Bangla - তন্ত্র

চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য

Spread the love

অপূর্ব ঘোষ


অধ্যায় ১ – আগমন

ভুবনেশ্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন গাড়ির চাকা ধুলো উড়িয়ে হিরাপুর গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তায় ঢুকল, তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে রক্তিম আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে। একদল প্রত্নতাত্ত্বিক, যাদের চোখে স্পষ্ট কৌতূহল ও উত্তেজনা, গাড়ি থেকে নেমে এল ধীরে ধীরে। দলের নেতৃত্বে ছিলেন ডক্টর অনিরুদ্ধ মুখার্জি, প্রাচীন ভারতীয় স্থাপত্য ও তান্ত্রিক মন্দির নিয়ে খ্যাত এক গবেষক। তার সঙ্গে ছিলেন সহকারী প্রফেসর সঞ্জনা সেন, যিনি সম্প্রতি পুরাণ ও লোকবিশ্বাস নিয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন। এছাড়াও ছিলেন দুই তরুণ প্রত্নতত্ত্ববিদ—অভিজিৎ ও রোহন—যাদের উচ্ছ্বাস প্রায় বালকসুলভ। তারা এসেছেন বিখ্যাত চৌষট্টি যোগিনী মন্দিরের রহস্য অনুধাবন করতে, যেটি শুধু শিল্পকলার নয়, আধ্যাত্মিক ও গুপ্ততান্ত্রিক ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন। দূর থেকে দেখা যায়, একটি বৃত্তাকার পাথরের স্থাপনা—প্রাচীন অথচ নিস্তব্ধ, যেন সময়ের কুহেলিকা ভেদ করে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ি থেকে নামতেই তারা স্থানীয় কিছু গ্রামবাসীকে দেখতে পেল, যাদের চোখে ছিল অদ্ভুত ভয় ও কৌতূহলের মিশ্রণ। এক বৃদ্ধ এগিয়ে এসে ভাঙা ওড়িয়ায় বললেন—“সাহেব, ও মন্দিরে রাত্রি কাটিও না। সূর্যাস্তের পর দেবীর স্থান জাগ্রত হয়।” অনিরুদ্ধ হেসে বললেন, “এগুলো কুসংস্কার মাত্র। আমরা ইতিহাস খুঁজতে এসেছি, ভয় নয়।” গ্রামের মানুষ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, কিন্তু তাদের চোখে অস্বস্তির ছায়া আরও ঘন হয়ে উঠল। সন্ধ্যার আলোয় মন্দিরের কালো পাথর যেন এক অজানা আভা ছড়াচ্ছিল, আর দূরে পেঁচা ডেকে উঠতেই সঞ্জনা শিহরিত হয়ে উঠল।

মন্দিরে প্রবেশ করার মুহূর্তেই তারা বুঝল, এ কেবল একটি সাধারণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নয়। বৃত্তাকার অঙ্গনজুড়ে পাথরে খোদাই করা চৌষট্টি যোগিনীর মূর্তি প্রতিটি দিকেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে, যেন অদৃশ্য কোনো দর্শকের দিকে তাকিয়ে। প্রত্যেক মূর্তির ভঙ্গি আলাদা—কোনোটি ক্রুদ্ধ, কোনোটি মাতৃসুলভ স্নেহে ভরা, কোনোটি আবার রহস্যময় হাসিতে ভরপুর। অঙ্গনের মাঝখানে শিবলিঙ্গ, যার চারপাশে ঘোরার সময় সঞ্জনার মনে হচ্ছিল, মূর্তিগুলো যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে আছে তাদের প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে। অভিজিৎ টর্চ জ্বালিয়ে খোদাইয়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ পর্যবেক্ষণ করছিল, আর রোহন ছবি তুলছিল একাগ্র মনোযোগে। অনিরুদ্ধ তখন নোটবইয়ে লিখছিলেন—“চতুর্দিকে যোগিনী, কেন্দ্রে ভুবনেশ্বর। স্থাপত্য কেবল ধর্মীয় নয়, এটি তন্ত্রচর্চার প্রতীক।” কিন্তু যখন হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটা এসে টর্চ নিভিয়ে দিল, তারা সবাই থমকে গেল। চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, শুধু দূরে ঝিঁঝিঁর ডাক আর শিয়ালের হাহাকার। সেই মুহূর্তে বৃদ্ধ গ্রামবাসীর সতর্কবাণী যেন কানে বাজতে লাগল। সঞ্জনা বলল, “আমাদের কি কাল ভোরে কাজ শুরু করা উচিত নয়?” কিন্তু অনিরুদ্ধ দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন—“না, সময় নষ্ট করা যাবে না। গবেষণার জন্য প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান।” দলের তরুণেরা উত্তেজিত ছিল, তারা ভয়কে পাত্তা দিল না। তবু অদৃশ্য এক চাপা অস্বস্তি সবার মধ্যে ঢুকে পড়ল।

যখন রাত নেমে এলো, তারা মন্দিরের পাশেই তাঁবু খাটাল। দূরে গ্রামের প্রদীপের আলো টিমটিম করছিল, আর গাছে গাছে বাদুড় উড়ছিল কালো ছায়ার মতো। আগুন জ্বেলে তারা খাবার গরম করল, কিন্তু খাওয়ার সময়ও সঞ্জনা অনুভব করছিল মূর্তিগুলোর চোখ যেন তার দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে আছে। হাওয়ায় ভেসে আসছিল ধূপের মতো এক গন্ধ, অথচ আশেপাশে কেউ ধূপ জ্বালায়নি। অভিজিৎ হেসে বলল, “সঞ্জনা দি, তুমি কি ভূতের গল্প ভাবছ?”—কিন্তু হাসির আড়ালেও তার গলায় অস্বস্তি ছিল স্পষ্ট। অনিরুদ্ধ দলের সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, “প্রতিটি প্রাচীন স্থানেরই নিজস্ব রহস্যময়তা থাকে। বিজ্ঞান দিয়ে সবকিছুর ব্যাখ্যা সম্ভব।” কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছিল, বাতাসের চাপা শব্দ, দূরে শিয়ালের দীর্ঘ আর্তনাদ, আর মন্দিরের ভেতর থেকে আসা অজানা প্রতিধ্বনি—সব মিলিয়ে তারা অনুভব করছিল এক অজানা শক্তির উপস্থিতি। তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে সঞ্জনা যখন আকাশের দিকে তাকাল, দেখতে পেল মেঘের ফাঁকে পূর্ণিমার আলো পড়ছে মন্দিরের মূর্তিগুলোর উপর, আর সেই আলোয় প্রতিটি মূর্তি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। হঠাৎ বাতাস কেঁপে উঠল, আগুন টলমল করে নিভে গেল, আর সবাই নিস্তব্ধতার মধ্যে অনুভব করল—তারা আর একা নয়। গ্রামের সতর্কবাণী তারা উপেক্ষা করলেও, সেই রাতেই প্রথমবার তাদের মনে হল—হিরাপুরের চৌষট্টি যোগিনী মন্দির কেবল ইতিহাসের নিদর্শন নয়, এর গভীরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা মানুষের বোধের বাইরে।

অধ্যায় ২ – পাথরের বৃত্ত

ভোরবেলা প্রথম আলো ফুটতেই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের চারজন আবার মন্দিরের অঙ্গনে প্রবেশ করল। রাতের ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতা কাটিয়ে উঠলেও তাদের মনে অদ্ভুত এক অস্বস্তি রয়ে গিয়েছিল। মন্দিরটি উন্মুক্ত আকাশের নিচে বৃত্তাকার কাঠামো—প্রাচীন পাথরের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। অন্য সব মন্দিরের মতো নয়, এখানে কোনো ছাদ নেই; ওপরে শুধু আকাশ, আর সেই আকাশের তলায় সমান দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে চৌষট্টি যোগিনী। চারজনের চোখে পড়ল, এই স্থাপত্য কেবল ধর্মীয় নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে কোনো তান্ত্রিক নিয়ম। অনিরুদ্ধ ব্যাখ্যা করছিলেন, “বৃত্ত মানে সম্পূর্ণতা, অসীম চক্র। এখানে যোগিনীরা বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছেন—এ একেবারেই তান্ত্রিক ধারণা, শক্তির প্রবাহকে কেন্দ্রে নিয়ে আসার জন্য।” সঞ্জনা বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখছিল প্রতিটি যোগিনী যেন ভিন্ন কোনো ব্যক্তিত্ব বহন করছে। কারো চোখে আছে করুণার ছাপ, কারো ঠোঁটে বিদ্রূপাত্মক হাসি, কারো মুখে ক্রোধের রেখা। অভিজিৎ আর রোহন ছবি তুলতে ব্যস্ত, কিন্তু ছবিগুলোতে তারা লক্ষ্য করল, আলো-ছায়ার খেলা অনুযায়ী মূর্তিগুলোর মুখের অভিব্যক্তি যেন বারবার বদলে যাচ্ছে। দিনের আলোতে স্পষ্ট দেখা গেল, প্রতিটি মূর্তির ভঙ্গি কতটা সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা—কোনো যোগিনী হাতে তরবারি, কেউ বা শঙ্খ, আবার কেউ ভয়ংকরভাবে খালি হাতে মাংস টেনে ধরেছে। এ যেন এক ভয়ঙ্কর ও রহস্যময় শিল্পকলা, যেখানে ভক্তি আর ভয় একাকার হয়ে গেছে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে তারা আবার মন্দির পরিদর্শনে বেরোল। এবার তাদের চোখে পড়ল আরও অদ্ভুত ব্যাপার। রোদের কোণ পাল্টাতেই প্রতিটি মূর্তির ছায়া যেন অদ্ভুতভাবে স্থান বদল করছে। সঞ্জনা বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি কি লক্ষ্য করেছ? এই মূর্তিগুলো যেন আলোর সঙ্গে সঙ্গে জীবন্ত হয়ে ওঠে।” অভিজিৎ মজা করে বলল, “মূর্তি বদলাবে কী করে? এটা নিশ্চয়ই অপটিক্যাল ইলিউশন।” কিন্তু সঞ্জনা একেবারেই নিশ্চিত ছিল না। সে খেয়াল করছিল—একটি মূর্তি, যেটি সকালে শান্ত হাসিতে দাঁড়িয়েছিল, এখন তার ঠোঁটের কোণে স্পষ্ট বিদ্রুপ দেখা যাচ্ছে। রোহন ছবিগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখল, সত্যিই ছবির সঙ্গে বাস্তবের কিছু মিলছে না। ছবিতে ধরা পড়ছে অন্যরকম অভিব্যক্তি, যা তারা খালি চোখে দেখছে না। অনিরুদ্ধ যদিও শান্তভাবে বললেন, “এগুলো কেবল মনস্তাত্ত্বিক খেলা। এত ভয়ঙ্কর পরিবেশে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই কল্পনা করতে শুরু করে।” কিন্তু তার কণ্ঠে অস্বস্তি ঢেকে রাখা যাচ্ছিল না। হঠাৎ হাওয়া বইতে শুরু করল, আর যোগিনীদের খোদাই করা চুল ও অলংকারগুলো দুলছে বলে মনে হল, যেন তারা নিঃশব্দে নড়ে উঠছে। চারজন একে অপরের দিকে তাকাল, কারো মুখে কোনো কথা নেই। চারপাশের পাথরের বৃত্ত তাদেরকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছিল যে মনে হচ্ছিল, তারা যেন এক রহস্যময় আচার অনুষ্ঠানের অংশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

রাত নামতেই তারা আবার অঙ্গনে ফিরে গেল, কারণ অনিরুদ্ধ জোর দিয়েছিলেন—“এই মন্দিরের প্রকৃত রহস্য রাতেই ধরা পড়তে পারে।” আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়তেই এক অদ্ভুত দৃশ্য তাদের চোখে পড়ল। মূর্তিগুলোর মুখভঙ্গি আর একই নেই—প্রতিটি যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। কেউ দাঁত বের করে হেসে উঠছে, কেউ চোখ বড় বড় করে রাগে তাকিয়ে আছে, আবার কেউ অদ্ভুত ভঙ্গিতে আহ্বান করছে অদৃশ্য শক্তিকে। সঞ্জনার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, সে স্পষ্ট শুনতে পেল মূর্তির ঠোঁট থেকে নিঃশব্দ ফিসফিসানি বেরোচ্ছে। অভিজিৎ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—“দেখো! ওই মূর্তির চোখ নড়ছে!” কিন্তু রোহন ছবিতে সেটি ধরতে পারল না। ছবি তুললেই মূর্তিগুলো পাথরের মতো স্থির, কিন্তু খালি চোখে দেখলে যেন প্রতিটি নিঃশ্বাস নিচ্ছে। চারজনের মনে হতে লাগল, তারা আর ইতিহাস খুঁজছে না—বরং কোনো গুপ্ত শক্তির চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে। বাতাসের মধ্যে ধূপ ও রক্তমিশ্রিত গন্ধ ভেসে এল, আর পূর্ণিমার আলোয় মূর্তিগুলো একসঙ্গে ছায়া ফেলে এমনভাবে যে মনে হচ্ছিল, পুরো অঙ্গন একটি জীবন্ত চক্রে ঘুরছে। অনিরুদ্ধ প্রথমবারের মতো চুপ হয়ে গেলেন, তাঁর চোখে ভয় স্পষ্ট। পাথরের বৃত্ত এখন কেবল স্থাপত্য নয়, এটি এক জীবন্ত শক্তির আখড়া—যেখানে মানুষ আর দেবীর সীমানা মিলিয়ে যায়, আর যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের আরও গভীর রহস্যের দিকে ঠেলে দেয়।

অধ্যায় ৩ – লিপির রহস্য

সকালবেলায় কুয়াশা কাটতেই প্রত্নতাত্ত্বিক দলের চারজন আবার মন্দিরের কোণে ঘুরে বেড়াতে লাগল। অভিজিৎ প্রথমে খেয়াল করেছিল, মন্দিরের দক্ষিণ প্রাচীরের পাশে একটি ভগ্নপ্রায় স্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে, যেটি অন্য অংশের মতো নয়—পাথরের উপর অদ্ভুত খোদাই রয়েছে। কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে তারা দেখল, মলিন ও ক্ষয়ে যাওয়া পাথরের গায়ে প্রাচীন লিপি খোদাই করা আছে, যা প্রথম দর্শনে নাগরী বা ব্রাহ্মী কোনোটির সঙ্গেই পুরোপুরি মেলে না। সঞ্জনা ভেজা কাপড় দিয়ে আলতো করে ধুলো মুছে দিল, আর সূর্যের আলো পড়তেই অক্ষরগুলো যেন হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রোহন বিস্মিত গলায় বলল, “এগুলো নিশ্চয়ই কোনো গোপন শিলালিপি। সাধারণ দর্শনার্থীর চোখে পড়ে না, কিন্তু যারা মনোযোগ দিয়ে খুঁজবে, শুধু তাদের জন্যই রেখে যাওয়া।” অনিরুদ্ধ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝলেন, এটি কোনো উপাসনালয়ের পরিচয়লিপি নয়; বরং এখানে কোনো তান্ত্রিক অনুষঙ্গ জড়িত। তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল, কারণ তিনি জানতেন—যোগিনী মন্দিরের সঙ্গে তন্ত্রচর্চার গভীর সম্পর্ক বহুবার ইতিহাসে আলোচিত হয়েছে। তারা লিপিটি নোটবইয়ে নকল করতে লাগল, কিন্তু অনেক অক্ষর এতটাই ক্ষয়প্রাপ্ত যে স্পষ্ট করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখনই হাওয়ার ঝাপটায় লিপির উপরকার মাকড়সার জাল সরে গেল, আর কিছু অক্ষর হঠাৎই জেগে উঠল, যেন শতাব্দী ধরে লুকিয়ে থাকা শব্দগুলো আলোয় ফিরে এসেছে।

অনিরুদ্ধ, যিনি বহুদিন ধরে গুপ্ত তান্ত্রিক লিপি নিয়ে কাজ করেছেন, নোটগুলো পরীক্ষা করতে গিয়ে ধীরে ধীরে অনুবাদ করলেন। তাতে প্রকাশ পেল ভয়ংকর এক সত্য—“এ স্থান কেবল যোগিনীর উপাসনা নয়, বরং যজ্ঞমণ্ডল। চৌষট্টি দেবী বৃত্তাকারে বসে শক্তিকে আহ্বান করেন, আর কেন্দ্রস্থলে যজ্ঞশিখা জ্বলে উঠে মিলিয়ে দেয় দেহ ও আত্মার সীমারেখা।” সঞ্জনার বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে মন্দিরটি তো একেবারেই আলাদা অর্থ বহন করছে। এটি মাটির মন্দির নয়, এটি এক বিশাল তন্ত্রযজ্ঞের মঞ্চ।” অভিজিৎ আর রোহনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল, তারা ইতিহাসের বইয়ে এমন কিছু পড়েনি। অনিরুদ্ধ ব্যাখ্যা করলেন, “যোগিনী উপাসনা একসময় নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কারণ সমাজ এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি। কিন্তু এই লিপি প্রমাণ করছে, এখানে রাত্রিকালীন আচার অনুষ্ঠিত হত, যেখানে রক্ত, মন্ত্র ও অগ্নি মিলিয়ে শক্তির উন্মেষ ঘটত।” সঞ্জনা শিউরে উঠে বলল, “হয়তো সেই শক্তিই এখনো এখানে বিরাজ করছে।” তারা একে অপরের দিকে তাকাল, কিন্তু কেউ কিছু বলল না। বাতাসে এক চাপা ভারী গন্ধ ছড়িয়ে ছিল, যেন পুরোনো ধূপ আর ছাই মিশে আছে। পাখির ডাকও সেখানে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই নিস্তব্ধতার ভেতরে তাদের মনে হচ্ছিল, লিপিটি যেন তাদের আহ্বান করছে—আরও গভীরে প্রবেশ করতে, অতীতের অন্ধকার রহস্য উন্মোচন করতে।

তারা যখন নোটবইয়ে অনুবাদ করা লিপিটি নিয়ে বসেছিল, তখন সূর্যাস্ত ঘনিয়ে আসছিল। চারদিকে রক্তিম আলো ছড়িয়ে পড়ছিল মন্দিরের পাথরে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গনের যোগিনী মূর্তিগুলো যেন আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। লিপির শেষাংশ অনিরুদ্ধ পড়ে শোনালেন—“যজ্ঞে উপস্থিত সাধক যদি ভয়কে জয় করতে না পারে, তবে দেবীরা তাঁকে নিজেরাই গ্রাস করেন।” কথাগুলো শুনে চারজনই গম্ভীর হয়ে গেল। রোহন অস্বস্তি চেপে বলল, “এটা কি আমাদের জন্য সতর্কবার্তা নয়?” কিন্তু অনিরুদ্ধ কণ্ঠ কঠিন করে বললেন, “আমরা গবেষক, ভয়ের কারণে পিছিয়ে আসা আমাদের কাজ নয়।” যদিও তাঁর গলায় আত্মবিশ্বাসের চেয়ে অজানা শঙ্কার ছাপ বেশি ছিল। হঠাৎই বাতাস তীব্র হয়ে উঠল, স্তম্ভের চারপাশে শুকনো পাতাগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরতে লাগল। সঞ্জনা তাকিয়ে দেখল, অক্ষরগুলো আবার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, যেন তারা কেবল সন্ধ্যার আলোতেই জীবন্ত থাকে। মূর্তিগুলোও অদ্ভুত ছায়া ফেলছিল, আর সেই ছায়া মিলে গিয়ে তৈরি করছিল এক বিশাল বৃত্তাকার নৃত্যের ভঙ্গি। দলটি স্তম্ভ থেকে দূরে সরে গেল, কিন্তু মনে হচ্ছিল, তারা এখন এমন এক সত্য আবিষ্কার করেছে যা হয়তো জানা উচিত ছিল না। পাথরের ভগ্নপ্রায় স্তম্ভ তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল এক নীরব প্রহরীর মতো, আর তার বুকে খোদাই করা সেই লিপি যেন ফিসফিস করে বলে চলল—এ মন্দির কেবল ইতিহাস নয়, এটি এক চলমান শক্তির কেন্দ্র, যার দ্বার একবার খুলে গেলে ফের বন্ধ করা অসম্ভব।

অধ্যায় ৪ – নিষিদ্ধ কক্ষ

দলটি যখন ভগ্নপ্রায় স্তম্ভের লিপি নিয়ে আলোচনা করছে, তখনই অভিজিৎ হঠাৎ লক্ষ্য করল মন্দিরের উত্তর প্রাচীরে এক অদ্ভুত ফাঁক। প্রথমে মনে হল, পাথর ভেঙে তৈরি হয়েছে, কিন্তু কাছে গিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল, এটি একেবারেই কৃত্রিম। অনিরুদ্ধ সাবধানে হাত বোলাতেই এক টুকরো ধুলো খসে পড়ল, আর প্রকাশ পেল সরু এক গোপন পথ, যেন বহু বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, স্থানীয় গাইডও, যে তাদের প্রতিদিন সাহায্য করছিল, সে অবাক হয়ে বলল—“মু আমি আগে কখনো এ পথ দেখিনি।” কথায় একরাশ ভয় মিশে ছিল। সঞ্জনা দ্বিধা করছিল, কিন্তু অনিরুদ্ধ বললেন, “যদি সত্যিই এখানে তন্ত্রচর্চার আচার অনুষ্ঠিত হত, তবে এরকম গোপন পথ থাকাটাই স্বাভাবিক।” তারা চারজন টর্চ হাতে নিয়ে সরু পথ ধরে হাঁটতে শুরু করল। পাথরের দেয়ালে চাপা গন্ধ জমে আছে—শুকনো ছত্রাক, পুরোনো রক্ত আর ধূপের মিশ্রণ। প্রতিটি পদক্ষেপে বাতাস ভারী হতে লাগল, আর পথটা ক্রমশ নেমে যাচ্ছিল নীচের দিকে। মনে হচ্ছিল, তারা যেন মন্দিরের তলা দিয়ে ভূগর্ভে নামছে, এক অজানা অন্ধকারের গহ্বরে।

পথটা শেষ হল এক গুমোট, বন্ধ ভূগর্ভস্থ কক্ষে, যেখানে বাতাস স্থির এবং ঠান্ডা। টর্চের আলো ফেলতেই তারা থমকে দাঁড়াল। চারদিকে পাথরের দেয়ালে লালচে দাগ ছড়িয়ে রয়েছে, যা প্রথমে মরচে বলে মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা গেল—এগুলো আসলে রক্তের চিহ্ন, শুকিয়ে গিয়ে গাঢ় বাদামি হয়ে গেছে। দেয়ালে আঁকা রয়েছে অসংখ্য মন্ত্র, অদ্ভুত প্রতীক, এবং অর্ধেক মুছে যাওয়া ছবি। সঞ্জনার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল; সে ফিসফিস করে বলল, “এগুলো তো সরাসরি তান্ত্রিক মন্ত্র… রক্ত দিয়ে লেখা।” অনিরুদ্ধ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন, “হ্যাঁ, এগুলো নিষিদ্ধ আচারসংক্রান্ত লিপি। সাধারণ উপাসনার মন্দিরে এমন জিনিস থাকার কথা নয়।” কক্ষের মাঝখানে পাথরের তৈরি এক আসন, যার চারপাশে পুড়ে যাওয়া প্রদীপ আর ছাই ছড়িয়ে রয়েছে। অভিজিৎ মেঝেতে খেয়াল করল—সেখানে আঁকা আছে এক বিশাল বৃত্ত, যার ভেতরে যোগিনীর প্রতীক খোদাই করা। মনে হচ্ছিল, কোনো সাধক এখানে বসে বহু রাত ধরে অগ্নিযজ্ঞ বা বলি দিয়েছে। টর্চের আলোতে মন্ত্রগুলো যেন হালকা চকচক করে উঠছিল, যেন তারা কেবল আলো পেলে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

হঠাৎ রোহন চিৎকার করে উঠল—“দেখো! মন্ত্রগুলো নড়ছে!” বাকিরা তাকিয়ে দেখল, সত্যিই রক্তে লেখা অক্ষরগুলো হালকা দপদপ করছে, যেন তারা শ্বাস নিচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল, এবং অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন তাদের বুক চেপে ধরল। সঞ্জনা টর্চ আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মনে হচ্ছিল, পেছন থেকে কেউ তাকে নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখছে। কক্ষের এক কোণে ছায়ার আড়ালে যেন নড়াচড়া হচ্ছে, কিন্তু আলো ফেলতেই ফাঁকা দেখা গেল। অনিরুদ্ধ শান্ত থাকতে চেষ্টা করে বললেন, “আমাদের এখনই বেরিয়ে যাওয়া উচিত, নইলে এই শক্তি আমাদের গ্রাস করতে পারে।” কিন্তু একই সঙ্গে তাঁর চোখে ছিল প্রবল কৌতূহল—এমন প্রমাণ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ইতিহাসবিদেরা খুঁজে বেড়িয়েছেন। মন্ত্রগুলোর চারপাশে টর্চের আলো পড়তেই দেখা গেল, প্রতীকের ভেতর থেকে হালকা কুয়াশা বের হচ্ছে, আর মেঝেতে আঁকা বৃত্তে তা জমা হচ্ছে। সবাই আতঙ্কে পিছু হঠল। স্থানীয় গাইড বাইরে থেকে ডাকল—“সাহেব, আর ভেতরে থাকবেন না!” কিন্তু যেন কোনো অদৃশ্য টান তাদের ধরে রেখেছিল। অবশেষে এক ঝড়ো বাতাস এসে টর্চ নিভিয়ে দিল, আর মুহূর্তের মধ্যে কক্ষ অন্ধকারে ঢেকে গেল। তারা কেবল শুনতে পেল, অজানা কোনো ভাষায় মন্ত্রোচ্চারণ প্রতিধ্বনির মতো ভেসে আসছে, যেন শতাব্দী প্রাচীন যজ্ঞ আবারও শুরু হয়েছে।

অধ্যায় ৫ – প্রথম বিপর্যয়

ভূগর্ভস্থ নিষিদ্ধ কক্ষ থেকে যখন তারা কোনো রকমে বেরিয়ে এসে মন্দিরের অঙ্গনে দাঁড়াল, তখন সবার শরীর যেন নিঃশেষিত। চারজনের নিঃশ্বাস ভারী, যেন কেউ তাদের ভেতর থেকে শক্তি চুষে নিয়েছে। রাত ঘনিয়ে আসছিল, পূর্ণিমার আলো আবারও যোগিনী মূর্তিগুলির উপর পড়ে অদ্ভুত আভা ছড়াচ্ছিল। হঠাৎই অভিজিৎ কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়ল। প্রথমে সবাই ভেবেছিল সে ক্লান্তিতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই তার শরীর কেঁপে উঠল প্রবল ঝাঁকুনিতে। চোখ বড় বড় হয়ে গেল, আর ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল এক অদ্ভুত ভাষা—যা কেউ চেনে না। শব্দগুলো ছন্দে বাঁধা, গর্জনের মতো, যেন কোনো প্রাচীন মন্ত্র আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সঞ্জনা ভয়ে তার পাশে বসে হাত ধরতেই অনুভব করল, অভিজিতের শরীর অস্বাভাবিক গরম হয়ে আছে, তাপ যেন ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। অনিরুদ্ধ শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললেন, “এটা হয়তো কোনো বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাব। ভূগর্ভস্থ কক্ষে দীর্ঘদিনের আবদ্ধ বাতাসে হ্যালুসিনেশন হতে পারে।” রোহন আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “কিন্তু ও যা বলছে, ওসব তো শব্দ নয়! যেন কেউ ওর মুখ দিয়ে কথা বলছে।” হাওয়া থমকে দাঁড়াল, চারপাশে নিরবতা নেমে এল, আর অভিজিতের চোখে দেখা দিল ভয়ংকর আতঙ্কের ছাপ—সে যেন এমন কিছু দেখছে, যা অন্য কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

সঞ্জনা মরিয়া হয়ে ব্যাগ থেকে পানি বের করে অভিজিতকে খাওয়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সে ছটফট করতে লাগল, গলায় অদ্ভুত শব্দ বের হতে লাগল। “অগ্নি… বৃত্ত… রক্ত…” শব্দগুলো শুনতে পেল তারা, যা স্পষ্টতই তাদের আগের রাতে দেখা লিপির সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল। অনিরুদ্ধ বুঝতে পারলেন, এটি নিছক শারীরিক অসুস্থতা নয়। কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করলেন না; কেবল বললেন, “সম্ভবত মনের বিভ্রম। ভয় পেও না, আমি দেখছি।” রোহন অস্থির হয়ে ফোনে আলো জ্বালাল, কিন্তু আলো পড়তেই তারা দেখল অভিজিতের মুখে ছায়ার মতো রেখা খেলে যাচ্ছে, যেন তার ত্বকের নিচে কোনো অদ্ভুত প্রতীক আঁকা হচ্ছে। সঞ্জনা ভয়ে কেঁদে ফেলল, “এটা পরিবেশগত প্রভাব নয়, কিছু একটা ওর ভেতরে ঢুকে পড়েছে!” কিন্তু অনিরুদ্ধ কঠিন গলায় বললেন, “আমাদের এখনই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত নয়। বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথমে যুক্তি দিয়ে ভাবতে হবে।” যদিও তাঁর হাত কাঁপছিল, চোখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠছিল স্পষ্ট। অভিজিৎ তখনও অজানা ভাষায় বকবক করছিল, তার কণ্ঠে এমন এক সুর ছিল, যা শুনলে মনে হচ্ছিল—এটি কোনো মানুষের কণ্ঠ নয়, বরং বহু কণ্ঠ একসাথে গর্জে উঠছে।

কিছুক্ষণ পর হঠাৎই অভিজিতের শরীর ঢিলে হয়ে এল। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, কপালে ঘাম জমে আছে, চোখ আধখোলা, ঠোঁটে এখনো অস্পষ্ট ফিসফিসানি। রোহন কাঁপা গলায় বলল, “আমাদের এখনই গ্রামে নিয়ে যেতে হবে, ডাক্তার দেখাতে হবে।” কিন্তু অনিরুদ্ধ বললেন, “রাতের এই সময়ে গ্রাম থেকে সাহায্য পাওয়া সম্ভব নয়। বরং আমাদের এখানেই ওকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।” সঞ্জনা মাথা নাড়ল, কিন্তু তার চোখে স্পষ্ট ভয়—সে জানত, যা ঘটছে তা চিকিৎসার আওতার বাইরে। তারা তাঁবুর মধ্যে অভিজিতকে শুইয়ে দিল, তার শরীর ঢেকে রাখল কম্বলে, কিন্তু সারা রাত তার ঠোঁট থেকে ভেসে আসতে থাকল সেই অদ্ভুত ভাষা। কখনো মৃদু, কখনো প্রবল, আর কখনো নিস্তব্ধ। তারা ঘুমোতে পারল না, বাইরে মন্দিরের পাথরের বৃত্ত যেন নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিল, যেন সেই অদৃশ্য শক্তি তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করছে। ভোরের আলো ফুটতেই তারা দেখল অভিজিত একেবারেই অচেতন, কিন্তু তার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু প্রমাণ দিচ্ছে, রাতভর সে ভয়ঙ্কর কিছু দেখে গেছে। দলের বাকিদের মনে তখন একটাই প্রশ্ন—এটা কি সত্যিই গ্যাস বা পরিবেশের প্রভাব, নাকি তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে সেই প্রাচীন শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছে, যে এখন তাদের মধ্যে প্রথম শিকার বেছে নিয়েছে?

অধ্যায় ৬ – রাতের আচার

গ্রামের প্রবীণদের মুখ থেকে শুনে নেওয়া কাহিনিটি দলের সদস্যরা প্রথমে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। পূর্ণিমার রাতে যোগিনীরা জীবন্ত হয়ে ওঠে—এমন কথা শোনার পর তাদের কৌতূহল বেড়েছিল দ্বিগুণ। কেউ কেউ ভেবেছিল, হয়তো এটি লোকবিশ্বাস, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গল্পের আকারে চলে এসেছে। কিন্তু দলের প্রধান অনির্বাণের মনে হচ্ছিল, এই কিংবদন্তির আড়ালে হয়তো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক সত্য লুকিয়ে আছে। সেই কৌতূহল থেকেই তিনি প্রস্তাব দিলেন যে তারা সবাই পূর্ণিমার রাতে মন্দিরে থাকবে। প্রথমে দ্বিধা থাকলেও, শেষমেশ দলের বাকি সদস্যরাও রাজি হয়ে গেল। সন্ধ্যা নামতেই তারা মন্দিরের চারপাশে মশাল জ্বালিয়ে বসে পড়ল। আকাশে তখন গোল চাঁদ ওঠার অপেক্ষা। ধীরে ধীরে চাঁদ উপরে উঠতেই পুরো মন্দির এক অদ্ভুত রূপ নিতে শুরু করল। খোলা আকাশের তলায় গোল বৃত্তে দাঁড়ানো চৌষট্টি যোগিনীর মূর্তি চাঁদের আলোয় যেন অন্য রকম দীপ্তি ছড়াতে লাগল। প্রথমে সবাই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মুগ্ধতা বদলে গেল অস্বস্তিতে। কারণ মূর্তিগুলোর ছায়া ক্রমশ লম্বা হতে শুরু করেছে, আর সেগুলো যেন নিজেরাই নড়াচড়া করছে।

মধ্যরাত ঘনিয়ে এলে চারপাশে নেমে এলো ভয়ঙ্কর নীরবতা। বাতাস যেন হঠাৎ থেমে গেল, শুধু শোনা যাচ্ছিল নিজেরাই শ্বাস নেওয়ার শব্দ। হঠাৎ করেই কারো কানে এল এক অচেনা সুর, যেন বহু কণ্ঠ একসঙ্গে মন্ত্র উচ্চারণ করছে। প্রথমে মনে হলো, হয়তো দূরের কোনো মন্দির থেকে শব্দ ভেসে আসছে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে শব্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল—ঠিক তাদের চারপাশ থেকে। প্রতিটি যোগিনীর মূর্তির ঠোঁট যেন নড়ছে, আর এক অজানা ভাষায় মন্ত্র গাইছে। দলের সদস্যরা স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। কারো হাত থেকে মশাল পড়ে গেল, আগুন মাটিতে গড়িয়ে ছাই হয়ে গেল। তারা দেখল, পাথরের ঠাণ্ডা মুখগুলোতে ধীরে ধীরে এক জীবন্ত অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে—কেউ ক্রুদ্ধ, কেউ হাসছে, কেউ আবার চোখ বুজে অদ্ভুত এক তন্ময়তায় মগ্ন। মূর্তিগুলোর পাথরের চোখে লাল আভা ঝলমল করছে, আর চারপাশে শোনা যাচ্ছে ঢাক-ঢোলের মতো শব্দ, অথচ কোথাও কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই। অনির্বাণ কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বলল, “এগুলো আসলেই জীবন্ত হয়ে উঠছে।” বাকিরা ভয়ে কাঁপছিল, কিন্তু তবুও চোখ সরাতে পারছিল না, যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাদের স্থির করে রেখেছে।

আচারের সেই মুহূর্তে মন্দির যেন ভিন্ন এক জগতে পরিণত হলো। মাটির নিচে থেকে কাঁপুনি উঠল, যেন অদৃশ্য ঢেউ পাথরের মেঝেতে ছুটে যাচ্ছে। চাঁদের আলো একেবারে কুণ্ডের কেন্দ্রে এসে পড়ল, আর হঠাৎ করেই মূর্তিগুলোর গা থেকে ছায়া আলাদা হয়ে মাটিতে নাচতে শুরু করল। সেই নৃত্য ভয়ঙ্কর, অশুভ এবং অচেনা তালযুক্ত। দলের একজন হঠাৎ আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে, কারণ তার মনে হলো ছায়াগুলোর মধ্যে একটি এগিয়ে এসে তার শরীর স্পর্শ করেছে। বাকিরা তাকে শান্ত করতে চাইলেও নিজেরাই টের পেল, তাদের শরীরের ভেতরেও এক অদ্ভুত শীতলতা ঢুকে যাচ্ছে। মন্ত্রোচ্চারণ এখন আরও জোরালো হয়েছে, নারীকণ্ঠের সঙ্গে যেন বজ্রের গর্জন মিশে এক ভয়ঙ্কর সুর তৈরি করেছে। তাদের মাথা ঘুরতে লাগল, মনে হচ্ছিল, তারা আর এই বাস্তব জগতে নেই, বরং কোনো প্রাচীন তান্ত্রিক যজ্ঞের দর্শক হয়ে গেছে। ঠিক সেই সময়েই হঠাৎ সব শব্দ থেমে গেল। আবার নীরবতা। যোগিনীদের চোখের আভা নিভে এলো, ঠোঁট স্থির হয়ে গেল, ছায়াগুলো আবার পাথরের গায়ে মিশে গেল। যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু দলের সদস্যরা জানত—এ কোনো স্বপ্ন বা ভ্রম নয়, বরং তারা প্রত্যক্ষ করেছে সেই আচার, যা যুগ যুগ ধরে লোককথার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। আর এখন তারা একেবারে নিশ্চিত—এই মন্দির কেবল ইতিহাস নয়, এর ভেতর লুকিয়ে আছে এমন এক শক্তি, যা মানুষের কল্পনার বাইরে।

অধ্যায় ৭ – শক্তির প্রকাশ

প্রত্নতাত্ত্বিক দলের প্রধান অধ্যাপক অনির্বাণ দীর্ঘদিন ধরে চৌষট্টি যোগিনী মন্দির নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এতদিন ধরে খুঁটিনাটি খুঁজে বের করা, প্রাচীন লিপি অনুবাদ করা এবং মূর্তিগুলির প্রতীক বোঝার চেষ্টায় তার মন আরও উৎসাহী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি অনুভব করছিলেন, যেন এই মন্দির কেবল ইতিহাসের এক অংশ নয়, বরং কোনো অদৃশ্য শক্তির আধার। তার কৌতূহল ও একধরনের আসক্তি তাকে বাকি দলের থেকে আলাদা করেছিল। এক রাতে, সবাই ঘুমোতে গেলে তিনি একাই মন্দিরের কেন্দ্রে যান। সেখানে বহুদিন আগে ব্যবহৃত একটি প্রাচীন যজ্ঞকুণ্ড আবিষ্কার করেছিলেন তারা, যার চারপাশে অদ্ভুত প্রতীক খোদাই করা ছিল। অনির্বাণ অজান্তেই একটি পুরনো শিলালিপি থেকে পড়া মন্ত্র স্মরণ করে কুণ্ডের কাছে বসে পড়েন। তার ধারণা ছিল, হয়তো কেবল প্রতীকী অর্থে যজ্ঞটি সক্রিয় হবে, তাতে ইতিহাসের কিছু রহস্য আরও স্পষ্ট হবে। কিন্তু যখন তিনি মন্ত্র উচ্চারণ করেন এবং মাটিতে রাখা কিছু ভগ্ন মাটির প্রদীপে আগুন ধরান, তখন হঠাৎ চারপাশের বায়ু ভারী হয়ে আসে। যেন সময় স্থির হয়ে গেছে। বাতাস এক অদৃশ্য ঘূর্ণির মতো কুণ্ডের ভেতর ঢুকতে শুরু করে, আর শীতল পরিবেশে এক অজানা গরম হাওয়া বইতে থাকে।

শুরুতে অনির্বাণ ভেবেছিলেন, এটি কেবল কাকতালীয় ঘটনা। কিন্তু কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মন্দিরের চারপাশে এক অস্বাভাবিক কম্পন ছড়িয়ে পড়ে। দলের অন্যরা আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে আসে এবং দেখে, কুণ্ড থেকে ধোঁয়ার মতো এক কালো ঘূর্ণি উঠছে, যেন আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে আবার মাটিতে নেমে আসছে। সেই ঘূর্ণির সঙ্গে সঙ্গে মন্দিরের পাথরের দেয়ালে খোদাই করা যোগিনীদের মূর্তির চোখে এক অদ্ভুত আভা জ্বলে ওঠে—লালচে আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছিল, পাথরের মূর্তিগুলি কেবল স্থির নয়, জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাদের মুখের অভিব্যক্তি বদলাতে শুরু করেছে—কখনো ক্রোধে, কখনো ভয়ঙ্কর হাসিতে, আবার কখনো গভীর দুঃখে। বাতাসে শঙ্খধ্বনির মতো এক অচেনা শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, যা ক্রমশ গর্জনের রূপ নেয়। দলের কয়েকজন আতঙ্কে মন্দির ছেড়ে পালাতে চাইলে দেখে, চারদিক কালো ছায়ায় ঢেকে গেছে, যেন মন্দির এক ভিন্ন জগতে বন্দি। কোনো পথ খোলা নেই। সেই অদৃশ্য শক্তি তাদের পিছু হেঁটে আটকে দিয়েছে। এক সদস্য মাটিতে বসে কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগল, “এটা মানুষ নয়… এটা দেবীর ক্রোধ।” বাকিরা একে অপরকে থামিয়ে কোনোভাবে সাহস জোগাতে চেষ্টা করলেও সবার চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

যজ্ঞকুণ্ডের শক্তি ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। বাতাসের ঘূর্ণি এখন ঝড়ের রূপ নিয়েছে, আর মন্দিরের শূন্য আকাশের তলে বজ্রপাতের মতো আলোর ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। প্রতিটি যোগিনীর চোখ থেকে নির্গত অগ্নিশিখা চারপাশ আলোকিত করছে, আর তাদের ছায়াগুলি মাটির উপর নড়ে উঠছে যেন জীবন্ত সত্তা। দলের প্রধান অনির্বাণ নিজেও আতঙ্কিত হলেও মনে মনে ভাবছিলেন, তিনি কি সত্যিই কোনো গোপন শক্তিকে জাগিয়ে তুলেছেন? তার কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু এক অদ্ভুত টান তাকে যজ্ঞকুণ্ডের দিকে টেনে নিচ্ছিল। অন্যরা তাকে থামাতে চাইলেও তিনি যেন কোনো অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণে আছেন, সেই আগুনের কুণ্ডে হাত বাড়িয়ে দিতে থাকেন। ঠিক তখনই এক প্রবল ঝড়ো হাওয়া তাদের সবাইকে মাটিতে ফেলে দেয়। মন্দিরের দেয়াল থেকে প্রতিধ্বনিত হয় অচেনা নারীকণ্ঠের উচ্চারণ, যা মন্ত্রের মতো শোনায়, অথচ ভয়ঙ্কর এক হুঙ্কারের সুরে। দলটি বুঝতে পারে, তারা আর শুধু গবেষক নয়, তারা এখন এমন এক শক্তির সাক্ষী হয়েছে, যা মানুষ বহু শতাব্দী ধরে ভয় করত, আর নিষিদ্ধ বলে মানত। যোগিনীদের সেই জ্যোতিষ্মান চোখ যেন সতর্ক করে দিচ্ছিল—একবার শক্তি জেগে উঠলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা আর মানুষের সাধ্যের মধ্যে নয়।

অধ্যায় ৮ – পালানোর চেষ্টা

ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে বেরোনোর সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রথমেই বুঝতে পারে, যে পথ দিয়ে তারা ঢুকেছিল তা এখন আর আগের মতো খোলা নেই। দরজার মতো দেখতে সেই চাপা পথের শিলাগুলো অদৃশ্য কোনো শক্তির দ্বারা যেন এক অচল প্রাচীরে রূপান্তরিত হয়েছে। যতই তারা ঠেলতে থাকে, ধাক্কা দিতে থাকে, কোনো শব্দই বেরোয় না, যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতার আবরণ পুরো কক্ষটিকে গ্রাস করেছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। অরিন্দম, দলের তরুণতম সদস্য, হঠাৎ চিৎকার করে উঠল—কারণ সে অনুভব করেছিল তার কাঁধে কেউ অদৃশ্য হাত রেখেছে। কিন্তু যখন সবাই তার দিকে তাকাল, দেখা গেল পাশে কেউ নেই। ভয় আর আতঙ্কে সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ছে। অনির্বাণ বারবার বলছিল, “শান্ত থাকো, এরও কোনো ব্যাখ্যা আছে।” কিন্তু তার নিজের চোখের আতঙ্কই প্রমাণ দিচ্ছিল, তিনিও এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কোনো বৈজ্ঞানিক উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না।

হঠাৎই তারা টের পেল, তাদের মধ্যে একজন নেই। কক্ষের চারদিকে তাকিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। অর্পিতা নামের সেই সদস্য কয়েক মুহূর্ত আগেও সবার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এখন তার কোনো চিহ্ন নেই। মশালের আলোয় চারদিকে তাকালে শুধু রক্তলাল প্রতীকের আভা দেখা যাচ্ছে দেয়ালে, আর শিলালিপি যেন নড়ে নড়ে উঠছে। কেউ কেউ বলল, হয়তো সে আতঙ্কে পালিয়ে গেছে, কিন্তু অন্যরা জানত—পালানোর কোনো রাস্তা নেই। ভয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে অরিন্দম বলতে শুরু করল, “ওদের মধ্যে চলে গেছে… যোগিনীরা ওকে টেনে নিয়েছে।” এই কথা শুনে বাকিরা কেঁপে উঠল। কক্ষের অদ্ভুত অন্ধকার যেন গাঢ় হয়ে আসছে, আলো গিলে নিচ্ছে, আর সেই অন্ধকারের ভেতর থেকে কখনো নারীকণ্ঠে হাসি, কখনো অদ্ভুত শ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। তারা মশালের আলো উঁচু করে দেয়ালগুলোতে খুঁজতে থাকে কোনো গোপন ছিদ্র বা ফাঁকফোকর আছে কিনা, কিন্তু কেবলই মিলে রক্তে লেখা মন্ত্রের দাগ আর অদ্ভুত প্রতীক। তাদের পায়ের নিচে মাটিও কেঁপে উঠতে শুরু করে, যেন কক্ষের ভেতরে কোনো বৃহৎ শক্তি নড়াচড়া করছে।

মুক্তির মরিয়া চেষ্টায় দলের সবাই আলাদা আলাদা হয়ে দরজার প্রতিটি অংশ খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। অনির্বাণ প্রাচীন লিপি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলেন, হয়তো কোনো মন্ত্র বা প্রতীক দরজার বন্ধন খুলে দিতে পারে। কিন্তু সময় ফুরিয়ে আসছিল। অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে আসছিল, শ্বাস জমে যাচ্ছিল, আর প্রত্যেকের কান জুড়ে ক্রমাগত গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ এক সময় দেখা গেল, মশালের আলো নিভে আসছে, যেন আলো টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ। তখনই দলের এক সদস্য হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য দড়ি তাকে টেনে নামিয়ে দিল। সবাই ছুটে গেল তাকে বাঁচাতে, কিন্তু দেখা গেল তার মুখে আতঙ্ক জমে আছে—চোখ বড় বড় করে স্থির হয়ে আছে, আর ঠোঁট নড়ছে অজানা ভাষার ছন্দে। তারা বুঝতে পারল, তাদের মুক্তির পথ সহজ হবে না। দরজার ওপাশে শুধু মুক্তি নেই, আছে এক ভয়ঙ্কর শক্তির প্রতিরোধ। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মরিয়া হয়ে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে থাকল, কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল—মন্দির এখন তাদের বন্দিশালা, আর যোগিনীদের অদৃশ্য শক্তি তাদের একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে।

অধ্যায় ৯ – গোপন ইতিহাস

ভূগর্ভস্থ কক্ষে যখন আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার ঘনঘটা নেমে এসেছে, তখন দলনেতা অনির্বাণ মশালের ক্ষীণ আলোয় খুঁজতে খুঁজতে এক কোণে পড়ে থাকা ধুলোয় ঢাকা এক প্রাচীন পুঁথির সন্ধান পেলেন। পুঁথিটি চামড়ার মলাটে বাঁধানো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভঙ্গুর হয়ে গেছে, তবু তার ভেতরের অক্ষরগুলো যেন আগুনের আঁচে লেখা, অমোঘ আর অক্ষয়। তিনি ধীরে ধীরে পাতাগুলো উল্টাতে থাকলেন, আর দলটির বাকিরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার চারপাশে ভিড় করল। অনির্বাণ যখন শব্দগুলো উচ্চারণ করতে শুরু করলেন, তাদের সবার শরীর কেঁপে উঠল। লিপিটি স্পষ্ট বলছিল—এ মন্দির কেবল দেবী পূজার স্থান নয়, বরং শক্তিপীঠ, যেখানে আকাশ, ভূমি আর পাতালের শক্তি মিলিয়ে এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক যজ্ঞমণ্ডল রচিত হয়েছিল। কিন্তু এ যজ্ঞমণ্ডল কোনো সাধারণ ভক্তির জন্য ছিল না। এটি ছিল শক্তি বন্দী রাখার এক ভয়ঙ্কর প্রকোষ্ঠ, যেন দেবীর প্রতীকী রূপের আড়ালে তান্ত্রিক শক্তিগুলিকে শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে। সেই শক্তি একবার মুক্ত হলে মানুষ, প্রকৃতি, সভ্যতা সব ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

পুঁথিতে আরও লেখা ছিল, বহু শতাব্দী আগে তান্ত্রিক সাধকরা এখানে গোপনে এমন এক আচার সম্পাদন করেছিলেন, যেখানে যোগিনীদের প্রতীকী রূপের ভেতরে নিষিদ্ধ শক্তিকে স্থাপন করা হয়েছিল। সেই শক্তি ছিল দেহাতীত, নিরাকার, অথচ ভয়ঙ্করভাবে জীবন্ত। তান্ত্রিকরা চেয়েছিলেন, দেবীর নামের আড়ালে সেই শক্তিকে ব্যবহার করে জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু তাদের আচার শেষ হওয়ার আগেই ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে—শক্তি তাদেরই গ্রাস করে নিতে শুরু করে। তখন স্থানীয় ঋষি ও ব্রাহ্মণরা মিলিত হয়ে দেবীর আরাধনা করে সেই শক্তিকে প্রতিরোধ করেন এবং যোগিনীদের মূর্তির ভেতর আবদ্ধ করে ফেলেন। সেই থেকে মন্দির নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, আর কেবলমাত্র যোগিনী পূজার ছদ্মরূপে এর ব্যবহার চলতে থাকে। পুঁথিতে স্পষ্ট নির্দেশ ছিল—কেউ যদি অজ্ঞানে বা অহংকারে সেই শক্তিকে মুক্ত করতে চেষ্টা করে, তবে তার সর্বনাশ অবধারিত। কারণ শক্তিকে জাগিয়ে তুললে মানুষের পক্ষে তাকে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়; সে নিজের পথেই ছড়িয়ে পড়ে, আর মানুষকে কেবল ভস্মে পরিণত করে।

এই সত্য আবিষ্কার করে অনির্বাণের বুক ঠান্ডা হয়ে এলো। তিনি বুঝতে পারলেন, যে আগুন নিয়ে খেলা করেছেন তা কেবল ইতিহাসের রহস্য নয়, বরং জীবন্ত ধ্বংসের বীজ। তার মনে পড়ল যজ্ঞকুণ্ড সক্রিয় করার মুহূর্তটি—যে মন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, তা আসলে সেই প্রাচীন নিষিদ্ধ আহ্বান ছিল। দলের বাকিরা তার চোখের ভয় দেখে বুঝতে পারল, তাদের বিপদ কোনো কুসংস্কার নয়, বরং এক ভয়ঙ্কর বাস্তব। কক্ষে চারপাশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল অচেনা নারীকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ, যা পুঁথির শব্দের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, যোগিনীরা আবারও মুক্তি চাইছে, আর মূর্তির ভেতর বন্দী শক্তি ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। দলের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ল, কেউ পাগলের মতো বেরোনোর রাস্তা খুঁজতে লাগল, কিন্তু অনির্বাণ জানতেন—এখন আর পালিয়ে বাঁচা যাবে না। তারা ইতিহাসের যে গোপন অধ্যায় খুঁজছিলেন, সেটি এখন নিজের ভয়ঙ্কর রূপে তাদের জীবনকে গ্রাস করতে এসেছে।

অধ্যায় ১০ – শেষ সিদ্ধান্ত

ভূগর্ভস্থ কক্ষের নিঃশ্বাসরুদ্ধকর আঁধারে যখন দলটি পুঁথির শেষ লাইনগুলো পড়ে শেষ করল, তখন যেন প্রত্যেকের বুকের ভেতর থেকে রক্ত শীতল হয়ে গেল। সেখানে লেখা ছিল—এই ভয়ঙ্কর শক্তিকে শান্ত করার একমাত্র উপায় হলো যজ্ঞকুণ্ডে একজন জীবন্ত আত্মাকে উৎসর্গ করা। দেবীর নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সেই বলি দিলে শক্তি আবার নিস্তব্ধ হয়ে যোগিনীদের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে। কিন্তু যদি তা না করা হয়, তবে শক্তি ক্রমশ প্রবল হয়ে মন্দির ভেঙে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। এই কথা পড়তেই দলের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কারো চোখে জল, কারো চোখে উন্মাদ ভয়—কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না, তবু মনের ভেতর সবাই বুঝছিল, এই মন্দির থেকে বেঁচে ফেরা এখন আর সবার পক্ষে সম্ভব নয়। ভাঙা কণ্ঠে অরিন্দম বলল, “তাহলে আমাদের মধ্যে কাউকে মরতে হবে?” তার কথার সঙ্গে সঙ্গে কক্ষে চাপা সিসকি আর তর্ক শুরু হলো। কেউ বলতে লাগল, বলি দেওয়া মানেই অযৌক্তিক কুসংস্কার মানা, আবার কেউ বলছিল, মৃত্যু যদি একমাত্র মুক্তির পথ হয় তবে তাকে মানতেই হবে।

ক্রমে পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। বাইরে বজ্রবিদ্যুৎ শুরু হলো, আকাশ যেন ছিঁড়ে ফেটে যাচ্ছে। মন্দিরের ভেতরে কালো ঘূর্ণি আবার তীব্র হয়ে উঠল, যোগিনীদের চোখ থেকে অগ্নিশিখা ছিটকে বেরোতে লাগল। সেই আলোতে দলের প্রত্যেকের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল—অতৃপ্ত ভয়, শূন্য হতাশা আর জীবনের জন্য মরিয়া আকুতি। কেউ বলল, দলনেতা অনির্বাণকেই দায় নিতে হবে, কারণ তিনিই ভুল করে যজ্ঞকুণ্ড সক্রিয় করেছিলেন। আবার কেউ বলল, দলের তরুণতম সদস্য অরিন্দমের জীবন এখনো সামনে পড়ে আছে, তাকে বাঁচানো উচিত। অর্পিতা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাকি সদস্যরা আরও ভেঙে পড়েছিল, আর এবার যেন প্রত্যেকেই অপরের দিকে শিকারীর মতো তাকাতে শুরু করল। মুহূর্তেই বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা আর একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়ে তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর লড়াইয়ে নেমে পড়ল। কক্ষে হঠাৎ এক অদ্ভুত গর্জন ভেসে এলো, যেন যোগিনীদের সম্মিলিত কণ্ঠে বলা হচ্ছে—“বলি দাও, না হলে তোমরা সবাই ভস্ম।”

শেষ রাতে ঝড় তুফান তীব্র হয়ে উঠল। বজ্রপাতের আলোয় মন্দিরের পাথর যেন নড়ে উঠছিল, যজ্ঞকুণ্ড থেকে কালো আগুনের কুণ্ডলী আকাশের দিকে ছুটছিল। দলের ভেতরে তখনও সিদ্ধান্তহীনতা, টানাপোড়েন আর অরাজকতা চলছিল। কেউ কাউকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছিল, কেউ পাগলের মতো প্রার্থনা করছিল, কেউ আবার চোখ বন্ধ করে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঠিক সেই মুহূর্তে, কক্ষে এক প্রচণ্ড শব্দ প্রতিধ্বনিত হলো—কেউ একজন যজ্ঞকুণ্ডের দিকে ঝাঁপ দিয়েছে। আগুনের শিখা মুহূর্তে লেলিহান হয়ে আকাশমুখী হলো, আর সেই আলোয় বাকিরা সাময়িকভাবে অন্ধ হয়ে পড়ল। তারা কিছু দেখতে পেল না, শুধু শুনতে পেল এক অচেনা নারীকণ্ঠের তৃপ্তির নিঃশ্বাস আর যোগিনীদের চোখ ধীরে ধীরে নিভে আসছে। কালো ঘূর্ণি থেমে গেল, বজ্রবিদ্যুৎ স্তব্ধ হলো, আর মন্দিরে নেমে এলো এক ভয়ঙ্কর নীরবতা। সকালের আলো ফুটতেই স্থানীয়রা মন্দিরের পাশে ভাঙাচোরা জিনিসপত্র পেল, কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক দলের কারো চিহ্ন তারা খুঁজে পেল না। কে বলি দিল, কে বাঁচল—তার উত্তর চিরকাল অজানাই থেকে গেল। চৌষট্টি যোগিনীর রহস্য আবার গোপনে মিলিয়ে গেল, যেন ইতিহাসের বুক থেকে নয়, সরাসরি অন্ধকারের গভীর থেকে।

সমাপ্ত

 

1000070557.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *