Bangla - রহস্য গল্প

ছায়ার নীচে গ্রীষ্ম

Spread the love

হেমন্ত সরকার


পর্ব ১

রিয়ান জানালার পাশে বসে ট্রেনের ধুকধুক শব্দ শুনছিল। গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে মাত্র দু’দিন, আর তাতেই বাবা-মায়ের পরিকল্পনা—তাকে আর তার কাজিন উজ্জ্বলকে গ্রামের বাড়ি পাঠানো হবে ঠাকুরদার কাছে। সে যেন এক আলাদা জগৎ—চাঁপারপুকুর। শহুরে শব্দহীনতা আর মোবাইলের ‘নেট নেই’ বোঝা এই গ্রামেরই অন্য নাম হতে পারে।

“এই গ্রামে কি সত্যিই রাতে জোনাকি দেখা যায়?” পাশের সিটে বসে থাকা উজ্জ্বল হঠাৎ প্রশ্ন করল।

রিয়ান চোখ সরিয়ে বলল, “দাদু বলেছিল, পুরো বাঁশঝাড়ে টিমটিমে আলোয় ভরে যায়। তবে এখন কি আর আগের মতো জিনিস থাকে?”

উজ্জ্বল একটু ভাবল, তারপর হেসে বলল, “আমি কিন্তু সন্ধে নামলেই দেখব। সত্যিই যদি জোনাকি থাকে, তো ফেসবুকে একটা রিল হবেই!”

রিয়ান হাসল না, কেবল জানালার বাইরে তাকিয়ে রইল। সে জানে, এই গ্রামে এসে তারা যেমন প্রকৃতিকে ছুঁতে পারবে, তেমনি ছুঁয়ে যাবে একটা অচেনা ইতিহাস, একটা গল্প—যা হয়ত তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

ট্রেন যখন চাঁপারপুকুর স্টেশনে থামে, তখন দুপুর গড়িয়ে পড়েছে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম প্রায় খালি, মাথার ওপর ঝাঁঝালো রোদ। কাঁপতে থাকা বাতাসে হঠাৎ থেমে থাকা সময়ের মতো একটা অনুভূতি।

স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন রিয়ানদের ঠাকুরদা—লাঠিতে ভর দিয়ে, পরনে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, চোখে শান্ত গভীরতা। তার পেছনে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট ঘোড়ার গাড়ি। ঠিক যেন পুরনো দিনের ছবি।

“এসে পড়লে! বেশ বড় হয়ে গেছিস রে তোরা!”—ঠাকুরদা বললেন হাসিমুখে।

“আপনিও তো একটুও বদলাননি,” উজ্জ্বল বলল চমৎকৃত হয়ে। “কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন গরমে এখানে ভালো লাগে। এটা গরম নয়, একেবারে ঝলসে যাওয়ার মতো!”

ঠাকুরদা হেসে বললেন, “এই গরমেই কিন্তু প্রকৃতি তার সত্যিকারের রূপ দেয়। বিকেলে মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে দেখিস, কেমন বাতাস বয়।”

তাদের বাড়ির পথটা প্রায় আধঘণ্টার। ছোট্ট পাথরের রাস্তা, দু’পাশে শস্যক্ষেত, দূরে নারকেলগাছ আর আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে থাকা বাঁশঝাড়। ঘোড়ার গাড়ির চলতে চলতে মাঝে মাঝে ছোট্ট ঝাঁকি দেয়, আর উজ্জ্বল বলে ওঠে, “আহা, আবার পিছনটা ধাক্কা খেলাম!”

রিয়ান রাস্তার বাঁদিকে একটা লাল ইটের বাড়ি দেখে চমকে উঠে বলল, “ওইটা কি ভূতের বাড়ি?”

ঠাকুরদা একবার তাকিয়ে বললেন, “ওটা রায় বাহাদুর শশীচরণর বাড়ি ছিল। এক সময় খুব জমজমাট ছিল, কিন্তু অনেক বছর আগে ওনার মেয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যায়। তারপর থেকে কেউ ও বাড়িতে থাকেনি। কেউ ঢোকেও না।”

উজ্জ্বল ফিসফিসিয়ে বলল, “আমি তো কালই ঢুকে পড়ব দেখবি!”

“ধারেকাছে যাবি না,” ঠাকুরদা হঠাৎ কড়া স্বরে বললেন। “ও বাড়ির ভেতরে এখনও সন্ধ্যার পর আলো জ্বলে, অথচ কেউ থাকে না।”

এই কথায় একটা শীতল স্রোত যেন গায়ে বয়ে গেল দুই কিশোরের। তারা কিছু না বলেই গাড়ির বাকি পথ পেরোল।

বাড়িতে পৌঁছে তারা দেখল—দোতলা লাল ইটের পুরোনো বাড়ি, ছাদে ধুতি শুকোচ্ছে, উঠোনে রাখা কুয়া, আর একপাশে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট কাঠের ঘর। সেই ঘরে থাকেন চঞ্চলা পিসিমা—এক রহস্যময়ী মহিলা, যিনি নাকি কুয়োর পাশে বসে মাঝেমাঝে নিজের সঙ্গে কথা বলেন।

রিয়ান আর উজ্জ্বল তাদের ঘরে ব্যাগ রেখে ছুটে বেড়িয়ে পড়ল উঠোনে। কাঠের মেঝে আর পাখির ডাক—সবকিছুই যেন নতুন, অথচ পুরনো। সন্ধের সময় ঠাকুরদা ডাকলেন, “চলো, আজ তোমাদের জন্য শালপাতায় ভাত, আলুভাজা, আর ঘি দেওয়া ডাল।”

রাতের খাবার শেষ করে বারান্দায় বসে দুই কিশোর ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনছিল।

“এই বাড়ির পেছনে একটা শিবমন্দির আছে,” ঠাকুরদা বললেন। “তুমি যখন ছোট ছিলি, একবার সেখান থেকে উঠে এসেছিলি ছুটে, বলেছিলি—‘মা, ওখানে আলো জ্বলছে।’ তখন ভাবতাম, হয়ত তোর ভুল দেখার ফল। কিন্তু পরের বছর থেকে কেউ আর সন্ধের পর মন্দিরে যেত না।”

উজ্জ্বল বলল, “তাহলে তো আমাদের কাল ওদিকেই যাওয়া উচিত। ঠিক রহস্যময় অ্যাডভেঞ্চার হবে!”

ঠাকুরদা হেসে বললেন, “সাবধানে যাবে। কিছু জায়গা এমনই হয়—যেখানে ইতিহাস নিজেই লুকিয়ে থাকে।”

রাতে শোবার সময় রিয়ান জানালা দিয়ে দেখল—বাঁশঝাড়ের দিকটায় একটা ধোঁয়াটে আলো নড়ছে। হয়ত বাতাসে পাতার ছায়া, কিংবা… হয়ত কিছু নয়।

কিন্তু তার বুকের ভিতর থেকে একটা আওয়াজ আসছিল—এই ছুটি অন্যরকম হবে। শুধু খাওয়া-ঘুম নয়, এই গ্রামে কিছু আছে, যা তাদের ডেকে আনছে। ছায়ার ভিতর, আলো-আঁধারির মাঝে লুকিয়ে থাকা কোনও সত্য, যা দুই কিশোরের জন্য অপেক্ষা করছে।

আর তখনই এক ঝাঁক জোনাকি উঠে এল বাঁশঝাড়ের মাথা থেকে।

রিয়ান চোখ মেলে তাকিয়ে থাকল—হয়ত এটা শুধুই প্রকৃতি… অথবা, হয়ত কোনও বার্তা।

পর্ব ২

সকালবেলা উঠেই রিয়ান বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পাখিদের কিচিরমিচির, ঠাণ্ডা বাতাস আর সামনের আমগাছে দোল খাওয়া রোদ—সবকিছু যেন শান্তির চাদরে মোড়া। তবে তার ভিতরটা অদ্ভুত রকম ব্যস্ত। কাল রাতে যে আলোটা দেখেছিল বাঁশঝাড়ের দিক থেকে, সেটা কি সত্যিই কল্পনা ছিল?

উজ্জ্বল এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “রাতে তো দেখি জোনাকি দেখে পুরো কবি হয়ে গিয়েছিলি।”

রিয়ান একটু হেসে বলল, “তুই দেখিসনি কিন্তু, আলোটা স্থির ছিল না, নড়ছিল।”

“হয়ত বাতাসে পাতার প্রতিফলন, না হয় মোষের গলায় ঘণ্টা—সবুজ আলোতেই তো ঝিলমিল করে।”

“না, ওটা অন্যরকম ছিল। আর দাদু তো বলল মন্দিরে কেউ যায় না। তাহলে আলো আসছে কোথা থেকে?”

“তোর কথায় তো দেখি গোয়েন্দা গোগোলের গন্ধ পাচ্ছি!”—উজ্জ্বল হাসল।

সকালের নাশতা—মুড়ি, কলা আর গুড় খেতে খেতে তারা ঠিক করল বিকেলেই মন্দিরে যাওয়া হবে। ঠাকুরদার অনুমতি চাওয়ার দরকার হবে না, কারণ ‘অনুমতি’ মানেই অনেক প্রশ্ন, অনেক ভয় দেখানো, আর তারপরে একরাশ নিষেধ।

বিকেল হতেই তারা বেরিয়ে পড়ল। হাতে একটা ছোট টর্চ আর রিয়ান ব্যাগে নিল তার বাবার পুরোনো ডায়েরি, যে ডায়েরিতে আঁকা ছিল চাঁপারপুকুরের মানচিত্র। সেই ডায়েরির এক কোণায় লেখা ছিল—
“মন্দিরের পেছনে একটা ধাতব গেট, সূর্যাস্তের ঠিক আগে সেখানে কিছু দেখা যায়।”

রাস্তা ধরে যেতে যেতে তারা লক্ষ্য করল, গ্রামের মানুষ তাদের একটু কৌতুহলী চোখে দেখছে। এক বয়স্ক লোক বলল, “বাঁশঝাড়ের ওদিকেই যাচ্ছ, বাবু? সন্ধ্যে হওয়ার আগেই ফিরে এসো।”

রিয়ান নম্রভাবে বলল, “হ্যাঁ কাকু, ঘুরে আসছি।” উজ্জ্বল পেছন ফিরে মুখ টিপে হেসে বলল, “আমরা ঘুরতেই যাচ্ছি, ওরা ভাবছে ভয় পেয়ে পালিয়ে আসব!”

মন্দিরটা প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে, বাঁশঝাড় পেরিয়ে। একসময় নিশ্চয়ই জমজমাট ছিল, এখন ভাঙাচোরা, পেছনের পাঁচিল ভেঙে পড়েছে, আর ভেতরে ছোট ছোট ঝোপ। বিশাল গেটটা তালা মারা, তবে বামদিকের ফাঁক দিয়ে ঢোকা যায়।

ভিতরে ঢুকেই যেন সময় থেমে গেছে। সাদা পাথরের শিবলিঙ্গে এখনো কিছু সিঁদুর লেগে আছে। মাটিতে গরু-বাছুরের পায়ের ছাপ। আর ঠিক পেছনে, বাঁশের ছায়ায় ঢাকা একটা ছোট ইটের ঘর, যার দরজাটা অর্ধেক ভাঙা।

উজ্জ্বল বলল, “দেখ, ওই ঘরটার গায়ে ধাতব কিছু ঝকঝক করছে!”

রিয়ান টর্চ বের করে আলো ফেলল—একটা আয়তাকৃতির লোহার দরজা, মাটির সমান্তরালভাবে সেট করা। সেটা কোনোরকমে ঢাকা আছে শুকনো পাতা, ধুলো আর ঘাসে। সেই দরজার একপাশে ছোট্ট একটা গর্ত, যেন চাবি বসানোর মতো।

রিয়ান বলল, “এইটা কি সেই ‘ধাতব গেট’ না? ডায়েরিতে যে কথা লেখা ছিল…”

হঠাৎ তারা পেছনে আওয়াজ পেল—‘টুং টাং’। যেন ধাতব কিছু পড়ে গেল। উজ্জ্বল চমকে উঠে বলল, “কে? কে ওখানে?”

কিন্তু চারপাশে কেউ নেই। শুধু বাতাসে নড়ছে বাঁশের মাথা, আর একটা অদ্ভুত গন্ধ—মাটির সঙ্গে মিশে থাকা ধূপের গন্ধ। রিয়ান নিঃশব্দে বলল, “চল, ওই দরজাটা পরিষ্কার করি।”

দু’জনে মিলে পাতাগুলো সরাতে লাগল। ধীরে ধীরে দেখা গেল, দরজাটার মাঝে একটা নিখুঁত বৃত্তাকৃতি খাঁজ। যেন কিছু বসালে খুলে যাবে। কিন্তু কী বসানো হবে?

“তোর বাবার ডায়েরিতে কিছু লেখা আছে?”

রিয়ান ডায়েরির শেষ পাতায় একবার চোখ বুলিয়ে পড়ল:
“মন্দিরের দেবতা স্বয়ং রক্ষা করেন গোপন কক্ষের দ্বার। তাঁর চোখে যে চায়, সে পথ পায়।”

উজ্জ্বল কাঁধে হাত রেখে বলল, “তাহলে কি শিবলিঙ্গের মধ্যেই আছে কোনো সূত্র?”

দু’জনে ফিরে গেল মূল মন্দিরে। পাথরের শিবলিঙ্গটা হালকা করে নড়ানো যায়। অনেক চেষ্টার পর তারা লক্ষ করল, শিবলিঙ্গের নিচে একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স, যা কাদা মাটিতে চাপা ছিল।

বাক্স খুলতেই বেরিয়ে এল একটা তামার চাকতি, যার মাঝে খোদাই করা একটি ত্রিনয়ন—ত্রিশূলের চিহ্ন।

রিয়ান কাঁপা হাতে চাকতিটা তুলে বলল, “এটাই আমাদের চাবি।”

তারা আবার গেল সেই লোহার দরজার কাছে। তামার চাকতিটা বসাল খাঁজে। একটা ক্লিক শব্দ—আর যেন মাটি কেঁপে উঠল। ধীরে ধীরে দরজাটা এক পাশে সরে গেল। নিচে অন্ধকার নামছে, সিঁড়ি ঘোরানো নেমে গেছে অনেকটা গভীরে।

রিয়ান ফিসফিস করে বলল, “তুই ভয় পাচ্ছিস?”

উজ্জ্বল বলল, “না, তবে টর্চটা একটু ভালো করে ধর!”

দু’জনে নামতে শুরু করল। নিচে নামার সঙ্গে সঙ্গে বাতাস ঠাণ্ডা হয়ে এল। দেয়ালে ছোপ ছোপ জল, ছাঁদ থেকে গুঁড়ো মাটি ঝরছে। কিন্তু হঠাৎ নিচে এক ঘরে আলো! যেন কেউ আগেই নিচে নামা শেষ করেছে।

রিয়ান থামল, টর্চ নিভিয়ে দিল। কানে এল কারো শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, ভারী, ক্লান্ত।

উজ্জ্বল কাঁপা গলায় বলল, “ওখানে কেউ আছে।”

রিয়ান বলল, “হ্যাঁ, এবং আমরা তার খুব কাছে চলে এসেছি।”

পর্ব ৩

সিঁড়ির শেষ ধাপটা মাটির খুব কাছাকাছি, এতটাই নিচে যে টর্চের আলোও পুরো ঘরটা দেখাতে পারছিল না। রিয়ান আর উজ্জ্বল দুজনেই নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে ছিল। উপরের পৃথিবী যেন অনেক দূরে, আর নিচের এই গুহার মতো ঘরে যেন সময় থমকে আছে।

একটা কটকটে ধূপের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। দেয়ালের গায়ে হাত দিলেই ঠাণ্ডা ছোঁয়া। রিয়ান ফিসফিসিয়ে বলল, “টর্চ নিভিয়ে দে। আগে দেখি আলোটা কোথা থেকে আসছে।”

উজ্জ্বল এক মুহূর্ত দ্বিধা করল, তারপর টর্চ নিভিয়ে দিল। চোখ অন্ধকারে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু হালকা একটা হলদে আলো দোল খাচ্ছিল সামনের কোনে। তারা খুব আস্তে এগিয়ে গেল।

আলোটা আসছিল একটা লণ্ঠন থেকে, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল এক বৃদ্ধ—চুল-দাড়ি একসাথে মিশে গেছে, গায়ে মলিন গেরুয়া কাপড়, চোখ দুটো অবিশ্বাস্যভাবে টকটকে লাল। তিনি হাঁ করে চেয়ে রইলেন দুজনের দিকে, যেন জানতেন কেউ আসবে, কিন্তু ভাবেননি এত তাড়াতাড়ি।

“তোমরা কারা?” গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন এল।

রিয়ান আর উজ্জ্বল একে অপরের দিকে তাকাল। তারপর রিয়ান জবাব দিল, “আমরা… রিয়ান আর উজ্জ্বল। গ্রামে এসেছি ছুটিতে। মন্দিরের পাশে কিছু একটা দেখেছিলাম… আমরা জানতে চেয়েছিলাম এটা কী জায়গা।”

বৃদ্ধ মানুষটা একটুও অবাক হল না। বরং আস্তে আস্তে বলল, “সবাই ভাবে, নিচে শুধু মাটি আর নীরবতা। কিন্তু এর নিচে থাকে ইতিহাস, আর ইতিহাসের নিচে—গোপন সত্য।”

উজ্জ্বল একটু জোর দিয়ে বলল, “আপনি কে? এখানে থাকেন?”

“আমার নাম মদন,” তিনি বললেন, “এই মন্দিরের শেষ সেবায়েত ছিলাম আমি। মন্দির যখন ধ্বংস হতে শুরু করল, আমি তখনই বুঝেছিলাম, কিছু একটা শেষ হয়নি—কিছু একটা লুকিয়ে আছে এই মাটির নিচে।”

রিয়ান দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করল, “কী লুকিয়ে আছে এখানে?”

মদনের চোখে এক ঝলক আগুন জ্বলে উঠল। “তোমরা কি জানো, রায় বাহাদুর শশীচরণ একসময় কী করেছিলেন এই গ্রামে?”

উজ্জ্বল ধীরে মাথা নাড়ল।

“তিনি ছিলেন ধর্মবিশ্বাসী, কিন্তু গোপনে খুঁজতেন এমন এক বস্তু, যা মানুষকে অমর করতে পারে। অনেক সাধনার পরে তিনি খুঁজে পান একটি প্রাচীন তান্ত্রিক মণি—‘শরীরেশ্বর’। সেটা মন্দিরের গর্ভগৃহে স্থাপন করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল, মণিটা কেবল শক্তি নয়, সর্বনাশও ডেকে আনতে পারে। তার মেয়ে, ললিতা, মণির স্পর্শে… হারিয়ে গিয়েছিল।”

রিয়ান চোখ বড় করে বলল, “হারিয়ে গিয়েছিল মানে?”

“একদিন সন্ধ্যাবেলা সে ঘরে ঢুকেছিল একা। তারপর দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আর কোনোদিন কেউ তাকে খুঁজে পায়নি। গুজব ছড়িয়ে পড়ে—মেয়েটা মণির অভিশাপে অদৃশ্য হয়েছে।”

উজ্জ্বল ফিসফিস করে বলল, “তাহলে মণিটা এখনও এখানে কোথাও আছে?”

মদন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। এবং সেটা রক্ষা করাই আমার কাজ। কারণ কেউ যদি ভুল করে ওটার ব্যবহার করে, তাহলে এই গ্রাম তো নয়, পুরো অঞ্চল ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু…”

সে থেমে গেল।

“কিন্তু কী?”—রিয়ান জিজ্ঞেস করল।

“কিছুদিন ধরে আমি টের পাচ্ছি কেউ ওটার গন্ধ পেয়েছে। বাইরে থেকে কেউ এসেছে। হয়ত গ্রামেই আছে এখন। ওরা জানে, মণি আছে। আর ওরা এটা চাইবে, কোনও মূল্যেই হোক না কেন।”

এক অজানা আতঙ্কে ভরে গেল দুই কিশোরের বুক। উজ্জ্বল বলল, “তাহলে আপনি একা এখানে কীভাবে এতদিন ধরে রক্ষা করে চলেছেন?”

মদন হেসে বলল, “আমি একা নই। মন্দিরের আত্মা এখনো জেগে আছে। আর এই ঘরের দেয়ালে যেসব চিহ্ন দেখছো, ওরা সবাই পাহারা দেয়। কিন্তু সময় বদলে যাচ্ছে। পুরোনো চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে চলেছে।”

এতক্ষণ নীরব থেকে রিয়ান সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনার সাহায্য দরকার?”

মদনের চোখে জল চিকচিক করল, “হ্যাঁ। কারণ তোমরা যারা অজ্ঞানে এসেছো, তারাই হয়ত এই পথের নতুন রক্ষক। তবে আগে তোমাদের পরীক্ষা দিতে হবে।”

“কেমন পরীক্ষা?”—উজ্জ্বল গলা কাঁপিয়ে বলল।

মদন একটা ইশারা করল। মাটির এক কোনা থেকে সরে গেল একটা পাথরের ঢাকনা। নিচে নামার আরেকটা সিঁড়ি, যা আরও গাঢ় অন্ধকারে চলে যায়।

“এই সিঁড়ির নিচে আছে প্রথম কক্ষ—যেখানে সময় থেমে আছে। সেখানে ঢুকলে বুঝবে তুমি সত্যিই প্রস্তুত কি না।”

দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তারপর রিয়ান বলল, “আমরা যাব। কিন্তু এক শর্তে—আপনি আমাদের সব জানাবেন। পুরোটা। আমরা যদি নামি, তাহলে চোখ বন্ধ করে নয়।”

মদন মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। তবে একবার নামলে, তোমরা আর আগের মতো থাকবে না।”

রিয়ান উজ্জ্বলর হাত ধরল। দুজন একসঙ্গে এগিয়ে গেল সেই নতুন সিঁড়ির দিকে।

উপরে সূর্য ডুবে গেছে। বাঁশঝাড়ে আবার আলো জ্বলছে।

আর নিচে? নিচে শুরু হতে চলেছে এক অজানা যাত্রা, যেখানে শুধু রহস্য নয়, লুকিয়ে আছে ইতিহাস, রক্ষা, আর হয়ত… আত্মদান।

পর্ব ৪

সিঁড়িগুলো সরু, ভেজা, আর প্রতিটা ধাপে যেন একটা অজানা ইতিহাস জমে আছে। মদন কাকু এক হাতে লণ্ঠন ধরে সামনে এগোচ্ছেন, পেছনে রিয়ান আর উজ্জ্বল নিঃশব্দে হাঁটছে। ছাদের ওপর থেকে জলের ফোঁটা টপ টপ করে পড়ে যাচ্ছে, আর বাতাসে একটা কেমন অদ্ভুত গন্ধ—ধূপ, ধুলো আর পুরোনো মাটির গন্ধ মিশে।

রিয়ান ফিসফিসিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস তো?”

উজ্জ্বল মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, তবে এই জায়গাটা ভয়ানক নির্জন… মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে পুরো পৃথিবীতে আমরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই।”

হঠাৎই মদন কাকু থেমে গেলেন। সামনে একটা গোল ঘর, যার চারদিকে দেওয়ালে খোদাই করা অক্ষর—সংস্কৃত, পালি আর এমন কিছু যা দুজনে কোনোদিন দেখেনি। ঘরের মাঝে একটা বেদি, আর তার ওপরে একটা পাথরের পাত্র, যাতে রাখা তামার পাতে মোড়া কিছু একটা।

“এই ঘরটা কি সেই প্রথম কক্ষ?” রিয়ান জিজ্ঞেস করল।

মদন মাথা নাড়লেন। “হ্যাঁ। এই ঘর সময়কে ধরে রাখে। এই পাত্রের ভেতরে আছে রায় বাহাদুরের সেই গবেষণার শেষ স্মৃতি।”

“মানে?” উজ্জ্বল কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

মদন চুপ করে পাত্রটা খুললেন। ভেতর থেকে বেরোল একটা পুরোনো নীলচে রঙের খাতা, পাতাগুলো ভিজে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার মধ্যেই ঝাপসা অক্ষরে লেখা আছে—‘প্রবেশের আগে চিন্তা করো, কারণ সত্য জানার মূল্য চাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি।’

“এটা ওনার নিজের হাতে লেখা খাতা?” রিয়ান চোখ বড় করে তাকিয়ে বলল।

“হ্যাঁ,” মদন উত্তর দিলেন। “এই খাতায় তিনি লিখে গেছেন কীভাবে সেই মণি তিনি পেলেন, কীভাবে সেটাকে প্রতিষ্ঠা করলেন মন্দিরের গর্ভগৃহে, আর তারপর কীভাবে তার জীবনের সবকিছু বদলে গেল। এই খাতা শুধু ইতিহাস নয়, সতর্কবাণী।”

উজ্জ্বল বলল, “আপনি এই সব জানেন, এত বছর ধরে পাহারা দিচ্ছেন, কিন্তু কেউ কখনো জানতে চায়নি?”

মদন এক নিঃশ্বাসে বললেন, “অনেকেই চেয়েছে, কিন্তু কেউ ধৈর্য রাখেনি। কেউ বিশ্বাস করেনি যে কিছু জিনিস শুধু জানার জন্য নয়, বাঁচার জন্যও ভয় পাওয়ার মতো। তোমরা জানো, রায় বাহাদুর নিজের মেয়েকে হারিয়েছিলেন এই মণির হাতেই?”

রিয়ান ধীরে মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আপনি বলেছিলেন। কিন্তু কীভাবে… সে তো শুধু একটা পাথর?”

“সেটাই সমস্যা,” মদন বললেন। “এই মণি কোনো সাধারণ পাথর নয়। তান্ত্রিক শক্তির দ্বারা সিদ্ধ এই বস্তু মানুষের মনে এমন আকর্ষণ জাগায়, যা সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। ললিতা, মানে রায় বাহাদুরের মেয়ে, এক সন্ধ্যায় গিয়েছিল মন্দিরে। মণিটা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়ে। আর তারপর… সে হারিয়ে যায়। কেউ দেখেনি সে বেরিয়ে এসেছে। গর্ভগৃহের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর তার পর থেকে সেই দরজা আজও কেউ খোলেনি।”

উজ্জ্বল অবাক হয়ে বলল, “তাহলে আপনি গিয়েছেন ওখানে?”

“না,” মদনের চোখে বিষাদ ভেসে উঠল। “আমি শুধু রক্ষা করি, প্রবেশ করি না। কারণ আমি জানি, ওটা কেবল আকর্ষণ করে না, ওটা পরীক্ষা নেয়। তুমি নিজেকে যতই শক্তিশালী ভাবো, ও তোমাকে ভেঙে ফেলবে।”

রিয়ান বলল, “তাহলে আমাদের পরীক্ষাটা কী?”

মদন মৃদু হেসে বললেন, “এই ঘরের ভিতরে বসে তোমাদের খাতা পড়তে হবে। প্রতিটি লাইন বুঝে নিতে হবে। আর সেই খাতার ভিতরে লেখা শেষ তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। যদি উত্তরগুলো সত্য হয়—তোমাদের মধ্যে ‘আলো’ জাগবে, আর তোমরা পরবর্তী পথে পা রাখতে পারবে। যদি না পারো, তবে মনে রাখবে, ফিরে যাওয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে না, কিন্তু নিজের ভয় নিয়ে ফিরতে হবে।”

উজ্জ্বল একটু কাঁপা গলায় বলল, “আপনি কি নিশ্চিত যে আমরা পারব?”

মদন চুপ করে বললেন, “না। কিন্তু এই পথ কাউকে নিশ্চিত করে দেয় না। এই পথ চায় শুধুই সাহস আর সততা।”

দুজন একসঙ্গে মাথা নাড়ল।

মদন খাতা এগিয়ে দিলেন রিয়ানের হাতে। “শুরু করো। সময় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এই ঘরে সেটা বোঝা যায় না।”

রিয়ান প্রথম পাতাটা খুলল। তাতে লেখা—
“আমি শশীচরণ রায়, এই খাতায় আমার সেই যাত্রার কথা লিখছি, যা এক বিশ্বাসী মানুষকে রূপান্তরিত করেছিল এক অভিশপ্ত পথিক হয়ে।”

পাশে বসে উজ্জ্বল বলল, “লিখেছে—‘আমি যা খুঁজেছি, তা ছিল না শুধুমাত্র শক্তি, ছিল নিজের মৃত্যু দেখার আগ্রহ।’ এই মানুষটা আসলে কী চাইছিল?”

রিয়ান ধীরে বলল, “আমরা সবাই চিরকাল বাঁচতে চাই, তাই না? কেউ মৃত্যুকে মেনে নিতে পারে না। হয়ত তিনিও পারেননি।”

দু’জনে ধীরে ধীরে পড়তে লাগল। সময় যেন থেমে আছে। ঘরের দেয়াল থেকে ঝরে পড়ছে শীতলতা, আর মাথার ওপর ঘোরাফেরা করছে অনিশ্চয়তা।

অবশেষে তারা পৌঁছাল সেই তিনটি প্রশ্নে—

১. তুমি কি জানো, তুমি কে?
২. তুমি যদি সব জেনে যাও, তবে তুমি কি মাফ করতে পারবে নিজেকে?
৩. তুমি কি সত্যি চাইছো জেনে যেতে, না শুধু কৌতূহল তাড়াচ্ছে তোমায়?

দুজনের মুখে কোনো শব্দ নেই। কিন্তু চোখে ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে সেই আলো, যা হয়ত সত্যিকারের সাহস।

মদন পেছন থেকে বললেন, “এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর মনে মনে দাও। দরজা নিজের পথ দেখাবে।”

আর তখনই, ঘরের একপাশে দেওয়াল ধীরে ধীরে ফাঁটতে শুরু করল।

পর্ব ৫

ঘরের ডানদিকের দেয়ালটা ধীরে ধীরে ফাঁটতে শুরু করল। প্রথমে একটা সূক্ষ্ম রেখা, তারপর যেন মাটি নিজে আলগা হয়ে ভেঙে পড়ল একপাশে। সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখা গেল—আরও একটা ঘর। ঘর নয়, যেন কোনো গোপন মন্দিরকক্ষ, যেখানে কোনো আলো নেই, অথচ যেন আলো ছড়িয়ে আছে দেয়ালের প্রতিটি চিত্রে।

রিয়ান আর উজ্জ্বল একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। মদন কাকু পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন, “এবার থেকে যা দেখবে, সেটা শুধু চোখে দেখার নয়। অনুভব করার। কারণ এ ঘরে ঢুকে কেউ ফিরে আসেনি আগের মতো।”

ঘরে পা রাখতেই যেন একটা ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে ছুঁয়ে গেল। অদ্ভুতভাবে শান্ত, অথচ এক চিমটি উদ্বেগময়। দেয়ালের গায়ে খোদাই করা চিত্র: একজন পুরুষ মাটির নিচে কিছু একটা খনন করছে, একজন নারী চোখে কাপড় বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির সামনে, আর আরেকটা দৃশ্যে আগুনের মধ্যে এক বৃদ্ধ বসে আছে নিঃশব্দে।

“এই ছবিগুলোর মানে কী?” উজ্জ্বল জিজ্ঞেস করল।

মদন কাকু আস্তে বললেন, “এই ছবিগুলো হল এই মন্দিরের ইতিহাস। রায় বাহাদুর নিজের চোখে দেখা তিনটি দৃষ্টান্ত এঁকেছিলেন। খননকারী—তিনি নিজে, যিনি খুঁজে বের করেছিলেন সেই মণি। চোখ বেঁধে দাঁড়ানো নারী—তার মেয়ে, ললিতা। আর আগুনের মধ্যে বৃদ্ধ—আমি।”

“আপনি?”—রিয়ান চমকে উঠল।

“হ্যাঁ। আমি সেই সময় ছিলাম তরুণ সেবায়েত। আমি বাধা দিয়েছিলাম। বলেছিলাম—এটা শুধু শক্তি নয়, অভিশাপ। কিন্তু রায় বাহাদুর শোনেননি। পরে, যখন মেয়েটা হারিয়ে যায়, তখন তিনিই আমায় বলেছিলেন—‘তুই পাহারা দে, আমি তো হারিয়ে গেছি।’”

এই বলে মদন চোখ বন্ধ করলেন।

ঘরের কেন্দ্রে একটি মূর্তি—অদ্ভুত সুন্দর, অথচ ভয়ানক। কালো পাথরের ওপর জ্বলজ্বলে ত্রিনয়ন, ত্রিশূল হাতে, পায়ে নরদেহ, কপালে রক্তের চিহ্ন। এই দেবতার মতো দেখতে কিন্তু তার রূপ স্বাভাবিক নয়। যেন হাসছে না, কাঁদছেও না—শুধু তাকিয়ে আছে।

রিয়ান ধীরে গিয়ে মূর্তিটার সামনে দাঁড়াল। “এই মূর্তির মধ্যেই কি লুকিয়ে আছে সেই মণি?”

মদন বললেন, “হ্যাঁ। মূর্তির পেটের ভিতরে। খুব জটিল যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ওটা সেখানে বসানো হয়েছিল, যাতে কেউ চাইলেও সহজে পায় না। আর একমাত্র এক বিশেষ শব্দ-সংকেত থাকলে তবেই সেটা বের হয়।”

“সেই সংকেত কি আপনি জানেন?” উজ্জ্বল জিজ্ঞেস করল।

“জানি না। আমি শুধু জানি, মূর্তির তলায় বসে ধ্যান করলে কখনো কখনো মন্ত্র নিজে উচ্চারিত হয়। সেই মন্ত্রই চাবি।”

রিয়ান চোখ বন্ধ করে মূর্তিটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। এক অজানা শক্তি যেন তাকে নিচের দিকে টানছিল। বুকের ভেতর কাঁপছিল হৃদস্পন্দন। হঠাৎ সে শুনল… না, আসলে অনুভব করল… এক ছায়াস্বর—

“যা খোঁজে সে হারায়, যে হারায় সে খোঁজে…
আলো নয়, অন্ধকারে বিশ্বাস করো।
তোমার ভয় যদি সত্য হয়, তবে তুমি প্রস্তুত।
জপো—’তপঃ সর্বং বিদ্যাময়ী তানভি'”

সে কাঁপা গলায় উচ্চারণ করল সেই শব্দগুলো—“তপঃ… সর্বং… বিদ্যাময়ী… তানভি…”

হঠাৎ মূর্তির গায়ের পাথর হালকা কেঁপে উঠল। চোখের মাঝখান থেকে একটা ক্ষীণ আলো বের হতে লাগল, ঠিক যেন তৃতীয় নয়নের ভিতর থেকে। আলোটা সরু লেজের মতো গড়িয়ে এল পায়ের দিকে, তারপর ধীরে ধীরে মূর্তির বুকের মাঝখান খুলে গেল।

ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটি ছোট, নীলচে সবুজ রঙের মণি—একটা কাঁচের মতো বস্তু, যার মধ্যে যেন ছুটে বেড়াচ্ছে আলোর রেখা। সেটা এতটাই উজ্জ্বল যে পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করে উঠল।

উজ্জ্বল বিস্ময়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “এটাই শরীরেশ্বর?”

মদন মাথা নাড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ। ওটাই। এখন প্রশ্ন, কী করবে তোরা ওটা নিয়ে?”

রিয়ান ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মণিটা তুলল। সঙ্গে সঙ্গে একটা প্রবল শীতলতা তার শরীর ভেদ করে গেল। চোখের সামনে যেন ফেলে আসা স্মৃতিগুলো—মা, বাবা, শহরের জীবন, বন্ধু, হাসি, কান্না—সব ঘুরে ঘুরে উঠছে।

সে বুঝতে পারল—এই মণি শুধু তন্ত্র নয়, মনও খুলে দেয়।

উজ্জ্বল বলল, “তুই কি ঠিক আছিস?”

রিয়ান ধীরে বলল, “হ্যাঁ। কিন্তু এটা কোনো সাধারণ কিছু না। এটা নিজের অস্তিত্বকে প্রশ্ন করে তোলে। কে আমি? কেন বাঁচি? কেনই বা জানতে চাই এই সবকিছু?”

মদন বললেন, “এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার সাহসই তো এই শক্তির প্রকৃত রূপ। যে ভয়কে মানে না, সে ওর অধীনে পড়ে। আর যে ভয়কে বুঝে, সে ওর রক্ষাকর্তা হয়।”

রিয়ান একবার মণিটার দিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে সেটা ফিরিয়ে দিল মূর্তির বুকের ভিতরে। “আমরা জানতে চেয়েছিলাম। পেয়েছি। কিন্তু এটা আমাদের নয়। এটা এ গ্রামের, এ মন্দিরের, আর আপনার কাছে ভালোবাসায় রক্ষিত থাকুক।”

মূর্তির বুক আবার বন্ধ হয়ে গেল। আলো নিভে গেল। ঘরটা আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত।

মদন চোখে জল নিয়ে বললেন, “আজ এত বছর পর কেউ ফিরে এল, যে জানল—সব পেতে হয় না, কিছু ফিরিয়ে দিলেও ইতিহাস তৈরি হয়।”

রিয়ান আর উজ্জ্বল ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারা জানে, কিছুই আর আগের মতো নয়। কিন্তু আজ তাদের মধ্যে জন্ম নিয়েছে এমন এক অভিজ্ঞতা, যা তারা কোনোদিন ভুলবে না।

পর্ব ৬

পরদিন সকালবেলা রিয়ান আর উজ্জ্বল যখন ঠাকুরদার বারান্দায় এসে বসল, তখনও তাদের চোখে ঘুমের ছায়া। কিন্তু মনে ছিল অস্থির এক আলোড়ন। তারা কথা বলছিল খুব নিচু গলায়, যেন বাতাসেও কেউ শুনে ফেলতে পারে।

“তুই কাল রাতে ঘুমোতে পারলি?”—উজ্জ্বল ফিসফিস করে বলল।

“না রে, বারবার মূর্তিটার কথা মনে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল, যেন চোখ বন্ধ করলেই আলোটা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে।”

“আমার তো মনে হচ্ছিল কেউ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। গ্রামে কি সত্যিই কেউ জানে মণিটার কথা?”

রিয়ান মাথা নাড়িয়ে বলল, “জানত না হয়তো। কিন্তু এখন জানে।”

“মানে?”—উজ্জ্বল চমকে উঠল।

“সকালবেলা উঠেই দেখলাম, আমাদের উঠোনের পাশে রামধন গোপাল কাকার ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে কৌতুহল। বলল—‘তোমরা মন্দিরে গেছিলে, না? রাতে আলো দেখা গেছে।’”

উজ্জ্বল থমকে গেল। “তাহলে গুজব ছড়াতে শুরু করেছে?”

ঠিক সেই সময়, ঠাকুরদা বাইরে এসে বসলেন। চোখে চশমা, হাতে সকালের খবরের কাগজ। কিন্তু তার মুখটা কেমন যেন চিন্তিত।

“কি হয়েছে, দাদু?”—রিয়ান জিজ্ঞেস করল।

“আজ সকালে পঞ্চায়েত থেকে লোক এসেছিল,” তিনি বললেন। “মন্দিরে কেউ ঢুকেছে রাতে। ওরা বলছে, কেউ হয়ত আবার গুপ্তধনের খোঁজে নেমেছে।”

“তারা কি আমাদের কথা জানে?”—উজ্জ্বল আতঙ্কিত গলায় বলল।

“না, এখনো নাম নেয়নি কেউ। তবে গ্রামের কিছু ছেলে বলেছে, মন্দিরে রাতের দিকে আলো দেখা গেছে, কারা যেন ঢুকেছিল। আমি কিছুই বলিনি, শুধু বলেছি, তোমরা বাড়িতে ছিলে।”

রিয়ান চুপ করে রইল। সে জানে, এই গুজব যদি ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে শুধু বিপদে পড়বে না ওরা, গ্রামেও শুরু হবে লোভ আর বিভ্রান্তির খেলা।

“দাদু, ওরা যদি সত্যিই মণিটার খোঁজে আসে?”—রিয়ান জিজ্ঞেস করল।

ঠাকুরদা গভীর চোখে তাকাল, “তাহলে মন্দিরটা হয়তো আর নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না।”

বিকেলে তারা গেল চায়ের দোকানে। গাঁয়ের একমাত্র কাঠের দোকান, যেখানে দুটো বেঞ্চে বসে গরম চা খায় মানুষজন, আর চলে অবিরাম আলোচনা।

আজকের আলোচনার বিষয় ছিল একটাই—মন্দিরে আলো, গুপ্তধন, আর রায় বাহাদুরের অভিশাপ।

“আমি তো কাল রাতে নিজে দেখেছি আলো,” বলল হরিচরণ কাকা। “মনে হচ্ছিল কেউ যেন কুন্দনের মতো কিছু নিয়ে ঘুরছে ভিতরে।”

আরেকজন বলল, “রায় বাহাদুরের সিন্দুক এখনও ওখানে আছে বলেই শুনেছি। তাতে শুধু টাকা নয়, নাকি সোনার মূর্তিও আছে।”

“আরে ধুর! কেউ ওখানে গেলেই নাকি ঘুমিয়ে পড়ে, আর আর ফিরে আসে না,” বলল আরও একজন।

রিয়ান আর উজ্জ্বল মুখ নিচু করে চা খাচ্ছিল। তারা জানত, এসব গুজব একটা বড় বিপদের ইঙ্গিত। কারণ যে গ্রামে মানুষ নিজের ছায়াকেও সন্দেহ করে, সেখানে লোভ ছড়িয়ে পড়া মানেই সর্বনাশ।

হঠাৎ দোকানে ঢুকল এক নতুন লোক—লম্বা, কালো শার্ট পরা, চোখে কালো চশমা, গলায় মোটা চেইন।

“আমি সুদীপ দে,” সে বলল গলা খাঁকিয়ে। “জমির ব্যবসা করি, কলকাতা থেকে এসেছি। শুনেছি এখানে একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি আছে, আর তার পাশে এক ধ্বংসপ্রায় মন্দির। সরকারি কাগজে যদি সেটার মালিকানা পাওয়া যায়, আমি কিনতে রাজি।”

সবাই একদম চুপ।

উজ্জ্বল ধীরে রিয়ানকে কানে কানে বলল, “এই লোকটাই কিনা সেই ‘বাইরের মানুষ’? যে মণিটার গন্ধ পেয়ে এসেছে?”

রিয়ান বলল, “হতেই পারে। লোকটা বেশ আত্মবিশ্বাসী, আর তার চোখ যেন সবকিছু গিলে খেতে চাইছে।”

সুদীপ দে আবার বলল, “আমার সঙ্গে আছে ইনভেস্টর। জায়গাটা যদি ঠিক হয়, এখানে রিসোর্ট বানানো যাবে। আর এই রহস্যময় ইতিহাস—সেটা হয়ে যাবে ট্যুরিস্টদের জন্য চমক।”

এই কথা শুনে রিয়ান আর উজ্জ্বল বুঝে গেল, এবার সময় কম। ওদের এখনই কিছু একটা করতে হবে। না হলে শুধু মন্দির নয়, হারিয়ে যাবে ইতিহাস, আর হয়তো সেই অভিশপ্ত শক্তি আবার ছড়িয়ে পড়বে।

রাতের বেলা তারা আবার গোপনে গেল মদন কাকুর কাছে। তিনি মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে ছিলেন ধ্যানের ভঙ্গিতে। চোখ খুলতেই বললেন, “আমি জানি, গুজব ছড়িয়ে পড়েছে।”

রিয়ান বলল, “হ্যাঁ। এক লোক এসেছে কলকাতা থেকে, নাম সুদীপ দে। সে জায়গাটা কিনে রিসোর্ট বানাতে চায়। এবং আমার মনে হয়, সে মণির গন্ধ পেয়েছে।”

মদনের চোখে একটুও বিস্ময় নেই। “অনেক বছর ধরে আমি জানতাম, একদিন কেউ আসবেই। আর সেই দিন হয়তো এসে গেছে।”

উজ্জ্বল বলল, “তাহলে আমরা কী করব? লোকটা যদি জোর করে মন্দির দখল করে নেয়?”

মদন ধীরে বললেন, “তোমাদের এবার গ্রামের মানুষকে বোঝাতে হবে সত্যিটা। কিন্তু শুধু মুখে না—প্রমাণ দিয়ে। তোমরা যদি সত্যিই দেখাতে পারো, মণি শুধু শক্তি নয়, সেটা অভিশাপও—তাহলে গ্রামের লোকই তোমাদের পাশে দাঁড়াবে।”

রিয়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “আমরা করব। কারণ এই গ্রামের ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে।”

পর্ব ৭

রাতটা যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল। বাঁশঝাড়ের মাথায় জোনাকি টিমটিম করছিল, আর সেই আলোয় ধরা দিচ্ছিল গ্রামের নিঃশব্দ শ্বাসপ্রশ্বাস। রিয়ান আর উজ্জ্বল বসেছিল ঠাকুরদার পুরোনো লাইব্রেরি ঘরে, তাদের সামনে খোলা বাবার ডায়েরি, পাশে ছড়িয়ে থাকা মন্দিরের মানচিত্র আর মণির অবস্থানের খসড়া।

উজ্জ্বল বলল, “আমরা শুধু জানি ওটা ভয়ানক কিছু। কিন্তু গ্রামের লোক তো শুধু শুনছে ‘গুপ্তধন’। আমাদের বিশ্বাস করবে কেন?”

রিয়ান একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তাদের চোখে দেখতে দিতে হবে, কানে নয়। ভয়টা দেখতে হবে। সত্যি বলতে গেলে শুধু যুক্তি নয়, প্রমাণ লাগে। আর সেই প্রমাণ… আমাদের দেখাতে হবে।”

“মানে?”

“মানে, আমাদের আবার যেতে হবে মন্দিরে। সেই মূর্তিটার সামনে বসে, আবার জপ করতে হবে সেই মন্ত্র। আর তারপর যদি মণি বের হয়, তাহলে সেটা নিয়ে যেতে হবে সবার সামনে।”

“তুই পাগল! মদন কাকু তো বলেছিলেন—একবার মণির সংস্পর্শে এলে তা থেকে নিজেকে সরানো কঠিন। আর ওটা যদি প্রকাশ্যে আনা হয়, কেউ না কেউ নিতে চাইবেই।”

“এইবার ওটা আমাদের হাতে থাকবেই না,” রিয়ান বলল। “আমাদের শুধু দেখাতে হবে—ওটা কেমন শক্তি। তারপর… মন্দিরেই ওটাকে ফিরিয়ে দিয়ে সিল করে দিতে হবে। চিরতরে।”

সকালে তারা গিয়ে উপস্থিত হল পঞ্চায়েত কার্যালয়ে। সেখানে বসে ছিলেন মোড়ল হরিলাল, মল্লিক কাকু, রামধন গোপাল, আরও অনেক প্রবীণ গ্রামবাসী। আর এক কোণে দাঁড়িয়ে সেই লোকটা—সুদীপ দে, চোখে চশমা, মুখে অতিরিক্ত হাসি।

“তোমরা এসেছো ভালো করেছো,” হরিলাল মোড়ল বললেন। “সবাই বলছে, তোমরাই নাকি মন্দিরে গিয়েছিলে। আলোও নাকি তোমাদের থেকেই এসেছে।”

রিয়ান সামনে এগিয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমরা গিয়েছিলাম। কারণ আমরা জানতে চেয়েছিলাম—সেই মন্দিরে কী আছে। আমরা আবিষ্কার করেছি, সেখানে শুধু ইতিহাস নয়, ভয়ঙ্কর এক শক্তি লুকিয়ে আছে। সেটা কেউ পেলে, গ্রাম শেষ হয়ে যাবে।”

লোকজন ফিসফিস করতে লাগল।

সুদীপ দে হেসে উঠল, “তুমি তো দেখি সিনেমার গল্প বলছো! শক্তি! ভয়! এগুলো দিয়ে কি কেউ জায়গা বিক্রি আটকাতে পারে?”

উজ্জ্বল গলা শক্ত করে বলল, “আপনি বিশ্বাস না করলে আসুন, আজ রাতে চলুন আমাদের সঙ্গে মন্দিরে। আমরা দেখাব কী আছে ওখানে। কিন্তু একটা শর্তে—আপনি যদি ভয় পান, তবে চিরতরে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন।”

চ্যালেঞ্জটা জনতার ভেতর ছড়িয়ে পড়ল আগুনের মতো।

সুদীপ বলল, “ঠিক আছে। আমি আসব।”

সেদিন রাতেই, গ্রামের কুড়িজন মানুষ, পঞ্চায়েত মোড়ল, আর সুদীপ দে একসাথে উপস্থিত হল মন্দিরে। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ, কুয়াশার মতো বাতাস আর বাঁশঝাড়ে পাখির ডাক।

মদন কাকু সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখে অভিভাবকের মতো গভীরতা। “তোমরা সবাই এসেছো ভালো কথা। তবে যা দেখবে, সেটা ভোলার নয়। আজকের রাত শুধু মন্দির নয়, তোমাদের মনকেও পালটে দেবে।”

রিয়ান আর উজ্জ্বল মূর্তির সামনে গিয়ে বসলো। ধুপকাঠি জ্বলছে, বাতাসে সেই পুরোনো গন্ধ—ধূপ আর আশঙ্কার। রিয়ান চোখ বন্ধ করে আবার সেই মন্ত্র উচ্চারণ করল—

“তপঃ সর্বং বিদ্যাময়ী তানভি…”

ঘরের মাঝে আলো জ্বলে উঠল। মূর্তির ত্রিনয়ন খুলে গেল। বুকের মাঝখান থেকে উথলে উঠল সেই মণি—নীল সবুজ আলোয় ঝলমল করছে।

এক মুহূর্তের জন্য চারদিক স্তব্ধ।

সুদীপ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, “এটা কী! এটা তো… এটা তো জ্বলছে! এটা… এটা যেন টানছে!”

সে এগিয়ে যেতে চাইলো। কিন্তু মদন কাকুর কণ্ঠ গর্জে উঠল, “থেমে যাও!”

গ্রামের অন্য লোকজন চমকে গেল। রায় বাহাদুরের মেয়ের কাহিনি বলা হল—কীভাবে সে হারিয়ে গিয়েছিল, কিভাবে রায় বাহাদুর নিজেই তাঁর সর্বস্ব হারিয়ে এই শক্তিকে শিকলবন্দি করেছিলেন।

মল্লিক কাকু চোখ বড় করে বলল, “এটা কি… সেই অভিশপ্ত বস্তু?”

রিয়ান বলল, “হ্যাঁ। আমরা এটা চাই না। শুধু দেখাতে চেয়েছিলাম, কতটা ভয়ানক শক্তি এর মধ্যে আছে। এটা কারোর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। এটা মন্দিরের, গ্রামের, সময়ের স্মৃতি। এখন এটাকে ফিরিয়ে দিতে চাই।”

রিয়ান ধীরে মণিটা মূর্তির বুকে ফিরিয়ে দিল।

আর তখনই এক ভয়ানক গর্জনের শব্দ হল। ঘর কাঁপতে লাগল। মূর্তির চারপাশে আগুনের মতো আলো ছড়িয়ে পড়ল। তারপর সব শান্ত।

সবাই স্তব্ধ।

মদন কাকু চোখ বুজে বললেন, “এবার ও ঘুমিয়ে গেছে। আর কেউ ওকে না জাগালে, সে শুয়ে থাকবে চিরতরে।”

পঞ্চায়েত মোড়ল ধীরে বললেন, “এই জায়গা আমরা বিক্রি করব না। এই মন্দির, এই ইতিহাস আমরা রক্ষা করব। সুদীপবাবু, আপনি আপনার রিসোর্ট অন্য কোথাও করুন।”

সুদীপ দে মুখ থুবড়ে বসে রইল। সে বুঝে গিয়েছিল—এই গ্রামের মাটি কেবল জমি নয়, আত্মা।

রিয়ান আর উজ্জ্বল ফিরে এল বাড়িতে। রাত গভীর, কিন্তু তারা জানত—তারা একটা সময়কে রক্ষা করেছে। নিজের কৌতূহলকে পেরিয়ে, তারা ফিরিয়ে দিয়েছে সেই বস্তুটিকে যা লোভ নয়, আত্মত্যাগের প্রতীক।

পর্ব ৮ 

চাঁপারপুকুরের আকাশটা আজ অদ্ভুত শান্ত। সকালবেলার রোদে আমগাছের পাতায় আলো ঝিকমিক করছে, বাঁশঝাড়ের মাথায় দুলছে একরাশ জোনাকির ছায়া, আর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে কাঁচা মাটির গন্ধ। ছুটির শেষ দিন, এবং এটাই রিয়ান ও উজ্জ্বলদের গ্রামের শেষ সকাল।

ঠাকুরদা সকালের চা হাতে বারান্দায় এসে বসেছেন। তাঁর পাশে বসে উজ্জ্বল, আর মাটিতে বসে রিয়ান একটা পুরোনো খাতা লিখছে। ডায়েরির পাতায় তার হাতের লেখা—আলগা, কিন্তু স্পষ্ট:

“এই গ্রীষ্ম বদলে দিল আমাদের। কিছুই পরিকল্পনায় ছিল না। মন্দির, মণি, মদন কাকু, আর ভয়—সবই যেন কল্পনার মতো, অথচ বাস্তব। সত্যি বললে, এবার ছুটি মানে শুধুই খাওয়াদাওয়া বা ঘুম নয়, এবার ছুটি মানে ইতিহাসের হাত ধরে ভয়কে ছুঁয়ে দেখা।”

উজ্জ্বল পাশ থেকে বলল, “তুই তো দেখি ডায়েরি লেখার বই বের করে দিবি!”

রিয়ান হেসে ফেলল। “লেখাটা দরকার, না হলে মন থেকে হারিয়ে যাবে। সময়ের ভেতরে যে কিছু দেখা যায় না, সেটা লিখে রাখলেই তার ছায়া বাঁচে।”

ঠাকুরদা চোখে চশমা নামিয়ে বললেন, “এই কয়েকটা দিন তোদের দেখে আমার নিজের ছেলেবেলা মনে পড়ল। একসময় আমিও ঘুরতাম এই মন্দিরের চারপাশে। তখন কিছুই জানতাম না, শুধু ভয় পেতাম। কিন্তু তোরা এসে যে সাহস দেখালি, আমি সত্যিই গর্বিত।”

চুপচাপ বসে থাকা উজ্জ্বল হঠাৎ বলল, “মদন কাকুর কী হল? কাল রাতের পর তো আর দেখা পাইনি।”

ঠাকুরদা একটু থেমে বললেন, “আজ ভোরে উনি চলে গেছেন। না বলে, চুপচাপ। বাড়ির পেছনের আমগাছের নিচে একটা চিঠি রেখে গেছেন।”

“কি লেখা ছিল?”—দুজন একসঙ্গে বলে উঠল।

ঠাকুরদা একটা কাগজ বের করলেন। মদন কাকুর কাঁপা হাতে লেখা:

“আমি আর এই মন্দিরের প্রয়োজন নেই। রায় বাহাদুরের সেই অশান্ত আত্মা এবার শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। আমার কাজ শেষ। নতুন রক্ষকরা এসে গেছে। যারা ভয়কে বুঝেছে, ক্ষমতাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সময় এলেই তারা আবার ফিরে আসবে, যদি মন্দির ডাক দেয়।”

চিঠিটা পড়ে রিয়ান বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক আলো অনুভব করল। কেমন যেন একটা বন্ধনের শেষ চিহ্ন রেখে গেছেন সেই মানুষটা—যিনি নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন অতীতের পাহারায়।

দুপুরবেলা ট্রেন ধরার জন্য তারা রওনা দিল স্টেশনের দিকে। পেছনে ঠাকুরদা, পিসিমা, আর গ্রামের কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে রইলেন। সবার চোখে কিছু না বলা কথার ছায়া। একদম চলে যাওয়ার সময় রামধন গোপাল এগিয়ে এসে বলল, “তোরা যা করেছিস, সেটা কেবল একটা মন্দিরকে বাঁচানো নয়, আমাদের বিশ্বাসকে ফিরিয়ে দিয়েছিস। আমরা ভাবতাম, বাচ্চারা শুধু মোবাইল দেখে। কিন্তু তোরা দেখালি, ইতিহাস আজও কারও কারও হাতে নিরাপদ।”

উজ্জ্বল হেসে বলল, “এবারের গরমের ছুটি কিন্তু খুব গরম ছিল। একটু বেশি রকম।”

রিয়ান যোগ করল, “তবে মনের ভেতরে একটুও গরম লাগেনি। বরং শান্তি পেয়েছি। যেন নিজের ভয়কে ছুঁয়ে এসেছি, আর সেখান থেকে ফিরে এসেছি নতুন কিছু নিয়ে।”

ট্রেন এসে দাঁড়াল। তারা দুজনে উঠে পড়ল কামরায়। জানালার পাশে বসে রিয়ান আবার ডায়েরি খুলল।

“মন্দির এখনও সেখানে আছে। মূর্তিও আছে। মণিটাও। কিন্তু এখন তার পাশে আছে সাহস। ইতিহাস শুধু ধ্বংসস্তূপ নয়, সেটা বিশ্বাসের শরীর। আর সেই বিশ্বাসকে রক্ষা করে কেউ না কেউ, চুপচাপ। মদন কাকু সেই মানুষ ছিলেন। আর আজ হয়ত আমরা। কিংবা আগামীকাল কেউ আরও।”

উজ্জ্বল মাথা ঘুরিয়ে বলল, “তোর কি মনে হয়, আমরা আবার ফিরে আসব এই গ্রামে?”

রিয়ান জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল, “যদি মন্দির ডাক দেয়, আমরা ফিরবই। কারণ আমরা এখন শুধু দর্শক নই, আমরা সেই গল্পের অংশ—যেটা ছায়ার নিচে লেখা হয়, আর আলোয় পড়ে না।”

ট্রেন চলতে শুরু করল। গ্রামের চেনা গন্ধ, সেই বাঁশঝাড়, শিবমন্দির, কুয়ো, মেঘলা আকাশ সব পেছনে ছুটে গেল। কিন্তু দুটো কিশোরের মনে রয়ে গেল এক অলৌকিক গ্রীষ্মের অভিজ্ঞতা, এক চিরকালীন বন্ধনের অনুভব।

রিয়ান চুপ করে ভাবল—এই অভিজ্ঞতা তারা কাউকে বলতে পারবে না ঠিকমতো। কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউ বলবে গল্প, কেউ বলবে বাজে কথা। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তারা জানে, তারা যা দেখেছে, তা সত্যি। আর সেই সত্যিকে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছে, বিনিময়ে পেয়েছে কিছু—অদৃশ্য, কিন্তু চিরন্তন।

আকাশে হালকা মেঘ। দূরে একটা বাজপাখি ডানামেলে উড়ছে। ট্রেনের জানালায় পড়ছে ছায়া। আর তার নিচে লেখা হচ্ছে এক গল্প—
ছায়ার নীচে গ্রীষ্ম।

[সমাপ্ত]

 

1000024364.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *