সমীর বাউড়ি
এক
পুরুলিয়ার চরীদা গ্রামের আকাশে যখন সূর্য ডুবে যেতে থাকে, তখন লাল মাটির উপর এক ধরনের নরম আলো পড়ে, যেন প্রকৃতি নিজেই নৃত্যের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই ছোট্ট গ্রামটি পাহাড়, শাল-পিয়াল আর বিস্তীর্ণ ধুলিধূসর পথের মাঝে লুকিয়ে থাকা এক বিস্ময়ের নাম—যেখানে মুখোশ পরে নাচে পুরুষেরা, যেখানে ছৌ নাচ কেবল শিল্প নয়, আত্মার প্রকাশ। গ্রামের এক কোণে থাকে অরিত্র—এক কিশোর, যার চোখে মুখে জেদ, আর ভিতরে ভিতরে দগ্ধ হওয়া এক আগুন। সে ছেলেবেলা থেকেই ছৌ নাচের প্রতি আকৃষ্ট, কিন্তু সেই ভালোবাসা যেন চোরাগোপ্তা সম্পর্কের মতো—জানাজানি হলে শাস্তি। তার মা, এক সাধারণ কিন্তু কঠোর নারী, নিজের চুল কাটার দোকান চালিয়ে কোনোরকমে সংসার চালান। স্বামীকে হারিয়েছেন জীবিত অবস্থায়—সে ছৌ নাচের শিল্পী ছিলেন বটে, কিন্তু মদ্যপান, হতাশা আর আর্থিক অনিশ্চয়তায় ভেঙে পড়েছিলেন। অরিত্র ছোটবেলায় বাবার মুখোশ গায়ে দিয়ে আঙিনায় নাচত, কিন্তু সেসব স্মৃতি মা মুছে দিতে চেয়েছেন বারবার। আজও সেই পুরোনো কাঠের বাক্সে, যেখানে তার বাবা নিজের মুখোশ রেখে দিতেন, অরিত্র লুকিয়ে চোখ রাখে—যেন ওই মুখোশের ভিতরেই তার প্রকৃত পরিচয় লুকিয়ে আছে।
প্রতি দিন স্কুল শেষে, সবাই যখন খেলাধুলা বা মোবাইলে ব্যস্ত, অরিত্র তখন চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে গ্রামের অন্যপ্রান্তে—বৃদ্ধ বিষ্ণু কাকুর উঠোনে। বিষ্ণু কাকু এক সময় বিখ্যাত ছিলেন জেলা পর্যায়ের ছৌ নৃত্যশিল্পী হিসেবে। বয়সের ভারে নড়াচড়া কম হলেও, চোখে আজও দীপ্তি রয়েছে। তিনি এখনো হাতে গোনা কয়েকজন বালককে ছৌ শেখান—নিঃস্বার্থভাবে, সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অরিত্র প্রথম যেদিন সেখানে পৌঁছায়, মুখে কিছু বলেনি, শুধু গিয়ে মাটিতে প্রণাম করে দাঁড়িয়ে ছিল। কাকুর চোখে তখনই চিনে গিয়েছিলেন কিছু—একটা তৃষ্ণা, একটা জেদ। শুরু হল শিক্ষা—শুধু নাচ নয়, শরীরের ভারসাম্য, শ্বাসপ্রশ্বাস, তালমেল, মুখোশ ধারণ করার নিয়ম, চরিত্রের অন্তর্নিহিত অনুভূতি বোঝা—সবকিছু শেখানো হয় ধৈর্য আর অধ্যবসায়ে। মুখোশ পরে যখন সে প্রথম সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, নিজেই ঘেমে যায়, কিন্তু কাকুর চোখে তখন হাসি। দিনে দিনে অরিত্রর পায়ে তাল জমে, দেহে গতি আসে, আর মুখে চরিত্রের ছায়া। নাচের সময় সে যেন আর অরিত্র থাকে না—সে হয়ে ওঠে দেবতা, পশু, অসুর—যা যা চরিত্র চায়।
তবে বাড়ি ফিরলেই সে আবার সেই চুপচাপ, গুটিয়ে থাকা কিশোর হয়ে যায়। মা কখনও সন্দেহ করেন না? অবশ্য করেন—শার্টের ধুলো, পায়ের ক্ষত, চোখে লুকানো উত্তেজনা—সবই তাঁর নজরে আসে। কিন্তু তিনি চুপ করে থাকেন, হয়ত ভেতরে ভেতরে ভয় পান—এই ছেলে যদি বাবার পথেই হাঁটে? তাই একদিন রাতে, মা যখন অরিত্রর স্কুল ব্যাগে মুখোশের ছোটখাটো রেপ্লিকা খুঁজে পান, রাগে ফেটে পড়েন। তাঁর চিৎকার ভেঙে দেয় রাতের নিস্তব্ধতা—“তুই কী আমার স্বামীর মতো শেষ হতে চাইছিস? ছৌ দিয়ে কি পেট চলে?” অরিত্র কিছু বলে না, শুধু তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে। কিন্তু সেই রাতে, তার মনের ভিতরে এক তীব্র সিদ্ধান্ত জন্ম নেয়—এই নাচ, এই মুখোশই তার পরিচয়। তার বাবা হয়ত হেরেছিলেন, কিন্তু সে হার মানবে না। বাবার ভুল পথে নয়, সে নিজের পথ গড়বে। ছৌকে লুকিয়ে রাখার নয়, গর্ব করে বাঁচার বিষয় বানাবে।
অধ্যায়ের শেষে, অরিত্র রাতের আঁধারে উঠে যায় ছাদের ওপরে। আকাশে তারাগুলি যেন তাকে দেখে হাসছে। দূরের জঙ্গল থেকে বাজে বাঁশির হালকা আওয়াজ, হয়ত কোনো বাউল বা ছৌ দলের অনুশীলন। সেই মুহূর্তে অরিত্র অনুভব করে, ছৌ কেবল নাচ নয়—এ তার জন্মভূমির ভাষা, তার আত্মার প্রতিধ্বনি। চরীদার লাল মাটির মধ্যেই লুকিয়ে আছে সেই ছন্দ, সেই রক্ত, সেই ঘাম—যা দিয়ে গড়া হবে তার ভবিষ্যৎ। সেদিন সে প্রতিজ্ঞা করে—একদিন সে মুখোশ পরে এমন নাচবে, যাতে শুধু চরীদা নয়, গোটা পৃথিবী তাকিয়ে থাকে। আর সেই পথে তার প্রথম পা পড়ে—লাল মাটির পথ বেয়ে, যেখানে শুরু হয় ছায়ার নাচ।
দুই
পুরুলিয়ার চরীদা গ্রামের মানুষদের কাছে মুখোশ শুধু একটি বস্তু নয়, বরং একটি পরিচয়—একটি আত্মার ছায়া, যা মানুষকে অন্য সত্তায় পরিণত করে। অরিত্রর বাবার মুখোশও একসময় তেমনই এক পরিচয় ছিল। তিনি ছিলেন এলাকার অন্যতম দক্ষ ছৌ নৃত্যশিল্পী—নাম ছিল চৈতন্য সেন। তার চোখে ছিল আগুন, শরীরে ছিল যোদ্ধার ছন্দ, আর মনে ছিল ছৌর জন্য অদম্য ভালোবাসা। অরিত্র ছোটবেলায় বাবাকে মঞ্চে দেখে মুগ্ধ হত—যখন তিনি রাবণের ভূমিকায় দাঁড়াতেন, পুরো দর্শক যেন নিশব্দ হয়ে যেত। কিন্তু সেই চৈতন্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়েছিলেন—প্রথমে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের উপেক্ষা, পরে অনুদান বন্ধ হওয়া, আর শেষে পরিবারের দায়। অরিত্রর মায়ের কাছে ছৌ নাচ মানেই ছিল এক অভিশাপ—যা তার স্বামীকে নেশায় ঠেলে দিয়েছে, আর সংসারকে টানাটানি দিয়েছে। মুখোশ যখন দেওয়ালে টাঙানো থাকে, তখন সে গর্ব; কিন্তু যখন সে মুখোশ নামিয়ে রেখে মদ কিনতে চলে যায়, তখন তা লজ্জা হয়ে ওঠে। অরিত্র এই দুই চেহারাই দেখেছে—একদিকে মানুষের বাহবা, আরেকদিকে বাবার চোখের ভিতরের ক্রমশ নিভে যাওয়া আলো।
তবুও, অরিত্রর বাবার মধ্যে একটা অলঙ্ঘ্য ছায়া থেকে গিয়েছিল, যা তাকে ছৌর প্রতি টানতো। মুখোশের ভিতরে সে বাবার মুখ দেখতে পেত, এমনকি সেই গর্জন—যা সে ছোটবেলায় ঘুমের মধ্যেও শুনত। এক সন্ধ্যায়, বিষ্ণু কাকুর অনুরোধে অরিত্র বাবার পুরনো মুখোশ নিয়ে আসে ক্লাসে। সেটি ছিল শিবের মুখোশ—নীল রঙে আঁকা, চোখে হালকা রাগ, কিন্তু ঠোঁটে করুণ হালকা হাসি। বিষ্ণু কাকু সেই মুখোশ হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকেন অনেকক্ষণ, তারপর বললেন—“তোর বাবা যখন এই মুখোশ পরে প্রথম নেচেছিল, আমি কেঁদে ফেলেছিলাম।” সেদিন, প্রথমবার অরিত্র বাবার চরিত্রে নিজের শরীর ঢুকিয়ে নেয়। সে যেমন ছিল না, তেমনই হয়ে ওঠে। নাচের সময় তার পা কাঁপে না, চোখে কোনো দ্বিধা থাকে না—শুধু যেন এক আত্মা আরেক আত্মাকে পূর্ণ করে চলেছে। ক্লাস শেষে কাকু বললেন—“তুই যদি চৈতন্যের ছেলে হবি, তাহলে তাঁর মতো নাচতে শিখ, কিন্তু তাঁর ভুলগুলো করিস না। তিনি মুখোশ ভালোবাসতেন, কিন্তু নিজের মুখ ভুলে গিয়েছিলেন।”
অরিত্র এবার বাবার পুরনো কাগজ ঘাঁটতে শুরু করে। সে দেখে, বাবা একসময় কলকাতার এক সংস্কৃতি উৎসবে পারফর্ম করেছিলেন, এমনকি ভারতভবন থেকেও নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক অনটন, পরিবহনের খরচ, আর গ্রামের ঈর্ষা তাকে ঠেলে দিয়েছিল বিষণ্ণতায়। অরিত্রর মনে প্রশ্ন জাগে—এই দেশে শিল্পীরা কেন হারিয়ে যায়? কেন মুখোশের পেছনে যে মানুষটা থাকে, তার খবর কেউ রাখে না? সে ভাবে, বাবার মতো শিল্পীদের জন্য যদি কিছু করা যেত, তবে এই মুখোশগুলো শুধু দেওয়ালে ঝোলানো থাকত না, বরং তারা ইতিহাস লিখত। এক রাতে মা রান্নাঘরে চুপ করে বসে ছিলেন, অরিত্র এসে পাশে বসে বলে—“মা, আমি জানি বাবা কোথায় ভুল করেছিল। আমি সেই ভুল করব না। আমি ছৌ নাচবো, কিন্তু তোমার মাথা কখনও নত করব না। আমি স্কুল শেষ করব, কিন্তু নাচ ছাড়ব না।” মা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বলেন—“তুই বাবার মতো ভয়ানক ছিলি ছোটবেলা থেকেই। এখন বুঝি, নাচ তোকে ছাড়বে না। তবে একটা কথা মনে রাখিস—শিল্প যদি তোর অহংকার হয়, তবে শিক্ষা হোক তোর হাতিয়ার।”
এরপরের দিনগুলো যেন নতুন করে শুরু হয়। বিষ্ণু কাকু আরও গভীরভাবে অরিত্রকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। এই অধ্যায়ে ছৌ নাচের ভেতরের দার্শনিক দিক উঠে আসে—কেন মুখোশ পরে মানুষ হয়ে ওঠে ভিন্ন কেউ, কেন দেবতা আর অসুরের গল্প হাজার বছরের পুরোনো হয়েও আজও প্রাসঙ্গিক। অরিত্র এখন শুধু স্টেপ শেখে না, সে শেখে প্রতিটি ভঙ্গির পেছনের ব্যাখ্যা—কেন রাবণ দশ মাথা নিয়ে হাসে, কেন শিবের ধ্যান এত স্থির, কেন পশুর মতো নাচার মধ্যেও থাকে সংযম। কাকু বলেন—“মুখোশ আমাদের শিখায়—আমরা যা দেখি, সবটাই সত্যি নয়। কিন্তু আমরা যা অনুভব করি, সেটাই শিল্প।” আর তখন থেকেই অরিত্র বুঝতে শুরু করে, মুখোশ শুধু তার বাবার মতো পুরোনো কাহিনি নয়, বরং একটি উত্তরাধিকার—যা সে নিজের মতো করে বয়ে নিয়ে যাবে। এই অধ্যায়ের শেষে, একটি নাটকীয় দৃশ্যে, অরিত্র একা ক্লাবে দাঁড়িয়ে মুখোশ পরে নাচে। বাইরে বৃষ্টি নামে, শালবনের ফাঁক দিয়ে ঢোকে জোছনার আলো। আর সেই আলোর নিচে এক কিশোর—যার শরীর নড়ছে, কিন্তু আত্মা যেন উড়ছে ছায়ার ভেতর দিয়ে, পুরুলিয়ার নাচ হয়ে উঠছে তার আত্মপরিচয়।
তিন
বিষ্ণু কাকুর উঠোনটা বাইরের দুনিয়ার থেকে একেবারেই আলাদা। মাটির দোতলা ঘরের পাশে যে খোলা জায়গাটা রয়েছে, সেটাই তাঁর “ক্লাসরুম”—একটা বড় নেবু গাছের নিচে এক চিলতে ছায়া, পাশে ছাউনি দেওয়া তিনটে কাঠের মুখোশ ঝোলানো, আর এক কোণে রাখা পুরোনো মাদলের ঢাক। এখানেই প্রতিদিন বিকেলে কয়েকজন কিশোর ছৌ শেখে, কিন্তু এই বছর বিষ্ণু কাকুর চোখের মণি একটাই—অরিত্র। সে সময়ের আগে পৌঁছায়, নিজের শরীর গরম করে, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে যেন মাটি থেকে শক্তি টেনে নিচ্ছে। বিষ্ণু কাকু নাচ শেখান কেবল কায়িক কসরত নয়, বরং দর্শন দিয়ে—প্রতিটি ভঙ্গির পেছনে এক মানে, প্রতিটি ঘূর্ণির পেছনে এক গৌরব। “তুই যখন রাবণের দশ মাথা বুঝিস না, তখন শুধু নাচিস; কিন্তু যখন বুঝিস, তখন তা তোর আত্মার আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায়,”—এই কথাগুলো বারবার বলেন কাকু। শুরুর দিকটা ছিল কঠিন—অরিত্রর হাঁটু ব্যথা করত, কাঁধে ব্যথা উঠত, ঘাড়ে টান খেত। কিন্তু সে ছাড়ত না। কাকুর চোখে যেমন ছিল শাসন, তেমনই ছিল স্নেহ, আর তার প্রতিটি সংশোধনে যেন জড়িয়ে থাকত এক অদৃশ্য সুরক্ষা।
একদিন ক্লাস শেষে বিষ্ণু কাকু ডেকে বলেন, “এবার প্রস্তুত হ হয়ে যা—জেলার ছৌ নৃত্য প্রতিযোগিতায় তোকেই নিয়ে যাচ্ছি।” সেই মুহূর্তটা ছিল অরিত্রর জীবনে প্রথম স্বীকৃতির আলো। চারপাশে মুখোশে ঘেরা তার জীবন এবার বাইরে আলোয় আসবে—পেশাদার মঞ্চে, বিচারকদের সামনে, নতুন দৃষ্টিকোণে। কিন্তু সেই খবর শুনে মা আবার দ্বিধায় পড়ে যান। ছেলের চোখে স্বপ্ন দেখেন বটে, কিন্তু জানেন এই মঞ্চে নামার অর্থ—সমাজের আবার নোংরা চাহনি, বাবার পুরোনো পরিচয়ের ছায়া, লোকের মুখে কানাকানি। “তুই ভালো করিস, কিন্তু মনে রাখিস, ভুল করলে লোকজন শুধু তোকেই না, আমাকেও ছোট করবে”—মা বলে দেন। অরিত্র কিছু বলেনা, শুধু তার বাবার মুখোশটা হাতে নেয়। প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি শুরু হয় এক অন্যরকম অনুশাসনে—ভোরে উঠে শরীরচর্চা, বিকেলে রিহার্সাল, রাতে বইয়ের মাঝে ছোট্ট নোটবুকে চরিত্র বিশ্লেষণ। সে এবার রাবণের চরিত্র নিচ্ছে—এক জটিল ছায়াময় সত্তা, একদিকে জ্ঞানী, অন্যদিকে অহঙ্কারী, একদিকে রাজা, আবার অন্যদিকে পরাজিত মানুষ। অরিত্র তাকে কেবল অসুর না ভেবে একজন গভীর মানুষ রূপে ধরতে চায়।
প্রতিযোগিতার দিন আসে। অরিত্রর গ্রাম থেকে প্রথমবার শহরে যাওয়া—পুরুলিয়া সদর শহর, বড় অডিটোরিয়াম, গেটের বাইরে পোস্টারে তাঁর দলের নাম। দল বলতে আসলে কেবল তিনজন—অরিত্র, এক ঢাকিওয়ালা, আর বিষ্ণু কাকু। মঞ্চে ওঠার আগে তার পেটের ভিতরে কেঁপে ওঠে কিছু, কিন্তু মুখোশ পরে সে আর অরিত্র থাকে না—সে হয়ে যায় রাবণ। তার পায়ের শব্দে মঞ্চ কাঁপে, তার দৃষ্টিতে ভয় জাগে, আর তার ঘূর্ণনে যেন সময়ও থেমে যায়। দর্শকসারিতে বসে থাকা বিচারকদের চোখে বিস্ময়, আর শেষে থামার পরে হলে নেমে আসে কয়েক সেকেন্ডের নিঃশব্দতা—তারপর হাততালি, সিটি, করতালি। বিষ্ণু কাকু পিছন থেকে ফিসফিস করে বলেন, “তুই এবার আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে গেলি।” মঞ্চ থেকে নামার পর এক সাংবাদিক এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন, “তুমি কি চৈতন্য সেনের ছেলে?” প্রশ্নটা হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। অরিত্র মাথা নিচু করে বলে, “হ্যাঁ, আমি তাঁর ছেলে। কিন্তু আজ আমি শুধু ছৌ শিল্পী। আমি নিজেকে নিয়ে এসেছি।” আর সেই জবাবে যেন তাঁর বাবার মুখোশ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সেই দিনটাতেই অরিত্র বুঝে যায়—মুখোশ শুধু লুকানোর জন্য নয়, কখনও কখনও তা দিয়ে নিজের মুখ দেখা যায়।
সন্ধ্যায় গ্রামে ফেরার সময় নেমে আসে বৃষ্টি। গ্রামের মানুষ থেমে দাঁড়িয়ে পড়ে—কারও হাতে মোবাইলে অরিত্রর নাচের ভিডিও, কারও চোখে গর্ব। মা বাইরে এসে দাঁড়ান, প্রথমে কিছু না বলে শুধু ছেলের ভিজে কপালে হাত বোলান, তারপর বলেন, “তুই পারলি রে। আমি ভুল ছিলাম হয়তো।” অরিত্র চুপ করে, আর তারপর বাবার সেই পুরনো মুখোশ কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়, যেন সে মুখোশ এবার কোনো বোঝা নয়—একটি পতাকা, তার শিল্পীর পরিচয়ের প্রতীক। বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে, বিষ্ণু কাকু ক্লান্ত চোখে বলে ওঠেন, “এই মাটি, এই নাচ, এই ছেলেগুলো—এদের মধ্যে এখনও আগুন আছে।” সেই রাতের আকাশে মেঘ কাটতে থাকে, আর চরীদার বাতাসে যেন শোনা যায়—একটি নতুন গল্প শুরু হয়েছে, মুখোশের আড়ালে এক নতুন মানুষ জন্ম নিয়েছে, যে ছায়ার মতো নাচে… কিন্তু এবার আর লুকিয়ে নয়, আলোয় দাঁড়িয়ে।
চার
অরিত্র জেলার প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জেতার পরে গোটা চরীদা গ্রামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। তাকে ঘিরে উঠোনে শুরু হয় চা-আড্ডা, পাড়ার ছেলেরা তাকে “রাবণদা” বলে ডাকতে শুরু করে। এমনকি স্থানীয় এক স্কুল থেকে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ছোটদের ছৌ শেখানোর জন্য। কিন্তু এই সবের মাঝেই তাঁর মা, সোমা সেন, যেন ক্রমশ গুটিয়ে নিতে থাকেন নিজেকে। তিনি প্রতিবার অরিত্রকে মঞ্চে যেতে দেখেন, কিন্তু চোখে আনন্দের বদলে থাকে আতঙ্ক। তাঁর স্বামীর অতীত এখনও তাঁর মনে রক্তক্ষরণের মতো তাজা—চৈতন্য সেন মঞ্চে নাচতে নাচতেই একদিন হারিয়ে গিয়েছিলেন, শুধুই গর্ব নিয়ে নয়, হেরে গিয়ে, ঋণের ভার নিয়ে, নেশায় ডুবে। সোমা জানতেন অরিত্র তাঁর বাবার মতো নয়, কিন্তু মা হিসেবে তার ভয়—সন্তান সেই একই শূন্যতায় না হারিয়ে যায়। এক সন্ধ্যায়, যখন অরিত্র তার নতুন একটি মুখোশ আঁকছিল, মা দরজায় দাঁড়িয়ে সোজাসুজি বলে ফেলেন—“তুই আর কোনো নাচে যাবি না। এইবার থাম।” ঘরে হঠাৎ নিস্তব্ধতা। অরিত্র আকাশ থেকে পড়ে। সে জিজ্ঞাসা করে, “কিন্তু মা, কেন?” মা বলে ওঠেন, “কারণ আমি জানি এই পথ কোথায় গিয়ে শেষ হয়।”
এই নিষেধাজ্ঞা অরিত্রর ভেতরটা ভেঙে দেয়। সে অনুভব করে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—একদিকে নাচ, যা তার আত্মপরিচয়; অন্যদিকে মা, যার ত্যাগ ছাড়া সে এতদূর আসতেই পারত না। বিষ্ণু কাকুকে জানালে তিনিও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “তোর মায়ের ভয়টা আমি বুঝি। কিন্তু তুই যদি থেমে যাস, তবে তো শুধু মুখোশ খুলবি না, তোর মুখটাই হারাবি।” অরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়, সে এবার মুখোমুখি হবে—তবে ঝগড়া করে নয়, বরং বুঝিয়ে। এক রাতে সে মায়ের সামনে বসে পড়ে বাবার পুরোনো চিঠিগুলো খুলে দেখায়—যেখানে চৈতন্য সেন লিখেছিলেন, “আমি চাই আমার ছেলে যদি নাচে, সে যেন আমার মতো পালিয়ে না যায়, বরং মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় গড়ে তোলে।” সোমা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকেন, তারপর বললেন, “তোর বাবার লেখা এখনো চোখ ভিজিয়ে দেয়। কিন্তু আমি চাই, তুই যদি নাচিস, তবে অন্যদের মতো হয়ে যাস না। নিজের স্বপ্ন দেখ, তবে আমাদেরও সঙ্গে রাখিস।” সেই প্রথমবার মা একটু নরম হন। কিন্তু তারও এক শর্ত—“তুই যদি নাচিস, তবে পড়াশোনাও চালিয়ে যাবি। শুধু ছৌ দিয়ে জীবন চলে না।”
সেই চুক্তির পর থেকে শুরু হয় নতুন অধ্যায়—দিনে স্কুল, রাতে অনুশীলন। কিন্তু এবার গ্রামে অন্য সমস্যা শুরু হয়। স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান ও এক রাজনৈতিক কর্মী ছৌ দলকে নিজেদের প্রচারের হাতিয়ার করতে চান। তারা অরিত্রর কাছে প্রস্তাব রাখে—একজন নেতার জন্মদিনে ছৌ পরিবেশনা দিতে হবে, বিনিময়ে সম্মান ও অনুদান। অরিত্র দ্বিধায় পড়ে—বিষ্ণু কাকু কড়া ভাষায় বারণ করেন, “শিল্প যদি তোর আত্মা হয়, তবে তাকে বিক্রি করিস না। রাজনীতির খেলা যখন শুরু হয়, তখন শিল্প শেষ হয়।” কিন্তু পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা, স্কুল ফিস, মায়ের ওষুধের খরচ, আর নিজের মুখোশ তৈরির স্বপ্ন—সব মিলিয়ে অরিত্র চিন্তায় পড়ে। তখনই সে এক বিকেলে পুরুলিয়ার এক সরকারি সাংস্কৃতিক আধিকারিকের কাছে যায় নিজের প্রজেক্ট নিয়ে—একটি ছৌ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলতে চায় সে, যেখানে গ্রামের ছেলেরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ পাবে। আধিকারিক প্রথমে হাসলেও, যখন অরিত্র নিজ হাতে আঁকা মুখোশ, তার চিঠিপত্র, আর তার পুরস্কার দেখান, তখন তিনি মনোযোগী হন। বললেন, “তুই ঠিক পথেই আছিস, তবে এই পথ দীর্ঘ—মাথা গরম করিস না, স্থির থাক।”
এই অধ্যায়ের শেষে, এক নাটকীয় দৃশ্যে, অরিত্র মা ও বিষ্ণু কাকুকে নিয়ে প্রথম নিজের উদ্যোগে একটি ছোট ছৌ নাট্যানুষ্ঠান আয়োজন করে। সে নিজের চিত্রনাট্য লেখে—রাবণের নয়, এবার সে বেছে নেয় এক ভগ্ন রাজ্যের গল্প—যেখানে একজন যোদ্ধা হারানোর মধ্যেও দাঁড়ায় সত্যের পাশে। এই গল্পে যেন প্রতিফলিত হয় তাঁর বাবার জীবনের ছায়া, আর তাঁর নিজের সংগ্রাম। অনুষ্ঠানের শেষে, মা আস্তে আস্তে উঠে এসে দর্শকদের মধ্যে হাততালি দেন। বিষ্ণু কাকুর চোখে জল আসে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে অরিত্র বুঝে যায়—নৃত্য শুধু গতি নয়, এটি সম্পর্কেরও ভাষা। মুখোশ পরে সে বাবার স্বপ্নকে ছুঁয়েছে, কিন্তু এবার মায়ের হাত ধরেই সে তা সত্যি করতে চায়।
পাঁচ
পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে ছৌ মুখোশ শুধু একটি শিল্প নয়—এটি এক আত্মিক ধ্যান, এক আত্ম-উন্মোচনের প্রক্রিয়া। অরিত্র ছোটবেলা থেকেই তার বাবার রেখে যাওয়া মুখোশগুলোর দিকে চেয়ে থেকেছে—রাবণের রক্তচক্ষু, মহিষাসুরের কোঁচকানো ভ্রু, কিংবা মহাদেবের শান্ত মুখ। কিন্তু এবার সে ঠিক করল—নিজের চরিত্রের জন্য একটি নিজস্ব মুখোশ তৈরি করবে। বিষ্ণু কাকুর অনুপ্রেরণায় সে পৌঁছে যায় বাঘমুণ্ডির সেই বিখ্যাত মুখোশশিল্পী রাজীবদার কাছে, যিনি তার বাবার সময়েও নাম করা ছিলেন। রাজীবদা প্রথমে অবাক হয়ে বলে ওঠেন, “তুই চৈতন্যর ছেলে?” তারপর বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, যেন বাবার মুখ খুঁজছেন ছেলের চোখে। রাজীবদা বলে ওঠেন, “তোর বাবা শেষ জীবনে একটা মুখোশ বানাতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ করতে পারেনি।” অরিত্র কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে, “কি রকম মুখোশ?”—উত্তরে রাজীবদা বলেন, “একটি দ্বিমুখী মুখোশ—একদিকে শান্ত, অন্যদিকে ক্রুদ্ধ। বলেছিল, ‘আমার জীবনের দুই চেহারা যদি এক মুখোশে ধরা যায়, তবেই আমি সত্যি শিল্পী।’” সেই ভাবনার সূত্র ধরেই অরিত্র এবার নিজের একটি মুখোশ বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়—একটি এমন মুখোশ, যা রাবণ কিংবা মহিষাসুর নয়, বরং এক আধুনিক তরুণের—যার মধ্যে আছে দ্বন্দ্ব, স্বপ্ন, এবং প্রতিবাদ।
প্রথম দিন রাজীবদার ওয়ার্কশপে গিয়ে সে কেবল মাটি ছোঁয়, আঙুল দিয়ে ঠেলে দেখে তার নমনীয়তা। রাজীবদা তাকে বলেন, “শুধু চোখ, নাক আর ঠোঁট গঠন করলেই মুখ হয় না। প্রতিটি রেখা এক ভাষা বলে। তুই যদি সত্যিকারের শিল্পী হোস, তবে মুখোশ তোকে নিজের গল্প বলবে।” অরিত্র শুরু করে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে—মায়ের চোখের হতাশা, বিষ্ণু কাকুর প্রশ্রয়, মঞ্চের আলো, গ্রামের কানাঘুষো—সব মিলিয়ে সে এক অদ্ভুত মুখ রূপ দিতে শুরু করে। মুখোশে সে দুই পাশ রাখতে চায়—একপাশে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত চোখ; অন্যপাশে তীক্ষ্ণ, রণচণ্ডী দৃষ্টি। এই দ্বৈততা যেন তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি রাতে সে কাগজে স্কেচ আঁকে, দিনে মাটি ঘষে, বাঁশের কাঠামো বানায়, আর মাঝে মাঝে মুখোশটার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই দেখে। সে বুঝতে পারে—এই মুখোশ কেবল তার চরিত্রের অংশ নয়, বরং তার আত্মার প্রতিবিম্ব।
তবে কাজটা সহজ নয়। একদিন হঠাৎ মুখোশের একটি অংশ ভেঙে যায়। হাল ছেড়ে দিতে চায় সে। তখন রাজীবদা এসে বলেন, “মুখোশ ভাঙা মানেই শেষ নয়। কিছু কিছু শিল্প কেবল ভেঙেই গড়ে ওঠে।” এই কথা শুনে অরিত্র নিজের ভাঙা অংশটা রেখে দেয়, মেরামত করে না। সেই ফাটলটাকেই সে মুখোশের অভিব্যক্তিতে রূপ দেয়—জীবনের ভাঙনও তো একরকম শক্তি। তৈরি হয় মুখোশ—আধা পাথরের মতো কঠিন, আধা মাটির মতো নরম। এই মুখোশে না আছে দেবতা, না আছে রাক্ষস—এ এক মানুষ, যাকে সমাজ বোঝে না, কিন্তু সে নিজের স্বরূপে দাঁড়িয়ে থাকে। যখন সে মুখোশটা পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, তখন নিজেকেই চিনতে পারে না—আবার চিনতেও পারে। যেন সে আর অরিত্র নেই, সে এখন শিল্প। রাজীবদা মুখোশটি দেখে চুপ করে থাকেন অনেকক্ষণ, তারপর বলেন, “তুই একদিন নতুন অধ্যায় খুলবি ছৌর ইতিহাসে।” সেই প্রশংসা যেন কোনো পুরস্কারের চেয়েও বড়।
অধ্যায়ের শেষে, অরিত্র নিজের বানানো মুখোশ পরে গ্রামের মেলায় একটি একক নৃত্য পরিবেশন করে—নাম দেয়, “ছায়ার নাচ”—যেখানে চরিত্র নেই, কেবল অনুভূতি। নাচের প্রতিটি ভঙ্গিমায় সে তুলে ধরে ভয়ের, লজ্জার, প্রতিবাদের, আর সাহসের সুর। মানুষ বোঝে না সবটা, কিন্তু মুগ্ধ হয়। কেউ কেউ বলে, “এটা কি নতুন ধরনের ছৌ?” কেউ বলে, “এটা তো ছৌ না, অন্য কিছু!” কিন্তু সবাই বোঝে—এ এক নতুন ভাষা। অনুষ্ঠানের শেষে এক বৃদ্ধ এসে বলে, “তুই মুখোশ না পরে থাকলে যা বলতে পারিস না, মুখোশ পরে সব বললি।” সেই দিন অরিত্র বুঝে যায়—মুখোশ তার লুকোবার জন্য নয়, বরং প্রকাশের এক মাধ্যম। আর তার ভিতরের ছায়াগুলো, যেগুলো এতদিন ধরে তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল, আজ তারা নেচেছে, আর নাচতে নাচতেই মুক্ত হয়েছে।
ছয়
বাঘমুণ্ডি থেকে ফিরে এসে অরিত্র তার তৈরি মুখোশটি ঘরের এক কোণে স্থাপন করে, যেন সেটি কেবল একটি শিল্প নয়, এক আত্মস্মৃতি। কিন্তু ঠিক সেই সময় তার জীবনে আসে এক অপ্রত্যাশিত মোড়—পুরনো কাঠের সিন্দুকটি, যা মায়ের বিছানার নিচে বছরের পর বছর পড়ে ছিল, তা হঠাৎ খোলা হয় একটি কাকতালীয় ঘটনায়। মা অসুস্থ হয়ে পড়লে, ওষুধ খুঁজতে গিয়ে অরিত্র সিন্দুকের তলায় একটি পাতলা খামে মোড়ানো পত্র খুঁজে পায়, যার ওপরে ধুলো জমেছে, কিন্তু কালি এখনও স্পষ্ট—“চৈতন্য সেন, ২০০৬”। অরিত্রর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে। সে ধীরে ধীরে খাম খুলে চিঠিটি পড়ে—লিখেছেন তার বাবা, ঠিক মৃত্যুর কিছুদিন আগে, কিন্তু চিঠিটি কোনোদিন পোস্ট করা হয়নি। সেখানে লেখা—“পুতুল, যদি কখনও তুই ছৌর পথ বেছে নিস, তবে মনে রাখিস, মুখোশ পরে তোকে সত্যিই দেখতে হবে নিজেকে। আমার মতো ভুল করিস না—আমি মুখোশ বানিয়ে নিজেকে লুকিয়েছিলাম, তুই মুখোশ পরে নিজেকে খুঁজে নিস।” চিঠির প্রতিটি বাক্যে এক অনুতপ্ত শিল্পীর কণ্ঠস্বর, এক ভাঙা পিতার স্বীকারোক্তি।
চিঠিটি অরিত্রর মনে জন্ম দেয় এক দ্বন্দ্ব ও এক শক্তি—সে উপলব্ধি করে, তার বাবা শুধুই ব্যর্থ নৃত্যশিল্পী ছিলেন না, বরং ভেতরে ছিলেন এক সাহসী শিল্পী, যিনি নিজের দুর্বলতা স্বীকার করতে পেরেছিলেন। পরের দিন সে বিষ্ণু কাকুকে চিঠি পড়ে শোনায়, যিনি নীরবে শোনেন, চোখের কোণে জল এসে পড়ে। “চৈতন্য শেষদিকে অনেক পাল্টে গিয়েছিল,” বলেন তিনি। “সে চেয়েছিল তোকে সঠিক পথে ফেরাতে, কিন্তু সময় আর সাহস ছিল না।” অরিত্র এবার সিদ্ধান্ত নেয়, সে ছৌকে শুধু ঐতিহ্য হিসেবে নয়, এক ব্যক্তিগত প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সে তার চিঠির লাইনের ওপর ভিত্তি করে একটি নতুন নাট্যচিত্র লিখতে শুরু করে—“অচেনা আয়না”, যেখানে একটি ছেলে মুখোশ পরে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, এবং নিজের সমস্ত রূপকে একে একে চিহ্নিত করে—ভয়, রাগ, লজ্জা, অহংকার, ভালোবাসা, সব। সে চায়, গ্রামের ছোট ছোট ছেলেরা যারা শুধু রাবণ হতে চায়, তারা জানুক—রাবণের ভেতরও ছিল প্রশ্ন, দ্বিধা, দুঃখ।
এই সময়েই, জেলা প্রশাসন থেকে একটি প্রস্তাব আসে—“পুরুলিয়া যুব শিল্প উৎসব”-এ জেলার তরুণ শিল্পীদের নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী হবে। অরিত্র ও তার দলকে আহ্বান জানানো হয় সেখানে পরিবেশনার জন্য। মা প্রথমে দ্বিধায় থাকলেও এবার আর আপত্তি করেন না। তিনি চিঠিটি বারবার পড়েন, যেন প্রতিটি অক্ষর চৈতন্যর মুখ হয়ে কথা বলে। উৎসবের দিন অরিত্র যখন “অচেনা আয়না” পরিবেশন করে, গোটা অডিটোরিয়ামে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। আর তা শেষ হওয়ার পরে, কয়েক সেকেন্ডের নিঃশব্দতা পেরিয়ে দর্শকদের হাততালি ফেটে পড়ে। মুখোশধারী ছেলেটি যেভাবে নিজের রূপ উন্মোচন করে মঞ্চে, তা যেন শুধু নাটক নয়—এক মুক্তি। বিচারকরা, সাংবাদিকেরা সবাই বলে, “এটা ছৌর নতুন রূপ—এক নতুন ভাষা।”
অধ্যায়ের শেষে, উৎসব শেষে এক বৃদ্ধ শিল্পী এসে অরিত্রর পাশে বসেন। তিনি বলেন, “ছৌ এতদিন ছিল চরিত্রভিত্তিক, তুই একে আত্মভিত্তিক করলি। তুই চৈতন্যর ছেলে, এটা এখন শুধু গর্ব নয়—এটা উত্তরাধিকার।” অরিত্র বুঝে যায়, তার বাবার যে অপূর্ণ স্বপ্ন ছিল, তার অংশ সে পূরণ করতে পেরেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে সে বুঝে নেয়, পথ এখানেই থেমে নেই। ছৌর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে নতুন আলো, নতুন অন্ধকার। সে এবার আর নিজের ছায়াকে ভয় পায় না। বরং সে জানে—ছায়া না থাকলে আলোকে চেনা যায় না। সেই রাতেই, বাড়ি ফিরে, মুখোশটা চোখে চাপিয়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আর চুপচাপ বলে—“আমি আসছি, বাবা। এবার মুখোশ খুলব না, তোমার মতো পালাবও না। শুধু নাচব, যতক্ষণ না সত্যি বেরিয়ে আসে।”
সাত
“অচেনা আয়না” পরিবেশনার সাফল্যের পর অরিত্রর নাম ছড়িয়ে পড়ে জেলা জুড়ে। তাকে ডাকা হয় রাঁচি, জামশেদপুর, এমনকি কলকাতার একটি আঞ্চলিক নাট্যপ্রতিযোগিতায় ছৌ পরিবেশন করতে। পুরুলিয়ার ছৌ হঠাৎ করেই শহরের আলোচনায় উঠে আসে—তবে শুধু ঐতিহ্য নয়, এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক হিসেবে। কিন্তু যেই আলো আসে, তার সঙ্গে সঙ্গে ছায়াও ঘনিয়ে ওঠে। জেলা পরিষদের এক প্রভাবশালী নেতা, যিনি “পুরুলিয়া লোকশিল্প উন্নয়ন মঞ্চ” পরিচালনা করেন, অরিত্রকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে পাঠান। তিনি সরাসরি বলেন, “তোমার দলের নাচ আমরা এবার আমাদের উৎসবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাখতে চাই—কিন্তু একটি পরিবর্তন চাই। মুখোশে একটু ‘ভারতীয় সংস্কৃতির গর্ব’ ফুটিয়ে তুলতে হবে, রাজনৈতিক ভাবনায় কিছু ইঙ্গিত রাখতে হবে।” অরিত্র প্রথমে চমকে ওঠে—সে ভাবতে পারেনি, তার শিল্পকে কেউ এক রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিংয়ের হাতিয়ার করতে চাইবে। সে বলেই ফেলে, “ছৌ তো কখনোই কারও মুখপাত্র নয়, সে তো নিজস্ব কথা বলে।” নেতা হেসে বলেন, “সব শিল্পই কারও না কারও মুখপাত্র হয়, তুমি সেটা চেনো না।”
অরিত্র বাড়ি ফিরে রাতভর ঘুমাতে পারে না। বিষ্ণু কাকুকে বিষয়টি জানালে তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়েন। “ছৌ আমাদের আত্মার মতো ছিল,” বলেন তিনি, “এখন যদি সেটাকে ভোটের মুখোশ পরানো হয়, তবে এই শিল্প মরবে।” পরিস্থিতি আরও জটিল হয়, যখন জেলা প্রশাসনের কিছু সদস্য গোপনে অরিত্রকে জানায়, যদি সে প্রস্তাব না মানে, তবে তার দলের সরকারি অনুদান, উৎসব অংশগ্রহণের অনুমতি, সবই বাতিল হয়ে যেতে পারে। তার কিশোর সঙ্গীদের কেউ কেউ ভয়ে সরে যেতে শুরু করে—তাদের পরিবার চায় না ছেলেরা রাজনৈতিক বিপদের মুখোমুখি হোক। অরিত্র দ্বিধায় পড়ে যায়। সে জানে, প্রতিবাদ করলে হয়ত সব বন্ধ হয়ে যাবে, কিন্তু যদি মাথা নোয়ায়, তবে তার শিল্প মরে যাবে। সে এক সিদ্ধান্ত নেয়—সে ওই উৎসবে যাবে না, বরং নিজের একটি “স্বাধীন ছৌ উৎসব” আয়োজন করবে গ্রামে, যেখানে কেউ রাজনৈতিক কথা বলবে না, কেবল শিল্পের স্বাধীনতা নিয়ে কথা হবে।
এই উৎসবের আয়োজন ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। প্রশাসনের কেউ অনুমতি দিতে চায় না, সামান্য মাঠ বরাদ্দ করাও কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু গ্রামের কিছু প্রবীণ মানুষ, যারা কখনোই অরিত্রর অনুষ্ঠান দেখে না, এবার পাশে দাঁড়ায়। “তুই ঠিক কাজ করছিস,” বলে এক বৃদ্ধ মুখোশকার, “আমরা তোকে মাটি, রঙ, কাঠ—সব দেব।” তার স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক, যারা এতদিন নাচকে সময় নষ্ট বলে দেখতেন, এবার ছেলেমেয়েদের রিহার্সালের ছুটি দেন। এমনকি তার মা, যিনি আগে কেবল ভয়ে থাকতেন, এবার নিজ হাতে অতিথিদের জন্য পিঠা তৈরি করেন। উৎসবের দিন মাঠভর্তি মানুষ, রোদ ঝলমলে দুপুর, আর সেই নতুন মুখোশ—যা তার তৈরি নয়, কিন্তু যা তার শিল্পের অন্তর থেকে উঠে আসে—একটি গল্প, যেখানে কোনো রাবণ নেই, শুধু মানুষের মুখোশ খুলে ফেলা হয়। সেই উৎসবের নাম দেয়, “ছায়ার আলো”। সেই দিন অরিত্র কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানার ছাড়াই, শুধু নিজের দলের নামেই নৃত্য পরিবেশন করে—ভিড় নীরব হয়ে শোনে, তার প্রত্যেক পদক্ষেপ যেন হয়ে ওঠে এক নীরব প্রতিবাদ।
অধ্যায়ের শেষ দৃশ্যে, স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয় এক ছোট শিরোনাম—“ছাত্রের নিজের ছৌ উৎসব: নীরব বিপ্লব”। রাজ্য পর্যায়ের কিছু শিল্পবোদ্ধা যোগাযোগ করে অরিত্রর সঙ্গে। কিন্তু তার থেকেও বড় পাওয়া হয় উৎসব শেষে তার মায়ের মুখে এক বাক্য—“তোর বাবাও চাইত এই রকম কিছু, কিন্তু সাহস ছিল না। তুই করেছিস।” অরিত্র জানে, এই লড়াই শেষ নয়—রাজনীতি, ভ্রান্তি, ভয় সব থাকবে, কিন্তু যতদিন সে নাচতে পারে, ততদিন মুখোশ হবে মুক্তির প্রতীক, কারাগার নয়। এবার তার লক্ষ্য শুধু নিজের দল নয়—সে চাই, গ্রামে আরও ছেলেমেয়েরা ছৌ শিখুক, শুধু গর্ব নয়, স্বাধীনতার স্বাদ নিয়েই।
আট
উৎসবের সাফল্যের পর অরিত্রর ভাবনায় জন্ম নেয় এক নতুন আন্দোলনের বীজ—ছৌ যদি মুখোশ পরে আত্মার কথা বলে, তবে মুখোশ খুলেও কি সেই আত্মা প্রকাশ করা সম্ভব নয়? এই ভাবনার উৎস ছিল চৈতন্যর পুরোনো চিঠির শেষ লাইন—“একদিন মুখোশ খুলে সত্যি নাচলে বুঝবি, কোথা থেকে শুরু করেছিলি।” প্রথমে মনে হয়েছিল এটা কেবল কাব্যিকতা, কিন্তু এখন তা বাস্তবের ডাক মনে হয়। অরিত্র এবার এক অভাবনীয় পরিকল্পনা করে—একটি সম্পূর্ণ মুখোশবিহীন ছৌ নৃত্যর উপস্থাপনা, যেখানে প্রতিটি অভিব্যক্তি মুখ, চোখ আর শরীর দিয়ে ফুটে উঠবে। ছৌর শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যে মুখোশ ছাড়া পারফরম্যান্স প্রায় অপরাধের সমান। বিষ্ণু কাকু পর্যন্ত প্রথমে বলে ওঠেন, “এ তো ছৌই নয়!” অরিত্র জবাব দেয়, “এটা ছৌর অন্তরস্বর। মুখোশ ছাড়া যদি সত্যি কথা বলা না যায়, তবে সেই মুখোশ কেবল দেয়াল সাজানো শিল্প।”
পরিকল্পনা সহজ ছিল না। দলের অনেকেই প্রথমে মুখোশ ছাড়া মঞ্চে উঠতে রাজি হয়নি। তারা ভয় পেত—পরিচয়ের, বিচার হওয়ার, এমনকি বিদ্রুপের। মুখোশ তো তাদের আত্মরক্ষার ঢাল ছিল। তখন অরিত্র তাদের বোঝায়—এই নতুন ছৌ কেবল এক শিল্প নয়, এক সাহসের পরীক্ষা। ধীরে ধীরে, রিহার্সালের পর রিহার্সালে, তারা নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করতে শেখে—ভয়, ক্ষোভ, প্রেম, হতাশা—সবকিছু মুখ দিয়ে না বলে মুখমণ্ডলের পেশীতে প্রকাশ করা। নতুন নাট্যরূপের নাম দেওয়া হয় “নয়নছায়া”—যেখানে মুখই মুখোশ, চোখই প্রতীক। অরিত্র দলের প্রতিটি সদস্যকে নিজের গল্প লিখতে বলে, আর সেই গল্পকে রূপ দেয় মঞ্চনাট্যে। মুখোশহীন নৃত্য হয়ে ওঠে এক একান্ত ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি। গ্রামে গুজব ছড়ায়, “অরিত্র এবার ছৌকে নষ্ট করছে!”—কিন্তু সে থামে না।
অবশেষে সেই দিন আসে—“নয়নছায়া” প্রথমবার মঞ্চস্থ হবে বিষ্ণুপুরের এক ছোট নাট্যমঞ্চে, যেখানে উপস্থিত থাকবে শহরের কিছু শিল্পবোদ্ধা ও সাংবাদিক। মঞ্চে যখন প্রথম ছেলেটি মুখোশহীন উঠে দাঁড়ায়, দর্শকরা কিছুক্ষণের জন্য অবাক হয়ে চুপ করে থাকে। কেউ ফিসফিস করে বলে, “এ তো ছৌ না!” কিন্তু পারফরম্যান্স শুরু হতেই বদলে যায় আবহ। ছেলেটির চোখে লেগে থাকে এক প্রশ্ন—“আমি কে?” আর সেই প্রশ্ন নিয়ে একে একে হাজির হয় আরও চরিত্র, কেউ তার বাবার অভাবের কথা বলে শরীরী ভাষায়, কেউ বলে বোনের বাল্যবিবাহের ট্র্যাজেডি, কেউ নিজের স্কুলে মার খাওয়ার লজ্জা। আর সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অনন্য ‘ছৌ’, যা মুখোশহীন হয়েও পূর্ণ, কারণ তা অন্তরের ছায়াকে প্রকাশ করে। মঞ্চ শেষে উপস্থিত শিল্প বোদ্ধা রুদ্রনীল স্যার বলে ওঠেন, “এটাই ভবিষ্যতের ছৌ—বর্ণের বাইরে, মুখোশের বাইরে, ঠিক মানুষের ভেতরের মতো।”
অধ্যায়ের শেষ অংশে, অরিত্র তার বাবার পুরোনো মুখোশটিকে আবার তুলে নেয় হাতে। কিন্তু এবার সেটা দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে—স্মৃতির, শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে। সে জানে, মুখোশের প্রয়োজন ফুরায়নি, কিন্তু মুখোশহীন পথও এখন খোলা। “ছায়ার নাচ” আর শুধুই নৃত্য নয়, এক প্রক্রিয়া, যেখানে কেউ নিজেকে খুঁজে পায়, কেউ নিজেকে চ্যালেঞ্জ করে, কেউ আবার নিজেকে মুক্ত করে। গল্প এখানেই শেষ নয়—এই নতুন ছৌ একদিন আরও ছেলেমেয়ের হাতে ছড়িয়ে পড়বে, যারা আর শুধু রাবণ কিংবা মহিষাসুর হতে চাইবে না—তারা হবে নিজের জীবনের মুখোশহীন নায়ক। আর অরিত্র? সে দাঁড়িয়ে থাকবে মঞ্চের এক পাশে, মুখোশ হাতে, চোখে প্রশ্ন—তুমি কে?
নয়
মুখোশহীন “নয়নছায়া” পরিবেশনার সাফল্য যেন অরিত্রর শিল্পজীবনের এক নতুন সূর্যোদয় হয়ে আসে। কিন্তু তার মন জানত—এই যাত্রা তখনই পূর্ণতা পাবে, যখন এর বীজ ছড়িয়ে দেওয়া যাবে আরও মানুষ, আরও প্রজন্মের মধ্যে। অরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়, সে আর শুধু নৃত্যশিল্পী থাকবে না, বরং হয়ে উঠবে এক “নেতা”—শিল্পে, চিন্তায়, বিকল্পে। সে পুরনো স্কুলের এক ফাঁকা পরিত্যক্ত ঘরকে সংস্কার করতে শুরু করে—কখনও নিজের হাতে ইট বয়ে, কখনও গ্রামের বয়স্কদের কাছে সহযোগিতা চেয়ে। এই ঘরই একদিন হবে একটি সাংস্কৃতিক বিদ্যালয়—“ছায়াশালা”—যেখানে মুখোশ তৈরি শেখানো হবে, ছৌর কাহিনি শেখানো হবে, কিন্তু সবকিছুর ভেতরে থাকবে আত্ম-অনুসন্ধানের দিশা। অরিত্রর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট—এই বিদ্যালয়ে কেউ শুধুই রাবণ হতে আসবে না, বরং রাবণ হওয়ার মানে জানতে আসবে। কেউ রামের ধনুক তুলে ধরবে না, বরং প্রশ্ন করবে—এই যুদ্ধ কার?
বিদ্যালয়ের কাজ শুরু হতেই নানা প্রতিকূলতা আসে—পুরনো শিল্পী মহল থেকে কেউ কেউ বলে, “এই আধুনিকতা ছৌকে ধ্বংস করবে।” স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আবার সন্দেহ করে—“এই ছেলেটা কী শিখিয়ে চলেছে গ্রামের বাচ্চাদের?” তবু অরিত্র থামে না। সে চায়, এই বিদ্যালয়ে মেয়েরাও ছৌ শিখুক, যারা এতদিন ছৌ থেকে দূরে ছিল কেবল লিঙ্গভিত্তিক বিধিনিষেধে। প্রথমে মায়েরা ভয়ে না করলেও, যখন এক সন্ধ্যায় ছাত্রী পূর্ণিমা মুখোশ পরে তার দারিদ্র্যকে নাচে ফুটিয়ে তোলে, তখন গ্রামের নারীরা চোখ মুছে বলে, “এও সম্ভব?” মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যাচ খোলা হয়, ছেলেরা ও মেয়েরা একসাথে নাটক লেখে—নিজেদের গল্প নিয়ে, নিজেদের ছায়া নিয়ে। আর এই সময়েই অরিত্র খুঁজে পায় নিজের সত্যিকারের সার্থকতা—সে জানে, তার বাবা চৈতন্য হয়তো এমন কিছুই চেয়েছিলেন, কিন্তু করতে পারেননি। এবার ছায়াশালায় সেই অপূর্ণতার প্রতিশোধ নিচ্ছে তার সন্তান, সৃজনের মাধ্যমে।
এক বছর পরে, “ছায়াশালা” থেকে প্রথম বের হয় এক যৌথ নাটক—“ছায়ার বাইরে”—যেখানে মুখোশধারী ও মুখোশহীন শিল্পীরা একসাথে মঞ্চে উঠে আসে। নাটকের বিষয়বস্তু—এক ছেলে, যে মুখোশ পরে জন্মেছে, কিন্তু বুঝতে পারে, সেই মুখোশেই লুকিয়ে আছে তার মা-বাবার না বলা গল্প, তার সমাজের চেপে রাখা ইতিহাস। এই নাটক রাজ্যজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়। কলকাতার এক নামী নাট্যসংঘ “ছায়াশালা”-কে আমন্ত্রণ জানায় শহরে মঞ্চস্থ করার জন্য। অরিত্র ও তার দল কলকাতা যায়—ট্রেনে, চোখে স্বপ্ন নিয়ে। শহরের প্রচলিত বৃত্তে দাঁড়িয়ে যখন তারা তাদের শরীরের ভাষায় বলছিল—“আমরা শুধু গল্প বলি না, আমরা নিজেকে খুঁজি”—তখন শিক্ষিত শহুরে দর্শকেরাও প্রথমবার পুরুলিয়ার এক নতুন আলো দেখতে পেল। মুখোশের, ছায়ার, চুপচাপ প্রতিবাদের।
অধ্যায়ের শেষাংশে, অরিত্র ছায়াশালার বারান্দায় বসে চৈতন্যর পুরোনো চিঠিটি আবার পড়ে। হালকা বাতাসে কাগজ কাঁপে, যেন বাবার কণ্ঠ আবার তার পাশে ফিসফিস করে বলে, “তুই পারলি।” দূরে ছাত্রছাত্রীরা খেলছে, কেউ রঙ মাখছে, কেউ ছৌর স্ক্রিপ্ট লিখছে। অরিত্রের চোখে এক শান্তির ছায়া। সে জানে—এই স্কুল, এই ছায়ার নাচ, মুখোশ ও মুক্তির মাঝের যে পথ সে তৈরি করেছে, তা কোনওদিন থেমে যাবে না। হয়তো ভবিষ্যতের কোনো এক অচেনা শিল্পী, এই ছায়াশালার বারান্দা ধরে হাঁটবে, নিজের ছায়া খুঁজতে, নিজের মুখোশ গড়তে। তখন অরিত্র থাকবে না, চৈতন্যও থাকবে না—থাকবে শুধু সেই নিরব ভাষা, যাকে বলে… “ছায়ার নাচ”।
দশ
পুরুলিয়ার সেই ছোট্ট গ্রামটা এখন আর শুধু ধুলোয় ভরা মাঠ, মুখোশের দোকান আর লৌহের শরীরি নাচের জায়গা নয়—এখন সেটা একটা পথের নাম, যেখানে চলতে শেখে মানুষ, মুখোশ খুলে দাঁড়াতে শেখে আত্মা। ছায়ার মতো দীর্ঘ এই যাত্রা একা শুরু হয়েছিল—এক কিশোর, এক প্রশ্ন, আর এক মুখোশ দিয়ে। এখন সেই পথজুড়ে রয়েছে অনেক মুখ, অনেক গল্প, যারা নিজেদের ছায়া নিয়ে লড়তে চায়, হার মানতে নয়।
অরিত্র হয়তো আর মঞ্চে দাঁড়ায় না প্রতিদিন, হয়তো তার মুখ পরিচিত নয় শহরের বড় পোস্টারে। কিন্তু সে রেখে গেছে এক নাচ—যে নাচ কেবল হাত পা নাড়িয়ে বিনোদন দেয় না, বরং মনে প্রশ্ন তোলে, ভেতরটা কাঁপিয়ে দেয়, আর শেখায়—প্রতিটি মানুষেরই একটা নিজস্ব মুখোশ থাকে, আর একদিন সেই মুখোশ খুলে ফেলাই সবচেয়ে বড় নৃত্য।
ছায়াশালা আজও চলছে। সেখানে প্রতিদিন কেউ না কেউ প্রথমবার নিজের গল্প লিখছে, প্রথমবার মুখোশ পরছে, কিংবা সাহস করে মুখোশ খুলে ফেলছে। হয়তো আগামীকাল কেউ নতুন করে ভাববে—ছৌ কি শুধুই ঐতিহ্য, না কি এক সম্ভাবনা? হয়তো কোনো নতুন অরিত্র উঠে আসবে, যার চোখেও থাকবে সেই একই আগুন—চুপ করে থাকা ছায়াকে নাচিয়ে তোলার।
“ছায়ার নাচ” কোনো শেষের গল্প নয়। এটা শুরু—একটা যাত্রার, যেখানে প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি পদক্ষেপে লুকিয়ে থাকে সেই নীরব আর্তি:
“আমাকেও দেখে যাও, আমিও একটা গল্প বয়ে চলেছি।”
-সমাপ্ত-