ইমন দে
পর্ব ১
শিলিগুড়ির দক্ষিণ চৌরঙ্গী এলাকায় একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। লাল ইটের সেই বাড়িটা বেশিরভাগ সময়ই নির্জন। দিনের বেলায় স্থানীয়রা পাশ কাটিয়ে যায়, রাত হলে কেউই পথ মাড়ায় না। লোকজন বলে, বাড়িটার পাশের গলিতে মাঝরাতে কার যেন হেঁটে যাওয়ার শব্দ শোনা যায়, আবার জানালার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় এক মেয়ের মুখ—মাথায় লাল ঘুঙুরের টিপ, চোখে নিঃশব্দ আর্তি।
এই এলাকাতেই নবাগত পরিবার দত্তরা নতুন ভাড়া নিয়েছে। রণদীপ দত্ত, তার স্ত্রী পৌলমী এবং একমাত্র মেয়ে রিয়া। পৌলমীর স্কুলে চাকরি হয়েছে, আর রণদীপ ব্যাঙ্কে। বাড়িভাড়া কম, চারপাশে গাছপালা, তাদের বেশ ভালোই লেগেছিল। প্রতিবেশীরা প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে আর কিছু বলেনি। তারা জানে, এই বাড়ি বেশিদিন কেউ টিকতে পারে না।
রিয়া, ক্লাস এইটে পড়ে। সাহসী আর কৌতূহলী মেয়ে। নতুন বাড়িতে উঠে সে দোতলার ঘরটা বেছে নেয়। জানালা দিয়ে দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় পরিষ্কার দিনে। তবে প্রথম রাত থেকেই সে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করে—একটা লাল ঘুড়ি, একটা পুরনো সেতু, আর এক মেয়ে যাকে সে চিনতে পারে না, কিন্তু অনুভব করে যেন সে খুব চেনা।
একদিন বিকেলে রিয়া স্কুল থেকে ফিরে দেখে, বাড়ির পেছনের আঙিনায় একটা ঘুড়ি পড়ে আছে—লাল ঘুড়ি। কেটে গিয়ে পড়েছে হয়তো। সে সেটা তুলে আনে ঘরে। ঘুড়িটা বেশ পুরনো, একটু ছেঁড়া, কিন্তু তার গায়ে সোনালি রঙে একটা নাম লেখা—”মালিনী”।
সেই রাতেই রিয়া ঘুমাতে পারছিল না। হঠাৎ জানালার বাইরে শব্দ পায়—হাওয়ায় যেন কারও চুল ওড়ে, ঘুড়ির মতোই। জানালার পর্দা নড়ছে, অথচ জানালা বন্ধ। তখনই সে আবার সেই মেয়েটার স্বপ্ন দেখে, যাকে সে আগেও দেখেছে। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, “আমার ঘুড়ি… ফেরাও…”
পরদিন সকালে পৌলমী রিয়াকে প্রশ্ন করে, “তুই কাল রাতে উঠেছিলি?”
রিয়া মাথা নাড়ে। “না তো মা, কেন?”
পৌলমী বলে, “তোর ঘরের দরজা খোলা ছিল, আর রান্নাঘরে কিচেন লাইট জ্বলছিল। মনে হল কেউ হাঁটছিল।”
রিয়া অবাক। সে রাত তিনটের পর ঘুম থেকে উঠেনি। রণদীপ বলে, “হয়তো টোকা পড়েছে, দরজা খুলে গেছে।”
কিন্তু ঠিক সেই সময় পাশের বাড়ির বুড়ো দাদু, হরিপদ, হঠাৎ বলে ওঠেন, “এই ঘরে কবে থেকে আবার লাল ঘুড়ি ওড়ে?”
পৌলমী অবাক, “মানে?”
হরিপদ বলেন, “এই বাড়ির আগের বাসিন্দা ছিল বিশু দা আর তার বোন মালিনী। খুব চুপচাপ মেয়ে ছিল। ঘুড়ি ওড়াতে ভালোবাসত। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে সে নিখোঁজ হয়ে যায়। কাকে খুঁজলেও পাওয়া যায়নি। তারপর থেকেই লোকে বলে, সে ফিরে আসে… তার ঘুড়ি খুঁজতে…”
রণদীপ হেসে বলেন, “ভূতের গল্প?”
হরিপদ মাথা নাড়েন, “হাসি পায়? ও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল বিশু দা। পুলিশও খুঁজে পায়নি। শুধু জানালার ফাঁকে মাঝে মাঝে মালিনীর মুখ দেখা যায়, আর ঘুড়ি উড়ে…”
রিয়া চুপচাপ ছিল, কিন্তু তার বুকের ভিতর যেন কেমন করে উঠল। সেই রাতে সে ঘুড়িটা আবার জানালার পাশে রেখে ঘুমাতে যায়।
রাত একটা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় রিয়ার। জানালার বাইরে কুয়াশা। সে দেখতে পায়, তার ঘরের পাশে দোতলার বারান্দায় একটা মেয়ের অবয়ব। লাল টিপ, সাদা জামা। হাত তুলে ঘুড়ির দিকে ইশারা করছে। মুখে কোনো শব্দ নেই, কিন্তু চোখে একরাশ কান্না। রিয়া চিৎকার করে ওঠে।
পৌলমী ছুটে আসে, “কি হল রিয়া?”
সে কিছু বলতেও পারে না, কাঁপছে। রণদীপ এসে দেখে, জানালা খোলা! অথচ সেটা লক করে ঘুমিয়েছিল তারা।
পৌলমী বলে, “চলো, এবার ঘর বদলাও।”
কিন্তু রিয়া ভাবে, “না, এই ঘরেই থাকব। মালিনী কিছু বলতে চাইছে। হয়তো কেউ তাকে ভুল বোঝে। হয়তো তার গল্পটা এখনো কেউ জানে না।”
তারপর দিনগুলো কেটে যায়। কিন্তু ঘুড়ির সেই সুতো ধরা রইল রিয়ার হাতে—একটা অদৃশ্য রহস্যের সুতো।
পর্ব ২
রিয়া ঠিক করল, সে ভয় পেয়ে সরে আসবে না। দোতলার ঘরটা তার নিজের করে নিয়েছে সে, আর মালিনীর ঘুড়ি—তা যেন এক অলিখিত বন্ধনের মতো। পরদিন সকালে সে ঘুড়িটা নিয়ে বসে, আবার খুঁটিয়ে দেখে। এবার খেয়াল করে ঘুড়ির কাগজের মধ্যে একটা অদ্ভুত গন্ধ—ধূপের মতো, পুরনো কোনো মন্দিরের ধূপকাঠির ঘ্রাণ, কিন্তু একধরনের তীব্রতা আছে, যেটা গায়ে লাগার মতো।
সেই গন্ধে ঘুমঘোর চলে আসে। চোখ বুজলে আবার সেই দৃশ্য—একটা ঘরে ধূপকাঠি জ্বলছে, জানালার পর্দা উড়ছে, আর একটা মেয়ে বসে ঘুড়ি বানাচ্ছে। হঠাৎ একটা পুরুষ কণ্ঠ বলে, “মালু, আর ঘুড়ি নয়, এবার পড়াশোনায় মন দাও।”
মেয়েটা মুখ তুলল। মায়াবী মুখ, কিন্তু চোখে একরাশ অভিমান।
রিয়া আঁতকে উঠে জেগে ওঠে। সে বুঝতে পারে, মালিনীর স্মৃতি তার ঘুমে ঢুকে পড়ছে।
এদিকে পৌলমী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। রিয়ার আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। সে একা একা বসে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে না, মাঝরাতে হেঁটে বেড়ায় ঘরে। একরাতে পৌলমী দেখে, রিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে আছে, ঠোঁটে এক অচেনা হাসি।
পরদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় রিয়া রিকশা না নিয়ে হেঁটে এল। হঠাৎ সে রাস্তার ধারে পুরনো একটা দোকানে চোখে পড়ল—ধূপকাঠি, ঘুড়ির কাঁচামাল, পুরনো রঙের কৌটা। দোকানের নাম ‘সন্ধ্যাবাতি’। দোকানের ভেতরে একটা বৃদ্ধা বসে আছেন, কানে হুঁকো, চোখে ঘোলাটে চশমা।
রিয়া জিজ্ঞেস করল, “এই ধরণের লাল ঘুড়ি কি আপনি আগে বিক্রি করতেন?”
বৃদ্ধা একটু অবাক হয়ে বললেন, “ও রকম ঘুড়ি… মালিনী বানাত। বিশু বানাত ভাইয়ের সঙ্গে। দুজনের খুব মায়া ছিল ঘুড়ির ওপরে। কিন্তু একটা ঘুড়ি… শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল…”
রিয়া ধপ করে বসে পড়ল, “মানে?”
বৃদ্ধা মুখ নামিয়ে বললেন, “বাড়ির ছাদে সেই দিন ঘুড়ি ওড়াতে গিয়েই মালিনী পড়ে গেছিল। সবাই বলে হাওয়ায় পা পিছলে গিয়েছিল। কিন্তু আমি জানি… ওর কান্না আমি এখনো শুনি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বারান্দা থেকে ধূপের গন্ধ আসে আমার নাকে।”
রিয়ার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। সে ফিরে এল বাড়ি, কিন্তু মাথায় গুনগুন করছে একটা নাম—”সন্ধ্যাবাতি”।
সেই রাতে আবার কিছু ঘটল। ঘুমের মধ্যে সে শুনল—দরজা খোলে, ধূপকাঠির গন্ধ ছড়ায় ঘরের ভেতরে, আর বারান্দা থেকে একটা ছায়া আসে তার মাথার পাশে। এবার সেই মেয়েটা কিছু বলছে, কিন্তু অস্পষ্ট। রিয়া জেগে উঠে চিৎকার করতে পারে না, কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। তার চোখের সামনে মালিনীর অবয়ব ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে, আর তার ঠোঁটে একটাই কথা—“আমাকে মুছে দিচ্ছে… আমাকে ভুলে যাচ্ছে…”
পরদিন সকালে পৌলমী রিয়ার পাশে একটা সাদা খাম পায়। খামের ভেতরে একটা পুরনো চিঠি, যার উপর লেখা—“মালু, এই ঘুড়িটা আমার পক্ষ থেকে উপহার। দাদার জন্য নয়, শুধু তোমার জন্য। — রবি”
পৌলমী হতভম্ব। রবি কে? বিশুর বাইরের কেউ?
রিয়া ধীরে ধীরে জানে, সে কিছুর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। এই শহরের বুকের তলায় লুকিয়ে আছে এক ভুলে যাওয়া প্রেম, এক গোপন মৃত্যু আর এক দমবন্ধ করা আর্তনাদ।
আর তার জানালার ওপাশে কেউ অপেক্ষা করছে।
পর্ব ৩
পৌলমী যখন সকালে স্কুলে বেরিয়ে যায়, তখন রিয়া চুপচাপ ঘরের জানালার পাশে বসে ছিল। রাতের ঘুম কেটে কেটে গেছে। চোখে ঘুম নেই, তবু ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথায় কেমন যেন ঘোর লেগে আছে। বারবার মালিনীর মুখটা চোখের সামনে আসছে। যেন সে কিছু বলতে চাইছে, যেন কেউ তাকে থামিয়ে দিচ্ছে বারবার।
সেই দুপুরে রিয়া প্রথম ছাদে উঠল। আগে ওঠেনি কখনও, কারণ তাদের ওই ছাদে যাওয়ার দরজা প্রায় বন্ধই থাকে। কেয়ারটেকার বুড়ো কেশব কাকা বলেন, ছাদে উঠতে নেই, ভাঙাচোরা পাটাতন, সাবধানে চলতে হয়। কিন্তু আজ যেন কিছু একটা টানল তাকে। সে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠল, দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল—ধূপের সেই পুরনো গন্ধ, আবার।
ছাদটা অদ্ভুত নীরব। চারদিকে পাহাড়ের আবছা ছায়া, কিছু শুকনো পাতা, আর এক কোণায় একখানা পুরনো ঘুড়ির কঞ্চি পড়ে আছে। একটা ছোট টালির চালা ঘর, তালা মারা, কিন্তু দরজার ফাঁক দিয়ে যেন কারও নিঃশ্বাস শোনা যায়। রিয়া এগিয়ে যায়, দরজার কাছে কান পেতে শোনে।
“রিয়া…”
মুহূর্তেই সে সরে আসে। কাঁপতে কাঁপতে নীচে নেমে আসে, কিন্তু এই প্রথমবার তার মনে হয়—মালিনী তাকে ডেকেছে নাম ধরে। অথচ… মালিনী কি জানত, সে কে?
সেই রাতেই সে চিঠিটার খোঁজ করে। চিঠির প্রান্তে লেখা তারিখ—১৮ অক্টোবর ২০০৩। এখন ২০২৩, ঠিক কুড়ি বছর। চিঠির কাগজ পুরনো, কিন্তু হস্তাক্ষর স্পষ্ট। “রবি” নামটা বারবার মাথায় ঘুরছে। কে এই রবি? স্কুলের কোনো ছাত্র? প্রতিবেশী?
রিয়া পরদিন স্কুল থেকে ফিরে আসে, আর কেশব কাকাকে ধরে, “কাকু, এই বাড়ির মালিনীর কথা জানেন তো?”
কেশব কাকা গম্ভীর মুখে বলেন, “সবাই জানে, কিন্তু কেউ বলবে না। ওই মেয়েটার ঘরে আমি কাজ করতাম। ধূপ জ্বালাতো প্রতিদিন বিকেলে। বিশুদা বলত, মেয়েটা একটু অন্যরকম। একা থাকে, ঘুড়ি নিয়ে ভাবে, কারও সঙ্গে কথা বলে না। তারপর হঠাৎ একদিন…”
রিয়া চেপে ধরে, “কী হয়েছিল সেদিন?”
কেশব কাকা ফিসফিস করে বলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় মালিনী ছাদে উঠেছিল। তারপর একটা চিৎকার, একটা ঝনঝন শব্দ, আর একটা দীর্ঘ নিঃশব্দ। লোকে বলল, পা পিছলে পড়ে গেছিল। কিন্তু…”
“কিন্তু?”—রিয়া জিজ্ঞেস করে।
“আমি যখন ছুটে উঠলাম, ওর পাশে একটা ছেঁড়া ঘুড়ি, আর আরেকটা ছায়া… যেন কেউ ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিল… আমাকে দেখেই মিলিয়ে গেল। তারপর কেউ ছাদে উঠত না। আপনি তো জানেন, ওই দরজা বন্ধই থাকে।”
রিয়ার গলা শুকিয়ে আসে। সে জানে, মালিনী পড়ে যায়নি শুধু—কেউ হয়তো তাকে ঠেলেছে। কারো হাতের দাগ ছিল সেই ছেঁড়া ঘুড়ির সুতোয়। এবং সেই কারো ছায়া এখনো ঘোরাফেরা করে ওই ছাদে।
সেই রাতে রিয়া দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে। ঘুড়িটা টেনে আনে কোলের কাছে, আর মোমবাতি জ্বালায়। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয়। নিঃশব্দে বলে ওঠে, “মালিনী, তুমি এসো। আমি শুনব। আমি দেখব। আমি তোমার কণ্ঠে কান দেব।”
ঘরের জানালায় হাওয়া আসে। পর্দা নড়ে ওঠে। ধূপের গন্ধ আবার ছড়ায়, এবার আরও বেশি ঘন। হঠাৎ জানালার কাঁচে একটা হাতের ছাপ—ছোটো, পাতলা আঙুল, লাল টিপ লাগানো মধ্যমা।
রিয়া কাঁপে না। এবার সে জানে, মালিনী আসবে। তাকে সব বলবে। কিন্তু যেটা সে জানে না, তা হল—মালিনী একা নয়। তার পাশে কেউ আছে… আর সেই কেউ আজও ছায়ার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে, চুপচাপ, আরেকটা মৃত্যুর অপেক্ষায়।
পর্ব ৪
পরদিন সকালে রিয়ার ঘরটা অদ্ভুতভাবে গুমোট। জানালার কাঁচে সেই আঙুলের ছাপ এখনও আছে—ছোট, সূক্ষ্ম, যেন শিশিরের ওপর রাখা কারো নরম হাতের ছাপ। পৌলমী ঘরে ঢুকে দেখে জানালা হালকা খোলা, আর বাতাসে ঘরের পর্দা ধীরে ধীরে দুলছে। কিছু বলার আগেই রিয়া বলে ওঠে, “আমি জানি তুমি কিছু বলবে, কিন্তু আমাকে এখানে থাকতে দাও, মা।”
পৌলমী এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। মেয়ের চোখের গভীরে একটা অন্য আলো দেখে সে। ভয় নয়, কৌতূহল নয়, যেন কারো ব্যথা বোঝার আগ্রহ। সে আর কিছু না বলে ঘর ছেড়ে চলে যায়।
সেই দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে এসে রিয়া তার পুরনো নোটবুকে কিছু লিখতে শুরু করে—একটা ছায়া, একটা মেয়ে, একটা ছাদ, আর একটা ঘুড়ি—যা বয়ে চলেছে কুড়ি বছরের হাওয়া। হঠাৎ সে খেয়াল করে, ঘুড়িটার নিচে লুকোনো এক ফাঁপা জায়গা। কাগজের আবরণের নিচে আঙুল চালাতেই বেরিয়ে আসে একটা ভাঁজ করা কাগজ। পুরনো, বাদামি রঙে মোড়া।
খুলে দেখে একটা ছোটো নকশা আঁকা—একটি ছাদের খসড়া। আর নিচে লেখা: “শহরের সবচেয়ে শান্ত জায়গাটাই সবচেয়ে বেশি চেঁচিয়ে কাঁদে, যদি কেউ না শোনে।”
এই লেখাটা এক অচেনা হস্তাক্ষরে লেখা, কিন্তু সেই শেষের ‘R’ অক্ষরটা যেন চিঠির রবির হস্তাক্ষরের মতো।
রিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, সন্ধ্যাবেলায় সে আবার যাবে সেই দোকানে—‘সন্ধ্যাবাতি’। কিন্তু পৌঁছে দেখে, দোকান বন্ধ। পাশে এক কাগজে লেখা—“আজ বন্ধ, কাল আসুন।”
হতাশ হয়ে ফেরার সময় তার পেছনে একটা গলা শোনা যায়, “ঘুড়ির গল্প শুনবে, কিন্তু কান থাকতে হবে মনেও।”
সে ঘুরে দেখে, দোকানের পেছনে সেই বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে, মুখে হালকা হাসি। “চলো, পেছনের ঘরে।”
রিয়া একটু দ্বিধা নিয়ে ভেতরে ঢোকে। ঘরটা অন্ধকার, ছাদ থেকে ঝোলানো একটাই হ্যাজাক। বৃদ্ধা বলে, “মালিনী আর রবি স্কুলে একসঙ্গে পড়ত। রবি কাগজে আঁকত, মালিনী ঘুড়িতে। বিশু ভাইয়ের চাপে রবিকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল মালিনী—ভেবেছিল ভাই বুঝবে না। কিন্তু বিশু জানত।”
“কি জানত?”—রিয়া জিজ্ঞেস করে।
“তাদের প্রেম।”
রিয়ার চোখ বড় হয়ে যায়।
“একদিন ছাদে তিনজন ছিল—মালিনী, রবি, আর বিশু। তিনজনের মধ্যে একজন আর নেমে আসেনি।”
রিয়া ফিসফিস করে, “তাহলে… কে তাকে ঠেলেছিল?”
বৃদ্ধা বলল না। শুধু এক টুকরো কাপড় বের করে দিল—লাল ঘুড়ির রঙের সঙ্গে মিল। “এটা মালিনীর ওড়না ছিল। তুমি রেখে দাও। ও ফিরে আসছে।”
রিয়া ওড়নাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এল। সেই রাতে, ঠিক বারোটায়, যখন সে ঘরে বসে ওড়নাটার উপর হাত রাখল, জানালার পাশে একটা শব্দ হল—টুক্… টুক্… যেন কাঁচে কেউ টোকা দিচ্ছে।
সে ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগোয়। কাঁচের ওপারে কেউ নেই, কিন্তু সেই আঙুলের দাগ এবার আরও স্পষ্ট। এবং ঠিক নিচে লেখা একটি শব্দ, যেন কুয়াশার মধ্যে কেউ আঙুল দিয়ে লিখেছে—“বিশ্বাস…”
রিয়া শিউরে ওঠে। শব্দটা কিছু বোঝায়। মালিনী চাইছে সে বিশ্বাস করুক—কিন্তু কাকে?
আর সেই মুহূর্তেই দরজার ওপাশ থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে—”আমার গল্পটা শেষ হয়নি, রিয়া। এবার তুমিই লিখবে শেষ অধ্যায়।”
পর্ব ৫
রিয়া পুরোপুরি বুঝে গিয়েছে, মালিনীর মৃত্যু কোনো দুর্ঘটনা ছিল না। সে অনুভব করতে শুরু করেছে যে রাত বাড়লেই বাড়ির প্রতিটি দেয়ালে, বাতাসে, এমনকি তার শরীরেও ছায়ারা হেঁটে বেড়ায়—একটা অতীত যা ভুলে যাওয়ার নয়, বরং প্রকাশের অপেক্ষায়।
সেই রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে সে মোমবাতির আলোয় আবার পড়ছিল সেই আঁকা ছাদের নকশাটা। এবার খেয়াল করল, এক কোণায় ছোট করে লেখা একটা নাম—“সঞ্জীব স্ট্রিট, ব্লক বি”। এই ঠিকানাটা তার চেনা নয়, কিন্তু একটা টান অনুভব করে সে।
পরদিন সে মা-বাবার অনুমতি ছাড়াই টিউশন-এর অজুহাতে বেরিয়ে পড়ে। অটো নিয়ে পৌঁছে যায় সেই ঠিকানায়। খুঁজতে খুঁজতে দেখে, একটা ছোটো একতলা বাড়ি, বারান্দায় তালা। পাশের এক বৃদ্ধ বলল, “ওখানে তো আগে কেউ থাকত, এখন অনেকদিন বন্ধ। এক যুবক ভাড়া নিয়েছিল বছর দশেক আগে, তারপর… একটা সন্ধ্যায় আর ফেরেনি।”
“তার নাম কি ছিল?”—রিয়া জিজ্ঞেস করে।
“রবি। একটা কাগজে কাজ করত শুনেছি। খুব চুপচাপ ছেলেটা ছিল।”
রিয়া যেন পাথর হয়ে যায়। তাহলে রবি, মালিনীর প্রেমিক, হয়তো কিছু জানত। কিংবা… তাকেও চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছে?
সে ফিরে আসে বাড়ি। কিন্তু রাতে কিছু একটার গন্ধ তার নাক টানে—পুড়তে থাকা কিছু… না, পুড়তে থাকা কাগজ! সে ছুটে যায় বারান্দার পাশে, দেখে তার নোটবুকের একটা পৃষ্ঠা অদ্ভুতভাবে কালো হয়ে আছে, মাঝখানে ছাইরঙা দাগ, আর তার লেখাগুলো ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে।
একটা শব্দ তবুও পড়া যায়—“বিশু…”
সেই মুহূর্তে ঘরের বাতি নিভে যায়। জানালা খুলে যায় নিজে থেকেই। আর বাতাসে সেই ধূপের গন্ধ, আরও ঘন, যেন কাউকে এক মুহূর্তের জন্য দেখা যাচ্ছে না—তাকে শোনা যাচ্ছে।
“সে আমাকে থামিয়েছিল… সে বলেছিল, রবি আমাকে খুন করবে… আমি ভুল করেছিলাম…”
একটা মেয়েলি কণ্ঠ, ভারী, দুঃখভরা, কিন্তু ভেসে আসছে দেওয়ালের দিক থেকে, যেন দেওয়ালেই কোনো কণ্ঠ আটকানো আছে।
রিয়া জানে এই বাড়ির ইটের মাঝখানে কেউ লুকিয়ে আছে। বা বলা যায়, কাউকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
ঘুম না আসা চোখে সে তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরের দিকে, যেখানে আজও সেই পুরনো ছাদ, পুরনো টিনের চাল, আর এক আধোছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে কেউ—যার গায়ে কোনও রঙ নেই, শুধু চোখে অভিমান, আর ঠোঁটে একটিমাত্র শব্দ, “শেষটা তুমি জানো না, রিয়া।”
ঘড়িতে তখন ঠিক ৩:১৭।
আর সেই মুহূর্তেই বারান্দায় রাখা ঘুড়িটা নিজে থেকেই উড়ে ওঠে জানালার দিকে। তার সুতো ছিঁড়ে যায়, আর দেয়ালের গায়ে ছায়ার মতো একটা দাগ পড়ে। দেখতে দেখতে সেটা রক্তের মতো গাঢ় হয়ে ওঠে। তার নিচে লেখা হয়, “সে ছিল আমার ভাই… আর সে আমাকেই শেষ করেছিল।”
রিয়া কেঁপে ওঠে। মালিনী নিজেই বলছে, কে তাকে ঠেলেছে।
বিশু।
কিন্তু কেন?
রিয়া জানে না এখনও। তবু সে জানে, উত্তর পাওয়া যাবে, আর সেই উত্তর ছড়িয়ে আছে এই দেয়ালের ফাঁকে, ছাদের কাঠের তলায়, আর পুরনো ঘুড়ির গায়ে লুকিয়ে থাকা আঘাতের চিহ্নে।
পর্ব ৬
রাতটা রিয়া আর ঘুমোতে পারেনি। মোমবাতির আলো নিভে যাওয়ার পরও সে জেগে ছিল, সেই দাগটা দেখছিল জানালার পাশে। দেয়ালে এখনও স্পষ্ট রক্তরঙা দাগ, যেটা কেউই দেখতে পাচ্ছে না—শুধু সে।
পরদিন সকালবেলা, রণদীপ আর পৌলমী যখন কাজে বেরিয়ে যায়, তখন রিয়া উঠে ছাদে যায় আবার। দিনের আলোতে ছাদটাকে নিরীহ আর সাধারণ লাগে, কিন্তু সে জানে রাতের ছাদ আলাদা, ছায়াদের ঘর।
সে খেয়াল করে, ছাদের এক কোণে কাঠের পাটাতনের ফাঁকে একটা পুরনো গর্ত। একদিন আগেও সেটা ছিল না, বা চোখে পড়েনি। সে হাঁটু মুড়ে বসে, কাঠ সরানোর চেষ্টা করে। প্রথমে কিছুই হয় না, তারপর পেরেকগুলো আলগা হয়ে আসে। কাঠের নিচে ধুলোবালির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটা লোহার বাক্স।
বাক্সটা খুব ভারী না, কিন্তু খোলার সময় তার গায়ে একটা ঝাঁজালো গন্ধ উঠে আসে—ধূপ, সুরকি আর পুরনো কাগজের মিশ্রণে একরকম মৃত সময়ের ঘ্রাণ। সে খুলে দেখে ভেতরে তিনটে জিনিস—
১. একটা পুরনো চিঠি,
২. একটা ছেঁড়া কানের দুল,
৩. একটা পুড়ে যাওয়া ফটো—যেখানে এক যুবক আর এক মেয়ে হাসছে, মেয়েটা মালিনী, ছেলেটার মুখটা কিছুটা অস্পষ্ট, তবু অনুমান করা যায়, রবি।
রিয়া চিঠিটা পড়ে—
“মালু, আমি আর পারছি না। তোর ভাইটা জানে, জানে আমি তোকে ভালোবাসি। কিন্তু তুই কিছু বলিস না কেন? তোর চোখে আমায় দেখিনি অনেকদিন। আজ ছাদে দেখা করব, না বললে আমি চলে যাব। আর যদি ও আসে… জানি না, কী হবে…
— রবি”
রিয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে আসে। তার মনে হচ্ছে, এ কেবল একটা প্রেমের ভাঙন নয়, বরং একটা পূর্ব পরিকল্পিত অন্যায়, যেটা ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে কুড়ি বছর ধরে।
সে মাকে কিছুই না বলে কেশব কাকার ঘর ধাক্কা দেয়।
“কাকু, বিশুদা এখন কোথায়?”
কেশব কিছুক্ষণ চুপ করে বলে, “গাড়ি চালাত। এখন রেটায়ার করে মালদায় থাকে। কেন খুঁজছিস?”
“আপনি কি জানেন, মালিনীকে কে ঠেলেছিল?”
কেশব কাকা মাথা নিচু করে বলেন, “আমি কিছুই বলিনি কারো। শুধু বলেছিলাম, বিশুদা আগে উঠেছিল ছাদে… তারপর রবি এল… কিন্তু মালিনী নিচে পড়ে গেল।”
“তাহলে আপনি জানেন, রবি তাকে ঠেলেনি?”—রিয়া জোর দিয়ে বলে।
“আমি শুধু জানি, মালিনীর চোখে সেইদিন ভয় ছিল… কিন্তু সেটা কার জন্য, কে জানে?”
রিয়া এবার স্থির করে, সে এই রহস্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামবে না। ঘরে ফিরে চিঠিগুলো গুছিয়ে রাখে, আর সেই কানের দুলটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে নেয়—একটা প্রতীক হিসেবে, যেন মালিনীর গল্প তার মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে।
সেই রাতে, জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সে ফিসফিস করে বলে, “মালিনী, আমি দেখেছি। আমি পড়েছি। আমি জানি, তুমি তাকে ভালোবাসতে। তুমি ঠকেছিলে।”
জানালার কাঁচে আবার সেই ছাপ। এবার পুরো হাতের ছাপ। একেবারে স্পষ্ট।
এবং দেওয়ালের গায়ে এবার শুধু এক লাইন লেখা—
“সত্য বলবে, না ভয় পাবে?”
রিয়া পেছন ফিরে চেয়ে দেখে, ঘরের দরজা একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে।
আর বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি।
তার শরীর নেই, শুধু চোখ।
দুটি চোখ, বিষণ্ণ, অথচ অগ্নিদৃষ্টিতে বলছে—
“তুই আমার কণ্ঠস্বর। শুনিস?”
পর্ব ৭
রিয়া ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে, তার বুকের ধুকপুকানি এত জোরে চলছে যে মনে হয়, পুরো বাড়িটাই হয়তো শুনতে পাবে। দরজা পুরোপুরি খোলা, আর বাইরে ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে নেই—একটা চোখ-মাত্র দৃশ্যমান, অথবা সেই চোখেই যেন সমস্ত মুখের রূপরেখা আঁকা।
রিয়া কিছু বলতে চায়, কিন্তু কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। তবু সেই চেয়েও ভয়ঙ্কর অনুভব—সে বুঝতে পারে, তার ভয়টা শুধুই নিজের নয়। কারও বুকের ভিতরে জমে থাকা বছর কুড়ির হতাশা, অভিমান আর চাপা কান্না যেন ঢুকে পড়ছে তার শরীরে।
ছায়াটা ধীরে ধীরে পেছনে সরতে থাকে, রিয়ার ঘরের বাইরে গিয়ে দেয়ালের দিকে এগিয়ে যায়। তার আঙুল, নরম, হিমেল, যেন বায়ুর ছোঁয়া—দেয়ালের ওপর আবার লিখে দেয়—
“সে আমাকে ভালোবাসত, কিন্তু বিশ্বাস করেনি।”
রিয়া এবার জোরে বলে ওঠে, “কে? তুমি কাকে বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলে? রবিকে?”
সেই মুহূর্তে ছায়া থেমে যায়। একটা গর্জনের মতো আওয়াজ হয় ঘরের মধ্যে—মেঝেতে থাকা ঘুড়িটা হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে ওঠে, কাগজের খসখস আওয়াজে জানালার কাঁচ কাঁপে, আর দরজা বন্ধ হয়ে যায় ঝড়ের মতো শব্দে।
তারপর নিস্তব্ধতা।
রিয়া দম নিয়ে ধীরে ধীরে ঘরের মেঝেতে বসে পড়ে। কিছুক্ষণের জন্য চারপাশে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে আসে, যেন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু জানালার কাঁচে আরও একটি দাগ—এইবার সম্পূর্ণ মুখাবয়ব, ধোঁয়ার মতো, হিমের মতো ছাপ—একটা মেয়ের মুখ।
মালিনী।
চোখ দুটি যেন ঠিক তার চোখের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। সেই চোখে লজ্জা, দুঃখ, ক্রোধ, কিন্তু তার থেকেও বেশি এককালের অনুচ্চারিত অনুরোধ।
রিয়া এবার নিজের নোটবুকে নতুন করে লেখে—
“যদি বিশু-ই ছিল খুনি, তবে রবি কোথায় গিয়েছিল?”
আর তখনই, মোবাইলের ইনবক্সে একটা অজানা নম্বর থেকে মেসেজ আসে—
“প্রমাণ নেই বলে কেউ দোষী হয় না, কিন্তু নীরবতা একটা অন্যরকম অপরাধ।”
রিয়া অবাক হয়ে যায়। নম্বরটা ট্রেস করতে পারে না, কিন্তু উত্তর দেয়—
“তুমি কে?”
কয়েক সেকেন্ড পর আসে আরেকটি উত্তর—
“আমি সেই প্রাক্তন সাংবাদিক, যে মালিনীর চিঠিগুলো আজও নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। সন্ধ্যায় দেখা করো কনক সিনেমার পেছনের রঙচঙে দেওয়ালটায়।”
রিয়া জানে, এটা রবি।
সে চুপচাপ মায়ের কাছে বলে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। পৌলমী কিছু সন্দেহ না করে ছেড়ে দেয়। কিন্তু রিয়ার মনে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—“যদি রবি এখনও বেঁচে থাকে, তবে সে এতদিন কোথায় ছিল?”
সন্ধ্যায় কনক সিনেমার পাশের গলি নিঃঝুম, রাস্তার আলো মিটমিট করে জ্বলছে। গলির শেষ মাথায় রঙচঙে একটা পুরনো দেয়াল, তার সামনে দাঁড়িয়ে এক ছায়ামূর্তি—কাঁধে ঝোলা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।
“তুমি রবি?”—রিয়া জিজ্ঞেস করে।
ছেলেটি তাকায়। তার চোখ লালচে, মুখ ক্লান্ত, কিন্তু তাতেই এক অদ্ভুত সত্যতার ছাপ।
“আমি তার কণ্ঠস্বরটা হারিয়ে ফেলেছিলাম, রিয়া,” সে বলে। “কিন্তু তুমি তাকে ফিরিয়ে এনেছ। এখন আমার পালা—তোমায় সব বলার।”
পর্ব ৮
রবির কণ্ঠস্বর ছিল কাঁপা, যেন বহু বছর গলার নিচে লুকিয়ে রাখা একটা নদী এক মুহূর্তে বাঁধভাঙা হয়ে পড়ছে।
“তুমি জানো, আমি পালিয়ে যাইনি, আমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।”
রিয়া চমকে ওঠে। “মানে?”
রবি নিচু গলায় বলে, “মালিনীর মৃত্যুর পরে আমি সবকিছু বলতে চেয়েছিলাম—পুলিশ, পাড়া, এমনকি কাগজের রিপোর্টারদের। কিন্তু বিশু… সে তখন এলাকার রাজনৈতিক নেতাদের কাছের লোক ছিল। আমায় বদনাম করল, বলল আমি ওকে ছাদে ডাকতাম, মানসিকভাবে নির্যাতন করতাম।”
“তুমি করেছিলে?”—রিয়া সরাসরি জিজ্ঞেস করে।
রবি মাথা নাড়ে, চোখে জল। “মালিনী আমাকে একবারও বলেনি সে ভয় পাচ্ছে। বরং ওকে আমি একবার বলেছিলাম, ‘চলে যাই দুজনে শহর ছেড়ে।’ কিন্তু ওর ভাই ছিল ওর পৃথিবী। বিশ্বাস করেছিল ভাই বোঝে, রক্ষা করবে।”
“আর?”—রিয়া থমথমে গলায় জানতে চায়।
“শেষ বিকেলে আমরা তিনজনই ছাদে ছিলাম। আমি গিয়েছিলাম মালিনীর সঙ্গে কথা বলতে। বিশু আগে থেকেই দাঁড়িয়ে ছিল। মালিনী কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ… বিশু বলল, ‘তুই আমার বোনের জীবন নষ্ট করছিস।’ আর তারপর ঠেলে দিল। আমি দৌড়ে ধরতে গিয়ে পারিনি। ও পড়ে গেল। আমি চিৎকার করেছিলাম। কিন্তু…”
“কেউ শুনল না,”—রিয়া ফিসফিস করে।
“হ্যাঁ,” রবি মাথা নাড়ে, “আর তারপর পুলিশ এলো, বিশু বলল—আমি ধাক্কা দিয়েছি। আমার কেউ ছিল না পাশে।”
“তুমি পালালে?”
“না,” সে গলা শক্ত করে বলে, “আমাকে বলা হয়েছিল, যদি আমি সরে না যাই, তবে আমারও সেই ছাদের কাহিনী হবে। আমি চলে গিয়েছিলাম মালদায়, নাম পাল্টে থাকতাম। কিন্তু প্রতিরাতেই আমি মালিনীর সেই চোখ দেখি—যেটা পড়ে যাচ্ছিলেও বিশ্বাস করেছিল, আমি তাকে ধরতে পারব।”
রিয়ার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এতদিন পরে, এই টুকরো সত্য এতটাই ভারী লাগে যে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
“তুমি এখন কী চাও?”—সে বলে।
রবি সোজা চোখে তাকায়, “তুমি তাকে খুঁজে পেয়েছ। মালিনী ফিরে এসেছে তোমার মধ্যে। এখন তোমাকে বলতে হবে ওর হয়ে—সত্যটা সবাইকে।”
“কিন্তু প্রমাণ?”—রিয়া জিজ্ঞেস করে।
রবি কাঁধ থেকে একটা পুরনো চিঠির খাম বের করে দেয়। “এইটা ওর শেষ চিঠি আমাকে লেখা, যেটা কেউ দেখেনি। লিখেছিল, ‘বিশু আমাকে বোঝে না। তুমি আমার একমাত্র ঠিকানা।’”
রিয়া চিঠিটা হাতে নিয়ে ভাবে, এই চিঠি যদি জনসমক্ষে আনা যায়, তবে সত্যটা আলো পাবে।
“তুমি এবার ফিরবে?”—সে জিজ্ঞেস করে।
রবি হাসে না, শুধু বলে, “যেদিন সত্যি ঘুড়ির মতো খোলা আকাশে ওড়ে, সেদিন আমার ফেরাও হবে। এখন তুমি ওড়াও ঘুড়িটা। জানালার ওপাশে যে অপেক্ষা করছে, তার মন শান্ত করো।”
সেই রাতটা অন্যরকম। রিয়া ছাদে ওঠে, লাল ঘুড়িটা নিয়ে। হাতে মালিনীর কানের দুল, আর বুকের মধ্যে প্রতিজ্ঞা।
পৌলমী জানে না কেন মেয়ে আজ ঘরে নেই। কিন্তু ঘরের জানালার পাশে এসে সে দেখে, আকাশে একটা লাল ঘুড়ি ভেসে উঠেছে—উড়ছে ধীরে ধীরে, এক অদৃশ্য বাতাসে। আর তার নিচে রিয়া দাঁড়িয়ে, চোখ বন্ধ করে যেন কারও সঙ্গে কথা বলছে।
আকাশের এক প্রান্তে যেন একটি ছায়া—একটা মেয়ে, মাথায় লাল টিপ, হাতে ঘুড়ির সুতো। সে তাকিয়ে আছে নিচে, তার চোখে এবার আর কোনো অভিমান নেই—শুধু শান্তি।
পর্ব ৯
লাল ঘুড়িটা আকাশে ওড়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার সুতো যেন ধরা নেই শুধু রিয়ার হাতে—ধরা আছে এক মৃত কণ্ঠের, এক চাপা দীর্ঘশ্বাসের, আর কুড়ি বছরের অন্ধকারে ঢেকে রাখা চোখের।
রিয়া জানে, মালিনীর আত্মা শুধু প্রতিশোধ চায় না। সে চায় শোনা হোক তার শেষ সত্যটা। সেই যে ভালোবাসার কথা মুখে আনতে পারেনি, সেই যে বিশ্বাসের অপমান হয়েছিল এক ভাইয়ের হাতে, সেই কথাগুলো যেন বাতাসে ফিরে ফিরে আসছে।
পরদিন স্কুল কামাই করে রিয়া পৌলমীকে বলে, “মা, তোমার সঙ্গে একটা জায়গায় যেতে হবে।”
“কোথায়?”—পৌলমী অবাক হয়।
“থানায়। আমাকে একটা FIR করতে হবে।”
থানার অফিসাররা প্রথমে পাত্তা দেয় না। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে বলছে কুড়ি বছরের পুরনো এক মেয়ের আত্মহত্যা আদতে খুন ছিল। কিন্তু যখন রিয়া রবির হাতে লেখা চিঠিটা, পুরনো ছবি, কানের দুল, এবং লুকিয়ে রাখা নোটবুক থেকে ছাদের নকশা জমা দেয়, তখন একজন সিনিয়র অফিসার কেসটা খুলে দেখতে রাজি হন।
“তুমি বলছো, তুমি ওকে দেখেছ?”—তিনি জিজ্ঞেস করেন।
“হ্যাঁ,” রিয়া বলে। “কিন্তু চোখে না। অনুভবে। ঘরে ঘরে ওর গল্প লুকিয়ে আছে।”
“আর খুন করেছে তার ভাই?”—তিনি সন্দেহভরে বলেন।
“আপনারা যদি বিশ্বাস না করেন, তাহলে আজও একজন খুনি আড়ালে বেঁচে থাকবে।”
থানার লোকেরা বলল, “ঠিক আছে, আমরা নতুন করে ইনকোয়ারি শুরু করবো। কিন্তু তুমি এখন এসব ভুলে পড়াশোনায় মন দাও।”
রিয়া মাথা নাড়ে। তার কাজ এখানেই শেষ না।
সেই রাতে সে আবার ছাদে যায়। এবার সে হাতে ধরে ল্যাম্প, ব্যাগে করে আনে সেই লোহার বাক্সটা। ধুলো আর কাঠের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে পায় কিছু পুরনো দাগ—যেন সেখানে একবার রক্ত লেগেছিল, যেটা কালের ভারে ফিকে হয়ে গেছে।
ঠিক সেই সময় হাওয়ার দমকা আসে। ঘরের জানালায় ধাক্কা লাগে। নিচে রান্নাঘরের কাঁচ ভেঙে যায় হঠাৎ। আর ছাদের আকাশে আবার সেই ছায়া দেখা যায়—এইবার সে হাঁটছে, ধীরে ধীরে কাছে আসছে।
রিয়া কাঁপে না। সে বলে, “মালিনী, আমি সব করে ফেলেছি। তারা শুনবে এবার। তুমি শান্তি পাও।”
ছায়া থেমে যায়। তার চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি, যেন অনেকদিন পর কেউ তার কথা শোনার সাহস দেখাল। সে ঘুড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর হাত তুলে ইশারা করে—একবার, শেষবারের মতো।
আর তারপর সে মিলিয়ে যায় কুয়াশার মধ্যে।
রিয়া ধীরে ধীরে নিচে নামে। পৌলমী অপেক্ষা করছিল।
“তুই ঠিক করলি, তোর জীবন নিয়ে ওর জীবন জোড়া দিবি?”—সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে।
রিয়া চুপ করে থাকে। তার মনে হয়, মালিনী তার ভিতরে ঢুকে পড়েছে—না আত্মা হয়ে, বরং গল্প হয়ে।
ঘর ফিরে এসে সে নোটবুক খুলে লেখে—
“একটা ঘুড়ি ছিল, যেটা কেবল বাতাসে উড়তে চাইত না। সে চেয়েছিল কেউ তার সুতোটা ধরে রাখুক। কিন্তু বাতাসের বিশ্বাস করতে গিয়ে সে হারিয়ে ফেলেছিল তার নিজের মাটি।”
আর নিচে লেখে—
“শেষ কথা বলেছিলাম আমি, এবার লেখা শুরু হোক তোমাদের।”
পর্ব ১০
পৌলমী এই কদিনে নিজের মেয়েকে যেন চিনতে পারছিল না। রিয়া এখন আর কিশোরী নেই—সে যেন এক বয়স্ক আত্মা, যে বহু যন্ত্রণার সাক্ষী হয়ে উঠেছে। সে যেভাবে ধীরে ধীরে প্রতিটি প্রমাণ একত্র করেছে, প্রতিটি টুকরো তথ্যের ভেতর থেকে সত্যটাকে তুলে এনেছে—তা দেখলে পৌলমীর ভিতরেও কাঁপুনি ধরে।
থানায় নতুন করে তদন্ত শুরু হয়েছে। পুলিশ এখন বিশুদার খোঁজে মালদায় গেছে। রিয়া জানে, একদিন না একদিন ও ধরা পড়বেই। সত্য চাপা পড়লেও ছায়া হয়ে থেকে যায়। আর ছায়ারা কখনো ভুলে না।
সেই দিন বিকেলে আবার সেই দোকানে যায় রিয়া—‘সন্ধ্যাবাতি’। বৃদ্ধা এখনও আছেন, গায়ে মাটির রঙের শাল, চোখে সেই পুরনো ধোঁয়াটে চশমা।
“তুমি ফিরে এলে,”—বৃদ্ধা বলেন।
“শেষ কথা বলার আগে ওর কাছে আসা দরকার,”—রিয়া বলে।
বৃদ্ধা এক টুকরো কাপড়ের পুঁটলি এগিয়ে দেন। ভেতরে একটা ছোট খাতা—ছেঁড়া, মলিন, কিন্তু প্রতিটি পাতায় মালিনীর লেখা।
“এটা কেউ জানত না,” বৃদ্ধা বলেন, “ও লিখত, চুপিচুপি। প্রতিদিন। ঘুড়ির গায়ে যে গল্প থাকত, সেটা জন্মাত এখানেই।”
রিয়া খাতা খুলে পড়ে—
“আজ দাদা খুব রাগ করল। বলল, রবি আমার জন্য বিপদ। আমি চুপ করে থাকলাম। যদি বলতাম, তবে বুঝত? আমাকে যে কেউই বোঝে না, শুধু রবি ছাড়া…”
আরেক পাতায়—
“আমি চাই রবি পালিয়ে যাক। আমাকে নিয়ে না, শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে ফেলুক। আমার ভরসা, যদি আমি না থাকি, সে লিখবে আমার হয়ে।”
রিয়া চোখ বন্ধ করে খাতাটা বুকে চেপে ধরে। এই লেখাগুলোই মালিনীর শেষ চিহ্ন—তার আত্মার, তার সত্যির।
পরদিন, সে স্কুলে গিয়ে ইংরেজির প্রজেক্ট হিসেবে এক প্রবন্ধ জমা দেয়—“Ghosts Are Not Always Dead”।
শিক্ষিকা অবাক হয়ে যান। প্রবন্ধে রিয়া লিখেছে—
“ভূত মানে শুধু মরা মানুষ নয়। অনেক সময় কিছু ঘটনা, কিছু চাপা সত্য, কিছু না বলা অনুভব ঘুরে ফিরে বেড়ায় আমাদের চারপাশে—মাথার ভেতরে, জানালার গায়ে, পুরনো দেওয়ালে, এমনকি মেঝেতে পড়ে থাকা একটা ঘুড়ির কাগজেও।”
সেই সন্ধ্যায়, থানা থেকে খবর আসে—বিশুদা ধরা পড়েছে। তার বয়ানে অসংলগ্নতা, তার মুখে আতঙ্ক। পুলিশ জানায়, সে স্বীকার করেছে, ঝগড়া হয়েছিল, সে রাগে ঠেলে দেয় মালিনীকে।
পৌলমী ফোন রেখে রিয়াকে জড়িয়ে ধরে। “তুই পারলি, মা… তুই সত্যিটাকে জিতিয়ে আনলি।”
রিয়া কিছু বলে না। সে জানে, এই জয় শুধু তার নয়। এটা মালিনীর গল্পের শেষ অধ্যায়, যেটা আজ বলা হল।
রাতে, জানালার পাশে বসে, রিয়া চুপচাপ সেই ঘুড়িটার দিকে তাকায়। সেটা এখন নিস্তব্ধ, বাতাস নেই, হাওয়া থেমে গেছে।
কিন্তু হঠাৎ একটা মৃদু দোলন লাগে কাগজে। আর জানালার কাঁচে জলবিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়ে একটা শব্দ “ধন্যবাদ।”
পর্ব ১১
সেদিন রাতে আকাশটা ছিল নির্লিপ্ত, যেন সব গল্প শেষ হয়েছে বলে একটু শূন্য লাগছিল চারপাশে। রিয়া জানালার পাশে বসে ছিল, বুকের মধ্যে লাল ঘুড়িটা চেপে ধরে। সেটা আর ওড়ে না, তার সুতো ছিঁড়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু সেই ছেঁড়া সুতোতেই যেন বাঁধা পড়ে ছিল একটি আত্মা, একটি অসমাপ্ত বেঁচে থাকা।
রিয়া ধীরে ধীরে খাতার পাতা উল্টাচ্ছিল। মালিনীর প্রতিটি লেখা যেন তার নিজের কণ্ঠে মিশে গেছে এখন।
“একদিন কেউ হয়তো আমার কথা বলবে। আমার গল্প শুনবে। আমার নামে ঘুড়ি ওড়াবে। সেদিন আমি সত্যিই শান্ত হব।”
সেই রাতে সে লেখে—
“প্রিয় মালিনী,
তোমার জন্য এই শহরে একজন দাঁড়িয়েছিল, একটা মেয়ে, যে জানালার কাঁচে তোমার ছায়া দেখেছিল, ঘুড়ির সুতোয় তোমার কান্না শুনেছিল, আর মেঝের ধুলোয় তোমার পায়ের ছাপ খুঁজেছিল। আজ তোমার গল্প বলা শেষ হয়েছে। এবার তুমি বিশ্রাম নাও।”
আর তার নিচে সে লেখে—
“তোমার গল্পটা আমি শেষ করলাম না, আমি কেবল তোমার লেখা পাতাগুলো পড়ে ফেললাম উচ্চস্বরে। যাতে সবাই শুনতে পারে।”
সেই মুহূর্তে জানালার বাইরে একটা ধোঁয়া উঠলো—একটা ছায়া, হালকা, টুকটুকে টিপ, সাদা জামা, মাথার চুল খোলা। সে দাঁড়িয়ে, চোখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। তার ঠোঁটে হাসি, চোখে জল নেই—শুধু আলো।
মালিনী।
সে আর কিছু বলে না, শুধু একবার মাথা ঝাঁকায় ধীরে। তারপর সে পেছনে ঘোরে, হাওয়ার ভেতর ভেসে যায়, মিশে যায় চাঁদের আলোয়।
সেই সঙ্গে জানালার কাঁচে থাকা সব দাগ মুছে যায়। ঘুড়িটার রঙ ফিকে হয়ে আসে। আর রিয়া জানে, সে চলে গেছে।
পৌলমী এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। “তুই জানিস, তোর জন্য একটা আত্মা মুক্তি পেল।”
রিয়া বলে, “না মা, ও নিজেই মুক্তি পেতে চেয়েছিল। আমি শুধু ওর গল্পটা লিখে দিয়েছি।”
আর তখনই ভেতরের ঘর থেকে একটা আওয়াজ—মেঝের ওপর কিছু পড়ল যেন।
রিয়া ছুটে গিয়ে দেখে, সেই পুরনো বাক্সটা। এককোণায় জমে থাকা ধুলো সরে গেছে, আর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি ছোট্ট পুঁটলি—ভিতরে একজোড়া ছোট কাঠের পাখা, ঘুড়ির সাথে জুড়ে দেওয়ার মতো।
রিয়া বুঝে যায়—শেষ উড়ান এখনো বাকি।
সন্ধ্যায়, সে একা ছাদে ওঠে। ফিকে লাল ঘুড়িটার সঙ্গে সেই কাঠের পাখা জুড়ে দেয়, আর হালকা বাতাসে ছেড়ে দেয় আকাশে।
ঘুড়িটা এবার আর তেমন উড়ে না, কিন্তু একবার ছুঁয়ে যায় আকাশের নীল সীমারেখা, তারপর ধীরে ধীরে ভেসে পড়ে এক অচেনা আলোয়, যেন কে তাকে নিয়ে নিচ্ছে।
তখনই রিয়া ফিসফিস করে বলে—
“ভালো থেকো, মালিনী। এই শহর তোমার নাম জানবে না, কিন্তু তোমার কান্না আর উড়ে আসবে না কোনো জানালায়। কারণ এখন তুমি কোথাও নয়—তুমি মুক্ত।”
একটা গল্প শেষ হয়। কিন্তু তার ছায়া থেকে যায়।
একটা লাল ঘুড়ির মতো।
আকাশে।
চুপচাপ।
— সমাপ্ত —