Bangla - প্রেমের গল্প

ছাদবাগানের গল্প

Spread the love

অভিক ধর


শহরের জীবন মানেই একটানা দৌড়ঝাঁপ, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অফিসের চাপ, যানজট, হর্নের শব্দ আর ব্যস্ততার ক্লান্তি। কংক্রিটের এই জগতে মানুষ খুঁজে ফেরে একটুখানি শান্তির আশ্রয়, যেখানে নেই হইচই, নেই ক্লান্তি—শুধু নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সুযোগ। এই শহরের এক বহুতল ভবনের ছাদে ঠিক তেমনই এক আশ্রয় তৈরি করেছে নায়িকা তৃণা। দিনভর অফিসের কাজ আর একা থাকার নিঃসঙ্গতার মাঝেও তার মন খুঁজে নেয় অন্যরকম আনন্দ—গাছপালার সান্নিধ্য। ছাদের এক কোণ জুড়ে সাজানো টব, ড্রাম, পুরোনো বালতি আর কৌটোতে নানা রঙের ফুল, ঔষধি গাছ আর শাকসবজি। প্রতিদিন সকালে কাজের আগে সে গাছগুলোকে জল দেয়, শুকনো পাতা ছেঁটে ফেলে, আর বিকেলে ফিরে আবারও তাদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটায়। শহরের ধোঁয়া-ধুলোর মধ্যে এই সবুজ টুকরোই যেন তার শ্বাস নেওয়ার জায়গা। তৃণার কাছে এই বাগান শুধু শখ নয়, বরং একধরনের আত্মীয়তা, যেখানে সে নিজের ক্লান্তি, আনন্দ আর দুঃখ ভাগ করে নিতে পারে। প্রতিটি ফুল ফোটা, প্রতিটি নতুন কুঁড়ি গজানো তার জীবনের একেকটা ছোট্ট অর্জন, যেন গাছের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেও একটু একটু করে নতুন করে বাঁচতে শেখে। তার প্রতিবেশীরা অনেকেই এই শখকে অদ্ভুত মনে করে, বলে এত ব্যস্ত শহরে গাছ লাগিয়ে সময় নষ্ট করার কী দরকার। কিন্তু তৃণার কাছে গাছগুলোই জীবনের প্রাণ, প্রতিদিনের একঘেয়ে সময়ের মধ্যে ভিন্ন এক রঙ।

যদিও ছাদের এই বাগান তার আনন্দের জায়গা, তবুও শহরের ভিড় আর ব্যস্ততার কারণে অনেক সময়ই সে মনে করে, জীবনটা যেন বড় বেশি একঘেয়ে। কাজের চাপ, একা থাকার নিঃসঙ্গতা, আর চারপাশে যান্ত্রিক মানুষের ভিড় তাকে মাঝেমধ্যে হতাশ করে তোলে। তবুও প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই সে ছাদে উঠে যায়—ক্লান্ত শরীর হলেও মনটা যেন খুঁজে পায় শান্তি। একে একে টবগুলোতে জল ঢালে, পাতার ধুলো মুছে দেয়, শুকনো ডাল ছেঁটে ফেলে। গাছের সবুজ পাতা আর ফুলের কোমল সৌন্দর্য তাকে মনে করিয়ে দেয়—এখনও পৃথিবীতে সৌন্দর্য আছে, এখনও ছোট ছোট জিনিসেই পাওয়া যায় সুখ। ঠিক এমন এক সন্ধ্যাতেই হঠাৎ সে খেয়াল করে, পাশের ছাদ থেকে ভেসে আসছে অচেনা এক সুর। গিটারের টানটান তারে বাজছে মৃদু সুর, যা বাতাসে মিশে এসে তার গাছেদের পাতায় দোল খাওয়াচ্ছে। তৃণা থমকে দাঁড়ায়। শহরের এত শব্দ, এত কোলাহলের মাঝেও এই সুরটা যেন অন্যরকম—শান্ত, কোমল, হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া। সে প্রথমে ভাবে হয়তো কেউ রেডিও চালিয়েছে বা মোবাইল থেকে গান বাজছে, কিন্তু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে বুঝতে পারে, পাশের ছাদের এক কোণে বসে আছে একজন যুবক, গিটার হাতে মনোযোগ দিয়ে বাজাচ্ছে। শহরের কোলাহলের ভিড়েও তার ভঙ্গিটা যেন একদম ভিন্ন—চোখ বুঁজে সুরে ডুবে থাকা, নিজের একান্ত জগতে হারিয়ে যাওয়া।

তৃণার মনে হঠাৎ অদ্ভুত এক অনুভূতি জাগে। এতদিন এই শহরে সে যত মানুষের ভিড় দেখেছে, তারা সবাই যেন কেবল দৌড়াচ্ছে, নিজের কাজ আর সাফল্যের পেছনে ছুটছে। অথচ এই ছেলেটি যেন অন্য এক মানুষ—যে কোলাহলের মধ্যে থেকেও খুঁজে পেয়েছে নিজের শান্তির ভাষা। গিটারের সুরটা ছাদের বাতাসে ভেসে এসে তৃণার হৃদয়ে দোলা দেয়। সে জল দেওয়ার কাজ থামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে শোনে, তারপর আবার টবের গাছগুলোর দিকে ফিরে যায়। কিন্তু মনের ভেতর সেই সুরটা রয়ে যায়, যেন তার নিঃশব্দ জীবনে হঠাৎ কোনো অচেনা আলো এসে পড়েছে। সেই রাতে বিছানায় শুয়েও সে মনে মনে গিটারের সুর শুনতে থাকে, আর ভাবে—কে এই ছেলেটি? প্রতিদিন কি সে গিটার বাজায়? তৃণার একঘেয়ে জীবন যেন হঠাৎ করেই একটু রঙিন হয়ে ওঠে। ছাদবাগানের সবুজ আর পাশের ছাদ থেকে ভেসে আসা গিটারের সুর—এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই শুরু হয় এক নতুন গল্পের আভাস।

পরের দিন সন্ধ্যাতেই তৃণা আবার ছাদে উঠে আসে, যেমন প্রতিদিন করে। কিন্তু আজ তার ভেতরে অদ্ভুত এক আগ্রহ কাজ করছে। গাছগুলোকে জল দেওয়ার মাঝেই সে কানে কানে খুঁজছে সেই গিটারের সুর। ব্যস্ত শহরের বাতাসে অনেক শব্দ—গাড়ির হর্ন, বাজার থেকে আসা আওয়াজ, দূরের রেলস্টেশনের ঘোষণা, আবার কোথাও থেকে টিভির কোলাহল। তবুও সেই সব শব্দের মাঝ দিয়ে হঠাৎ ভেসে আসে পরিচিত এক তারের ঝংকার। তৃণার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। সে ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে পাশের ছাদের দিকে তাকায়। আগের দিনের মতোই ছেলেটি বসে আছে, হাতে গিটার, চোখে গভীর মনোযোগ। আকাশে তখন হালকা অন্ধকার, সূর্যের শেষ রোদ ছাদের উপর ছড়িয়ে পড়েছে। গিটার হাতে ছেলেটিকে দেখে মনে হয় যেন এই কংক্রিটের শহরের মাঝখানে কোনো শিল্পী বসে আছে, যে নিজের জগৎ বানিয়েছে সুরের ভেতরে। তৃণার মনে হয়, এই সুর কেবল শোনার নয়, বরং অনুভব করার মতো। তার বুকের ভেতর জমে থাকা একাকিত্ব, সারাদিনের ক্লান্তি, অফিসের চাপ—সবকিছু যেন মুহূর্তের মধ্যে হালকা হয়ে আসে। গাছের পাতায় ঝরে পড়া সন্ধ্যার আলো, বাতাসে দুলতে থাকা ফুল আর সেই সঙ্গে গিটারের সুর—সব মিলিয়ে ছাদ যেন পরিণত হয় এক অন্যরকম জগতে।

তৃণা প্রথমে কিছুটা সংকোচ নিয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। তার ইচ্ছে করে ছেলেটির কাছে গিয়ে বলে—“তুমি দারুণ বাজাও।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে থামিয়ে নেয়। এতদিনে তো একবারও কথা হয়নি, হঠাৎ গিয়ে কী বলবে? হয়তো ছেলেটি বিরক্ত হবে। তাই সে আবার নিজের কাজে মন দেয়, টবে জল ঢালে, শুকনো পাতা তুলে ফেলে। কিন্তু কানে কানে চলতে থাকে সেই সুর। মাঝে মাঝে তার চোখ গিয়ে পড়ে পাশের ছাদের দিকে। সে খেয়াল করে, ছেলেটি একেবারে অন্যরকমভাবে বাজায়—শুধু গান গাওয়ার জন্য নয়, যেন নিজের মনের কথা বলছে তারের ঝংকারে। প্রতিটি টান, প্রতিটি কর্ড যেন একেকটা অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। তৃণা ভাবে, এই ছেলেটি নিশ্চয়ই অনেক কিছু ভেবে বাজায়, হয়তো তারও জীবনে কোনো একাকিত্ব আছে, হয়তো সেই একাকিত্ব ভরাট করে সে সুর দিয়ে। তার ভেতরে ভেতরে অচেনা এক টান জন্ম নেয়, কিন্তু সে তা স্বীকার করতে চায় না। নিজের মনে বোঝাতে চায়—এ তো কেবল সুর, এর বেশি কিছু নয়।

রাত বাড়তে থাকে, গিটার থেমে যায়, ছাদ অন্ধকারে ঢেকে যায়। তৃণা ঘরে ফিরে আসে, কিন্তু মনটা এখনও সুরের ভেতরে আবদ্ধ। বিছানায় শুয়ে সে ভাবতে থাকে—এমন সুর আগে কোনোদিন কানে আসেনি। কেন যেন মনে হয়, এই সুর কেবল তার জন্যই বাজানো হচ্ছে। পরদিন সকালেও যখন সে ছাদে গিয়ে গাছের টবগুলোতে জল দেয়, তখনও সেই গিটারের তারের শব্দ তার মনে বাজতে থাকে। একসময় সে বুঝতে পারে, এই সুর তার জীবনে নতুন কিছু নিয়ে এসেছে। এতদিন ছাদ ছিল শুধু সবুজের এক টুকরো স্বপ্ন, কিন্তু এখন সেই ছাদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অন্য এক অনুভূতি—অচেনা কারও উপস্থিতি। শহরের ভিড়ে একাকী জীবন হঠাৎ যেন একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তৃণার অজান্তেই শুরু হয়েছে এক নতুন অধ্যায়, যেখানে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে গিটারের সুর, আর সেই সুরেই বাঁধা পড়ে তার নিঃসঙ্গ হৃদয়।

সেদিন বিকেলটা ছিল অন্যসব দিনের চেয়ে কিছুটা আলাদা। সারাদিনের গুমোট গরমের পর হঠাৎ কালো মেঘ জমে শহরের আকাশ ঢেকে ফেলেছিল, দূরে বজ্রপাতের আলোয় আকাশ কেঁপে উঠছিল, আর হালকা বাতাসে যেন ছাদবাগানের গাছগুলো নাচতে শুরু করেছিল। তৃণা অফিস থেকে ফিরে এসেই ছাদে চলে আসে, টবগুলোতে জল দেওয়ার জন্য নয়, বরং নিজের ভেতরের অদ্ভুত অস্থিরতাকে একটু শান্ত করার জন্য। দিনের পর দিন গিটারের সুর শুনে তার মনে যে কৌতূহল জমে উঠেছিল, আজ যেন তা আরও বেশি তীব্র। সে দাঁড়িয়ে গাছেদের পাতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল, তখনই পাশের ছাদ থেকে ভেসে এলো পরিচিত তারের শব্দ। মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই সে অবাক হয়ে যায়—আজ ছেলেটি বাজানোর ফাঁকে হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসল। এতদিন সে কেবল পাশের ছাদে সুর শুনেছে, কিন্তু আজ যেন চোখে চোখে হলো প্রথম আলাপ। মুহূর্তের জন্য তৃণার বুক ধড়ফড় করে ওঠে, মনে হয় যেন ধরা পড়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক অচেনা উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ে।

ছেলেটির নাম তখনও তার অজানা, কিন্তু চোখে-মুখে এক ধরনের শান্তি ছিল, যা শহরের আর দশজন মানুষের থেকে আলাদা। সে গিটার বাজাতে বাজাতে আরেকবার তাকাল, যেন বলতে চাইছে—“শোনো, এই সুর শুধু তোমার জন্য।” তৃণা গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকায়, আর ভাবে, কী আশ্চর্য ব্যাপার! এতদিনের নিঃসঙ্গ সন্ধ্যাগুলোতে যেখানে শুধু গাছ ছিল তার সঙ্গী, সেখানে আজ যেন এক অচেনা মানুষ হঠাৎ ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এই অচেনাতেই অদ্ভুত এক টান আছে। সে নিজের মনে নিজেকে বোঝায়—এ কেবল কাকতালীয়, এর কোনো মানে নেই। কিন্তু মনটা যেন মানতে চায় না। শহরের কোলাহল, হর্ন, ট্রাফিকের শব্দ, সবকিছুর মাঝেও তাদের ছাদের মাঝখানে তৈরি হয়ে গেছে এক অদৃশ্য সেতু, যা যুক্ত করছে গিটারের সুর আর তৃণার ছাদবাগানের সবুজকে। গাছের পাতার দোল, বাতাসে ফুলের গন্ধ আর তারের ঝংকার—সবকিছু যেন মিলেমিশে তৈরি করছে এক নিঃশব্দ আলাপন।

সেদিন রাতে ঘুমোতে গিয়েও তৃণা বারবার সেই চোখাচোখির মুহূর্তটা মনে করতে থাকে। তার মনে হয়, এতদিনের অচেনা সুর হঠাৎ যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে, এখন সে শুধু শব্দ নয়, বরং একজন মানুষের উপস্থিতির সঙ্গে বাঁধা। এই প্রথম সে অনুভব করে, তার একাকিত্বের প্রাচীর ভাঙতে শুরু করেছে। হয়তো একদিন নাম জানবে, হয়তো কথা হবে, কিন্তু আপাতত এই নীরব পরিচয়ই তাকে ভরিয়ে তুলছে। তৃণার জীবনে ছাদবাগান ছিল তার সবকিছু, কিন্তু আজ থেকে সেই বাগানেই শুরু হলো নতুন এক গল্পের বীজ বপন—যেখানে ফুলের গন্ধ আর গিটারের সুর মিলেমিশে প্রথম দেখা আর প্রথম অনুভূতির সূচনা করল।

দিনগুলো একের পর এক গড়িয়ে যাচ্ছিল, আর প্রত্যেক সন্ধ্যা যেন তৃণার কাছে নতুন এক অপেক্ষা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। অফিস থেকে ফেরার পথে সে এখন আর ক্লান্তি নিয়ে ভাবে না, বরং মনে মনে কল্পনা করে, আজ আবার পাশের ছাদ থেকে ভেসে আসবে গিটারের সুর, আর সেই সুরের ফাঁক দিয়ে এক ঝলক চোখাচোখি হবে। অচেনা ছেলেটির সঙ্গে এই নীরব সম্পর্কের মধ্যেই যেন সে নতুন করে বাঁচার রং খুঁজে পায়। তৃণা গাছের যত্ন নিতে নিতে মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করত—যদি একটু কথাও হয়! কিন্তু সাহস জুটত না। তবে একদিন হঠাৎ করেই সুযোগ এসে গেল। তার টবের একটা ফুলগাছের শিকড় হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল, আর মাটি ছড়িয়ে পড়েছিল ছাদের একপাশে। সে যখন তা গুছিয়ে তুলছিল, তখন পাশের ছাদ থেকে ছেলেটি হেসে বলে উঠল, “ফুলটা খুব সুন্দর, কিন্তু মনে হচ্ছে একটু বেশি জল পেয়েছে।” তৃণা প্রথমে ভড়কে গিয়েছিল, কিন্তু তার মুখের হাসি আর গলার স্বরে অদ্ভুত এক আন্তরিকতা ছিল। অচেনা হলেও কথাটা যেন একদম পরিচিত মনে হচ্ছিল। কিছুক্ষণ থেমে তৃণা শুধু বলেছিল, “হয়তো তাই। আমি যত্ন করি, কিন্তু কখনও কখনও বুঝতে পারি না।” আর সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হলো তাদের প্রথম আলাপ।

এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই দুজনের মধ্যে ছোট ছোট কথা হতে লাগল। কখনও গাছের নাম নিয়ে, কখনও সঙ্গীত নিয়ে, আবার কখনও শুধু আবহাওয়া নিয়েই। তৃণা শিখল ছেলেটির নাম অরণ্য—শহরের এক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করে, কিন্তু গিটারই তার আসল ভালোবাসা। অরণ্যও অবাক হয়ে শুনল তৃণার গল্প—অফিসের একঘেয়ে কাজের ফাঁকে কীভাবে সে ছাদবাগান তৈরি করেছে, আর গাছগুলোকে নিজের সন্তানের মতো যত্ন করে। ধীরে ধীরে তাদের কথোপকথন বাড়তে লাগল। অরণ্য মাঝে মাঝে নতুন কোনো সুর বাজিয়ে শোনাত, তৃণা শোনার সময় গাছেদের মতো মাথা দোলাত, আর তার চোখে আনন্দের ঝিলিক ফুটে উঠত। আবার তৃণা কোনো ফুল ফোটার খবর দিলে অরণ্য সেই ফুল দেখতে চেয়ে পাশের ছাদের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াত। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই যেন তাদের মধ্যে তৈরি করছিল অদ্ভুত এক সখ্য। শহরের কোলাহল, প্রতিযোগিতা, যান্ত্রিক দিনযাপন—সব ভুলিয়ে দিচ্ছিল এই ছাদের সন্ধ্যা।

একদিন হঠাৎ বৃষ্টি এলো। কালো মেঘে ঢেকে গেল শহরের আকাশ, ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়তে লাগল। তৃণা ছুটে ছাদে এসে গাছগুলো সরানোর চেষ্টা করছিল, তখনই অরণ্যও তার ছাদ থেকে ডেকে উঠল—“ছাতা নেই?” তৃণা ভিজে ভিজে হেসে উত্তর দিল, “গাছদের আগে ভিজতে দিই, তারপর নিজেকে বাঁচাই।” অরণ্য তখন হেসে গিটারটা পাশে রেখে ছাতাটা বাড়িয়ে ধরল দেওয়ালের ওপাশ থেকে। বৃষ্টির জল, ছাতার নিচে দুজনের হঠাৎ তৈরি হওয়া আশ্রয় আর হাসির শব্দ—সেই মুহূর্তেই তাদের বন্ধুত্ব যেন আরও গভীর হলো। বৃষ্টির ফোঁটা গাছেদের পাতায় পড়ে সুর তুলছিল, আর অরণ্যের চোখে যেন নতুন এক সুর বাজছিল। তৃণার মনে হলো, এতদিনের নিঃসঙ্গতা আর ব্যস্ততার ভিড়ের মধ্যে সে অবশেষে খুঁজে পেল এমন একজনকে, যে তার সবুজ ভালোবাসা আর সন্ধ্যার নীরবতাকে সত্যিই বোঝে। বন্ধুত্বের আভাস তখনই স্পষ্ট হয়ে উঠল, আর সেই আভাসই তাদের সম্পর্ককে নিয়ে গেল এক নতুন পথের দিকে।

দিনগুলো যত গড়িয়ে যাচ্ছিল, তৃণা আর অরণ্যের ছাদের সন্ধ্যাগুলো ততই রঙিন হয়ে উঠছিল। প্রথমে দূর থেকে কথা, তারপর ছাদের দেওয়ালের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে গল্প—এভাবেই একসময় দুজনের মাঝে তৈরি হলো আরও স্বাচ্ছন্দ্য। অরণ্য একদিন নিজেই প্রস্তাব দিল, “তোমার ছাদে বাগান এত সুন্দর, একদিন যদি এসে দেখি?” তৃণা প্রথমে লজ্জায় কিছু বলতেই পারছিল না, কিন্তু চোখের চাহনিতে ছিল স্পষ্ট সম্মতি। সেইদিন সন্ধ্যায় অরণ্য সত্যিই এল তার ছাদে। ছাদে পা দিয়েই সে বিস্ময়ে বলে উঠল, “এ যেন শহরের ভেতরে আরেকটা ছোট্ট স্বর্গ!” টবের পর টব সাজানো ফুল, লতানো গাছ, সবুজ পাতার সারি—সবকিছু অরণ্যকে মুগ্ধ করেছিল। তৃণা হেসে বলল, “স্বর্গ হলে তুমি সুর বাজাবে, আমি জল দেব।” অরণ্য গিটার হাতে বসল, আর তৃণা গাছেদের পাশে দাঁড়িয়ে টবগুলোতে জল দিতে লাগল। গাছের পাতায় ফোঁটা ফোঁটা জলের শব্দ আর গিটারের সুর মিলেমিশে ছাদটাকে এক অদ্ভুত মায়ায় ভরে দিল। শহরের নিচে তখন হর্ন বাজছিল, মানুষজন ছুটছিল, কিন্তু সেই ছাদের ওপরে যেন অন্য এক জগৎ তৈরি হলো, যেখানে ছিল কেবল সবুজ আর সুর।

সন্ধ্যা থেকে রাত গড়িয়ে গেল, কিন্তু তাদের গল্প ফুরোল না। তৃণা বলছিল, কোন গাছ কোথা থেকে এনেছে, কিভাবে যত্ন করে বড় করেছে। অরণ্য মন দিয়ে শুনছিল, মাঝে মাঝে হেসে বলছিল, “তুমি গাছ নিয়ে যেমন কথা বলো, আমি তেমন করে কখনও গিটার নিয়েও বলিনি।” তৃণার মুখে খুশির আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, কারণ এতদিনে কেউ তার এই শখকে এত গুরুত্ব দেয়নি। অন্যদিকে অরণ্যও নিজের সঙ্গীতের কথা খুলে বলছিল—কীভাবে ব্যস্ততার ফাঁকে সে গিটারকে আঁকড়ে ধরে থাকে, কীভাবে প্রতিটি সুর তার কাছে মানে বহন করে। তৃণা মুগ্ধ হয়ে শুনছিল, তার মনে হচ্ছিল, অরণ্যের সুর আর তার বাগান যেন একে অপরের পরিপূরক। সেই রাতে অরণ্য যখন একটি নরম সুর তুলল, তৃণার মনে হলো গাছেরা যেন দুলে উঠল সেই সুরে, ফুলের গন্ধে ছড়িয়ে পড়ল অচেনা মায়া।

দিনের পর দিন এই আড্ডা চলতে লাগল। কখনও অরণ্য নতুন গান নিয়ে আসত, কখনও তৃণা নতুন ফুল দেখাতো। ছাদের বাতাসে তারা দুজন একে অপরের উপস্থিতি উপভোগ করত। কোনোদিন চুপচাপ বসে থাকত, কোনোদিন হেসে কেটে যেত ঘন্টা। তৃণা বুঝতে পারছিল, অরণ্যের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো তার জীবনে অন্যরকম আনন্দ এনে দিচ্ছে। অফিসের ক্লান্তি, একাকিত্ব, সব ভুলিয়ে দেয় এই ছাদের মুহূর্ত। অরণ্যও অনুভব করছিল, তার সুরগুলো যেন তৃণার জন্যই আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। গিটার বাজানোর সময় সে বারবার তৃণার দিকে তাকিয়ে হাসত, আর তৃণা হাসি দিয়ে উত্তর দিত। ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কের বাঁধন আরও গভীর হয়ে উঠছিল। বন্ধুত্বের আড়ালে অচেনা এক আবেগ জন্ম নিচ্ছিল, যা এখনও কেউ মুখে আনেনি, তবুও বাতাসে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল। ছাদের এই আড্ডাগুলো শুধু সময় কাটানো নয়, বরং একে অপরের ভেতরের মানুষটিকে চেনার এক মধুর যাত্রা হয়ে উঠছিল।

সেই দিনটা শুরু থেকেই যেন ভালো যাচ্ছিল না। অফিসে সকালে একটা বড় প্রজেক্টের মিটিং ছিল, তৃণা যতই চেষ্টা করুক, তার আইডিয়াগুলোকে গুরুত্ব দিল না কেউ। সহকর্মীদের তাচ্ছিল্য, বসের বিরক্তি, আর সারাদিনের চাপ তার মনটাকে ভারী করে তুলেছিল। দুপুরে বন্ধুরা সবাই একসঙ্গে ক্যান্টিনে গেলেও তৃণা একা বসে ছিল ডেস্কে, কারণ আজ কারও সঙ্গ তার ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যা নামতেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাসায় ফিরল, মনে হচ্ছিল মাথার ভেতর যেন ঝড় বইছে। সে ভেবেছিল ছাদে উঠে গাছেদের সঙ্গে একটু সময় কাটাবে, তাতে হয়তো মন হালকা হবে। কিন্তু সেদিন ছাদে গিয়েও যেন শান্তি পেল না। গাছগুলো জল চাইছিল, কিন্তু সে জল দিতে গিয়েও থেমে গেল। টবের মাটি শুকিয়ে গিয়েছিল, পাতাগুলো নুইয়ে পড়েছিল, তবুও আজ তার ভেতরে গাছেদের যত্ন করার শক্তি নেই। হঠাৎ বুক ভরে উঠল অজানা কষ্টে, চোখ বেয়ে নেমে এলো জল। সে বসে পড়ল ছাদের এক কোণে, মাথা নিচু করে কান্না চেপে রাখতে চাইল, কিন্তু পারল না। শহরের আকাশ অন্ধকার হয়ে আসছিল, বাতাসে কেবল তার নিঃশব্দ কান্নার সুর মিশে যাচ্ছিল।

অরণ্য সেদিনও নিজের মতো গিটার হাতে বসেছিল। কিন্তু আজ বাজাতে বাজাতে খেয়াল করল, তৃণার ছাদটা অদ্ভুত নিস্তব্ধ। গাছের ফাঁক দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু সে গিটার শুনছিল না, জল দিচ্ছিল না, শুধু চুপচাপ বসে আছে। অরণ্যের মনে কেমন যেন লাগল। কিছুক্ষণ দ্বিধায় থাকল, তারপর গিটারটা একটু অন্যভাবে ধরল। সে ধীরে ধীরে একটা মেলোডি তুলল—একটা সুর, যা নরম, শান্ত, যেন মনকে জড়িয়ে ধরার মতো। তৃণা প্রথমে খেয়ালই করেনি, কিন্তু ধীরে ধীরে সুরটা তার কানে পৌঁছালো। কান্নার ভেতরেই সে তাকাল পাশের ছাদের দিকে। অরণ্যের চোখে ছিল মমতা, তার গিটারের প্রতিটি টান যেন বলছিল—“তুমি একা নও, আমি আছি।” সেই সুরের ভেতরেই তৃণা অনুভব করল এক অদ্ভুত শান্তি। তার বুকের ভেতর জমে থাকা ভার যেন একটু একটু করে হালকা হয়ে আসছে। কান্নার ভেতর হাসির রেখা ফুটে উঠল তার ঠোঁটে, যদিও চোখের জল তখনও থামেনি। কিন্তু সে জানল, আজকের এই কষ্টে সে একা নয়, কেউ একজন তার জন্য সুরের আশ্রয় তৈরি করে দিয়েছে।

রাত বাড়তে থাকল, সুর থেমে গেল, কিন্তু তৃণার ভেতরে অরণ্যের গিটার যেন বাজতেই থাকল। সে বুঝতে পারল, এই মানুষটা কেবল প্রতিবেশী নয়, কেবল গিটার বাজানো ছেলেও নয়—তার থেকেও বেশি কিছু। গাছেদের মতোই অরণ্যও তাকে শান্তি দেয়, তার ভেতরের ক্লান্তিকে মুছে দেয়। সেদিন রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তৃণা নিজের মনে স্বীকার করল, এতদিন যা কেবল বন্ধুত্ব ছিল, তা আজ অন্য রঙে রঙিন হয়েছে। হয়তো প্রেম শব্দটা মুখে আনেনি এখনও, কিন্তু মনের ভেতরে অরণ্যের সুরই যেন সবচেয়ে কাছের আশ্রয় হয়ে উঠেছে। শহরের হাজার শব্দের মাঝেও তার মনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল কেবল একটাই সুর—যে সুর তার মন খারাপের দিনেও তাকে ভরসা দেয়।

বসন্তের এক সন্ধ্যা শহরের আকাশে সোনালী আলো ছড়িয়ে পড়ছিল, আর ছাদের বাতাসে বাতাসের সঙ্গে মিশে ছিল ফুলের সুবাস। তৃণা ছাদে বসে ফুলের কুঁড়িগুলো পরীক্ষা করছিল, হঠাৎ মনে হলো পাশের ছাদের দিকে অরণ্য তাকাচ্ছে। তার হাতে গিটার, কিন্তু চোখে আজ এক অদ্ভুত উষ্ণতা। হঠাৎ সে ধীরে ধীরে গিটার বাজানো বন্ধ করে তৃণার দিকে হাঁটে, চোখে স্পষ্ট কিছু বলার ইচ্ছা। তৃণা কিছুটা লজ্জায় গাছের পাতায় হাত বুলিয়ে রাখে, কিন্তু অরণ্য থেমে যায় না। তার কণ্ঠে ভেসে ওঠে নরম সুর, আর সেই সুরের ভেতরেই বেরিয়ে আসে শব্দ—“তৃণা, আমি তোমাকে কিছু বলব। এই ছাদবাগান, এই সবুজ আর এই সুর—সবকিছুই শুধু তোমার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চেয়েছি। তুমি আমার জীবনের সেই সুর, যা আমি সারাজীবন খুঁজেছি।” তৃণা চোখ বড় করে তাকাল, এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো যেন তার হৃদয় থেমে গেছে। বাতাসে ফুলের সুবাস, গিটার থেকে বেরোয়া সুর, শহরের দূরের কোলাহল—সব মিলেমিশে তৈরি হলো এমন এক মুহূর্ত, যা শুধু তাদেরই জন্য।

তৃণা প্রথমে কিছু বলতে পারল না। তার ভেতরের অনুভূতি এতদিন লুকানো ছিল, আজ হঠাৎ অরণ্যের কথায় প্রকাশ পেয়ে যেন সে থরথর করে উঠল। লজ্জা, আনন্দ, বিস্ময়—সবকিছু একসঙ্গে তার মনে ভেসে উঠল। সে ধীরে ধীরে হাসল, চোখে জল ঝরে পড়ল, কিন্তু সেই হাসিতে ছিল স্পষ্ট সম্মতি। “আমি… আমিও…” তার কণ্ঠ নরম হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠল। অরণ্য তার দিকে এগিয়ে আসে, ছাদের ধুলো-মাটি ভরা পাথরের ওপর বসে ধীরে ধীরে হাত বাড়ায়। তৃণা তার হাত ধরে বসে যায়, আর সেই স্পর্শে তাদের দুজনের ভেতরে সেই বন্ধুত্ব, সেই সুর, সেই সবুজ—সব মিলেমিশে প্রেমের রূপ নেয়। তারা আরও কাছে বসে, গাছের পাতার দুল আর হাওয়ার নরম সুরের সঙ্গে মিলিয়ে, একসাথে নিশ্বাস নেয়।

রাত যখন গভীর হয়ে আসে, তারা ছাদে বসে কথা বলে। ছোট ছোট স্বপ্ন, শহরের আড্ডা, জীবনের আশা—সবই ভাগাভাগি হয়। তারা বুঝতে পারে, এই প্রেম কোনো হঠাৎ আগমন নয়, বরং বহুদিন ধরে ছোট ছোট মুহূর্তে তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনের চোখাচোখি, কথোপকথন, গিটারের সুর আর গাছের যত্ন—সব মিলেমিশে তৈরি করেছে এই সম্পর্কের ভিত্তি। তৃণা ভাবল, শহরের এত কোলাহলের মধ্যে তার জীবনে এমন একজন এসেছে, যিনি তার অনুভূতিকে সত্যিই বোঝে, যিনি তার নিঃশব্দ খুশি আর দুঃখে সঙ্গে আছেন। অরণ্যও অনুভব করল, তৃণার সঙ্গেই তার জীবনের সুর সম্পূর্ণ হয়েছে। বসন্তের এই রাতে ছাদবাগান আর গিটার তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে উঠল, আর সেই মুহূর্ত থেকে তারা জানল, এই সম্পর্ক এখন শুধু বন্ধুত্ব নয়, এক গভীর প্রেমের যাত্রা।

1000066493.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *