সম্রাট দত্ত
১
সকালের কলকাতা শহরটা যেন নিজের মতো করে ব্যস্ত। ধর্মতলার দিকে গাড়ির হর্ন, ফুটপাথের দোকানদারের হাঁকডাক, চায়ের দোকানে ভিড়—সব মিলিয়ে এক চেনা শব্দমালা। কিন্তু প্রেস ক্লাবের ভেতরে আজ ভিন্ন এক উন্মাদনা। বড় হলরুমে সারি সারি চেয়ার, সামনের টেবিলে সাজানো মাইক্রোফোন আর ঝকঝকে বোতলের পাশে ফাইলের স্তূপ। মিডিয়ার লোকজন, ক্যামেরাম্যান, ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক—সবাই অপেক্ষায়। কারণ আজ কথা বলবেন রাজ্যের সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিক সুমিত্রা দেবী। সাদা তাঁতের শাড়ি, কপালে বড় লাল টিপ, চোখে একরাশ দৃঢ়তা—এমন উপস্থিতি যাকে দেখলে ঘরে সবাই কিছুক্ষণ চুপ হয়ে যায়। মঞ্চে উঠে প্রথমেই তিনি চারপাশে তাকালেন, চোখে সেই পরিচিত কড়া দৃষ্টি। কণ্ঠে তেমনই দৃঢ়তা, কিন্তু কোথাও যেন এক অদৃশ্য কাঁপন লুকিয়ে আছে। কয়েকটি প্রারম্ভিক বক্তব্য শেষে, হঠাৎ এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি এমন এক ঘোষণা দিলেন যা মুহূর্তেই ঘরটাকে স্তব্ধ করে দিল—“আমার জীবনের একটি বড় অংশের স্মৃতি হারিয়ে গেছে।” মাইক্রোফোনের শব্দ যেন আরও তীক্ষ্ণ শোনালো, ফ্ল্যাশবাল্বের আলো হঠাৎ থেমে গেল এক সেকেন্ডের জন্য।
প্রথমে অনেকেই ভেবেছিল এটি হয়তো রাজনৈতিক নাটক—সমর্থন পাওয়ার জন্য বা মিডিয়ার নজর কাড়তে সাজানো কোনো খেলা। কিন্তু সুমিত্রা দেবী কথা বাড়ালেন, তার গলায় ছিল অস্বস্তি মেশানো আন্তরিকতা। তিনি বললেন, “প্রায় ছ’মাস আগে আমি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার অংশ হিসেবে নিউরোচিপের সফটওয়্যার আপডেট করিয়েছিলাম। চিকিৎসকের মতে, নিউরোচিপে রাখা তথ্যের মাধ্যমে অনেক পুরনো স্মৃতিও টিকে থাকে, এমনকি অস্পষ্ট ঘটনাও পরিষ্কারভাবে মনে পড়ে। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে হঠাৎ দেখলাম, আমার অতীতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত যেন কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেছে—বিশেষ করে দশ বছর আগের কিছু ঘটনা।” সাংবাদিকরা একে অপরের দিকে তাকালো; কেউ কেউ তড়িঘড়ি নোট নিচ্ছে, কেউ মোবাইলে ভিডিও রেকর্ড করছে। নিউরোচিপ প্রযুক্তি নিয়ে এর আগেও বিতর্ক ছিল—এটি কি মানুষের স্বাধীন স্মৃতি সুরক্ষিত রাখছে, নাকি তাকে সম্পাদনার সুযোগ দিয়ে ইতিহাস বদলে দিচ্ছে?—কিন্তু এভাবে প্রকাশ্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের স্মৃতি হারানোর কথা স্বীকার করা নজিরবিহীন। সুমিত্রা দেবীর কণ্ঠে এক অদ্ভুত মিশ্রণ—দৃঢ়তা, অপমানবোধ, আর লুকোনো ভয়—যেন তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না কতটা গভীর এই বিপদ।
এই সম্মেলনের শেষের দিকে, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন রক্তিম সেনগুপ্ত—তদন্তধর্মী সাংবাদিক হিসেবে যার খ্যাতি আছে নিরপেক্ষতার জন্য, আবার কড়া প্রশ্ন করার জন্যও। চুলের একপাশে হালকা পাকা রঙ, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, আর গলায় ঝোলানো প্রেস কার্ড—রক্তিম নিজের অভ্যাসমতো কথা না বলে কেবল পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সুমিত্রা দেবীর এই স্বীকারোক্তি তার কাছে নিছক সংবাদ নয়, বরং এক রহস্যের দরজা। তিনি নিউরোচিপ প্রযুক্তি নিয়ে আগেও লিখেছেন—যেখানে অনেকেই বলেছে এটি মানুষের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার শেষ সীমা ভেঙে দিচ্ছে। সম্মেলন শেষ হওয়ার পর, সাংবাদিকরা ভিড় করে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, ফ্ল্যাশবাল্বের আলো আবার ঝলসে উঠছে, আর সুমিত্রা দেবী ধীরে ধীরে মঞ্চ ছাড়ছেন, মুখে অদ্ভুত স্থিরতা। বাইরে বেরিয়ে রক্তিমের মনে তখন একটাই প্রশ্ন ঘুরছে—যদি সত্যিই কারো মস্তিষ্ক থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতি মুছে ফেলা হয়, তবে এর উদ্দেশ্য কী? কে এমন ক্ষমতা রাখে, আর কেন একজন প্রভাবশালী রাজনীতিকের অতীত পরিবর্তন করা দরকার? তিনি জানতেন, এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে বিপদ অবধারিত, কিন্তু কৌতূহল তার কাছে সবসময় ভয়ের চেয়ে বড়। সেই মুহূর্তেই, ভিড়ের শব্দ, গাড়ির হর্ন, রাস্তার ধুলো—সবকিছুর মাঝেও, রক্তিম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন—তিনি এই রহস্যের শেষ বিন্দু পর্যন্ত যাবেন।
২
বিকেলের কলকাতা তখন ধীরে ধীরে সাঁঝের দিকে এগোচ্ছে। চৌরঙ্গির মোড়ে হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়াশা, রাস্তার বাতি একে একে জ্বলে উঠছে। রক্তিম সেনগুপ্ত নিজের ছোট নোটবুক হাতে প্রেস ক্লাব থেকে বেরিয়ে সরাসরি গাড়ি ডেকে টালিগঞ্জের দিকে রওনা দিলেন। তার প্রথম লক্ষ্য—সুমিত্রা দেবীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. অশোক নন্দী। ডাক্তারের চেম্বার একটি পুরনো বাড়ির প্রথম তলায়, দেয়ালে পুরনো মেডিকেল ডিগ্রির সার্টিফিকেট আর কাঠের তাক ভর্তি বই। দরজা খুলতেই ড. নন্দীর চোখে চেনার আভাস ফুটে উঠল, হয়তো পত্রপত্রিকায় রক্তিমের ছবি দেখে। প্রথমে তিনি কথাবার্তায় সতর্ক ছিলেন, কিন্তু রক্তিমের ভদ্র অথচ দৃঢ় প্রশ্নে ধীরে ধীরে দেয়াল ভাঙল। চুপচাপ গলায় তিনি বললেন, “হ্যাঁ, প্রায় ছ’মাস আগে সুমিত্রাদেবীর নিউরোচিপে একটি অফিসিয়াল আপডেট হয়েছিল। তখন কোম্পানির একজন সিনিয়র টেকনিশিয়ান নিজে এসে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছিলেন। আমার তত্ত্বাবধানে চিপটি খুলে নিয়মিত স্ক্যান করা হয়, কিন্তু সেই দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা আমার উপস্থিতি ছাড়াই তারা চিপ নিয়ে কাজ করেছে। পরে আমি যখন পরীক্ষা করলাম, সব ঠিকঠাক লাগল… অন্তত তখন তাই মনে হয়েছিল।” ড. নন্দীর চোখে অস্বস্তি স্পষ্ট, যেন তিনি এখন বুঝতে পারছেন সেই ফাঁকটাই হয়তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
চেম্বার থেকে বেরিয়ে রক্তিম এবার গেলেন সুমিত্রার পুরনো বন্ধু মধুমিতা ঘোষের কাছে, যিনি দীর্ঘদিন ধরে তার রাজনৈতিক সহকর্মীও। শ্যামবাজারের এক শান্ত গলির ভেতর, পুরনো কাঠের বারান্দাওয়ালা দুই তলা বাড়িতে থাকেন তিনি। রক্তিম পৌঁছতেই দরজার সামনে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা আর বিস্কুট নিয়ে মধুমিতা হাসিমুখে বসালেন, কিন্তু হাসির আড়ালে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। আলাপের এক পর্যায়ে মধুমিতা বললেন, “সুমিত্রা খুবই গোপনীয় মানুষ, কিন্তু আমি জানি সেই আপডেটের পর থেকে সে অদ্ভুত আচরণ করছে। অনেক পুরনো ঘটনা—যেগুলো আমরা বহুবার একসাথে আলোচনা করেছি—সে এখন বলে মনে পড়ছে না। এমনকি কিছু ব্যক্তির নামও যেন তার কাছে অচেনা। আর একটা বিষয়, আপডেটের দিন সন্ধ্যায় সে বাড়ি ফিরেই কয়েক ঘণ্টা একদম চুপচাপ বসে ছিল, কারও সাথে কথা বলেনি।” রক্তিম নোটবুকে দ্রুত লিখে রাখলেন এই কথাগুলো, কারণ মানুষের স্মৃতিতে হঠাৎ করে এমন ছেদ পড়া কখনোই নিছক কাকতালীয় নয়। তার অভিজ্ঞতা বলছে—যে সময়টুকুতে নিউরোচিপ কোম্পানির লোকেরা ডাক্তারের উপস্থিতি ছাড়া কাজ করেছে, সেই ফাঁকেই রহস্যের আসল চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে।
সন্ধ্যা নেমে গেছে, রাস্তায় আলো আর ছায়ার খেলা চলছে। রক্তিম হাওড়া ব্রিজ পার হয়ে নিজের ফ্ল্যাটে ফেরার পথে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলেন, শহরের গতি তার ভাবনাকে আরও গভীর করে তুলছিল। এই আপডেট কেবল সফটওয়্যার পরিবর্তন নয়—এ যেন কারও অতীতকে নতুন করে সাজানোর জন্য পরিকল্পিত অস্ত্রোপচার। যদি সত্যিই সেই সময়ে সুমিত্রার স্মৃতির কিছু অংশ মুছে ফেলা হয়ে থাকে, তবে প্রশ্ন জাগে—কার স্বার্থে? রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী, ব্যক্তিগত শত্রু, নাকি এমন কোনো শক্তি যার হাতে প্রযুক্তি আর প্রভাব দুই-ই আছে? রক্তিমের মাথায় তখনই একটা পরিকল্পনা আসে—নিউরোচিপ কোম্পানির ভেতরে ঢুকে জানতে হবে, সেই আপডেটের আসল ডেটা কোথায় সংরক্ষিত। কারণ কাগজপত্রে যা লেখা থাকে, সেটাই সত্য নয়; সত্য থাকে সেই ফাঁকফোকরে, যেখানে কেউ চুপচাপ ইতিহাস বদলে দেয়। তার মনে হচ্ছিল, এই পথ ধরে এগোলে খুব শিগগিরই তিনি এমন কারও নাম পাবেন, যিনি প্রকাশ্যে আসতে চান না, কিন্তু যাঁর ছায়া সুমিত্রার বর্তমান আর অতীত—দুটোই বদলে দিয়েছে।
৩
পরদিন বিকেলে রক্তিম ফোন পেলেন এক অচেনা নম্বর থেকে। কণ্ঠস্বরের ভেতরে ছিল সাবধানতা, যেন প্রতিটি শব্দ বেছে বলছে, “আপনি কি রক্তিম সেনগুপ্ত? আমি ঈশান রায় বলছি… নিউরোচিপ নিয়ে কিছু কথা আছে, তবে সরাসরি মুখোমুখি হলে বলব। এখন ফোনে কিছু বলা ঠিক হবে না।” রক্তিম বুঝলেন, এ কথোপকথন সাধারণ নয়। কয়েকটি দ্রুত প্রশ্ন করতেই ঈশান জানালেন তিনি নিউরোচিপ কোম্পানির একজন প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন এবং কোম্পানির ভেতরে এমন কিছু দেখেছেন যা বাইরে বলা যায় না। দেখা করার ঠিকানা দিলেন—কলকাতার উত্তরে বাগবাজার ঘাটের কাছের এক পুরনো ক্যাফে। সন্ধ্যা নামতেই রক্তিম সেখানে পৌঁছে দেখলেন কোণের টেবিলে বসা এক পাতলা, ফর্সা-শ্যামলা গড়নের তরুণ, চোখে এক ধরনের ক্লান্তি আর সতর্কতার ছাপ। চুল একটু এলোমেলো, শার্টের কলার ভাঁজ হয়ে আছে, হাতের কাছে ধোঁয়া ওঠা চা। ঈশান প্রথমে চারপাশটা ভালোভাবে দেখে নিলেন, তারপর নিচু গলায় বললেন, “আমি জানি আপনি কী খুঁজছেন, কিন্তু সতর্ক থাকুন—এখানে শুধু স্মৃতি নয়, মানুষের জীবনও মুছে ফেলার খেলা চলছে।”
রক্তিম নোটবুক বের করলেন না, শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন। ঈশান বললেন, নিউরোচিপ প্রযুক্তি মূলত মানুষের স্মৃতিকে সংরক্ষণ ও প্রয়োজনে চিকিৎসা বা গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভেতরের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। কোম্পানির কিছু গোপন প্রকল্পে চিপের সফটওয়্যার ব্যবহার করে মানুষের মস্তিষ্ক থেকে নির্দিষ্ট সময়ের স্মৃতি সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া সম্ভব, এমনকি সেই জায়গায় মিথ্যা স্মৃতি স্থাপন করাও যায়। “ভাবুন, আপনি নিজের চোখে কিছু দেখেছেন, কিন্তু একদিন জেগে উঠে দেখলেন সেই স্মৃতি নেই—বরং অন্য কিছু মনে পড়ছে,” ঈশানের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক। তিনি আরও জানান, এই প্রক্রিয়াটি এত নিখুঁতভাবে করা হয় যে ব্যক্তি নিজেই টের পায় না কিছু বদলে গেছে, শুধু মনে হয় ওই সময়টা অস্পষ্ট বা স্বপ্নের মতো ঝাপসা। রক্তিমের মনে সঙ্গে সঙ্গে সুমিত্রা দেবীর স্বীকারোক্তির কথা ভেসে উঠল—দশ বছর আগের ঘটনাগুলো মনে নেই, এবং সেই আপডেটের সময় ডাক্তারের উপস্থিতি ছাড়া প্রায় দেড় ঘণ্টা চিপ খোলা ছিল। ঈশান চুপচাপ মাথা নাড়লেন, যেন এই ফাঁকটিই তার আশঙ্কার সত্যতা প্রমাণ করছে।
চায়ের কাপ খালি হয়ে গেলে ঈশান গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আরও নিচু গলায় বললেন, “আপনি যদি সত্যিই এটা খুঁজে বের করতে চান, তাহলে আপনাকে ভেতরে ঢুকতে হবে—ডেটা আর্কাইভে। সেখানে প্রতিটি চিপ আপডেটের রেকর্ড থাকে, কিন্তু সাধারণ লগ ফাইলের মতো নয়; এগুলো এনক্রিপ্টেড, আর কেবল কয়েকজন সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ারই দেখতে পায়।” রক্তিম জানতেন, এ পথ বিপজ্জনক। এই মুহূর্তে তিনি ঈশানের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলেন, এই তরুণ কেন নিজের সব ঝুঁকি নিয়ে এমন তথ্য দিচ্ছে। ঈশান হালকা হাসলেন, “আমি একসময় বিশ্বাস করতাম এই প্রযুক্তি মানুষের জীবন বাঁচাবে… কিন্তু এখন দেখি, এটা ক্ষমতার অস্ত্র হয়ে গেছে। আমি ভেতরের অনেক কিছু দেখেছি, আর চুপ থাকাটা আর সম্ভব নয়।” রক্তিম বুঝলেন, তার তদন্তে এখন একজন ভেতরের মানুষ আছে, যে শুধু তথ্য নয়, প্রমাণও দিতে পারবে—যদি সে বেঁচে থাকে। বাইরে গঙ্গার ধারে হাওয়া বইছে, আলো-ছায়ার ভেতরে বাগবাজার ঘাটের পুরনো ঘড়ি আটটা বাজাল, আর রক্তিম মনে মনে ঠিক করে ফেললেন—এই অন্ধকার গলিপথের শেষ প্রান্তে যতই বিপদ থাকুক, তিনি আর পিছু হটবেন না।
৪
রক্তিমের চোখে তখন এক অদ্ভুত অস্থিরতা—যেন তিনি অনেকটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন সত্যের, অথচ ঠিক হাতের মুঠোয় পাওয়ার আগে তা আবার সরে যাচ্ছে। তিনি বসেছিলেন তাঁর ছোট্ট অফিসে, ডেস্কের উপর ছড়ানো পুরনো সংবাদপত্রের কাটিং, কুঁচকানো ফাইলের কাগজ আর কয়েকটা সাদা খাতার পাতা। সুমিত্রার অতীত খুঁজতে গিয়ে তিনি হঠাৎই পেয়ে গেছেন এক বিস্মৃত সংবাদ—দশ বছর আগে কলকাতার এক প্রভাবশালী সামাজিক আন্দোলনের নেতা অমিতাভ সেন, রহস্যজনকভাবে খুন হয়েছিলেন রাতে নিজের বাড়ি ফেরার পথে। ঘটনাটি সেই সময় শহরজুড়ে তুমুল চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানায়, অমিতাভের সাথে তীব্র রাজনৈতিক মতবিরোধ ছিল একাধিক সংগঠনের, এবং তার মধ্যে সুমিত্রার নেতৃত্বাধীন একটি দলও ছিল সন্দেহের তালিকায়। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সেই মামলা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যায়, মিডিয়াও অন্য খবরে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রক্তিমের কপালে ভাঁজ পড়ে—এই তথ্য এতদিন তার জানা ছিল না কেন? তিনি একে একে পড়ছিলেন সংবাদপত্রের কাটিংগুলো, আর বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিল সুমিত্রার নামের উপর, যা প্রত্যক্ষভাবে না হলেও অমিতাভ সেনের মৃত্যুর সাথে যুক্ত ছিল গুজব ও অভিযোগের মাধ্যমে। প্রশ্ন জাগল—যদি এই ঘটনাটির সাথে সুমিত্রার বর্তমান রহস্যের কোনো যোগ থাকে?
রক্তিম সিদ্ধান্ত নিলেন, পুরনো ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ছাড়া এই রহস্যের গিঁট খোলা সম্ভব নয়। তিনি ফোন করলেন কয়েকজন পুরনো সাংবাদিক ও রাজনৈতিক মহলের পরিচিতকে, যারা সেই সময়ের ঘটনাগুলো কাছ থেকে দেখেছিলেন। একজন প্রবীণ সাংবাদিক বললেন, “তুমি যেটা খুঁজছো, ওটা খুবই নোংরা অধ্যায়… তখন সবাই জানত কে কে জড়িত, কিন্তু কারও পক্ষে মুখ খোলা সম্ভব হয়নি।” অন্য এক সূত্র জানাল, অমিতাভ সেন খুনের দিন বিকেলে এক সভায় সুমিত্রার সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেই তর্ক ছিল তীব্র, প্রায় ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। অথচ তার পরদিনই খবর আসে—অমিতাভ মারা গেছেন। রক্তিম বুঝতে পারলেন, এটুকু তথ্য যথেষ্ট নয়; তাঁকে আরও গভীরে যেতে হবে। তিনি তখন সেই পুরনো কোর্টরুম রেকর্ড, ফরেনসিক রিপোর্ট, এমনকি সেই সময়ের পুলিশ অফিসারদের নামও সংগ্রহ করতে শুরু করলেন। ফাইলের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা সাক্ষ্য, প্রমাণের অভাব, আর রাজনৈতিক প্রভাব—সব মিলিয়ে মামলাটি ছিল যেন এক অদৃশ্য প্রাচীর, যা ভাঙতে হলে তাঁকে নিজেকে ভেতরের অন্ধকারে নামতে হবে।
তদন্ত যত এগোতে লাগল, রক্তিম ততই অনুভব করলেন—এটা কেবল একটি পুরনো অপরাধ নয়, বরং এমন এক ছায়া, যা এখনও বেঁচে আছে। সুমিত্রা যদিও সেই সময় আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অভিযোগে গ্রেপ্তার হননি, কিন্তু তাঁর চারপাশে তখন থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল সন্দেহের বাতাবরণ। আশ্চর্যের বিষয়, ওই ঘটনার পর থেকেই সুমিত্রা অনেকটাই রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্র থেকে সরে দাঁড়ান, প্রকাশ্যে খুব কমই দেখা যেত তাঁকে। রক্তিম বারবার মনে করছিলেন, যদি সুমিত্রা সেই খুনে সরাসরি জড়িত না-ও থাকেন, তবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন কে বা কারা জড়িত ছিল। হয়তো সেই তথ্য আজও তাঁর কাছে আছে, আর সেই কারণেই তিনি বর্তমান সময়ে হুমকির মুখে। পুরনো অপরাধের ছায়া যেন ধীরে ধীরে রক্তিমের চারপাশে ঘনিয়ে আসছিল—প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও সব সূত্র অদৃশ্যভাবে ইঙ্গিত করছিল এক অন্ধকার অতীতের দিকে। রক্তিমের কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল, তিনি যদি এই ঘটনার মূল পর্যন্ত না পৌঁছান, তবে বর্তমান রহস্যের সমাধান কোনোদিনই সম্ভব হবে না। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন—এই পুরনো অপরাধের সব গোপন অধ্যায়, যত গভীরেই চাপা থাকুক না কেন, একে একে উন্মোচন করতেই হবে।
৫
কাব্যী মুখার্জীর অফিসটা যেন এক অদ্ভুত মিশ্রণ—ক্লিনিকাল পেশাদারিত্ব আর মানবিক উষ্ণতার। জানালার পাশে টেবিলের উপর রাখা পুরনো কাঠের মূর্তি, দেয়ালে সাদা-কালো শহরের ছবি, আর কোণে ছোট্ট একটি ফোয়ারা থেকে জল পড়ার শব্দ—সব মিলিয়ে এমন এক পরিবেশ তৈরি করেছে যা রোগীদের আরাম দেয়, কিন্তু মনোযোগও ধরে রাখে। রক্তিম, সুমিত্রাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকতেই কাব্যীর তীক্ষ্ণ চোখ এক ঝলকে দু’জনকেই পড়ে নিল। তবু প্রথমেই তিনি সুমিত্রার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নরম স্বরে বললেন, “আপনি শুধু নিজের মতো করে কথা বলবেন, কোনও চাপ অনুভব করবেন না।” প্রথমে তিনি কিছু সহজ প্রশ্ন করলেন—শৈশব, প্রিয় খাবার, পছন্দের গান—সবকিছুর উত্তর সুমিত্রা দিলেন, কিন্তু তাতে কোথাও যেন একটুখানি বিচ্ছিন্নতা রয়ে গেল। মাঝে মাঝে তাঁর দৃষ্টি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল, যেন কোথাও অন্যত্র ভেসে যাচ্ছে। কাব্যী তা খেয়াল করলেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কোনও মন্তব্য করলেন না। এরপর শুরু হল একটু গভীর সেশন—শব্দ ও ছবির মাধ্যমে স্মৃতি জাগানো, নির্দিষ্ট ঘটনাবলির তারিখ ও সময় মনে করিয়ে দেওয়া, এবং কিছু মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া পরীক্ষা। প্রতিবারই সুমিত্রা কিছু অংশে পরিষ্কার মনে করতে পারছেন, কিন্তু কিছু জায়গায় এসে পুরোপুরি থমকে যাচ্ছেন।
এক ঘণ্টার সেশন শেষে কাব্যী রক্তিমকে আলাদা ডেকে পাঠালেন। তাঁর কণ্ঠে ছিল পেশাদারি দৃঢ়তা, কিন্তু চোখে চিন্তার ছায়া। “রক্তিম, আপনার বন্ধুর স্মৃতিভ্রংশ স্বাভাবিক নয়,” তিনি সরাসরি বললেন। “সাধারণ ট্রমা বা মানসিক চাপ থেকে এই ধরনের ব্লক তৈরি হতে পারে, কিন্তু এখানে ব্যাপারটা আলাদা। আমি তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, চোখের নড়াচড়া, কথা বলার গতি, এমনকি বিরতির সময়কাল—সবকিছুই খেয়াল করেছি। এগুলো ইঙ্গিত দিচ্ছে, কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁর স্মৃতিতে হস্তক্ষেপ করেছে। এটা হতে পারে ‘সাজেস্টিভ ইন্ডাকশন’—যেখানে নির্দিষ্টভাবে কিছু ভুল বা বিকৃত স্মৃতি স্থাপন করা হয়, অথবা কিছু স্মৃতি সম্পূর্ণ মুছে দেওয়া হয়।” রক্তিম চমকে গেলেন। “মানে কেউ ওকে এমন অবস্থায় নিয়ে গেছে?” কাব্যী মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ। আর এই প্রক্রিয়াটা হালকা কিছু নয়—এতে মানসিক ও স্নায়বিক স্তরে প্রভাব ফেলার মতো টেকনিক ব্যবহার হয়। আমি সন্দেহ করছি, ও কোনওভাবে এক ধরনের সিস্টেমেটিক ম্যানিপুলেশনের শিকার হয়েছে, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। এর পেছনে হয়তো পেশাদার কেউ আছে, বা এমন কেউ, যার এই বিষয়ে গভীর জ্ঞান আছে।”
এরপর কাব্যী আরও বিশদ ব্যাখ্যা দিলেন—সুমিত্রার নির্দিষ্ট প্রশ্নে নির্দিষ্ট শব্দ শুনে যে শারীরিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ‘কন্ডিশনড রেসপন্স’। উদাহরণস্বরূপ, “লাল দরজা” বলতেই সুমিত্রার শ্বাস দ্রুত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তিনি কিছু মনে করতে পারেননি। “এটি ইঙ্গিত করে যে, স্মৃতিটি কোথাও মস্তিষ্কে আছে, কিন্তু তার অ্যাক্সেস রোধ করা হয়েছে,” কাব্যী বললেন। রক্তিমের মস্তিষ্কে একের পর এক প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—কে এমন কাজ করতে পারে, কেন করবে, আর এর পেছনের উদ্দেশ্য কী? কাব্যী প্রস্তাব দিলেন, সুমিত্রাকে নিয়মিত সেশন চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন, পাশাপাশি একটি নিউরোলজিক্যাল স্ক্যানও জরুরি। “এটা শুধু মনস্তত্ত্বের খেলা নয়, রক্তিম,” তিনি সতর্ক করলেন, “এখানে বিজ্ঞান আর অপরাধ—দুটোই একসঙ্গে মিশেছে।” রক্তিম বুঝলেন, এই কেসের পথ আরও জটিল হয়ে উঠল। বাইরে রাত নামছিল, শহরের আলো একে একে জ্বলে উঠছিল, কিন্তু রক্তিমের মনে হচ্ছিল—এই আলোয় লুকিয়ে আছে আরও গভীর অন্ধকার, যার ভিতরে ঢুকতে হলে তাঁকে কাব্যীর সাহায্য নিয়েই এগোতে হবে।
৬
অভ্রনীল দত্তের আগমনটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে রক্তিম প্রথমে কিছুক্ষণ ভেবে পেল না কী বলবে। রাতের শহর তখন নিস্তব্ধ, বাইরের রাস্তার হলদে আলো তার ঘরের জানালায় ছায়া ফেলছে। অভ্রনীল এসে সরাসরি বসে পড়লেন, যেন বহুদিনের চেনা জায়গায় এসেছেন। তার মুখে ছিল অদ্ভুত এক মিশ্র হাসি—আংশিক সৌজন্য, আংশিক তাচ্ছিল্য। কথাবার্তার শুরুতে তিনি সুমিত্রার প্রসঙ্গে একরকম নীরস মন্তব্য করেন, তারপর হঠাৎ স্বরে গাঢ় হয়ে বলেন—”আপনি জানেন, ওর অতীতে এমন কিছু আছে যা প্রকাশ পেলে… সব শেষ।” রক্তিম ভ্রু কুঁচকে তাকায়, কিন্তু অভ্রনীল চুপচাপ থাকেন, যেন নিজের কথার ভার বোঝাতে চাইছেন। তিনি কোনো কাগজ, ছবি বা প্রমাণ বের করেন না—বরং ইঙ্গিতেই থেমে যান। তার প্রতিটি শব্দ যেন তিরের মতো ছুটে আসে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে থেমে গিয়ে রক্তিমকে ভাবনার ফাঁদে ফেলে দেয়। মনে হয়, এ যেন কোনো রাজনৈতিক খেলা—প্রতিপক্ষকে সরাসরি আঘাত না করে, তার চারপাশে সন্দেহ আর রহস্যের মেঘ তৈরি করা।
রক্তিম চেষ্টা করে অভ্রনীলকে সরাসরি জিজ্ঞেস করতে—”আপনি যদি প্রমাণ না দেন, তবে আমি কেন আপনার কথা বিশ্বাস করব?” কিন্তু অভ্রনীলের চোখে তখন এক অদ্ভুত ঠান্ডা আলো। তিনি বলেন—”বিশ্বাস করা বা না করা আপনার বিষয়, তবে আপনি যদি খুঁজে দেখেন, পেয়ে যাবেন।” এই কথা বলার পর তিনি চেয়ারে হেলান দেন, সিগারেট জ্বালিয়ে ধোঁয়া ছাড়েন ধীর গতিতে, যেন সময়টাকে ইচ্ছাকৃতভাবে টেনে নিচ্ছেন। রক্তিমের মাথায় নানা সম্ভাবনা ঘুরতে থাকে—সুমিত্রার অতীত কি সত্যিই অন্ধকারে ভরা, নাকি অভ্রনীল শুধু রাজনৈতিক কৌশলে তাকে ব্যবহার করছেন? এই দ্বিধা তার মনে অস্বস্তির মতো চেপে বসে। কথোপকথনের মাঝে রক্তিম লক্ষ্য করে, অভ্রনীল কোনো সময়ই সুমিত্রার নাম সরাসরি অপমান করার মতো কিছু বলেননি—বরং সবসময় শব্দ বেছে নিয়েছেন এমনভাবে, যাতে সরাসরি দায়ী না হয়েও সন্দেহ তৈরি হয়। এ যেন দাবার খেলায় এক চাল, যেখানে গুটি সরাসরি মারছে না, কিন্তু পরের কয়েক ধাপে মারার সুযোগ তৈরি করছে।
মিটিং শেষ হলে অভ্রনীল ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান, স্যুটের কুঁচি ঠিক করেন, আর দরজা পেরিয়ে যাবার আগে একবার থেমে পিছনে তাকান—”আপনি সাংবাদিক, আপনার কাজ সত্যি খুঁজে বের করা। বাকিটা আমি বলব না।” দরজা বন্ধ হওয়ার পর রক্তিম অনুভব করে ঘরের ভেতর বাতাস যেন ভারি হয়ে গেছে। সে জানে, এই সূত্রের পেছনে ছুটতে গেলে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক, নৈতিকতা—সবই পরীক্ষার মুখে পড়তে পারে। কিন্তু অভ্রনীলের দেওয়া ইঙ্গিত এতটাই শক্তিশালী যে তা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। জানালার বাইরে তাকিয়ে রক্তিম ভাবতে থাকে, এটা কি নিছক প্রতিদ্বন্দ্বীর কূটচাল, নাকি সত্যিই সুমিত্রার জীবনের এমন কোনো অন্ধকার অধ্যায় আছে যা তাকে ধ্বংস করতে পারে? শহরের আলো-আঁধারিতে সেই রাতের মতোই তার মনের ভেতরে আলো আর ছায়ার লড়াই চলতে থাকে, আর দূরে কোথাও গাড়ির শব্দ মিলিয়ে গেলে মনে হয়—এই খেলা এখনই শুরু হল।
৭
রাত তখন প্রায় আড়াইটা, শহরটা যেন ঘুমের গভীর স্রোতে ভাসছে। একেবারে নীরব অফিস বিল্ডিংয়ের ভেতরে রক্তিম ও ঈশান বসে আছে, চোখ দু’টো ল্যাপটপের স্ক্রিনে আটকে। নিউরোচিপ কোম্পানির অভ্যন্তরীণ সার্ভারে ঢোকার জন্য তারা প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিয়েছে—বিভিন্ন ফায়ারওয়াল ভেঙে, এনক্রিপশন ডিকোড করে, ডাটা ট্রেইলের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করে। আজ অবশেষে তারা সেই সুরক্ষিত গোপন ডাটাবেসে ঢুকে পড়েছে, যেখানে প্রবেশাধিকার কেবলমাত্র তিনজন শীর্ষ বিজ্ঞানীর হাতে। স্ক্রিনে নীল রঙের একটি ফোল্ডার ফুটে উঠল—নাম দেওয়া “M-ALTER/Case_1137”। ঈশান নিঃশ্বাস চেপে ফোল্ডারটি খুলল, আর রক্তিম কীবোর্ডে হাত চালিয়ে ডাটা ডাউনলোড শুরু করল। ভেতরে ছিল বিশাল আকারের নথি, যেখানে সুমিত্রার নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে—তার নিউরাল নেটওয়ার্কে কৃত্রিমভাবে তৈরি কিছু স্মৃতি ইনস্টল করা হয়েছে, কিছু পুরনো স্মৃতি মুছে ফেলা হয়েছে। প্রতিটি এন্ট্রির পাশে ছিল টাইমস্ট্যাম্প, টেস্ট নোট, এবং পরিচালকের সই। নথির মধ্যে কিছু শব্দ এমন ছিল, যা পড়তেই গা শিউরে উঠছিল—“Memory Overwrite: Phase-3”, “Emotion Dampening Test”, “Implant ID: SR-2095”। সুমিত্রার হাসি, কান্না, ভয়—সবই যেন কারও হাতের খেলনা হয়ে গেছে।
কিন্তু ঠিক তখনই, যখন ডাউনলোডের বার দেখাচ্ছিল ৭৬%, স্ক্রিনে হঠাৎ লাল রঙের সতর্কবার্তা ভেসে উঠল—“REMOTE PURGE INITIATED”। ঈশান চমকে উঠে বলল, “কেউ লাইভ মনিটর করছে!” এক মুহূর্তের মধ্যে ডাটাগুলো অদৃশ্য হতে শুরু করল—প্রথমে ফোল্ডারের সাবফাইল, তারপর মূল ফাইল নিজেই। রক্তিম তড়িঘড়ি করে ডাউনলোড পজ করে লোকাল কপি সেভ করতে গেল, কিন্তু ম্যালওয়্যার-সদৃশ এক স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রাম তার সিস্টেমকে লক করে দিল। কীবোর্ডে যতই চাপা হোক, কমান্ড গ্রহণ করছে না। স্ক্রিনে শুধু দ্রুত স্ক্রল হতে থাকা ডিলিট লগ দেখা যাচ্ছে—প্রতিটি লাইনে লেখা “File Removed: Irrecoverable”। ঈশানের গলা কেঁপে উঠল—“আমাদের ট্রেস করছে, রক্তিম… আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে লোকেশন বেরিয়ে যাবে।” কিন্তু রক্তিম ফাইলের এক টুকরো প্রমাণও হাতছাড়া করতে রাজি নয়, সে সিস্টেমের ক্যাশ থেকে একখানা স্ক্রিনশট তুলতে সক্ষম হলো—যেখানে সুমিত্রার নাম আর Implant ID স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেই মুহূর্তে সার্ভারের সংযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, এবং ল্যাপটপের স্ক্রিন কালো হয়ে নীরব হয়ে দাঁড়াল।
দু’জনেই ঘামে ভিজে গেছে, যেন হঠাৎ করে ঘরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেড়ে গেছে। বাইরের রাস্তায় দূরে সাইরেনের শব্দ ভেসে আসছে—এটা কি কেবল কাকতালীয়, নাকি তাদের খোঁজে কেউ ইতিমধ্যেই রওনা হয়ে গেছে? ঈশান দ্রুত ব্যাকআপ ড্রাইভ ব্যাগে ভরে নিল, আর রক্তিম স্ক্রিনশট ফাইলটি এনক্রিপ্ট করে পকেটের ছোট পেনড্রাইভে সেভ করল। তবুও মনে হচ্ছিল—যেটুকু তারা পেয়েছে, সেটা পুরো সত্যের শুধু এক টুকরো; মূল প্রমাণ হাতছাড়া হয়ে গেছে, এবং যে কেউ সেই ফাইল ডিলিট করেছে, তার ক্ষমতা ও প্রযুক্তি সাধারণ হ্যাকার বা কোম্পানির কর্মীর ক্ষমতার বাইরে। রক্তিম জানত—এখন থেকে প্রতিটি পদক্ষেপ তাদের জন্য বিপজ্জনক হবে, কারণ এই খেলায় তারা এমন এক শক্তির বিরুদ্ধে নেমেছে, যার হাতে মানুষের স্মৃতিই কেবল নয়, জীবন-মৃত্যুর সুইচও আছে। ঘর থেকে বেরোনোর সময় ঈশান ফিসফিস করে বলল, “আমরা যত গভীরে যাচ্ছি, ততই অন্ধকার ঘন হচ্ছে…” আর রক্তিমের মনে হচ্ছিল—অন্ধকারটা শুধু বাইরের নয়, কারও মস্তিষ্কের ভেতরেও নীরবে ছড়িয়ে পড়ছে।
৮
রাতটা ছিল ভয়ানক নিস্তব্ধ। শহরের এই প্রান্তে, যেখানে রক্তিমের পুরনো দোতলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে, রাত নামলে প্রায় কিছুই শোনা যায় না—শুধু মাঝে মাঝে দূরের কুকুরের ডাক বা হাওয়ার শব্দ। সেদিনও তিনি নিজের স্টাডি রুমে বসে নোটপ্যাডে কিছু লিখছিলেন। তদন্তের সূত্রগুলো একের পর এক মিলিয়ে নিচ্ছিলেন, যেন এক অদৃশ্য জালের টুকরোগুলো একত্রিত করছেন। ঠিক তখনই হঠাৎ করে জানালার পাশ দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এল—মৃদু ইঞ্জিনের গুঞ্জন, যেন কোনো গাড়ি এসে থেমেছে। তিনি কৌতূহলবশত জানালার পর্দা সরিয়ে তাকালেন। রাস্তার হলুদ আলোয় দেখা গেল, এক কালো রঙের গাড়ি বাড়ির সামনের গেটে থেমে আছে। ভিতরে বসা মানুষদের মুখ বোঝা যাচ্ছে না, শুধু গাড়ির সামনের হেডলাইট আধা মিনিটের মতো জ্বলে থেকে নিভে গেল। রক্তিম দেখলেন, কেউ নামল না, দরজাও খুলল না। কয়েক মিনিট পর গাড়িটি ধীরে ধীরে উল্টোদিকে চলে গেল। সেই অদ্ভুত দৃশ্য মনে এক অস্বস্তির রেখা টেনে দিল। কিন্তু তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো পথ হারানো কোনো গাড়ি ভুল করে এখানে এসে পড়েছিল। তাই বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি না ভেবে আবার কাজে মন দিলেন—তবে অবচেতনে একটা অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ফেলল তার মনকে।
পরদিন সকালটা শুরু হয়েছিল যথারীতি। কিন্তু সকালবেলার চা বানানোর সময় গেটে যাওয়া প্রয়োজন পড়ল না, তবুও হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন—ডাকবাক্সের ঢাকনাটা সামান্য খোলা। কৌতূহলবশত তিনি গিয়ে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখলেন, ভাঁজ করা একটি হলুদ খাম পড়ে আছে। খামটির উপরে কোনো প্রেরকের নাম নেই, আর হাতে লেখা অক্ষরগুলো তাড়াহুড়ো করে লেখা মনে হচ্ছিল। ভেতরের কাগজটি খুলতেই তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল—মাত্র এক লাইন লেখা, কিন্তু সেই লাইনেই শীতলতা ছড়িয়ে গেল সারা শরীরে: “তুমি যদি অতীতে হাত দাও, বর্তমান তোমার থাকবে না।” অক্ষরগুলো অদ্ভুতভাবে কাঁপা কাঁপা, যেন লেখক আতঙ্কিত বা প্রচণ্ড রাগান্বিত অবস্থায় লিখেছে। রক্তিম কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্থির হয়ে রইলেন, চিঠির কাগজটা হাতে নিয়ে। কে পাঠাতে পারে এই বার্তা? তার তদন্ত কি কারও এতটাই অস্বস্তি তৈরি করেছে যে সরাসরি হুমকি দিতে বাধ্য হয়েছে? তিনি চিঠিটা বারবার পড়লেন, শব্দগুলোর ভেতরে লুকিয়ে থাকা অর্থ বোঝার চেষ্টা করলেন। একধরনের অনিবার্য বিপদের ইঙ্গিত যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ খুব কাছে আছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ নজরে রাখছে। রক্তিমের বুকের ভেতর চাপা ধ্বনি তৈরি হতে লাগল, কিন্তু তার চোখে ধীরে ধীরে জেদ আর দৃঢ়তার ঝিলিক জ্বলে উঠল।
তিনি বুঝে গেলেন—এটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়, কাল রাতে দেখা গাড়ি আর এই চিঠি একই সূত্রে বাঁধা। মানে কেউ গতকাল থেকেই তার গতিবিধি অনুসরণ করছে, আর সেই কেউ জানে তিনি “অতীত” খুঁড়ে দেখছেন—যে অতীতের রহস্য চাপা পড়ে আছে বহু বছর ধরে। হয়তো সেই গোপনীয়তাই কারও কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ যে সেটি প্রকাশ পেলে তার বর্তমান, তার জীবন, সবকিছু নষ্ট হয়ে যাবে। তাই তারা ভয় দেখিয়ে তাকে থামাতে চাইছে। কিন্তু রক্তিমের স্বভাবই ছিল বিপদ যত বাড়ে, তার অনুসন্ধানী মন তত উজ্জীবিত হয়। তিনি জানতেন, এই হুমকি আসলে সঠিক দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে—মানে তিনি ঠিক পথেই এগোচ্ছেন। তবে একইসাথে এটাও পরিষ্কার, এখন থেকে তাকে আরও সতর্ক থাকতে হবে, কারণ এই খেলায় প্রতিপক্ষ নিছক হুমকি দিয়ে থামবে না। গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তিনি চিঠিটা ভাঁজ করে রেখে দিলেন, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন—এবার তিনি পিছু হটবেন না। যা-ই হোক, অতীতের দরজা তিনি খুলবেনই, আর যেই চায় তার বর্তমান কেড়ে নিতে, তাকেও আলোর সামনে টেনে আনবেন। রাতের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা সেই কালো গাড়ি যেন আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠল, কিন্তু এবার ভয়ের পরিবর্তে তাতে ছিল শুধু একরাশ চ্যালেঞ্জের ছাপ।
৯
ঈশানের দ্রুত এবং নিখুঁত অনুসন্ধানী দক্ষতার ফলেই রক্তিম কাব্যীর গবেষণার সাথে মিলিয়ে বের করে আনলেন এক পুরনো, প্রায় বিস্মৃত ভিডিও সাক্ষাৎকার। ভিডিওটি তেমন জনপ্রিয় কোনো সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়নি বলেই হয়তো বছরের পর বছর অগোচরে রয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল প্রায় পনেরো বছর আগের একটি স্থানীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ফাঁকে তোলা ফুটেজ, যেখানে সুমিত্রা দেবী সাংবাদিকদের হালকা গম্ভীর আলাপের মাঝে হঠাৎ করে এক খোলামেলা মন্তব্য করে ফেলেছিলেন। পরনে তার সাদা শাড়ি, কপালে লাল বড় টিপ, চুল বাঁধা, চোখে এক ধরনের অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস— যেন নিজের চারপাশের সবকিছু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। সাংবাদিক তখন কোনো রাজনৈতিক প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি হাসিমুখে বলেন— “হ্যাঁ, আমি তো উনার সঙ্গে দেখা করেছি, ঠিক খুন হওয়ার দুই দিন আগে। কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে প্রসঙ্গ এখন আর তোলার দরকার নেই।” এর পরই বিষয় পরিবর্তনের চেষ্টা করলেও, ক্যামেরায় তার চোখের এক ঝলক আতঙ্ক এবং দ্বিধা ধরা পড়ে। রক্তিম ভিডিওটি মনোযোগ দিয়ে বারবার চালিয়ে দেখলেন— সেই এক সেকেন্ডের কাঁপন যেন হাজারো গোপন সত্যের চাবিকাঠি। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, ভিডিওটির মূল চিপে এই অংশ আর নেই; সুমিত্রা দেবীর ব্যক্তিগত প্রভাব হয়তো সংবাদমাধ্যমের ওপর কাজ করেছিল। কিন্তু ঈশান যেভাবে আর্কাইভাল ফুটেজ খুঁজে বের করেছেন— পুরনো ভিডিও স্টোরেজ সার্ভার, অনলাইন রেকর্ড এবং একটি আঞ্চলিক সংবাদকর্মীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ ঘেঁটে— তা ছিল অবিশ্বাস্য এক দক্ষতার নিদর্শন।
রক্তিম ভিডিওর প্রতিটি ফ্রেমে থেমে থেমে কাব্যীর বিশ্লেষণের সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলেন। কাব্যী আগেই বলেছিলেন— সুমিত্রা দেবীর কণ্ঠে প্রায়শই থাকে এক বিশেষ ধরনের অসঙ্গতি, যা তিনি সত্য গোপন করার সময় অবচেতনে প্রকাশ করেন। এই সাক্ষাৎকারেও সেই অসঙ্গতি স্পষ্ট— একটি বাক্য শেষ করার আগে তার গলায় হালকা থেমে যাওয়া, শব্দের স্বরে টান, আর চোখের দৃষ্টি অস্থির হয়ে ওঠা। রক্তিম হঠাৎ অনুভব করলেন, এই ভিডিও শুধু প্রমাণ নয়, বরং একটি দরজা— যা খোলামাত্রই অনেকদিনের অন্ধকার রহস্য আলোর মুখ দেখবে। ঈশান প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, পাশাপাশি এই ভিডিওর আসল শুটিং ডেট, ক্যামেরাম্যান এবং সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের খোঁজ করছিলেন। সবারই মনে হচ্ছিল, সময় খুব কম— কারণ সুমিত্রা দেবী হয়তো এখনো বুঝে উঠতে পারেননি যে অতীতের এই সামান্য মুহূর্ত আজ আবার ফিরে এসে তার বর্তমান ভেঙে দিতে চলেছে। রক্তিমের মনে কেবল একটি চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল— “এটাই হয়তো সেই শেষ কাঁটা, যা টেনে বের করলে পুরো জাল খুলে যাবে।”
কিন্তু সত্যের মুখোমুখি হওয়া সবসময় সহজ নয়। পরদিন সন্ধ্যায় রক্তিম, ঈশান আর কাব্যী একসাথে বসলেন ভিডিওটি নিয়ে শেষ পরিকল্পনা করার জন্য। ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠেছিল, যেন চারপাশে অদৃশ্য চোখ তাদের প্রতিটি নড়াচড়া নজরে রাখছে। কাব্যী ধীর কণ্ঠে বললেন— “আমরা জানি, এই ভিডিও আদালতে গেলে সুমিত্রা দেবীর পক্ষে পাল্টা দেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু আমাদের কাছে আরও সমর্থনযোগ্য তথ্য দরকার, যা এই মুহূর্তের সাথে সরাসরি খুন হওয়া নেতার মৃত্যু জুড়ে দিতে পারে।” ঈশান মাথা নাড়লেন— তিনি ইতিমধ্যে একটি পুরনো সিসিটিভি ফুটেজের খোঁজ পেয়েছেন, যেখানে দেখা যাচ্ছে সুমিত্রা দেবী একই সপ্তাহে একটি প্রাইভেট গাড়িতে করে নেতার বাসভবনের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছেন। পরিকল্পনা হচ্ছিল— ভিডিও এবং সিসিটিভি প্রমাণ একসাথে তুলে ধরে তার মুখোমুখি হওয়া। রাত গভীর হচ্ছিল, কিন্তু সবার চোখে ছিল তীক্ষ্ণ এক দৃঢ়তা— আগামীকালই হবে সেই দিন, যেদিন তারা সুমিত্রা দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে বলবে— “আপনি যা লুকিয়ে রেখেছেন, আমরা তা জেনে গেছি।” সেই মুহূর্তে বাইরে হাওয়া বইছিল ঠাণ্ডা, কিন্তু রক্তিমের অন্তরে বয়ে যাচ্ছিল ঝড়— কারণ তিনি জানতেন, সত্যকে মুখোমুখি করার পর আর ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
১০
রক্তিম গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, তার ফল অবশেষে হাতে এসেছে। তাঁর ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ডকুমেন্ট, ল্যাপটপে খোলা ডজনখানেক ফাইল, আর পাশে রাখা রয়েছে সেই গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ফুটেজ—যা সুমিত্রা দেবীর কুকীর্তির অমোঘ প্রমাণ। ঘরের কোণে রাখা অ্যাশট্রেতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জমে গেছে অসংখ্য সিগারেটের অবশিষ্টাংশ। জানলার বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে, অথচ রক্তিমের চোখে ঘুম নেই; বরং তাঁর মধ্যে এক ধরনের তীব্র উত্তেজনা কাজ করছে। যে সত্য তিনি জানেন, তা পৃথিবীর সামনে আনার সময় এসেছে। সংবাদ সংস্থার অফিসে পৌঁছে তিনি তাঁর রিপোর্টিং টিমকে একত্রিত করেন। স্লাইডশোতে প্রমাণগুলো সাজিয়ে দেন—দূর থেকে স্নায়ুবিক তরঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করার প্রোটোটাইপ, পরীক্ষামূলকভাবে স্থাপিত নিউরোচিপ, এবং সেসব ব্যবহার করে মানুষের স্মৃতি বদলে দেওয়ার প্রকল্পের চূড়ান্ত পরিকল্পনা। তাঁর সহকর্মীরা মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে যায়, কিন্তু রক্তিম জানেন—এই প্রতিবেদনের প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ এমনভাবে লেখা হয়েছে যাতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শীর্ষস্থানীয় তদন্তকারী সংস্থা পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলতে পারে। দুপুর নাগাদ অনলাইন পোর্টাল ও প্রিন্ট সংস্করণে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সারা শহর, এমনকি দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলিতে তা ছড়িয়ে পড়ে।
সুমিত্রা দেবী প্রথমে এই অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেন। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা যায়, তিনি প্রায় হাস্যকর ভঙ্গিতে রক্তিমের নাম উল্লেখ করে বলছেন—”এ সবই রাজনৈতিক চক্রান্ত, আর এক অসৎ সাংবাদিকের প্রচারবাজি।” কিন্তু এইবার জনমত অন্যদিকে মোড় নেয়। প্রতিবেদন প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সামাজিক মাধ্যম জুড়ে তীব্র ক্ষোভের ঝড় ওঠে। হাজার হাজার মানুষ নিউরোচিপ প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে। মিছিল বের হয়, সরকারি অফিসের সামনে স্লোগান শোনা যায়—”আমাদের স্মৃতি আমাদেরই থাকুক!”, “মনের ওপর হস্তক্ষেপ নয়!” সংবাদ চ্যানেলগুলোতে একের পর এক বিতর্কসভা বসছে, যেখানে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা রক্তিমের তথ্যের সত্যতা যাচাই করে সমর্থন দিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমও খবরটি তুলে ধরে, ফলে সরকারের ওপর চাপ বহুগুণ বেড়ে যায়। তদন্তকারী সংস্থা বাধ্য হয় অফিসিয়ালভাবে নিউরোচিপ প্রকল্পের নথি জব্দ করতে এবং সুমিত্রা দেবীর দপ্তরে হানা দিতে। সেই দৃশ্য সংবাদে সম্প্রচারিত হওয়ার মুহূর্তেই তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ভিত্তি ভেঙে পড়ে। তিনি একসময় ক্ষমতাশালী, অদম্য নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু এবার তাঁর মুখে পড়ে গিয়েছে আতঙ্ক ও ব্যর্থতার ছাপ। অবশেষে, জনমতের চাপে এবং দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে বাধ্য হন। ক্যামেরার সামনে তাঁর শেষ বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত—”আমি নির্দোষ, কিন্তু আমি এই পরিবেশে কাজ করতে পারছি না।”
তবে রক্তিম জানেন, এটি কোনো চূড়ান্ত বিজয় নয়। সুমিত্রা দেবীর পতন সাময়িকভাবে নিউরোচিপ প্রকল্পকে থামালেও, এর পেছনে থাকা বিজ্ঞানীরা, অর্থদাতারা এবং গোপন স্বার্থান্বেষী মহল এখনো ছায়ার আড়ালে সক্রিয়। কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি দেখতে পান, বিভিন্ন বিদেশি প্রযুক্তি সংস্থা চুপিসারে এই গবেষণায় আগ্রহ দেখাচ্ছে। কিছু প্রাক্তন সহকর্মী তাঁকে সতর্ক করে বলে—“তুমি খুব বড় খেলায় পা দিয়েছ, সাবধান।” তবুও তাঁর ভেতরে এক ধরনের জেদ কাজ করছে; তিনি জানেন, যদি এখন থেমে যান, তবে এই প্রযুক্তি আবার ফিরে আসবে, আরও গোপনে, আরও শক্তিশালী আকারে। রাতে একা বসে তিনি পুরনো ডকুমেন্ট ঘাঁটেন, নতুন সূত্র খোঁজেন। জানলার বাইরে শহরের আলো জ্বলছে, কিন্তু তাঁর চোখে ফুটে উঠছে এক ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের ছবি—যেখানে মানুষের স্মৃতি আর ইচ্ছাশক্তি কেবল কয়েকটি কোড আর চিপের নিয়ন্ত্রণে। সিগারেটের ধোঁয়া ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে যেতে তিনি নিজেকে প্রতিজ্ঞা করেন—এই যুদ্ধ চলবে, যতদিন না স্মৃতির ওপর এই অদৃশ্য শৃঙ্খল সম্পূর্ণ ভেঙে যায়। তিনি জানেন, পরবর্তী অধ্যায়ে লড়াই হবে আরও কঠিন, আরও বিপজ্জনক, কিন্তু তাঁর কলম ও সত্য বলার সাহসই হবে একমাত্র অস্ত্র।
শেষ




