কলকাতার চৌরঙ্গীর ব্যস্ত রাস্তার কোলাহল পেরিয়ে হঠাৎই যেন সময় থমকে যায় যখন চোখে পড়ে হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্স। লাল-ইটের গাঁথুনি, কড়িকাঠের বারান্দা, আর চারতলার মাথায় পুরনো দিনের ঘড়িঘর—যার কাঁটা আজ বহু বছর ধরে নড়েনি। এই হোটেলটা যেন এক প্রাচীন জীবাশ্ম, চারপাশের আধুনিক কাচের ভবনের ভিড়ে হার মানতে না চেয়ে গোপনে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ঢোকার গেটের ওপরে ঝুলছে বড় বড় অক্ষরে নাম, তবে রঙ মুছে গেছে, কিছু অক্ষর ভাঙা। দরজার দুইপাশে দুটো পাথরের সিংহ, যাদের চোখে জমে থাকা ধুলোতে একটা চাপা বিষণ্ণতা। অরিন্দম মুখার্জী, তিরিশের শেষের এক অভিজ্ঞ ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক, ধীর পায়ে গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলেন। তাঁর হাতে ছোট্ট একটি নোটবুক আর ব্যাগে ভরা রেকর্ডার, কলম, আর কিছু পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং। ক’দিন আগে তিনি একটি অদ্ভুত গুজব শুনেছিলেন—এই হোটেলের লিফট নাকি মাঝেমধ্যে ১৩ তলায় থামে, অথচ সরকারি নথিতে এবং সবার জানা তথ্যে হোটেলের তলা মাত্র ১২টি। বিষয়টি তাঁর সাংবাদিক মনের ভিতরে কৌতূহলের আগুন জ্বেলে দেয়। কিন্তু হোটেলের প্রবেশদ্বারেই দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, এই জায়গাটা শুধু একটা পুরনো হোটেল নয়—এখানে বাতাসে যেন এক অদৃশ্য ভারী ভাব, যেটা চেপে বসেছে। দূরে রিসেপশনের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অতিথি অরিন্দমের দিকে কৌতূহল মাখা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিলেন, যেন তারা নতুন আগন্তুককে দেখে বুঝতে চাইছেন—এই মানুষটিও কি সেই গুজবের পেছনে ছুটে এসেছে?
লবি-তে ঢুকতেই অরিন্দমের নাকের ভিতরে ঢুকে গেল পুরনো পালিশ-করা কাঠের আর ধুলোমাখা কার্পেটের গন্ধ। ছাদের বিশাল ঝাড়বাতি, যা একসময় হয়তো সোনালি আলো ছড়াত, এখন মাত্র কয়েকটা ম্লান বাল্বে জ্বলে আছে। চারপাশের দেয়ালে পুরনো ফ্রেমে বাঁধানো ছবি—কিছুতে ব্রিটিশ অফিসারদের ভোজসভা, কিছুতে স্বাধীনতার আগের কলকাতার রাস্তার দৃশ্য। রিসেপশনের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রুবিনা দত্ত, ত্রিশের গোড়ার এক সুঠাম মহিলা, পরনে নিখুঁত শাড়ি, চোখে তীক্ষ্ণতা। অরিন্দম এগিয়ে গিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিলেন, নিজের পরিচয় দিলেন, এবং জানালেন যে তিনি শহরের পুরনো হেরিটেজ স্থাপনা নিয়ে একটি রিপোর্ট করছেন। রুবিনা হাসলেন, তবে তার চোখের কোণে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি খেলে গেল যখন অরিন্দম কথায় কথায় ১৩ তলার প্রসঙ্গ তুললেন। “হোটেলে মাত্র ১২ তলা, মিস্টার মুখার্জী,” ঠান্ডা গলায় বললেন তিনি, “আপনি হয়তো ভুল শুনেছেন।” অরিন্দম বুঝতে পারলেন, এই উত্তরটা যান্ত্রিক, যেন মুখস্থ করা। তার নজর চলে গেল রিসেপশনের পাশের পুরনো খাঁচা-লিফটের দিকে—কালো লোহার জালি, ভিতরে কাঠের মেঝে, আর উপরে ধাতব প্যানেল যেখানে তলার নম্বরগুলো খোদাই করা। অদ্ভুতভাবে, ১২-এর পরেই ফাঁকা, কোনো ১৩ লেখা নেই। তবুও, ধুলো জমা পিতলের বোতামগুলোর মাঝে মাঝেমধ্যেই ১৩-এর জন্য থাকা ফাঁকা স্থানটির ঠিক উপরে হালকা আঙুলের ছাপ দেখা যায়, যেন কেউ সেখানে স্পর্শ করেছে।
লিফটের কাছে দাঁড়িয়ে অরিন্দম অনুভব করলেন, এখানে দাঁড়ালেই চারপাশের শব্দ যেন নিঃশেষ হয়ে যায়। বাইরে রাস্তায় হর্ন বাজছে, লবি-তে অতিথিদের কথোপকথন চলছে, কিন্তু লিফটের দু’কদমের মধ্যে এলে সবকিছুই চাপা পড়ে একধরনের ভৌতিক নিস্তব্ধতায়। এই লিফটটি নাকি প্রথম বসানো হয়েছিল ১৯২৪ সালে, হোটেল চালুর বছরেই। পুরনো খবরের কাটিং-এ তিনি পড়েছিলেন, এই লিফটে কোনোদিন যান্ত্রিক ত্রুটি খুব বেশি ধরা পড়েনি, কিন্তু প্রায়ই অতিথিরা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন—লিফট নিজে নিজেই ওঠানামা করছে, ভেতরে কারও নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে, বা বোতাম চাপা ছাড়াই দরজা খুলছে। অরিন্দম খেয়াল করলেন, লিফটের অপারেটর সোমনাথ চক্রবর্তী—বয়স্ক, শীর্ণ, চোখে গাঢ় কালি—চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন, আর তাঁকে একবারের জন্যও সরাসরি তাকাচ্ছেন না। যেন তিনি অরিন্দমকে চেনেন, বা অন্তত জানেন কেন তিনি এখানে এসেছেন। সেই মুহূর্তে অরিন্দমের ভিতরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল—এই শহরে অনেক রহস্য তিনি খুঁজে পেয়েছেন, কিন্তু হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্স যেন তাকে শুধু একটি গল্প নয়, বরং এক দুঃস্বপ্নের ভিতরে নিয়ে যেতে চলেছে। তিনি বুঝতে পারলেন না, এই অনুসন্ধান থেকে ফিরেও তিনি আগের মতো স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারবেন কি না।
–
রিসেপশনের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা রুবিনা দত্তের চোখে সেই বিশেষ ধরনের সতর্কতা ছিল, যা শুধু যারা দীর্ঘদিন এক রহস্যময় জায়গায় কাজ করেছে তারাই পায়। অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে তিনি মাপা গলায় বললেন, “মিস্টার মুখার্জী, এখানে ১৩ তলা বলে কিছু নেই—ভুলে যাবেন না।” তাঁর কণ্ঠে এমন একটা শীতল দৃঢ়তা ছিল যে, স্বাভাবিক মানুষ হলে হয়তো কথাটা চুপচাপ মেনে নিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যেত। কিন্তু অরিন্দম থামলেন না। নিজের ব্যাগ থেকে তিনি একটি পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং বের করলেন—১৯৯৭ সালের, যেখানে একজন অতিথির সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল: “আমি লিফটে উঠেছিলাম ৮ তলা থেকে, বোতাম চাপিনি। দরজা খুলল, আর সেখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা করিডর, যার শেষে ১৩ নম্বর লেখা দরজা।” রুবিনা সেই কাগজের দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে গেলেন। তাঁর ঠোঁট সামান্য কেঁপে উঠল, কিন্তু কিছু বললেন না। বরং কাগজটা ধীরে ধীরে কাউন্টারের নিচে সরিয়ে রাখলেন, যেন এটা খোলাখুলি পড়া বা দেখার মতো জিনিস নয়। সেই মুহূর্তে অরিন্দমের মনে হল, এই নারী শুধু একটি হোটেলের ম্যানেজার নন—বরং এখানে ঘটে যাওয়া কিছু অদেখা ঘটনার নীরব সাক্ষী।
লিফটের দিকে এগিয়ে গিয়ে অরিন্দম দেখতে পেলেন, প্যানেলের তলার নম্বরগুলো পিতলের পাতায় খোদাই করা—১ থেকে ১২ পর্যন্ত। ১৩ নেই, কিন্তু ১২-এর ঠিক নিচে একটি অদ্ভুত ফাঁকা স্থান, যেখানে কোনো লেখা নেই। এই ফাঁকা স্থানটার ধাতু আশেপাশের তুলনায় কিছুটা উজ্জ্বল, যেন সেখানে অনেকবার আঙুল রাখা হয়েছে। রুবিনার কথার বিপরীতে, সোমনাথ চক্রবর্তী—হোটেলের লিফট অপারেটর—চোখ না তুলেই ধীরে ধীরে বললেন, “বেশি সময় লিফটের সামনে দাঁড়াবেন না, বাবু। এখানে দাঁড়ালে সময় গলতে থাকে অন্যভাবে।” অরিন্দম চমকে তার দিকে তাকালেন, কিন্তু সোমনাথ আর কোনো কথা বললেন না, কেবল ধীরে ধীরে লিফটের লোহার জালি সরিয়ে দিলেন। লিফটের ভিতরে দাঁড়িয়ে অরিন্দম লক্ষ করলেন, দেওয়ালের কাঠে পুরনো খোঁচা, আঁচড়ের দাগ—যেন কেউ তাড়াহুড়ো করে কিছু আঁকড়ে ধরেছিল। আর লিফটের ছাদের কোণায় একটি পুরনো ব্রাসের বাতি, যার ম্লান আলো ঠিক যেন জীবন্ত নয়, বরং মৃত সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। তিনি বোতাম প্যানেলের দিকে তাকালেন—১৩ নেই। কিন্তু সেই মুহূর্তে, কোনো বোতাম না চাপা সত্ত্বেও, ১২-এর নিচের ফাঁকা স্থানটি ক্ষীণ লাল আলোয় জ্বলে উঠল, যেন গভীর ঘুম থেকে হঠাৎ কারও চোখ খুলে গেছে। অরিন্দম স্থির হয়ে গেলেন; রুবিনা দূর থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিলেন, আর সোমনাথ চোখ নামিয়ে বোতামগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন।
লিফট চলতে শুরু করল, কিন্তু তার গতি ছিল অদ্ভুতভাবে ধীর, যেন প্রত্যেক তলা পার হওয়ার আগে দীর্ঘ সময় নিয়ে থেমে থেমে উঠছে। লিফটের বাইরে করিডরগুলো চোখের কোণে ধরা পড়ছিল—পুরনো কার্পেট, জীর্ণ ওয়ালপেপার, মাঝে মাঝে ছায়ার মতো কিছু দ্রুত সরে যাচ্ছে। অরিন্দম বোঝার চেষ্টা করছিলেন, এগুলো কি অতিথির ছায়া, নাকি আলো-আঁধারের খেলা? কিন্তু লিফট যখন ৮ তলা পার হল, তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে তিনি দেখলেন এক করিডরে দাঁড়িয়ে আছে কালো স্যুট-পরা একজন, যার মুখ ছায়ায় ঢাকা। লিফট এগিয়ে যাওয়ার সময় সেই মানুষটির মাথা ধীরে ধীরে ঘুরল অরিন্দমের দিকে, আর অন্ধকারের ভিতর থেকে ঝিলিক দিল দুটি সাদা চোখ। তলার সংখ্যা বদলাচ্ছে, কিন্তু লিফটের ভিতরে শ্বাস নেওয়াই যেন কঠিন হয়ে আসছে—এক ধরনের ঠান্ডা, ধাতব গন্ধ জমে যাচ্ছে ফুসফুসে। অবশেষে লিফট থামল ১২ তলায়, দরজা খুলে দিল সোমনাথ, কিন্তু অরিন্দম বুঝতে পারলেন—এই যাত্রার মাঝখানে, অদৃশ্যভাবে, তিনি এক মুহূর্তের জন্য সেই অস্তিত্বহীন ১৩ তলার ছায়ার করিডরের ঠিক দরজার সামনে দিয়ে চলে এসেছেন। বাইরে বেরিয়ে তিনি রুবিনার দিকে তাকালেন; তাঁর চোখে স্পষ্ট লেখা ছিল—আপনি যা খুঁজছেন, তা পেয়ে গেলে হয়তো ফিরতে চাইবেন না।
–
রাত তখন নেমে এসেছে কলকাতার ওপর, কিন্তু হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্সের ভিতরে লবি-র আলো এখনও উষ্ণ ও স্থির। অরিন্দম নিজের নোটবুক খুলে রিসেপশনের একপাশের আরামকেদারায় বসে আছেন। দূরে, পুরনো লিফটের পাশে, সোমনাথ চক্রবর্তী দাঁড়িয়ে ছিলেন—চিরচেনা স্থির দেহভঙ্গি, ক্লান্ত চোখ, আর পাকা চুলের ফাঁকে সময়ের চিহ্ন। হঠাৎ করেই তিনি এগিয়ে এলেন, যেন বহু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিছু বলবেন। তাঁর কণ্ঠ গভীর ও কর্কশ, কিন্তু সেখানে এমন এক ভার ছিল যা দশকের পর দশক বহন করা যায় না। “আপনি ১৩ তলার কথা শুনেছেন, তাই না, বাবু?” প্রশ্নটা যেন না করে, বরং নিশ্চিত করে বললেন। অরিন্দম মাথা নাড়তেই তিনি একটু তাকালেন লিফটের দিকে, যেন নিশ্চিত হতে চাইছেন, ওই লোহার খাঁচার মধ্যে কিছু তাদের গোপন কথা শুনছে না। তারপর ধীরে ধীরে, চাপা গলায় বললেন, “১৯৮৬ সাল… সেই বছরই প্রথম ১৩ তলার অস্তিত্ব দেখা দেয়।” তাঁর এই একটি বাক্যেই হোটেলের হাওয়ায় যেন হালকা শীতলতা নেমে এল। লিফটের প্যানেলে যে বোতাম আজ নেই, সেটা একসময় ছিল—উজ্জ্বল পিতলের মতো ঝকঝকে, ১২-এর নিচে গর্বভরে জ্বলত ১৩ নম্বর।
সোমনাথের চোখে স্মৃতির ছায়া ভেসে উঠল। “সেই সময় আমি এখানে নতুন চাকরি শুরু করেছি। এক শীতের রাতে, ডিসেম্বর মাসে, হোটেল প্রায় ফাঁকা। এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এলেন—মিস্টার দেবাশিস সেনগুপ্ত। তিনি একা ছিলেন, আর দেখতে একেবারে সাধারণ মানুষ। মাঝরাতে তিনি লিফটে উঠলেন, হাতে একটা চামড়ার ব্রিফকেস। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম কোন তলা, তিনি হাসলেন আর বললেন, ‘নতুন তলা দেখতে চাই।’ আমি ভেবেছিলাম হয়তো মজা করছেন, কিন্তু তিনি ১৩ নম্বর বোতামে চাপ দিলেন। লিফট ধীরে ধীরে উঠতে লাগল, কিন্তু এবার সময় লাগছিল বেশি। ১২ তলা পার হওয়ার পর হঠাৎ দরজা খুলল—সেখানে আমি যা দেখলাম, আজও মনে হলেই কাঁপুনি আসে।” সোমনাথ একটু থামলেন, গলার স্বর নামালেন, “করিডরটা ছিল লম্বা, কার্পেটের রঙ মরচে ধরা লাল, দেয়ালের ওয়ালপেপার খসে পড়ছে। বাতাসে যেন পুরনো ধূপের গন্ধ, কিন্তু তাতে পচা ফুলের একটা তীব্র গন্ধ মিশে ছিল। একপাশে কয়েকটা দরজা, সব বন্ধ, আর করিডরের শেষে একটা বড় কাঠের দরজা, তাতে সোনালি অক্ষরে লেখা ‘১৩’। দেবাশিসবাবু কিছু না বলে লিফট থেকে নেমে সেই করিডরে ঢুকে গেলেন। আমি ডাকলাম, কিন্তু তিনি ফিরলেন না।”
এরপরের কথাগুলো বলার সময় সোমনাথের হাত সামান্য কাঁপছিল। “আমি কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইলাম, তারপর বোতাম চাপলাম নিচে নামার জন্য। লিফট দরজা বন্ধ করে নেমে এল, কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার ওপরে পাঠানো হল—১৩ তলায়। আমি তখন ভয়ে জমে গেছি, কিন্তু হোটেলের কাজ বলে যেতে হল। দরজা খুলতেই দেখি—করিডরটা ফাঁকা, বাতাস ঠান্ডা, আর সেই বড় দরজাটা আধখোলা। ভিতরে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলাম না, শুধু অন্ধকার। দেবাশিসবাবু কোথাও নেই। আমরা সেদিন রাতভর খুঁজলাম, পুলিশ এল, কিন্তু কোনো রেকর্ডেই তাঁর চেক-আউট পাওয়া গেল না। যেন তিনি অস্তিত্বই হারিয়ে ফেললেন।” সোমনাথ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, “তারপর থেকেই ১৩ নম্বর বোতাম খুলে ফেলা হয়, জায়গাটা ফাঁকা রাখা হয়, আর সবাইকে বলা হয়—হোটেলে মাত্র ১২ তলা। কিন্তু আমি জানি, বাবু… মাঝে মাঝে, একদম মাঝরাতে, সেই ফাঁকা স্থানে হালকা লাল আলো জ্বলে ওঠে, আর লিফট নিজে থেকেই ওপরে উঠতে শুরু করে। কেউ যদি তখন ভিতরে থাকে…” তিনি বাক্য শেষ করলেন না, শুধু অরিন্দমের দিকে এমন এক দৃষ্টি দিলেন যেখানে সতর্কবার্তা আর অনুচ্চারিত আতঙ্ক মিলেমিশে আছে।
–
নীলা সেনগুপ্ত অরিন্দমের সঙ্গে দেখা করতে এলেন বিকেলের পর, হাতে তাঁর চেনা পুরনো কিন্তু যত্নে রাখা DSLR ক্যামেরা। ব্লগার হিসেবে তাঁর খ্যাতি আগেই অরিন্দমের জানা—শহরের অন্ধকার গলি থেকে পরিত্যক্ত প্রাসাদ, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে নীলা ভয় পেয়ে পা টানেন। তাঁর ব্লগের নাম “দেয়াল পেরিয়ে”, আর প্রতিটি ছবির পেছনে থাকে অদ্ভুত, শীতল গল্প। হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্সের লবিতে ঢুকতেই তিনি চারপাশে চোখ বোলালেন—ছাদের ধুলো জমা ঝাড়বাতি, দেওয়ালের পুরনো পোর্ট্রেট, আর সেই কালচে লোহার লিফট যার গায়ে সময়ের ক্ষতচিহ্ন খোদাই হয়ে আছে। অরিন্দম তাঁকে সোমনাথের গল্প শোনালেন, আর নীলা মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন, “এমন জায়গায় আলো সবসময় সত্যি বলে না, কিন্তু ছায়া কখনও মিথ্যে বলে না। আমি দেখতে চাই, এই লিফট কী লুকিয়ে রাখছে।” তাঁর গলায় কোনো নাটকীয়তা ছিল না—বরং গবেষকের ঠান্ডা কৌতূহল। রুবিনা দূর থেকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু এবার আর কাউকে থামালেন না, শুধু তাঁর চোখে যেন এক নিঃশব্দ অনুরোধ ছিল—ফিরে আসবেন, যদি পারেন।
রাত দশটা নাগাদ, লবি-তে মানুষের আনাগোনা প্রায় শেষ। অরিন্দম, নীলা আর সোমনাথ—তিনজন লিফটের সামনে দাঁড়ালেন। নীলা তাঁর ক্যামেরার ফ্ল্যাশ অফ করে রাখলেন, ISO আর শাটার স্পিড ঠিক করলেন যাতে অল্প আলোতেও স্পষ্ট ছবি ধরা পড়ে। সোমনাথ লিফটের লোহার দরজা সরালেন, ভিতরের বাতি ম্লান সোনালি আলো ছড়াচ্ছে। প্রথমে কিছুই অস্বাভাবিক লাগল না—প্যানেলে ১ থেকে ১২ পর্যন্ত বোতাম, ১৩-এর জায়গায় ফাঁকা স্থান। কিন্তু ঠিক যখন লিফট ৮ তলায় পৌঁছাল, কোনো বোতাম না চাপা সত্ত্বেও সেই ফাঁকা স্থানে ক্ষীণ লাল আলো জ্বলে উঠল। মুহূর্তে নীলার আঙুল শাটার চাপল—ক্লিক!—দরজা ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করল। বাইরের দৃশ্যটি ছিল অরিন্দমের কাছে প্রায় অন্ধকার, কিন্তু ক্যামেরার লেন্স ভিন্ন কিছু ধরল। সেই ক্ষুদ্রতম ফাঁকের ভিতর, যেন অস্পষ্ট এক হলুদাভ আলো, আর সেই আলোর গভীরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু এক ধরনের উপস্থিতি যেন সোজা লেন্সের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলা দ্রুত একাধিক শট নিলেন, কিন্তু দরজা পুরো খোলার সাথে সাথেই বাইরের করিডরটা খালি—কোনো আলো নেই, কোনো মানুষ নেই। কেবল বাতাসে এক মুহূর্তের জন্য পচা ধূপের গন্ধ ভেসে এল।
নীলা ক্যামেরার স্ক্রিনে ছবি বড় করে দেখালেন অরিন্দমকে। প্রথম ছবিতে দরজার ফাঁক দিয়ে সোনালি ধোঁয়ার মতো কিছু ভেসে আছে, দ্বিতীয়টিতে সেই ধোঁয়ার ভেতরে একজোড়া অস্পষ্ট সাদা বিন্দু—যেন চোখ। তৃতীয়টিতে মনে হয় কেউ পাশ ফিরে হাঁটতে শুরু করেছে। ছবিগুলো দেখার সময় অরিন্দম অনুভব করলেন তাঁর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ফিরে তাকালে শুধু খালি লবি। সোমনাথ নিচু স্বরে বললেন, “এটাই ১৩ তলার ডাক… আজ রাত হয়তো ওরা জানিয়ে দিল, আপনারা এখানে আছেন।” নীলা কিছু না বলে ক্যামেরা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলেন, কিন্তু তাঁর চোখে কৌতূহলের আগুন আরও জ্বলে উঠেছে। অরিন্দম বুঝতে পারলেন—এই মহিলার কাছে ১৩ তলা শুধু একটি ভয়ঙ্কর গল্প নয়, বরং এক দরজা, যেটা খুলে ভেতরের সত্যটা ধরা পড়া বাকি। আর সেই সত্য দেখতে নীলা যে কোনো ঝুঁকি নিতেই প্রস্তুত।
–
হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্সের রিসেপশন এলাকার পরিবেশ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। সকাল থেকেই একটি নতুন চাঞ্চল্য ছিল—একজন বিদেশি অতিথি এসেছিলেন, যিনি ছিলেন পাকিস্তানি ব্যবসায়ী মিঃ আখতার। তিনি হোটেলে আসার পর থেকেই রিসেপশনের পরিবেশ কিছুটা অস্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। তাঁর পোশাক, অঙ্গভঙ্গি, এবং কথাবার্তা অনেকটাই আলাদা ছিল। তিনি যখন রিসেপশনের দিকে এগিয়ে আসলেন, তাঁর চোখে এমন এক রহস্যময় আলো ছিল, যা কিছুটা শীতল এবং তীব্র। রুবিনা তাকে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলেন, কিন্তু অরিন্দমের চোখে মিঃ আখতার যেন অবাক করার মতো কিছু ছিল। তিনি সোজা রুবিনাকে উপেক্ষা করে অরিন্দমের দিকে চলে এলেন। হোটেলের মাঝখানে, যেখানে সবাই ব্যস্ত, সেখানে তার উপস্থিতি যেন এক গা ছমছমে অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তাঁর গা dark ়, পুরু কোট, সোনালী রঙের একটি ঘড়ি আর সোজা দাঁড়ানো কোমর, সব মিলিয়ে একটি অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করছিল। মিঃ আখতার একটানা অরিন্দমের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, যেন তাঁকে পর্যবেক্ষণ করছেন। কিছুক্ষণ পরে তিনি বললেন, “১১ তলার উপরের ঘর চাই।” তাঁর গলায় একটি গম্ভীরতা ছিল, যা সাধারণ অতিথিদের মধ্যে ছিল না। রুবিনা অস্বস্তি নিয়ে বললেন, “দুঃখিত, মিঃ আখতার, আমাদের এখানে শুধু ১২ তলা পর্যন্ত ঘর রয়েছে। ১৩ তলা তো… আপনি তো জানেন।”
মিঃ আখতার তখন একটু থামলেন, তারপর একদম অদ্ভুতভাবে মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, “১৩ তলা মানে মৃতদের তলা, রুবিনা। এখানে কেউ থাকলে ফিরে আসে না।” তাঁর গলার সুরে কিছু ছিল যা অরিন্দমকে চমকে দিয়েছিল। সেই কথা যেন অদৃশ্য ভাবে হোটেলের প্রাচীরের ভিতর ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তিনি এক মুহূর্তে আশপাশের মানুষের দিকে তাকালেন, আর তার চোখে এক অজানা ভয় দেখা দিল। এর পরেই তিনি অরিন্দমের দিকে ফিরে বললেন, “তোমরা জানো না, হোটেলগুলো কখনো সাধারণ থাকে না। বিশেষত এমন পুরনো হোটেলগুলো, যা শত বছরের পুরনো। তাদের একেকটা তলা একেকটা রহস্য বহন করে। ১৩ তলা ছাড়া এই হোটেলের কোনো দিকই পুরোপুরি পরিচ্ছন্ন নয়।” তার কথা শুনে রুবিনা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে ফিরে গিয়ে কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ালেন, কিন্তু অরিন্দমের মনের ভিতর একটা অদ্ভুত ভাবনার জন্ম নিল। মিঃ আখতার কি জানেন কিছু, যা তারা জানে না? হোটেলের অতীতের কোনো গোপন ইতিহাসের সঙ্গে তিনি কীভাবে সম্পর্কিত?
মিঃ আখতার হোটেলের করিডর ধরে চলে গেলেন, কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টি অরিন্দমের মনে এক গভীর দাগ রেখে গেল। সেই দৃষ্টি যেন তাকে প্রতিনিয়ত অনুসরণ করছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে চাচ্ছে কোথাও নিয়ে যেতে। তিনি জানতেন, মিঃ আখতার কোনও সাধারণ অতিথি নন—তার মধ্যে এমন কিছু ছিল, যা অরিন্দমের মতো একজন সাংবাদিকও ঠিকভাবে বোঝার চেষ্টা করতে পারছিল না। তাঁর পেছনে হালকা পায়ের শব্দ আসছিল, কিন্তু যখন তিনি ফিরে তাকালেন, মিঃ আখতার তখনও উঁচু শীতল সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে চলেছিলেন। অরিন্দম সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলেন, যে রহস্য তিনি খুঁজে বের করতে চাইছেন, সেটা শুধু একটাই না—এটা বেশ কয়েকটা অন্ধকার আচ্ছন্ন গল্পের সমষ্টি হতে চলেছে। মিঃ আখতার হোটেলে এসে যা বললেন, তাতে অরিন্দমের আরও বেশি আগ্রহ জন্মাল। ১৩ তলার গোপন তলা, সেখানে মৃত্যু আর অদ্ভুত অনুরণন—এক একটা কথা যেন বিঁধে যাচ্ছিল তাঁর ভিতরে, ঠিক যেমন বিঁধেছিল হোটেলের সেই অদৃশ্য শীতলতা।
–
বৃষ্টি ভেজা এক দুপুরে, যখন হোটেল নীহারিকা রেসিডেন্সের লবি প্রায় ফাঁকা, অরিন্দম অনুমতি নিয়ে রিসেপশনের পেছনের পুরনো রেকর্ড রুমে ঢুকলেন। ঘরের ভেতরটা স্যাঁতসেঁতে, ধুলো আর পচা কাগজের গন্ধে ভরা। দেওয়ালের তাকগুলোতে সাজানো অসংখ্য মোটা রেজিস্টার—প্রতিটি অতিথির নাম, তারিখ, আর কক্ষ নম্বর ধরে রাখা সেই হলদেটে পাতাগুলো যেন সময়ের সিন্দুক। তিনি পাতাগুলো উল্টে উল্টে ১৯৮৬ সালের দিকে যেতে লাগলেন—সেই বছরই সোমনাথ বলেছিলেন প্রথম ১৩ তলার অস্তিত্ব দেখা দিয়েছিল। রেজিস্টারের একটি পাতায় এসে তাঁর হাত থেমে গেল—নাম লেখা আছে রিয়াজ মির্জা, রুম নম্বর ১৩০১। কিন্তু হোটেলে তো ১৩ তলা নেই! নামটির পাশে একটি লাল কালি দিয়ে টানা দাগ, আর মন্তব্য কলামে অস্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা “চেক আউট—নেই”। ঠিক সেই রেজিস্টারের নীচের তাকেই একটি পুরনো চামড়ার স্যুটকেস পড়ে ছিল, যার তালা মরচে পড়ে ঝুলছে। অরিন্দম কৌতূহলে হাত বাড়িয়ে তালাটা খুলতে চেষ্টা করলেন, আর অল্প চাপেই সেটি খুলে গেল। ভিতরে কিছু পুরনো কাপড়, একটি ছেঁড়া ফটোগ্রাফ, আর কিছু চিঠি এলোমেলোভাবে রাখা।
চিঠিগুলোর মধ্যে একটি বিশেষ চিঠি অরিন্দমের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। হলুদে পড়া কাগজে কালো কালির লেখাগুলো এখনো স্পষ্ট—উপরের তারিখ ৫ই জুলাই, ১৯৮৬। চিঠিটি কোনো ব্যক্তিগত সম্বোধন ছাড়াই লেখা, যেন পাঠক আগে থেকেই জানেন কাকে উদ্দেশ্য করে লেখা হচ্ছে। তাতে লেখা, “যদি ১৩ তলায় যেতে চাও, প্রথমে ছায়ার সিঁড়ি খুঁজে বের কর। সিঁড়ি কখনো একই জায়গায় থাকে না—রাতের ভেতর বদলে যায়। তুমি যদি আলো সঙ্গে নাও, ছায়া তোমাকে পথ দেখাবে না। মনে রেখো, লিফট সবসময় সত্য বলে না।” লেখার ভঙ্গি ছিল সতর্কবার্তার মতো, তবু এক ধরনের টান ছিল, যেন লেখক চাইছেন পাঠক নিজেই চেষ্টা করুক। চিঠির নীচে শুধু একটি চিহ্ন—অর্ধচন্দ্রের ভেতরে একটি চোখ। অরিন্দম কাগজের উপর আঙুল বুলিয়ে ভাবলেন, এটা কি সেই রিয়াজ মির্জার লেখা, নাকি কারও দেওয়া গোপন নির্দেশ? চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন তাঁর মনের ভিতরে অদৃশ্য দরজা খুলে দিচ্ছিল। ‘ছায়ার সিঁড়ি’—এর মানে কী হতে পারে? হোটেলের কোথায় লুকিয়ে আছে এমন কোনো সিঁড়ি যা অন্য তলায় নিয়ে যায়, অথচ কারও নজরে পড়ে না?
অরিন্দম চিঠিটি ভাঁজ করে নিজের নোটবুকে রেখে দিলেন, কিন্তু তাঁর মন এখন আর রেকর্ড রুমে ছিল না—ছিল সেই অদৃশ্য সিঁড়ির খোঁজে। তিনি স্যুটকেসের বাকিটুকু তন্ন তন্ন করে ঘাঁটলেন, আর পেলেন আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস—একটি হোটেলের লোগোযুক্ত পুরনো রুম-কি, যাতে ১৩০১ নম্বর খোদাই, আর একটি ছেঁড়া ফটোগ্রাফ, যেখানে দেখা যাচ্ছে হোটেলের একটি করিডর, কিন্তু ফটোর শেষ প্রান্তে সিঁড়ি নেমে যাচ্ছে এক অন্ধকার গহ্বরে। ফটোর ডান পাশে ছায়ার মতো এক অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু শরীরের ভঙ্গিতে যেন অপেক্ষা করার আভাস। অরিন্দম ফটোটি পকেটে রাখলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, যেন তিনি নিজের অজান্তেই এমন এক খেলায় পা রেখেছেন, যার নিয়ম আগে থেকেই লেখা—১৯৮৬ সালের সেই রাত থেকে শুরু হওয়া এক খেলা। আর এই চিঠি, এই ছবি, আর সেই ‘ছায়ার সিঁড়ি’ই হয়তো তাঁকে সরাসরি নিয়ে যাবে ১৩ তলার গোপন সত্যের মুখোমুখি। বাইরে তখন মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছিল, আর হোটেলের পুরনো দেয়ালগুলো যেন অদৃশ্য কণ্ঠে ফিসফিস করছিল—এবার সময় এসেছে।
–
রাত তখন প্রায় দেড়টা। হোটেলের করিডরগুলো ফাঁকা, শুধু দূরে কোথাও পুরনো পেন্ডুলাম ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যাচ্ছে। অরিন্দম ও নীলা চুপচাপ লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, দুজনের হাতেই ছোট টর্চ, যদিও অরিন্দমের মনে হচ্ছিল আলো তাদের শত্রু হতে পারে—চিঠিতে যেমন লেখা ছিল। লিফটের দরজা খুলতেই ভেতরের হালকা কমলা আলো অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়াল, কিন্তু সেই উষ্ণতা যেন এক গোপন শীতলতার আড়াল। তারা ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল। প্যানেলে একে একে তলার নম্বরগুলো জ্বলতে লাগল—১২ পর্যন্ত সব স্বাভাবিক। তারপর হঠাৎই, যেন কোথাও থেকে ভেসে আসা এক প্রেতাত্মীয় ইচ্ছায়, বোতাম প্যানেলের ফাঁকা জায়গায় ১৩ নম্বর জ্বলে উঠল। কোনো বোতাম চাপা হয়নি, তবুও যেন লিফট নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নীলা ঠোঁট কামড়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি এটা দেখছ?” অরিন্দম শুধু মাথা নাড়ল, কিন্তু বুকের ভেতর ঢেউ খেলতে লাগল এক অদ্ভুত উত্তেজনা ও ভয়। লিফট কোনো শব্দ ছাড়াই উপরে উঠতে লাগল, কেবল ধাতব তারে ঘর্ষণের ক্ষীণ সুর শোনা যাচ্ছিল। প্রতিটি সেকেন্ড যেন দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছিল, আর লিফটের ভেতরের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল।
একটি নরম, প্রায় অদৃশ্য ধাক্কা দিয়ে লিফট থেমে গেল। দরজা খুলে যেতেই তারা প্রথমবার ১৩ তলার মুখোমুখি হলো। করিডরটি প্রত্যাশার মতো নয়—এটি যেন জীবন্ত এক শূন্যতা। আলো নেই, অথচ অন্ধকারের মধ্যেও সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়, যেন দেয়ালগুলো নিজেই আলো ছড়াচ্ছে। বাতাস নেই—কোনো হাওয়া বইছে না, এমনকি তাদের নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও যেন দূরে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ছিল নীরবতা—তবে সম্পূর্ণ নীরবতা নয়, কারণ গভীর থেকে ভেসে আসছিল এক অদ্ভুত ফিসফিসানি, যা স্পষ্ট কোনো ভাষায় নয়, তবুও মনে হচ্ছিল তারা বুঝতে পারছে। দেয়ালগুলো ছিল ফ্যাকাসে ধূসর, কিন্তু কাছে তাকালে দেখা যাচ্ছিল সেখানে অসংখ্য হাতের ছাপ, যেন বহু মানুষ এখানে এসে হাত রেখে গেছে। নীলা ক্যামেরা তুলতে গিয়েও থেমে গেল—লেন্সে অদ্ভুত ধোঁয়ার মতো কিছু জমে যাচ্ছিল, যা মুছলে আরও ঘন হয়ে ফিরে আসছিল। করিডরের শেষ মাথায় যেন একটি বাঁক, কিন্তু সেই বাঁক থেকে অদৃশ্যভাবে ঠান্ডা ছায়া টেনে নিচ্ছিল তাদের দৃষ্টি।
অরিন্দম ধীরে ধীরে সামনে এগোল, নীলা তার পেছনে। ফিসফিসানি হঠাৎই স্পষ্ট হয়ে উঠল—এবার যেন তারা নাম শুনতে পাচ্ছে, এমন কিছু নাম যা তারা আগে কখনো শোনেনি, তবে একবার শোনার পরেই মনে হচ্ছে বহু পুরনো কোনো স্মৃতি থেকে উঠে আসছে। করিডরের মেঝে ছিল অদ্ভুত নরম, যেন ধুলো বা বালি দিয়ে ঢাকা, কিন্তু হাঁটার সময় কোনো শব্দ হচ্ছিল না। হঠাৎ নীলা তার কাঁধে হাত রাখল—সে দেয়ালের একটি ফাটল দেখিয়েছিল, যেখান থেকে ফিসফিসানি আরও জোরে শোনা যাচ্ছিল। ফাটলের ভেতরে যেন কালো কুয়াশা ঘূর্ণায়মান, আর সেই কুয়াশার ভিতর ক্ষণিকের জন্য দেখা গেল এক জোড়া চোখ, যা স্থির হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। দুজনেরই শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে করিডরের বাতি—যা তারা ভেবেছিল নেই—একসঙ্গে জ্বলে উঠল, আর দেখা গেল অসংখ্য দরজা, প্রতিটির নম্বর ১৩০১, ১৩০২, ১৩০৩… যেন সব কক্ষ একই তলার নয়, বরং এক অদৃশ্য গোলকধাঁধার অংশ। দূরে কোথাও থেকে লিফটের দরজার ডিং শব্দ ভেসে এল, যেন ফিরে যাওয়ার শেষ সুযোগ দিচ্ছে। কিন্তু অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, এখন ফিরে গেলে হয়তো তারা সত্যের কাছে আর কখনো পৌঁছতে পারবে না। নীলা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা কি যাচ্ছি?”—অরিন্দম শুধু ফিসফিস করে বলল, “আরও একটু।”
–
করিডরের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অরিন্দমের মনে হচ্ছিল, যেন তারা শুধু হাঁটছে না—বরং এক অদৃশ্য টান তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে একটা ঘন ধুলো-মাটি আর মরচের গন্ধ ভাসছিল, যা ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছিল। করিডরের বাঁক ঘুরতেই তারা একটি কাঠের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল—দরজাটি প্রায় আধখোলা, যেন বহু বছর ধরে কেউ এটিকে পুরোপুরি বন্ধ বা খোলেনি। দরজার গায়ে ছিল অদ্ভুত কিছু আঁকিবুকি, যা কাছে গিয়ে বোঝা গেল তন্ত্রমন্ত্রের চিহ্ন—কিছু সংস্কৃত অক্ষর, কিছু জ্যামিতিক প্রতীক, আর কিছু অচেনা লিপি, যা নীলা স্বীকার করল যে আগে কখনো দেখেনি। অরিন্দম আলতো করে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক ঘন, স্থির গন্ধ তাদের আঘাত করল—গন্ধটি ছিল পুরনো, যেন সময় নিজেই এখানে পচে গেছে। কক্ষটি ছিল প্রায় ফাঁকা, কিন্তু দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি ভর্তি সেই চিহ্নগুলোতে, যা কালো, লাল ও গাঢ় বাদামি রঙে আঁকা। কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি ভাঙা লিফট শ্যাফ্ট, যার লোহার ফ্রেম মরচে ধরে খসে পড়ছে, আর গভীরে তাকালে দেখা যাচ্ছিল অন্ধকারের এক অসীম গহ্বর।
শ্যাফ্টের চারপাশে পড়ে ছিল অসংখ্য ছড়িয়ে থাকা জিনিস—প্রতিটি যেন কোনো একসময় জীবিত মানুষের দৈনন্দিন সঙ্গী ছিল। একটি রুপালি পকেট ঘড়ি, যার কাঁটা রাত ১টা ১৩ মিনিটে থেমে আছে; একটি সাদা রুমাল, যাতে শুকিয়ে যাওয়া লালচে দাগ; ভাঙা চশমা, যার কাচে চিরে যাওয়া রেখা যেন কোনো ভয়ঙ্কর মুহূর্তের সাক্ষ্য বহন করছে। নীলা নিচু হয়ে একটি ছোট মেয়ের গোলাপি চুলের ক্লিপ তুলে নিল, তারপর ধীরে ফেলে দিল, যেন স্পর্শ করাটাই বিপজ্জনক। অরিন্দম লক্ষ্য করল, জিনিসগুলো সবই ভিন্ন সময়কালের—কিছু হয়তো দশ বছর আগের, কিছু আরও পুরনো, হয়তো সেই ১৯৮৬ সালেরও আগে। দেয়ালের এক কোণে ছিল কিছু পুরনো ছবি—ম্লান হয়ে গেলেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, প্রতিটিতে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের মুখ, কিন্তু সবার চোখে একই শূন্যতা, আর পেছনে দেখা যাচ্ছে এই একই কক্ষ। যেন তারা এখানে এসে আর ফেরেনি। শ্যাফ্টের ধাতব কাঠামোতে ঝুলে ছিল একটি সাইনবোর্ডের ভাঙা অংশ, তাতে লেখা—”SERVICE ONLY”, আর ঠিক নিচে লাল রঙে অস্পষ্ট একটি হাতের ছাপ।
নীলা টর্চের আলো শ্যাফ্টের গভীরে ফেলতেই তারা দেখতে পেল, অনেক নীচে কোথাও এক মৃদু নড়াচড়া, যেন কিছু নড়ছে বা বেঁচে আছে। অরিন্দম আলো সরাতেই আবার সব স্থির, শুধু এক ঠান্ডা বাতাস তাদের মুখে এসে লাগল, যদিও এই কক্ষে কোনো জানালা নেই। তারা দুজনেই বুঝতে পারছিল, এই কক্ষ শুধু হোটেলের ভেতরের অংশ নয়—এটি এক ধরনের সীমারেখা, যেখানে এসে বহু মানুষের যাত্রা শেষ হয়েছে। চিঠিতে লেখা “লিফট সবসময় সত্য বলে না” কথাটি হঠাৎ আবার মনে পড়ল। হয়তো এই ভাঙা শ্যাফ্টই ছিল সেই ১৩ তলার আরেক রূপ—যেখানে পৌঁছে গেলে আর ফেরার পথ থাকে না। কক্ষের ফিসফিসানি এবার স্পষ্টভাবে তাদের নাম ডাকতে লাগল, আর সেই ডাক যেন শ্যাফ্টের গভীর থেকে আসছিল। অরিন্দম ও নীলা একে অপরের দিকে তাকাল—চোখে একই প্রশ্ন, একই ভয়—তারা কি এখান থেকে পালাবে, নাকি আরও গভীরে যাবে? বাইরে লিফটের ঘণ্টার শব্দ নেই, করিডরও নেই, যেন এই কক্ষ তাদের পুরোপুরি গ্রাস করেছে।
–
হোটেলের পুরনো বেসমেন্টে, যেখানে ম্লান হলুদ আলোয় দেয়ালগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছে, অরিন্দম ও নীলা বসেছিল একটি কাঠের টেবিল ঘিরে। তাদের সামনে চুপচাপ বসে ছিল সোমনাথ চক্রবর্তী—লিফট অপারেটর, যিনি এই হোটেলে কাজ করছেন ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে। তার মুখের ভাঁজগুলো যেন এই ভবনের প্রতিটি ফাটলের মতোই পুরনো ও গভীর। অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর সে ধীরে ধীরে বলল, “তোমরা যা দেখেছ, সেটা হোটেলের আসল তলা নয়। ওটা পুরনো ভবনের অংশ, যা এখন নেই—কাগজে-কলমে, দেয়াল আর ইটের দুনিয়ায় নেই। ১৯৭৮ সালে এখানে ছিল আরেকটি ডানদিকের উইং—তিনতলা উঁচু বাড়তি অংশ, যেখানে অনেক ধনী অতিথি থাকতেন। এক রাতে হঠাৎ আগুন লেগে যায়, আর আগুন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে যে কাউকে বের করে আনা সম্ভব হয়নি। সব মিলিয়ে সাতাশ জন মানুষ সেই রাতে মারা যান।” সোমনাথের কণ্ঠে কোনো নাটকীয়তা নেই—শুধু এক শীতল সত্য, যা অরিন্দম ও নীলার শিরদাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত বয়ে দিল।
সে আরও বলল, “পরে যা রয়ে গেল, সেটা ভেঙে ফেলা হয়। যেখানে এখন তোমরা ১৩ তলা বলো, ওটা আসলে সেই পোড়া অংশের প্রতিচ্ছবি। আমি জানি, তোমরা ভাবছ—একটা ভেঙে ফেলা অংশ আবার লিফটে উঠে দেখা সম্ভব কিভাবে? এটা বোঝানো মুশকিল, কিন্তু এখানে সময় আর জায়গা এক নয়। মাঝেমাঝে, গভীর রাতে, লিফট আপনাআপনি ডাকা না হয়েও থামে… আর দরজা খোলে সেই মৃত অংশে। যারা যায়, তারা আর ফেরে না। আমি দু’বার দেখেছি—একবার ১৯৮৬ সালে, যখন এক অতিথি রাতে অদৃশ্য হয়ে যায়, আরেকবার ১৯৯৯-এ, যখন এক হোটেল কর্মচারী কৌতূহলবশত সেখানে ঢুকেছিল। দু’জনেরই কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।” নীলা বিস্মিত দৃষ্টিতে অরিন্দমের দিকে তাকাল—তারা নিজেরাই তো সেই জায়গায় গিয়েছে, এবং ফিরে এসেছে, অন্তত আপাতদৃষ্টিতে। কিন্তু সোমনাথের চোখে সেই স্বস্তির কোনো ছাপ নেই; বরং গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “তোমরা এখনো পুরোপুরি ফেরেনি… বুঝতে পারছ তো?”
অরিন্দম কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সোমনাথ হাত তুলে থামিয়ে দিল। “যদি বাঁচতে চাও, তাহলে সত্যের দরজা বন্ধ করতে হবে। পুরনো অংশে একটাই প্রবেশপথ আছে—লিফট, আর সেই লিফটের সাথেই যুক্ত একটি গোপন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। আমি সেটার অবস্থান জানি, কিন্তু সেখানে যেতে মানে আবার সেই জায়গায় প্রবেশ করা। তোমরা যা দেখেছ, সেটা শুধু প্রথম স্তর—অদৃশ্য করিডর, ফিসফিসানি, হাতের ছাপ… কিন্তু এর পরে আছে আরও ভয়ঙ্কর কিছু, যেটা কখনোই দিনের আলোতে আসে না। মৃতরা শুধু মারা যায় না, তারা জায়গাটার সাথে মিশে যায়, আর সেই মিশে যাওয়া মানে, জায়গাটাই জীবন্ত হয়ে ওঠে।” নীরবতা নেমে এল ঘরে, শুধু দূরে বেসমেন্টের ছাদের কোথাও থেকে পড়ে আসা পানির ফোঁটার টুপটাপ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। অরিন্দম অনুভব করল, তাদের সামনে এখন আর শুধু এক রহস্য নেই—এটা একটা সিদ্ধান্তের মুহূর্ত। সত্য জানলে হয়তো তারা বাঁচতে পারবে, কিন্তু সেই সত্যের পথে পা বাড়ানো মানে মৃত্যু হতে পারে মুহূর্তের ব্যাপার। নীলা ধীরে ধীরে বলল, “আমরা যাচ্ছি।” আর সোমনাথের চোখে এক মুহূর্তের জন্য দেখা গেল এক ধরনের স্বস্তি—বা হয়তো সেটা ছিল আসন্ন অন্ধকারের জন্য প্রস্তুতির ঝিলিক।
–
লিফটের ভেতরে অরিন্দম ও নীলা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়েছিল। প্যানেলের সব বোতাম নিভে আছে, শুধু ধীরে ধীরে নিচে নামার নির্দেশক আলোটি বদলাচ্ছে—১১, ১০, ৯… তারা যেন কোনো দুঃস্বপ্নের ভেতর দিয়ে বাস্তবে ফিরে আসছে, কিন্তু সেই বাস্তবও কতটা নিরাপদ, তা তারা জানে না। ১৩ নম্বর বোতামটি আর জ্বলছে না, দরজা খুলছে না, শুধু এক অদৃশ্য চাপ তাদের বুকে বসে আছে। হঠাৎ এক ঝাঁকুনিতে লিফট থামল, দরজা খুলে গেল—তারা অবাক হয়ে দেখল, তারা ৫ তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। এই তলা একেবারেই পরিচিত, উজ্জ্বল আলো, পরিষ্কার কার্পেট, দূরে অতিথিদের চলাফেরা। এক মুহূর্তে যেন ১৩ তলার অন্ধকার ও ফিসফিসানি কেবল এক কল্পনা হয়ে মিলিয়ে গেল। নীলা তাকিয়ে বলল, “আমরা ফিরে এসেছি।” কিন্তু অরিন্দম কোনো উত্তর দিল না—তার চোখে তখনও এক ধরনের সংশয়, যেন সে পুরোপুরি নিশ্চিত নয় যে তারা সত্যিই ফিরে এসেছে কি না।
দু’জন মিলে সিঁড়ি দিয়ে লবিতে নেমে এল, আর সেই মুহূর্তে তারা প্রথমবারের মতো এক ধরনের অদ্ভুত হালকা ভাব অনুভব করল—যেন ভারী কোনো বোঝা হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লবি ছিল আগের মতোই—রিসেপশনে রুবিনা দত্ত অতিথিদের চেক-ইন করাচ্ছেন, পেছনে বাজছে পিয়ানো, বাইরে চৌরঙ্গীর ট্রাফিকের শব্দ ভেসে আসছে। সব কিছু স্বাভাবিক, সব কিছু বাস্তবের মতো। নীলা হাসতে চেষ্টা করল, কিন্তু সেই হাসিতে শিরশিরে ভয় লুকিয়ে ছিল। “দেখছো তো, আমরা ঠিক আছি,” সে বলল, যেন নিজের মনকেই বোঝাচ্ছে। অরিন্দম ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, তারপর পাশের দেয়ালে বড় আয়নার দিকে তাকাল, যেখানে লবির পুরো দৃশ্য প্রতিফলিত হচ্ছিল। প্রথমে তিনি কেবল তাদের দুজনকে দেখলেন—অবসন্ন, কিন্তু জীবিত। কিন্তু পরের মুহূর্তে তার গলা শুকিয়ে গেল। আয়নায় তাদের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছে আরেকজন—একটি লম্বা ছায়াময় অবয়ব, যার মুখ স্পষ্ট নয়, কিন্তু চোখের দৃষ্টি সোজা আয়নার মধ্য দিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।
অরিন্দম তাড়াহুড়ো করে পেছনে ঘুরে তাকাল—সেখানে কেউ নেই। আবার আয়নায় চোখ ফেরাতেই সেই অবয়ব এখনও দাঁড়িয়ে আছে, এবার একটু কাছাকাছি। নীলা ফিসফিস করে বলল, “ও… ওটা আমাদের সাথে আসেনি।” তার কণ্ঠে এমন এক শীতল ভয় ছিল, যা লবির উজ্জ্বল আলোও দূর করতে পারল না। অবয়বের ঠোঁট ধীরে ধীরে নড়ল, যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হল না—বরং আশপাশের সব শব্দ মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল। অরিন্দম অনুভব করল, লবি, অতিথি, রিসেপশন—সব কিছু যেন ধীরে ধীরে পেছনের দিকে গলে যাচ্ছে, আর চারপাশে সেই ১৩ তলার অন্ধকার আবার ঘনিয়ে আসছে। তারা কি সত্যিই ফিরে এসেছে, নাকি কেবল এক ভিন্ন স্তরে আটকে পড়েছে? আয়নার ভেতরের সেই তৃতীয় ব্যক্তি অদ্ভুত এক হাসি দিল, আর তার সাথে সাথে আয়নায় প্রতিফলিত দৃশ্য সম্পূর্ণ বদলে গেল—লবির জায়গায় দেখা গেল সেই ভাঙা শ্যাফ্ট ও তন্ত্রমন্ত্রে ঢাকা দেয়াল। নীলা চিৎকার করার আগেই অরিন্দমের চোখে ভয় জমে বরফ হয়ে গেল—তারা বুঝল, ফিরে আসা কখনোই মানে নিরাপদ হওয়া নয়।
—