চৈতালি রায়
অধ্যায় ১:
রাতটা ছিল ঠান্ডা আর নির্জন। শহরের প্রান্তে থাকা পুরনো গুদামঘরটাকে দিনের আলোয় যতটা ভাঙাচোরা মনে হয়, রাতের আঁধারে ততটাই গা ছমছমে লাগে। কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে রাখা জায়গাটায় কেবল একটি লোহার গেট, আর তার পেছনে ঝুলে থাকা আধমরা ফ্লাডলাইট। সে আলো মাঝে মাঝে ঝিমিয়ে পড়ে, আবার হঠাৎ জ্বলে উঠে যেন নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চায়। চিনু, ছায়ার মতো নিঃশব্দ পায়ে হেঁটে ঢুকে পড়ে সেই জায়গায়। শহরের অন্য প্রান্তে দুটো মোবাইল আর একটা মানিব্যাগ চুরি করে সে এখন একটু বড় মাছ ধরার আশায় এখানে এসেছে। খবরে পড়েছিল, এই গুদামে নাকি নতুন ইলেকট্রনিক্স মাল এসেছে—টিভি, ফ্রিজ, ইনভার্টার—যা প্যাকেটবন্দি অবস্থায় পড়ে থাকে অন্তত এক-দুইদিন। চিনুর মাথায় একটা স্পষ্ট হিসেব: একটা গুদাম, রাত একটা, নিশ্চই কেউ নেই। ভেতরে ঢুকে হালকা একটা আলো চালিয়ে সে এগোতে থাকে। ঠিক তখনই, হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে চারপাশ জ্বলে ওঠে আর একটা কড়া গলা শোনা যায়—”ওই শালা! দাঁড়া, কোথায় যাচ্ছিস?”
চিনু চমকে ওঠে। হাত থেকে টর্চ পড়ে যায়। চোখ ধাঁধিয়ে যায় ফ্লাডলাইটের তীব্র আলোয়। সে ভাবতেই পারেনি কেউ এখানে ডিউটিতে থাকবে। আরও অবাক হয় যখন দেখে আলো থেকে বেরিয়ে আসছে একজন মহিলা, মাথায় মোটা কম্বল জড়ানো, হাতে লাঠি, আর চোখে আগুন। মহিলা সামনে এসে দাঁড়ায়, বোঝা যায়, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, কিন্তু শরীরে বয়সের ক্লান্তি নেই, চোখে ভয় পাইয়ে দেওয়ার মতো এক দৃঢ় দৃষ্টি। “চুরি করতে এসেছিস, না ঘুমোতে?” মহিলার গলায় কটাক্ষ। চিনু পালাতে পারে না, কারণ তার পায়ের নিচে কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখে কথা নেই। মহিলা একটু কাছে আসে, চিনুর চোখে চোখ রেখে বলে, “তোর মত লোক অনেক দেখেছি। কিন্তু আজ তুই ধরা পড়েছিস। পুলিশে দেব?” চিনু শান্ত গলায় বলে, “না দিলে খুশি হই…।” তারপর মাথা নিচু করে বসে পড়ে একপাশে। মহিলাও বসে পড়ে তার পাশে, কাঁধ থেকে লাঠি নামিয়ে রাখে, তারপর হঠাৎ হেসে ওঠে—”এই যে ধরা পড়ে গেছিস, এখন বল তো, চুরি করিস কেন?” চিনু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “বাঁচতে হয়।”
মহিলা চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু দূরের কুকুরের ডাক আর মাঝেমধ্যে ফ্লাডলাইটের ঘনঘন ঝিম ধরা। চিনু ভাবছিল এবার বুঝি মারধর হবে, বা কোনো গালাগালি শুনতে হবে। কিন্তু না—মহিলা হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “তোর নাম কী?” চিনু ধীরে উত্তর দেয়, “চিনু… আসলে চিন্ময়। ছোটবেলা থেকেই কেউ ডাকেনি পুরো নামে।” মহিলা বলে, “আমি কমলা। এই গুদামের পাহারাদার। দশ বছর ধরে এই শীত, গরম, বৃষ্টি—সব কিছু সহ্য করে বসে থাকি রাতভর। তোদের মতো লোক আসে মাঝে মাঝে, কিন্তু তোর মত ধরা পড়েও বসে পড়া কেউ না।” কমলার গলায় একটা ক্লান্ত সুর ছিল, কিন্তু অপমান বা কটাক্ষ ছিল না। চিনু যেন এই অদ্ভুত আচরণে কিছুটা থমকে যায়। সেদিন সেই প্রথম, দুজন অপরিচিত মানুষ—একজন চোর আর একজন চৌকিদার—নিঃশব্দে পাশাপাশি বসে থাকে গুদামের ভেতরের কংক্রিটের উপর, মাঝখানে পড়ে থাকা টর্চের আলোয় তাদের ছায়া মিশে যায়। কোনো শব্দ হয় না, শুধু বোঝা যায়—এই রাতে কিছু একটার শুরু হয়েছে, যা হয়তো তারা নিজেরাও জানে না। এই রাতটা ভুল ছিল না, একেবারে ঠিক ছিল।
অধ্যায় ২:
পরদিন রাতটা ছিল আরও ঠান্ডা, যেন হাড়ের ভেতরে ঢুকে যাওয়ার মতো কাঁপন। গুদামঘরের বাইরে বাতাস বয়ে যাচ্ছিল ফুঁসতে থাকা নদীর মতো। কমলা যথারীতি ফ্লাডলাইটের নিচে বসে ছিল, গায়ে মোটা শাল, হাতে তামার কেটলি ভর্তি চা, আর মুখে সেই একই নির্লিপ্ত ভঙ্গি। আগের রাতের ঘটনার পর তার মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা ছিল, যদিও মুখে প্রকাশ করেনি। সে ভেবেছিল, ছেলেটা আর আসবে না—ধরা পড়ে গিয়েছে, হয়তো ভয় পেয়েছে, হয়তো পালিয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক তখনই, যেন সময়মতো, আবার সেই নিঃশব্দ ছায়ার মতো উপস্থিতি। চিনু আস্তে করে গেট ঠেলে ঢোকে, এবার আর টর্চ নিয়ে নয়, বরং হাতে এক পুরনো বই। চোখে তার চেনা দ্বিধা, কিন্তু পায়ে আত্মবিশ্বাস। কমলা তাকে দেখে বলে না কিছুই, কেবল চোখ তুলে তাকায়, তারপর হাতের কাপটা উঁচু করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—”চা খাবি?”
চিনু মাথা নাড়ায়। তারা আবার বসে পড়ে পাশাপাশি, আগের রাতের মতো। কিছুক্ষণ কেউ কিছু বলে না। বাতাসে ধোঁয়া আর নীরবতা মিশে গিয়ে একটা অদ্ভুত উষ্ণতা তৈরি করে। চিনু এবার নিজেই কথা শুরু করে—”আপনার কথায় ভাবছিলাম, যে লোকটা দশ বছর ধরে এই শীতের রাতে পাহারা দেয়, তার নিজের জীবনটাই তো যেন তালাবন্দি। আপনি একা থাকেন?” কমলা হালকা হেসে বলে, “থাকি, কিন্তু একা নই। চারপাশে অনেক কিছু থাকে—স্মৃতি, অভিমান, শূন্যতা।” তারপর একটু থেমে বলে, “স্বামী মরে গেছে অনেক আগেই। মেয়ে আছে, কিন্তু থাকে অন্য শহরে। ফোন করে, কিন্তু মনে হয় শুধু দায়িত্ব থেকে।” চিনু চুপ করে থাকে। কমলা এক চুমুকে চা শেষ করে, তারপর বলে, “তুই চুরি করিস ঠিক আছে, কিন্তু আজ তুই চুরি করতে আসিসনি। এই বইটা নিয়ে এসেছিস কেন?” চিনু একটু হেসে বলে, “এটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা। একটা পড়তে চেয়েছিলাম আপনাকে শোনাতে… যদি অনুমতি দেন।” কমলার মুখে চমক ভাঙার মতো হাসি ফুটে ওঠে। “চোর যদি কবিতা পড়ে, তাহলে পাহারাদারও তো শ্রোতা হতে পারে। পড়, দেখি।”
সেই রাতে, শহরের প্রান্তে, এক পুরনো গুদামের নিচে বসে একজন চোর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পড়ে আর একজন মহিলা পাহারাদার মন দিয়ে তা শোনে। আশ্চর্যের ব্যাপার, চারপাশের নীরবতা যেন সেই শব্দগুলোকে ভর করে এক অদ্ভুত নরমতায় ছড়িয়ে দেয়। পড়া শেষ হলে চিনু বলে, “এই কবিতাটা আমি প্রথম পড়েছিলাম এক ট্রেন স্টেশনে ছেঁড়া পৃষ্ঠায়। তারপর মনে গেঁথে গিয়েছিল। আজ আপনার মুখে যেন তার মানে বদলে গেল।” কমলা বলে, “তোরও বদলাচ্ছে মনে হয়। চুরি করে কেউ কবিতা পড়তে আসে না।” দুজনে আবার চুপ করে বসে থাকে। দূরে এক কুকুর ডেকে ওঠে, যেন রাতটাকে জাগিয়ে রাখে। সেই মুহূর্তে, যেন অজান্তেই, দুই মানুষের মাঝখানে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য সেতু—যেখানে অপরাধ নেই, পাহারা নেই, শুধু আছে বোঝাপড়া। দ্বিতীয় রাত শেষ হয়, কিন্তু তাদের এই অদ্ভুত সম্পর্কের শুরুটা এবার সত্যিই জমি খুঁজে পায়।
অধ্যায় ৩:
গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল সেই রাতে, যেন শহরটাকে ধুয়ে দিচ্ছিল ক্লান্তি আর ধুলো থেকে। গুদামের সামনে ঝুলন্ত ফ্লাডলাইট একটানা জ্বলছিল, তার কাঁচে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আলোকে ভেঙে টুকরো করে ফেলছিল। কমলা সেই আলোয় বসে ছিল আগের মতোই—পাথরের মতো নিশ্চল, শালের নিচে গুঁজে রাখা হাতে ধরা গরম চায়ের কাপ। তার চোখ জুড়ে ছিল অপেক্ষার অভ্যাস, কিন্তু সেই রাতে অপেক্ষাটাও যেন একটু বেশি দীর্ঘ মনে হচ্ছিল। হঠাৎ, গেটের দড়ি নাড়া পড়ল, তারপর ধীরে ধীরে প্রবেশ করল চিনু—আজকের রাতে একটু ভিজে, গায়ের ওপর হালকা ছাতা, আর মুখে এমন এক রকম প্রশান্তি যেন সে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। কমলা চোখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। চিনু হাসল, ধীরে ধীরে পাশে বসে বলল, “আজ আসতে মন চাইছিল না, কিন্তু না এসে থাকা গেল না।”
বৃষ্টির শব্দের ফাঁকে চিনু গল্প শুরু করল নিজের ছেলেবেলার—কিভাবে ফুটপাথে বড় হয়েছে, কিভাবে পাঁচ বছর বয়সে মা হঠাৎ এক দুপুরে হারিয়ে গেলেন, আর কিভাবে এক বস্তির খালু তাকে তুলে নিয়ে চুরি শেখাতে শুরু করেছিল। “কেউ কখনো ভালোবাসেনি,”—চিনু বলে—“তাই ভালোবাসা জিনিসটা চুরি করা যায় কি না, সেটা বুঝতে চেয়েছিলাম ছোটবেলায়।” কমলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে, “তুই কি কাউকে মারিস কখনো চুরি করতে গিয়ে?” চিনু মাথা নাড়ায়, “না, আমি শুধু নিঃশব্দে চলে আসি। কারও চোখের দিকে তাকিয়ে নিতে পারি না কিছু।” কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটে। তারপর কমলা বলে, “তোর চোখে কেমন একটা বিষণ্ণতা আছে। আমি প্রথম দিনই দেখেছিলাম।” চিনু হেসে ওঠে, “আপনিও দেখার চোখ রাখেন, চোর ধরার থেকেও বড় গুণ সেটা।” সেই হাসি আর বৃষ্টির শব্দ মিলেমিশে যেন এক অন্যরকম শান্তি এনে দেয় সেই রাতে, যেখানে দু’জন মানুষ আস্তে আস্তে বোঝে—তাদের সম্পর্কটা আর শুধুই কৌতূহল বা করুণা নয়, বরং অদ্ভুত এক আত্মিক বন্ধন।
চিনু হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট ছাপা কবিতার খাতা বের করে দেয় কমলার হাতে—“এইটা লিখেছিলাম কয়েক বছর আগে, কিন্তু কাউকে দিইনি। আপনি শুনলে ভালো লাগবে ভাবলাম।” কমলা অবাক হয়ে কবিতাগুলোর পাতা উল্টে দেখে, প্রতিটি লাইনে জীবনের কষ্ট, না-পাওয়ার হাহাকার, আর একটা অদৃশ্য আলোর খোঁজ। সে চুপ করে পড়ে, তারপর বলে, “তোর মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে, চোর হিসেবে তোকে অপচয় মনে হয়।” চিনু এবার আর হাসে না, বরং গভীর গলায় বলে, “তবে আপনি পাহারাদার হিসেবে অদ্ভুত। ধরা পড়িয়েও মুক্তি পাই আপনার কাছে।” তারা দু’জন বসে থাকে, বৃষ্টি বাড়তে থাকে, শহরের ঘুমিয়ে পড়া রাস্তায় তখন কেবল গুদামের ফ্লাডলাইটের নিচে দু’জন মানুষের নীরব আলাপ চলতে থাকে, শব্দহীন প্রেমের মতো—যেখানে কেউ প্রেম শব্দটা উচ্চারণ করে না, কিন্তু তার উপস্থিতি অনুভব করা যায় প্রতিটি ফোঁটা জলে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে। সেই রাতে, দু’জন মানুষের ছায়া এক হয়ে যায়, আর আলোর নিচে বসে তারা বুঝতে পারে—কখন যেন পাহারা আর চুরির খেলা শেষ হয়ে গিয়ে এক অদ্ভুত আত্মার সংলাপ শুরু হয়েছে।
অধ্যায় ৪:
তাদের কথোপকথন যেন ধীরে ধীরে এক অভ্যাসে পরিণত হচ্ছিল। আর অভ্যাসগুলোই তো মানুষকে বদলে দেয়—চিনু সেটা বুঝতে পারছিল নিজের অজান্তেই। চুরির প্রয়োজন যেন অনেক আগেই মুছে গিয়েছিল, গুদামঘরে ঢোকার আসল কারণ এখন আর মালামাল নয়, বরং একজন মানুষ, যার মুখে জীবনের গল্প আছে, যার চোখে একরাশ গভীরতা আছে। চিনু সেই রাতে কমলার জন্য সঙ্গে করে এনেছিল দুইটা ডিমের সিঙাড়া আর একটা পুরনো রেডিও, যেটা সে আগের সপ্তাহে এক ফেলে দেওয়া দোকান থেকে তুলে এনেছিল। কমলা প্রথমে নিতে চায়নি, বলেছিল, “আমি ভিক্ষা নিই না।” চিনু বলেছিল, “এটা ভিক্ষা নয়, গল্পের দাম।” তারপর দু’জন আবার ফ্লাডলাইটের নিচে বসে, রেডিওতে বাজতে থাকা পুরনো রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাঝখানে এক চুমুকে চা খেতে খেতে কমলা বলে, “তোকে দেখে মাঝে মাঝে আমার ছোটবেলার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে। সেও এমন কবিতা লিখত, বই পড়ত, পরে কীভাবে যেন হারিয়ে গেল…” চিনু শুনে শুধু বলে, “আমি কোথাও যাইনি, শুধু অন্য পথে হেঁটেছি।” সে কথা শুনে কমলা আর কিছু বলে না, শুধু চোখ তুলে তাকায়, যেন তার ভেতরে কিছু একটা গলে যেতে চায়।
রাত এগিয়ে যায়, আর আলাপ গাঢ় হয়। আজ তারা কেবল নিজেদের অতীত নয়, ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলে। কমলা বলে, “তুই কি সবসময়ই চুরি করে বাঁচবি?” চিনু একটু হাসে, “চুরি না করলেও আমার মতো মানুষকে কেউ কাজ দেয় না।” কমলা গম্ভীর গলায় বলে, “মানুষ তোকে কবি হিসেবে জানলে কাজ না দিয়ে পারবে না।” চিনু চুপ করে থাকে। হয়তো তার ভিতরে কোথাও একটা সত্যিই চিড় ধরেছে সেই শব্দে। কিছু মুহূর্ত পরে সে বলে, “আপনি যখন বলেন, তখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।” কমলা আর কিছু বলে না, শুধু জানে—এই কথাগুলোই সম্পর্ক তৈরি করে, অদৃশ্য আঙুল দিয়ে হৃদয়ের দেয়ালে দাগ কাটে। গুদামঘরের ধাতব গন্ধ, গাঢ় নীরবতা, আর মাঝেমধ্যে পাশের রেললাইন ধরে ছুটে যাওয়া ট্রেনের আওয়াজ—সব কিছু যেন মিলেমিশে এক দৃশ্যপট তৈরি করে, যেখানে চোর আর চৌকিদার নেই, আছে শুধু দু’জন নিঃসঙ্গ মানুষ, যারা গল্পের ছলে একে অপরকে জুড়ে দিচ্ছে নিজেদের জীবনের খালি পাতা দিয়ে।
চিনু সেই রাতে খুব বেশি কিছু বলেনি। বরং, গল্পের মাঝখানে হঠাৎ চুপ করে গিয়ে গুদামের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াটার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি জানেন, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াগুলোও যেন আজকাল আমাদের কথা শুনে। এরা চোর-চৌকিদার বোঝে না, বোঝে সঙ্গ।” কমলা কোনো উত্তর দেয় না, কিন্তু তার হাতে ধরা চায়ের কাপটাকে বুকের কাছে নিয়ে একটু চেপে ধরে। সেই চেপে ধরা কাপেই যেন জমে থাকে তাদের সম্পর্কের সবটুকু উষ্ণতা, অনুচ্চারিত একটা অনুভব। গল্পের বাঁধা ফর্ম্যাট সেই রাতেই ভেঙে যায়, কারণ ওই প্রথম তারা বুঝতে পারে—তাদের মাঝখানে কেবল গল্প নেই, আছে অভ্যাস, নির্ভরতা, এবং অজানা এক টান। সেই রাতে বিদায়ের সময় কমলা বলে, “কালও আসবি?” চিনু বলে না কিছু, শুধু মাথা ঝাঁকায়, কিন্তু তার সেই মৌন সম্মতি যেন ফ্লাডলাইটের আলোতেও চকচক করে ওঠে। গুদামের সেই রাত, সেই আলো আর সেই দু’জন মানুষ—সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সম্পর্কের রূপরেখা তৈরি হতে থাকে, গল্পের ছায়া ছাড়িয়ে গিয়ে বাস্তবতার রঙে।
অধ্যায় ৫:
রাতটা ছিল অস্বাভাবিক নিস্তব্ধ। বাতাস থেমে গিয়েছে যেন, গুদামের চারপাশে কোনো কুকুরের ডাক নেই, রেললাইনেও দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ট্রেন চলে না। এই নিস্তব্ধতা যেন কিছু বলার আগে জমে ওঠা শব্দহীনতা—কিছু একটা শেষ হওয়ার আগে যেমন হয়। চিনু সেই রাতে গেট ঠেলে ঢুকল একটু ধীর পায়ে, আর আজ তার চোখে ছিল এক অন্যরকম ভার। সে বসে পড়ল কমলার পাশে, কিন্তু আগের রাতগুলোর মতো সহজ স্বর, সপ্রতিভ আলাপ ছিল না তার মধ্যে। কমলা বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, “আজ তোর চোখে ক্লান্তি?” চিনু একটুখানি হাসল, তবু গলা ভারী, “আজ শেষবার এসেছি। কাল সকালে চলে যাব।” এই কথাটা যেন হাওয়ার মতো ধাক্কা দিল কমলার ভেতরে। সে প্রথমে কিছু বলল না। শুধু চা এগিয়ে দিল, চুপচাপ।
চিনু বলল, “এখানে কিছু রেখে যাচ্ছি না, শুধু আপনি—আপনার সঙ্গে কাটানো রাতগুলো নিয়ে যাচ্ছি। আমি ভাবিনি, আমার মতো একজন চোর কারও কাছে কিছু রেখে যেতে পারবে।” কমলা এবার বলে উঠল, “তুই পালিয়ে যাচ্ছিস?” চিনু মাথা নাড়ল, “না, পালানো নয়। হয়তো এগোনো। একটা সুযোগ পেয়েছি—এক নাট্যগোষ্ঠীর ছেলেরা আমার কবিতা শুনেছে একবার, তারা আমাকে লেখালেখির কাজ দিতে চায়। আমি বলিনি আপনি পাহারাদার, আমি বলেছি আপনি শ্রোতা—আমার একমাত্র শ্রোতা।” কমলার চোখে কিছু ঝলমল করে উঠল, হয়তো জল, হয়তো আলো। সে আবার চুপ করে রইল। চিনু আবার বলে, “আমি জানি, আমি আসলে কাউকে ভালোবাসার যোগ্য নই, কিন্তু এই কয়েকটা রাত আপনি আমাকে যে সম্মান দিয়েছেন, তা কেউ দেয়নি কখনো। আজ তাই বিদায়ের আগে শুধু বলি—আপনার মুখের গল্পগুলো আমাকে বদলে দিয়েছে।”
সেই রাত তারা আর কোনো গল্প করেনি। শুধু পাশাপাশি বসে ছিল, ফ্লাডলাইটের নিচে, গুদামের সিমেন্টের মেঝেতে, হাতের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছিল ধীর গতিতে। আলোর নিচে ছায়া লম্বা হচ্ছিল, আবার ছোটো হচ্ছিল—ভোর আসছে বুঝতে পারা যাচ্ছিল বাতাসের হালকা ঘ্রাণে। কিছু কথা বলার ছিল, বলা হয়নি। কিছু চোখে ছিল, মুখে আসেনি। কিন্তু দু’জনই জানত, এই নীরবতার মধ্যেই ছিল সব কথা। বিদায়ের আগে চিনু কেবল বলল, “আমাকে মনে রাখবেন?” কমলা মাথা নিচু করে বলল, “রাখার তো কিছু নেই, তুই তো রয়েই গেছিস এখানে—এই আলো, এই ছায়া, আর আমার গল্পের ভেতরে।” চিনু ধীরে উঠে দাঁড়াল, একটু পেছনে হাঁটল, তারপর একবার ঘুরে তাকিয়ে হালকা হাসল—সেই হাসিতে ছিল কৃতজ্ঞতা, প্রেম, অভিমান আর বিদায়ের স্বাদ। আর সেই রাতেই শেষবারের মতো গুদামঘরের ফ্লাডলাইটের নিচে চোর আর চৌকিদার পাশাপাশি বসেছিল, কিন্তু তারা আর অপরাধী আর পাহারাদার ছিল না—ছিল দুটি মানুষ, যারা একে অপরের ভেতরে বেঁচে ছিল নিঃশব্দভাবে।
অধ্যায় ৬:
চিনুর চলে যাওয়ার পর প্রথম কয়েকটা রাত যেন কিছুতেই পেরোতে চাইছিল না। ফ্লাডলাইট ঠিক আগের মতোই জ্বলছিল, টিমটিম করে, কিন্তু তার আলোয় বসা মানুষটা আগের মতো নির্ভার নয়। কমলা সেই একই শাল জড়িয়ে বসে থাকত, হাতে চায়ের কাপ থাকত, পাশে একটা খালি জায়গা রাখত—যেখানে আগে চিনু বসত, মাটিতে হেলান দিয়ে কবিতা বলত, গল্প করত, কখনও চুপ করে শুধু তাকিয়ে থাকত। গুদামের চারপাশের বাতাসটাও যেন ভারী হয়ে উঠেছিল; শীতটাও এক অন্যরকম লাগত—কাঁপিয়ে দেওয়ার চেয়ে বেশি রকমের নিঃসঙ্গতাজনিত ঠান্ডা। প্রথম সপ্তাহে কমলা ভাবত, চিনু হয়তো ফিরে আসবে, হয়তো কিছু একটা ভুলে যাবে নিয়ে যেতে, হয়তো শেষ কথা না বলেই আবার দাঁড়িয়ে যাবে গেটের পাশে। কিন্তু সময় যেমন করে, তেমন করেই সে অভ্যাস গড়ে দিতে লাগল অনুপস্থিতির সঙ্গে।
তবে কিছু জিনিস রয়ে গিয়েছিল। চিনু রেখে গিয়েছিল তার কবিতার সেই খাতা, একটা পুরনো রেডিও (যেটা মাঝে মাঝে গুঞ্জন তুলে থেমে যায়), আর সবচেয়ে বড় কথা—একটা উপস্থিতির স্মৃতি, যা কমলার প্রতিটি রাতের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল। রাতে যখন বৃষ্টি পড়ে, বা ট্রেন ধেয়ে যায় দূর থেকে, কমলা নিজের অজান্তেই চোখ রাখে গেটের দিকে। একদিন রেডিওটা চালাতে গিয়ে রেকর্ড করা চিনুর কণ্ঠ শুনে থমকে যায়—সে নিজের কণ্ঠে একটা কবিতা রেখে গিয়েছিল। কমলা জানত না, ঠিক কী নাম এই অনুভবটার—ভালোবাসা? স্নেহ? না কি সহমর্মিতা?—কিন্তু বুঝতে পারছিল, জীবনটায় যে জায়গাটা এতদিন খালি ছিল, চিনু সেখানে অদৃশ্যভাবে এসে বসে পড়েছে। চায়ের কাপটা এখন সে দুইটা রাখে, যদিও জানে, কেউ আর আসবে না তা নিতে।
তবুও রাতে, ফ্লাডলাইটের আলো যখন ধীরে ধীরে কাঁপতে কাঁপতে পড়তে থাকে তার মুখের ওপর, তখন কমলার মনে হয়—চিনুর ছায়াটা এখনো ওর পাশে বসে আছে। অনেক রাত সে চুপ করে নিজের গলার স্বরে বলে, “তুই কোথায় রে?”—জবাব আসে না, কিন্তু বাতাস একটু নড়ে ওঠে যেন। কমলার চোখে আর জল আসে না, কিন্তু বুকের ভেতর একটা কাঁপুনি থেকে যায়। সম্পর্কটা যেন একটা অতীতের গল্প নয়, বরং চলমান কিছু, একধরনের অপেক্ষা, যে অপেক্ষা কখনো ফুরোয় না। গুদামের রাতগুলোকে নতুন করে বেঁধে নেয় কমলা, যেখানে পাহারা দেওয়ার বাইরেও একটা অনুপস্থিত মানুষকে প্রতিদিন মনে করে বসে থাকা—একটা নিজস্ব অভ্যস্ততা হয়ে দাঁড়ায়। চিনু চলে গিয়েও থেকে যায়, কমলার জীবনের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।
অধ্যায় ৭:
হঠাৎ করেই একদিন সন্ধের দিকে গুদামঘরের সামনে একটি সাদা ট্যাক্সি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নেমে আসে একটি মেয়ে, আধুনিক পোশাক, কাঁধে ল্যাপটপ ব্যাগ, চোখে স্পষ্ট ক্লান্তি আর কিছুটা বিরক্তি। তার নাম রমা—কমলার মেয়ে। গত পাঁচ বছর ধরে অন্য শহরে ছিল, পড়াশোনা আর চাকরি নিয়ে ব্যস্ত, মাঝে মাঝে ফোনে কথা হলেও মা সম্পর্কে খুব একটা কিছু জানত না। আজ হঠাৎই সে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে মায়ের সঙ্গে কয়েকদিন কাটাতে। গুদামের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রথমে সে চমকে যায়—মা এক কোণে বসে, পাশে একটা খালি চায়ের কাপ রাখা, চোখ ফ্লাডলাইটের নিচে দূরে কোথাও থেমে আছে। রমা কৌতূহল নিয়ে কাছে এসে বলে, “মা, তুমি এখানে এইভাবে বসে থাকো? একা?” কমলা ধীরে তাকায়, যেন চেনা মুখকেও একটু সময় লাগে চিনে নিতে। তারপর হালকা হাসে—“তুই এলি রে?”
রমা প্রথম কয়েকটা দিন শুধু দেখছিল। মা ভোরে বাড়ি ফেরে, বিকেলে একটু ঘুমোয়, রাতে আবার সেই গুদামে চলে যায়। সে লক্ষ্য করছিল, মা কিছু একটার জন্য অপেক্ষা করে—একটা চায়ের কাপ দ্বিতীয়টি রাখে, মাঝরাতে কাউকে উদ্দেশ করে কথা বলে, এমনকি মাঝে মাঝে একটা পুরনো রেডিও চালিয়ে তার পাশে বসে কবিতা শোনে। এই অদ্ভুত আচরণ রমাকে প্রথমে অস্বস্তিতে ফেলে, কিন্তু তারপর এক রাতে সে মায়ের ব্যাগে পায় একটা ছোট খাতা—হাতে লেখা কবিতায় ভরা, শেষ পাতায় একটা নোট: “কমলা দি’র জন্য—চোরের চিঠি।” সে খাতা খুলে পড়ে, প্রতিটি লাইনে এক অচেনা পুরুষের গন্ধ, তার ভাঙা অতীত, তার কবিতা, তার চোখ দিয়ে দেখা এক অদ্ভুত প্রেম। রমা অবাক হয়, স্তব্ধ হয়, তারপর মনে মনে ভাবে—“মা এসব কখন বাঁচতে শুরু করল, আমি তো জানতামই না!”
রাতে সে গুদামের সামনে গিয়ে মাকে দেখে ফ্লাডলাইটের নিচে বসে আছে, চোখে সেই শান্ত ছায়া। সে ধীরে গিয়ে পাশে বসে, বলে, “মা, সে কে ছিল?” কমলা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “একজন চোর, যে আমাকে মানুষ বানিয়ে দিয়ে গিয়েছে। আমি তো শুধু পাহারা দিতাম রে, কিন্তু সে এসে আমাকে জাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে।” রমা তার মায়ের গলায় এই অচেনা কোমলতা শুনে থেমে যায়। এই প্রথম সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা সবসময় নিয়মের মধ্যে থাকে না। মায়ের এই অতল সম্পর্কের কথা সে না জানলেও, অনুভব করতে পারে—এটা সত্যি ছিল, প্রয়োজন ছিল, আর এখনও মায়ের সঙ্গে থেকেও যায়। সে আর কিছু বলে না। শুধু দেখে, রাত গভীর হচ্ছে, ফ্লাডলাইট কাঁপছে, আর দু’জন মানুষ—এক মা, আর এক মেয়ে—একসাথে বসে আছে এক চোরের গল্পের মধ্যে, যেখানে অনুপস্থিতিও এক ধরনের উপস্থিতি হয়ে যায়।
অধ্যায় ৮:
একদিন সকালবেলা, ছুটির দিনে গুদামের পোস্টবক্সে একটি হলুদ খাম এসে পড়ে। চিঠিটা হাতের লেখায় লেখা, প্রেরকের নাম লেখা নেই, শুধু উপরেই কালি দিয়ে বড় অক্ষরে লেখা: “কমলা দি’র হাতে নিজে দিন।” চিঠিটা কমলার হাতে আসে বিকেলে, যখন সে চা বানাচ্ছিল। প্রথমে কিছু বুঝতে না পেরে খামটা কয়েক মুহূর্ত ধরে তাকিয়ে থাকে, তারপর ভেতর থেকে একপাতার চিঠি বের করে পড়ে—চিনুর লেখা। প্রতিটি অক্ষরে তার সেই পরিচিত গলা, সেই টানটান ছন্দ, সেই অসমাপ্ত গল্প বলার ঢঙ। চিঠিতে লেখা ছিল:
“কমলা দি,
চলে আসার পর অনেকবার ভেবেছি, ফিরে আসব। কিন্তু আমি জানি, কিছু জিনিস ফিরে গেলে তারা হারিয়ে যায়। আমি এখন লিখছি, কবিতা পড়াচ্ছি, অভিনয়ের দলের সঙ্গে আছি—শিখছি কীভাবে জীবনকে মঞ্চের মতো সাজিয়ে বলা যায়, আর সত্যিকারের মানুষগুলোকেও চরিত্র বানানো যায়।
কিন্তু আপনি—আপনি চরিত্র নন, আপনি বাস্তব। আপনি আমার গল্পের প্রথম শ্রোতা, যার চোখে আমি আমার নিজের ছায়া খুঁজে পেয়েছিলাম। অনেকেই প্রশংসা করে আজ, কিন্তু কারও মুখে আপনার সেই ‘চুপ কর, আবার শুরু কর’ বলার সুর পাই না।
আপনি বলেছিলেন আমি পালাতে চাই। না, আমি পালাইনি। আমি রয়ে গেছি—আপনার মুখে বলা গল্পের মধ্যে, আপনার দুই কাপ চায়ের অভ্যাসে, গুদামের সেই একফালি আলোয় যেখানে আপনি চুপ করে বসে থাকেন।
যদি কোনোদিন এই চিঠিটা পড়ে মনে হয়, আমি চলে গেছি—ভুল করবেন না। আমি আছি, শুধু আলাদা পাতায়।
—চিনু”
চিঠিটা পড়ে কমলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। রমা তখন ঘরের এক পাশে বসে ছিল, সে কিছু বলল না। শুধু দেখল, তার মা ধীরে চায়ের কাপটা নিলেন, বাইরে গিয়ে গুদামের দিকে হাঁটলেন, যেন আর একবার বসতে চান ফ্লাডলাইটের নিচে। সেই সন্ধ্যায়, আবার দুটো কাপ সাজিয়ে রাখা হলো, একটায় চা ঢালা হলো, আর একটা খালি রাখা হলো—ঠিক যেমন আগেও রাখা হতো।
কমলা চুপ করে বসে থাকে। তার পাশে কেউ নেই, তবু তার মুখে যেন সংলাপ বয়ে যায়। চিনুর কণ্ঠের মতোই একধরনের অভ্যস্ত ছন্দে তার চোখে খেলে যায় ছায়া, আলো, সম্পর্কের জট, আর সেই জ্যামিতি, যা এক চোর আর এক চৌকিদারের মাঝে তৈরি হয়েছিল। আজ বুঝতে কষ্ট হয় না—এই গল্প শেষ হয়নি, শুধু ছায়া বদলেছে। সেই মানুষটা, যাকে সমাজ চোর বলেছিল, এক পাহারাদারের হৃদয়ে চুপিচুপি জ্বালিয়ে রেখে গেছে এক কবিতার প্রদীপ। আর সেই আলোয় আজও বসে থাকেন কমলা—সেই একই জায়গায়, দুই কাপ চায়ের মাঝে একটায় কারও উপস্থিতি অনুভব করে।
গল্প শেষ হলেও… অপেক্ষা থেকে যায়।
—
সমাপ্ত