Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

ছিন্নমস্তার প্রলয়

Spread the love

ঊর্মি পাল


অধ্যায় ১: “অশ্রু ও বিষ”

অমৃতা এক কঠিন সন্ধ্যায় ঘরের জানালার কপাট বন্ধ করে বসেছিল। তার চারপাশে সন্ধ্যার অন্ধকার পসরানো শুরু করেছে, কিন্তু তার মনে এখনও মায়ার মতো সাদা আলোয় একটা বিষণ্ণ রূপের প্রতিফলন। এক সময় সে স্বপ্ন দেখেছিল, কী সুন্দর হবে তার জীবন! কিন্তু এখন তার সামনে শুধু একটা দীর্ঘ অন্ধকার পথ, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তার জীবনের সবকিছুই যেন একটা অদৃশ্য বেষ্টনীতে আটকে গেছে, পরিবারের চাহিদা, তার স্বামী রোহিতের প্রত্যাশা, তার সন্তান মাহির স্নেহের আগ্রহ—এসব কিছু মিলে এক ভারী বোঝা হয়ে গেছে। রোহিত একজন সফল ব্যবসায়ী, কিন্তু তার সাফল্যের পেছনে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। রোহিতের চোখে অমৃতা কখনোই পুরোপুরি স্ত্রীর মর্যাদা পায়নি। সে চেয়েছিল একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, যেখানে স্বামী এবং স্ত্রী একে অপরকে বুঝবে, একে অপরকে সহযোগিতা করবে, কিন্তু বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। রোহিত কখনও তার অসুবিধা বোঝেনি, বরং তার নিজের ক্যারিয়ার এবং কর্মজীবনের চাপে অমৃতার প্রতি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। সেই অবহেলা, অস্বীকার, এবং একাকীত্বের অনুভূতি অমৃতার মনকে বিষাক্ত করে তুলেছিল। সে প্রতিদিন এক ধরণের মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করত, কিন্তু তার মুখে সেটা কখনো প্রকাশ পেত না। পারিবারিক সুখের সাজানো ছবি, তার চারপাশের লোকদের মুখে হাসি, সব কিছু যেন এক নাটক ছিল, যেখানে অমৃতা শুধু একটি ভূমিকা পালন করছিল, তার কোন নিজস্ব চাহিদা ছিল না।

অমৃতা তার নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পায় না। সে একটি বাচ্চা ছেলে মাহির মা, একজন স্ত্রী, একটি সংসারের প্রাণ, কিন্তু কোথাও তার নিজস্ব পরিচয় হারিয়ে গেছে। মা হওয়ার চাপে তার নিজের পরিচিতি বদলে গেছে, একজন স্ত্রীর প্রত্যাশায় তার আত্মমর্যাদা সংকুচিত হয়েছে। এই ধীরে ধীরে তাকে পঁচে যেতে হয়েছে। মাহি তার একমাত্র আশার আলো, কিন্তু সেই মিষ্টি শিশুর ছোট ছোট হাসির মধ্যেও এক ধরনের দুঃখভরা ভাবনা ঢুকে পড়ে। মায়ের মতো একজন নারী, যে অন্যদের জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত, তার নিজস্ব প্রয়োজনগুলোকে ঘৃণা করে, কি না সে নিজেকে খুঁজে পেতে চায়? অমৃতার এই প্রশ্ন তাকে প্রায়ই অশান্ত করে তোলে। রোহিত যদি একটু সময় দিতো, যদি সে বুঝত অমৃতার মনোভাব, যদি সে তার দুঃখের কথা শুনতো, তবে কী হতে পারত? কিন্তু তা কখনো ঘটেনি। রোহিতের জীবনে তার নিজের সাফল্য, তার নিজের কাজ এবং বাইরের বিশ্বের চাপ এতটাই প্রবল যে, সে কখনোই নিজেকে স্ত্রীর চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি।

অমৃতা যখন থেরাপির জন্য শুভ্রর কাছে যায়, তখন সে আশা নিয়ে যায় যে, হয়তো এখানে সে নিজের জন্য কিছু শুনতে পাবে। শুভ্র একজন অভিজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী, কিন্তু সে নিজেও একধরণের বিপদে আটকা পড়েছে, যেভাবে সে তার নিজের জীবনের ভার সামলাতে পারে না, সেভাবেই অন্যদের সাহায্য করতে চায়। অমৃতার প্রথম দেখা শুভ্রর সঙ্গে ছিল অনেক আগে, যখন সে তরুণ ছিল, একটি স্বপ্নমুখী মেয়ে, যিনি ভবিষ্যৎ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন সে সেই অতীতের অচেনা মেয়ে হয়ে গেছে, যার হৃদয় আচ্ছন্ন। শুভ্র তার চিন্তা ও অনুভূতিগুলিকে ছড়িয়ে দেয়, এবং অমৃতার মনকে এক নতুন দৃষ্টিতে দেখতে শেখায়, কিন্তু সে যখন নিজের পুরনো জীবন ফিরে পেতে চায়, তখন শুভ্র তাকে বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। শুভ্র জানে, অমৃতা শুধু একজন নারীর জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতি ক্ষোভে ও হতাশায় বিভ্রান্ত। এটি শুধুমাত্র পারিবারিক সমস্যা নয়, বরং একটি বৃহত্তর সংকট, যেখানে নারী তার অস্তিত্বের সত্যিকারের অর্থ খুঁজে পেতে চায়, কিন্তু প্রতিনিয়ত তাকে সমাজের আড়ালে থেকে যেতে হয়। অমৃতার মনোবিজ্ঞানী শুভ্র, একদিকে তাকে তার অনুভূতিগুলি বুঝতে সাহায্য করে, তবে তার নিজের জীবনেও এক ধরনের সমাধানের অভাব থাকে। সেই সন্ধ্যায়, যখন অমৃতা শুভ্রের সাথে তার শৈশব, তার শ্বশুরবাড়ি, তার স্ত্রীর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করে, তার চোখে এক ধরনের অন্তর্দৃষ্টি আসে। সে অনুভব করে, সে শুধু দুঃখিত নয়, বরং সেই দুঃখের ভেতর একটা শক্তি লুকিয়ে আছে, যে শক্তি তাকে তার সংগ্রাম থেকে মুক্তি দিতে পারে।

অমৃতা জানে, এই পথ এত সহজ হবে না, কিন্তু তার ভিতর থেকে একটা অন্তর্দৃষ্টি আসে, যেন সে তার জীবনটাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখতে চায়। সে ঠিক করেছিল, এবার সে শুধু তার পরিবার এবং তার দায়িত্বের কাছে বন্দী থাকবে না, তার নিজেরও কিছু অধিকার রয়েছে। তখন থেকেই তার ভিতরে এক নতুন লড়াই শুরু হয়, যে লড়াই তাকে তার পুরনো জীবন এবং বিশ্বাসের বেড়াজাল ভেঙে নতুন জীবন গড়তে সহায়তা করবে।

অধ্যায় ২: “মনে রেখো, আমি তোমার পাশে আছি”

অমৃতা আজ অনেক দিন পর পার্ণার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। পার্ণা, তার সহকর্মী ও প্রিয় বন্ধু, এমন একজন মহিলা, যে জীবনের সব কিছুই নিজের শর্তে বাঁচে। অমৃতা জানে, পার্ণা জীবনে সমস্ত কিছু সহজে অর্জন করেছে বলে নয়, বরং সে সবসময়ে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নিজের সত্যিকারের পরিচয় খুঁজে বের করেছে। আজকের দিনটি একেবারে অন্য রকম, কারণ অমৃতা জানে, আজ তাকে তার সমস্ত গোপন দুঃখ ও সংগ্রামের কথা পার্ণার সঙ্গে শেয়ার করতে হবে, যেগুলো সে নিজে অনেক দিন ধরে ঢেকে রেখেছে। অমৃতা মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, কি বলবে, কোথা থেকে শুরু করবে, তার ভেতরের গভীর অনুভূতিগুলি কিভাবে খুলে বলবে, যাতে পার্ণা বুঝতে পারে।

পার্ণার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল এক ধরনের অদৃশ্য যোগসূত্র। পার্ণা ছিল অমৃতার জীবনে সেই মানুষ, যার পাশে দাঁড়িয়ে সে নিজের ভয় এবং দ্বন্দ্বের কথা বলে উঠতে পারত। পার্ণার কাছে অমৃতা খুব কমই নিজের দুঃখের কথা বলেছে, কিন্তু আজকের দিনটি ছিল তার জন্য অন্য কিছু। আজ, সে তার নিজস্ব অবস্থান নিয়ে কথা বলবে, নিজের ভিতরের কষ্টগুলির সঙ্গে এক নতুন সম্পর্ক গড়বে। পার্ণার বাড়ি যাওয়ার পথে অমৃতার মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল— “পার্ণা আমাকে কি বুঝবে? সে কি বুঝতে পারবে, আমি একে একে সব কিছু হারিয়ে ফেলেছি? সে কি আমাকে সাহস যোগাবে?”

পার্ণার বাড়ি পৌঁছানোর পর, পার্ণা হাসিমুখে তাকে স্বাগতম জানায়, কিন্তু তার মুখে কিছুটা উদ্বেগ ছিল। পার্ণা অমৃতার মধ্যে এক ধরনের পরিবর্তন দেখেছে, যেটি সে আগে কখনো দেখেনি। অমৃতা বসে পড়ল, এবং পার্ণা তার কাছে কফি নিয়ে আসতে গিয়েছিল, কিন্তু অমৃতা তাকে থামিয়ে দিল। “পার্ণা, আমি একটু কথা বলতে চাই,” সে বলল, “আজ আমি তোমার কাছে আসিনি শুধুমাত্র সময় কাটানোর জন্য, আমি কিছু বলতে চাই, কিছু শেয়ার করতে চাই যা আমি বহুদিন ধরে চুপ করে রেখেছি।”

পার্ণা অমৃতার চোখের দিকে তাকাল, এবং তার ঠোঁটে এক সান্ত্বনার হাসি ফুটে উঠল। “তুমি জানো, আমি তোমার পাশে আছি, অমৃতা। তুমি যা বলবে, আমি শুনব, কারণ আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তোমার ভেতরে অনেক কিছু জমে গেছে, কিন্তু এখন সময় এসেছে এগুলো বেরিয়ে আসার। তুমি কি কিছু শেয়ার করতে চাও?”

অমৃতা এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, “আমি জানি, তুমি জানো না—আমি বহুদিন ধরে নিজের জন্য কিছু করতে পারিনি। আমি শুধু মায়ের দায়িত্ব পালন করেছি, স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছি, কিন্তু কখনো নিজের জন্য কিছু করিনি। আমি জানি, আমি অনেক কিছু হারিয়ে ফেলেছি, কিন্তু এখন আমি জানি যে, আমাকে নিজেকে খুঁজে পেতে হবে।” অমৃতা কিছু সময় চুপ থেকে পার্ণার দিকে তাকাল। “কিন্তু আমি জানি না কোথা থেকে শুরু করতে হবে। আমি জানি না, আমার জন্য কোনো জায়গা আছে কিনা। আমার জীবন শুধু পরিবারের জন্য, আমার স্বামী রোহিতের জন্য, আর মাহির জন্য। কিন্তু কোথাও আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি।”

পার্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে অমৃতার কথাগুলি শোনে। তারপর সে ধীরে ধীরে উত্তর দিল, “তুমি জানো, অমৃতা, তোমার জীবন শুধু তোমার পরিবারের জন্য নয়, এটি তোমারও জীবন। তোমার জন্য তোমার অধিকার আছে, তোমারও কিছু পাওয়ার অধিকার আছে। তুমি যদি শুধু পরিবার ও স্বামীকে নিয়ে বাঁচো, তাহলে তোমার ভিতরের মানুষটি চিরকাল নিখোঁজ হয়ে যাবে। তুমি তোমার অনুভূতি, তোমার সুখ, তোমার স্বপ্নগুলোও বিবেচনা করবে, এটাই জীবনের মূল। তুমি যেমন মায়ের ভূমিকা পালন করো, তেমনি নিজেও এক জন নারী, যার নিজস্ব স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষা রয়েছে।”

পার্ণার কথায় অমৃতার ভেতর কিছু পরিবর্তন অনুভূত হল। তার মনে হতে লাগল, হয়তো তার নিজের জীবনে নতুন কিছু শুরু করার সময় এসেছে। পার্ণা যখন বলল, “অমৃতা, তোমার জীবন তোমার হাতে। তুমি যে কোনো সময় সিদ্ধান্ত নিতে পারো, তোমার জীবনের পথে নতুন রূপরেখা তৈরি করতে পারো। আর আমি নিশ্চিত, তুমি সেটা করতে পারবে।” অমৃতা সেদিন এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেতে শুরু করল। সে জানল, শুধু পরিবারের জন্য নয়, তার নিজের জন্যও জীবনে কিছু করতে হবে।

তারা আরও কিছু সময় একসঙ্গে কাটাল। পার্ণা অমৃতাকে অনেক কিছু বলল, তাকে সাহস জোগাল, তার ভেতরের শক্তিকে বের করে আনার জন্য অনুপ্রাণিত করল। অমৃতা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে লাগল, সে নিজেই তার জীবনের চিত্রকলা আঁকতে পারে, সে নিজে নিজের ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারে। সে পার্ণার কথাগুলি মনে রেখে, তার জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে চেয়েছিল।

পার্ণা চলে যাওয়ার সময় অমৃতা সেদিন নিজের অজানা পথের দিকে এক পা এগিয়ে দিল। তার সামনে ছিল জীবনের এক নতুন যাত্রা, যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পাবে, নিজেকে শিখবে এবং তার আত্মবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাবে।

অধ্যায় ৩: “আত্মসম্মান ও সংকট”

অমৃতার মন এক অস্থিরতার মধ্যে ছিল। পার্ণার কথা গুলি তার হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলেছে, কিন্তু সে জানত, নিজের জীবন বদলানোর জন্য তাকে আরো অনেক কিছু করতে হবে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কিভাবে নিজেকে খুঁজে পাবে, কিভাবে পুরনো জীবন থেকে বেরিয়ে আসবে। তার ভেতরের এক শক্তি জন্ম নিচ্ছিল, কিন্তু সেই শক্তির পরিচয় সে পুরোপুরি খুঁজে পায়নি। এই পরিবর্তনকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য, তার কিছু গভীরতর অভ্যন্তরীণ জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে। নিজের দুঃখ এবং ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে, যাতে সে তার আসল পরিচয়টি পুনরায় খুঁজে পেতে পারে। তবে, অমৃতা জানত, এই যাত্রা এক দিনেই শেষ হবে না। এটি একটি দীর্ঘ পথ এবং এই পথের প্রতিটি ধাপ তাকে নিজের ভেতরের অন্ধকার এবং আলোকে একসাথে গ্রহণ করতে হবে।

রোহিত আজ রাতে বাড়ি আসবে। প্রতিদিনের মতো তার মুখে থাকবে এক ধরনের একঘেয়েমি, কিন্তু অমৃতা জানত, আজ তার কিছু বলার আছে। সে আর অপেক্ষা করতে পারছিল না। যদিও রোহিত তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে অমৃতার পাশে ছিল, কিন্তু সেই উপস্থিতি ছিল একটা বাধ্যবাধকতার মতো, যা আসল সম্পর্কের গভীরতা তৈরি করতে পারেনি। অমৃতা জানত, তাকে আজ সত্যি কথা বলতেই হবে। রোহিতকে জানাতে হবে, যে সে আর শুধু তার স্ত্রীর ভূমিকা পালন করতে চায় না, তার জীবনও তার নিজের অধিকার। সে আর শুধু তার স্বামীর মেয়ে, তার সন্তানের মা হতে চায় না।

রোহিত বাড়ি ফিরলে, অমৃতা খোলামেলা কথা বলতে শুরু করল। “রোহিত, আমি তোমার কাছে কিছু বলছি, যা আমি বহুদিন ধরে মনে মনে চেপে রেখেছি। আমি জানি, তুমি আমার প্রতি সহানুভূতিশীল, কিন্তু আমার ভিতরের ভয়ের কথা কখনো বলিনি। আমি জানি, তুমি আমার কষ্ট জানো না। আমি জানি, তুমি একজন ব্যস্ত মানুষ, কিন্তু আমি সব সময় শুধু তোমার জন্য এবং এই পরিবারের জন্য কাজ করেছি, কিন্তু এখন, আমি জানি, আমি আর শুধু ‘মা’ বা ‘স্ত্রী’ হতে চাই না, আমি নিজেও একটা মানুষ।”

রোহিত একটু বিরক্ত হয়ে বলল, “অমৃতা, তুমি কি বলছ? আমি তো তোমার পাশে আছি। তুমি কি মনে কর, আমি তোমাকে ভালোবাসি না?” তার চোখে এক ধরনের অসহিষ্ণুতা ফুটে উঠল। “কী চাও তুমি? বাড়ির কাজ, সন্তান, সংসার—আমি তো সবকিছুই করি। তুমি কি আরও কিছু চাইছো?”

অমৃতা স্তব্ধ হয়ে গেল। রোহিতের কথাগুলো তার মনকে আঘাত করল, কিন্তু সে জানত, এই ক্ষোভের উত্তরে তাকে ভেঙে পড়া উচিত নয়। সে এক দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি চাই, তুমি আমাকে বুঝো, রোহিত। আমি তোমার পাশে আছি, কিন্তু কখনো কখনো আমার নিজস্ব প্রয়োজনগুলোও রয়েছে।” তার চোখের কোণে জল চলে এল। এই মুহূর্তে তার মনে হয়েছিল, সেই পুরনো নারী, যে নিজের পরিচয় ভুলে গেছে, আবারও তার শ্বাস নিতে শুরু করেছে।

রোহিত চুপ হয়ে গেল। সে জানত, অমৃতার কথা শোনা দরকার, তবে তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা সে কোনদিন ভাবতে চায়নি। সেদিন রাতেই অমৃতা পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে এক নতুন জীবন শুরু করবে। তার মানসিক শান্তি এবং স্বাধীনতা তার নিজের হাতে, তাকে এই জীবনে নতুন কিছু আবিষ্কার করতে হবে।

পরের দিন অমৃতা শুভ্রর কাছে যেতে লাগল। যদিও তাকে জানাতে চায়নি, তবুও তার মনে মনে এক ধরনের প্রস্তুতি চলছিল। শুভ্র ছিল সেই মানুষ, যে তার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বগুলো বুঝতে পারতো। একদিন, শুভ্র বলেছিল, “অমৃতা, তোমার ভেতরে যেসব সংকট আছে, সেগুলো শুধু তোমার নয়, বরং এক গভীর সমাজিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। নারীরা অনেকসময় নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে যায়। নিজেদের স্বপ্নের কথা বলতে ভয় পায়, নিজের প্রয়োজনগুলো প্রকাশ করতে পারে না। তুমি যদি নিজের জায়গাটা খুঁজে পাবে, তবে সেটি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে।”

অমৃতা জানত, শুভ্র ঠিক বলেছে। সে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতে শুরু করেছিল। সে আর তার পুরনো পরিচয়কে পরিত্যাগ করতে চায়নি। তার মায়ের ভূমিকা, স্ত্রীর দায়িত্ব, সকল কিছু সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এখন, তার নিজের পরিচয়ও তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।

অমৃতা শুভ্রকে জানাল, “আমি নিজেকে খুঁজে বের করতে চাই। আমি জানি, আমাকে আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। নিজের জন্য কিছু করতে হবে। আমি জানি, এখনই সময়।” শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে বলল, “অমৃতা, তুমি যে পথ বেছে নিয়েছ, তা সহজ নয়। কিন্তু তুমি জানো, তুমি একবার শুরু করলে, তুমি নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাবে। মনে রেখো, কোনদিন একা থাকলে, আমি তোমার পাশে আছি।”

অমৃতা এবার দৃঢ় সংকল্পে নিজের পথে এগিয়ে চলল। জানল, এটি একটি দীর্ঘ পথ, তবে এই যাত্রা তাকে সত্যিকার অর্থে তার জীবনের লক্ষ্য খুঁজে দিতে সাহায্য করবে।

অধ্যায় ৪: “স্বপ্নের পরিসীমা”

অমৃতার জীবনে পরিবর্তনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছিল। পার্ণার সঙ্গে হওয়া আলোচনাগুলির পর, সে একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি পেতে শুরু করেছে। নিজেকে আর সে পুরনো ‘স্ত্রী’ বা ‘মা’ হিসেবে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় না। তার ভেতরের এক অব্যক্ত চাহিদা ছিল, যে সে নিজেকে খুঁজে পাবে, তার স্বপ্ন, তার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে চাইবে। কিন্তু এই পথের প্রথম পদক্ষেপে তাকে অনেক কষ্ট ও দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, এবং এই দ্বন্দ্ব শুধু তার পরিবারের সঙ্গে নয়, বরং তার নিজের সাথেও ছিল। সে নিজেকে নতুন করে জানার এবং তার মনের গভীরে লুকানো শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে ছিল। কিন্তু সে জানত, এই যাত্রা সহজ হবে না।

রোহিতের সঙ্গে এক সপ্তাহ পর আবার কথা বলতে হয়েছিল। সে জানতো, তার স্বামী এখনো পুরোপুরি বিষয়টি বোঝেনি, এবং তার জীবন পরিবর্তনের এই নতুন অধ্যায়টি তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করা এত সহজ ছিল না। রোহিত এক ধরনের পরিত্যক্ত মনোভাব নিয়ে বসেছিল, তার চোখে যেন এক ধরনের অসন্তোষ ফুটে উঠছিল। অমৃতা তার চোখে সরাসরি তাকিয়ে বলল, “রোহিত, আমি জানি, তুমি এই সব কিছু সহজে মেনে নাওনি, কিন্তু আমি জানি, আমারও কিছু প্রয়োজন আছে। আমি তোমার সঙ্গে আছি, তবে আমি চাই আমার নিজস্ব পরিচয়ও থাকতে পারে। তুমি আমার পাশে থাকলে, আমি নিজের জন্যও কিছু করতে চাই।” রোহিত কিছুটা নীরব হয়ে গেল। “অমৃতা, আমি জানি না তুমি ঠিক কী চাও। আমি তো তোমার জন্য সব কিছু করি।”

অমৃতা শান্তভাবে বলল, “তুমি যা চাও, তাও আমি করি, কিন্তু এই জীবনে আমাকে নিজের জন্য কিছু করতে হবে। আমি একটা নতুন পথ খুঁজে বের করতে চাই, যেখানে আমি নিজেকে পূর্ণভাবে বুঝতে পারব। আমি জানি, আমি মায়ের ভূমিকা পালন করব, স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করব, কিন্তু আমি চাই, আমারও একটা শ্বাস নেবার জায়গা থাকুক।” রোহিত কিছু সময় চুপ হয়ে ছিল। অমৃতা জানত, এই সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তবে, সে জানত, নিজেকে খুঁজে পাওয়া তার জন্য সবচেয়ে জরুরি।

এই কথোপকথনের পর অমৃতা এক নতুন অনুভূতির মধ্যে ছিল। কিছুটা ভয়ও ছিল, কারণ রোহিত তাকে কখনোই পুরোপুরি বুঝতে পারেনি। তার অজানা চিন্তা-ভাবনা ছিল, কিন্তু অমৃতা জানত, তার এই নতুন যাত্রা শুরু করা জরুরি। সে আর ফিরে তাকাতে চায়নি। পার্ণার কথাগুলি তার মনে বার বার ফিরে আসছিল—”নিজেকে খুঁজে পাও, নিজের শক্তির দিকে তাকাও, এবং জানো, তুমি একা নও।”

অমৃতা থেরাপি সেশনে যাবার পর, শুভ্র তাকে কিছু প্রশ্ন করেছিল। “অমৃতা, তুমি কি মনে কর, তোমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কি?” এই প্রশ্নের উত্তরে অমৃতা কিছুক্ষণ চুপ ছিল, তারপর বলল, “আমার পরিবারের সুখ, আমার সন্তানের ভালোলাগা—এগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, তবে, আমি যদি নিজের অস্তিত্ব খুঁজে না পাই, যদি নিজের স্বপ্ন পূরণ না করতে পারি, তবে আমি কি হতে পারব?” শুভ্র কিছুটা নীরব হয়ে বলল, “তুমি জানো, তোমার জীবন তোমার নিজের, আর তুমি যখন নিজের স্বপ্নের দিকে এগিয়ে যাবে, তখন তোমার পরিবারও তা বুঝতে পারবে। তোমার জীবন মানেই শুধু অন্যদের জন্য নয়, তোমারও কিছু অধিকার রয়েছে।”

অমৃতা এবার নিজের সিদ্ধান্তে আরও দৃঢ় হয়ে উঠল। সে জানত, তার ভেতরের যে শক্তি রয়েছে, তা কখনোই তাকে হতাশ করবে না। তবে, এই পথে তাকে একাকী হতে হতে পারে। সমাজ, পরিবার, বা অন্যদের মতামতকে অনেক সময় তার স্বপ্নের পথে প্রভাবিত করতে হতে পারে, কিন্তু সে জানত, এই যাত্রা তাকে তার সত্যিকারের পরিচয় ও শক্তি খুঁজে দেবে।

একদিন, যখন অমৃতা একা একটি ক্যাফেতে বসেছিল, তার মনে একটা চিন্তা এল—”আমি যদি কখনো নিজের স্বপ্নগুলিকে সত্যি করি, যদি কখনো নিজের জীবনকে নতুন করে গড়ে তুলি, তবে সেটি কেবল আমার জন্য নয়, বরং আমার পরিবার ও সমাজের জন্যও বড় কিছু হতে পারে।” এই চিন্তা তাকে এক ধরনের শান্তি দিল, এবং তার জীবনকে নতুন করে দেখার ক্ষমতা দিল।

অমৃতা এক নতুন জীবনের সন্ধানে ছিল। সে জানত, এটি কোনো সহজ যাত্রা নয়, তবে তাকে তার নিজের পথে হাঁটতে হবে, তার শক্তিকে আবিষ্কার করতে হবে। তার স্বপ্নের পরিসীমা এখন সীমাহীন হয়ে উঠছিল, এবং সে সেই পরিসীমা পূর্ণ করতে প্রস্তুত ছিল।

WhatsApp-Image-2025-07-09-at-3.01.27-PM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *