Bangla - কল্পবিজ্ঞান

চোখের ভেতর মহাবিশ্ব

Spread the love

সন্দীপ পাল


অয়ন তখন সবে সতেরোর কিশোর, ক্লাস টেনের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করে কিছুদিন অবসর কাটাচ্ছে। তার সবচেয়ে বড় অভ্যাস ছিল রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, কারণ অন্ধকার ভরা আকাশে ছড়িয়ে থাকা নক্ষত্রগুলো যেন তাকে এক অদ্ভুত শান্তি এনে দিত। সে জানালার পাশে বসে থাকত, অনেক সময় ডায়েরি খুলে নোট লিখত—কোন নক্ষত্র কোন দিকে জ্বলছে, চাঁদের আলো কেমনভাবে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু সেদিন রাতে, হঠাৎ করেই সবকিছু বদলে গেল। আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে সে টের পেল, তার চোখে যেন ভেতর থেকে এক অদ্ভুত আলো ঝলমল করছে। প্রথমে সে ভেবেছিল হয়তো আলো পড়ার কারণে এমন দেখাচ্ছে, হয়তো ঘরের টিউব লাইট আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে। কিন্তু কাছে গিয়ে যখন তাকাল, তখন সে ভয়ে শিউরে উঠল—তার কালো মণির গভীরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিন্দুর মতো ঝিকমিক করছে, যেন অসংখ্য নক্ষত্র ভেসে বেড়াচ্ছে ভেতরে। শ্বাস রুদ্ধ হয়ে এল তার, হাত দিয়ে চোখ ঘষল, পানি ছিটাল, এমনকি চোখ বন্ধ করে আবার খোলার পরও সেই আলো নিভল না। বরং আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল, যেন চোখের ভেতরে ঘূর্ণি তৈরি করে ঘুরছে ক্ষুদ্র গ্যালাক্সি।

অয়ন প্রথমে ভেবেছিল তার চোখে কোনো গুরুতর অসুখ হয়েছে। সে তড়িঘড়ি করে ঘরের লাইট বন্ধ করে আবার আয়নায় তাকাল—অন্ধকারেও সেই ঝিকিমিকি দেখা যাচ্ছে। ভয়ে বুক কাঁপতে শুরু করল, কারণ সে জানত না এটা কীভাবে সম্ভব। অসুখ হলে তো দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার কথা, কিন্তু এখানে সে যেন আরও স্পষ্ট, আরও গভীরভাবে দেখতে পাচ্ছে। জানালার বাইরে তাকিয়ে সে হঠাৎ টের পেল, দূরের অন্ধকার গাছের ডালপালা পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, এমনকি পাতার ফাঁকে ঝুলে থাকা একটি ছোট পাখির নড়াচড়াও চোখ এড়িয়ে গেল না। তার মনে হল, দৃষ্টি শক্তি যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সে আতঙ্কিত হলেও এক অদ্ভুত কৌতূহল তাকে গ্রাস করল। কপালে ঘাম জমে উঠল, কিন্তু ডায়েরিতে দ্রুত লিখতে শুরু করল—“চোখের ভেতরে আলো, যেন তারার ঝলক, আমি জানি না এটা সত্যি নাকি মায়া। যদি সত্যি হয়, তাহলে আমার চোখের ভেতর লুকিয়ে আছে আরেকটা আকাশ।” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে এল, যদি সত্যিই এটা অসুখ হয় তবে কী হবে? যদি সে অন্ধ হয়ে যায়? এই ভয়ে সে পরদিন বাবাকে কিছু বলার কথা ভেবেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গেল। বাবার কাছে বললে হয়তো তাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যাবে, আর ডাক্তাররা যদি বোঝে না এটা কী, তবে তারা হয়তো ভয় পেয়ে অন্য কিছু করে ফেলবে।

রাত বাড়তে থাকল, আর অয়ন বিছানায় শুয়েও চোখ বন্ধ করতে পারল না। চোখ বন্ধ করলেই ভেতরে দেখা যাচ্ছিল অসীম অন্ধকারে ভাসমান জ্বলজ্বলে কণাগুলো, যেন কোনো মহাশূন্য তার ভেতরে তৈরি হয়েছে। সে ভাবল—এটা কি শুধুই তার কল্পনা? নাকি সত্যিই তার চোখের ভেতরে আরেকটা মহাবিশ্ব আছে? তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে এল। সে মনে মনে হিসেব কষল, ছোটবেলা থেকেই তারকা আর মহাশূন্য নিয়ে পড়তে ভালোবাসত, হয়তো সেই আগ্রহই আজ মনের ভেতরে একধরনের ভ্রম তৈরি করেছে। কিন্তু তাও ব্যাখ্যা মেলেনি—ভ্রম হলেও এটা এত জীবন্তভাবে কীভাবে দেখা যায়? ঘুম আর এল না, ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত সে কেবল অন্ধকার ঘরের ভেতর বসে নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে কাটাল। ভোরের আলো ফুটতেই আয়নায় শেষবারের মতো দেখল—হ্যাঁ, সোনালি আলোয় ভরা ভোরের সঙ্গেও তার চোখে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক মহাবিশ্ব। তখনই সে বুঝল, এটা কোনো সাধারণ অসুখ বা মায়া নয়; বরং এক এমন রহস্য, যা তার জীবন চিরকালের মতো বদলে দেবে।

সেদিন রাতটা ছিল একেবারে নির্ঘুম। দিনের বেলা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে অয়ন দম বন্ধ হয়ে আসা কৌতূহল আর ভয়ের সঙ্গে লড়াই করছিল। ভোরবেলায় বাবাকে বলার কথা ভেবেছিল, কিন্তু শেষমেশ আর সাহস জোগাতে পারেনি। স্কুলের বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা, বিকেলের ক্রিকেট খেলা—সবকিছুই যেন কৃত্রিম মনে হচ্ছিল। চারদিকে স্বাভাবিক জীবন চললেও অয়নের ভেতরকার জগৎ যেন অচেনা অদ্ভুত রহস্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠছিল। রাত নামতেই সে আবার অস্থির হয়ে পড়ল। মনে হচ্ছিল, চোখ বন্ধ করার আগেই কিছু একটা ডেকে যাচ্ছে তাকে, এক অদ্ভুত আকর্ষণ টানছে অন্ধকারের দিকে। রাত দশটার সময় সে ঘরের লাইট নিভিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াল। কাঁপা হাতে আয়নার ওপাশে নিজেকে দেখে প্রথমে একটা হালকা আতঙ্ক বোধ করল। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখের ভেতরে যে দৃশ্য ফুটে উঠছিল, তা কোনো আতঙ্ক নয়, বরং নিখাদ বিস্ময়। তার চোখের কালো মণির গভীরে যেন অসংখ্য বিন্দু ঝলমল করছে, তারা ক্রমশ একে অপরকে ঘিরে বৃত্ত তৈরি করছে, যেন ক্ষুদ্র গ্যালাক্সি ঘূর্ণি খেলছে ভেতরে। সে চোখ পিটপিট করলে ওই তারাগুলোও যেন একটু কেঁপে ওঠে, যেন কোনো সমান্তরাল জগতে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। অয়ন অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, সেই আলোয় মাঝে মাঝে ধূসর রেখার মতো ছায়া ভেসে উঠছে, যেন কোনো অজানা গ্রহের রেখাচিত্র। ভয় এবং বিস্ময়ের এই মিশ্র অনুভূতিতে তার বুক কাঁপতে লাগল, কিন্তু একইসঙ্গে মনে হল—এতদিন যাকে আকাশ বলে বাইরে খুঁজেছে, তা আসলে তার ভেতরেই লুকানো।

অয়নের কাছে তখন আর পুরো ব্যাপারটা অসুখের মতো মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল সে এক অনন্য সৌভাগ্যের সাক্ষী। তবু ভেতরের ভয় মুছে যাচ্ছিল না, কারণ এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। হঠাৎ তার মনে হল, যদি এই রহস্য চিরকাল নিজের মধ্যে জমা রাখে, তবে একদিন হয়তো ভুলে যাবে, অথবা ভেবে নেবে এটা কেবল এক অদ্ভুত বিভ্রম ছিল। তাই সে দ্রুত নিজের ডায়রি খুলে বসে গেল। কলম হাতে নিতে নিতে মনে হচ্ছিল, শব্দ হয়তো পুরোপুরি তুলে ধরতে পারবে না চোখের ভেতরে ভাসমান সেই মহাবিশ্বের ছবি, তবু সে চেষ্টা চালিয়ে গেল। প্রথম পাতায় লিখল—“আজ আয়নায় নিজের ভেতরে দেখলাম আরেকটা আকাশ। ভেতরে ঘুরছে গ্যালাক্সি, গ্রহ, নক্ষত্র—যেন আমি নিজেই কোনো মহাবিশ্বের প্রহরী।” লিখতে লিখতে তার শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছিল, কাগজে কলমের আঁচড়গুলোও যেন কেঁপে উঠছিল। সে প্রতিটি অনুভূতি নোট করে রাখল—কেমনভাবে তার চোখের মধ্যে আলো ছড়িয়ে পড়ছে, সেই আলো আবার চারপাশের অন্ধকারকে ভেদ করে তাকে অন্যরকম দৃষ্টি দিচ্ছে। বাইরে রাতের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ কোনো কুকুরের ডাক ভেসে এলে সে চমকে উঠত, আবার আয়নার দিকে তাকিয়ে চোখের ভেতরের আলোকিত দিগন্তে ডুবে যেত।

একসময় অয়নের মনে হল, এই পুরো বিষয়টা শুধু দেখা বা বোঝার নয়, বরং অনুভব করার মতো। সে খেয়াল করল, প্রতিটি তারকা যেন ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক নির্দিষ্ট ছন্দ তৈরি করছে। সঙ্গীতের মতো সেই ছন্দ তার মস্তিষ্কে প্রতিধ্বনি তুলছিল, যেন অদৃশ্য কোনো সিম্ফনি বেজে চলেছে। আর সেই সুরে ভেসে যেতে যেতে অয়ন বুঝতে পারল, ভয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে, জায়গা করে নিচ্ছে এক অভূতপূর্ব বিস্ময়। তার মনে হল, সে যদি চায়, তবে এই গ্যালাক্সির ভেতরে আরও গভীরে প্রবেশ করতে পারে—কিন্তু কিভাবে, সেটা তার কাছে রহস্যই রয়ে গেল। তবুও সে প্রতিটি মুহূর্ত লিখে রাখল, প্রতিটি ক্ষুদ্র তারার অবস্থান আঁকার চেষ্টা করল ডায়রির পাতায়, যদিও জানত আঁকাগুলো কখনোই বাস্তব সৌন্দর্য ধারণ করতে পারবে না। রাত কেটে যাচ্ছিল, অথচ তার মনে হচ্ছিল সময় থমকে গেছে। চোখের ভেতরের সেই অচেনা মহাবিশ্ব তার অস্তিত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। একসময় ক্লান্তিতে কলম ফেলে শুয়ে পড়লেও চোখ বন্ধ করার পরও তার ভেতরে ঝলমল করে জ্বলতে থাকল সেই অদ্ভুত নকশা—আলোয় ভরা আকাশের মতো। ঘুম নামল না, বরং তাকে নিয়ে গেল গভীর বিস্ময়ের অতলে, যেখানে সে প্রথমবার উপলব্ধি করল—তার ভেতরেই বেঁচে আছে এক সম্পূর্ণ অচেনা জগৎ।

পরদিন বিকেলের দিকে স্কুল থেকে ফেরার পথে ইরার সঙ্গে দেখা হল অয়নের। ইরা তার সহপাঠী, তবে বন্ধু হিসেবে অনেকটা ঘনিষ্ঠ—যার সঙ্গে অয়ন প্রায় সবকিছুই ভাগাভাগি করে। সেদিনও ইরা খেয়াল করছিল, অয়ন যেন অন্যদিনের মতো হাসিখুশি নেই, বেশ চুপচাপ। ক্লাসে শিক্ষক পড়াতে থাকলেও অয়ন বেশিরভাগ সময় জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিল। বাড়ি ফেরার পথে ইরা তাকে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে, তুই এত চুপচাপ কেন? কাল রাত থেকে কিছু যেন আলাদা লাগছে তোকে।” অয়ন প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইল, কিন্তু তার চোখে তাকাতেই ইরা হঠাৎ থেমে গেল। সে অবাক হয়ে বলল, “অয়ন, তোর চোখে কী হচ্ছে? ভেতরে যেন আলোর ঝিকিমিকি দেখছি!” অয়ন হতবাক হয়ে গেল, কারণ এতদিন ধরে সে ভেবেছিল শুধুই সে নিজে দেখতে পাচ্ছে চোখের ভেতরের সেই অদ্ভুত আলো। অন্য কেউ যদি সত্যিই সেটা দেখে, তবে এটা নিছক কল্পনা নয়। মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা হিম হয়ে এল, কিন্তু তারপর সাহস করে বলল, “হ্যাঁ, তুই ভুল দেখিসনি। আমি নিজেও কিছুদিন ধরে এটা দেখছি। রাতে আয়নায় তাকালে মনে হয় আমার চোখের ভেতরে ঘূর্ণি খেলছে গ্যালাক্সি, ঝলমল করছে তারারা।” কথা শেষ করতে না করতেই ইরা চমকে উঠল। ভয় তার চোখেমুখে স্পষ্ট হলেও অদ্ভুত কৌতূহলও ফুটে উঠল সেখানে।

ইরা কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, “এটা তো অসাধারণ! তুই ভয় পাচ্ছিস, আমি বুঝি। কিন্তু ভাব, যদি সত্যিই তোর চোখের ভেতরে মহাবিশ্ব থাকে, তাহলে এটা তো কোনো অভিশাপ নয়, বরং এক মহাজাগতিক আশীর্বাদ। হয়তো ঈশ্বর তোকে বেছে নিয়েছে।” অয়ন দ্বিধায় পড়ে গেল—ভয় আর বিস্ময়ের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিল সে। ইরা হালকা হাসল, তার কাঁধে হাত রাখল, বলল, “শোন, ভয় পাবি না। আমি তোকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যাই হোক না কেন, আমি পাশে থাকব।” এই আশ্বাস শুনে অয়নের বুক থেকে যেন একটা ভার নেমে গেল। এতদিন ধরে যে রহস্য একা একা বহন করছিল, তা হঠাৎ ভাগ করে নেওয়ার পর এক ধরনের স্বস্তি এল। দু’জনে পার্কের বেঞ্চে বসে দীর্ঘক্ষণ আলাপ করল। অয়ন ডায়রিতে যা লিখেছে, ইরাকে সব পড়ে শোনাল। প্রতিটি শব্দ শুনে ইরার চোখে উজ্জ্বল কৌতূহল ভেসে উঠল। সে বলল, “তোকে বিশ্বাস কর, অয়ন, এটা হয়তো কেবল শুরু। তুই হয়তো এমন কিছু দেখবিস বা বুঝবিস, যা অন্য কেউ কোনোদিন পারেনি।”

সেদিন থেকেই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে গেল। আগে যেখানে তারা পড়াশোনা, সিনেমা বা সঙ্গীত নিয়ে গল্প করত, এখন তাদের আলোচনার মূল বিষয় হয়ে উঠল এই রহস্যময় দৃষ্টি। ইরা প্রায় প্রতিদিন অয়নকে নতুন প্রশ্ন করত—“তুই কি চোখ বন্ধ করেও ওই আলো দেখতে পাচ্ছিস?” “তারাগুলো কি নড়াচড়া করে?” “ওই গ্যালাক্সিগুলো কি কোনো অচেনা ভাষা লিখে রাখছে?”—অয়নের কাছে প্রতিটি প্রশ্নই ছিল নতুন ধাঁধার মতো। কখনো সে উত্তর দিতে পারত, কখনো মাথা নেড়ে শুধু বলত, “আমি জানি না।” কিন্তু এই না-জানার মাঝেই তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক বন্ধন তৈরি হচ্ছিল। ইরার উপস্থিতি অয়নকে সাহসী করে তুলছিল, মনে হচ্ছিল সে আর একা নয়। ইরা প্রায়ই বলত, “ভাব, আমরা হয়তো প্রথম মানুষ যারা বুঝতে পারছি যে আমাদের ভেতরে আসলে মহাজাগতিক শক্তি লুকানো থাকতে পারে। তুই একা নস, আমিও আছি।” এই কথাগুলো শুনলেই অয়নের মনে হত—হয়তো সত্যিই সে কোনো অজানা শক্তির বাহক, যার পথচলা শুরু হয়েছে কেবল এখনই। রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে তারা দু’জন কল্পনা করত, চোখের ভেতরের মহাবিশ্ব আর বাইরের মহাবিশ্ব কি একই সুতোয় বাঁধা? নাকি দুটো আলাদা, অথচ একে অপরকে প্রতিফলিত করছে? ধীরে ধীরে অয়ন বুঝতে পারল, তার চোখের রহস্য শুধু ভয়ের নয়, বরং এক অভিযাত্রার সূচনা, যেখানে ইরা তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে পাশে থাকবে।

অয়ন আর ইরার গোপন কথা বেশিদিন গোপন রইল না। প্রথমে ইরা ভেবেছিল এ বিষয়টি তারা দু’জন ছাড়া আর কারো জানার প্রয়োজন নেই, কিন্তু অজান্তেই একদিন স্কুলের আড্ডায় তার চোখে পড়া অদ্ভুত আলোকছটার কথা ফিসফিস করে বলে ফেলল এক বান্ধবীকে। সেখান থেকেই শুরু হল গুজবের বিস্তার। কারো কারো কাছে এটা ছিল নিছক কল্পকাহিনি, আবার কেউ কেউ ভয়ে বলছিল, ছেলেটা নাকি ভূতের আছরে পড়েছে। গুজবের ঢেউ যখন পুরো শহর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, তখন এক স্থানীয় চিকিৎসক—ড. সমরেশ—এটা গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করলেন। তিনি নিজেও অয়নের চোখের ভেতর এক অদ্ভুত ঝিকিমিকি আলো দেখতে পেয়েছিলেন, যা কোনো চিকিৎসা-বিজ্ঞানের যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। প্রথমে তিনি চক্ষু রোগের সাধারণ পরীক্ষার মাধ্যমে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলেন, কিন্তু যতই পরীক্ষার চেষ্টা করেন, ততই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। শেষমেশ নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে তিনি এই রহস্যের কথা আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিলেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই খবরটি পৌঁছাল বিশ্বখ্যাত গবেষক ও বিজ্ঞানীদের কানে। আর তখনই শহরে নামল আলোড়ন—অয়নের পরীক্ষা করতে আসছেন দুই খ্যাতনামা বিজ্ঞানী: ভারতীয় অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট ড. ঋতাম্বরী সেন এবং মার্কিন গবেষক প্রফেসর গ্রান্ট।

তাদের আগমন যেন গোটা মহল্লায় এক প্রকার উৎসবের আমেজ তৈরি করল। সাংবাদিক, ক্যামেরা, টিভি—সবকিছুতেই ভরে উঠল অয়নের বাড়ির সামনের রাস্তা। অথচ ভেতরে ছিল একেবারেই ভিন্ন দৃশ্য। অয়নের বাবা, নির্মল দত্ত, ভিতরে ভিতরে ভয়ে কাঁপছিলেন। তিনি এক সাধারণ সরকারি কর্মচারী, ছেলে তার চোখে একেবারে সাধারণ কিশোর—কিছুটা স্বপ্নালু, কিছুটা অগোছালো, কিন্তু আদতে স্নেহময়। এখন হঠাৎ করেই ছেলেকে ঘিরে এত আলোড়ন, এত গুজব—এসব কিছুই তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁর মনে হচ্ছিল, বিজ্ঞানের নামে এই বিদেশি গবেষকরা হয়তো ছেলেকে নিয়ে গিয়ে কোনো অজানা পরীক্ষার ফাঁদে ফেলবে, আর তাদের কাছে সে আর কখনো ফিরে আসবে না। বারবার তিনি স্ত্রীকে বলছিলেন, “আমার ছেলে কোনো পরীক্ষার যন্ত্র নয়। ওকে যদি কেটে-ছেঁটে গবেষণা করে, তবে আমি সেটা হতে দেব না।” কিন্তু মায়ের মন ভিন্ন ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, যদি সত্যিই ছেলের ভেতরে কোনো মহাজাগতিক শক্তি লুকানো থাকে, তবে তার ভাগ্যকে থামানো যাবে না। ফলে পরিবারের ভেতরে তৈরি হল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব—একদিকে বাবার ভয়, অন্যদিকে মায়ের আশীর্বাদমিশ্রিত বিশ্বাস।

ড. ঋতাম্বরী সেন ও প্রফেসর গ্রান্ট অবশেষে অয়নের বাড়িতে এলেন। তাঁরা দু’জনই প্রচণ্ড অভিজ্ঞ বিজ্ঞানী, আর তাঁদের সঙ্গে ছিল আধুনিক যন্ত্রপাতি। প্রথমবার অয়নের সঙ্গে দেখা করেই ড. সেন এক অদ্ভুত মমতায় তাকালেন। তিনি বললেন, “ভয় পেও না, আমরা শুধু জানতে চাই তোমার ভেতরে কী রহস্য লুকানো আছে।” প্রফেসর গ্রান্ট আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের—তাঁর চোখে কৌতূহল যেমন প্রবল, তেমনি এক ধরনের শীতল বৈজ্ঞানিক বিচ্ছিন্নতা। অয়নকে বসিয়ে তাঁর চোখে আলো ফেলতেই দু’জন বিজ্ঞানী একইসঙ্গে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। ভেতরে যা দেখা গেল, তা তাঁদের দীর্ঘ গবেষণার কোনো বইপত্রে লেখা ছিল না। গ্যালাক্সির ঘূর্ণি, অচেনা গ্রহের ছায়া, আর তারা ঝিকিমিকির অদ্ভুত নকশা—সবকিছু যেন এক জীবন্ত মহাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি। তাঁরা যন্ত্রে রেকর্ড করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আলো-কণা কোনোভাবেই লেন্সে ধরা দিল না। যেন সেই মহাবিশ্ব শুধুই অয়নের চোখের গভীরে লুকিয়ে আছে, বাইরের যন্ত্র তাকে বন্দি করতে পারে না। নির্মল দত্ত উৎকণ্ঠিত হয়ে ছেলেকে আঁকড়ে ধরলেন, কিন্তু অয়ন ভেতরে ভেতরে অনুভব করছিল অন্যরকম টান—যেন তাকে ডাকছে সেই আলোকিত ভেতরকার জগৎ, আর বিজ্ঞানীরা কেবল তার প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশে শুরু হল অয়নের জীবনের নতুন অধ্যায়, যেখানে তার পরিবার আর বিজ্ঞান—দু’পক্ষের টানাপোড়েনের মাঝখানে সে হয়ে উঠল এক মহাবিশ্বের দ্বারপ্রান্ত।

অবশেষে সেই মুহূর্ত এলো যখন অয়নকে গবেষণাগারে নিয়ে যাওয়া হল। সাদা দেয়ালের বিশাল এক কক্ষ, চারদিকে ঝকঝকে যন্ত্রপাতি, ক্যামেরা আর আলো—সবকিছুই যেন কোনো বৈজ্ঞানিক সিনেমার দৃশ্য। অয়নকে বসানো হল এক বিশেষ চেয়ারে, তার চারপাশে জটিল তার আর মনিটর বসানো। ড. ঋতাম্বরী সেন তাঁর মমতামাখা কণ্ঠে বললেন, “অয়ন, ভয় পেও না। আমরা তোমাকে আঘাত করব না, শুধু তোমার চোখের ভেতরে কী আছে তা দেখতে চাই।” প্রফেসর গ্রান্ট কিন্তু একেবারেই ভিন্নভাবে ব্যস্ত, তিনি ল্যাপটপে কোড চালাচ্ছিলেন, যন্ত্রগুলোর সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছিলেন সিগন্যাল। প্রথমে অয়ন চোখ বন্ধ করে ফেলল। চারদিকে এত মানুষ, এত যন্ত্রপাতি, আর তার চোখে যেন কোনো গোপন দরজা খুলে দেওয়ার অপেক্ষা—এসব ভেবে শরীর শিউরে উঠছিল। কিন্তু যখন ড. সেন আলতো করে বললেন, “চোখ খোলো,” অয়ন ধীরে ধীরে চোখ মেলল। আর সেই মুহূর্তে পুরো গবেষণাগারের পরিবেশ বদলে গেল।

বড়সড় প্রজেক্টরের পর্দায় অয়নের চোখ থেকে আসা প্রতিফলন ভেসে উঠতে শুরু করল। প্রথমে মনে হল যেন কোনো গভীর মহাশূন্যের ছবি—কিছু ছায়াপথ, দূরের আলোছটা। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠল, এটি কোনো টেলিস্কোপে ধরা চিত্র নয়; এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন, জীবন্ত। একের পর এক তারা ফুটে উঠছে, গ্রহগুলো তাদের কক্ষপথে ঘুরছে, কোথাও বিশাল গ্যাসীয় দানব গ্রহ, কোথাও পাথুরে উপগ্রহ, এমনকি কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণিও দেখা গেল—যেন চোখের ভেতরেই মহাবিশ্বের এক অজানা সংস্করণ। গবেষণাগারে উপস্থিত সব বিজ্ঞানী নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। প্রফেসর গ্রান্ট দ্রুত নোট লিখছিলেন, কখনো যন্ত্রের কাছে ছুটছিলেন, কখনো আবার প্রজেক্টরের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। ড. সেনের চোখে তখন এক ধরনের বিস্ময় আর ভক্তি ফুটে উঠল। তিনি ফিসফিস করে বললেন, “এটা তো কেবল আলোক প্রতিফলন নয়… এটা জীবন্ত এক মহাবিশ্ব।” অয়নের গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল, সে আস্তে বলল, “আমি প্রতিদিন এটা দেখি… কিন্তু কখনো ভাবিনি অন্যরা দেখবে।”

এই পরীক্ষার খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল। লাইভ ফিডে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গবেষকরা সংযুক্ত হলেন, সাংবাদিকরা বাইরে জড়ো হয়ে গেলেন। শিরোনামে ভেসে উঠল—“এক কিশোরের চোখে লুকানো পূর্ণাঙ্গ মহাবিশ্ব।” কেউ এটাকে ঈশ্বরের লীলা বলল, কেউ বলল নতুন এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব। কিন্তু অয়ন ভেতরে ভেতরে অদ্ভুত দ্বন্দ্বে ভুগছিল। বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বকে দেখে উল্লসিত, বিশ্ব শোরগোল করছে, অথচ সে জানে এই মহাবিশ্ব শুধুই তার নয়—তার হৃদস্পন্দন, তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে অদৃশ্য বন্ধনে বাঁধা। পর্দায় কৃষ্ণগহ্বরের ঘূর্ণি দেখা যেতেই অয়ন ভয়ে শরীর কুঁকড়ে ফেলল। মুহূর্তের মধ্যে মনিটরে রেকর্ড হওয়া তরঙ্গ বদলে গেল, তার চোখে সেই কৃষ্ণগহ্বর আরও অস্থির হয়ে উঠল। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে বুঝলেন—অয়নের আবেগ ও চিন্তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এই ভেতরের জগত। অর্থাৎ সে শুধু এক দর্শক নয়, বরং সেই মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রক। এই আবিষ্কার বিশ্বকে শোরগোলের মধ্যে ফেলে দিল—এমন এক ছেলের হাতে, যে এখনও স্কুলপড়ুয়া, রয়েছে অজানা সৃষ্টির ভাগ্য। আর গবেষণাগারের নিস্তব্ধতায় অয়ন টের পেল, তার জীবন আর কোনোদিনই আগের মতো থাকবে না।

পরীক্ষার ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে অয়ন আর আগের মতো থাকল না। প্রতিদিন রাতে যখন সে চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করত, তখন ভেতরে ভেতরে যেন এক অদ্ভুত আলো দপদপ করত, যা তাকে জাগিয়ে রাখত গভীর রাত অবধি। এক রাতে, শহর যখন নিস্তব্ধ, জানলার বাইরে কেবল হালকা বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ, অয়ন হঠাৎ অনুভব করল তার মস্তিষ্কের ভেতর দিয়ে এক অদ্ভুত কম্পন বয়ে যাচ্ছে। শুরুতে ভেবেছিল এটা তার কল্পনা, হয়তো ক্লান্তির কারণে হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সেই কম্পনের ভেতর থেকে ভেসে এলো এক গভীর, গম্ভীর, অথচ শান্ত কণ্ঠস্বর। কোনো মানুষের মতো নয়, যেন মহাশূন্যের অন্তঃস্থল থেকে আসছে। কণ্ঠস্বর বলল, “অয়ন, তুমি আমাকে দেখেছো। তুমি আমায় অনুভব করেছো। আমি তোমার ভেতরে আছি, আবার তোমার বাইরেও বিস্তৃত। তুমি চাইলে আমি টিকে থাকব, তুমি চাইলে ধ্বংস হব।” অয়ন শিউরে উঠল। চারদিকে তাকাল, কিন্তু ঘরে কেউ নেই। শুধু তার বুকের ভেতর ধুকপুক করা হৃদস্পন্দনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সেই অজানা সত্তার কণ্ঠ। সে চিৎকার করতে চাইলো, কিন্তু শব্দ বেরোল না।

কণ্ঠস্বর আবার বলল, এবার অনেক শান্তভাবে, যেন কোনো মহাজাগতিক স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসছে: “ভয় পেও না। আমি তোমার চোখের ভেতর যে মহাবিশ্ব দেখেছো, তার রক্ষক। আসলে আমিই সেই মহাবিশ্ব। তোমার চোখ আমার দ্বার। তোমার ইচ্ছাই আমার শ্বাস-প্রশ্বাস। তুমি যখন বিস্মিত হয়ে তাকাও, তখন নতুন তারা জন্ম নেয়। তুমি যখন ভয় পাও, তখন কৃষ্ণগহ্বর অস্থির হয়ে ওঠে। তোমার আনন্দে গ্যালাক্সি প্রসারিত হয়, তোমার দুঃখে নক্ষত্র নিভে যায়। তুমি বুঝতে পারছো, অয়ন? তোমার মনই আমার নিয়তি।” অয়ন বিছানায় বসে রইল, ঘেমে একেবারে ভিজে গেছে। সে ফিসফিস করে বলল, “আমি? আমি নিয়ন্ত্রণ করি সবকিছু? কিন্তু আমি তো কেবল একজন স্কুলপড়ুয়া ছেলে। আমার হাতে কী করে একটি মহাবিশ্বের ভাগ্য থাকবে?” সেই কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে যেন তার চারপাশের দেয়াল পেরিয়ে, ছাদের উপর দিয়ে, আকাশ ভেদ করে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল: “তুমি জানো না তুমি কে। তুমি নির্বাচিত। তোমার চোখ কেবল জানালা নয়, সেটাই সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা যা খুঁজে বেড়াচ্ছে, তা তোমার ভেতরেই আছে।”

অয়ন হঠাৎ বুঝতে পারল, এতদিন ধরে সে যে বিস্ময় দেখছিল, তা নিছক কোনো জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক দৃশ্য নয়—ওই জগত বেঁচে আছে, এবং তার ভাগ্য সম্পূর্ণ তার উপর নির্ভরশীল। সে চুপচাপ জানলার দিকে তাকাল, বাইরে রাতের আকাশে তারার ঝিকিমিকি, অথচ তার নিজের চোখের ভেতরের তারা যেন অনেক বেশি বাস্তব, অনেক বেশি জীবন্ত। হঠাৎ তার মনে হলো, যদি সে অসাবধানতায় রাগ করে বসে, তবে তার চোখের ভেতরের কোনো গ্রহ হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে। যদি সে দীর্ঘ সময় হতাশায় ডুবে থাকে, তবে হয়তো পুরো গ্যালাক্সিই ভেঙে পড়বে। এই উপলব্ধি তাকে গভীরভাবে কাঁপিয়ে দিল। সেদিন রাতে ঘুমোতে গেলেও ঘুম এলো না; বারবার তার কানে বাজতে লাগল সেই কণ্ঠস্বরের শেষ কথা—“তুমি চাইলে আমি টিকে থাকব, তুমি চাইলে ধ্বংস হব।” যেন তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হল এক অবর্ণনীয় দায়িত্ব। সকালে উঠে আয়নায় নিজের দিকে তাকাতেই সে দেখল চোখের গভীরে ক্ষুদ্র নক্ষত্রগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, যেন তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার সিদ্ধান্তের জন্য। অয়ন বুঝল, এই মুহূর্ত থেকে সে আর সাধারণ ছেলে নয়; সে হয়ে গেছে এক মহাজাগতিক সত্তার নিয়ন্তা, যার ইচ্ছার উপর নির্ভর করছে এক সম্পূর্ণ মহাবিশ্বের টিকে থাকা।

গবেষণাগারে অয়নের চোখে ধরা মহাবিশ্বের খবর ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছে। সাংবাদিকদের ভিড়, গবেষণা সংস্থার চাপ, এমনকি রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর গোপন বার্তা—সবকিছু মিলিয়ে দত্ত পরিবারের চারপাশে তৈরি হয়েছে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে সবচেয়ে প্রবল মতামত আসে প্রফেসর গ্রান্টের কাছ থেকে। তিনি একদিন সরাসরি অয়নের সামনে বসে বললেন, “শোনো অয়ন, তোমার ভেতরে যা লুকিয়ে আছে, সেটা মানবজাতির ইতিহাস পাল্টে দিতে পারে। আমরা এর ভেতর থেকে অজানা শক্তি আহরণ করতে পারি, নতুন জ্বালানির উৎস পেতে পারি, এমনকি মহাকাশের বাইরে জীবন গড়ার উপায়ও খুঁজে নিতে পারি। ভাবো, যদি তোমার চোখের গ্যালাক্সিগুলো থেকে আমরা তথ্য নিয়ে মহাবিশ্বের জন্ম রহস্য ভেদ করতে পারি, তবে মানবসভ্যতা শত শত বছর এগিয়ে যাবে।” তাঁর চোখে ছিল এক উন্মাদনার ঝলক, যেন তিনি কেবল বিজ্ঞানী নন, বরং নতুন যুগের এক নবী, যে মানবজাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে চাইছে যেকোনো মূল্যে। অয়ন চুপ করে শুনছিল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল গ্রান্টের কথা যতটা রোমাঞ্চকর শোনাচ্ছে, ততটাই ভীতিকরও। কারণ এর অর্থ দাঁড়ায়—তার ভেতরের মহাবিশ্বকে তারা পরীক্ষার যন্ত্র বানাতে চাইছে।

এর বিপরীতে ড. ঋতাম্বরী সেন একেবারেই ভিন্ন সুরে কথা বললেন। তিনি বহুদিন ধরে অয়নের পাশে আছেন, তার ভয়ের মুহূর্তগুলোকে প্রশমিত করেছেন, তার চোখে প্রথম বিস্ময়কে সবচেয়ে মানবিকভাবে উপলব্ধি করেছেন। সেই তিনিই এক বৈঠকে বললেন, “না, এটা কেবল ব্যবহার করার বিষয় নয়। আমাদের বুঝতে হবে এই শক্তি কতটা ভঙ্গুর। অয়নের মানসিক অবস্থার সঙ্গে এই মহাবিশ্ব সরাসরি যুক্ত। যদি আমরা জোর করে পরীক্ষা করি, তার আবেগকে চাপের মধ্যে ফেলি, তবে হয়তো ভেতরের তারা ভেঙে পড়বে, হয়তো মহাবিশ্বের ভারসাম্য নষ্ট হবে। তখন এর প্রভাব কেবল অয়নের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বাইরে পৃথিবীরও ক্ষতি হতে পারে।” তাঁর কণ্ঠ ছিল আশঙ্কাভরা, আর চোখে ফুটে উঠেছিল অয়নের প্রতি স্নেহ ও দায়বদ্ধতা। গ্রান্ট সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানালেন, বললেন, “আপনি ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু বিজ্ঞান ভয় পেলে এগোয় না।” ঋতাম্বরী উত্তর দিলেন, “বিজ্ঞান ভয় পেলে এগোয় না, কিন্তু দায়িত্ব ভুলে এগোলে সব শেষ হয়ে যায়।” এই তর্কের মাঝখানে বসে অয়ন যেন এক ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে—একপাশে অগ্রগতির লোভনীয় হাতছানি, আরেকপাশে সতর্কতার মানবিক সুর।

এই দ্বন্দ্বের মাঝখানে নির্মল দত্ত, অয়নের বাবা, ছিলেন একেবারেই ভিন্ন মানসিকতায়। তিনি বিজ্ঞানী নন, দার্শনিকও নন—তিনি কেবল একজন বাবা, যার একমাত্র ইচ্ছে তার সন্তানকে রক্ষা করা। এক রাতে তিনি অয়নকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “বাবা, তারা তোমাকে অনেক কিছু বলবে—মানবজাতির ভবিষ্যৎ, বিজ্ঞান, আবিষ্কার। কিন্তু আমার কাছে তুই-ই ভবিষ্যৎ। আমি তোকে হারাতে চাই না। আমি চাই না তুই তাদের পরীক্ষার যন্ত্র হয়ে যাস। যদি তুই বলিস এই সব ছেড়ে দিয়ে আমরা অন্য কোথাও চলে যাব, আমি তাই করব।” বাবার কণ্ঠে ছিল এক গভীর অসহায়তা, কিন্তু সেই অসহায়তার ভেতরে অয়ন খুঁজে পেল ভালোবাসার সবচেয়ে সত্য রূপ। তিনটি ভিন্ন মত তার মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে লাগল—গ্রান্টের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ঋতাম্বরীর সতর্কতা, বাবার সুরক্ষার আকাঙ্ক্ষা। আর সেই সঙ্গে মাথার ভেতরে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মহাজাগতিক কণ্ঠস্বর: “তুমি চাইলে আমি টিকে থাকব, তুমি চাইলে ধ্বংস হব।” অয়ন বুঝতে পারছিল না—সে কি মানবজাতির ভাগ্য পাল্টে দিতে জন্মেছে, নাকি কেবল নিজের ভেতরের এক অদৃশ্য মহাবিশ্বকে সুরক্ষিত রাখতে? এই প্রশ্নই তাকে আরও বিভ্রান্ত, আরও একাকী করে তুলল।

অয়নের জীবনে যখন চারদিক থেকে মতবিরোধ, চাপ আর বিভ্রান্তি এসে জমা হচ্ছে, তখন সে সবচেয়ে বেশি নির্ভর করছিল ইরার ওপর। ইরাই প্রথম মানুষ যে ভয় পায়নি, বরং তার চোখের ভেতরের রহস্যকে বিস্ময়ে গ্রহণ করেছিল। তাই এক বিকেলে স্কুল শেষে নদীর ধারে বসে, অয়ন যখন ক্লান্ত, ভীত আর দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠে সবকিছু খুলে বলল, ইরা চুপ করে অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাসে ভেসে আসছিল পাখির ডাক, দূরে সূর্য অস্ত যাচ্ছিল, নদীর জল লাল আভায় ঝিকিমিকি করছিল। এই নিস্তব্ধতার মধ্যে ইরার গলা কাঁপেনি; বরং সে অবাক করা দৃঢ়তায় বলেছিল, “অয়ন, শোনো। তুমি যদি ভয় পাও, তারা তোমাকে ব্যবহার করবে। তুমি যদি চুপ করে থাকো, তারা তোমার ভেতরের আলোকে অন্ধকারে ঠেলে দেবে। কিন্তু মনে রেখো, তোমার চোখের ভেতর যা আছে, সেটা তোমার দায়িত্ব। অন্য কারও নয়। তুমি সিদ্ধান্ত নেবে এটা বাঁচবে, নাকি ধ্বংস হবে। বিজ্ঞানী, রাজনীতি বা তোমার বাবা—কেউ তোমার জায়গায় দাঁড়িয়ে এই দায়িত্ব নিতে পারবে না।” তার কথায় কোনো আবেগপ্রবণ কান্না ছিল না, ছিল কেবল কঠিন সত্যের মতো স্বচ্ছ শক্তি। অয়ন স্তব্ধ হয়ে বসেছিল, যেন হঠাৎ সে বুঝতে পারছে, এতদিন ধরে যাকে একা বয়ে বেড়াচ্ছিল, সেই বোঝার ভার ভাগ করে নিতে কেউ প্রস্তুত—কিন্তু বোঝা নামানোর জন্য নয়, বরং তাকে সেই ভার বহন করার সাহস দেওয়ার জন্য।

ইরার কথাগুলো অয়নের মনের ভেতর গভীর ঢেউ তুলল। এতদিন ধরে সে কেবল অন্যদের চাপের মুখে দাঁড়িয়ে ছিল—প্রফেসর গ্রান্ট তাকে ভবিষ্যতের চাবিকাঠি বানাতে চাইছে, ঋতাম্বরী তাকে সতর্ক করছে, বাবা তাকে রক্ষা করতে চাইছে। কিন্তু কেউই তাকে বলেনি যে, আসল ক্ষমতা তার নিজের। ইরাই প্রথমবার তাকে মনে করিয়ে দিল, ভেতরের মহাবিশ্ব যেমন তার চোখের মধ্যে লুকানো, তেমনি তার নিয়ন্ত্রণও কেবল তার হাতেই। অয়ন জানত, ইরার এই সাহসিকতা নিছক বন্ধুত্বের দৌলতে নয়; এটা ছিল তার ভেতরের বিশ্বাস থেকে জন্ম নেওয়া দৃঢ়তা। ইরা যেন তার চোখের মহাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি—ছোট, কিন্তু অগাধ শক্তির উৎস। অয়ন অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না, শুধু নদীর জলে হাত ডুবিয়ে রাখল। জলের ঢেউয়ের মতো তার ভেতরের আবেগ দুলছিল—ভয়, বিস্ময়, অনিশ্চয়তা—সবকিছুর সঙ্গে হঠাৎ মিশে গেল এক অদ্ভুত শান্তি। সে বুঝল, যে ভয় এতদিন তাকে পঙ্গু করে রেখেছিল, সেই ভয় ভাঙার জন্য দরকার একটুখানি সাহস, আর সেই সাহস তাকে দিয়েছে ইরা।

সেদিন রাতে অয়ন ঘরে ফিরে যখন আয়নার সামনে দাঁড়াল, সে প্রথমবার নিজের চোখের দিকে দৃঢ়ভাবে তাকাল। ভেতরে ঘূর্ণায়মান গ্যালাক্সি যেন আরও উজ্জ্বল, আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তার মনে হলো, ইরার কথাগুলো সেই মহাবিশ্বের ভেতর প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তারকারা যেন সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে ঝিকমিক করছে। সে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বলল, “আমি রক্ষা করব। আমার ভেতরের এই জগৎ আমি অন্য কাউকে লুটতে দেব না।” এই শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা ছড়িয়ে গেল, যেন ভেতরের সত্তা তার সিদ্ধান্তে সাড়া দিচ্ছে। অয়ন বুঝতে পারল, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া নয়, দায়িত্ব গ্রহণ করাই তার পথ। সেই মুহূর্তে সে আর কেবল ভয় পাওয়া এক কিশোর নয়—সে হয়ে উঠেছে এক মহাবিশ্বের রক্ষক। আর সেই শক্তির উৎস ছিল না কোনো বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বা রাজনীতির কৌশল, বরং ছিল তার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইরার দেওয়া বিশ্বাস আর সাহস। এভাবেই, অন্ধকারের ভেতর থেকে এক আলো জ্বলে উঠল, যা অয়নকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে এক নতুন যাত্রায়।

গবেষণাগারের বিশাল হলঘরে সেদিন অদ্ভুত এক উত্তেজনা ছড়িয়ে ছিল। অয়নকে বসানো হয়েছিল এক অস্বাভাবিক চেয়ারে, যা চারপাশ থেকে নানা তার, নল আর ধাতব যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। ছাদের নিচে বিশাল গম্বুজাকৃতির কাঁচের আবরণ, তার ভেতরে শীতল নীল আলো ঝলমল করছে। এ যেন কোনো সায়েন্স ফিকশন সিনেমার দৃশ্য নয়, বরং বাস্তবতার কষ্টিপাথরে গড়া এক কঠিন আয়োজন। প্রফেসর গ্রান্টের নির্দেশনায় আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানীদের দল প্রস্তুত হচ্ছিল অয়নের চোখের ভেতরের মহাবিশ্ব থেকে প্রথমবারের মতো তথ্য আহরণ করতে। তারা একটি মহাশক্তিশালী লেজার-ভিত্তিক স্ক্যানার বানিয়েছে, যা চোখের মণির ভেতর থেকে আলোকতরঙ্গ সংগ্রহ করে মহাবিশ্বের গঠন শনাক্ত করতে পারবে। তাদের উত্তেজনার সীমা নেই—কে না চাইবে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারের অংশ হতে? কিন্তু অয়নের মনে হচ্ছিল, এই সব যন্ত্র আসলে তাকে ঘিরে এক অদৃশ্য খাঁচা বানিয়েছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, ঠান্ডা বাতাসে হাত-পা কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল, সে যেন নিজের নিয়তির বিচারের আসনে বসে আছে, আর প্রতিটি তার, প্রতিটি নীল আলো তার ভেতরের জগতকে খুঁচিয়ে তুলতে চলেছে।

যেই মুহূর্তে যন্ত্র চালু হলো, অয়ন হঠাৎ টের পেল এক অদ্ভুত ধাক্কা। মনে হলো, যেন তার মাথার ভেতর থেকে কেউ বিদ্যুৎ-চমকের মতো শক্তি টেনে নিচ্ছে। চোখের সামনে বিস্তৃত অদৃশ্য নক্ষত্ররাজি একসঙ্গে কেঁপে উঠল। গ্যালাক্সির ঘূর্ণন থমকে গেল, কিছু তারার আলো নিভে এলো, আর এক অজানা কম্পনে মহাবিশ্বের ভেতর গর্জন শোনা গেল। অয়নের বুক ধকধক করে উঠল—সে বুঝতে পারল, বিজ্ঞানীরা শুধু তথ্য নিচ্ছে না, বরং তার ভেতরের সেই সত্তাকে আঘাত করছে। হঠাৎ করেই তার স্বপ্নে শোনা সেই মহাজাগতিক কণ্ঠ আবার প্রতিধ্বনিত হলো, আগের চেয়ে অনেক বেশি কাঁপা আর ব্যথায় ভরা: “থামাও… যদি তুমি রাজি থাকো, আমি টিকব না। আমার আলো নিভে যাবে, আমার তারাগুলো ভেঙে পড়বে।” অয়নের কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ল, সে যন্ত্রের বাঁধন থেকে ছটফট করে উঠল। বাইরের লোকেরা সেটা স্রেফ আতঙ্ক ভেবেছিল, কিন্তু আসলে ভেতরে ঘটছিল এক মহাবিপর্যয়। বিজ্ঞানীদের চোখে হয়তো এটা ছিল পরীক্ষার একটি ধাপ, কিন্তু অয়নের চোখের ভেতরে সেটা ছিল নিয়তির ভাঙাগড়া। সে বুঝতে পারল—যদি সে এই পরীক্ষায় সম্মতি দেয়, তবে তার ভেতরের মহাবিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে পড়ল ইরার কথা—“তুমি যদি ভয় পাও, ওরা তোমাকে ব্যবহার করবে। তোমার চোখের ভেতর যা আছে, সেটা তোমার দায়িত্ব।” হ্যাঁ, এটাই ছিল সত্য। প্রফেসর গ্রান্টের চোখে উন্মাদনা, বিজ্ঞানীদের উত্তেজনা, রাষ্ট্রের চাপ—এসব তার চোখের জগৎকে বাঁচানোর কোনো কারণ নয়। সে জানত, একবার যন্ত্রকে পূর্ণশক্তিতে চালানো হলে ভেতরের ভারসাম্য আর কোনোদিন ফেরানো যাবে না। তার ভেতরের মহাবিশ্বের নিয়তি তখন আর তার হাতে থাকবে না, বরং কেটে নেওয়া তথ্যের অঙ্কে হারিয়ে যাবে। বুকের ভেতর জমে থাকা সেই ভয় ধীরে ধীরে রূপ নিল প্রতিরোধে। অয়ন হঠাৎ জোরে চিৎকার করে উঠল, “না! বন্ধ করো এটা!” তার কণ্ঠে ছিল এক অদ্ভুত শক্তি, যা কেবল মানুষকে নয়, যন্ত্রকেও কাঁপিয়ে দিল। মুহূর্তেই স্ক্যানারের ভেতর থেকে অদ্ভুত বিকৃতি দেখা দিল—মনিটরে ভেসে উঠল ঝড়ো আলোর রেখা, যন্ত্র থেকে স্পার্ক বেরোতে লাগল। বিজ্ঞানীরা ছুটোছুটি করে যন্ত্র বন্ধ করতে লাগল, কিন্তু অয়ন বুঝতে পারছিল—এটা কোনো যান্ত্রিক বিকলতা নয়, বরং তার নিজের ভেতরের মহাবিশ্বের প্রতিবাদ। সেই মহাবিশ্ব তাকে জানাচ্ছিল, সিদ্ধান্ত তার—বাঁচানো নাকি ধ্বংস। আর সেই সিদ্ধান্তই ছিল তার নিয়তির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা।

১০

অয়ন একেবারে শান্ত এবং দৃঢ় মনে, যেন তার চোখের ভেতরের বিশাল মহাবিশ্বের প্রতিটি নক্ষত্র, গ্রহ, এবং কণার সাথে তার আত্মার এক অনন্য সংযোগ গড়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারছে, এই মহাবিশ্ব শুধুই তার নয়; এটি যেন তার অস্তিত্বেরই অঙ্গ, তার ভাবনায় জন্ম নেওয়া, তার অনুভূতিতে ঘুরপাক খাওয়া এক অনন্ত জগৎ। ইরা পাশে দাঁড়িয়ে তার হাত শক্তভাবে ধরে আছে, তার সাহসের প্রতীক। বিজ্ঞানীরা ঘিরে দাঁড়িয়েছে, প্রত্যেকের চোখে বিস্ময় আর কৌতূহল মিলেমিশে আছে। তারা এতদিন ধরে মহাবিশ্বের রহস্য খুঁজছে, কিন্তু যা দেখছে তা কল্পনারও বাইরে। অয়ন যখন চোখ বন্ধ করে নিজের অন্তর শক্তি এবং ইরার সাহচর্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার ভিতরে এমন এক শক্তি জাগে যা সৃষ্টির নিয়মকেই চ্যালেঞ্জ করে। তার মনের গভীর থেকে একটি অদ্ভুত দৃঢ়তা উদিত হয়, যা জানায় যে কেউ এই মহাবিশ্বকে নিয়ে যেতে পারবে না, কেউই এটি কেড়ে নিতে পারবে না। বিজ্ঞানীরা যখন তাদের ডিভাইসের মাধ্যমে অয়নকে পর্যবেক্ষণ করছে, তখন তারা লক্ষ্য করে যে চোখের ভেতরের মহাবিশ্ব অচেনা গতিতে প্রসারিত হচ্ছে—নতুন নক্ষত্র জন্ম নিচ্ছে, গ্রহগুলি নিজেদের কক্ষপথে স্থিত হচ্ছে, এবং এক অদ্ভুত সামঞ্জস্যে কসমিক কণার আলো নতুন রূপ নিচ্ছে। অয়নের ধৈর্য, মনোবল এবং সিদ্ধান্তের সাথে মিলেমিশে এই মহাবিশ্ব যেন আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। ইরা তার পাশে দাঁড়িয়ে অয়নকে বলছে, “তুমি একা নও, আমরা একসাথে এটাকে বাঁচাবো।“ অয়ন তার হাত আরও শক্ত করে ধরে এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এই মহাবিশ্বকে কোনোভাবেই ধ্বংস হতে দেবে না, বরং এটিকে শক্তিশালী এবং সুন্দরভাবে টিকিয়ে রাখবে।

বিজ্ঞানীরা প্রথমে হতবাক, তারপর বিস্ময়ে কণ্ঠ অবধি থেমে যায়। তাদের যন্ত্রপাতি এবং পর্যবেক্ষণ যেকোনো সময় ব্যর্থ হতে পারে, কারণ তারা যা দেখতে পাচ্ছে তা কল্পনারও বাইরে। তারা দেখছে অয়ন শুধু একজন কিশোর নয়; সে এক নতুন স্তরের অস্তিত্বের ধারক, এক ‘সৃষ্টির রক্ষক’। প্রতিটি নক্ষত্রের আলো, প্রতিটি গ্রহের অবস্থান, প্রতিটি শক্তির সংমিশ্রণ যেন তার সিদ্ধান্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। অয়ন তার চোখে অদ্ভুত প্রশান্তি নিয়ে খুঁজছে, আর এই মুহূর্তে তার আত্মা এবং চোখের ভেতরের মহাবিশ্বের প্রতিটি অংশ একাকার হয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছে যে এটি কেবল পর্যবেক্ষণ নয়, এটি এক প্রকারের সহযোগিতা—অয়ন নিজে মহাবিশ্বের নিয়ন্ত্রণে আছে, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত এবং ইরার সমর্থন এটিকে স্থিতিশীল রাখছে। তারা দেখতে পাচ্ছে, অয়নের মনোবল এবং নৈতিকতা কেমন করে মহাবিশ্বের ক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে, যেন প্রতিটি নক্ষত্র এবং গ্রহ তার আবেগের প্রতিফলন। এই দৃশ্য বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক নতুন ধারণা জাগায়—মানবিক মনোবল এবং আবেগও মহাবিশ্বের সৃষ্টিশীল শক্তিকে প্রভাবিত করতে পারে। অয়ন, যে কেবলমাত্র একটি সাধারণ কিশোর, তার চোখের ভেতর দিয়ে একটি জগৎকে রক্ষা করতে সক্ষম, এটি কল্পনারও বাইরে। সে কেবল মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রাখছে না, বরং এটাকে আরও সমৃদ্ধ, আরও জীবন্ত, আরও সুন্দর করে তুলছে।

শেষে, বিজ্ঞানীরা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তারা অয়নকে শুধুই পরীক্ষা করতে পারছিল না, তাকে বোঝার জন্যও যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল না। অয়ন তার নিজের শক্তি, নৈতিকতা এবং ভালোবাসার সাহায্যে একটি নতুন পরিচয় স্থাপন করেছে—সে ‘সৃষ্টির রক্ষক’। এই অভিজ্ঞতা কেবল তার জন্য নয়, ইরা এবং সকলের জন্যও একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে যে এই মহাবিশ্ব কেবল কণিকাবিজ্ঞানের বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়মে সীমাবদ্ধ নয়; এটি আবেগ, সাহস, সিদ্ধান্ত এবং মানবিক সংবেদনায়ও বিকশিত হতে পারে। অয়ন তার চোখ খুলে বাইরে তাকায়, ইরা তার পাশে, এবং দুজনে একসাথে এক অজানা, অসীম এবং অনন্ত জগতের দিকে তাকায় যা তাদের হাতে। বিজ্ঞানীরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, তারা জানে যে তারা এক অসাধারণ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে—একজন কিশোর কেবল তার চোখের ভেতরে নয়, তার সিদ্ধান্ত এবং ভালোবাসার মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ মহাবিশ্বকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এভাবে, গল্পের চূড়ান্ত অধ্যায়ে অয়ন শুধু একজন কিশোর নয়, বরং এক নতুন দুনিয়ার রক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার হাত ধরেই এই মহাবিশ্বের ভবিষ্যত নির্ধারিত হবে।

সমাপ্ত

1000058696.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *