আরাত্রিকা সেনগুপ্ত
বর্ষার সেই রাত
বৃষ্টি পড়ছে। জানলার বাইরে সারা শহর কুয়াশার মতো ঝাপসা হয়ে আছে। কলকাতার বর্ষা বড় অদ্ভুত—যেন পুরনো স্মৃতিগুলোকেই ঘুম থেকে তুলে আনে। রাধা চুপচাপ বসে ছিল বিছানার এক কোণে, চায়ের কাপটা ঠান্ডা হয়ে গেছে হাতের মধ্যে। বালিশের পাশে পড়ে ছিল একটা পুরনো খাম—ভেতরে কিছু চিঠি, যেগুলোর কালি এখন ধূসর হয়ে গেছে।
রণর শেষ চিঠি। পাঁচ বছর আগে লেখা।
“রাধা, যদি কোনোদিন ফিরে আসি, তুমি আমাকে চিনতে পারবে তো?”
সে দিনটার কথা রাধা আজও ভুলতে পারেনি। অদ্ভুতভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল রণ। কোনো ঝগড়া, বিদায়, বা সতর্কবার্তা ছাড়াই। তার ফোন বন্ধ, বাড়ির দরজা তালা, বন্ধুরা কিছু জানে না। পুলিশ বলেছিল, “স্বেচ্ছায় গেছেন সম্ভবত। প্রেমের মানুষ মাঝেমধ্যেই এমনটা করে।” রাধা কিছুই বলেনি। তার শুধু মনে পড়ছিল সেই শেষ দুপুরটাকে—রণ বলেছিল, “জানি না কেন, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, কিছু একটা হতে চলেছে। যদি আমি একদিন হঠাৎ না থাকি, ভয় পেয়ো না।”
রাধা ভয় পেয়েছিল।
তারপর পাঁচ বছর কেটে গেছে। চাকরি, বদলি, কিছু নতুন সম্পর্ক—কিন্তু সেই শূন্যতাটুকু রয়ে গেছে, প্রতিটি বৃষ্টির সঙ্গে ফিরে আসে রণর মুখটা। তার গলার স্বর, কপালের ওপর ভেজা চুল পড়ে থাকা, আর সেই চোখদুটো—যেন কিছু লুকিয়ে রাখতো।
চমকে উঠল সে। বেল বাজলো।
রাত তখন দশটা পেরিয়ে গেছে। কুয়াশায় ঢেকে আছে রাস্তা। এই সময়ে কেউ? রাধা জানলার দিকে এগোলো, ভেতর থেকে কিছু দেখা যায় না। সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল, একটু দ্বিধা নিয়ে।
“কে?” — তার গলায় কাঁপুনি।
বাইরেটা নীরব। তারপর খুব হালকা একটা আওয়াজ এলো, যেন বাতাসে ডাকে কেউ।
“আমি… ফিরে এসেছি, রাধা।”
তার বুকটা কেঁপে উঠলো। অচেনা এক অনুভূতি। সে ধীরে ধীরে ছিটকিনি খুললো।
দরজা খুলতেই চোখ আটকে গেল।
সে দাঁড়িয়ে আছে।
রণ।
একই মুখ, একই চোখ, শুধু যেন আরও গভীর, আরও শীতল। গায়ে গাঢ় নীল জামা, ভেজা চুলগুলো কপালে সেঁটে আছে। বৃষ্টিতে তার মুখটা চকচক করছে, কিন্তু তার চোখে… কোনও উষ্ণতা নেই।
রাধা এক পা পিছিয়ে গেল।
“রণ?”
সে কিছু বললো না। এক পা বাড়িয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
রাধা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল, ঘড়ির টিক টিক শব্দ ছাড়া চারপাশ নীরব। রণ ভেতরের সোফার দিকে এগিয়ে গেল, গা থেকে চুপচাপ ভেজা জামা খুলে পাশের চেয়ারে রেখে দিল। সে যেন ঘরের প্রতিটি কোণ আগে থেকেই জানে।
“তুমি… কোথায় ছিলে এতদিন?” রাধার গলা কেঁপে উঠল।
রণ মাথা ঘুরিয়ে চেয়ে দেখল তার দিকে। অদ্ভুত একটা হেসে বলল, “তুমি তো বলেছিলে, ফিরে এলে চিনতে পারবে?”
রাধার গা শিউরে উঠল। কারণ তার সামনে যে মানুষটা দাঁড়িয়ে, সেটা রণ হলেও যেন রণ নয়। তার ভঙ্গিমা বদলে গেছে, চাওয়ার ধরণও। আগে রণ যে ভাবে তাকাত, সেই চোখে কিছুটা মায়া থাকত। এই চোখে শুধুই… হিসেব।
“তুমি… রণ তো?” সে ধীরে ধীরে বলে।
রণ একটা হাসি হেসে বলল, “তুমি কী মনে করো?”
রাধা জবাব দিতে পারল না। হঠাৎ একটা হাওয়ার ঝাপটা এসে জানলার কাঁচে ধাক্কা দিল। রণ উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করল। কিন্তু জানলার কাঁচে তার প্রতিবিম্ব পড়ে না।
রাধা চমকে তাকিয়ে রইল।
রণ ফিরে এসে বলল, “তুমি কি এখনও সেই চিঠিগুলো রাখো?”
“চিঠি? কোনটা?”
“যেটা আমি লিখেছিলাম, যাওয়ার আগে।”
রাধা মাথা নাড়ল।
রণ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াল, খুব কাছে। তার গলা খুব নিচু কিন্তু কেমন এক ছায়াময় স্বরে বলল—“তবে তুমি এখনও ভালোবাসো আমাকে, তাই না?”
রাধা কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার গলা শুকিয়ে গেছে।
হঠাৎ রণ ধীরে ধীরে সামনে ঝুঁকে পড়ল, তার কানে বলল, “তবে এবার আমাকে এমনভাবে ভালোবাসো, যেন চেনা-অচেনার পার্থক্যটাই মুছে যায়।”
একটা বাতাস যেন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। বাইরের রাস্তায় বৃষ্টির শব্দ আরও জোরালো হয়ে উঠল। রাধা পেছনে হটতে হটতে বিছানার কোণায় এসে দাঁড়াল।
তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা রণ হলেও, তার চোখে আজ কিছু নেই—কোনো অতীত, কোনো স্মৃতি, কোনো প্রেম নয়। শুধু অন্ধকার।
একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে নিজেই নিজের ভিতরে—
“যদি এই মানুষটা রণ না হয়, তবে কে?”
ঘড়ির কাঁটা তখন ১০:১৩।
আর একটা বৃষ্টিভেজা রাত শুরু হলো—আর রাধার জীবনে যে নতুন অধ্যায়, সেটার নাম: অজানা।
এই রণ, সেই রণ নয়
সকালের আলো ঘরে ঢুকেছে, কিন্তু রাধার বুকের ভিতরকার অন্ধকার কিছুতেই কাটছে না। ঘুম বলতে কিছু হয়নি। সারারাত একপাশ থেকে আরেকপাশে গড়িয়ে গেছে। রণ পাশে শুয়ে ছিল না—সে ঘরের অন্যদিকে সোফার উপর বসে ছিল, চুপচাপ। মাঝে মাঝে জানলার বাইরে তাকাত, কখনো বা চোখ বুজে বসে থাকত, যেন ধ্যান করছে।
রাধা অনেকক্ষণ তাকিয়েছিল তাকে। চেনা মুখ, কিন্তু অচেনা চলাফেরা। কেমন যেন যান্ত্রিক, নিস্তব্ধ, আর অদ্ভুত এক নির্লিপ্তি। যেন সবকিছু তাকে ছুঁয়েও যায় না।
সকালে সে ধীরে ধীরে উঠে এসে দেখে রান্নাঘরে কফি বানাচ্ছে রণ। অথচ রণ কখনো কফি খেত না। তার চা-প্রেম ছিল বিখ্যাত।
“তুমি কফি খাও কবে থেকে?” রাধা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
রণ একটু থেমে বলে, “চা তেতো লাগে। এখন আর পছন্দ হয় না।”
রাধা কিছু বলল না। সে খেয়াল করল, রণ তার প্রিয় টাকটাক লাল মগটা না নিয়ে অন্য একটা সাদা মগ ব্যবহার করছে। ছোট ছোট পরিবর্তন। অথচ এটাই সেই ছেলে, যে একসময় বলত—”রাধা, তুমি জানো তো, মগ বদলালে আমার দিনটাই খারাপ যায়!”
সকালটা যেন একটা অচেনা ঘরে কাটছে—যেখানে রণ আছে, কিন্তু রাধার মনে হচ্ছে সে একজন অন্য মানুষকে আতিথ্য দিচ্ছে।
কিছু একটা ঠিক নেই।
“তুমি বলেছিলে পাঁচ বছর মানসিক হাসপাতালে ছিলে? কোথায়?”
রাধা একটু সাবধানে প্রশ্নটা করল।
রণ তাকাল না। শুধু বলল, “তুমি চিনবে না। শহরের বাইরে, পাহাড়ের কাছে একটা জায়গা।”
“নাম?”
“নাম মনে নেই।”
রাধা থেমে গেল। এটা কোনো উত্তর না।
পাঁচটা বছর—এতটা সময় কেউ কোথায় ছিল, সেটা ভুলে যায়?
“তোমার ফোনটা কোথায়?”
“ফোন নেই আমার,”—রণ ঠাণ্ডা স্বরে বলল, “এখনও ব্যবহার করি না।”
রাধা অনুভব করল, তার ভেতরে একটা সন্দেহ গাঢ় হচ্ছে। হয়তো এটা ভালোবাসার স্নেহে তৈরি অনাস্থা, অথবা আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সে টের পাচ্ছে, এই মানুষটা রণ হতে পারে না। হয়তো মুখটা একই, কিন্তু ভেতরের কারিগর আলাদা।
সন্ধেবেলা রণ বাইরে যাওয়ার কথা বলল।
“চলো, ময়দানে যাই। আগের মতো।”
রাধা একটু চমকে গেল। ওখানে তো ওরা প্রথম দেখা করেছিল, প্রেমে পড়েছিল। সেখানে হাঁটার মাঝেই রণ প্রথমবার তার হাত ধরেছিল।
সে চুপচাপ রাজি হয়ে গেল।
বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছে হালকা করে। দুজন হাঁটতে হাঁটতে যখন ময়দানে পৌঁছাল, তখন চারদিক কুয়াশায় ঘেরা। ঘাসে জল জমে আছে। বাতাসে শীত।
“তুমি এখানে এসেছো আগে?” রাধা জিজ্ঞেস করল।
রণ দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি অনেক আগে এখানে এসেছিলাম। এমনকি… তোমার জন্মেরও আগে।”
রাধা বিস্ময়ে তাকাল।
“মানে?”
“তোমার কিছু মনে নেই?”
“কোনো ব্যাপারে?”
“এই জায়গাটার সঙ্গে তোমার অতীত একটা সম্পর্ক আছে, রাধা। শুধু তুমি ভুলে গেছো।”
রাধার মাথা ঘুরতে লাগল। রণ কখনোই এমন কথাবার্তা বলত না। সে ছিল যুক্তিনিষ্ঠ, স্পষ্ট কথা বলা এক তরুণ—কখনো এমন গোলকধাঁধার মতন সংলাপ বলত না।
এই মানুষটা কে?
তারা ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। হঠাৎ রণ থেমে বলে, “এই গাছটার নিচে আমরা বসেছিলাম, মনে আছে?”
রাধা চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। ওই গাছটা, হ্যাঁ, মনে আছে। কিন্তু কীভাবে? সে এই স্মৃতিটা চাপা দিয়েছিল অনেক দিন। এত দিন পরে হঠাৎ রণ কীভাবে বলল ঠিক সেই জায়গাটার কথা?
“তুমি… ঠিক কি চাও এখন?”
রণ তাকাল তার দিকে। তারপর নিচু স্বরে বলল, “তোমার পাশে থাকতে চাই। যতদিন তুমি আমায় সহ্য করতে পারো।”
তার গলায় একটা কষ্টের ছোঁয়া ছিল। অথবা—সেটা কৃত্রিম?
রাধার পেছনে হঠাৎ একটা শব্দ হলো। সে ঘুরে তাকাল—কেউ নেই। আবার ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল রণ তাকিয়ে আছে তার দিকে, কিন্তু মুখে যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা। যেন মুখোশ খুলে পড়ার অপেক্ষা।
তারা বাড়ি ফিরে এলো। রাত তখন গভীর।
রাধা ঘরের লাইট নিভিয়ে ঘুমোতে গেল। কিন্তু ঘুম এল না। একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করছে তার ভিতরে।
রাত একটা বেজে গেছে। ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ।
সে বিছানা ছেড়ে উঠল।
ঘরের মধ্যে নীরবতা। জানলার পর্দা হালকা দুলছে।
রণ নেই।
সে ধীরে ধীরে বাইরের ঘরে এল। জানলা খোলা। রণ দাঁড়িয়ে আছে জানলার পাশে, তাকিয়ে আছে অন্ধকারের দিকে। কিন্তু রাধা যা দেখল, তাতে গা কেঁপে উঠল—
রণর মুখ আয়নায় পড়ছে না।
ঘরের এক কোণে রাখা আয়নাটার গায়ে শুধু রাধার প্রতিবিম্ব। রণ যেন… সেখানে নেই।
রাধা ধীরে ধীরে পিছিয়ে গেল।
সে একটাই কথা ভাবল—
“এই মানুষটা রণ নয়। কেউ একজন তার ছায়া পরে এসেছে। কে?”
আয়নার মানুষ
আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে রাধা নিজের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছিল—ধপধপ… ধপধপ…
সামনে রণ দাঁড়িয়ে, কিন্তু আয়নায় নেই। যেন সে আলো-ছায়ার মাঝখানে দাঁড়ানো এক অস্তিত্বহীন ছায়া।
“রণ…” রাধার গলা শুকিয়ে এসেছে। “তুমি… তুমি তো… আয়নায়…?”
রণ ধীরে ধীরে ঘুরে তাকায় তার দিকে। চোখে সেই একই গভীর, অদ্ভুত শীতলতা।
“সব আয়নায় সব দেখা যায় না, রাধা। বিশেষ করে যখন দেখার ইচ্ছেটাই ভুল হয়ে যায়।”
তার ঠোঁটে একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে, কিন্তু সেই হাসি অদ্ভুতভাবে কৃত্রিম। যেন মুখোশের নিচে অন্য কেউ হাসছে।
রাধা পিছিয়ে যায়। হাতের তালু ঘামে ভিজে গেছে। সে জানে না কীভাবে রণকে প্রশ্ন করবে—সে জানে না এই মানুষটা কে। শুধু এটুকু বোঝে, এটা সেই রণ নয় যে তাকে ভালোবেসেছিল।
সে অজান্তেই চিৎকার করে ওঠে, “তুমি কে?”
রণ কিছু বলে না। সে ধীরে ধীরে সামনে এগোয়।
“রণ মারা গেছে, তাই না?” রাধা কাঁপা গলায় বলে। “তুমি তার শরীর নিয়ে এসেছো, কিন্তু তুমি রণ নও। তুমি কে?”
রণ হঠাৎ থেমে যায়। তারপর একধরনের শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “রণ চলে গিয়েছিল অনেক দূরে। এমন এক জায়গায়, যেখানে কেউ একবার গেলে আর ফেরে না। কিন্তু আমি ফিরেছি। কারণ তোমার কিছু বাকি ছিল রাধা। এক অসমাপ্ত প্রতিজ্ঞা… এক অর্ধেক ছায়া… একটা অর্ধেক প্রেম।”
রাধার চোখ ছলছল করছে। “তুমি কী বলছো এসব? কী অসমাপ্ততা?”
রণ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ায়। তার কণ্ঠ একেবারে নিচু, যেন একটা ফিসফিস করে বলা অভিশাপ—
“তুমি কি ভুলে গেছো রক্তের সেই রাতটা?”
রাধা কেঁপে ওঠে।
“কোন রাতটা?” সে প্রায় কান্নার গলায় বলে।
“রণ যে রাতে চলে গেল। তুমি কি জানো, সে সেদিনই শেষবার চেষ্টা করেছিল তোমাকে দেখতে? সে এসেছিল, কিন্তু তুমি ঘরে ছিলে না। তার হাতে একটা বাক্স ছিল। তুমি জানো কী ছিল সেখানে?”
রাধা মাথা নাড়ে, অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“তোমার লেখা কিছু চিঠি আর একটা নীল রঙের কাচের টুকরো—যেটা তুমি বলেছিলে, তোমার ‘মন’।”
হঠাৎ রাধার মাথায় বিদ্যুতের মতো একটা স্মৃতি ফিরে আসে—কলেজে পড়ার সময়, একবার সে একটা নীল কাচের টুকরো দিয়েছিল রণকে, মজা করে বলেছিল, “এটা আমার মন। হারিয়ে ফেলো না।”
রণ খুব যত্নে সেটা রেখেছিল।
“তুমি কোথা থেকে জানলে এইসব?” রাধা জিজ্ঞেস করে।
রণ তখন চুপচাপ আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ এবার ধীরে ধীরে কালো হয়ে উঠছে—অন্ধকার, অতল।
“আমি জানি… কারণ আমি রণকে শেষবার ধরে রেখেছিলাম,” সে বলল। “তাকে যেতে দিইনি একেবারে। আর সেই কারণেই, আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
“তুমি তাহলে কে?” রাধার গলা ফাটতে চলেছে।
রণ ধীরে ধীরে বলে—
“আমি সেই ছায়া, যে ভালোবাসা অসমাপ্ত রেখে চলে যায় না।
আমি সেই অস্তিত্ব, যাকে নাম দেওয়া যায় না।
রণ যখন চলে গেল, তার প্রেমটা থেকে গেল… আর সেই প্রেম আমায় জন্ম দিল।
আমি… আয়নার মানুষ।”
রাধা হঠাৎই অনুভব করে, কাঁচের জানলার বাইরে একটা চুলবুলে বাতাস বইছে, যেন অনেক অদৃশ্য কণিকা ঘরের চারদিকে ঘুরছে। সময় থমকে গেছে।
রাধার কানে বাজছে একটা পুরনো গান—রণ একদিন গেয়েছিল সেটা। কিন্তু এই মুহূর্তে, সেই গানের প্রতিটি লাইন যেন ব্যাখ্যা দিচ্ছে যা কিছু ঘটছে—
“যদি ফিরে আসি, আমি আমি না হই… তবু কি রাখবে তুমি, আমার নামে স্মৃতি?”
রাধা আর দাঁড়াতে পারে না। সে দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, নেমে আসে রাস্তায়।
বৃষ্টি পড়ছে। তার চুল ভিজে গেছে, মুখে জল গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু তার বুকের ভিতর শুধুই একটাই প্রশ্ন—
“এই যে ফিরে এল—সে রণ নয়, তবে কী?”
তার পেছনে দাঁড়িয়ে কেউ বলে, খুব আস্তে, যেন বাতাস ফিসফিস করছে—
“রাধা, তুমি বলেছিলে ভালোবাসা শরীর চায় না, আত্মা চায়। আজ তুমি পেয়েছো আত্মার প্রেম। এবার বলো—তোমার ভালোবাসা সত্যি ছিল তো?”
রাধা ঘুরে তাকায় না।
সে হাঁটতে থাকে… যেন পালাতে চাইছে।
কিন্তু প্রশ্নটা থেকে যায় তার মনে—
এই ফিরে আসা কি আশীর্বাদ? নাকি এক অভিশাপ?
মৃত প্রেমিকের চিঠি
রাধা দরজা বন্ধ করে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। মেঝে ভিজে গেছে তার কাপড় থেকে পড়া জল দিয়ে, কিন্তু সে তা টের পাচ্ছে না। শুধু একটা কথা তার মাথার ভিতর ধাক্কা মারছে বারবার:
“আমি আত্মার প্রেম… আমি আয়নার মানুষ।”
তার নাকের ডগায় কাঁপুনি, বুকের ভেতর কাঁপা স্রোত। রণ নেই, কিন্তু রণ আছেও—এই অর্ধেক সত্য আর অর্ধেক বিভ্রমের মাঝখানে সে এখন দাঁড়িয়ে।
তখনই সে খেয়াল করল, চেয়ারের উপর একটা খাম রাখা। সাদা খামে হাতের লেখা—রণর হাতের লেখা, সে একঝলকে চিনে ফেলল।
চিঠিটা ঠিক যেন অনেকদিন আগের, কিন্তু সেই মুহূর্তে ঠিক সেদিনকার মতোই সতেজ।
রাধা ধীরে ধীরে চিঠিটা খুলল—
রাধা,
যদি কখনও এই চিঠি তোমার হাতে পড়ে, জানবে—আমি আর বেঁচে নেই।
কিন্তু এই মৃত্যু মানে শেষ নয়। অন্তত, আমার প্রেমের জন্য তো নয়।
তুমি হয়তো জানতে না, যে দিন আমরা শেষ দেখা করেছিলাম, তার ঠিক দুদিন পর আমি একটা অনন্তর অন্ধকারের দিকে এগিয়েছিলাম—নিজে ইচ্ছা করেই।
আমি বেছে নিয়েছিলাম এক নিঃশব্দ মৃত্যু। কারণ আমি জানতাম, আমি তোকে ভালোবাসি… অথচ আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। আমার ভিতর কে যেন বাসা বেঁধেছে, যার প্রতিটা ভাবনা আমার থেকে আলাদা। আমি আয়নায় নিজেকে দেখতাম, আর চিনতাম না।
শেষ কয়েক মাসে আমি একটা অদ্ভুত ছায়ার সঙ্গে বাস করছিলাম। সে আমার কথা বলত, আমার মতো হাঁটত, কিন্তু সে আমি ছিলাম না।
আমি তখন বুঝলাম, আমার ভিতর দুজন মানুষ আছে।
তাদের একজন তোর প্রেমে পাগল, অন্যজন শুধু দেখতে চায়—একটা প্রেম কীভাবে ভাঙে, কীভাবে একটা মানুষ ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়।
আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, রাধা। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম সেই মানুষটাকে, যে আমার ভিতর জন্ম নিচ্ছিল।
এবং আমি জানতাম, যদি আমি তাকে থামাতে না পারি, সে তোকে আঘাত করবে।
তাই আমি চলে গিয়েছিলাম—চিরতরে।
কিন্তু আজ যদি এই চিঠি তুই পড়িস, তার মানে হয়তো আমি ফিরেছি। আমার শরীর নয়, আমার সেই অপর পিছুটান নিয়ে ফিরে এসেছে।
সে আমার ছায়া।
সে সেই মানুষ, যাকে আমি মৃত্যুর আগে বন্দি করে রেখে গিয়েছিলাম এক ভাঙা ঘরে, আয়নার মধ্যে।
এবং সে এখন তোকে চাইছে।
রাধা, সে প্রেম চায় না, সে মালিকানা চায়।
সে তোকে ফিরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু ভালোবাসবে না।
সে তোকে ধরে রাখবে, কিন্তু ছুঁবে না।
সে তোকে মনে রাখবে, কিন্তু তোর হাসি আর চিনবে না।
প্লিজ, তার ফাঁদে পা দিস না।
একটা আয়নার পেছনে তাকে আমি বন্দি করে রেখেছিলাম। সেই আয়নাটা, যেটায় একসময় আমরা একসঙ্গে তাকিয়ে বলেছিলাম—“এই ছবিটার নাম ‘আমাদের’।”
তুই যদি সেই আয়না ভেঙে ফেলিস, সে চিরতরে মুক্তি পাবে। আর তোর জীবনে ঢুকে পড়বে তার আসল রূপ নিয়ে।
আমি জানি না এখন কোন দিন, কোন বছর—
কিন্তু জানি, আমি তোকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আজ তোকে বাঁচানোটা তোর দায়িত্ব।
ভালোবাসা নিয়ে,
রণ (হয়তো শেষবারের মতো)
রাধা চুপচাপ বসে। তার হাতে চিঠির কাগজটা কাঁপছে। তার মনে পড়ল সেই আয়নাটা—পুরনো, কাঠের ফ্রেমের, যে আয়নাটার সামনে রণ তাকে প্রথম “সুন্দরী” বলেছিল। সেই আয়না এখন তাদের ঘরের কোণে বসে আছে।
সে উঠে গেল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে।
আয়নাটায় এবার সে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল, আর পিছনে—রণ।
কিন্তু এই রণের চোখে আজ কোনও দুঃখ নেই, কোনও প্রেম নেই।
শুধু… শূন্যতা। গভীর, অতল শূন্যতা।
সে ধীরে ধীরে বলে ওঠে—
“তুমি এত বছর পরেও আমার আয়নাটা রেখে দিয়েছো।
এটাই প্রমাণ, তুমি এখনও আমায় ভুলতে পারো না।”
রাধা কাঁপা গলায় বলে,
“তুই রণ নোস। রণ তো কখনো এত ঠাণ্ডা করে কথা বলত না। রণ তো কখনো নিজের প্রতিচ্ছবি হারাত না।”
রণ হাসে। এবার মুখটা টানটান, কণ্ঠ কাঁপছে না।
“আমি তার ভেতরের মানুষ। সেই অংশ, যাকে সে দমন করেছিল।
আর এখন, আমি মুক্ত।
তোমার মনে এখনও আমার জায়গা আছে, তাই আমি ফিরে এসেছি।”
রাধা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে না।
সে এগিয়ে যায়। টেবিল থেকে কাচের কাগজকাটারটা তুলে নেয়।
রণ বলে ওঠে—“তুমি জানো, আয়না ভাঙলে কী হয়?”
রাধা ফিসফিস করে—
“ছায়া মুক্ত হয় না, ছিন্নভিন্ন হয়।”
সে আয়নাটায় সজোরে আঘাত করে।
টান!
আয়নাটার কাঁচ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে মেঝেতে।
রণ কাঁপতে কাঁপতে পেছনে যায়। তার চোখ থেকে আলো নিভে আসে। চেহারার ভেতরের ছায়া যেন কুঁচকে যাচ্ছে।
তার কণ্ঠে গুঞ্জন—“রাধা… তুমি ভুল করছো… আমি তো তোমার মধ্যেই ছিলাম… আমি…”
তার শরীর হঠাৎ হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়।
শুধু পড়ে থাকে একটা নীল কাচের টুকরো—রাধার ‘মন’।
রাধা হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
সত্যি কি সে মুক্তি পেল?
না কি, এই শুরু মাত্র?
সেই অনন্ত জানলা
রাধা জানালার পাশে বসে ছিল। বাইরে গ্রীষ্মকালীন সন্ধ্যা—আকাশে হালকা নীলচে-সোনালি আভা, দূরে একটা কাক ডেকে উঠলো, আর হঠাৎ যেন হাওয়া বয়ে গেল তার পিঠের পাশ দিয়ে।
এমনই হাওয়া, যেটা থাকে না… কিন্তু ছুঁয়ে দিয়ে যায়।
তার পাশে পড়ে থাকা নীল কাচের টুকরোটা তখনো মেঝেতে, আয়নার ভাঙা দাগগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে সূর্যাস্তের আলো পড়ছে।
এমন সময় সে আবার শুনতে পেল সেই শব্দটা—ফিসফিসানি।
কীভাবে ব্যাখ্যা করবে জানে না, কিন্তু শব্দটা যেন জানলার বাইরে থেকে নয়, জানলার ভিতর থেকে আসছে।
সে ধীরে ধীরে জানালার দিকে এগিয়ে যায়।
এই জানলাটা কোনও সাধারণ জানলা নয়। এটা তাদের পুরনো বাড়ির পূর্বদিকের দেয়ালে, যেটা রণ একসময় বলত—“এই জানলাটার ওপারে আরেকটা জগৎ আছে।”
সেদিনও সেই কথা মনে পড়ে গেল।
রণ হেসে বলত, “এই জানলা দিয়ে তাকালে নিজের অতীত দেখা যায়। এমনকী, ভবিষ্যতও।”
রাধা জানত, রণ মাঝে মাঝে গভীরভাবে ভাবত এই জানলাটাকে নিয়ে। এমনভাবে তাকিয়ে থাকত, যেন কিছু বা কাউকে দেখছে।
আজ সেই জানলার গ্লাসে হালকা কুয়াশার মতো কিছুর ছায়া। সে দেখে, জানলার কাচে তার প্রতিচ্ছবি নেই। কিন্তু একজন আছে।
রণ।
কিন্তু এবার সে আয়নার রণ নয়। এবার যেন অন্য এক রণ। ক্লান্ত, অশ্রু ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁট কাঁপছে, যেন কিছু বলতে চাইছে।
রাধা কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে, “তুমি কে? আবার সেই ছায়া?”
রণ শুধু মাথা নাড়ে। তারপর আঙুল দিয়ে জানলার কাচে লেখে—”আমি শেষ রণ।”
রাধার চোখে জল চলে আসে।
সে কী ভাবে বুঝবে কে আসল আর কে ছায়া?
রণ এবার জানলার কাচে স্পষ্ট করে একটা দাগ আঁকে—এক বৃত্ত, যার মাঝে একটি বিন্দু।
এই চিহ্নটা সে চেনে। রণ একসময় বলেছিল, “এই প্রতীক মানে ‘সূত্র’। যার শুরু নেই, শেষ নেই—শুধু এক কেন্দ্রবিন্দু আছে। ভালোবাসা যেমন।”
রাধা ফিসফিস করে, “তুমি কি সত্যিই রণ? আমার রণ?”
জানলার কাচে সে দেখে, রণ মাথা ঝাঁকায়।
তার ঠোঁটে আবার সেই পুরোনো হাসি—মৃদু, নির্ভেজাল, তার “সেই রণ”র হাসি।
এবার রাধা একটা অদ্ভুত কিছুর মধ্যে ঢুকে পড়ে। জানলার কাচ থেকে একটা ঠান্ডা আলো ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই আলো গায়ে লাগতেই সে দেখতে পায়—ঘর আর নেই, সে যেন একটা অলীক জগতে পৌঁছে গেছে।
চারপাশে সব সাদা, কুয়াশার মতো। শুধু সামনেই একটা দরজা। দরজার উপর লেখা—“আত্মার দরজা। প্রবেশ করলে ফিরে আসা নিষেধ।”
রাধা দ্বিধায় পড়ে যায়।
তবু সে দরজার হাতলে হাত রাখে।
হঠাৎ পেছনে একটা কণ্ঠ—“তুমি জানো না তুমি কী করতে চলেছো।”
রাধা ঘুরে দেখে—আবার সেই ছায়া-রণ, চোখে অন্ধকার।
“তুমি যদি ওদিকে যাও, ফিরতে পারবে না। আমি আবার তোমার জগতে আসব… এবার চিরদিনের জন্য।”
রাধা জোরে বলে ওঠে, “আমি যদি নিজের রণকে পেতে চাই, তবে আমাকে সেই ঝুঁকি নিতে হবে!”
ছায়া-রণ হেসে ওঠে। “তুমি কি জানো—তুমি যাকে খুঁজছো, সে নিজেই আর চায় না ফিরতে?”
রাধা থমকে যায়।
“হয়তো,” সে ধীরে বলে। “কিন্তু আমি চাই তাকে একবার জিজ্ঞেস করতে—সে বেঁচে থাকলে কী বলত আমাকে। শুধু একবার। কারণ আজ না বললে আমি সারাজীবন জানতেই পারব না, কে ফিরেছিল—তুমি, না সে।”
সে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এক ঝলক আলো। তারপর, নিস্তব্ধতা।
তার সামনে তখন এক মাঠ—ধু-ধু শূন্যতা। সেখানে, এক চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে একজন। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে শান্তি।
রণ।
এবার সত্যিই সে।
রণ ধীরে ধীরে রাধার দিকে এগিয়ে আসে। আর বলে—
“তুই চলে এসেছিস?”
রাধার চোখ ছলছল করে। “তুই কে?”
রণ একটু হাসে। “আমি সেই রণ, যাকে তুই ভালোবেসেছিলি। আমি মরিনি। আমি তো তোর মনে ছিলাম, আর তোর মনে যে থাকে, সে তো কখনো মরে না।”
রাধা ভেঙে পড়ে। “তুই ফিরছিস না কেন?”
রণ বলে, “কারণ তোকে বাঁচতে হবে। আমি এই অনন্ত জানলার ওপাশে আছি, কিন্তু তুই এখনো জীবনের জানলার সামনে। তুই জানিস না—তোর জীবনে এখনো অনেক কিছু বাকি। শুধু একটা কথা মনে রাখিস—যদি কোনোদিন কাউকে ভালোবাসিস, নিজেকে পুরোপুরি তার ভেতরে হারাস না। নিজের একটা আয়না রেখে দিবি, যেখানে তুই শুধু তুই।”
রাধা চোখ বন্ধ করে।
যখন সে আবার চোখ খোলে, সে নিজেকে দেখে জানলার পাশে বসে—তার হাতের মুঠোয় সেই নীল কাচের টুকরো, এবং বুকের ভিতর একটা শান্তি।
রণ গেছে।
কিন্তু সে আজ জানে, কে ফিরেছিল… কে না।
কাগজে লেখা কণ্ঠস্বর
ঘড়ির কাঁটা যেন হঠাৎ ধীর হয়ে এসেছে। রাধা বিছানায় বসে আছে—আলো নিভু নিভু, জানলার কাঁচ এখন পরিষ্কার, তার প্রতিবিম্ব ফিরে এসেছে।
তবুও একটা অদ্ভুত অস্বস্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। মনে হচ্ছে, কিছু একটা এখনো বাকি।
সে বিছানার পাশে রাখা ছোট বাক্সটা টেনে নেয়। বাক্সটা রণর দেওয়া—লাল কাঠের তৈরি, ওপরে ছোট করে খোদাই করা:
“ভালোবাসা কখনো একা থাকে না”
রাধা এই বাক্সটা বহু বছর খোলেনি। আজ, জানলার ঘটনার পর প্রথমবার সে বুঝল—সম্ভবত এটাই পরবর্তী সংকেত।
বাক্স খুলতেই একগুচ্ছ পুরনো চিঠি, কিছু শুকনো গন্ধরাজ ফুল, একটা সাদা স্কার্ফ, আর একটা পুরনো টেপ রেকর্ডার।
রাধা অবাক হয়ে খেয়াল করল—টেপ রেকর্ডারের পাশে একটা ছোট কাগজ আটকানো।
তাতে লেখা—
“যদি আমি আর না থাকি, এই কণ্ঠস্বর রাখিস।
এইটুকুই আমার উত্তর।”
—রণ
রাধার বুক ধকধক করতে থাকে। সে জানে না, রেকর্ডারে কী আছে।
তবু, সে চালায়।
ক্লিক
একটা সোঁ সোঁ শব্দের মাঝে ধীরে ধীরে শোনা গেল রণর কণ্ঠস্বর।
নিস্তব্ধ ঘরে সেই কণ্ঠ যেন বহু বছর পরে ফের ঘুম ভাঙাচ্ছে রাধার।
রণর রেকর্ডেড কণ্ঠে—
“রাধা,
যখন তুই এটা শুনবি, তখন আমি হয়ত আর থাকব না, কিংবা হয়ত থাকব অন্য কোনো রূপে।
তোর সাথে কাটানো সময়গুলোর প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনের গায়ে লেখা হয়ে গেছে, একরকম অসাধারণ হরফে।
কিন্তু আমি জানি, আমি সবসময় সত্য বলিনি।
আমি তোকে বলিনি, যে আমাদের প্রেমের শেষ বছরটায় আমি অন্য কারো কণ্ঠ শুনতে পেতাম—নিজের ভিতর।
তুই যাকে চিনতিস ‘রণ’ বলে, সে ধীরে ধীরে কেউ একটা হয়ে উঠছিল—ভয়ংকর ঠান্ডা, নিঃশব্দ, শীতল।
সে বলত,
‘তুই রাধাকে ভালবাসিস না, তুই ওকে নিয়ে খেলতে চাস।’
সে বলত,
‘ভালোবাসা তো শুধু এক ধরণের দুর্বলতা।’
আমি খুব লড়েছি।
আমি তোকে ভালোবাসতাম, রাধা।
কিন্তু আমি বুঝে গেছিলাম, যে আমি আর আমি নই।
তুই নিশ্চয় খেয়াল করেছিলি, আমি বদলে যাচ্ছি।
একেক দিন যেন তোর সামনে দাঁড়িয়ে ছিল একটা অজানা মানুষ।
সেই মানুষটাই ছিল আমার ছায়া।
সে আমার কণ্ঠ ধার করত, ভাবনা ধার করত, এমনকী ভালোবাসাও নকল করত।
আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম।
এতটাই ভয়, যে তোকে আগেই বিদায় না জানিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া আর কিছু মাথায় আসেনি।
কিন্তু আমি চাইনি তুই ভেঙে পড়।
তাই আমি এই রেকর্ডটা রেখে গেলাম, যাতে তুই জানিস—
যে মানুষটা তোর জন্য গান লিখত, ভোরে চা বানাত, তোর আঁকা দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলত—সে ছিল আমি।
আর ছায়া-রণ?
সে শুধু একটা ফাঁকা খোলস, একটা দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।
তুই যদি কখনো তাকে দেখিস, মনে রাখিস—সে আমার মতোই দেখতে হতে পারে, আমার মতোই কথা বলতে পারে,
কিন্তু সে তোর চোখে তাকিয়ে নিজেকে চিনতে পারবে না।
কারণ, আমি তোকে ভালোবেসেছিলাম।
সে শুধু তোকে চাইবে।
বিদায়,
রাধা।”
টেপ থেমে যায়।
রাধা কাঁদে না। তার চোখে জল নেই, কিন্তু একটা স্থির শোক ভরে গেছে গলার কাঁপুনিতে।
এত বছর পরেও সে এই কণ্ঠস্বরের উষ্ণতায় রণকে স্পষ্ট অনুভব করে।
কিন্তু তখনই সে টের পায়—ঘরের ভিতর আবার কিছু অস্বাভাবিক।
একটা শব্দ—কাগজের খসখসানি।
সে ঘুরে তাকায়।
তার ডেস্কের উপর রাখা ডায়েরিটার পাতা আপনি আপনি উলটে যাচ্ছে।
তারপর এক জায়গায় থেমে যায়।
পৃষ্ঠার মাঝখানে লেখা এক লাইন— “আমার গল্প এখনো শেষ হয়নি, রাধা।”
রাধা হিমশীতল অনুভব করে।
তবে কি ছায়া-রণ এখনো আছে? তবে কি রেকর্ডেড কণ্ঠস্বর শুধু স্মৃতি ছিল, সতর্কতা নয়?
সে ডায়েরিটার পাতা উলটে দেখে—আরও কিছু লেখা হচ্ছে। নিজে থেকে!
“আমি জানালায় ফিরব না।
এইবার দরজা খুলে ঢুকব।
এবার তুমি থামাতে পারবে না।
এবার আমি আসল হব।”
রাধার চোখ ফেটে জল আসে না। আসে সাহস।
সে ধীরে ধীরে ডায়েরিটা বন্ধ করে। এবার বোঝা গেছে, যে লড়াই এখন শুরু হলো।
রাধা জানে, তাকে এবার খুঁজে পেতে হবে সেই মূল ছায়ার উৎস। কে সে? কোথা থেকে সে জন্ম নিয়েছিল?
আর তার উত্তর আছে—রণর পুরনো, গোপন করা সেই ‘ডার্ক স্কেচবুক’-এ, যেখানে সে একসময় তার নিজের ভয়গুলো এঁকেছিল।
ছায়ার খাতা
রাধা এবার আর সময় নষ্ট করতে চায় না।
রণর রেকর্ড আর ডায়েরির পাতায় নিজে থেকে লেখা অদ্ভুত শব্দগুলো তাকে জানিয়ে দিয়েছে—ছায়া ফিরে এসেছে। আর এবার সে জানলা দিয়ে নয়, দরজা ঠেলে ঢুকতে চায়।
রাধা জানে, রণ একসময় আঁকত। ছেলেবেলাতে, কলেজে, এমনকি সম্পর্কের প্রথম দিকেও সে একটা স্কেচবুক সঙ্গে রাখত।
কিন্তু শেষ বছরটায়, হঠাৎ সেটা লুকিয়ে ফেলে। রাধা কখনো জানতে পারেনি কেন।
শুধু একদিন রাতে, ভুল করে একটা পাতায় চোখ পড়েছিল তার।
একটা মুখ—রণর মতো দেখতে, কিন্তু চোখ দুটো ছিল ফাঁকা, কালো, গহ্বরের মতো। নিচে লেখা ছিল—
“এই আমি নই, কিন্তু এর ভিতরে আমিই বাস করি।”
রাধা সেইদিন শিউরে উঠেছিল। এরপর সেই খাতা আর চোখে পড়েনি।
এখন, এতদিন পর সেই স্কেচবুকই হতে পারে একমাত্র চাবিকাঠি।
রাধা ফিরে যায় পুরনো বাড়িতে। যেটা এখন অনেকটাই ফাঁকা, অন্ধকারে ঢাকা, আর স্মৃতিতে ভরা।
ছোট্ট স্টোররুমটা—রণ যেখানে প্রায়ই নিজের জিনিস লুকিয়ে রাখত—তাকেই খুঁজতে শুরু করে।
ধুলোমাখা একটা ট্রাঙ্ক, সাদা কাপড়ে মোড়া বইপত্র, পুরনো কাগজপত্রের স্তূপ।
তার নিচে একটা চামড়ার বাঁধাই খাতা—বহুদিন স্পর্শহীন, কিন্তু রাধা স্পর্শ করতেই যেন একটা শ্বাস-শ্বাস শব্দ ওঠে ভিতর থেকে।
সে খাতা খুলে দেখে, প্রথম পাতায় লেখা—
“স্কেচেস অফ দ্য শ্যাডো”
তার নিচে ছোট করে সই—রণ।
প্রথম ক’টা পাতায় সাধারণ ডুডল, মুখের স্কেচ, কিছু চোখের ছবি।
কিন্তু পাতায় পাতায় যেতে যেতে আঁচ করে—এই খাতা আসলে এক মানসিক পতনের নথি।
রণ কীভাবে নিজেকে হারিয়ে ফেলছিল ধীরে ধীরে, তা ছবি হয়ে ফুটে উঠছে।
একটা পাতায়—একটা লোক, যার মুখ নেই, শুধু মুখের জায়গায় ঘুরছে একটা গোল আয়না।
তাল পাতার মতো একটা আঁকা—যার নিচে লেখা,
“সে আমার মুখ পরে, আমার স্বপ্ন খায়, আর একদিন আমার জায়গা নেবে।”
রাধার বুক ধড়ফড় করে।
পরের পাতায় খণ্ড খণ্ড সংলাপ—রণ নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছে।
— “তুই কে?”
— “তুই নিজেই।”
— “তুই আমাকে বদলে দিচ্ছিস।”
— “আমি শুধু তোকে আসল করছি।”
হঠাৎ এক পাতায় আঁকা একটা দরজা।
দরজার ওপরে অদ্ভুত এক চিহ্ন—যেটা রাধা আগেও দেখেছে। জানলার কাচে রণ যে চিহ্ন এঁকেছিল—বৃত্তের মাঝে বিন্দু।
কিন্তু এবার সেই বিন্দুর আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লাল রঙের দাগ।
এ যেন রক্ত।
পাতার নিচে একটা লাইন—
“যেদিন সে দরজা খুলবে, সেদিন আমি আর আমি থাকব না। থাকব সে।”
রাধা বই বন্ধ করতে গিয়েও পারে না।
আরও কয়েকটা পাতা উলটে দেখে—রণ নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে কীভাবে লিখেছিল এক জায়গায়—
“আমি যখন তোকে ছেড়ে চলে যাই, তখন সত্যিই চলে যাইনি।
আমার ছায়াটা থেকে গেছিল।
সে তোর চারপাশ ঘুরত, তোর স্বপ্নে ঢুকত, তোর নিঃশ্বাসে লুকিয়ে থাকত।
তুই বুঝতিস না, সে তোকে ভালোবাসে না, সে তোকে অধিকার করতে চায়।”
রাধা থমকে যায়।
এর মানে, এতদিন ছায়া-রণ তাকে শুধু অনুসরণ করেনি…
সে তাকে গ্রাস করতে চেয়েছিল।
তার প্রেমকে, তার স্মৃতিকে, তার মনকে নিজের মতো করে রঙ দিতে চেয়েছিল।
ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ পেছনের জানালায় একটা শব্দ—ঠক ঠক ঠক।
সে ঘুরে দেখে—কেউ নেই।
কিন্তু স্কেচবুকের পাতা আবার নিজের থেকে উলটে যায়।
একটা অদ্ভুত স্কেচে থামে পৃষ্ঠা—ছবি এক মেয়ের, তার পেছনে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি রাধা।
ছায়া-রণ তার কানে কিছু বলছে, আর নিচে লেখা—
“তোর ভিতর দিয়ে আমি জন্ম নেব।”
রাধা ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়।
সে বুঝতে পারে—এই স্কেচবুক শুধু রণর মানসিক বিপর্যয়ের দলিল নয়, এটা একটা দরজা, যার ভেতর দিয়ে ছায়া আজও বেঁচে আছে।
তবে কি রণ তাকে বাঁচাতে নিজের ছায়াকে এই খাতার পাতায় আটকে ফেলেছিল?
রাধা জানে না। কিন্তু সে এবার সিদ্ধান্ত নেয়—যদি সত্যিই খাতার ভেতর ছায়া বাস করে, তাহলে এইখানেই তার শেষও হবে।
সে খাতাটাকে বন্ধ করে, জড়ায়ে বেঁধে, একটা লোহার বাক্সে ঢুকিয়ে নেয়।
তারপর সে চলে যায় নদীর ধারে—সেই পুরোনো ঘাটে, যেখানে একসময় তারা দু’জনে বসত।
সন্ধ্যা নামছে।
রাধা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে জলে খাতা নামিয়ে দিয়ে।
তার মনে শুধু একটা প্রশ্ন—
“সে কি সত্যিই চলে যাবে?”
ঠিক তখন হালকা হাওয়া বয়ে যায়।
দূরে একটা পেঁচা ডাকে।
আর রাধা দেখতে পায়—নদীর উপর কিছুটা কুয়াশার মধ্যে এক ছায়া মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সে হাসে।
আর বলে—“আমি তো কেবল শুরু করলাম।”
পেছনের দরজা
রাধা ভেবেছিল, স্কেচবুকটা নদীতে ডুবিয়ে দিলে সব শেষ হয়ে যাবে।
কিন্তু ছায়ারা কি এত সহজে বিদায় নেয়?
সেদিন রাতেই সে অনুভব করল—বাড়িতে কিছু বদলে গেছে।
জিনিসপত্র ঠিক জায়গায় নেই। রান্নাঘরের লাইট জ্বলে উঠছে নিজের মতো। আয়নায় তার প্রতিবিম্ব একটু দেরিতে নড়ে।
তবে সবচেয়ে ভয়ংকর—পেছনের দরজাটা, যা অনেক বছর ধরে বন্ধ ছিল, হঠাৎ খুলে গেছে।
কেউ যেন ভিতর থেকে বেরিয়ে এসেছে।
অথচ ওই দরজার চাবি তো ছিল রাধার কাছে, আর তালা তো মরেই গিয়েছিল!
রাধা জানে—এবার লড়াই ঘরের ভিতরে।
সেই রাতে রাধা স্বপ্ন দেখে।
সে আবার ফিরে গেছে সেই পুরনো কলেজ ক্যাম্পাসে।
গাছেদের ছায়া, ক্যান্টিনের ধোঁয়া, সেমিনার রুমের আলোছায়া সবকিছুই নিখুঁত।
কিন্তু চারপাশে কোনও মানুষ নেই।
সব খালি।
শুধু একটি কক্ষের দরজা খোলা। ভিতরে ঢুকতেই সে দেখে—একটা প্রজেক্টর চলছে। স্ক্রিনে চলছে তাদের পুরনো ভিডিও—সে আর রণ হাসছে, কথা বলছে, ঠাট্টা করছে।
রাধা পেছন ঘোরে।
সেখানে বসে রণ।
অথচ তার চোখ দুটো এখনো সেই ফাঁকা গহ্বর।
সে বলে,
“তুই তোর গল্প ভুলে গেছিস রাধা। আমি মনে করিয়ে দিতে এসেছি।”
রাধা চিৎকার করে উঠে বসে।
ভোর রাত।
পেছনের দরজা আবার শব্দ করছে।
টুপটাপ টুপটাপ।
জল পড়ার মতো শব্দ।
সে এগিয়ে যায়—ভয়ে নয়, কৌতূহলে।
দরজার গায়ে আঙুল চালিয়ে যায় ধীরে ধীরে।
হঠাৎ তার হাতের নিচে কিছু লেখা অনুভব করে—খোদাই করা যেন।
দরজার গায়ে আঁকা চিহ্নটা সেই একই—বৃত্তের মাঝে বিন্দু।
আর নিচে খুব ছোট করে লেখা—
“তুই আমায় ডাকলি, আমি এলাম।”
রাধা এবার বুঝতে পারে—এই ‘পেছনের দরজা’ শুধু বাড়ির কাঠের দরজা নয়।
এটা একটা সীমানা—তার স্মৃতি আর বাস্তবের মাঝখানে।
এই দরজা এত বছর ধরে বন্ধ ছিল বলে সে স্বাভাবিক ছিল।
আর এখন?
এই দরজা একবার খুললে, শুধু ছায়া নয়—তার নিজের ভিতরকার ভয়, না-বলা দুঃখ, রণর না বলা সত্য—সব বেরিয়ে আসবে।
সে বাড়ির পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে থাকে।
রণর মৃত্যুর সময়কার কাগজ, মনোরোগ বিশেষজ্ঞের রিপোর্ট, একরকম স্কেচ যেগুলো খাতার বাইরেও ছিল।
একটি রিপোর্টে সে দেখতে পায় এক লাইন—
“প্রকৃত ‘ডিলিউশন অব ডুপ্লিকেশন’—রোগী নিজেকে ও ছায়াকে আলাদা ব্যক্তি বলে চিহ্নিত করত। ছায়াটি প্রাথমিকভাবে মনের ভিতরে, পরে তার চোখে বাস্তব প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।”
রাধা ভাবে—রণ কি সত্যিই মানসিক রোগে ভুগছিল?
নাকি—এটা ছিল অন্য কিছু?
কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা, যা একটা দুর্বল মানসিক অবস্থাকে ব্যবহার করে রণকে গ্রাস করেছিল?
ঠিক সেই সময় সে খুঁজে পায় একটি খাম—রণর হাতে লেখা।
খামের উপর লেখা—
“এটা তুই যদি কখনও দেখিস, জানবি আমি ফিরে আসব।”
রাধার গা শিউরে ওঠে।
খাম খুলে দেখে একটিই কাগজ।
রণ লিখেছিল—
“ছায়ারা কখনো মরে না।
তারা শিকড় গাড়ে স্মৃতিতে, দুঃখে, চাওয়া-পাওয়ার অসমাপ্ত তালিকায়।
তুই যদি আমার ছায়াকে বন্ধ করতে চাস, তাহলে তোর নিজের ছায়াকেও চিনতে শিখ।”
আর নিচে আরও একটা লাইন—
“পেছনের দরজাটা কিন্তু তোর ভিতরেই আছে, রাধা। প্রশ্ন শুধু—তুই কী খুলতে রাজি?”
রাধা এবার বুঝে গেছে—এই লড়াই একা তার আর রণর নয়।
এই ‘ছায়া’ আসলে একপ্রকার সত্তা, যা মানুষের মানসিক ভাঙনের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ে।
প্রেম, ক্ষত, অপরাধবোধ—এসবই তার শক্তির উৎস।
রণর ভিতরে ঢুকেছিল সেই ছায়া, রাধার মধ্যেও এখন সে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর এই পেছনের দরজা—তাকে খুলতেই হবে।
তবে নিজেকে হারিয়ে নয়—নিজেকে ফিরে পেতে।
রাধা চোখ বন্ধ করে। মনস্থির করে এক গভীর ধ্যানের মতো অনুভবে ডুবে যায়।
সে মনে মনে বলে—
“আয়, আমি তোকে দেখি। এবার শেষ করি।”
এক ঝটকায় সে আবার সেই ঘরে—যেখানে রণর প্রতিচ্ছবি তার দিকে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু এবার রাধা ভীত নয়।
সে বলে—
“তুই তোর নাম বল। তুই রণ না, তুই কে?”
ছায়া কাঁপে।
সে জবাব দেয় না।
শুধু ফিসফিস করে—
“আমি তোকে চেয়েছিলাম, রাধা।
তুই আমায় কখনো চাইলি না।”
রাধা এগিয়ে গিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে—
“তুই চাওয়া না, তুই ভয়।
তুই আমার, রণর, আমাদের ভাঙনের চিহ্ন।
আমি তোকে আর ভয় পাই না।”
ছায়া ধীরে ধীরে ফেটে যায়, গলতে থাকে কুয়াশার মতো।
পেছনের দরজা বন্ধ হয়—একটা ধুপধাপে।
রাধা জেগে ওঠে।
সে জানে না, ওই মুহূর্তে সে ঘুমাচ্ছিল, ধ্যান করছিল, না সত্যিই ছায়ার মুখোমুখি হয়েছিল।
কিন্তু এক জিনিস নিশ্চিত—
পেছনের দরজাটা এখন আবার বন্ধ।
আর এবার চাবি শুধুই রাধার হাতে।
ভাঙা আয়নার ভিতর
রাধার হাত ধীরে ধীরে ছুঁয়ে গেল ভাঙা আয়নার নিচের এক কোণ।
শিশিরের মতো ঠাণ্ডা স্পর্শ তার ত্বকের ওপর ছড়িয়ে গেল। আয়না ভাঙা হলেও একটা কাঁটা ছুঁয়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি ছিল।
অন্য কোনো আয়না যেমন প্রতিবিম্ব দেয়, এই ভাঙা আয়নার প্রতিটা টুকরো যেন ভেঙে যাওয়া স্মৃতির ছোট্ট অংশ।
সে চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস নিলো। ভেতর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ডাক দিল, সে জানে এই আয়নার ভেতরেই লুকিয়ে আছে তার এবং রণর পুরো সত্যি।
একটা ভাঙা আয়নায় তার প্রতিচ্ছবির ছয়টা অংশ মিশে আছে — তার নিজের, রণর, এবং অজানা কোনো ছায়ার।
কেউ যখন জানালার বাইরে থেকে ডাকে, তখন সে আভাস পায়, এই আয়নার ভেতরে তার সঙ্গে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে — কেউ যা সে আগে কখনো দেখেনি।
সে আয়নার সামনে থেকে পিছিয়ে আসে, আর স্মৃতির বৃত্ত শুরু হয়।
বছর আগেকার সেই দিনের কথা, যখন রণ প্রথম বলেছিল, “আমি হয়তো কখনো ফিরে আসব না, কিন্তু আমার একটা অংশ সবসময় থাকবে তোমার কাছে।”
সে সময় রাধা বুঝতে পারেনি, সেই কথার অর্থ কতটা গভীর।
কিন্তু আজ সে জানে — রণর ছায়া, সে রণ নয়, বরং তার মুছে যাওয়া নিজস্ব আত্মার অন্ধকার অংশ।
রাধার কানে বাজতে থাকে ছায়ার ফিসফিসানো—
“আমি তোমার ভেতর বাস করি। আমি তোমাকে ভাঙতে চাই না, আমি তোমার অংশ হতে চাই।”
সে এবার বুঝতে পারে, এই ভাঙা আয়নার মত তার সম্পর্কও ভাঙা, ফাটল ধরেছে, এবং শুধুমাত্র পুরো হয়ে উঠলেই তারা এক হতে পারবে।
রাধা সিদ্ধান্ত নেয় নিজের ভেতরকার ভাঙা অংশগুলোকে মেলাতে হবে।
সে চায় ছায়াকে ভয় না পেয়ে, তাকে নিজের একটা অংশ হিসেবেই গ্রহণ করতে।
আয়নার সামনে থেকে উঠে সে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
বাইরে রাতের কুয়াশায় রোদ বাষ্প মিশে গেছে।
তার হৃদয়েও কুয়াশার ভেতর সূর্যের প্রথম কিরণ ঢুকেছে।
ভাঙা আয়নার ভেতর থেকে সে আর ভয় পায় না, কারণ সে বুঝেছে—প্রেম শুধু স্মৃতির জাল নয়, এটি তার অস্তিত্বের অংশ।
এবার সে নিজেকে, রণকে, আর ছায়াকে একসঙ্গে আঁকবে নতুন জীবনের ক্যানভাসে।
শেষ চিঠি
রাধার হাতে এক ঝুলন্ত খামের ওজন।
কান্নার মতো ভারী সেই শেষ চিঠিটি সে আজকের দিন পর্যন্ত খুলতে পারেনি।
কেউ না কেউ প্রতিদিন মনে করিয়েছে যে খুলতে হবে, মুখোমুখি হতে হবে সেই কথাগুলোকে, কিন্তু তার ভেতর একটা অদৃশ্য হাত তাকে থামিয়েছে।
“শেষ চিঠি” – এটা রণর লেখা। সে লিখেছিল, যখন সে জানত বাঁচার সময় খুব কম। কিন্তু কী জন্য, কী উদ্দেশ্যে, সে কখনো স্পষ্টভাবে বলতে পারেনি। রাধার জন্য রণর জীবনের সব রহস্য আর অর্ধেক কথা গুলো একে একে ধীরে ধীরে জমে গেছে এই এক চিঠিতে।
আজ, ভাঙা আয়নার আড়ালে দাঁড়িয়ে, রাধা বুঝে নিয়েছে, এই চিঠিই তার একমাত্র পথ। পথে যেতে হবে নিজের ভেতরের অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে।
সে হাতে নিল চিঠিটা। রাত্রির নীরবতা ঘিরে ধরেছে তার চারপাশ।
“প্রিয় রাধা,
যখন তুমি এই চিঠি পড়বে, আমি হয়তো তোমার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছি। কিন্তু আমার আত্মা তোমার কাছে কখনো দূরে ছিল না। তুমি জানো না, কতবার আমি তোমার মুখখানা কল্পনা করেছি, কতবার নিজের গলাকে বলেছি ‘আর একটু ধরো, আর একটু সহ্য করো।’
আমাদের গল্পটা, আমার জীবনের গল্পটা, তোমার চোখে ভেসে ওঠে আমার ভেতরের ছায়ার সঙ্গে লড়াইয়ের ছবি। তুমি যেটা কখনো বুঝতে পারোনি, সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় যুদ্ধ।
তুমি আমার ভালোবাসার দ্যুতি, কিন্তু সেই দ্যুতির সঙ্গে একটি অন্ধকারও ছিল – আমার ভেতরের ছায়া। সেটাই আমাকে ভেঙে দিয়েছিল। সেটাই আমাকে একাকী করে রেখেছিল।
তুমি বলেছিলে, ‘পুরোনো প্রেম ফিরে আসলে, সে আগের মানুষ হয় না।’ আমি সেই কথাটাই এখন বুঝতে পারি।
আমার ছায়াটা হয়তো সেই পুরনো মানুষ ছিল না। আমি আর সে ছিলাম আলাদা কেউ। আমি তোমার কাছে ফিরে আসতে চাইেছিলাম, কিন্তু ছায়াটা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল।
আমার ভেতরের ভয়, অপরাধবোধ, আর আগ্রহের মিশ্রণে ছায়াটা জন্ম নিয়েছিল – যা আমাকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছিল।
আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়েছি, তোমাকে ভয় দেখিয়েছি, কিন্তু কখনো সত্যিকারের আমি ছিলাম না।
আমি আজ তোমাকে বলতে চাই – তুমি আমাকে আর সেই ছায়াটার সঙ্গে মিশিয়ে ভাবো না। আমি তোমার স্মৃতির একটা অংশ, কিন্তু পুরো ছবি নই। তুমি জীবনের সেই নতুন অধ্যায় শুরু করো যেখানে আমি আর নেই।
তুমি তোমার ভেতরের ছায়াকে ভয় পেও না। ছায়া মানে আমাদের জীবন, আমাদের অস্পষ্ট দিক, যা আমরা সবসময়ই লুকাতে চাই।
আমার জন্য কষ্ট পেয়েছো – তোমার কাছে ক্ষমা চাই। কিন্তু নিজেকে ভুলে যেও না। তোমার ভালোবাসা তোমার নিজের জন্যও প্রয়োজন।
শেষে, আমার একটা অনুরোধ আছে –
আমার স্মৃতির সঙ্গে না হারাও, বরং আমার স্মৃতির ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে ভালোবাসো।
যদি কখনো তুমি আবার ছায়ার মুখোমুখি হও, হাল ছাড়িও না। ছায়া মানে ভয় নয়, জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাকে আলিঙ্গন করো, কারণ সে তোমাকে শক্তিশালী করবে।
তোমার জন্য আমার ভালোবাসা চিরন্তন।
রণ।”
চিঠিটি শেষ হলো, কিন্তু রাধার হৃদয়টা যেন খুলে গেল নতুন আলোয়।
সে বুঝতে পারল, রণ না হয় হারিয়ে গেছে, কিন্তু তার ভালোবাসা থেকে গেছে, তার স্মৃতির গভীরে থেকে গেছে।
আর সেই স্মৃতি আর ছায়া ছাড়া কোনো জীবন অসম্পূর্ণ।
রাধা চিঠিটি ধরে ধরে কাঁদল, কিন্তু এবার কাঁদা ছিল মুক্তির।
সে বুঝল, তাকে আর ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে হবে না। তাকে তাকে মেনে নিতে হবে। নিজের জীবনের নতুন সূচনা করতে হবে।
পরদিন সকালে রাধা বুকে ছোট্ট একটি খাতা নিয়ে শহরের পুরানো বাগানে গেল।
সেখানে সে লেখালেখি শুরু করল – নিজের ভেতরের কাহিনী, প্রেম, ভয়, হারানো আর ফিরে পাওয়া গল্পগুলো।
সে জানত, এই লেখাগুলো শুধু তার জন্য নয়। যারা ভাঙা, যারা হারানো, যারা নতুন করে শুরু করতে চায় তাদের জন্য।
রণর স্মৃতির ছায়া থেকে মুক্ত হয়ে, রাধা নিজেই হয়ে উঠল নতুন আলোয়, নতুন আলো।
চিঠির শেষ লাইনগুলো যেন আজকের তার নতুন সংকল্পের সঙ্গী—
“ছায়া মানে ভয় নয়, জীবনের অপরিহার্য অংশ। তাকে আলিঙ্গন করো, কারণ সে তোমাকে শক্তিশালী করবে।”
রণ আর নেই, কিন্তু তার ভালোবাসা থেকে গেছে। আর রাধা এখন প্রস্তুত তার নিজের গল্পের লেখক হতে।
নতুন সকাল
রাধার জীবনে নতুন সকাল এসেছে, তবে সকাল মানেই নতুন গল্প শুরু হওয়ার নিশ্চয়তা নয়। অনেকসময় সকাল আসে নতুন ভয় আর সংশয়ের সঙ্গে। তবে রাধার মধ্যে এক নতুন শক্তি জন্ম নিয়েছে — নিজের ছায়াকে মেনে নেওয়ার, নিজেকে গলার স্বর দিয়ে বলতে শেখার।
বাগানের সেই একাকী বেঞ্চে বসে, রাধা তার নতুন ডায়েরি খুলে লেখার চেষ্টা করছিল। শেষ চিঠি পড়ে তার চোখের সামনে ঝলমল করছে রণের মুখ, কিন্তু এইবার সেই মুখটা ভয় নয়, শান্তি আর ভালোবাসায় ভরা। সে জানত, ছায়ার সঙ্গে আলাপ করার পথ সহজ ছিল না, কিন্তু আর সে লুকিয়ে থাকবে না। সে তার ভয়, তার অপরাধবোধ, তার ক্ষত সব নিয়ে কথা বলবে। কারণ, যাদের সঙ্গে আমরা কথা বলি, তারা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষ হয়।
রাধা লিখতে শুরু করল —
“আজকের এই সকালটা আমার জন্য এক নতুন সূচনা। আজ থেকে আমি আর আমার ছায়াকে আলাদা করে ভাবব না। আমরা একসঙ্গে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকব।”
সেই দুপুরে, সে শহরের পুরনো লাইব্রেরিতে গেল। বইয়ের মলাটে ধুলো জমে থাকা একরাশ গোপন গল্পের ভেতর কিছু অজানা কথা খুঁজতে চাইল। রাধা বুঝতে পারল, তার যাত্রাটা শুধু তার নিজের নয়, অনেকেরই ভেতরে সেই ছায়ার সঙ্গে লড়াই চলছে।
লাইব্রেরির এককোণে, সে পেল এক অজানা খাতা — এক তরুণীর দিনলিপি, যার নাম ছিল প্রিয়া। প্রিয়া তার ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছিল, ঠিক রাধার মতোই। পৃষ্ঠা পৃষ্ঠা পড়তে পড়তে রাধা বুঝল, ছায়ার সঙ্গে লড়াই একটি মানসিক যাত্রা, আর তাকে গ্রহণ করাই মুক্তির পথ।
রাধা নিজেকে স্মরণ করাল—ছায়া মানেই ভয় নয়, বরং জীবনের অর্ধেক সত্য। আমরা যদি ছায়াকে ভয় না পাই, তাহলে তার শক্তি আমাদের ভেঙে দিতে পারে না।
সন্ধ্যায়, বাগানের মৃদু বাতাসে রাধার ফোনে একটা মেসেজ এল।
“তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”
মেসেজ পাঠিয়েছিল অরিজিত — রণর পুরনো বন্ধু, যাকে সে অনেক বছর বাদ দিয়েছিল।
রাধা ভাবল, কেন না অরিজিতের সঙ্গে কথা বলে দেখতে? হয়তো রণর অনেক অজানা দিক এখনও লুকিয়ে আছে। হয়তো অরিজিতের কথা তার জন্য নতুন দরজা খুলবে।
সেই রাতে তারা একটা ছোট ক্যাফেতে দেখা করল। অরিজিত মুখে অজস্র কথা নিয়ে এল — রণর জীবনের গোপন কথা, তার ভেতরের দ্বন্দ্ব, আর কিভাবে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল।
“রণ আমার বন্ধু ছিল, কিন্তু তার ছায়া আমাদের সবার জন্য একটা রহস্য। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলা মানুষের মতোই,” বলল অরিজিত।
“আমরা কেউ তাকে পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।”
রাধা বলল, “আমি তাকে ভালবেসেছি, কিন্তু কখনো বুঝিনি তাকে পুরোপুরি। এখন বুঝতে পারছি, হয়তো সে নিজেও নিজেকে জানত না।”
অরিজিত তখন একটা পুরনো ডায়েরি বের করল, রণর লেখা।
“তুমি পড়বে?”
রাধা চোখে জল নিয়ে ডায়েরিটি নিল।
সেই ডায়েরিতে ছিল রণর অন্তর্মুখী যাত্রার গল্প — প্রেম, ব্যর্থতা, আর নিজের ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ।
প্রতিটি পৃষ্ঠায় সে খুঁজে পেতে থাকল সেই ছায়ার অস্পষ্ট কণা, যা তাকে শেষ পর্যন্ত বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।
রাত্রি গভীর হতে হতে রাধা বুঝল, রণ ছিল শুধুই একজন মানুষ, যার ভেতরে ভয়ের ছায়া এতটাই বড় ছিল যে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু সেই মানবিক দুর্বলতাই তাকে এত শক্তিশালী ও অনন্য করে তোলে।
অরিজিত বিদায় নিল যখন, রাধা বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল রাতের নিস্তব্ধতায়। তার হৃদয়ে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। সে জানত, রণ তার অতীত, কিন্তু সে তার ভবিষ্যৎ নিজের হাতে নিয়েছে।
পরদিন সকালে, রাধা বাগানে ফিরে এল। সেদিনের সূর্যটা ছিল আরও উজ্জ্বল, আর পাখির গান যেন তার নতুন জীবনের সুর। সে ডায়েরিটি খুলে নতুন পাতা খুলল, নিজের গল্প লেখা শুরু করল।
“এই গল্প শুধু আমার নয়,” সে ভাবল, “এই গল্প হলো সব ছায়াকে আলিঙ্গন করার, সব ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার, আর নতুন করে বাঁচার।”
রাধার জীবনে নতুন সকাল শুরু হলো, যেখানে সে আর ভয়ের ছায়ায় আটকে থাকবে না। বরং সে তার ভেতরের সব দুঃখ, ভালোবাসা, আর স্মৃতি নিয়ে এগিয়ে যাবে।
সে জানত, নতুন এই যাত্রায় অনেক ওঠাপড়া থাকবে, কিন্তু এবার সে প্রস্তুত। কারণ সে শিখেছে—ছায়া থাকা মানেই আমরা জীবিত।
মুক্তির ছায়া
রাধার হৃদয়ে আজ অদ্ভুত একটা শূন্যতা আর zugleich এক গভীর শান্তির সংমিশ্রণ ছিল।
বহু রাত জেগে সে চিন্তা করেছিল, ভাঙা স্মৃতিগুলো কি কখনো আবার গড়তে পারবে? রণ যে এখন আর আগের রণ নয়, তা সে বোঝে, কিন্তু ভালোবাসার বাকি কিস্মতটা কী হবে?
তার হাত এখন আর ভয় পেত না ভাঙা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। সে জানত, ভাঙা আয়নাও তার মতো—পুরোনো ছিল, কেঁদেছিল, ফাটল ধরে, কিন্তু আবার নতুন করে জোড়া লাগানো যেতে পারে। নতুন করে দেখা যায় জীবন।
সকালে বাগানে বসে রাধা নিজের ডায়েরির পাতাগুলো খুলে দেখছিল। তার লেখা লাইনগুলো যেন আজকের নিজস্ব আত্মার কথা বলছে—ছায়ার ভয়কে কাটিয়ে উঠে জীবনের আলোয় নতুন করে জন্ম নেওয়ার গল্প।
“প্রেম কখনো পুরোপুরি ফিরে আসে না,” সে লিখল, “তবে প্রেমের ছায়া সবসময় থেকে যায়। আর সেই ছায়াই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক।”
আলো ধীরে ধীরে গাছে পাতা ওড়ানোর মতো তার চারপাশ ছড়িয়ে পড়ছিল। রাধা গভীর নিশ্বাস নিয়ে ভাবল—এখন আর ছায়া মানে শুধুই ভয় নয়, তা মুক্তির পথও হতে পারে।
তার ফোন বাজল। বার্তায় লেখা ছিল — “আজ সন্ধ্যায় তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
সেই বার্তাটি পাঠিয়েছিল অরিজিত। রাধা ভাবল, “হয়তো আজকের সন্ধ্যায় তার থেকে আমার জীবনের কিছু নতুন অধ্যায় জানবো।”
সন্ধ্যায় তারা দেখা করল শহরের একটা ছোট্ট কফি শপে। অরিজিত তার মুখে অনেক কথার ভার নিয়ে এল — রণর জীবনের আড়াল আর তার শেষ দিনের ঘটনার গোপন কথা।
“রণ যে শুধু একজন প্রেমিক ছিল না, সে একজন যোদ্ধাও ছিল,” বলল অরিজিত।
“তার ভেতরের ছায়া তাকে চেপে ধরেছিল, কিন্তু সে লড়াই দিয়েছিল জীবনের জন্য।”
অরিজিতের কথায় রাধার চোখে জল জমল। সে বুঝল, যে যোদ্ধা রণ ছিল, তার যুদ্ধ আজও শেষ হয়নি। তার জীবন ছিল যন্ত্রণা আর ভালোবাসার মিলনস্থল।
তখন অরিজিত বের করল একটি পুরনো নোটবুক—রণর শেষ লেখা।
“এটা হয়তো তোমার জন্য,” বলল সে।
রাধা কাঁপতে থাকা হাতে নোটবুকটা নিল। প্রথম পৃষ্ঠায় ছিল রণর নিজের হাতের লেখা—‘মুক্তির ছায়া’।
পড়তে পড়তে রাধা বুঝল, রণর লেখাগুলো তার অন্তরের কথা বলছে। সে লিখেছে—
“ছায়া থেকে মুক্তি মানে সে ছায়ার সঙ্গে মিশে যাওয়া নয়, বরং তাকে বোঝা, তাকে আলিঙ্গন করা এবং তার থেকে শক্তি নেওয়া।
আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে আছে সেই ছায়া—যে ছায়া আমাদের শক্তি আর দুর্বলতার সমন্বয়। যদি আমরা তাকে ভয় না করি, সে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে পারে।”
রণর লেখা ছিল তার আত্মার আরেকটি দিক, যা রাধা আগে কখনো দেখেনি—একটি আত্মা যিনি নিজের ভেতরের অন্ধকারকে গ্রহণ করেছেন, আর সেই থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
রাধা তখন বুঝতে পারল, মুক্তি মানে নিজেকে পুরোপুরি গ্রহণ করা। ভালোবাসা মানে শুধু কাউকে পাওয়া নয়, নিজের ভেতরের ছায়াকে আলিঙ্গন করা।
সে নির্দিষ্ট করল আজ থেকে নিজের জীবনের গল্প লেখবে, যা শুধুই ভালোবাসার নয়, বরং মানুষের আত্মার জটিলতাকে তুলে ধরবে।
তাদের আলাপের শেষে অরিজিত বলল—
“রণর মতো মানুষরা হয়তো আমাদের কাছ থেকে চলে যায়, কিন্তু তাদের গল্প, তাদের ছায়া থেকে আমরা শিখতে পারি। তুমি সেই গল্পের অংশ হয়ে গেছো।”
রাধা কাঁদল, কিন্তু এই কাঁদাটা ছিল মুক্তির। সে জানত, তার জন্য নতুন জীবন শুরু হয়েছে।
পরের দিন সকালে রাধা বাগানের বেঞ্চে বসে আবার নতুন লেখা শুরু করল।
তার লেখাগুলো ছিল শুধু নিজেকে নয়, যারা হারিয়েছেন, যারা ভয় পেয়ে আছেন তাদের জন্য।
তার শব্দগুলো এখন শক্তিশালী ছিল—যে শক্তি আসে নিজের ছায়াকে গ্রহণ করার থেকে।
সে জানত, জীবন কখনো সোজা পথ নয়।
তার পথে থাকবে ওঠা-পড়া, থাকবে অন্ধকার, থাকবে নতুন সকাল। কিন্তু সে আর একা নয়।
রণ না থাকলেও তার ভালোবাসা থেকে গেছে। তার ছায়া রাধাকে শক্তি দিয়েছে। আর সেই শক্তি দিয়ে সে নিজের জীবন নতুন করে গড়বে।
শেষ কথাগুলো সে নিজের ডায়েরিতে লিখল—
“মুক্তি মানে ভয়কে জয় করা নয়, বরং ভয়কে নিজের অংশ করা। ছায়া আমাদের জীবন, আর জীবন মানে ছায়ার আলিঙ্গন।”
রাধা জানত, এই কথাগুলো শুধু তার জন্য নয়, বরং পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষের জন্য, যাদের ভেতর লুকিয়ে আছে প্রেম আর ছায়া।
রাত্রি নামল, বাগানের গাছগুলো নীরব।
রাধা তার ডায়েরি বন্ধ করে মাথা তুলে দেখল আকাশের তারা জ্বলজ্বল করছে। তার মনে হল, এই তারা যেন রণর ভালোবাসার নতুন আলোকবর্তিকা।
সে জানল, প্রেম ফিরে আসতে পারে, তবে তা আর আগের মতো হয় না। প্রেম হয় নতুন আকারে, নতুন শক্তিতে।
রাধা এখন প্রস্তুত ছিল সেই প্রেমকে আলিঙ্গন করার জন্য—একটি মুক্তির ছায়া হিসেবে।