মীনাক্ষী ধর
ভোর সাড়ে পাঁচটা। গ্রামের কুয়াশার চাদরের ভেতর ধীরে ধীরে জেগে উঠছে চারপাশের ধুলোমাখা জগৎ। রেনু মণ্ডল মাটির বারান্দায় বসে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা লাল চা হাতে নিয়ে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। বাড়ির ভেতর গরুর ঘটি থেকে টুপটাপ করে দুধ পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, আর রান্নাঘর থেকে বীণা খাঁর গলা — “আজি মাইনসেগো পেট ভরাই খাওয়াবার হইব না, রেনুবৌদি?” — রেনু কিছু বলল না। তার চোখে ক্লান্তি ছিল না, কিন্তু শান্তিও ছিল না। চোখদুটো যেন অনেক দূর দেখছিল, অনেক গভীরে—সেই জায়গায়, যেখানে শব্দ পোঁছায় না, শুধু গর্জন জমে থাকে। তার স্বামী কুন্তল মারা গিয়েছিল এই বাড়ির একচালা ঘরের বাঁ পাশের পথটাতে। এক সন্ধ্যায়, সাইকেল নিয়ে মাঠ থেকে ফেরার পথে, পা হড়কে পড়ে গিয়েছিল কুন্তল। মাথায় চোট লেগে নাকি তখনই মৃত্যু। সবাই বলে ছিল “অ্যাকসিডেন্ট।” কিন্তু রেনু আজও জানে, সেটাকে দুর্ঘটনা বলা চলে না। বরং বলা চলে—প্রকৃতি একটু দয়া করেছিল। হয়তো প্রতিশোধ। হয়তো মুক্তি।
রেনু আজও নিজের স্বামীকে ভালোবেসে ফেলেনি, এই সত্যটা সমাজকে বোঝানো কঠিন। তারা সবসময় রেনুর মুখ দেখে বলত, “ভাগ্যবান বউ ছিল কুন্তলদার। এমন শান্ত মেয়ে, মুখে কথাই নাই।” কিন্তু সেই মুখের ভেতর কতগুলো না-বলা কথা যে ঘুরপাক খেতো, তা কেউ জানত না। কুন্তল ঘরে আসার পর দরজা বন্ধ করে দিত, আর বাইরে থেকে শোনা যেত রেনুর গলা চাপা কান্না। স্কুলে গিয়ে রেনু হাসত, পড়াতো, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় আগ্রহ জাগিয়ে তুলত। কিন্তু রাতে, রান্নাঘরের জানালা দিয়ে একটানা তাকিয়ে থাকত নির্জন মাঠের দিকে, যেটা কুন্তল বলত “অন্ধকারে মেয়েমানুষের জাইগা না।” সে সময় কেউ বুঝত না, এই নারী আস্তে আস্তে এক চোরাবালির মতো হয়ে উঠছে। শান্ত মুখের আড়ালে গিলে নিচ্ছে নিজের রাগ, অপমান, ভয় — যতদিন না সেই গলা পর্যন্ত জমে ওঠা কাদা একদিন থাবা মারে।
আজ স্কুলে নতুন একজন শিক্ষক আসবে — শহর থেকে বদলি হয়ে আসা অনিরুদ্ধ সেন। কথাটা গতকালই জানিয়েছে প্রধান শিক্ষক মিহিরবাবু, যিনি নিজেও রেনুকে সন্দেহের চোখে দেখেন সেই কুন্তলের মৃত্যুর পর থেকে। রেনু জানে, আজকের এই নতুন আগমন তার জীবনের দীর্ঘকাল ধরে চাপা দেওয়া অতীতটাকে আবার নাড়িয়ে দিতে পারে। কারণ চোরাবালির যেমন একরকম নীরবতা থাকে, তেমনি কোনো এক মুহূর্তে সে গিলে নেয় এমন কাউকে, যে শুধু তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। রেনু জানে না অনিরুদ্ধ কে, কেমন — কিন্তু তার মনে আজ সকালে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। সেই এক ধরনের কাঁপুনি, যা হঠাৎ জমা জল ঠেলে উপরে উঠে আসে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তে রেনু অনুভব করে, এই শান্ত সকাল আসলে এক খারাপ বাতাস নিয়ে এসেছে। হয়তো নতুন শিক্ষক নয়, বরং পুরনো কোনো প্রশ্নই আজ ঘুরে দাঁড়াবে তার জীবনে—আর সে প্রস্তুত কিনা, তা সে নিজেও জানে না।
–
স্কুলের ঘন্টার শব্দে যখন ক্লাসরুমগুলো ধীরে ধীরে জীবন্ত হতে শুরু করল, তখন অনিরুদ্ধ প্রথমবারের মতো প্রবেশ করল বিদ্যালয়ের মূল ভবনে। গাঢ় নীল-সাদা রঙে রাঙানো স্কুলবাড়িটি আশপাশের গাছপালার ছায়ায় কিছুটা ঘুমন্ত, কিছুটা জেগে থাকা অনুভূত হচ্ছিল। ছেলেমেয়েরা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে ছিল নতুন স্যারের দিকে — কেউ ফিসফিস করছিল, কেউ পেন্সিল চিবোচ্ছিল। রেনু তখন কিচেনশেডের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল — চায়ের কাপ হাতে, নীরব। সে অনিরুদ্ধকে দূর থেকে দেখছিল, কিন্তু এগিয়ে গেল না। মিহিরবাবু যথারীতি তার গম্ভীর মুখে অনিরুদ্ধকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, এবং রেনুর দিকে একটু তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “এই রেনুবৌদি, স্কুলের সবচেয়ে পুরনো শিক্ষক… কিন্তু এখন একটু… অত চুপচাপ।” অনিরুদ্ধ মৃদু হাসল, কিন্তু রেনুর চোখে সেই হাসি কোনো বিশেষ আগ্রহ জাগাল না। বরং, তার হৃদয়ের একপাশে আবার সেই পুরনো সতর্কতা জেগে উঠল—একজন অপরিচিত পুরুষ, শহরের, সরল মুখোশের নিচে কী আছে, তা জানে না সে।
অনিরুদ্ধ খুব তাড়াতাড়িই বুঝে গেল—এই স্কুল যেন একটা কড়াইয়ের মতো, যার ঢাকনার নিচে চাপা চাপা কিছু ফুটছে। মিহিরবাবু একদিকে খুব নিয়মানুবর্তী, আবার রেনুকে নিয়ে তার মধ্যে একরকম অদ্ভুত ঠাণ্ডা বিরক্তি আছে। ছাত্ররা কিছুটা শাসনে, কিছুটা ভয় মিশিয়ে চলে। আর রেনু… তাকে দেখতে শান্ত মনে হলেও, তার চোখে যেন সবকিছু দেখে ফেলার একটা নীরব ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। অনিরুদ্ধ তার প্রথম ক্লাসে প্রবেশ করেই রিতু নামের এক ছাত্রীকে লক্ষ্য করল—চুপচাপ মেয়েটা খাতা খুলে কিছু লিখছিল, কিন্তু হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “স্যার, আপনি শহর থেকে এসেছেন না? শহরের মানুষ রাগ কম করে না?” অনিরুদ্ধ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি এমন বলছ কেন?” মেয়েটা মুচকি হেসে বলল, “রেনু ম্যাডাম বলেন শহরের মানুষের হাসির নিচেও ভয় থাকে।” সেই কথা শুনে সবার সামনে হাসলেও, অনিরুদ্ধ মনে মনে কিছুটা চমকে উঠল—কে এই রেনু, যার কথায় এমন তীক্ষ্ণতা? তার ভেতরে কি আছে, যা বাইরে এতটা নিঃশব্দ?
সন্ধ্যেবেলায় বিদ্যালয়ের বারান্দায় বসে অনিরুদ্ধ যখন নোট তৈরি করছিল, তখন রেনু হঠাৎ পাশে এসে দাঁড়াল। “স্কুলের কাজকর্মে সাহায্যের দরকার হলে বলতে পারেন,” সে বলল, একেবারে নিরুত্তাপ গলায়। অনিরুদ্ধ মাথা তুলে তাকিয়ে শুধু বলল, “আপনাকে সবাই বেশ ভয় পায় বুঝি।” রেনু এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে মৃদু হাসল, “ভয়, নাকি শ্রদ্ধা—এই পার্থক্যটা অনেক সময় গুলিয়ে যায়।” বলেই সে চলে গেল। অনিরুদ্ধ বসে রইল, চুপচাপ। তার মনে হল, রেনু এক অদ্ভুত ধাঁধার মতো—যাকে ছুঁতে গেলে কাদা লেগে যায়, কিন্তু না ছুঁলে বোঝা যায় না, তার গভীরতা কতটা। এই গ্রামের নিঃশব্দ সন্ধ্যায় সেই প্রথমবার সে বুঝল—এই জায়গাটা শুধু গাছ, মাঠ, আর নদী নয়। এখানে অতীতও ঘুরে বেড়ায়। আর সেই অতীতের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে রেনু, এক রকম চোরাবালি হয়ে।
–
বিগত কয়েক দিনে অনিরুদ্ধ স্কুলের পরিবেশে একটু একটু করে মানিয়ে নিচ্ছিল। সে প্রতিদিন ছাত্রছাত্রীদের সাথে কথা বলছিল, তাদের আঁকা ছবি দেখছিল, আর গ্রামের সহজ সরল জীবনকে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কিছু একটা যেন সবকিছুর ফাঁকে বারবার তার মনোযোগ টেনে নিচ্ছিল — রেনু। তার হাঁটার ধরণ, নিঃশব্দে ক্লাসে প্রবেশ, কোনো ছাত্রের ভুল ধরলেও গলায় কোনও চড়া সুর না থাকা — সব কিছুতেই যেন এক অদ্ভুত চাপা শক্তি মিশে ছিল। অথচ, সেই শক্তির নিচে একটা হিম হাওয়া বয়ে যেত। একদিন দুপুরবেলা, খেলার ছুটির সময় অনিরুদ্ধ প্রধান শিক্ষক মিহিরবাবুর কক্ষে ঢুকে পড়ল চায়ের কাপ হাতে। মিহিরবাবু তখন স্কুলের পুরনো খাতা ঘাঁটছিলেন। হঠাৎ একটি হলুদ হয়ে যাওয়া পাতায় চোখ রেখে হালকা গলায় বললেন, “কুন্তল মণ্ডলের মৃত্যুর পর স্কুলটা যেন অনেকটাই শান্ত হয়ে গেছে। আপনি জানেন না হয়তো, উনি কিন্তু এই স্কুলেই কাজ করতেন।” অনিরুদ্ধ কিছুটা চমকে বলল, “না তো, আমি শুনেছিলাম উনি কৃষিকাজ করতেন।” মিহিরবাবু হেসে বললেন, “তা করেন, কিন্তু এখানে কিছু হিসাবপত্র দেখভাল করতেন। মারা যাওয়ার আগের দিন এক রিপোর্ট হাতে পেয়েছিলাম… জমা পড়ার আগেই, তার মৃত্যু। অদ্ভুত না?”
সেই রাতে, অনিরুদ্ধ তার থাকার ঘরে বসে খাতায় ক্লাস প্ল্যান তৈরি করতে গিয়ে বারবার বিভ্রান্ত হচ্ছিল। মাথায় ঘুরছিল মিহিরবাবুর বলা কথা—এক রিপোর্ট, মৃত্যুর আগের দিন, আর তার সঙ্গে রেনুর নীরবতা। কী এমন ছিল সেই রিপোর্টে? আর রেনুরই বা ভূমিকা কী ছিল সেখানে? পরদিন সকালে সে আবার রিতুর সঙ্গে দেখা করল। ছাত্রীটি দুষ্টুমি করছিল, কিন্তু মুখে ছিল টানটান কৌতূহল। “তুমি রেনু ম্যাডামকে চেনো অনেকদিন?” জিজ্ঞেস করতেই রিতু বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমাদের পাড়ার লোকেরা বলে উনি কুন্তলদার মৃত্যুর পর একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছেন। আগের রেনু ম্যাডাম হেসে পড়াতেন। এখন শুধু চোখ দিয়ে পড়ান।” কথাটা শুনে অনিরুদ্ধ হালকা শিউরে উঠল। এমন কথা হয়তো কোনো বাচ্চা বলে ফেলতেই পারে, কিন্তু তার মধ্যে যে অদ্ভুত সত্য লুকিয়ে ছিল, সেটা সে অস্বীকার করতে পারল না। রেনু কেবল শান্ত বা শক্ত নয় — সে যেন কিছু লুকিয়ে রাখা এক ছায়া, যেটা দিনভর স্কুলে হাঁটে, আর রাতের নিঃশব্দে কাঁদে।
অনিরুদ্ধ সেই দিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে হঠাৎ বাঁ পাশের সরু মাটির পথ ধরে হেঁটে রেনুর বাড়ির দিকে গেল। সে জানত এটা অপ্রত্যাশিত হবে, কিন্তু তার মধ্যে একটা টান কাজ করছিল — না জানার, না বোঝার এক অস্বস্তি। রেনু তখন উঠোনে শুকনো কাপড় তুলছিল। হঠাৎ স্যারের আগমন দেখে একটু চমকে উঠল, তারপর বলল, “কোনো দরকার ছিল?” অনিরুদ্ধ সরাসরি প্রশ্ন করল, “আপনার স্বামীর মৃত্যুর পরের দিন কিছু রিপোর্ট জমা পড়ার কথা ছিল স্কুলে?” রেনু থেমে গেল, হাতে থাকা কাপড়টা নিচে পড়ে গেল মাটিতে। চোখে এক মুহূর্তের জন্য কাঁপুনি দেখা গেল, তারপর সে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “সব রিপোর্ট সময়মতো জমা পড়ে না। আর কিছু রিপোর্ট শুধু মনেই থেকে যায়।” কথা শেষ করে সে ভিতরে চলে গেল, দরজা বন্ধ করল না। অনিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে থাকল, মাথার ওপরে বাতাসের ফিসফাস — যেন চোরাবালির মধ্য থেকে উঠছে পুরনো শ্বাস।
–
রেনু সেদিন রাতে ঘুমোতে পারেনি। ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বাতির নিঃসঙ্গ আলোয় তার ঘরের দেওয়ালগুলো যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠছিল। বালিশের নিচে রাখা পুরনো সেই খাতা — যার পাতায় কুন্তলকে ঘিরে লেখা কিছু দিনলিপি আর কিছু খসড়া রিপোর্ট — ওটাই যেন রাতভর তাকিয়ে ছিল তার দিকে। অনেক বছর ধরে এই স্মৃতিগুলোকে জমিয়ে রেখেছে সে, এমনভাবে যে, বাইরে থেকে তাকে দেখে কেউ বুঝতে পারে না, তার ভেতরে একটা মৃত নদী শুয়ে আছে। কিন্তু অনিরুদ্ধের প্রশ্ন যেন সেই মৃত নদীর তলায় পাথর ছুঁড়ে দিয়েছে। রেনু জানত, কিছু কিছু মুখোশ একবার খুলে ফেললে আর পরা যায় না। কুন্তলের মৃত্যু নিয়ে সে যা জানত, তার অনেকটাই কারও অজানা থাকলেই ভালো ছিল। কিন্তু আজ রাতে, এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে সে ডায়েরির পাতা উল্টাতে শুরু করল — যেন নিজের কাছেই নিজেকে খুলে বলতে চায়।
“১৮ এপ্রিল… ওর চোখে আজ আগুন ছিল। কারণ আমি বলেছিলাম, মেয়েটা যেন স্কুলে না আসে আর। ওর গায়ে হাত দিয়েছে, আমি জানি। সে অস্বীকার করেছিল, রাগে হাত তুলেছিল আমার উপর। পরে বলেছিল, ‘আমার নাম কেউ কলঙ্কিত করার সাহস করবে না।’ আমি চুপ করেছিলাম। কিন্তু মিথ্যে বলিনি।”
“২০ এপ্রিল… হেডস্যারকে কাল রাতে গিয়ে বলেছিলাম রিপোর্টটা জমা দেব। প্রমাণ আছে, ছাত্রীর বক্তব্য আছে, আমি শুধু আমার দায় পালন করব। ও এটা জানে। ও রাতে কথা বলেনি। শুধু দরজাটা খোলাই রাখল। আর সকালবেলা বেরিয়ে গেল — ফিরে এল না।”
এই পাতাগুলো পড়তে পড়তে রেনু যেন সময়ের মধ্যেই ডুবে যাচ্ছিল। কুন্তলের মৃত্যু দুর্ঘটনা ছিল না—সে জানত। কুন্তল যেভাবে সাইকেল নিয়ে মদ খেয়ে ফিরছিল, যেভাবে ওই নির্জন বাঁকে তার গতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েছিল — রেনু জানত সেই পথটাতে পাথর কবে ফেলা হয়েছিল, কে ফেলেছিল। কিন্তু সে কখনো নিজের হাতে তাকে ঠেলে দেয়নি। শুধু নিজের মুখ বন্ধ রেখেছিল। সময়কে সুযোগ করে দিয়েছিল। সমাজ তাকে চুপ থাকতে শিখিয়েছে — সে শুধু সেই শিক্ষা মেনে চলেছে, কিন্তু এবার নীরবতাই হয়তো হয়ে উঠেছিল তার ভাষা। কুন্তল বেঁচে থাকলে হয়তো আরও অনেক কিশোরী ভাঙত, আরও অনেক দিনলিপি শুধু কষ্ট হয়ে থাকত। তার মৃত্যু একরকম মুক্তি ছিল — হয়তো সবার জন্য না, কিন্তু রেনুর নিজের জন্য, নিশ্চয়ই।
রাত গভীর হলে রেনু সেই ডায়েরি আবার তুলে রেখে দিল। বালিশের নিচে নয়, এবার কাঠের পুরনো বাক্সের ভেতর। কারণ তার ভেতরে আজ নতুন ভয় জন্মেছে — যদি কেউ তার চোখে তাকিয়ে ফেলে, যদি কেউ মুখোশ সরিয়ে ফেলে, যদি কেউ সত্যটা জেনে যায়? অনিরুদ্ধের চোখে কিছু একটা ছিল — আগ্রহ না সহানুভূতি, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে সে জানে, চোরাবালি যতই নরম দেখাক, কাছে এলেই টেনে নেয়। তাই সে আবার মুখোশ তুলে পরল — নিরুত্তাপ, নীরব, পরিশ্রুত রেনু ম্যাডাম — যার চোখ দেখে কিছু বোঝা যায় না, যার পায়ের ছাপ থেকে কাদা উঠে আসে না, কিন্তু যার বুকের তলায় এক অজস্র পাথর জমে থাকে।
–
স্কুলের অফিসঘরে দুপুরের আলোটা একটু বেশিই চড়া ছিল সেইদিন। জানালার ফাঁক গলে এসে পড়ছিল তীব্র রোদ, যেন জানালার বাইরে জমে থাকা অতীতও আজ জোর করে ঢুকতে চাইছে ক্লাসঘরের ভিতর। অনিরুদ্ধ স্যার খাতাপত্র গুছিয়ে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ঢুকলেন কোনও এক পুরনো নথির খোঁজে, কিন্তু হেডস্যার ছিলেন না। সময়টা কাজে লাগিয়ে তিনি পুরনো রেজিস্টারগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন—তার নিজের মনের দোটানাই যেন তাকে ঠেলছিল সেই খাতা হাতে নিতে। হঠাৎই একটি পাতার কোণে কাঁচা হাতে লেখা একটি নোট চোখে পড়ল: “বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ তদন্ত প্রতিবেদন (বিষয়: কুন্তল মণ্ডল সংক্রান্ত অভিযোগ)।” ঠিক তার নিচেই ছোট করে লেখা, “প্রমাণ অনুপস্থিতির কারণে স্থগিত।” অনিরুদ্ধ কাগজটি মুঠো করে ধরলেন। প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার তারিখ ছিল মৃত্যুর এক দিন আগে। তাঁর বুকের ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত কাঁপুনি জেগে উঠল। যেটা কেবল কৌতূহল নয়—বরং এক ধরনের ভীতি। রেনুর কথাগুলো, তার চোখের ভাষা, তার শান্ত মুখ—সব কিছু যেন একসাথে এসে এই পাতাটার পাশে দাঁড়িয়ে গেল।
সন্ধ্যাবেলায় সে যখন রেনুর বাড়ির সামনে পৌঁছাল, আকাশে তখন রক্তিম আভা। হালকা বাতাসে শুকনো ধানের গন্ধ। রেনু উঠোনে বসে কাঁথা সেলাই করছিল। তাকে দেখে সে চমকাল না, শুধু চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, “আপনার কিছু জানার ছিল, তাই তো?” অনিরুদ্ধ নিঃশব্দে বসে পড়ল তার পাশে, দূরত্ব বজায় রেখে। “আপনার স্বামীকে নিয়ে যে রিপোর্ট আপনি জমা দিতে চেয়েছিলেন, সেটা আমি দেখেছি আজ। আপনি জানতেন তিনি কিছু করছিলেন — এমন কিছু, যা একজন শিক্ষকের করা উচিত না।” রেনু থেমে গেল। সুই-সুতো তার আঙুলে জড়িয়ে গিয়েছিল, তিনি ছাড়িয়ে নিলেন ধীরে ধীরে। তারপর বললেন, “আমি চেষ্টা করেছিলাম তাকে থামাতে। কথা বলেছিলাম। শোনেনি। ভয় দেখিয়েছিল আমাকে — বলেছিল, ‘তুই রিপোর্ট দিলে তোকে জ্যান্ত পুড়িয়ে ফেলব।’ আমি তাকে বোঝাতে পারিনি… কাউকে বোঝাতে পারিনি।” অনিরুদ্ধ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “আর আপনি? আপনি কি তাকে…?”
রেনু চুপ করে রইল। শুধু তার চোখে তখন যেন অদ্ভুত এক শূন্যতা। সে বলল, “আমি কাউকে মারিনি। আমি শুধু ওকে আর রক্ষা করিনি।”
ঠিক তখনই রান্নাঘরের দিক থেকে বেরিয়ে এলো বীণা খাঁ, হাতে থালায় মুড়ি আর চানাচুর। রেনুর দিকে না তাকিয়ে সরাসরি অনিরুদ্ধকে বলল, “স্যার, এই বাড়ির অনেক ইতিহাস আপনারা জানেন না। কুন্তলবাবু যেমন মানুষ ছিলেন, তেমন মৃত্যুই তার জন্য ঠিক ছিল। রেনুবৌদি তাকে বাঁচায়নি ঠিকই, কিন্তু কেউ যদি ভাবে উনি খুন করেছেন—তাহলে তার নিজের চোখে দেখার অভাব আছে।” এরপর সে আর কিছু না বলে থালাটা মাটিতে নামিয়ে ফিরে গেল। অনিরুদ্ধ কাঁপা গলায় বলল, “এখন আপনি কী ভাবছেন, রেনুদি?”
রেনু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “চোরাবালির মধ্যে কেউ একবার পড়ে গেলে, সে শুধু নিজে তলিয়ে যায় না। যে তার হাত ধরতে আসে, তাকেও নিয়ে যায়। আপনি কি হাত বাড়াতে চাচ্ছেন, অনিরুদ্ধ?”
অনিরুদ্ধ কোনও উত্তর দিতে পারল না। কারণ তার চোখে তখন সে নিজেকে দেখছিল, রেনুর চোখের মধ্যে—একটা প্রতিবিম্ব, যেটা হয়তো চোরাবালিতে নামার আগের মুহূর্ত।
–
সেদিন রাতে ঝড় উঠেছিল। বাতাসে ধানের গন্ধে মিশে ছিল বিদ্যুৎচমক আর কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়া এক অস্বস্তিকর ঘনত্ব। অনিরুদ্ধ তার ঘরের জানালার পর্দা হঠিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল—রেনুর বাড়ির দিকে, যেটা এখন শুধু অন্ধকারের মধ্যে এক ঘোলাটে ছায়া। তার ভেতরে যেন এক অদ্ভুত আকর্ষণ কাজ করছিল, এমনকিছু যা সরাসরি তলিয়ে যেতে ডাকে, অথচ চোখে দেখে বুঝে ওঠা যায় না—একটা ধোঁয়াশা, একরকম চোরাবালি। শেষমেশ সেই আকর্ষণের কাছে হার মেনে সে ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল, রেনুর বাড়ির দিকে। উঠোনে ঢুকতেই দরজাটা যেন অপেক্ষায় থাকা কারও মতো হালকা খোলা। রেনু বারান্দায় বসে ছিল — তার হাতে চায়ের কাপ, চোখে দূরের দিকে স্থির দৃষ্টি। অনিরুদ্ধ কিছু না বলে পাশে বসে পড়ল। গরম কাপের ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠল অতীতের দীর্ঘশ্বাস, যার গন্ধ বড় চেনা। সে আস্তে বলল, “আমি আজ কিছু জানতে আসিনি। আমি বুঝতে এসেছি।” রেনু চমকাল না, কেবল চোখ সরিয়ে বলল, “বোঝা আর বাঁচার মধ্যে অনেক ফারাক আছে। অনেকেই বোঝে, কিন্তু কেউ পাশে দাঁড়ায় না। তুমি কী চাও, অনিরুদ্ধ? আমার পাশে দাঁড়াতে? নাকি আমাকে বাঁচাতে?”
অনিরুদ্ধ তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “আমি কাউকে বাঁচাতে আসিনি। আমি শুধু চাই, তুমি নিজেকে দোষী ভাবো না। কেউ তো কিছু করতেই পারত, করল না। তুমি অন্তত মুখে এনেছ সত্যটা। তবু তুমি চুপ ছিলে এতদিন—কেন?” রেনু এবার চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখল। তার চোখে যেন অতল থেকে ওঠা জল ছিল, যা কখনো পড়বে না, কিন্তু পোড়াবে। “কারণ এই সমাজে নারীর চুপ থাকাই প্রশংসনীয়। আমি মুখ খুললে বলত—আমি চরিত্রহীন, স্বামীবিরোধী, কু-স্ত্রী। আমি যদি স্কুলে প্রতিবেদন জমা দিতাম, কুন্তলের চাকরি চলে যেত, নাম মাটি হত। ও আমাকে ঠেকাতে পারত না, কিন্তু সমাজ পারত। তখনও আমি জানতাম, এই পৃথিবীতে ভালো-মন্দ আলাদা করা যায় না। সব একসঙ্গে মিশে থাকে, যেমন বৃষ্টির মধ্যে মাটির গন্ধে চোরাবালি মেশে। আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকতাম, ভেতরে একরকম জ্বলন নিয়ে। তুমি জানো অনিরুদ্ধ, প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি চাইতাম ও যেন না ফেরে। ওর সাইকেল পড়ে থাকে মাটিতে, আমি জানালা দিয়ে দেখি, কিন্তু দৌড়ে যাই না… আমি চেয়েছিলাম সে মরে যাক।”
এই স্বীকারোক্তির পর যেন সময় থেমে গেল। অনিরুদ্ধ কিছু বলল না, বলতেও পারল না। বাইরে বৃষ্টি বাড়ছিল, ভিতরে রেনুর কণ্ঠ আরও ধীর হয়ে উঠল, “একদিন সে মরল। মাঠের ধারে খালপাড়ে পা পিছলে পড়ে গেল। আমি জানতাম, সেই বাঁকটায় আমি আগের দিন পাথর সরিয়েছিলাম, ঠিক সেই জায়গাটায় যেখানে জল গড়িয়ে পড়ে। আমি কিছু করিনি—শুধু একটু ‘না করিনি’। এইটাই কি খুন? নাকি এইটাই ছিল আমার মুক্তি?” অনিরুদ্ধ ধীরে ধীরে বলল, “এটা তুমি ঠিক করবে, রেনুদি। আমি না।” রেনু তাকাল তার দিকে—ভেজা, নিরাবরণ, এবং কিছুটা হালকা হয়ে। “তুমি যদি আজ না যেতে চাও, যেতে পারো না, তাহলে থাকবে? নাকি চোরাবালির পাশে দাঁড়িয়ে ফিরে যাবে?” অনিরুদ্ধ একটুও না ভেবে বলল, “আমি থাকছি। কারণ এই কাদা থেকে কেউ তখনই ওঠে, যখন কেউ পাশে দাঁড়িয়ে বলে — ‘তুমি একা নও।’”
রেনু মাথা নামিয়ে রাখল, আর ঝড়ের আওয়াজে ভেসে এল দুটি মানুষের শ্বাস — একটাতে পাপ, একটাতে ক্ষমা। আর সেই রাতে চোরাবালি নিঃশব্দে এক ধাপ নেমে গেল, কারণ কেউ একজন এবার সেই কাদার ভিতর পা দিয়েছিল ইচ্ছা করেই।
–
পরদিন সকালটা অদ্ভুত শান্ত ছিল, যেন ঝড়ের পর প্রকৃতি কিছুটা ক্লান্ত, কিছুটা নিষ্পাপ। কিন্তু সেই নিঃশব্দ আকাশের নিচে রেনু আর অনিরুদ্ধের ভিতরের আলোড়ন থেমে থাকেনি। রেনু স্কুলে যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখটা একটু বেশিক্ষণ দেখল—চোখের নিচে হালকা কালি, তবু সেখানে এক ধরনের স্বস্তিও। বহু বছর পর কারো সামনে সত্য উচ্চারণ করে তার বুকটা যেন হালকা হয়েছে, অথচ সেই সত্যই তাকে আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে, সেটা সে জানে। স্কুলে ঢোকার সময় ছাত্রছাত্রীরা আগের চেয়ে যেন একটু বেশি চোখে চোখ রাখছিল, ফিসফিস শব্দ একটু বেশিই কানে আসছিল। রেনু পাত্তা দিল না। কিন্তু বিরতির সময় অনিরুদ্ধ যখন ক্লাসঘরের দরজা বন্ধ করে তার কাছে এসে বলল, “তুমি জানো কুন্তলের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুধু তোমার রিপোর্টে ছিল না? আরও একটা ছাত্রী… তার মা এসেছিলেন স্কুলে,” তখন রেনুর পায়ের নিচে মাটি যেন একটু কেঁপে উঠল।
“কী বলছ?”
“হ্যাঁ। আমি হেডস্যারের পুরনো নথিতে পেয়েছি। কিন্তু সেটাও ধামাচাপা দেওয়া হয়। কুন্তলের বন্ধু ছিল স্কুল ম্যানেজমেন্টে, তাই সব চেপে যায়। কিন্তু তার আগেই তুমি প্রতিবেদন লিখেছিলে—এবং তার পরদিনই সে মারা যায়।”
রেনু কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তুমি কী জানতে চাইছ? আমি খুন করেছিলাম কিনা?”
অনিরুদ্ধ মৃদু কণ্ঠে বলল, “না রেনুদি। আমি শুধু বুঝতে চাই তুমি কি প্রতিশোধ চেয়েছিলে, না বিচার?”
রেনুর চোখের পেছনের ছায়া যেন তখন একটু নড়ে উঠল। “বিচার,” সে বলল, “আমরা নারী যখন বিচার চাই, তখন তাকে বলে প্রতিহিংসা। যখন চুপ থাকি, তখন বলে ‘সংস্কার’। আমি কুন্তলের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছিলাম, কারণ সে মেয়েদের গায়ে হাত দিত, কারণ সে ক্ষমতা ব্যবহার করত। আমি তাকে দণ্ড দিতে চাইনি। আমি শুধু চাইছিলাম কেউ তাকে থামাক। কিন্তু কেউ থামায়নি।”
অনিরুদ্ধ বলল, “তুমি কি জানো, সেই রিপোর্টগুলো সংরক্ষিত ছিল না। বরং, তার মৃত্যুর পর সব ফাইল হঠাৎ করে ‘হারিয়ে’ যায়। হেডস্যার নিজেই বলল—‘স্কুলের সুনামের কথা ভেবে ফাইলটা সরানো হয়েছিল।’ তাই তো সমাজ চলেছে, রেনুদি—সত্য বাঁচে না, শুধু বেঁচে থাকে মুখোশ।”
এই কথার পরে রেনু যেন হঠাৎ থেমে গেল, তার মুখে এক বিষণ্ন প্রশান্তি। “তুমি এবার চলে যাবে অনিরুদ্ধ। আমাকে ভালোবাসবে না। আমি জানি।”
“ভালোবাসা নয়, রেনুদি,” অনিরুদ্ধ বলল, “আমি শুধু সত্যটাকে ভয় পাই। কারণ সে কারো গায়ে হাত রাখে না—সে পুরোটা গিলে ফেলে।”
সেই রাতে অনিরুদ্ধ আর তার থাকার ঘরে ফিরল না। সে বাসস্ট্যান্ডের দিকে হেঁটে গেল — এক কাপড়, এক ব্যাগ বই নিয়ে। যাওয়ার আগে হেডস্যারের ঘরে ঢুকেছিল। কাগজপত্র, রিপোর্ট, নোট — সব দেখে সে বলেছিল, “আমরা কী শেখাচ্ছি আমাদের ছাত্রছাত্রীদের? ভয় পেতে? নাকি মুখ বন্ধ রাখতে?” হেডস্যার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
রেনু বারান্দায় বসে ছিল সেই রাতে। আকাশে ছিল না চাঁদ, বাতাসে ছিল না শব্দ। শুধু তার মনে ছিল এক নিঃশব্দ প্রলাপ—“সবাই ফিরিয়ে দেয়। কেউ থাকতে পারে না। সবাই ভয় পায়। আর আমি… আমি শুধু দাঁড়িয়ে থাকি, যেন কাদার ভেতর আটকে যাওয়া কোনো গাছ, যার শিকড় আর ওপরে উঠবে না।”
কিন্তু সেই রাতে রেনু আর কাঁদেনি। কারণ সে জানত—এই সমাজ, এই স্কুল, এই পুরুষেরা কেউ তাকে বোঝেনি, বুঝবেও না। কিন্তু তার সত্য সে জানে। তার একাকীত্ব, তার প্রতিরোধ, তার অপরাধ—সবই সে নিজের মতো করে জেনেছে। আর সেই চেনার মধ্যেই হয়তো এক অদ্ভুত মুক্তি লুকিয়ে ছিল।
চোরাবালি এবার আবার স্তব্ধ — কিন্তু এবার সে তলিয়ে নেইনি কাউকে। কারণ এবার কেউ নিজেই ফিরে গেছে, পা না ডুবিয়ে। আর সেই ছেড়ে যাওয়া প্রলোভনের গন্ধ ছড়িয়ে ছিল বাতাসে—নির্বাক, তবু তীব্র।
–
বর্ষা চলে যাওয়ার পরের সকালে রোদটা ছিল নির্মল, ঝকঝকে। স্কুলে জাতীয় সঙ্গীতের গলা একটু বেশি জোরে উঠছিল, যেন বাচ্চারা কোনো দম বন্ধ ভাবকে ভেঙে দিতে চাইছে। রেনু স্কুলে ঢোকার সময় বুঝতে পারল—অনিরুদ্ধ আর ফিরবে না। তার ডেস্ক খালি, আলমারিতে রাখা কয়েকটা বইও নেই। হেডস্যার কিছু বলেননি, শুধু বলেছিলেন, “উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়ে চলে গেছে।” অথচ রেনু জানত, অনিরুদ্ধ চলে গেছে ভয় পেয়ে, দ্বিধায় পড়ে। চলে গেছে এক সত্যের মুখোমুখি হয়ে, যেটাকে সে ধারণ করতে পারেনি। চোরাবালির মতোই — সে পা বাড়িয়েছিল, কিন্তু টান বুঝেই পিছিয়ে গিয়েছিল। রেনুর ঠোঁটে এক অনাবিল হাসি ফুটে উঠল—না, বিদ্বেষের নয়, অপমানেরও নয়। সেই হাসি ছিল নিজের একাকীত্বকে গ্রহণ করে ফেলার হাসি।
স্কুলের ছাত্রী রিতু সেদিন শেষে ক্লাসের পরে তার হাতে একটা কাগজের নৌকা দিয়ে বলল, “ম্যাডাম, আপনি তো এখন আমাদের গল্প বলেন না কেন?”
রেনু কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, “গল্প অনেকগুলো থাকে রে রিতু। কিছু বলা যায়, কিছু শুধু ভেতরে বয়ে চলে। যেমন নদীর নিচে কাদা থাকে, তেমনই।”
রিতু বলল, “আপনি কি কাদার মতো নাকি, ম্যাডাম?”
রেনু তাকাল মেয়েটার চোখে, বলল, “আমি কাদাও নই, জলও নই। আমি এমন একখান জায়গা, যেখানে হাঁটতে গেলে মানুষ ভাবে, মাটি। কিন্তু একটু পরেই ডুবে যেতে হয়। তখন বোঝা যায়, কী ছিল আর কী নয়।”
ছাত্রী অবাক চোখে তাকিয়ে রইল, আর রেনু চলে গেল লাইব্রেরির দিকে — পুরনো গল্পের বই ঝাড়তে ঝাড়তে যেন নিজের কাহিনিকে সযত্নে গুছিয়ে রাখছিল তার ভিতরের বইয়ের তাকেই।
এক সন্ধ্যায়, বীণা খাঁ এল এক চায়ের কাপ হাতে। বলল, “রেনুবৌদি, স্যার তো আর এল না।”
রেনু বলল, “সে আসেনি, কারণ ও যা জানল, তা নিতে পারেনি।”
বীণা থেমে গেল। তারপর বলল, “তুমি কি সত্যিই ওর মৃত্যুতে কিছু করেছিলে?”
রেনু এবার একটু হেসে বলল, “আমি কাউকে খুন করিনি, বীণা। কিন্তু আমি ওকে বাঁচাইওনি। আমি তাকে ভয় পাইনি, ভালোবাসিনি, শুধুই নিজেকে বাঁচিয়েছি। এটুকুই।”
বীণা চুপ করে গেল। কারণ তার মতো নারীরাও জানে—অনেক অপরাধ হয় না ছুরি চালিয়ে, হয় চুপ থেকে। এবং অনেক মুক্তি মেলে অন্যকে না বাঁচিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে।
রাত নামলে রেনু ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল—
“আমি এক নদীর কাদার মতো — যারা ভাবে, তারা পার হবে, তারা ডুবে যায়। আমি তা চাইনি। শুধু চেয়েছিলাম, কেউ যেন জানে—এই শান্ত মুখের নিচে ছিল আগুন। যা আমি শুধু নিজেকেই বলেছি।”
পরদিন সকালে রেনু স্কুলে গেল নিজের মতো করে—কোনো নতুন শিক্ষক নয়, কোনো প্রত্যাশা নয়। ক্লাসে ঢুকে সে এক নতুন ছাত্রীকে পড়াতে শুরু করল। একটা ছড়ার প্রথম লাইন শেখাচ্ছিল, “এই মাটির নিচে কী লুকানো?”
মেয়েটা বলল, “সোনা!”
রেনু বলল, “হয়তো। আবার কাদা আর দুঃখও হতে পারে।”
শেষে, চোরাবালি কোনও শেষ নয়, কোনও একলপ্তে বিচার নয়। এটা এক দীর্ঘ, নিঃশব্দ যাপন—যেখানে এক নারী নিজেকে না বাঁচিয়ে, অন্যকে ডোবায় না; বরং সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কেবল বলে, “আমি আছি।”
আর সেই উপস্থিতিই হয়ে ওঠে এক নারীর সবচেয়ে গভীর, সবচেয়ে ভয়ংকর গান।
সমাপ্ত