প্ৰভাত বিশ্বাস
(১)
হরিপদ বসু সকাল সকাল ছাপাখানার ভারী লোহার গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই যেন এক অন্য জগতে পা রাখেন, একটুখানি আলো ফাঁক দিয়ে ঢুকেই ধুলো ঝরা অক্ষর, লিনোটাইপ আর লেটার প্রেসের মৃদু গন্ধে জেগে ওঠে তার বুকের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্মৃতি। এই প্রেসের প্রতিটি মেশিন, প্রতিটি খোপের কালি শুকনো দাগ, পুরনো কাঠের তাকের রং ওঠা অক্ষরমালা সব যেন তার পরিবারের চেয়েও আপন—যেমন হয়, শৈশব থেকে চোখের সামনে বড় হতে হতে মানুষের জীবন মিশে যায় এক টুকরো জায়গায়, এক টুকরো লোহার জিনিসেও। বহু বছর আগে তার বাবা যত্ন করে খুলেছিলেন এই ছাপাখানা, “বসু প্রেস”—তখন চারপাশে নতুন দেশের গন্ধ, স্বাধীনতার রঙ, মিছিলের গান, আর কাগজে কাগজে ছাপা হতো মানুষের স্বপ্ন, সাহস আর প্রেম। সেই দিনগুলো মনে পড়ে গেলেই হরিপদর বুক কেঁপে ওঠে; মনে হয়, এই প্রেস শুধু ব্যবসা নয়, এ এক সংগ্রহশালা—এখানেই কত মানুষের কথা, হাসি-কান্না, প্রেমপত্র, বিদায়পত্র, কবিতা, স্মৃতিচারণা আর ছোটদের হাতে আঁকা ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ ছাপা হয়েছে। সেই ভোরবেলা ছাপাখানায় ঢুকেই পুরনো লোহার চাকা আর ভারী হ্যান্ডেল ছুঁয়ে হরিপদ চোখ বুজে ফেলেন; অদ্ভুত এক অনুভূতি, যেন মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে লুকানো বন্ধুত্ব আবার জেগে ওঠে। গলার কাছে কেমন দলা পাকায়; বাইরে ভোরের আলো আসছে, দোকানের পাশে রাস্তায় দু’একটা রিকশা চলছে, কিন্তু ভেতরে এই অন্ধকারে কেবল সেই অক্ষরের গন্ধ—যা কেবল ছাপাখানার মানুষই চেনে।
আজকাল অবশ্য অর্ডার কমে গেছে, দিন পাল্টে গেছে, তবু কিছুটা আলো আসে সেই পুরনো কাস্টমারেরা—যারা এখনও নিজের ছেলেমেয়ের জন্য স্কুল ম্যাগাজিন ছাপায়, কেউ বা বার্ধক্য ভাতা নেবার ফর্ম ফোটোকপি করায়। কিন্তু হরিপদ জানেন, এই কয়েকটা অর্ডারে আর কুলোচ্ছে না। দোকানের দেয়ালে ঝুলে থাকা বাবার পুরনো সাদাকালো ফোটোটা অনেক দিন হল ফ্রেমের ভেতর ফেটে গিয়েছে; তবু ছবি ফেলার সাহস হয়নি, কারণ সেই চোখের দিকে তাকালেই বুক ভরে যায় অন্যরকম দায়িত্ববোধে। প্রেসের একপাশে কমলা দিদি বসে পাতার পর পাতা গুনছেন—তার হাতের কাছে ছড়ানো ঝাঁকড়া টাইপ, কালি, হরফের বাক্স; আর একপাশে শিবু, সেই কাঁচা বয়সের ছেলে, স্কুল থেকে ফিরে একটু আধটু কাজ শিখছে—তিনিই যেন পুরনো আর নতুনের মাঝের সেতু। শিবুর চোখে কৌতূহল, আর হরিপদের চোখে ভয়—কেমন সময় আসছে, যখন টাইপের বদলে ডিজিটাল প্রিন্ট, মানুষের হাতে বানানো লাইন, স্পেস, ব্লক আর সযত্নে সাজানো পৃষ্ঠার বদলে এক ক্লিকেই তৈরি হয়ে যাবে সব? ভেতরে ভেতরে হরিপদ জানেন, হয়তো ভবিষ্যত থেকে পালিয়ে থাকা যায় না; কিন্তু কেমন করে বোঝাবেন, এই ছাপাখানার কাঠের তক্তায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা টাইপ সেট করা, অক্ষরের ভেতর লুকোনো মানুষের গল্পগুলো শুনে নেওয়া, কালি শুকনোর গন্ধ—এটাই তো আসল প্রাণ? এই অনুভূতিটা কি সত্যিই মরবে? কত পুরনো স্মৃতি এসে ভিড় করে; ছোটবেলায় বাবা যখন প্রথম তাকে টাইপ ধরতে শেখালেন, বলেছিলেন, “দেখ, অক্ষরের চেহারা চিনতে শিখ, তবেই অক্ষরকে বাঁচাতে পারবি।” সেই দিনগুলোতে অর্ডারের ভিড় থাকত, প্রেস চলত গরম হয়ে; হরিপদর হাত জ্বলে যেত, তবু একরাশ আনন্দের মধ্যে দিন কেটে যেত।
তবু এদিন সকালটায় কিছু আলাদা ছিল। হরিপদ শুনেছেন, আজ তার ছেলে সায়ন্তন ফিরছে—মাস ছয়েক আগে শহরের বড় কলেজ থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে এসেছে; এখন নাকি বাবার সঙ্গে কাজ করতে চায়। কেমন এক মিশ্র অনুভূতি বুকের ভেতর—আনন্দ, দুশ্চিন্তা আর অজানা ভয়। সায়ন্তন চিঠিতে লিখেছিল, বাবাকে একটা নতুন পরিকল্পনা দেখাবে—নতুন প্রযুক্তির প্রেস, ডিজিটাল মেশিন, ওয়েবসাইট বানানো, অনলাইন অর্ডার। হরিপদ জানেন, ছেলে ঠিক ভুল বলে না; তবে মনে মনে ভয় পান—এই নতুনের ঢেউ হয়তো বয়ে নিয়ে যাবে সেইসব ছোট ছোট কাহিনি, যেগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে ছাপাখানার আত্মা। দূর থেকে শোনা যায় বাইরের রিকশার ঘণ্টা, দোকানের পাশের গলিতে হকারের হাঁক। হরিপদ ধীরে ধীরে লিনোটাইপের ধুলো ঝাড়েন, যেন সন্তানের মুখ মুছিয়ে দিচ্ছেন। বাইরে নতুন সূর্যের আলো ফোটে, আর প্রেসের ভেতর ছড়ায় সেই অক্ষরের গন্ধ—যা কেবল হরিপদর মতো মানুষেরাই বোঝেন, যার মধ্যে আছে স্বপ্ন, পরিশ্রম আর মানুষের হারিয়ে যাওয়া গল্পের মায়া। এই অক্ষরের গন্ধই তার আসল শক্তি, আসল আশ্রয়—আর ছেলের সঙ্গে আসন্ন আলোচনায় সেটাই হয়তো তার শেষ অস্ত্র।
(২)
সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে, হরিপদ বসু প্রেসের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছেলের ফেরার প্রতীক্ষায় এক অদ্ভুত উত্তেজনা আর অজানা আশঙ্কায় জড়িয়ে পড়েন। কমলা দিদি তখনও কাগজের রোল খুলে গুনছেন, আর শিবু একপাশে দাঁড়িয়ে নতুন একটা অক্ষর সেট করার চেষ্টা করছে—কিন্তু তার চোখও মাঝেমধ্যেই দরজার দিকে চলে যায়। হরিপদের মনে পড়ে ছেলেটা যখন ছোট ছিল, স্কুল থেকে ফিরে ছুটে আসত এই ছাপাখানায়; তখন তার হাতের কাছে কালি মাখানো টাইপ ধরিয়ে দিতেন, ছেলেটার চোখ বড় বড় হয়ে যেত, আর মুখে লেগে থাকত বিস্ময়ের হাসি। কিন্তু সময় পাল্টেছে, আর সেই ছোট্ট সায়ন্তন এখন বড় শহরের কলেজ থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে ফেরা একজন যুবক—যার চোখে থাকবে নতুন স্বপ্ন, নতুন পরিকল্পনা আর হয়তো এমন কিছু কথা যা হরিপদ শুনতেও চাইবেন না। তবু বুকের ভেতরে পিতৃত্বের এক অদ্ভুত টান রয়েছে; ছেলেকে দেখে গলা ধরে আসবে, সেই গলা সরিয়ে হয়তো হাসি মুখে বলবেন, “কেমন আছিস রে?”—আর ছেলেটা হয়তো সেই পুরনো গন্ধটুকুতে আবার একটুখানি ফেরা অনুভব করবে। হরিপদ জানেন না, এই ছেলেটা তার চোখে দেখা বসু প্রেসকে কি নতুন রূপে ভাবছে—তবে বোঝেন, নতুনকে অস্বীকার করা যায় না, আর সেই নতুনের মধ্যে নিজের অতীতটুকু বাঁচিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
দরজার ঘন্টা বেজে ওঠে, আর সায়ন্তন ধীরে ধীরে ঢোকে ছাপাখানায়। মুখে হাসি, হাতে একটা ব্যাগ, আর চোখে শহরের রোদ মাখা আত্মবিশ্বাস। বাবা-ছেলের চোখ মিলতেই কয়েক মুহূর্তের জন্য কেবল নীরবতা; যেন পুরনো দেওয়ালের গায়ে আটকানো ছবিগুলোও তাকিয়ে থাকে, কী বলবে তারা একে অপরকে? হরিপদ আগ বাড়িয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও কিছুটা সংকোচে থেমে যান, আবার সায়ন্তন এগিয়ে গিয়ে বাবাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। সেই স্পর্শেই মনে হয়, রক্তের বন্ধন এত সহজে হারায় না। “কেমন আছো বাবা?”—সায়ন্তনের গলায় শোনা যায় একটুখানি ক্লান্তি আর শহুরে চটক; হরিপদ বলেন, “ভালই আছি রে… তুই?” ছেলেটা ঘুরে ঘুরে প্রেসটাকে দেখে, যেটা তার ছোটবেলায় খেলার মাঠ ছিল, আজ যেন তার চোখে এক আধা-অচেনা স্মৃতির খণ্ড। শিবু কৌতূহলে তাকিয়ে থাকে, কমলা দিদি হাসিমুখে বলে, “বড় হয়েছিস বাবা! কবে এলি?” সায়ন্তনও হাসে, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে বাবার দিকে একবার তাকায়—যেন বলতে চায়, “বাবা, অনেক কিছু বদলাতে হবে।” ক’মিনিট চুপচাপ চারপাশ দেখে ছেলেটা বলে ওঠে, “বাবা, আমি তোকে কিছু দেখাবো”—আর ব্যাগ থেকে বের করে ল্যাপটপ। হরিপদের বুকের ভেতর একটু কেঁপে ওঠে; এতদিন এই অন্ধকার ঘরে অক্ষরের গন্ধ, কালি আর টাইপ সেট ছিল রাজা—আজ সেখানে ঢুকে পড়ল কাঁচের গায়ে বসা প্রযুক্তির আলো।
সায়ন্তন ল্যাপটপ খুলে বাবাকে দেখায় কিছু প্রেজেন্টেশন, নতুন প্রিন্টিং মেশিনের ছবি, অনলাইন অর্ডার সিস্টেমের স্ক্রিনশট, আর ক’জন নতুন কাস্টমারের সম্ভাব্য তালিকা। ছেলে উত্তেজিত গলায় বোঝায়, “বাবা, দেখো, এখন অফসেট আর ডিজিটাল প্রেসে কাজ অনেক দ্রুত হয়, দামও কম পড়ে। আমরা চাইলে স্কুল, কলেজ, দোকান, এমনকি অনলাইনেও অর্ডার নিতে পারি। আর ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে পেজ খুললে আরও অনেক মানুষ জানবে আমাদের কথা।” হরিপদ নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকেন; চোখে পড়ে ল্যাপটপের উজ্জ্বল স্ক্রিনে তার প্রেসের ছবি, কিন্তু সেটা যেন তার চেনা বসু প্রেস নয়—এটা ঝকঝকে ডিজাইন, চকচকে লোগো আর সুন্দর রঙে সাজানো এক আধুনিক দোকান। ছেলে স্বপ্নের মধ্যে বলেই চলে, “বাবা, শুধু একটুখানি ইনভেস্ট করলে আমরা সব বদলে দিতে পারি; টাইপ সেটের ঝামেলা থাকবে না, কাস্টমাররাও খুশি হবে।” হরিপদ চুপ করে থাকেন; তার চোখ চলে যায় লিনোটাইপের দিকে, সেই পুরনো বন্ধুর দিকে, যার হাত ধরে তিনি জীবনের অক্ষর শিখেছেন। কমলা দিদি দূর থেকে তাকিয়ে থাকেন; বোঝেন না সব, তবু অনুভব করেন, এখানে শুধু ব্যবসার হিসাব নয়—এখানে এক পুরনো ভালোবাসা আর নতুন বাস্তবতার দ্বন্দ্ব লুকিয়ে আছে। সায়ন্তন বাবাকে আরও বোঝায়, “তুমি বুঝছো না বাবা, এটা করতেই হবে, না হলে এই প্রেস বন্ধ হয়ে যাবে।” কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর হরিপদ ধীরে বলে ওঠেন, “সব কিছু বদলালে এই প্রেসের গন্ধটাও তো হারিয়ে যাবে রে… মানুষ শুধু কাগজ ছাপায় না, গল্প ছাপে, স্মৃতি ছাপে।” ছেলের চোখে একটুখানি বিরক্তি, কিন্তু আবার নিজের বাবা বলে চুপ করে যায়। সেই মুহূর্তে মনে হয়, এই প্রেস শুধু এক ব্যবসা নয়, দুটো প্রজন্মের বিশ্বাস আর ভালোবাসার মেলবন্ধন, যেখানে নতুন আর পুরনোর মধ্যে শুরু হলো এক অদৃশ্য লড়াই।
(৩)
পরের দিন সকালে ছাপাখানার দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠার আগেই হরিপদ বসু আবার লিনোটাইপের সামনে দাঁড়ালেন, যেন সারারাতের অশান্তির পর এখানেই তার একমাত্র আশ্রয়। সায়ন্তন সকালে আসেনি, হয়তো বাবার সঙ্গে আরও তর্ক এড়াতেই; কমলা দিদি এসে চুপচাপ মেশিনের ধুলো ঝাড়ছেন, আর শিবু আগের দিনের মতই কৌতূহলে তাকিয়ে আছে লিনোটাইপের পিতলের অক্ষরগুলোর দিকে—যেগুলো আসলে আর পাঁচটা ধাতব টুকরো নয়, বরং কাহিনির বীজ। এই লিনোটাইপই একদিন ছিল বসু প্রেসের প্রাণ, প্রতিটি অক্ষরের ছোঁয়া, গরম কালি, আর লোহার ছন্দে তৈরি হতো মানুষের গল্প, কবিতা, প্রেমপত্র, এবং লড়াইয়ের আহ্বান। আজ এই মেশিনটিই যেন একা দাঁড়িয়ে আছে সময়ের কাছে হেরে যাওয়া সৈনিকের মত, কিন্তু হরিপদর কাছে সে এখনো আগের মতোই বীর। তিনি হাত বুলিয়ে বলেন, “তুই কিন্তু এখনো আমায় ভুল করোনি।” মেশিনের কালো লোহার শরীর, ছেঁড়া বেল্ট আর অক্ষরের গায়ের ক্ষতগুলো যেন সেই কথা শুনে নিজের মতো করে জবাব দেয়—মৃদু একটা ধাতব শব্দ, যার মধ্যে লুকিয়ে আছে স্মৃতি আর ক্লান্তির সুর।
হরিপদ মনে মনে ভাবে, এই মেশিন কত কিছু দেখেছে! মনে পড়ে একদিন সন্ধ্যায় বাবা আর তিনজন কর্মচারীর সঙ্গে রাতভর কাজ করে ছাপিয়েছিলেন এক কবিতার বই—যা শেষ পর্যন্ত বিখ্যাত হয়েছিল, আর কবির নাম ছাপাখানায় সোনালি অক্ষরে টাঙানো হয়েছিল। আবার একদিন ভোররাতে এক বৃদ্ধ মানুষ কাঁপা হাতে একটি চিঠি ছাপাতে এসেছিলেন, যাতে লেখা ছিল তার হারিয়ে যাওয়া ছেলের জন্য শেষ কথা। সেসব গল্প হয়তো এখন সায়ন্তনকে বোঝানো যায় না; তার কাছে সবই হিসাবের খাতা আর প্রেজেন্টেশন। কিন্তু হরিপদের চোখে, এই লিনোটাইপ আর লেটারপ্রেস শুধু কালি ছাপায় না, ছাপায় মানুষের কান্না, আশা আর ভালবাসা—যা আর কোনো প্রযুক্তি দিতে পারবে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই তিনি হাত বাড়িয়ে পুরনো অক্ষরের বাক্স খোলেন, যেখানে অক্ষরের গায়ে লেগে থাকা ধুলো আর কালি শুকিয়ে গেছে, কিন্তু এখনো গন্ধ ছাড়ে সেই হারিয়ে যাওয়া কালের। শিবু একপাশ থেকে বলে ওঠে, “কাকু, আমি শিখতে চাই, কীভাবে এভাবে অক্ষর বসাও?” হরিপদর চোখে এক ফোঁটা জল জমে, যা তিনি দ্রুত চশমা ঠিক করার অজুহাতে লুকিয়ে ফেলেন, তারপর ধীরে বলে ওঠেন, “আয়, শেখাবো।” সেই মুহূর্তে মনে হয়, হয়তো একদিন শিবুর হাত ধরেই এই অক্ষরের প্রেম বাঁচবে।
ঠিক সেই সময় কমলা দিদি খবর নিয়ে আসে—একটি ছোট স্কুল থেকে ম্যাগাজিন ছাপানোর অর্ডার এসেছে। খুব বড় নয়, মাত্র পঞ্চাশ কপি, কিন্তু হরিপদর চোখে তাতে ফিরে আসে বেঁচে থাকার নতুন রোদ। সায়ন্তন জানে না, এই ছোট ছোট অর্ডারই হয়তো দিনের পর দিন বাঁচিয়ে রাখে প্রেসটাকে। তিনি শিবুকে ডাকেন, “দেখ, টাইপগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা,” আর নিজের হাতে কাগজের রিম খুলে ছুঁয়ে দেখেন, যেন প্রতিটি পাতার সঙ্গে মিশিয়ে নেন নিজের হৃদয়ের স্পর্শ। লিনোটাইপের হ্যান্ডেল ঘোরানোর সময় অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করেন হরিপদ, যা কোনো ল্যাপটপের স্ক্রিনে পাওয়া যায় না। সেই ধাতব শব্দ, লোহার ঘর্ষণ, আর কালির গন্ধ মিলে তৈরি হয় এক অনন্ত সঙ্গীত—যেখানে হারিয়ে যাওয়া সময়ের সুর বাজে। বাইরে রোদ পড়ছে, পাখিরা ডাকছে, কিন্তু ছাপাখানার ভেতর সেই লিনোটাইপের আওয়াজই হরিপদর কাছে জীবনের আসল সঙ্গীত, যা শুনে তিনি আবার মনে মনে বলেন, “আমি এখনো হেরে যাইনি।” আর অদূরেই শিবু বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে, কিভাবে এক বৃদ্ধ মানুষের হাতে অক্ষর থেকে তৈরি হয় গল্প, আর সেই গল্প থেকেই বাঁচে ছাপাখানার প্রাণ। সেই লিনোটাইপের আওয়াজেই হয়তো লুকিয়ে আছে বসু প্রেসের ভবিষ্যৎ, যেটা হয়তো একদিন নতুন প্রজন্মও শুনতে শিখবে।
(৪)
রোদ পড়তে পড়তে ছাপাখানার ভেতরে ছায়া লম্বা হয়ে আসছে, সেই ছায়ার ফাঁকে একদিন প্রথম পা রাখে নন্দিনী—হাতের ব্যাগে নোটবুক, কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা আর চোখে কৌতূহলের ঝিলিক। দরজার ঘণ্টা বেজে ওঠার পর তার ঢোকার ভঙ্গিতেই বোঝা যায়, সে শুধু সংবাদ করতে আসেনি; যেন এই ধুলো, কালি আর লোহার গন্ধের মধ্যে কিছু একটা খুঁজতে এসেছে, যা হয়তো আজকের শহরের মানুষ ভুলে গেছে। হরিপদ তাকিয়ে থাকেন, এই প্রথম দেখাতেই মনে হয়, এই মেয়ের চোখে আছে সেই জিজ্ঞাসু আলোর ছটা, যা মানুষকে শুধু খবরের জন্য নয়, গল্পের জন্যও আগ্রহী করে তোলে। নন্দিনী নিজের পরিচয় দেয়—একটি ছোট পত্রিকায় কাজ করে, পুরনো শহরের হারিয়ে যাওয়া শিল্প আর কারিগরদের নিয়ে ফিচার লিখছে। তার গলায় এমন এক আন্তরিকতা রয়েছে যে হরিপদের ভেতরের সন্দেহও কিছুটা গলে যায়, আর তিনি লাজুক হাসিতে বলেন, “এসো মা, বসো”—যেন এক মেয়েকে বসতে দিচ্ছেন, যাকে কোনোদিন দেখেননি, তবু অচেনা লাগে না।
নন্দিনী চুপচাপ চারপাশে তাকায়, দেয়ালের পুরনো ফ্রেমে আটকানো হরিপদের বাবার ছবি, লিনোটাইপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিবু, আর কমলা দিদির হাতে কালি লেগে থাকা আঙুল দেখে তার চোখে কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা শ্রদ্ধা। সে হরিপদর কাছে জানতে চায়, এই প্রেসের ইতিহাস, কীভাবে শুরু, কীভাবে এত বছর টিকে থাকা, আর এখন কেমন সময় যাচ্ছে। হরিপদ প্রথমে কিছুটা সংকোচে থাকলেও ধীরে ধীরে খুলে যান—বাবা কীভাবে ছোট পুঁজিতে এই প্রেস শুরু করেছিলেন, কেমন করে স্বাধীনতার পর থেকে পুজোর স্মারক, কবিতার বই, স্কুল ম্যাগাজিন ছাপা শুরু হয়েছিল, আর সেইসব দিনে অর্ডারের ভিড় কেমন রাত জাগিয়ে রাখত কর্মীদের। কথা বলতে বলতে হরিপদর চোখের কোণে জল চলে আসে, আর নন্দিনী নোট নিতে নিতে থমকে যায়, যেন বুঝতে পারে এই প্রেস শুধু এক ব্যবসা নয়, এটা আসলে একটুকরো শহরের হারানো ইতিহাস, যা কালি আর কাগজে লুকিয়ে আছে। শিবু সেই সময় লিনোটাইপের পিতলের অক্ষরগুলো দেখিয়ে দেয়, আর নন্দিনীর বিস্ময় বেড়ে যায়—সে হাত দিয়ে স্পর্শ করে অক্ষরগুলো, যেন সেই ছোঁয়ার মধ্যে অনুভব করতে চায় শতকেরও বেশি সময় ধরে গড়ে ওঠা মানুষের গল্প।
সন্ধ্যার দিকে সায়ন্তনও এসে পৌঁছায়, আর বাবার পাশেই দাঁড়িয়ে পড়ে; নন্দিনী তাকে দেখে হেসে বলে, “আপনিই সায়ন্তন? আমি শুনেছি আপনি নতুন কিছু করতে চাইছেন?” সায়ন্তনও হাসে, গলা কিছুটা দ্বিধায় বেঁধে যায়, তবু বলে ওঠে, “হ্যাঁ, আমি ভাবছি আধুনিক মেশিন আনবো, ডিজিটাল প্রিন্ট শুরু করবো, যাতে অর্ডার বাড়ে।” নন্দিনী মাথা নেড়ে বলে, “নতুন তো প্রয়োজনই, কিন্তু পুরনোটাকেও তো বাঁচিয়ে রাখা দরকার, তাই না?” সেই কথায় সায়ন্তন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে; হয়তো তারও মনে হয়, এ মেয়েটা কেবল ব্যবসার কথা বুঝতে আসেনি, বরং বোঝে এই দেয়ালগুলোর কাহিনি। বাইরে তখন আলো মিলিয়ে গিয়েছে, লিনোটাইপের পাশে রাখা একটিমাত্র টেবিল ল্যাম্পের আলোয় ভেসে ওঠে ধুলোবালি, আর সেই আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা এই তিন প্রজন্মের মানুষ—হরিপদ, তার ছেলে সায়ন্তন আর অচেনা নন্দিনী—যেন তিনজনের চোখে ভিন্ন স্বপ্ন, ভিন্ন ভয়, তবু কোথাও একটা অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। ছাপাখানার বাতাসে ছড়ায় কালি আর মানুষের গল্পের গন্ধ, আর সেই গন্ধের মধ্যেই হয়তো নন্দিনী পেয়ে যায় তার খুঁজে ফেরা গল্পের সূত্র—একটা হারাতে বসা শিল্প, এক বাবা আর ছেলের দ্বন্দ্ব, আর কিছু মানুষের নিরন্তর লড়াই বাঁচিয়ে রাখার জন্য যা শুধু অক্ষর নয়, জীবনও।
(৫)
পরের দিন ছাপাখানায় সকাল থেকেই অদ্ভুত এক চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে থাকে, যেন কিছু একটা বদলানোর বাতাস লেগেছে দেয়ালে দেয়ালে; সেই বাতাসের স্রোত নিয়ে আসে সায়ন্তন, যাকে দেখে মনে হয় সে রাতের ঘুম হারিয়ে ফেলেছে নানা ভাবনায়, আবার চোখে রয়েছে একরাশ দৃঢ়তা। হরিপদ তখনও লিনোটাইপের কাছে দাঁড়িয়ে, অক্ষরের বাক্সের ধুলো ঝাড়ছেন, যেন নিজের ভিতরের অস্থিরতাটাকেও ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন; কিন্তু সায়ন্তনের চোখে সেই দৃশ্য পড়ে না, কারণ তার চোখ এখন ভবিষ্যতের দিকে, ল্যাপটপের পর্দায় ঝলমলে প্রেজেন্টেশন আর নতুন মেশিনের ছবি নিয়ে। কমলা দিদি দূর থেকে সব দেখেন, তিনি বোঝেন না ব্যবসার খুঁটিনাটি, কিন্তু বোঝেন এই প্রেসকে কেন্দ্র করেই এই পরিবার টিকে আছে; আর শিবু একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে, তার কিশোর চোখে নতুন আর পুরনোর টানাপোড়েন জেগে ওঠে, যেটা হয়তো সে এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারে না। সায়ন্তন শুরু করে, “বাবা, আমি সব ভেবেছি—একটু ইনভেস্ট করলে নতুন ডিজিটাল প্রিন্টিং মেশিন আনতে পারি, অফসেট প্রেস বসাতে পারি, ওয়েবসাইট খুলে অনলাইন অর্ডার নিতে পারি; শুধু তাই নয়, ফেসবুক আর ইন্সটাগ্রামে পেজ চালালে আমাদের কাজ অনেক মানুষের কাছে পৌঁছাবে।” তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, কথার সঙ্গে হাতের ভঙ্গিতে বোঝায় সে কেবল কল্পনা করছে না, পুরো পরিকল্পনা তৈরি।
হরিপদ প্রথমে কিছু বলে না; চোখ নামিয়ে লিনোটাইপের গায়ে হাত বুলিয়ে নেন, তারপর বলে, “তুই বুঝেছিস বোধহয়, এই মেশিনগুলো তো শুধু মেশিন নয় রে… এখানে মানুষের গল্প ছাপা হয়, মানুষের স্পর্শ থাকে, সেটা কি থাকবে তোর ওই নতুন মেশিনে?” সায়ন্তন এক মুহূর্ত থেমে গিয়ে আবার বলে, “বাবা, আমি জানি তোমার অনুভূতি, কিন্তু কাস্টমারদের দেখো—they don’t care! ওরা চায় দ্রুত, সস্তা আর ঝকঝকে প্রিন্ট। আমাদের যদি টিকে থাকতে হয়, এই পরিবর্তন দরকার।” কথার মধ্যে যেন লেগে থাকে একরাশ বিরক্তি, যেন বাবাকে না বুঝিয়ে পারলে সে নিজেকেই ব্যর্থ মনে করবে। সেই সময় নন্দিনীও আসে, তার কাঁধে সেই পরিচিত ব্যাগ, মুখে হালকা হাসি, আর চোখে সেই আগ্রহের দীপ্তি। সায়ন্তন তাকিয়ে বলে, “তুমি বুঝতে পারছো না? শুধু ইতিহাস দিয়ে তো ব্যবসা চলে না!” নন্দিনী চুপচাপ শোনে, তারপর ধীরে বলে, “আমি বুঝি ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দরকার, কিন্তু ভাবো তো, এই পুরনো লেটারপ্রেস, এই লিনোটাইপ—এগুলো আমাদের শহরের ইতিহাসের অংশ। নতুন আনবে, ভালোই হবে, কিন্তু পুরনোটাকে ফেলে দিলে শুধু এক দোকান নয়, এক টুকরো সময়কেও হারিয়ে ফেলবে।” সেই কথায় সায়ন্তন কিছুটা থমকে যায়, চোখে একটুখানি দ্বিধা আসে; কিন্তু পরমুহূর্তেই বলে ওঠে, “তাহলে কী করব? নতুন না আনলে তো এই প্রেস একদিন বন্ধ হয়ে যাবে!”
এই কথাগুলো শুনে হরিপদের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যায়, মনে হয় নিজের ছেলে তার স্বপ্নটাকেই অস্বীকার করছে; কিন্তু চোখে জল আসা আটকাতে গিয়ে গলার স্বর শক্ত করে বলেন, “দেখ, নতুন আনিস, আমি বারণ করছি না, কিন্তু তোর এই লিনোটাইপ, এই লেটারপ্রেস—এগুলো ফেলে দিস না। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে শুধু আমি না, অনেক মানুষের স্মৃতি, অনেক গল্পও মুছে যাবে।” কমলা দিদির মুখেও চিন্তার ছাপ পড়ে, তিনি বলেন, “সায়ন্তন, তোর বাবা যা বলছে, সেটা ভেবেচিন্তে করিস বাবা; নতুন আসুক, কিন্তু পুরনোটাকেও জায়গা দে।” সেই সময় শিবু হঠাৎ বলে ওঠে, “আমি শিখতে চাই কাকুর কাছে, কিভাবে অক্ষর বসায়, কিভাবে লেটারপ্রেস চলে!” সবার চোখ যায় ছেলেটার দিকে, যার কাঁচা কণ্ঠে নতুন আর পুরনোর মধ্যে সেতু গড়ার ইচ্ছে। সায়ন্তন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে, “বাবা, আমি ভাববো… আমরা একসাথে কিছু একটা করব, যাতে নতুনও থাকে, আর পুরনোটাও মরে না।” সেই মুহূর্তে নন্দিনীর মুখে ছোট্ট একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, আর হরিপদ গভীর নিশ্বাস নিয়ে জানালা দিয়ে রোদেলা আকাশের দিকে তাকান, যেন বুঝতে চেষ্টা করেন এই নতুন যুগের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছাপাখানার অক্ষরের গন্ধটাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আর সেই চাপা আলো-আঁধারিতে বসু প্রেসের দেয়ালে দেয়ালে যেন শোনা যায় একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস, একটুখানি আশার শব্দ—যা বলে, “এ গল্প হয়তো এখানেই শেষ নয়।”
(৬)
পরের কয়েক দিন বসু প্রেসের ভেতর এক অদ্ভুত রকমের নীরব ব্যস্ততা দেখা যায়—সায়ন্তন আর হরিপদ যেন দুই ভিন্ন নদীর মতো চলতে চলতে একটা মোহনার দিকে এগোচ্ছে, যেখানে পুরনো স্মৃতি আর নতুন পরিকল্পনা একসাথে মেশার চেষ্টা করছে। সায়ন্তন একদিকে ল্যাপটপে বসে সম্ভাব্য কাস্টমারের লিস্ট বানাচ্ছে, ডিজাইন সফটওয়্যার শিখছে, আর অন্যদিকে হরিপদ নিজের হাতে লিনোটাইপে অক্ষর বসাচ্ছেন, যেন প্রমাণ করতে চাইছেন, ‘এখনো আমি পারি’। শিবু কখনো বাবার দিকে, কখনো কাকুর দিকে তাকিয়ে শিখছে অক্ষরের প্রেম আর কম্পিউটারের খেলা—তার চোখেই যেন ভবিষ্যতের বীজ বোনা হচ্ছে। সেই ব্যস্ত সময়ের মধ্যে একদিন ভোরে আসে এক স্কুলের অর্ডার—বার্ষিক ম্যাগাজিন, পঞ্চাশ কপি, খুব বড় না হলেও হরিপদর কাছে এই অর্ডার স্বস্তির নিঃশ্বাসের মতো। ফোনে কথা বলার পর তিনি আনন্দে বললেন, “দেখলি? এখনো মানুষ আমাদের বিশ্বাস করে।” সায়ন্তনও হাসল, যদিও তার চোখে ভাবনা—যদি ডিজিটাল মেশিন থাকত, অর্ডারটা আরো বড় হতে পারত। কিন্তু বাবার হাসিটা দেখে সে আর কিছু বলে না, শুধু ল্যাপটপের পর্দায় চোখ রাখে, যেন নিজের মতো করে নতুন স্বপ্ন আঁকছে।
সকালে কাজ শুরু হয়, হরিপদ নিজের হাতে টাইপ সেট করেন, কমলা দিদি কাগজ গুনে রাখেন, আর শিবু কৌতূহলে দেখে—কীভাবে একটি একটি অক্ষর মিলে গড়ে ওঠে বাক্য, বাক্য থেকে পৃষ্ঠা, আর পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সেই ধাতব অক্ষরগুলোর গায়ে লেগে থাকে কালি, আর সেই কালি শুকিয়ে গিয়ে হয়ে যায় মানুষের স্মৃতি। এই দৃশ্যটা শিবুর কাছে জাদুর মতো, আর হরিপদর কাছে জীবনের মানে। কিন্তু সেই জাদু ভেঙে যায় দুপুরের ঠিক আগে, যখন লিনোটাইপের হ্যান্ডেল ঘোরাতে গিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ হয়—ধাতব ঘর্ষণের, ভাঙনের। হরিপদর বুকের ভেতর কেঁপে ওঠে, ঘাম ছুটে যায়। তিনি মেশিন থামিয়ে পরীক্ষা করেন, কমলা দিদি শঙ্কিত মুখে তাকিয়ে থাকে, শিবুর মুখে ভয়। কিন্তু পুরনো যন্ত্র, বহু বছর ধরে চলতে থাকা লোহার শরীর, শেষমেশ হেরে যায় সময়ের কাছে—মেশিন আর চলে না। হরিপদর কণ্ঠে কান্না লুকানো একরাশ ক্লান্তি মিশে যায়, “আরেকবার চেষ্টা করি”—কিন্তু মেশিনের নিঃশব্দ জবাব বোঝায়, সে আর পারবে না।
অর্ডার বাতিল হয়, স্কুল থেকে ফোন আসে—“আমরা দেরি সহ্য করতে পারব না, অন্য প্রেসে দিতে হচ্ছে।” ফোন রাখার পর হরিপদ নিঃশব্দে বসে থাকেন লিনোটাইপের পাশে, যেন নিজের হৃত্তপিণ্ডের স্পন্দন থেমে গেছে। সায়ন্তন ধীরে কাছে আসে, কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়; বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে সেই ভাঙা বিশ্বাস, যেটা কোনো যুক্তি দিয়ে ভরিয়ে তোলা যায় না। কমলা দিদির চোখে জল, শিবু দূর থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সেই নিঃশব্দ ভিড়ে যেন শুনতে পাওয়া যায় লিনোটাইপের ভেতরে ভাঙা চাকার কান্না, শূন্য প্রেসের ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে ওঠে হরিপদর দীর্ঘশ্বাস। সায়ন্তন মনে মনে ভাবে, “এটাই প্রমাণ, নতুন দরকার”—কিন্তু গলায় সেই কথাগুলো উচ্চারণ করতে পারে না; বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝে, এই ব্যথার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এখন আর কিছু করার নেই। আর সেই সন্ধ্যায় বসু প্রেসের অন্ধকারে কেবল থেকে যায় লিনোটাইপের স্তব্ধতা, ছাপাখানার বাতাসে মিশে যায় হেরে যাওয়ার গন্ধ, আর মানুষের গল্পের অসমাপ্ত অক্ষরগুলো নীরবে চেয়ে থাকে সেই মানুষের দিকে, যে এতকাল ধরে তাদের প্রাণ দিয়েছিল।
(৭)
সেই রাতে ছাপাখানার ভেতর অদ্ভুত এক নিঃশব্দতা নেমে আসে, যেন দেয়ালের গায়ে আঁকা পুরনো কাগজগুলোও কথা বলতে ভুলে গেছে, লিনোটাইপের স্তব্ধ লোহার চাকা থেকে ধুলো ঝরে পড়ে আর তার শব্দটুকুও বড্ড বেশি স্পষ্ট মনে হয়। হরিপদ বসু একা বসে থাকেন অন্ধকারের মধ্যে, জানালার বাইরে স্ট্রিট লাইটের আলো এসে পড়ে তার ক্লান্ত মুখে, তবু চোখের ভেতর কোথাও একরাশ আলোর টুকরো এখনো জ্বলছে। মনে পড়ে যায় কত শত রাতের কথা, যখন বাবা তাকে হাতে ধরে টাইপ শিখিয়েছিলেন, কেমন করে প্রতিটি অক্ষরকে একটুকরো জীবনের মতো যত্নে বসাতে হয়, আর সেই অক্ষরগুলো দিয়ে তৈরি হয় মানুষের গল্প, হাসি-কান্না আর লড়াইয়ের ইতিহাস। আজ সেই মেশিনটা থেমে গেছে, স্কুলের অর্ডার বাতিল হয়েছে, কিন্তু হরিপদর মনে হয়, থেমে যাওয়া মানেই শেষ নয়। তবু বুকের গভীরে কেমন শূন্যতা বাসা বাঁধে, মনে হয়, এই লিনোটাইপটা তো শুধু এক টুকরো লোহা নয়—এ যেন তার মনের অংশ, আর সেই অংশটাই আজ নীরবে কাঁদছে।
ওই সময়েই সায়ন্তন চুপচাপ আসে, বাবার পাশে বসে, অনেকক্ষণ কিছু বলে না—শুধু বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে ক্লান্তির রেখার মধ্যে মিশে আছে একরাশ জেদ আর অদম্য ভালোবাসা। “বাবা, মেশিনটা তো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে,” আস্তে বলে সে, গলায় দ্বিধা আর দায়িত্বের ভার। হরিপদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “জানি রে, তবে সব মেশিনই একদিন থামে, কিন্তু মানুষ যদি হেরে যায়, তখনই শেষ।” ছেলের চোখে একটুখানি অশ্রু চিকচিক করে, সে চুপচাপ বলে, “বাবা, আমরা নতুন মেশিন আনবো, তুমিও শিখবে ডিজিটাল সেটআপ, কিন্তু লিনোটাইপটাকেও ফেলে দেব না, ওটাকে ঠিক করার চেষ্টা করবো, অন্তত যতটুকু পারি।” বাবার চোখে সেই কথায় ক্ষীণ এক আশার আলো জ্বলে ওঠে, যেন মনে হয় সব কিছু হয়তো একসাথে বাঁচানো যাবে। সেই সময় শিবুও এসে দাঁড়ায়, কিশোর মুখে ভর করে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা, বলে, “কাকু, আমিও শিখতে চাই সব কিছু, নতুন আর পুরনো দুইটাই।” হরিপদর চোখে জল আসে, এই প্রথম তার মনে হয়, হয়তো এই ছেলেটার হাত ধরে প্রেসের গল্পটা একদিন নতুন করে লেখা হবে।
রাত বাড়তে থাকে, ছাপাখানার ভেতর লিনোটাইপের পাশেই তিনটি প্রজন্মের মানুষ বসে থাকে, বাইরে থেকে ভেসে আসে দূর গলির কুকুরের ডাক, আর জানালায় স্ট্রিট লাইটের আলোতে ধুলো উড়ে ওঠে। কমলা দিদি চুপচাপ চা এনে দেয়, তিনজনেই একসাথে বসে সেই গরম চা খায়, কারোর মুখে কোনো কথা নেই, তবু মনে হয় এই নীরবতায়ই সবচেয়ে গভীর কথা বলা হয়ে যাচ্ছে। হরিপদ মনে মনে ভাবে, “হয়তো নতুনের সঙ্গে লড়াই করতে হবে, কিন্তু হারতে হবে না,” আর সায়ন্তন ভাবে, “বাবাকে বোঝাতে হবে যে নতুন মানেই পুরনোকে মুছে ফেলা নয়।” শিবুর চোখে সেই রাতের ছায়া আর আলো মিলে তৈরি হয় একরাশ স্বপ্ন, যেটা শুধু অক্ষরের নয়, সম্পর্কেরও। আর সেই নীরব রাতের কথা যেন দেয়ালের ফাটলে, ধুলো জমা অক্ষরের খোপে, আর লিনোটাইপের স্তব্ধ চাকার মধ্যে লিখে যায় এক অদৃশ্য অক্ষরে—যে গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
(৮)
ভোরের আলো ছাপাখানার কাঁচের জানালায় এসে পড়তেই এক নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে, আর সেই আলোয় লিনোটাইপের কালো লোহার গায়ে ঝিলিক ধরে, যেন মেশিনটিও বলে ওঠে—আমি এখনো আছি। হরিপদ বসু খুব ভোরেই প্রেসে চলে আসেন, চোখে অদ্ভুত এক শান্তি আর মনে অগোছালো চিন্তার ঢেউ। পুরো রাতটা যেন কাটিয়েছেন অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু খুঁজে; জানালার বাইরের আকাশ লালচে হতে হতে ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে যায়, আর হরিপদর বুকের ভেতরের অন্ধকারও যেন খানিকটা সরতে থাকে। শিবুও খুব সকালেই এসে পৌঁছায়, চোখে ঘুম আর কৌতূহলের মিশেল, মুখে সেই নির্ভেজাল বিশ্বাস যা কেবল নতুনের কাছে থাকে। হরিপদ মুচকি হেসে বলে, “আজ থেকে তোকে শিখতে হবে অক্ষরের ছন্দ,” আর শিবুর মুখে ফুটে ওঠা হাসিটা দেখে হরিপদর মন ভরে যায়—যেন সেই লড়াইটা একা নয়, আর তার পাশে দাঁড়িয়েছে ভবিষ্যতের একজন উত্তরাধিকারী। কাগজের রিম, টাইপের বাক্স আর লিনোটাইপের স্তব্ধ শরীর—সব মিলিয়ে প্রেসটা যেন আবার নিঃশ্বাস নিতে শেখে, আর সেই নিঃশ্বাসেই ভেসে আসে নতুনের গন্ধ আর পুরনোর শেকড়ের শক্তি।
এমন সময় সায়ন্তন হাতে ল্যাপটপ আর কাগজের ফাইল নিয়ে আসে, চোখে জেগে থাকা রাতের ক্লান্তি, কিন্তু কণ্ঠে দৃঢ়তার ছাপ। “বাবা, একটা আইডিয়া হয়েছে,” সে বলে, “আমরা শুধু নতুন মেশিন আনবো না, পাশাপাশি এই লেটারপ্রেস আর লিনোটাইপকে ঘিরে একটা heritage printing service চালু করতে পারি। স্কুল, কলেজ আর ছোট পত্রিকা যারা এখনো লেটারপ্রেসে ছাপাতে চায়, তাদের জন্য স্পেশাল অফার; আর ট্যুরিস্টদের জন্য ওয়ার্কশপ—যেখানে ওরা নিজের হাতে অক্ষর বসিয়ে দেখতে পাবে।” হরিপদ বিস্ময়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন, যেন এই ছেলেটিই প্রথমবার বাবার স্বপ্নকে নিজের মতো করে বুঝতে পেরেছে। সায়ন্তন বলে চলে, “আমরা ওয়েবসাইটে heritage printing-এর আলাদা সেকশন রাখব, ফেসবুকে ভিডিও দেব, যাতে মানুষ দেখতে পায় লিনোটাইপ কিভাবে কাজ করে। নতুন ডিজিটাল মেশিনে কমার্শিয়াল অর্ডার হবে, কিন্তু এই লেটারপ্রেস দিয়ে ছাপা হবে স্মারক, কবিতার বই, ছোট ম্যাগাজিন। পুরনোটাকে আর ফেলে দিতে হবে না বাবা।” কথাগুলো বলতে বলতে সায়ন্তনের গলায় খানিকটা আবেগ জমে ওঠে, যেন সে বোঝাতে চায়, “আমি সত্যিই চাই তুমি খুশি হও।” আর হরিপদর মনে হয়, এতদিন পরে হয়তো এই ছেলেটার মধ্যে সেই ছোট্ট সায়ন্তনকে দেখতে পাচ্ছেন, যে একদিন বাবার হাত ধরে টাইপ শিখতে চেয়েছিল।
বাইরে তখন সকাল পুরোপুরি নেমে এসেছে, পাখির ডাক আর রোদ মিলে বসু প্রেসের ভেতরে ঢুকে পড়ে, যেন দেয়ালের ফাটলেও আলো গিয়ে লুকায়। নন্দিনীও এসে দাঁড়ায় দরজায়, চোখে সেই অদম্য কৌতূহল আর একরাশ আনন্দের ঝিলিক—সে বলে, “আমি এই গল্পটা লিখব, মানুষকে জানাবো কিভাবে এক ছাপাখানা শুধু মেশিন নয়, এক টুকরো ইতিহাস, যেখানে নতুন আর পুরনো একসাথে বাঁচতে শিখছে।” হরিপদ হাসেন, চোখে জল চলে আসে, আর শিবুর মাথায় হাত রাখেন—যেন এই নতুন সকাল শুধু ব্যবসার নয়, সম্পর্কেরও পুনর্জন্ম। সায়ন্তন লিনোটাইপের পাশে দাঁড়িয়ে ধীরে বলে, “বাবা, চল আমরা একসাথে শুরু করি,” আর সেই কথার মধ্যে লুকিয়ে থাকে এক প্রজন্মের ক্ষমা চাওয়া, বোঝাপড়া আর স্বপ্নের হাত ধরা। হরিপদ মেশিনের গায়ে হাত বুলিয়ে বলেন, “চল, শুরু হোক নতুন সকাল”—আর সেই সকালেই লিনোটাইপের স্তব্ধ শরীরের ভেতর যেন একটুখানি প্রাণ ফিরে আসে, যেন গল্পটা এখনো শেষ হয়নি, বরং ঠিক এখানেই নতুন করে শুরু হচ্ছে।
(৯)
নতুন পরিকল্পনা শুরু হতেই বসু প্রেসের ভেতর যেন উৎসবের রঙ লেগে যায়—ধুলো আর কালি মুছে ফেলা পুরনো দেয়ালে যেন নতুন আলোর রেখা আঁকে, লিনোটাইপের স্তব্ধ শরীরকেও ধুয়ে-মুছে সাজিয়ে তোলা হয়, আর শিবুর চোখে সেই জাদুর স্পর্শ পেয়ে যায় নতুন প্রজন্মের কৌতূহল। সায়ন্তন নিজের ল্যাপটপে বসে তৈরি করে heritage printing-এর পেজ, ছবির সঙ্গে যোগ করে লিনোটাইপের ছোট্ট ভিডিও, যেখানে হরিপদ নিজেই দেখাচ্ছেন কীভাবে অক্ষর বসানো হয়; সেই ভিডিওতে হরিপদের চোখে লুকোনো গর্ব আর ভালোবাসা দেখে অনেকেই মন্তব্য করে—“এটাই তো আসল শিল্প।” কমলা দিদিও ব্যস্ত হয়ে ওঠেন, কাগজের রিম গুনে রাখেন, নতুন অর্ডারের হিসাব লিখে রাখেন, আর মাঝে মাঝে শিবুকে বলেন, “বুঝলি, এই প্রেসটা শুধু দোকান নয়, এইটাই আমাদের পরিবার।” বাইরে তখন বাতাসে উৎসবের গন্ধ, শীতের সকালে রোদ এসে পড়ে লিনোটাইপের লোহার গায়ে, আর সেই আলোয় হরিপদর হাতের স্পর্শে অক্ষরগুলো যেন নতুন প্রাণ পায়।
সেই সময়েই আসে নতুন অর্ডার—একটি ছোট কবিতার বই, লেখক নিজেই বলেন, “আমি শুধু লেটারপ্রেসেই ছাপাতে চাই, কারণ সেই কালি আর অক্ষরের গন্ধটায় আলাদা প্রেম আছে।” হরিপদের মুখে লুকানো হাসিটা দেখে সায়ন্তনও মৃদু হেসে ফেলে, বুঝতে পারে, এই ছোট্ট অর্ডারেই লুকিয়ে আছে বেঁচে থাকার বড় স্বপ্ন। আরেকদিন আসে একদল কলেজের ছাত্রছাত্রী, যারা heritage printing দেখতে চায়; শিবু তাদের দেখায় কীভাবে অক্ষর বসানো হয়, আর হরিপদ ধীরে ধীরে বোঝায়—“এটা শুধু ছাপা নয়, এ একরকম সাধনা।” ছেলেমেয়েগুলো মোবাইলে ভিডিও তোলে, ছবি তোলে, আর কেউ কেউ বলে, “এ রকম জিনিস আমরা আগে কখনো দেখিনি।” সেই কথা শুনে হরিপদের মনে হয়, এই গল্পটা হয়তো এখানেই থামবে না, বরং এভাবেই ছড়িয়ে যাবে একের পর এক মানুষের মনে। সায়ন্তনও বুঝতে শেখে—বাবার হাতে গড়া অক্ষরের কষ্টের মূল্য টাকা দিয়ে মাপা যায় না, আর নন্দিনী নিজের লেখায় বসু প্রেসের গল্প ছাপিয়ে দেয় শহরের মানুষের মনে।
একদিন রাতে কাজ শেষ করে তিনজন একসাথে বসে চা খায়—হরিপদ, সায়ন্তন আর শিবু। লিনোটাইপের পাশেই সেই চায়ের কাপ রেখে হরিপদ বলেন, “তুই জানিস, একেকটা অক্ষর শুধু লোহা নয়, এগুলো মানুষের স্বপ্ন বয়ে আনে,” আর সায়ন্তন মাথা নেড়ে বলে, “আজ বুঝতে পারছি বাবা।” শিবুর চোখে জ্বলজ্বল করে সেই অদ্ভুত আগ্রহ, যা নতুনকে শিখতে শেখায়, আর পুরনোকে ভালোবাসতে শেখায়। কমলা দিদি দূর থেকে তাকিয়ে বলেন, “দেখেছিস? অক্ষরেরও উৎসব হয়।” সেই মুহূর্তে মনে হয়, এই ছোট্ট ছাপাখানা এখন আর শুধু এক দোকান নয়, বরং নতুন-পুরনোর মিলনে গড়ে ওঠা এক পরিবার, এক গল্পের আখ্যান, যেখানে প্রতিটি অক্ষর আর মানুষের হাতের ছোঁয়া মিলে লিখে যায় সেই উৎসবের ভাষ্য—যা কোনও দিন শেষ হবে না, বরং থেকে যাবে মানুষের মনে, কালি আর কাগজের গন্ধে, আর বসু প্রেসের নিঃশ্বাসে।
(১০)
শীতের শেষ বিকেলে বসু প্রেসের ভেতরে রোদ ঢুকে পড়ে সেই চিরচেনা জানালা দিয়ে, আর লিনোটাইপের স্তব্ধ লোহার গায়ে ধুলো জমে থাকা অক্ষরগুলোকে নতুন আলোয় দেখা যায় যেন তারা এখনো বাঁচতে চায়। হরিপদ বসু মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে বলেন, “তুই আমায় অনেক কিছু শিখিয়েছিস,” আর মনে মনে স্বীকার করেন, এই অক্ষরগুলো শুধু ছাপাখানার নয়, তার নিজের জীবনেরও মেরুদণ্ড। বাইরে তখন সায়ন্তন এক কলেজের গ্রুপকে দেখাচ্ছে কিভাবে heritage printing হয়, শিবু পাশে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে শিখছে আর শোনাচ্ছে কাহিনি—যেমন, একবার কিভাবে এক কবিতা ছাপতে গিয়ে মাঝরাতে মেশিন নষ্ট হয়েছিল, আর কেমন করে হরিপদ কাঁপা হাতে ঠিক করেছিলেন। কলেজের ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে শোনে, মোবাইলে ছবি তোলে, আর তাদের চোখে সেই বিস্ময় দেখে হরিপদ বুঝতে পারেন, নতুন প্রজন্মও গল্প ভালোবাসে, শুধু তাকে পৌঁছে দিতে হয় সঠিক ভাষায়। সেই ভাষা কাগজের নয়, সম্পর্কের, স্পর্শের আর অক্ষরের গন্ধের; এই গন্ধ কখনও মুছে যায় না, যতই ডিজিটাল জগত বড় হোক।
নন্দিনীও আবার এসেছে, হাতে নোটবুক আর ক্যামেরা, চোখে সেই চিরন্তন কৌতূহল যা মানুষকে গল্পকার করে তোলে। সে হরিপদকে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কি কখনো ভেবেছিলেন একদিন আপনার প্রেসের গল্প এত মানুষের কাছে পৌঁছাবে?” হরিপদ মৃদু হেসে বলেন, “না, তবে সব অক্ষরই একদিন গল্প হয়, শুধু সময় লাগে।” নন্দিনী সেই কথায় মাথা নাড়ে, আর মনে মনে ভাবে, এই প্রেস শুধু মেশিনের নয়, মানুষের; এখানে হারানো চিঠি, অজানা কবিতা আর কষ্টের উপাখ্যান মিলিয়ে তৈরি হয় এক অদ্ভুত সঙ্গীত, যা কেবল ছাপা শব্দের মধ্যে বেঁচে থাকে না, ছাপাখানার দেয়াল, জানালা আর ধুলোতেও লুকিয়ে থাকে। সায়ন্তন পাশ থেকে বলে ওঠে, “নতুন মেশিন আসছে আর দুই দিনে, তারপর heritage printing আর ডিজিটাল—দুটোই চলবে সমানভাবে।” হরিপদ তাকিয়ে বলেন, “ভালোই করেছিস বাবা, নতুনকে ভয় পেলে চলবে না, তাকে কাছে টেনে আনতে হয়।” সায়ন্তনের চোখে সেই কথায় ভরে ওঠে গর্ব, যেন বাবার কাছ থেকে অনুমোদন পেয়েই তার সব দ্বিধা দূর হয়ে যায়।
সন্ধ্যা নামে, লিনোটাইপের ধাতব গায়ে আলোর রঙ বদলে যায়, আর বসু প্রেসের ভেতরে ছায়া লম্বা হতে হতে মিলিয়ে যায় অন্ধকারে। সেই অন্ধকারেও লুকিয়ে থাকে গল্পের শেষ পৃষ্ঠা, যা আসলে কখনো শেষ হয় না। হরিপদ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকান, মনে হয় কত গল্প এ বাড়ির অজানা দেয়ালে লুকিয়ে আছে, আর একদিন সেই গল্পই নতুন প্রজন্মকে বাঁচতে শেখাবে। শিবু লিনোটাইপের পাশে দাঁড়িয়ে মেশিনের গায়ে হাত রাখে, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, “আমি শিখব, আমি এ গল্পটা বাঁচিয়ে রাখব।” নন্দিনী ক্যামেরা নামিয়ে হাসে, আর তার চোখে সেই হাসি যেন বলে দেয়—গল্প এখনো বাকি আছে। সায়ন্তন বাবার দিকে তাকিয়ে আস্তে বলে, “বাবা, এটাই তো আসল কথা—শেষ পৃষ্ঠাই আসলে নতুন গল্পের শুরু।” আর বসু প্রেসের নিঃশব্দ অক্ষরগুলো যেন নীরবে সম্মতি জানায়, কারণ অক্ষরের জীবনে সত্যিই কোনো শেষ নেই, শুধু নতুন করে লেখা আর বাঁচার গল্প থাকে প্রতিটি পাতায়।
***
বছরখানেক পরে বসু প্রেসের সামনে দিয়ে হাঁটলে এক নতুন দৃশ্য চোখে পড়ে—পুরনো লাল ইটের দেয়ালে ঝুলছে একটি ছোট্ট সাইনবোর্ড, তাতে লেখা ‘Basu Press – Heritage & Digital Printing’ আর তার নিচে ছোট অক্ষরে ‘Stories Printed Here Since 1946’। সেই সাইনবোর্ডের নিচ দিয়ে গেলে এখনো কালি, ধুলো আর পুরনো কাগজের গন্ধ পাওয়া যায়, আর ভেতরে ঢুকলে দেখা যায় দু’জগতের আশ্চর্য মেলবন্ধন—একদিকে নতুন কম্পিউটার, ডিজিটাল প্রিন্টারের শব্দ, আর অন্যদিকে লিনোটাইপের পাশে ধুলো ঝেড়ে রাখা পিতলের অক্ষরের বাক্স, যেগুলো এখনো স্পর্শে গরম হয়, আর স্পর্শেই জেগে ওঠে। হরিপদ বসু চুলে পাক ধরা সেই চিরপরিচিত হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেন, কিভাবে তার ছেলে সায়ন্তন স্বপ্ন আর হিসাবের মধ্যে সেতু গড়েছে, আর শিবু কীভাবে প্রতিটি অক্ষরকে নিজের মনে আঁকছে। এই মিলনমেলা শুধু ব্যবসা নয়, যেন এক জীবন্ত যাদুঘর, যেখানে অক্ষরগুলো গল্প শোনায়, সম্পর্ক জোড়ে আর সময়কে ছুঁয়ে থাকে।
নন্দিনী সেই এক বছরে বসু প্রেসের গল্প নিয়ে একটি বই লিখেছে—‘ছাপাখানার গল্প: অক্ষরের মানুষ’—যা অনেককে ছুঁয়েছে, শহরের নতুন প্রজন্ম জানিয়েছে সেই পুরনো মেশিন আর মানুষের কথাগুলো, যেগুলো হয়তো ডিজিটালের চাপে হারিয়ে যেতে বসেছিল। সেই বইয়ের লঞ্চ ইভেন্টে হরিপদর চোখে জল এসে গিয়েছিল যখন নন্দিনী বলেছিল, “এই গল্প শুধু একটা প্রেসের নয়, এটা এক শহরের, এক পরিবারের, আর সেই মানুষদের, যারা অক্ষরের চেয়ে বড় করে দেখেছে স্বপ্ন আর সম্পর্ককে।” সেদিন সায়ন্তন বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসেছিল, আর হরিপদ তার ছেলের কাঁধে হাত রেখেছিলেন—কোনো কথা বলেননি, কিন্তু সেই স্পর্শেই সব বলা হয়ে গিয়েছিল। আর শিবু, যে একসময় শুধু কৌতূহল নিয়ে ঘুরে বেড়াত, এখন নিজেই নতুন কাস্টমারের অর্ডার নেয়, টাইপ গুণে দেখে আর লিনোটাইপের গল্প শোনায় যেন সেই গল্পের মধ্যেই তার নিজের শিকড় খুঁজে পেয়েছে।
আজও যখন সন্ধ্যা নামে, বসু প্রেসের ভেতরে লিনোটাইপের ছায়া লম্বা হয়, সেই ছায়া যেন শুধু এক মেশিনের নয়, হরিপদ বসু আর তার জীবনেরও প্রতিফলন। কমলা দিদি সন্ধ্যার চায়ের কাপ সাজান, শিবু হাতের স্পর্শে অক্ষর বসায়, আর সায়ন্তন নতুন অর্ডারের হিসাব মিলায়—এই দৃশ্যগুলো বারবার ফিরে আসে, নতুন নতুন রঙে। আর হরিপদ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ভাবেন, অক্ষরের বাইরেও আছে মানুষের গল্প, ভালোবাসা, লড়াই আর সময়কে হার না মানা এক ইচ্ছে; আর সেই ইচ্ছের জন্যই এ গল্প কখনো থামে না, কেবল নতুন পৃষ্ঠা খুলে যায়, নতুন হাতের ছোঁয়ায়। বসু প্রেস থেকে ভেসে আসে কালি আর কাগজের গন্ধে ভরা নীরব সুর—যা বলে, “এ গল্পের আসল শেষ নেই, আছে শুধু শুরু, বারবার।”
সমাপ্ত