Bangla - তন্ত্র

চৌষট্টি যোগিনী

Spread the love

গৌরব মিত্র


কলকাতার আর্চিওলজি ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমে বসেছিলেন দীপাংশু মুখার্জী। দেওয়ালের একপাশে প্রাচীন শিবমূর্তির ছবি, অন্যপাশে মধ্যযুগীয় মন্দিরের স্থাপত্যের স্লাইড প্রজেক্টর থেকে আলো ফেলে ঝলমল করছে। টেবিলের ওপর ছড়ানো নোটবুক, কাগজপত্র, আর তার হাতের পরিচিত সিগারেটের ধোঁয়া মিলেমিশে যেন কক্ষটিকে এক অদ্ভুত আবহে ভরিয়ে তুলেছিল। সেমিনার চলাকালীনই দপ্তরের এক চতুর্থশ্রেণির কর্মী এসে একটি খাম দিয়ে গেল—সাধারণ বাদামি রঙের, কোন প্রেরকের নাম নেই, কেবল কালো কালিতে লেখা তাঁর নাম আর ডিপার্টমেন্টের ঠিকানা। খানিকটা অবাক হয়ে খাম খুলতেই চোখ আটকে গেল মাত্র এক লাইন লেখায়—“চৌষট্টি যোগিনীর পূজা অসমাপ্ত, তুমি কি দেখতে চাও?”। মুহূর্তেই শরীরের ভেতর শিরশিরে একটা শীতলতা ছড়িয়ে গেল। ‘চৌষট্টি যোগিনী’ শব্দবন্ধটা তাঁর কাছে অপরিচিত নয়, বহুবার প্রবন্ধে পড়েছেন, তন্ত্রসাধনার ইতিহাসে এটি এক অদ্ভুত অধ্যায়। কিন্তু কলকাতার মাঝেই কেউ এভাবে সরাসরি ডাক পাঠাবে, সেটা তাঁর কাছে এক অদ্ভুত ধাঁধা হয়ে দাঁড়াল।

পত্রটি হাতে নিয়েই তিনি ভাবতে লাগলেন, কে পাঠাতে পারে? সহকর্মী বা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কেউ কি মজা করেছে? নাকি এর ভেতরে সত্যিই কোনো সূত্র লুকিয়ে আছে? মনের গভীরে কৌতূহলের বীজ তখনই শেকড় গাঁথতে শুরু করল। তিনি জানতেন, বীরভূম জেলায় কয়েকটি পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপ আছে, যেগুলোর সঙ্গে শৈব তন্ত্রসাধনার সম্পর্ক নিয়ে লোকমুখে নানা গুজব প্রচলিত। হঠাৎই যেন তাঁর মনে পড়ল—কয়েক মাস আগে এক বিদেশি গবেষক বলেছিলেন, “তোমাদের বাংলার মাটিতেই আছে অসমাপ্ত যোগিনী পূজার আসর, যা আজও অন্ধকারে রয়ে গেছে।” সেই কথাগুলো তখন গুরুত্ব দেননি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অচেনা পত্রটির সঙ্গে যেন কোনো এক অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। তিনি জানেন, প্রত্নতত্ত্ব কেবল ভগ্নস্তূপ মাপজোখ বা ইটের গাঁথুনি খোঁজা নয়, বরং মাটির নিচে চাপা পড়া ইতিহাসের ফিসফিসানি শোনার নাম। আর সেই ডাক এখন যেন তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও গভীর অজানার দিকে।

সন্ধ্যা নামতেই দীপাংশু নিজের অফিস থেকে বেরোলেন। বাইরে কলকাতার ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ির হর্ন, লোকজনের ভিড়, চায়ের দোকানে আড্ডার ঝড়। কিন্তু তাঁর মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছিল শুধু সেই এক লাইন লেখা। বাড়ি ফিরে টেবিলে পত্রটি রেখে অনেকক্ষণ ধরে দেখলেন। অজানা আতঙ্কের পাশাপাশি অদ্ভুত টান কাজ করছে—যেন ইতিহাস নিজেই তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছে। অবশেষে তিনি ঠিক করলেন, আর অপেক্ষা নয়। সামনের সপ্তাহেই বীরভূমের পথে রওনা দিতে হবে। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখলেন, নোটবুকে প্রাথমিক প্রস্তুতির তালিকা লিখে ফেললেন—কোন কোন যন্ত্রপাতি নিতে হবে, কোন কোন ধ্বংসস্তূপ খুঁজতে হবে। মনের মধ্যে জ্বলতে লাগল এক অদম্য কৌতূহল—“অসমাপ্ত পূজা” কথাটার মানে কী? কীসের পূজা? আর সেই পূজা কেন শেষ হয়নি? হয়তো লোককথা, হয়তো গুজব। কিন্তু ইতিহাসে গুজবেরও তো ভিত্তি থাকে। সিগারেটের ধোঁয়া ঘরভর্তি অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে তিনি অনুভব করলেন—এই যাত্রা হয়তো তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা হতে চলেছে। বীরভূমের মাটি যেন অপেক্ষা করছে এক অচেনা সত্য উন্মোচনের জন্য।

***

দীপাংশুর ট্রেন বীরভূম স্টেশনে পৌঁছোল বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে। ছোট্ট শহর, চারিদিকে ধুলো মেখে থাকা বাজার, ভাঙাচোরা দোকানপাট, আর সেই স্বতন্ত্র গ্রামীণ গন্ধ—মাটির, শস্যের আর শুকনো পাতার পোড়া ধোঁয়ার। তিনি হোটেলে গা এলিয়ে রাখার বদলে সরাসরি বেরিয়ে পড়লেন সেই গ্রামে, যেখানে কথিত ধ্বংসস্তূপটি রয়েছে। স্থানীয় গাড়িওয়ালাকে জায়গার নাম বলতেই লোকটা ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, পরে গলা নামিয়ে বলল, “ওখানে যাবেন বাবু? রাস্তাটা পাকা নয়, আর অন্ধকার নামলেই ভয়ানক।” দীপাংশু তবু গাড়ি ভাড়া করে বসলেন। কয়েক ঘণ্টার ভাঙাচোরা রাস্তা পেরিয়ে, ঝোপঝাড়ে ঢাকা পথ অতিক্রম করে পৌঁছোলেন তিনি। দূরে দেখা গেল কেবল ধূসর ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে থাকা ইটের দেওয়াল, কিছু ভগ্নস্তম্ভ, আর শুকনো শিমুলগাছের পাতা ঝরে পড়া মাটি। গ্রামের এক বৃদ্ধ, নাম রতন মাঝি, এগিয়ে এসে তাঁকে স্বাগত জানাল, তবে স্বাগত থেকে বেশি সতর্কতা তার কণ্ঠে। “বাবু, আপনি গবেষণা করতে এসেছেন, সেটা ভালো কথা। কিন্তু শোনেন, এই ধ্বংসস্তূপে রাত কাটাতে যাবেন না। বহুবার দেখেছি, রাত হলে আলো জ্বলে, ঢোল বাজে, মেয়েলি গলার হাহাকার শোনা যায়। আমরা কেউই কাছে যাই না।” দীপাংশু প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি জানতেন, প্রতিটি পরিত্যক্ত স্থানের সঙ্গে এ ধরনের লোকগল্প জড়িয়ে থাকে।

তবুও যখন অন্ধকার নামল, গ্রাম একে একে আলো নিভিয়ে নিদ্রায় তলিয়ে গেল, দীপাংশুর ভেতর কেমন এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। হোটেলের কক্ষ ছেড়ে টর্চ, নোটবুক আর ক্যামেরা হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। রতন মাঝি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিল, মাথা নাড়ছিল অনুশোচনায়। “যেও না বাবু, মনের জেদে প্রাণটা খোয়াতে হবে।” দীপাংশু তবে যুক্তির মানুষ—এই ভয়ে তিনি পিছিয়ে যাবেন না। ধ্বংসস্তূপের কাছে পৌঁছে বাতাসটা হঠাৎই থমথমে ঠাণ্ডা লাগল। ঝোপঝাড়ের ফাঁকে পোকামাকড়ের ডাকও যেন থেমে গেছে। ভগ্ন প্রাচীরগুলো কেমন অন্ধকারে মিশে আছে, মনে হচ্ছে বিশাল দানব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে টর্চের আলো ফেলতেই দেখা গেল ভাঙা মূর্তির হাত, আধো পাথরের মুখাবয়ব, শ্যাওলা জমে যাওয়া ইট। নীরবতার ভেতর তাঁর নিজের নিঃশ্বাস আর বুটের আওয়াজ কানে ধাক্কা দিচ্ছিল। টর্চ বন্ধ করে তিনি মাটিতে বসলেন, কানে এল মৃদু ফিসফিসানি—প্রথমে মনে হল বাতাসের খেলা, কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠল। যেন কেউ এক সুরে মন্ত্র পড়ছে, ছন্দ মিলিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

দীপাংশুর বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হলেও তিনি নোটবুকে লিখতে থাকলেন—“প্রথম শ্রবণ: মন্ত্রোচ্চারণ, অচেনা ভাষা, নারীকণ্ঠ।” কৌতূহল তাঁকে টেনে নিল আরও ভেতরে। ধ্বংসস্তূপের কেন্দ্রস্থলে এসে তিনি দেখলেন ভাঙা পাথরের বেদির চারপাশে ছায়া যেন নড়ছে। চোখ কচলালেন, আবার তাকালেন—আলো নেই, অথচ যেন অগ্নিশিখার প্রতিফলন ঝিলিক দিচ্ছে ভগ্নমূর্তির গায়ে। হঠাৎই ঠাণ্ডা বাতাস গায়ে বয়ে গেল, পেছনে যেন কারও পায়ের শব্দ, কিন্তু ঘুরে তাকালে কিছু নেই। মনে হল, অদৃশ্য কোনো নারীসমাবেশে তিনি অনাহূত অতিথি হয়ে পড়েছেন। কণ্ঠস্বর ক্রমেই তীব্র হচ্ছে, ছন্দ আরও দ্রুত। তাঁর হাতে থাকা টর্চ এক ঝটকায় নিভে গেল, ক্যামেরার লেন্সে কুয়াশা জমে গেল। বুক কাঁপতে কাঁপতে তিনি আবার নোট লিখলেন—“ধ্বনি আরও স্পষ্ট, একাধিক কণ্ঠ, তন্ত্রমন্ত্র সদৃশ।” ভয়ে কপালের ঘাম গড়িয়ে পড়ছিল, তবু যুক্তির নেশা তাঁকে টেনে রাখল। অবশেষে তিনি টর্চ আবার জ্বালালেন, আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ছায়ারা মিলিয়ে গেল, কেবল ভগ্নস্তূপের গায়ে চাঁদের আলো পড়ছে। নিঃশব্দতার ভেতর সেই মুহূর্তে তিনি বুঝলেন—লোককথার গভীরে হয়তো সত্যিই কিছু আছে, যা এখনও সময়ের গর্ভে চাপা পড়ে আছে। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে ফিরে আসতে চাইলেন, কিন্তু পায়ের নিচে হঠাৎ চাপা পড়ল কিছু শক্ত বস্তু। টর্চের আলোয় দেখা গেল, এক ভাঙা নারীমূর্তির হাত, যার আঙুলে অদ্ভুত নকশা খোদাই করা। মনে হল সেই আঙুলই যেন তাঁকে নির্দেশ করছে—“এখনও শেষ হয়নি, আরও গভীরে আস।”

***

বীরভূমের ধ্বংসস্তূপে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতায় দীপাংশুর ভেতরে অদ্ভুত এক দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল। যুক্তিবাদী মন বলছিল—সবই হয়তো ভ্রম, মস্তিষ্কের ক্লান্তি আর ভাঙা স্থাপত্যের প্রতিধ্বনি। কিন্তু অন্তরের গভীরে তিনি জানতেন, যেটা শুনেছেন, যেটা দেখেছেন, তা নিছক কাকতালীয় নয়। সকালে তিনি স্থানীয় গ্রন্থাগারে গিয়ে নথিপত্র ঘাঁটছিলেন, তখনই হঠাৎ দরজার বাইরে শোনা গেল দৃপ্ত পায়ের শব্দ। ভেতরে ঢুকলেন এক তরুণী, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি, গলায় নীল ওড়না, হাতে খাতা-কলমে ভরা থলে। পরিচয় দিলেন—ঐশ্বর্য সেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকসংস্কৃতির গবেষক। দীপাংশু অবাক হলেন শুনে যে, তিনি বিশেষভাবে এসেছেন ‘চৌষট্টি যোগিনী পূজা’ নিয়ে মাঠপর্যায়ের কাজ করতে। প্রথম আলাপেই বোঝা গেল, ঐশ্বর্যের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর বিশ্বাস, লোককথা নিছক গুজব নয়—গ্রামীণ মানুষের চেতনায় যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বেঁচে থাকে, তার মধ্যে কোনো না কোনো সত্যের কণা অবশ্যই থাকে। দীপাংশু ব্যঙ্গ করে বললেন, “লোককথা দিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না।” ঐশ্বর্যের তৎক্ষণাৎ জবাব—“কিন্তু ইতিহাস তো শেষ পর্যন্ত মানুষেরই গল্প। মানুষের ভয়ের, বিশ্বাসের, আকাঙ্ক্ষার ভিতরেও ইতিহাস লুকিয়ে থাকে।” এই প্রথমবার দীপাংশুর যুক্তি ও ঐশ্বর্যের কল্পনার দ্বন্দ্ব শুরু হল, কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই দ্বন্দ্বই তাদের কথোপকথনকে প্রাণবন্ত করে তুলল।

ঐশ্বর্য জানালেন, কয়েক বছর ধরে তিনি যোগিনী পূজা সংক্রান্ত বিভিন্ন লোককথা সংগ্রহ করেছেন। কোথাও বলা হয়, ষাটচল্লিশ যোগিনীই ছিলেন প্রকৃত নারী, যাদের বলি দিয়ে অমরত্ব অর্জনের চেষ্টা করেছিলেন এক তান্ত্রিক; কোথাও বলা হয়, তাঁরা ছিলেন দেবীর অবতার, যাঁদের অসমাপ্ত আহ্বানের কারণে আজও পূজা শেষ হয়নি। তিনি গ্রামের বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে কথা বলে শুনেছেন, রাতের আঁধারে ধ্বংসস্তূপে নাচগানের শব্দ শোনা যায়। দীপাংশু এ কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন, “আমিও গত রাতে মন্ত্রোচ্চারণ শুনেছি। কিন্তু ওসব হয়তো বাতাসে গাছের ঘর্ষণ, বা কোনো প্রতিধ্বনি। মানুষের কান অনেক সময় ভ্রম তৈরি করে।” ঐশ্বর্য একদম চোখে চোখ রেখে বললেন, “তাহলে ভগ্নমূর্তির আঙুলে খোদাই করা নকশাটা কিসের প্রতিধ্বনি? আপনি যুক্তি খুঁজছেন, কিন্তু সব কিছুই যুক্তি দিয়ে মাপা যায় না।” দীপাংশু চুপ করে গেলেন, কারণ তিনি জানেন ঐশ্বর্যের কথায় আংশিক সত্য আছে—যা তিনি আগের রাতে নিজের চোখে দেখেছেন, তা নিছক ব্যাখ্যা দিয়ে মুছে ফেলা যায় না। তাঁদের আলোচনার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এক অদৃশ্য সেতু তৈরি হচ্ছিল—দুজনেই রহস্যে টানা পড়েছেন, দুজনের অনুসন্ধান ভিন্ন পথে শুরু হলেও লক্ষ্য একটাই।

সন্ধ্যার পর তাঁরা দুজন মিলে আবার ধ্বংসস্তূপের দিকে পা বাড়ালেন। এবার দীপাংশুর সঙ্গে আর একা থাকার ভয় নেই, আর ঐশ্বর্যের চোখে ছিল এক অদ্ভুত জেদ—তিনি শুনে আসা লোককথার সত্যতা যাচাই করতে চান। গ্রামবাসীরা তাঁকে আরও বেশি নিরস্ত করার চেষ্টা করল, বিশেষত রতন মাঝি বারবার বলল, “মেয়ে মানুষকে নিয়ে যাবেন না বাবু, এটা ভালো হবে না।” কিন্তু ঐশ্বর্য দৃঢ় গলায় উত্তর দিলেন, “আমার কাজের ক্ষেত্রেই তো আমাকে যেতে হবে।” অন্ধকারে ভগ্নমন্দিরের গায়ে চাঁদের আলো পড়ছিল, নিস্তব্ধতার ভেতর তাদের পদক্ষেপ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। হঠাৎ ঐশ্বর্য থমকে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন, “শুনুন… এটা কি গান?” দীপাংশু কান পাতলেন, সত্যিই দূর থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠস্বরের মতো টান। এবার তিনি যুক্তি খুঁজতে গিয়ে থেমে গেলেন। ঐশ্বর্য মৃদু হাসলেন, “দেখলেন তো? লোককথা শুধু গল্প নয়।” সেই মুহূর্তে দুজনেই বুঝলেন, তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হলেও এই অদ্ভুত রহস্য তাঁদের এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে। তাঁরা একসাথে খুঁজতে শুরু করলেন—অতীতের ধ্বংসস্তূপের গায়ে লুকিয়ে থাকা সত্য, যেটা হয়তো তাঁদের জীবনকেই অন্য খাতে টেনে নিয়ে যাবে।

***

পরদিন সকালে দীপাংশু ও ঐশ্বর্য স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ধ্বংসস্তূপে প্রাথমিক খনন কাজ শুরু করলেন। হাতে যন্ত্রপাতি খুব বেশি নেই, কেবল এক-দু’জন শ্রমিকের সাহায্যে ভাঙা ইট সরানো, মাটি খুঁড়ে দেখা—এইটুকুই। তবুও তাঁদের মনে হচ্ছিল, ধ্বংসস্তূপ যেন নিজে থেকেই কিছু গোপন সত্য প্রকাশ করতে চায়। খননের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই এক শ্রমিক হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। সবাই ছুটে গিয়ে দেখল মাটির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে এক ভগ্নমূর্তি—অর্ধেক শরীর ভাঙা, কিন্তু মুখমণ্ডল আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত। মূর্তিটি নারী, চোখ অর্ধনিমীলিত, ঠোঁটে যেন অদ্ভুত হাসি, আর কপালে খোদাই করা এক অজানা প্রতীক। আশ্চর্যের বিষয়, মূর্তির একপাশ পুরোপুরি ক্ষয়ে গেছে, শ্যাওলা আর মাটি ঢেকে দিয়েছে, কিন্তু অন্য পাশটিতে অদ্ভুত দীপ্তি ছড়াচ্ছে। সূর্যের আলো পড়লে মনে হচ্ছিল, মূর্তির অর্ধেক অংশ এখনো জীবন্ত, শ্বাস নিচ্ছে। ঐশ্বর্য মূর্তিটির দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন, যেন বহু পুরনো কোনো লোককথার চরিত্র হঠাৎ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এরা মুক্তি পায়নি… তাই তো রাতে তাঁদের কণ্ঠ শোনা যায়।” দীপাংশু কপাল কুঁচকালেন, তবু ভিতরে ভিতরে শিরদাঁড়ায় এক শীতল স্রোত বইতে শুরু করল।

মূর্তির গোড়ার কাছে পাওয়া গেল কিছু শিলালিপি, ক্ষয়ে যাওয়া অক্ষরের ভেতর থেকেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল কয়েকটি শব্দ—“অসমাপ্ত যজ্ঞ… মুক্তি অর্পণ হয়নি…”। দীপাংশু নোটবুকে লিপিবদ্ধ করতে করতে বিড়বিড় করে বললেন, “এর মানে, পূজাটা সত্যিই অসমাপ্ত ছিল।” ঐশ্বর্য উত্তেজিত গলায় যোগ করলেন, “লোককথার সঙ্গে মিল পাচ্ছেন তো? চৌষট্টি যোগিনীর আহ্বান হয়েছিল, কিন্তু পূর্ণতা পায়নি। তাই তাঁদের আত্মা আজও আটকে আছে।” দীপাংশু উত্তর দিলেন, “হতে পারে, কিন্তু আমাদের খুঁজে বের করতে হবে প্রকৃত কারণ—কেন অসমাপ্ত রইল পূজা? কে বা কারা বাধা দিয়েছিল?” আলোচনার মাঝে হঠাৎ দেখা গেল, মূর্তির চোখের কোণে কেমন আলো ঝিলিক দিল। শ্রমিকরা ভয় পেয়ে একে একে সরে দাঁড়াল, রতন মাঝি তো প্রায় প্রণাম করে ফেলল। দীপাংশু নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে গেলেন, কিন্তু ঐশ্বর্য তাড়াতাড়ি ধরে ফেললেন তাঁর কবজি। “না, ছোঁবেন না! ওরা অসমাপ্ত অবস্থায় আছে, জাগিয়ে তুললে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে পারে।” সেই মুহূর্তে দুজনেই বুঝলেন—তাঁরা যে রহস্যের পথে পা দিয়েছেন, তা আর শুধু প্রত্নতত্ত্ব বা লোককথার গণ্ডিতে আটকে নেই। এখানে ইতিহাস, বিশ্বাস আর অদৃশ্য শক্তি মিলেমিশে এমন এক জটিল অরণ্য তৈরি করেছে, যেখান থেকে হয়তো ফেরা সহজ হবে না।

সন্ধ্যার পর মূর্তির সামনে মাটিতে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসেছিলেন ঐশ্বর্য। তিনি চেষ্টা করছিলেন পুরনো লোকগাথার সুর মনে করে পড়তে—যেটা গ্রামে শুনেছিলেন ছোটবেলায়। দীপাংশু কিছুটা বিরক্ত হলেও তাঁর পর্যবেক্ষণ থামালেন না। নোটবুকে লিখলেন—“অর্ধেক ভগ্ন, অর্ধেক দীপ্ত। শিলালিপি নির্দেশ করছে অসমাপ্ত যজ্ঞ।” হঠাৎই আশপাশের বাতাস ভারী হয়ে এল। দূরে শেয়ালের ডাক যেন মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গত দিচ্ছে। মোমবাতির আলোয় মূর্তির ঠোঁট কাঁপল কি না, দীপাংশু নিশ্চিত হতে পারলেন না, তবে ঐশ্বর্যের চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল। তিনি নিঃশব্দে ফিসফিস করলেন, “ওরা কিছু বলতে চাইছে।” দীপাংশু এক ধাপ পিছিয়ে এলেন, কিন্তু মনের গভীরে কৌতূহল আরও তীব্র হল। মূর্তির অদ্ভুত দীপ্তি যেন তাঁদের জানাচ্ছিল—এ কেবল শুরু। চৌষট্টি যোগিনীর রহস্য, অসমাপ্ত পূজার শেকল, আর মুক্তি না পাওয়া আত্মারা তাঁদের সামনে ধীরে ধীরে পর্দা সরাচ্ছে। আর সেই রহস্যের টান দুজনকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে এমন এক অন্ধকার পথে, যেখান থেকে আর ফেরার পথ নাও থাকতে পারে।

***

সেই দিন বিকেল থেকেই আকাশে অদ্ভুত এক অস্থিরতা জমে উঠেছিল। পশ্চিম দিগন্তে কালো মেঘ গাঢ় হতে শুরু করেছিল, আর গ্রীষ্মের মাঝরাতে যেভাবে হঠাৎ ঝড় ওঠে, তার আভাস মিলছিল বাতাসের বুকে। দীপাংশু ও ঐশ্বর্য তখনও ধ্বংসস্তূপের ভেতর নোট নিচ্ছিলেন, মূর্তিগুলো ঘেঁটে যাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রকৃতির এই পরিবর্তন যেন তাঁদের ভেতরও এক অনিশ্চয়তার ছায়া ফেলে দিল। সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন রাত নামল, হাওয়া ততক্ষণে ঝড়ো রূপ নিয়েছে। গ্রামবাসীরা একে একে কুটিরের ভেতর লুকিয়ে পড়েছে, রতন মাঝিও বারবার এসে সতর্ক করে দিয়ে গেছে—“বাবু, আজ রাতে বাইরে থাকবেন না। ঝড়ের রাতে ওরা বেরোয়। আগুন নিভে যায়, বাতাসে ওদের নাচ শুরু হয়।” দীপাংশু শুনেও পাত্তা দিলেন না। তাঁর কাগজ-কলম তখনও হাতে, যেন সত্যিই তিনি অজানা ইতিহাস লিখে রাখার সাক্ষী হতে চান। ঐশ্বর্য একটু ভীত হলেও তাঁর কৌতূহল ভয়কে ছাপিয়ে যাচ্ছিল। রাত যত গাঢ় হতে লাগল, ততই তাঁদের মনে হচ্ছিল, বাতাসে যেন অদ্ভুত শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে—কর্কশ, দীর্ঘ মন্ত্রোচ্চারণের মতো।

হঠাৎই দূরের শ্মশানমুখী পথের দিকে তাকিয়ে দুজনেই স্থির হয়ে গেলেন। বজ্রবিদ্যুৎ ঝলসে উঠতেই দেখা গেল, ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে আলোকছায়ার মতো ভেসে উঠেছে অগণিত নারী অবয়ব। তারা যেন কুয়াশা বা ধোঁয়ার মতো, অথচ স্পষ্ট মানবী শরীরের আকার আছে। ষাটচল্লিশ নারীর মতো অবয়ব, সবাই বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নাচছে। তাঁদের চুল উড়ছে বাতাসে, চোখে শূন্য দৃষ্টি, ঠোঁটে একসাথে উচ্চারিত হচ্ছে অজানা মন্ত্র। শব্দটা কর্কশ, কিন্তু তাতে এমন এক ছন্দ আছে যা কারও হৃদস্পন্দনকে বদলে দিতে পারে। ঐশ্বর্য ভয়ে দীপাংশুর হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। তাঁর গলা শুকিয়ে গিয়েছে, কেবল ফিসফিস করে বললেন, “এরা… এরা সত্যিই আছে।” দীপাংশু যদিও কেঁপে উঠেছিলেন, তবু কাগজে কলম চালাতে থাকলেন। তাঁর নোটে লেখা হল—“চৌষট্টি অবয়ব, অর্ধেক দৃশ্যমান, অর্ধেক ছায়ায়। একযোগে নৃত্য। কর্কশ মন্ত্র।” এই দৃশ্য তাঁর গবেষণার যুক্তিবাদী মানসে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছিল। যুক্তি ভেঙে যাচ্ছে, চোখের সামনে বাস্তব হয়ে উঠছে লোককথার ভৌতিক রূপ।

মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের বাতাস আরও ঠান্ডা হয়ে গেল। ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে এক অদ্ভুত শীতলতা তাঁদের শরীর ভেদ করে প্রবেশ করতে লাগল, যেন অদৃশ্য হাত তাঁদের ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঐশ্বর্য আতঙ্কে চোখ বন্ধ করে দিলেন, অনুভব করলেন কারও নখর যেন তাঁর কাঁধে স্পর্শ করছে। দীপাংশুরও মনে হল, মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ এক ছায়া বয়ে গেল। বাতাস ঘূর্ণি তৈরি করল, মোমবাতি নিভে গেল, আর চারপাশে নাচতে থাকা ছায়াগুলো যেন একে একে তাঁদের দিকে ফিরতে শুরু করল। ঐশ্বর্য কেঁপে উঠে দীপাংশুর কানে বললেন, “ওরা আমাদের দেখতে পাচ্ছে!” দীপাংশুর হাতের কাগজ ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কাঁপছিল, তবু তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সেই ভৌতিক নৃত্যের দিকে। তাঁর চোখে ভয়ের সঙ্গে মিশে ছিল এক পাগল করা কৌতূহল। এই দৃশ্য, এই অভিজ্ঞতা—কোনো ইতিহাসের বইতে লিপিবদ্ধ হয়নি। অথচ তিনি এখন সশরীরে এর সাক্ষী। চারপাশে ঝড় তীব্র হয়ে উঠছিল, আর ষাটচল্লিশ যোগিনীর নৃত্য সেই ঝড়ের বুকে ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, যেন প্রাচীন অসমাপ্ত পূজা আবার পুনর্জীবিত হয়েছে। দীপাংশু বুঝলেন, এ শুধু ভ্রম নয়, এ বাস্তব। এবং এ বাস্তব তাঁকে এমন এক গভীর গহ্বরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যেখান থেকে ফেরা সম্ভব কি না, তিনি নিশ্চিত নন।

***

পরের দিন সকালবেলা ঝড় থেমে গেলেও চারপাশে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। আকাশ কুয়াশায় ঢেকে আছে, যেন সূর্যও আলো দিতে ভয় পাচ্ছে। দীপাংশু ও ঐশ্বর্য সারা রাতের ভয়ানক অভিজ্ঞতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তবু দুজনের চোখে ছিল অদ্ভুত আলো। তাঁরা জানতেন, এই রহস্যের গভীরে কিছু একটা আছে যা কেবল প্রত্নতত্ত্বের বা লোকসংস্কৃতির পরিভাষায় ব্যাখ্যা করা যাবে না। ঠিক তখনই গ্রামের সীমানার কাছে এক পুরনো বটগাছের তলায় তাঁরা দেখতে পেলেন এক বৃদ্ধকে বসে থাকতে। লম্বা দাড়ি, এলোমেলো চুল, গায়ে মলিন কাপড়, চোখে কেমন যেন শূন্যের দৃষ্টি। গ্রামের লোকজন তাঁকে “বিষ্ণুনাথ” নামে ডাকে। কেউ বলে তিনি বহু বছরের সাধক, যিনি তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ। আবার কেউ ফিসফিস করে বলে, তিনি আসলে অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক পিশাচ, যিনি রাতের বেলা ধ্বংসস্তূপে ঘোরেন। দীপাংশু প্রথমে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন, কিন্তু ঐশ্বর্যের মনে হল, এই মানুষটির চোখে যেন শতাব্দীর গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।

বিষ্ণুনাথ তাঁদের আগমন বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মনে হল। তিনি ধীরে ধীরে মাথা তুললেন, গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “তোমরা ওদের দেখেছো, তাই না?” তাঁর কণ্ঠে এমন নিশ্চয়তা ছিল যে প্রশ্নের বদলে উত্তর দিয়েই যেন শুরু করলেন। ঐশ্বর্য চমকে উঠলেন, দীপাংশু কিছুটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলেন, “আমরা গবেষক। চোখ যা দেখে, তা-ই লিখে রাখি।” বিষ্ণুনাথ মৃদু হাসলেন। তাঁর হাসি শীতল বাতাসের মতো গায়ে লাগছিল। তিনি বললেন, “যা দেখেছো, তা ইতিহাস নয়, তা অগ্নির মতো। অসমাপ্ত সাধনার আগুন এখনো জ্বলছে। যতদিন তা শেষ না হবে, ততদিন যোগিনীরা মুক্তি পাবে না।” কথাগুলো শুনে ঐশ্বর্যের বুক কেঁপে উঠল। তিনি হঠাৎই গ্রাম্য কাহিনীগুলোর টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে করতে শুরু করলেন। কিন্তু দীপাংশু দৃঢ় গলায় বললেন, “লোককথা দিয়ে ইতিহাস লেখা যায় না। পূজা অসমাপ্ত হয়েছিল কেন, সেটা জানতে হবে খননের মাধ্যমে, প্রমাণের মাধ্যমে।” বিষ্ণুনাথ এবার তাঁর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। চোখদুটো যেন হঠাৎ জ্বলজ্বল করে উঠল। “প্রমাণ চাইছো? ঠিক আছে, তবে জানো—যারা অসমাপ্ত পূজার পথে পা বাড়ায়, তাদের ফিরে আসা সহজ নয়। যোগিনীরা শুধু মুক্তি চায় না, ওরা প্রতিশোধও চায়।”

ঐশ্বর্যের শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। তিনি কেঁপে উঠে বললেন, “তাহলে কি এর শেষ আছে? পূজাটা কি সম্পূর্ণ করা সম্ভব?” বিষ্ণুনাথ গভীর নিশ্বাস ফেললেন। তাঁর কণ্ঠে যেন দূরের বজ্রপাতের মতো গম্ভীর ধ্বনি শোনা গেল। “হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু যে করবে, তাকে নিজের জীবন দিয়ে দাম চুকোতে হবে। অসমাপ্ত সাধনার আগুন জ্বলছে এই ভূমিতেই। ও আগুন নিভলে তবেই মুক্তি। তবে মনে রেখো, মুক্তির সঙ্গে সর্বনাশও আসতে পারে।” দীপাংশু ঠোঁট চেপে ধরে নোট লিখে চললেন, যেন কথাগুলোকে তথ্য হিসেবে ধরে রাখতে চান। কিন্তু তাঁর ভিতরের যুক্তিবাদী সত্তা কাঁপতে শুরু করেছে—কারণ যুক্তি দিয়ে তিনি আর এই রহস্যকে বোঝাতে পারছেন না। ঐশ্বর্যের মুখ苍苍 হয়ে উঠল। তাঁর মনে হচ্ছিল, এই বৃদ্ধ শুধু একজন মানুষ নন, বরং সেই অজানা শক্তিরই দূত, যাকে তাঁরা গত রাতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। বিষ্ণুনাথ তখন ধীরে ধীরে বটগাছের ছায়ায় মিলিয়ে গেলেন, যেন তিনি কখনোই বাস্তব ছিলেন না। চারপাশের বাতাস আবার ভারী হয়ে উঠল। দীপাংশু জেদী গলায় বললেন, “অলৌকিক কিছু নেই। সব ব্যাখ্যা করা যায়।” কিন্তু তাঁর কণ্ঠ কেঁপে যাচ্ছিল। ঐশ্বর্য নিঃশব্দে ভাবছিলেন, হয়তো এই বারের মতো তাঁরা সত্যিই যুক্তি আর অলৌকিকতার সীমারেখা পেরিয়ে এসেছেন। তাঁদের যাত্রা এখন আর শুধু গবেষণা নয়, বরং বেঁচে থাকার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়াল।

***

বীরভূমের সেই দূরবর্তী গ্রামটিতে খননকাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই প্রশাসনের নজর ছিল কাজের অগ্রগতির দিকে। জেলা প্রশাসক দেবাশীষ চৌধুরী একজন শিক্ষিত, শহুরে মানুষ। তাঁর চোখে ইতিহাস মানে প্রাচীন নিদর্শন, প্রত্নতত্ত্ব মানে শুধু বৈজ্ঞানিক খনন, আর লোককথা মানে অশিক্ষিত গ্রামবাসীর কুসংস্কার। তাই প্রথমে যখন দীপাংশু মুখার্জী অনুমতি চাইলেন, তিনি খুব আনন্দের সঙ্গেই সম্মতি দিয়েছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, এর মাধ্যমে জেলার নাম আরও উজ্জ্বল হবে, পত্রিকায় খবর বেরোবে, হয়তো পর্যটনের সুযোগও বাড়বে। কিন্তু কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠল। প্রতিদিন সকালে কয়েকজন গ্রামবাসী তাঁর অফিসের দরজায় ভিড় জমাত। তারা বলত, “বাবু, ওই খনন বন্ধ করুন। যোগিনীরা রাগ করেছে। ওরা রক্ত চাইছে।” দেবাশীষ শুরুতে এসব হেসেই উড়িয়ে দিলেন। তিনি নরম গলায় বোঝাতেন, “দেখুন, বিজ্ঞান ছাড়া উন্নতি নেই। এসব অলৌকিক ব্যাপারে ভয় পেলে চলবে না।” কিন্তু দিন যত যাচ্ছিল, গ্রামবাসীর চোখের ভয়ের ছাপ ততই গভীর হচ্ছিল, আর গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল আগুনের মতো।

দেবাশীষ নিজের যুক্তিবাদী মন দিয়ে বিষয়গুলো সামলাতে চাইছিলেন। তিনি জানতেন, ভয় মানুষের ভেতরেই জন্মায় এবং কুসংস্কার সেই ভয়ের ওপর ভর করে বিস্তার লাভ করে। তাই একদিন তিনি নিজেই খননস্থলে গিয়ে কাজ দেখলেন। দীপাংশু ও ঐশ্বর্যের সঙ্গে কথা বললেন, তাঁদের গবেষণা শুনলেন। বাইরে থেকে সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। মাটির নিচ থেকে মূর্তির ভগ্নাংশ উঠছে, শিলালিপি পাওয়া যাচ্ছে, আর গবেষকরা নোট নিচ্ছেন। কিন্তু তবু তাঁর মনে হচ্ছিল, বাতাস যেন অদ্ভুতভাবে ভারী হয়ে আছে। তিনি কথাটা কাউকে বললেন না। সেই রাতেই প্রথম ঘটল অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। দেবাশীষ নিজের বাংলোর বারান্দায় বসে কিছু ফাইল পড়ছিলেন। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পোকামাকড়ের ডাক ভেসে আসছে। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন এক অচেনা নারীকণ্ঠ—কোনো মন্ত্রোচ্চারণ নয়, আবার গানও নয়, বরং দীর্ঘ টানা স্বর, যেন কেউ হাহাকার করছে। শব্দটা স্পষ্টই ভেসে আসছিল ধ্বংসস্তূপের দিক থেকে। তাঁর হাত থেকে কলম পড়ে গেল। বুকের ভেতর কাঁপন ধরল, অথচ তিনি নড়তে পারলেন না। কয়েক সেকেন্ড পর শব্দ মিলিয়ে গেল, আবার চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তিনি কপালে হাত বুলিয়ে নিজেকে বোঝালেন—হয়তো বাতাসের শব্দ, হয়তো মনের ভুল। কিন্তু অন্তরের গভীরে তিনি জানতেন, এটা কেবল কল্পনা নয়।

পরদিন সকালে অফিসে বসে তিনি চেষ্টা করলেন নিজেকে শক্ত রাখার। গ্রামবাসী আবার এসে জটলা করল, তাদের চোখে আতঙ্ক আরও গাঢ়। তারা প্রায় হুমকির সুরে বলল, “বাবু, এবার যদি খনন বন্ধ না করেন, অশান্তি ছড়িয়ে পড়বে। যোগিনীকে শান্তি দিতে হবে।” দেবাশীষ গম্ভীর গলায় বললেন, “আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, কোনো অশান্তি হবে না। এগুলো শুধু কুসংস্কার।” কিন্তু নিজের ভিতরে তিনি জানতেন, সেদিন রাতের শোনা সেই নারীকণ্ঠ তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। যুক্তিবাদী প্রশাসকের মনে প্রথমবার সংশয়ের ছায়া নেমে এসেছে। তিনি খননকাজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না—কারণ তাতে সরকারি রোষানলে পড়তে হবে। আবার একেবারে ভয়ও অস্বীকার করতে পারলেন না। ফলে দ্বিধা আর সংশয়ের এক অদ্ভুত টানাপোড়েন তাঁকে পীড়িত করতে লাগল। তিনি জানতেন না, এই দ্বিধাই ভবিষ্যতে তাঁর জন্য ভয়ঙ্কর ফাঁদের দরজা খুলে দেবে। এভাবে প্রশাসকের শক্ত, যুক্তিনিষ্ঠ মুখোশের আড়ালে শিউরে ওঠা এক মানুষের আতঙ্ক ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছিল, আর গ্রামের উপর ছায়া ফেলছিল এক অনিবার্য ভৌতিক অশনি সংকেত।

***

বীরভূমের সেই নিস্তব্ধ গ্রামে হঠাৎ এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটল। গ্রামের এক চঞ্চল কিশোর, নাম সুখেন, যাকে সবাই মাঠে-ঘাটে খেলতে দেখত, একদিন হঠাৎ উধাও হয়ে গেল। সকালে সে বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ঘাটে গিয়েছিল, তারপর আর ফেরেনি। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতেই যখন ছেলেটির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না, তখন পুরো গ্রাম উত্তেজিত হয়ে উঠল। মায়ের আর্তচিৎকার, বাবার অসহায় দৌড়ঝাঁপ—সব মিলে বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। স্থানীয়রা জড়ো হয়ে একসাথে বলতে লাগল, “ওকে যোগিনীরা টেনে নিয়েছে! এতদিন সাবধান করেছিলাম, খনন বন্ধ করো, পূজা অসমাপ্ত থাকুক, কিন্তু তোমরা শোনোনি। এখন রক্ত চাইছে ওরা।” আতঙ্ক আর কান্নার স্রোতে গ্রাম ছেয়ে গেল। প্রশাসক দেবাশীষ কিছু লোক পাঠালেন খোঁজ করার জন্য, কিন্তু গ্রামবাসীরা অনড়—তাদের বিশ্বাস, শিশুটি আর বেঁচে নেই, কারণ যোগিনীর অভিশাপের হাত থেকে কেউ রক্ষা পায় না। ঐশ্বর্য কাঁপতে কাঁপতে দীপাংশুকে বললেন, “তুমি বুঝতে পারছো তো, এর সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের যোগ আছে?” দীপাংশু ঠোঁট কামড়ে নীরব রইলেন, কারণ তিনি যুক্তিবাদী হলেও হৃদয়ের গভীরে এক অস্বীকার্য ভয় জেগে উঠেছিল।

রাত নামতেই দীপাংশু ও ঐশ্বর্য নিজেদের হাতে অনুসন্ধানে বেরোলেন। গ্রামবাসীর অনেকে যেতে রাজি হল না, এমনকি পুলিশও সীমান্তের বাইরে সাহস করে পা রাখতে চাইছিল না। দুজন হাতে টর্চ নিয়ে ধ্বংসস্তূপের দিকে এগোলেন। ভাঙা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ চারপাশে ছায়ার মতো ছড়িয়ে আছে, হাওয়ায় শোনা যাচ্ছে শুকনো পাতার মর্মর, কোথাও কোথাও পেঁচার ডাক। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ দীপাংশু টর্চের আলোয় দেখতে পেলেন কিছু চকচক করছে। নিচে নেমে ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠলেন। মাটির ওপর পড়ে আছে ছোট্ট একটা লাল পুঁতির চুড়ি—যা সুখেন প্রতিদিন হাতে পরে খেলত। ঐশ্বর্য ভয়ে চিৎকার করে উঠলেন, “এটা তো সুখেনের!” কিন্তু চুড়ির পাশেই মাটি যেন অস্বাভাবিকভাবে চেপে গেছে। দীপাংশু ঝুঁকে ভালো করে দেখলেন—কিছু পায়ের ছাপ আছে। কিন্তু সেই ছাপ মানুষের মতো নয়, আবার কোনো পশুর মতোও নয়। সেগুলো যেন দীর্ঘ, অস্পষ্ট, ছায়ার মতো দাগ, যেগুলো মাটিতে পড়েছে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট আকার নেই। মনে হচ্ছিল, যেন বাতাস নিজে পা ফেলে গেছে। সেই দাগগুলো ভেতরের দিকে, ধ্বংসস্তূপের অন্ধকারের গভীরে এগিয়ে গেছে।

ঐশ্বর্য ভয়ে কেঁপে উঠলেন। তাঁর কণ্ঠ ফিসফিস করে উঠল, “এটা মানুষ নয়… এ তো ছায়া।” দীপাংশুর শরীর শিউরে উঠল, কিন্তু তিনি চেষ্টা করলেন দৃঢ় থাকতে। তিনি কাঁপা গলায় বললেন, “হয়তো পশুর ছাপ… আলোয় ঠিকমতো বোঝা যাচ্ছে না।” অথচ তাঁর নিজের মনই জানত, যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার বাইরে চলে গেছে এই প্রমাণ। চুড়িটা তিনি হাতে তুলে নিলেন, বুকের ভেতর শ্বাস গরম হয়ে আসছিল। ঐশ্বর্য তাঁর কাঁধ চেপে ধরলেন, “আমাদের এখানে থাকা উচিত নয়। যেভাবে ছেলেটি হারিয়েছে, আমাদের সাথেও কিছু ঘটতে পারে।” দীপাংশু চারপাশে টর্চের আলো ঘুরিয়ে দেখলেন, কিন্তু চারপাশ আরও অন্ধকার, আরও নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। যেন বাতাসও চেপে আসছে তাঁদের দিকে। তিনি ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললেন, “সুখেন কোথাও আছে। ওর খোঁজ আমরা পাবই।” কিন্তু তাঁর নিজের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের থেকে আতঙ্কই বেশি ধরা পড়ছিল। ঐ রাতের পর গ্রামে আতঙ্ক তুঙ্গে পৌঁছল। লোকেরা আর খোলাখুলি বাইরে বেরোতে সাহস করছিল না। তাদের বিশ্বাস আরও দৃঢ় হল—যোগিনীরা জেগে উঠেছে, আর এবার রক্তের পিপাসা মেটানো পর্যন্ত কেউ নিরাপদ নয়। দীপাংশু ও ঐশ্বর্যের কাছে সেই ছায়ার পায়ের ছাপ হয়ে উঠল অমোঘ এক সংকেত—যে অন্ধকারের সঙ্গে তারা লড়াই শুরু করেছে, তা কেবল লোককথা নয়, তা ভয়ঙ্করভাবে বাস্তব।

***

বীরভূমের আকাশে সে রাতটা ছিল ভৌতিকভাবে নীরব, যেন প্রকৃতিও শ্বাস আটকে রেখেছিল। দীপাংশু ও ঐশ্বর্য শেষবারের মতো সাহস জোগাড় করে ধ্বংসস্তূপের দিকে রওনা দিলেন। দু’জনের মনে ভয় চেপে বসেছিল, কিন্তু একই সঙ্গে ছিল অদ্ভুত এক টান—সত্যিটা জানতেই হবে, শেষটা দেখতে হবেই। চারপাশে বাতাসে কেমন শীতলতা ছড়িয়ে পড়েছিল, রাতের অন্ধকার অস্বাভাবিকভাবে ঘন হয়ে উঠছিল। ধ্বংসস্তূপের কাছাকাছি পৌঁছতেই তাঁদের কানে ভেসে এল কর্কশ মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ, যা কখনও উঁচু হয়ে আছড়ে পড়ছে, কখনও মৃদু গুঞ্জনের মতো কানে বাজছে। টর্চের আলোয় সামনে এগোতেই চোখে পড়ল—পুরোনো ভাঙা মন্দিরের ভেতর যেন এক অদ্ভুত আসর বসেছে। মাঝখানে অগ্নিবৃত্ত, আগুন নেভে না, নিভে না, কেবল জ্বলে ওঠে অস্বাভাবিক নীলচে শিখায়। সেই আগুনের চারপাশে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি নাচছে, যেন তারা শরীরবিহীন অথচ জীবন্ত। তাদের হাতের ভঙ্গি, পদক্ষেপ, দোলানো চুল—সবকিছু এত জীবন্ত অথচ এত অস্পষ্ট যে চোখ আটকে যায় অথচ মন ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ঐশ্বর্যের বুক ধড়ফড় করে উঠল। তাঁর ঠোঁট থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এল, “এরা… এরা তো চৌষট্টি যোগিনী।” দীপাংশু শ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর যুক্তি, তাঁর বিজ্ঞানের সব হিসেব মুহূর্তে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল।

আগুনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পরিচিত অবয়ব—বৃদ্ধ তান্ত্রিক বিষ্ণুনাথ। তাঁর চোখে অদ্ভুত দীপ্তি, চুল উসকোখুসকো, দেহে ছেঁড়া গেরুয়া, অথচ সেই ভগ্ন অবয়ব যেন এক অমোঘ শক্তিতে দীপ্যমান। তিনি দু’হাত আকাশের দিকে তুলে মন্ত্র পড়ছিলেন, আর যোগিনীর ছায়ারা একসাথে তাল মিলিয়ে ঘুরছিল। হঠাৎ তিনি দীপাংশু ও ঐশ্বর্যকে লক্ষ্য করলেন। তাঁর চোখ রক্তাভ হয়ে উঠল। বজ্রনিনাদের মতো গলায় তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “এসেছো অবশেষে! তোমাদের ছাড়া পূজা অসম্পূর্ণ! তোমাদের একজনকে উৎসর্গ না করলে এই সাধনা শেষ হবে না। যোগিনীরা মুক্তি পাবে না, আর এ ভূমি কখনও শান্তি দেখবে না।” তাঁর কণ্ঠস্বর যেন চারপাশে প্রতিধ্বনিত হয়ে অন্ধকারকে আরও ঘন করে তুলল। ঐশ্বর্য কেঁপে উঠলেন, হাত চেপে ধরলেন দীপাংশুর বাহু। তাঁর মনে হচ্ছিল, পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। দীপাংশু কাঁপলেও নিজের মনকে শক্ত করলেন। তিনি গর্জে উঠলেন, “মানুষকে হত্যা করে মুক্তি আসবে না, এ মিথ্যে সাধনা।” কিন্তু তাঁর কথার পর মুহূর্তে যেন অগ্নিবৃত্ত আরও উঁচু হয়ে জ্বলে উঠল। ছায়ামূর্তিগুলো ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘুরে তাঁদের ঘিরে ধরতে শুরু করল। তাদের ফিসফিসানি, তাদের পদক্ষেপে চারদিক কেঁপে উঠছিল।

দীপাংশুর মনে হঠাৎই এক কঠিন সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠল—এখানে বিজ্ঞান বা প্রত্নতত্ত্বের কোনো নিয়ম প্রযোজ্য নয়। এই আসর এক অচিন্তনীয় শক্তির কেন্দ্রবিন্দু, যেখানে যুক্তি ভেঙে যায়, ইতিহাস নীরব হয়ে যায়। তিনি বুঝলেন, বিষ্ণুনাথ শুধু এক বৃদ্ধ তান্ত্রিক নয়, বরং অসমাপ্ত সাধনার রক্ষক, যে তার শেষ চাওয়ার জন্য মানুষকেও উৎসর্গ করতে পিছপা হবে না। ঐশ্বর্য শিউরে উঠে ফিসফিস করে বললেন, “আমাদের পালাতে হবে।” কিন্তু চারপাশের আগুনের বৃত্ত ও ছায়ামূর্তির ঘূর্ণন তাঁদের বন্দি করে ফেলেছিল। এই ভৌতিক আসরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দীপাংশু প্রথমবারের মতো স্বীকার করলেন, জ্ঞান, গবেষণা, যুক্তি—সবকিছু অচল হয়ে যেতে পারে এমন এক স্তর আছে, যাকে মানুষ কখনও ছুঁতে চায় না, অথচ যার মুখোমুখি হলে আর ফিরে আসা যায় না। অগ্নিশিখার আলোয় বিষ্ণুনাথের মুখ তখন দানবের মতো লাগছিল। তিনি হাত তুলে চিৎকার করলেন, “উৎসর্গ চাই! রক্ত চাই!” চারপাশের বাতাস হিম হয়ে এলো, ছায়ারা একসাথে চেঁচিয়ে উঠল। দীপাংশু জানলেন, সেই রাতে অসমাপ্ত পূজার আসর কেবল তাঁদের গবেষণার শেষ ধাপ নয়, বরং জীবনেরও এক ভয়ংকরতম পরীক্ষা—যেখানে বেঁচে ফেরার নিশ্চয়তা নেই।

***

অগ্নিবৃত্তের ভেতর দাঁড়িয়ে দীপাংশুর মনে হচ্ছিল, এ এক দুঃস্বপ্নের গভীরতম গহ্বর, যেখানে মানুষ বাঁচার প্রবৃত্তির চেয়ে বড় হয়ে ওঠে সত্য জানার তৃষ্ণা। বিষ্ণুনাথ তখনও চিৎকার করছে, “উৎসর্গ ছাড়া পূর্ণ হবে না সাধনা!” যোগিনীদের ছায়ারা একসাথে হাত তুলছে, তাদের শূন্য চোখে ভয়ংকর শূন্যতা। ঐশ্বর্য বুকের ভেতর কাঁপতে কাঁপতে দীপাংশুর দিকে তাকালেন—চোখে ছিল অসহায় অনুনয়। সেই মুহূর্তে দীপাংশু যেন হঠাৎই উপলব্ধি করলেন, গবেষণা, যুক্তি, প্রত্নতত্ত্ব সবকিছুই অর্থহীন হয়ে যাবে যদি তিনি ঐশ্বর্যকে না বাঁচাতে পারেন। তিনি দাঁত চেপে ঝাঁপিয়ে পড়লেন অগ্নিবৃত্তের দিকে। তাঁর হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না, ছিল কেবল মাটির নিচ থেকে পাওয়া ভগ্নমূর্তির একটি টুকরো, যেটি এখনও অদ্ভুত আলোয় দীপ্তমান ছিল। আগুন তাঁকে পোড়াতে পারল না—বরং যেন মূর্তির টুকরোতে অদৃশ্য এক শক্তি সঞ্চারিত হচ্ছিল। দীপাংশু গর্জন করে বিষ্ণুনাথের দিকে ছুঁড়ে মারলেন সেই অংশটুকু। মুহূর্তে অগ্নিবৃত্ত কেঁপে উঠল, আগুনের রঙ নীল থেকে সাদা হয়ে গেল, আর বিষ্ণুনাথ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। ছায়ামূর্তিগুলো থমকে গেল, তাদের নৃত্য থেমে গেল। দীপাংশুর বুক ধড়ফড় করতে লাগল, তিনি জানতেন—এটা শেষ নয়, বরং শুরু।

ঐশ্বর্য দীপাংশুর দিকে দৌড়ে এলেন, কাঁপা কণ্ঠে বললেন, “তুমি… তুমি এটা করলে কেমন করে?” দীপাংশু হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “আমি জানি না। শুধু অনুভব করলাম, এই অসমাপ্ত পূজা ভাঙতে হবে। না হলে আর কিছুই থামবে না।” সেই মুহূর্তে মাটির নিচ থেকে গর্জনের মতো শব্দ উঠল। চারপাশের ভগ্নমূর্তিগুলো কাঁপতে শুরু করল। তারপর একে একে সব মূর্তি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল, তাদের টুকরো আকাশে উড়ে গিয়ে আগুনে মিশে গেল। ধ্বংসস্তূপের দেওয়ালগুলো ভেঙে পড়তে শুরু করল, চারদিকে ধুলো উড়ল, যেন শত শত বছরের ক্রোধ হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসছে। ঐশ্বর্য আতঙ্কে দীপাংশুর হাত চেপে ধরলেন, আর দু’জনে মিলে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে। পেছনে গর্জন, চিৎকার, আর ভাঙনের আওয়াজ মিলেমিশে এক অদ্ভুত মৃত্যুকোলাহল সৃষ্টি করল। বাইরে এসে তারা হাঁপাতে হাঁপাতে থামল, শরীর জুড়ে মাটি ও ধুলো, কানে বাজছিল ভাঙনের শব্দ। তারপর হঠাৎই নিস্তব্ধতা নেমে এল। মনে হলো, সবকিছু শেষ।

কিন্তু শেষ সত্যিই কি শেষ হলো? ধ্বংসস্তূপের ধ্বংসাবশেষ থেকে বেরোনোর ঠিক আগে, যখন মাটি ধসে পড়ছিল, দীপাংশু স্পষ্ট শুনেছিলেন এক নারীকণ্ঠ—মৃদু অথচ শীতল, যেন কারো গভীর প্রতিশ্রুতি: “অসমাপ্ত রইল… আবার ফিরব।” এই শব্দ তাঁর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বারবার, যেন মনের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। বাইরে এসে ঐশ্বর্য তাঁকে আঁকড়ে ধরে বললেন, “আমরা মুক্তি দিয়েছি, তাই না? সব শেষ তো?” দীপাংশু তাঁর দিকে তাকালেন, কিন্তু উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখে ছিল ক্লান্তির সঙ্গে এক অমোঘ সংশয়। সত্যিই কি যোগিনীরা মুক্তি পেয়েছে? নাকি ভগ্নমূর্তি ভাঙার সঙ্গে সঙ্গেই আরও গভীর অন্ধকারের পথ খুলে গেল? তিনি জানতেন, এই প্রশ্নের উত্তর সহজ নয়, আর হয়তো কোনোদিনই জানা যাবে না। আকাশে তখন প্রথম ভোরের আলো ফুঁটে উঠছিল। ধুলোভরা বাতাসে দাঁড়িয়ে দু’জন গবেষক নীরব হয়ে তাকিয়ে রইলেন, আর তাঁদের হৃদয়ে বেজে চলল এক ভয়ঙ্কর অমোঘ প্রশ্ন—মুক্তি এল, নাকি নতুন অন্ধকারের বীজ বোনা হলো? এ প্রশ্নই হয়ে রইল “চৌষট্টি যোগিনী”-র শেষ উত্তরহীন প্রতিধ্বনি।

___

1000055100.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *