ফাল্গুনী মিশ্র
এক
গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা সেই গ্রাম, নাম মালঞ্চপুর। দিনের বেলায় এ গ্রাম চিরচেনা ছবির মতো শান্ত, ধানখেতের সবুজ গালিচা, কুঁড়েঘর আর দিঘির জলে ছেলেদের হাসি-ঠাট্টা। কিন্তু সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গেই যেন অন্য এক ছায়াময় আবহ নামত এখানে। বিশেষত গ্রামের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পুরোনো বটগাছটি যেন অজস্র রহস্য গিলে রেখেছে। সেই গাছের নিচে প্রতিদিন সন্ধের পরে ভিড় জমত, গল্পগুজব করতে করতে গ্রামের লোকেরা আসত, কেউ কেউ তামাক টানত, কেউবা পাকা পান চিবোতে চিবোতে নিজের শোনা লোককথা খুলে ধরত। আর এইসব গল্পকথার ভিড়েই ছিলেন গদাধর কাকা—আশি ছুঁইছুঁই এক বুড়ো মানুষ, সাদা দাড়ি বুক অবধি নেমে এসেছে, চোখদুটো যেন এক অদ্ভুত আলোয় জ্বলে। তাকে ঘিরেই গ্রামের ছেলেমেয়েরা ভিড় করত, কারণ কাকার কাছে এমন সব অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার ছিল যা শুনলেই গা ছমছম করত। সেদিনও তেমনি এক সন্ধ্যায়, কুয়াশা ধীরে ধীরে নেমে আসছিল মাঠের বুক জুড়ে, আর গদাধর কাকা নরম গলায় বলতে শুরু করলেন—“তোমরা কি জানো, এই গ্রামের বিবাহবাড়ির আশেপাশে রাত বারোটার পর শোনা যায় ঢাক-ঢোলের আওয়াজ? যেন কোনো বরযাত্রীর আগমন হচ্ছে। কিন্তু আসল ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো, যারা আসে তারা সবাই মাথাহীন!” কথাটা বলতেই হঠাৎ চারপাশের হাওয়া নিস্তব্ধ হয়ে উঠল, শিশুদের খিলখিল হাসি মিলিয়ে গেল, আর উপস্থিত প্রত্যেকেই কেমন যেন কেঁপে উঠল ভিতরে ভিতরে।
গদাধর কাকার মুখের রেখাগুলোয় ঝুলে ছিল ইতিহাসের ছাপ। তিনি থেমে থেমে বলতে থাকলেন, যেন কোনো অদৃশ্য বোঝা বয়ে চলেছেন বহু বছর ধরে। “আমি নিজে দেখেছি, বছর পঞ্চাশেক আগে…,” গলা নামিয়ে বললেন তিনি। “এক বিয়ে বাড়ি ছিল নদীর পাড়ে। মাঝরাতে ঢাকের শব্দে বাইরে ছুটে গিয়েছিলাম। দেখি, ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে শোভাযাত্রা এগিয়ে আসছে—তাদের পোশাক আমাদের মতোই, পাগড়ি, ধুতি, কেউ ঢোল বাজাচ্ছে, কেউ শঙ্খ ফুঁকছে। কিন্তু যতই কাছে আসছিল, আমি ততই আতঙ্কে কাঁপছিলাম। কারণ একটাও মাথা নেই! কেবল বুক পর্যন্ত শরীর, আর কাঁধের ওপরে শূন্য ফাঁকা অন্ধকার।” কাকার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠল। চারপাশে বসে থাকা মানুষদের বুকের ভেতর হাওয়া আটকে গেল। শিবানী, রণজিতের ছোট বোন, ভয়েভয়ে দু’চোখ মেলে তাকাল ভাইয়ের দিকে। তার মনে হচ্ছিল, এ যেন নিছক কল্পকথা নয়, বরং দুঃসহ কোনো অতীতের দাগ। কিন্তু রণজিৎ, গ্রামের সাহসী যুবক, ভয় নয় বরং অদ্ভুত কৌতূহল অনুভব করছিল। তার চোখে ঝিলিক ফুটে উঠল, যেন নতুন কোনো রহস্য উদঘাটনের দুঃসাহস তাকে ডাকছে। সে মনে মনে ভাবল, “মাথাহীন বরযাত্রী… এসব কীভাবে সম্ভব? হয়তো এর পেছনে কোনো অচেনা কাহিনি লুকিয়ে আছে, হয়তো মানুষ ভয়কে গল্পে রূপ দিয়েছে।”
যখন গদাধর কাকা থেমে গেলেন, চারদিকে কেবল শীতল বাতাস বয়ে চলছিল। বটগাছের শেকড়গুলো ঝুলে পড়ে বাতাসে দুলছিল, যেন সেগুলোও কাকার কথার সঙ্গে সায় দিচ্ছে। গ্রামের বয়স্করা কণ্ঠ নামিয়ে বলল, “এসব নিয়ে বেশি নাড়া-চাড়া করিস না, অভিশপ্ত ব্যাপার। যারা খুঁজতে গেছে, তারা কেউ শান্তি পায়নি।” কিন্তু রণজিৎ দাঁতে দাঁত চেপে ঠিক করল, সে এ রহস্যের মূলে পৌঁছবেই। তার কাছে এটা ভৌতিক গল্প নয়, বরং লুকিয়ে থাকা কোনো ঘটনার সত্য। শিবানী তাকে বারবার চোখে চোখে সতর্ক করে দিলেও, রণজিৎ কেবলই বটগাছের ছায়ার ভেতর তাকিয়ে রইল, যেন কোনো অচেনা ঢাকের আওয়াজ ভেসে আসছে দূরে। আর এইভাবেই, মালঞ্চপুর গ্রামে প্রথম বীজ বোনা হলো এক ভয়ঙ্কর অভিযাত্রার—যার শুরু হলো বিবাহবাড়ির ফিসফাস দিয়ে, আর শেষ কোথায় হবে তা কেউ জানত না।
দুই
রাতভর বটগাছের তলায় গদাধর কাকার বলা সেই শিহরণজাগানো কাহিনি রণজিতের মাথা থেকে একটুও সরছিল না। সকালের আলো গ্রামটিকে নতুন করে সাজালেও তার চোখে তখনও ভেসে উঠছিল সেই মাথাহীন বরযাত্রীদের ভয়ংকর শোভাযাত্রা। গ্রামজুড়ে লোকেরা ভয়ে একে অপরকে ফিসফিস করে কথা বলছিল, কেউ বলছিল অভিশাপ, কেউ বলছিল অপদেবতার খেলা, আবার কেউবা সোজাসুজি কাকার গল্পকে ছেলেখেলা মনে করে উপহাস করছিল। কিন্তু রণজিৎ আলাদা। সে ছিল ভেতরে ভেতরে এক অদম্য কৌতূহলপীড়িত যুবক, যাকে গ্রামবাসী চিনত সাহসী বলে। তার চোখে ভয় নয়, বরং সত্য জানার এক প্রবল আকর্ষণ। সে ভাবছিল, “এসব ভূতের গল্পে বিশ্বাস করলে চলবে না। নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সত্যি লুকিয়ে আছে এর পেছনে। হয়তো কোনো মানুষ, হয়তো কোনো ঘটনা, যা সবাইকে বিভ্রান্ত করছে।” তার বোন শিবানী এসময় ক্রমাগত ভাইকে থামাতে চাইছিল। শিবানী ছোটবেলা থেকেই লোককথা শুনতে ভালোবাসত, কিন্তু সেসব নিয়ে খোঁচাখুঁচি করতে গেলে ভয়ও পেত প্রচণ্ড। ভোরে যখন ভাইকে উঠতে দেখল, তখনই হাত ধরে বলল, “দাদা, এসব খুঁজতে যেও না। গদাধর কাকা যদি দেখে থাকেন, তবে সেটা নিশ্চয়ই অভিশপ্ত কিছু। আমি ভালো করে ঘুমোতেই পারি না, রাত হলেই কানে বাজে ঢাকের আওয়াজ।” রণজিৎ মৃদু হেসে বলল, “তুই ভয় খাচ্ছিস, তাই এসব শুনতে পাচ্ছিস। আমি জানি, এসবের পেছনে কোনো ব্যাখ্যা আছে। আমি না জানলে শান্তি পাব না।” তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল, আর সেই দৃঢ়তাই শিবানীকে আরও আতঙ্কিত করছিল।
দিন গড়িয়ে দুপুরে যখন সূর্য মাথার ওপরে ঝুলছিল, তখন রণজিৎ সরাসরি গ্রামের মোড়ের দিকে হাঁটল। সেখানে বসেছিলেন গ্রামের মোড়ল কালীপদ মল্লিক, এক ষাটোর্ধ্ব মানুষ, গায়ে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় একটি সোনার লকেট। গ্রামের সব সিদ্ধান্ত মূলত তার মুখের কথাতেই গৃহীত হতো। রণজিৎ সামনে গিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল—“কালীপদ কাকু, আপনি তো সব জানেন। বলুন তো, এই মাথাহীন বরযাত্রীদের রহস্যটা কী?” মুহূর্তের জন্য কালীপদ থমকে গেলেন। তার মুখে প্রথমে অবজ্ঞার হাসি ফুটল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “এসব কুসংস্কার, রণজিৎ। গ্রামে কাকা-বুড়োরা গল্প বানায়, আর তোমাদের মতো ছেলেরা ভয় পেয়ে বিশ্বাস করে। পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু নেই।” কথাগুলো দৃঢ়ভাবে বললেও তার চোখের ভেতর এক চিলতে অস্বস্তি ছিল, যা রণজিতের চোখ এড়ায়নি। কাকুর হাতের আঙুল কাঁপছিল, তিনি কথার ফাঁকে ফাঁকে চশমা মুছছিলেন বারবার, যেন নিজের ভেতরের আতঙ্ক আড়াল করার চেষ্টা করছেন। রণজিৎ লক্ষ্য করল, অন্য গ্রামবাসীরাও পাশে দাঁড়িয়ে শুনছে, কিন্তু কেউই কালীপদের কথাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করছে না। কেউ আবার ফিসফিস করে বলছিল—“মোড়ল মশাইয়ের পরিবারই তো সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল।” এসব কথা কালীপদের কানে গেলেও তিনি গম্ভীর মুখে চুপ করে রইলেন। রণজিৎ তখনই বুঝল, এখানে কিছু একটা গোপন রয়েছে, যা কালীপদ ইচ্ছে করেই চাপা দিয়ে রাখছেন।
সেদিন রাতে, যখন চাঁদের আলো দিগন্তজুড়ে সাদা আস্তরণ ফেলেছিল, তখন রণজিৎ একাই উঠোনে বসে রইল। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু শিবানী বারবার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে ভাইকে ডেকে বলছিল—“ভিতরে আসো, বাইরে বসো না।” কিন্তু রণজিৎ তার কথায় কর্ণপাত করল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছিল, “গ্রামের এই শান্ত আবরণের নীচে যে ভয়ঙ্কর রহস্য লুকিয়ে আছে, আমি সেটাকে উন্মোচন করবই।” তার মনে পড়ছিল কালীপদের সেই অস্বস্তি, মনে পড়ছিল গদাধর কাকার ভৌতিক অভিজ্ঞতা, আর শিবানীর স্বপ্নে শোনা ঢাকের আওয়াজ। সবকিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশ ঘনিয়ে উঠছিল তার চারপাশে। সে সিদ্ধান্ত নিল, যতই বিপদ আসুক না কেন, পরের পূর্ণিমার রাতে সে মাঠে যাবে, যেখানে নাকি বরযাত্রীরা দেখা দেয়। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরণ হচ্ছিল, ভয় আর সাহস একসঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছিল তার মনে। শিবানী তখন বিছানায় কুঁকড়ে শুয়ে কাঁপছিল, মনে মনে প্রার্থনা করছিল ভাই যেন সেই অন্ধকার যাত্রার দিকে না ছুটে যায়। কিন্তু ভাগ্যের রথ তখন ধীরে ধীরে রণজিতকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল এমন এক পথে, যেখানে আলো আর অন্ধকারের সীমারেখা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
তিন
পূর্ণিমার আলোয় মালঞ্চপুরের মাঠগুলো সেদিন যেন অস্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। চারদিকের সাদা আলোয় গাছপালা, পুকুরের জল আর ধানখেতের আড়ালগুলো এক অদ্ভুত ঝিকমিক করা পর্দার মতো লাগছিল। রণজিৎ সেদিন চারজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিল—মাখন, হরিপদ, বাপ্পা আর কার্তিক। সবাইকে সে বোঝিয়েছিল যে ভয়ের কিছু নেই, আজকের রাতেই সত্যটা প্রমাণ হবে। তবু প্রত্যেকের চোখেমুখে স্পষ্ট আতঙ্ক, কারণ গ্রামে বহুবার শোনা হয়েছে, পূর্ণিমার রাতে বরযাত্রীরা নাকি সত্যিই বেরোয়। রাত বারোটার পর যখন চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে এল, কেবল ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ভেসে আসছিল দূর থেকে, তখন তারা পা টিপে টিপে মাঠের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। রণজিৎ দৃঢ়স্বরে বলল, “দেখো, আজ কিছু না কিছু বের হবেই। ভয়ের কিছু নেই, আমি আছি।” কিন্তু এই কথার আড়ালে তার বুকেও তখন অজানা উত্তেজনা আর শঙ্কা কাজ করছিল। চারপাশের বাতাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে উঠছিল, যেন রাত নিজেই নিঃশ্বাস আটকে রেখেছে।
হঠাৎ করেই শোনা গেল ঢাকের আওয়াজ। প্রথমে খুব ক্ষীণ, যেন দূরের গ্রাম থেকে কেউ বাজাচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে আওয়াজ ঘনিয়ে উঠতে লাগল, প্রতিটি ধ্বনি যেন মাটির বুক কাঁপিয়ে তুলছিল। বন্ধুরা একে অপরের দিকে ভয়ভরা চোখে তাকাল। একই সঙ্গে দেখা গেল, দূরের বাঁশবনের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত আলোর ঝলকানি আসছে। আলোর উৎসটা বোঝা যাচ্ছিল না—কখনো লাল, কখনো নীল, আবার হঠাৎ অদৃশ্য। মাখন তো ভয়ে ফিসফিস করে বলল, “দাদা, চলো ফিরি, এটা মানুষের কাজ নয়।” কিন্তু রণজিৎ এক পা-ও পিছোল না। সে বলল, “না, আজকে সত্যি জানতেই হবে।” ধীরে ধীরে শব্দ আরও কাছে আসতে থাকল, আর আলোও যেন মাঠের দিকে এগিয়ে আসছিল। আর তখনই তারা দেখতে পেল—মিছিল। প্রথমে শুধু অস্পষ্ট ছায়া, তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো। প্রায় বারোজন, সবাই সাদা ধুতি পরা, কেউ ঢোল বাজাচ্ছে, কেউ শঙ্খ ধরেছে, কেউ হাতে মশাল। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার—তাদের কারোরই মাথা নেই! ধুতি-পাঞ্জাবির ওপরে ফাঁকা কাঁধ, তার ওপরে কেবল কালো শূন্যতা। যেন মাথাটা বাতাসেই মিশে গেছে।
দৃশ্যটা চোখে পড়তেই হরিপদ আর কার্তিক চিৎকার করে ছুট দিল গ্রামের দিকে। বাপ্পা তো ভয়ে মাটিতে বসেই পড়ল, তারপর প্রাণপণে দৌড়ে পালাল। শুধু রণজিৎ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখ তখন শূন্যতার দিকে আটকে গেছে। সে স্পষ্ট দেখতে পেল, মিছিলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত অবয়ব—মাথাহীন বর। তার গলায় মালা ঝুলছে, হাতে এক পুরনো ধাতব শঙ্খ। বরযাত্রীরা তাকে ঘিরে ঢাক বাজাচ্ছে, আর প্রতিটি আওয়াজে চারপাশের বাতাস কেঁপে উঠছে। পূর্ণিমার আলোয় সেই বরযাত্রীরা যেন আধা-স্বচ্ছ, যেন তারা আছে আবার নেইও। রণজিতের মনে হচ্ছিল, পুরো দৃশ্যটা কোনো মৃত সময় থেকে উঠে এসেছে। তার বুকের ভেতর প্রচণ্ড শিহরণ হচ্ছিল, হাত-পা জমে গিয়েছিল, তবু সে পালাল না। বরং তার চোখের সামনে সেই মাথাহীন বর হঠাৎ হাত উঁচিয়ে শঙ্খ বাজাল, আর এক বিকট শব্দে চারপাশের আলো ঝলসে উঠল। কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাঠটা যেন অগ্নিসাগরে ভরে উঠল, তারপর সব আবার নিস্তব্ধ। যখন রণজিৎ চোখ মেলল, তখন মাঠ ফাঁকা, কোনো বরযাত্রী নেই, নেই ঢাকের আওয়াজ—শুধু চাঁদের আলো আর নীরবতা। তার বন্ধুরা তখন অনেক দূরে পালিয়ে গেছে, কিন্তু রণজিৎ দাঁড়িয়েই রইল, মুখে নিঃশ্বাস কাঁপছে, চোখে এক অদ্ভুত জেদ। সে বুঝল, আজ সে সত্যিই এমন কিছু দেখেছে, যা কেবল লোককথা নয়, বরং এক অভিশপ্ত বাস্তব।
চার
রাতের সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পর রণজিতের চোখে আর ঘুম আসছিল না। সকালে মাটির উঠোনে বসে, মাথার ভেতর বারবার বাজছিল ঢাকের আওয়াজ, ভেসে উঠছিল সেই মাথাহীন বরযাত্রীদের শোভাযাত্রা। বন্ধুরা কেউই আর মুখ খোলেনি, তারা ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল নিজেদের ঘরে। কিন্তু রণজিৎ ঠিক করল, সে কাউকে না জানিয়ে গদাধর কাকার কাছে যাবে। বটগাছের তলায় কাকাকে প্রতিদিন দেখা যায়, তবু সেদিন তিনি যেন আলাদা এক অস্থিরতায় ছিলেন। ধোঁয়াটে চোখ, কুঁচকানো মুখে আতঙ্কের রেখা। রণজিৎ সোজা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাকা, আমি দেখেছি। সত্যিই দেখেছি মাথাহীন বরযাত্রীদের। আপনি সব জানেন, আমায় সত্যিটা বলুন।” কথাটা শুনে গদাধর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দূরের মাঠের দিকে চেয়ে রইলেন, যেন বহু পুরোনো এক দুঃস্বপ্নের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। তারপর গলা নামিয়ে বলতে শুরু করলেন, “শোন রণজিৎ, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই গ্রামে ঘটেছিল এক অমানবিক কাণ্ড। এক বরযাত্রীর রক্তে ভেসেছিল এই মাটি। আর সেই রাতের অভিশাপ এখনো মুছেনি।”
গদাধরের কণ্ঠ কেঁপে উঠল, কিন্তু তিনি থামলেন না। তিনি বললেন, “সেই সময় গ্রামেরই এক প্রভাবশালী পরিবারে বিয়ে ছিল। বর আসছিল দূরের এক গ্রাম থেকে। তখনকার দিনে বরযাত্রী মানেই ছিল মশাল, ঢাক, শঙ্খ আর ঘোড়ার গাড়ি। রাতের অন্ধকারে পুরো পথজুড়ে আনন্দ-উৎসব। কিন্তু কেউ জানত না, ছায়ার আড়ালে ওঁত পেতে আছে একদল ডাকাত। যখন বরযাত্রীর গাড়ি পৌঁছল বাঁশবনের ধারে, তখন হঠাৎই আক্রমণ হলো। ঢাকের শব্দ চাপা পড়ে গেল আর্তচিৎকারে। ডাকাতেরা তলোয়ার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল, লুটপাট করল গয়না আর ধনসম্পদ। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বরকে ধরে তারা নির্মমভাবে হত্যা করল, আর ভয়াবহভাবে তার মাথা কেটে নিয়ে গেল। কেন? কেউ জানে না। হয়তো সোনা-গয়নার লোভে, হয়তো প্রতিশোধের কারণে। সেই রাতের পর থেকেই মানুষ বলে, বরযাত্রীদের আত্মা শান্তি পায়নি। পূর্ণিমার রাতে তারা আবার ফিরে আসে, সেই ভয়ংকর শোভাযাত্রা নিয়ে। ঢাক-ঢোল বাজতে থাকে, আলো ঝলসে ওঠে, আর দেখা যায় মাথাহীন বর।” কথা শেষ করতে করতে গদাধরের গলায় যেন হাহাকার জমে উঠল। তিনি চোখ মুছে নিলেন হাতের পাড়ে, যেন সেই রক্তাক্ত দৃশ্য এখনও চোখের সামনে ভাসছে।
রণজিৎ স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। সে ধীরে ধীরে বলল, “কিন্তু কাকা, এই ঘটনার সঙ্গে কালীপদ কাকুর কী সম্পর্ক?” গদাধরের চোখ হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনি চারপাশে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললেন, “সবাই বলে, ওই ডাকাতদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল গ্রামেই এক পরিবার। আর সেই পরিবারই হলো কালীপদের পূর্বপুরুষরা। গ্রামের লোক জানলেও প্রকাশ্যে কিছু বলে না, কারণ কালীপদ আজ গ্রামের মোড়ল। কিন্তু অশরীরীরা তো সব জানে, রণজিৎ। তাই যখন বরযাত্রীদের দেখা যায়, তখন অনেকেই শপথ করে বলেছে—মিছিলের শেষ প্রান্তে কালীপদের বাবার মতো এক অবয়বকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। আমি নিজে এক রাতে দেখেছি। তখন থেকে আমার নিদ্রা উধাও।” রণজিতের বুকের ভেতর ঠকঠক করে উঠল। তার মনে হলো, রহস্যের জট খুলছে ধীরে ধীরে। কালীপদ বাইরে যতই কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিন, ভেতরে তিনি জানেন ভয়াবহ সত্যি। রণজিৎ স্থির করল, এই অভিশাপের মূল কারণ খুঁজে বের করবেই। গদাধরের স্মৃতি শুধু অতীত নয়, বরং বর্তমানের অন্ধকারকে চাবির মতো খুলে দিল তার সামনে। এখন আর ফিরবার পথ নেই—সে এগোবে, যতই বিপদ সামনে আসুক।
পাঁচ
সেই রাতটা শিবানীর জীবনে যেন এক অবিরাম দুঃস্বপ্নের মতো নেমে এলো। দিনের বেলাতেই সে লক্ষ্য করেছিল, রণজিতের চেহারায় এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন সে এক অজানা আহ্বান শুনেছে। কিন্তু রাত নামতেই শিবানী নিজেই ডুবে গেল ভয়ঙ্কর এক স্বপ্নের জালে। সে দেখল, চারপাশ ঘন কুয়াশায় ঢেকে গেছে। কোথাও কোনো মানুষ নেই, নেই কোনো শব্দ, শুধু কুয়াশার ভেতর থেকে আসছে ঢাক-ঢোলের থেমে থেমে বাজনা। শিবানী ধীরে ধীরে এগোতে লাগল, তার বুক কেঁপে উঠছিল, কিন্তু পা যেন নিজের অজান্তেই টেনে নিয়ে যাচ্ছিল তাকে। হঠাৎই কুয়াশার আড়াল ভেদ করে এক মাথাহীন বর সামনে এসে দাঁড়াল। তার গায়ে পুরনো ধুতি-পাঞ্জাবি, গলায় শুকিয়ে যাওয়া ফুলের মালা, হাতে এক শঙ্খ, আর বুকের ওপরে ফাঁকা কাঁধ—যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে তার হারানো মুখ। সেই ভয়ঙ্কর অবয়ব ঠাণ্ডা অথচ স্পষ্ট কণ্ঠে বলল, “আমাদের মুক্তি দাও… আমাদের মুক্তি দাও।” শব্দটা যেন ধ্বনিত হয়ে শিবানীর মাথার ভেতর প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। তার গা শিউরে উঠল, সে চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। শুধু দেখল, সেই বরযাত্রীর পেছনে সারি সারি মাথাহীন ছায়া দাঁড়িয়ে আছে, সবাই যেন একসঙ্গে তার দিকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে।
ভয়ে চমকে শিবানী ঘুম ভাঙল। তার শরীর ঘামে ভিজে গেছে, ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ। জানলার ফাঁক দিয়ে পূর্ণিমার আলো এসে পড়েছে ঘরের মাটিতে, আর বাইরে কোথাও একটা দূর থেকে আবার শোনা যাচ্ছে ঢাকের ক্ষীণ আওয়াজ। শিবানী তড়িঘড়ি করে উঠে বসে রণজিতের ঘরে ছুটল। ভাই তখনও জেগে ছিল, কাগজে কিছু নোট নিচ্ছিল গদাধরের কথাগুলো নিয়ে। বোনকে এতটা আতঙ্কিত দেখে রণজিৎ অবাক হলো। শিবানী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ভাই, ওরা আমার কাছে এসেছে। স্বপ্নে দেখেছি, মাথাহীন বর নিজে আমায় ডাকছে। বলছে মুক্তি দাও। তুমি এসবকে কেবল কৌতূহলের খেলা ভেবো না। এটা একটা অসমাপ্ত অভিশাপ, আর আমাদের এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া উচিত নয়।” তার চোখে তখন আতঙ্কের সঙ্গে কান্নার ছাপ স্পষ্ট। রণজিৎ প্রথমে বোঝানোর চেষ্টা করল—“ওসব শুধু স্বপ্ন, বাস্তব নয়।” কিন্তু শিবানী জেদ করে বলল, “না ভাই, এটা শুধু স্বপ্ন নয়। স্বপ্নের ভেতরও তারা সত্যি হয়ে আসে। তুমি যে পথে হাঁটছ, সেটা ভীষণ বিপদজনক। তারা তোমাকে টেনে নিয়ে যাবে, তোমারও মুক্তি হবে না।” কথাগুলো বলতে বলতে শিবানীর ঠোঁট কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, সে যেন ভাইকে হারানোর অজানা ভয় বুকের ভেতর টের পাচ্ছে।
রণজিৎ কিছুক্ষণ চুপ করে বোনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানত, শিবানী অকারণে ভয় পায় না। তার চোখে যে আতঙ্কের ছাপ, সেটা কোনো সাধারণ দুঃস্বপ্নের নয়। কিন্তু নিজের ভেতরে জেগে ওঠা অদম্য কৌতূহল আর সত্য জানার ইচ্ছা তাকে থামতে দিল না। সে ধীরে ধীরে বলল, “শিবানী, তুই যা দেখেছিস সেটা হয়তো কোনো সংকেত। কিন্তু আমি পিছিয়ে আসতে পারব না। যদি সত্যিই কোনো অভিশাপ থাকে, তবে তার শেষ হওয়াও দরকার। আমি যদি পিছিয়ে যাই, তবে চিরকাল এই গ্রাম আতঙ্কে থাকবে।” শিবানী কাঁদতে কাঁদতে বলল, “কিন্তু ভাই, সত্য খুঁজতে গিয়ে যদি তুই নিজেই তাদের ফাঁদে পড়িস?” রণজিৎ মৃদু হাসল, যদিও তার চোখে তখন অদ্ভুত দৃঢ়তা। সে বলল, “ভয় না পেয়ে যদি কেউ না এগোয়, তবে মুক্তি কবে আসবে? হয়তো সেই মাথাহীন বর সত্যিই মুক্তি চাইছে। আমি চেষ্টা করব তাকে সেটা দেওয়ার।” শিবানী নিশ্চুপ হয়ে গেল, শুধু ঠাণ্ডা বাতাসে তার কান্নার শব্দ মিলিয়ে গেল। ঘরের বাইরে তখনো অজানা উৎস থেকে আসছিল ঢাকের মৃদু আওয়াজ, যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি জানিয়ে দিচ্ছে—এই খেলা আর থামবে না।
ছয়
রণজিৎ যতই এগোচ্ছে, রহস্যের জট ততই ঘন হয়ে উঠছে। শিবানীর স্বপ্নের সতর্কবার্তা তার মনে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে, তবু সে থেমে নেই। একদিন সে এক পুরোনো দলিল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ আবিষ্কার করল কালীপদ মল্লিকের পারিবারিক ইতিহাসে এক অন্ধকার অধ্যায়। গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের পুরোহিতের কাছে থাকা নথিপত্রে লেখা ছিল—প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে যখন বরযাত্রীর উপর আক্রমণ হয়, তখন স্থানীয় কিছু লোক ডাকাত দলের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেই নামের তালিকায় স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে এক নাম—মধুসূদন মল্লিক, কালীপদ মল্লিকের দাদু। এ তথ্য পড়েই রণজিতের বুক কেঁপে উঠল। সে বুঝল, গদাধর কাকার সন্দেহ নিরর্থক ছিল না। অভিশাপের শিকড় যে আসলে এই মল্লিক পরিবারেই, তা আর গোপন রইল না। কিন্তু প্রশ্ন রইল—কেন কালীপদ নিজেই এত জোর দিয়ে বারবার এই ঘটনাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয়? নিশ্চয়ই সত্যিটা লুকিয়ে রাখার জন্যই। সেই রাতে ঘুম আসেনি রণজিতের চোখে। সে ভাবছিল, হয়তো এই পরিবারই অভিশপ্ত আত্মাদের শান্তি না পাওয়ার মূল কারণ।
কিছুদিন পর সুযোগ করে রণজিৎ কালীপদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করল। মোড়লের ঘরে গেলে দেখা গেল, কালীপদ এক কোণে বসে পানের রস টিপছেন, আর চোখে-মুখে এক ধরনের বিরক্তি। রণজিতকে দেখে তিনি কড়া গলায় বললেন, “কী রে, আবার এসব ভৌতিক গল্পে মেতেছিস? আমি তোকে আগেই বলেছি, এসব কিছুই নেই।” কিন্তু রণজিত এবার চুপ থাকল না। সে ধীরে ধীরে পকেট থেকে সেই নথির কাগজ বের করে কালীপদের সামনে রাখল। কাগজ দেখে মোড়লের মুখ সাদা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তিনি নির্বাক, তারপর কাগজটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। রণজিৎ তা থামিয়ে বলল, “আপনার পরিবার কেন এই সত্য লুকিয়ে রাখে? গ্রামের লোক কেন অভিশাপের শিকার হবে আপনার দাদুর পাপের জন্য?” কালীপদ প্রথমে গর্জে উঠলেন, কিন্তু পরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেঙে পড়লেন। তিনি নিচু স্বরে বললেন, “সত্যিই, আমার দাদু ছিল সেই দলে। লোভের বশে তিনি ডাকাতদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। শুধু ধনসম্পদ নয়, বরকে হত্যা করার পরিকল্পনায়ও তিনি যুক্ত ছিলেন। তারপর থেকে আমাদের পরিবার এই দায় বয়ে চলেছে। কিন্তু আমি যদি সেটা প্রকাশ করি, তবে পুরো পরিবার লজ্জায় ডুবে যাবে, সমাজ আমাদের ঘৃণায় বাঁচতে দেবে না।” তাঁর চোখ ভিজে উঠল, কিন্তু গলায় ছিল অপরাধবোধের সঙ্গে জেদ—একই সঙ্গে সত্য চাপা দেওয়ার প্রবল চেষ্টা।
রণজিতের মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছিল—“কিন্তু লজ্জা বা মানহানি কি এতটাই বড়, যে মৃত আত্মাদের চিরকালীন যন্ত্রণা মেনে নিতে হবে?” সে দৃঢ় গলায় বলল, “মোড়ল কাকা, সত্যি চাপা দিয়ে অভিশাপ কখনো মেটে না। বরং প্রতিশোধের আগুনে তা আরও বাড়ে। মাথাহীন বরযাত্রীরা শান্তি পাচ্ছে না আপনার দাদুর সেই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য। আপনি যদি সত্য স্বীকার না করেন, তবে এই গ্রামের মুক্তি কোনোদিন আসবে না।” কালীপদ চুপচাপ বসে রইলেন। তাঁর হাতে তখনো ছিঁড়ে যাওয়া কাগজের টুকরো কাঁপছিল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “আমিও জানি, প্রতি পূর্ণিমার রাতে তাদের ফিরে আসা আমাদের পরিবারকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। আমি তাদের চোখ দেখেছি, রণজিৎ। যদিও তারা মাথাহীন, তবু এক অদৃশ্য দৃষ্টি যেন আমাকে প্রতিদিন অনুসরণ করে। আমি ঘুমোতে পারি না।” রণজিতের বুক ভারী হয়ে উঠল। সে বুঝল, কালীপদ যতই সত্য লুকানোর চেষ্টা করুন, অভিশাপের ছায়া তাঁকে এক মুহূর্তও ছাড়ছে না। এবার রণজিৎ স্থির করল—এই গোপন ইতিহাস প্রকাশ পেতেই হবে, তা না হলে মুক্তি মিলবে না। গ্রামের সবাইকে জানতে হবে, এবং অভিশপ্ত আত্মাদের শান্তি আনতে হলে মল্লিক পরিবারের পাপ স্বীকারের পথেই হাঁটতে হবে।
সাত
দিনের পর দিন খুঁজে বেড়াতে গিয়ে অবশেষে রণজিৎ পৌঁছে গেল নদীর ধারে এক বিস্মৃত শ্মশানে। একসময় এ জায়গা ছিল গ্রামের দাহস্থল, কিন্তু বহু বছর ধরে আর কেউ ব্যবহার করে না। চারপাশ ভাঙা চিতা, ধ্বংসস্তূপ, আর বুনো ঝোপঝাড়ে ভরা। বটগাছের গুঁড়ি জড়িয়ে আছে ভাঙা শিলালিপির ওপর, বাতাসে ভেসে আসছে স্যাতসেঁতে মাটির গন্ধ। গ্রামবাসী নাকি এখানে আসতে ভয় পায়, বিশেষ করে সূর্য ডোবার পর। রণজিৎ লণ্ঠন হাতে নিয়ে এগোতে লাগল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল মাটির ওপর অদ্ভুত দাগ, যেন অনেকগুলো পা বারবার একই জায়গায় হেঁটে গেছে। সে মাটিতে হাত দিয়ে খোঁড়ার চেষ্টা করল, আর দেখতে পেল পুরনো অস্থির চিহ্ন—কিছু সাদা হাড় মাটির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছে। রণজিতের বুক কেঁপে উঠল, কারণ গদাধর কাকা যেমন বলেছিলেন, এটাই সেই বরযাত্রীর কবরস্থান, যাদের হত্যা করে মাথা কেটে নেওয়া হয়েছিল। চারদিকে হাড়গোড়ের উপর চাপা দেওয়া শুকনো ফুল আর মাটির ঢিবি স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এখানে বহু আত্মা আজও অশান্ত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে টের পেল, তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন কারও নজরে পড়ছে, যেন কেউ অন্ধকারের আড়াল থেকে তাকে নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করছে।
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে নদীর ধারে শ্মশান জুড়ে নেমে এল ভয়ানক নীরবতা। হঠাৎ করেই অকারণ কুয়াশা ছেয়ে গেল চারদিক। রণজিৎ একসময় শুনতে পেল সেই পরিচিত শব্দ—ঢাকের ধুপধাপ আওয়াজ। তার গা শিউরে উঠল। আওয়াজটা ধীরে ধীরে কাছে আসছিল, যেন মৃতদের অদৃশ্য পা মাটিতে আছড়ে পড়ছে। সঙ্গে বাজতে লাগল শাঁখ, ঝঙ্কার, আর এক অদ্ভুত বিয়ের সুর। রণজিৎ স্থির হয়ে দাঁড়াল, কাঁপতে থাকা লণ্ঠনটাকে শক্ত করে ধরল। কুয়াশার ভেতর থেকে ঝলসে উঠল আলো, আর একে একে দেখা দিল মাথাহীন বরযাত্রীরা। তারা সবাই পুরনো পোশাক পরে আছে—কারও শরীরে ছিঁড়ে যাওয়া ধুতি, কারও কাঁধে ছেঁড়া চাদর, কারও হাতে এখনো শঙ্খ বা ঢাক। কিন্তু তাদের মাথার জায়গাটা ফাঁকা, শুধু কালো অন্ধকার। তারা একে একে এগিয়ে এল, তাদের ছায়া লম্বা হয়ে পড়ল কবরের মাটির ওপর। আর ঠিক মাঝখানে এসে দাঁড়াল এক বিশেষ অবয়ব—বর। তার গায়ে বিবাহের পোশাক, গলায় শুকনো মালা, আর বুকের ওপরে মাথাহীন শূন্যতা। তবু রণজিৎ অনুভব করল, সে যেন বরটির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, এক অদৃশ্য দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করে যাচ্ছে। ঢাকের শব্দ তখন কানে তালা ধরার মতো বাজছে, মাটির নিচ থেকে যেন শত শত আত্মার কান্না ভেসে আসছে।
রণজিৎ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ভেতরে ভয় তাকে গ্রাস করছিল। তবু সে জানত, এই মুহূর্তে ভয় পেলে চলবে না। ছিন্নমাথা বর হঠাৎ এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত তুলল, যেন তাকে কাছে ডাকছে। রণজিৎ বুঝল, স্বপ্নে শিবানী যেমন শুনেছিল, সেই একই বার্তা এবার তার সামনেই ফুটে উঠছে—“আমাদের মুক্তি দাও।” চারপাশের বরযাত্রীরা ধীরে ধীরে বৃত্ত তৈরি করে রণজিতকে ঘিরে ধরল। ঢাকের শব্দ আরও তীব্র হয়ে উঠল, আর হঠাৎ কবরের মাটি থেকে কুঁকড়ে ওঠা হাড় যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। রণজিতের লণ্ঠনের আলো কাঁপতে কাঁপতে নিভে গেল, চারদিক ভরে গেল অন্ধকারে। তার কানে শুধু প্রতিধ্বনি হচ্ছিল—“মুক্তি দাও… মুক্তি দাও…” সেই মুহূর্তে রণজিৎ বুঝল, সে আর কোনো কুসংস্কারের গল্পের মধ্যে নেই, সে সত্যিই মৃতদের অভিশপ্ত জগতে ঢুকে পড়েছে। এখন তার সামনে একটাই পথ—এই আত্মাদের মুক্তি দেওয়া, নইলে এ রাত তার শেষ রাত হয়ে দাঁড়াবে।
আট
রণজিৎ কবরস্থানে মৃত বরযাত্রীদের সঙ্গে দেখা করার পর পুরো শরীর কাঁপছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল সত্যের দরজা যেন অল্প একটু ফাঁক হয়েছে। সে পরদিন ভোরে ছুটে গেল গদাধর কাকার কাছে। কাকা তখন ভাঙা চারপাইয়ের উপর বসে বিড়ি টানছিলেন। রণজিতের চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখে তিনি প্রথমেই বুঝে গেলেন, কিছু একটা ঘটেছে। রণজিৎ সব খুলে বলল—শ্মশানের কবরস্থান, ঢাক-ঢোল, মাথাহীন বরযাত্রীর আবির্ভাব, আর সেই হাহাকার করা আওয়াজ। গদাধর কাকা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন, যেন বহু বছর ধরে বুকের ভেতরে চাপা থাকা এক গোপন ইতিহাসকে গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন। তারপর তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “হ্যাঁ রে, তুই যা দেখেছিস, তা নিছক কল্পনা নয়। এই অভিশাপের কথা আমার দাদু আমায় বলেছিলেন। তাদের মুক্তি পেতে হলে শুধু প্রার্থনা নয়, চাই এক বিশেষ আচার।” রণজিৎ হাঁফ ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন আচার কাকা? কীভাবে মুক্তি মিলবে?” কাকা মাটিতে আঙুল দিয়ে আঁকতে আঁকতে বললেন, “সেই বর, যে অসমাপ্ত যাত্রায় প্রাণ হারিয়েছিল, তাকে পুনরায় বিবাহের পূর্ণতা দিতে হবে। যেমন সে শোভাযাত্রা নিয়ে কনের বাড়ি যাওয়ার পথে ডাকাতির শিকার হয়েছিল, এবার তাকে শান্তিপূর্ণভাবে শোভাযাত্রা নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু সমস্যা হল—তার কনে কোথায়?”
রণজিৎ বিস্মিত হয়ে তাকাল। গদাধর কাকা আরও বললেন, “গ্রামের কারও রক্ত-মাংসের মানুষকেই ‘কনে’ হয়ে দাঁড়াতে হবে। মৃতের আত্মা অন্যথায় মুক্তি পাবে না। তারা আবার বেরোবে পূর্ণিমার রাতে, কিন্তু এবার যদি বর তার কনে পায়, আর শোভাযাত্রা শান্তিতে সম্পন্ন হয়, তবে অভিশাপ ভেঙে যাবে। নয়তো আরও ভয়াবহ পরিণতি ঘটবে।” রণজিতের মাথা চক্কর খেয়ে গেল। মানুষের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই আচার সম্পন্ন করা—এ কেমন ভয়ঙ্কর শর্ত! সে প্রতিবাদ করে বলল, “কোনো মেয়েকে এভাবে মৃত্যুর ঝুঁকিতে ফেলা যায় না। এটা তো আসলে তাদের আত্মাদের হাতে মানুষকে উৎসর্গ করা।” কাকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তাই তো গ্রামের কেউ এই আচার করতে রাজি হয়নি। যে দুঃসাহস দেখাবে, তাকে হয়তো মৃত্যু গ্রাস করবে, হয়তো মুক্তি আনবে। এই দুইয়ের মাঝেই অভিশাপের খেলা।” রণজিৎ বুঝতে পারল, এ শর্ত আসলে কেবল অদৃশ্য ভয়ের নয়, জীবন্ত মানুষের আত্মত্যাগেরও পরীক্ষা। তবু মনে হচ্ছিল, সত্যিই যদি এটাই পথ হয়, তবে হয়তো আত্মাদের শান্তি দেওয়া সম্ভব।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রণজিৎ শিবানীর কাছে সব খুলে বলল। শিবানী ভয়ে আঁতকে উঠল। সে তো স্বপ্নেই দেখেছে মাথাহীন বর তাকে ডাকছে—“আমাদের মুক্তি দাও।” এবার যখন শুনল সত্যিই কনের ভূমিকায় কাউকে দাঁড়াতে হবে, তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। শিবানী কাঁপা গলায় বলল, “ভাই, হয়তো ভাগ্য আমাকেই সেই পথে ঠেলে দিচ্ছে। যদি আমার মধ্যেই তাদের মুক্তির উত্তর লুকিয়ে থাকে?” রণজিৎ তৎক্ষণাৎ অস্বীকার করল, “না, তা হতে পারে না! আমি তোকে এ বিপদে ফেলতে পারি না। তুই আমার একমাত্র আপন।” কিন্তু শিবানীর চোখে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল। সে বলল, “ভাই, অভিশাপ ভাঙতে যদি কাউকে এগোতে হয়, তবে আমি পিছিয়ে থাকব না। কারণ ওরা আমাকে ডাকছে, আমি তা স্পষ্ট অনুভব করেছি।” রণজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মনে দ্বন্দ্ব—একদিকে বোনের জীবনের ভয়াবহ ঝুঁকি, অন্যদিকে গ্রামের মুক্তি আর মৃত আত্মাদের শান্তি। গদাধর কাকা দূর থেকে সব শুনছিলেন, আর ধীরে ধীরে মাথা নাড়ছিলেন। তিনি জানতেন, সময় খুব অল্প। পরের পূর্ণিমা রাতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কে হবে সেই কনে, আর কীভাবে সম্পন্ন হবে এই ভয়ঙ্কর আচার।
নয়
পূর্ণিমার আলোয় ভেসে উঠেছিল গোটা গ্রাম। সেদিন আকাশ ছিল ভৌতিকভাবে লালচে, যেন রক্তে রাঙা চাঁদ তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। নদীর ধারে সেই পরিত্যক্ত শ্মশান আর কবরস্থান ঘিরে বসেছিল গ্রামের কয়েকজন সাহসী যুবক, সঙ্গে গদাধর কাকা আর রণজিৎ। তারা চারপাশে প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিল, যেন অন্ধকারকে ঠেকিয়ে রাখা যায়। বাতাসে ধূপ আর গন্ধরাজ ফুলের ঘ্রাণ ভাসছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে মিশে ছিল মৃত্যুর এক অচেনা গন্ধ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের বৃদ্ধারা কানে কানে মন্ত্রোচ্চারণ করছিল, কেউ কেউ আবার কেঁপে কেঁপে শ্লোক আওড়াচ্ছিল। গদাধর কাকা নির্দেশ দিলেন, “যা হবে, হবে আজ রাতে। মৃত বরকে তার কনে দিতে হবে, নইলে ওরা আর কখনো শান্তি পাবে না।” রণজিতের বুকের ভেতর ধকধক করছিল, কারণ আজ শিবানীকে সেই ভয়ঙ্কর পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। চারপাশে উত্তেজনা, ভয় আর শঙ্কা একসঙ্গে মিশে অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছিল। পূর্ণিমার আলো নদীর জলে প্রতিফলিত হচ্ছিল, আর মনে হচ্ছিল লাল রক্তধারা বয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ করে চারদিক থেকে ভেসে উঠল ঢাকের শব্দ। প্রথমে ক্ষীণ, তারপর যেন অগ্নিবেগে ছুটে আসছে। ঢাকের সঙ্গে মিশে গেল শঙ্খধ্বনি, ঝঙ্কারের আওয়াজ, আর এক করুণ বিলাপ। কুয়াশা হঠাৎ ঘন হয়ে চারদিক ঢেকে দিল। প্রদীপের আলো কেঁপে উঠতে লাগল, যেন মৃত্যুর ভয়ে তারাও নিভে যেতে চাইছে। আর সেই কুয়াশার ভেতর থেকে একে একে এগিয়ে এল মাথাহীন বরযাত্রীরা। কারও হাতে ঢাক, কারও হাতে শঙ্খ, কারও হাতে শুকনো ফুলের ঝুড়ি। তাদের পোশাক ছেঁড়া, শরীর জীর্ণ, আর তাদের শূন্য ঘাড় থেকে রক্তাক্ত কুয়াশার মতো ধোঁয়া বের হচ্ছিল। রণজিৎ স্থির দাঁড়িয়ে দেখল, বরযাত্রীরা বৃত্তাকারে মিছিল করছে, আর তাদের মাঝখানে ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল সেই বর—মাথাহীন, অথচ পরনে ফুলমাখা জোব্বা, গলায় মালা, হাতে শ্বেতপদ্ম। সে থেমে দাঁড়াল শিবানীর সামনে। মুহূর্তেই চারপাশে ভেসে উঠল অদ্ভুত শীতলতা। শিবানীর বুক ধড়ফড় করছিল, কিন্তু সে চোখ নামাল না। সে জানত, আজ ভয়কে জয় করতে হবে। বর তার হাতে ফুলের মালা বাড়িয়ে দিল, আর সেই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল, মৃত আর জীবিতের মাঝের সীমারেখা ভেঙে গেছে।
যখন বর মালা শিবানীর দিকে বাড়িয়ে দিল, হঠাৎ চারপাশের কবরগুলো থেকে গুঞ্জন উঠল। শ্মশানের মাটি যেন দুলে উঠল, হাড়গোড়ের শব্দ ভেসে এল বাতাসে। একসঙ্গে শত শত অদৃশ্য কণ্ঠ বিলাপ করতে লাগল, যেন তাদের মুক্তির মুহূর্ত এসে গেছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, ঢাকের শব্দ আছড়ে পড়ছিল হৃদয়ে। গদাধর কাকা তখন জপ করতে লাগলেন, “শান্তি… শান্তি…” কিন্তু সেই মন্ত্রোচ্চারণ ঢাকের আওয়াজে চাপা পড়ছিল। শিবানী সাহস করে বরটির দিকে হাত বাড়াল। তার আঙুল ফুলমালার স্পর্শ পেল, ঠাণ্ডা, ভিজে, মৃতের গন্ধে ভরা। মুহূর্তেই চারপাশে এক বিকট ঝড় বইতে শুরু করল। চাঁদ রক্তবর্ণ আলো ছড়াল, শ্মশানের চারদিক কেঁপে উঠল, আর শঙ্খধ্বনি মিলিয়ে গেল মৃতদের কান্নার সঙ্গে। মনে হচ্ছিল, পুরো গ্রামটাই কেঁপে যাচ্ছে সেই শপথবদ্ধ সাক্ষাতের সাক্ষী হয়ে। রণজিৎ অসহায় চোখে তাকিয়ে দেখল, তার বোন ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর দরজার সামনে, আর ছিন্নমাথা বর তাকে নিয়ে যেতে চাইছে অভিশাপ ভাঙার পথে। এখন আর ফেরার কোনো উপায় নেই।
দশ
পূর্ণিমার রক্তলাল আলোয় শিবানীর হাত কাঁপছিল, তবু সে পিছু হটল না। বর তার শূন্য ঘাড় উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে সাদা পদ্মফুলের মালা। মুহূর্তটা যেন সময়কে থামিয়ে দিল—কেউ নিশ্বাস নিচ্ছিল না, কেউ শব্দ করছিল না। শুধু নদীর জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি কাঁপছিল, আর ঢাকের আওয়াজ ধুকপুক করছিল মানুষের হৃদস্পন্দনের মতো। শিবানী চোখ বুজে মালা তুলল, আর ধীরে ধীরে সেটি বর-এর গলায় পরিয়ে দিল। মালার ছোঁয়া লাগতেই বাতাসে শীতলতার বদলে অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। মাটির গন্ধ, ফুলের ঘ্রাণ আর মৃতদের বিলাপ একসঙ্গে মিশে গেল এক অনির্বচনীয় শান্তিতে। বর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল, যেন শত বছরের অপেক্ষা শেষে সে তার অপূর্ণ মিলন সম্পন্ন করেছে। তারপর শোভাযাত্রা হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে ভেসে উঠল। একে একে মাথাহীন বরযাত্রীরা মশাল উঁচু করে ধরল, আর তাদের শরীর থেকে রক্তাক্ত কুয়াশা বদলে গেল সোনালি আলোয়। যে কণ্ঠস্বর এতদিন বিলাপ করত, সেই কণ্ঠ আজ উচ্চারণ করল মুক্তির গান। গ্রামের মানুষরা হাওয়ায় অনুভব করল এক দমকা হাওয়া, যেন কোনো অদৃশ্য হাত তাদের বুক থেকে ভার নামিয়ে দিল।
ধীরে ধীরে শোভাযাত্রা আলোর ভেতরে মিলিয়ে যেতে লাগল। ঢাকের শব্দ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে এলো, শঙ্খধ্বনি মিলিয়ে গেল বাতাসের গভীরে। বর শিবানীর দিকে শেষবার হাত বাড়াল, তার কাঁপা আঙুলে ঠাণ্ডা ছোঁয়া লাগল, আর তারপর হঠাৎ সে মিলিয়ে গেল অগ্নিশিখার মতো। বরযাত্রীরা একে একে অদৃশ্য হলো, কবরস্থান নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল, শুধু মাটির উপর কয়েকটি শুকনো ফুল ছড়িয়ে রইল। গদাধর কাকা হাঁটু গেড়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন—“শেষ হল, অবশেষে মুক্তি মিলল।” গ্রামের সবাই চোখের জলে ভেসে উঠল, কারণ তারা জানত, এত বছর ধরে বুক চেপে রাখা আতঙ্কের অবসান হয়েছে আজ রাতে। শিবানী স্থির দাঁড়িয়ে ছিল, তার মুখে কোনো ভয় নেই, বরং অদ্ভুত এক শান্তির ছাপ। রণজিৎ দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল, যেন মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে তার প্রিয় বোনকে। চারপাশের বাতাস আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠল, দূরের পাখিদের ডাক শোনা গেল, নদীর জলে প্রতিফলিত চাঁদ আর লাল ছিল না, সে হয়ে উঠেছিল স্বচ্ছ সাদা। অভিশাপ ভেঙে গেছে—এটাই ছিল গ্রামের শতাব্দীর সবচেয়ে বড় মুক্তি।
কিন্তু রাত গভীর হলে, সবাই ঘরে ফিরে যাওয়ার পর, রণজিৎ একা ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পূর্ণিমার চাঁদ তখন সাদা আলো ছড়াচ্ছিল, শান্ত আর কোমল। হঠাৎ দূরে, অনেক দূরে, কোথাও বনভূমির গভীরে সে শুনতে পেল ঢাকের ক্ষীণ শব্দ। এতটাই ক্ষীণ যে তা হয়তো ভ্রম বলেই মনে হতে পারত। কিন্তু রণজিৎ বুঝল—ওরা বিদায় নিচ্ছে। এটা আর ভয়ের ঢাক নয়, বরং শেষ প্রণাম, শেষ কৃতজ্ঞতা। তার বুক ভরে উঠল অদ্ভুত আবেগে। সে জানত, মুক্তি মিললেও আত্মাদের চিহ্ন গ্রাম থেকে চিরকাল মুছে যাবে না। তারা যেন রাতের আকাশের নক্ষত্র হয়ে দূরে থেকে তাকিয়ে থাকবে। শিবানী ঘুমিয়ে পড়েছিল গভীর নিদ্রায়, কিন্তু রণজিৎ অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে শপথ নিল—এই ইতিহাস সে ভুলতে দেবে না। আগামী প্রজন্মকে বলবে, কেমন করে এক বোন নিজের সাহস আর আত্মত্যাগ দিয়ে শতবর্ষের অভিশাপ ভেঙে দিয়েছিল। ঢাকের শেষ আওয়াজ মিলিয়ে গেল বাতাসে, আর গ্রাম ডুবে গেল অচেনা এক শান্তির ঘুমে।
সমাপ্ত




