যদিকে অপর্ণার কথাও তার মনে বিরূপ প্রভাব ফেলছিল। ‘‘এটা তো সেতু নয়, একটা সামাজিক বিপ্লব হতে যাচ্ছে,’’ রাজু মনে মনে বলেছিল।
গ্রামে একটি বড় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সেতু নির্মাণ নিয়ে সব ধরনের আলোচনা করা হয়। আফতাব এবং অপর্ণা সিং একে অপরের বিরুদ্ধে শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরেন। অপর্ণা সিং বলেন, ‘‘এটি শুধু একটি শারীরিক সেতু নয়, এটি আমাদের সমাজের সেতু ভেঙে ফেলবে।’’ আফতাব পাল্টা বলেন, ‘‘এটা সমাজের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করবে। এটি শুধু সেতু নয়, এটি আমাদের জীবনের নতুন দিগন্ত।’’ এই অবস্থায়, গ্রামবাসীরা বিভক্ত হয়ে যায়, কেউ একপক্ষে, কেউ আরেকপক্ষে। যদিও সেতু নির্মাণের জন্য অনুমতি ছিল, তবে গ্রামে উত্তেজনা এবং বিভক্তি ক্রমেই গভীর হতে থাকে। পরিবর্তন শ্বাসরুদ্ধকর হয়ে উঠছিল, একদিকে পুরনো সমাজের প্রাচীন মূল্যবোধের বিরুদ্ধে এবং অন্যদিকে নতুন আধুনিকতার সংগ্রাম।
এভাবে, সেতু নির্মাণের প্রস্তাব একটি গভীর সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়, যা গ্রামগুলোর মধ্যে এক নতুন সংকটের সৃষ্টি করেছিল।
–
সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা অবশেষে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, কিন্তু গ্রামগুলোতে উত্তেজনা ও অস্থিরতা অব্যাহত থাকে। আফতাবের চেষ্টায় কিছু অগ্রগতি হলেও, পুরনো ধাঁচের সমাজের বাধা ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। গ্রামবাসী বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, একদল আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, অন্যদিকে, একদল রক্ষণশীলতা আঁকড়ে ধরেছিল। সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতি অবশেষে পাওয়া গেল, তবে এটি কোনও সহজ পথ ছিল না। গ্রামবাসীদের মধ্যেকার এই সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যখন কিছু মানুষ সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিলে কিছু মানুষের মধ্যে উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে, আফতাব ছিল, যে বিশ্বাস করত যে সেতু হবে গ্রামগুলোর মধ্যে এক নতুন বন্ধন। অন্যদিকে, অপর্ণা সিং এবং তার সমর্থকরা এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে একে একে শক্তিশালী প্রতিবাদ গড়ে তোলে।
নতুন উত্তেজনায়, অনেক গ্রামবাসী সেতু নির্মাণে আপত্তি জানাতে শুরু করে। গ্রামে এক বিকেলের আলোতে, একটি বড় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে সেতুর পক্ষে এবং বিপক্ষে গ্রামবাসী নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে আসে। আফতাব উন্মুক্ত মন নিয়ে সভায় উপস্থিত হন, যেখানে তিনি আবারও তার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন, ‘‘এটি শুধু রাস্তা নয়, এটি আমাদের মানসিক বন্ধন হবে। সেতুর মাধ্যমে আমরা একে অপরকে বুঝতে পারবো, একে অপরকে শ্রদ্ধা করতে শিখবো, এবং আমাদের সমাজের মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে, তা দূর হবে।’’ তবে, এই বক্তব্যের মধ্যে যে প্রত্যাশিত উত্তেজনা ছিল, তা ছিল একেবারেই বিরোধী গ্রুপের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত। অপর্ণা সিং, যার মধ্যে পুরনো ঐতিহ্য এবং সমাজের রক্ষণশীলতা অটুট ছিল, সেতু নির্মাণের বিরোধিতা করেন এবং বলেন, ‘‘এটি কোনও সাধারণ রাস্তা নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী আঘাত। আপনি যদি এই সেতু নির্মাণ করেন, তাহলে আমাদের গ্রামগুলোর মধ্যে সামাজিক বিভেদ এবং শ্রেণীভেদের ধারা ভেঙে পড়বে।’’ তার বক্তব্যে উত্তেজনা আরও বাড়ে। একে একে, অপর্ণার সমর্থকরা তাদের বক্তব্য তুলে ধরে, যা পুরো সভাকে এক অস্থির পরিস্থিতিতে পরিণত করে।
এই পরিস্থিতি উত্তেজনা এবং সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। একদিন বিকালে, গ্রামবাসীরা যখন সেতুর জন্য উপকরণ সংগ্রহ করতে গেলে, কিছু গ্রামবাসী যারা প্রতিবাদ করছিল, তারা নির্মাণ কাজে বাধা দিতে শুরু করে। একটি বিশাল অশান্তি সৃষ্টি হয়, যখন কিছু বিরোধী গ্রামবাসী আফতাবের প্রতি শত্রুতা প্রকাশ করে এবং তাকে একপাশে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। রাজু দাস, যিনি সাধারণত আফতাবের পাশে দাঁড়ান, এই সংঘর্ষের মধ্যেও নিজেকে একটু পিছিয়ে রাখেন, কারণ তার মনেও কিছুটা দ্বিধা ছিল। রাজু জানত, সেতু নির্মাণের ফলে তার কৃষি কাজ এবং জীবিকা সহজ হবে, কিন্তু সেই সাথে তার গ্রামের ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদেও বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। রাজু যদি পুরোপুরি আফতাবের পাশে দাঁড়াত, তাহলে তাকে অনেক সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হতে পারত, কারণ তার পরিবার এবং সমাজ পুরনো ধাঁচে বিশ্বাস করত। ফলে, রাজু সেই মুহূর্তে নিরব থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
এদিকে, জীবন্তী মিশ্র, যিনি আফতাবের মূল সমর্থক ছিলেন, সেতু নির্মাণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি জানতেন, পরিবর্তন আনাটা সহজ কাজ নয়, বিশেষত যখন পুরনো সমাজের নিয়মগুলো অনেক শক্তিশালী হয়ে থাকে। তিনি একদিন আফতাবের কাছে গিয়ে বলেন, ‘‘আমি তোমার উদ্দেশ্যকে পুরোপুরি সমর্থন করি, কিন্তু জানো, যদি সমাজের প্রতিক্রিয়া এমনই তীব্র হয়, তবে তোমার লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে যাবে।’’ আফতাব তখন জীবন্তীকে শান্ত করে বললেন, ‘‘এটা জানি, কিন্তু আমাদের এই যাত্রা শুরু করতে হবে। আমাদের যদি প্রথম পদক্ষেপ না থাকে, তবে আমরা কখনোই আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না। আমাদের যাত্রা আরম্ভ হোক, সে যেভাবেই হোক।’’
পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে, যখন গ্রামের একদল তরুণ যুবক যারা সেতু নির্মাণের পক্ষে ছিলেন, তারা প্রস্তাবিত সেতু নির্মাণস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকে। তারা বলেছিল, ‘‘আমরা চাই আমাদের জীবনের মান বাড়ুক, এবং সেতু আমাদের সেই সুযোগ দিতে পারে।’’ তাদের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘‘এটি শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যত।’’
গ্রামবাসীদের মধ্যে চলা এই স্নায়ুযুদ্ধ আরো জটিল হয়ে ওঠে, যখন নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। কিছু পুরনো চিন্তা-ভাবনা এবং পূর্ববর্তী সামাজিক অবস্থানগুলি সেতুর নির্মাণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে, আফতাব তার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যায়, জানতো যে এই পরিসরের বাইরে গ্রামবাসীদের মনের অন্ধকার জায়গাগুলো আলোকিত করতে হলে বড় ধরনের সংগ্রাম করতে হবে। সে জানত, এই উদ্যোগ সবার কাছে প্রশংসিত হবে না, তবে সত্যের জয় আসবেই।
তবে, সেতু নির্মাণের প্রথম পাথর স্থাপন হলেও, গ্রামগুলোতে সংঘর্ষ থামল না। সেতু নির্মাণের কর্মীরা প্রতিদিন নির্মাণের কাজ শুরু করলেও, আশপাশের গ্রামে বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। আফতাব এবং তার সমর্থকরা অবিচলিত ছিল, কিন্তু তারা জানতো, সামনে আরও কঠিন পথ অপেক্ষা করছে।
–
সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু হওয়ার পর গ্রামে এক অদ্ভুত ধরনের পরিবেশ তৈরি হয়। একদিকে, সেখানে উত্তেজনা ও উদ্বেগ ছিল, অন্যদিকে, ছিল একটি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি—এটি একটি নতুন যুগের সূচনা। আফতাব এবং তার সমর্থকরা কাজের প্রতি একাগ্রতার সঙ্গে মনোযোগী ছিলেন, তবে সামাজিক বিভাজন এবং প্রতিবন্ধকতা বাড়ছিল। প্রাথমিকভাবে, সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরণ এবং শ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়েছিল, কিন্তু গ্রামবাসীদের মধ্যে বিরোধ এবং বিভাজন অনেক সময় কাজের গতি শ্লথ করে দেয়। যদিও কিছু দৃঢ় প্রতিজ্ঞ গ্রামবাসী কাজ শুরু করে, সেতু নির্মাণের বিপক্ষে বিরোধীরা প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। গ্রামে এখন এক অস্থিরতা বিরাজমান ছিল। একদল আফতাবের পরিকল্পনার সমর্থক ছিল, যারা তার সাহসিকতা এবং আগ্রহকে প্রশংসা করছিল, কিন্তু অন্যদিকে, অপর্ণা সিং এবং তার সমর্থকরা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে একের পর এক প্রতিবাদ গড়ে তুলছিল। তারা বিশ্বাস করত, সেতু গ্রামে সামাজিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে, এটি পুরনো ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদের বিরুদ্ধে এক অমীমাংসিত যুদ্ধ ঘোষণা করবে।
এসময়, সেতু নির্মাণের প্রথম পাথর স্থাপনের কাজ শুরু হয়। এটি ছিল একটি প্রতীকী মুহূর্ত, কিন্তু আফতাব জানত, এক পাথরের পরিবর্তন পুরো গ্রামকে বদলে দিতে পারে না। সে জানত, সেতু নির্মাণের প্রথম দিন থেকে গ্রামে শান্তি আসবে না, বরং এক ধরনের উত্তেজনা এবং অনিশ্চয়তা থাকবে। কাজের প্রথম দিনটি ছিল এক আনন্দমুখর দিন, তবে পিছনের পরিবেশে বিরোধীদের এক শক্তিশালী প্রতিবাদ লুকিয়ে ছিল। সেতু নির্মাণের শুরুর সময়, আফতাব এক পাথর রেখে বলেছিল, ‘‘এটা শুধু একটি পাথর নয়, এটি আমাদের জীবনের পথে প্রথম পদক্ষেপ। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমাদের ভবিষ্যতের জন্য, আমরা এই সেতু তৈরি করব এবং আমরা একে অপরকে বুঝব।’’ তবে, আফতাব জানত, সেতুর এই প্রথম পাথরটি শুধু একটি শারীরিক কাজ নয়, এটি ছিল একটি মানসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন। গ্রামবাসীদের মধ্যে যে ভীতি এবং দ্বিধা ছিল, তা সহজেই দূর হতে পারত না। অপর্ণা সিং এবং তার সমর্থকরা জানতেন, এই প্রথম পদক্ষেপটি কেবল একটি শুরু মাত্র, কিন্তু তাদের জন্য এটি ছিল এক বিরাট প্রতিকূলতা।
গ্রামে যখন সেতুর কাজ শুরু হয়, তখন কিছু লোক সরাসরি নির্মাণস্থলে উপস্থিত হয়ে কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করে। তারা আফতাব এবং তার সমর্থকদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের হুমকি দিতে থাকে, ‘‘এই সেতু তৈরি করলে, আমরা আপনাদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেব না।’’ এই সময়, রাজু দাস, যিনি কখনো আফতাবের বড় সমর্থক ছিলেন, নিজেকে কিছুটা সরে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তার মনেও কিছু দ্বিধা তৈরি হয়েছিল। রাজু জানত যে, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে তার কৃষি কাজ সহজ হবে, কিন্তু একই সঙ্গে সামাজিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনাও থাকত। সে মনে করত, ‘‘যদি সেতু নির্মাণের মাধ্যমে আমাদের পুরনো প্রথা ভেঙে যায়, তবে আমাদের সমাজ কোথায় দাঁড়াবে? আমি কি সত্যিই একে গ্রহণ করতে পারব?’’ তাই, রাজু সেতুর বিপক্ষে বা পক্ষে কোন স্পষ্ট অবস্থান নিতে পারছিল না। সে চুপচাপ থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, কিন্তু তার মন চুপসে গিয়েছিল, কারণ সে জানত, সমাজের পরিবর্তন অনেক সময় সমষ্টিগত শান্তি আনার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।
অপর্ণা সিং যখন দেখলেন যে, গ্রামে সেতু নির্মাণের জন্য প্রথম পাথর স্থাপন করা হয়েছে, তখন তিনি তার সমর্থকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘‘এটা আমাদের ঐতিহ্যের অবমাননা। তারা আমাদের পুরনো শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলছে, তারা গ্রামে এক অজানা বিপদের ডেকে আনছে।’’ তার কথা শুনে, আরও অনেক পুরনো চিন্তাধারার মানুষ সরাসরি নির্মাণস্থলে গিয়ে কাজ বন্ধ করার চেষ্টা করে। তারা নির্মাণ কাজকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার জন্য নানা উপায়ে বাধা দেয়। একদিন, কিছু লোক সেতুর পাথর সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, কিন্তু আফতাব এবং তার সমর্থকরা বাধা দেয়। তারা জানত, এই প্রথম পদক্ষেপের মাধ্যমে সেতুর পূর্ণ নির্মাণ সম্ভব হবে না, কিন্তু এই পাথরটি ছিল তাদের সংগ্রামের একটি দৃশ্যমান প্রতীক। আফতাব জানত, এই প্রথম পাথরের স্থাপন গ্রামবাসীদের মধ্যে এক ঐক্য সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু এটি তাদের কাছে একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে কাজ করবে—একটি নতুন দৃষ্টিকোণ এবং চিন্তা-ভাবনার দরজা খুলে দেবে।
এই দিনটি ছিল সংঘর্ষ এবং প্রতিকূলতার, তবে আফতাব তার দলের সবার কাছে বলেছিল, ‘‘আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি একটি নতুন পৃথিবী গড়ার জন্য, যেখানে কোনও সামাজিক বিভেদ থাকবে না, যেখানে সবাই সমানভাবে শ্রদ্ধা পাবে।’’ আফতাব জানত, সেতু নির্মাণের প্রথম পাথর তার স্বপ্নের পথে এক চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে, তবে তার ধারণা ছিল, এই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই গ্রামের মানুষ নতুন পথে এগিয়ে যাবে। তবে, এর জন্য যে মূল্য দিতে হবে, তাও সে জানত। সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে, গ্রামে যে বিভাজন ছিল তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, কিন্তু আফতাব দৃঢ় ছিল—এই পথ ধরেই একটি নতুন সমাজ গড়ে উঠবে, যেখানে একতা এবং সমঝোতা থাকবে।
গ্রামের মধ্যে উত্তেজনা আরও তীব্র হতে থাকে, কিন্তু প্রথম পাথর স্থাপনের পরেও আফতাব থেমে যায়নি। সে জানত, তার পথ দীর্ঘ এবং কঠিন, তবে এটি তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, এবং সে তার সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ না তার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়।
–
সেতু নির্মাণের কাজ যত এগিয়ে যেতে থাকে, ততই গ্রামে উত্তেজনা এবং বিভাজন গভীর হতে থাকে। প্রথম পাথর স্থাপনের পর আফতাব এবং তার সমর্থকরা বিশ্বাস করছিলেন যে, সেতু নির্মাণ একটি দীর্ঘ অপেক্ষিত পরিবর্তনের সূচনা হবে, তবে বাস্তবতা ছিল অন্যরকম। গ্রামে এই সেতু নির্মাণের জন্য সমর্থন ও বিরোধের মধ্যে এক অস্থির সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। একদিকে, কিছু মানুষ আফতাবের উদ্যোগকে অত্যন্ত সঠিক এবং সময়োপযোগী মনে করছিল, অন্যদিকে, কিছু পুরনো চিন্তাধারার মানুষ মনে করছিল, এই উদ্যোগ সমাজের সংস্কৃতির জন্য বিপদজনক হতে পারে। বিভাজন এবং মতবিরোধ ক্রমেই বাড়তে থাকে। সেতু নির্মাণের প্রাথমিক কাজের শুরু থেকেই, যখন কাজের গতি বাড়ছিল, তখন কিছু গ্রামবাসী সেতু নির্মাণের প্রকল্পে বাধা সৃষ্টি করতে শুরু করে। তারা বিশ্বাস করত, এই সেতু তাদের সমাজের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি আঘাত হবে, যা কখনো মেনে নেওয়া উচিত নয়।
বিভাজন বাড়তে থাকার কারণে, একদিন আফতাব সিদ্ধান্ত নিলেন, যে গ্রামবাসীদের মধ্যে শান্তি এবং সমঝোতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি সাধারণ সভা আয়োজন করা উচিত। তিনি জানতেন যে, যতদিন না গ্রামবাসীরা একে অপরকে বুঝতে পারবে, ততদিন সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাবে না। আফতাব নিজের পরিকল্পনা নিয়ে একটি বড় সভা আয়োজন করেন, যেখানে গ্রামের সকল শ্রেণীর মানুষকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অপর্ণা সিংও তার সমর্থকদের নিয়ে উপস্থিত হন, যাতে তাদের মতামতও শোনা যায়। সভাটি ছিল একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে গ্রামবাসীরা নিজেদের মতামত প্রকাশ করার সুযোগ পায়, এবং এর মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা স্থাপনের আশা করে।
অপর্ণা সিং সভায় উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘‘আমরা জানি, এই সেতু নির্মাণের পিছনে আফতাবের উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু এর মাধ্যমে যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন আসবে, তা আমাদের সমাজের মৌলিক স্তম্ভকে ভেঙে দেবে। গ্রামগুলোর মধ্যে ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদ আছে, যা আমাদের সমাজের ভারসাম্য রক্ষা করে। এই সেতু আমাদের সেই ভারসাম্য নষ্ট করবে।’’ অপর্ণা সিংয়ের এই বক্তব্যে কিছু সমর্থক মৃদু হর্ষধ্বনি প্রদান করল, তবে অনেকে আফতাবের পক্ষে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরলেন। আফতাব এরপর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করেন, ‘‘আমরা যদি পরিবর্তনের পক্ষে না দাঁড়াই, তবে আমরা কখনোই সমাজের উন্নতি সাধন করতে পারব না। সেতু শুধু একটি শারীরিক কাঠামো নয়, এটি একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে সবাই একে অপরকে বুঝবে, শ্রদ্ধা করবে। আমরা শুধু দুই গ্রামের মধ্যে শারীরিক সংযোগ তৈরি করতে যাচ্ছি না, আমরা সামাজিকভাবে একে অপরকে কাছে নিয়ে আসতে চাই।’’
এই সভা শেষ হওয়ার পর, গ্রামবাসীরা একে অপরের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতি ও বোঝাপড়া তৈরি করতে শুরু করেন। তবে, পুরোপুরি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কিছু মানুষ এখনও প্রতিবাদী ছিল, তারা মনে করেছিল, সেতু তাদের পুরনো নিয়ম এবং সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ করবে। আবার, কিছু মানুষ আফতাবের কথায় আস্থাশীল ছিল, তাদের বিশ্বাস ছিল যে, এই সেতু গ্রামের মধ্যে একটি নতুন শুরুর প্রতীক হবে। সভা শেষ হওয়ার পর, সেতু নির্মাণের কাজ আবার শুরু হয়, তবে এবার একটু ভিন্নভাবে—গ্রামের কিছু বিরোধী অংশও কিছুটা সহযোগিতা করতে শুরু করে। তারা জানতো, যতদিন না তারা একে অপরকে সহানুভূতির চোখে দেখে, ততদিন এই বিভাজন মিটবে না।
এদিকে, রাজু দাস তার অবস্থান আরো পরিষ্কার করে। তিনি আফতাবের সঙ্গে একদিন কথা বলে বলেন, ‘‘আমার মনে হয়, এই সেতু আমাদের গ্রামের জন্য প্রয়োজন, কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি—যদি আমাদের সমাজের ভিতরে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়, তাহলে কী হবে? আমি জানি, আমাদের মধ্যে ঐক্য তৈরি করার জন্য এই সেতু দরকার, কিন্তু সেই ঐক্য কি আসলেই সম্ভব?’’ আফতাব রাজুর কথাগুলো শোনার পর তার কাঁধে হাত দিয়ে বলেন, ‘‘এটাই আমাদের সংগ্রাম। পরিবর্তন কখনও সহজ নয়, কিন্তু সেতু তৈরির মাধ্যমে আমরা একে অপরকে সম্মান করা শিখব। আমাদের পুরনো চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তবে একে একে।’’ রাজু একটু চুপ থেকে বলেন, ‘‘তুমি ঠিক বলছ, আফতাব। আমাদের পরিবর্তনের দিকে এগোতে হবে, তবে একে একটু ধীরে এবং বুঝে বুঝে নিতে হবে।’’
গ্রামে যখন এই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের কাজ এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন আফতাব আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে। সে জানত, সেতু নির্মাণের প্রথম পাথর স্থাপন করার পর গ্রামে কিছু সমঝোতা এসেছে, তবে সেতু নির্মাণের পুরো প্রকল্প সফল করতে তাকে অনেক কঠিন বাধা অতিক্রম করতে হবে। সেতু নির্মাণের প্রথম দিন থেকেই যে সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসেছিল, তা আসলেই অনেক বড় ছিল। কিন্তু আফতাব তার লক্ষ্য থেকে একচুলও সরে না, জানত যে, একদিন এই সেতু কেবল একটি শারীরিক কাঠামোই নয়, বরং একটি নতুন সমাজের ভিত্তি হয়ে উঠবে, যেখানে একতা এবং সম্মান থাকবে।
এই অধ্যায়টি ছিল গ্রামের মধ্যে বিভাজন এবং পুনঃসংযোজনের যাত্রা। একদিকে, পুরনো সমাজের রক্ষণশীলতা ছিল, অন্যদিকে, আধুনিকতার প্রয়োজনীয়তা ও স্বপ্নের সাথে এগিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ। সেতু নির্মাণের কাজ যেমন এগিয়ে যাচ্ছিল, তেমনি গ্রামবাসীদের মধ্যে এক নতুন চেতনাও জন্ম নিচ্ছিল, যা ভবিষ্যতের দিকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সম্মান নিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
গ্রামে সেতু নির্মাণের কাজ যখন এক নতুন গতি পেতে শুরু করেছিল, তখন গ্রামের মধ্যে এক পরিবর্তনের হাওয়া প্রবাহিত হতে থাকে। যদিও বিরোধী গ্রামবাসী এখনো সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে অবিচল ছিল, তবে আফতাবের নেতৃত্বে গ্রামে একটি স্বল্প, তবে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। গ্রামবাসীরা একে অপরকে বুঝতে শুরু করেছিল, আর সমাজে প্রথমবারের মতো একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উঠে আসে—এটা ছিল এক নতুন ধরনের সম্মান, সহানুভূতি এবং সহযোগিতার ভিত্তি। যাদের মনে সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে ভয় ও সংশয় ছিল, তাদের এক বড় অংশের মনোভাব কিছুটা নরম হতে শুরু করেছিল। সেতু কেবল একটি শারীরিক সংযোগ নয়, এটা ছিল মানুষের মনকে একত্রিত করার চেষ্টা।
এদিকে, গ্রামে অপর্ণা সিংয়ের সমর্থকরা এখন আরও সতর্ক হয়ে উঠেছিল। তারা জানত, সেতু নির্মাণ এখন থামানো সম্ভব নয়, কিন্তু তারা এটাকে একটি ‘বিষফোঁড়’ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল—যে বিষ তাদের সমাজের শৃঙ্খলা ও ঐতিহ্যকে বিপদের মধ্যে ফেলতে পারে। অপর্ণা সিং, যদিও ভেতরে ভেতরে ক্রুদ্ধ ছিলেন, তবে তিনি কিছুটা শান্তভাবে গ্রামবাসীদের মধ্যে আরও বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য কয়েকটি শক্তিশালী আর্গুমেন্ট জমা দিচ্ছিলেন। ‘‘এই সেতু যদি নির্মিত হয়, তাহলে দুই গ্রাম এক হতে বাধ্য হবে, এবং তা আমাদের সংস্কৃতির শৃঙ্খলাকে ভেঙে ফেলবে,’’ তিনি বলতেন, ‘‘আমরা জানি না, এই পরিবর্তন সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে, কিন্তু একটা নিশ্চিত কথা হল—এই সেতু আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের পরিচয় ও আমাদের শ্রেণীভেদ মুছে ফেলবে।’’
তবে, তার এসব কথার মধ্যে এখন কিছুটা দুর্বলতা ফুটে উঠতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা প্রথমবারের মতো তার কথার মাঝে সন্দেহ এবং অস্বস্তি অনুভব করতে শুরু করে। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারছিল, অপর্ণার বক্তব্য তীক্ষ্ণ হলেও বাস্তবতা কিছুটা আলাদা। তারা আফতাবের কথা শুনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সেতু কেবল শারীরিক পথ তৈরি করবে না, এটি সম্পর্ক ও শ্রদ্ধারও পথ খুলে দেবে।
গ্রামের মধ্যে কিছু প্রবীণ ব্যক্তির মনোভাব একদম বদলে যায়। জীবন্তী মিশ্র, যিনি এক সময় আফতাবের সঙ্গে আরও ধীরে চলার পরামর্শ দিয়েছিলেন, এখন সম্পূর্ণভাবে আফতাবের সমর্থনে দাঁড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যা ভয় পাচ্ছি, তা হল এক নতুন পৃথিবী, কিন্তু আমাদের এটাই বুঝতে হবে যে, পরিবর্তন আসবেই। এই সেতু আমাদের সমাজে এক নতুন দিশা দেখাবে, যেখানে আমরা একে অপরকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারব।’’ জীবন্তী মিশ্রের এই বক্তব্য গ্রামবাসীদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করে।
এদিকে, গ্রামে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটতে থাকে। রাজু দাস, যিনি কিছুদিন আগে আফতাবের কাছে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে উঠেছিলেন, তার অবস্থানও কিছুটা পরিবর্তিত হয়। রাজু নিজের কৃষিকাজ এবং গ্রামের জীবনযাত্রার উন্নতির কথা ভাবছিলেন। তিনি বুঝতে পারেন, সেতু শুধুমাত্র একটি রাস্তা নয়, এটি দুটি গ্রামকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসবে, যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হবে। একদিন, তিনি আফতাবের কাছে এসে বলেন, ‘‘তোমার চিন্তা সঠিক, আফতাব। আমি এই পরিবর্তনকে ভয় পাচ্ছি, তবে আমি জানি, আমাদের ভবিষ্যত সেতু নির্মাণের সঙ্গে জড়িত। আমি তোমার পাশে আছি।’’ রাজুর সমর্থন আফতাবকে আরো শক্তি যোগায়।
সেতুর নির্মাণকাজ যখন তীব্র গতিতে এগোচ্ছে, গ্রামে মানুষের মধ্যে এক ধরনের শৃঙ্খলাবোধ এবং সহানুভূতি তৈরি হতে থাকে। গ্রামের অনেক তরুণ তাদের পুরনো চিন্তা-ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করে। তারা জানত, গ্রামগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত না হলে, তারা কখনও পরিপূর্ণ উন্নতি লাভ করতে পারবে না। আফতাব তরুণদের মধ্যে নতুন চিন্তা এবং দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ দেখতে শুরু করেছিল। ‘‘এই সেতু আমাদের ভবিষ্যৎ গড়বে। আমরা এখানে শুধুমাত্র একটি রাস্তা তৈরি করছি না, আমরা একে অপরকে বুঝতে শিখব, শ্রদ্ধা করব।’’
এদিন, সেতুর কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে পৌঁছেছিল, গ্রামে এক বড় উৎসবের আয়োজন করা হয়। এটি ছিল এক উল্লাসমুখর মুহূর্ত, যেখানে দুই গ্রামের মানুষ একে অপরের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিল। এই উৎসব ছিল শুধু সেতু নির্মাণের জন্য নয়, এটি ছিল এক নতুন সমাজের সূচনা, যেখানে মানুষের মধ্যে সহযোগিতা, একতা এবং সমঝোতার জায়গা তৈরি হয়েছিল। আফতাব, জীবন্তী, রাজু, অপর্ণা এবং গ্রামবাসীদের মাঝে এক নতুন ধরনের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল, যদিও কিছু কনফ্লিক্ট এখনও ছিল, তবে তারাই জানতেন যে, একে অপরকে সম্মান করা এবং শ্রদ্ধা করা তাদের সমাজের অগ্রগতির জন্য একমাত্র পথ।
অপর্ণা সিং, যদিও এখনও পুরোপুরি গ্রামে সেতু নির্মাণের পক্ষে আসেননি, কিন্তু তার মনোভাব কিছুটা নরম হয়ে আসে। তিনি অবশেষে স্বীকার করেন, ‘‘এটি আমাদের ঐতিহ্যের বিরোধী না, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটাবে।’’ তিনি জানতেন, তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসা জরুরি ছিল, তবে তিনি পুরোপুরি আফতাবের স্বপ্নে বিশ্বাস না করলেও, তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে শুরু করেছিলেন।
এভাবে, সেতু নির্মাণের কাজ শেষ হওয়ার পর, গ্রামে এক নতুন দিশা দেখতে পাওয়া যায়—একটি দিশা, যেখানে মানুষ একে অপরকে বুঝে, সম্মান করে, এবং নতুন চিন্তা-ভাবনা গ্রহণ করে চলতে শিখেছে। সেতু শুধু দুই গ্রামের মাঝে শারীরিক সংযোগ স্থাপন করেনি, এটি ছিল এক সাংস্কৃতিক এবং মানসিক সংযোগ, যা সমাজের ভেতরে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিল। গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল, পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া, যা কখনও সহজ হয় না, কিন্তু যদি সবার সম্মতিতে চলে, তবে তা সবাইকে এক নতুন দিশা দেখাতে পারে।
সেতু নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর গ্রামে এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। দীর্ঘদিন ধরে যে বিভাজন এবং দ্বন্দ্ব গ্রামে ছিল, তা ধীরে ধীরে মিটে যেতে শুরু করে। নতুন সেতুটি শুধু শারীরিক সংযোগই তৈরি করেনি, বরং মানুষের মধ্যে একটি মানসিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনও আনতে সক্ষম হয়েছে। গ্রামে এখন একটি নতুন ভোর, একটি নতুন আশা দেখা দেয়। আফতাবের স্বপ্ন, যা কখনও শুধুই একটি পথ ছিল, আজ তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে—একটি ঐক্য, সহানুভূতি এবং সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে।
প্রথম দিকে, যখন সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল, গ্রামের মানুষদের মধ্যে দ্বিধা এবং সংশয় ছিল, তবে এখন সেইসব ভয়ের জায়গাগুলো একে একে ভেঙে পড়ছিল। গ্রামবাসীরা আর আগের মতো একে অপরকে শত্রু মনে করত না। বরং, তারা একে অপরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করেছিল। সেতু শুধু দুটি গ্রামকে এক করেছে, তা নয়; এটি মানুষের হৃদয়কেও একত্রিত করেছে।
গ্রামে এখন একটি ঐতিহাসিক উৎসবের প্রস্তুতি চলছিল। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল, যা শুধু একটি শারীরিক প্রাপ্তির উৎসব নয়, বরং এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক পুনর্নির্মাণের সূচনা। গ্রামবাসীরা নিজেদের মধ্যে শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক সেতু তৈরি করার পথে চলছিল। আফতাব, জীবন্তী, রাজু, অপর্ণা, এবং অন্য সব গ্রামবাসী—যারা এক সময় একে অপরের প্রতি সন্দেহ এবং শত্রুতা অনুভব করতেন—আজ সবাই একসঙ্গে কাজ করছিল।
অপর্ণা সিং, যিনি সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন, আজ অবশেষে আফতাবের সাথে একমত হয়ে গ্রামে আসেন। তিনি তার সমর্থকদের মধ্যে গিয়ে বলেন, ‘‘এখন আমি বুঝতে পারছি, আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখা হলেও, পরিবর্তন এড়ানো সম্ভব নয়। সেতু নির্মাণ আমাদের ঐতিহ্যের ধ্বংস নয়, বরং একটি নতুন সমাজের সৃষ্টি।’’ অপর্ণার এই বক্তব্য গ্রামবাসীদের মধ্যে একটি নতুন উপলব্ধি তৈরি করে, যে, শুধু পুরনো চিন্তাধারা নয়, আমাদের ভবিষ্যতও আমাদের হাতে। তারা বুঝতে পারে, সেতু কেবল একটি শারীরিক কাঠামো নয়, এটি ছিল একসঙ্গে চলার পথ—যেখানে সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং নতুন চিন্তা একত্রিত হয়ে একটি নতুন সমাজ গড়ে উঠবে।
উৎসবের দিন, সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্রামে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়। গ্রামবাসীরা আনন্দে মেতে ওঠে, যেভাবে তারা কখনো চিন্তাও করতে পারেনি। তাদের চোখে এক নতুন আশা, এক নতুন ভবিষ্যতের প্রতীক ছিল। সেতুর উদ্বোধন অনুষ্ঠান ছিল শুধু এক শারীরিক কাঠামোর উদ্বোধন নয়, বরং এটি ছিল মানুষের মানসিক এবং সামাজিক নির্মাণেরও উদ্বোধন। আফতাব এবং জীবন্তী মিশ্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন, এবং গ্রামবাসীদের উদ্দেশে আফতাব বলেন, ‘‘এটি আমাদের ঐক্য এবং সমঝোতার জয়। আজ আমরা যে সেতু তৈরি করেছি, তা শুধু একটি রাস্তা নয়, এটি আমাদের ভবিষ্যতের পথ।’’
রাজু দাস, যিনি আগে দ্বিধাবিভক্ত ছিলেন, এখন পুরোদমে আফতাবের পাশে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানটি উপভোগ করছিল। তিনি জানতেন, সেতু নির্মাণের ফলে তার কৃষিকাজ ও ব্যবসায় উন্নতি আসবে, তবে তার চেয়ে বড় বিষয় ছিল, সেতু সমাজের মধ্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, যা পূর্বে কখনও ছিল না। রাজু অনুভব করেছিল, ‘‘আজকে আমরা শুধু একটি সেতু নির্মাণ করিনি, আমরা একটি নতুন ভবিষ্যত গড়েছি, যেখানে আমরা একে অপরকে সম্মান করব, একে অপরকে সহযোগিতা করব।’’
এদিকে, অপর্ণা সিং, যিনি একসময় সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে ছিলেন, আজ অবশেষে বুঝতে পারেন, পরিবর্তন প্রতিটি মানুষের জীবনে আসবেই। তিনি জানতেন, সেতু কেবল একটা শারীরিক কাঠামো নয়, এটি মানুষের জীবনে এমন এক নূতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এসেছে, যা গ্রামগুলির জন্য একটি আশীর্বাদ হতে পারে। অপর্ণা, যখন সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘এটা একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সমন্বয় ঘটবে।’’ তার এই কথা গ্রামবাসীদের মনে গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়।
এছাড়া, জীবন্তী মিশ্রের মুখে ছিল সন্তুষ্টির হাসি। তিনি জানতেন, সেতু নির্মাণের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের মধ্যে যে বিভাজন ছিল, তা দূর হয়েছে। তিনি জানতেন, এই সেতু শুধু সড়ক নয়, এটি ছিল এক নতুন সমাজের জন্য এক অমূল্য ভিত্তি। তিনি মনে করলেন, ‘‘এটি আমাদের পরিবর্তনকে গ্রহণ করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।’’
এভাবে, গ্রামে সেতু উদ্বোধন সম্পন্ন হওয়ার পর, গ্রামবাসীরা একে অপরকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারল। পূর্বে যে কিশোররা একে অপরকে অচেনা মনে করত, তারা আজ একসঙ্গে হাসিখুশি হয়ে কাজ করছিল। যে শ্রেণীভেদ এতদিন বিরাজমান ছিল, তা এখন ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করে। সেতু নির্মাণের পর গ্রামে এক নতুন ধারা তৈরি হয়েছিল, যেখানে সবাই একে অপরকে সাহায্য করছিল, শ্রদ্ধা করছিল। গ্রামটি আর একক সংস্কৃতির ছিল না; এটি ছিল একে অপরের চিন্তা, মেধা এবং শ্রদ্ধার মিশেল।
এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে দুই গ্রাম এক হয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, সহযোগিতা এবং ঐক্যের পথে চলতে শুরু করেছিল। সেতু নির্মাণ, যা একসময় একটি বিভেদ সৃষ্টি করেছিল, আজ তা ঐক্য এবং সমঝোতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। গ্রামে এক নতুন সূচনা হয়েছিল—একটি নতুন দিগন্তের দিকে যাত্রা।
				
	

	


