দিব্যজ্যোতি নন্দী
এক
বর্ধমান শহরের শেষপ্রান্তে যে পুরনো রেলগেটটা পড়ে আছে, তার ঠিক পরেই একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা সোজা চলে গেছে চৌরাস্তার দিকে। দিনের বেলায় জায়গাটা নেহাতই সাধারণ—দুটো চায়ের দোকান, একটা পানের খুচরো স্টল, আর রাস্তার ধারে পুরনো বিদ্যুতের খুঁটি। কিন্তু রাত নামলেই জায়গাটার চেহারা পাল্টে যায়। এই শহরের বাসিন্দারা জানে, চৌরাস্তার সেই ধূসর শ্মশানঘরটার পাশ দিয়ে কেউ বারোটার পরে হেঁটে যায় না। নতুন থানায় বদলি হয়ে আসা ঋষভ চট্টোপাধ্যায় এসব কাহিনি প্রথম শুনেছিল থানার কনস্টেবল অসীমের মুখে। “স্যার, ওদিকে একবার গেলে পেছনে তাকাবেন না। লোকজন বলে, পেছনে তাকালে নিজের ছায়াও হারিয়ে যায়।” ঋষভ এসব কথা শুনে হেসেছিল। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় কাজ করে অভ্যস্ত সে, ভয় তার চেনা শব্দ নয়। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো—এই কথাগুলোর মধ্যেই যেন একটা চাপা টান অনুভব করছিল সে। যেন তার ভেতরের কেউ তাকে বলছে, এই শ্মশানে যাওয়ার সঙ্গে তোমার একটা অসমাপ্ত হিসেব রয়ে গেছে।
ঋষভের বদলি হয়েছে হঠাৎ। শহরের ব্যস্ততা থেকে ছিটকে এসে এই অর্ধ-ঘুমন্ত বর্ধমান শহরে তার প্রথম দিন ছিল বেশ শান্ত। থানায় আধবোজা চোখে ফাইল ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ সন্ধ্যেবেলা একটা কেসের ফোল্ডার খুলে ফেলেছিল সে—সেই ফোল্ডারে লেখা ছিল “মিসিং কেস: সুতপা চট্টোপাধ্যায়, ১৯৯৯, লোকেশন: চৌরাস্তার শ্মশান”। ঋষভ চমকে উঠে বসেছিল। সুতপা—তার মা’র নাম। কেসের পেছনে কোনো অগ্রগতি ছিল না, শুধু লেখা ছিল “Final Status: Abandoned. No trace found.” চোখদুটো মুহূর্তে ঝাপসা হয়ে এলো ঋষভের। তার ছয় বছর বয়সে মা নিখোঁজ হন, তাকে বলা হয়েছিল তিনি কলকাতার এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং হারিয়ে যান। কখনও সত্যটা জানার সুযোগ হয়নি। কিন্তু এভাবে, হঠাৎ এক সরকারি ফাইলে, নিজের মা’র নাম আর চৌরাস্তার শ্মশানকে একসাথে দেখে একটা ঘূর্ণির মতো অনুভব করল সে। সেই মুহূর্তেই তার মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা জাগল—এই শ্মশান, এই গুজব, এই কুয়াশার ভেতরে যেটাই লুকিয়ে থাক, সে সেটা খুঁজে বের করবেই।
সেই রাতেই, এক অদ্ভুত টানে ঋষভ প্রথমবার সেই রাস্তা ধরে হেঁটে গেল চৌরাস্তার শ্মশানঘরের দিকে। বাতাস থমথমে, নিঃশব্দ, যেন সময়টা ঘন হয়ে এসেছে। তার হাতে ছিল শুধু একটি টর্চ, আর কোমরে সার্ভিস রিভলবার। রাস্তার ধারে একটা কুকুর হঠাৎ কুঁই কুঁই করে কেঁদে উঠল—তারপর ছুটে পালিয়ে গেল অন্ধকারে। বাঁ দিকে তাকিয়ে ঋষভ দেখল শ্মশানঘরটা যেন জেগে আছে। ভেতর থেকে উজ্জ্বল কোনো আলো আসছে না, কিন্তু তার ইটের গায়ে কুয়াশা গড়িয়ে পড়ছে, ঠিক যেন কেউ ধোঁয়ার পর্দা তুলে দিচ্ছে। সে সামনে এগোতেই শুনল কিছু ফিসফিসানি। গা ছমছম করে উঠল। পেছনে তাকাতে গিয়েও নিজেকে সংবরণ করল—অসীমের কথাটা মনে পড়ল তার: “পেছনে তাকাবেন না।” শ্মশানের সামনে এসে দাঁড়াতেই, অজানা কারণে তার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল। সে দেখল, ভাঙা দেওয়ালের পাশে যেন ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ—ধোঁয়ার মতো গায়ে, কিন্তু মুখটা নেই। এক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাতা পড়ে গেল, আবার যখন খুলল—ছায়াটা উধাও। শ্মশান তখন নিঃসাড়, নিস্তব্ধ, কিন্তু ঋষভের ভেতর জানাল, এ শুধু শুরু। তার জীবনযাত্রার ছকে এবার অন্য সময়, অন্য আত্মা ও অন্য সত্য প্রবেশ করতে চলেছে। আর চৌরাস্তার এই ধোঁয়ার আস্তরণ শুধু ভয় নয়—স্মৃতি, হারিয়ে যাওয়া, এবং এক অজানা প্রতিশোধের ঘন ছায়া।
দুই
সকালে থানায় বসে ফাইল রিপোর্ট লিখছিল ঋষভ, রাতের ঘটনার রেশ এখনও চোখেমুখে। চৌরাস্তার শ্মশানে যা ঘটেছে সেটা কল্পনা না বাস্তব—তাহার সিদ্ধান্ত তখনও নেওয়া হয়নি। ভেতরের ভয়টা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, অথচ সে কাউকে কিছু বলছিল না। এ সময়েই এক যুবতী থানায় প্রবেশ করে সোজা অফিসারের ঘরের দিকে এগিয়ে আসে। পরনে ধূসর টপ আর গাঢ় নীল জিন্স, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, হাতে ক্যামেরা ঝোলানো। পরিচয় দেয়—“আমি মানসী সরকার। সাংবাদিক, ‘ডার্ক বেঙ্গল’ নামে একটা হরর ইনভেস্টিগেশন চ্যানেলের রিপোর্টার। শুনেছি আপনি গতরাতে চৌরাস্তার শ্মশানে গিয়েছিলেন?” কথাটা শুনে চমকে ওঠে ঋষভ। সে তো কাউকে বলেনি! এত দ্রুত খবর এল কীভাবে? সে একটু অবাক হয়ে বলে, “হ্যাঁ, গিয়েছিলাম। আপনি জানলেন কীভাবে?” মানসী হেসে বলে, “ওদিকে যাওয়ার সময় যে আপনি ফোনে টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটছিলেন, তার ভিডিও আমি তুলেছিলাম। আমি প্রায় প্রতি রাতেই ওই জায়গায় যাই।” ঋষভের চোখে পড়ে মেয়েটির চোখে কোনো ভয় নেই, বরং একরকম কৌতূহলের তীব্র দীপ্তি। তখনই সে বুঝে যায়, মানসীকে হালকা ভাবে নেওয়া উচিত হবে না।
মানসী ফোন বের করে একটি ক্লিপ প্লে করে। রাতের আঁধারে দেখা যাচ্ছে, ঋষভ এগোচ্ছে শ্মশানঘরের দিকে, আর পেছন থেকে ধোঁয়ার মধ্যে একটা ছায়ামূর্তি তাকে অনুসরণ করছে—একটা অস্পষ্ট ঘন কুয়াশার অবয়ব, যা মানুষের চেহারার মতো হলেও চোখ-মুখ কিছু নেই। ক্লিপের শেষদিকে, ঠিক যখন ঋষভ পেছন ফিরে তাকাতে যাচ্ছিল, তখন ভিডিওটা ঝাপসা হয়ে যায় এবং একটা বিকট শব্দ হয়—যেন কেউ ক্যামেরার খুব কাছে এসে নিঃশ্বাস ফেলছে। ঋষভের শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। এমন কিছু সে অনুভব করেছিল ঠিকই, কিন্তু এবার সেটা প্রমাণও পেল। মানসী বলে, “আমি তিন মাস ধরে এই জায়গার উপর কাজ করছি। কত রাত ভিডিও করেছি, কিন্তু গতকাল যা উঠেছে, তা এই প্রথম।” এই অদ্ভুত যোগসূত্রে দুজনের মধ্যে এক নীরব বোঝাপড়া তৈরি হয়। তাদের দুজনেরই উদ্দেশ্য একই—চৌরাস্তার শ্মশানঘরের রহস্য উন্মোচন। তবে পথটা কেমন হবে, তা তখনও অজানা।
ঋষভ সিদ্ধান্ত নেয়, মানসীর সঙ্গে আরও বিস্তারিত কথা বলবে। সে মানসীকে থানার পাশেই এক নিরিবিলি চায়ের দোকানে নিয়ে যায়। সেখানে বসে মেয়েটি বলে, “জানো, আমার দাদু ছিলেন এই শহরের পুরোহিত, এই শ্মশানে নিয়মিত ক্রিয়া করতেন। কিন্তু এক রাতে তিনিও নিখোঁজ হয়ে যান। কাউকে কিছু না বলে, একা গিয়েছিলেন, আর ফেরেননি। আমি তখন ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। মা-ঠাকুমা বলতেন, চৌরাস্তার কালো ছায়া তাকে নিয়ে গেছে।” ঋষভ চুপচাপ শুনছিল, তার মনে হচ্ছিল যেন দুই ভিন্ন অতীত এক ভয়াল বিন্দুতে এসে মিশছে। তারা দু’জনেই কারও না কারও হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে ফিরে পেতে চাইছে, না হলেও অন্তত জানতে চাইছে কেন হারাল। হঠাৎ মানসী বলে, “রাতে আবার যাব? এবার আমরা একসাথে যাব। আমি ইনফ্রারেড ক্যামেরা আনব, আর তুমি… তুমি শুধু ভয় পেও না।” ঋষভ একবার তাকিয়ে দেখে মেয়েটির চোখে সত্যিই ভয় নেই—শুধু রয়েছে অন্বেষণ, আর একরকম না-বলা দুঃসাহস। সে মাথা নেড়ে রাজি হয়। তার ভেতরে যে উত্তরগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে, সেগুলো বোধহয় এই মেয়েটির সঙ্গে একসাথে সন্ধান করলেই পাওয়া যাবে।
তিন
ঋষভ এবং মানসী ঠিক করে নেয়, পরবর্তী রাতে তারা আবার চৌরাস্তার শ্মশানে যাবে। তবে এবার, তারা নিঃশব্দে সেখানে গিয়ে কোনো প্রমাণ সংগ্রহ করতে চায়, যাতে অশুভ শক্তির উপস্থিতি যদি থাকে, সেটা ধরা পড়বে। কিন্তু একটি প্রশ্ন ঋষভের মনকে ঘিরে ছিল—সেই পুরনো চৌকিদার, রঘুনাথ সাঁতরা। মানসী তার নামটা আগে বলেছিল, এবং সে বলেছিল যে রঘুনাথ শ্মশানের অনেক রহস্য জানে। “সে এখনও এখানে বসবাস করে, কিন্তু খুব কম মানুষই তাকে খুঁজতে আসে,” মানসী বলেছিল। ঋষভের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। সেই রঘুনাথের মুখ থেকেই হয়তো এই জায়গার আসল কাহিনী জানা যাবে।
ঋষভ রাতে মানসীকে নিয়ে রঘুনাথের খোঁজে বের হয়। বর্ধমান শহরের একটু বাইরে, একটা পুরনো টিনের চালাবাড়ির নিচে ছোটো একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন রঘুনাথ। বাড়ির সামনের উঠোনে একটি মাটির পাত্রে জল রাখা ছিল, আর জানালার গ্লাসে বৃষ্টির দাগ ছিল। ভেতর থেকে ধূসর আলো আসছিল। ঋষভ এবং মানসী দরজায় দাঁড়িয়ে রঘুনাথের নাম ডাকতেই, ভেতর থেকে দুর্বল কণ্ঠে উত্তর এল, “কে, কে আসছে? সন্ধ্যা হয়ে গেল, এই সময় কাউকে দেখতে আসা উচিত নয়।” দরজা খুলতেই, ঋষভ চোখে দেখে, বয়সের ভারে ভেঙে পড়া এক বৃদ্ধ মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। রঘুনাথের মুখে অনেক রুক্ষতা, গাঢ় চুলে সাদা দাগ, এবং তার চোখের কোণে অদ্ভুত কিছু ঘোর ছিল। “আসুন, আসুন,” রঘুনাথ বলল। তার চোখের দিকে তাকানোর পর, ঋষভ বুঝতে পারে—রঘুনাথ শুধু একজন চৌকিদার ছিল না, সে একটি অতীতের সাক্ষী ছিল, যে অতীতটা শ্মশানের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
রঘুনাথ তাড়াহুড়া করে তাদের বসতে বলে। এরপর, গলাটা চিমটি দিয়ে সাফ করে, “আপনারা যে শ্মশান নিয়ে জানতে চাইছেন, সেটা অনেক পুরনো। আমি সেই জায়গায় প্রায় দশ বছর কাজ করেছি। অনেক কিছু দেখেছি, কিন্তু কিছু জানি না। সবাই বলে, শ্মশানে কিছু অশুভ শক্তি বাস করে। আমি নিজেও একদিন সে সব দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু এরপর আর কাউকে বলিনি।” সে বিরতি দিয়ে, এক পলক চোখ বন্ধ করে মনে হয় যেন কিছু গভীর চিন্তা করছিল। তারপর আবার বলল, “দেখুন, এখানে এক জায়গা আছে, যেখানে কেউ জীবিত ফিরে আসে না। সেই জায়গাটার নাম, ‘নির্বাণ চিতা’—যেখানেই কেউ মারা যায়, সেখানে তাদের আত্মা আটকা পড়ে থাকে। আমি নিজেও একদিন দেখা পেয়েছিলাম। চিতা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছিল—বৃদ্ধি হতে হতে এক ভয়ের মুখ বেরিয়ে এলো। তাও তো জানেন—আজকাল আর কেউ ‘নির্বাণ চিতা’র কাছে যায় না।” রঘুনাথ একটু থেমে, যেন সেই মুহূর্তটায় ঘোরে চলে গিয়েছিল, তারপর আবার বলল, “যে রাতটা তোমরা যাচ্ছ, সেই রাতেই সব হবে। ২৫ বছর আগে, আমার চোখের সামনে সেই চিতায় একজন মানুষ পুড়ে গিয়েছিল, কিন্তু সে কখনোই মারা যায়নি। সে ফিরে আসে, ফিরে আসবে।”
রঘুনাথের কথাগুলো আসলে একটাই কথা বলে যাচ্ছিল—চৌরাস্তার শ্মশান কোনো সাধারণ জায়গা নয়। তার ভেতর কিছু অদৃশ্য শক্তি কাজ করছে, যা শারীরিক চোখে দেখা সম্ভব নয়। মানসী তাকে প্রশ্ন করে, “এটা কি কোনো তন্ত্রসাধনা?” রঘুনাথ উত্তর দেয়, “এটা তন্ত্রের কাজ নয়। তন্ত্র তো শুধু পাথরের ওপর থাকে। এখানে কোনো মানবিক অনুভূতি নেই। এটা একটা অদ্ভুত হিসেব—যাকে বলা হয়, ‘কালোমুখো’। আর যারা ওই ছায়ার মধ্যে একবার ঢোকে, তারা আর ফেরে না।” রঘুনাথ এর পর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে, যেন কিছু বলতে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু তারপর বলল, “তোমরা যা দেখেছ, সেটা শুরু। অশুভ শক্তি ঘনিয়ে আসছে। এবার আমি কিছু বলব, শ্মশানঘরের রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে তোমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ঋষভ এবং মানসী উভয়েই জানে, তারা যে পথে পা রেখেছে, তা একেবারে বিপজ্জনক। কিন্তু তাদের একসাথে পথ চলা, তাদের সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। রঘুনাথ যে তাগিদ দিয়েছিল, সে তাগিদ যদি সত্যি হয়, তাহলে তাদের জানার অভ্যন্তরে যা লুকিয়ে আছে, সেটার মোকাবিলা করতেই হবে।
চার
সকালের আলোয় বর্ধমান থানার রেকর্ড রুমটা ছিল এক ধুলোমাখা, অগোছালো জায়গা। সিলিং ফ্যানের গতি শ্লথ, আর বাতাসে পুরনো কাগজের গন্ধ। ঋষভ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল আলমারির সামনে—সেখানে খুঁজে বের করতে হবে ১৯৯৯ সালের সেই ফাইল, যার সূত্রে তার মায়ের নাম এসেছিল সামনে। মানসী তখন বাইরে দাঁড়িয়ে, কারণ রেকর্ড রুমে বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া যায় না। কনস্টেবল অসীম মুখ বাঁকিয়ে বলেছিল, “স্যার, ওই সময়ের কেসগুলোর ফাইল তো ড্যাম্পে পড়ে গেছে, স্যাঁতসেঁতে হয়ে ছিঁড়ে গিয়েছে বেশিরভাগ।” কিন্তু ঋষভ দমেনি। তার মনে হচ্ছিল, সত্যি যদি কিছু লুকিয়ে থাকে, তবে সেটাই আজ তাকে খুঁজে নিতে হবে—আর নয় পালানো, আর নয় ভয়কে এড়িয়ে যাওয়া।
তিনটি পুরোনো ট্রাঙ্কের ভেতর খুঁজে অবশেষে একটা হলুদচে প্যাঁচানো ফোল্ডারে চোখ আটকে যায়। তাতে লেখা: “Ref: M-241 | Missing Persons | Location: Chowrastha Crematorium | Date: 11/06/1999”। খুলতেই প্রথম পাতায় তার চোখ থেমে যায়—“Name: Sutapa Chattopadhyay | Age: 31 | Status: Missing | Last seen by: Child (name withheld)”। তার বুকের মধ্যে কিছু একটার তীব্র ধ্বনি উঠল, যেন অতীতের কোনও কান্না ফিরে আসছে। এরপর ছিল কয়েকটি সাক্ষ্যবক্তব্যের কপি—পাড়ার কয়েকজন বলেছে, সুতপা রাত ন’টার দিকে একা বেরিয়েছিলেন এবং আর ফেরেননি। কেউ বলেনি কেন, কেউ জানত না কোথায়। শুধু একজন নামহীন পুরুষের উক্তি ছিল, যিনি বলেছিলেন, “রাতে শ্মশান থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখেছিলাম, কিন্তু চিতা জ্বলছিল না।” শেষ পৃষ্ঠায় অফিসার ইনচার্জ লিখেছিলেন, “Possibility of cult activity suspected. No body recovered. Case closed without resolution.” এবং একটি অদ্ভুত শব্দ ছিল লাল কালিতে ঘেরা—S-4।
ঋষভ এই ‘S-4’ শব্দটি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ মাথা ঘামায়। এটা কি কোনো গোপন কোড? স্থান, তারিখ, নাকি চিহ্নিত কোনো বিশেষ এলাকা? বাইরে এসে সে মানসীকে জানায় ব্যাপারটি। মানসী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমার দাদুর ডায়েরিতে একটা জিনিস পড়েছিলাম… শ্মশানের একটা চতুর্থ চিতা ছিল, যেটাকে কেউ ব্যবহার করত না। মানুষজন বলত, ওটা অভিশপ্ত। তার নাম দেওয়া হয়েছিল S-4। তান্ত্রিকরা ওখানেই তাদের শেষ ক্রিয়া করত। আমি ভেবেছিলাম গল্প। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, হয়তো সেই চিতার কাছে গিয়েই তোমার মা…” বাক্যটা শেষ করতে পারে না সে। কথা থেমে যায়। ঋষভের চোখে তখন আর জল নেই—শুধু প্রতিজ্ঞার দহন।
সন্ধ্যা নামার আগেই তারা সিদ্ধান্ত নেয়—S-4 কে খুঁজতেই হবে। এবার আর শুধু অতিপ্রাকৃত রোমাঞ্চ নয়, এবার ব্যক্তিগত সত্যকে জানার লড়াই। তারা পুরোনো মানচিত্র খোঁজে, যেখানে শ্মশানের ভেতরের কাঠামো ছিল। থানা অফিসের এক বৃদ্ধ বাবু একটু বিরক্ত হয়ে, কিন্তু সহানুভূতির ছাপ রেখে একটা স্কেচ বের করে দেয়—যেখানে চারটি চিতা চিহ্নিত, কিন্তু চতুর্থ চিতাটিকে এক কালো দাগ দিয়ে কাটা ছিল, এবং পাশে লেখা ছিল – “S-4: Do Not Use (since 1987)”. মানসী বলে, “তুমি বুঝতে পারছ? এই জায়গাটা সরকারি নথিতেও নিষিদ্ধ। তাহলে নিশ্চয়ই এর পেছনে কিছু আছে।” ঋষভ চোখ বুজে মনে মনে বলে, “মা, তুমি যদি ওখানে থাকো, আমি আসছি।” এইবার তার ভিতরে কোনো ভয় নেই। ছিল শুধু তীব্র আগ্রহ—আর এক অন্ধকার ভোরের প্রতীক্ষা।
পাঁচ
চাঁদের আলো কুয়াশায় মিশে যখন সাদা কফিনের মতো ছড়িয়ে পড়ে শ্মশানের চারপাশে, তখন রাত ঠিক ১১টা ৪৫। ঋষভ এবং মানসী দাঁড়িয়ে আছে চৌরাস্তার শ্মশানের গেটের সামনে—চুপচাপ, নিঃশব্দ, হাতের মুঠোয় টর্চ আর ইনফ্রারেড ক্যামেরা। চারপাশে যেন নিস্তব্ধতার মধ্যেও এক অদৃশ্য গুঞ্জন চলছে, ঠিক যেন অন্ধকারের গভীর থেকে কেউ শ্বাস নিচ্ছে। বাতাস থেমে গেছে, পাতা নড়ে না, এমনকি রাস্তার কুকুরের ঘেউ-ও নেই। সেই নীরবতা ভেদ করে ঋষভ ধীরে ধীরে গেট ঠেলে ভেতরে ঢোকে। তার পাশে মানসী এক হাতে ক্যামেরা ধরে আছে, চোখে রাতচোখের চশমা। তারা দুজন জানে, আজ রাতে কিছু হবে। তারা চতুর্থ চিতা—S-4—এর দিকেই যাচ্ছে, সেই জায়গার দিকে যেখানে বলা হয়, মৃতেরা শ্বাস নেয়।
চিতাগুলোর পাশে দাঁড়ালে বোঝা যায়, কোনটা বেশি পুরনো, কোনটা কার্যকর। প্রথম তিনটি চিতার ইটভাটা তুলনামূলক নতুন, কিন্তু S-4 যেন অন্য এক জগতের। তার ইট ধরা, কালচে ছোপে আচ্ছন্ন, আর মাঝখানে একটা ভাঙা কাষ্ঠের পাটাতন। আশেপাশে মাটি ফাটা, আর গন্ধ—একটা পোড়া ধূপের মত, যার মধ্যে পচা কিছু লুকিয়ে আছে। মানসী হঠাৎ বলে ওঠে, “ক্যামেরায় হিট সিগন্যাল উঠছে… কিন্তু এই জায়গায় তো কেউ নেই!” ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে ধোঁয়ার মধ্যে এক অনির্বচনীয় অবয়ব—মানুষের চেহারার মতো, মাথা নিচু, কিন্তু মুখ নেই। তারা দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে, যেন শরীর হিম হয়ে গেছে। তারপর আচমকাই S-4 এর পাশ থেকে একটা খসখসে শব্দ আসে—মাটির নিচ থেকে যেন কেউ হাত বাড়িয়ে কিছু খুঁড়ছে। ঋষভ তার টর্চ ফেলে দেয়, আলো নিভে যায়। আর তখনই সেই শব্দ—একটা ঘন নিঃশ্বাস। খুব কাছে, খুব ভারী।
“ঋষভ…” মানসী ফিসফিস করে বলে, “তোমার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছো?” ঋষভ স্তব্ধ হয়ে যায়। সত্যি, তার কানে ভেসে আসে এক কণ্ঠস্বর—“ঋষু… ফিরে যা… ওরা এখানেই আছে…”। সে পিছন ফিরে তাকাতে চায়, কিন্তু মনে পড়ে রঘুনাথের কথা—“পেছনে তাকালেই ছায়া তোমাকে নিয়ে নেবে।” সে দাঁতে দাঁত চেপে সামনে তাকিয়ে থাকে। সামনে তখন কুয়াশার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক কালো অবয়ব—“কালোমুখো”—তার মুখ নেই, কেবল এক শূন্য গহ্বর, যার ভেতরে কোনো আলো পড়ে না। অবয়বটি এক পা এক পা করে S-4 এর দিকে এগিয়ে আসে, আর তার আশপাশে বাতাস যেন হিম হয়ে যাচ্ছে। মানসী ক্যামেরা তুলতেই ক্যামেরা বন্ধ হয়ে যায়, স্ক্রিন ব্ল্যাক। ঋষভ তার রিভলবার বের করে, কিন্তু বোঝে—এটা এমন এক অস্তিত্ব, যা গুলিতে থামে না। কালোমুখো একটা ক্ষীণ গলায় বলে ওঠে, “তোর রক্তের হিসেব শেষ হয়নি, ঋষভ। তোর মা এখনও এখানে, যেমন অন্যরা…”
এক তীব্র ঝাপটা বাতাস এসে তাদের উপর দিয়ে যায়, ধুলো, ছাই, আর পুরনো পোড়া কাঠের টুকরো উড়ে ওঠে। মানসী হঠাৎই ঢলে পড়ে, অচেতন। তার মুখে একটা অভিব্যক্তি—যেন কোনো অপরিচিত দৃশ্য দেখেছে, যেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ঋষভ ঝুঁকে পড়ে তাকে ধরতে যায়, কিন্তু কালোমুখো তখন S-4 এর পেছনে মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার ভেতর। ঠিক শেষ মুহূর্তে, শ্মশানঘরের প্রাচীন বটগাছের ছায়ায় সে দেখে একটি শাড়িপরা নারী ছায়া—হাঁটুতে বসে, মাথা নিচু করে কাঁদছে। সেই ছায়া ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকায়, এবং ঋষভ নিশ্চিত—এটা তার মা। সুতপা চট্টোপাধ্যায়, যিনি ২৫ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিলেন, এখন এই শ্মশানেই আটকে আছেন, কালোমুখোর ছায়ার ভেতরে। চারপাশ আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ১২টা ৫৭। সময় থেমে আছে, এবং ঋষভ বুঝতে পারে—এবার তাকে শুধু রহস্য নয়, আত্মার মুক্তির জন্যও লড়াই করতে হবে।
ছয়
মানসীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাত দুটো নাগাদ। চোখ খোলা, কিন্তু একদম নিঃসাড়। ডাক্তাররা বললেন, “সে কোনও শারীরিক আঘাত পায়নি, কিন্তু ট্রমার মধ্যে রয়েছে। যেন গভীর কোনো মানসিক আঘাতে আটকে গেছে।” ঋষভ জানে, এটা কোনও ডাক্তারি ব্যাখ্যায় চলবে না। সে নিজেই তো দেখেছে কালোমুখোকে, আর দেখেছে তার মাকে, একটা শাড়ি পরা কুয়াশার ছায়ায় দাঁড়িয়ে কাঁদতে। শ্মশানঘর থেকে ফিরে এসেও তার মনে হচ্ছিল, সে এখনও সেখানেই আছে—সেই ধোঁয়ার মধ্যে, S-4-এর সামনে, যেখানে সময় আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য নেই। ঠিক তখনই, হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন ব্যক্তি এগিয়ে আসে। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, শ্মশ্রুশোভিত মুখ, চোখে গভীরতা। “আমি ড. বিভাস রায়, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। শুনলাম আপনি চৌরাস্তার শ্মশানে গিয়েছিলেন। আপনি যেটা দেখেছেন, আমি তা বহু বছর আগে দেখেছি।”
ড. বিভাস রায় একটি কাগজের ফাইল থেকে একটি ছবি বের করে ঋষভকে দেখান। ছবিতে দেখা যাচ্ছে—একটি সাদা শাড়িপরা নারী, মাথা নিচু, পায়ের কাছে আগুন জ্বলছে, আর পাশে ধোঁয়ার মাঝে এক কালো অবয়ব দাঁড়িয়ে। বিভাস বলেন, “এটা আমি আঁকেছিলাম, যখন আমি দশ বছর বয়সে প্রথমবার ওই শ্মশানে গিয়েছিলাম। আমার মামা ছিলেন ওখানকার পুরোহিত, এক রাতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমি ওখানে কিছু দেখেছিলাম যা আজও আমার ঘুম কাড়ে।” তিনি থেমে গলায় একটুখানি জল ঢালেন। তারপর বলেন, “এই ছায়াটিকে আমরা বলি ‘কালোমুখো’। এটা আত্মাগুলোর অমীমাংসিত ক্রোধ, দুঃখ, আর তৃষ্ণার প্রতীক। যেখানে আত্মা বন্ধি হয়ে পড়ে, সেখানে কালোমুখো জন্মায়। আপনি যদি সত্যি আপনার মাকে দেখতে পেয়ে থাকেন, তাহলে তার আত্মা এখনও মুক্ত নয়।” ঋষভ স্তব্ধ হয়ে শোনে। বিভাস বলেন, “মানসী যেটা দেখেছে, সেটা শুধু চাক্ষুষ নয়—সে সেই ছায়ার মানসিক স্রোতে ঢুকে গিয়েছে। তাকে ফিরিয়ে আনতে হলে, সেই ছায়াকে দেখতে হবে আবার, মুখোমুখি হতে হবে ভয়কে।”
ঋষভ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে, তারপর ধীরে বলে, “তাহলে আমাকে আবার ফিরতে হবে S-4 এর কাছে। ওখানেই সবকিছু আটকে আছে। আমার মা, মানসী, আর এই ভয়াবহ অতীত।” বিভাস মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, কিন্তু এবার আপনাকে শুধু পুলিশ অফিসার হিসেবে নয়, একজন সন্তান হিসেবে যেতে হবে। আত্মার মুক্তি কেবল অস্ত্র দিয়ে হয় না, হয় উপলব্ধি দিয়ে।” ড. বিভাস আরও একটি তথ্য দেন—“আপনার মা নিখোঁজ হওয়ার পর ওই জায়গায় একটি নিষিদ্ধ তান্ত্রিক আচারের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু পুলিশের ফাইল সিল করে দেওয়া হয়। কারণ, তাতে উচ্চপদস্থ কিছু মানুষের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। আপনি যদি S-4 খুলতে চান, তবে আপনার বিরুদ্ধে শক্তি দাঁড়াবে শুধু অতিপ্রাকৃত নয়—মানুষেরও।” কথাগুলো শুনে ঋষভের চোখে জেদ জ্বলে ওঠে। এবার এই শহরের পচা অতীত আর কালোমুখোকে একসাথে সরিয়ে ফেলার সময় এসেছে।
সাত
বিকেলবেলা বৃষ্টি থেমেছে, কুয়াশা নেমেছে আগেভাগেই। ঋষভ এবার একা নয়—তার সাথে আছেন রঘুনাথ সাঁতরা, চুপচাপ হেঁটে চলেছেন থানার পুরনো সাইকেল রোড ধরে। তাদের গন্তব্য: চৌরাস্তা শ্মশানের পেছনে, জঙ্গলের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি পুরনো কুটির, যেখানে একসময় কিছু নিষিদ্ধ তান্ত্রিক কার্যকলাপ চলত। এই কুটিরের কথাই বলেছিলেন ড. বিভাস—সেই জায়গা যেখানে, সম্ভবত, সুতপা চট্টোপাধ্যায় নিজ হাতে নিজের ছেলেকে রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে যান এক অন্ধকারে। রঘুনাথ হাঁটতে হাঁটতে বলেন, “সেই রাতে আমি ডিউটিতে ছিলাম। আপনার মা একা এসেছিলেন। কেউ বলেছিল, ওঁর স্বামী মারা গেছেন। অথচ আপনি তো জানেন, ওঁর স্বামী তখনও জীবিত ছিলেন। তারপর থেকে ওঁকে আর কেউ দেখেনি।” কুয়াশার ভেতর দিয়ে তারা পৌঁছায় এক ধ্বংসপ্রায় মাটির কুটিরের সামনে, যার দরজা খুলে গেছে, আর ছাদের খড় পচে গিয়ে একপাশে ধসে পড়েছে।
কুটিরের ভেতরে অন্ধকার, একমাত্র আলো ঋষভের টর্চ। একটা কাঠের টেবিল, ধুলোয় ঢেকে থাকা এক পুরনো ধাতব ট্রাঙ্ক, আর পাশে ছেঁড়া কাপড়ের গাঁটরি। ট্রাঙ্কটা খোলার পর, একপলকে কিছুই বোঝা যায় না। পুরনো বই, ঘুঁটে মোড়ানো চামর বস্তু, আর মাঝখানে একটা আধপোড়া চিঠি। ঋষভ ধীরে সেটি তোলে—চিঠির কাগজে আগুনে পোড়া দাগ, কিন্তু বাক্যগুলো অর্ধেকভাবে স্পষ্ট—
“…ঋষু আমার, যদি কখনো এ চিঠি তোমার হাতে পড়ে, জানবে আমি চেয়েছিলাম তোমাকে রক্ষা করতে। আমি ভুল পথে এসেছিলাম, বিশ্বাস করেছিলাম যারা বলেছিল, তারা তোমার বাবাকে ফিরিয়ে দেবে… তারা চেয়েছিল আমার আত্মা, আর আমি দিয়েছিলাম… আমি এখন বাঁধা… চৌরাস্তার ছায়ায়… আমাকে মুক্ত করো, যদি পারো… মা।”
ঋষভের হাত কাঁপে। সেই ছোট্ট ছেলেটা যাকে বলা হয়েছিল, “তোমার মা গেছেন আত্মীয় বাড়ি,” আজ সেই ছেলেই দাঁড়িয়ে আছে এমন এক সত্যের সামনে যা তার সমস্ত অস্তিত্ব বদলে দিচ্ছে। রঘুনাথ তখন বলল, “এই কুটিরটা সেই সময় শ্মশানের বাইরে এক তান্ত্রিক, অঘোরী ‘ভোলানাথ বাপা’র ঘর ছিল। সে বলেছিল, মৃত্যুর পরেও আত্মা শক্তিশালী হতে পারে—তবে তাকে চিতার ধোঁয়ার মাঝে বেঁধে রাখতে হয়। আপনার মা সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে সে পালাতে চেয়েছিলেন, আর তখনই… কালোমুখো জন্ম নেয়।”
হঠাৎ হাওয়া কেমন ঘন হয়ে আসে। কুটিরের ভেতরে বাতাসের দমকা ধাক্কা, যেন বাইরের জগত ছিঁড়ে কিছু ঢুকে পড়ছে। চিঠিটার ওপর ধোঁয়ার রেখা জেগে ওঠে, ছিঁড়ে যায় কিছু অক্ষর, আর পাশের মাটিতে আগুনের মতো গন্ধ। ঋষভ কণ্ঠস্বর শক্ত করে বলে, “আমি যদি ওদের তৈরি করেও থাকি, তাহলে আমিই ওদের শেষ করব।” রঘুনাথ জবাব দেয় না, শুধু ধীরে তার পিঠের ঝোলা থেকে একটি পুরনো, কাঠের খোদাই করা ছোট বাক্স বের করে দেয়—যাতে কিছু রুদ্রাক্ষ, এক ধাতব গুটি, আর কিছু পঞ্চধাতুর ছাই। “এটা তোমার মায়ের তাবিজ, ওই চিতায় পড়েছিল। এটাকে নিয়েই তোমাকে শেষবার যেতে হবে। কাল রাত বারোটা—চূড়ান্ত সময়।”
আট
রাত বারোটা। চৌরাস্তার আকাশ আজ অন্যরকম। চাঁদের আলো নেই, কিন্তু যেন পুরো শ্মশানখানা জ্বলছে অদৃশ্য আগুনে। বাতাস ভারী, ছায়ারা নড়ছে নিজের ইচ্ছেমতো। ঋষভ, পকেটে মায়ের সেই তাবিজ আর হাতে ছোট্ট তামার গুটি নিয়ে, আবার পা রাখে S-4-এর সামনে। তার পাশে নেই মানসী—সে এখনও হাসপাতালে, নিঃশব্দ ঘুমে। রঘুনাথ দূর থেকে তাকে পথ দেখিয়ে এনে বলেছিল, “আজ রাতেই সিদ্ধান্ত হবে। বা তোকে নিয়ে যাবে, না তুই ওদের থেকে কাউকে ফিরিয়ে আনবি।” S-4-এর সামনে এসে দাঁড়ালে, তার মনে হল, এবার আর ভয় কাজ করছে না। বরং এক অদ্ভুত শান্তি। যেন সে জানে, কী করতে হবে। চারদিক হঠাৎ করে নিস্তব্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে হাওয়া ছিঁড়ে ওঠে গলা ভাঙা এক কান্নার শব্দ—মেয়েলি কণ্ঠ, ব্যথায় ভরা। “ঋষু… ঋষু…”।
ধোঁয়ার মধ্যে যেন সময় থেমে গেছে। S-4-এর চিতায় আগুন নেই, কিন্তু তপ্ততা আছে। হঠাৎ তার সামনের মাটি ফেটে এক কুয়াশার ফাঁপা ফাটল তৈরি হয়, যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কালোমুখো। এবার সে অনেক স্পষ্ট। মুখহীন সেই অবয়ব কেবল দাঁড়িয়ে নেই—সে এগিয়ে আসছে, দুটো হাত তুলে বলছে, “তুই আজ যা এনেছিস, তাতে আমায় ছুঁতে পারবি না… তবু চাস?” ঋষভ চুপ। সে মায়ের সেই তাবিজ একহাতে ধরে, ধীরে ধীরে কালোমুখোর দিকে এগোয়। তার কণ্ঠে কোনও উচ্চারণ নেই, কেবল তার মন বলছে—“মা, ফিরে এসো। এবার মুক্তি দাও নিজেকে।” হঠাৎই কালোমুখোর পাশ থেকে বেরিয়ে আসে সেই শাড়িপরা নারী। মাথা নিচু, দুটো হাত বুকের ওপর ভাঁজ করা। সেই মুখ দেখলে বোঝা যায় না সে মানুষ না ছায়া। কিন্তু তার চোখে জল। সে ধীরে বলে, “ঋষু, আমাকে নিয়ে চলে যা… আমি আর পারি না।” এই প্রথমবার, কালোমুখো কাঁপে। গর্জে ওঠে, “না! সে আমার! তার দুঃখ, তার অপরাধ, সব আমায় শক্তি দেয়। তাকে দিলে তুই মরবি!”
ঋষভ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে সেই তাবিজ ছুঁড়ে দেয় চিতার মাঝখানে। মুহূর্তেই চারপাশে একটা উজ্জ্বল আলোর বিস্ফোরণ। কালোমুখো ছায়ার মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, আর শাড়িপরা নারীর মুখে এক প্রশান্ত হাসি খেলে যায়। সে বলে, “তুই পারলি, ঋষু। আমি এখন যেতে পারি। যারা আটকে আছে, সবাইকে মুক্ত করিস।” এরপর সে পেছন ফিরে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে কুয়াশার গভীরে, যেখানে আলো আরও গাঢ়, কিন্তু ভয় নেই—শুধু শান্তি। চারপাশে যেন বাতাস নেমে আসে। S-4-এর পাশের ইট থেকে ধোঁয়া উধাও, শ্মশানটা আজ নিঃশব্দ নয়, মুক্ত।
পরদিন সকালে মানসীর চোখ খোলে। সে বলে, “আমরা কি ফিরে এসেছি?” ঋষভ শুধু মাথা নাড়ে। বাইরে তখন সূর্য উঠেছে, আর বর্ধমান শহরের মানুষজন হয়তো জানেই না, রাতের অন্ধকারে এক সন্তান তার মা’র আত্মাকে মুক্ত করেছে, এক পুরনো শ্মশানের অভিশাপ ঘুচেছে। S-4-এর সামনে আজ আর কোনও ছায়া নেই, শুধু একফোঁটা হলদে রোদ পড়ে আছে ভাঙা ইটের ওপর। আর এই গল্প—শুধু যারা দেখেছে, তাদের মধ্যেই রয়ে গেছে, চিরকাল।
শেষ