Bangla - প্রেমের গল্প

চুপচাপ তোমার শহর

Spread the love

অনন্যা চক্রবর্তী


পর্ব ১ : স্টেশন নম্বর সাত

শীতের বিকেল নামছিল একরকম ধীর অনুতাপে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের চতুর্থ প্ল্যাটফর্মটা অকারণে নির্জন হয়ে উঠেছিল — যেন এই শহর, এই ট্র্যাক, এই হুইসেল, এই কুয়াশার ভেতর লুকিয়ে রাখা হয়েছে কারও একান্ত চিঠির মতো কিছু, যা কেউ পড়ে না, তবুও লিখে যায়। ঈশিতা প্রথম দিন এই স্টেশনের এক কোণে দাঁড়িয়ে ভাবেনি, সে কবে নিজে এই শহরের নির্জনতায় মিশে যাবে। তার বুকে তখনও কলকাতার জ্যাম ছিল, ট্রামলাইনের শব্দ ছিল, আর ছিল ব্যস্ততা — যা ভেতরে ভেতরে তাকে ফাঁপা করে তুলছিল।

দার্জিলিং কলেজ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন একমাস হলো। কোয়ার্টারে বই খুলে বসতে গিয়ে যেসব শব্দ মাথায় আসে — তারা কেউই এখন আর কবিতায় জুড়ে বসে না। শিলিগুড়ি তার কাছে ছিল না-পুরনো না-নতুন শহর, ঠিক মাঝামাঝি জায়গা। আর এই ‘মাঝখানে’ থাকা অবস্থানটাই ঈশিতার চিরকালীন দুর্বলতা। কিছুই তার চূড়ান্ত হয়ে ওঠে না। ভালোবাসাও না। সিদ্ধান্তও না। এমনকি চা খাওয়ার সময় চামচে চিনি গুলে ফেলা নিয়েও দ্বিধা।

স্টেশনের কাছাকাছি একটা বইয়ের দোকান আছে — “স্টেশন বুক কর্নার”। দোকান নয়, দোকানপাটের চেয়ে বেশি কিছু। পুরনো বই, অসমাপ্ত ডায়েরি, বিদেশি পত্রিকা, আর এক কোণে বসে থাকা ধোঁয়া-তোলা উনুনের পাশে মাঝেমাঝে যে কাঁচা গলায় রবীন্দ্রসংগীত বাজে, তার মধ্যে একটা ক্লান্ত প্রেম লুকিয়ে আছে। সেদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ করেই দেখা হয় রুদ্রপ্রতাপের সঙ্গে — প্রথম দেখা।

সে ট্রেন ছাড়ার সময় ভুল বার্তা গিয়েছিল কন্ট্রোল রুমে। ঈশিতা অপেক্ষা করছিল। সে বই কিনছিল। তখনই রুদ্র এসে দোকানের মালিককে কিছু বলে যায়। কণ্ঠটা গম্ভীর, কিন্তু গলা নীচু। ঈশিতা প্রথমে শুধু গলার শব্দ শুনেছিল। চোখে তখন ‘ইভলিন ওয়’য়ের গল্প’, কিন্তু কানে ঢুকছিল একজনের নীরব অথচ নিশ্চিত স্বরের ধ্বনি। সেদিন সে তার নাম জানেনি।

দোকানদার হেসে বলেছিল, “ওটা রুদ্রদা, রেলওয়েতে কাজ করেন। কবিতা লেখেন একসময়, এখন লেখেন না।”
ঈশিতা অবাক হয়েছিল — কেউ কি সত্যিই কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে পারে?
“কেন লেখেন না?”
“কে জানে… হয়তো সব কবিতাই কারও জন্য হয়।”

তখনই প্রথম মনে হয়েছিল — এই শহরে আরও কেউ আছে, যে হারিয়েছে; আর যার হারানোর শব্দ একা শুধু হুইসেলের মাঝে ফেলে গেছে।

তারপর একদিন হঠাৎ চিঠি।
স্টেশন বুক কর্নারের পাশেই একটি পুরনো পোস্টবক্স — নাম নেই, কেবল নাম্বার: ৭। দোকানদার বলল, “রুদ্রদা মাঝে মাঝে ওইখানে চিঠি রেখে যায়।”
কৌতূহল হয়েছিল। সে একদিন সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করে — সত্যিই একটি চিঠি আছে, খামে লেখা: “যে কেউ পড়তে চায়, তার জন্য”।

ঈশিতা চিঠি খুলে পড়ে। ভিতরে ছিল একটি অসমাপ্ত কবিতা —
“যে শহরে ট্রেন চলে যায় ঠিক সময়মতো
সেই শহরে ভালোবাসা এসে দাঁড়ায় কুয়াশার ভেতরে।
তুমি যদি চুপ করে থেকো, শহর বুঝে নেয় —
তোমার মনের ট্রেন কখনই প্ল্যাটফর্মে থামে না।”

সে চমকে যায়। কে এই মানুষ? এমন লিখতে জানে, তবু লেখে না? চিঠি আবার খামে রেখে দেয় — ঠিক যেমন ছিল। কিন্তু মন থেকে রেখে আসতে পারে না।
সেই রাতেই, সে লেখে নিজের প্রথম চিঠি —
“আপনার কবিতা পড়ে মনে হলো কেউ যেন স্টেশনেই রয়ে গেল। আমি যদি সেই যাত্রী হই, যার গন্তব্য নেই — তাহলে চিঠি লিখতে পারি?”
সে রাখে সেই পোস্টবক্সে। নাম লেখে না। শুধু লেখে — “একজন ট্রেনভ্রমণকারী”।

চিঠি চালাচালি শুরু হয়। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায়। প্রতি চিঠি অচেনা অথচ অদ্ভুতভাবে কাছের মানুষের মতো স্পর্শ করে। তারা কেউই নিজের পরিচয় প্রকাশ করে না। দু’জনই জানে — একে অপরকে হয়তো কোথাও দেখে ফেলেছে, তবু চেনে না। বা চিনে নিয়েও কিছু বলেনি।

ঈশিতা এখন নিয়মিত সেই পোস্টবক্সে চিঠি রেখে আসে। স্টেশন হয়ে উঠেছে তার চুপচাপ ভালোবাসার শহর। রুদ্র যে তা জানে — কে বলবে? কিন্তু তার চিঠিগুলোয় থাকে — চায়ের স্বাদ, বইয়ের পাতার গন্ধ, আর একাকীত্বের কবিতাময় শব্দ।

তবে এই শহর শুধু প্রেম জমিয়ে রাখে না। মাঝে মাঝে দূর থেকে রেল ইঞ্জিনের বাঁশি কেমন ফাঁকা করে দেয় মন। সেই ফাঁকা জায়গায় ঈশিতা অনুভব করে — তার অতীত, তার ভাঙাগুলো যেন এখানেই লুকিয়ে থাকে। প্রেম নয়, অপ্রেমের মধ্য দিয়েই সে আরেকবার ভালোবাসা শিখছে।

শেষ দৃশ্য — সেই রাতে স্টেশনে হঠাৎ বৃষ্টি নামে।
ঈশিতা ছাতা ছাড়াই দাঁড়িয়ে, হাতে তার লেখা চিঠি। পোস্টবক্সের মুখটা জ্যাম হয়ে গেছে। ভিতরে জল জমেছে।
রুদ্র আসে হঠাৎ। সাদা রেইনকোট, মাথায় টুপি। সে কিছু না বলে এগিয়ে এসে খামের মুখ বন্ধ করে দেয়। তারপর খামে পলিথিন জড়িয়ে পোস্টবক্সে ঢুকিয়ে দেয়।
ঈশিতা তখনও চুপ।

রুদ্র কেবল একবার চোখ তুলে বলে, “ভিজে গেলে লেখা পড়া যায় না। তুমি কী লিখেছিলে, জানতে ইচ্ছে করে।”
ঈশিতা অবাক হয়ে যায় — সে জানে?
রুদ্র হেসে বলে, “তুমি ঠিক সেই মেয়ে, যে প্রতিবার চিঠি শেষ করো এই লাইনটায় —
‘যদি কোথাও থেমে যাই, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থেকো।’”

পর্ব ২ : কুয়াশার মাঝে একটি ছায়া

শীতকাল যেন নিউ জলপাইগুড়িতে একটু বেশিই দীর্ঘ হয়। ভোর ছ’টায় যখন স্টেশন চত্বর ধোঁয়া আর কুয়াশায় মিশে যায়, তখন মনে হয় শহরটা ঘুমের মধ্যেও কিছু একটা খুঁজছে। ঈশিতা প্রতিদিন সকালবেলা চা খেতে বের হন না, কিন্তু সেদিন বেরোলেন। একটা অস্থিরতা তাকে ঠেলে নিয়ে গেল রেললাইনের দিকে — যেন কারও অপেক্ষায় আছে স্টেশনটা, আর ঈশিতা বুঝতে পারছে না, সেটা তার না রুদ্রর।

তার হাতে ছিল আগের রাতের সেই চিঠির উত্তর। লিখেছিলেন –
“আমি থেমে যেতে চাই না। তবু আপনি যদি একদিন খুঁজে পান এই শহরের ভেতরে আমার ছায়াকে — তাকিয়ে দেখবেন, সে আপনার অপেক্ষায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।”
চিঠির খামে নাম লেখেননি, শুধু লিখেছেন — “এখনও ছায়া হয়ে থাকা এক মেয়ে”।

স্টেশনে পৌঁছে বুঝলেন, আজ শুক্রবার নয়। পোস্টবক্স ফাঁকা থাকবে। তবু তিনি চিঠিটা রেখে এলেন, কুয়াশার ভিতর সেই লাল রঙের পুরনো বক্সটার সামনে দাঁড়িয়ে যেন সময়টাকে একটু ছুঁয়ে দিলেন। কেউ দেখছিল কি?

হ্যাঁ, দেখছিল।
স্টেশনের ইলেকট্রিক রুমের ছাদে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল। হাতে কফির কাপ, চোখে বিস্ময় নয়, বরং অভ্যস্ত ভালোবাসার নীরবতা।
সে জানে, ঈশিতা কে। তার সব চিঠির ভাঁজে যে অদ্ভুত গন্ধ থাকে — পুরনো কাগজ, শরতের দুপুর আর মুছে-ফেলা কান্নার।
সে জানে, এই মেয়েটা কেবল কবিতা লেখে না, কবিতা হয়ে বাঁচে। তবু মুখোমুখি হয় না।
রুদ্র চায় না এই নৈঃশব্দ্য ভেঙে যাক। কারণ অনেক সময় শব্দ বেশি হলে অনুভূতি কমে যায়।

সেদিন রাতে ঈশিতা প্রথমবারের মতো স্বপ্ন দেখেন — নিজেকে একটি ট্রেনের কামরায় বসে থাকতে। বাইরে কুয়াশা। ভিতরে আলো-আঁধারি। হঠাৎ সেই কামরায় কেউ উঠে আসে। মুখ দেখা যায় না, কেবল কণ্ঠস্বর — “এই কামরা কোথাও থামে না, যাত্রী শুধু অপেক্ষা করে নামে, কখনওই পৌঁছায় না।”

ঘুম ভেঙে যায় তার। পাশের টেবিলে সেই চিঠি।
রুদ্রর লেখা –
“তুমি কি কখনও এমন কাউকে দেখেছ, যে তোমার ভালোবাসার ভাষা বোঝে অথচ মুখে স্বীকার করে না? আমি সেই শহরের মানুষ — যেখানে সব চিঠি লেখা হয়, কিন্তু কেউ পোস্ট করে না।”
চিঠির শেষে নেই কোনও নাম, নেই কোনও তারিখ। কেবল একটা ছোট লাইন:
“স্টেশনের ছায়া হয়ে থাকো। আমি যদি আলোর দিক ভুলে যাই, তোমার ছায়া আমায় চিনিয়ে দেবে ঠিকানা।”

ঈশিতা সেদিন সকালেই বুঝে গেলেন — এ প্রেম মুখে বলা হয় না। এ প্রেম লেখার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে না। এটা সেই নীরবতা, যেখানে দুটি মানুষ নিজের না-বলা কথাগুলো দিয়ে একে অপরকে চিনে নেয়।

রবিবারের বেলা। চতুর্থ প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তে একটানা বসে ছিলেন রুদ্র। হাতে নোটবুক। অনেকদিন বাদে আবার লেখা শুরু করেছেন।
তাকে দেখে ঈশিতা এগিয়ে গেলেন না। দূরে দাঁড়িয়ে দেখলেন — কীভাবে কেউ নিঃশব্দে নিজেকে আবার ফিরে পায়।

স্টেশন চত্বরে অল্প বৃষ্টি নামল। বাতাসে একধরনের পচা পাতার গন্ধ।
রুদ্র একবার মাথা তোলে। চোখে পড়ে — দূরে দাঁড়িয়ে আছেন ঈশিতা, ছাতা ছাড়াই।
সে আবার লেখে — এইবার চোখের ভেতর।

কেউ কিছু বলেনি। কিছুই না।
শুধু কুয়াশার ভেতর দিয়ে দুটি ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে একে অপরের দিকে।
যেমন হয় — এক ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর, পরবর্তী ট্রেন আসার আগের সেই নিঃশব্দ ফাঁকে —
ঠিক তেমনভাবেই এগিয়ে আসে দুইটা ভালোবাসা।

পর্ব ৩ : চিঠির ভাঁজে নাম লেখা ছিল না

চিঠির খামে নাম ছিল না, ঠিক যেমন ভালোবাসার ওপর কারও মালিকানা চলে না। ঈশিতা জানেন, রুদ্রপ্রতাপ তাকে চিনে ফেলেছে। যে ভাষায় চিঠি লিখত রুদ্র, তাতে নামের দরকার ছিল না — শব্দেই চিনে নেওয়া যায় মানুষকে, যদি তার যন্ত্রণা প্রকৃত হয়।

সেই রাতের পর থেকে স্টেশন যেন বদলে গেল। তারা আর আগের মতো নির্লিপ্ত নয়, কিন্তু স্পষ্টও না। দুজনেই জানেন, মুখোমুখি হয়ে গেলে সেই ভাঙা স্পর্শ ভেঙে যেতে পারে। কিংবা আরও গভীর হয়ে চুপচাপ বসে যাবে শহরের গায়ে।

সোমবার সকাল। ঈশিতা কলেজে ক্লাস নিচ্ছিলেন। ব্ল্যাকবোর্ডে হেমিংওয়ের উদ্ধৃতি লিখছেন — “The world breaks everyone and afterward many are strong at the broken places.” লিখে থেমে গেলেন। রুদ্রর চিঠির কথাই মনে পড়ে।
তিনি হঠাৎ করে জানেন, তাদের সম্পর্কটা বইয়ের মতো নয়। এটা রেলস্টেশনের দেয়ালে টাঙানো সেই টাইম টেবিল — যা কখনও সময়মতো ঠিক থাকে না, তবু সবাই তাকিয়েই থাকে।

বিকেলে স্টেশন বুক কর্নারের সামনে রুদ্র দাঁড়িয়ে ছিল। খুব সাধারণ, ছেঁড়া সোয়েটার, হাতে পুরনো এক বই — “Jibanananda Samagra”।
ঈশিতা পাশ দিয়ে যেতে যেতে থেমে গেলেন।
কিছু বলেন না।
রুদ্র বইয়ের ভাঁজ খুলে একটি পাতায় কাগজ গুঁজে দেয়। তারপর বইটি ঈশিতার দিকে এগিয়ে দেয়।
“এইটা আপনার জন্য।”
ঈশিতা হাসলেন না। কেবল বইটা নিলেন।

বাড়ি ফিরে বই খুলে সেই পাতায় কাগজ বের করেন। সেটি চিঠি নয় — কবিতা।
“যদি কখনও ফিরে আসো এই শহরে
দেখবে, শহর বদলায়নি, শুধু আমাদের ছায়াগুলো আরেকটু দীর্ঘ হয়েছে।
আমরা যে শহরকে ভালোবেসে ফেলেছি, সে জানে না —
তারই গায়ে লেগে আছে কিছু অসমাপ্ত চোখের জল।”

ঈশিতা জানেন, প্রেম যদি শব্দে নাও ধরা দেয়, অনুভবে ঠিক ঠিক জমে থাকে।
সেই রাতেই তিনি আরেকটি চিঠি লেখেন।
“আমরা যদি কোনওদিন একে অপরকে ভুলে যাই, শহর ভুলবে না। কারণ এই শহরেই তো আমাদের সমস্ত না-বলা কথা জমে আছে। স্টেশন নম্বর সাত এখন শুধু পোস্টবক্স নয়, একটা ভালোবাসার সময়।”
খামের মধ্যে একটি পাতা ভাঁজ করে রেখে দেন। তাতে কিছু লেখা নেই। শুধু প্রথমবারের মতো নিজের নাম লেখেন —
“ঈশিতা”

পরদিন, রুদ্র চিঠি পায়। পেয়ে থেমে যায়। অনেকক্ষণ ধরে খোলা চিঠির খাম দেখে। নামটা দেখে তার ভেতরে কী যেন থেমে যায় —
ঈশিতা।
সে কাঁপা হাতে খামে রাখা সেই সাদা পাতাটা খোলে। কিছু লেখা নেই।
তবু যেন পাতাটাই ছিল চিঠির সবচেয়ে সত্য অংশ।

এটাই কি প্রেম?
যেখানে মানুষ কথা বলে না, লিখেও না, তবু কোনো এক অনুচ্চারে সব বুঝে ফেলে?

স্টেশনের এক কোনায় রুদ্র বসে ছিল, সন্ধে নামে। সে লেখে —
“তুমি চিঠির পাতায় যা লেখো না, আমি তা পড়ে ফেলি।
তুমি নাম লেখার পরে যা চেপে যাও, আমি তার ভেতরে নিজেকে খুঁজে পাই।
তুমি যদি না-লিখেও ভালোবাসো, আমি লিখে ফেলি —
একটা শহর, একটা প্ল্যাটফর্ম, আর সেই মেয়েটা যে চুপ করে ভালোবাসে।”

সে খামে ভরে চিঠিটা রাখে। খামের পেছনে লিখে —
“তুমি যদি আজ না আসো, তবু এই চিঠিটা স্টেশন অপেক্ষা করে রাখবে।”

ঈশিতা আসেন না সেদিন।
স্টেশনের উপর দিয়ে ট্রেন যায়। রাত গভীর হয়। পোস্টবক্সে জমে থাকে চিঠি।
হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়া আসে। খামের মুখ খুলে একটানা উড়ে যায় সেই কবিতা।
রুদ্র ছুটে গিয়ে ধরতে পারেন না।

তবু পরদিন সকালে, ঈশিতা চুপচাপ হেঁটে আসেন। স্টেশন বুক কর্নারে দাঁড়ান।
দোকানদার বলেন —
“রুদ্রদা গতকাল এসেছিলেন। আপনাকে একটা বই দিয়েছেন। নাম ‘Kothao Keu Nei’।”
ঈশিতা বইটা খোলেন না।
হঠাৎ কুয়াশার মধ্যে দেখতে পান, কিছুটা দূরে প্ল্যাটফর্মে বসে আছে রুদ্র। চোখে ক্লান্তি। হাতে খালি কফির কাপ।

তিনি এগিয়ে যান না।

শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন — ঠিক যেমন প্রেম দাঁড়িয়ে থাকে শহরের নির্জন কোণে।
চুপচাপ, অচেনা, তবু পরিচিত।

পর্ব ৪ : ট্রেন কখনও ঠিক সময়ে আসে না

রুদ্রপ্রতাপ সময় মেপে চলে না। সে জানে না কখন ট্রেন ছাড়বে, কিন্তু সে জানে কবে ট্রেন থেমে যাবে, আর কবে একজন যাত্রী সিদ্ধান্ত নেবে — নামবে না।
শহরটার সঙ্গে তার এমনই এক বোঝাপড়া।
শীতের বিকেলে সেই বোঝাপড়াটাই হয়তো তার একমাত্র স্থিরতা।

ঈশিতা কখনও সময় মতো আসেন না স্টেশনে। আবার কখনও ঠিক সেই মুহূর্তে এসে দাঁড়ান, যখন কুয়াশার ভিতর থেকে ভেসে আসে হুইসেলের অস্পষ্ট শব্দ, যাকে অনেকেই ভয় পায় — কিন্তু রুদ্র ভালোবাসে।
ঈশিতা জানেন না কেন। তবে বুঝে গিয়েছেন, এই মানুষটার সময়ের সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক রেললাইনের মতো — চলতেই থাকে, তবু কোথাও গিয়ে থামে না।

সেইদিন স্টেশনটা ছিল আরও নীরব। শীত আর ধোঁয়া একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল, প্ল্যাটফর্ম যেন একটা অস্পষ্ট ছবি।
ঈশিতা এলেন, ধীরে ধীরে। হাতে সেই বই — Kothao Keu Nei।
আজ তিনি জানেন, বইটা দিয়ে রুদ্র তাকে কী বলতে চেয়েছে।
এই ‘কেউ নেই’-এর ভেতরেই তো আছে সেই অসম্পূর্ণ চাহনি, যা ভালোবাসাকে আরো গভীর করে।

সে এগিয়ে এলেন প্ল্যাটফর্মের ধারে। আজ তারা দুজন মুখোমুখি।
প্রথমবার এতটা কাছ থেকে।
কিন্তু তবু কেউ কিছু বলল না।

রুদ্র তাকিয়ে ছিল শুধু ঈশিতার দিকে — তার চোখে, কপালে, ওড়নার আঁচলে যেন কোথাও লেগে আছে পাহাড়ের রোদ, পুরনো ট্রেনের গন্ধ আর সেই চিঠির ছাপ — যেটা লেখা হয়নি কখনও।

ঈশিতা বললেন, “আপনার চিঠিটা বাতাস উড়িয়ে নিয়ে গেছে।”
রুদ্র ধীরে মাথা নেড়ে বলল, “কিছু কিছু চিঠি হারিয়ে যাওয়ার জন্যই লেখা হয়।”
“আর কিছু কিছু চিঠি?”
“তারা ঠিক সময়মতো পৌঁছায় না। যেমন ভালোবাসা।”

সেই সময় ঘোষণার মাইকে ভেসে এল — “Apologies, train number 15959 Kamrup Express is delayed by one hour.”

রুদ্র হাসে। “দেখলেন? ট্রেনও জানে, কেউ কিছু বলবে আজ।”
ঈশিতা একটু থেমে বলে, “কিন্তু আমরা তো এখনো কিছু বলিনি।”
রুদ্র বলে, “তাই তো ট্রেন ছাড়ছে না। সময়ও অপেক্ষা করে, যদি কেউ কিছু না-বলা রাখে।”

তারা পাশাপাশি বসে থাকে। কেউ চুমুক দেয় না চায়ের কাপেও। কথা বলে না, শুধু পাশে থাকার শব্দটাই যেন হালকা গায়ে ছুঁয়ে যায়।

ঈশিতা বললেন, “আপনি যদি আমার শহরে না থাকতেন, আমি কি এইভাবে ভালোবাসতাম?”
রুদ্র বলল, “আমি থাকলেও, আপনি শহরটাকেই ভালোবেসেছেন। আমি তো শুধু তার একটা ছায়া।”
“তবু আমি চিঠিতে শুধু আপনার কথাই লিখি।”
“কারণ ছায়াই সবচেয়ে বেশি নিজের হয়, ঠিক কুয়াশার মতো। দেখা যায় না, তবু চলে না ওকে ছাড়া।”

ট্রেন চলে আসে ধীরে, এক ঘণ্টা দেরিতে।
কিন্তু তারা কেউ ওঠে না।
ঈশিতা বললেন, “এই শহরে আমি আর বেশি দিন থাকব না। বদলি চিঠি এসেছে।”
রুদ্র মাথা নিচু করে বলেন, “আমি জানি।”
“কীভাবে?”
“আপনার চিঠিগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে আরও নীরব হয়ে উঠছিল।”
“তবু আপনি কিছু বলেননি?”
“কারণ, না-বলা থাকলে শহর থেমে থাকে।”

ঈশিতা কিছু বললেন না।
কেবল পাশে রাখা কফির কাপটা হাতে তুলে বললেন —
“এই শহরে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি কাউকে ভালোবেসেছিলে কি? আমি বলব, হ্যাঁ —
কিন্তু সে কখনই সময়মতো আসত না।
আর আমি, সবসময় অপেক্ষা করতাম।”

রুদ্র বললেন না কিছু।
তবে সেই মুহূর্তে তার ভেতরে কোনও ট্রেন থামেনি —
বরং একটা শহর থেমে গিয়েছিল। চুপচাপ, ঠিক প্রেমের মতো।

পর্ব ৫ : প্ল্যাটফর্মে রেখে যাওয়া একটা নাম

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের চতুর্থ প্ল্যাটফর্মে একটা নাম পড়ে ছিল — লেখা ছিল না কোথাও, বলা হয়নি কারও কাছে, কেবল বাতাসে ছড়িয়ে পড়া একরকম নির্দিষ্ট ব্যথার মতো।
ঈশিতা চলে যাবেন ঠিক হয়েছে। কলকাতা ফিরে যাবেন না, বদলি চিঠিতে নাম রয়েছে বর্ধমান কলেজের।
তার শহর, তার ট্রেন, তার চিঠি, তার না-বলা কথাগুলো — সব ফেলে রেখে যাবেন।
রুদ্র জানেন, ঈশিতা বলবেন না আর কিছু। শেষ মুহূর্তেও তিনি শব্দ দিয়ে সম্পর্ক শেষ করতে চান না। কারণ যে প্রেম শব্দ ছাড়াই গড়ে উঠেছে, তাকে শব্দে শেষ করা যায় না।

সেই সকালে ঈশিতা স্টেশনে আসেন, একা। হাতে শেষ চিঠি — খামে কিছু লেখা নেই।
ভিতরে নয় লাইনের একটা কবিতা, আর একদম নিচে লেখা —
“আমি তোমার ছায়া ছিলাম। তুমি তাকিয়ে দেখোনি বলেই সে ছিল এত গাঢ়।”
চিঠির শেষে প্রথমবারের মতো সে লিখলেন —
“ঈশিতা সেন, ১২/১, নতুন ঠিকানা — বর্ধমান”

সে খামটা রেখে আসেন স্টেশনের সেই পুরনো পোস্টবক্সে — নম্বর সাত।

কিন্তু আজ আর বক্সটা ফাঁকা ছিল না।

একটা খাম আগে থেকেই ছিল ভিতরে। ঈশিতা অবাক হয়ে তা তুলে নিলেন।
খামের গায়ে লেখা —
“চলে যাওয়ার আগে যদি একবার থামো, এই চিঠিটা পড়ে যেও। যদি না থামো, আমিই একদিন ঠিক পৌঁছে দেব।”
ভেতরে লেখা —

“ভালোবাসা যদি কখনও সময় পায়, সে ঠিক ফিরে আসে।
তুমি যদি যাও, শহর থেমে থাকবে না, আমি থেমে থাকব।
যেখানে তোমার পা পড়ে না, আমি সেখানে প্রতিদিন ঘুরে বেড়াবো,
তোমার ছায়ার সাথে, যার নাম ঈশিতা নয় —
যার নাম, একদা ছিল আমার।”

পড়তে পড়তে ঈশিতা অনুভব করেন — বুকের এক কোণে জমে থাকা ট্রেনের হুইসেল আজ একটু বেশি কাঁপে।

সে চিঠিটা খামে রেখে ফের ঢুকিয়ে দেন পোস্টবক্সে।
কেন করেন, তিনি নিজেও জানেন না। হয়তো এটাই শেষ চিঠি নয়, বরং একটা অপেক্ষার শুরু।

দুপুরের ট্রেন এসে পড়ে। কামরার জানালা দিয়ে দেখা যায় স্টেশনের চারপাশের ছায়া ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে।
ঈশিতা ট্রেনের জানালার পাশে বসে, বইয়ের ভাঁজে রাখা রুদ্রর কবিতা পড়ে যান।
স্টেশন ছুঁয়ে ট্রেন যখন চলতে শুরু করে, তিনি জানেন — কিছুই ফুরোয়নি।

আর ঠিক তখনই রুদ্র দৌঁড়ে প্ল্যাটফর্মে ওঠে।
তার হাতে একটি বই — Post Office Love Letters, যার ভিতরে রাখা চিঠিতে লেখা —
“তুমি যদি কোনওদিন ফিরো, শহরটাকে চিনে নিও এই নাম দিয়ে —
প্ল্যাটফর্মে রেখে যাওয়া তোমার নাম।”

কিন্তু ট্রেন চলে গেছে।

রুদ্র দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের ভিতরে যেটুকু শহর জমে ছিল, সেটুকু ছড়িয়ে পড়ে রেললাইনে।

পর্ব ৬ : পাঁচ বছর পর, ঠিক একই হুইসেল

শীত তখনও এসে পৌঁছায়নি ঠিকঠাক। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ, নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আবারও সন্ধের আলো মিশে যাচ্ছে রেললাইন পেরোনো হালকা কুয়াশায়। পেছনের দোকানে এখনও কয়লার উনুনে চা ফুটছে, আর দূরে চতুর্থ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি লোকাল ট্রেন — ঠিক যেন পাঁচ বছর আগের সেই সন্ধ্যার মতোই।

রুদ্রপ্রতাপ স্টেশনে কাজ করছে না এখন। চাকরি ছেড়েছেন তিন বছর আগে। আজকাল স্টেশনের বুক কর্নারের পাশে চুপচাপ বসে থাকেন, মাঝে মাঝে বই কিনে ফেলেন, অথবা পুরনো খাতার ভাঁজে কবিতা লেখেন — সেগুলো আর কাউকে পাঠানো হয় না।

তার জীবনটা যেন এখন একটা নিরব ট্রেন — প্ল্যাটফর্ম আছে, ট্র্যাক আছে, ঘোষণা নেই, যাত্রী নেই।

এদিন হঠাৎ বুক কর্নারের মালিক বলে ওঠে —
“রুদ্রদা, চেনা একটা মানুষ স্টেশনে এসেছেন। যেন আপনাকে খুঁজছেন।”

রুদ্র কাগজে চোখ রেখে বলে, “অনেকেই তো আসে। কেমন দেখতে?”

“চোখে কালো চশমা, ধূসর শাল, আর হাতে একটা হলুদ খামের মতো কিছুর ভাঁজ। খুব পরিচিত লাগল, কিন্তু মনে পড়ছে না। নাম বলেননি।”

রুদ্র চুপ করে থাকে। তার বুকের ভেতর দিয়ে যেন একটা পুরনো হুইসেল কেঁপে ওঠে — ঠিক সেই ট্রেনের মতো, যা পাঁচ বছর আগে একটানা চলে গিয়েছিল তার পাশ দিয়ে।

সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। বুকের পকেটে রাখা ছোট্ট নোটবুকের শেষ পাতায় লেখা —
“যদি কোনওদিন ফিরে আসো, আমায় চেনা যাবে না।
কিন্তু আমার নীরবতার গায়ে তখনও থাকবে তোমার নামের ছায়া।”

ঈশিতা ফিরে এসেছেন।

বর্ধমানে কাটানো বছরগুলো তাকে বদলে দিয়েছে — তিনি এখন অধ্যাপক, লেখিকা, মাঝে মাঝে সাহিত্য পত্রিকায় ছাপেন তার “ছায়া স্মৃতি” নামে কলাম। কিন্তু কোথাও যেন পুরনো ঈশিতা রয়ে গিয়েছেন একইরকম। শহর বদলেছে, প্রেম বদলায়নি।

তিনি এসেছেন কোনও প্ল্যান ছাড়াই। রুদ্রকে খুঁজবেন এমনটা ঠিক করেননি। তবু স্টেশনে পা রেখেই বুঝলেন — কিছু কিছু পথ শুধু শরীর দিয়ে মাপা যায় না, তাকে মন দিয়ে চিনতে হয়।

তিনি হাঁটতে থাকেন স্টেশনের ভেতর।
সেই চতুর্থ প্ল্যাটফর্ম।
সেই বুক কর্নার।
আর সেই পুরনো লাল পোস্টবক্স — নম্বর ৭।

আশ্চর্যভাবে পোস্টবক্সটা এখনও আছে।
সে সামনে দাঁড়ান, খুব ধীরে।
হাতের ব্যাগ থেকে একটা খাম বার করেন।
চিঠিতে লেখা নেই কোনও নতুন কবিতা —
শুধু একটি বাক্য, পরিষ্কার হস্তাক্ষরে —
“আমি আজ এই শহরে এসেছি, রুদ্র। তুমি যদি এখনও অপেক্ষা করো, চতুর্থ প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়িও, ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগে।”

রুদ্র তখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্টেশনের কোণে কোণে।
তার মনে পড়ে, এই তো সেই জায়গা, যেখানে সে প্রথম চিঠি লিখে রেখেছিল।
এই তো সেই কুয়াশা, এই তো সেই ঘড়ির কাঁটা —
সব কিছুই যেন বদলায়নি, শুধু সময় থেমে ছিল তার নিজের মতো করে।

তিনি হঠাৎ চোখে পড়েন পোস্টবক্সে রাখা সেই খাম।
চিঠিটা খুলে পড়েন, শব্দগুলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সময়টা আবার জেগে ওঠে।

তিনি ছুটে যান চতুর্থ প্ল্যাটফর্মের দিকে।

সেই ট্রেন তখনও দাঁড়িয়ে।
আর স্টেশনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ঈশিতা —
চোখে আগের মতোই চশমা, কিন্তু চোখের ভেতর নরম আলোর মতো কিছু।

দূর থেকে দুজন একে অপরকে দেখেন —
প্রথমবার নয়, শেষবারও নয়।
কেবল একটানা শ্বাস ফেলার মতো — নীরব, সহজ, সত্যি।

রুদ্র এগিয়ে গিয়ে কিছু বলেন না।
ঈশিতা ধীরে বলেন —
“পাঁচ বছর আগেও আমি এসেছিলাম। কিন্তু প্ল্যাটফর্মে আমি একাই ছিলাম।”
রুদ্র বলেন, “না, আমি ছিলাম। শুধু বুঝিনি, ফিরে আসাটা ঠিক কোন শব্দে লিখলে তুমি চিনে ফেলবে।”
“এবার চিনেছো?”
“এই শহরে ফিরে আসা মানেই তো চেনা। আমরা কেউ ভুলিনি।”

ট্রেন হুইসেল দেয়।
তারা কেউ ওঠেন না।
শুধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকেন।

যেন কোনও চিঠি এইবার ঠিক সময়ে পৌঁছেছে।

পর্ব ৭ : যে চিঠি কখনও শেষ হয় না

স্টেশন চত্বরে আলো জ্বলছে। ট্রেন চলে গেছে, কিন্তু সেই আলো এখনও জ্বলছে — হয়তো কারও ফেরার অপেক্ষায়, হয়তো কারও থেমে যাওয়ার পরে কিছু বলার ইচ্ছেতে।
ঈশিতা আর রুদ্র পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, কোনও কথা নেই, তবু আশ্চর্যভাবে কিছুই অনুচ্চারিত থাকে না।

রুদ্র প্রথমে মুখ খোলে —
“এই পাঁচ বছর, আমি চিঠি লিখিনি। তবে প্রতিদিন নিজের জন্য একটা করে বাক্য লিখতাম। আজ সেগুলো সব পুরনো হয়ে গেছে। আজকের কথাগুলো আলাদা।”
ঈশিতা বলেন, “আমি প্রতিটি শুক্রবার রাতে এক কাপ চা বানাতাম। আর ভাবতাম — তুমি এখন নিশ্চয়ই পোস্টবক্সের সামনে দাঁড়িয়ে। অথচ জানতাম, তা হচ্ছে না।”

দু’জনের মধ্যে তৈরি হয় এক অদ্ভুত নীরব সমঝোতা —
তারা জানে, কোনও কিছুই ফেরানো যায় না, তবে কিছু কিছু অনুভূতি থেমে ছিল বলেই এখনও স্পষ্ট।
ভালোবাসা ফেরে না, ভালোবাসা শুধু দাঁড়িয়ে থাকে —
একটি শহরের ধুলোর গায়ে, ট্রেনের শেষ হুইসেলে, কিংবা একটি চিঠির অস্পষ্ট অক্ষরে।

ঈশিতা বললেন, “তুমি জানো, আমি বর্ধমানে থেকেও প্রায়ই নিউ জলপাইগুড়ির স্টেশন ওয়েবক্যাম খুলি। লাইভ ক্যামেরা থাকে এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে, কিন্তু আমি তাকিয়ে থাকতাম চতুর্থ প্ল্যাটফর্মের দিকেই। ভাবতাম, হয়তো তুমি হেঁটে যাচ্ছো। হয়তো খেয়াল করছ না, কে দেখছে তোমায়।”
রুদ্র বললেন, “আমি প্রতিদিন চতুর্থ প্ল্যাটফর্মে বসতাম। ভাবতাম, কেউ দূর থেকে দেখছে কিনা। তবু সেই কেউকে চেনার সাহস হয়নি।”

তারা হাসে। কিন্তু সে হাসিতে কোনও রং নেই — শুধু বাতাসের মতো স্বচ্ছ, যা কান্না আর স্মৃতিকে একসঙ্গে বইয়ে নেয়।

হঠাৎ ঈশিতা ব্যাগ থেকে বের করেন একটা পুরনো খাম।
“তুমি একবার বলেছিলে, ‘কিছু চিঠি হারানোর জন্যই লেখা হয়।’
এইটা হারিয়ে যেতে পারত। আমি হারাতে দিইনি।”
খামটা কাঁপা হাতে এগিয়ে দেন রুদ্রর দিকে।
ভেতরে সেই চিঠি, যেটা পাঁচ বছর আগে রুদ্র লিখে পোস্টবক্সে রেখে ছিল, আর যা বাতাসে উড়ে গিয়েছিল।

রুদ্র চমকে ওঠে।
“তুমি এটা পেল কী করে?”
“আমি ফিরে গিয়েছিলাম, ট্রেন ছাড়ার পর।
চিঠিটা উড়ে গিয়েছিল স্টেশনের বাউন্ডারি পেরিয়ে, আমি কুড়িয়ে রেখেছিলাম।
তখন জানতাম না, কবে তোমায় এটা ফিরিয়ে দেব।
আজ দিলাম।”

রুদ্র চিঠিটা হাতে নেয়, পড়ে না।
সে জানে, ততদিনে সমস্ত শব্দ তারা দুজনেই মুখস্ত করে ফেলেছে —
পড়ার দরকার নেই।

রাত্রি নামে, বাতি নিভে আসে একে একে।
স্টেশন বুক কর্নার বন্ধ হয়ে গেছে, শুধু স্টেশনের এক কোণে চায়ের দোকান খোলা —
যেখানে তারা দুজনে গিয়ে বসে।
চা আসে, কিন্তু কেউ চুমুক দেয় না।

ঈশিতা বলেন, “চলো, আর কোনও চিঠি নয়।”
রুদ্র তাকিয়ে বলেন, “তবে কি সব লেখা ফুরিয়ে গেল?”
“না। চিঠি থাক, কিন্তু পত্রবিহীন হোক।
কথা থাক, শব্দ ছাড়া।
ভালোবাসা থাক, কিন্তু চুপচাপ।”

রুদ্র হেসে বলেন, “ঠিক তোমার শহরের মতো। চুপচাপ, অথচ নিজের।”
ঈশিতা মাথা ঝাঁকান।
“এই শহর আর আমার নয়। এই শহর এখন আমাদের।”

সেই রাতে পোস্টবক্স নম্বর সাতের গায়ে কেউ একটা ছোট্ট কাগজ গুঁজে দিয়ে যায়।
কাগজে লেখা:
এই বক্স আর চিঠি রাখে না। এখন এখানে শুধু অপেক্ষা রাখা হয়। কেউ যদি ফিরে আসে, যেন খুঁজে পায়।

পর্ব ৮ : শহর যাকে মনে রেখেছিল

সকালে শহর ছিল ঝকঝকে, কুয়াশাহীন।
রোদ এসে পড়েছে রেললাইনের উপর, স্টেশনের মাথায় রঙচটা বিজ্ঞাপনে, আর বুক কর্নারের পাটকাঠির বেঞ্চিটায় — যেখানে একসময় ঈশিতা চুপচাপ বসে থাকতেন, রুদ্রের চিঠির উত্তর নিয়ে দ্বিধায়।

আজ আর কোনও চিঠি নেই।
তবু বুকের মধ্যে একটি চিঠির মতো অনুভব — খোলা হয়নি, তবু প্রতিটি শব্দ জানা।
আজ এই শহর তাদের আর খুঁজে ফেরে না।
বরং শহর এখন দু’জন মানুষকে মনে রেখেছে, যারা একে অপরকে মনে রেখেছে শহরের গায়ে দাঁড়িয়ে।

ঈশিতা নিউ জলপাইগুড়িতে নতুন একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন।
রেললাইন থেকে সামান্য দূরে। এমন জায়গা, যেখানে প্রতিদিন অন্তত দশটা ট্রেন চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়
তাদের মধ্যে কোনওটিই পৌঁছে না কোথাও, তবু চলে।

রুদ্র মাঝেমাঝেই আসেন বিকেলে, বই নিয়ে। তারা আর অপেক্ষা করেন না চিঠির, অপেক্ষা করেন নিজেদের।
মাঝে মাঝে ট্রেনের হুইসেল বাজলে ঈশিতা হঠাৎ চুপ করে যান।
রুদ্র বুঝে যান — এখনও কোনও কিছু অতীতকে স্পর্শ করে গেছে।

একদিন বিকেলে, রুদ্র জিজ্ঞেস করেন,
“তুমি কি এখনও ভেতরে ভেতরে ফিরে যেতে চাও সেই দিনে, যেদিন প্রথম চিঠি দিয়েছিলে?”
ঈশিতা বলেন, “না, আমি চাই না ফিরে যেতে। আমি চাই সেইদিনটা আরেকবার ঘটুক।
এইবার বুঝে বুঝে, দেখেশুনে, সময় নিয়ে।”

রুদ্র চুপ করে থাকেন।
তার বুকের খাতায় লেখা —
“তুমি যদি সময় চাও, আমি নীরবতা দেব।
তুমি যদি ভেবে নিতে চাও, আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকব।
কারণ তুমি ফিরে এসেছ —
এই শহর যাকে মনে রেখেছিল, আমি শুধু সেই ঠিকানাটা খুলে দিয়েছি আবার।”

বুক কর্নারের মালিক এখন নতুন একজন।
পুরনো মালিক অসুস্থ হয়ে চলে গেছেন গ্রামে।
নতুন ছেলেটি জানে না রুদ্র আর ঈশিতা কে, তবু তারা এলে হাসিমুখে বলে —
“আপনাদের জন্যই স্টেশন এখনও রোজের মতো দেখতে লাগে। কারা যেন রোজ এসে দাঁড়ায়, তাই শহরটা মনে রাখে।”

একদিন তারা দুজনে হাঁটতে হাঁটতে সেই পুরনো পোস্টবক্সের সামনে দাঁড়ান।
অর্ধেক মরচে ধরা, আর ভিতরে আর কোনও চিঠি জমা পড়ে না।
তবু ঈশিতা হাত দিয়ে ছুঁয়ে বলেন,
“এইটুকু লোহা আর একচিলতে গর্ত — এতদিন আমাদের পুরোটাই ছিল।”

রুদ্র বলেন, “তুমি বলেছিলে না, শহর মানুষকে মনে রাখে।
এই পোস্টবক্স সেই শহরের মেমোরি কার্ড।”

ঈশিতা হাসেন না, কেবল চোখ নামিয়ে বলেন,
“চলো না, একটা চিঠি রেখে আসি, শুধু নিজেদের জন্য। কেউ পড়বে না, তবু থাক।”
রুদ্র বলেন, “লিখে দাও। আমার তরফ থেকেও।”

চিঠির কাগজে ঈশিতা লেখেন:
“তুমি যদি আর কখনও এই শহরে ফিরে না আসো, আমি তোমায় খুঁজব না।
তবে পোস্টবক্সের গায়ে আমার ছায়া রয়ে যাবে,
যেন কোনও এক সন্ধ্যাবেলা তুমি জানো —
এইখানে একদিন আমরা একসাথে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
এইখানে আমাদের ভালোবাসা একবার শব্দ ছাড়াই লিখে পড়া হয়েছিল।
এইখানেই শহর আমাদের চিনে ফেলেছিল।”

চিঠিটা রুদ্র খামে ভরে।
দু’জনে মিলে পুরনো রংচটা বাক্সে ঢুকিয়ে দেন।

সন্ধ্যা নামে। স্টেশনে আলো জ্বলে ওঠে।
তারা পাশাপাশি হেঁটে ফেরে, জানে না কে আগে কিছু বলবে, কিংবা বলতেই হবে কিনা।

শহর আজ আর কিছুই বলে না।
শুধু মনে রাখে।
চুপচাপ।

পর্ব ৯ : ছায়া যখন শরীর হয়ে দাঁড়ায়

রাত্রির শহর ছায়া গিলে নেয় না, বরং ছায়াকে আশ্রয় দেয় — এমনভাবে, যেন প্রতিটি চুপ করে থাকা মুহূর্ত একেকটা স্পর্শ, যা প্রকাশ না পেলেও অনুভব হয়ে যায়।
ঈশিতা জানেন, যেসব অনুভব স্পর্শ চায় না, তারাই সবচেয়ে গভীরভাবে শরীরে গেঁথে থাকে।

এই শহরে পাঁচ বছর আগেও যেমনটা ছিল, আজও তেমন
বুক কর্নারে এখনও শীতের সন্ধ্যাবেলা উনুনে চা ফোটে,
স্টেশনের দেয়ালে টাঙানো ঘোষণাপত্রের পাশে কেউ নাম লেখে না,
কিন্তু কেউ একজন মাঝরাতে ফিরে এসে নিজের ছায়া রেখে যায় প্ল্যাটফর্মে।

ঈশিতা রুদ্রর সঙ্গে এখন প্রতিদিন না থাকলেও, একটা স্থিরতা তৈরি হয়ে গেছে —
না-থাকার মধ্যেও যে-থাকা,
যেখানে সম্পর্ক মানে হাত ধরা নয়, বরং পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি।

এক সন্ধ্যায় হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে যায় স্টেশনের একাংশে।
বুক কর্নারের সামনের বাতি নিভে গেলে ছায়া ঘন হয়ে আসে।

রুদ্র আর ঈশিতা পাশাপাশি বসে ছিলেন কাঠের বেঞ্চিতে, কেউ কিছু বলেনি।
হঠাৎ বাতাসে চায়ের গন্ধের সঙ্গে মিশে যায় এক ধরনের অস্থিরতা —
যেন দু’জনেই জানেন, কিছু একটা এসে দাঁড়িয়েছে মাঝখানে,
কিন্তু কেউ নাম জানে না তার।
তবু তাকে চেনা যায়।

রুদ্র বলেন, “তুমি জানো? অনেক সময় ছায়া শরীরের থেকেও বেশি বাস্তব হয়।
যেমন, তুমি পাশে বসে থাকলেও — আমি যেন বারবার সেই তোমাকেই দেখতে পাই, যাকে আমি চিঠির পাতায় এঁকেছিলাম।”
ঈশিতা বলে, “তুমি কি ভয় পাও যে, সেই ছায়ার সঙ্গে আমার শরীর এক হতে পারবে না?”
রুদ্র চুপ করেন।
তারপর বলেন, “ভয় পাইনি কখনও। শুধু চাইনি ছায়াটা হারিয়ে যাক।”

ঈশিতা ধীরে বলে, “তবে আজ আমি চাই, ছায়া আর না থাকুক।
আমি চাই তুমি আমার হাত ছুঁইয়ে বোঝো —
আমি আছি। শরীর হয়ে, সময় হয়ে, ভুল হয়ে, ক্ষমা হয়ে — একেবারে সত্যি হয়ে।”

বাতি ফিরে আসে। আলো জ্বলে ওঠে বুক কর্নারের মাথায়।

ঈশিতা হঠাৎ হাত বাড়িয়ে ধরেন রুদ্রর আঙুল।
শীতল, নরম, একটু কাঁপা।
তবু ভিতরে একটা নিঃশব্দ আত্মবিশ্বাস —
যা দীর্ঘ সময় আর অনুচ্চার অনুভবের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়।

রুদ্র তাকিয়ে থাকেন —
ঈশিতার চোখে ছায়া নেই আজ।
আজ সেখানে শুধু আলোর মতো স্পষ্ট একটা সিদ্ধান্ত।

তিনি হাতটা আরও শক্ত করে ধরেন।
কোনও কথা বলেন না।
কথা আজ দরকার নেই।

কারণ, আজ ছায়া শরীর হয়ে উঠেছে।
ভালোবাসা আর চিঠির পৃষ্ঠায় সীমাবদ্ধ নয়।
আজ তা শরীর ছুঁয়ে ফিরে এসেছে —
অতীতের ভেতর থেকে, অপেক্ষার গভীরতা পেরিয়ে, শহরের স্মৃতি গায়ে মেখে।

স্টেশন বুক কর্নারের পুরনো রেকর্ডারে কেউ আবার চালিয়ে দেয় রবীন্দ্রসংগীত —
“চিরদিন তুমি যে আমার…”

রুদ্র বলেন, “এই গানটা শুনলেই মনে পড়ে যায় সেই সন্ধ্যাটা, যেদিন প্রথম তোমাকে দেখি।”
ঈশিতা বলেন, “তুমি আমায় দেখোনি, আমার ছায়া দেখেছিলে।”
রুদ্র হেসে বলেন, “হ্যাঁ, তবে আজ আমি সেই ছায়াটাকেই ভালোবেসে ফেলেছি —
এই শরীরের মধ্যে, এই শহরের নীরবতার মধ্যে,
এই প্রেমের সেই ঠিকানায়,
যেটা চিঠির মতো হারায় না আর।”

পর্ব ১০ : চুপচাপ তোমার শহর

রাত্রি শেষের দিকে। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসে, প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে যায়, আর শহরের গায়ে পড়ে থাকে শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস — যেমনটা থেকে যায় কোনও গল্পের শেষ লাইনে, অথবা কোনও অসমাপ্ত কবিতার শেষে চিহ্নহীন বাক্যতলে।

ঈশিতা জানেন, গল্প শেষ হতে নেই, তাই সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন।
রুদ্র পাশে, চোখের কোণে আর কিছুই নেই — না সময়ের খোঁজ, না দিগন্তের মুখ।
আজ তাদের কাছে শহরটা আর সেই পুরনো চিঠির স্টেশন নয় —
আজ এটি একটি নামহীন ঠিকানা,
যেখানে দু’জন মানুষ নিজেদের অপেক্ষা দিয়ে গড়ে তুলেছে একটি জীবন।

সকালে তারা হাঁটতে বেরোলেন —
রেললাইন পেরিয়ে গলির ভেতর, এক পুরনো মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে দু’জন।
ঈশিতা হালকা করে বলেন, “এই শহর এখন কেমন মনে হয় তোমার কাছে?”
রুদ্র বলেন, “এখন আর কুয়াশা নয়, এখন এটা রোদ উঠবার আগের ঠিক সেই আলো —
যেখানে ভালোবাসা গায়ে পড়ে না, ভেতর থেকে আলো দেয়।”
ঈশিতা থেমে বলেন, “তুমি চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলে?”
“না, আমি এখনও লিখি — তবে কাউকে পাঠাই না।”
“তাহলে তুমি কাকে লিখো?”
“তোমাকে — যেদিন তুমি আর আমার পাশে থাকবে না,
সেদিন যেন এই শহর তোমার হয়ে যায় আবার।
এইখানে রাখা থাকবে প্রতিটি বাক্য —
যেটা আমি মুখে বলিনি, কিন্তু প্রতিদিন তোমার শরীরের ছায়ায় রেখে গিয়েছি।”

ঈশিতা বলেন, “তাহলে আমি চুপ করে রয়ে যাবো।
কারণ আমি চাই, তুমি প্রতিদিন একটা করে বাক্য লেখো —
আমার জন্য, এই শহরের জন্য, আর সেই সময়ের জন্য যেটা থেমে থেকেও চলেছে।”
রুদ্র হেসে বলেন, “তোমার চুপ করাটাই আমার চিঠি হয়ে গেছে।”

বুক কর্নারে তারা আর যান না।
নতুন দোকানি জানে না এই শহরের ভিতর কী রেখে গেছে দুজন মানুষ।
শুধু একদিন সেই দোকানির ছেলে, খুদে বয়স, এসে বলে
“দাদু বলতেন, এই শহরে একবার একজন মেয়ে ছিল,
যার ছায়া পড়তো স্টেশনের চতুর্থ প্ল্যাটফর্মে,
আর এক লোক ছিল, যিনি কবিতা লিখতেন বাতাসে।
তারা নাকি কখনও কিছু বলেননি, কিন্তু সবাই জানত তারা একে অপরকে ভালোবাসে।”
ঈশিতা হেসে মাথায় হাত রাখেন ছেলেটার।
“তোমার দাদু ঠিকই বলেছিলেন।
কিন্তু একটা কথা বলো — সেই শহরটা কী এখনও আছে?”
ছেলেটা মাথা নাড়ে, “আছে।
আমি দেখেছি।
শহর এখনও চুপচাপ।”
ঈশিতা তখন চুপচাপ তাকিয়ে থাকেন দূরের দিকে।
রুদ্র পাশে এসে দাঁড়ান, কোনও শব্দ নেই।

বাড়ি ফেরার পথে রুদ্র বলেন,
“তুমি যদি কোনওদিন আবার চলে যাও — একেবারে, স্থায়ীভাবে —
তাহলে কি আমি আবার চিঠি লিখতে পারবো?”
ঈশিতা বলেন, “লিখবে।
আর আমি প্রতিদিন রাতে তোমার চিঠিগুলো পড়বো বাতাসে,
তোমার হাতে ধরা কলমের শব্দে,
এই শহরের ট্রেনের হুইসেলে।”

রুদ্র বলেন, “তুমি কি জানো, আমার জীবনের সবচেয়ে গভীর কবিতার নাম কী?”
ঈশিতা বলে, “কি?”
রুদ্র উত্তর দেন —
“চুপচাপ তোমার শহর।”

রাত্রি নামে।
চিঠি লেখা হয় না আর, তবু প্রতিদিন একটি করে বাক্য জন্ম নেয়।
শহর আর কোনও ঠিকানায় ফিরিয়ে দেয় না,
সে নিজেই হয়ে ওঠে ঠিকানা।

এই শহর আর কারও নয় —
এই শহর শুধু তাদের, যারা অপেক্ষা করতে জানে,
ভালোবাসাকে চিঠির মতো ভাঁজ করে রাখতে জানে,
আর নীরবতার ভাষা বোঝে।

চুপচাপ…
একদম,
তোমার শহর।

সমাপ্ত

Lipighor_1754121394775.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *