Bangla - প্রেমের গল্প

ছেঁড়া পাজলের ভালোবাসা

Spread the love

সায়নী বসু


শীতল জানলার কাচে ভোরের শিশির জমেছে, আলো এসে পড়েছে থেরাপি রুমের কাঠের মেঝেতে। ড. মেঘলা দত্ত প্রতিদিনের মতো আজও ক্লিনিকের টেবিলে বসে, পেশেন্ট ফাইল ঘাঁটছেন। ঘড়িতে তখন সাড়ে ন’টা। নতুন রোগী আসার কথা সাড়ে দশটায়—রেফার করা হয়েছে একটি সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র থেকে। “স্মৃতিভ্রষ্ট, আচরণ স্বাভাবিক, অস্থায়ী আবাসন হোমে রাখা হয়েছে,”—এইমাত্র এমন একটি রোগী এসেছেন যার জীবন যেন এক ছেঁড়া পাজল। মেঘলা চোখ বুলিয়ে নেয় রিপোর্টে, কিন্তু বিশেষ কিছু ধরা পড়ে না। তার মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা কাজ করে, কারণ এই ধরনের রোগীদের মাঝে প্রায়ই এমন কিছু থেকে যায়, যা রিপোর্টে ধরা পড়ে না—হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, অসম্পূর্ণ গল্প, বা মুখের রেখায় আটকে থাকা চেনা যন্ত্রণার ছায়া। সে জানে, সে নিজেও তো এমন এক গল্পের মাঝে আটকে আছে—ছয় বছর আগে যার পরিণতি মেলেনি, যার উত্তর খুঁজে পায়নি সে কখনও।

দশটা বেজে তেত্রিশ। রুমের দরজা ঠেলেই ভেতরে ঢুকে আসে একজন পুরুষ—চোখে ক্লান্তি, মুখে নিস্তব্ধতা। পরনের শীতের সোয়েটার, উঁচু গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে একটি আঁচল-ধরা গলার দাগ, যেন পুরনো জীবনের ছায়া লেগে আছে তার শরীরে। মেঘলা উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, “দয়া করে বসুন,” কিন্তু তার চোখ স্থির হয়ে যায় পুরুষটির চোখে—এ যে ঋভু! ছয় বছর আগে হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া সেই প্রেমিক, যার খোঁজ করতে করতে সে এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ঋভুর চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, কোনো চিন্তার রেখা নেই, শুধু একটা স্থির প্রশ্ন—”আমার নাম কী?” মেঘলা কোনো কথা বলে না, তার কণ্ঠ শুকিয়ে যায়। এই মানুষটা কি সত্যিই ঋভু, না কি তার মতো দেখতে কেউ? সে চোখ সরিয়ে ফাইল খুলে দেখে—”নাম নেই। বয়স আনুমানিক ৩৫। ভাষায় স্পষ্টতা আছে, তবে স্মৃতি নেই। বারবার ঘুমে কিছু দৃশ্য দেখতে পান—একটা ভাঙা ঘর, ঝড়ো হাওয়া, আর একটা মুখ।” মেঘলা মাথা নিচু করে রাখে, যেন চোখের জল লুকোতে চায়। তার চোখের সামনে একে একে ভেসে ওঠে পুরনো মুহূর্ত—রবিবার সকালের চায়ের কাপ, ঝড়ের রাতে দু’জনে একসাথে একটি ভাস্কর্য তৈরি করা, আর সেই শেষ চুম্বন, যার পরে ঋভু হঠাৎই উধাও হয়েছিল।

“আপনি কিছু মনে করতে পারেন?” সে জিজ্ঞেস করে নিজের কণ্ঠকে স্বাভাবিক রেখে। ঋভু মাথা নাড়ায়, “কখনও মনে হয়, আমি কিছু হারিয়েছি। মাঝে মাঝে একটা মুখ চোখে ভেসে ওঠে—সে যেন বলে, ‘পাজলের শেষ টুকরোটা কোথায়?’” মেঘলা টেবিলের নিচে নিজের আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে। এটা সে-ই—এই কথা তো একদিন সে-ই বলেছিল, যখন তারা একসাথে একটি পাজল ভাস্কর্য তৈরি করছিল। “আপনার ঘুমে কী দেখেন?” প্রশ্নটি নিছক পেশাগত, কিন্তু তার ভিতরে ঝড় বইছে। ঋভু চোখ বন্ধ করে বলে, “ঝড়… একটা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে। তার গলায় নীল স্কার্ফ। আমি চিৎকার করে কিছু বলি, কিন্তু সে শুধু তাকিয়ে থাকে। তারপর সব অন্ধকার।” মেঘলার বুকের গভীরে ছ্যাঁকা লাগে—নীল স্কার্ফ ছিল তার প্রিয়, যেটা ঋভু দিয়েছিল। সে জানে না কীভাবে এই স্মৃতি এখনো ঋভুর মনের অতলে বেঁচে আছে। মেঘলা ফাইল বন্ধ করে বলে, “আজকের মতো এই পর্যন্ত থাক। আমি চাই আপনি আগামীকাল আবার আসুন। আমরা ধীরে ধীরে কথা বলব, ছবি আঁকতে বলব, হয়ত আপনি নিজেকে খুঁজে পাবেন।” ঋভু উঠে দাঁড়ায়, মেঘলার চোখে তাকিয়ে বলে, “আপনার গলার আওয়াজটা খুব চেনা লাগছে, জানেন?” মেঘলা হাসে না, শুধু বলে, “স্মৃতিগুলো কখনও একেবারে মুছে যায় না।” ঋভু বেরিয়ে গেলে, মেঘলা দরজা বন্ধ করে দেয়। জানলার কাচে শিশিরের বদলে তখন জল গড়িয়ে পড়ছে—তাকে দেখে মনে হয়, যেন চোখের জল পড়ছে একটা অদৃশ্য পাজলের ওপর, যার কোনোদিন পূর্ণতা আসবে না।

***

মেঘলার ঘরে সেই সকালটা অন্যরকম। বাইরে মেঘ জমেছে, কিন্তু তার মনজুড়ে যেন এক অদ্ভুত রোদ এসে দাঁড়িয়ে আছে—ছেঁড়া রোদ, যেমনটা হয় কোনো হারিয়ে যাওয়া বিকেলে। আজ ঋভুর দ্বিতীয় সেশন। সে আজও নির্ধারিত সময়েই আসে, নির্ভুলভাবে। কিন্তু তার চলাফেরায় এমন এক সংযত নির্লিপ্ততা, যা চোখে পড়লেও ব্যাখ্যা করা যায় না। মেঘলা তাকে বসতে বলার আগেই ঋভু পকেট থেকে কিছু কাগজ বার করে বলে, “আমি আঁকতে শুরু করেছি। আপনি বলেছিলেন, যা মনে আসে তাই আঁকতে।” কাগজগুলোতে রঙিন পেনসিলে আঁকা কিছু ছবির মাঝে একটিতে দেখা যায় এক নারীকে—লম্বা চুল, চোখে গভীরতা, আর গলায় নীল স্কার্ফ। মেঘলা মুহূর্তের জন্য দম বন্ধ করে চেয়ে থাকে। সে নিজেকে চিনতে পারে ছবির রেখায়, কিন্তু ঋভুর মুখে কোনোকিছু চিনে ফেলার চিহ্ন নেই। সে বলে, “এই মেয়েটা কে, জানি না। কিন্তু এই মুখটা বারবার মাথায় আসে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি তার হাত ধরেছিলাম। আবার কখনো মনে হয় সে চলে যাচ্ছে।” মেঘলার মুখ থমথমে, তবু শান্ত। সে জানতে চায় না এখনই কিছু, জানে, অত তাড়াহুড়ো করলে স্মৃতির পর্দা আরও ধোঁয়াটে হয়ে যাবে।

“আপনি যখন এই ছবি আঁকেন, তখন কেমন অনুভব করেন?” সে জিজ্ঞেস করে। ঋভু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “আধেক শান্তি, আধেক হাহাকার। যেন কিছু প্রায় পাওয়া—কিন্তু ঠিক ধরতে পারছি না।” মেঘলা বুঝতে পারে—ঋভুর মধ্যে গভীর এক মানসিক ক্লেদ জমে আছে। সে তাকে আরেকটি পদ্ধতির প্রস্তাব দেয়—“আপনি কি কখনো পাজল খেলেছেন?” ঋভু অবাক হয়, “ছোটবেলায়… বা হয়তো পরে? মনে নেই। তবে আমি সবসময় অসম্পূর্ণ ছবি পছন্দ করতাম।” মেঘলা তাকে একটি ৫০-পিসের পাজল দেয়, যার মাঝের কিছু টুকরো ইচ্ছাকৃত বাদ দেওয়া ছিল। ঋভু সেটি হাতে নিয়ে বলে, “এই টুকরোগুলো যদি না থাকে, পুরো ছবিটা তো বোঝা যাবে না।” মেঘলা মৃদু হেসে বলে, “জীবনের অনেক ছবিও এমনই হয়—সব টুকরো থাকে না, কিন্তু তাও আমরা বোঝার চেষ্টা করি।” এই প্রথমবার, ঋভু কিছুটা স্থিরভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, বলে, “আপনার চোখে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি আছে, যেন আমি আগে কোথাও দেখেছি।” মেঘলা চমকে ওঠে, কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “অজানা কিছু চিনে ফেলা মানেই তা অতীত নয়।” তারা দুজনে কয়েক মিনিট নীরব থাকে, কেবল পাজলের টুকরোগুলো ঘোরাফেরা করে তাদের আঙুলের ফাঁকে—জীবনের মতোই, কোথায় কোন টুকরো বসবে তা বুঝে ওঠা কঠিন।

সেশন শেষে ঋভু উঠে দাঁড়ানোর আগে পেছনে তাকিয়ে বলে, “এই মেয়েটা”—সে ইঙ্গিত করে তার আঁকা ছবির দিকে—“আমার মনে হয়, আমি তাকে হারিয়েছি। কিন্তু সে এখনও আছে কোথাও, আমার ভিতর।” মেঘলা থেমে যায়। চোখ নামিয়ে বলে, “হারানো সবই হারিয়ে যায় না, কেউ কেউ থেকে যায় সময়ের বাইরে, স্পর্শের বাইরে।” সে জানে এই মুহূর্তে সে কেবল একজন থেরাপিস্ট নয়, সে এক পুরনো প্রেমিকার ছায়া, এক অসমাপ্ত গল্পের জীবন্ত অংশ। ঋভু চলে গেলে, মেঘলা ছবিগুলো একে একে গুছিয়ে রাখে, কিন্তু একটিকে আলাদা করে টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখে—সেইটিই, যেখানে ‘সে’ নিজেকে দেখেছে। থেরাপি ঘরের দেয়ালে তখন মেঘলার নিজের মুখ, নিজের স্মৃতি, নিজের গোপন কান্না যেন আঁকা হয়ে গেছে—কিন্তু কোনো রঙে নয়, নিঃশব্দ রেখায়, যা শুধুই দু’জনের জানা।

***

ঋভুর থেরাপি সেশনগুলো নিয়মিত চলতে থাকে। সে ধীরে ধীরে খুলে বলছে তার অস্থির স্বপ্ন, তার অকারণ বিষণ্ণতা, আর কিছু আবছা দৃশ্য যা কোনো পূর্ণ গল্পে গাঁথা নয়, বরং যেন খণ্ড খণ্ড স্লাইডশো। তৃতীয় সপ্তাহে, সেশনের মাঝপথে হঠাৎ সে বলে বসে—“আমার ঘুমে একটা নাম আসে বারবার… তারা।” মেঘলার বুক কেঁপে ওঠে। সে জানে, এ নাম ঋভু জীবনে প্রথম শুনেছিল তার মুখে, ভালোবাসার সময়ে, যখন তারা দুজনেই এই বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইত আর একে অপরকে নামহীন এক দুনিয়ায় নতুন নামে ডাকত। ‘তারা’ ছিল সেই দুনিয়ার নাম, সেই ছদ্মনাম—মেঘলার নিজেরই বেছে নেওয়া। “তারা কে?”—মেঘলার প্রশ্ন যেন নিজেকেই বিদ্ধ করে। ঋভু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “জানি না। কিন্তু তার নাম বললেই বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপন ধরে যায়। যেন কেউ ডাকছে, অথচ শব্দ শোনা যাচ্ছে না।”

সেদিন রাতে মেঘলা একা বসে তার পুরনো চিঠিগুলো বের করে। একটি চিঠিতে লেখা ছিল: “তারা, তোমার নামটাই আমার পিছুটান। যদি কখনো কিছু মনে না থাকে, তবুও এই নামটা যেন আমাকে জাগিয়ে দেয়।” সেই লাইনটা তার মাথায় গেঁথে যায়। মেঘলা বুঝতে পারে, ঋভুর স্মৃতি ভেঙে গেছে ঠিকই, কিন্তু সবকিছু হারায়নি—অনুভবের স্তর, যেটা বেঁচে থাকে স্মৃতির উর্ধ্বে, সেটা টিকে আছে। পরদিন সেশনে সে একটি রোলপ্লে থেরাপির প্রয়োগ করে। সে বলে, “আজ আমরা একটা গল্প খেলব। আপনি একটা চরিত্র হবেন, যার সব কিছু হারিয়েছে, আর আমি হবো সেই কেউ যাকে সে খুঁজে বেড়ায়।” ঋভু দ্বিধা নিয়ে রাজি হয়। খেলায় সে বলে, “আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। একটা নদীর পাড়ে এক মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল… তার নাম মনে নেই, কিন্তু সে আমার নাম বলত…” মেঘলা শান্ত গলায় বলে, “সে কি তোমায় ‘ঋভু’ বলে ডাকত?” এই প্রথম ঋভুর শরীর ঝাঁকিয়ে ওঠে। সে চোখে জল নিয়ে বলে, “হ্যাঁ… কে আপনি?” মেঘলা থেমে যায়, কথা গলায় আটকে যায়, সে জানে সে এই মুহূর্তে সীমা অতিক্রম করছে। কিন্তু তার চোখ বলে দেয় সব।

তারপর দিনগুলো পাল্টায়। ঋভু আঁকা শুরু করে এক নতুন ছবি—একটি পাজলের টুকরো হাতে এক নারী দাঁড়িয়ে আছে, পেছনে এক ঝড়ো আকাশ। সে ছবিটা দেখিয়ে বলে, “এই পাজলটা অসম্পূর্ণ। আমি জানি না কেন, কিন্তু আমার মনে হয়, এই মেয়েটি সেই শেষ টুকরোটা হারিয়ে ফেলেছে।” মেঘলার চোখে জল আসে। সে নিজেও জানে, এই নারীটা সে-ই, এই পাজলের টুকরোটা তার হাতেই ছিল একসময়, কিন্তু সে দিতে পারেনি। তার মনে পড়ে সেই ঝড়ের রাত—যেদিন তারা শেষবার দেখা করেছিল। ঝড়ের শব্দে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল তাদের কথোপকথন, আর এক ভুল বোঝাবুঝিতে ঋভু হেঁটে গিয়েছিল অজানার দিকে, আর মেঘলা বসে ছিল সেই স্টুডিওর এক কোণে, একটা চিঠি হাতে, যেটা আর কখনো খোলা হয়নি। ঋভু এখনও কিছু মনে করতে পারে না পুরোপুরি, কিন্তু তার স্বপ্নে, তার আঁকায়, তার দৃষ্টি এবং চুপচাপ প্রশ্নে—মেঘলা বুঝতে পারে, অতীত ফিরে আসছে, কেবল তার ভাষা পাল্টে গেছে। কিন্তু সে জানে, ভাষা যতই পাল্টাক, ভালোবাসার ছেঁড়া পাজল একদিন নিজের পথ খুঁজে নেয়। প্রশ্ন একটাই—ঋভু যদি সব মনে পড়ে, সে কি ক্ষমা করবে? ভালোবাসা কি আবার জন্ম নিতে পারবে সেই পুরনো ক্ষতবিক্ষত মাটিতে?

***

বৃষ্টি ভেজা সকালে থেরাপি সেন্টারে যখন সবকিছু নিস্তরঙ্গ, তখন এক অচেনা মুখ ঢোকে রিসেপশনে—উজ্জ্বল চোখ, কাঁচের ফ্রেমের চশমা আর হাতে ধরা একটা টিউব ক্যানভাস। তার নাম তিস্তা পাল, একজন আর্ট কিউরেটর, শহরের একটি গ্যালারিতে কাজ করে। সে জানতে চায়, এখানে কি একজন রোগী আছে যার নাম মনে নেই, কিন্তু সে হয়তো একজন ভাস্কর ছিলেন? রিসেপশনিস্ট তাকে ড. মেঘলার কাছে পাঠায়। মেঘলা প্রথমে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও তিস্তার হাতের ছবিটা দেখে থমকে যায়—এটা সেই পাজল-ভিত্তিক ভাস্কর্যের অংশ, যা ঋভু ছয় বছর আগে তৈরি করেছিল তাদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে। সেই অসমাপ্ত ভাস্কর্য, যার নাম ছিল “Incomplete Memory।” তিস্তা জানায়, “এই ভাস্কর্যটা এক অজানা শিল্পীর—কোনো নাম নেই, শুধু কয়েকটি আদ্যাক্ষর—R.S. আমি বহুদিন ধরে খুঁজছি তাকে। কিছু সূত্র আমাকে এই থেরাপি ক্লিনিকে টেনে এনেছে। আপনার একজন রোগী কি সম্ভবত…?”

মেঘলার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সে পেশাদার গাম্ভীর্য বজায় রেখে বলে, “আমার রোগীদের বিষয়ে কিছু বলা ঠিক নয়। তবে আপনি কি বলবেন, আপনি কেন এতটা খুঁজছেন তাকে?” তিস্তা ক্যানভাস খুলে দেখায় একটি স্কেচ—তিনটি মানুষের ছবি: একজন পুরুষ, একজন নারী এবং মাঝখানে এক অসম্পূর্ণ পাজল অংশ। সে বলে, “এই ভাস্কর্যটার ভেতর কোনো এক আবেগ আছে—আমি এক প্রদর্শনীতে এই কাজটা দেখি, তারপর থেকে এর পেছনে ছুটছি। এটি শুধু শিল্প নয়, মনে হয় যেন এক ব্যক্তিগত গল্প যা শেষ হয়নি।” মেঘলার গলা শুকিয়ে আসে। তার চোখে ঋভুর সেই চেনা পাগলাটে মুখটা ভেসে ওঠে, যে তাকে ‘তারা’ বলে ডেকে বলেছিল—“আমরা এক পাজল, যার শেষ অংশ একে অপরের হৃদয়ে লুকানো।”

সেদিন সন্ধ্যায়, ঋভুর সেশন শেষে মেঘলা তাকে ছবিগুলো দেখায়। ছবি দেখেই ঋভুর চোখ ছলছল করে ওঠে। সে ফিসফিস করে বলে, “এই টুকরোটা… আমি জানি এটা কোথায় ছিল একসময়। আমি খুঁজে ফিরেছি… মনে পড়ে না কোথায়, কিন্তু এই ছবি আমি অনেকবার ঘুমে দেখেছি।” মেঘলা তার দিকে তাকায়, দেখে তার ঠোঁট কাঁপছে। কিন্তু তার স্মৃতি এখনও ধোঁয়াটে, যেন জলের নিচে থাকা রঙিন কাপড়—স্পষ্ট, অথচ ধরা যায় না। ঠিক সেই মুহূর্তে তিস্তা ঘরে প্রবেশ করে। সে ঋভুকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। “তুমি…?”—তার গলা স্তব্ধ হয়ে যায়। ঋভু তাকিয়ে থাকে, একটু কপাল কুঁচকে বলে, “আপনি কে? আপনি কি আমাকে চিনেন?” তিস্তা সাড়া দেয় না, শুধু চোখ ভরে ওঠে জল দিয়ে। সে মুখ ফিরিয়ে নেয়, আর মেঘলার দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে বেরিয়ে যায়।

মেঘলা বুঝতে পারে, অতীত এখন শুধু তার আর ঋভুর মধ্যে নেই—এতে জড়িয়ে পড়ছে বাইরের জগত, স্মৃতি, শিল্প, আর মানুষ, যারা সেই পাজলের ছেঁড়া অংশ নিজেরাও হয়ে উঠেছে। একদিকে তিস্তার সন্দেহ, অন্যদিকে ঋভুর মনের দ্বন্দ্ব, এবং মেঘলার নিজের ভালোবাসা—সব মিলিয়ে গল্পটা আর নিছক থেরাপির পরিসরেই থাকছে না। এটা এক মানসিক পুনর্জন্মের পথ, যেখানে প্রেম, পেশা, এবং অপরাধবোধ একই সাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে, এক ভাঙা ভাস্কর্যের চারপাশে, যার শেষ টুকরো হয়তো কারো হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেছে—অপেক্ষায়।

***

রাত গভীর। জানলার বাইরেই একটা রাস্তার বাতি কাঁপছে বাতাসে, তার আলো এসে পড়ে মেঘলার ডেস্কে রাখা চিঠির উপর। সেই চিঠি—যেটা ছয় বছর আগে লিখে ঋভুকে দিতে চেয়েছিল, কিন্তু পারিনি। তখনকার ঝড়ের রাতে তারা ভুল বুঝেছিল একে অপরকে, ছোট একটা ঝগড়ায় জন্ম নিয়েছিল এক বিশাল দূরত্ব, আর সেই দূরত্ব পেরিয়ে ঋভু নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, চিঠিটা থেকে গিয়েছিল মেঘলার বুকের ডায়েরির মধ্যে। আজ, এতগুলো বছর পর, সে আবার এসেছে তার সামনে—তবে একজন রোগীর পরিচয়ে, ভুলে যাওয়া স্মৃতির ভারে নত হয়ে। আজ সেই চিঠিটা আবার পড়তে গিয়ে মেঘলা বুঝতে পারে, এই কাগজটা যতটা না ভাষা বহন করে, তার চেয়ে বেশি বোঝায় না-বলা শব্দ, না-ঘটা অনুভব। সে ঠিক করে, এবার আর সে চুপ থাকবে না। তাকে সব জানাতে হবে, কিন্তু কীভাবে? সে কি শুধু রোগী হিসেবে তাকে গ্রহণ করবে, না কি হারানো প্রেমিক হিসেবে পুনরায় তাকে ফিরে চাইবে?

পরদিন, সেশন শুরু হতেই মেঘলা কাঁপা গলায় বলে, “আজ আমরা কিছু আলাদা করব।” সে ঋভুকে একটি আয়না দেয়—পুরনো, একটু ভাঙা ধাঁচের কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো। “আপনি নিজের মুখে কী দেখেন?” ঋভু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “অচেনা। এই চোখটা চেনা, কিন্তু আমি জানি না কে আমি। মনে হয়, কেউ আমার ভিতর বাস করে, যার কথা আমি জানি না।” মেঘলা ধীরে বলে, “ধরুন, আমি বলি আপনি একজন শিল্পী ছিলেন… নাম ছিল ঋভু সেন… আপনি একটা পাজল ভাস্কর্য বানাতেন, যেখানে ভালোবাসা লুকানো থাকত… আপনি ভালোবাসতেন একজনকে, যার নাম ছিল ‘তারা’।” কথাগুলো ঋভুর মনে যেন কোথাও ধাক্কা খায়। সে হঠাৎ আয়না সরিয়ে চোখ চেপে ধরে। “তারা… সেই নামটা আমি স্বপ্নে শুনি। আপনি কী করে জানলেন?” মেঘলা এবার ধীরে ডায়েরির ভাঁজ থেকে চিঠিটা বের করে দেয় তার হাতে। “এইটা তুমি আমায় পড়ে শোনাতে বলেছিলে, পড়িনি। আজ আমি পড়তে চাই।” তার কণ্ঠে আর কোনো পেশাদার মুখোশ নেই—শুধু এক নারীর বুকভরা কান্না।

ঋভু কাগজটা নেয়, তাতে লেখা—“তুমি যদি চলে যাও, আমি তোমাকে দোষ দেব না। যদি ভুলে যাও, আমিও মনে রাখব আমাদের সময়টুকু। কিন্তু যদি কোনোদিন ফিরে আসো, আমি ঠিক এখানেই থাকব—আমাদের পাজলের শেষ টুকরো হয়ে।” সে বারবার পড়ে, বারবার চোখ বেয়ে জল গড়ায়। একটা সময় সে মেঘলার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তুমি তাহলে… তারা?” মেঘলা মাথা নাড়ায়, ঠোঁটে এক ফাঁকা হাসি, চোখে বেদনার আলো। ঋভু তার কপাল ধরে ফেলে, যেন মাথার ভিতর কিছু ফেটে বেরোতে চাইছে। হঠাৎ সে বলে, “ঝড়ের রাতে… আমি স্টুডিও থেকে পালিয়েছিলাম, কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি চলে গেছো।” এরপর সে থেমে যায়। মেঘলা এগিয়ে এসে বলে, “আমি তো এসেছিলাম তোমার কাছে, চিঠি নিয়ে… তুমি ছিলে না। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেছো।” দু’জনেই চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ—ঘরে যেন নিঃশব্দে কেঁপে ওঠে অতীতের প্রেত।

সেদিন সেশন শেষে ঋভু চলে যাওয়ার আগে শুধু বলে, “আমার মনে পড়ছে… সব নয়, কিন্তু কিছু কিছু… মুখ, শব্দ, সেই পাজল ভাস্কর্য…” মেঘলা আর কিছু বলে না, শুধু জানালার বাইরে তাকায়। সেই ভাঙা আয়নায় সে নিজেকেই দেখতে পায়—একজন থেরাপিস্ট, একজন প্রেমিকা, একজন সাক্ষী যে নিজের জীবনের অসম্পূর্ণ অধ্যায়কে সামনে বসে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখছে। আর আয়নার ফ্রেমে খোদাই হয়ে থাকে একটি অদৃশ্য প্রশ্ন—ভালোবাসা কি স্মৃতি ছাড়া টিকে থাকতে পারে?

***

সেদিন রাতে বৃষ্টি নামে শহরে, যেন কেউ অদৃশ্য আঙুলে স্মৃতির ধুলো ঝাড়ছে। মেঘলা জানালার কাচে ভিজে থাকা জলছবির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার ডায়রির একটি পাতায় শুধু একটা লাইন লিখে—“স্মৃতি ফিরে আসছে, কিন্তু ভালোবাসার পথ এখনও কাঁটা।” সে জানে, তাকে আর বসে থাকা চলবে না। এবার ঋভুকে নিয়ে যেতে হবে সেই জায়গায়, যেখানে তারা শেষবার একসঙ্গে ছিল—স্টুডিওটা, যা এখন বন্ধ, মাটির গন্ধে ভরা, ঝুলে ঢাকা এক সময়ের কবরের মতো। মেঘলা ক্লিনিক থেকে সেদিন একটা ছুটি নেয়। ঋভুকে জানায়, “চলো, আজ আমরা একটা ভ্রমণ করব। তোমার পুরনো কিছু জায়গায়।” ঋভু প্রথমে একটু কুণ্ঠিত হয়, কিন্তু তার চোখে সেই চেনা কৌতূহল জেগে ওঠে—যা একসময় তাকে শিল্পী করে তুলেছিল। গাড়িতে চেপে তারা পাড়ি দেয় শহরের পুরনো অংশে, যেখানে গলির কোণে সেই পুরনো স্টুডিওটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, গাছে-ঢাকা, নীরব, বিস্মৃত।

স্টুডিওর দরজাটা খুলতেই ভেতর থেকে ধুলো, পুরনো কাঠ, এবং রঙের মিশ্র গন্ধ উঠে আসে। মেঘলা আলো জ্বালায় না, শুধু একটা জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়—সূর্যের ম্লান আলো এসে পড়ে ভেতরের রঙমাখা মেঝেতে। ঋভু ধীরে ধীরে ঘোরে চারপাশে, তার আঙুল ছুঁয়ে যায় পুরনো ক্যানভাস, পাথরের খণ্ড, আর কোণে রাখা একটি অর্ধসমাপ্ত ভাস্কর্যের ওপর—যেটা সে একসময় মেঘলার জন্য বানিয়েছিল। “এই জায়গাটা… আমি চিনি,” সে ফিসফিস করে। “এই জানালাটা দিয়ে সন্ধ্যায় আলো ঢুকত… আর আমি একটা মুখ আঁকতাম বারবার… আমি জানি না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছে আমি এখানে কাউকে খুঁজতাম।” হঠাৎই সে দাঁড়িয়ে পড়ে, তার কপালে হাত ঠেকায়। “আমি সেদিন চলে গিয়েছিলাম, তাই না? আমি ভেবেছিলাম সে আমায় ছেড়ে গেছে।” মেঘলার ঠোঁট শুকিয়ে যায়, সে ধীরে বলে, “না… আমি তো এসেছিলাম, তোমার জন্য। শুধু ঝড়টা আমাদের আলাদা করে দিল।”

ঋভু টেবিলের পাশে রাখা একটি পুরনো চায়ের কাপ তুলে নেয়। সেটাতে এখনো দাগ লেগে আছে, মেঘলা হাসে, “এই কাপেই তুমি আমার জন্য চা করেছিলে, তিন চামচ চিনি দিয়ে।” মুহূর্তে ঋভু থেমে যায়, তার চোখের পাতা ভারী হয়। “তুমি কি… তারা?” প্রশ্নটা আসে নিঃশব্দ বজ্রপাতের মতো। মেঘলা এবার আর কিছু না লুকিয়ে, চোখের জল লুকাতে না পেরে বলে, “হ্যাঁ ঋভু, আমি-ই। আমি তোমার সেই ‘তারা’, যে আজও সেই অসমাপ্ত পাজলের শেষ টুকরো হয়ে রয়ে গেছে।” ঋভু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর সে মেঝেতে বসে পড়ে—যেন নিজের ভিতর ভেঙে পড়ে। সে মাথা নিচু করে বলে, “তুমি আমায় ডাকছিলে, তাই না? সেই রাতে? কিন্তু আমি শুনিনি…” মেঘলা এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে, তার কাঁধে হাত রাখে, “তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে শুধু বাস্তব থেকে, কিন্তু আমি জানতাম, কোথাও না কোথাও তুমি এখনও রয়ে গেছো।”

সেদিন সন্ধ্যায়, স্টুডিওর মেঝেতে তারা দুজনে বসে থাকে এক কাপ কুসুম গরম চায়ের সঙ্গে। বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে, আকাশে একফালি আলো উঠেছে। মেঘলা পকেট থেকে বের করে ঋভুর সেই পুরনো চিঠি—যেটা সে কখনও পড়েনি, শুধু নিজের ভিতর রেখে দিয়েছিল। “তুমি বলেছিলে, যদি কোনোদিন সব ভুলে যাও, আমি যেন তোমায় মনে করিয়ে দিই, আমরা কী ছিলাম। আজ আমি তাই করলাম, ঋভু। আজ আমি সেই পাজলের শেষ টুকরোটা তোমার হাতে দিয়ে গেলাম।” ঋভু তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার চোখে কোনও ঝড় নেই এখন—শুধু এক গভীর শান্তি, যেন হারিয়ে যাওয়া পথিক অবশেষে পথ খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু স্মৃতির দরজা পুরোপুরি খুলেছে কি? নাকি এখনও কিছু অন্ধকার থেকে গেছে, যার ছায়া শুধু ভালোবাসার আলোয় ধরা পড়ে? তাদের চোখের মাঝে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন ভাসে—এই সন্ধি কি নতুন শুরু, নাকি অতীতের সঙ্গে শেষ একবার হাত মেলানো?

***

স্টুডিও থেকে ফিরে আসার পর দিনগুলো যেন থেমে থাকে, অথচ প্রতিটি মুহূর্ত ঋভুর মনে রেখে যায় অদ্ভুত ছায়া। তার স্মৃতিগুলো আর আগের মতো এলোমেলো নয়—এখন তারা ধীরে ধীরে একে অপরের সঙ্গে সংলগ্ন হচ্ছে। খণ্ডচিত্রগুলো পূর্ণ গল্প হয়ে উঠতে চাইছে, ঠিক যেমন ছেঁড়া পাজলের শেষ অংশ খুঁজে পেলে একটি ছবি সম্পূর্ণ হয়। তবে সেই অংশটি এখনও অধরা—আর সেই অধরার মাঝেই মেঘলা অনুধাবন করে, ঋভুর ভেতরে চলছে এক গভীর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। একদিকে, সে এখন জানে—‘তারা’ তার জীবনে ছিল, ভালোবাসার মতো নিবিড়, অথচ হারিয়ে যাওয়া এক মুখ। অন্যদিকে, স্মৃতির ধ্বংসাবশেষের নিচে চাপা পড়ে থাকা অপরাধবোধ তাকে টেনে নিচ্ছে, যেন কিছু একটা ভুল করে ফেলেছে সে—যার জবাব এখনো দেয়নি।

সেদিন সন্ধ্যায়, থেরাপি সেশনের মাঝখানে মেঘলা বলে, “আমি চাই তুমি কিছু লেখো আজ। তোমার যা মনে পড়ে, যা মনে পড়ে না—সবকিছু।” ঋভু শুরু করে লিখতে, তার হাত কাঁপে। লেখার মাঝে সে থামে, চোখে জল আসে, বলে, “মনে পড়ে, একটা চিঠি লিখেছিলাম… কিন্তু দিতে পারিনি। আমি তখন ভাবছিলাম তুমি আমায় ছেড়ে গেছো, আর সেই রাগে আমি তোমার দেওয়া পাজলটা ছুঁড়ে ফেলেছিলাম।” সে থেমে যায়। মেঘলা শান্ত গলায় বলে, “আমি সেই পাজলের টুকরো আজও রেখেছি। জানো, আমি একবার ভেবেছিলাম, ভালোবাসা শুধু তখনই থাকে যখন আমরা একে অপরকে মনে রাখি। কিন্তু এখন বুঝি, ভালোবাসা কখনও যায় না। স্মৃতি মুছে গেলেও, অনুভব রয়ে যায়।”

ঋভু মৃদু হেসে, অশ্রুভেজা চোখে তাকায়। “তোমার কাছে একটা প্রশ্ন আছে আমার,” সে বলে। “তুমি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছো?” মেঘলা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “আমি বহু আগেই ক্ষমা করে দিয়েছিলাম, ঋভু। শুধু তোমার ফেরা বাকি ছিল।” সেই মুহূর্তে ঘরের নিঃশব্দতা যেন ভেঙে পড়ে, ঋভু মাথা নিচু করে বলে, “তাহলে এবার হয়ত আমি শেষ পাজলটা লাগাতে পারি।” সে ডায়েরির একটি পাতা ছিঁড়ে মেঘলার হাতে দেয়। তাতে লেখা—
“তারা, যদি কোনোদিন সব ভুলে যাই, এই অনুভবটা যেন থেকে যায়—তুমি ছিলে, তুমি আছো, আর তুমি থাকবে। ভালোবাসা কোনো বোধ নয়, এটা একটা আশ্রয়। তুমিই আমার আশ্রয়।”

সেদিন, মেঘলা যখন ক্লিনিক বন্ধ করে বাইরে আসে, আকাশে তখন একফালি পূর্ণিমা। ঋভু তার পাশে দাঁড়িয়ে, শান্তভাবে বলে, “তুমি জানো, আজকাল পাজল খেললেই মনে হয়, শেষ টুকরোটা সবসময় থাকে না হাতে, অনেক সময় সেটা হয় চোখে, কিংবা মনে।” মেঘলা উত্তর দেয়, “আর অনেক সময়, সেই টুকরোটা হয়ে ওঠে এক মানুষ।” তারা পাশাপাশি হাঁটে, কোনো কথা হয় না। কিন্তু বাতাসে ভেসে থাকে সেই শব্দহীন সম্মতি—এইবার সত্যিই সব মনে পড়ছে। হয়ত একটা নতুন শুরু হতে চলেছে, অসম্পূর্ণতার সৌন্দর্যের মধ্য দিয়েই।

***

সপ্তাহখানেক পরে, শহরের এক ছোট গ্যালারিতে আয়োজন করা হয় একটি ক্ষুদ্র প্রদর্শনী—নাম “Unremembered, Yet Loved”। তিস্তার উদ্যোগে এবং মেঘলার অনুপ্রেরণায়, ঋভুর পুরনো ও নতুন ভাস্কর্য একত্রিত করে প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। প্রতিটি পাথরের খণ্ড যেন বহন করে ঋভুর হারানো স্মৃতি, তার ভাঙা গল্প, এবং একটি ভালোবাসার নিঃশব্দ ইতিহাস। প্রদর্শনীতে শেষ একটি ভাস্কর্য রাখা হয়—একটি অসম্পূর্ণ মুখ, যার একটি অংশ এখনও না খোদাই করা, এবং নিচে লেখা—
“Incomplete, yet whole — for she remembered what I forgot.”
এটি মেঘলার প্রতি ঋভুর এক নীরব চিঠি, যা তিনি কখনও কাগজে লেখেননি, কিন্তু পাথরে খোদাই করে দিয়ে গেছেন।

প্রদর্শনীতে বহুজন আসে, কিন্তু ভিড়ের মাঝে তারা দুইজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে একটি কোণের পাশে, হাতছোঁয়া দূরত্বে। মেঘলা চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সেই মুখোশ-মতো মুখটির দিকে, যে মুখ একসময় ছিল তার, আর আজ একটি শিল্পকর্ম—সমস্ত অস্পষ্টতার পরেও স্পষ্ট। ঋভু ধীরে ধীরে বলে, “তুমি জানো, আমি এখনো পুরোটাই মনে রাখতে পারিনি। অনেক কিছুর ছবি ধোঁয়াটে। কিন্তু যখন তোমার চোখের দিকে তাকাই, মনে হয়… সব মনে আছে। এমনকি সেই শেষ চুম্বনের আগে তুমি যেভাবে আমার হাত ধরেছিলে, সেটাও।” মেঘলা কাঁপা গলায় বলে, “ভালোবাসা কি কেবল স্মৃতি দিয়ে তৈরি?” ঋভু উত্তর দেয় না, শুধু তার হাত ধরে। সেই স্পর্শেই যেন জড়িয়ে থাকে তারা দুজন, সময়ের ভাঁজে জমে থাকা যন্ত্রণা, অপরাধবোধ, এবং ক্ষমার সমস্ত ছায়া।

মাঝরাতে প্রদর্শনী শেষ হয়। মানুষজন চলে যায়, আলো নিভে আসে একে একে। তারা দুজন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সেই পাজলভাস্কর্যের সামনে—যেটা তারা একসঙ্গে শুরু করেছিল ছয় বছর আগে, ঝড়ের রাতে, আর শেষ করেছে আজ—ঝড়ের অনেক পরে। মেঘলা বলে, “এই ভাস্কর্যটার নাম কী রাখবে?” ঋভু বলে, “তুমি বলো।” মেঘলা একটু ভেবে বলে, “ছেঁড়া পাজলের ভালোবাসা।” তারা দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে—এক ধরনের ভারহীন হাসি, যেটা ভাঙনের ওপারে জন্ম নেয়।

শেষ দৃশ্যে তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে। পিছনে প্রদর্শনীর হল ঘর নিভে আসে। ক্যামেরা দূর থেকে দেখায় তাদের ছায়া—দুটি মানুষ, দুটি অতীত, দুটি অপরাধবোধ, দুটি অনুশোচনা, আর একটি অসম্পূর্ণ প্রেম—যা আজ নতুনভাবে খুঁজে পেয়েছে নিজেকে।
আর তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসে মেঘলার ডায়েরির সেই চিরন্তন পংক্তি—
“সবকিছু মনে থাকে না… তবু যা সত্যি ছিল, তা-ও থেকে যায়।”

— সমাপ্ত —

 

1000041048.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *