Bangla - ভূতের গল্প

চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী

Spread the love

অধ্যায় ১ – রাতের যাত্রী

শহীদুল আলি সেই রাতের ট্যাক্সি চালানোর অভিজ্ঞতা কখনো ভুলবেন না—যেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন বাস্তবের আড়ালে ঝুঁকে থাকে, ঠিক তেমনই। রাত গভীর, পার্ক স্ট্রিটের আলো ফিকে, দোকানগুলোর ঘুমে ঢেকে থাকা রঙিন নৈশপ্রদীপ যেন আংশিক জ্বলছে। শহীদুলের চোখ সারাদিনের ক্লান্তি সঞ্চয় করে ঠিক তেমনই ম্লান, কিন্তু তিনি সচেতন ছিলেন—রাতের শহর তাঁর জন্য এক বিশেষ অবসান নয়, বরং একটি নতুন দিনের শুরু। হঠাৎ, মোহনগলি পার্কের কাছে, ফুটপাথে দাঁড়ানো এক মহিলা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সাদা শাড়ি, যার ধূসর আলোয় প্রায়ই নরম ক্রীমের আভা ফুটে উঠছে, এবং নরম হাসি যা যেন অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়াচ্ছে। তিনি ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন নিখুঁত ভদ্রতার সঙ্গে, কণ্ঠস্বর এতটাই কোমল যে শহীদুলের কানে বাজলো যেন দূর কোনো পুরনো গান। “চৌরঙ্গী,” বললেন তিনি, অথচ চোখে কোনো নির্দেশ বা ভয় ছিল না। শহীদুল দমবন্ধ করে রাস্তার দিকে তাকালেন, মনে মনে ভাবলেন—রাতের এই নিভৃত মুহূর্তে শহর যেন তার নিঃশ্বাসে থেমে আছে।

গাড়ি ধীরে ধীরে চলতে শুরু করল। শহীদুলের নজর চালকের আসন থেকে সিটের দিকে ঘুরল—মহিলা যেন কোনো শব্দ বা কথা ছাড়া নিজের উপস্থিতিতে পুরো গাড়ি ভরে দিচ্ছে। শহরীর ল্যাম্পপোস্টের আলো তাদের উপর ভেসে উঠল, এবং মহিলার চোখে এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখা দিল, যেন তিনি সময়ের এবং বাস্তবের মধ্যে ভাসছেন। শহীদুল চুপচাপ চালাচ্ছেন, কারো সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করছেন না, কারণ সেই নীরবতা যেন একটি অদ্ভুত সুরের মতো তাদের চারপাশে ভেসে চলেছে। হঠাৎ, ঠাণ্ডা হাওয়ার একটি ঝাপটায় শহীদুলের বুক কেঁপে উঠল। গাড়ির ভেতর অদ্ভুতভাবে এক লঘু শীত অনুভূত হলো, যা মহিলার উপস্থিতির সঙ্গে যেন মিলিয়ে গেছে। শহীদুল কল্পনা করলেন—শুধু মহিলাই নয়, পুরো রাত যেন তার সঙ্গে খেলছে। তার চোখের কোণায় তিনি লক্ষ্য করলেন, মহিলার সিটে এক টুকরো শুকনো কাশফুল পড়ে আছে, প্রায় নিশ্চুপ, অথচ সেই ছোট্ট কাশফুলের সৌন্দর্য এবং সংযম এমনকি রাতের অন্ধকারকেও ভেঙে দিচ্ছে।

চৌরঙ্গী পৌঁছানোর পর, শহীদুল হেলান দিয়ে দরজা খুললেন। মহিলার কোনো সাড়া নেই, গাড়ি খালি। শহীদুল অবাক হয়ে তাকালেন—নিশ্চয়ই কেউ এই শহরের অদ্ভুত নিয়মে খেলছে। গাড়িতে শুধু শীতল বাতাস, কাশফুলের নরম গন্ধ, এবং একটি অদ্ভুত শান্তি ভেসে থাকে। শহীদুল বুঝতে পারলেন, মহিলার উপস্থিতি শরীর ও মনকে নরমভাবে স্পর্শ করেছে, কিন্তু বাস্তবে তিনি নেই। শহীদুল ট্যাক্সি চালানোর অভিজ্ঞতায় অনেক অদ্ভুত রাত দেখেছেন, কিন্তু এই রাত যেন অন্যরকম। পার্ক স্ট্রিট থেকে চৌরঙ্গী—এই সাধারণ পথেও যে এক অদ্ভুত, নিঃশব্দ যাত্রা হতে পারে, তা তিনি আগে কখনো অনুভব করেননি। তিনি বসে রইলেন, কাশফুল হাতে নিয়ে, মনে মনে ভাবলেন—এই মহিলার গল্প কি কখনো শেষ হবে? রাতের শহরের নিঃশব্দে, সেই যাত্রীর ছায়া যেন স্থায়ী হয়ে রইল শহীদুলের মনে, যা আগামীদিনে তাঁর প্রতিটি রাতকে অদ্ভুতভাবে স্পর্শ করবে।

অধ্যায় ২ – আতঙ্কের ফিসফিসানি

পরের দিন শহীদুল আলি সকালে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে এসে বসলেন। রাতের অভিজ্ঞতার কথা তিনি ভাবছিলেন—চৌরঙ্গীর সেই অদ্ভুত যাত্রী, যে হঠাৎ গাড়িতে উঠে এসে আবার নিখোঁজ হয়ে গেল, যেন কখনো উপস্থিতই ছিলেন না। স্ট্যান্ডের অন্য চালকরা, যারা দীর্ঘদিন ধরে কলকাতার রাতের রাস্তায় ট্যাক্সি চালান, শহীদুলের মুখের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শুনে চোখ বড় করে তাকালেন। শহীদুল শুরু করলেন সেই ঘটনা বর্ণনা করতে—কিভাবে পার্ক স্ট্রিটে এক সাদা শাড়ি পরা মহিলা উঠে বসেছিলেন, নরম কণ্ঠে “চৌরঙ্গী” বলেছিলেন, কিভাবে তিনি গন্তব্যে পৌঁছে বুঝলেন, গাড়িতে আর কেউ নেই, শুধু এক টুকরো শুকনো কাশফুল। কথার মাঝখানে শহীদুল একটু থমকে গেলেন, মনে হলো আবারও সেই শীতল হাওয়া তাঁর চামড়ায় ছুঁয়ে যাচ্ছে।

অন্যান্য চালকরা চুপচাপ শোনলেন, একে অপরের দিকে তাকিয়ে নীরবতা ভেঙে বললেন, “শহীদুল, শুনেছি আমরা সবাই এরকম কিছুটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা পেয়েছি।” একজন বৃদ্ধ চালক, যার চেহারা বছরের অভিজ্ঞতা দ্বারা গঠিত, হেসে বললেন, “এই শহরে রাতের কোনও জায়গা স্বাভাবিক নয়, এবং এমন কিছু ঘটনা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়, আমরা মানুষের ভেতর নেই, আমরা শহরের ছায়ায়।” কিছু চালক মৃদু ফিসফিস করে বললেন, “আমরা তাকে ‘চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী’ বলি। কেউ জানে না তাঁর নাম, কেউ দেখেছে না তাঁকে আবারও। তবে যিনি এই রাস্তায় রাত কাটান, তাঁরা সবাই অনুভব করেছেন—কখনো কখনো এই শহরের নিঃশব্দে কিছু অতিপ্রাকৃতিক উপস্থিতি আমাদের কাছাকাছি আসে।” শহীদুলের কণ্ঠে অবিশ্বাস আর ভয় একসাথে ভেসে উঠল। তিনি বললেন, “আমি দেখেছি… এবং বিশ্বাস করতে পারছি না। কিন্তু সত্যিই, গাড়িতে কেউ ছিল না, শুধু সেই কাশফুল। মনে হচ্ছে, শহর নিজেই আমাদের গল্প বলছে।”

সেই সকালে শহীদুলের বর্ণনা শুনে ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের সবাই অদ্ভুতভাবে নীরব হয়ে গেল। কেউ কেউ একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি একা নন, শহীদুল। আমরা সবাই এই নিঃশব্দ যাত্রীকে কখনো না কখনো দেখেছি।” কথাগুলো ফিসফিস করে ভেসে গেল, যেন শহরও নীরবতা এবং রহস্যের সঙ্গে হাসছে। শহীদুল অনুভব করলেন, এই ঘটনা শুধুই তাঁর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—পুরো শহর, পুরো ট্যাক্সি চালকদের নীরব অভিজ্ঞতা, এক ধরনের আতঙ্ক এবং কৌতূহল ছড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে, ‘চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী’ কেবল একটি নাম নয়, এটি রাতের শহরের অদৃশ্য ভয়, যা প্রত্যেক রাতেই ফিসফিস করে শহীদের মনে গুঁজে দেয়। কথোপকথন শেষ হলেও শহীদুল জানতেন, এই গল্প তার মনে থেকে যাবে, এমনকি যখন তিনি নিজেও রাতের রাস্তায় ফিরবেন, সেই অদ্ভুত, অদৃশ্য যাত্রীর ছায়া তাঁর সঙ্গে থাকবে, ফিসফিস করে কথা বলবে, আর শহরকে আরও রহস্যময় করে তুলবে।

অধ্যায় ৩ – ইউনিয়ন নেতার সংশয়

গৌতম দে, ট্যাক্সি ইউনিয়নের নেতা, এক ব্যক্তিত্ব যার মধ্যে সঙ্গতি এবং বাস্তববাদী মনোভাব ছিল প্রায় অতিরিক্ত মাত্রায়। স্ট্যান্ডে প্রতিদিন সকালে আসা–যাওয়া, চালকদের অভিযোগ শোনা এবং কাজের সূচি ঠিক রাখা—সবকিছুই তাঁর নিয়মিত জীবনের অংশ। সেই কারণে, শহীদুল আলি এবং অন্যান্য চালকদের ‘চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী’ নিয়ে ভয়ঙ্কর গল্পগুলোকে তিনি একেবারেই মানতে রাজি ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, “এই রাতের গল্পগুলো, চালকরা নিজেদের ভয়কে কিছুটা নাটকীয় করে তুলে ধরে। রাতের একাকিত্ব, ভাঙা রাস্তার আলো, একা থাকার মানসিক চাপ—সব মিলিয়ে কিছু অভিজ্ঞতা বড় হয়ে যায়।” তিনি চালকদের সঙ্গে আলোচনা করে বললেন, “আপনাদের কিছু দেখার প্রয়োজন নেই। এই শহরের অন্ধকার রাতে কিছুই অদ্ভুত নয়। কেউ যদি অদ্ভুত কিছু দেখতে পায়, তা শুধু মনের খেলা।” তাঁর কণ্ঠে দৃঢ়তা এবং অভিজ্ঞতার প্রমাণ মিলেছিল—একজন নেতা যে চেয়েছিল বাস্তবকে সরলভাবে দেখাতে। কিন্তু সেই রাতের নিস্তব্ধতা, সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলার গল্প, সবকিছুই তার মনের কোণে অদ্ভুতভাবে প্রতিধ্বনি করতে থাকল।

একটি রাত, গৌতম নিজেই সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি দেখবেন—কতটা সত্যি বা ভানমূলক এই কাহিনী। তিনি তাঁর পুরনো ট্যাক্সি চালু করলেন, রাস্তায় নামলেন এবং পার্ক স্ট্রিটের কাছে সেই স্থানে পৌঁছালেন, যেখানে শহীদুল এবং অন্যান্যরা মহিলাকে তুলেছেন বলে বলেছিলেন। অন্ধকার গভীর, বাতাস নরমভাবে শীতল। হঠাৎ, তিনি দেখলেন—ফুটপাথের আলোয় এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, সাদা শাড়ি পরা, শান্ত অথচ রহস্যময়। তাঁর হৃদয় হঠাৎ কেঁপে উঠল। তিনি ট্যাক্সি থামালেন, দরজা খুললেন, এবং মহিলার দিকে হাত বাড়ালেন। মহিলার চোখে কোনো ভয় বা উত্তেজনা নেই, বরং একটি অদ্ভুত নিরবতা যা সবকিছুকে স্তব্ধ করে দিচ্ছিল। গৌতম হালকা কণ্ঠে বললেন, “আপনি… চৌরঙ্গীর দিকে যাচ্ছেন?” মহিলার কোনো উত্তর নেই, শুধু নীরবভাবে হালকা হাঁসি এবং নিখোঁজ হাওয়ার মতো উপস্থিতি। গৌতমের অবিশ্বাস কেঁপে উঠল—তাঁর বাস্তববাদী মনও সেই মুহূর্তে স্থবির হয়ে গেল।

গাড়ি ধীরে ধীরে চালু হলো, কিন্তু গৌতম অবাক হয়ে দেখলেন—যে মুহূর্তে তিনি মহিলার গাড়ি থেকে নামার আশা করলেন, তিনি দেখলেন, গাড়িতে কেউ নেই। শুধু ঠাণ্ডা বাতাস এবং একটি টুকরো শুকনো কাশফুল, যা যেন অদ্ভুতভাবে হালকা আলোতে ভেসে যাচ্ছে। গৌতম হঠাৎ বুঝলেন, যা তিনি আগে অবিশ্বাস্য বলে মনে করেছিলেন, তা বাস্তবে ঘটেছে। স্ট্যান্ডে ফিরে আসার পর, তিনি কিছুই বলেননি—কিন্তু তাঁর চোখে সেই রাতের ছায়া, সেই মহিলার নিখোঁজ উপস্থিতি, বারবার ফিরে আসছিল। পরের দিন, গৌতম চালকদের কাছে দাঁড়িয়ে ভেবেছিলেন, কীভাবে তিনি এই গল্পগুলোকে কেবল ভয়ঙ্কর গল্প বলার চেষ্টা মনে করেছিলেন। গৌতমের মধ্যে যে বাস্তববাদ এবং সঙ্গতি ছিল, তা সেই রাতে প্রথমবার কেঁপে উঠল, কারণ তিনি নিজেই অনুভব করেছিলেন—চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী কেবল গল্প নয়, বরং শহরের রাতের একটি নিঃশব্দ সত্য, যা যেকোনো অভিজ্ঞ মনকে স্তব্ধ করে দিতে পারে। সেই রাতের অভিজ্ঞতা, যা শুরুতে অবিশ্বাসের সঙ্গে উপেক্ষিত হয়েছিল, গৌতমের কাছে একটি নতুন আতঙ্কের সংজ্ঞা হয়ে উঠল, এবং সেই আতঙ্ক তার প্রতিদিনের রাস্তায় প্রতিফলিত হতে লাগল, যেন শহর নিজেই তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে—নিশ্চয়ই কিছু নেই যা মানুষের চোখে দেখা যায়।

অধ্যায় ৪ – সাংবাদিকের অনুসন্ধান

সঞ্জনা চক্রবর্তী, কলকাতার একটি ছোট কিন্তু প্রতিশ্রুতিশীল সংবাদপত্রের তরুণ সাংবাদিক, শহীদুল আলি এবং অন্যান্য চালকদের গল্প শুনে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। তার মনের মধ্যে প্রশ্নগুলো ভাসছিল—কেন এক রাত্রে এক অদ্ভুত যাত্রী এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল, এবং কেন ট্যাক্সি চালকেরা একে ভয়ঙ্কর ও রহস্যময় অভিজ্ঞতা বলে মনে করে। সঞ্জনা দৃঢ় ছিলেন—তিনি এক বৃত্তান্ত লিখবেন যা শুধুমাত্র কৌতূহলের খাতায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং শহরের ইতিহাস ও মানুষের অদৃশ্য ভয়কে উদ্ভাসিত করবে। তিনি রাতের কলকাতার ভিড়, ফুটপাথের দোকান, চায়ের হাট, পুরনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ড—সব জায়গায় উপস্থিত হলেন, যেখানে এই গল্পগুলোর সাক্ষী থাকতে পারে। শহীদুল, গৌতম দে, এবং অন্যান্য চালকরা তাকে একে একে অভিজ্ঞতা শোনালেন। সঞ্জনা লক্ষ্য করলেন, গল্পের নোটগুলো একরকম নয়—প্রত্যেকটি চালক ভিন্নভাবে ঘটনা বর্ণনা করেছে, কিন্তু সবকিছুর মূলধারায় একটি নির্দিষ্ট নিঃশব্দ আতঙ্ক ও অদৃশ্য উপস্থিতি স্পষ্ট।

সঞ্জনা চালকেরা যে স্থানে মহিলাকে তুলেছে, সেই পার্ক স্ট্রিট, চৌরঙ্গী পর্যন্ত নিজে গিয়ে দেখলেন। তিনি দোকানদারদের সঙ্গে আলাপ করলেন, যারা রাতের সময়ের অদ্ভুত ঘটনার কিছুটা জ্ঞান রাখে। তাদের কথায় উঠে এল কলকাতার পুরনো ইতিহাস, যেখানে বলা হয়, শহরের কিছু নির্দিষ্ট স্থান এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক শক্তি ধারণ করে। কেউ বললেন, “শহরের এই অংশগুলো শতবর্ষ ধরে নিঃশব্দ গল্প রাখে—কিছুই মানুষের চোখে দেখা যায় না, কিন্তু শহর নিজেই স্মরণ রাখে।” সঞ্জনা নোট তুললেন, যেগুলো দেখিয়েছে যে ‘চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী’ কেবল কোনো এক রাতের কল্পনা নয়; বরং এটি শহরের অতীত এবং ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত, এমনকি ১৯ শতাব্দীর পুরনো রেকর্ডেও ট্যাক্সি বা রিকশা চালকদের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার উল্লেখ রয়েছে। পুরনো যাত্রীদের সাক্ষাৎকার থেকে জানা গেল, একসময় এমন মহিলাদের দেখা যেত, যারা এক অদ্ভুত উদ্দেশ্য নিয়ে শহরের নির্দিষ্ট পথে ঘুরতেন, কিন্তু কখনও কেউ তাদের ঠিকভাবে চিনতে পারত না।

সঞ্জনা গভীরভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে বুঝতে পারলেন, এই ঘটনার শিকড় কলকাতার পুরনো ইতিহাসে গাঁথা। শহরের রেলস্টেশন, পার্ক স্ট্রিটের গলির মোড়, এবং চৌরঙ্গীর কিছু নিঃসঙ্গ স্থান—সবই এক ধরনের নিঃশব্দ শক্তি ধারণ করে, যা অতীতের স্মৃতি, অদৃশ্য যাত্রীর ছায়া এবং শহরের সামাজিক ইতিহাসকে একত্রিত করে। তিনি নোট করেছেন, এই সব ঘটনা শুধু রাতের অন্ধকারে সীমাবদ্ধ নয়, বরং শহরের প্রতিটি কৌতূহলপূর্ণ স্থান এবং মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। সঞ্জনা বুঝতে পারলেন, তার প্রতিবেদন কেবল গল্পের সংকলন নয়—এটি শহরের অদৃশ্য ইতিহাসের একটি দরজা, যা পাঠককে রাতের কলকাতার নিঃশব্দ রহস্যের সঙ্গে পরিচয় করাবে। অনুসন্ধান যত বাড়ছিল, তিনি অনুভব করছিলেন যে ‘চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী’ শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতা নয়, বরং কলকাতার এক নিরব গল্পের অংশ, যা শোনা, দেখা বা বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভূত হয়—সেটি শহরের প্রতিটি রাতে নিঃশব্দ ফিসফিসানি হয়ে ঘুরে বেড়ায়।

অধ্যায় ৫ – চায়ের দোকানের সাক্ষী

হরিপদ মিস্ত্রি, পার্ক স্ট্রিটের এক ছোট কিন্তু পরিচিত চায়ের দোকানের মালিক, রাতের কলকাতার নিঃশব্দ অভিজ্ঞতার এক অদ্ভুত সাক্ষী। সঞ্জনা চক্রবর্তী যখন তাঁর দোকানে প্রবেশ করলেন, হরিপদ একটু হতবাক হলেও আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানালেন। রাতের ভিড়, রাস্তার ফ্লিকারিং আলো এবং দূরের সাউন্ড অফ ট্রাফিক—সবই দোকানের ভেতর নিঃশব্দভাবে প্রবেশ করছিল। হরিপদ বললেন, “আমি বহু বছর ধরে রাতের চায়ের দোকান চালাই। রাতের নীরবতা, ফোঁটা ফোঁটা চা, আর পথচারীদের চলাচল—সবই আমাকে অভ্যস্ত। কিন্তু এই সাদা শাড়ি পরা মহিলার ঘটনা, তা অন্যরকম। আমি বহুবার তাঁকে দূর থেকে দেখেছি, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তাঁর ছায়া ভেসে ওঠে, কিন্তু কাছে গেলে—অদ্ভুতভাবে—মিলিয়ে যায়, যেন কখনো উপস্থিতই ছিলেন না।” তিনি চোখের কোণ দিয়ে রাস্তার দিকে ইঙ্গিত করলেন, যেখানে কয়েক সেকেন্ডের জন্য আলোতে মহিলার ছায়া ফুটে উঠত। হরিপদ বললেন, “আপনি দেখবেন, এই ছায়া কেবল অদ্ভুত নয়, বরং একটি গল্প বহন করে—শহরের অতীত, অসমাপ্ত কিছু কাজ, যা এখনও সমাপ্ত হয়নি।”

সঞ্জনা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। হরিপদের কথা মনে মনে যেন এক নিঃশব্দ সঙ্গীতের মতো ভেসে উঠল। তিনি আরও বললেন, “কেউ কখনো দেখেছে না তাঁকে কাছে থেকে। অথচ রাতের শহর যখন নিঃশব্দ, এমনকি গাড়ির হর্নের আওয়াজও দূরে হারিয়ে যায়—তখন সেই ছায়া যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। একবার, আমি দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, মহিলার ছায়া হঠাৎ করে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে উঠল, আমার দিকে তাকাল, এবং আমি যেন কিছুই করতে পারিনি। তিনি মৃদু হাসলেন, চোখে রহস্যময় চাহনি, তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলেন। সেই মুহূর্তের শীতলতা আজও আমার রক্তে লেগে আছে।” হরিপদ বিশ্বাস করতেন, এই মহিলার উপস্থিতি শুধুই ভয়ঙ্কর নয়; বরং এটি শহরের এক অদৃশ্য ইতিহাসকে বহন করছে, যা দিনের আলোয় দেখা যায় না। তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, মহিলার ছায়া কেবল স্থান নয়, বরং সময়ের মাঝেও ভাসছে—যে সময়ে মানুষ অদৃশ্য গল্পকে মনে করে, কিন্তু তা স্পর্শ করতে পারে না।

সঞ্জনা নোট তুলতে তুলতে বুঝলেন, হরিপদের অভিজ্ঞতা পুরো ঘটনাটিকে একটি গভীর মাত্রা দিচ্ছে। এই সাদা শাড়ি পরা মহিলার উপস্থিতি কেবল কোনও অতিপ্রাকৃতিক কল্পনা নয়; এটি শহরের নিঃশব্দ ইতিহাসের অংশ, যা আজও রাতের আলোয়, ফিসফিসানি বাতাসে, এবং পুরনো ল্যাম্পপোস্টের আলোয় পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। হরিপদ বললেন, “আমি বিশ্বাস করি, এই আত্মা চৌরঙ্গীর কোনো অসমাপ্ত কাহিনি বহন করছে। হয়তো কোনো প্রাচীন প্রতিশ্রুতি, কোনো অসমাপ্ত দায়িত্ব, যা সমাপ্ত হওয়ার জন্য শহরের রাস্তায় ভেসে বেড়াচ্ছে।” সঞ্জনা অনুভব করলেন, এই গল্প কেবল ভয়ঙ্কর নয়, বরং একটি নিঃশব্দ ইতিহাসের সাক্ষ্য। হরিপদের অভিজ্ঞতা শহরের রাতের রহস্যকে আরও বাস্তব করে তুলল—যে রাতের নিঃশব্দ, ছায়া, বাতাস এবং আলো একসাথে মিশে একটি অসমাপ্ত কাহিনীর ছায়া সৃষ্টি করে, যা কখনোও পুরোপুরি বোঝা যায় না, তবে অনুভূত হয়, এবং যারা দেখেছে, তাদের মনে স্থায়ীভাবে লেগে থাকে।

অধ্যায় ৬ – হারানো নারীর গল্প

ড. সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতার ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত, দীর্ঘদিন ধরে শহরের পুরনো নথিপত্র, সংবাদপত্র এবং সরকারি রেকর্ড সংগ্রহ করে আসছেন। সঞ্জনার অনুসন্ধান শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, বিষয়টিকে গভীরভাবে খুঁজে দেখা উচিত। ড. সৌম্য কলকাতার পুরনো সংবাদপত্র, বিশেষ করে ১৯৫০-এর দশকের আর্কাইভ ঘেঁটে দেখেন। তাঁর চোখে পড়ে এক অদ্ভুত ঘটনা—চৌরঙ্গীর একটি পুরনো বাড়িতে এক মহিলা বহু বছর আগে দুঃখজনক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। নাম জানা যায়—মাধুরী সেন। সংবাদপত্রে লেখা রয়েছে, “মাধুরী সেন, ২৬ বছর বয়সী, রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত কারণে নিখোঁজ। পরবর্তীতে তাঁর দেহ নদীর পাশে পাওয়া গেল, সম্ভবত দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু।” কিন্তু গল্পের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটি ছিল—স্থানীয়রা বলছেন, মাধুরী সেই রাতে স্বামীকে খুঁজতে গিয়েছিলেন। তিনি এক নিঃশব্দ অন্ধকারে, একা, ট্যাক্সি ধরে শহরের পথ পরিক্রমা করেছিলেন। কিন্তু সেই রাতের পর তিনি আর ফিরে আসেননি।

ড. সৌম্য আরও বলেন, “এই ঘটনা শুধু দুর্ঘটনা নয়। স্থানীয়দের কথা অনুযায়ী, ওই ট্যাক্সি যাত্রা, যা শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে গেছে, সেই সময়ের একটি নিঃশব্দ ট্র্যাজেডির প্রতিফলন। মাধুরীর স্বামী তখনই বিদেশে ছিলেন, এবং মাধুরী একা শহরে, নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যান। খবরের কাগজে লেখা ছিল—‘কেউ মাধুরীকে আর দেখেনি।’ কিন্তু স্থানীয়দের কথা, বিশেষ করে ট্যাক্সি চালক এবং রাতে কর্মরত দোকানদারদের অভিজ্ঞতা, প্রমাণ করে যে, মাধুরীর আত্মা এখনও সেই পথেই ভেসে বেড়ায়, হয়তো স্বামীকে খুঁজে পাওয়ার আশা নিয়ে, হয়তো শহরের অসমাপ্ত গল্প বহন করে।” ড. সৌম্য তাঁর নোটে সংযোজন করলেন, এই ঘটনাটি শুধুই অতীতের খবর নয়; এটি চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রীর সাথে সরাসরি যুক্ত—যে মহিলার ছায়া রাতের আলোয় ভেসে ওঠে, যে কখনো কাছাকাছি আসে না, কিন্তু নিঃশব্দে উপস্থিত থাকে।

সঞ্জনা চক্রবর্তী শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, এই সব গল্প, চালকের অভিজ্ঞতা, হরিপদ মিস্ত্রির ছায়া দেখা, এবং মাধুরীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ—all মিলিয়ে এক গভীর ইতিহাসের অংশ। ড. সৌম্য বলেন, “শহর শুধু জীবিত মানুষেরই নয়; অতীতের স্মৃতি, অসমাপ্ত প্রতিশ্রুতি, এবং হারানো আত্মাগুলোও এখানে বেঁচে আছে। চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী সেই হারানো মহিলার ছায়া—যিনি স্বামীকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। শহীদুল আলি, গৌতম দে, হরিপদ মিস্ত্রি—তাদের প্রত্যেক অভিজ্ঞতা এই নিঃশব্দ ট্র্যাজেডির সাক্ষ্য বহন করে।” সঞ্জনা তখন বুঝলেন, তার প্রতিবেদন কেবল রহস্যের গল্প নয়; এটি শহরের নিঃশব্দ ইতিহাসের পুনর্গঠন, যা হারানো মহিলার কষ্ট, চৌরঙ্গীর নিঃশব্দ পথ এবং কলকাতার রাতের শহরের সঙ্গে যুক্ত। শহরের ইতিহাস, নিঃশব্দ বাতাস, এবং ছায়ার মধ্যে সেই মহিলার গল্প এখন জীবন্ত হয়ে ওঠে, যা প্রত্যেক রাতেই ফিসফিস করে নতুন করে শহরে ভেসে ওঠে।

অধ্যায় ৭ – রহস্যের গভীরে

সঞ্জনা চক্রবর্তী, তাঁর অনুসন্ধানকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য সেই পুরনো বাড়িতে পৌঁছালেন। চৌরঙ্গীর এই মহল, যা একসময় শহরের একটি ভিড়পূর্ণ, প্রাচীন পরিবারের গর্বের প্রতীক ছিল, এখন ধ্বংসপ্রায় অবস্থায়। ভাঙা জানালা, ছেঁড়া জানালা-পট্টি, ধুলো-মাটি আর উড়ে থাকা পুরনো কাগজপত্র—সবই তাকে সময়ের প্রবাহে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী মনে করাল। বাড়ির গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তিনি কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকালেন, মনে করলেন—কত মানুষ, কত গল্প, কত স্বপ্ন এখানে শুরু হয়েছিল এবং হারিয়েছে। তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন। প্রত্যেক ধাপে ধুলো এবং ভাঙা কাঠের শব্দ যেন অতীতের নিঃশব্দ কণ্ঠকে উদ্দীপ্ত করছে। ঘরের প্রতিটি কোণ, জানালার ফাঁক, এবং ছাদে উড়ে থাকা ধুলো—সবই যেন তাঁর চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা সৃষ্টি করছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল মূল হল—যেখানে দেয়াল এবং একটি পুরনো আলমারি এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যদিও জায়গা প্রায় ধ্বংসপ্রায়।

সঞ্জনা আলমারি ঘেঁটে ঘরে প্রবেশ করলেন এবং চোখ পড়ল দেয়ালে ঝুলে থাকা এক পুরনো ছবিতে। ছবিটি প্রায় ধুলোমাখা, রঙ ফিকে হয়ে গেছে, কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে সে সাদা শাড়ি পরা মহিলার উপস্থিতি অনুভূত হলো। মহিলার চোখে যে শূন্যতা—যা শহীদুল, গৌতম দে এবং হরিপদ মিস্ত্রি বর্ণনা করেছিলেন—ঠিক সেই একই শূন্যতা সেখানে ফুটে উঠেছে। ছবির আঙুল, চুল, এবং ভঙ্গি—সবই এক অদ্ভুত স্থিরতা বহন করছে, যা যেন বলতে চাচ্ছে, “আমি এখানে ছিলাম, কিন্তু এই শহরের ইতিহাসের অংশ হয়ে একেবারেই অদৃশ্য।” সঞ্জনা অনুভব করলেন, যে রাতের মহিলার ছায়া তিনি দেখেছেন, যে কাশফুল চালকের সিটে পড়েছিল, সবকিছু এই ছবির সঙ্গে জড়িত। একটি নিঃশব্দ শিহরণ তাঁর মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল—এটি কোনো কল্পনা নয়; এই মহিলার গল্প বাস্তব, এবং এই প্রাচীন বাড়ি সেই বাস্তবের নিঃশব্দ ধারক।

তিনি ছবির চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলেন, এবং খুঁজে পেলেন দেয়ালে লিখে থাকা অদ্ভুত আখ্যা ও নম্বর। এগুলো কোন সাধারণ লেখা নয়; স্থানীয় চিহ্ন, তারিখ, এবং অদ্ভুত প্রতীকগুলো দেখে সঞ্জনা বুঝলেন, এটি হয়তো ওই মহিলার বা তার পরিবারের কোনো গোপন চিহ্ন। তিনি হাত দিয়ে ছবির ফ্রেম স্পর্শ করলেন—হঠাৎ একটি হালকা হাওয়া ঘরে প্রবেশ করল, যেন সে মহিলার উপস্থিতিকে পুনরায় জীবিত করছে। সঞ্জনা অনুভব করলেন, এই বাড়ি, এই ছবি, এবং সেই মহিলার নিঃশব্দ চোখ—সব মিলিয়ে শহরের অতীত, অসমাপ্ত ট্র্যাজেডি, এবং চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রীর রহস্যের কেন্দ্র। তিনি স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, জানতেন যে, তার প্রতিবেদন শুধুই তথ্য সংগ্রহ নয়—এটি শহরের নিঃশব্দ ইতিহাস এবং হারানো আত্মার গল্পের পুনর্গঠন। সেই রাতে, সঞ্জনা বুঝলেন, রহস্য কেবল অতীতের গল্প নয়; এটি এখনও শহরের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, নিঃশব্দ ফিসফিসানি হয়ে প্রতিটি রাস্তায়, ছায়ায়, এবং বাতাসে উপস্থিত।

অধ্যায় ৮ – ভয়ংকর রাত

গৌতম দে, ট্যাক্সি ইউনিয়নের দৃঢ় নেতা, যিনি আগে চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রীকে কেবল গল্প মনে করতেন, সেই রাতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন। তিনি জানতেন, এটি কেবল একটি পরীক্ষা নয়—একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা, যা তাঁর জীবনের সমস্ত ধ্রুব বাস্তববাদকে কাঁপিয়ে দিতে পারে। রাত গভীর, পার্ক স্ট্রিটের ল্যাম্পপোস্ট ম্লান আলো ছড়াচ্ছে, এবং শহরের রাস্তা নীরব। গৌতম ট্যাক্সি চালাচ্ছিলেন, চারপাশে হালকা বাতাস বইছে, তবে মন জানছিল—কিছু অদ্ভুত ঘটতে যাচ্ছে। হঠাৎ, তিনি দেখলেন সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলা, নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে, ট্যাক্সির দরজার দিকে তাকিয়ে। গৌতম থামলেন, ভয় এবং কৌতূহলের মধ্যে দ্বিধা অনুভব করলেন, কিন্তু সাহস করে দরজা খুললেন। মহিলার চোখে সেই নিঃশব্দ শূন্যতা, যা চালকেরা আগে দেখেছেন, সরাসরি তাঁর সামনে উপস্থিত হলো।

গৌতম ট্যাক্সির ভেতরে বসালেন, কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা, কিন্তু স্পষ্ট—“চৌরঙ্গী,” বলল মহিলা। গৌতম চালু করলেন গাড়ি এবং সাহস করে পেছন দিকে তাকালেন। মুহূর্তের মধ্যে চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা পড়ল, যেন শহরের সমস্ত আলো নিভে গেছে। গাড়ির ভেতর হঠাৎ একটি দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল, মৃদু, গভীর এবং মর্মস্পর্শী—“আমি এখনও পৌঁছাতে পারিনি…” গৌতমের বুক কেঁপে উঠল। শ্বাসরুদ্ধ করে তিনি অনুভব করলেন, নিঃশ্বাসে ঠাণ্ডা হাওয়া, কাশফুলের মতো ছোট্ট নিঃশব্দ চিহ্ন, এবং মহিলার অস্তিত্ব—সবই এক অদ্ভুত বাস্তবতার সঙ্গে মিলিত। তাঁর হাত দমতে থাকল, চোখের কোণ দিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে অনুভব করলেন, যে সময় এবং স্থান কেবল বাস্তব নয়, বরং এক অদৃশ্য অতীত এবং বর্তমানে ভেসে বেড়াচ্ছে।

গৌতম আতঙ্কে প্রায় জ্ঞান হারাতে চললেন। তার মনকে জড়িয়ে ধরল সেই সব অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি—শহীদুল আলি, হরিপদ মিস্ত্রি, সঞ্জনার অনুসন্ধান, এবং ড. সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিখুঁত নথি সবই এক সঙ্গে মিলিয়ে ভয়ঙ্কর বাস্তবতা হয়ে উঠল। গাড়ি অন্ধকারে ঘোরাঘুরি করছিল, রাস্তার প্রতিটি কোণ যেন মহিলার উপস্থিতির সাক্ষী। গৌতম বুঝতে পারলেন, এই মহিলার গল্প কেবল অতীতের ট্র্যাজেডি নয়; এটি শহরের প্রতিটি রাতের নিঃশব্দ ফিসফিসানি, যা মানুষের ভয় এবং কৌতূহলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ, ঠাণ্ডা হাওয়া, অদৃশ্য ছায়া—সব মিলিয়ে গৌতমের মনে স্থায়ীভাবে একটি বার্তা ছেড়ে গেল: চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী কেবল গল্প নয়, বরং একটি নিঃশব্দ সত্য, যা কখনও পৌঁছায় না, কিন্তু প্রতিটি রাতে শহরের নিঃশব্দ পথ ধরে ভেসে বেড়ায়।

অধ্যায় ৯ – অসমাপ্ত যাত্রা

সঞ্জনা চক্রবর্তী এবং ড. সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় রাতের কলকাতার অন্ধকার রাস্তা এবং পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে এক অদ্ভুত সত্যের খোঁজে বের হলেন। তারা বুঝতে চেয়েছিলেন, চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী কেবল একটি শহরের শহীদুল আলি বা গৌতম দে–এর অভিজ্ঞতা নয়; এটি এক ব্যক্তির অসমাপ্ত গল্প, যা অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে। তারা পুরনো সংবাদপত্র, সরকারি নথি, এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানলেন, যে মহিলার নাম মাধুরী সেন। এক রাত, স্বামীকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু আর ফিরে আসেননি। তার মৃত্যু কোনো সাধারণ দুর্ঘটনা ছিল না—এটি ছিল এক অপূর্ণ অভিমান এবং প্রতীক্ষার বোঝা। শহরের কৌতূহল এবং নিঃশব্দতা তাকে এমন একটি বাস্তবতার মধ্যে আটকে রেখেছিল, যেখানে জীবিতদের চোখে দেখা যায় না, কিন্তু নিঃশব্দে প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি ল্যাম্পপোস্ট এবং প্রতিটি বাতাসের ঝোঁক তার উপস্থিতিকে বহন করে।

সঞ্জনা এবং ড. সৌম্য বাড়ি ঘেঁটে, স্থানীয় দোকানদার, চালক এবং পুরনো প্রতিবেশীদের সাক্ষাৎকার নিলেন। তারা জানতে পারলেন, মাধুরীর আত্মা চৌরঙ্গীর রাস্তা ধরে বারবার ঘুরছে। কেউ বলেন, রাতের নিঃশব্দে যে মহিলার ছায়া দেখা যায়, সেটি মাধুরীরই। কারও মতে, তিনি ট্যাক্সিতে ওঠেন, আবার অদৃশ্য হয়ে যান—যেমন সে আশায় ভরা অভিমানকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিটি রাতের পথ চলছেন। শহীদুল আলি, গৌতম দে, হরিপদ মিস্ত্রি—প্রত্যেকের অভিজ্ঞতা একে অপরের সাথে মিলেছে, কিন্তু কেউই পুরো ছবি বোঝেনি। সঞ্জনা এবং সৌম্য বুঝলেন, এটি এক অসমাপ্ত যাত্রা, যেখানে মহিলার মৃত্যুর আগে এবং পরে হওয়া ঘটনাগুলো এখনো শহরের চারপাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। তার অভিমান, তার স্বামীর অপেক্ষা, তার অজানা দুঃখ—সবই একটি নিঃশব্দ বাস্তবতার অংশ, যা রাতের আলো এবং ছায়ার মধ্য দিয়ে শহরকে অনুসরণ করছে।

শেষ পর্যন্ত তারা বুঝলেন, চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রা কেবল অতীতের গল্প নয়; এটি জীবিত এবং মৃতের মাঝের সংযোগ। মাধুরীর আত্মা শহরের নিঃশব্দ পথে প্রতিটি রাতে ঘুরছে, যেমন একজন যিনি কখনো তার উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারেননি। সঞ্জনা মনে করলেন, এই যাত্রা, এই ছায়া, এই দীর্ঘশ্বাস এবং কাশফুল—সবই শহরের ইতিহাস এবং মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অমর হয়ে আছে। ড. সৌম্য যোগ করলেন, “আমরা যা দেখছি, তা শুধুই ঘটনা নয়, বরং একটি নিঃশব্দ বার্তা—কত মানুষই তাদের প্রতীক্ষা, অভিমান এবং অসমাপ্ত কাজের কারণে শহরের পথে হেঁটে যায়।” সঞ্জনা এবং সৌম্য বুঝলেন, যাত্রা কখনও শেষ হয় না; যেমন মাধুরীর ছায়া এখনও চৌরঙ্গীর পথে ভেসে বেড়াচ্ছে, মানুষের চোখে অদৃশ্য, তবে অনুভূত হয়—একটি নিঃশব্দ যাত্রা, যা শহরের রাতের গল্পকে চিরন্তন করে তুলেছে।

অধ্যায় ১০ – চিরন্তন যাত্রী

শহীদুল আলি জানতেন, এটি অন্য কোনো রাত নয়—এটি সেই রাত, যেটি সমস্ত রহস্য এবং দীর্ঘ অনুসন্ধানের চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছে গেছে। তিনি ট্যাক্সি চালাচ্ছিলেন, রাতের শহর নীরব, বাতাস ঠাণ্ডা, আর রাস্তায় শুধু হালকা আলো ফুটছে। তিনি জানতেন, সেই সাদা শাড়ি পরা মহিলা আবার তাঁকে অপেক্ষা করছে। কিন্তু ভয়, সংশয় বা আতঙ্ক এই রাতে তার মনকে ঘিরে রাখেনি। বরং সহানুভূতি, গভীর বোঝাপড়া এবং ইতিহাসের বোঝা তাকে পরিচালিত করছিল। তিনি চুপচাপ ট্যাক্সি চালাচ্ছিলেন, যেন জানতেন—মহিলা শুধু তার গন্তব্যে পৌঁছাতে চায়, আর শহীদুল সেই নিঃশব্দ যাত্রার একমাত্র সাক্ষী। হঠাৎ, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মহিলার উপস্থিতি ফুটে উঠল, কিন্তু তার চোখে কোনো ভয় নয়—শুধু এক গভীর, চিরন্তন নিরবতা। শহীদুল মৃদু কণ্ঠে বললেন, “আপনার গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন।” সেই মুহূর্তে, তিনি বুঝলেন, এটি কোনো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা নয়; এটি একটি দীর্ঘ অপেক্ষা ও অভিমান বহনকারী আত্মার শান্তির এক মুহূর্ত।

গাড়ি ধীরে ধীরে চৌরঙ্গীর মোড়ে পৌঁছাল। শহীদুল থামলেন, ট্যাক্সি স্থির হলো, আর মহিলার ছায়া ধীরে ধীরে উজ্জ্বল আলোতে ভেসে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে, তিনি মিলিয়ে গেলেন—কিন্তু হঠাৎ একটি মৃদু হাসি রেখে গেলেন, যা শহীদুলের মনে গভীর ছাপ ফেলল। সেই হাসি ভয়ঙ্কর নয়, বরং শান্তি এবং সমাপ্তির প্রতীক। শহীদুল বুঝলেন, সমস্ত রাতের রহস্য, চালকের ভয়, সঞ্জনার অনুসন্ধান, ড. সৌম্যর খোঁজ— সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মহিলার উপস্থিতি আর নেই, কিন্তু তার নিঃশব্দ যাত্রার প্রতিধ্বনি এখনও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। শহীদুলের মনে একটি অদ্ভুত প্রশান্তি জন্মালো—যেমন শহর নিজেই এক দীর্ঘ ইতিহাসের অভিমানকে মেনে নিয়েছে এবং এক আত্মাকে শান্তি দিচ্ছে।

পরের দিন থেকে, শহীদুল আর কাউকে সেই মহিলার দেখা দেওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। তবে চৌরঙ্গীর বাতাসে, রাতে রাস্তার নিঃশব্দে, ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এখনও শোনা যায় তার নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি। কেউ তার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে না, কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারে না, কিন্তু প্রতিটি রাতের নিঃশব্দ পথের সাথে তার যাত্রা এখনও শহরের সাথে মিলেমিশে চলতে থাকে। শহীদুল বুঝলেন, চৌরঙ্গীর অদৃশ্য যাত্রী কেবল একটি নিঃশব্দ গল্প নয়; এটি শহরের ইতিহাস, মানুষের কৌতূহল, ভয়, অভিমান এবং প্রতীক্ষার চিরন্তন প্রতীক। শহর হয়তো পরিবর্তিত হয়েছে, রাস্তা নতুন হয়েছে, মানুষ এসেছে এবং গেছে—তবু সেই মহিলার নিঃশব্দ উপস্থিতি, তার শেষ হাসি এবং অসমাপ্ত যাত্রার প্রতিধ্বনি চিরকাল চৌরঙ্গীর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, শহরের রাতকে রহস্যময় এবং চিরন্তন করে রেখেছে।

–শেষ–

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *