মৈত্রেয়ী দত্ত
শহরের ব্যস্ততম অংশটি চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। দিনের উন্মুক্ত আলো অদৃশ্য হয়ে রাতের অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল, আর সেই অন্ধকারে কেবল কিছু একটিই দৃশ্যমান ছিল—বাসস্ট্যান্ড। একে একে বাসগুলো চলে যাচ্ছে, কিন্তু তাতে কোনো কোলাহল নেই, যেন শহরের জীবন থেমে গিয়েছে। এই সন্ধ্যার মধ্যে এক তরুণী, সুহানা, দীর্ঘ সময় ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। সেদিন তার মন ভীষণ বিষন্ন ছিল। তার জীবনের প্রতিদিনের দৌড়, কর্মব্যস্ততা, আর সামাজিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে তাকে কোথাও কিছু হারিয়ে যেতে দেখাচ্ছিল। তার কাছে প্রতিটি দিন যেন একরকমের আলগা হয়ে উঠছিল—যেমন কিছু না কিছু তার হাত থেকে ফসকে যাচ্ছিল, কিন্তু সে কিছু করতে পারছিল না। এই অদৃশ্য শূন্যতা তাকে আজ সন্ধ্যায় তাড়া করছিল। সবকিছু গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছিল, আর সুহানা তার মধ্যে এক ধরনের একাকীত্ব অনুভব করছিল, যেটা সে আগে কখনো অনুভব করেনি। যদিও তার চারপাশে মানুষ চলাচল করছিল, কিন্তু তার মন ছিল একেবারে একা, যেমন একটি অপ্রকাশিত কষ্ট তাকে একাকী করে দিয়েছে।
এদিন, সাধারণত যেভাবে সময় কাটিয়ে ফেলত, ঠিক সেভাবেই সুহানা আজ রাতেও দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু হঠাৎ তার অনুভূতিতে কিছু পরিবর্তন আসে। তার দৃষ্টি সরে গিয়ে এক বিশেষ জায়গায় আটকে যায়। বাসস্ট্যান্ডের অপর প্রান্তে একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তার চেহারা ছিল একদম অদ্ভুত, যেন সে এই শহরের সাধারণ একজন মানুষ নয়। প্রথমে সুহানা ভাবলো হয়তো এটি তার মনের ভুল, কিন্তু যখন সে আবার তার দিকে তাকালো, তখন সে দেখতে পেল সেই পুরুষটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। সুহানা একটু পিছিয়ে যেতে চাইল, কিন্তু ততক্ষণে সেই অদ্ভুত পুরুষ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তার চোখে এমন কিছু ছিল, যা সুহানার ভেতর একটা অস্বস্তি তৈরি করেছিল। পুরুষটি এক টান দিয়ে তার নাম বললো, “সুহানা, আমি রবি।” প্রথমে সুহানা তার দিকে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল, কিন্তু পরক্ষণেই পুরুষটি বলে উঠল, “আমি কয়েক বছর আগে এই জায়গাতেই মারা গিয়েছিলাম।” সুহানার হাত কাঁপছিল, সে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষটিকে বুঝে উঠতে পারছিল না। কী ধরনের হাস্যকর গল্প বলছে সে? এটা কি তার ভেতরকার কোনো মানসিক বিভ্রান্তি, নাকি কিছু একটিই অন্যরকম হচ্ছে?
এটা ছিল এক অনন্য অনুভূতি। সুহানা সেদিন রাতে বুঝতে পারছিল না যে সে কী অনুভব করছে—ভয়, অবিশ্বাস, না আবার কৌতূহল? সে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তার মনে এক ধরনের শূন্যতা আসছিল, যেন জীবনের সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়ার জন্য কিছু একটা গভীরভাবে তার কাছে দাঁড়িয়ে। রবির কথায় কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না, কিন্তু সুহানা অনুভব করেছিল কিছু একটা অদ্ভুতভাবে তার সামনে অবস্থান করছে। এরকম পরিস্থিতিতে সে কখনোই নিজেকে আবিষ্কার করেনি। তার কাছে এই মূহুর্তটা যেন সিনেমার কোনো দৃশ্যের মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার অনুভূতি তো ছিল বাস্তব—অথচ কীভাবে এই রবি তার সামনে দাঁড়িয়ে বলছে, “আমি মারা গিয়েছিলাম, কিন্তু এখানে ফিরেছি।” পরক্ষণে, রবির মুখে এক শূন্যতা ছিল, যেন সে কিছু গোপন বলছে, কিছু এমন যা সুহানার জানা উচিত, কিন্তু তার জন্য প্রস্তুত ছিল না। কোনো এক কারণে, সুহানা তার ভেতরের ভয়কে অগ্রাহ্য করে তাকে আরও কিছু বলতে বলল, যেন কিছু একটা প্রতীক্ষা করছে তার সামনে। যদিও সে জানতো না, কিন্তু কিছু একটা ছিল যা তাকে এ পরিস্থিতিতে টেনে নিয়ে আসছিল।
–
রবিনের কথা শুনে প্রথমে সুহানার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। তার চোখে অবিশ্বাসের ছাপ, মুখে প্রশ্ন—”তুমি বলছো, তুমি মৃত?”—এই প্রশ্নটি মুখ দিয়ে বের হওয়ার আগেই সে বুঝতে পারছিল, তার সমস্ত বাস্তবতা হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। বাসস্ট্যান্ডের মাঝখানে তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আর সুহানা অনুভব করছিল, পৃথিবীটা যেন তার চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। রবিন যেন একটা রহস্যে ডুবে থাকা পুরানো কাহিনীর চরিত্র। তার শরীরের সব দিক থেকে এক ধরনের অদ্ভুত কাঁপন ছড়াচ্ছিল, কিন্তু সেই সত্তা, সেই উপস্থিতি, সেগুলো যেন বাস্তবতা থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সুহানা যাই ভাবুক, রবিন তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, এবং তার কথায় এমন এক ধরনের শক্তি ছিল যা সুহানার ভেতর কোনওভাবেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছিল না।
সুহানা সেদিন প্রথমবার নিজের অজানা আশঙ্কাকে মুখোমুখি দেখেছিল। সে তার নিজের শ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেত, তার হৃদপিণ্ডের গতি মৃদু হয়ে আসছিল। তার ভিতরের কৌতূহল তাকে আরো কাছে টেনে নিচ্ছিল, কিন্তু একই সঙ্গে ভয়ও ছিল। তার সামনে এক অদ্ভুত পুরুষ, যে বলছিল যে সে মৃত, অথচ তার উপস্থিতি এমনভাবে ছিল যে সুহানার মনে হচ্ছিল, সে এখনও জীবিত। রবিন বলে চলেছিল, “আমার মৃত্যু আজও এখানে, এই বাসস্ট্যান্ডের মধ্যে যেন আটকে আছে। কিছু বছর আগে, এমন একটা রাতে আমি এই জায়গাতেই নিহত হয়েছিলাম। কিন্তু আমার আত্মা এই জায়গায়, এই সময়েই ফিরে আসে।” সুহানা শুনতে পায়, তবে তার বিশ্বাস করা মুশকিল হচ্ছিল। এই ভেবে, সে একটু হেসে বলে, “তুমি নিশ্চয়ই মজা করছো। আমি জানি, এমন কিছু সম্ভব নয়।”
কিন্তু রবিন একদম শান্তভাবে তাকে জানায়, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে বলছি না, কিন্তু যদি তুমি একবার আমার সঙ্গে আসো, তাহলে তুমি জানবে—কীভাবে আমি এখানে আটকে আছি।” সুহানা তার চোখের দিকে তাকায়, যেন চেনার চেষ্টা করছে তাকে। তার চোখে যেন কিছু এক ধরনের রহস্য ছিল, কিছু যা সে হয়তো জানতেও চাইত। আর সেই সময়ই, রবিন তাকে নিজের গল্প বলতে শুরু করল। “এখানে কী ঘটেছিল জানো? আমি একজন সাধারণ মানুষ ছিলাম, অনেক কিছু চেয়েছিলাম, অনেক কিছু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এক রাতে, এই বাসস্ট্যান্ডের কাছে একজন অচেনা মানুষ আমাকে আক্রমণ করেছিল। তখনই আমি মারা যাই। কিন্তু আমার আত্মা এই জায়গায় আটকে আছে, যেমন সবাই আটকে থাকে। কিন্তু কিছু কারণে, আমি এখনও এখানে ফিরি।” রবিনের কণ্ঠে এক ধরনের শূন্যতা ছিল, যেন সে এক দুঃস্বপ্নের মাঝে জড়ানো।
এমন এক অদ্ভুত সম্পর্কের সূচনা হয় তাদের মধ্যে। সুহানা অনুভব করেছিল, তার জীবনের প্রতিদিনের একঘেয়েমি, তার ভিতরের প্রশ্নগুলি যেন একটা নতুন আলো পেয়ে যাচ্ছে। রবিনের কথা শোনার পর, সে বুঝতে পারে যে, তার মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমে তার ভেতর ভয় ছিল, কিন্তু পরে তা কৌতূহলে পরিণত হয়। রবিনের মৃত্যু, তার ফিরে আসা—এই সবকিছুই যেন সুহানাকে এক রহস্যময় পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সুহানা কোনোরকম প্রস্তুতির আগেই বুঝতে পারে, সে এমন কিছু অনুভব করছে যা তার কাছে অবাস্তব। সে রবিনের কাছে প্রশ্ন করতে থাকে, “তুমি কেন ফিরে এসেছো? এখানে থাকতে কি তুমি কিছু চাও?” রবিন কিছুক্ষণ চুপ থাকে, যেন তার ভেতরের অনেক কথাই রয়েছে যা সুহানার কাছে এখনো বলা হয়নি। তার চোখের গভীরতা যেন সুহানার মধ্যে আরও বেশি আগ্রহ তৈরি করে। রবিন তার রহস্যময় কথাগুলো বলতেই থাকে, “কিছু অতিপ্রাকৃত ঘটনা এখানে ঘটছে, কিন্তু আমি একা তাকে অতিক্রম করতে পারব না। তুমি যদি আমাকে সাহায্য করো, তাহলে হয়তো আমি অবশেষে মুক্তি পেতে পারব।”
সুহানার মনে প্রশ্ন জাগে, “এটা কি সম্ভব? এই সব কিছু কি আসলেই ঘটছে?” কিন্তু তার মনে আরেকটি প্রশ্নও গেঁথে যায়—কীভাবে এক অদৃশ্য আত্মা তার জীবনে প্রবেশ করেছে? সে নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করতে না পারলেও, রবিনের প্রতি কিছু আকর্ষণ, কিছু গভীর জিজ্ঞাসা তার ভেতরে বাড়তে থাকে। এটি ছিল এক নতুন দ্বন্দ্ব—একদিকে বাস্তবতা, অন্যদিকে অজানা রহস্য। সেদিন রাতে, সুহানার মনে এক চিরস্থায়ী পরিবর্তন শুরু হয়, যা তাকে অজান্তে এক অতিপ্রাকৃত জগতের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
–
রবিনের উপস্থিতি যেন সুহানার জীবনের এক অদৃশ্য কোণ থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ার মতো ছিল, যা কোনোদিন সে কল্পনাও করেনি। পরের দিনগুলোর মধ্যে একটি অদ্ভুত যাত্রা শুরু হয়। সুহানা আর রবিনের মধ্যে কথোপকথন আরো গভীর হতে থাকে। প্রথমে তার কাছে এই সমস্ত ঘটনা কল্পনা মনে হচ্ছিল, কিন্তু প্রতিটি কথার পর, প্রতিটি সাক্ষাতের পর, সে বুঝতে থাকে যে এই ঘটনা আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা। প্রতি রাতে, যখন শহরের ব্যস্ততা ধীরে ধীরে কমে যেত, সুহানা বাসস্ট্যান্ডের সেই নির্জন কোণে অপেক্ষা করত, যেখানে সে প্রথম রবিনের দেখা পেয়েছিল। মাঝে মাঝে সে নিজেকে প্রশ্ন করত, “আমি কি ঠিক করছি? কি হবে যদি এটি সত্যি হয়?” কিন্তু সে আর ফিরে যাওয়ার চিন্তা করত না। রবিনের প্রতি তার অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে প্রতিবার আরো কাছে টেনে আনত।
একদিন রাতে, যখন শহরের চতুর্দিকে কেবল পেছনের গাড়ির আলো আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের আওয়াজ ছিল, রবিন আবার হাজির হয়। তবে আজ তার চোখে কিছুটা ভিন্নতাও ছিল, যেন কিছু বলার আছে। সে সুহানাকে এক অদ্ভুত দৃশ্যে নিয়ে যায়—বাসস্ট্যান্ডের এক কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি পুরনো ঘর। ঘরটি এমন এক জায়গায় ছিল, যেখান থেকে বাইরের আলো প্রবাহিত হয় না, আর চারপাশটা গভীর অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে। সুহানার মনে কৌতূহল আর ভয় একসাথে ফুটে ওঠে। “এই ঘর… এটা কোথা থেকে এসেছে?” সে জিজ্ঞেস করে। রবিন জানায়, “এখানে কিছু বিশেষ ঘটনা ঘটেছিল। আমি এখানে শেষবার এসেছিলাম, যখন আমি মারা গিয়েছিলাম। এখানে, সেই রাতে, আমার শেষ শ্বাস বেরিয়েছিল।” সুহানার গা শিউরে ওঠে, কিন্তু সে বলার মতো কিছু পায় না।
রবিন তাকে জানায়, “এখানে ফিরে আসার পর, আমি কিছু অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে শুরু করি। মৃতদের আত্মারা এখানে থাকে, কিন্তু তাদের কিছু অসম্পূর্ণ কাজ থাকে। আমার কাজও অসম্পূর্ণ। এই জায়গা আমার মুক্তি নয়, আমি এখানেই আটকে আছি।” সুহানার মনে তখন এক অদ্ভুত চিন্তা আসে। তার নিজের জীবনের মাঝেও কী এমন কোনো অসম্পূর্ণতা ছিল যা সে বুঝতে পারেনি? অথবা, সে কি অন্য কোনো কারণে রবিনের সঙ্গে এই সম্পর্ক তৈরি করতে যাচ্ছিল? রবিনের গল্প শুনে, সে বুঝতে পারে, তার নিজের একাকীত্ব, তার মনের ভেতরের অসম্পূর্ণতা, তার অস্থিরতা—এগুলি সব একে অপরের সঙ্গে মিলিয়ে এক অদ্ভুত সমীকরণ তৈরি করছে।
পরের দিনগুলোতে, সুহানা আরো গভীরভাবে রবিনের সঙ্গে সময় কাটাতে শুরু করে। তার মন অজানা এক আকর্ষণে বাঁধা পড়ে যায়। প্রথমদিকে, সে রবিনের কথাগুলোকে শুধু গল্প হিসেবে নিত, কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, এই গল্পের মধ্যে কিছু সত্যি আছে। রবিন তার সঙ্গে আরো কিছু একান্ত মুহূর্ত কাটাতে চায়, যেখানে তারা একে অপরের অস্তিত্বের বাইরে আরও কিছু অনুভব করতে পারে। “তুমি জানো, পৃথিবীটা আসলে অনেক বড়, কিন্তু আমরা এখানে কি খুঁজে পাচ্ছি?” একদিন রবিন বলল। সুহানা জানালো, “আমি জানি না, হয়তো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, কিন্তু কিছু একটা তো আছেই।” সেই রাতে, তারা বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু রাতের অন্ধকার আর শহরের নিস্তব্ধতা তাদের মধ্যে এক নতুন সম্পর্ক তৈরি করে। একদিকে, সুহানা ভয় পেয়েছিল—তবে অন্যদিকে, সে অনুভব করছিল, যেন কিছু বিশেষের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে, যা তার জীবনের অন্ধকারকে আলোকিত করবে।
তবে সুহানার মনে এক রহস্য ছিল। রবিন তাকে যত বেশি জানাতো, ততই তার মনে প্রশ্ন বাড়ত—কীভাবে রবিন এখানে থাকে? সত্যিই কি তার আত্মা এই বাসস্ট্যান্ডে আটকে আছে? তার মৃত্যুর পরও কি সে এখানে অব্যক্ত কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ফিরে এসেছে? রবিন কিছু বলার আগে, সুহানা মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করত, “কী ধরনের সম্পর্ক এই? এই ভয় আর কৌতূহলের মাঝে কোথায় যেতে পারি আমি?” তার মন অস্পষ্ট হয়ে পড়ছিল। প্রতিটি সাক্ষাতে, তার মনে এক নতুন কৌতূহল সৃষ্টি হচ্ছিল, এবং সেই কৌতূহল তাকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল।
এক রাতে, যখন সবকিছু চুপচাপ ছিল, সুহানা আবার একবার তার কাছে পৌঁছল। রবিনের চোখে কোনো অস্বস্তি বা গোপনীয়তা ছিল না, তবে তার মুখে এক ধরনের সূক্ষ্ম চাপ ছিল। সুহানা তাকে আবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি জানো, আমি তোমার মতো থাকতে চাই?” রবিন এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “এটা তুমি ঠিক বুঝে না। কিছু কথা যদি তুমি জানো, তবে তোমার জীবনটা আরো বেশি অস্পষ্ট হয়ে যাবে।” সুহানার মনে যেন একটা অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। সে জানতো না, সে আর কোথায় যাচ্ছে, কিন্তু এক অদ্ভুত শক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
–
রবিনের কথাগুলোর মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা ছিল, যা সুহানার মনে অস্থিরতা তৈরি করছিল। তার মনে হচ্ছিল, কিছু একটা অদৃশ্যভাবে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সেই অদৃশ্য শক্তির প্রকৃতি ঠিক কী, সেটা সে বুঝতে পারছিল না। রবিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের শুরুটা ছিল অস্বাভাবিক—এক রহস্যের মেঘে ঢাকা, কিছুতেই পরিষ্কার না হওয়া। কিন্তু প্রতিবার যখন রবিন তার কাছে আসত, সুহানা অনুভব করত যেন তাকে কিছু না কিছু জানার জন্য এই সম্পর্কের মধ্যে প্রবাহিত হতে হচ্ছে। এই অনুভূতি এতই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে, সে আর কখনো একা থাকতে পারছিল না। সে প্রতিনিয়ত ভাবত, কী হচ্ছে তার জীবনে? মৃত্যুর পরও, রবিন এখানে ফিরে আসছে। তার উদ্দেশ্য কী? এবং সুহানার মনে এক প্রশ্ন ঘুরত—”কীভাবে আমি তাকে ছাড়ব? কিংবা, আমি কি তাকে ছাড়তে চাই?”
এক রাতে, যখন শহরের কোলাহল আর রাতের নিস্তব্ধতা এক অদ্ভুত সঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল, সুহানা একা একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখের সামনে তখন রবিন উপস্থিত হল। তবে আজ রবিনের মুখে কিছুটা চাপ ছিল, যেন সে কিছু গোপন রেখেছে। সুহানার মনে তীব্র কৌতূহল আর ভয় একসাথে জাগ্রত হল। “রবিন, আজ তোমার চোখে কিছু ভিন্নতা আছে,” সে জিজ্ঞেস করে। রবিন একটি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে, “হ্যাঁ, আজ আমি তোমাকে কিছু বলব যা তোমার জানা উচিত।” সুহানা একপা এগিয়ে যায়, তার মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগও ছিল, কিন্তু সে তার কৌতূহলকে প্রতিরোধ করতে পারছিল না।
রবিন শুরু করে, “এটা জানো, আমি ফিরে আসতে চাইনি। মৃত্যুর পর, আমি এখানেই আটকে আছি, কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমি কোনো দিন শান্তি পেয়ে যাবো। কিছু অসম্পূর্ণ কাজ আমাকে আটকে রেখেছে। আমি ফিরে এসেছি, কিন্তু আমাকে মুক্তি পেতে হলে তোমার সাহায্য প্রয়োজন।” সুহানার হৃদয়ে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়। সে রবিনের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর তার মনে অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হয়—একদিকে তার কাছে এসব কিছু অস্বাভাবিক মনে হয়, অন্যদিকে এটা তার জীবনের সঙ্গেই somehow মিশে যাচ্ছে। রবিনের কথা, তার ভেতরের হতাশা, তার অসম্পূর্ণ কাজ—এগুলি সব সুহানার মধ্যে এক তীব্র আকর্ষণ তৈরি করছে।
রবিন আবার বলে, “যতদিন তুমি আমার সাহায্য না করবে, আমি এখান থেকে মুক্তি পাবো না। আমি জানি, তুমি ভাবছো—এটা কি সম্ভব? কিন্তু, যদি তুমি চাও, তুমি বুঝবে। তোমার ভিতরে এমন এক শক্তি আছে যা এই অদ্ভুত জগতের সমস্ত রহস্য খুলে দিতে পারে।” সুহানার মনে আবার প্রশ্ন উঠে, “শক্তি? আমি কি সত্যিই কিছু করতে পারি?” রবিন তার কাছে আরও কিছু জানায়, “তুমি জানো না, তবে তোমার মধ্যে কিছু রয়েছে, যা তুমি এখনও খুঁজে পাওনি। তোমার জীবনের এক অদ্ভুত রহস্য রয়েছে, যা তোমার সঙ্গী হতে পারে, তবে তাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য তোমাকে নিজের ভিতরের দিকগুলো দেখতে হবে।”
এই কথা শুনে সুহানা কিছুটা ভেঙে পড়ে। “আমি কি আদৌ এমন কিছু পেতে পারব?” তার মনে এত বেশি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল, যে সে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, রবিনের সঙ্গে তার সম্পর্কের সূচনা যেভাবে হয়েছিল—অচেনা, অদ্ভুত—ঠিক সেভাবে সে বুঝে উঠতে পারছিল না, তার নিজের জীবনের কোনো অদ্ভুততা কি তাকে এই পথে নিয়ে আসছে? কিছু না কিছু তো তার ভিতরে ছিল, যা এই অন্ধকারের মধ্যে আলোকের মতো এসে পড়ছিল। আর সে কি আদৌ প্রস্তুত ছিল এই অদ্ভুত জীবনযাত্রার জন্য?
রবিন তার কথায় পরিস্কার করে জানিয়ে দিল, “এটা এক প্রকার চক্র—যতদিন তুমি আমার সাহায্য করবে না, ততদিন আমি এখান থেকে বের হতে পারব না। এবং যতদিন আমি এখানেই আটকে আছি, ততদিন তোমার জীবনও আমার সঙ্গে সংযুক্ত হবে।” সুহানার মনে এক অদ্ভুত প্রশ্ন উঠল। “এটা কি সত্যি? আমি কি নিজেকে এমন এক অদ্ভুত জগতে প্রবাহিত হতে দিচ্ছি?” কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করা সুহানার পক্ষে তখন কঠিন ছিল। সে জানত, একদিকে তার ভিতরের অস্থিরতা এবং অপরদিকে রবিনের কথাগুলোর প্রতি অস্বাভাবিক আকর্ষণ—এগুলি একে অপরকে এক অদ্ভুত শক্তির মতো টেনে নিচ্ছিল।
রবিনের কথা শুনে, সুহানার মন শান্ত হয়নি, বরং আরও বেশি অস্থির হয়ে পড়েছিল। তবে সে একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে রবিনের সাথে এই রহস্যের দিকে এগিয়ে যাবে। সে জানতো, এক অদ্ভুত শক্তি তাকে এই পথে নিয়ে আসছে, আর সে যেখানেই যাবে, সেখানে অন্ধকার এবং আলো একসঙ্গে থাকবে।
–
রবিনের কথাগুলো সুহানার মনে এক অদ্ভুত আচ্ছন্নতা তৈরি করেছিল, কিন্তু সে তবুও এ বিষয়ে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার ভিতরে একধরনের বিভ্রান্তি ছিল, যেন তার মনের মধ্যে কিছু লুকানো ছিল যা সে খুঁজে পাচ্ছিল না। রবিনের কাছে যখন আরও একবার দেখা করতে গেল, সে আরো এক নতুন দিগন্ত দেখতে শুরু করল—এমন এক দিগন্ত, যেখানে তার নিজের অতীত আর রবিনের আত্মা এক অদ্ভুতভাবে মিলিত হয়ে যাচ্ছিল। রবিন তাকে এক রাতে আরও এক নতুন তথ্য জানায়। “তুমি জানো না, সুহানা, তুমি যে অতীতে ছিলে, তা তোমার বর্তমান জীবনকে প্রভাবিত করছে,” রবিন বলে, তার চোখে গভীর এক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। “যতদিন তুমি নিজের অতীতের মুখোমুখি না হবে, ততদিন তুমি এখানে আটকে থাকবে।”
সুহানা একটু অবাক হয়, কিন্তু রবিনের গাঢ় কথা তার মনে নতুন প্রশ্ন সৃষ্টি করে। সে ভেবেছিল, এই সম্পর্কটি শুধুমাত্র অতিপ্রাকৃত বা মৃত্যুর রহস্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি, কিন্তু এবার সেটা মনে হচ্ছে না। রবিনের কথা শুনে তার মনে জেগে ওঠে এক ধরণের পুরোনো স্মৃতি, এক অজানা শূন্যতা যা তাকে এক বিশেষ জায়গায় নিয়ে যেতে চায়। “তুমি বলছো, আমি অতীতে কিছু ভুল করেছি? কী ধরনের ভুল?” সুহানা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করে। রবিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “তোমার অতীত জীবনের এক দুঃখজনক পরিণতি রয়েছে। তুমি যদি জানো, তবে তুমি এই বর্তমান জীবনটিকে আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবে।”
সুহানা বুঝতে পারে, তার জীবন এক বিরাট দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সামনে দাঁড়িয়ে। রবিনের কথাগুলো তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে তাকে তার নিজের অতীতের মুখোমুখি হতে হবে। “তুমি আমাকে কি মনে করিয়ে দিতে চাও?” সে আরেকবার জিজ্ঞেস করে। রবিন তার দিকে একরকমের সহানুভূতির চোখে তাকিয়ে বলে, “তুমি অনেক কিছু হারিয়েছ, সুহানা। কিন্তু তোমার ভিতরে এমন কিছু আছে, যা তোমাকে পূর্ণতা দেবে। অতীতের দিকে ফিরে তাকানো তোমার জন্য এক বিশেষ রহস্যের সমাধান হতে পারে।”
এরপর সুহানা আর কোনো প্রশ্ন না করেই রবিনের কথাগুলোর গভীরে ঢুকে যায়। একদিন, যখন রাতের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল, সে সিদ্ধান্ত নেয়—সে রবিনের সঙ্গে তার অতীতের কিছু সত্য খুঁজে বের করবে। সে রবিনকে অনুসরণ করে এক পুরনো ঘর পর্যন্ত নিয়ে যায়, যেখানে এক ধরনের অদ্ভুত শীতলতা ছিল। সুহানা জানত, এই ঘরটা কোনো সাধারণ জায়গা নয়। ঘরের প্রতিটি দেয়াল যেন এক ধরনের তামাশা করছিল, যেন সেখানে দীর্ঘকাল ধরে কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে, কিন্তু সেগুলো কোনোদিন প্রকাশ পায়নি।
রবিন তাকে জানায়, “এখানে তোমার অতীতের কিছু ঘটনা লুকানো আছে। তোমার জীবনের একটি বড় অংশ এখানে হারিয়ে গেছে, কিন্তু তুমি যদি সেই সময়টিকে ফিরে পেতে পারো, তবে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে।” সুহানা থেমে গিয়ে ঘরটির ভেতর ভালো করে তাকায়। তার চোখে এক ধরনের বিচিত্র আলো ছিল, যা তাকে সেদিনের মন্দ স্মৃতিগুলোর দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারে, এই ঘরটি তার অতীতের গোপন রহস্যের কাছে পৌঁছানোর সোপান হতে পারে। সে রবিনের কথার মধ্যে কিছু সত্য খুঁজতে চেষ্টা করে, তবে তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা গেঁথে যায়। কেন তাকে অতীতে ফিরতে হবে? কেন তার জীবন যেন এক চক্রে বন্দী হয়ে আছে? এ সব প্রশ্ন তার মাথায় বারবার ঘুরতে থাকে।
রবিন তার হাত ধরে বলে, “এই ঘরটিই তোমার অতীতের প্রতিবিম্ব। এখানে কিছু পুরোনো স্মৃতি রয়েছে, যা তোমার মনকে উদ্বুদ্ধ করবে। তুমি যদি এখনই সেগুলো দেখো, তাহলে তুমি বুঝতে পারবে, তুমি কি হারিয়েছ আর কীভাবে তা তোমার বর্তমান জীবনকে প্রভাবিত করছে।” সুহানার মনে শঙ্কা ছিল, তবে কৌতূহলও প্রবল ছিল। সে চোখ বন্ধ করে কিছু মুহূর্তের জন্য অতীতে হারিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, যেন কোনো একদম পুরনো সময়ের ভেতর দিয়ে সে তার জীবনের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাবে।
এতক্ষণে সুহানা বুঝতে পারে, রবিন তার জীবনের এক অপ্রত্যাশিত অংশ হয়ে উঠেছে। তার অতীতের স্মৃতি আর রবিনের কথাগুলো মিশে গিয়ে তার কাছে এক দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল। কিন্তু এই দুঃস্বপ্নের মধ্যে যে সত্য রয়েছে, তা খুঁজে বের করতে হবে—তাহলে হয়তো সে জানবে, কেন তার জীবন এত অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। রবিন তাকে অতীতের এক বিশেষ মুহূর্তে ফিরিয়ে নেয়, যেখানে সে এক দুঃখজনক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল, কিন্তু তা কখনো প্রকাশ পায়নি। সেই ঘটনার পর থেকেই, সুহানা কিছু অদ্ভুত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল—যা তার জীবনে এক নতুন পথে প্রবাহিত হয়ে গেছে।
সুহানা অবশেষে সিদ্ধান্ত নেয়, সে তার অতীতের সাথে সঙ্গী হয়ে যাবে, আর সেখান থেকে বের হয়ে আসা সত্যগুলোর উপর নির্ভর করে তার ভবিষ্যতকে গড়বে।
–
রবিনের কথাগুলো সুহানার মনে গভীরভাবে বিঁধে ছিল। অতীতের প্রতিফলন, গোপন রহস্য—এই সমস্ত কিছু তাকে এক নতুন দিগন্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই দিগন্তটা ছিল ভয়ানক, অন্ধকার। সে জানত, এই পথের যাত্রা তার জীবনকে চিরকাল বদলে দিতে পারে, তবে তার ভেতর এক অদ্ভুত টান ছিল, যেন তাকে সেই পথে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। রবিনের কথায় যেন এক ধরনের সত্তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল, যা তার মনকে আরও বিভ্রান্ত করছিল। সে বুঝতে পারছিল না, সে সত্যিই কি করছে, অথবা কোথায় যাচ্ছে। একদিকে তার ভয়, অন্যদিকে অদ্ভুত আকর্ষণ—এই দ্বন্দ্বের মধ্যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল।
এদিন, এক নির্জন রাতের অন্ধকারে, রবিন সুহানাকে তার কাছে ডাকে। “আজ তোমাকে সত্যিই কিছু দেখাতে হবে,” রবিন বলে, তার চোখে সেই পুরানো রহস্যের ছাপ ছিল। সুহানার মধ্যে এক অদ্ভুত তীব্রতা সৃষ্টি হয়—তার মধ্যে প্রবাহিত হয়ে আসে এক অজানা শক্তি, যেন তার জীবন তার হাতে নয়, কোনো অদৃশ্য শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। রবিন তাকে নিয়ে যায় সেই পুরনো ঘরের দিকে, যেখানে তাদের অতীতের অন্ধকার অপেক্ষা করছিল। সুহানা জানত, আজ যদি সে এই জায়গায় প্রবেশ করে, তাহলে তার জীবন আর কখনো আগের মতো থাকবে না। সে তার ভেতরের ভয়ের সাথে লড়াই করতে থাকে, কিন্তু এক অদ্ভুত প্রবাহ তাকে তার সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
“তুমি জানো, সুহানা, এই ঘরটাই তোমার জীবনের একমাত্র পথ। এখানে যা ঘটেছে, তা তোমার ভবিষ্যতকে নির্ধারণ করবে,” রবিন বলে। সুহানা তার দিকে তাকায়, তারপর ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরটি একসময় ছিল একটি শান্ত পরিবেশে, কিন্তু আজ তার চারপাশে যেন এক অন্ধকারের ছায়া। ঘরের ভেতর গিয়ে সুহানা এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করে। ঘরের দেয়ালগুলো যেন তার দিকে চাপ সৃষ্টি করছিল, প্রতিটি কোণ যেন পুরনো স্মৃতি আর অজানা ভয় দিয়ে ভরা। সুহানা জানত, এই ঘরের ভেতর কিছু রয়েছে—একটা পুরনো সত্য, যেটা সে আগে কখনো জানত না।
রবিন তাকে কাছ থেকে এক টুকরো কাগজ দেয়। কাগজের উপর কিছু অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা ছিল, যেগুলো সুহানার কাছে অচেনা ছিল। রবিন বলে, “এই চিহ্নগুলো তোমার জীবনের এক অংশ। তুমি যদি এগুলো বুঝতে পারো, তাহলে তোমার অতীতের সমস্ত রহস্য খুলে যাবে।” সুহানার হাতে কাগজটি নেওয়ার পর, তার মধ্যে একটা ভিন্ন অনুভূতি তৈরি হয়। যেন সে তার জীবনের এক গোপন রহস্যের কাছে পৌঁছাচ্ছে। তার মনে কিছু প্রশ্ন উঠে আসে—”এটা কি সত্যিই আমার জন্য? এই চিহ্নগুলোর মধ্যে কি কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে?” সে কাগজটি হাতে নিয়ে আরো একবার খুঁটিয়ে দেখে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। তবে, তার মনে যে সংকোচ ও ভয় ছিল, সেটা যেন এক মুহূর্তে লুপ্ত হয়ে যায়, আর সে বুঝতে পারে যে তাকে আর পিছনে ফিরতে হবে না।
রবিন বলে, “এটাই তোমার জীবন, সুহানা। তুমি যদি চাও, তাহলে তুমি অতীতের সঙ্গে এক হয়ে যাবে, আর তারপর তোমার ভবিষ্যত তুমি নিজেই তৈরি করবে। কিন্তু যদি তুমি তা না করতে চাও, তবে তোমার জীবন এখানেই থেমে যাবে।” সুহানা গভীরভাবে শ্বাস ফেলে, তার মাথার মধ্যে কেবল একটাই চিন্তা—সে কি প্রস্তুত? প্রস্তুত কিনা সে জানত না, তবে এখন তাকে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সে সেই অন্ধকার পথে পা বাড়াতে পারে, যা তাকে তার নিজের জীবন, তার অস্তিত্বের ভেতর এক নতুন ধারণায় নিয়ে যাবে।
“আমি প্রস্তুত,” সে নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কিন্তু তার কণ্ঠে কিছুটা দ্বিধা ছিল। তবে, সেই দ্বিধা খুব দ্রুত মিলিয়ে যায়, যখন রবিন তার হাত ধরতে এগিয়ে আসে। “তুমি যদি প্রস্তুত হও, তাহলে তোমার সব কিছু বদলে যাবে,” রবিন বলে। সুহানা তার হাত ধরে, আর দুজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেই মুহূর্তে সুহানার মনে হলো, একে অপরের সংস্পর্শে তাদের জীবনের সব কিছুই মুছে যাচ্ছে—এক অজানা দিকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
রবিন তখন তাকে বলে, “এখন তোমার জীবন আর অতীতের মধ্যে একটা সীমানা থাকবে না। তুমি জীবিত, কিন্তু মৃতের দিকেও চলে যাবে। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই নিজেকে খুঁজে পাও, তবে তোমার সমস্ত ভয়ের উর্ধ্বে চলে যাবে।” সুহানার মনে হয়, সে সেই অদৃশ্য সীমানা পেরিয়ে চলে যাচ্ছে, যেখানে মৃত্যুর অনুভূতি, অতীতের ভয়—সব কিছু মিলিয়ে গিয়ে তাকে এক নতুন জীবন উপহার দেবে।
এই পথটি চিরকাল বদলে যেতে পারে, কিন্তু এখন সুহানার কাছে আর কোনো পেছনে ফিরে যাওয়ার পথ নেই।
–
রবিনের কথাগুলো সুহানার মনে একটা বিশাল আছাড় মারেছিল। সে জানত না, সে কোথায় যাচ্ছে, কিংবা তার সামনে কী আসছে। তার জীবন যেন এক সাইকোলজিক্যাল ঘূর্ণিবন্ধনে আটকে গেছে। মৃত্যুর সীমানা, অতীতের দুঃখ—সবকিছু একে অপরের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি পা যখন সে বাড়াচ্ছিল, প্রতিটি মুহূর্তে সে এক ধরণের অস্বস্তি অনুভব করছিল, যেন বাস্তবতা এবং কল্পনা একত্রিত হয়ে তার সামনে এক নতুন জগত তৈরি করছে। রবিনের সাথে যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে, তার সমস্ত পরিচিত পৃথিবী ভেঙে পড়তে শুরু করেছিল। এভাবে সে ভাবতে শুরু করেছিল, “এটা কি সত্যিই ঘটে যাচ্ছে?” তার মাথার মধ্যে বারবার প্রশ্নের ঢেউ উঠছিল, কিন্তু কোনো উত্তর সে পাচ্ছিল না।
এক রাতে, যখন শহরের রাস্তা একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিল, সুহানা আর রবিন এক জায়গায় বসে ছিল। তারা একটি পার্কের বেঞ্চে বসে, আশেপাশে শুধুমাত্র একাকী ঝিঁঝিঁ পোকাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। সুহানা চিন্তা করতে করতে একসময় রবিনকে প্রশ্ন করে, “রবিন, তুমি কি কখনো ভাবো, আমি যদি তোমার মতো হয়ে যাই—যেমন তুমি একজন মৃত আত্মা, যা সব সময় এখানে আটকে থাকবে—তাহলে কি আমি আর কখনো আমার জীবন ফিরে পাবো?” রবিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ধীরে ধীরে উত্তর দেয়, “সুহানা, তুমি যদি আমার মতো হয়ে যাও, তবে তুমি সেই পৃথিবীকে পেছনে ফেলে আসবে, কিন্তু তোমার নিজের অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করতে হবে।”
তার কথা শুনে সুহানার মনে আরও এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। সে তার সামনে থাকা বাস্তবতা ও পৃথিবীর মধ্যে সীমানা তৈরি করার চেষ্টা করে, কিন্তু সেই সীমানা কোথাও ঠিকে থাকছিল না। এই পৃথিবী যেন সে চিনত, তবে আর পুরোপুরি তাকে ধারণ করছিল না। প্রতিটি মুহূর্তে, সুহানার মনে হচ্ছিল, সে যেমন একে একে তার অস্তিত্বের গভীরে প্রবেশ করছে, তেমনই তার চারপাশের পৃথিবী একে একে অবাস্তব হয়ে উঠছে। আর রবিনের উপস্থিতি যেন সেই পৃথিবীর অমীমাংসিত অংশ।
সুহানার চোখে বিভ্রান্তি, উদ্বেগ, আর এক ধরনের অসহায়ত্ব ছিল। সে অনুভব করতে শুরু করল, তার কাছে আর কোনো সহজ রাস্তা নেই। মৃত্যুর পরের বিশ্ব কি সত্যিই তাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ দেবে? তার কাছে জীবন, মৃত্যু—সব কিছু এক ধরনের অস্পষ্ট বোধ হয়ে উঠেছিল। জীবিত থাকলেও, সে যেন মৃতের সাথে জড়িত ছিল, আর সেই জায়গায় সে এক ধরণের অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছিল। তবে সেই শান্তির মধ্যে এক দীর্ঘশ্বাস ছিল, যা তার ভিতর গোপন এক অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছিল। সে জানত, কোনো এক অজানা সময় তার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু তার মনে দ্বিধা ছিল—কি সে সত্যিই রবিনের পথ অনুসরণ করবে? কি সে তার জীবনের সমস্ত নিরাপত্তা ত্যাগ করবে এবং সেই অন্ধকারের দিকে চলে যাবে, যা তাকে এক অনন্ত জগতের দিকে নিয়ে যেতে পারে?
রবিন তার দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন সে বুঝতে পারছিল সুহানার ভেতরের দ্বন্দ্ব। “তুমি যদি সেই বাস্তবতাকে অতিক্রম করতে চাও, তুমি হয়তো নতুন কিছু দেখতে পাবে। কিন্তু মনে রেখো, একবার যদি তুমি এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাও, তোমার আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না,” রবিন বলল। সুহানার চোখে এক অস্থিরতা ফুটে ওঠে। সে ভাবল, যদি সে রবিনের কথায় এগিয়ে যায়, তাহলে কী হবে? কিছু একটা তার ভিতর তাকে টানছিল, কিন্তু সেই টান কি তাকে শুধুমাত্র আরও গভীরে টেনে নিয়ে যাবে?
সে মাথা নিচু করে নিজের ভাবনাগুলোকে একত্রিত করতে চেষ্টা করে। তার মনের মধ্যে হাজার হাজার প্রশ্ন ঘুরছিল—কীভাবে একে একে সমস্ত ভীতি, সমস্ত অস্বস্তি মুছে ফেলবে সে? রবিন, যে তাকে তার অতীতের সাথে পুনরায় মিলিত করতে চেয়েছিল, সে কী সত্যিই তার জীবনের জন্য একটি পথ তৈরী করতে চাচ্ছিল, নাকি তাকে আরও গভীর অন্ধকারে ঠেলে দিতে চেয়েছিল? রবিনের কথাগুলো যেন সুহানার পৃথিবীটাকে নতুন করে তৈরি করতে চাইছিল, কিন্তু সে জানত, এর মধ্যে যদি কোনো ভুল হয়, তবে সেই ভুল তাকে এমন এক গহ্বরে ফেলে দিতে পারে, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
অথচ, সুহানার মনে হয়েছিল, তার জীবনের অন্ধকার দিকগুলোই তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। সে অনুভব করছিল, প্রতিটি মুহূর্তে তার শ্বাসের সাথে মিলিয়ে তার ভয়ের সীমানা আরও কমে আসছিল। এবং এক অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল—যার মধ্যে মৃত্যুর এক সীমাহীন শক্তি ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, এই শক্তির দিকে এগিয়ে গিয়ে কি সে নিজের অস্তিত্বকে খুঁজে পাবে, না কি তার জীবনের শেষের শুরু হবে?
তবে, একসময় সুহানা স্থির হয়ে গেল। তার সামনে দুটো পথ ছিল—একটি ছিল নিজের ভয়কে জয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার, আর অন্যটি ছিল সেই পৃথিবীকে ফিরিয়ে নেওয়া যা সে আগে জানত। কিন্তু সে জানত, নিজের ভয়কে পরাজিত করতে না পারলে, তার কোনো মুক্তি নেই। তার সামনে এক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল, যেটা তাকে নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মোকাবিলা করতে বাধ্য করছিল। রবিনের দিকে তাকিয়ে, সুহানা বলল, “আমি প্রস্তুত। আমি জানি, আমার জীবনের কোন দিক আমাকে দেখতে হবে।”
রবিন একটু বিরতি নিয়ে, তারপর এক মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “তাহলে তুমি জানবে, তোমার পথে কতটা অন্ধকার আর আলো আছে।”
–
সুহানা এখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে ছিল—যেখানে তার নিজের অস্তিত্ব, তার অতীত, এবং রবিনের সাথে সম্পর্ক সব কিছু মিশে গিয়ে এক অচেনা পথ তৈরি করেছে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্তে তার মনে এক নতুন প্রশ্ন তৈরি হচ্ছিল, কিন্তু সেই প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর সে পেত না। রবিনের কাছে তার কাছে একটা দারুণ আশা ছিল—তবে সেই আশা কি তাকে এক সত্যের দিকে নিয়ে যাবে, নাকি আরও এক অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাবে?
এদিন রাতে, যখন শহরের সমস্ত আলো নিভে গিয়েছিল, সুহানা আবার রবিনের সঙ্গে দেখা করতে এল। আজ তার মনে কিছুটা নির্ধারণ ছিল—সে জানত, আজকের রাতেই তাকে সত্যি সত্যি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রবিন তখন তাকে নিয়ে যায়, এক নতুন জায়গায়—এক জায়গা যেখানে কোনোদিন সে যায়নি, কিন্তু যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে বড় রহস্য লুকানো ছিল।
“এটা তোমার জন্য,” রবিন বলে, তার হাতের দিকে কিছু একটা এগিয়ে দিয়ে। সুহানা তাকিয়ে দেখে, সেটা একটি পুরনো সান্ধ্যবেলী স্মৃতির মতো, যা বহুদিন আগে হারিয়ে গেছে। এই জিনিসটা তার জীবনে কি আসলেই কিছু পরিবর্তন আনবে? তবে তার মধ্যে এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যেন কিছু একটা তাকে এই পুরনো স্মৃতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সুহানা কাগজটি হাতে নেয়, আর রবিন বলে, “এটা তোমার অতীতের কিছু চিহ্ন, সুহানা। তোমার মধ্যে কিছু ছিল, যেটা তুমি হারিয়েছ, কিন্তু এই চিহ্নের মাধ্যমে তুমি তা পুনরুদ্ধার করতে পারবে।”
কাগজে আঁকা থাকা চিহ্নগুলো সুহানার কাছে অদ্ভুত মনে হয়। তার ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি ছিল, কিন্তু সেই অস্বস্তির মধ্যে এক গভীর আগ্রহও ছিল। কেন রবিন তাকে এই কাগজটা দিয়েছে? কেন তার অতীতের চিহ্নগুলোর দিকে তাকে ফিরে যেতে বলা হচ্ছে? সুহানা কাগজটি খুলে দেখে—এই চিহ্নগুলো তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা সে বহুদিন ভুলে ছিল। তার মধ্যে কয়েকটি চিহ্ন ছিল, যা তাকে এক সময়ে কিছু বিশেষ স্মৃতির কথা মনে করিয়ে দেয়—একটি পুরনো ঘটনা, যা তার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছিল।
“এই চিহ্নগুলো তোমার জীবনের গোপনীয় সত্যগুলো উন্মোচন করতে সাহায্য করবে। তুমি যদি এগুলো অনুসরণ করতে পারো, তাহলে তুমি জানবে, কেন তুমি এখানে এসেছো। কিন্তু মনে রেখো, এই পথ সহজ নয়।” রবিনের কথায় আবারও সুহানার মনে অস্বস্তি শুরু হয়। সে জানতো, এটি সেই পথে যাওয়ার মুহূর্ত, যেখান থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব হবে না। তবে একদিকে, তাকে এই পথে এগোতেই হবে, অন্যদিকে, তার ভেতর আরেক ধরনের ভয় কাজ করছিল। তার মনে হচ্ছিল, তার অতীতের যে ঘটনা গুলি ছিল, তা এবার সত্যি সত্যি সামনে চলে আসবে, কিন্তু সে কি সেই সত্যটা সহ্য করতে পারবে?
রবিন জানায়, “তোমার অতীতের ত্রুটিগুলির জন্য তুমি যতই ভয় পাবে, ততই তোমার বর্তমান জীবন আরও ঘূর্ণিত হবে। এই সত্যের দিকে এগিয়ে যাও, তাহলে তুমি শিখতে পারবে, কীভাবে তোমার আত্মাকে মুক্তি দিতে হয়।” সুহানা তখন কাগজটি হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তার মনে এমন এক অনুভূতি সৃষ্টি হয়, যেন তার সমস্ত জীবন এক নতুন দিক পেতে যাচ্ছে—এটা এক যাত্রা, যেটি তার আত্মাকে শুদ্ধ করবে, কিন্তু সেই শুদ্ধতার পথে অনেক কিছু ছাড় দিতে হবে।
জীবনের এই রোমাঞ্চকর এবং ভয়ঙ্কর পথে যাত্রা করতে গিয়ে সুহানা বুঝতে পারে, রবিন শুধুমাত্র তার পথপ্রদর্শক নয়, বরং তার জীবনের সমস্ত অন্ধকার দিকের প্রতিবিম্ব। রবিন তার কাছে একটি চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে, যেটি তার কাছে শুধু অতীতের নয়, বরং ভবিষ্যতেরও একটি গূঢ় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। তার সামনে এক দরজা খুলে গেছে, কিন্তু সেই দরজা পার করার পর, তাকে অবশ্যই এক অজানা গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে—যেখানে নিজের ভয় আর কৌতূহল, একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সুহানা চুপচাপ কাগজটি পড়তে থাকে, আর প্রতিটি শব্দ যেন তার ভিতরে এক গভীর অনুভূতি সৃষ্টি করে। কাগজের শেষে লেখা ছিল, “তোমার ভয়ের দিকে না তাকালে, তোমার মুক্তি আসবে না। তবে যদি তুমি সত্যি সত্যি জানতে চাও, তাহলে তোমার অতীতের সাথে এক হয়ে যাও।” সুহানার মুখে একটা সংকল্প স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার সামনে এক নতুন দরজা, এক নতুন জীবন—যেখানে সে তার অতীতের বীভৎসতার মুখোমুখি হবে, আর তার সেই ভয়কে অতিক্রম করে, তার নিজস্ব পথ তৈরি করবে।
সুতরাং, সুহানা জানত, এই পথ আর ফিরিয়ে নেওয়ার নয়। এই পথে একবার পা দিলেই, সে শুধু নিজেকে নয়, সমস্ত পৃথিবীকে নতুনভাবে দেখতে পাবে।
–
সুহানার জীবন এখন এক স্পষ্ট সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। তার সামনে এক দুঃস্বপ্নের মতো অতীতের কিছু ফেলে আসা দৃশ্য আর ভয়াল অন্ধকার, যেখানে সে এক অচেনা পৃথিবীতে প্রবাহিত হচ্ছিল। রবিন তাকে এক নতুন বাস্তবতার দিকে নিয়ে গেছে, যেখানে তার নিজের অস্তিত্বের প্রশ্নগুলো তাকে আর পেছনে ফিরে যেতে দেয়নি। এখন সে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার পরিণতি শুধুমাত্র তার নয়—এটি তার অস্তিত্বের একটি বিশাল পরিবর্তন।
আজকের রাত ছিল অন্য রকম। পুরো শহর নিঃশব্দ, তেমন কোনও গতি নেই। বাতাসও যেন থেমে গেছে। সুহানা রবিনের সাথে সেই পুরনো ঘরের দিকে যাচ্ছিল, যেটা তার অতীতের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আজ, তার মনে এক ধরনের শীতলতা ছিল, যেন আজ সে এক নতুন শক্তি অর্জন করতে যাচ্ছে, অথবা হারাতে যাচ্ছে। “আজ তোমাকে আমি একটা সত্য জানাবো,” রবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল। তার কণ্ঠে এক ধরনের রহস্য ছিল, যা সুহানাকে আরও বিভ্রান্ত করছিল। রবিনের চোখে তখন সেই পুরনো অবয়ব ছিল—এক ধরনের অতিপ্রাকৃত শক্তি, যে শক্তি তাকে আসল পৃথিবী থেকে আলাদা করে দেয়।
সুহানা জিজ্ঞেস করে, “কী সত্য? আমি তো এত দিন ধরে নিজেকে খুঁজছি, আর আজকে আমার সামনে কী সত্য দাঁড়িয়ে থাকবে?” রবিন তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে, “এই যে তুমি এতদিন জীবনকে যেভাবে দেখেছো, তা সবই ভুল ছিল। তুমিই আসলে তোমার অতীতের সবচেয়ে বড় শত্রু। তোমার নিজের অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে তোমার আত্মাকে খুঁজতে হবে, তবে সেই আত্মা খুঁজে পাওয়ার জন্য তোমাকে প্রথমে নিজের ভয়ের মুখোমুখি হতে হবে।”
সুহানার মনে তখন এক অদ্ভুত চিন্তা আসে। “আমি কি প্রস্তুত? আমার ভয়ের মোকাবিলা করার জন্য কি আমি নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবো?” তার মনে মনে, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। জীবন, মৃত্যু, অতীত এবং ভবিষ্যত—এই সব কিছু একাকার হয়ে যাচ্ছিল, আর সে বুঝতে পারছিল না, কোথা থেকে শুরু করবে। রবিন তাকে আরো কাছে নিয়ে যায়, সেই ঘরের ভেতরে, যেখানে সব কিছু এক দীর্ঘশ্বাসের মতো জমে ছিল। ঘরটির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণা যেন সেই অতীতের গল্পগুলো বলা শুরু করেছিল।
রবিন তখন তাকে জানায়, “এখানে, তোমার অতীতের সবচেয়ে অন্ধকার ঘটনা লুকানো আছে। এই জায়গা শুধু তোমার নয়, এটি আমারও। আমরা একে অপরকে জানলে, একে অপরের অতীতকে শুদ্ধ করলে, তখন এই জায়গাটা আমাদের মুক্তি দেবে।”
সুহানার ভেতর তখন একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। সে জানত, রবিন তাকে যে পথে নিয়ে যাচ্ছিল, তা সহজ কোনো পথ নয়। এই পথের কোনো সোজা উত্তর নেই, এবং সেই উত্তর তাকে হয়তো এমন এক সত্যের সামনে দাঁড় করাবে, যা সে কখনো ভাবেনি। তবে তাকে সামনে এগিয়েই যেতে হবে—এটা ছিল তার একমাত্র উপায়। সে রবিনের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি প্রস্তুত, রবিন। আমি জানি, এই পথ আমাকে যেখানেও নিয়ে যাক, আমি তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাবো।”
সেই মুহূর্তে, ঘরের বাতাসে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে। সুহানা তখন নিজেকে এক নতুন জগতে প্রবেশ করতে দেখে—যেখানে সময়, স্থান, সব কিছু এক নতুনভাবে ঘুরতে থাকে। সে চোখ বন্ধ করে নিজের ভেতরের সত্তার দিকে তাকাতে শুরু করে। তাকে অতীতের সেই বিশেষ ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে, যা সে কখনো বুঝতে পারেনি।
ঘরটির মধ্যে এক অদ্ভুত আলো জ্বলে ওঠে, আর সুহানা অনুভব করে, তার সামনে সমস্ত পৃথিবী উন্মোচিত হচ্ছে। অতীতের স্মৃতিগুলো তার মনে উঠে আসে—এক পুরনো দুঃখজনক ঘটনার কথা, যা সে নিজের হৃদয়ে চেপে রেখেছিল। তার চোখে তখন সেই মুহূর্তের ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেদিন সে প্রিয়জনকে হারিয়েছিল। সেই মুহূর্তেই সে বুঝতে পারে, তার ভয়ের মূল কারণ ছিল সেই ক্ষতি, যে ক্ষতির কারণে সে নিজের অস্তিত্বের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।
“তুমি জানো, সুহানা, যে অন্ধকারের মধ্যে তুমি হারিয়ে যাচ্ছো, সেটি তোমার নিজেরই তৈরি। তুমি যখন সেই অতীতের দুঃখকে সম্মুখীন করবে, তখনই তোমার আত্মা মুক্তি পাবে।” রবিনের কথা গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে, যেন তা সুহানার মনে প্রবাহিত হচ্ছে। সুহানা তখন নিজের ভেতরের শক্তিকে অনুভব করে, এবং তার মন আর শরীর এক গভীর শুদ্ধতা লাভ করতে শুরু করে।
“তুমি যদি নিজেকে মুক্তি দিতে চাও, তাহলে তোমার অতীতকে আগলে রাখো না। তুমি যা হারিয়েছো, তা তোমার অংশ নয়। তোমার মুক্তি তোমার নিজস্ব সত্যের মধ্যে রয়েছে,” রবিন বলে।
এটা বুঝতে পারার পর, সুহানার মন কিছুটা শান্ত হয়ে আসে। সে জানে, তার সামনে এখনও অনেক প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু সে জানে, তার নিজের ভয়ের সাথে এক হয়ে তাকে এগিয়ে যেতে হবে। রবিনের দিকে তাকিয়ে সে ধীরে ধীরে বলে, “আমি জানি, এবার আমি আমার সত্যি খুঁজে পাবো।”
রবিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে, তারপর তাকে বলল, “তাহলে তুমি এবার মুক্তি পাবে।”
সুহানার সামনে সেই অদৃশ্য দরজা খুলে গেছে। সে জানত, আর পেছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
–
সুহানা দাঁড়িয়ে ছিল এক নতুন পৃথিবীর সীমানায়। তার চারপাশে সমস্ত কিছু যেন এক রহস্যময় আলোয় ডুবে ছিল, এমন আলো যা অন্ধকারকে ছুঁয়ে, তাকে নিজের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলেছিল। একসময়, যেখানে তার অতীতের শিকলগুলি তাকে বন্ধী করেছিল, আজ সেখানে সে মুক্তির গন্ধ পাচ্ছিল। রবিন তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এখন তার উপস্থিতি আর সেই আগের মতো ভয়ানক ছিল না। রবিন এক ধীর হাসি দিয়ে বলল, “তুমি আজ নিজের আসল সত্য খুঁজে পেয়েছো, সুহানা।”
সুহানার মনে কিছুটা অস্থিরতা ছিল, তবে সেই অস্থিরতার মধ্যে একটা শুদ্ধির অনুভূতি ছিল, যেন সে কিছু কঠিন পথ পেরিয়ে, নিজের প্রকৃত অস্তিত্বের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। অতীতের ভয়, যন্ত্রণা, আর সেই অন্ধকারের দুঃখ—এসব এখন তার হৃদয়ের মধ্যে এক গভীর শান্তিতে পরিণত হচ্ছিল। সে জানত, আজকের এই মুহূর্তে সে নিজের ভেতর এক নতুন জীবনের সূচনা করতে যাচ্ছে।
রবিন তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি এখন বুঝতে পারবে, তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছো। এখন তুমি এক নতুন চোখে দেখতে শিখেছো। তোমার অতীত, তোমার ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তুমি সত্যি সত্যি নিজের জীবনকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখবে।” সুহানা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। রবিনের কথা তাকে যেন গভীরভাবে স্পর্শ করছিল। সে জানতো, তার জীবন আর আগের মতো নয়, সে আর সেই অস্পষ্ট দিক দিয়ে চলতে পারবে না। সে যেভাবে এগোবে, সেই পথই তার নিজস্ব পথ হয়ে উঠবে।
“আমি ভয় পেতাম,” সুহানা মৃদু স্বরে বলে। “আমি ভয় পেতাম, কারণ আমি জানতাম না কোথায় যাচ্ছি। আমি জানতাম না, আমার অতীত কি আমাকে ছাড়বে না। কিন্তু এখন, আমি জানি, আমি যদি ভয় পেয়ে থাকি, তবে আমি সত্যি কখনও মুক্তি পাবো না।” রবিন তাকে সমর্থন করে বলে, “বয়স, সময়, কিংবা কোনো পরিস্থিতি তোমাকে থামাতে পারবে না, যদি তুমি সত্যিকার অর্থে নিজের ভয়ের মুখোমুখি হও। এখন তুমি প্রস্তুত, সুহানা।”
অদূরে, ঘরের দেয়ালে এক অদ্ভুত প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হতে থাকে—এক পুরনো ছবি, যা সুহানার জীবনের চিহ্ন হয়ে উঠেছিল। ছবির মধ্যে সেই দিনগুলোর কথা ছিল, যখন সে অনবরত নিজের আত্মাকে খুঁজতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনোদিন তা খুঁজে পায়নি। এখন, সে অনুভব করছিল, তার জীবনের এই পুরনো স্মৃতি যেন শুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। তার সারা জীবনের এক গভীর বোঝাপড়ায় এসে পৌঁছেছে, আর সেই বোঝাপড়াই তাকে তার সঠিক পথের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
সে রবিনকে এক দীর্ঘ দৃষ্টিতে দেখল। রবিন এখন আর সেই অদ্ভুত আত্মা ছিল না, যে তাকে ভয় দেখানোর জন্য উপস্থিত হয়েছিল। সে ছিল, তবে, একটি পুরনো বন্ধুর মতো—যে তাকে তার অন্তরাত্মার সন্ধান দিতে সাহায্য করেছে। “তুমি যখন আমার সাথে এই পথ পেরিয়েছো, তখন তুমি জানবে, এই পথে কোনো শেষ নেই। তবে এই পথেই রয়েছে তোমার জীবনের আসল অর্থ,” রবিন বলল, তার কণ্ঠে স্নিগ্ধতা ছিল। “এটা তোমার জন্য, সুহানা। তুমি যদি এটাকে গ্রহণ করতে পারো, তাহলে তুমি সত্যিই মুক্তি পাবে।”
রবিনের কথা শুনে সুহানার মনে এক অদ্ভুত শান্তি ছড়িয়ে পড়ে। সে জানত, আর কোনো অন্ধকার তার উপরে শক্তি দেখাতে পারবে না। যে ভয়ের মধ্যে সে একসময় বাস করত, সেটি যেন একেবারে মুছে গেছে। সে অনুভব করেছিল, সে এক নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে—এক জীবনে, যেখানে আর কোনো সংকোচ, কোনো ভীতি, কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। তার চোখে তখন নতুন স্বপ্নের প্রতিফলন ছিল, আর সেই স্বপ্ন তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।
রবিন এক শেষবার তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি জানো, সুহানা, আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়নি। যদিও তুমি অন্য জগতে প্রবেশ করছো, কিন্তু তোমার ভেতরের দিকগুলো আর আমার মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে। তুমি যেখানেই থাকো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
সুহানা এক স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলল, “আমি জানি, রবিন। আমি জানি, আমি আর একা নই।” সেই মুহূর্তে, সুহানা অনুভব করেছিল, তার জীবনের সমস্ত ভয়, সমস্ত দ্বন্দ্ব যেন একদিনে মুছে গিয়েছে। তার ভিতর একটা শান্তি, এক নতুন শক্তি, এক নতুন অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। তার সামনে এক নতুন জীবন, এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গিয়েছিল, আর সে জানতো, এই পথেই তাকে এগোতে হবে।
সে এক গভীর শ্বাস নিল, আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এবার আমি জানি, আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি এখন মুক্ত।”
এই এক নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে, সুহানার জীবনে সবকিছু বদলে গেল। সে আর কোনো অন্ধকারে হারাবে না। তার পথ এখন এক নতুন দিগন্তের দিকে—এবং সেই দিগন্তের দিকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সে নিজেই পেয়েছে।
***
				
	

	


