Bangla - সামাজিক গল্প

ছায়ার মতো জীবন

Spread the love

অনিমেষ চট্টোপাধ্যায়


কলকাতার উত্তর প্রান্তে, এক পুরনো গলির শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাড়ি যেন শহরের কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। বাড়িটির দেওয়ালগুলোয় বয়সের ছাপ স্পষ্ট। ফাটল ধরা দেওয়ালের গায়ে বুনেছে লতা-পাতা, জানালার কাঁচগুলোয় জমেছে বছরের পর বছর ধুলো। প্রতিদিন সেই জানালার ফাঁক দিয়ে একজোড়া চোখ তাকিয়ে থাকে রাস্তায়—কোনো চেনা মুখ, কোনো সঙ্গ, বা নিদেনপক্ষে কারও একটা হাসি খুঁজে পেতে চায়।

এই বাড়ির বাসিন্দা হেমন্তি দেবী। বয়স ছিয়াসট্টি। চুলের রঙ ফিকে ধূসর হয়ে এসেছে অনেক আগেই। মুখের ভাঁজগুলোয় জীবনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। একসময় এই পাড়ার প্রিয়তম বৌদি ছিলেন তিনি। যে কোনো উৎসবে তাঁর হাতের মিষ্টি না খেলে পাড়ার মানুষদের চলত না। প্রতিটি দুর্গাপুজোয়, অন্নপ্রাশনে বা বিয়েতে তাঁর উপস্থিতি ছিল অতি আবশ্যক। অথচ আজ—একটাই বাড়িতে, কত শত স্মৃতির ভিড়ে একা তিনি।

সকালবেলা ভোর হতে না হতেই হেমন্তি দেবীর ঘুম ভাঙে। জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসে দূরের আজানের সুর, পাখির কিচিরমিচির। তিনি ধীরে ধীরে বিছানা ছাড়েন। একসময় যে পা দুটোতে চঞ্চলতা ছিল, সেগুলো এখন ভারী হয়ে গেছে। প্রতিটি পা ফেলাই যেন কঠিন।

কিচেনের দিকে যান তিনি। পুরনো স্টিলের কেটলিতে জল চড়িয়ে চা বসান। চায়ের সুগন্ধ যেন তাকে সামান্য বেঁধে রাখে জীবনের সঙ্গে। চা হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে পড়েন। সামনের গলিটা এখনও ফাঁকা। কেবল মাঝে মাঝে দু-একটা সাইকেলওয়ালা ভিড় কেটে বেরিয়ে যায়।

হেমন্তি চোখ বুজে বসে থাকেন কিছুক্ষণ। মনের মধ্যে ভেসে ওঠে স্বামী অজিতের মুখ। দশ বছর আগে এক সকালে, হঠাৎ স্ট্রোক করে চলে গেছেন অজিত। কফির কাপটা অর্ধেক খেয়ে নামিয়ে রেখেছিলেন, টেবিলের ওপর সেই দাগটা আজও আছে। অজিত ছিলেন স্কুলশিক্ষক—নিয়মে বাঁধা জীবন, কড়া শৃঙ্খলার মানুষ। পাড়ার ছোট বড় সবাই তাকে সমীহ করত।

অমিত, হেমন্তি-অজিতের একমাত্র সন্তান। মায়ের চোখের মণি ছিল সে। ছোটবেলায় মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকত, মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুলে গিয়েছিল। অমিত পড়াশোনায় ভালো ছিল, বাবা-মায়ের গর্ব। কলেজ শেষে চাকরির সন্ধানে মুম্বাই পাড়ি দেয়। প্রথম প্রথম ফোন আসত প্রতিদিন, তারপর সাপ্তাহিক, পরে মাসে একবার। এখন সেই ফোনও যেন দায়িত্বের মতো হয়ে গেছে।

“মা, ব্যস্ত আছি, পরে ফোন করি।”
“মা, টাকাটা ব্যাংকে দিয়ে দেব, চিন্তা কোরো না।”
“মা, কলকাতায় আসার সময় পাচ্ছি না রে।”

হেমন্তি ফোন রেখে বসে থাকেন। চেয়ে থাকেন সেই নিঃসঙ্গ ফোনটার দিকে, যদি আবার বেজে ওঠে!

দিন কাটে একইভাবে। দুপুরবেলা গ্যাসের হালকা আঁচে এক বাটি ডাল, কিছু সবজি আর দুটো রুটি। একা খেতে বসেন, কোনো স্বাদ নেই মুখে। খাওয়া শেষ করে আবার বারান্দায় এসে বসেন। রাস্তায় মানুষজন আসে-যায়। কেউ দেখে না বারান্দায় বসে থাকা বৃদ্ধার মুখ।

সন্ধ্যে নেমে আসে। পাড়ার আলো জ্বলে ওঠে একে একে। বাড়ির পেছনের ঘর থেকে শোনা যায় পুরনো ঘড়ির টিক টিক শব্দ। মাঝে মাঝে হেমন্তি ওঠেন, ঘরের আলোটা নেভান, জানালাটা টেনে দেন। কিন্তু ঘুম আসতে চায় না। বিছানায় শুয়ে থাকেন, চোখ মেলে তাকান ছাদের দিকে। অন্ধকার ঘরে টিমটিম করে জ্বলে ওঠা আলোয় একাকিত্ব যেন আরো ঘনীভূত হয়।

শুধু একমাত্র সঙ্গী সেই ছোট্ট বিড়ালছানা—ছায়া। হেমন্তি তাকে পেয়েছিলেন একদিন সকালে বারান্দার কোণে কাঁপতে কাঁপতে। সে-ই এখন হেমন্তির একমাত্র সঙ্গী। রাতে বিছানার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকে ছায়া। মাঝে মাঝে হেমন্তির গা ঘেঁষে এসে বসে। হেমন্তি তার পিঠে হাত বুলিয়ে দেন, ফিসফিসিয়ে বলেন—“তুই না থাকলে আমার দিন কাটত কী করে?”

বাইরের পৃথিবী তার কাছে অনেক দূরের হয়ে গেছে। পাড়ার অনুষ্ঠান, পুজো-পার্বণ, সব কিছুই যেন অন্য জগতের ঘটনা। শুধু মাঝেমধ্যে ভোরের আলোয় পাখিদের ডাক, বা দূরের মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি, তাকে মনে করিয়ে দেয়—সে এখনও বেঁচে আছে।

একদিন সকালে দরজায় টোকা পড়ল। হেমন্তি অবাক হয়ে দরজা খুললেন। বাইরে পাড়ার মুদি দোকানের ছোট ছেলে দাঁড়িয়ে। হাতে একটা প্যাকেট।
“হেমন্তি দিদি, মা বলেছে, এই মিষ্টি রাখবেন। কাল আপনার অন্নপ্রাশনের পায়েস খেতে খুব মন চাইছিল। আপনি তো বানান না এখন, তাই মা আপনাকে মিষ্টি দিল।”

ছেলেটি চলে গেল। হেমন্তি দরজা বন্ধ করে চেয়ে রইলেন প্যাকেটটার দিকে। প্যাকেট খুলে দেখলেন—চিনির মুড়ি, নারকেলের লাড্ডু। চোখ ভিজে এল। কত দিন নিজের হাতে এমন কিছু বানাননি! ক’জন আর মনে রাখে তাকে?

রাতের বেলা ঘুমুতে যাবার সময় হেমন্তি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। একফালি চাঁদের আলোয় গোটা পাড়া ডুবে আছে নিস্তব্ধতায়। হেমন্তি মনে মনে বললেন, “এ শহর আমাকে ভুলে গেছে। আমি একা হয়ে গেছি। কিন্তু তবুও এই ঘর, এই বারান্দা, এই পাড়াই আমার চেনা।”

তাঁর চোখের কোণে জমা জলটুকু টুপ করে নেমে এল বারান্দার মেঝেতে। আর রাতের হাওয়ায় ভেসে গেল তাঁর নিঃশব্দ দীর্ঘশ্বাস।

হেমন্তি দেবীর দিনগুলো কাটছিল আগের মতোই—নিয়মবদ্ধ নিঃসঙ্গতা আর শূন্যতার বৃত্তে বন্দি হয়ে। কিন্তু সেই দিনটি যেন অন্যরকম শুরু হয়েছিল। সকালে ঘুম ভাঙতেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল তাঁর। বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখলেন, আকাশে হালকা মেঘের আনাগোনা, রাস্তায় সকালবেলার পরিচিত কোলাহল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছিল, হাওয়ায় যেন এক অন্যরকম বার্তা ভেসে আসছে।

সকালের চা খেতে খেতে হেমন্তি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন সামনের রাস্তায়। পোস্টম্যানের সাইকেলটা দূর থেকে আসতে দেখা গেল। হেমন্তি একসময় চিঠির অপেক্ষায় দিন গুনতেন। স্বামীর জীবদ্দশায় অজিতবাবুর স্কুলের সহকর্মীদের চিঠি, গ্রামের আত্মীয়দের চিঠি, অমিতের ছাত্রাবস্থায় লেখা কিছু পত্র—সব মিলিয়ে জীবনের এক মধুর অংশ ছিল সেইসব কাগজের টুকরোগুলো। এখন কেবল বিল বা ব্যাঙ্কের নোটিশ ছাড়া আর কিছুই আসে না।

কিন্তু আজ, পোস্টম্যান এসে থামল হেমন্তিদের বাড়ির সামনে। দরজায় টোকা পড়তেই হেমন্তি একটু কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললেন। পোস্টম্যান হাসি দিয়ে বলল,
“হেমন্তি দিদিমনি, আপনার জন্য চিঠি এনেছি।”

হেমন্তি অবাক। চিঠি? কে লিখবে তাকে চিঠি?

সাদা খামে লাল কালি দিয়ে লেখা তার নাম—শ্রীমতি হেমন্তি মিত্র। নিচে ঠিকানা। অচেনা হাতের লেখা। হেমন্তি ধীরে ধীরে খাম খুললেন। চিঠির কাগজটা বের করে যখন পড়া শুরু করলেন, তখন তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল—

“প্রিয় হেমন্তি বৌদি,
অনেকদিন হলো আপনাকে দেখি না। ছোটবেলায় আপনার হাতে পায়েস খাওয়ার স্বাদ আজও ভুলিনি। সেই মধুর দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। আমি এখন শহরের কাছেই থাকি। ইচ্ছে আছে, যদি অনুমতি দেন, একদিন আপনার কাছে এসে বসি, গল্প করি।
আমি, আপনার সেই পুরনো ছাত্র—সৌম্য।”

হেমন্তি চিঠিটা পড়ে চুপ করে বসে রইলেন। চিঠির শব্দগুলো যেন তার হৃদয়ে ছুঁয়ে গেল। কত বছর পর কেউ তাকে বৌদি বলে ডাকল! কতদিন পর কেউ তার স্মৃতিকে এভাবে জাগিয়ে তুলল!

সেদিন সারাদিন ধরে চিঠিটা বারবার পড়তে থাকলেন হেমন্তি। কখনও চশমা পরে, কখনও চশমা খুলে। যেন প্রতিটি শব্দকে হৃদয়ে গেঁথে রাখার চেষ্টা করছেন। বারান্দায় বসে দূরের আকাশের দিকে চেয়ে থাকলেন তিনি। তাঁর মনে পড়ল, সেই ছোট্ট ছেলেটা—সৌম্য। বয়সে অমিতের সমান। পাড়ার স্কুলে পড়ত। ক্লাস শেষে অজিতবাবুর কাছে পড়তে আসত। কতবার দুপুরবেলায় খেতে বসিয়ে পায়েস খাইয়েছেন ছেলেটাকে! কত আদর করতেন!

যত ভাবছেন, তত মনে হচ্ছে—হ্যাঁ, সেই ছোট্ট ছেলেটা কত বড় হয়ে গেছে এখন। তবু সে আজও তাঁকে মনে রেখেছে। এই শহরে এতজন মানুষের ভিড়ে, এই ভোলার মধ্যে কেউ তাঁকে মনে রেখেছে—এ ভাবনা হেমন্তির বুকটা গরম করে তুলল।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় হেমন্তি চিঠিটা বালিশের নিচে রেখে শুয়ে পড়লেন। যেন সেই চিঠি তাঁর স্বপ্নে এক আলো হয়ে থাকবে। ঘুম আসছিল না। কত স্মৃতি ভিড় করছিল মনে—সৌম্যের ছোটবেলা, পাড়ার হারিয়ে যাওয়া মানুষজনের মুখ, অজিতের হাসি।

পরের দিন সকালে উঠেই হেমন্তি প্রথমে চিঠিটার দিকে তাকালেন। কাগজটার ভাঁজগুলো হাত বুলিয়ে ঠিক করলেন, যেন আরও যত্নে রাখতে হবে তাকে। একটা খালি খামে নিজের হাতেই উত্তর লিখতে বসলেন তিনি—

“প্রিয় সৌম্য,
তোমার চিঠি পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। তুমি যে আজও আমাকে মনে রেখেছ, তাতেই আমার জীবনের অনেক শূন্যতা পূরণ হলো। এসো, একদিন সময় করে এসো আমার কাছে। অনেক গল্প করব আমরা।
স্নেহাশীষ,
হেমন্তি বৌদি”

চিঠিটা লিখে পোস্ট করতে দিলেন মুদি দোকানের ছেলেকে। মনে মনে এক আশার আলো জ্বলে উঠল—শুধু চিঠি নয়, হয়তো দেখা হবে। হয়তো জীবনের এই নিঃসঙ্গ ঘর আবার হাসির আওয়াজে ভরে উঠবে।

সেই দিন থেকে হেমন্তির প্রতিটি সকাল যেন নতুন করে শুরু হতে লাগল। সকালে উঠে ছেলেটাকে চোখে খুঁজতেন, পাড়ার গলির দিকে তাকিয়ে থাকতেন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ভাবতেন—সৌম্য কবে আসবে?

চিঠির স্পর্শ যেন তাঁর জীবনের ধুলো জমা জানালার কাচ মুছে দিল। অজানা এক প্রতীক্ষা, অজানা এক আশায় ভরে উঠল তাঁর নিঃসঙ্গ দিনগুলো।

সকালের নরম আলো জানালার কাঁচ ছুঁয়ে ঘরের মেঝেতে পড়ছে। একফালি রোদ যেন হেমন্তি দেবীর বুকের মধ্যে জমে থাকা অন্ধকারকে আলোকিত করার চেষ্টা করছে। আজ তার মনে হচ্ছে, সকালটা সত্যিই নতুন। কারণ আজ তিনি জানেন, এই নিঃসঙ্গ জীবনের গণ্ডিতে আবার কারও পায়ের ছাপ পড়বে।

হেমন্তি চুপচাপ বসে চায়ের কাপ হাতে বারান্দা দিয়ে সামনের গলিটা লক্ষ্য করছেন। প্রতিটি পায়ের আওয়াজ, প্রতিটি সাইকেলের বেল, প্রতিটি দরজার খোলার শব্দ—সব কিছুতেই তিনি খুঁজছেন সেই পুরনো ছাত্র, সেই চিঠির প্রেরককে। মনটা যেন অকারণেই উত্তেজনায় ভরে উঠছে।

একসময় বারান্দার রেলিংয়ে বসে থাকা ছায়া বিড়ালটা ডেকে উঠল, “মিঁয়াঁও…” হেমন্তি ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “ছায়া, তুইও বুঝতে পারছিস, আজ আমাদের ঘরে অতিথি আসবে?” বিড়ালটি মনের মতো পেছনের পায়ের ওপর বসে গা চাটতে চাটতে ঘুমোতে গেল।

হেমন্তি আজ ঘরদোর একটু গুছিয়ে রাখলেন। বুকশেলফের ধুলো মুছলেন। পুরনো অ্যালবামগুলো টেনে বের করলেন। পাড়ার পুজোর ছবি, অজিতের হাসিমাখা মুখের ছবি, অমিতের ছোটবেলার স্কুলের প্রথম দিনের ছবি। চেয়ে চেয়ে দেখলেন, চোখের কোণে জল জমল।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামল। পাড়ার গলিতে চেনা কাকুর মিষ্টির দোকান থেকে ভেসে এলো মিষ্টির গন্ধ। হেমন্তি একটু মিষ্টি আনাবেন ভেবেছিলেন সৌম্যের জন্য। ঠিক সেই সময় দূরের গলিতে ভেসে এলো পরিচিত এক কণ্ঠস্বর,
“হেমন্তি বৌদি?”

হেমন্তি চমকে উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন—এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি, গায়ের রং চাপা, মুখে মৃদু হাসি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ।

হেমন্তি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“সৌম্য?”

ভদ্রলোক মাথা হেঁট করে হাসলেন,
“হ্যাঁ বৌদি, অনেক দিন পরে আসা হলো। ভেবেছিলাম, দেখা হবে না আর।”

হেমন্তি যেন কয়েক মুহূর্ত কথা হারিয়ে ফেললেন। তারপর সরে দাঁড়িয়ে বললেন,
“এসো বাবা, এসো। অনেক বছর পর এলি, ভিতরে এসো।”

সৌম্য ঘরে ঢুকল। বসার ঘরটা আজ অচেনা মনে হলো হেমন্তির কাছে। কতদিন কারও পদচিহ্ন পড়েনি এই ঘরে! কুড়িয়ে পাওয়া সঙ্গ যেন নতুন রূপে ফিরল।

সৌম্য চারদিক দেখে নিল। চোখে যেন জল এসে গেল। বলল,
“সব ঠিক আছে বৌদি, ঠিক যেমন ছিল। শুধু তোমার এই একা থাকা দেখে মনটা খারাপ লাগছে।”

হেমন্তি এক গ্লাস জল আর চা দিয়ে বসলেন পাশে। দুজনের মুখে গল্পের ঢল নামল। সৌম্য বলতে শুরু করল তার জীবনের কথা। সে এখন কলকাতার কাছেই একটি স্কুলে শিক্ষকতা করে। স্ত্রী আর এক মেয়ে নিয়ে সংসার। অজিতবাবুর থেকে পাওয়া শিক্ষা আর আদর্শ এখনও মনের মধ্যে গেঁথে আছে।

হেমন্তি শুনলেন মুগ্ধ হয়ে। তাঁর মনে হলো, এই ছেলে তাঁর অমিত নয় ঠিকই, কিন্তু কোথায় যেন অনেকটা সেই ছেলের মতোই। কথার ফাঁকে ফাঁকে অজিতের কথা উঠল, পাড়ার পুরনো দিনের কথা উঠল।

সন্ধ্যে গড়িয়ে গেল। সৌম্য উঠে দাঁড়াল। বলল,
“বৌদি, আজ যেতে হবে। কিন্তু আমি আবার আসব। তুমি যদি অনুমতি দাও, আমার স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়েও একদিন আসতে চাই। তুমি তো তাদের আশীর্বাদ করবে, তাই না?”

হেমন্তি মৃদু হেসে বললেন,
“অবশ্যই বাবা। তুমি এলে ঘরটা যেন বেঁচে ওঠে।”

সৌম্য প্রণাম করল। হেমন্তি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেই স্পর্শে যেন নিজের ছেলেকে আশীর্বাদ করছেন। সৌম্য চলে যাওয়ার পর হেমন্তি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আকাশে তখন পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। সেই নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে পাড়া।

হেমন্তি মনে মনে বললেন,
“এ আলো, এ বাতাস আজ নতুন করে প্রাণ দিল আমাকে। হয়তো একাকিত্বের দেওয়ালগুলো টপকে আবার মানুষের কাছে ফিরতে পারব।”

ছায়া বিড়ালটা এসে পায়ের কাছে গা ঘেঁষে বসল। হেমন্তি তাকে কোলে তুললেন। চাঁদের আলোয় সেই দৃশ্য যেন এক অনন্ত আশার প্রতীক হয়ে রইল।

সৌম্যের চলে যাওয়ার পরের দিনগুলো যেন হেমন্তির জীবনে এক নতুন আলোর রেখা টেনে দিল। সকাল হোক বা সন্ধ্যা, ঘরে এক ধরনের আশার বাতাস বইতে লাগল। মনে হচ্ছিল, জীবনের যে সম্পর্কগুলো কালের নিয়মে ঝরে পড়েছিল, সেগুলো আবার অদৃশ্য হাতে বোনা নতুন বন্ধনে জড়িয়ে যাচ্ছে।

সেদিন সকালেই হেমন্তি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আর ভাবছিলেন—কতজন মানুষ জীবনের পথে হারিয়ে গিয়েছে! অমিত, যে একসময় মায়ের প্রতি একরাশ স্নেহ নিয়ে বড় হয়েছিল, সেই ছেলে আজ বিদেশের মাটিতে। কত চিঠি লিখেছেন হেমন্তি, কতদিন অপেক্ষা করেছেন ফোনের ঘণ্টাধ্বনির জন্য! অমিতের গলাটা কতদিন শোনেননি তিনি? সৌম্যের দেখা পাওয়ার পর যেন সেই ব্যথা আবার জেগে উঠেছে।

হেমন্তি সিদ্ধান্ত নিলেন—না, আর নয়। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে। তাই সকালে নাস্তা সেরে তিনি বসলেন চিঠি লিখতে। প্রথমেই লিখলেন অমিতকে—

“প্রিয় অমিত,
কেমন আছিস বাবা? তোর চিঠি বা ফোন অনেকদিন পাইনি। মায়ের মনটা খুব কষ্ট পায়। আমি এখনো অপেক্ষা করি, কখন তুই ডাকবি, কখন বলবি ‘মা, কেমন আছ?’ যদি পারিস, একটু খবর দে। মা তোকে খুব ভালোবাসে।
আশীর্বাদ রইল,
মা”

চিঠিটা লিখে তিনি পোস্ট করতে পাঠালেন। তারপর ভাবতে লাগলেন—আর কে কে ছিল যাদের হারিয়ে ফেলেছেন তিনি? অজিতের এককালের প্রিয় ছাত্র সুব্রত, যে একসময় মায়ের মতো স্নেহ পেত হেমন্তির কাছে; পাড়ার লতিদি, যিনি একসময় তাঁর সুখদুঃখের সঙ্গী ছিলেন; কিংবা সেই সরলা বউ, যাকে নানান বিপদের দিনে হেমন্তি আগলে রাখতেন।

সেদিন দুপুরের পরপরই হেমন্তি বেরিয়ে পড়লেন পাড়ার পথে। লাঠি হাতে, শাড়ির আঁচল কাঁধে জড়িয়ে। গলির মোড়ে পুরনো দোকানের দাদাটি এখনো আছে, যিনি অজিতবাবুর সময় থেকে তাকে চিনতেন। দোকানের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই সে হেসে বলল,
“হেমন্তি বৌদি? অনেকদিন পর তোমায় দেখছি এইভাবে রাস্তায়!”

হেমন্তি মৃদু হাসলেন।
“বলতো মধু, লতিদির খোঁজ জানিস? কোথায় থাকে এখন?”

মধু বলল,
“লতিদি তো গিয়ে উঠেছে বেহালায়, মেয়ের কাছে। আর সুব্রত? ও তো এখন বড় চাকরি করে, শোনা যায় মুম্বই থাকে।”

এই খবর পেয়ে হেমন্তির বুকের মধ্যে কোথায় যেন হালকা ব্যথা জেগে উঠল। কিন্তু তবু তিনি ভাবলেন—যাক, অন্তত খোঁজটা পেলেন।

বাড়ি ফিরে এসে আবার চিঠি লিখতে বসলেন তিনি। সুব্রতর জন্য একটা চিঠি লিখলেন, যেখানে শুধু লিখলেন—

“সুব্রত,
তুই কি মনে রাখিস সেই মানুষটিকে, যে তোকে একদিন গরম পায়েস খাইয়েছিল, পরম মমতায় তোকে দেখেছে বড় হতে? যদি পারিস, একবার খবর দিস।
হেমন্তি বৌদি”

এরপর লতিদির মেয়ের ঠিকানা জোগাড় করার চেষ্টা শুরু করলেন। পাড়ার পুরনো ফোন ডাইরিতে চোখ বোলালেন, পাড়ার দু-একজন চেনা মুখের সাহায্য নিলেন। ধীরে ধীরে যেন একটা মিশন হয়ে উঠল হেমন্তির এই প্রচেষ্টা—হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলিকে ফিরে পাওয়ার মিশন।

দিন যায়, রাত আসে। হেমন্তি এখন আর একা নয়। অন্তত তাঁর মনের মধ্যে এক জোয়ার এসেছে। প্রতীক্ষা যেন তাঁকে শক্তি যোগাচ্ছে। প্রতিটি চিঠি, প্রতিটি খোঁজ তাঁকে যেন জীবনের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত করছে।

একদিন বিকেলে পোস্টম্যান আবার এল। আজ সে দুটি চিঠি দিল। একটির খাম খুলে হেমন্তি পড়লেন—সুব্রতের চিঠি।

“হেমন্তি বৌদি,
তোমার চিঠি পেয়ে কত যে আনন্দ পেয়েছি, বলে বোঝাতে পারব না। ছোটবেলার সেই মায়ের মতো স্নেহের দিনগুলো এখনও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি আসব, সময় বের করে তোমার পায়ে প্রণাম করতে আসব।
স্নেহে,
সুব্রত”

আরেকটি চিঠি ছিল অমিতের। সংক্ষিপ্ত কিন্তু আবেগভরা—

“মা,
তোমার চিঠি পেয়ে খুব লজ্জা পেলাম। আমি যে এতদিন তোমার খবর নিইনি, তা সত্যিই অন্যায়। আমি ফোন করব খুব শিগগিরই। ভালো থেকো মা।
তোর ছেলে,
অমিত”

হেমন্তি চোখ মুছলেন। মনে মনে বললেন,
“দেখেছ অজিত, তুমিই তো বলেছিলে—ভালোবাসা কখনও হারায় না। সে একদিন না একদিন ফেরে।”

রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেমন্তি আকাশের দিকে তাকালেন। আকাশে অগণিত তারা জ্বলছে। তাঁর মনে হলো, আজ অজিতবাবু নিশ্চয়ই সেই তারার ভিড়ের মধ্যে বসে হাসছেন।

সেইদিন বিকেলে পাড়ায় যখন আলো-আঁধারি খেলা করছে, হেমন্তি দেবীর বাড়ির উঠোনে যেন এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা নেমে এলো। পানের পাতা, নিমগাছের পাতা, আর পুরনো কুয়োর ধারে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুলগুলো যেন চুপ করে সেই মুহূর্তের সাক্ষী থাকল।

পোস্টম্যানের নিয়ে আসা দুটি চিঠি যেন হেমন্তির জীবনে আবার আলোর মিছিল জ্বালিয়ে দিল। দিনের পর দিন যে নিঃসঙ্গতা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল, আজ তার দেওয়ালগুলো ভেঙে যাচ্ছে। অমিতের চিঠি পড়ে তাঁর বুকের মধ্যে চাপা কষ্টের জায়গায় আজ এক ধরনের উষ্ণতা জন্ম নিল। সুব্রতের চিঠি পড়ে মনে হলো—সেই ছোট্ট ছেলেটা যাকে তিনি একদিন হাত ধরে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন, সে আজও তাঁর কথা মনে রেখেছে!

রাতের বেলা বারান্দায় বসে হেমন্তি আকাশের দিকে চাইলেন। শহরের আলোর মিছিল আকাশের তারাদের ঢেকে রাখলেও, আজ তাঁর চোখে সেই তারাগুলো স্পষ্ট দেখা গেল। মনে হলো, প্রতিটি তারা অজিতবাবুর আশীর্বাদ হয়ে ঝিকমিক করছে।

পরদিন সকালে হেমন্তি ঘরদোর গুছিয়ে রাখলেন। আজ তাঁর মন বলছে—আজকেই অমিত ফোন করবে। সত্যিই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই টেলিফোনের ঘণ্টাধ্বনি বেজে উঠল। বহুদিন পর সেই আওয়াজ যেন তাঁর হৃদয়ে কাঁপন তুলল।

“হ্যালো, মা?” অমিতের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ফোনের ওপার থেকে।

হেমন্তির কন্ঠ বেদনার ভারে কম্পিত হলেও ভালোবাসার উষ্ণতায় ভরা,
“অমিত? তুই? কেমন আছিস বাবা?”

অমিত বলল,
“ভালো আছি মা। তুই কেমন আছিস? আমি তোকে খুব মিস করি। অনেকদিন পর ফোন করলাম, খুব ভুল হয়েছে আমার।”

হেমন্তি মৃদু কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
“তোর গলাটা শুনেই মনটা শান্ত হলো রে বাবা। তোকে ছাড়া এই বাড়িটা ফাঁকা ফাঁকা লাগত। তুই কবে আসবি?”

অমিত একটু থেমে বলল,
“মা, টিকিট কাটব। তিন মাস পর কাজের একটা সুযোগে দেশে আসব। তখন তোদের বাড়ি থাকব কিছুদিন।”

হেমন্তি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“তুই এলেই এই ঘরটা আবার প্রাণ পাবে।”

ফোন রেখে হেমন্তি চুপচাপ বসে রইলেন। তারপরে কী এক ভেবে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন। গলির মোড়ে গিয়ে পুরনো সেই ছোট্ট মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন। মনে মনে বললেন,
“ঠাকুর, তোরা আমাকে অনেক দিয়েছিস। শুধু এই শেষ সময়ে যেন আমার ছেলে আর প্রিয়জনদের আশীর্বাদ করতে পারি, সেটুকু দিস।”

কয়েকদিন পর এক শনিবারের বিকেলে সুব্রত এলো। সে এখন একজন বড় অফিসার, তবু সেই পুরনো দিনের মতোই নম্র আর সোজা-সরল। পায়ে প্রণাম করল হেমন্তির, আর বলল,
“বৌদি, তোমার আশীর্বাদ না থাকলে আমি আজ যেখানে পৌঁছেছি, তা হতো না। তোমার রান্না করা গরম পায়েস খেতে মন চায় আজও।”

হেমন্তি হেসে বললেন,
“আরে, তখন পায়েস রান্না করতাম তোদের খাইয়ে তৃপ্তি পেতে। তুই বস, আমি এবারো পায়েস করব। একবার মুখে তুলেই যাস।”

সুব্রতের চোখে জল এসে গেল। সে বলল,
“তুমি মায়ের মতোই ছিলে আমাদের কাছে।”

সেদিন বিকেলের সেই আড্ডা, সেই পায়েস খাওয়া, সেই গল্প—সবকিছুতে যেন জীবনের সব কষ্ট মুছে গিয়ে এক নতুন আনন্দের আলোর মিছিল নেমে এলো হেমন্তির উঠোনে। পাড়ার বাচ্চারা আবার খেলার ছলে এসে উঠোনে জড়ো হলো, ছায়া বিড়ালটি এসে কোলে ঘুমিয়ে পড়ল, আর বারান্দার কোণের সেই ত্রিপর্ণীর টবটাও যেন সেদিন আরও সবুজ হয়ে উঠল।

হেমন্তি ভেবে ভেবে বললেন,
“জীবন বড় অদ্ভুত। সব হারিয়ে ফেলেছি ভেবে যখন কষ্টে ভেঙে পড়েছিলাম, তখনই তো জীবন আবার নতুন করে সম্পর্কগুলো ফিরিয়ে দিল। মানুষের ভালোবাসা ফুরোয় না, শুধু সময়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকে।”

রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। হেমন্তি জানালার পাশে বসে চাঁদ দেখতে দেখতে ভাবলেন,
“অজিত, তুই তো বলেছিলি—একদিন মানুষের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ নিয়ে ঘর ভরে যাবে। আজ সত্যিই তাই হলো।”

সুব্রতের চলে যাওয়ার পর দিনের পর দিন হেমন্তি এক অদ্ভুত তৃপ্তি নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলেন। প্রতিটি সকাল যেন নতুন আশার আলো বয়ে আনত। ভোরের প্রথম রোদের মতো সম্পর্কগুলোর উষ্ণতা বাড়ির প্রতিটি কোণকে ভরে রাখছিল।

তবু, কোথায় যেন এক অপূর্ণতার সুর বাজত হেমন্তির মনে। অমিতের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে বটে, কিন্তু সেই মায়ের বুকের মধ্যে জমে থাকা অভিমান, সেই শূন্যতা মুছে যায়নি এখনো। ছেলেকে নিজের চোখে দেখার অপেক্ষা যেন দিন দিন আরও গভীর হতে লাগল।

সেই সময় একদিন চেয়ারে বসে হেমন্তি পুরনো চিঠির বাক্সটি বের করে আনলেন। অজিতবাবুর লেখা কিছু চিঠি, অমিতের ছোটবেলার আঁকা চিঠি, আর একগুচ্ছ ডাকটিকিট—সবই ছিল সেই বাক্সে। চিঠিগুলো একটার পর একটা পড়তে পড়তে তিনি যেন সময়ের নদীর স্রোতে ভেসে যেতে লাগলেন।

এমন সময় তাঁর মনে হলো, একখানা চিঠি তিনি লিখবেন অজিতবাবুকে। হ্যাঁ, অজিত যেখানেই থাকুক না কেন, তাঁর মনের ভাষা তো পৌঁছে যেতেই পারে।

তিনি কাগজ বের করে লিখতে শুরু করলেন—

“প্রিয় অজিত,
তুমি চলে যাওয়ার পর জীবনের প্রতিটি দিন কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছিল, তা আমি কাকে বলব? কিন্তু দেখো, তোমার আশীর্বাদে আজ সেই নিঃসঙ্গতার মেঘ সরছে। অমিত আবার যোগাযোগ করেছে, সুব্রত এসেছিল দেখা করতে। পায়েস খাইয়ে তৃপ্তি পেয়েছি। শুধু তুমিই নেই পাশে। তবু জানি, তুমি উপরে বসে সব দেখছ।
আজ আমার আর কিছু চাওয়ার নেই। শুধু চাই, যখন আমার ডাক আসবে, তখন যেন তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
হেমন্তি”

চিঠিটা শেষ করে চোখের জল মুছে তিনি জানালার ধারে বসে থাকলেন। দূরে গঙ্গার পাড় থেকে ভেসে আসছে সান্ধ্যআরতির ঘণ্টাধ্বনি। মনে হলো, সেই আওয়াজ অজিতবাবুর কাছেই পৌঁছে যাবে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। পূর্ণিমার আলোয় বাড়ির উঠোন ভেসে যাচ্ছে। হেমন্তি বারান্দায় বসে বসে ভাবছেন—জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসাব আজ যেন মিটে গেছে। তিনি ধীরে ধীরে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করে মনে মনে অজিতকে ডাকলেন—
“আমি প্রস্তুত অজিত। এবার তুমিই এসো।”

রাত গভীর হলো। পাড়ার কুকুরের ডাক, দূরের ট্রামের ঘণ্টা সব মিলিয়ে এক নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়ল। হেমন্তির ঘরের বাতি নিভে গেল। সেই রাতেই যেন অজিতবাবুর স্বপ্নের হাত ধরে তিনি চিরনিদ্রায় পাড়ি দিলেন।

পরদিন সকালে পাড়ার লোকজন এসে দেখল, হেমন্তির মুখে এক অপার্থিব শান্তির ছাপ। জানালার পাশের টেবিলে শেষ চিঠিখানা খোলা আছে, আর সেই চিঠির উপর পড়ে আছে একফোঁটা শুকনো অশ্রুজল।

পাড়ার মানুষজন সেই সকালে হেমন্তির শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক কিছুই বুঝে গিয়েছিল। যে মানুষটি সারাজীবন সম্পর্ককে আগলে রেখেছিলেন, ভালোবাসার সুতায় জীবন বুনেছিলেন, তিনি এবার তাঁর অজিতের কাছে চলে গেছেন।

হেমন্তির ঘরজুড়ে তখন শুধুই স্মৃতি। টেবিলের ওপর খোলা শেষ চিঠিটা যেন সেই স্মৃতির নিদর্শন হয়ে রয়ে গেছে। সেই চিঠিতে লেখা প্রতিটি অক্ষর যেন বয়ে আনছে জীবনের এক অমোঘ সত্য—যে ভালোবাসা মন থেকে জন্ম নেয়, সে কখনও হারায় না।

পাড়ার লোকেরা মিলে শেষকৃত্যের আয়োজন করল। অনেকে এসে বলল,
“হেমন্তি বৌদি ছিলেন মা-ঠাকুরমার মতো। তাঁর আশীর্বাদে কত ঘর আলো পেয়েছে!”

সুব্রত খবর পেয়ে ছুটে এলো। সে এসে হেমন্তির পায়ে প্রণাম করে চুপ করে বসে থাকল অনেকক্ষণ। তার চোখ বেয়ে নেমে এল অশ্রু।
“বৌদি, শেষবারের মতো তোমার হাতে একবেলা পায়েস খাওয়া হলো না।”

অমিতও দেশে ফিরে এল। মায়ের ফেলে যাওয়া চিঠিগুলো পড়ে সে বোঝে, কত বড় ভুল হয়েছিল তার। মায়ের শূন্য ঘর আর সেই চিঠির বাক্স সে বুকের কাছে চেপে ধরল।

অমিত সিদ্ধান্ত নিল—এবার সে এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। মায়ের স্মৃতিকে আগলে, এই পৈতৃক বাড়িতেই সে নতুন জীবন গড়বে। সুব্রত, পাড়ার মানুষ, পুরনো চেনা মুখেরা মিলে সেই বাড়িতে আবার প্রাণ ফিরিয়ে আনল।

বছর ঘুরে গেল। সেই বাড়ির উঠোনে আবার শিউলি ফুল ঝরে পড়ে, বারান্দায় শিউলির ঘ্রাণ মিশে থাকে বাতাসে। অমিতের ছোট মেয়েটি দাদির পুরনো গল্প শোনে রাতে ঘুমোবার আগে।

আর হেমন্তি? তিনি কোথাও হারিয়ে যাননি। বাড়ির প্রতিটি কোণায় তাঁর উপস্থিতি যেন টের পাওয়া যায়। কখনও সকালবেলার হালকা বাতাসে, কখনও বিকেলের আলো-আঁধারিতে, কখনও বা পূর্ণিমার চাঁদের হাসিতে।

আর সেই শেষ চিঠি? অমিত তা সুন্দর করে বাঁধিয়ে ঘরের এক কোণে রেখে দিয়েছে। যে চিঠি মায়ের শেষ ভাষা, সেই চিঠিই আজও পরিবারের মানুষের হৃদয়ে এক ভালোবাসার আলো হয়ে জ্বলছে।

1000027153.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *