তিথি বসু
পর্ব ১: তাবিজওয়ালা ঘর
শহরের কোলাহলের মাঝখানে, যেখান থেকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঝাপসা দেখা যায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে চৌরঙ্গীর একটি পুরনো হোটেল—‘হোটেল সম্রাট’। বাইরে থেকে দেখলে আধুনিক মনে হলেও ভিতরে ঢুকলেই যেন সময় পিছিয়ে যায়—ফিকে আলো, সাদা কাঠের জানালা, আর মোটা মোটা পর্দা যা আলো ঢুকতে দেয় না। সেই হোটেলের ৩১৫ নম্বর ঘর থেকে পাওয়া গেল এক মৃতদেহ।
পুলিশ এসে দরজা ভেঙে দেখে—একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ খাটে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। ঘরের ভিতর অদ্ভুত একটা গন্ধ—মাটির, ধূপের, আর যেন ভেজা ছাইয়ের গন্ধ। মৃতদেহের পাশে পড়ে ছিল একটি তাবিজ—লাল সুতোয় বাঁধা, তাতে শিকল দিয়ে আটকানো একটা ক্ষুদ্র রৌপ্য বাক্স।
এই খুনের তদন্তে ডাক পড়ল অভিজিৎ লাহার।
সে এখন আর সরকারি গোয়েন্দা নয়। ছ’বছর আগেই রিজাইন করে দিয়েছে এক ভয়ংকর কেসের পর। এখন কলেজ স্ট্রিটের এক ছোট লাইব্রেরিতে কাজ করে। তবু যখন কেসটা শহরের হূদয়ে ঘটে আর ঘরে পাওয়া যায় এমন তাবিজ—তখন পুলিশই অভিজিৎ-এর দরজায় কড়া নাড়ে।
সঙ্গে এসেছিল রোহিণী ব্যানার্জি—এক ফরেনসিক ইন্টার্ন। বয়স বাইশ-তেইশ, কিন্তু চোখে তীক্ষ্ণতা। অভিজিৎ প্রথমে কেসটা নিতে চায়নি। কিন্তু তাবিজটার ছবি দেখামাত্র তার মুখটা খানিক শুকিয়ে যায়। সে ফিসফিস করে বলে,
“এটা শুধু তাবিজ নয়। এটা… সিলমোহর।”
“কিসের সিলমোহর?”—রোহিণীর প্রশ্নে সে শুধু বলে, “অমাবস্যার।”
তদন্ত শুরু হয় হোটেল থেকে।
ঘর ৩১৫—চুপচাপ, কিন্তু যেন কিছু বলছে। দেয়ালে একটা ফ্রেমে কালো কাপড়। খাটের নিচে খোঁজ করে পাওয়া গেল পোড়া কাঠকয়লার দাগ। রোহিণী ছবি তোলে, সোয়াব নেয়।
“মৃতদেহের নাম অরূপ গুহ,” পুলিশ জানায়, “ট্র্যাভেল রাইটার। একা এসেছিলেন, তৃতীয় দিন ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে স্টাফ মৃতদেহ দেখে। ঘরের দরজা ভেতর থেকে লক ছিল।”
“সুইসাইডের মতো লাগছে না,” রোহিণী ফিসফিস করে বলে।
অভিজিৎ ছাদে ওঠে। ছাদের এক কোণে ধুলোর মাঝে বসে আছে এক ভিখিরি—সাদা ধুতি, উল্কি আঁকা কপালে, হাতে কাঠের মালা। চোখ বন্ধ করে বোলছে, “অমাবস্যা… অমাবস্যার আগুন…”
অভিজিৎ তার সামনে দাঁড়ালে সে চোখ মেলে।
“তুই আবার ফিরলি, গোয়েন্দাবাবু?”
রোহিণী অবাক, “আপনি চিনেছেন?”
“ও আমায় চেনে, আমি ওকে। ওর যাত্রা এখান থেকেই শুরু হয়েছিল, ছ’বছর আগে। আর এবার শেষও এখানেই হবে।”
“কে আপনি?”
“আমি? আমি চৌরঙ্গীর সাধু। আগে ছিলাম গায়ক, এখন তান্ত্রিকের ছায়া। তোদের এই শহর জানে না, কীভাবে তাবিজে লুকিয়ে রাখা যায় অভিশাপ।”
অভিজিৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
“এই তাবিজটা আমি আগে দেখেছি,” সে বলে। “ছ’বছর আগে যে সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছিল ভবানীপুর থেকে, তার বাড়ির জানালায় একইরকম তাবিজ পাওয়া গেছিল। তারপর আরও দুটো কেসে… সব অমাবস্যার সময়।”
“তার মানে খুনের সঙ্গে তন্ত্রজগৎ জড়িত?” রোহিণী জিজ্ঞেস করে।
“তন্ত্র নয়,” অভিজিৎ সজোরে বলে ওঠে, “তন্ত্রের অপব্যবহার। এই তাবিজ সিল করে কিছু একটা। যা খোলা উচিত নয়।”
“তবে কে খোলার চেষ্টা করছে?”
সাধু এবার উঠে দাঁড়ায়। বাতাসে তার ধুতি উড়তে থাকে যেন ছায়া।
“তোমরা দেখছ একটা খুন। আমি দেখছি এক ডাক।
যখন তিনটি তাবিজ খোলে, তখন কলকাতার আকাশ বদলায়।
এখন একটাই খোলা হয়েছে। দুটো বাকি।”
“আর তারপর?”
“তারপর অমাবস্যা আসবে।
অন্ধকার নামবে।
এ শহর স্মৃতি হারাবে।
কারণ তাবিজ যখন খোলে, স্মৃতি চলে যায়।”
সেই রাতে, লাইব্রেরিতে ফিরে অভিজিৎ তার পুরনো খাতা খুলে বসে। প্রতিটি কেস, প্রতিটি তাবিজের ছবি, সেই সাংবাদিক নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট, পত্রিকায় বেরোনো অদ্ভুত বিজ্ঞাপন—সব খুঁটিয়ে দেখে।
এক জায়গায় থেমে যায়।
একটি স্কেচ—একটি ঘর, যেখানে তিনটি তাবিজ দেওয়া রয়েছে তিন কোণে। ঠিক যেমন রক্ষাকবচ দেওয়া হয় কোনো কিছু আটকে রাখার জন্য।
“ঘরটা কোথায়?”
সে জানে, যদি সে এই ঘরের অবস্থান খুঁজে বের করতে পারে, তবে পরের খুন আটকানো সম্ভব।
কিন্তু সময় খুব কম।
কারণ, ক্যালেন্ডারে সে চোখ রাখতেই দেখে—আর মাত্র সাতদিন বাকি অমাবস্যা।
পর্ব ২: অমাবস্যার পাণ্ডুলিপি
কলেজ স্ট্রিটের বুকের ভেতর ছায়া ঢাকা এক গলি, যেটার নাম অধিকাংশ মানুষ ভুলেই গেছে—সুধীর ঘোষ লেন। সেখানেই একটা পুরনো বইয়ের দোকান আছে, নাম—‘রুদ্র গ্রন্থবিতান’। তামার ধুলো জমে থাকা সাইনবোর্ড আর ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা বইয়ের স্তূপ, যেন কত শতাব্দীর ইতিহাস সেখানে জমা আছে। এই দোকানে অভিজিৎ এসেছে বহুবার, কিন্তু আজ তার চোখে এক অদ্ভুত উন্মত্ততা।
রোহিণী তার পেছনে পেছনে হাঁটছিল, কৌতূহলী।
“তুমি কি নিশ্চিত, এখানেই পাওয়া যাবে?”
“যা খুঁজছি, সেটা অন্য কোথাও থাকবে না। এখানে তন্ত্রবিদ্যার সব অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি আছে—বিক্রি হয় না, শুধু দেখার অনুমতি মেলে। দোকানের মালিক এক সময় কাশ্মীরের শৈবতান্ত্রিক ছিলেন।”
ভিতরে বসে থাকা বৃদ্ধ মানুষটি কাঁধে চাদর জড়ানো, সাদা চোখে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার চোখ দেখে বুঝতে পারছি, পুরোনো সেই ‘তাবিজের ঘর’-এর কথা মনে পড়ে গেছে।”
“আপনার কাছে অমাবস্যার ত্রিকোণ-পাণ্ডুলিপি আছে?”
বৃদ্ধ হেসে উঠলেন।
“যে নামটা জানে, তার হাতে না দিলে অভিশাপ নামে। তুমি জানো সেই নাম?”
“তিন কোণে তিনটি তাবিজ—মাতৃতন্ত্র, ভূততন্ত্র, আর রক্ততন্ত্র।
এই ত্রয়ীর সীমানার মাঝে যে ঘর, সেখানেই আটকে রাখা হয় ‘স্মৃতি’। সেই স্মৃতির নাম… কালিকলেখা।”
দোকানটি কেঁপে উঠল যেন। বৃদ্ধ উঠে গিয়ে একটি কাঠের বক্স বের করলেন। ভিতরে কাপড়ে মোড়ানো এক পাণ্ডুলিপি।
“নাও। কিন্তু সাবধানে খোলো। এর ভেতরে শুধু তত্ত্ব নয়, অভিশাপও ঘুমিয়ে আছে।”
অভিজিৎ সেদিন রাতেই রোহিণীর সঙ্গে ফিরে যায় তার গড়িয়াহাটের ছোট্ট ফ্ল্যাটে। পাণ্ডুলিপিটি বিছানায় রেখে দু’জন চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। যেন বুঝতে চাইছে, তারা যা খুলতে চলেছে, তা মানুষিকতার বাইরের কিছু।
“আমি বিশ্বাস করি না এসব কুসংস্কারে,” রোহিণী বলে।
“এটা কুসংস্কার নয়। এটা এক ধরনের প্রযুক্তি—শুধু বৈজ্ঞানিক ভাষায় প্রকাশ হয়নি।”
পাণ্ডুলিপির পাতা খুলতেই ধূপের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে। প্রথম পাতায় লেখা:
“যাহারা স্মৃতি সংরক্ষণ করিবে, তাহারা উন্মাদ হইবে।
তবুও স্মৃতির ঘর ভাঙিলে, সময় বিপরীত দিকে চলিবে।”
রোহিণী পাতায় পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখছিল। হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেল।
একটি চিত্র—একটি ঘর, যার তিন কোণে তিনটি চিহ্ন আঁকা। এক কোণে লাল রক্তবিন্দু, এক কোণে নারীর গর্ভ থেকে প্রসবিত কণ্যা, আর এক কোণে শবদেহের উপর মাটি।
“এই তিন কোণ তৈরি করে এক ত্রিকোণ—স্মৃতির রক্ষাকবচ।
এই ঘরের মাঝেই আটকে রাখা হয় সেই সকল স্মৃতি যা মানুষ ভুলে যেতে চায়—পাপ, প্রতিহিংসা, দুর্ভাগ্য।”
অভিজিৎ ফিসফিস করে বলে,
“আর যদি কেউ তাবিজ তিনটি খুলে ফেলে, তাহলে সেই স্মৃতিরা আবার জীবিত হয়ে ওঠে। তারা শুধু ফিরে আসে না, প্রতিশোধও নেয়।”
“তাহলে খুনটা… একরকম স্মৃতি হত্যার মধ্য দিয়ে পুনরুত্থানের চেষ্টা?”
ঠিক তখনই রোহিণীর ফোন বেজে ওঠে। মৃত অরূপ গুহর ফরেনসিক রিপোর্ট এসেছে।
মৃত্যুর কারণ: মস্তিষ্কের অজ্ঞাত রক্তক্ষরণ।
দেহে বাইরের আঘাতের চিহ্ন নেই।
তবে হৃদপিন্ডের চারপাশে এক অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া গেছে—চূর্ণকরা ভুসো ধূপ, যা সাধারণত শ্মশানে ব্যবহার হয়।
“অর্থাৎ ওর মস্তিষ্ক নিজে নিজেই ফেটে গিয়েছিল,” রোহিণী বলে। “কিন্তু বিজ্ঞান এটা ব্যাখ্যা করতে পারে না।”
“কারণ এটা একটা অভ্যন্তরীণ স্মৃতি বিস্ফোরণ,” অভিজিৎ গম্ভীর।
“অরূপ গুহ একসময় ভবানীপুরে থাকত। আমি খুঁজে দেখেছি—সে সেই সাংবাদিকের বন্ধু ছিল যে ছ’বছর আগে নিখোঁজ হয়েছিল। তার নাম ছিল সৌম্যকেতু পাল।”
“আর তৃতীয় তাবিজ?”
“ভবিষ্যতের খুন… যা এখনো হয়নি। কিন্তু হবে। আমরা যদি আগে না পাই।”
পরদিন সকালে তারা ছুটে যায় ভবানীপুরের সেই পুরনো দোতলা বাড়িতে—সৌম্যকেতুর শেষ বাসস্থান। এখন সেটি বন্ধ, গেট তালাবদ্ধ। এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী জানালেন,
“ওর মা তো বলতেন, ছেলে হঠাৎ করে রাত্তিরে বাড়ি ফিরত না। তারপর একদিন অমাবস্যা রাতে, তার ঘরে পাওয়া গিয়েছিল এক গাদা পুঁথি আর ভাঙা আয়না।”
ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে অভিজিৎ দেখল—আলনায় এখনো সেই তাবিজ ঝুলছে। কালো সুতোয় বাঁধা, ধুলো ধরা।
“তিনটি তাবিজের দুটি আমরা খুঁজে পেয়েছি। এখন তৃতীয়টা কোথায়?”
ঠিক তখনই পেছন থেকে চিৎকার:
“এই জায়গা থেকে সরে যান!”
একজন যুবক ছুটে এসে বলে, “এই বাড়িটা আজ নিলামে উঠেছে। এক কোম্পানি কিনছে। আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।”
রোহিণী জিজ্ঞেস করল, “কোন কোম্পানি?”
উত্তর আসে—“আধিকারী কনস্ট্রাকশনস।”
অভিজিৎ মুহূর্তেই থমকে যায়। আধিকারী—সেই পরিবার যারা এক সময় রাজস্থানের কালী পীঠে নিষিদ্ধ ‘রক্ততন্ত্র’ চালাত। তাদের ইতিহাস বহু পুরনো।
“ওরা শহরের তৃতীয় তাবিজের অবস্থান জানে।”
“তাহলে এবার কী হবে?”
“আমাদের কাছে সাতদিন সময় আছে। তার আগে তিনটি তাবিজ একসাথে খুলে গেলে…”
রোহিণী ভয় পেয়ে বলে, “কি হবে তাহলে?”
“তাহলে এই শহরের স্মৃতি ভেঙে যাবে।
মৃতেরা ফিরে আসবে।
আমরা কেউ চিনতে পারব না নিজেদের।
এবং… আমরা ভুলে যাব কাকে ভালোবাসতাম, কাকে ঘৃণা করতাম।”
রোহিণীর ঠোঁট শুকিয়ে আসে।
“তাহলে, আমাদের পরবর্তী গন্তব্য?”
অভিজিৎ চোয়াল শক্ত করে বলে,
“আধিকারী পরিবারের গোপন আখড়া—মাঠারঘাটের প্রাচীন শ্মশান।
সেখানেই লুকানো আছে শেষ তাবিজ।
স্মৃতির যুদ্ধে এবার শহর রক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।”
পর্ব ৩: মাঠারঘাটের আগুন
মাঠারঘাট—কলকাতার মানচিত্রে এখন আর কেউ খোঁজে না এই নামটা। গঙ্গার এক প্রাচীন উপশাখার ধারে, শিয়ালদহ স্টেশন থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এক সময় এখানে ছিল মহাশ্মশান। এখন শুধু কিছু ভাঙাচোরা ঘাট, দাউদাউ আগুনের বদলে পড়ে থাকা সিঁদুর-মাটি-মাছিরা, আর মাঝেমধ্যে ভোররাতে জ্বলে ওঠা ধূপের গন্ধ।
অভিজিৎ আর রোহিণী পৌঁছাল ভোর পাঁচটায়। গঙ্গার কুয়াশা যেন ঘন কালো মেঘে ঢেকে রেখেছে শ্মশানের ধারে সেই পুরনো আখড়াটা।
“এইখানেই ছিল আধিকারী পরিবারে এক গোপন ঘর। যেটা পণ্ডিত ত্রৈলোক্যনাথ অধিকারী বানিয়েছিলেন—কথিত আছে, তিনিই প্রথম এই তাবিজের রক্ষণবিদ্যা তৈরি করেন, যাতে ত্রিকোণ সম্পূর্ণ হয় না,” অভিজিৎ বলল।
“তুমি কীভাবে জানলে?”
“ছ’বছর আগের সেই কেসে আমি যেটুকু পৌঁছেছিলাম, সেই অভিশপ্ত রাতে এই আখড়া ঘিরেই ঘটেছিল অদ্ভুত এক দাহক্রিয়া। মৃত ছিল না, তবুও রাতভর আগুন জ্বলেছিল। খবরের কাগজেও আসে না এমন কিছুর কথা।”
তারা যখন পুরনো ঘরের ধারে পৌঁছাল, তখন পুব আকাশে আলো ফুটেছে। ঘরটা যেন অর্ধেক মাটিতে বসে গেছে—ইট খসে পড়ছে, ভিতরে গাছের মূল ঢুকে গেছে। কিন্তু ঠিক মাঝখানে, মেঝের উপর তিন কোণের এক অদ্ভুত চিহ্ন আঁকা ছিল। এবং কেন্দ্রে রাখা ছিল কিছু একটা…
একটা তাবিজ।
তবে সেটা খোলা। সুতো ছেঁড়া, রূপার বাক্সে ধুলো আর কিছুমিছু ছাইয়ের চিহ্ন।
“শেষ তাবিজ খুলে গেছে…” রোহিণী ফিসফিস করে।
“মানে এখন অমাবস্যার রাতে যা ঘটবে, তা আর ঠেকানো যাবে না।”
ঠিক তখনই পাশের এক ঝোপের মধ্যে থেকে শব্দ এল—চুপচাপ হেঁটে এল এক লোক, বয়স ত্রিশ পেরিয়েছে, চোখে কালো সানগ্লাস, পরনে হালকা কুর্তা। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আপনারা অনেক আগেই চলে এসেছেন, গোয়েন্দাবাবু। খেলা এখন অন্য মাত্রায়। এখন শুধুই দর্শক থাকা যায়।”
“তুমি কে?” অভিজিৎ প্রশ্ন করল।
“আমার নাম অর্জুন অধিকারী। আধিকারী পরিবারের শেষ প্রতিনিধি। আমরা বিশ্বাস করি না তন্ত্রে, আমরা ব্যবহার করি। স্মৃতি রাখলে মানুষ দুর্বল হয়, ভুলে গেলে মানুষ ভয়ংকর হয়। আমরা শহরটাকে মুক্ত করছি… তার অতীত থেকে।”
রোহিণী জিজ্ঞেস করল, “তুমি তো খুনি?”
“না। আমি শুধু স্মৃতি অপসারণকারী। খুন করেছে তারা—যারা পাণ্ডুলিপির শব্দ গিলেছে। তারা এখন মানুষ নয়, স্মৃতির দাস। আর ওই তাবিজগুলি? ওগুলো ছিল শুধু সীল, দরজা খুলে দিয়েছে আমি।”
“কেন?”
অর্জুন হেসে বলে,
“কারণ এই শহর ভুলে গেছে কাকে ভালোবাসে, কাকে ঘৃণা করে। আমিই তাদের মনে করিয়ে দিচ্ছি, যেন তারা আবার একে অপরকে খুঁজে পায়। কিন্তু ভুলে যাওয়া লোকেদের ফিরিয়ে এনে, সবকিছু গুলিয়ে দিতে চাইছি। কারণ মানুষের ইতিহাসটাই হচ্ছে একটা ভুল বোঝাবুঝির মহাকাব্য।”
“তাহলে তোমার টার্গেট কে?” অভিজিৎ জোরে জিজ্ঞেস করে।
“তোমায়!” অর্জুন ঠান্ডা স্বরে বলে। “তুমি একমাত্র লোক, যে সব মনে রাখে। তোমার খাতার প্রতিটি পাতায় স্মৃতি বন্দী। তোমার ভেতরে আটকে আছে সেই ছ’বছর আগের কাহিনি। আজ সেই খাতা পুড়বে। আর তখন শহরের শেষ সচেতন মানুষটাও নিঃশেষ হবে।”
তারপর ঝট করে অর্জুন পকেট থেকে বের করল একটা তাবিজ—তৃতীয় রক্ততন্ত্র।
“তুমি এটা পুড়িয়ে ফেললে?”
“হ্যাঁ। এবং সেটার মধ্যেই বন্দী ছিল সেই স্মৃতি যা তোমায় এতদিন তাড়া করেছে। এখন তুমি ভুলে যাবে। আমি তোমায় সে সুযোগটা দিতে চাই—ভুলে যাও। না হলে, দেখবে যা তুমি কখনো দেখতে চাওনি।”
ঠিক তখনই পেছন থেকে চিৎকার—
“ফেলে দে ওটা, অর্জুন!”
ঘুম জড়ানো গলায় দাঁড়িয়ে চৌরঙ্গীর সেই সাধু। হাতে কাঁটার মালা, চোখে আগুন।
“তুই জানিস না, তিন তাবিজ একসাথে খুললে কী ঘটে।
এই শহরের বুকে যখন স্মৃতি ফিরে আসে, তখন মৃত্যুর সঙ্গে ফেরত আসে আগুন। এই আগুন কেউ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।”
অর্জুন কিছু বলার আগেই আকাশ কালো হতে শুরু করে। শ্মশানের ওপর ঝাপটে পড়ে অন্ধকার, যেন অমাবস্যা আগেই নেমে এসেছে।
তিনজনের চোখের সামনে দেখা গেল—পুরনো ঘরটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক অদ্ভুত ছায়া, শরীর নেই, শুধু কুয়াশা, চোখের মতো দুটো উজ্জ্বল বিন্দু।
“আমরা স্মৃতি। আমরা ফিরে এসেছি।”
ছায়াটা কথা বলে না, কিন্তু শব্দ মাথার মধ্যে বাজে।
রোহিণী চিৎকার করে বলে,
“এটা তো… আমার ছোটবেলার ভয়! আমি এটা স্বপ্নে দেখতাম!”
অভিজিৎ কাঁপা গলায় ফিসফিস করে,
“এটা সেই স্মৃতি, যা আমরা সবাই চাপা দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন… স্মৃতিই প্রতিশোধ নিচ্ছে।”
ছায়াটা এগিয়ে আসে অর্জুনের দিকে। অর্জুন পিছিয়ে যায়, মুখে ভয়।
“তুমি জানো না, কী ডেকে এনেছ।”
আর তখনই ছায়া স্পর্শ করল অর্জুনের কপাল।
সে পড়ে গেল মাটিতে। হাঁপাচ্ছে। চোখ কোটরের বাইরে বেরিয়ে আসছে।
সে শুধু বলল—
“আমি সব ভুলে যাচ্ছি… আমি কে?”
আর তারপর সে নিশ্চল।
অভিজিৎ ছুটে এসে ধরল রোহিণীর হাত।
“চলো, আমাদের ফিরে যেতে হবে।
এই শহর আবার ভুলে যেতে শুরু করেছে।”
“কিন্তু এখন কী করব?”
“আমাকে আমার খাতা পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
যতদিন পর্যন্ত সেই সব লেখা থাকবে,
স্মৃতি ফিরে আসবে।”
তারা ছুটে চলল। আর আকাশের ওপরে উঠতে থাকল অমাবস্যার নিঃশব্দ অশনি।
পর্ব ৪: যে খাতা লেখা ছিল রক্ত দিয়ে
কলকাতা শহর জেগে ওঠে ধোঁয়া আর চায়ের কাপে, বাসের হর্ণে, দোকানের শাটারে। কিন্তু সেদিন, শহরের ভোরটাই যেন ভুলে গিয়েছিল সে কীভাবে জাগে। যেন কিছু একটা—অদৃশ্য, অথচ প্রবল—হাঁটছে কলকাতার রাস্তায়।
অভিজিৎ আর রোহিণী রিকশায় বসে ছুটে চলেছে কলেজ স্ট্রিটের দিকে, তার ছোট্ট ফ্ল্যাটের দিকে, যেখানে একটা পুরনো খাতা রাখা আছে—চামড়ার বাঁধাই, পাতায় পাতায় তাবিজ আঁকা, স্মৃতির ছাপ, এবং—রক্তের গন্ধ।
“তুমি তো বলেছিলে, তুমি সব বন্ধ করে দিয়েছ সেই কেসের পর। তাহলে এই খাতা?” রোহিণী তীক্ষ্ণ স্বরে বলল।
“বন্ধ করেছিলাম… কিন্তু মুছিনি,” অভিজিৎ চুপচাপ বলে। “এটা শুধু তদন্ত নয়, এটা আমার নিজের স্মৃতিও। প্রতিটা কেস, প্রতিটা সাক্ষাৎ, প্রতিটা মৃত্যু আমি লিখে রেখেছি—যেন ভুলে না যাই। কিন্তু হয়তো এটাই আমার ভুল ছিল।”
ফ্ল্যাটে ঢুকে তারা খাতাটা বের করে। রোদ তখন ছাদে পা রেখেছে, কিন্তু ঘরের ভেতরটা অন্ধকার।
রোহিণী ধীরে ধীরে খাতার পাতা উল্টায়।
পাতা ১: সৌম্যকেতু পাল—নিখোঁজ, ভবানীপুর, অমাবস্যা
পাতা 4: অরূপ গুহ—মৃত, ঘর ৩১৫, তাবিজ
পাতা 7: একটি মেয়ের নাম—তর্পণা—তার নাম কোনো কেসে নেই, তবুও সে ফিরে ফিরে এসেছে অভিজিতের লেখায়।
“তর্পণা কে?” রোহিণী জিজ্ঞেস করে।
অভিজিৎ চোখ বুজে ফেলে।
“সে একজন স্বপ্নের মেয়ে ছিল। আমি তাকে কখনো বাস্তবে দেখিনি। কিন্তু প্রতিটি কেসের সময়, যখন আমি বিভ্রান্ত হতাম, তখন তার মুখ ভেসে উঠত। কালো চোখ, উজ্জ্বল কপাল… সে বলত, ‘ভুলে যেও না’। আমি ভাবতাম, সে আমার মানসিক কল্পনা মাত্র। কিন্তু এখন বুঝি… সে-ও এক স্মৃতি। হয়তো সেই স্মৃতি যা আমি ভুলিনি, অথচ ভুলে যাওয়াই উচিত ছিল।”
রোহিণী হঠাৎ বলে,
“খাতা পুড়িয়ে দিলে কি সব ভুলে যাওয়া যাবে?”
“হয়তো। হয়তো না। কিন্তু চেষ্টা করতে হবে। কারণ এখন শহরের মানুষের স্মৃতি হিংস্র হয়ে উঠছে।”
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে কেউ।
রোহিণী দরজা খোলে—দেখে দাঁড়িয়ে আছে সেই চৌরঙ্গীর সাধু।
“তুমি এ খাতা পুড়িয়ে দিলে কি তোমারও সব শেষ হয়ে যাবে, গোয়েন্দাবাবু?”
“হয়তো,” অভিজিৎ বলে। “কিন্তু এটাই তো দরকার। এই স্মৃতিগুলো এখন আর আমার নয়, ওরা শহরের শত্রু হয়ে গেছে।”
সাধু ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকে বলে,
“তুমি জানো এই খাতা কী দিয়ে লেখা?”
“কালি দিয়ে, রক্ত দিয়ে, চোখের জল দিয়ে…”
“না। এটা লেখা হয়েছিল এক বিশেষ তান্ত্রিক বর্ণে—কোয়ি লিপি—যা শুধুমাত্র চেতনায় কাজ করে। চোখে যা লেখা নেই, মস্তিষ্কে তার প্রতিধ্বনি পড়ে। এই খাতা যতক্ষণ না ধ্বংস হয়, ততক্ষণ স্মৃতির দরজা খোলা থাকবে। কিন্তু এই খাতা পুড়লে, হয়তো তোমার নিজের স্মৃতিও যাবে।”
“আমি প্রস্তুত।”
“তুমি পারবে না,” সাধু ধীরে ধীরে বলে। “কারণ খাতা যখন আগুনে পড়বে, তখন সে তোমায় একবার শেষবারের মতো দেখাবে—তর্পণাকে।”
রোহিণী ফিসফিস করে বলে,
“তুমি প্রস্তুত তো?”
অভিজিৎ মাথা নাড়ে।
ছাদের ওপর ছোট্ট মাটির চুল্লি বসানো হয়। কাঠকয়লা জ্বলে ওঠে। খাতা ধীরে ধীরে তুলে নেয় অভিজিৎ।
ঠিক সেই মুহূর্তে—
ঘরের ভেতর বাতাস জমাট বাঁধে। দরজা বন্ধ হয়ে যায় হঠাৎ। ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এক ছায়া—নারীর। তার কপালে শ্বেত চন্দনের রেখা, চোখ দুটি অবিশ্বাস্য কালো, ঠোঁটে নিঃশব্দ হাসি।
“তুমি যাচ্ছো, অভি?”
অভিজিৎ স্তব্ধ। রোহিণী এক পা পিছিয়ে যায়।
“তর্পণা…”
“আমি চলে যাচ্ছি, অভি। আমায় আবার ভুলে যেও। আমি তো কেবল তোমার সেই অংশ, যে বেঁচে ছিল ভালোবাসায়, আর হারিয়েছিল বিশ্বাসে। তুমি আবার শুরু করতে চাও, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তবে পুড়িয়ে দাও।”
তর্পণার মুখ ধীরে ধীরে মুছে যায় কুয়াশায়।
অভিজিৎ হাত কাঁপতে কাঁপতে খাতা আগুনে ফেলে দেয়। আগুন উঁচু হয়ে ওঠে, যেন চিৎকার করে।
রোহিণী দেখল—আগুনের শিখার মধ্যে একেকটা দৃশ্য জ্বলছে—একটা মৃতদেহ, একটা ভাঙা আয়না, একটা তাবিজ, আর একটা ছেলেবেলার বিকেল—যেখানে অভিজিৎ দাঁড়িয়ে, মাঠে খেলছে, আর একটা মেয়ে তাকে বলছে,
“ভুলে যেও না, তুমি অভিজিৎ লাহা। তুমিই সেই মানুষ, যে সত্যকে ভয় পায় না।”
আগুন থেমে গেল।
ঘরে আর গন্ধ নেই, নেই কোনো ছায়া।
সুধু অভিজিৎ চুপ করে বসে আছে। কাঁধে রোহিণীর হাত।
“তুমি কেমন আছো?”
“জানি না। কিছু মনে নেই… কিন্তু হালকা লাগছে।”
সাধু ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়।
“তোমার কাজ শেষ। এখন শহর আবার ঘুমোবে। স্মৃতি ফিরে যাবে যেখানে তার জায়গা—মনের গভীরে, প্রকাশের নয়।”
“তবে কি সব ঠিক হয়ে গেল?”
“না,” সাধু বলে, “কারণ স্মৃতি কখনো মরে না। শুধু অপেক্ষা করে। পরের ভুলে যাওয়ার জন্য।”
অভিজিৎ জানালার বাইরে তাকায়। কলকাতা শহর হাঁটছে, চলছে, হাসছে।
কিন্তু জানালার পাশে পড়ে আছে ছাইভরা একটা বাক্স। খোলস। তাবিজের।
একটা তাবিজ হয়তো এখনও অক্ষত।
পর্ব ৫: স্মৃতিহীন শহরের ডায়েরি
তিন দিন কেটে গেছে। কলকাতার আকাশ আবার সেই চেনা মেঘের চাদরে ঢাকা। বাস, ট্রাম, কফির কাপে শহর কেমন যেন নিজের গতিতে ফিরে এসেছে। কেউ আর হোটেল সম্রাটের ৩১৫ নম্বর ঘরের কথা বলে না। কেউ জানে না মাঠারঘাটে আগুন জ্বলেছিল এক রাতে।
অভিজিৎ আবার ফিরে গেছে তার লাইব্রেরির ছোট্ট কাজটায়—পুরনো বই ঠিকঠাক করা, পাতা গুনে দেখা, কিংবা সদ্য আসা রাশিয়ার এক গবেষণাপত্রে টাইপরাইটার ভুল খুঁজে বের করা। তার চোখে আজকাল যেন একধরনের নির্লিপ্তি, এক গভীর শূন্যতা।
রোহিণী অবশ্য তাকে ছেড়ে যায়নি। দিনে দু-তিনবার আসে, কখনও চা নিয়ে, কখনও পুরনো কেসের রিপোর্ট। অভিজিৎ যদিও বলে, “সব মনে নেই,” তবু মাঝে মাঝে তার চোখের দিকে তাকালে রোহিণী বুঝতে পারে—কিছু একটা কোথাও জমে আছে, ঠিক যেন জলের নিচে চাপা দেওয়া আগুন।
এদিন সকালে রোহিণী তার নিজের ঘরের আলমারি পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা পুরনো ডায়েরি পেল—নীল কাভারের, উপরে ইংরেজিতে লেখা “Journal – 2012”।
“আমি তো কখনও ডায়েরি লিখতাম না!”—সে নিজেই অবাক হয়।
তবু সে পাতাগুলো উল্টে দেখতে থাকে।
প্রথম পাতায় তার নিজের হাতের লেখা—
“আজ আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি, আমার খাটের নিচে পড়ে আছে একটি তাবিজ। মনে নেই কোথা থেকে এল। দাদু বলতেন, ‘স্মৃতির খেলায় হারলে মানুষ পাথর হয়ে যায়।’ আমি কি হারছি?”
রোহিণীর কাঁপুনি দেয় শরীর।
সে তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিল। মনে পড়ে, কলেজের বায়োলজি ডিপার্টমেন্টে একবার প্রজেক্ট করার সময় সে কয়েকটা রহস্যময় চিঠি পেয়েছিল পুরনো এক শিক্ষকের ডেস্কে। চিঠিতে লেখা ছিল—“রক্ততন্ত্র এখনও বেঁচে আছে। চৌরঙ্গীর নিচে একটি ঘর আছে, যার দরজা কেউ খোলে না।”
সে হাসি-ঠাট্টায় ছেড়ে দিয়েছিল ব্যাপারটা। কিন্তু ডায়েরি বলছে—সে শুধু পড়ে থামেনি, সে গিয়েছিল সেখানে। চৌরঙ্গীর এক পুরনো টানেলের ভিতরে, এক ধূসর ঘরে।
তৃতীয় পাতায় লেখা—
“আমি তাকে দেখলাম। কালো পোশাক, চোখে সাদা রঙ, সে বলল, ‘তুই ফিরবি একদিন, যখন সব ভুলে যাবি।’ আমি হেসেছিলাম। এখন বুঝছি, আমি কী নিয়ে খেলেছিলাম।”
রোহিণী ফোন করে অভিজিৎকে ডাকে।
“তুমি বলেছিলে, তিনটি তাবিজ পুড়ে গেছে। কিন্তু আমি মনে করতে পারছি, এক সময় আমিও তার মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। আমার শরীরের ভাঁজে যেন কোন স্মৃতি ঢুকে আছে, যা আমি জানি না।”
অভিজিৎ তার দিকে তাকায়। কিছু বলে না।
“তোমার খাতা কি সত্যিই সব মুছে দিয়েছে?”
“আমারটা… হয়তো। কিন্তু তোমারটা নয়।”
“তাহলে কি তাবিজ আবার কাজ শুরু করেছে?”
অভিজিৎ তখন হঠাৎ আলমারির এক কোণা থেকে একটা ছাইরঙা খাপ বের করে।
“আমি একটা তাবিজ পুড়াইনি,” সে বলে। “আমি ভেবেছিলাম, হয়তো এটা নকল। কিন্তু এখন বুঝছি—এটাই আসল। স্মৃতির কেন্দ্র।”
রোহিণী চুপ করে বলে, “তাহলে আমি কেন?”
“কারণ স্মৃতিকে পুড়িয়ে দিলে, সে রক্ত খোঁজে। আর তুমি, রোহিণী, একদিন মাঠারঘাটে গিয়েছিলে। তুমি হয়তো ছোট ছিলে, হয়তো কেউ নিয়ে গিয়েছিল, কিংবা নিজের অজান্তে। কিন্তু সেখানে তুমি কিছু দেখেছিলে। যা এই তাবিজ মনে রেখেছে।”
“তাহলে এটা এখন আমাকে খুঁজছে?”
“তাবিজ নয়। স্মৃতি। আর স্মৃতি কখনও একা আসে না। সে ফিরে আসে তার ছায়া নিয়ে।”
ঘরটা ঠান্ডা হয়ে আসে।
রোহিণীর গলার স্বর ফিসফিস করে।
“আমার মনে হচ্ছে, কেউ আমাকে দেখছে। আমার ঘুমের মাঝে এখন সেই ঘরটা আসে। সাদা দেয়াল, কালো দরজা, আর ভিতরে আমার ছায়া বসে থাকে। আমাকে ডাকছে।”
অভিজিৎ ধীরে ধীরে বলে,
“তোমাকে যেতে হবে। সেই ঘরে। মনে করার জন্য। কারণ স্মৃতি যতদিন অবচেতন থাকে, সে ভয়ঙ্কর হয় না। কিন্তু যদি তাকে ধামাচাপা দেওয়া হয়… সে ছিন্ন করে সব কিছু।”
“কোথায় সেই ঘর?”
“চৌরঙ্গীর নিচে। সেই পুরনো টানেলে।”
সেই রাতেই তারা দুইজনে যায় চৌরঙ্গীর এক পুরনো বাসস্ট্যান্ডের নিচে, যেখানে একসময় মেট্রোর কাজ শুরু হয়েছিল কিন্তু পরে বন্ধ হয়ে যায়।
সেই টানেলে এখনো ধুলো জমে আছে, মাঝে মাঝে ইঁদুর ছুটে যায়, আর দেয়ালে পুরনো পোস্টার—“মৃত্যুই শেষ নয়” লেখা।
টানেলের শেষে এক কালো দরজা। রোহিণী থমকে যায়।
“এটাই তো সেই দরজা! আমি দেখেছি এটা… কিন্তু কখন?”
অভিজিৎ পেছন থেকে ফিসফিস করে,
“তোমার ভেতরে যে মেয়েটা বসে আছে, তাকে বের করো। তাকে বলতে দাও। কারণ এবার যদি স্মৃতি কথা না বলে, তাহলে সে রক্ত চাইবে।”
রোহিণী হাত বাড়ায় দরজার দিকে।
দরজা খুলে যায়।
ভিতরে নিঃশব্দ।
একটা পাথরের মেঝে, একটা আয়না, আর একটা খালি খাট।
আর খাটের ওপরে বসে আছে একটা ছায়া—নারীর, তার মুখ নেই, শুধু চোখ।
ছায়াটা বলে—
“তুমি তো ভুলে গিয়েছিলে, আমি কে।
আমি সেই ভয়, যাকে তুই চাপা দিয়েছিলি।
এখন সময় এসেছে মনে করার।”
রোহিণী তখন আয়নার দিকে তাকায়।
আয়নায় দেখা যায়—সে ছোট বেলায় এখানে এসেছিল। তার দাদু তাকে নিয়ে এসেছিল এক অদ্ভুত তান্ত্রিক সাধনার জন্য। কিন্তু কিছু একটা ভয়ঙ্কর হয়েছিল—স্মৃতিতে সেই অংশটা ব্ল্যাঙ্ক।
ছোট্ট রোহিণী ছুটে পালিয়ে গিয়েছিল।
আর আজ… স্মৃতি ফিরেছে।
ঘরটা কাঁপতে শুরু করে।
অভিজিৎ চিৎকার করে,
“তোমার ভয়কে বলো, আমি মনে রেখেছি! বলো! বলো!”
রোহিণী ছায়াটার দিকে তাকিয়ে বলে—
“তুই আমার ভয়।
কিন্তু আমি ভয় পাই না।
আমিই স্মৃতি। আমিই অভিশাপ।
তুই আর কিছু না।”
ছায়াটা চিৎকার করে উঠে যায়। বাতাস জমে ওঠে। আয়না ভেঙে পড়ে।
ঘর থেমে যায়।
শুধু দেয়ালের গায়ে লেখা—
“স্মৃতি হারায় না, সে শিখে যায় চুপ থাকতে।”
পর্ব ৬: ভুলে যাওয়া নামের কবিতা
কলকাতা শহরটা যেন হঠাৎ করে কেমন ধোঁয়াটে হয়ে উঠেছে।
চেনা দোকানের নাম ভুলে যাচ্ছে দোকানদার। ট্রাম স্টপের নাম ভুলে গেছে ঘোষদা, যে চল্লিশ বছর ধরে টিকিট কেটে যাত্রী তুলছে।
আর এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটছে—মানুষ নিজেদের নাম মনে রাখতে পারছে না।
এক বৃদ্ধ হকার একদিন ভোরে রাস্তার মোড়ে বসে চা খাচ্ছিল। পুলিশ জিজ্ঞেস করল তার নাম, সে বলল,
“হাতের রেখায় আছে, কিন্তু মুখে নেই। আমার নাম ছিল, এখন শুধু কাজ আছে।”
একটা মেয়ে হাওড়ার স্টেশনে তার বাবা-মার হাত ধরে কাঁদছে, “ওঁরা আমার মা-বাবা কি না আমি জানি না। ওঁরা বলছে আমি ‘দিয়া’, কিন্তু আমার মন বলে আমি ‘পিয়া’…”
রাতের খবর জানাচ্ছে,
“নাম হারানোর মহামারী ছড়িয়ে পড়ছে শহরে। চিকিৎসা চলছে মনোবিজ্ঞানের স্তরে, কিন্তু চিকিৎসকেরাই নাম বলার সময় থেমে যাচ্ছেন। এই কী নতুন রোগ, না কি নতুন অভিশাপ?”
রোহিণী আর অভিজিৎ তখন চুপ করে বসে রয়েছে কলেজ স্ট্রিটের সেই পুরনো লাইব্রেরির ভিতর, যেখানে বাতাসে পাণ্ডুলিপির গন্ধ আর পেছনে একটা বাওল গলায় গাইছে,
“নাম ছাড়িয়া যাইস না রে মন,
নাম হারাইলে কেমনে চিনবি আপনজন?”
রোহিণী বলে, “তুমি কি জানো এটা ঠিক কী হচ্ছে?”
“হ্যাঁ,” অভিজিৎ বলে, “এই শহর তার নাম হারাচ্ছে, কারণ নামও একটা স্মৃতি। আর যদি স্মৃতি পুড়ে যায়, নাম থাকে না—থাকে শুধু শরীর আর অভ্যেস।”
“তাহলে এটা কি চূড়ান্ত স্তর?”
“না। এটা মাঝপথ। নাম ভুলে গেলে, মানুষ নিজেকে আর আলাদা করে না। তার পরিচয় গুলিয়ে যায়। তখন সে যেকোনো কিছু করতে পারে—ভালবাসতে, ঘৃণা করতে, খুন করতেও। কারণ যে নিজের নাম জানে না, সে অপরাধের দায় নেবে কেন?”
সেই রাতে রোহিণী তার ঘরে ফিরে পুরনো ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাচ্ছিল, হঠাৎ এক পাতায় চোখ পড়ে যায়—
“তান্ত্রিক বংশে চতুর্থ তাবিজের উল্লেখ আছে—‘নামতন্ত্র’।
এ তাবিজ শরীর নয়, আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে।
যারা একে ব্যবহার করে, তাদের চারপাশের মানুষ তাদের নাম ভুলে যায়। তারা থেকে যায় চিরচেনা, অথচ অচেনা হয়ে।”
পাশেই লেখা—
“এই তাবিজ সর্বশেষ ব্যবহার করেছিল শ্রীহট্টের এক মহিলা—তার নাম কেউ মনে রাখতে পারেনি। শুধু স্মরণে আছে তার লেখা কবিতার শেষ লাইন:
‘আমার নাম ভুলে যেও,
কিন্তু আমার সুর রেখো।’”
রোহিণী হঠাৎ শিউরে ওঠে।
তার ছোটবেলার এক স্কুলের বান্ধবীর কথা মনে পড়ে—মেয়েটা একদিন স্কুলে এসে বলেছিল, “তুই যদি আমায় ভুলে যাও, আমি তোর ছায়া হয়ে থাকব।”
কিন্তু আজ, রোহিণী মনে করতে পারছে না তার নাম।
সে অভিজিৎকে ফোন করে বলল,
“চতুর্থ তাবিজ আছে। সেটা নাম নিয়ন্ত্রণ করে। আমি নিশ্চিত শহরের নাম হারানোর পিছনে এই তাবিজই দায়ী। আমাদের সেটা খুঁজে পেতে হবে।”
পরদিন তারা ছুটে যায় শ্যামবাজারের এক পুরনো লাইব্রেরিতে—‘চন্দ্রলেখা পাঠাগার’। কথিত আছে, এই লাইব্রেরির ভিতরে একসময় নামতন্ত্রের চর্চা হত, যখন বাউলরা শুধু গানের ভেতর দিয়ে আত্মা চেনার চেষ্টা করত, আর কবিতার শব্দে নাম লুকিয়ে রাখত।
বইয়ের র্যাকের ফাঁকে অভিজিৎ এক পুরনো পাণ্ডুলিপি খুঁজে পায়—“নামশিল্পা: তন্ত্র ও পরিচয়”
প্রথম পাতায় লেখা:
“একটি নাম মানে একটুকরো চিহ্ন। নাম থাকলেই মানুষ চেনা যায়। কিন্তু যদি সে নিজেই নিজের নাম ভুলে যায়?”
দ্বিতীয় পাতায় আঁকা এক নারীর মুখ—কিন্তু তার মুখ জুড়ে শুধু চোখ আর ঠোঁট, নামহীন।
পাশেই লেখা—
“নামহারা নারী ফিরছে অমাবস্যায়। সে গান গায়, সে কবিতা লেখে। সে শহরের প্রতিটি সাইনবোর্ডে বানান পালটে দেয়। তুমি যদি তার চোখে তাকাও, তোমার নামও ভুলে যাবে।”
রোহিণী ফিসফিস করে বলে,
“তাহলে এ কেসে খুনি একজন কবি?”
“না,” অভিজিৎ বলে, “একজন নামহারানো মানুষ, যে ফিরে এসেছে। তাকে কেউ ডাকে না, কেউ চিনে না। তাই সে চায় শহরের প্রত্যেকে ভুলে যাক নিজেদের নাম, যাতে সবাই তার মতো হয়ে যায়।”
“তাহলে আমাদের কী করতে হবে?”
“তাকে মনে করাতে হবে তার নাম। কারণ নামই তাকে মানুষ করে তুলবে, স্মৃতি নয়। আর সেই নাম লুকিয়ে আছে তার কবিতায়।”
সেই রাতে কলেজ স্ট্রিটে ঝড় ওঠে। বইয়ের পাতা উড়তে থাকে রাস্তার ধারে।
আর এক মোড় ঘুরে দেখা যায় এক নারী, হুড তোলা জ্যাকেটে, দাঁড়িয়ে ছেঁড়া পোস্টার ছিঁড়ে সেগুলো দিয়ে কবিতার নতুন লাইন লিখছে।
একটি দেয়ালে লেখা—
“তুমি যদি আমায় মনে রাখো, আমি তোমার নাম ভেঙে দেব।
যতবার আমায় ডাকবে, তোমার পরিচয় বদলে যাবে।”
অভিজিৎ সেই দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
“তুমি তর্পণা?”
নারী থামে। হুড ফেলে দেয় মাথা থেকে। তার চুল ধূসর, চোখ গভীর, ঠোঁটে সেই পুরনো হাসি।
“তুমি মনে রেখেছ, অভি?”
“হ্যাঁ। আমি জানি, তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমার নাম জানি—তুমি সেই মেয়েটি, যে কখনও নাম পায়নি। তাই তুমি চাইছ, কেউ যেন নিজের নাম না রাখে। কিন্তু… আমি তোমাকে নাম দিচ্ছি।”
সে কাঁপা গলায় বলে,
“তুমি চিত্রা।
তুমি সেই কবিতা, যে নিজেকে ভুলে গিয়েছিল।”
নারী থেমে যায়। চোখ ভিজে ওঠে।
তার চারপাশে বাতাস ঘুরে যায়।
দেয়ালের লেখা মুছে যায়।
শহরের উপর থেকে যেন এক চাপা যন্ত্রণা সরে যায়।
ট্যাক্সির চালক হঠাৎ বলে ওঠে, “আমি তো সোমনাথ! কাল সারাদিন মনে পড়েনি!”
এক বৃদ্ধা রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাসছেন, “আমার নাতনির নাম মিমি… মনে পড়ছে আবার।”
চিত্রা ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায় অন্ধকার গলির দিকে। আর ফিসফিস করে বলে,
“ধন্যবাদ অভি। কেউ যদি মনে রাখে, তবে নাম কখনো মরে না।”
পরদিন সংবাদপত্রের শিরোনাম:
“নামভোলা শহর আবার তার পরিচয় ফিরে পেল।”
কিন্তু অভিজিৎ জানে, এই যুদ্ধে জিতলেও স্মৃতি সবসময় ফিরে আসার রাস্তা খুঁজে নেয়। আর কখনও তা ফিরে আসে গান হয়ে, কখনও তাবিজ হয়ে।
তবে এখন… শহর ঘুমোচ্ছে। কিছু সময়ের জন্য।
পর্ব ৭: তাবিজের পরে যে দাগ থাকে
কলকাতা, ভোর ৪টা ৪২।
ঘড়ির কাঁটা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যায়।
বউবাজারের এক অন্ধকার গলিতে একটি ছেলে ছুটে পালাচ্ছে—হাত কাঁপছে, শ্বাস কাঁপছে। তার গায়ে স্কুলের ইউনিফর্ম, পিঠে ব্যাগ। সে মাঝেমধ্যে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, যেন কেউ তাড়া করছে।
গলির শেষ মাথায় এসে পড়ে যায়। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে দাঁড়ায়। এক দেওয়ালে তাকিয়ে পড়ে তার চোখ। সেখানে আঁকা—একটা তাবিজ। লাল কালি দিয়ে। রক্ত নয়, তবু ঠিক রক্তের মতোই।
ছেলেটি দেয়ালে হাত রাখে। তখনই তার চোখে ভেসে ওঠে এক দৃশ্য—একটা ঘর, যেখানে তিনটি মুখ জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে, কারো মুখে নেই চোখ, কারো মুখে নেই ঠোঁট।
সে চিৎকার করে উঠে যায়।
ঘুম ভাঙে—সে নিজের বাড়িতে, মায়ের কোলে।
“তুই আবার স্বপ্নে দেখলি?” মা জিজ্ঞেস করে।
সে কাঁপা গলায় বলে, “মা… আমি আবার সেই দাগটা দেখেছি… ওই চিহ্নটা… যে তাবিজের মতো দেখতে।”
অভিজিৎ তখন কলেজ স্ট্রিটের লাইব্রেরিতে বসে পুরনো এক বইয়ের পাতা ঘেঁটেছে—“তন্ত্র ও শহর: এক ইতিহাস”। বইটা সে এতবার পড়েছে যে তার পাতার ভাঁজে তার নিজের হাতের ছাপ পড়ে গেছে।
এক অধ্যায়ে লেখা—
“তাবিজ, পুঁথি, অভিশাপ—এসব এককালে কুসংস্কার হিসেবে দেখা হলেও, আজকের মনস্তত্ত্বে এই ধারণা তৈরি হয়েছে যে, মানুষের ভয়ের স্মৃতি শরীর থেকে কখনও মুছে যায় না। সে তাবিজ সরালেও দাগ থাকে—স্নায়ুর ভেতর, চোখের পেছনে, এমনকি ভবিষ্যতের সম্ভাবনার মধ্যে।”
ঠিক তখনই রোহিণী এসে হাজির।
তার হাতে একটি কৌটা। তার ভিতরে একটি কাগজের টুকরো, আর একটি ছোট্ট সুতোর গোটানো রিং।
“তুমি বিশ্বাস করবে না, এটা কোথায় পেয়েছি,” সে বলে।
“কোথায়?”
“এক রোগীর বুকের এক্স-রে করতে গিয়ে, ছবিতে দেখি, ছায়া পড়েছে এই চিহ্নের। প্রথমে ভেবেছিলাম টিউমার। কিন্তু পরে দেখা যায়, সে বহুদিন আগে এক তান্ত্রিক পূজোয় অংশ নিয়েছিল। তখন তার গলায় দেওয়া হয়েছিল এক ‘অদৃশ্য তাবিজ’। সেই তাবিজ শরীরে নেই, কিন্তু ছায়া থেকে গেছে।”
অভিজিৎ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
“তাহলে তাবিজ খুলে ফেলা মানেই মুক্তি নয়?”
“না। বরং বিপদ সেখানেই। তাবিজ খুলে দিলে ‘অচেনা’টা ঢুকে পড়ে। তখন মানুষ ভাবে সে মুক্ত, অথচ ভিতরে ভিতরে সে আর নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই।”
“মানে, যারা ভুলে গেছে তাদের অতীত, তারা এখন স্মৃতির খাঁচা হয়ে আছে?”
“হ্যাঁ। তারা এখন অন্যদের স্মৃতি শুষে নিচ্ছে।”
রাতে তারা পৌঁছে এক অবাক জায়গায়—সল্টলেক সেক্টর ২-র এক বহুতল ফ্ল্যাটে। সেখানকার কেয়ারটেকার জানায়, ফ্ল্যাট নম্বর 5A-তে নতুন দম্পতি এসেছে মাসখানেক আগে। কিন্তু কেউ জানে না তাদের নাম। তারা কারোর সঙ্গে কথা বলে না, শুধু রাতে এক বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণের শব্দ শোনা যায়, আর প্রতিদিন সকালে তাদের ফ্ল্যাটের দরজার নিচে দিয়ে বেরিয়ে পড়ে—একটি কাগজ। তাতে কিছু লেখা, ঘোরানো হরফে, যেন কারও আত্মজীবনী।
তারা সেই কাগজ নিয়ে যায়। অভিজিৎ পড়ে—
“আমার নাম ছিল অনিরুদ্ধ। কিন্তু এখন আমি জানি না, আমি কী পছন্দ করি, কী ভয় পাই, কাকে ভালোবাসি। আমি শুধু জানি, আমি একবার একটা মেয়েকে ডেকেছিলাম নাম ধরে, আর সেই রাতে আমার জিভে লেগে গিয়েছিল আগুন।”
রোহিণী ফিসফিস করে বলে,
“এটা তো সিজোফ্রেনিয়ার মতো!”
“হয়তো,” অভিজিৎ বলে। “কিন্তু আমি বিশ্বাস করি—এই শহরের ভেতরে কিছু স্মৃতি মিশে গেছে যা মানুষ মনে রাখতে পারেনি, অথচ ভুলতেও পারেনি। সেই স্মৃতিগুলোই এখন নতুন রূপে ফিরে আসছে—মানুষের মধ্যেই।”
পরদিন সকালে তারা গিয়ে দাঁড়ায় ভবানীপুরের এক স্কুলের সামনে। সেই স্কুলে এক ছাত্রী বিগত কয়েকদিন ধরে ক্লাসে নিজের নাম বলে উঠতে পারছে না। তার বন্ধুরা বলে, “সে আছে, অথচ নেই।”
মেয়েটি অভিজিৎকে দেখে বলে,
“তোমার চোখে সেই আলো আছে… যে আলোয় আমি একদিন আমার নাম দেখেছিলাম। তুমি কীভাবে জানো?”
“তুমি কি কখনও তাবিজ পরেছিলে?”
“মা দিয়েছিল। কিন্তু আমি খুলে ফেলি। পরে স্বপ্নে দেখি, এক মহিলা এসে বলছে—‘তাবিজ খুলেছিস? তাহলে নাম রাখবি আমি যা বলি…’”
“সে কী বলেছিল?”
“সে বলেছিল—‘তুই এখন অচেনা। আর তোর নাম হবে… অভ্রবসনা।’”
রোহিণী থমকে যায়।
“অভ্রবসনা… মানে যার পরনে কুয়াশা। যার শরীরে কোনো পরিচয় নেই। যে হারিয়ে দিয়েছে সব। এ তো আত্মার অচেনা রূপ!”
অভিজিৎ মেয়েটিকে বলে,
“তুমি তোমার আসল নাম জোরে বলো। জোরে চিৎকার করে বলো।”
মেয়েটি কাঁপা গলায় বলে, “সীমন্তিনী…”
তখনই বাতাসে যেন একটা ফিসফিসানি কেটে যায়। স্কুলের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীরা চোখ ঘুরিয়ে একবার তাকায়। তারপর ছায়া সরে যায় মেয়েটির মুখ থেকে।
সে হাসে।
“আমার নাম ফিরে এসেছে।”
ফিরে আসার পথে রোহিণী বলে,
“তাহলে কি আমাদের এখন শহরের প্রতিটি মানুষকে তার নাম মনে করিয়ে দিতে হবে?”
“না,” অভিজিৎ বলে। “আমাদের মনে করিয়ে দিতে হবে তাদের ভয়গুলোকে।
কারণ মানুষের নাম ভুল হয় না—ভয় তাকে ভুলিয়ে দেয়।
আর ভয়ই আসল তাবিজ, যেটা কেউ খুলে ফেললে তার উপর ছায়া নামে।”
রোহিণী কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“আমাদের ভিতরেও কি তাবিজ ছিল?”
“হয়তো আছে এখনও। কারণ আমরা এখনও সব ভুলে যাইনি।”
সেদিন রাতে, কলকাতার আকাশে আবার ঘন কালো মেঘ।
একটা পোস্টার উড়ে গিয়ে লাগে কলেজ স্ট্রিটের রাস্তার মোড়ে। তাতে লেখা—
“তিনটি তাবিজ পুড়েছে, চতুর্থটি নাম দিয়েছে।
কিন্তু পঞ্চমটি এখনও খুঁজে পায়নি কেউ।
পঞ্চম তাবিজ, যা আত্মাকে চুরি করে…”
অভিজিৎ জানে, এবার সত্যিকারের লড়াইটা শুরু।
পর্ব ৮: আত্মাহরণ তন্ত্র
শহরের প্রাচীনতম স্মৃতিগুলো কখনও কাগজে লেখা থাকে না। তারা ঘুমিয়ে থাকে ইটের ফাঁকে, কাঠের তক্তায়, ধুলোর স্তরে। আর মাঝেমধ্যে, যখন বাতাস থমকে যায়, ঠিক তখনই তারা উঠে আসে—ছায়া হয়ে, ছন্দ হয়ে।
অভিজিৎ জানত, তাবিজের খেলা এখানেই শেষ নয়। তিনটি তাবিজ পুড়েছে, চতুর্থটি নাম নিয়ন্ত্রণ করেছে, কিন্তু এখনও কোথাও কিছু অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। তারই প্রমাণ—শেষ কয়েকদিন শহরের মাঝবয়সি মানুষেরা হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে, কোনও ক্লু ছাড়াই।
তাদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে আসছে দুদিন পর—কিন্তু মুখের ভাষা হারিয়ে গেছে। চোখে শুধু ফাঁকা দৃষ্টি, আর ঠোঁটে একটি মাত্র বাক্য:
“আমি এখানে ছিলাম না। আমি এখানে ছিলাম না।”
রোহিণী রাত্তিরে এসে জানায়,
“সেন্ট্রাল হাসপাতালে পাঁচজন রোগী ভর্তি আছে, যারা নিজেদের আত্মপরিচয় হারিয়েছে। শুধু শরীরটা আছে, কিন্তু কথা নেই, চিন্তা নেই। মনে হচ্ছে, যেন আত্মা নেই।”
“তাহলে পঞ্চম তাবিজ কাজ শুরু করেছে,” অভিজিৎ ফিসফিস করে। “এটা আত্মাহরণ তন্ত্র।”
“তুমি এটা জানলে কী করে?”
অভিজিৎ টেনে বের করে একটি পুরনো স্কেচবুক। পাতায় আঁকা একটি চিহ্ন—
একটি বৃত্ত যার ভেতরে তিনটি ত্রিভুজ, তিন রঙে।
লাল (রক্ত), সাদা (নাম), কালো (ভয়)।
আর কেন্দ্রে একটি ফাঁকা চোখ—
“নির্মল চক্ষু“, যা তন্ত্রের শেষ স্তর।
“এই চিহ্নটা আমি প্রথম দেখি বারো বছর আগে, মুর্শিদাবাদের এক পোড়া জমিদারবাড়ির দেওয়ালে। তখন বুঝিনি কী। আজ বুঝছি—এটা পঞ্চম তাবিজের সিগিল। আত্মাহরণ তন্ত্রের প্রতীক। যার ছায়ায় মানুষ শরীর নিয়ে বাঁচে, কিন্তু আত্মা ছাড়া।”
“তাহলে কীভাবে কাজ করে এটা?”
“এই তাবিজ আত্মা চুরি করে। সে কোনও শব্দে, স্পর্শে বা চেহারায় আসে না। সে আসে শূন্যতায়। আর তার লক্ষ্য সেইসব মানুষ, যাদের ভিতর অতিরিক্ত স্মৃতি জমে আছে—যারা অতীত নিয়ে বাঁচে। অতীতকে আঁকড়ে থাকে।”
“অর্থাৎ, তারা নিজেরা চায় না ভুলতে, অথচ ভুলতে বাধ্য হয়?”
“হ্যাঁ। তখন আত্মা ত্যাগ করে শরীর। তাবিজ সেই আত্মাকে ‘গ্রন্থিবদ্ধ’ করে রাখে।”
তাদের পরবর্তী গন্তব্য: উত্তর কলকাতার মেছুয়া বাজার।
এখানে পুরনো একটি বাড়ি আছে, ‘দত্ত ভবন’। একসময় এখানে লিপিবিশেষজ্ঞ, কবি ও গায়কেরা থাকতেন। এখন ভাঙাচোরা কাঠের সিঁড়ি, ছাদের জলধরা ছোপ, আর সন্ধ্যার পর যাওয়া বারণ।
দত্ত ভবনের এক পুরনো ঘরে গিয়ে তারা পায় এক রহস্যময় ঘ্রাণ—জবা ফুল, পোড়া ঘি, আর চাঁপাফুলের মতো অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ।
ঘরের এক কোণে কাঠের ছোট বাক্সে পাওয়া যায় একটি মাদুলি—পাণ্ডুলিপির মতো গুটানো। খুলতেই ভিতরে লেখা—
“যারা আত্মাকে রাখতে চায়, তারা ভুলে যাক শরীর।
যারা শরীর বাঁচাতে চায়, তারা ভুলে যাক আত্মা।
পঞ্চম তাবিজ সেই দ্বন্দ্বের সীমানায় দাঁড়িয়ে থাকে।
আর সে সময়ের বাইরের কিছু।”
রোহিণী বলে,
“মানে, এটা সময়নিরপেক্ষ শক্তি? স্মৃতি যখন শরীরে আসে, তখনই সে আত্মাকে হরণ করে?”
“ঠিক তাই,” অভিজিৎ বলল। “এই তাবিজ খুঁজে নেয় সেইসব মানুষের আত্মা, যারা স্মৃতির ভারে ভেঙে পড়ে গেছে। সে তাদের থেকে আত্মা চুরি করে, কারণ তাদের মনে একটাই আকুতি—‘এই জীবন না থাকলে ভালো হতো’। আত্মাহরণ তন্ত্র সেই প্রার্থনার উত্তর দেয়।”
“কিন্তু কে ব্যবহার করছে এই তাবিজ?”
অভিজিৎ জানালার দিকে তাকিয়ে বলল,
“সে শহরের কোনো প্রান্তে নেই। সে হয়তো আমাদের মাঝেই আছে—তোমার, আমার, বা কারও ভেতরে।
তিনটি তাবিজ বাইরের ছিল, চতুর্থটা নামের।
কিন্তু পঞ্চমটা—এটা ভিতরের।
এটা নিজের ভিতরের শত্রু।”
সেই রাতে রোহিণী ঘুমোতে পারে না। তার চোখে ভেসে ওঠে বাবা-মার মুখ। ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনার কথা, যা সে মনে করতে চায় না।
সে ভাবে, “আমি কি সত্যিই চাই এই স্মৃতি ভুলে যেতে?”
ঠিক তখনই সে অনুভব করে তার বুকের মাঝখানে অদ্ভুত চাপ। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। সে আলো জ্বালিয়ে আয়নার দিকে তাকায়—
আর দেখতে পায়, নিজের প্রতিচ্ছবির চোখ নেই।
তখনই সে অনুভব করে, কিছু একটা তার ভিতর থেকে টানছে। তার স্মৃতি, তার ভয়, তার পুরনো গান—সব যেন বেরিয়ে যাচ্ছে।
সে জোরে চিৎকার করে উঠে বসে।
ঘাম ভেজা কপাল। আর সামনে দাঁড়িয়ে অভিজিৎ।
“আমি জানতাম এটা ঘটবে,” সে বলে। “তুমি ভেঙে পড়ছো। তাবিজ তোমার ভিতরেই জন্ম নিচ্ছে।”
“তাহলে আমি?”
“তুমি বাঁচতে পারো, যদি নিজের ভয়কে আলিঙ্গন করো।
যদি তুমি সেই স্মৃতিকে মেনে নাও, যা তুমি ভুলতে চাও।”
“কিন্তু সেটা কষ্টের…”
“তাই তো আত্মাহরণ তন্ত্র কাজ করে।
আমরা যা সহ্য করতে পারি না, সেটাই আমাদের শরীর থেকে আত্মাকে আলাদা করে দেয়।
কিন্তু তুমি যদি সহ্য করো, যদি মনে রাখো…
তবে তুমি মুক্তি পাবে।”
পরদিন তারা যায় কাশী মিত্র ঘাটে—সেখানে এক সাধুর সঙ্গে দেখা করে, যার চোখে ছিল অপার শূন্যতা।
তিনি বলেন,
“আত্মাহরণ রোধ করা যায় না। শুধু আত্মাকে শক্ত করে তোলা যায়।
তাবিজকে আটকাতে হলে তাকে আয়নায় দেখতে হবে।
কারণ তার আসল রূপ প্রতিচ্ছবিতে ধরা পড়ে।”
রোহিণী তখন সিঁড়িতে বসে একটি আয়না বের করে। নিজের দিকে তাকায়।
সে বলে,
“আমার নাম রোহিণী।
আমি ভুলে যেতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এখন আমি মনে রাখব।
সব, সবকিছু।
আমার ভয়, আমার ভুল, আমার ভালোবাসা।
কারণ আমি বাঁচতে চাই, আত্মাহীন হয়ে নয়।”
আর ঠিক তখনই, সেই আয়নার ভিতরে এক ছায়া যেন কেঁপে উঠে মিলিয়ে যায়।
তাবিজটা ছিল না, কিন্তু তার ছায়া ছিল।
এবং রোহিণী তাকে হারিয়ে দিল।
সেদিন রাতে কলকাতায় এক অদ্ভুত শান্তি নামে।
নেমে আসে বৃষ্টি।
কোনও শিরোনাম নেই, কোনও অ্যালার্ট নেই।
শুধু শহর জানে—একটা সময়, যখন স্মৃতি নিজেকে রক্ষা করেছিল।
অভিজিৎ জানালার ধারে বসে। রোহিণী পাশে।
“তাহলে সব শেষ?”
“না,” সে বলে। “তাবিজ পুড়েছে, আত্মা ফিরেছে।
কিন্তু স্মৃতি?
স্মৃতি তো আগুন নয়, তা ছাইও নয়—
স্মৃতি…
স্মৃতি বৃষ্টির মতো। পড়ে, ভিজিয়ে দেয়, চলে যায়, কিন্তু গন্ধ রেখে যায়।”
পর্ব ৯: শেষ তাবিজের ছায়া
কলকাতার আকাশ সেই ভোরে ছিল ঘোলাটে, যেন ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলে তাকানো এক বৃদ্ধ শহর, যার অতীতের আবছা স্মৃতি এখনও জানালার কাঁচে জমে থাকে।
অভিজিৎ জানত, সব শেষ হয়নি। হয়তো, সব ঠিক তখনই শুরু।
তিনটি তাবিজ পুড়েছে।
নামতন্ত্র জাগ্রত হয়েছিল।
আত্মাহরণ তন্ত্র ধ্বংস হয়েছে।
তবু এক তাবিজের ছায়া এখনও ঘোরাফেরা করছে—একটা ছায়া, যার রূপ নেই, গন্ধ নেই, অথচ তার প্রভাব গভীর।
এই তাবিজ কোনও ধাতব বাক্সে বাঁধা নয়, না কোনও মন্ত্রে বন্দী।
এই তাবিজ মানুষদের ‘প্রতিচ্ছবি’ ব্যবহার করে।
রোহিণী সেই রাতেই দেখেছিল, আয়নায় সে নিজেকে দেখে না—দেখে আরেকটা ‘রোহিণী’, যে ঠিক তার মতো, অথচ নয়।
সকালে তারা যায় চৌরঙ্গীর পুরনো মেট্রো টানেলে, যেখানে সেই নামহীন দরজার পেছনে এক সময় স্মৃতির ঘর ছিল। কিন্তু আজ সেখানে একদম নতুন দেয়াল। রঙ করা, গন্ধহীন, ধুলোমুক্ত।
“কেউ সবকিছু ঢাকা দিয়েছে,” অভিজিৎ বলে।
“অথচ… ছায়া থেকে গেছে।”
তারা দেয়ালের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। হঠাৎ অভিজিৎ নিজের ছায়ার দিকে তাকায়।
আর থমকে যায়।
তার ছায়া তাকিয়ে আছে ঠিকঠাক। কিন্তু তার ডানহাত নড়ছে না।
“ছায়া ঠিক মতো অনুসরণ করছে না,” সে ফিসফিস করে।
“মানে—এটা আমার ছায়া নয়।”
রোহিণী বলল, “এই তাবিজ নিজেকে ছায়া আকারে রাখে। সে আমাদের অনুসরণ করে, প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে। সে শুধু দেখতে চায়—আমরা কোন সময়ে সবচেয়ে দুর্বল। সেই সময়েই সে ঢোকে, আত্মা নয়, ‘চেতনা’ চুরি করতে।”
“তাহলে এটা আত্মাহরণ নয়—চেতনার দখল। এটা মনের প্রতিচ্ছবিতে ঢুকে পড়ে।”
“মানে এই তাবিজ আসলে আমাদেরই এক বিকৃত রূপ।
একজন অভিজিৎ, যে ভয় পায়।
একজন রোহিণী, যে অতীত ভুলতে চায়।
এই তাবিজ আমাদের ভিতরের ছায়া।”
সেই রাতে তারা যায় এক অদ্ভুত মানুষের কাছে—নাম নেই, পরিচয় নেই, লোকেরা তাকে ডাকে “ছায়াসাধু”।
সে বলে,
“পাঁচ নম্বর তাবিজ সৃষ্টি হয়েছিল ‘পরিচয়ের অভিশাপ’ থেকে।
যখন মানুষ বুঝতে পারে সে কে নয়, তখনই ছায়া তৈরি হয়।
তুমি যত নিজেকে জানতে চাও, তত ছায়া তোমাকে অনুসরণ করে।”
অভিজিৎ বলে, “তাহলে এটা রোখার উপায় কী?”
ছায়াসাধু চোখ বন্ধ করে বলে,
“আয়নায় ফিরে দেখো সেই সময়কে,
যেখানে তুমি ভুলে গিয়েছিলে তুমি কে।
যদি সাহস থাকে নিজের ছায়াকে জড়িয়ে ধরার,
তাহলে তাবিজ নিজেই ছায়াহীন হয়ে যাবে।”
তারা ফিরে আসে অভিজিৎ-এর ফ্ল্যাটে। দরজা বন্ধ। ঘরে নীরবতা।
একটি আয়না রাখা হয় মাঝখানে। আলো বন্ধ করা হয়।
রোহিণী বলে,
“আমি এখন আয়নার সামনে দাঁড়াব।
যদি আমি নড়ি, আর প্রতিচ্ছবি না নড়ে,
তবে আমি জানব—ছায়া ঢুকেছে।”
সে দাঁড়ায়। চুপ করে তাকায় নিজের চোখে।
হঠাৎ আয়নার প্রতিচ্ছবি চোখ বন্ধ করে।
আর খুলতেই বলে,
“তুমি ভুলে গিয়েছিলে, রোহিণী।
তুমি একদিন বলেছিলে,
‘আমি যদি অন্য কিছু হয়ে যাই, তবুও কি তুমি আমাকে চিনবে?’”
“হ্যাঁ, আমি চিনব।”
“তাহলে আমি কে?”
“তুমি আমি।
আমার সেই ভয়,
আমার সেই অভিমান,
আমার সেই ভুল, যা আমি লুকিয়ে রেখেছিলাম।
আজ আমি তোমায় জড়িয়ে ধরব। কারণ আমিই তুমিও। আমরা এক।”
রোহিণী হাত বাড়ায় আয়নার দিকে।
আর তখনই, আয়নার কাচে দেখা যায়—ছায়া থমকে গেছে। ফেটে গেছে তার গঠন। সে গলে যাচ্ছে, শব্দ করছে না, শুধু ঘন ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে যাচ্ছে।
এক মুহূর্ত পর—ঘর আবার নিঃশব্দ।
আয়নায় এখন শুধুই প্রতিচ্ছবি।
রাত ৩টে ১৩।
কলকাতা শহর নিঃশ্বাস ফেলে।
সব স্মৃতি থেকে যায় না, কিছু চলে যায়—তবু কিছু ফিরে আসে ছায়া হয়ে।
এ শহরের শরীরে, দাগ রয়ে যায়।
তাবিজ পোড়ে, কিন্তু ছায়া থেকে যায়।
আর সেই ছায়া, এখন শুধু স্মৃতি নয়।
সে হয়ে গেছে কবিতা।
একটা অচেনা কবি লিখে রাখে দেয়ালে—
“যারা নিজেদের ছায়ার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারে,
তারা তাবিজ পুড়িয়ে নিজের নাম ফিরে পায়।”
পর্ব ১০: অমাবস্যার পরে যে ভোর আসে
চৌরঙ্গীর বাতাসে সেদিন কেমন যেন এক ভারহীনতা।
কলকাতা শহরের বুকের মধ্যে যে সমস্ত চাপা ভয়, ভুলে যাওয়া নাম, আত্মা আর ছায়া ঘুমিয়ে ছিল এতদিন, তারা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন অমাবস্যার রাত শেষে সূর্য ফিরছে সেই চেনা ভঙ্গিমায়—বাম দিক থেকে আসা হালকা হলুদ আলোয়।
তিনটি তাবিজ পুড়েছে।
নামতন্ত্র চুপ হয়ে গেছে।
আত্মাহরণ তন্ত্র প্রতিহত হয়েছে।
আর ছায়া… সে আজ আয়নায় আর আলাদা নয়।
সে আমাদের সঙ্গেই হেঁটে চলে, কিন্তু ভয় দেখায় না।
তবুও অভিজিৎ জানত—এখনও একটা কাজ বাকি।
সে নিজের ঘরে ফিরে খুঁজে বার করে সেই ছোট নোটবুকটা, যেখানে লেখা ছিল তার জীবনের প্রথম তদন্তের সারাংশ।
ছয় বছর আগের এক কেস। এক ছেলের হারিয়ে যাওয়া।
সেই কেসের ফাইল তার হাতে নেই। পুলিশের রেকর্ডেও নেই।
কিন্তু তার মনে পড়ে—ছেলেটির নাম ছিল সঞ্জয় দত্ত।
সে-ই প্রথম বলেছিল, “আমার ছায়া আমার সঙ্গে কথা বলে।”
সে-ই প্রথম বলেছিল, “তাবিজ খুলে দিলে ভিতরের অন্ধকার উঠে আসে।”
অভিজিৎ সিদ্ধান্ত নেয়, এবার তাকে যেতে হবে সেই পুরনো স্কুলে, যেখানে সঞ্জয় পড়ত।
আজ স্কুলটি নেই। আধা ভাঙা বিল্ডিং, পরিত্যক্ত মাঠ, আর দেয়ালে লতাগুল্মের ছায়া।
তবু সে দাঁড়িয়ে পড়ে, যেন কারও অপেক্ষায়।
হঠাৎ সেই ছেলেটি ফিরে আসে, একজন তরুণ যুবক রূপে। চোখে গভীরতা, মুখে বিস্ময়।
“আপনি কি অভিজিৎ লাহা?”
“তুমি সঞ্জয়?”
সে মাথা নাড়ে।
“আমি ভুলে গিয়েছিলাম আপনি ছিলেন। আপনি সেই একমাত্র মানুষ যিনি বিশ্বাস করেছিলেন আমার ছায়া কথা বলে। আপনি বলেছিলেন, ‘ভয়কে চেনা মানেই ভয়কে জয় করা।’”
অভিজিৎ তার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমার ছায়া এখন কেমন?”
সঞ্জয় হেসে বলে,
“এখন আর আলাদা হয় না। এখন আমি জানি—ছায়া আমিই। সে পালাতে চায় না। সে সঙ্গে থাকে।”
সেই সময় রোহিণী এসে দাঁড়ায় পাশে। তার মুখে ক্লান্তির রেখা, কিন্তু চোখে স্থিরতা।
“কলকাতা এখন কেমন?” সে জিজ্ঞেস করে।
“আস্তে আস্তে ঠিক হচ্ছে,” সঞ্জয় বলে।
“মানুষ এখন আবার নিজের নাম মনে রাখতে পারছে,
তাদের প্রিয়জনদের চেহারা, পুরনো গানগুলো, এমনকি হারিয়ে যাওয়া চিঠিগুলোর বানানও।”
অভিজিৎ চুপ করে থাকে।
তার মনে হয়, এই শহর ঠিক যেন একটা জীবন্ত তাবিজ।
যেখানে প্রতিটি গলি এক স্মৃতির রেখা,
প্রতিটি দেয়াল এক আড়াল করা ভয়,
আর প্রতিটি আলো ফেলার কোণে লুকিয়ে আছে এক টুকরো ছায়া।
তবু, এই শহর বেঁচে আছে।
কারণ মানুষ ভুলে গেলেও, শহর কখনও ভুলে যায় না।
সন্ধেবেলা তারা তিনজনে হেঁটে আসে কলেজ স্ট্রিটের দিকে।
পেছনে বইয়ের দোকানগুলো খোলে, আলো জ্বলে, বাচ্চারা ছুটে যায় মায়ের হাত ধরে।
রোহিণী অভিজিৎ-এর হাত ছুঁয়ে বলে,
“তুমি কি সব মনে রাখতে চাও? নাকি এবার একটু ভুলে যেতে ইচ্ছে করে?”
অভিজিৎ হেসে বলে,
“ভুলে যেতে চাই না।
শুধু মনে রাখতে চাই, যে আমি একদিন ভয় পেয়েছিলাম,
আর তারপর সেই ভয়কেই আলিঙ্গন করেছিলাম।”
রোহিণী থেমে যায়।
তাদের সামনে একটা দেয়াল, যেখানে নতুন রঙ করা হয়েছে।
কিন্তু তার গায়ে একটা চিহ্ন—
একটা ছোট্ট লাল ত্রিভুজ।
তার নিচে লেখা—
“স্মৃতি ফিরে আসবে।
তবে এবার সে গান হয়ে আসবে, নয়তো গল্প হয়ে।
ভয় নেই, শুধু শুনে নিও।”
অভিজিৎ হাসে।
রোহিণী বলে,
“তাহলে এই গল্প কি এখানেই শেষ?”
সে মাথা নাড়ে।
“না। এটা কেবল একটা অমাবস্যার গল্প।
ভোর তো এখনও বাকি।”
তারা হাঁটে।
পেছনে ছায়া পড়ে।
তবে সেই ছায়ায় আর কোনও ভয় নেই।
ওটা শুধু একটা প্রমাণ—
যে আমরা সবাই একদিন নিজের অন্ধকারকে চিনেছি,
আর সেই অন্ধকারেই আলো খুঁজে পেয়েছি।
শেষ।




