রুদ্রনীল সেন
পর্ব ১: শুরু
কলকাতার ভোর সবসময় এক অদ্ভুত শব্দে ভরে থাকে—হর্ণের মৃদু চিৎকার, ট্রামের ঘড়ঘড়ানি, ভাপওঠা চায়ের দোকান থেকে উঠে আসা ধোঁয়া, আর দূর থেকে ভেসে আসা মাইকের আওয়াজ। অদ্রিজ বসু প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম ভাঙল এই শব্দের ভেতরেই। তবে আজকের সকালটা অন্যরকম। আজ সে আর চাকরিজীবী নয়—আজ থেকে সে উদ্যোক্তা।
মাত্র তিন বছর আগে সে নামকরা এক বহুজাতিক কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টে কাজ শুরু করেছিল। ভালো বেতন, অফিসের এয়ার কন্ডিশনড চেম্বার, আর মাথার ওপর বসের অনুমোদনের গণ্ডি—সব কিছুই তার ছিল। কিন্তু তবুও যেন কিছু একটা তাকে টানত না। প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার সময় ট্রামে বসে শহরের ব্যবসায়িক ভিড় দেখে মনে হত—“আমি তো শুধু অন্য কারও স্বপ্ন পূরণ করছি। আমার নিজের স্বপ্ন কোথায়?”
অদ্রিজ ছোট থেকেই হিসেবী ছেলে। বাবা ছিলেন ব্যাঙ্কের ক্লার্ক, মা স্কুলশিক্ষিকা। সংসারে অভাব ছিল না, কিন্তু সচ্ছলতাও তেমন ছিল না। বাবা চেয়েছিলেন ছেলেটা সরকারি চাকরি পাক, নিরাপদ জীবন কাটাক। কিন্তু অদ্রিজের মাথায় সেই নিরাপত্তা কখনও তৃপ্তি এনে দেয়নি। তার চোখে ছিল অন্যরকম স্বপ্ন—নিজের একটা ব্যবসা দাঁড় করানো।
কিন্তু ব্যবসা মানে টাকা। আর টাকা তার কাছে ছিল না। তাই তিন বছর চাকরি করে সে কিছুটা সঞ্চয় জমাল, সাথে লোন নিল ব্যাংক থেকে। সেই টাকাতেই শুরু করল নিজের প্রথম উদ্যোগ—একটা ছোট্ট স্টার্টআপ, যার নাম দিল “লোকাল লিংকস”।
আইডিয়াটা সহজ: শহরের ছোট ব্যবসায়ীরা—স্টেশনারি দোকান, কেকের দোকান, দর্জি, মেকানিক, ফটোকপি সেন্টার—তাদের অনেকেরই অনলাইন উপস্থিতি নেই। অথচ সাধারণ মানুষ আজকাল গুগল করে জিনিস খোঁজে, অনলাইন অ্যাপে অর্ডার দেয়। অদ্রিজ ভাবল, যদি এই ছোট দোকানগুলোকেই সে একটা সাধারণ অ্যাপে নিয়ে আসে, যেখানে যে কেউ নিজের লোকাল এলাকায় দরকারি পরিষেবার খোঁজ পাবে, তাহলে দোকানদাররাও লাভবান হবে, আর গ্রাহকরাও সহজে পরিষেবা পাবে।
ব্যাপারটা নতুন ছিল না, কিন্তু শহরভিত্তিক, লোকালাইজড সার্ভিস দেওয়ার মতো উদ্যোগ তখনও তেমন গড়ে ওঠেনি। তাই অদ্রিজ ভেবেছিল—“সময়টা আমার পক্ষে।”
আজকের সকালেই তার প্রথম মিটিং। গড়িয়াহাটের এক নামকরা মিষ্টির দোকানের মালিককে বোঝাতে হবে যে “লোকাল লিংকস”-এ তাদের নাম রাখলে বিক্রি বাড়বে। মিষ্টির দোকানদার বৃদ্ধ মানুষ, অনেকটা রক্ষণশীল। তাই অদ্রিজ জানে, বোঝানো সহজ হবে না।
চা খেতে খেতে সে নিজের প্রেজেন্টেশনটা মনে মনে আওড়াচ্ছিল। ছ’ফুটের লম্বা গড়ন, চোখে একরাশ স্বপ্ন, গলায় মৃদু উত্তেজনার সুর। মা রান্নাঘর থেকে ডাক দিলেন—
“অদ্রিজ, খালি চা খেয়ে বেরোবে না। দুটো লুচি খেয়ে যা।”
অদ্রিজ হেসে বলল, “আজ সময় নেই মা। প্রথম মিটিংটা মিস করলে চলবে না।”
মা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “শুনিস অদ্রিজ, আমরা তোর ওপর ভরসা করি। কিন্তু এই পথটা খুব সহজ নয়। সাহস রাখতে হবে।”
অদ্রিজ ব্যাগ কাঁধে তুলে নিল। বলল, “সাহস আছে মা। শুধু চাই, তুমি পাশে থাকো।”
গড়িয়াহাটের ভিড় তখন জমে উঠেছে। দোকানের সামনে নানান রঙের শাড়ি, টুকটাক ক্রেতার ভিড়, আর ট্রাফিকের কোলাহল। অদ্রিজ তার ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বের করল, দোকানের মালিক হরিপদ সেনকে প্রেজেন্টেশন দেখাতে বসলো।
হরিপদবাবু কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন, “বাবা, আমরা তো বহু বছর ধরে ব্যবসা করছি। গ্রাহক আমাদের নামেই আসে। আবার অ্যাপে গিয়ে কেন নাম দিতে হবে?”
অদ্রিজ ধৈর্য ধরে বলল, “আপনার নাম আছে, সুনামও আছে। কিন্তু ধরুন, নতুন প্রজন্ম যারা গুগল সার্চ করে, বা মোবাইল অ্যাপ ঘেঁটে দোকান খোঁজে, তারা কি আপনার দোকানের খোঁজ পাবে? আমাদের অ্যাপে থাকলে তারা সহজে আপনাকে খুঁজে পাবে। মানে, আপনার বাজার আরও বড় হবে।”
হরিপদবাবু চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে গম্ভীরভাবে বললেন, “তোর কথাটা শুনতে ভালো। কিন্তু আমরা পুরনো ধাঁচের মানুষ। টেকনোলজির ওপর ভরসা করতে শিখিনি।”
অদ্রিজ একটু থেমে নরম গলায় বলল, “বাবা, ব্যবসার নিয়ম বদলাচ্ছে। আজকের বাজারে টিকে থাকতে গেলে আপনাকেও বদলাতে হবে। আপনার মিষ্টি যদি শহরের অন্য প্রান্তের মানুষও পেতে চায়, তাহলে আমাদের প্ল্যাটফর্ম আপনাকে সাহায্য করবে। একটা চেষ্টা করে দেখুন।”
তার চোখে এমন এক আগুন ছিল, যা হরিপদবাবু অস্বীকার করতে পারলেন না। শেষে বললেন, “আচ্ছা, ঠিক আছে। এক মাস দেখি তোমার অ্যাপে নাম রাখলে কী হয়।”
অদ্রিজ মনে মনে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। এটাই তার প্রথম জয়।
কিন্তু ব্যবসার পথ এতটা সহজ নয়। ওইদিন সন্ধেবেলা যখন সে ক্যাফেতে বসে ল্যাপটপে নোট নিচ্ছিল, তখন তার পুরনো সহকর্মী দেবাশিস এসে হাজির।
“কী রে, শুনলাম চাকরি ছেড়ে দিলি? মাথা খারাপ নাকি?” দেবাশিস ঠাট্টা করে বলল।
অদ্রিজ হেসে বলল, “মাথা খারাপ নয়। আমি আমার স্বপ্নকে বেছে নিয়েছি।”
দেবাশিস চশমার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে বলল, “স্বপ্ন দিয়ে সংসার চলে না রে। তুই যতই প্ল্যান কর, শেষমেশ দেউলিয়া হয়ে যাবি। ব্যবসা মানে শুধু আইডিয়া নয়, বড় পুঁজি আর লোকবল লাগে।”
অদ্রিজ শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমার পুঁজি আমার বিশ্বাস। আর লোকজন? তারা আসবে। আমি জানি।”
দেবাশিস হেসে কফির কাপ নামিয়ে রাখল। “দেখা যাবে।”
অদ্রিজ বাইরে তাকাল—রাস্তায় ট্রাফিক লাইট জ্বলছে, মানুষ ছুটছে, জীবন থেমে নেই। তার ভেতরে তখন এক অদ্ভুত দৃঢ়তা তৈরি হচ্ছিল। সে জানত—আজ মাত্র প্রথম পদক্ষেপ। সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ আসবে।
কিন্তু সে প্রস্তুত।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাতে ডায়েরি লিখতে লিখতে সে একটা লাইন লিখল—
“ব্যবসা মানে শুধু লাভ নয়। এটা একটা যুদ্ধ—নিজের ভেতরের ভয়, বাইরের সন্দেহ আর সময়ের স্রোতের বিরুদ্ধে। আমি সেই যুদ্ধে নামলাম।”
এভাবেই শুরু হল অদ্রিজের নতুন পথচলা—“চুক্তির শহর”-এর প্রথম অধ্যায়।
পর্ব ২: প্রতিদ্বন্দ্বী
অদ্রিজ বসুর জীবনে প্রথম দিনের জয়টা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। গড়িয়াহাটের মিষ্টির দোকানটা অ্যাপে রেজিস্টার করার পরই সে বুঝতে পারল, ব্যবসায়ীরা আসলে ভয় পায় নতুনকে, কিন্তু একবার যদি বিশ্বাস জন্মায়, তাহলে আর পিছুটান থাকে না।
কিন্তু ঠিক তার পরের সপ্তাহেই সে বুঝতে পারল, মাঠের লড়াই শুধু দোকানদারকে বোঝানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এখানে আসল লড়াই হবে প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে।
প্রথম গ্রাহক
“লোকাল লিংকস”-এর প্রথম গ্রাহক এল সল্টলেকের এক তরুণী, নাম শ্রেয়া। সে ফেসবুকে অ্যাপটার বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করেছিল। দরকার ছিল একটা লোকাল টেইলার, যে তাড়াতাড়ি ব্লাউজ বানিয়ে দেবে। অদ্রিজ নিজে গিয়ে দেখা করল টেইলারের সঙ্গে, তার দোকানের প্রোফাইল তৈরি করল, তারপর শ্রেয়ার অর্ডার মেলাল।
শ্রেয়ার চোখে একধরনের উচ্ছ্বাস ছিল, “ওয়াও, এত সহজে লোকাল দোকান পাওয়া যায়! আমি তো ভেবেছিলাম শুধু বড় ই-কমার্সেই এসব হয়।”
অদ্রিজ হেসে বলল, “আমাদের লক্ষ্যই হলো আপনার নিজের পাড়ার দোকানকে হাতের মুঠোয় এনে দেওয়া।”
শ্রেয়ার এই অভিজ্ঞতা নিয়ে ইনস্টাগ্রামে একটা পোস্ট দিল। আর সেই পোস্টই যেন আগুনে ঘি ঢালল। কিছুদিনের মধ্যেই আরও কয়েকজন তরুণ তরুণী অ্যাপটা ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে লাগল।
অদ্রিজের টিম
কাজ বাড়তে থাকায় অদ্রিজ একা সামলাতে পারছিল না। তাই সে তার কলেজের দু’জন পুরোনো বন্ধু—অভিজিৎ আর প্রণব—কে দলে নিল।
অভিজিৎ ছিল টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের, ওয়েবসাইট আর অ্যাপ ডেভেলপমেন্টে দক্ষ। প্রণব ছিল ফাইন্যান্সে ভালো, হিসাবপত্র রাখায় দক্ষ।
একটা ছোট্ট রুম ভাড়া নেওয়া হলো পার্ক সার্কাসে। তিনটে চেয়ার, একটা পুরনো ডেস্কটপ, আর জানালা দিয়ে ভেসে আসা চায়ের দোকানের কোলাহল। এখান থেকেই শুরু হলো “লোকাল লিংকস”-এর প্রথম অফিস।
রাতে যখন তিনজন একসঙ্গে বসে প্ল্যান করছিল, অদ্রিজ বলল,
“আমাদের এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেশি দোকান অনবোর্ড করতে হবে। কিন্তু মনে রেখো—আমরা কেবল লিস্টিং অ্যাপ নই। আমাদের পরিষেবা দিতে হবে নির্ভরযোগ্য। সময়মতো ডেলিভারি, গ্রাহকের সন্তুষ্টি—এই জিনিসগুলোই আমাদের আলাদা করবে।”
অভিজিৎ হেসে বলল, “বড় স্বপ্ন দেখছিস রে, বসু।”
অদ্রিজ গম্ভীর চোখে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ। কারণ ব্যবসা ছোট বড় দিয়ে মাপা যায় না। মাপা যায় বিশ্বাস দিয়ে।”
প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব
একদিন সকালে হঠাৎ করেই একটি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল অদ্রিজের। বড় বড় হরফে লেখা—
“সিটি কানেক্ট—আপনার শহরের প্রতিটি দোকান, আপনার হাতে।”
অদ্রিজের বুক কেঁপে উঠল। এটাই সেই ভয় যা সে আঁচ করেছিল।
গুগল করে দেখল, “সিটি কানেক্ট” হলো এক বহুজাতিক কোম্পানির নতুন শাখা, যারা ভারতের বিভিন্ন শহরে লোকাল বিজনেস লিস্টিং সার্ভিস চালু করছে। প্রচুর ফান্ডিং, বড় টিম, আর আধুনিক মার্কেটিং কৌশল নিয়ে তারা নামছে।
অদ্রিজের মনে হলো, “আমরা তো মাত্র শুরু করেছি। আর ওরা কোটি কোটি টাকার পুঁজি নিয়ে মাঠে নামছে। এখন কী হবে?”
সেই রাতে টিম মিটিং ডাকা হলো। প্রণব হিসেব কষে বলল, “দেখ, ওরা যতই বড় হোক, আমাদের অ্যাপ এখনো লোকাল লেভেলে গ্রাহকদের টানছে। আমাদের বাজেট কম, কিন্তু আমাদের গতি আছে।”
অভিজিৎ বলল, “কিন্তু টেকনিক্যালি ওরা অনেক এগিয়ে যাবে। আমাদের সার্ভার এত লোড নিতে পারবে?”
অদ্রিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ, লড়াই কঠিন হবে। কিন্তু মনে রেখো—বড় কোম্পানি সবসময় ছোটকে হারাতে পারে না। আমরা যদি গ্রাহকদের কাছে মানবিক, নির্ভরযোগ্য পরিষেবা দিতে পারি, তাহলে আমাদের জায়গা তৈরি হবেই।”
প্রথম হুমকি
কয়েকদিন পর, গড়িয়াহাটের সেই মিষ্টির দোকানের মালিক ফোন করলেন। গলা কাঁপছিল তার, “বাবা, আজ সকালে এক লোক এসে বলল, আমাদের তোমাদের অ্যাপ থেকে নাম তুলে নিতে হবে। নাহলে সমস্যা হবে।”
অদ্রিজ থমকে গেল, “কী সমস্যা?”
“লোকটা বলল, ‘সিটি কানেক্ট’-এ নাম না দিলে ব্যবসা চলবে না। আর নাম দিলে তোমাদের সঙ্গে রাখা যাবে না।”
অদ্রিজের বুক হঠাৎ করে ভারী হয়ে গেল। এ তো কেবল ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, এটা ভয় দেখানো।
সন্ধেবেলা সে সেই দোকানে গিয়ে মালিককে আশ্বস্ত করল, “চিন্তা করবেন না। আপনার নিরাপত্তা আমরা দেখব। আমরা কাউকে ভয় পাই না।”
কিন্তু ভেতরে ভেতরে অদ্রিজ বুঝল—এটা শুধু শুরু। প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু বাজারে টাকার জোর দেখাবে না, প্রয়োজনে ভয় দেখিয়েও নিজেদের জায়গা তৈরি করতে চাইবে।
শ্রেয়ার প্রত্যাবর্তন
এই কঠিন সময়ে আবার এল শ্রেয়ার ফোন। সে বলল, “অদ্রিজদা, তোমাদের অ্যাপটা অসাধারণ। আমি আমার বন্ধুদেরও ডাউনলোড করতে বলেছি। কিন্তু শুনলাম অন্য একটা কোম্পানি বাজারে নেমেছে?”
অদ্রিজ একটু ক্লান্ত গলায় বলল, “হ্যাঁ, ওরা বড়। কিন্তু আমরা লড়াই করছি।”
শ্রেয়া দৃঢ় গলায় বলল, “আমি তোমাদের পাশে আছি। আমি চাই তোমরা জিতো। কারণ তোমাদের মধ্যে সত্যিকারের শহরের গন্ধ আছে। ওরা কেবল বাইরে থেকে আসা একটা ব্র্যান্ড।”
অদ্রিজের মুখে আবার হাসি ফুটল। ব্যবসা শুধু টাকার খেলা নয়—এটা মানুষের বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে।
নতুন পরিকল্পনা
টিম মিটিংয়ে অদ্রিজ বলল, “আমাদের সামনে এখন দুটো রাস্তা—এক, আমরা ভয় পেয়ে হার মানি। দুই, আমরা আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠি। আমি দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিচ্ছি।”
প্রণব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
“মানে আমাদের এখন এমন কিছু করতে হবে, যা ‘সিটি কানেক্ট’-ও কপি করতে পারবে না। আমাদের পরিষেবা আরও ব্যক্তিগত, আরও মানবিক করে তুলতে হবে। আমরা কেবল দোকানদার আর গ্রাহকের মধ্যে লিঙ্ক হব না—আমরা হব শহরের গল্পের অংশ।”
অভিজিৎ চোখ মেলে তাকাল, “শহরের গল্প?”
অদ্রিজ বলল, “হ্যাঁ। প্রতিটি দোকানের একটা গল্প আছে। কারও দোকান ষাট বছরের পুরোনো, কারও দোকান চালাচ্ছে এক তরুণী সিঙ্গল মাদার, কারও আবার ব্যবসা দেউলিয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। আমরা সেই গল্পগুলো তুলে ধরব, আমাদের প্ল্যাটফর্মে।”
প্রণব হাসল, “মার্কেটিংয়ের নতুন কৌশল! এটাই আমাদের আলাদা করবে।”
শেষ দৃঢ়তা
সেই রাতে অদ্রিজ তার ডায়েরিতে লিখল—
“প্রতিদ্বন্দ্বী যত বড় হোক, আমার স্বপ্নকে হারাতে পারবে না। শহর আমার পাশে আছে। আর আমি শহরের পাশে।”
পর্ব ৩: টাকার টানাপোড়েন
অদ্রিজ বসুর “লোকাল লিংকস” তখন ধীরে ধীরে শহরে আলোড়ন তুলছে। মিষ্টির দোকান, টেইলার, চায়ের স্টল, এমনকি পুরোনো বইয়ের দোকানও একে একে তাদের নাম লিখিয়ে ফেলছে। মানুষজন অ্যাপটা ব্যবহার করে সুবিধে পাচ্ছে। শ্রেয়ার মতো ক’জন তরুণ-তরুণী সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশংসা করায় আরও অনেকের কানে পৌঁছে যাচ্ছে খবর।
কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই বোঝা যাচ্ছে—শুধু স্বপ্ন দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় না। এর পেছনে লাগে টাকার জোগান।
অফিসে সন্ধ্যা
পার্ক সার্কাসের ছোট্ট রুমটা এখন যেন যুদ্ধক্ষেত্র। ল্যাপটপে চোখ গেঁথে অভিজিৎ কোড লিখছে। সার্ভার বারবার ক্র্যাশ করছে, কারণ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। এক কোণে প্রণব বসে ক্যালকুলেটর নিয়ে হিসেব করছে—ব্যাংকের লোনের কিস্তি, ইন্টারনেট বিল, বিদ্যুতের খরচ, অফিস ভাড়া সব মিলিয়ে মাস শেষে খরচ মাথা তুলছে।
অদ্রিজ টেবিলের ওপর ঝুঁকে নোট নিচ্ছিল, হঠাৎ প্রণব ফিসফিস করে বলল, “অদ্রিজ, এই মাসে আমাদের ক্যাশ ফ্লো ভয়াবহ খারাপ। রেভিনিউ প্রায় নেই বললেই চলে, অথচ খরচ চলছে রোজ।”
অদ্রিজ শান্ত গলায় বলল, “আমি জানি। কিন্তু আমরা যদি এখন থেমে যাই, তাহলে শুরু করারই মানে ছিল না। আমাদের প্ল্যান করতে হবে।”
অভিজিৎ হতাশ মুখে বলল, “প্ল্যান করেই তো বসে আছি, কিন্তু টাকা কোথা থেকে আসবে? গ্রাহকরা এখনো রেজিস্ট্রেশনের জন্য সামান্য ফি দিচ্ছে, কিন্তু সেটুকুতে অফিস ভাড়া পর্যন্ত উঠে না।”
অদ্রিজ টেবিলে আঙুল ঠুকতে ঠুকতে বলল, “আমাদের এখন ইনভেস্টর দরকার।”
প্রথম ইনভেস্টরের সাথে সাক্ষাৎ
কয়েকদিন পর, এক বন্ধুর মাধ্যমে দেখা হলো তরুণ ইনভেস্টর রাহুল মল্লিকের সাথে। আধুনিক পোশাক, হাতে আইফোন, চোখে ব্যবসার ঝলক।
অদ্রিজ উত্তেজিতভাবে প্রেজেন্টেশন দেখাল—“লোকাল লিংকস কেবল একটা অ্যাপ নয়, এটা শহরের গল্প। ছোট দোকানদারদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে যুক্ত করার সেতু। আমাদের এখন ১৫০ দোকান যুক্ত হয়েছে, ৪০০ অ্যাক্টিভ ইউজার আছে। ছ’মাসের মধ্যে আমরা এটা তিনগুণ করতে পারব।”
রাহুল ঠান্ডা মুখে শুনে বলল, “আইডিয়া খারাপ না। কিন্তু তোমাদের রেভিনিউ মডেল কোথায়? লাভ কবে হবে?”
অদ্রিজ একটু থেমে বলল, “প্রথম বছর আমরা ফোকাস করছি ইউজার বেস বাড়ানোয়। লাভ আসবে দ্বিতীয় বছর থেকে। আমরা তখন প্রিমিয়াম সার্ভিস চালু করব, যেমন হোম ডেলিভারি, বিশেষ অফার, কাস্টমাইজড প্যাকেজ।”
রাহুল ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “শোনো, আমি স্টার্টআপে ইনভেস্ট করি যখন দেখি টিমের ভিশন আছে আর এক্সিকিউশনও আছে। তোমাদের ভিশন আছে, মানছি। কিন্তু এক্সিকিউশন এখনো কাঁচা। আমি এখন টাকা দিতে পারছি না। তবে যদি তিন মাসের মধ্যে ইউজার টেন থাউজ্যান্ডে নিয়ে যেতে পারো, তখন আবার কথা বলব।”
অদ্রিজের বুকটা যেন চেপে গেল। কিন্তু মুখে হাসি রেখেই বলল, “ধন্যবাদ। আমরা প্রমাণ করব।”
টাকার সঙ্কট
অফিসে ফিরে এসে প্রণব হিসেব কষে বলল, “তিন মাসে ইউজার টেন থাউজ্যান্ড? অসম্ভব নয়, কিন্তু প্রায় আত্মঘাতী।”
অভিজিৎ গলা চড়াল, “আমাদের এখন ল্যাপটপ আপগ্রেড দরকার, সার্ভার আপগ্রেড দরকার। এগুলো ছাড়া ইউজার বাড়ালে সব ভেঙে পড়বে।”
অদ্রিজ একদম চুপ করে বসে রইল। মাথার ভেতর ঘুরছিল হাজারো চিন্তা। টাকার সঙ্কট তার ঘুম কেড়ে নিচ্ছিল।
রাতে বাড়ি ফিরেও মন শান্ত হলো না। মা মুখ তুলে তাকিয়ে বললেন, “কী রে, এত দেরি হলো কেন?”
অদ্রিজ শুধু বলল, “কাজের চাপ, মা।”
কিন্তু মা বোঝেন, ছেলের চোখে ক্লান্তি জমেছে।
শহরের গল্প প্রজেক্ট
তবুও অদ্রিজ থামল না। সে শুরু করল “শহরের গল্প” প্রজেক্ট। প্রতিটি দোকানের ইতিহাস, তাদের জীবনের লড়াই, সেই গল্পগুলো অ্যাপে তুলে ধরা শুরু হলো।
মুক্তার দোকান—যে বিধবা নারী স্বামী হারানোর পর নিজের হাতে ব্যবসা দাঁড় করিয়েছিলেন।
নকশার দোকান—যেখানে এক তরুণ ছেলেই পরিবারের সংসার চালাচ্ছে পড়াশোনার পাশাপাশি।
এসব গল্প গ্রাহকদের নাড়া দিল। মানুষ শুধু দোকান নয়, গল্পও পড়তে লাগল। শেয়ার হতে লাগল সোশ্যাল মিডিয়ায়।
শ্রেয়া নিজে এগিয়ে এসে একটা ভিডিও বানাল, যেখানে সে বলল—“লোকাল লিংকস শুধু একটা অ্যাপ নয়, এটা আমাদের শহরের আত্মা।”
এই ভিডিও হঠাৎ ভাইরাল হয়ে গেল।
কিন্তু অন্ধকার ঘনাচ্ছে
যখন সবকিছু নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে, তখনই সমস্যা আরও বড় আকার নিল।
ব্যাংক থেকে ফোন এলো—“বসু বাবু, আপনার লোনের কিস্তি তিন মাস ধরে বাকি। আর দেরি হলে লিগ্যাল নোটিস যাবে।”
অদ্রিজ কাঁপা গলায় বলল, “আমাদের একটু সময় দিন, আমরা শোধ করব।”
কিন্তু ফোনের ওপার থেকে ঠান্ডা গলা—“ব্যবসা করলে দায়ও নিতে হয়।”
অফিসে এসে সে খবরটা জানাল টিমকে। অভিজিৎ ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “মানে? এখন যদি ব্যাংক মামলা করে, আমরা তো শেষ!”
প্রণব মাথা নিচু করে বলল, “আমাদের হাতে নগদ টাকা নেই। স্পনসর না পেলে বা বড় গ্রাহক না এলে পরিস্থিতি সামলানো যাবে না।”
অদ্রিজ গভীর নিশ্বাস ফেলল। “কোনও না কোনও রাস্তা বের করতেই হবে।”
সিটি কানেক্টের চাল
ঠিক এই সময় খবর এল—“সিটি কানেক্ট” কলকাতায় বিশাল প্রচারাভিযান শুরু করেছে। বড় বড় বিলবোর্ডে তাদের বিজ্ঞাপন, রেডিওতে বিজ্ঞাপন, এমনকি রিকশার গায়ে পোস্টার।
আরও খারাপ হলো যখন কয়েকজন দোকানদার ফোন করে জানাল—“আমরা আপনার অ্যাপ থেকে নাম তুলছি, কারণ ওরা আমাদের বিনামূল্যে এক বছরের সাবস্ক্রিপশন দিচ্ছে।”
অদ্রিজ যেন মাটির তলায় গিয়েও দাঁড়াতে পারল না। প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু বাজার দখল করছে না, তাদের ভাঙার চেষ্টা করছে।
দৃঢ় সিদ্ধান্ত
সেদিন রাতে অদ্রিজ আবার ডায়েরি খুলল। লিখল—
“ব্যবসা মানে শুধু লাভ নয়, মানে বেঁচে থাকার লড়াই। আমাদের যদি হার মানতে হয়, তাহলে আমরা শহরের কাছে দায়ী হব। কিন্তু আমি হার মানব না। শহর যদি আমাদের পাশে থাকে, আমরাও শহরের পাশে থাকব।”
তারপর সে উঠে দাঁড়াল। ফোন হাতে নিল। ডায়াল করল কয়েকজন পুরোনো পরিচিতকে—ক্লাবের বন্ধু, কলেজের ব্যাচমেট, এমনকি এক সাংবাদিক পরিচিতকেও।
সে জানত, এখনই ঝুঁকি নিতে হবে। না হলে সব শেষ।
পর্ব ৪: ঝুঁকির আগুন
ব্যবসার দুনিয়ায় যখন চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, তখনই মানুষ সাহস দেখায়। অদ্রিজও সেই সাহস দেখাল। ব্যাংকের চাপ, প্রতিদ্বন্দ্বীর হুমকি, আর টাকার টানাপোড়েন—সব মিলিয়ে “লোকাল লিংকস” তখন টলমল করছে। কিন্তু ঠিক তখনই অদ্রিজ নিল এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত—শহরের রাস্তায় নামবে তারা, মানুষের কাছে গিয়ে জানাবে নিজেদের গল্প।
ক্যাম্পেইনের শুরু
অদ্রিজ একদিন সকালে অফিসে ঢুকেই বলল, “আমাদের এখন বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতো টাকা নেই। কিন্তু মানুষকে আমাদের কথা জানাতেই হবে। তাই আমরা নিজেদের হাতে একটা ক্যাম্পেইন চালাব। রাস্তায় নামব, দোকান ঘুরব, গল্প বলব। মানুষকে বোঝাব যে লোকাল লিংকস তাদেরই প্ল্যাটফর্ম।”
অভিজিৎ হতবাক, “মানে আমরা নিজেরাই লিফলেট বিলি করব?”
অদ্রিজ দৃঢ় গলায় বলল, “হ্যাঁ। এতে লজ্জার কিছু নেই। বরং মানুষের চোখে আমরা সৎ হব।”
প্রণব চুপচাপ মাথা নেড়ে বলল, “কাজটা ঝুঁকির। কিন্তু এর বাইরে আমাদের আর রাস্তা নেই।”
রাস্তায় নামা
পরদিনই শুরু হলো কাজ। সল্টলেক থেকে শ্যামবাজার, গড়িয়াহাট থেকে ভবানীপুর—অদ্রিজ আর তার দুই সঙ্গী হাতে লিফলেট নিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরতে লাগল।
“আমরা লোকাল লিংকস থেকে এসেছি। আপনার দোকানকে শহরের আরও মানুষ দেখুক, এই আমাদের চেষ্টা।”
কেউ শুনে হাসল, কেউ পাত্তা দিল না, আবার কেউ আগ্রহ দেখাল।
একটা পুরোনো বইয়ের দোকানে গিয়ে দোকানদার বৃদ্ধ বললেন, “বাবা, আজকাল কেউ বই কেনে না। তবু যদি তোমার অ্যাপে থাকলে একটু লাভ হয়, চেষ্টা করে দেখি।”
অদ্রিজের চোখ ভিজে উঠল। সে জানত—এই মানুষগুলোই তার আসল শক্তি।
শহরের গল্প লাইভ
তাদের “শহরের গল্প” প্রজেক্ট এবার রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ল। শ্রেয়া এগিয়ে এসে প্রস্তাব দিল, “চলুন আমরা ভিডিও ইন্টারভিউ করি। দোকানদাররা নিজের মুখে তাদের গল্প বলুক। আমি ভিডিও এডিট করে ইউটিউব আর ইনস্টাগ্রামে দেব।”
অদ্রিজ প্রথমে দ্বিধায় পড়েছিল, কারণ ভিডিও বানাতে টেকনিক্যাল স্কিল আর সময় লাগে। কিন্তু শ্রেয়া বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হলো।
ফল মিলল হাতেনাতে।
“লোকাল লিংকস প্রেজেন্টস: গড়িয়াহাটের মিষ্টির কিংবদন্তি”—ভিডিওটা ইউটিউবে আপলোড হতেই দুই হাজার ভিউ হয়ে গেল।
“সল্টলেকের একা মায়ের সংগ্রাম”—ভিডিওটা ইনস্টাগ্রামে ভাইরাল হলো।
মানুষ বুঝতে শুরু করল, এই প্ল্যাটফর্ম শুধু ব্যবসা নয়, শহরের আত্মাকে বাঁচাচ্ছে।
প্রথম বড় মিডিয়া কভারেজ
এইসব খবর পৌঁছল এক স্থানীয় সাংবাদিকের কানে। অদ্রিজের কলেজের পুরোনো পরিচিত অমিতাভ এখন একটি জনপ্রিয় সংবাদপত্রে কাজ করে। সে ফোন করে বলল,
“অদ্রিজ, তোমাদের গল্পটা দারুণ। আমি চাই এ নিয়ে একটা ফিচার লিখতে। লোকাল বিজনেসের লড়াইয়ের গল্প মানুষ পড়তে চাইবে।”
কয়েকদিনের মধ্যেই পত্রিকার রবিবারের সংখ্যায় বড় শিরোনামে ছাপা হলো—
“বড় কোম্পানির ভিড়ে এক তরুণের লড়াই: লোকাল লিংকস।”
সেই আর্টিকেলই যেন শহরের মানুষকে নতুন করে নাড়া দিল। হঠাৎ করেই কয়েকশো নতুন ইউজার অ্যাপ ডাউনলোড করল।
কিন্তু ঝুঁকির আগুন বাড়ছে
যখন মানুষজন তাদের চিনতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই সমস্যা আরও তীব্র হয়ে উঠল।
এক সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে অদ্রিজ লক্ষ্য করল, দুই অচেনা লোক তার পিছু নিচ্ছে। সে ভেবেছিল কাকতালীয়, কিন্তু কয়েকদিন ধরে একই ঘটনা ঘটল।
এক রাতে বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল এক লোক। অদ্রিজ এগোতেই সে হেসে বলল,
“বাবু, বড়দের সঙ্গে লড়াই করলে রাতের ঘুম উড়বে। আপনার লোকাল লিংকস টিকবে না। সিটি কানেক্টকে বাধা দেওয়া মানে ঝামেলা ডেকে আনা।”
অদ্রিজ কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে গেল। কিন্তু বুক কেঁপে উঠল। প্রতিদ্বন্দ্বীরা শুধু বাজারে টাকার জোর দেখাচ্ছে না, ভয়ও দেখাচ্ছে।
টিমের ভেতর দ্বন্দ্ব
পরদিন অফিসে প্রণব রেগে গিয়ে বলল, “আমরা কি মাফিয়া দুনিয়ায় নেমেছি নাকি? এভাবে তো চলতে পারে না। আমি আমার জীবন ঝুঁকিতে ফেলতে চাই না।”
অভিজিৎও দ্বিধায় পড়ল, “অদ্রিজ, আমাদের স্বপ্ন ভালো, কিন্তু যদি এর জন্য নিরাপত্তা না থাকে তাহলে কীভাবে এগোব?”
অদ্রিজ গম্ভীর গলায় বলল, “আমি জানি, ঝুঁকি আছে। কিন্তু মনে রেখো, ইতিহাসে কেউ সহজ পথে বড় কিছু করতে পারেনি। আমরা শহরের জন্য লড়ছি। আমি চাইলে এখনই চাকরিতে ফিরে যেতে পারতাম, কিন্তু সেটা কি আমাদের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা নয়?”
প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুই যদি এতটা নিশ্চিত থাকিস, তাহলে আমি আছি। তবে প্ল্যান আরও শক্ত করতে হবে।”
একটি আশ্চর্য ফোনকল
ঠিক তখনই এলো এক আশ্চর্য ফোনকল।
ফোন করল এক ব্যবসায়ী, নাম বিকাশ চৌধুরী। তিনি কলকাতার এক নামকরা রেস্তরাঁর মালিক। ফোনে বললেন,
“অদ্রিজবাবু, আপনারা শহরে যা করছেন তা আমি দেখছি। আমি চাই আমার রেস্তরাঁও আপনার অ্যাপে আসুক। শুধু তাই নয়, আমি চাই আপনাদের পুরো ক্যাম্পেইনে সাহায্য করতে।”
অদ্রিজ চমকে গেল। “কী ধরনের সাহায্য?”
“আমি স্পনসর করতে পারি। তবে শর্ত একটাই—আপনাদের প্ল্যাটফর্মে আমাদের রেস্তরাঁর বিশেষ প্রোমোশন থাকতে হবে।”
অদ্রিজের চোখে ঝিলিক ফুটল। এটাই হয়তো প্রথম বড় সুযোগ।
স্পনসরের আলো
বিকাশ চৌধুরীর সঙ্গে মিটিং হলো। তিনি নগদ কিছু অর্থ দিলেন, সাথে প্রতিশ্রুতি দিলেন, তার রেস্তরাঁয় “লোকাল লিংকস” গ্রাহকদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে।
এই অর্থে তারা সার্ভার আপগ্রেড করতে পারল, কিছু নতুন পার্ট-টাইম স্টাফ নিতে পারল, আর ক্যাম্পেইনকে আরও বড় আকারে চালাতে পারল।
শহরের পাড়ায় পাড়ায় এখন পোস্টার লাগছে—
“লোকাল লিংকস—আপনার পাড়ার দোকান, আপনার হাতের মুঠোয়।”
ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন
কিন্তু ব্যবসার এই যুদ্ধ অদ্রিজের ব্যক্তিগত জীবনকেও নাড়া দিচ্ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় ছিন্ন, পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা কমে গেছে। মা একদিন আক্ষেপ করে বললেন,
“তুই কি কেবল এই ব্যবসার জন্যই বেঁচে আছিস? নিজের জীবনের কথা ভেবেছিস?”
অদ্রিজ চুপ করে রইল। সে জানে, এখন তার জীবনে কেবল একটাই লক্ষ্য—লোকাল লিংকস বাঁচানো।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে একা লাগছিল তাকে। তখন শ্রেয়ার ফোন এলো। সে বলল,
“অদ্রিজদা, তুমি একা নও। আমরা সবাই আছি। তোমার স্বপ্নটা শুধু তোমার নয়, এখন আমাদেরও।”
অদ্রিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ধন্যবাদ, শ্রেয়া। এই কথাটাই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।”
শেষ দৃশ্য
সেদিন রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে অদ্রিজ শহরের আলো দেখছিল। তার চোখে আগুন, মনে ভয়, কিন্তু শরীরে অদ্ভুত এক শক্তি।
সে জানত, সামনে আরও বড় ঝড় আসবে। প্রতিদ্বন্দ্বী আরও আক্রমণ করবে। কিন্তু এই শহর, এই মানুষ, এই গল্পগুলো তাকে শক্তি দিচ্ছে।
সে ডায়েরিতে লিখল—
“ঝুঁকি ছাড়া ব্যবসা নেই। আগুন ছাড়া আলো নেই। আমি সেই আগুনে ঝাঁপ দিলাম।”
পর্ব ৫: ফাঁদের ছায়া
বিকাশ চৌধুরীর টাকা আসায় যেন কিছুদিনের জন্য “লোকাল লিংকস”-এর শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত বইতে শুরু করল। সার্ভার আপগ্রেড হলো, নতুন পোস্টার ছাপা হলো, বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে পড়ল। শহরের রাস্তায় হঠাৎ করেই পরিচিত হয়ে উঠল নামটা।
কিন্তু অদ্রিজ জানত, এত সহজে সবকিছু হয় না। প্রতিটি সাহায্যের আড়ালে একটা শর্ত থাকে। আর বিকাশ চৌধুরীর মতো ব্যবসায়ী সহজে বিনা স্বার্থে সাহায্য করবেন, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন।
প্রথম শর্ত
চৌধুরী একদিন অদ্রিজকে ডেকে পাঠালেন তাঁর রেস্তরাঁয়। সন্ধেবেলা আলো-ঝলমলে হলঘরে ঢুকে অদ্রিজ দেখল, বিকাশ সিগার হাতে বসে আছেন।
“এসো অদ্রিজবাবু,” তিনি হেসে বললেন, “তোমাদের ছেলেরা দারুণ কাজ করছে। আমি খুশি।”
অদ্রিজ নম্রভাবে বলল, “আপনার সাহায্য ছাড়া এত দ্রুত এগোনো যেত না।”
বিকাশ হেসে বললেন, “আমি সাহায্য করেছি কারণ তোমাদের ভিশন ভালো। তবে একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে—ব্যবসা মানেই গিভ অ্যান্ড টেক। এখন আমারও কিছু দাবি আছে।”
অদ্রিজ সতর্ক হলো। “কী ধরনের দাবি?”
“তোমাদের অ্যাপের হোমপেজে আমার রেস্তরাঁর বিজ্ঞাপন সবসময় শীর্ষে থাকবে। আর যদি অন্য কোনো রেস্তরাঁ যুক্ত হয়, তাহলে তাদের প্রমোশন আমার থেকে ছোট হতে হবে।”
অদ্রিজ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। এটা তো পরিষ্কারভাবে অন্যদের প্রতি অন্যায়। কিন্তু এখন টাকা ছাড়া টিকে থাকা কঠিন।
“আমি বুঝতে পারছি,” অদ্রিজ বলল ধীরে। “আমরা চেষ্টা করব।”
অফিসে দ্বন্দ্ব
অফিসে ফিরে প্রণব আর অভিজিৎকে পুরো ব্যাপারটা বলতেই আগুন জ্বলে উঠল।
অভিজিৎ চেঁচিয়ে বলল, “এটা তো পুরো অন্যায়! আমাদের মূল নীতি ছিল সবার জন্য সমান জায়গা। এখন যদি একটা রেস্তরাঁকে সবসময় উপরে রাখি, তাহলে বাকিরা আমাদের বিশ্বাস করবে না।”
প্রণব গম্ভীরভাবে বলল, “কিন্তু এই মুহূর্তে আমাদের ক্যাশ ফ্লো ওই টাকা ছাড়া চলবেই না। লোনের কিস্তি বাকি, অফিস ভাড়া বাকি। এখন যদি বিকাশ চৌধুরীর টাকা না থাকে, তাহলে আমাদের শাটডাউন করতে হবে।”
অদ্রিজ চুপচাপ শুনছিল। ভেতরে তার নিজেরও দ্বন্দ্ব চলছিল। স্বপ্নকে বাঁচাতে গিয়ে কি সে নিজের নীতিকে খুন করবে?
সিটি কানেক্টের নতুন চাল
ঠিক তখনই এল আরেক আঘাত। শহরের বড় মলে “সিটি কানেক্ট” বিশাল ইভেন্ট আয়োজন করল। লাইট, মিউজিক, সেলিব্রিটি উপস্থিতি—সব মিলিয়ে ধুমধাম। সংবাদমাধ্যমও হুড়মুড় করে হাজির।
তাদের মূল প্রচার স্লোগান ছিল—
“লোকালকে গ্লোবাল করো—সিটি কানেক্ট।”
অনেক দোকানদার সেই ইভেন্টে চুক্তি করল। যারা আগে “লোকাল লিংকস”-এ নাম লিখিয়েছিল, তারাও দোটানায় পড়ে গেল।
অদ্রিজ খবরটা পড়েই বুঝল, প্রতিদ্বন্দ্বীরা শুধু বাজার দখল করছে না, মন জয় করার চেষ্টা করছে।
শ্রেয়ার পরামর্শ
শ্রেয়া আবার এগিয়ে এল। এক রাতে ক্যাফেতে বসে সে বলল,
“অদ্রিজদা, আমি জানি তুমি চাপের মধ্যে আছো। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো—মানুষ সবসময় সত্যিকারের গল্পে বিশ্বাস করে। বড় কোম্পানি যতই টাকা খরচ করুক, তারা মানুষের হৃদয়কে ছুঁতে পারবে না। তোমরা সেটা পারো।”
অদ্রিজ ক্লান্ত গলায় বলল, “কিন্তু শ্রেয়া, টাকা ছাড়া গল্প বাঁচে না।”
শ্রেয়া হাসল, “গল্পের শক্তিকে ছোট করে দেখো না। আমি একটা নতুন ক্যাম্পেইন সাজাতে চাই—‘আমার দোকান, আমার গর্ব’। এখানে প্রতিটি দোকানদার নিজের গল্প নিজে বলবে। আমি ভিডিও বানাব, মানুষ শেয়ার করবে। এটা ফ্রি মার্কেটিং।”
অদ্রিজের চোখে আবার আলো ফুটল।
প্রথম বিশ্বাসঘাতকতা
কিন্তু টিমের ভেতরেই ভাঙন ধরতে শুরু করল। অভিজিৎ একদিন হঠাৎ অফিসে না এসে “সিটি কানেক্ট”-এর টেক টিমে যোগ দিল।
সে অদ্রিজকে একটা মেসেজ পাঠাল—
“আমাকে ক্ষমা করিস বন্ধু। আমি টাকার টানেই যাচ্ছি না, আমি যাচ্ছি কারণ ওদের হাতে রিসোর্স আছে। তুই যতই লড়িস, টিকতে পারবি না। আমি তোর প্রতি শুভেচ্ছা রইল।”
অদ্রিজ মেসেজটা পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। প্রণব রেগে গিয়ে বলল, “ও আমাদের বিশ্বাসঘাতকতা করল!”
অদ্রিজ শান্ত গলায় বলল, “না প্রণব, ওর দোষ নেই। এটা তার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমাদের কাজ থামবে না। আমরা লড়ব।”
বিকাশ চৌধুরীর আসল রূপ
অল্পদিনের মধ্যেই বিকাশ চৌধুরী তার দ্বিতীয় শর্ত সামনে রাখলেন।
“আমি চাই, সিটি কানেক্টের বিরুদ্ধে সরাসরি কড়া বিজ্ঞাপন দাও। বলো, তারা ভুয়ো, তারা বাইরের ব্র্যান্ড, তারা শহর চেনে না। আমি চাই তুমি তাদের কাঁপিয়ে দাও।”
অদ্রিজ আঁতকে উঠল। “কিন্তু স্যার, আমরা তো প্রতিযোগিতা চাই, শত্রুতা নয়।”
বিকাশ ধূর্ত হেসে বললেন, “ব্যবসা মানেই যুদ্ধ। শত্রু তৈরি না করলে জেতা যায় না।”
অদ্রিজ মনে মনে বুঝে গেল, এই স্পনসরশিপ আসলে এক ফাঁদ। বিকাশ চাইছেন তাকে নিজের স্বার্থের হাতিয়ার বানাতে।
ডায়েরির পাতা
সেই রাতে অদ্রিজ লিখল—
“আমরা শুরু করেছিলাম মানুষের বিশ্বাস জেতার জন্য। এখন বাজার চাইছে আমি সেই বিশ্বাসকে বিক্রি করি। এটা যদি মেনে নিই, তাহলে আমি আর অদ্রিজ থাকব না। আমি শুধু বিকাশ চৌধুরীর এক পুতুল হয়ে যাব।”
এক অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎ
এই টানাপোড়েনের মধ্যে একদিন এক অচেনা বৃদ্ধ তার অফিসে এলেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন—
“আমি শচীন দত্ত, বাগবাজারের পুরোনো মুদিখানার মালিক। তোমাদের গল্প পত্রিকায় পড়েছিলাম। আমি এসেছি শুধু বলার জন্য—হাল ছাড়ো না। আমাদের মতো লোকেদের জন্যই তো লড়ছো।”
তিনি একটি খামে কিছু টাকা এগিয়ে দিলেন। “এটা সামান্য সাহায্য। কিন্তু বিশ্বাস রাখো, শহর তোমাদের পাশে আছে।”
অদ্রিজ খামটা নিতে দ্বিধায় পড়ল। কিন্তু বৃদ্ধের চোখের দৃঢ়তা তাকে নীরব করে দিল।
শেষ দৃশ্য
সেদিন রাতে অদ্রিজ ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। বিকাশের ফাঁদ, সিটি কানেক্টের ঝড়, টিমের ভাঙন—সবকিছু একসাথে তার কাঁধে চেপে বসেছে।
কিন্তু বৃদ্ধ শচীনের কথা তার কানে বাজল—“শহর তোমাদের পাশে আছে।”
অদ্রিজ ডায়েরিতে লিখল—
“টাকা দিয়ে সবকিছু কেনা যায় না। বিশ্বাসের দাম টাকার চেয়ে বেশি। আমি ফাঁদের পথে হাঁটব না। আমি লড়ব আমার নীতি নিয়ে।”
পর্ব ৬: সংঘর্ষের মুখোমুখি
অদ্রিজ বসু সিদ্ধান্ত নিল—বিকাশ চৌধুরীর ফাঁদে সে পা দেবে না। ব্যবসা মানেই লড়াই, কিন্তু সেই লড়াই যদি নীতিকে হত্যা করে, তাহলে তার শুরু করার কোনো মানেই ছিল না।
প্রত্যাখ্যান
বিকাশ চৌধুরীর রেস্তরাঁয় গিয়ে অদ্রিজ শান্ত গলায় বলল,
“স্যার, আপনার সাহায্যের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই আমাদের প্ল্যাটফর্মকে শত্রুতা ছড়ানোর হাতিয়ার করতে পারি না। আমরা চাই শহরের সব দোকান সমানভাবে সুযোগ পাক।”
বিকাশের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে বললেন,
“ভেবে বলছো? আমি চাইলে তোমাদের সার্ভার একদিনে বন্ধ হয়ে যাবে। আমার হাতে মানুষ আছে, টাকা আছে। আমার বিরুদ্ধাচরণ করা মানে তোমার নিজের কবর খোঁড়া।”
অদ্রিজ দৃঢ় গলায় বলল,
“হয়তো তাই। কিন্তু আমি আমার স্বপ্ন বিক্রি করব না।”
রেস্তরাঁ থেকে বেরোনোর সময় অদ্রিজের মনে হচ্ছিল যেন শীতল বাতাস বুকে ছুরি চালাচ্ছে। সে জানত, এখন থেকে যুদ্ধটা হবে ব্যক্তিগত।
অফিসে সংকট
অফিসে ফিরে প্রণব খবর দিল, “দুইটা দোকান আজ নাম তুলে নিয়েছে। তারা বলছে, সিটি কানেক্ট তাদের বিনামূল্যে দিচ্ছে যেটা আমরা টাকা নিয়ে দিচ্ছি।”
অদ্রিজ মাথা চেপে ধরল। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছিল। এর ওপর অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর টেক টিম কার্যত ভেঙে পড়েছে। সার্ভারে বারবার সমস্যা হচ্ছে।
“আমরা কি একেবারেই হারছি, প্রণব?” সে জিজ্ঞেস করল।
প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “না, কিন্তু এইভাবে চালাতে গেলে একমাসের মধ্যে লোন ডিফল্ট করব।”
অদ্রিজ চুপ করে থাকল। তার মনে হচ্ছিল চারদিক থেকে দেয়াল চাপা দিচ্ছে।
শ্রেয়ার অনুপ্রেরণা
ঠিক তখন শ্রেয়া অফিসে এল। হাতে নিয়ে এসেছে একটা ইউএসবি ড্রাইভ।
“দেখো,” সে বলল, “আমরা কিছু দোকানদারের গল্প রেকর্ড করেছি। আমি সেগুলো কেটে-ছেঁটে একটা ছোট ডকুমেন্টারি বানিয়েছি। নাম দিয়েছি—‘শহরের মুখ’। এটা ইউটিউবে দিলে মানুষ বুঝবে তোমরা কী করতে চাইছো।”
অদ্রিজ ল্যাপটপে ভিডিও চালাল। পর্দায় ফুটে উঠল সেই বিধবা নারী যিনি একা দোকান চালাচ্ছেন, সেই তরুণ যে পড়াশোনার পাশাপাশি দোকান সামলাচ্ছে, আর শচীন দত্তর মুদিখানা। প্রতিটি গল্প মানুষের হৃদয়ে হাত রাখার মতো।
অদ্রিজের চোখ ভিজে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, “এটাই আমাদের শক্তি। গল্প।”
ভিডিওর প্রতিক্রিয়া
ডকুমেন্টারিটি আপলোড হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল। হাজার হাজার ভিউ, শত শত কমেন্ট। মানুষ বলছে—
“এই তো আসল কলকাতা।”
“লোকাল লিংকস আমাদের শহরকে বাঁচাচ্ছে।”
একটি স্থানীয় নিউজ চ্যানেল পর্যন্ত খবর করল—
“স্টার্টআপের অনন্য উদ্যোগ: শহরের দোকানের গল্প বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছে লোকাল লিংকস।”
অ্যাপ ডাউনলোডের সংখ্যা হঠাৎ করেই বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
প্রথম সরাসরি আঘাত
কিন্তু ঠিক তখনই এল সিটি কানেক্টের প্রথম সরাসরি আঘাত। এক রাতে অফিসে ঢুকে দেখল সার্ভার পুরোপুরি ডাউন। লগ চেক করে বোঝা গেল—ডিডিওএস আক্রমণ। অর্থাৎ ইচ্ছে করেই কেউ তাদের সার্ভার ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
প্রণব ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “এটা নিছক কাকতালীয় নয়। ওদের হাত ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে?”
অদ্রিজ দাঁত চেপে বলল, “ওরা চাইছে আমরা হার মানি। কিন্তু আমরা থামব না।”
তবে টেক টিম না থাকায় সমস্যাটা সামলানো কঠিন হয়ে উঠল। অদ্রিজ মরিয়া হয়ে এক ফ্রিল্যান্স ইঞ্জিনিয়ারকে ভাড়া করল। সে তিন রাত জেগে সার্ভার মেরামত করল।
প্রথম বড় মিছিল
এইসবের মধ্যেই অদ্রিজ নিল এক সাহসী সিদ্ধান্ত। সে আয়োজন করল “লোকাল বিজনেস ওয়াক”—শহরের দোকানদার আর গ্রাহকদের নিয়ে এক মিছিল। পোস্টার হাতে লেখা—
“শহর বাঁচাও, লোকালকে বাঁচাও।”
হাজার মানুষ সেই মিছিলে শামিল হলো। রাস্তায় স্লোগান উঠল—
“লোকাল দোকান, লোকাল প্রাণ!”
“আমাদের গল্প, আমাদের গর্ব!”
মিডিয়া আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল। অদ্রিজ মাইকে বলল,
“আমরা শুধু একটা অ্যাপ নই। আমরা শহরের কণ্ঠস্বর।”
বিকাশ চৌধুরীর পাল্টা চাল
মিছিলের ছবি সংবাদপত্রে বেরোতেই বিকাশ চৌধুরীর ফোন এল। গলায় কড়া সুর,
“অদ্রিজবাবু, তুমি আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছো। এখন দেখবে তার ফল। তোমার দোকানদাররা একে একে আমার দিকেই আসবে।”
অদ্রিজ শান্তভাবে বলল, “হয়তো তাই হবে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, যারা আমাদের বুঝেছে, তারা আমাদের ছাড়বে না।”
ফোন কেটে গেল। কিন্তু বুকের ভেতর একটা শীতল স্রোত বইতে লাগল।
ব্যক্তিগত আঘাত
সেই রাতেই হঠাৎ তার মায়ের শরীর খারাপ হলো। হাই ব্লাড প্রেশারের কারণে হাসপাতালে ভর্তি করতে হলো। অদ্রিজ সারা রাত হাসপাতালের করিডরে বসে থাকল। তার মনে হলো, এতদিন স্বপ্নের পেছনে ছুটতে গিয়ে সে মায়ের দিকে খেয়ালই রাখেনি।
ভোরে মা হাত ধরে বললেন,
“অদ্রিজ, তুই যা করছিস কর, কিন্তু মনে রাখিস, পরিবারই আসল শক্তি। সব হারিয়ে যদি একা হয়ে যাস, তাহলে কোনো জেতার মানে হয় না।”
অদ্রিজ মাথা নেড়ে মায়ের হাত চেপে ধরল।
একটা অপ্রত্যাশিত সহযোগিতা
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দেখল অফিসে প্রণব এক নতুন লোককে নিয়ে বসে আছে। নাম সায়ন। সে সাইবার সিকিউরিটির বিশেষজ্ঞ।
“আমি ডকুমেন্টারি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি,” সায়ন বলল। “আমি চাই স্বেচ্ছায় তোমাদের সাহায্য করতে। সিটি কানেক্ট যদি আবার আক্রমণ করে, আমি প্রতিরোধ করব।”
অদ্রিজ হাসল। “তুমি বুঝতে পারছো, এতে ঝুঁকি আছে?”
সায়ন মাথা নেড়ে বলল, “ঝুঁকি ছাড়া জয় নেই।”
শেষ দৃশ্য
রাতে অদ্রিজ ছাদে দাঁড়িয়ে শহরের দিকে তাকাল। নীচে আলো ঝলমল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত অন্ধকার আরও ঘনিয়ে আসছে।
ডায়েরিতে লিখল—
“আজ আমি বুঝলাম, ব্যবসা শুধু টাকা বা গ্রাহকের খেলা নয়। এটা মানুষের সম্পর্ক, তাদের ভালোবাসা, তাদের ভরসার খেলা। শত্রুরা যতই আঘাত করুক, যদি শহর আমার পাশে থাকে, আমি হারব না।”
সে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। যেন বলল—
“এসো, সংঘর্ষ। আমি প্রস্তুত।”
পর্ব ৭: ষড়যন্ত্রের আঁচ
সায়নের আগমনে যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল “লোকাল লিংকস”-এর টিম। অফিসের বাতাসে আবার আশা ভাসতে লাগল। সে সার্ভারের সিকিউরিটি আপগ্রেড করল, নতুন ফায়ারওয়াল বসাল, এমনকি একটি মনিটরিং সিস্টেম বানাল যাতে আক্রমণ হলে সঙ্গে সঙ্গে সতর্কবার্তা পাওয়া যায়।
অদ্রিজ হাসিমুখে বলল, “তুমি আমাদের ভরসা ফিরিয়ে দিয়েছো।”
সায়ন শান্ত গলায় উত্তর দিল, “আমি কেবল আমার শহরের জন্য কাজ করছি।”
কিন্তু ঠিক যখন টিম নতুন করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখনই এলো সেই আঘাত—যা “লোকাল লিংকস”-এর অস্তিত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিল।
অপ্রত্যাশিত সংবাদ
এক সকালে অফিসে ঢুকেই প্রণব খবর দিল,
“অদ্রিজ, আজ পত্রিকায় দেখেছিস? আমাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে।”
অদ্রিজ চমকে উঠল। “কিসের অভিযোগ?”
প্রণব পত্রিকার শিরোনাম পড়ল—
“লোকাল লিংকসের নামে প্রতারণা: ছোট দোকানদারদের অভিযোগ।”
অদ্রিজ বিস্ময়ে পত্রিকা ছিনিয়ে নিল। তাতে লেখা—কয়েকজন দোকানদার দাবি করছেন, অ্যাপে তাদের নাম রাখার জন্য বেশি টাকা নেওয়া হয়েছে, অথচ প্রতিশ্রুতি মতো গ্রাহক পাওয়া যায়নি।
অদ্রিজ অবাক হয়ে বলল, “কীভাবে সম্ভব? আমরা তো সব রেকর্ড পরিষ্কার রেখেছি।”
সায়ন গম্ভীর মুখে বলল, “এটা হয়তো ভেতর থেকে কেউ করছে, অথবা বাইরের ষড়যন্ত্র।”
শহরের আস্থা টলে ওঠা
সংবাদটি ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হলো সমস্যা। কয়েকজন গ্রাহক ফোন করে রেগে বলল,
“আপনারা কি সত্যিই দোকানদারদের ঠকাচ্ছেন?”
“আমাদের টাকা কি নিরাপদ?”
অদ্রিজ বুঝতে পারল, প্রতিদ্বন্দ্বীরা এবার অন্য চাল চালছে। তারা চাইছে শহরের চোখে তাদের বিশ্বাস নষ্ট করতে।
অভিযুক্ত দোকানদারদের সাথে দেখা
অদ্রিজ স্বয়ং গেল সেই দোকানদারদের কাছে, যারা অভিযোগ করেছেন। একজন বললেন,
“আমরা শুনেছিলাম অ্যাপে নাম রাখলে বিক্রি বাড়বে। কিন্তু আপনারা টাকা নিয়ে কোনও গ্রাহক পাঠাননি।”
অদ্রিজ শান্ত গলায় বলল, “স্যার, আমরা কখনও গ্রাহক পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিইনি। আমরা শুধু দোকানকে প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরি। গ্রাহকরা নিজেরাই খোঁজ করে আসে। হয়তো প্রচার কম হয়েছে।”
কিন্তু দোকানদার মাথা নাড়লেন, “আমাদের মনে হচ্ছে কেউ আমাদের ভুল পথে চালাচ্ছে। আপনার অ্যাপে নাম রাখলে ক্ষতি।”
অদ্রিজ বুঝল—এটা নিছক অসন্তোষ নয়, এর পেছনে কেউ আছে।
সায়নের তদন্ত
অফিসে ফিরে সায়ন লগ চেক করল। কিছুক্ষণ পর বলল,
“অদ্রিজ, অদ্ভুত কিছু পেয়েছি। কয়েকটা ভুয়ো অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে, যেগুলো দিয়ে দোকানদারদের কাছে ভুয়ো ইমেইল পাঠানো হয়েছে। তাতে লেখা—লোকাল লিংকস প্রিমিয়াম সার্ভিস চাইলে আলাদা টাকা দিতে হবে।”
প্রণব রেগে গিয়ে বলল, “মানে কেউ আমাদের নাম ভাঙিয়ে টাকা তুলছে!”
সায়ন মাথা নেড়ে বলল, “এবং সেই ভুয়ো অ্যাকাউন্টগুলো তৈরি করা হয়েছে খুব দক্ষভাবে। আমি ট্রেস করে দেখলাম, সার্ভার লোকেশন বাইরে থেকে হলেও, আইপি বারবার ঘুরে ফিরে আসছে একই জায়গায়—সিটি কানেক্টের ডেটা সেন্টারের কাছ থেকে।”
অদ্রিজ দাঁত চেপে বলল, “তাহলে এটা তাদের ষড়যন্ত্র।”
মিডিয়ার মুখোমুখি
পরদিন এক সংবাদ সংস্থা অফিসে এসে অদ্রিজকে ক্যামেরার সামনে প্রশ্ন করল,
“আপনাদের বিরুদ্ধে দোকানদারদের প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?”
অদ্রিজ মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে বলল,
“লোকাল লিংকস কখনও প্রতারণা করেনি। আমরা ছোট দোকানদারদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কাজ করছি। কিন্তু কিছু ভুয়ো ইমেইল আমাদের নামে পাঠানো হয়েছে, যা আমরা তদন্ত করছি। আমরা প্রমাণ করব, এটা ষড়যন্ত্র।”
তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। সংবাদমাধ্যমে সেই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ল। কিছু মানুষ আবার বিশ্বাস ফিরে পেল, কিন্তু অনেকেই সন্দিহান রইল।
টিমের ভাঙন
ঠিক তখনই আরেকটা ধাক্কা এলো। প্রণব একদিন অফিসে এসে বলল,
“অদ্রিজ, আমি আর পারছি না। ব্যাংক আমার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে চাপ দিচ্ছে। পরিবারও চাইছে আমি এই ঝুঁকি ছাড়ি। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি।”
অদ্রিজ স্তব্ধ হয়ে গেল। “তুইও যাচ্ছিস?”
প্রণব চোখ নামিয়ে বলল, “ক্ষমা করিস। তোর বিশ্বাস আছে, আমার নেই। আমি চাই না ডুবে মরি।”
অদ্রিজ কিছু বলল না। শুধু চুপচাপ প্রণবকে চলে যেতে দেখল।
এখন টিমে সে আর সায়ন, সাথে কয়েকজন পার্ট-টাইম স্টাফ। তবুও সে হাল ছাড়ল না।
শ্রেয়ার দৃঢ়তা
শ্রেয়া এসে বলল,
“অদ্রিজদা, মানুষ যদি সন্দেহ করে, তাহলে আমাদের আরও বেশি করে সত্যটা দেখাতে হবে। আমি চাই নতুন ডকুমেন্টারি বানাতে। যেখানে দোকানদাররা নিজেরাই বলবেন, তোমরা তাদের ঠকাওনি। তারা দেখাবে, কীভাবে তোমাদের প্ল্যাটফর্মে তারা উপকৃত হয়েছে।”
অদ্রিজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তুই কি জানিস, এতে তোকেও টার্গেট করা হতে পারে?”
শ্রেয়া হাসল, “ভয় পেলে স্বপ্ন পূরণ হয় না।”
হঠাৎ আক্রমণ
ডকুমেন্টারি বানানোর কাজ শুরু হলো। কিন্তু তার মাঝেই একদিন রাতে অফিসে আগুন লেগে গেল।
পুলিশ বলল, এটা হয়তো শর্ট সার্কিট। কিন্তু সায়ন ল্যাপটপে ক্যামেরা ফুটেজ ঘেঁটে বলল,
“না, এটা ইচ্ছাকৃত। দু’জন অচেনা লোক অফিসে ঢুকেছিল, তারাই আগুন ধরিয়েছে।”
অদ্রিজ বুক চাপড়ে বলল, “তারা চায় আমরা পুরোপুরি ধ্বংস হই।”
সৌভাগ্যক্রমে মূল সার্ভার আলাদা জায়গায় রাখা থাকায় ডেটা বেঁচে গেছে। কিন্তু অফিস ভস্মীভূত।
অদ্রিজের মনের ঝড়
রাতে ছাদে দাঁড়িয়ে অদ্রিজ ডায়েরি খুলল। লিখল—
“বন্ধুরা চলে যাচ্ছে, টিম ভেঙে পড়ছে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা ষড়যন্ত্র করছে। শহরও কখনও সন্দেহ করছে। তবু আমি থামব না। কারণ আমি জানি, সত্যির পক্ষে লড়াই সবসময় কঠিন। আমি একা হলেও লড়ব।”
শেষ দৃশ্য
সেদিনই ফোন এলো এক অচেনা নাম্বার থেকে। গলায় হুমকির সুর—
“বসু বাবু, তুমি যতই লড়ো, শহর তোমার হবে না। যদি থামো না, এবার শুধু ব্যবসা নয়, জীবনও যাবে।”
অদ্রিজ ফোন রেখে চোখ বন্ধ করল। ভয় শরীর কাঁপালেও তার ভেতরের আগুন আরও জ্বলে উঠল।
সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এসো ষড়যন্ত্র। আমি এখনও দাঁড়িয়ে আছি।”
পর্ব ৮: আইনের কাঠগড়ায়
অফিস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। চারদিকে কালো ধোঁয়ার গন্ধ, ভাঙা চেয়ার-টেবিলের স্তূপ, আর ছাইয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা পোড়া কাগজের টুকরো। অদ্রিজ দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। চোখের সামনে যেন এক মুহূর্তে ভেঙে পড়েছে সব পরিশ্রম। সায়ন এসে কাঁধে হাত রাখল, “সব শেষ হয়ে যায়নি, ডেটা বেঁচে গেছে। আবার শুরু করা যাবে।”
অদ্রিজ নিঃশ্বাস ফেলল, “কিন্তু লড়াই তো শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে নয়, এখন আগুনও আমাদের শত্রু।”
ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ি এসে থামল। দু’জন অফিসার এগিয়ে এসে বললেন,
“আপনিই কি অদ্রিজ বসু?”
“হ্যাঁ,” অদ্রিজ উত্তর দিল।
“আপনার বিরুদ্ধে প্রতারণা ও অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। কয়েকজন দোকানদার লিখিত অভিযোগ করেছেন যে, আপনার অ্যাপের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে বেআইনি টাকা নেওয়া হয়েছে।”
অদ্রিজ হতবাক হয়ে গেল। “কিন্তু এটা মিথ্যে! আমরা কোনও প্রতারণা করিনি।”
অফিসার ঠান্ডা গলায় বলল, “আপনাকে থানায় যেতে হবে। তদন্ত চলবে।”
থানার রাত
সেই রাতটা অদ্রিজ কাটাল থানার লোহার খাটে বসে। চারিদিকে অপরাধীদের কোলাহল, পুলিশদের গম্ভীর মুখ। তার মাথায় বারবার ঘুরছিল—এটা সব সিটি কানেক্টের খেলা।
শ্রেয়া দৌড়ে এল থানায়। চোখ ভিজে গেছে কান্নায়।
“অদ্রিজদা, তুমি কিছু করনি আমি জানি। কিন্তু এখন কী হবে?”
অদ্রিজ শান্ত গলায় বলল, “আইনই ঠিক করবে। আমি ভয় পাচ্ছি না।”
সায়নও এল, বলল, “আমি প্রমাণ জোগাড় করছি। ওই ভুয়ো অ্যাকাউন্ট আর মেইলের ট্র্যাকিং রিপোর্ট পুলিশের হাতে তুলে দেব। তাতে পরিষ্কার হবে এটা আমাদের কাজ নয়।”
পুলিশ প্রথমে গুরুত্ব দেয়নি, কিন্তু সায়নের টেকনিক্যাল প্রমাণ দেখে তারা অবাক হলো।
মিডিয়ার ঝড়
ঘটনাটা সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ল। শিরোনাম উঠল—
“লোকাল লিংকসের প্রতিষ্ঠাতা গ্রেফতার: প্রতারণার অভিযোগ।”
মানুষ দ্বিধায় পড়ে গেল। কেউ বলল, “হয়তো সত্যিই প্রতারণা করেছে।” কেউ আবার বলল, “এটা স্পষ্ট ষড়যন্ত্র।”
অদ্রিজ বুঝল, এবার লড়াই শুধু ব্যবসার নয়, তার ব্যক্তিগত সম্মানও ঝুঁকির মুখে।
আদালতের প্রথম দিন
কয়েকদিন পর তাকে আদালতে হাজির করা হলো। বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলল,
“আমরা কোনো প্রতারণা করিনি। এটা প্রতিদ্বন্দ্বীদের ষড়যন্ত্র।”
বিচারক শান্তভাবে বললেন, “প্রমাণ দিন।”
সায়ন কোর্টে প্রেজেন্টেশন দেখাল—ভুয়ো ইমেইলের ট্রেস, আইপি অ্যাড্রেস, সার্ভারের লগ।
বিচারক বললেন, “তদন্ত চলবে। আপাতত শর্তসাপেক্ষে জামিন দেওয়া হলো।”
অদ্রিজ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। কিন্তু জানত, লড়াই এখানেই শেষ নয়।
শহরের সমর্থন
আদালতের পরদিনই এক আশ্চর্য দৃশ্য ঘটল। গড়িয়াহাট থেকে শ্যামবাজার—বিভিন্ন দোকানদাররা নিজেরাই পোস্টার লাগাল—
“লোকাল লিংকস আমাদের গর্ব।”
শচীন দত্ত, সেই মুদিখানার বৃদ্ধ, টেলিভিশনে এসে বললেন,
“অদ্রিজ আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন আমাদের পালা ওর পাশে দাঁড়ানোর।”
এই সমর্থন দেখে অদ্রিজের চোখ ভিজে গেল। শহর বুঝিয়ে দিল, তারা এখনও বিশ্বাস রাখে।
বিকাশ চৌধুরীর হুঁশিয়ারি
ঠিক তখনই বিকাশ চৌধুরীর ফোন এলো। গলায় কড়া সুর,
“তুমি ভেবেছিলে আদালত থেকে বেরিয়ে বাঁচে গেছো? ভুল করছো। এই শহরে শুধু টাকা কথা বলে, নীতি নয়।”
অদ্রিজ দৃঢ় গলায় বলল, “হয়তো তাই। কিন্তু আমি টাকা দিয়ে শহর কিনতে চাই না, আমি চাই শহর আমাকে নিজের মতো করে গ্রহণ করুক।”
বিকাশ হেসে বললেন, “তাহলে প্রস্তুত থেকো, পরের আঘাত আসছে।”
নতুন অফিস
অদ্রিজ আর সায়ন মিলে একটি ছোট্ট গুদামঘর ভাড়া নিল নতুন অফিস হিসেবে। ছেঁড়া চেয়ার, খালি দেয়াল, একটা টেবিল—এই দিয়েই আবার শুরু হলো কাজ।
শ্রেয়া বলল, “এটা তো সিনেমার মতো! আগুনে ভস্মীভূত থেকে আবার উঠছে।”
অদ্রিজ হেসে বলল, “ফিনিক্সও তো ছাই থেকে জন্মায়।”
প্রশাসনের চাপ
কিন্তু এবার প্রশাসনও চাপে ফেলতে শুরু করল। নানা লাইসেন্স, নথিপত্র, ট্যাক্সের কাগজপত্র—প্রতিদিন নতুন নতুন চিঠি আসছে। যেন ইচ্ছে করেই ঝামেলা তৈরি করা হচ্ছে।
সায়ন বলল, “এটা স্পষ্ট যে কারও প্রভাবে হচ্ছে। হয়তো সিটি কানেক্ট বা বিকাশ।”
অদ্রিজ চুপ করে বসে থাকল। তার মনে হলো, বাজারের লড়াই এখন আর কেবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার নয়, এটা একেবারে রাজনৈতিক খেলায় রূপ নিচ্ছে।
শ্রেয়ার নতুন পরিকল্পনা
এই পরিস্থিতিতেই শ্রেয়া প্রস্তাব দিল,
“আমরা এক পাবলিক মিটিং আয়োজন করি। যেখানে দোকানদার আর গ্রাহকরা সরাসরি বলবেন, লোকাল লিংকস তাদের কীভাবে সাহায্য করেছে। মিডিয়াকে ডাকব, প্রশাসনকে ডাকব। সবাইকে চোখের সামনে সত্য দেখাতে হবে।”
অদ্রিজ কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “এটাই একমাত্র পথ। আমাদের লড়াই এখন জনতার আদালতে।”
শেষ দৃশ্য
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে অদ্রিজ ডায়েরি লিখল—
“আজ বুঝলাম, ব্যবসা শুধু বাজারের লড়াই নয়। এটা আইনের, প্রশাসনের, রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ। কিন্তু যদি শহর আমার পাশে থাকে, তবে কোনও ক্ষমতা আমাকে থামাতে পারবে না।”
তার চোখে আবার সেই আগুন জ্বলে উঠল।
পর্ব ৯: জনতার আদালত
কলকাতার শহরে এক অভূতপূর্ব আয়োজন হলো। গড়িয়াহাট মোড়ে বড় মাঠে “লোকাল লিংকস”-এর ডাক—জনতার সভা। উদ্দেশ্য স্পষ্ট: শহরের সামনে প্রমাণ করা যে তারা প্রতারক নয়, বরং মানুষেরই বন্ধু।
বড় মঞ্চ তৈরি হলো, ব্যানারে লেখা—
“আমার দোকান, আমার গর্ব—লোকাল লিংকস।”
দোকানদার, গ্রাহক, ছাত্রছাত্রী—শত শত মানুষ ভিড় করল। টেলিভিশনের ক্যামেরা, সংবাদপত্রের সাংবাদিকরা হাজির। পুলিশের ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে, প্রশাসনের নজরদারিতে অনুষ্ঠান চলছে।
অদ্রিজ বসু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করল। আলো তার মুখে পড়তেই চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
অদ্রিজের বক্তব্য
“বন্ধুরা,” সে শুরু করল, “আজ আমি আদালতে নই, থানায় নই—আমি দাঁড়িয়ে আছি তোমাদের সামনে। কারণ তোমরাই আমাদের বিচারক।
লোকাল লিংকস শুরু হয়েছিল এক স্বপ্ন নিয়ে—এই শহরের ছোট দোকানগুলিকে বাঁচানোর স্বপ্ন। কিন্তু কেউ কেউ বলছে, আমরা প্রতারক। আমরা টাকা নিয়ে মানুষকে ঠকাচ্ছি।
আমি আজ বলছি—আমরা কোনও প্রতারণা করিনি। আমরা শুধু একটিই কাজ করেছি, তোমাদের গল্প শোনাতে চেষ্টা করেছি। শহরের প্রতিটি দোকানের পেছনে যে ঘাম, যে কষ্ট, যে ইতিহাস, সেই গল্পগুলো সবাইকে জানাতে চেয়েছি।
কিন্তু বড় বড় কোম্পানি, যাদের হাতে টাকা আর প্রভাব আছে, তারা চাইছে আমাদের বিশ্বাস ভাঙতে। তারা চায় এই শহর শুধু তাদের শাসনে চলুক।
আমি বলছি—না। এই শহর আমাদের। তোমাদের।”
তার কণ্ঠে আগুন ছিল। ভিড় থেকে হাততালি উঠল। কয়েকজন দোকানদার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “অদ্রিজ সত্যি বলছে। ও আমাদের পাশে ছিল।”
দোকানদারদের কণ্ঠস্বর
মঞ্চে প্রথম উঠলেন শচীন দত্ত, সেই বাগবাজারের মুদিখানার বৃদ্ধ। মাইকে কাঁপা গলায় বললেন,
“আমি এই বয়সে ব্যবসা চালাচ্ছি। আমার দোকানকে নতুন গ্রাহক দিয়েছে অদ্রিজ। ও প্রতারক নয়, ও আমাদের সন্তান।”
তারপর উঠলেন এক তরুণী—মুক্তা। বিধবা হয়েও যিনি দোকান চালাচ্ছেন।
“লোকাল লিংকস ছাড়া আমি দাঁড়াতে পারতাম না। ওরা আমার গল্প সবার কাছে পৌঁছে দিয়েছে।”
মঞ্চে একে একে আরও কয়েকজন দোকানদার উঠলেন। তারা সবাই প্রমাণ দিলেন, লোকাল লিংকস তাদের ঠকায়নি, বরং সাহায্য করেছে।
মিডিয়ার ক্যামেরা সব রেকর্ড করছিল। মানুষের চোখে জল, করতালিতে মাঠ ভরে উঠছিল।
অদ্ভুত বিশৃঙ্খলা
সব কিছু সুন্দরভাবে চলছিল। হঠাৎ করেই ভিড়ের ভেতর থেকে কয়েকজন লোক চেঁচিয়ে উঠল—
“লোকাল লিংকস প্রতারক! প্রতারক!”
তারা হাতে ব্যানার তুলল, যেখানে লেখা—“লোকাল লিংকস আমাদের ঠকিয়েছে।”
ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু হলো। সাংবাদিকরা মাইক্রোফোন এগিয়ে দিল। পুলিশ এগিয়ে এলো।
অদ্রিজ বুঝল, এটা সাজানো খেলা। সিটি কানেক্টের ভাড়া করা লোকজন। তারা চাইছে সভা ভেঙে পড়ুক।
সে মাইকে চিৎকার করে বলল,
“ভাইয়েরা, তোমরা যদি সত্যিই প্রতারিত হও, তবে প্রমাণ দাও। আমাদের প্ল্যাটফর্মে সব রেকর্ড আছে। কিন্তু যদি তোমরা টাকা খেয়ে মিথ্যে বলো, তবে জানো—এই শহর তোমাদের বিশ্বাস করবে না।”
ভিড় থেকে আওয়াজ উঠল, “হ্যাঁ, প্রমাণ দাও! প্রমাণ!”
চেঁচানো লোকগুলো প্রমাণ দিতে পারল না। পুলিশ তাদের ভিড় থেকে বের করে দিল।
বিস্ফোরণ
কিন্তু ঠিক তখনই ঘটে গেল ভয়ঙ্কর ঘটনা। মঞ্চের পিছন দিক থেকে হঠাৎ এক বিস্ফোরণ হলো। কালো ধোঁয়া আকাশে উঠল, মানুষ চিৎকার করে দৌড়াতে লাগল। আতঙ্কে মাঠ ফাঁকা হতে লাগল।
অদ্রিজ ছুটে গিয়ে দেখল, বিস্ফোরণে কয়েকজন আহত হয়েছে। রক্তাক্ত মুখে একজন মাটিতে পড়ে কাঁদছে।
শ্রেয়া চিৎকার করে বলল, “এটা হামলা! কেউ আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে!”
পুলিশ দ্রুত এলাকা ঘিরে ফেলল। সাংবাদিকরা লাইভ টেলিকাস্ট করতে লাগল—
“লোকাল লিংকসের জনসভায় বিস্ফোরণ, আতঙ্কে শহর।”
অদ্রিজ হতবাক দাঁড়িয়ে ছিল। তার স্বপ্নের মঞ্চ রক্তে ভিজে যাচ্ছে।
অভিযোগের তীর
কিন্তু কয়েক মিনিটের মধ্যেই অদ্রিজের কানে এলো আরও ভয়ঙ্কর খবর। মাঠে থাকা কয়েকজন বলছে—
“বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে লোকাল লিংকস-ই! সহানুভূতি পাওয়ার জন্য নিজেরাই নাটক করেছে।”
অদ্রিজ চোখ মেলে তাকাল। এ তো আরও বড় ষড়যন্ত্র। এখন শুধু প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রমণ নয়, তার বিরুদ্ধে সরাসরি সন্ত্রাসবাদী অভিযোগ উঠছে।
পুলিশ এসে বলল, “বসু বাবু, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে। তদন্ত চলবে।”
থানায় দ্বিতীয়বার
আবার সেই লোহার খাট, আবার সেই ঠান্ডা দেয়াল। এবার পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। আগেরবার ছিল প্রতারণার অভিযোগ, এবার সন্ত্রাসবাদ আর বিস্ফোরণের মামলা।
শ্রেয়া ভাঙা গলায় বলল, “অদ্রিজদা, তুমি তো জানো, এটা ওদের ষড়যন্ত্র। কিন্তু মানুষ যদি বিশ্বাস করে তুমি দায়ী, তাহলে সব শেষ।”
অদ্রিজ মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি। কিন্তু সত্য একদিন বের হবেই।”
সায়ন থানায় বসে বলল, “আমি লগ চেক করছি। বিস্ফোরণের আগে আশেপাশে কারা ফোনে কল করেছিল, লোকেশন ডেটা বের করার চেষ্টা করছি। আমি শপথ করছি, সত্য প্রমাণ করব।”
শহরের দ্বিধা
এবার শহর দ্বিধায় পড়ে গেল। কেউ বলল, “অদ্রিজকে ফাঁসানো হচ্ছে।” আবার কেউ বলল, “না, হয়তো সত্যিই নাটক করেছে।”
সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বয়ে গেল। হ্যাশট্যাগে লেখা হলো—#SaveLocalLinks এবং #FraudLocalLinks—দুটি পক্ষই লড়াই করছে।
অদ্রিজ জানল, এবার শুধু ব্যবসা নয়, তার জীবনও ঝুঁকির মুখে।
শেষ দৃশ্য
রাত গভীর। থানার সেলে বসে অদ্রিজ ডায়েরি লিখছিল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু হাতে কলম থামেনি।
“আজ রক্ত ঝরল। আমি জানি, এটা আমি করিনি। কিন্তু দুনিয়া কি আমাকে বিশ্বাস করবে?
ব্যবসার যুদ্ধ এখন হয়ে গেছে জীবনের যুদ্ধ।
তবু আমি হার মানব না। কারণ যদি আজ আমি ভেঙে পড়ি, তাহলে শহর বিশ্বাস হারাবে। আর বিশ্বাস হারালে শহরই মরে যাবে।”
সে জানত, কাল সকালেই তার ভাগ্য নির্ধারণ হবে।
পর্ব ১০: চূড়ান্ত লড়াই
রাতটা কাটল অদ্রিজ বসুর জন্য এক অনন্ত অন্ধকারে। থানার সেলের ভেতর ঘড়ির কাঁটা যেন থেমে গিয়েছিল। মাথার ভেতরে শুধু ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন—আগামীকাল কি তার শেষ ভোর?
সে জানত, যদি বিস্ফোরণের দায় তার ওপর চাপানো হয়, তাহলে শুধু ব্যবসাই নয়, তার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সে আরও জানত, সত্যি কখনও লুকিয়ে থাকে না।
সকালের আলো
ভোরের আলো ঢুকতেই সায়ন থানায় হাজির হলো। হাতে ল্যাপটপ, চোখে রাত জাগার ক্লান্তি।
“অদ্রিজ, আমি প্রমাণ পেয়েছি।”
অদ্রিজ বিস্ময়ে তাকাল। “কী প্রমাণ?”
সায়ন বলল, “বিস্ফোরণের আগে আশেপাশের ফোন টাওয়ারের লোকেশন ডেটা ট্রেস করেছি। যে লোকগুলো ভিড়ের মধ্যে বিশৃঙ্খলা শুরু করেছিল, তাদের ফোন একসময় সিটি কানেক্টের অফিসের কাছেই ধরা পড়েছে। আরেকটা ব্যাপার—একজন বিস্ফোরণ ঘটানোর আগে বিকাশ চৌধুরীর রেস্তরাঁ থেকে কল পেয়েছিল।”
অদ্রিজের বুক কেঁপে উঠল। “মানে সব পরিষ্কার!”
সায়ন মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি এই ডেটা পুলিশের হাতে তুলে দেব। কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের খুব দ্রুত এটা মিডিয়ার সামনে আনতে হবে। নইলে তারা গোপন করে ফেলবে।”
আদালতের দিন
সেদিন দুপুরে আদালতে অদ্রিজকে হাজির করা হলো। কোর্টরুম ভর্তি সাংবাদিক, দোকানদার, সাধারণ মানুষ। বিচারক কঠিন মুখে বললেন,
“প্রমাণ আছে যে বিস্ফোরণ সভায় ঘটেছে। অভিযুক্ত অদ্রিজ বসুর বিরুদ্ধে অভিযোগ—জনসাধারণকে বিপদে ফেলা। এখন তাকে কেন দায়ী করা হবে না?”
পুরো কোর্টরুম নিস্তব্ধ।
ঠিক তখনই সায়ন দাঁড়িয়ে বলল, “আমার কাছে প্রমাণ আছে।”
সে ল্যাপটপে প্রজেকশন চালাল। স্ক্রিনে দেখা গেল লোকেশন ডেটা, কল রেকর্ড, আইপি ট্র্যাকিং। সায়ন বলল,
“বিস্ফোরণের সঙ্গে যুক্ত লোকজন আসলে সিটি কানেক্টের ভাড়া করা মানুষ। আর তাদের নির্দেশ এসেছে বিকাশ চৌধুরীর অফিস থেকে।”
কোর্টরুমে হৈচৈ পড়ে গেল। সাংবাদিকরা ক্যামেরা ঘুরিয়ে নিল।
বিচারক কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে অভিযুক্ত অদ্রিজ নির্দোষ। আমরা তদন্তের নির্দেশ দিচ্ছি বিকাশ চৌধুরী ও সিটি কানেক্টের বিরুদ্ধে।”
অদ্রিজের বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল।
শহরের সমর্থন আবার ফিরে আসা
সেই সন্ধ্যায় সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হলো—
“লোকাল লিংকস নির্দোষ প্রমাণিত, ষড়যন্ত্রে ধরা পড়ল প্রতিদ্বন্দ্বীরা।”
শহরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ল। হাতে পোস্টার—
“আমাদের অদ্রিজ, আমাদের লোকাল লিংকস।”
শচীন দত্ত বললেন, “আমরা জানতাম, ও নির্দোষ।”
মুক্তা বললেন, “ও আমাদের গর্ব।”
অদ্রিজের চোখ ভিজে গেল। সে অনুভব করল, শহর আবার তাকে আপন করে নিয়েছে।
সিটি কানেক্টের পতন
কয়েকদিনের মধ্যে প্রশাসন সিটি কানেক্টের কলকাতা অফিস সিল করে দিল। বিকাশ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলো। প্রমাণ মিলল, তারা পরিকল্পিতভাবে লোকাল লিংকসকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল।
মানুষ বুঝতে পারল, অদ্রিজের লড়াই শুধু ব্যবসার জন্য ছিল না—এটা ছিল শহরের মর্যাদার জন্য।
নতুন ভোর
অদ্রিজ আবার ফিরল অফিসে। আগের গুদামঘরটাই এখন তাদের আসল কার্যালয়। ছেঁড়া চেয়ার, খালি দেয়াল, কিন্তু ভেতরে আগুনের মতো আত্মবিশ্বাস।
সায়ন, শ্রেয়া আর কয়েকজন নতুন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে টিম আবার শুরু করল কাজ।
অদ্রিজ বলল,
“আমাদের পথ এখনও সহজ নয়। কিন্তু আমরা প্রমাণ করেছি—সত্যির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মানে কখনও না হারানো। এখন আমাদের আরও পরিশ্রম করতে হবে। এই শহরের প্রতিটি দোকানকে আমাদের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।”
শ্রেয়া হাসল, “আমরা এবার শুধু অ্যাপ চালাচ্ছি না, আমরা এক আন্দোলন চালাচ্ছি।”
ব্যক্তিগত শান্তি
এক সন্ধ্যায় অদ্রিজ বাড়ি ফিরল। মা বারান্দায় বসে আছেন। তাঁকে দেখে মা চোখ মুছে বললেন,
“আমি ভয় পাচ্ছিলাম রে, তুই হারিয়ে যাবি। কিন্তু তুই ফিরে এলে।”
অদ্রিজ মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা, আমি হয়তো অনেক কিছু হারিয়েছি, কিন্তু শহরের বিশ্বাস হারাইনি। এটাই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
শেষ দৃশ্য
এক বছর পর, কলকাতার এক বড় হলে “লোকাল লিংকস”-এর বার্ষিক সভা হলো। এখন তারা হাজারো দোকানকে প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করেছে, লাখো ইউজার ব্যবহার করছে।
মঞ্চে উঠে অদ্রিজ বলল,
“আজ থেকে এক বছর আগে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম আগুন, হুমকি আর ষড়যন্ত্রের মধ্যে। অনেকে ভেবেছিল আমরা টিকব না। কিন্তু আমরা টিকে আছি।
কারণ আমরা শুধু ব্যবসা করিনি, আমরা শহরের গল্প বাঁচিয়েছি। এই গল্পই আমাদের শক্তি।
লোকাল লিংকস কেবল একটা কোম্পানি নয়—এটা আমাদের শহরের আত্মা।”
শ্রোতাদের করতালি বজ্রধ্বনির মতো গর্জে উঠল।
অদ্রিজ আকাশের দিকে তাকাল। তার চোখে শান্তির জল, মুখে দৃঢ় হাসি।
ডায়েরিতে লিখল শেষ লাইন—
“চুক্তির শহর আজ আমাকে মেনে নিয়েছে। আমার লড়াই শেষ হয়নি, কিন্তু আমি জানি—আমি আর একা নই।”
সমাপ্ত




