মৌসুমী দাস
অধ্যায় ১:
দুপুরবেলা, পল্লীগ্রামের ছায়াঘেরা এক উঠোনে বসে আছে অরূপ। সামনে একটা ছোট্ট পিড়ি, তার ওপরে ছড়ানো স্কুলের বইখাতা। মাথার ওপর ছাউনি করা খড়ের চাল, পাশে মা-র গামছা দিয়ে ছেঁকে রাখা হাঁড়িতে কাঁচা আম আর ধানের গন্ধ মেশানো ভাত। কাঁচা উঠোনে মাঝে মাঝেই ধুলো উড়ে আসে বাতাসে, আর তাতে বইয়ের পাতাগুলো দুলে ওঠে। অরূপের চোখ মাটির দিকে, কিন্তু মন আকাশে—পড়াশোনার উচ্চাশায়, গ্রামের গণ্ডির বাইরে এক নতুন জগতে। এই ছোট্ট ঘরটিতে অভাব আছে, আছে ভাঙা চালের ছিদ্র দিয়ে বর্ষাকালে চুইয়ে পড়া জল; কিন্তু যা আছে, তা হল অদ্ভুত এক নির্ভরতার গন্ধ—মায়ের ভালোবাসা, নিঃশব্দ আত্মত্যাগ আর অকুণ্ঠ আশীর্বাদ। মা এখন বাইরে গেছেন নদীর পাড়ে কাজ করতে, যাতে আজকের রাতে একটু ডাল-ভাতের পাশে একফালি আলু পোড়া জোগাড় হয়। কিন্তু যাওয়ার সময় বলে গেছেন—“বইখাতা ফেলে উঠে যাস না, অরূপ… তোকে অনেক দূর যেতে হবে রে।” অরূপের চোখে জল আসে না, কারণ অভাব তার চোখ শুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু বুকের ভিতরটা ভিজে যায়।
অরূপের বাবা মারা গেছেন সে তখন পাঁচ বছরের। তখন থেকেই মা-ই তার বাবা, মা, অভিভাবক—সব। সাদা থানের শাড়ি পরে যেদিন মা সবার সামনে মাথা নিচু করে কাজের খোঁজে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন, সেদিনই অরূপ বুঝে গিয়েছিল, এখন তার ছোটবেলার দিন শেষ। কিন্তু সেই ছোট্ট বয়স থেকেই মা তাকে শেখাতে শুরু করলেন, “জগতে তুই যদি নিজের মাথা উঁচু করে থাকতে চাস, তবে পড়াশোনা কর—পায়ে ঠেকা না পড়ে, নিজের পায়ে দাঁড়াবি।” সেই থেকে অরূপের পড়াশোনা শুরু। সকালে মাঠে কাজ করে এসে মা তাকে স্নান করিয়ে হাতে বই ধরিয়ে দিতেন। বিদ্যুৎ ছিল না ঘরে, তাই হারিকেনের আলোয় রাত্রে বসে পড়ত অরূপ, মা তার পাশে বসে মুড়ি ভাঙতেন। গ্রামের কেউ কেউ হাসতো—“ছেলে তোদের কতদূরই বা যাবে?” কিন্তু মা মৃদু হেসে বলতেন, “আমার ছেলে ঠিক যাবে, ঈশ্বর চাইলে।” অরূপ জানতো, মা তাকে শুধু সাহস দেন না—তিনি নিজের স্বপ্ন ছেলেকে দিয়ে পূরণ করতে চান। মায়ের স্বপ্নই তার কাছে ছিল প্রতিজ্ঞার মতো পবিত্র।
একদিন হেডস্যার এসে বললেন—“অরূপ, তুমি কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়েছ। শহরে পড়তে যেতে হবে। স্কলারশিপও পেয়েছ।” খবরটা শুনে অরূপ যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। তার মনের মধ্যে হাজারো চিন্তা, হাজারো দ্বিধা—“আমি কি পারব? শহর কীভাবে সামলাব?” কিন্তু সে কিছু বলেনি। চোখের কোণে জল নিয়ে বাড়ি ফিরে দেখল, মা উঠোনে ধান ঝাড়ছিলেন। হেডস্যারের কথা শুনে মা থেমে গেলেন, কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “আমি জানতাম তুই পারবি। এবার শুধু মন দিয়ে পড়িস। সংসার আমি চালিয়ে নেব।” সেই রাতে ঘুমের আগে অরূপ দেখতে পায়—মা একা বসে, চুপচাপ গা ধুয়ে আসা শীতল জলে পা ভিজিয়ে রাখছেন, যেন দিনের ব্যথা কিছুটা হালকা হয়। কিন্তু চোখে তার স্বপ্ন—অরূপের শহরে যাবার প্রস্তুতি। সেই রাতে অরূপ জীবনে প্রথমবার নিজের ভবিষ্যতের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পায়, আর সেই ছায়ার ঠিক পেছনে মায়ের এক অদৃশ্য অস্তিত্ব—যিনি নিজের আলো নিভিয়ে ছেলেকে উজ্জ্বল করতে চান।
যেদিন শহরের ট্রেন ধরবে, সেদিন মা খুব ভোরে উঠে গামছায় ভরে কিছু তেলের পুড়ি, চিনি, আর একটা হাতঘড়ি জড়িয়ে দিলেন ছেলের ব্যাগে। বললেন, “ওই ঘড়িটা তোর বাবার ছিল। তুই যখন পড়বি, দেখবি কতদূর এলি, আর ঠিক কত সময় বাকি আছে। কখনো ভয় পাস না, আমি তোকে দেখতে পাব না, কিন্তু তুই আমায় মনে করলেই আমি রইলাম। ছায়ার মতো।” স্টেশনে ট্রেন ছাড়ার আগে মা ছেলের পায়ে জল ছুঁয়ে বললেন, “তুই যেন থেমে না যাস।” ট্রেন চলতে শুরু করল, জানালা দিয়ে অরূপ দেখল—মা এখনও দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা থান উড়ছে বাতাসে, চোখে জল নেই, কেবল ঠোঁটে একটুকরো শান্তির হাসি। সেই দৃশ্য অরূপের জীবনের দিগন্তে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে। আর সেদিন থেকে শুরু হয় এক কাঁচা উঠোন ছেড়ে পাকা স্বপ্নের পথে ছেলের যাত্রা—যার প্রতিটি পদক্ষেপে পাশে থাকবে এক ‘ছায়ার মতো মা’।
অধ্যায় ২:
ট্রেন যখন শহরের স্টেশনে ঢুকে পড়ে, তখন সকালের আলো ফুটে উঠেছে। অরূপ জানালার ধারে বসে বহুক্ষণ ধরে তাকিয়ে ছিল বাইরের দৃশ্যে—খোলা মাঠ থেকে ইঁট-কাঠের নগরীর উত্থান, ছোট দোকান থেকে বিশাল সুপারমার্কেট, আর পথঘাটে মানুষের ব্যস্ততার এক আলাদা রঙ। এতদিন যা শুধু কল্পনায় ছিল, আজ তা বাস্তব। শহর যেন বিরাট এক দৈত্যের মতো, যার প্রতিটি ইট অরূপকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে। স্টেশনে নেমে সে কাঁধে ব্যাগ তুলে হোস্টেলের ঠিকানা খুঁজতে শুরু করে। চারপাশে অজস্র গাড়ি, হর্ণ, ভিড়—এ যেন এক বিভ্রান্তির রাজ্য। গ্রামে যেমন কাউকে জিজ্ঞাসা করলে হাসিমুখে পথ দেখিয়ে দিত, এখানে সবাই যেন ব্যস্ত, তাড়া তাড়া চোখে তাকায়। হোস্টেলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে যায়। পুরোনো একটা তিনতলা দালান, ভেতরে সিঁড়ির পাশের দেওয়ালে নকশা করে লেখা কিছু ছেলের নাম, কেউ ফার্স্ট ক্লাসে পাশ করেছে, কেউ চাকরি পেয়েছে। অরূপের মনে হয়, এই নামগুলোর মাঝে একদিন তার নামও থাকবে কিনা। চতুর্থ কক্ষে তার বরাদ্দ—একটা টিনের খাট, একটুখানি বইয়ের তাক আর জানালাহীন ঘরের দেয়ালে একটা পোকামাকড়ের দাগ। এটা তার নতুন ঘর।
ঘর গুছিয়ে বসতেই পাশের রুম থেকে একজন ছেলেকে দেখে—গোঁফ গজানো, চোখে চশমা, পরনে ব্র্যান্ডেড টি-শার্ট। ছেলেটি কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞাসা করে, “নতুন এসেছো? কোথা থেকে?” অরূপ হেসে বলে, “বর্ধমানের কাছে একটা গ্রাম থেকে।” ছেলেটি সামান্য বিরক্তি নিয়ে বলে, “ওহ, গাঁ-গঞ্জের ছেলে… সাবধানে থেকো, শহর কিন্তু হজম করে না সবাইকে।” এই প্রথম শহরে এসে এমন সরাসরি মন্তব্যে অরূপ একটু কাঁপে। বুঝতে পারে, এখানে কেউ তাকে উৎসাহ দেবে না, বরং প্রশ্ন তুলবে তার উপস্থিতির যৌক্তিকতা নিয়ে। দুপুরে হোস্টেলের ক্যান্টিনে গিয়ে দেখল, সবার প্লেট ভর্তি বিরিয়ানি, পোলাও, চিকেন। সে শুধু একটা ডিম কারি আর ভাত নিল, কিন্তু দাম শুনে হাত কেঁপে যায়—গ্রামে এই দামে মা পাঁচ দিনের বাজার করতেন। চুপচাপ খেয়ে ফিরে আসে ঘরে। শহর তার মুখে হাসি ফোটাতে জানে না, এখানে কেউ পিঠে হাত রাখে না, কেউ “ভাল আছিস তো?” বলে না। এই ভিন্ন জগত তাকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দেয়।
রাত বাড়ে। হারিকেন নয়, এখানে টিউব লাইটের আলো। কিন্তু সেই আলোতেও যেন অন্ধকারের এক ধরনের নিঃসঙ্গতা জমে থাকে। অরূপ জানালার ধারে বসে, ব্যাগ থেকে মায়ের গামছায় মোড়ানো খাবার বের করে। শুকনো পুড়ি আর চিনির স্বাদ মুখে দিলেই মায়ের মুখ মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে, মা বলেছিলেন—“তোর মন খারাপ হলে এই পুড়ি খেয়ে নিস, আমি তোকে ছুঁয়ে আছি।” কোলের ওপরে বাবার পুরোনো ঘড়ি—সেটার কাঁটাগুলো যেন বলে চলেছে, “সময় থেমে থাকে না, চলতেই হবে।” কিন্তু অরূপের মনে হয়, যেন কেউ তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে না এই শহরে। কারও চোখে তার কষ্ট নেই। সে পড়তে বসে, কিন্তু অক্ষরগুলো যেন হিম হয়ে আসে চোখে—তাদের অর্থ নেই, তারা কেউ অরূপের অনুভব বোঝে না। হোস্টেলের জানালাবিহীন ঘর যেন তার হৃদয়ের মতোই—ভেতরে আলো আছে, কিন্তু বাইরে অন্ধকার। ঘুম আসে না সেদিন রাতে। শুধু বুকের ভিতরে মা’র কথা, তার স্পর্শের উষ্ণতা আর ছোটবেলার সেই উঠোনের মাটির গন্ধ বারবার ফিরে আসে।
ভোরের দিকে কিছুটা ঘুম আসে, তাও অস্থির। স্বপ্নে দেখে—মা দাঁড়িয়ে আছেন ধানের মাঠে, সাদা থান উড়ছে বাতাসে, কিন্তু অরূপ ডাকছে, মা শুনছেন না। ঘুম ভেঙে সে বোঝে—এই শহর শুধু তাকে নয়, তার স্বপ্নকেও ভয় দেখাচ্ছে। কিন্তু সে জানে, হাল ছাড়লে চলবে না। পরদিন সকালে সে হোস্টেলের ছাদের কোণে গিয়ে বসে, চোখ মেলে শহরটাকে দেখে। শহর নীরব, রুক্ষ, কিন্তু একইসঙ্গে সম্ভাবনাময়। তার ভিতরে হালকা একটা আলো জ্বলে ওঠে—এ শহর তাকে অস্বীকার করতে পারে, কিন্তু সে যদি নিজের পরিচয় ভুলে না যায়, তবে জয় অসম্ভব নয়। মনে পড়ে মায়ের সেই কথাগুলো—“তুই মাটি থেকে উঠবি, কিন্তু আকাশ ছুঁতে শেখবি।” একলা রাত শেষে অরূপ নিজের ভেতরে প্রতিজ্ঞা করে—মাকে কথা দিয়েছে সে, এবং মায়ের ছায়া তাকে ছুঁয়ে থাকলে, সে পিছিয়ে যাবে না।
অধ্যায় ৩:
অধ্যায় ৩: অপমানের দিনলিপি
কলেজে প্রথম ক্লাসের দিনটা ছিল একরকম বিভ্রান্তিকর। সকালবেলা অরূপ পুরোনো পাঞ্জাবি-চেক শার্ট পরে বেরিয়ে পড়েছিল, মাথায় তেল দিয়ে আঁচড়ানো চুল, চোখে একটু ভয়, মুখে মৃদু আত্মবিশ্বাস। তার ধারণা ছিল, ক্লাসে সবাই পড়াশোনার ব্যাপারে যত্নবান হবে, শিক্ষকরা উৎসাহ দেবেন, আর সহপাঠীরা বন্ধুর মতো পাশে থাকবে। কিন্তু বাস্তব বড় নির্মম। ক্লাসরুমে ঢুকেই সে বুঝল, তার পোশাক, উচ্চারণ, এমনকি বই হাতে ধরে রাখার ধরনটাও শহুরে শিক্ষার্থীদের থেকে আলাদা। কেউ কটাক্ষ করে তাকাল, কেউ ফিসফিস করে বলল, “নতুনটা আবার কোন গাঁ থেকে এসেছে রে?” প্রফেসর ইংরেজিতে পড়ানো শুরু করলেন—তাকে বোঝা গেলেও, প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় অরূপ একটু হকচকিয়ে গিয়ে বাংলায় উত্তর দিল। মুহূর্তেই ক্লাসে হাসির রোল। কেউ ব্যঙ্গ করে বলল, “বুঝি গুগল ট্রান্সলেটও বন্ধ!” ওই হাসির শব্দ অরূপের বুকের ভেতর গিয়ে বিধল, গাঁয়ের সরল ছেলেটা বুঝল—এখানে মেধা নয়, ভাষা, পোশাক, চালচলনেই মানুষ মাপা হয়।
দুপুরে ক্যান্টিনে গিয়ে নতুন লজ্জার মুখোমুখি হল সে। সবার হাতে দামি ফোন, টেবিলে আধুনিক ভাষা, আর মেনুতে যার যার পছন্দমতো ফাস্টফুড। অরূপ হাতে একটা ছোট থালায় শুধু ডালভাত নিল, পকেটে টান পড়বে জেনেও। সে চুপচাপ কোণের দিকে বসে খেতে শুরু করল। পাশের টেবিল থেকে কেউ বলল, “ওই, ডালভাতেই টপার হবে?” তারপর কেউ কৌতুক করে বলল, “মা বুঝি পাটালি গুড় দিয়ে পাঠিয়েছে?” অরূপ কিছু বলল না—তার মায়ের পাটালির স্বাদ তার কাছে সোনা সমান, কিন্তু এখানে তা উপহাসের বিষয়। তার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়, কিন্তু সে মুখ তুলেও তাকাল না কারও দিকে। বিকেলে লাইব্রেরিতে গিয়ে সে একা বসে থাকল, একটা বই হাতে নিলেও মন বসছিল না। মায়ের কথা মনে পড়ছিল—“তোর পথ সহজ হবে না রে, কিন্তু সাহস ছাড়িস না।” তবু সাহস কাকে বলে, কোথায় থাকে, এই মুহূর্তে তার হৃদয় খুঁজে পায় না।
দিন পেরোতে থাকে, অপমান যেন অরূপের নতুন রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। কেউ প্রশ্ন করে—“তুই ইংরেজি কিভাবে বুঝিস? গ্রামে কি স্পোকেন ইংলিশ শেখায়?” কেউ হোস্টেলের বাথরুমে শ্যাম্পু রেখে “চুরি হবে” ভেবে তালা লাগাতে চায়, আর তারপর তীর্যকভাবে অরূপের দিকে তাকিয়ে হাসে। রাতে ঘরে ফিরে সে চুপচাপ বিছানায় বসে। বাইরের হোস্টেল-কক্ষে গান বাজে, উচ্চস্বরে আলোচনা, হাসির ঝড়। অথচ তার ঘরটায় নিঃস্তব্ধতা—তেমনই নিঃস্তব্ধ যেভাবে মা রাতে চুপচাপ কাঁথা সেলাই করতেন, ছেলের স্কুল ফিস দিতে পারবে কিনা তা ভেবে। এখন সেই মায়ের কথা ভেবে চোখে জল আসে, কিন্তু অরূপ জানে—এই জল কারো কাছে কোনো মানে রাখে না। এই শহরে চোখের জল দেখালে মানুষ দুর্বল ভাবে। তাই সে শিখে যায়—কান্না ভিতরে রাখতে হয়।
তবু এই অপমানের দিনলিপির মাঝেও অরূপের ভিতরে কোথাও জমে ওঠে এক ধরনের ঘনীভূত অভিমান—নিজের জীবনের প্রতি, শহরের রুক্ষতায়, আর সব থেকে বেশি নিজের অক্ষমতা নিয়ে। সে ভাবতে থাকে, “আমি কি সত্যিই এদের থেকে পিছিয়ে?” কিন্তু উত্তরটা মেলে না। এক রাতে মায়ের ফোন আসে—প্রায় এক সপ্তাহ পরে। মা বলে, “শোন, তোর কণ্ঠটা কেন এমন? ক্লান্ত শোনাচ্ছে।” অরূপ সব কথা চাপা দিয়ে বলে, “না, মা, কলেজ তো খুব ভালো। পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত।” মা তখন হাসে, “তুই তো আমায় কিছু বলবি না, আমি বুঝি না রে? তোর কণ্ঠই বলে দিচ্ছে সব। তুই শুধু মনে রাখিস, তুই পেছনে ফিরবি না। কষ্ট হলে তুই কাঁদিস, কিন্তু থামিস না।” সেই ফোন কলে কথা বলা শেষ হয়, কিন্তু মায়ের বলা ওই শেষ বাক্যটাই সারারাত ধরে অরূপের কানে বাজতে থাকে। সে বুঝে যায়, অপমান সহ্য করেও যারা স্বপ্ন ধরে রাখে, তারাই একদিন নিজের জায়গা বানাতে পারে। আর তার তো একজন আছে, যিনি কখনো প্রশ্ন করেন না, শুধু বিশ্বাস করেন—এক ‘ছায়ার মতো মা’।
অধ্যায় ৪:
নভেম্বরের শুরু। শহরের আকাশটাও যেন কুয়াশা মেখে অরূপের মনের ভার তুলে ধরছিল। কলেজে যাবার আগেও এখন আর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ানোর ইচ্ছেটুকু হয় না তার। ঘুম থেকে উঠলেও ঘুম ভাঙে না যেন—মনে হয়, মাথার ভেতরটা বালির মতো ভারী, হৃদয়টা যেন পাথরে মোড়া। অরূপের বইয়ের তাক ধূলিধূসর, পড়ার ডেস্কে ল্যাম্প জ্বলে না দিনের পর দিন, আর খাতার পাতা ফাঁকা। একসময় যে ছেলেটা প্রতিটি শব্দ যত্ন করে লিখত, গাছের পাতায় পড়া কবিতার লাইন টুকে রাখত, এখন সে প্রতিটি শব্দের কাছে পরাজিত। ক্লাসে সে এখন নীরব, প্রফেসর প্রশ্ন করলে চোখ নামিয়ে থাকে, লাইব্রেরিতে গিয়ে বই ছুঁয়ে আবার রেখে দেয়। সহপাঠীরা তার অস্তিত্ব ভুলে যেতে বসেছে। কেউ আর তার পাশে বসে না, কেউ প্রশ্ন করে না “তুই ঠিক আছিস তো?”—শুধু একটা ছায়া হয়ে থেকে যায় অরূপ, শহরের ব্যস্ততা আর চঞ্চলতার মাঝখানে।
একা ঘরে বসে মাঝরাতে হঠাৎ হোস্টেলের জানালা খুলে যায় হাওয়ায়, আর সেই শীতল হাওয়ায় অরূপের শরীর কাঁপে না, কাঁপে তার ভেতরের ছিন্ন আত্মা। সে নিজেকে আয়নায় দেখে—ক্লান্ত চোখ, শুকিয়ে যাওয়া গাল, এবং ভেতরের সেই শক্তি, যা এক সময় তাকে শহরে টেনেছিল, তা যেন কোথাও মিলিয়ে গেছে। তার মনে হতে থাকে, মায়ের সব স্বপ্ন সে ভেঙে ফেলছে ধীরে ধীরে। সে চিঠি লেখে না, ফোন করে না। মা একদিন কল করেন—“তুই কেমন আছিস রে অরূপ?” সে শুধু বলে, “ভালো আছি মা, পড়াশোনা চলছে।” অথচ সে জানে, কিছুই চলছে না। বইয়ের অক্ষরগুলো চোখে সাদা কালো দাগের মতো ভাসে, কোন বিষয়ে কোন পৃষ্ঠা, কোন অধ্যায়—সবই এখন তার কাছে অচেনা। যেন সে পড়ে না, যেন সে ডুবে যাচ্ছে এমন এক জলজগতের ভেতরে, যেখানে ভাষা, শব্দ, অনুভব—সব হারিয়ে গেছে।
দিন যায়। একদিন পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়। হোস্টেলের ছেলেরা রাত জেগে পড়তে বসে, কফির কাপ ভরে ওঠে, চেয়ার ঘোরে, বইয়ে চিহ্ন পরে। কিন্তু অরূপের ঘরে নেই আলো, নেই শব্দ। সে চুপচাপ বসে, খাতার এক কোণে একটা রেখা টানে—টানা, টানা, আবার টানা, যেন তার জীবন একটা সরলরেখা যেখানে বাঁক নেই, গতি নেই, কেবল দিকহীন গমন। পরীক্ষার দিন সে কলেজে যায়, কিন্তু খাতায় লেখে না কিছুই। শুধু প্রথম পাতায় লিখে, “ক্ষমা করো মা। আমি পারিনি।” সে খাতা জমা দেয়, মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসে। ক্লাসরুমের দরজার বাইরে তার হৃদয়টা যেন কেঁপে ওঠে—এই প্রথমবার নিজেকে ব্যর্থ বলে মনে হয় তার। এতদিন সে নিজেকে বোঝাত যে সবাই একা ফেলে দিয়েছে, আজ বুঝল—সে নিজেকেই ছেড়ে দিয়েছে এক গভীর শূন্যতায়। আর এই শূন্যতা, এই লেখার থেমে যাওয়া, তাকে এক অলিখিত দুঃখের কবরে ঠেলে দেয়।
এক রাতে, হঠাৎ করেই সে জেগে ওঠে। জানালার ফাঁকে আকাশে ঝলমলে চাঁদ, দূর থেকে কোনও গানের ভেসে আসা সুর—এ যেন শহরের কোনো ঘুমন্ত মন বলছে, “তুই এখনো হারাসনি।” অরূপ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। তার খাতার পাতাগুলো আবার উল্টে যায়। সে কলম তোলে, কিন্তু কিছু লিখে না। কেবল তাকিয়ে থাকে। মনে পড়ে, মা একবার বলেছিলেন—“তুই যদি কাঁদতেও পারিস না, তোর কলমকে বলিস—ও জানে কীভাবে মনের ব্যথা লিখতে হয়।” কিন্তু আজ কলমও চুপ। এমন মুহূর্তে তার দরজায় কেউ কড়া নাড়ে না, কেউ পাশে এসে বসে না। তার চোখে জল আসে না, আসে না কোনো প্রতিশ্রুতিও। শুধু আসে মায়ের সেই মুখ, যে দূরে কোথাও ঘরের কোণে বসে ছেলের লেখা চিঠির অপেক্ষায়, জানেন না কী হয়েছে, তবুও বিশ্বাস করেন—ছেলে ফিরবে, ছেলের লেখনী আবার চলবে। আর সেই ছায়াময় ভালোবাসার স্পর্শেই অরূপ ধীরে ধীরে অনুভব করে, লেখার থেমে যাওয়া মানে শেষ নয়, কখনো কখনো সেটা এক নতুন অধ্যায়ের শুরুর নিঃশব্দ প্রস্তুতি।
অধ্যায় ৫:
ডিসেম্বরের শুরু। শহরের হালকা শীত জমতে শুরু করেছে। হোস্টেলের জানালার বাইরে দূরের আকাশ ধূসর, কুয়াশায় ঢাকা। অরূপের ঘরের এক কোণে জমে থাকা বইখাতার স্তূপে ধুলো জমেছে। তার চোখে ক্লান্তি, মুখে নিঃসঙ্গতা, হাতে কোনো চিঠি নেই, আর কলম ক’দিন ধরেই শুকনো। সে জানত না, কীভাবে আবার শুরু করতে হয়। সেই দিন সকালে হোস্টেলের করিডোরে ডাকপিয়ন এসে হাঁক দিল, “অরূপ ঘোষ! তোর চিঠি এসেছে রে!” চমকে উঠল অরূপ। এতদিনে কেউ কিছু পাঠায়নি, কোনো বন্ধু নেই, আত্মীয় নেই—তবে কে? সে ধীরে ধীরে চিঠিটা হাতে নেয়। মোড়ানো খামে মায়ের লেখা অচল বাংলার অক্ষর—“আমার অরূপ বাবুকে”। অরূপ চিঠিটা বুকের কাছে টেনে ধরে, যেন মা’র বুকের উষ্ণতা এসে পড়ে তার কাঁধে।
চিঠিটা খুলতেই শুকনো তুলসী পাতার গন্ধ ভেসে এলো। মা প্রতিবারের মতো এবারও গামছায় মোড়া পাটালির ছোট এক টুকরো গুঁজে দিয়েছেন। পাতায় লেখা ছিল—
“বাবু,
তোর কোনো খবর পাচ্ছি না, মনটা খুব খারাপ। জানি, ব্যস্ত থাকিস। তবে মায়েরা জানে, ছেলেরা ভালো থাকলে তারা চুপ করে থাকলেও মনে শান্তি থাকে। তুই ভালো নেই, তাই আমার বুক ধুকপুক করছে। কবে যে তোর গলা শুনব!
তুই তো জানিস, আমি লেখাপড়া জানি না ভালো। তোর বাবার কাছ থেকে শেখা এই অক্ষরগুলো দিয়ে যতটুকু পারি লিখি। এই ক’দিন তোদের পুকুরে কাজ করছি, যাতে তোর জানুয়ারির খরচটা জোগাড় হয়। শরীরটা খুব ব্যথা করছে, তবুও মন বলছে—তুই ঠিক দাঁড়িয়ে যাবি। তুই ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই রে, অরূপ।
সবার মতো তোর মাও চায় তোর নাম হোক, চাকরি হোক। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা—তুই নিজের ওপর বিশ্বাস রাখিস। তুই হারলে শুধু তুই না, আমি-ও হেরে যাব। আমি চাই না আমার অরূপ থেমে যাক। মনে রাখিস, তোর মা তোর পাশে আছে, ছায়ার মতো। চোখ বন্ধ করলেই আমাকে দেখতে পাবি।
ভালো থাকিস। পাটালিটা খেলে একটু মিষ্টি লাগবে মুখে—যেন আমার মুখের হাসি তোর কাছে পৌঁছয়।
—তোর মা”
চিঠিটা পড়ে অরূপ এক মুহূর্তে থমকে যায়। যেন একটা ঝড়ে সে কেঁপে ওঠে, কিন্তু সেই ঝড়ে কোনও ধ্বংস হয় না—বরং তার ভিতরে কোথাও জমে থাকা মেঘ ছিন্ন হয়ে আলো দেখা দেয়। চোখের জল ছুটে আসে। এতদিন নিজের দুঃখ, অপমান, হতাশা—সব কিছু সে নিজেই বহন করছিল, অথচ মা দূর থেকে তা টের পেয়েছেন। মায়েরা জানেন, ছেলের মুখ দেখা না গেলেও হৃদয়ের টান বলে দেয়—সে ভালো নেই। সেই চিঠির প্রতিটি অক্ষর যেন একটা ডাক, একটা সাহস—যা অরূপের নিভে যাওয়া আলোকে আবার জ্বালিয়ে দেয়। সে চিঠিটা বুকের ওপর রাখে, তারপর বারান্দায় গিয়ে শহরের আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “মা, আমি তোকে কথা দিচ্ছি—আমি হারব না।” সেই মুহূর্তে শহরের ব্যস্ত ট্রাফিকের শব্দ যেন থেমে যায়, দূরের হর্ন আর পাশের ঘরের গান কানে আসে না—শুধু মায়ের কণ্ঠটা যেন কানে বাজে—“তুই হারিস না রে।”
চিঠির পরদিন থেকেই অরূপের ভেতর কিছু একটা বদলে যেতে থাকে। সে ধীরে ধীরে বইয়ের পাতা খুলে। প্রথমে পড়তে কষ্ট হয়, কিন্তু মায়ের সেই চিঠির প্রতিটি বাক্য যেন তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। যখনই চোখ ক্লান্ত হয়ে আসে, চিঠিটা পড়ে সে বলে—“তুই থামিস না।” লাইব্রেরিতে আবার যায়, টিচারদের প্রশ্ন করে, সহপাঠীরা তাকিয়ে দেখে—এই ছেলেটা তো বদলে গেছে! কেউ কেউ আবার হাসে, কটাক্ষ করে বলে, “আহা, নতুন উদ্যম!”—কিন্তু এবার অরূপ সেই কটাক্ষকে পাত্তা দেয় না। কারণ সে জানে, সে কার জন্য যুদ্ধ করছে—শুধু নিজের জন্য নয়, তার মায়ের জন্য, যে মাটি কাটে, শরীরে ব্যথা নিয়ে পাটালি পাঠায়, আর ছেলের চিঠির অপেক্ষায় রাত কাটায়। হোস্টেলের ঘর, যা এতদিন তার কাছে একটা নিঃসঙ্গ কারাগার ছিল, এখন একটা সংগ্রামের ঘাঁটি হয়ে ওঠে। চিঠির ভাষায় প্রাণ ফিরে পায় অরূপ, এবং সেই প্রাণই তার মেধাকে আবার জাগিয়ে তোলে।
অধ্যায় ৬:
চিঠির পর দিনটা ছিল অন্যরকম। হোস্টেলের জানালায় সূর্যটা প্রতিদিনের মতোই উঠেছিল, কিন্তু যেন আলোর রংটা বদলে গিয়েছিল অরূপের চোখে। এতদিন সে সূর্যকে দেখত এক তপ্ত বাস্তবতা হিসেবে—যা কেবল ক্লান্তি এনে দেয়। কিন্তু আজ সেই আলোতেই সে দেখল সাহসের ইঙ্গিত, পুনর্জন্মের ইঙ্গিত। সে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল, স্নান করে নিজের জামা কাপড় ধুয়ে দিল নিজে হাতে, ডেস্কটা পরিষ্কার করল, আর মায়ের চিঠিটাকে গ্লাসের নিচে রেখে বলল—“এইটা আমার তাবিজ, আমার মনোবল।” প্রথমে বইয়ের প্রথম অধ্যায় খুলল—যেটা সে বহুদিন ছুঁয়েইনি। পড়া কঠিন লাগছিল, অক্ষরগুলো যেন একেকটা পাহাড়ের মতো চড়াই। কিন্তু আজ অরূপ ভয় পেল না, কারণ সে জানত—তার পেছনে এক নারী রয়েছেন, যিনি তার জন্য নিজের জীবনের সব কিছু বিসর্জন দিয়েছেন, বিনিময়ে কিছু চায়নি, শুধু চেয়েছেন ছেলেটা যেন থেমে না যায়। সেই ভালোবাসার ঋণ শোধ করা যায় না, কিন্তু সেই ঋণের ভারই তাকে শক্তি দেয়। প্রথমবার সে টিক দিয়ে যায়, নোট করে, নিজের মতো করে বোঝে।
ক্লাসে গিয়ে সে আবার নিজের পুরোনো জায়গায় বসে। প্রফেসর একটি প্রশ্ন করেন, এবং সে হাত তোলে। সবাই চমকে যায়। কিছু ছেলেমেয়ে ফিসফিস করে, কেউ হেসে ফেলে। অরূপ থামে না। প্রশ্নের উত্তর দেয়, ভুল হতে পারে, কিন্তু সে থামে না। প্রফেসর তাকিয়ে বলেন—“ভেরি গুড। পড়তে বসেছো আবার দেখি।” সেই কথাটা যেন আকাশ থেকে বৃষ্টি নেমে আসার মতো। কলেজের করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে সহপাঠীদের কেউ কেউ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, “তুই আবার পড়ছিস বুঝি?” সে মাথা নাড়ে—হ্যাঁ। কিন্তু আজ আর কারও কথায় সে ভাঙে না, কাঁপে না। সন্ধ্যাবেলায় লাইব্রেরিতে সে নতুন বই চায়, টিচারের কাছ থেকে রেফারেন্স চায়, বাড়তি প্রশ্ন করে। লাইব্রেরিয়ান অবাক হয়ে বলে, “এতোদিন তো এই ছেলেটাকে দেখতাম চুপচাপ কোণে বসে… আজ যেন অন্য কেউ।”
অরূপ নিজের মধ্যে এখন এক নতুন শক্তি খুঁজে পেয়েছে। মায়ের চিঠির প্রতিটি অক্ষর তার প্রতিটি দৌড়ের ধাপে সঙ্গী।
কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো মানেই সবকিছু বদলে যায় না। ভেতরের লড়াই থাকে, ক্লান্তি থাকে, সমাজের অবহেলা তো সহজে যায় না। তবু অরূপ প্রতিদিন নিজেকে টানতে টানতে এগোয়। রাত জেগে পড়ে, ঘুমের ঘোরে স্বপ্নে মা’র মুখ দেখে। মাঝে মাঝে মনে হয়—হয়তো পারবে না। কিন্তু তখন চিঠিটা পড়ে। মা লিখেছিলেন—“হারলে তুই না, আমি হারব।” এই লাইনটা যেন তলোয়ার। হোস্টেলে একদিন একজন ছেলে বলে, “তোর তো হঠাৎ করে বড্ড বেশি পড়ার উৎসাহ! গ্রামের ছেলে হয়ে শহরে নাম করতে চাস বুঝি?” অরূপ শান্তভাবে বলে—“আমি শুধু নিজের কাছে নাম করতে চাই। আর আমার মায়ের কাছে।” সেই উত্তর শুনে কেউ আর কিছু বলে না। সে বুঝে গেছে, তার লড়াইটা কারও সঙ্গে নয়—নিজের দৌর্বল্যের সঙ্গে, নিজের অতীতের সঙ্গে। প্রতিটি পড়া অধ্যায়, প্রতিটি দাগ দেওয়া লাইন, প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর—এইগুলোই তার অস্ত্র।
পরীক্ষার দিন আসে। অরূপ এবার আর থমকে থাকে না। খাতায় কলম চলে—অন্তরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে লিখে যায়, জানে না সে কেমন লিখেছে, কিন্তু জানে—এই লড়াইটা সে একা লড়েনি। খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় সে মনে মনে বলে—“মা, আমি লিখেছি।” দিন পেরিয়ে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পায়—অরূপ বিভাগে প্রথম। কলেজের নোটিশ বোর্ডে তার নাম ঝুলছে সবার ওপরে। হোস্টেলের ছেলেরা চমকে যায়, কেউ প্রশংসা করে, কেউ হিংসা। কিন্তু অরূপ সেদিকে তাকায় না। তার হাতে তখন একটা ছোট পোস্টকার্ড—সে তাতে লিখছে, “মা, তোর ছেলে পারছে।” হোস্টেলের রুমে ঢুকে সেই চিঠিটা সে জানালার ধারে মোমের পাশে রাখে, যেন মা সত্যিই এসে পড়েন আলো দেখে। সেই রাতে সে চুপচাপ ঘুমোয়, শান্ত মুখে, কারণ সে জানে—ঘুরে দাঁড়ানোটা সহজ ছিল না, কিন্তু এক ছায়ার মতো মা তাকে আগলে রেখেছেন বলে সে আজ দাঁড়িয়ে। আর এখানেই শুরু হয় তার নতুন যাত্রা।
অধ্যায় ৭:
শীতের সকাল। কলেজের মাঠে রোদ এসে পড়েছে ধীর গতিতে। বাতাসে হালকা রুক্ষতা, কিন্তু অরূপের মনে তীব্র উত্তাপ—আত্মবিশ্বাসের, প্রত্যয়ের, লড়াইয়ের ফল পাওয়ার। বিভাগের মেধা তালিকায় তার নাম প্রথম স্থানে দেখে যে কৃতিত্ব সবাই বাহবা দেয়, সেই কৃতিত্বের পেছনের যন্ত্রণা আর নিঃশব্দ যুদ্ধ কেউ জানে না। সে জানে, ওই একটি নাম—‘অরূপ ঘোষ’—শুধু তার নয়, সেই নাম মিশে আছে মায়ের সেই কষ্টের হাতের রেখায়, যেখানে প্রতিদিন পাটালি বানিয়ে, জমির আল কেটে, ভাত ফুটিয়ে তিনি একেকটি স্বপ্নের ইট গেঁথে দিয়েছেন ছেলের ভবিষ্যতের ভিতে। কলেজের শিক্ষকরাও অবাক—এই চুপচাপ গ্রাম্য চেহারার ছেলেটা এত ভালো পারল কীভাবে! কেউ জানতে চায়, “তোমার প্রেরণা কী?” অরূপ শুধু মৃদু হাসে—সে জানে, তার প্রেরণার নাম লেখা নেই কোনো বইয়ে, সে তো একজন—মা, যার চিঠির অক্ষরে প্রাণ আছে।
এই সাফল্য শুধু কলেজ ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অরূপ যখন বিভাগীয় বক্তৃতায় নিজের গবেষণার খসড়া উপস্থাপন করে, তখন কিছু প্রফেসর তার প্রেজেন্টেশনে অভিভূত হন। তার বিশ্লেষণ, তার যুক্তির গভীরতা এবং তার উপস্থাপনার ভঙ্গিমায় একটি অন্তর্নিহিত আবেগ থাকে—যা কোনো কৃত্রিম আত্মবিশ্বাস নয়, বরং অভিজ্ঞতা ও মায়ের প্রেরণায় গাঁথা। প্রফেসর মিত্র তাকে ডেকে বলেন, “তোমাকে একটা পেপার প্রেজেন্টেশনের জন্য ডাকা হবে ইন্টার-কলেজ সেমিনারে। তৈরি থেকো।” এই সংবাদ শোনার পর প্রথমে অরূপ স্তব্ধ হয়ে যায়। সে ভাবে, এতদিন যে ছেলে ক্লাসে দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে সাহস পেত না, আজ সে শত মানুষের সামনে কথা বলবে! কিন্তু সে জানে, সে আর একা নেই। তার পাশে মা আছেন—ছায়ার মতো, প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি দোলায়। সে প্রতিদিন নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে—অর্থনৈতিকভাবে অভাব থাকলেও মনোবলে সে আজ ধনী।
সেমিনারের দিনটা ছিল এক অন্যরকম দিন। অডিটোরিয়ামে অনেক বড় কলেজের ছাত্ররা, নামী প্রফেসররা, আর শহরের সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি পর্যন্ত উপস্থিত। অরূপের কাঁধে তখন একটা পুরোনো ব্যাগ, ভেতরে তার নিজের হাতে বানানো কিছু নোট, আর বুকের ভেতরে এক অচঞ্চল বিশ্বাস। যখন মঞ্চে উঠে মাইক হাতে নেয়, তার চোখে ভেসে ওঠে মায়ের মুখ—যিনি কুয়াশা ঘেরা উঠোনে বসে, আগুনে হাত সেঁকে নিচ্ছেন, আর মাটির দেওয়ালে অরূপের পাঠানো পুরোনো ছবি আটকে রেখেছেন। সেই মুহূর্তে তার কণ্ঠ একটুও কাঁপে না। সে বলে—“আমি এখানে এসেছি শুধু পড়াশোনার কথা বলতে নয়, আমার মায়ের স্বপ্নের কথা বলতে।” বক্তৃতার শেষে সম্পূর্ণ অডিটোরিয়াম দাঁড়িয়ে হাততালি দেয়। কিছু শিক্ষক চোখ মুছেন। একজন রিপোর্টার এসে প্রশ্ন করে, “তুমি এতটা আবেগ কীভাবে বয়ে আনলে?” অরূপ হেসে বলে—“আমার মা আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিই আমার ভাষা।” সেদিনই শুরু হয় তার নতুন পরিচয়—অরূপ ঘোষ, যিনি শুধু একজন ছাত্র নন, একজন অনুপ্রেরণা।
হোস্টেলে ফিরে সে সেই পুরোনো ডেস্কে বসে আবার চিঠিটা পড়ে। আজ চোখে জল আসে না—আজ আসে হাসি। সে জানে, সাফল্য আসলে এক দিনে আসে না—সাফল্য গড়ে ওঠে প্রতিটি অপমানে নীরব থেকে, প্রতিটি কাঁটার ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে। আর এই হাঁটার শক্তি যাঁরা দেন, তাঁরা সামনে থাকেন না—তাঁরা থাকেন ছায়ার মতো পাশে। মা তখন ফোন করেন—শুনে গেছেন ছেলের কীর্তি। ফোনের ওপাশে চুপচাপ মা শুধু বলেন, “তোর বাবার ঘড়িটা ঠিক সময় দেখিয়েছে রে।” অরূপ হেসে বলে, “আর তোর চিঠিটা ছিল কম্পাস।” মা হাসেন না, শুধু বলেন, “তুই তো আমার ছেলেই।” সেই মুহূর্তে অরূপ জানে—এই সাফল্য, এই প্রথম ধাপ, কেবল একটা সূচনা। এখনো অনেক পথ বাকি। কিন্তু সে তৈরি—কারণ তার পাশে রয়েছেন একজন, যিনি কখনো আলো চান না, শুধু আলো জ্বালাতে জানেন—একজন ছায়ার মতো মা।
অধ্যায় ৮:
পৌষ মাসের শেষ সপ্তাহ। কলেজে ছুটি পড়েছে, কিন্তু অরূপ এবার গ্রামে যাচ্ছে না। তার এক গবেষণাপত্রের কাজ বাকি, আর কিছু জরুরি প্রস্তুতি চলছে স্কলারশিপ ইন্টারভিউয়ের জন্য। প্রতিবার শীতকাল মানেই তার গ্রামে ফিরে যাওয়া, মা’র হাতে বানানো গরম পিঠে, কাঁথার ঘ্রাণ, উঠোনে বসে তার পড়া শোনানো। কিন্তু এবার মা নিজেই বলেছিলেন—“এবার পড়াশোনাটাই আগে কর, আমি তোর ফিরে আসা অপেক্ষা করব।” এই কথায় অরূপ একটু বিস্মিত হয়েছিল, মা তো সবসময় চাইতেন সে আসুক—এবার কেন এইভাবে নিজে থেকে না আসতে বললেন? সে ভাবে, হয়তো মা কষ্ট দিচ্ছেন না—যেন সে নিজের লক্ষ্যে ঠিকঠাক এগিয়ে যায়। তাই সে পড়াশোনায় মন দেয়, কিন্তু রাতে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলেই সেই লালপেড়ে শাড়ি পরা মুখখানি বারবার ভেসে ওঠে।
একদিন হঠাৎ হোস্টেলে চিঠি আসে—গ্রামের পোস্ট অফিস থেকে। প্রেরক: “গোপালপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র”। চিঠি খুলতেই অরূপের চোখ স্থির হয়ে যায়। মা অসুস্থ, হঠাৎ জ্বরের পর শরীর ভেঙে পড়েছে। এখন ভর্তি আছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ডাক্তার লিখেছেন—“আপনার মা বারবার আপনাকে দেখতে চেয়েছেন, কিন্তু বলতেও মানা করেছেন। বলেছেন—‘ওকে ডেকো না, ওর পড়াশোনা আছে।’” সেই মুহূর্তে অরূপ যেন ভিতর থেকে গুঁড়ে যায়। সে তো ভেবেছিল মা তাকে একটু দূরে রাখতে চেয়েছেন পড়াশোনার স্বার্থে—অথচ মা আসলে নিজে নিঃশব্দ যন্ত্রণার ভেতরেও তাকে নির্ভার রাখতে চেয়েছেন। চোখের জল রোধ করা যায় না। সে আর এক মুহূর্তও দেরি না করে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে—ট্রেন, বাস, পায়ে হেঁটে, কাদা ভেঙে, হাওয়ায় ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। সে জানে না পৌঁছে কী পাবে, কাকে পাবে—শুধু জানে, দেরি করলে হয়তো আর কিছুই পাবে না।
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছে দেখে মা শুয়ে আছেন, চোখে ক্লান্তি, ঠোঁটে ফাঁটা রেখা। কিন্তু মুখে শান্তি। অরূপ সামনে যেতেই মা তাকিয়ে মৃদু হাসলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন—“তুই এলি… আমি জানতাম।” অরূপ কাঁদতে চায় না, কারণ জানে, মা দুর্বল—এই কান্না তাকেও দুর্বল করবে। সে চুপচাপ মায়ের হাত ধরে বসে থাকে। ডাক্তার বলে যান, রোগ গুরুতর নয়, কিন্তু শরীর ভীষণ দুর্বল, মনের ওপর প্রভাব পড়েছে। রাতে মা তাকে বলেন, “তুই জানিস? আমি তোকে শেষ চিঠিটা লিখে রেখেছি। যদি কিছু হয়ে যেত…” অরূপ আঁতকে ওঠে—“না মা, আমি এখন তোকে একা ছাড়ব না।” মা মৃদু হাসেন—“তুই আমায় কখনোই একা রাখিসনি রে। আমি তো তোর ভেতরেই থাকি। তোর প্রতিটা সাহসী পদক্ষেপে আমি থাকি ছায়ার মতো।” সেই রাতে অরূপ পাশে বসে ঘুমায়, মায়ের কপালে হাত রাখে, বুকের ভেতর শপথ করে—এবার থেকে জীবনের প্রতিটি সাফল্যে, প্রতিটি উচ্চতায় শুধু “নিজের জন্য” নয়, “মা’র জন্যও” বাঁচবে।
পরদিন সকালে মা খানিকটা ভালো বোধ করেন। অরূপ তখন তার কাঁথার নিচে রাখা পুরোনো খামটা খুঁজে পায়—চিঠিটা, যা মা লিখেছিলেন “যদি না ফিরিস, তাহলেও পড়বি।” সেই চিঠিতে লেখা ছিল—
“আমার অরূপ,
যদি কখনো আমি না থাকি, তুই শুধু একটাই জিনিস মনে রাখিস—তোর চলার পথটা তুই নিজেই বেছে নিয়েছিস। আমি শুধু পাশে ছিলাম। ছায়া যেমন থাকে গাছের পাশে। আমি তো তোকে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছু দিতে পারিনি, তাও জানি, তুই সেটা একদিন সোনা করে তুলবি।
তুই কখনো নিজেকে ভুলে যাস না রে। তুই তো সেই ছেলেটা, যে ঘরের দরজা বন্ধ করে চুপিচুপি মা’র কাঁথার নিচে বই পড়ত, আর স্বপ্ন দেখত দূর আকাশে পৌঁছানোর। তুই পৌঁছাবি, আমি জানি।
তুই কাঁদিস না। শুধু ভালো থাকিস। আমি থাকব না হয় আকাশে—তুই তাকিয়ে ডাকলেই আমি ঠিক শুনতে পাব।
—তোর মা”
চিঠিটা পড়ে অরূপ আর কাঁদে না। সে জানে, মা এখনো আছে। প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি লড়াইয়ের রক্তকণায়। সে মায়ের শিয়রের পাশে বসে, মায়ের হাতটা ধরে ফিসফিস করে বলে—“আমি তোর প্রতিটা স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখব। প্রতিটা। আমি কথা দিচ্ছি মা।” আর সেই প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়েই শেষ হয় না কিছু, বরং নতুন শুরু হয়—এক ছেলের যাত্রা, যার পাশে থাকবে চিরকাল একজন ছায়ার মতো মা।
-সমাপ্ত-