Bangla - সামাজিক গল্প

ছোট্ট সোনালী সেতু

Spread the love

প্রিয়া সরকার


গ্রামের মাঝে যখন একটি সেতু নির্মাণের প্রস্তাব উঠলো, তখন তা সাধারণত গ্রামবাসীদের মধ্যে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হিসেবে ভাবা হয়। সেতু হবে দুই গ্রামের মধ্যে, একটি ছোট গ্রাম, অপরটি বড়। দুটো গ্রামের মানুষদের মাঝে দূরত্ব ছিল শুধু শারীরিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকও। গ্রামগুলো একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং একে অপরকে প্রায় কখনোই বুঝতে পারত না। আফতাব রহমান, এক তরুণ নেতা, জানত এই সেতুর মাধ্যমে শুধু দূরত্বের অভাবই পূর্ণ হবে না, বরং দুই গ্রামের মধ্যে এক শক্তিশালী সামাজিক ঐক্যও প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু, গ্রামবাসীরা জানত না যে, তাদের মধ্যে এক দীর্ঘকাল ধরে থাকা বিভেদ, সমাজের ঐতিহ্য এবং শ্রেণীভেদ এমন এক জটিল সমস্যার সৃষ্টি করবে যা এই সেতু নির্মাণের পথে এক বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আফতাব সে প্রস্তাব নিয়ে প্রথমবার গ্রামে আসেন, কিন্তু গ্রামবাসীদের প্রতিক্রিয়া খুবই মিশ্র ছিল। কেউ আনন্দিত, কেউ আবার ভয় পেয়ে গিয়েছিল। অপর্ণা সিং, গ্রামের এক প্রখ্যাত মহিলা, যিনি অনেকটা সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতীক, তিনি একেবারে এই সেতুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান। তার মতে, সেতু শুধু শারীরিকভাবে না, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিকভাবে গ্রামগুলোর মধ্যে যে বিভাজন রয়েছে, তা আরো গভীর করবে। তিনি জানতেন, যে ঐতিহ্য ও সমাজের শ্রেণীভেদ রক্ষা করার জন্য তাদের কঠিন সংগ্রাম করতে হবে, যাতে সেতু তাদের ন্যায্যতা ও ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ না করে। তবে, আফতাব কোনোভাবেই হাল ছাড়তে চাননি। তার বিশ্বাস ছিল যে, সেতু নির্মাণ গ্রামগুলোর মধ্যে নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি আনবে, যা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হবে না, বরং এক সামাজিক বিপ্লবের সূচনা করবে।

গ্রামের মধ্যে এই সেতু নিয়ে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। আফতাব সবার সামনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, “এই সেতু শুধু রাস্তা নয়, এটি একটি নতুন পথ দেখাবে, যেখানে আমরা একে অপরকে বুঝবো, সম্মান করবো এবং একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে পারবো।” কিন্তু অপর্ণা সিংয়ের মতো রক্ষণশীলদের মুখে কোনো হাসি ছিল না। তিনি মনে করেন, সেতুর মাধ্যমে শুধু গ্রামগুলোর একাত্মতাই হবে না, বরং তা হবে পুরনো সমাজের নিয়মের জন্য এক বড় ধাক্কা। তিনি এবং তার সমর্থকরা চিন্তা করছিলেন যে, সেতু গ্রামগুলোর মধ্যে যে পিতৃপুরাণের আধিপত্য রয়েছে, তা ধ্বংস করতে পারে। তাদের ধারণা ছিল যে, যদি দুই গ্রাম একে অপরের মধ্যে মিশে যায়, তবে তা তাদের সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলবে। অপর্ণার কথায়, “সেতু আমাদের ঐতিহ্যকে বিপর্যস্ত করবে। এই বিভাজন এবং শ্রেণীভেদ তো আমাদের সামাজিক কাঠামোরই অঙ্গ, তার প্রতি আঘাত হবে এটি।” একদিকে গ্রামে সংঘর্ষের সম্ভাবনা, অন্যদিকে আফতাবের প্রতিশ্রুতি—এই দুই মেরু গ্রামবাসীকে বিভক্ত করে রাখে। তাদের মধ্যে কিছু মানুষ আফতাবের পাশে দাঁড়ায়, কিন্তু অনেকেই অপর্ণার দিকে চলে যায়। এই অবস্থা দেখে জীবন্তী মিশ্র, যে একজন মধ্যবয়সী মহিলা, সেতুর পক্ষে হলেও মনে মনে কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি জানতেন যে, কিছু কিছু গ্রামবাসী এখনও পুরনো নিয়মের প্রতি ভালোবাসা রাখতে চান এবং তারা সামাজিক পরিবর্তন মেনে নিতে দ্বিধাগ্রস্ত। কিন্তু, জীবন্তী আফতাবের সঙ্গে পুরোপুরি একমত ছিলেন। তিনি মনে করতেন, পরিবর্তন আসবেই, এবং সেতু সেই পরিবর্তনের সূচনা।

সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রামে দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে, তবে কিছু গ্রামবাসী এখনও এই প্রস্তাব নিয়ে সন্দিহান ছিল। রাজু দাস, গ্রামের একজন কৃষক, তার মনে দ্বিধা পোষণ করেন। রাজু জানতেন, সেতু নির্মাণ তার জন্য আর্থিক এবং সামাজিক সুবিধা নিয়ে আসবে, তবে তার ভয় ছিল—এই পরিবর্তন তাকে এবং তার গ্রামের মানুষদের খুব দ্রুত বড় কোনো ঝামেলায় ফেলতে পারে। তিনি জানতেন, গ্রামের কিছু মানুষ পুরনো নিয়মের প্রতি খুবই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তাদের পক্ষে এধরনের আধুনিক উদ্যোগ মেনে নেয়া কঠিন হবে। তবুও, রাজু আফতাবের প্রতি নিজের আস্থা হারাননি, কিন্তু তার মনে কিছুটা আশঙ্কাও ছিল। গ্রামে তখন শুধু সামাজিক সংঘর্ষ নয়, একটি একান্ত মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বও শুরু হয়ে গিয়েছিল। একদিকে, এই সেতুর মাধ্যমে গ্রামগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বাড়বে, অন্যদিকে, এই যোগাযোগের মাধ্যমে পুরনো প্রথা এবং শৃঙ্খলাও ভেঙে যেতে পারে। জীবনযাত্রার মধ্যে যদি এই পরিবর্তন আসে, তবে তা কী গ্রামবাসীদের মনোবলে আঘাত হানবে না? এই প্রশ্ন তার মনের মধ্যে চলছিল, কিন্তু তবুও তিনি আশা করতেন, সেতু নির্মাণের ফলে সব সমস্যার সমাধান হবে। তবে, গ্রামে এখনো একটি অস্থিরতা বিরাজমান ছিল, যা সেতু নির্মাণের আসন্ন শুরুতে আরো তীব্র হয়ে উঠবে।

WhatsApp-Image-2025-07-05-at-3.06.06-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *