Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

ছাদবাগানের লুকোনো আকাশ

Spread the love

অনিতা রায়


কলকাতার দক্ষিণের ব্যস্ত এলাকায় দশতলা এক বহুতলের চতুর্থ তলায় মৌসুমি সেনগুপ্তের ফ্ল্যাট। বাইরে থেকে দেখে মনে হয়, এ এক স্বপ্নময় শহুরে সংসার—সাদা দেয়ালের পরিপাটি ফ্ল্যাট, বারান্দায় কিছু শুকনো টব রাখা, জানালার পাশে গামছা শুকোতে দেওয়া, আর ভেতরে এক স্বামী-স্ত্রী ও তাদের স্কুলপড়ুয়া ছেলের নিখুঁত রুটিন। কিন্তু সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর থেকে রাত অবধি চলতে থাকা মৌসুমির দিনচক্রের ভেতরে সেই নিখুঁত ছবির ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে থাকে অদৃশ্য শূন্যতা। ভোর ছ’টা বাজতেই অ্যালার্মের আওয়াজে উঠে রান্নাঘরে ঢোকা, ছেলের টিফিন আর স্বামীর চায়ের কাপ সামলানো, এর পর বাসন মাজার শব্দে ভেসে আসা শাশুড়ির ফিসফিসে মন্তব্য, সব কিছুই যেন তাকে এক অবিরাম যান্ত্রিক ঘূর্ণির মধ্যে বেঁধে রেখেছে। জানালার বাইরে রাস্তার কোলাহল, বাস-অটো, মুদিখানার ডাকে ভোর শহর জমে উঠলেও মৌসুমির ভেতরে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি হয়—সব কিছু চলছে, তবু সে কোথাও নেই, তার সত্তা যেন ঝাপসা হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটার মতো নির্দিষ্ট সময়ে সংসার ঘুরছে, কিন্তু সেই ঘড়িতে তার নিজের অস্তিত্ব যেন এক অনুচ্চারিত টিক-টিক শব্দ মাত্র।

শাশুড়ির ঘর থেকে ভেসে আসে চাপা নির্দেশ—“ইশানকে ঠিকমতো পড়াশোনার দিকে নজর দিস, ওর বাবার মতো শুধু বই না পড়লে চলবে না।” অভিজিৎ, তার স্বামী, তখন ব্যস্ত মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ব্যাংকের চাকরি তার জীবনকে কেবলই সংখ্যার খাতা আর দায়িত্বের খাঁচায় বেঁধে রেখেছে। মৌসুমির কথা বলার সুযোগ হয় না, আর হলেও সে বুঝে গেছে, তার মনের কথা, তার অস্থিরতা—এসব বোঝার মতো ধৈর্য্য বা ইচ্ছা অভিজিতের নেই। সংসার চলে নিয়মে, ইশান স্কুলে যায়, টিউশনে যায়, রাতে ফিরে মায়ের রান্না খেয়ে আবার বইয়ের ব্যাগে ডুবে থাকে। আর মৌসুমি? দিনের শেষে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে, জানালার বাইরে রাতের নিস্তব্ধতায় তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে—এটাই কি তার জীবনের শেষ গন্তব্য? ছোটবেলায় কবিতা লিখতে ভালোবাসত, অল্প বয়সে গল্পের খাতায় ভরেছিল কিশোরী মন, কলেজ জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিত সাহিত্য নিয়ে। অথচ এখন, সেই সমস্ত শব্দ, স্বপ্ন, আলো যেন কোথাও মিলিয়ে গেছে। শুধু থেকে গেছে চাপা এক দীর্ঘশ্বাস, যা হয়তো দিনের শেষে নির্জনতার মধ্যে কাগজে মিশতে চায়, কিন্তু পরিবারের কাছে সে প্রকাশ করতে পারে না।

দিনের পর দিন একই ছন্দে বেঁচে থাকতে থাকতে মৌসুমি অনুভব করে, তার জীবন যেন অদৃশ্য শিকলে বাঁধা। চারপাশে লোকজন থাকলেও একা বোধ করে সে। রান্নাঘরের ধোঁয়া, বাসনের শব্দ, টিফিনের গন্ধ, হোমওয়ার্কের চাপ—এসবের মাঝেই কোথাও নিজের জন্য সামান্য জায়গা খুঁজতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। মাঝে মাঝে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সে চেয়ে থাকে দূরের আকাশের দিকে। কলকাতার বহুতলের ঘিঞ্জি জানালাগুলোয় আকাশ দেখা যায় সামান্য ফালি, তাও তার কাছে যেন মুক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই আকাশের টুকরোটাই তাকে টানে, কিন্তু আবার ঘরে ফিরে তাকাতে হয় চাপা প্রত্যাশা আর দায়িত্বের পাহাড়ের দিকে। রাত নামলে বিছানায় শুয়ে তার মনে হয়, সে যেন নিজের শরীর আর মনের মধ্যে বন্দী এক অচেনা মানুষ। অথচ বাইরের চোখে সে নিখুঁত গৃহবধূ—সব ঠিকমতো সামলায়, শাশুড়ির কথার প্রতিবাদ করে না, ছেলের পড়াশোনা দেখে, স্বামীর চাহিদা পূরণ করে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানে, এই ছবির ভেতরে লুকিয়ে আছে তার নিঃশব্দ কান্না, এক অস্পষ্ট শূন্যতা, যা একদিন হয়তো তার জীবনকে ভেঙে দেবে। আর এই অদৃশ্য শূন্যতাকেই সে নাম দেয়—“ব্যস্ত ফ্ল্যাটের জানালার আড়ালে থাকা অদেখা আকাশ।”

সেই দিনটা ছিল একেবারেই সাধারণ, অথচ মৌসুমির কাছে তা হয়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত মোড়। সকালের রান্নাঘরের কাজ, ছেলের স্কুল, স্বামীর অফিস, দুপুরে শাশুড়ির ওষুধ আর বিকেলে বাজারের তালিকা—সবকিছু একসাথে সামলাতে সামলাতে শরীরের মতোই মনও যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। চারপাশে লোকজন থাকা সত্ত্বেও তার নিঃসঙ্গতা যেন আরও ঘনীভূত হচ্ছিল, আর সে নিজেই বুঝতে পারছিল না কীভাবে এ শূন্যতাকে ভরাট করা যায়। সেই বিকেলে হঠাৎ একটা অদ্ভুত আকর্ষণ তাকে ছাদের দিকে নিয়ে গেল। বহুতলের লিফটে না উঠে সে সিঁড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে ওপরে উঠল, প্রতিটি ধাপ যেন তার ভেতরের ক্লান্তি আর অচেনা উত্তেজনাকে মিশিয়ে দিচ্ছিল। ছাদে পৌঁছে দরজা ঠেলেই দেখল, ওপরে এক নির্জন দুনিয়া। চারপাশে শহরের বহুতল ছড়িয়ে আছে, কংক্রিটের দেয়ালের আড়ালে সূর্যের আলো ঢলছে তির্যকভাবে, আর ফাঁকা ছাদে হাওয়া বইছে অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে। একপাশে কিছু পুরনো টব পড়ে আছে, শুকনো মাটি আর ঝরে পড়া পাতায় ভরা। কারও যত্নের অভাবে সেই টবগুলো যেন মৃত, অথচ মৌসুমির চোখে তাতে জন্ম নিল এক নতুন আশার ঝিলিক। টবগুলোকে দেখে তার মনে হলো—যেমনভাবে তার নিজের ভেতরের সত্তা শুকিয়ে গিয়েছে, তেমনই শুকিয়ে আছে এই টবগুলোও। হয়তো এদের যত্ন করলে, এদের ভেতর থেকে আবার নতুন সবুজ বেরোতে পারে, ঠিক যেমন সে নিজে খুঁজছে নতুন প্রাণের উৎস।

সেই সন্ধ্যা থেকে মৌসুমির জীবনে ছাদ হয়ে উঠল এক অদ্ভুত মুক্তির জায়গা। গোপনে রান্নাঘরের কোণে পড়ে থাকা ছোট ছোট ডালপালা, কাঁচা সবজির বীজ, আর শুকনো ফুলের বীজ কুড়িয়ে এনে সে টবগুলোতে পুঁততে লাগল। হাতে মাটি মাখল, টবে জল দিল, আর মনে মনে কথা বলল গাছেদের সঙ্গে—যেন বহুদিন পর তার নিঃসঙ্গ কথোপকথনের সঙ্গী পেল। পরিবার বা প্রতিবেশীদের কেউ জানত না, মৌসুমির এই গোপন আড্ডা শুরু হয়ে গেছে ছাদে। দিনের বাকি সময়টুকুতে সে আগের মতোই সংসারের যন্ত্রচক্রে বন্দী থেকেছে, কিন্তু সুযোগ পেলেই চুপিচুপি ছাদে উঠে এসে টবগুলোর সঙ্গে সময় কাটিয়েছে। কখনও ছেলের ফেলে রাখা জল ভর্তি বোতল দিয়ে গাছে জল দিয়েছে, কখনও রান্নাঘরের আলু-পেঁয়াজের খোসা মাটির মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছে। প্রতিদিনের ব্যস্ততার মধ্যে এই কয়েকটা মুহূর্তই যেন তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। আর ছাদে দাঁড়িয়ে যখন সে চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়েছে, তখন মনে হয়েছে, এই আকাশের কোনো সীমা নেই—ঠিক তার ভেতরের ইচ্ছের মতোই। এই অনুভূতি তাকে সাহস দিয়েছে, নতুন করে শুরু করার এক নীরব শক্তি দিয়েছে।

ধীরে ধীরে মৌসুমির ছাদ যেন বদলে গেল। শুকনো মাটির টব থেকে বেরোতে শুরু করল সবুজ অঙ্কুর, ছোট ছোট পাতা আলোয় দুলতে লাগল, আর সেই দৃশ্য দেখে মৌসুমির মনে ভেসে উঠল হারিয়ে যাওয়া শৈশবের দিনগুলো, যখন সে দাদুর বাড়ির বাগানে বসে গাছেদের সঙ্গে খেলা করত। বহু বছর পর যেন সে আবার ফিরে পেল সেই অনুভূতি, যে অনুভূতি তাকে কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ করত। দিনের শেষে যখন রাত নামে, শহরের আলো ঝিকমিক করে ওঠে আর দূরের আকাশে চাঁদ ওঠে, মৌসুমি ছাদের কোণে বসে টবগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন মনে হয়, এই ছোট্ট বাগানই তার মুক্তির পৃথিবী, যেখানে তাকে কেউ বাঁধতে পারে না, কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ভেতরের অস্থিরতা যেন কমে আসে, আর তার বুক ভরে ওঠে এক অদ্ভুত শান্তিতে। পরিবার, দায়িত্ব, চাপ, নিঃসঙ্গতা—সব কিছুর বাইরে এই ছাদের আকাশে সে খুঁজে পায় নিজের জন্য একটা জায়গা, যেখানে সে সত্যিকারের মৌসুমি হয়ে বাঁচতে পারে। এভাবেই শুরু হয় তার নতুন যাত্রা—ছাদের আকাশে প্রথম পদচিহ্ন রেখে, নিজের একান্ত বাগান গড়ে তোলার নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা নিয়ে।

প্রথম কয়েক সপ্তাহে মৌসুমি বুঝতে পারল, তার ছাদের টবগুলোতে নতুন প্রাণের জন্ম হচ্ছে। শুকনো মাটির ভেতর থেকে ধীরে ধীরে সবুজ অঙ্কুর ফুঁড়ে উঠছে, যেন দীর্ঘ নিদ্রা ভেঙে জেগে ওঠা কোনও অলৌকিকতার মতো। প্রতিদিন ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় ছাদে গিয়ে টবগুলো দেখে সে এক অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে—যা সে অনেক বছর ধরে খুঁজেও পায়নি। স্নিগ্ধ সবুজ পাতা দেখে মনে হয় যেন কেউ তাকে মৃদু করে স্পর্শ করছে, তাকে নতুন করে বাঁচার সাহস দিচ্ছে। একদিন রান্নাঘরে আলু কাটতে গিয়ে অকারণেই চোখে জল চলে এসেছিল তার, কিন্তু ছাদে উঠে এসে যখন সে ছোট্ট একটি গাছের পাতায় শিশির বিন্দু ঝুলতে দেখল, তখন বুক ভরে উঠল আনন্দে, মনে হলো সেই শিশির যেন তার অশ্রুর জবাব হয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে সে প্রতিটি টবকে আলাদা নাম দিল—কোনোটা তার পুরোনো বন্ধুর নামে, কোনোটা ছেলের ডাকনামে, আবার কোনোটা কবিতার লাইন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। এভাবে গাছগুলো আর নিছক গাছ রইল না, তারা হয়ে উঠল তার নিঃসঙ্গ জীবনের সঙ্গী, যাদের সঙ্গে সে নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারে, অভিযোগ জানাতে পারে, অথবা ভালোবাসার গোপন কথা ভাগ করে নিতে পারে।

এক অদ্ভুত অভ্যাস তৈরি হলো মৌসুমির। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে চুপিচুপি তার পুরোনো ডায়েরি খুলে বসে, আর ছাদের গাছেদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো লিখে রাখে। ডায়েরির পাতায় সে সাজিয়ে রাখে সেই দিনের সব কথা—আজ কোন গাছে নতুন কুঁড়ি এসেছে, কোন টবের মাটি ভিজে আছে, আবার কোন পাতায় হলদে ছোপ পড়েছে। কিন্তু এর মধ্যেই সে গোপনে মনের কথাও ঢেলে দেয়। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের দূরত্ব, শাশুড়ির চাপা দৃষ্টি, নিজের অদৃশ্য ক্লান্তি, আর মুক্তির জন্য অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষা—সব কিছুই সে লিখে রাখে এই ডায়েরির পাতায়। যেন এই ডায়েরিই তার কাছে জীবনের সত্যিকারের সাক্ষী, যে সাক্ষীকে ঠকানো যায় না, আড়াল করা যায় না। গাছেদের সঙ্গে কথা বলার মতোই ডায়েরির সঙ্গে তার এক সেতুবন্ধন তৈরি হলো, যেখানে মৌসুমি নিজেকে নির্ভয়ে মেলে ধরতে পারে। অনেক সময় সে লিখে রাখে, “আজ মনে হচ্ছে এই টবের ভেতরে আমিই জন্ম নিচ্ছি নতুন করে,” আবার কখনও লেখে, “সবাই যখন আমার কণ্ঠ শুনতে চায় না, তখন এই সবুজেরা আমার গোপন কথাকে শোনে।” একসময় সে বুঝতে পারল, এই লেখা শুধু রোজনামচা নয়, বরং তার ভেতরের চিৎকারের নরম রূপ, যা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছাদের এই ছোট্ট বাগানটা হয়ে উঠল মৌসুমির আত্মার আশ্রয়স্থল। দিন যতই ব্যস্ততায় ভরে উঠুক, তার ভেতরে একটা অদ্ভুত টান কাজ করত—একবার ছাদে যাওয়া, গাছেদের দেখে আসা। যখন কোনো কারণে সারাদিন ছাদে যেতে পারত না, তখন অস্বস্তি ও অস্থিরতায় ভুগত। মনে হতো, কেউ যেন তার অপেক্ষায় বসে আছে। একদিন হঠাৎ শাশুড়ি জিজ্ঞেস করে ফেলেছিলেন, “এত দেরি করিস কোথায়?” মৌসুমি হেসে বলেছিল, “একটু কাপড় শুকোতে গিয়েছিলাম।” আসলে সেই সময় সে ছাদে দাঁড়িয়ে তার প্রিয় টবের পাশে বসে গল্প করছিল—কীভাবে সে স্কুলে প্রথম কবিতা আবৃত্তি করেছিল, কীভাবে কলেজের লাইব্রেরির জানালার পাশে বসে স্বপ্ন দেখত। গাছেদের সামনে এসব বলতে তার কোনো দ্বিধা হতো না, কারণ তারা বিচার করত না, তিরস্কার করত না। বরং প্রতিটি নতুন পাতার জন্ম যেন তাকে জানিয়ে দিত, সে একা নয়, তার ভেতরে এখনও জীবন আছে। আর ডায়েরির পাতায় প্রতিটি দিনের গল্প জমা হতে হতে যেন এক অদৃশ্য সাহস তৈরি হচ্ছিল তার ভেতরে—যেন এই লেখা, এই গোপন আকাশ একদিন তাকে মুক্তির দিকে ঠেলে দেবে। মৌসুমি তখনও জানত না, এই নিঃশব্দ মুক্তি-অনুসন্ধানই একদিন তার চারপাশে ঝড় বইয়ে দেবে, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার কাছে এটাই ছিল শান্তির একমাত্র পথ—সবুজের ভেতরে নিজেকে খুঁজে পাওয়া, আর ডায়েরির পাতায় সেই মুক্তির পদচিহ্ন রেখে যাওয়া।

সেই দিনটিও ছিল একেবারে অন্য সাধারণ দিনের মতো, কিন্তু তার ভেতরেই লুকিয়ে ছিল একটি অদৃশ্য পরিবর্তনের মুহূর্ত। বিকেলের রোদ তখন ক্রমে নরম হয়ে আসছে, মৌসুমি ছাদে বসে টবগুলোর মাটি আলগা করছে, কখনও শুকনো পাতাগুলো ছিঁড়ে সরিয়ে দিচ্ছে, আর নিজের মতো করে কিছু গুনগুন করছে। হঠাৎই তার খেয়াল হলো, পাশের ফ্ল্যাটের ছাদের দিকে থেকে কারও দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হয়ে আছে। সে চোখ তুলে তাকাতেই দেখল, এক মধ্যবয়সী মানুষ, হাতে ছোট্ট একটি নোটবুক, কাঁধে ঝোলানো পুরনো চামড়ার ব্যাগ—সাংবাদিক অলক মিত্র। মৌসুমি তাকে চেনে, কারণ দু-একবার লিফটে মুখোমুখি হয়েছিল, সৌজন্যের হাসি বিনিময় হয়েছিল। কিন্তু আজকের সেই দৃষ্টি ছিল ভিন্ন—কৌতূহল মেশানো এক গভীর দৃষ্টি। কিছুক্ষণ দ্বিধার পর অলক এগিয়ে এলো, ভদ্রভাবে অভিবাদন জানিয়ে বলল, “আপনার বাগানটা দূর থেকেই দেখছিলাম। সত্যি বলতে কি, শহরের এই কংক্রিটের ভিড়ে এমন প্রাণবন্ত জায়গা খুব একটা চোখে পড়ে না।” মৌসুমি প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করল—তার গোপন আশ্রয়স্থল যেন হঠাৎ অন্যের চোখে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু অলকের কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতায় একটা উষ্ণতা ছিল, যা তার অস্বস্তি কিছুটা কমিয়ে দিল।

আলাপচারিতা ধীরে ধীরে সহজ হয়ে উঠল। অলক জিজ্ঞেস করল, “এগুলো সব আপনি নিজে লাগিয়েছেন?” মৌসুমি মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ, একটু শখ, আর হয়তো নিজের জন্য একটা জায়গা খুঁজে নেওয়া।” তার কণ্ঠে লাজুকতা থাকলেও চোখে ফুটে উঠছিল গর্বের আলো। অলক টবগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু শখ নয়, এ এক ধরনের শিল্প। এই টবগুলোতে আপনি যে যত্ন দিয়েছেন, তা চোখে পড়ার মতো। জানেন তো, একটা গাছকে বাঁচিয়ে তোলা মানে শুধু জল আর মাটি নয়—এর ভেতরে একটা আত্মিক সম্পর্ক থাকে।” মৌসুমি অবাক হয়ে গেল, কারণ এতদিন ধরে সে নিজেই শুধু অনুভব করেছে এই সম্পর্ককে, কিন্তু কারও সামনে তা কখনও উচ্চারণ করেনি। সে ধীরে ধীরে নিজের গোপন কথাগুলো বলতে শুরু করল—কীভাবে একদিন হঠাৎ ছাদে উঠে এসে শুকনো মাটির টবগুলো দেখে তার ভেতর নতুন করে শুরু করার তাগিদ জেগেছিল, কীভাবে সে রান্নাঘরের উচ্ছিষ্ট বীজ বপন করে এই সবুজ জন্ম দিয়েছিল। অলক মন দিয়ে শুনছিল, মাঝেমধ্যে নোটবুকে কিছু লিখছিল, আর তার দৃষ্টিতে ছিল সত্যিকারের মুগ্ধতা। এতদিন পরে মৌসুমির মনে হলো, কেউ তাকে শুধুমাত্র একজন গৃহবধূ হিসেবে নয়, বরং একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে দেখছে। সেই উপলব্ধি তার বুক ভরে দিল এক অদ্ভুত প্রশান্তি ও সাহসে।

কথোপকথনের শেষে অলক বলল, “আপনার ভেতরে শুধু গাছের প্রতি ভালোবাসা নয়, এক ধরনের শিল্পীসত্তা আছে। আমি সাংবাদিক, অনেক শিল্পীর সঙ্গে কথা বলেছি, কিন্তু এই রকম আন্তরিক প্রকাশভঙ্গি খুব কম দেখা যায়। আপনি কি লিখেন কিছু?” প্রশ্নটা শুনে মৌসুমি একটু চমকে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে ধীরে ধীরে স্বীকার করল, “হ্যাঁ, মাঝে মাঝে লিখি… তবে শুধু নিজের জন্য।” অলকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “তাহলে একদিন আমাকে শুনতে দেবেন? আমি নিশ্চিত, আপনার কথাগুলো শুধু গাছের ডায়েরিতে নয়, মানুষের মনেও ছোঁয়া দেবে।” এতদিন যাকে নিজের নিঃশব্দ গোপন মনে করেছিল, সেই অনুভূতিগুলো অন্য কারও চোখে আলোর মতো প্রতিফলিত হচ্ছে—এটা মৌসুমির জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। প্রথমবার সে বুঝল, হয়তো তার ভেতরের কথা চাপা পড়ে থাকতে হবে না সবসময়, হয়তো কেউ আছে যে সত্যিই শুনতে চায়। সেই মুহূর্তে তার মনে হলো, ছাদের এই আকাশের নিচে সে একা নয়। আর অলকের চোখে সেই আলো দেখে মৌসুমি বুঝল, জীবনের এই অচেনা সংলাপ হয়তো তাকে আরও দূরে নিয়ে যাবে—অচেনা মুক্তির পথে, যেখানে তার সত্তাকে নতুন করে চিনতে পারবে পৃথিবী।

রাত যত গভীর হতে থাকে, মৌসুমির একাকীত্ব তত ঘন হয়ে উঠে তার চারপাশে। দিনের বেলা সে হাসে, কথা বলে, সংসারের যাবতীয় কাজ করে যায় যেন সব কিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু রাত নামলেই তার ভেতরের অন্ধকার আর শূন্যতা ঘনিয়ে আসে। বিছানার কোণে বসে কখনও সে জানলার বাইরে তাকায়, যেখানে চাঁদের আলো নিঃশব্দে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ে, কখনও আবার দূরের ট্রেনের হুইসেল শুনে তার মনে হয় এই পৃথিবীর কোথাও এমন একটা জায়গা আছে যেখানে সে সত্যিই মুক্ত হতে পারে। কিন্তু প্রতিদিনই সে আবদ্ধ হয়ে থাকে পরিচিত জীবনের ভেতরে, যেখানে তার হাসি কৃত্রিম আর তার ভালোবাসা অসম্পূর্ণ। ঠিক তখনই ডায়েরির পাতায় সে খুঁজে পায় নিজের ভরসা—কালো কালি আর সাদা পাতার এক নীরব সম্পর্ক, যেখানে কেউ তাকে প্রশ্ন করে না, কেউ বিচার করে না। সে লিখতে শুরু করে নিজের মনের কথা, প্রথমে ছোট ছোট বাক্য, পরে দীর্ঘ আবেগঘন অনুচ্ছেদ। একসময়ের নিছক শখ ধীরে ধীরে পরিণত হয় তার আত্মার মুক্তির উপায়। তার লেখায় জমে ওঠে দিনের বেলা না বলা অসংখ্য কথা, ভেতরের ক্রোধ, অপূর্ণ ইচ্ছা, চেপে রাখা ভালোবাসা। এই লেখাগুলো যেন এক অদৃশ্য আয়না, যেখানে সে নিজেকে নতুন করে চিনতে শেখে।

ডায়েরির পাতায় পাতায় ধীরে ধীরে জন্ম নেয় মৌসুমির ভেতরের আরেকটি সত্তা—যে কখনও সাহসী, কখনও বিদ্রোহী, কখনও ভীষণ ভঙ্গুর। প্রতিটি শব্দ যেন তার নিজের সঙ্গে কথোপকথন। সে লিখে রাখে সেই মুহূর্তগুলোর কথা, যখন ভিড়ের মধ্যে থেকেও নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ মনে হয়, অথবা যখন হঠাৎ করেই মনে হয় অদৃশ্য এক বন্ধন তাকে আটকে রেখেছে। প্রেম নিয়ে লিখতে গিয়ে তার কলম কাঁপে, কারণ তার হৃদয়ের গভীরে থাকা সেই আকাঙ্ক্ষা কখনও পূর্ণ হয়নি। ভালোবাসার হাতছানি সে অনুভব করেছে, কিন্তু তার রঙ, তার উষ্ণতা পুরোপুরি কখনও পায়নি। তাই ডায়েরি হয়ে ওঠে তার গোপন প্রেমিক, যে তাকে কখনও ফেলে যায় না। প্রতিটি বাক্যে সে স্বপ্ন আঁকে—কোনো একদিন হয়তো সব বাঁধন ভেঙে সে নিজের মতো করে বাঁচতে পারবে। কখনও আবার সে নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অস্থিরতাকে প্রকাশ করে, সমাজ আর সংসারের দেওয়া অদৃশ্য শৃঙ্খলাকে প্রশ্ন করে। তার ডায়েরি ক্রমশই হয়ে ওঠে এক গোপন আশ্রয়, যেখানে সে সত্যিকার অর্থে মুক্ত, যেখানে সে নিজেকে নির্ভয়ে নগ্ন করে রাখতে পারে, আর যেখানে তার নিঃসঙ্গতা সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।

রাতের শেষ প্রহরে, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, মৌসুমি তখন কলম হাতে চুপচাপ বসে থাকে। তার চোখে ভাসে দিনের বেলা দেখা স্বপ্নগুলো, অমিল প্রেম, অবদমন, আর স্বাধীনতার অপূর্ণ তৃষ্ণা। সে জানে, এই ডায়েরি কারও চোখে পড়লে তার ভেতরের জগত ফাঁস হয়ে যাবে, তাই প্রতিদিন লেখার পর ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখে আলমারির গোপন কোণে। কিন্তু যতই সে লুকিয়ে রাখে, তার ভেতরে এই লেখার নেশা ততই বেড়ে চলে। প্রতিটি পাতায় লিখতে লিখতে সে অনুভব করে—তার এই নিঃশব্দ যাত্রাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। ডায়েরি ছাড়া যেন তার রাতগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এক সময় সে বুঝতে পারে, এই ডায়েরিই তার নিঃশব্দ সঙ্গী, তার নিজের ভেতরের অন্ধকার আর আলোকে বোঝার একমাত্র পথ। হয়তো বাইরের পৃথিবী কোনোদিন তাকে তার মতো করে বুঝবে না, কিন্তু এই সাদা পাতাগুলো তাকে প্রতিদিন আলিঙ্গন করে, প্রতিদিন তার বেদনা শুষে নেয়। তাই গোপনে জন্ম নেয় এক অমূল্য সম্পর্ক—মৌসুমি আর তার ডায়েরির, যেখানে প্রতিটি শব্দ হয়ে ওঠে তার আত্মার নীরব সাক্ষ্য, প্রতিটি পাতাই হয়ে ওঠে তার অপূর্ণ জীবনের এক নীরব কাহিনী।

দিনগুলো যত এগোতে থাকে, মৌসুমির ভেতরে আর বাইরে তৈরি হতে থাকে এক অদৃশ্য টানাপোড়েন। সংসারের চাহিদা, সন্তানের পড়াশোনা, শ্বশুরবাড়ির খুঁটিনাটি দায়িত্ব—সবকিছুই আগের মতোই চলছে, কিন্তু এর ভেতরেই নিঃশব্দে বাড়ছে মৌসুমি আর অভিজিতের দূরত্ব। অভিজিত অফিস থেকে ফিরলেও তার চোখে ক্লান্তির ছাপ, কথাবার্তায় অন্যমনস্কতা, মাঝে মাঝে বিরক্তি। সে খেয়ালই করে না, মৌসুমি কেমন করে তার দিন কাটাচ্ছে, বা কোন জিনিসে খুঁজে পাচ্ছে আশ্রয়। অথচ মৌসুমির হৃদয়ের ভেতর ধীরে ধীরে জমা হতে থাকে এক অন্যরকম আনন্দ—ছাদের সবুজ, নতুন পাতা, নতুন ডাল, আর রাতের নির্জনে ডায়েরির পাতায় ঢেলে দেওয়া নিজের কথা। এই আনন্দ সে অভিজিতের সঙ্গে ভাগ করে নিতে চেয়েছিল একসময়, কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছে। যখনই সে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেছে, “আজ আমার গাঁদাফুলের চারা নতুন কুঁড়ি দিয়েছে,” অভিজিত হেসে ফেলে বলেছে, “এসব তুচ্ছ জিনিস নিয়ে এত ভাবছ কেন? এসব করার সময় কোথায় তোমার?” কথাগুলো মৌসুমির কানে যেন শীতল ধারালো ছুরির মতো লাগে। তখনই সে বুঝতে পারে, তাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে এমন এক অদৃশ্য ফাঁক, যেটা আর সহজে পূরণ করা সম্ভব নয়।

অভিজিতের কাছে মৌসুমির ছাদের টান একধরনের অদ্ভুত খেয়াল মনে হয়, যেন সে নিরর্থক কিছুতে সময় নষ্ট করছে। কিন্তু মৌসুমি বুঝতে পারে, এই ছাদই তার একমাত্র মুক্তির জানালা। যতবার সে টবে নতুন কুঁড়ি দেখে, মনে হয় জীবনে এখনও নতুন করে শুরু করার সম্ভাবনা আছে। যতবার গাছেদের সঙ্গে নিঃশব্দে কথা বলে, মনে হয় কেউ তার মনের কথা শুনছে। অথচ অভিজিত তার জীবনে দিন দিন হয়ে উঠছে এক প্রকার অচেনা মানুষ। সংসারের ভিড়ে তাদের কথোপকথন সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বাজার-হিসাব, সন্তানের পড়াশোনা, কিংবা দৈনন্দিন খুঁটিনাটির মধ্যে। একসময় তারা একে অপরের সঙ্গে স্বপ্ন ভাগ করত, ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করত, কিন্তু এখন সেসব আলোচনার জায়গায় এসেছে নির্লিপ্ত নীরবতা। মৌসুমি যখনই চেষ্টা করে অভিজিতকে নিজের ভেতরের দুঃখ বা শূন্যতার কথা বলতে, অভিজিত হয় বিষয় পাল্টে দেয়, নয়তো বিরক্ত হয়ে বলে, “এত আবেগপ্রবণ হলে সংসার চালানো যায় না।” এই কথাগুলো শুনে মৌসুমির বুকের ভেতরে জমে ওঠে অভিমান, হতাশা আর অসহায়তা। ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, সংসারে থেকেও সে আসলে একা।

এই একাকীত্ব থেকেই আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে তার গাছেদের প্রতি ভালোবাসা আর ডায়েরির সঙ্গে সম্পর্ক। প্রতিদিনের ক্লান্তি, অভিমান, অবহেলার গল্পগুলো সে ডায়েরির পাতায় লিখে রাখে। সে জানে, এই পাতাগুলো তাকে কখনও প্রত্যাখ্যান করবে না, বিচার করবে না। তার প্রতিটি গোপন অনুভূতির সাক্ষী হয়ে থাকে কালি-ছোপানো লাইনগুলো। অন্যদিকে, ছাদের গাছগুলো তার জীবনে যেন এক নতুন পরিবার হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিটি টবের ভেতর থেকে গজিয়ে ওঠা সবুজ তাকে মনে করিয়ে দেয়, সে এখনও বেঁচে আছে, তার ভেতরে এখনও আছে সৃষ্টির শক্তি। গাছেরা তার সঙ্গে কথা বলে না, তবু তাদের নীরব উপস্থিতি তাকে সান্ত্বনা দেয়। সে বুঝতে পারে, সংসারের ভিড়ে তার সত্যিকারের সঙ্গী আসলে এই নীরব সবুজ আর ডায়েরির সাদা পাতা। অভিজিত যেখানে প্রতিদিন তাকে অবহেলার দেয়ালে ঠেলে দেয়, সেখানে গাছেরা তাকে প্রতিদিন নতুন জীবন উপহার দেয়। তাই মৌসুমি ধীরে ধীরে নিজের ভেতর তৈরি করে নেয় এক অদৃশ্য আশ্রয়, যেখানে অভিজিতের কোনো জায়গা নেই—আছে শুধু তার নিঃসঙ্গতার অরণ্য আর মুক্তির আলো খোঁজার স্বপ্ন। আর এভাবেই সংসারের চার দেওয়ালের মধ্যেই জন্ম নেয় সেই গভীর ফাঁক, যা হয়তো আর কখনও মেরামত করা সম্ভব নয়।

অলকের সঙ্গে মৌসুমির আলাপচারিতা যেন প্রতিদিন একটু একটু করে নতুন রঙ ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার জীবনে। শুরুতে হয়তো সাধারণ গল্প-আড্ডা, বই নিয়ে আলাপ, কিংবা জীবনের ছোটখাটো অভিজ্ঞতা শেয়ার করা—এসব দিয়েই কথোপকথন চলত, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আড্ডার ভেতরে অন্য এক গভীরতা তৈরি হচ্ছিল। অলক ছিল অন্যরকম; শুধু ভালো শ্রোতাই নয়, সে মৌসুমির লেখার ভেতরে প্রবেশ করতে পারত, তার প্রতিটি শব্দের তলদেশে যে ব্যথা, আশা, স্বপ্ন কিংবা দ্বিধা লুকিয়ে থাকে, তা যেন নিখুঁতভাবে বুঝতে পারত। মৌসুমি যখন কোনো কবিতা তাকে পড়ে শোনাত, অলকের চোখে এক ধরনের মুগ্ধতা ফুটে উঠত, যা তাকে অদ্ভুতভাবে ছুঁয়ে যেত। নিজের লেখা এতটা প্রভাব ফেলতে পারে, আগে সে তা কোনোদিন অনুভব করেনি। সেই বিস্ময় থেকে জন্ম নিল একরকম কৃতজ্ঞতা, আবার এক ধরনের অজানা টানও। অথচ সে নিজেকে বারবার বোঝাতে চাইছিল—এ তো শুধু বন্ধুত্ব, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু মানুষের হৃদয় তো যুক্তির বাঁধনে বেঁধে রাখা যায় না। প্রতিদিন রাতে ডায়েরি খুলে সে নিজের ভেতরের কথাগুলো নিঃসংকোচে লিখে রাখত—“আজ ও বলল, আমার গল্পগুলো তাকে ভাবায়। আমি কি সত্যিই এতটা প্রভাব ফেলতে পারি? নাকি ওর ভেতরেও কোনো অচেনা আবেগ জেগে উঠছে?” এসব প্রশ্নের উত্তর তার কাছে ছিল না, কিন্তু অনুভবের ঢেউয়ে সে ধীরে ধীরে ভেসে যাচ্ছিল।

এদিকে অলকের দিক থেকেও সম্পর্কটা নতুন মোড় নিচ্ছিল। সে শুধু মৌসুমির লেখা পড়েই থেমে থাকত না, বরং প্রতিটি লাইনের অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা খুঁজে বের করত, আর সেই বিশ্লেষণ মৌসুমিকে আরও ভাবনায় ফেলত। কারও সঙ্গে এমন গভীরভাবে নিজের মনের জগৎ শেয়ার করার সুযোগ সে আগে পায়নি। অলকের উপস্থিতি তাকে যেন নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছিল, আবার একই সঙ্গে অস্থিরতাও জাগাচ্ছিল। যখন অলক কোনো সাধারণ বাক্যে প্রশংসা করত—“তুমি লিখলে যেন শব্দগুলো নিঃশ্বাস নেয়”—তখন মৌসুমির বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কম্পন বয়ে যেত। বন্ধুত্বের সীমারেখা পেরিয়ে যে অঞ্চলে আবেগ জন্ম নেয়, সেই অঞ্চলের কিনারায় দাঁড়িয়ে সে বারবার থেমে যাচ্ছিল। তবুও নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করত—“না, এটা শুধু লেখক-পাঠকের সম্পর্ক, এর বাইরে কিছু নয়।” কিন্তু দিনের শেষে ডায়েরি যখন খুলত, তখন কলমের নিব বারবার লিখে যেত—“আমরা কি কেবল বন্ধু? নাকি কিছু বেশি?” অলকের লেখা চিঠির মতো দীর্ঘ মেসেজ, কিংবা হঠাৎ কোনো বইয়ের লাইন পাঠিয়ে দেওয়া, এসবই তাকে অনিশ্চয়তার ভেতর ডুবিয়ে দিচ্ছিল। সে জানত, যদি হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতি স্বীকার করে নেয়, তবে হয়তো সবকিছু বদলে যাবে। তবু এক অদ্ভুত টান তাকে প্রতিদিন অলকের কাছে টেনে নিচ্ছিল।

দিন গড়াতে গড়াতে মৌসুমির ভেতরের দ্বন্দ্ব তীব্র হয়ে উঠল। তার ডায়েরি হয়ে উঠল সেই দ্বন্দ্বের একমাত্র সাক্ষী। পাতার পর পাতা সে লিখে যেত—“আজ ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, আমরা দুজন যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। কিন্তু আমি কি ভুল ভাবছি? যদি সবটাই আমার কল্পনা হয়?” এই অনিশ্চয়তার মাঝেই তার লেখাগুলো আরও আবেগপ্রবণ হয়ে উঠছিল। আগে যে লেখায় নিছক কল্পনার ছাপ থাকত, এখন সেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতির রঙ গভীর হচ্ছিল। অলক সেই লেখাগুলো পড়ে বারবার বিস্মিত হত, বলত—“তুমি কি জানো, তোমার প্রতিটি লাইন আমার ভেতরে একেকটা ঢেউ তোলে?” মৌসুমি চুপ করে যেত, অথচ মনে মনে ভাবত—“তাহলে কি ও-ও কিছু বুঝতে পারছে?” প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর ছিল না, কিন্তু হৃদয়ের গোপন ঘরে যে আলো-ছায়ার খেলা হচ্ছিল, তা থামছিল না। মৌসুমি জানত, এ দ্বিধা একদিন তাকে স্পষ্ট কোনো পথে নিয়ে যাবে—হয় বন্ধুত্বের নিঃশর্ত আশ্রয়ে, নয়তো প্রেমের অনন্ত সম্ভাবনায়। কিন্তু আপাতত সে শুধু লিখে যাচ্ছিল, নিজের মনে প্রশ্ন করে যাচ্ছিল, আর প্রতিদিন একটু একটু করে অলকের দিকে আরও বেশি ঝুঁকে পড়ছিল।

অলক যেমনটা ভেবেছিল, মৌসুমির ডায়েরি কেবল তার লেখার খাতা নয়, সেটি আসলে তার জীবনের নিঃশব্দ আত্মকথা। ঘটনাটা ঘটল হঠাৎ করেই—সেদিন মৌসুমি ছাদে গাছের টব গোছাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত ডায়েরিটা একপাশে ফেলে রেখে দেয়। বাতাসে পাতাগুলো ওলটপালট হয়ে যায়, আর সেই সময়েই অলক ছাদে এসে পড়ে। প্রথমে সে কেবল তাকিয়ে থাকে, কিন্তু কিছু লেখা চোখে পড়তেই অদ্ভুত এক টান তাকে পাতা উল্টে দেখতে বাধ্য করে। পড়তে পড়তে তার ভেতরটা কেঁপে ওঠে—প্রতিটি লাইনে ঝরে পড়ছে মৌসুমির নিঃসঙ্গতা, দমবন্ধ যন্ত্রণা, সংসারের অবহেলার ভার, আর অজানা এক আকাঙ্ক্ষার টান। অলকের কাছে যেন প্রথমবার মৌসুমি সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে ধরা দিল—গৃহবধূর সামাজিক পরিচয়ের বাইরে এক নারী, যার ভেতরে আছে সৃষ্টির তীব্র তৃষ্ণা, ভালোবাসার জন্য অস্থির এক হৃদয়, আর স্বাধীনতার জন্য অগাধ আকুলতা। প্রতিটি শব্দ যেন শিরায় শিরায় ঢুকে যাচ্ছিল, আর অলক বুঝতে পারছিল, এ ডায়েরি কোনো সাধারণ লেখা নয়, বরং এক দমবন্ধ আত্মার মুক্তি খোঁজার আর্তি। তার নিজের সাংবাদিক সত্তা মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গিয়ে কেবল এক মানুষ হয়ে উঠল সে, যে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে অন্য এক মানুষের উন্মোচিত অন্তর্জগতে।

ডায়েরি পড়তে পড়তে অলকের মনে অস্বস্তি আর অপরাধবোধও জন্ম নিতে লাগল। সে জানত, অনুমতি ছাড়া এভাবে কারও ব্যক্তিগত লেখা পড়া উচিত নয়, তবুও চোখ ফেরাতে পারছিল না। প্রতিটি পাতায় নতুন নতুন অনুভূতির বিস্ফোরণ, প্রতিটি বাক্যে জমে থাকা অশ্রুর ছাপ তাকে অস্থির করে তুলছিল। মৌসুমি লিখেছিল—“আমি প্রতিদিন সংসারের ভিড়ে হারিয়ে যাই, অথচ এই ছাদ আর ডায়েরিই আমাকে আবার খুঁজে পায়।” কোথাও লিখেছিল—“অভিজিতের চোখে আমি নেই, আমি শুধু একজন দায়িত্ব পালনকারী যন্ত্র। কিন্তু আমার ভেতরে যে নারী আছে, তার স্বপ্ন, তার আকাঙ্ক্ষা, তা কি কেউ কখনও বুঝবে?” এমনকি কিছু লাইনে অলক নিজের উপস্থিতিও টের পেল—“আজ ওর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, আমি আর একা নই। তবু ভয় হয়, এটা কি কেবল বন্ধুত্ব নাকি তার ভেতরে লুকোনো অন্য কিছু?” এসব পড়তে পড়তে অলকের বুকের ভেতর এক অদ্ভুত শিহরণ জেগে উঠল। মৌসুমি কি সত্যিই তাকে অন্যভাবে ভাবছে? নাকি এগুলো নিছক কল্পনার বহিঃপ্রকাশ? দ্বিধায় ভরা মনের ভেতরেও অলক বুঝতে পারল, মৌসুমি তার কাছে আর কেবল একজন প্রতিবেশী বা লেখক নন—সে এক গভীর জগতের দরজা খুলে দিয়েছে, যেখানে দুঃখ আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে, আবার অজানা ভালোবাসার আভাসও আছে। এই আবিষ্কার তাকে যেমন টানছিল, তেমনি ভয়ও দেখাচ্ছিল।

অন্যদিকে মৌসুমি যখন ফিরে এসে টের পেল যে তার ডায়েরি অলকের হাতে, তখন বুকের ভেতর হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। সে এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারল না কী বলবে—রাগ, লজ্জা, ভয়, সবকিছু মিলেমিশে তাকে নিঃশব্দ করে দিল। তার মনে হল, নিজের ভেতরের সব নগ্ন সত্য যেন হঠাৎ প্রকাশ হয়ে গেল কারও সামনে। যেসব অনুভূতি সে লুকিয়ে রেখেছিল সংসার, সমাজ এমনকি নিজের কাছ থেকেও, সেগুলো আজ অন্যের চোখে নগ্ন হয়ে পড়েছে। কিন্তু অলকের চোখে কোনো কৌতুক বা কৌতূহল ছিল না, বরং ছিল এক গভীর শ্রদ্ধা আর সহমর্মিতা। সে নরম গলায় বলল, “তুমি ভেবেছ তোমার কষ্ট কেউ বোঝে না। অথচ তুমি যা লিখেছ, তা শুধু লেখা নয়, তা এক অমূল্য সত্য। তুমি নিজের যন্ত্রণা, নিজের আকাঙ্ক্ষা এতটা সত্যভাবে প্রকাশ করেছ যে, আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তুমি যা লিখছ, তা শুধু ডায়েরির পাতায় আটকে থাকার মতো নয়।” মৌসুমি বুঝতে পারল, তার গোপন ভেঙে গেছে, কিন্তু একই সঙ্গে এক নতুন দরজাও খুলে গেছে। ভয়, লজ্জা আর অস্বস্তির ভেতর দিয়েও তার মনে হল, অলকের হাতে ধরা পড়া মানেই শেষ নয়, বরং হয়তো এখান থেকেই শুরু হবে তার জীবনের এক নতুন অধ্যায়। ডায়েরি যেমন তার আত্মার আয়না, তেমনি আজ সেটি হয়ে উঠেছে দুই মানুষের মধ্যে অদৃশ্য বন্ধনের প্রথম সেতু।

বহুতলের সিঁড়িঘরে যেন হাওয়ার দিকটাই পাল্টে গেল। কয়েকটি অচেনা শব্দ, কয়েকটি লিখিত বাক্য—সেটুকুই যথেষ্ট ছিল এক বহুতল ফ্ল্যাটে নিত্যদিনের নিরানন্দ সুরকে বিদ্যুতের মতো কাঁপিয়ে দেওয়ার জন্য। মৌসুমির ডায়েরির কিছু অংশ কে বা কারা গোপনে ছড়িয়ে দিল, যেন নিছক খেলাচ্ছলে ছিঁড়ে রাখা কয়েকটি পাতা লিফটের দরজার পাশে, ডাকবাক্সের কোণে, কিংবা মেঝেতে পড়ে আছে। বাক্যগুলো ছোট হলেও কাঁটার মতো বিঁধে গেল সবার মনে—“শ্বাসরুদ্ধ এই জীবন থেকে পালাতে চাই”, “সংসারের ঘেরাটোপে আমি ডুবে যাচ্ছি”, কিংবা “কারো কাছে কি আমার ব্যথার খবর পৌঁছয়?” …প্রতিবেশীরা একে একে পড়ে নিচু স্বরে ফিসফিস করতে শুরু করল। রান্নাঘরে ভেসে আসা ধোঁয়া কিংবা বাজারের ব্যাগে ভরা সবজির চেয়ে এখন সবার মুখে মুখে একটাই বিষয়—‘মৌসুমির ডায়েরি’।

অভিজিত প্রথমে কিছুই জানত না। সন্ধেয় অফিস থেকে ফিরেই সে অনুভব করল এক অদ্ভুত নীরবতা। লিফটে ওঠার সময় পাশের ফ্ল্যাটের অনিন্দিতা হেসে কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল, যেন অজানা অপরাধে দোষীকে সামনে পেয়ে গেছে। কারও চোখে বিস্ময়, কারও চোখে তাচ্ছিল্য—অভিজিত বুঝতে পারছিল না কী হচ্ছে। ঘরে ঢুকতেই মৌসুমিকে পেল নিস্তব্ধ, চুল খুলে বসে আছে জানালার ধারে, হাতে একখানা ফাঁকা ডায়েরি। চোখের নিচে ঘন কালো ছাপ, ঠোঁট কাঁপছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না। অভিজিত দ্বিধায় জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে, সবাই আজ আমাকে এভাবে দেখছে কেন?”—কিন্তু উত্তর আসেনি। পরে পাশের বাচ্চারা খেলার ছলে বলল, “কাকু, কাকুর বৌদির লেখা কাগজ নীচে পড়ে গেছিল।” তখনই অভিজিত স্তম্ভিত হয়ে সবকিছু বুঝতে পারল। তার স্ত্রী, যাকে এতদিন শুধু সংসারের দায়িত্বে ডুবে থাকা এক সাধারণ নারী মনে হয়েছিল, আজ হঠাৎ সবার চোখে হয়ে উঠেছে অস্থির, অসন্তুষ্ট, সংসারের গণ্ডি ভাঙতে চাওয়া এক রহস্যময়ী।

রাতে খাওয়ার টেবিলে দু’জনের মাঝে দেয়াল তৈরি হল। অভিজিত একদিকে অপরাধবোধে জর্জরিত—সে কি কখনো বুঝেছিল মৌসুমির নীরব চিৎকার? অন্যদিকে রাগও হচ্ছিল—এইসব ব্যক্তিগত কথা কেন লিখবে ও? কেন এমন ভাবনায় ডুবে থাকবে? মৌসুমি কোনও উত্তর দিল না। তার ভেতরে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে, বাইরে কেবল নিস্তব্ধতা। বহুতলের গৃহিণীরা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করছে—“দেখেছো? এতদিন সংসারী ভেবেছিলাম, আসলে ভেতরে কত আগুন!” আবার কেউ বলছে—“বেচারি, হয়তো খুব একা লাগে।” কিন্তু সমবেদনার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত আনন্দ, কারও গোপন ডায়েরি পড়ে নেওয়ার নিষিদ্ধ সুখ। মৌসুমির চোখে জল জমল। সে অনুভব করল, কাগজের পাতায় তার গোপন স্বীকারোক্তি এখন ফ্ল্যাটজুড়ে ঝড় ডেকে এনেছে—এ ঝড় কাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সে এখনও জানে না।

রাত্রি নামার পরও ছাদের গাছপালার কাছে আলো জ্বেলে বসেছিল মৌসুমি। চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে ধরলেও উপরে বিস্তৃত আকাশ ছিল অনন্ত মুক্তির প্রতীক। বিগত কয়েকদিন ধরে ফ্ল্যাটজুড়ে কটূক্তি, ফিসফিসানি, সন্দেহ আর তির্যক দৃষ্টি তার ভেতরটাকে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিল। কখনও মনে হচ্ছিল, সব ছেড়ে পালিয়ে যায় কোথাও, যেখানে কেউ নেই, কেবল প্রকৃতির সান্নিধ্য। আবার কখনও মনে হচ্ছিল, হয়তো তার ডায়েরি ধ্বংস করে দিলে সব শেষ হয়ে যাবে, কেউ আর তার ভেতরের সত্য জানবে না। কিন্তু এই গাছগুলো—যাদের নিজের হাতে সে রোপণ করেছে, প্রতিটি পাতার সঙ্গে যার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে—তারা যেন নীরবে তাকে বলছিল, পালিয়ে যাওয়া নয়, লুকিয়ে থাকা নয়, বরং দাঁড়িয়ে থাকা। গাছেরা যেমন ঝড়ের পরও মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তেমনি তাকেও নিজের ভেতরের ঝড় কাটিয়ে উঠে দাঁড়াতে হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে মৌসুমি অনুভব করল, তার গোপন আকাশ আর গোপন নেই, এখন সেটি খোলাখুলি, সবার সামনে উন্মুক্ত। আর এই উন্মোচন থেকে ভয় নয়, বরং এক নতুন শক্তিই জন্ম নিচ্ছে তার ভেতরে।

মৌসুমি বুঝল, এতদিন যেটাকে লজ্জা, অপমান, ব্যথা মনে করেছিল, আসলে সেটিই তার নিজের সত্যি সত্তা। সমাজ তাকে ‘সংসারী গৃহবধূ’র খাঁচায় আটকে রাখতে চেয়েছিল, কিন্তু তার কলম, তার গাছপালা আর আকাশ তাকে বারবার মনে করিয়েছে—সে কেবল দায়িত্বের যন্ত্র নয়, সে একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, যে বাঁচতে চায় নিজের শর্তে। অভিজিতের সন্দেহভরা চোখ, প্রতিবেশীদের ফিসফিসানি কিংবা অলকের অনিচ্ছাকৃত বিশ্বাসঘাতকতা—এসবের মাঝেই সে উপলব্ধি করল, তার জীবন অন্যের চোখে ধরা দেওয়ার জন্য নয়। সে লিখেছে, সে স্বপ্ন দেখেছে, আর সে বাগান সাজিয়েছে—সবই নিজের বেঁচে থাকার জন্য, নিজের ভেতরের আলোকে টিকিয়ে রাখার জন্য। আজ, এই ছাদে দাঁড়িয়ে, সে ঘোষণা করল নীরবে—“আমি আর লুকিয়ে থাকব না। আমার লেখা যদি অশান্তি ডাকে, তা ডাকুক; আমার স্বপ্ন যদি কারও চোখে অস্থিরতা হয়, তা হোক। আমার জীবন, আমার ডায়েরি, আমার আকাশ—সবই আমার নিজের।” এই স্বীকারোক্তি যেন তার শরীর জুড়ে মুক্তির বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিল। একেকটা টব, একেকটা সবুজ পাতা যেন তার সাক্ষী হয়ে উঠল।

দূরে আকাশে ভেসে আসা ম্লান তারাগুলো ঝিলমিল করছিল, আর মৌসুমির মনে হচ্ছিল তারা যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছে। যতদিন ধরে সে ভেবেছিল, তার জীবন অন্যদের হাতে বন্দী, ততদিন আসলে সে নিজেকেই ছোট করে দেখেছে। কিন্তু আজকের রাত অন্যরকম। আজ সে জানল, নিজের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কেউ যদি সত্যিই শক্ত হয়ে থাকে, তবে তাকে ভাঙার সাধ্য কারও নেই। মৌসুমির চোখে জল এল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়—মুক্তির। ডায়েরির পাতাগুলো এবার বাতাসে উড়ছিল না, ওগুলো শক্ত করে ধরা ছিল তার হাতে। এবার সে লিখবে, কিন্তু ভয়ে নয়—অহংকারে। এবার সে বাঁচবে, কিন্তু লুকিয়ে নয়—খোলাখুলিভাবে। ফ্ল্যাটজুড়ে ঝড় উঠুক, অপমান হোক, সন্দেহ আসুক—তবু তার ছাদের আকাশ, তার সবুজ বাগান, তার নিঃশব্দ কলম থাকবে তার সঙ্গী হয়ে। এটাই তার সত্যি, আর এই সত্যির সামনে কোনো সামাজিক মুখোশের আর দাম নেই। মৌসুমি আকাশের দিকে তাকাল, গভীর নিঃশ্বাস নিল, আর মনে মনে বলল—“আজ আমি আমার নিজের।”

শেষ

1000055232.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *