Bangla - রহস্য গল্প

চিত্রকূট রহস্য

Spread the love

ঐন্দ্রিলা মুখার্জী


এক

নরেন্দ্রপুর স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে ঈশার মনে হচ্ছিল যেন সে কোনও পুরনো পেইন্টিংয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। সময় যেন এখানে এক জায়গায় আটকে আছে। কলকাতার হাওড়ার চেনা কোলাহল, কাঁচা-পাকা রাস্তায় চলা গাড়ির গর্জন আর ইলেকট্রিক হর্নের বুনট থেকে বেরিয়ে এখানে যেন অন্য এক জগতে এসেছে সে।

চিত্রকূট — মুর্শিদাবাদ জেলার এক বিস্মৃতপ্রায় গ্রাম, যেখানে এখন কেবল ধুলোমাখা স্মৃতি আর ঠান্ডা বাতাস বয়ে চলে।

ঈশা মিত্র, বয়স সাতাশ, পেশায় আর্কাইভিস্ট। ইন্ডিয়ান আর্ট অ্যান্ড কালচারাল হেরিটেজ ফাউন্ডেশন (IACHF)-এর তরফ থেকে সাময়িক একটি প্রজেক্টে পাঠানো হয়েছে তাকে। চিত্রকূটের এক জমিদার পরিবারের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা ডিজিটাল আর্কাইভে রূপান্তর করার দায়িত্ব তার কাঁধে।

পাশে রাখা ব্যাকপ্যাকটায় সযত্নে রাখা আছে তার ক্যামেরা, UV ফ্ল্যাশলাইট, স্ক্যানার, এবং আরও কিছু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম।

তার সামনে এসে দাঁড়াল এক প্রাচীন ল্যান্ডরোভার — জংধরা রঙ, পেছনে লেখা ‘রাজবাড়ি – চিত্রকূট’। গাড়ি থেকে নামলেন একজন ষাটোর্ধ্ব লোক — ধূসর পাঞ্জাবি, মুখে রোদে পোড়া রেখা, চোখে অপার বিষণ্ণতা।

“ঈশা দেবী?”

“জি। আপনি হরিপদ কাকু?”

লোকটি হালকা মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, বাবুমশায়ের আদেশে এসেছি আপনাকে নিতে। অনেক দূর, চলুন।”

গাড়িতে বসে ঈশা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিল ধানক্ষেত, জলার ধারে শাপলা ফুল, আর মাঝে মাঝে দূরে কোনও দোতলা পুরনো বাড়ি। পথ যত এগোচ্ছে, আধুনিকতার চিহ্ন তত ফিকে হয়ে যাচ্ছে।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের পথ পেরিয়ে গাড়ি এসে দাঁড়াল এক বিশাল লোহার গেটের সামনে। দু’পাশে রুক্ষ গাছ, পেছনে এক কাঠামো — যেন সিনেমার সেট।

গেট খুলতেই দেখা গেল ইট ও খোদাই-করা পাথরের মিশেলে তৈরি এক রাজকীয় বাড়ি — চিত্রকূট রাজবাড়ি। একসময় হয়তো এখানেই বসতো সভা, চলতো নৃত্যগীত, ভরতো বৈঠকখানা।

কিন্তু এখন? কেবল শূন্যতা, ধুলো আর ইতিহাসের ভার।

ঈশা গাড়ি থেকে নামতেই এক গা ছমছমে অনুভূতি তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ — যেন পুরনো বই, বদ্ধ ঘর আর কিছু না বলা কথা।

“চলুন, আমি ঘরটা দেখিয়ে দিই,” বলল হরিপদ।

দোতলায় ছোট একটি ঘর — কাঠের মেঝে, এক জানালা যা থেকে দেখা যায় শালগাছের সারি। সেখানে একখানা বিছানা, পুরনো আলমারি, আর ছোট ডেস্ক। “আপনার থাকার জায়গা। লাইব্রেরি ঠিক নিচে,” হরিপদ বলল।

ঈশা ব্যাগ নামিয়ে জানালার দিকে এগোল। বাইরের দৃশ্য যেন কুয়াশার ফ্রেমে বাঁধা।

সন্ধ্যে নামতে বেশি সময় লাগল না। মৃদু আলোয় ঈশা নামল নিচের লাইব্রেরিতে।

লাইব্রেরি — বাড়ির মধ্যভাগে এক সুবিশাল কক্ষ। তিনদিকের দেয়াল জুড়ে বুকশেল্ফ, সব কটি ভরা — কাগজের গন্ধে ভর্তি শতবর্ষ পুরনো পাণ্ডুলিপি, পুরাতন ম্যাগাজিন, হাতে লেখা চিঠিপত্র। ধুলো জমেছে অনেকদিনের।

মাঝখানে এক লম্বা টেবিল, যার ওপর ছড়ানো পুরনো চিত্র — জলরঙ, কালি, কয়লা স্কেচ।

“এগুলোই তো আমার স্বপ্ন,” ঈশা আপনমনে বলল।

সে এক এক করে আলতো করে বই তুলছিল, ছবি উল্টে দেখছিল। হঠাৎ সে থেমে গেল। এক কোণায় রাখা একটি সাদা কাঠের বাক্সে ছিল একগুচ্ছ পাণ্ডুলিপি, বেশ কয়েকটি ছবির খাম আর একটি কালচে সবুজ রঙের খাতার মতো কিছু।

খাতা খুলতেই সে বুঝল — এটি একটি ডায়েরি।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে বেশ কিছু পৃষ্ঠা একেবারে ফাঁকা। অন্য পাতায়ও লেখা খুব হালকা, প্রায় অদৃশ্য।

সে মোবাইলের আলোতে পৃষ্ঠা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ এক পৃষ্ঠায় আলোর প্রতিফলনে যেন ছায়া দেখা গেল — অস্পষ্ট কিছু লাইন, যেন লেখা ছিল, এখন আর নেই।

“অদৃশ্য কালি?” ঈশা চমকে উঠল।

তার ব্যাগ থেকে UV ফ্ল্যাশলাইট বের করল। কাঁপা হাতে আলো ফেলতেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে থাকল অদৃশ্য অক্ষর —  “২৩শে আষাঢ়, ১৮৭৯ — আজ আবার সেই চোখদুটো দেখলাম। বাড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল সে। তার চাহনি… যেন আঁকতে না পারলে বাঁচতে পারব না।”

ঈশার বুক ধক করে উঠল। ডায়েরির নিচে লেখা — “বিনয় মিত্র”

কে এই বিনয় মিত্র? কেনই বা তার লেখা ডায়েরিতে অদৃশ্য কালি ব্যবহৃত? সে বাকিটুকু পড়তে যাবে, তখনই পেছনে এক শব্দ।

“আপনার কিছু দরকার, দিদিমনি?” — হরিপদ দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা লণ্ঠন।

“না… মানে… এই খাতাটা…”

হরিপদ চোখ ছোট করে বলল, “ওটা তো বাবুমশায়ের ঠাকুরদার সময়ের জিনিস। অনেকে বলতেন ওটা অভিশপ্ত। আপনি সাবধানে থাকবেন।”

ঈশা এক মুহূর্তে বুঝে গেল — এই বাড়ির প্রতিটি ইট যেন কিছু না কিছু চেপে রেখেছে। ইতিহাস শুধু বইয়ের পাতায় নয়, এখানে সে যেন দেয়ালের ফাটলেও লুকিয়ে আছে। সেই রাতে, খাওয়ার পর, ঈশা বিছানায় শুয়ে ডায়েরির পাতাগুলো মনে মনে উল্টে যাচ্ছিল।

কে এই বিনয়? কার চোখে এত গভীর ছাপ যে আঁকতে না পারলে তার মৃত্যু হবে?

চিত্রকূট রাজবাড়িতে এসেই সে যেন এক ছায়ার সঙ্গে বসবাস শুরু করেছে — যার মুখ নেই, নাম নেই, কিন্তু যার উপস্থিতি প্রতিটি বাতাসে জড়িয়ে। সেই রাতে, জানালার বাইরে বাতাস কাঁপছিল। আর তার ঘরের দেয়ালে লণ্ঠনের আলোয় দুলছিল এক অসমাপ্ত প্রতিচ্ছবি — যেন কেউ তাকে দেখছে।

দুই

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই ঈশা অনুভব করল ঘরের মধ্যে একধরনের ভারি নীরবতা। জানালার বাইরে শালগাছের পাতায় ঝিরঝিরে বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছিল না। আলো ছিল, কিন্তু সেটা যেন সোনালি নয়, ম্লান ধুলোমাখা হলুদ।

সে নিচে নামতেই হরিপদ চা নিয়ে হাজির হল। “ঘুম ভালো হয়েছে, দিদিমণি?”

“হ্যাঁ কাকু, এই বাড়িটা সত্যিই এক অদ্ভুত অনুভূতি দেয়। সবকিছু যেন সময়ের থেকে পিছিয়ে আছে।“

হরিপদ হালকা হেসে বলল, “এই বাড়িতে সময়টা চলে নিজের খেয়ালে। অনেক কিছু আছে যা চোখে দেখা যায় না।”

ঈশা মনোযোগ দিল না কথাটায়। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে আবার ঢুকল লাইব্রেরিতে। আজ তার লক্ষ্য: সমস্ত সংগ্রহশালার খোঁজ নিয়ে তালিকা তৈরি করা। লাইব্রেরির পূর্বদিকের প্রাচীরজুড়ে যে তাক, তা ছিল সবথেকে পুরনো। তার ওপরে হাতে লেখা কিছু নাম, কিছু হিজিবিজি চিহ্ন, যা ঈশার মনে পড়ে গেল সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালের পুরনো নথিপত্রে এমন কিছু দেখা গেছে — ব্রিটিশ শাসনকালে স্থানীয় জমিদাররা যে চিঠিপত্র আদান-প্রদান করত তার নমুনা। হরিপদ এসে দাঁড়াল পাশে।

“এই দিকটায় হাত কম পড়ে, দিদিমণি। কেউ আসেও না। তবে বাবুমশায়ের ঠাকুরদার সময় এই লাইব্রেরি ভরতি লোক থাকত। পণ্ডিতরা বসে বই অনুবাদ করতেন।“

“এই জমিদার বাড়ির ইতিহাসটা বলুন না কাকু,” ঈশা বলল।

হরিপদ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল, তার চোখ যেন দূরে হারিয়ে গেল।

“এই বাড়ি তৈরি হয় ১৮৪০ সালে। তখন রাজা গিরীশচন্দ্র রায় ছিলেন এখানকার জমিদার। তিনি সংস্কৃতজ্ঞ মানুষ ছিলেন। কাশ্মীর থেকে শিল্পী আনাতেন, দক্ষিণ থেকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। এই বাড়ির ঘরে ঘরে কবিতা লেখা হত, গান গাওয়া হত, ছবি আঁকা হত। তবে…”

“তবে?”

হরিপদ গলা নামিয়ে বলল, “তবে একদিন সব বন্ধ হয়ে গেল। এক মেয়ে নিখোঁজ হয়ে যায়। একজন শিল্পী পালিয়ে যায়। আর তারপর থেকে… লাইব্রেরির এই পাশটা তালাবদ্ধ ছিল প্রায় পঞ্চাশ বছর।”

ঈশা চমকে উঠে বলল, “কিন্তু কেন?”

“বাড়ির লোক বলতেন, অভিশাপ। কিন্তু আমি বলি, মানুষ যত গোপন করে, ছায়া তত ঘন হয়ে ওঠে।”

ঈশার মনে পড়ল গতরাতের ডায়েরি — “২৩শে আষাঢ়, ১৮৭৯”।

“আপনি বিনয় মিত্র নামটা শুনেছেন?”

হরিপদ চুপ করে গেল। তারপর অনেকক্ষণ বাদে বলল, “শুনেছি। তবে নামটা কেউ মুখে আনতে চায় না। কই, কী করতেন আপনি বলুন তো?”

“তিনি ছিলেন এক চিত্রশিল্পী, এখানে এসে থাকতেন… সেই ডায়েরিতে লেখা আছে।”

হরিপদ মাথা নাড়ল। “জমিদারবাড়ির মেয়েটি ছিল খুব সুন্দরী। অনুরাধা নাম ছিল। গায়িকা ছিল সে। শুনেছি তার গান শুনে মানুষ কাঁদত। বিনয়বাবু এসেছিলেন তার পোর্ট্রেট আঁকতে। তারপর হঠাৎ… দু’জনেই উধাও হয়ে যান এক রাতে। তারপর থেকেই এই লাইব্রেরি বন্ধ। কথিত আছে, সেই শেষ পোর্ট্রেট কখনও শেষ হয়নি।”

ঈশার মেরুদণ্ড বেয়ে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

“পোর্ট্রেটটা কোথায় আছে?” সে জিজ্ঞেস করল।

“জানি না দিদিমণি। হয়তো নিচের স্টোর রুমে, অথবা টাওয়ার ঘরে।”

“টাওয়ার ঘর?”

“বাড়ির উত্তর-পূর্ব কোণে একটা মিনার ছিল, ওখানে গিয়ে কেউ এখন আর যায় না। শুনেছি… সেখানে রাত হলে আলো জ্বলে।”

দুপুরে খাওয়ার পরে, ঈশা একা একা বাড়ির দক্ষিণ অংশ ঘুরে দেখছিল। এই দিকটা একেবারে পরিত্যক্ত। ছাদের করিডোরে পুরনো রঙ খসে পড়েছে, দেয়ালে সাদা প্যাঁচার বিষণ্ণ মুখ আঁকা — যেন কারও নজর রাখার চিহ্ন। একটা দরজা খুঁজে পেল সে — তালা নেই, কিন্তু আটকানো। চাপ দিয়ে খুলতেই ভেতরে একটা ছোট্ট গ্যালারি। চারপাশে ছবি — সবই অসম্পূর্ণ চিত্র। একটি ছবি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

হাতে আঁকা জলরঙে একজন নারীর মুখ — কেবল চোখ দুটো স্পষ্ট। গভীর, দুঃখভরা চোখ, যা যেন কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারছে না।

ছবির নিচে ম্লান কালি দিয়ে লেখা: “সে কি ফিরে আসবে?”

হঠাৎ পিছনে শব্দ — যেন কেউ গ্যালারির দরজায় দাঁড়ানো। ঈশা ঘুরে দেখল, কেউ নেই। কিন্তু ছবির চোখ যেন তখনও তাকিয়ে আছে তার দিকে। রাতে ঈশা আবার ডায়েরিটি খুলল। আজকের UV ল্যাম্পে আরও একটি পৃষ্ঠা ফুটে উঠল।

“আনুর চোখে আমি দেখেছি সেই দুর্বোধ্য আকুতি — যা বলে না, বোঝায়। আমি যদি না আঁকতে পারি, সে হারিয়ে যাবে। কিন্তু এই বাড়ির কেউ চায় না আমি তাকে আঁকি। তাদের ভয়, সে মুখ যদি প্রকাশ পায়, অনেক কিছু ফাঁস হয়ে যাবে…”

এই লেখা পড়ে ঈশার গা ছমছম করে উঠল। সে বুঝতে পারছিল, এই ডায়েরি কেবল এক শিল্পীর আবেগ নয় — বরং একটি ইতিহাসের দলিল, একটি নিষিদ্ধ প্রেমের, একটি চাপা পড়া অপরাধের। আর সেই অপরাধের ছায়া এখনও ঘুরে বেড়ায় চিত্রকূটের প্রতিটি দেওয়ালে।

তিন

ঈশা বসেছিল রাজবাড়ির লাইব্রেরির এক কোণায়। সেদিন সকাল থেকে বাইরের আকাশ যেন কোনো এক শোকগাথা গেয়ে চলেছে — মেঘলা, থমথমে, মাঝে মাঝে হালকা বজ্রধ্বনি। হরিপদ সকালের চা দিয়ে অনেক আগেই চলে গেছে। ঈশা তার টেবিলের সামনে বসে ছিল ডায়েরি, UV ল্যাম্প, ক্যামেরা ও স্ক্যানার নিয়ে। আজ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে — বিনয় মিত্রের ডায়েরির প্রতিটি পাতায় যতটুকু সম্ভব, তুলে আনা হবে।

সে পৃষ্ঠা উল্টে একটার পর একটা বাক্য আবিষ্কার করছিল — অদৃশ্য কালি জেগে উঠছিল নিঃশব্দে।

তৃতীয় পাতায় লেখা ছিল: “আজ সকালে দেখলাম আনুর ঘরে দরজার তলায় সাদা খাম রাখা। কেউ কেউ বলছে, তাকে নজর রাখা হচ্ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। এই বাড়িতে গোপন কিছু আছে — কেউ যেন সব কিছু ঢেকে রাখতে চায়।”

“আমার স্কেচবুক খোয়া গেছে। তাতে ছিল অনুর মুখের প্রথম রেখাচিত্র। কেবল একজনই পারে সেটা নিতে — রাজা গিরীশচন্দ্র নিজে। তিনি কি…?”

ঈশার ভ্রু কুঁচকে গেল। জমিদার নিজেই যদি শিল্পীর কাজ চুরি করে থাকেন, তবে তাতে কী এমন ছিল যা তাকে উদ্বিগ্ন করল?

সে ভাবছিল — কে ছিল এই অনুরাধা?

একটা খেয়ালী শিল্পীর প্রেমিকা? না কি একজন অজানা সত্যের ধারক?

ঈশা ডায়েরির পাশে রাখা সেই ছবির খামটা খুলে একটা জলরঙের অসম্পূর্ণ চিত্র বের করল — একটি মেয়ে, ঘোমটা ঢাকা মুখ, চোখ শুধু দৃশ্যমান। ছবিতে একটি তারিখ — ১৮৭৯, এবং এক কোণে আঁকা একটি অদ্ভুত চিহ্ন: তিনটি গোল বৃত্ত, একটির ভেতর ফুলের পাঁপড়ি।

এই প্রতীক আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে হল ঈশার।

সে দ্রুত ফিরে গেল লাইব্রেরির পশ্চিমের তাকের দিকে। সেখানে ছিল কিছু পুরনো আমলের সংগঠনের রেকর্ড — সমাজ সংস্কার, নারীমুক্তি আন্দোলন, বাঙালি রেনেসাঁ যুগের ব্যক্তিত্বদের পাণ্ডুলিপি।

একটা চিঠি খুঁজে পেল — লেখা ১৮৭৮ সালের জুন মাসে, প্রাপক: গিরীশচন্দ্র রায়।

চিঠির প্রেরকের নাম ছিল “সঞ্জীব সেন, সভাপতি – ‘সত্যবিমার্শ পরিষদ’”।

চিঠিতে লেখা: “আপনাকে অনুরোধ করছি, অনুরাধাকে নিয়ে আলোচনা যেন বন্ধ থাকে। তার নাম নতুন সংগঠনের ঘোষণায় থাকা নিয়ে আপনি যে আপত্তি তুলেছেন, তা অযৌক্তিক। তার কণ্ঠ ও চিন্তাভাবনা আমাদের আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ।”

ঈশার হৃদয় দপদপ করতে লাগল। অনুরাধা শুধু গায়িকা নন, তিনি ছিলেন একটি সামাজিক আন্দোলনের মুখ!

তাহলে কি রাজা গিরীশচন্দ্র নিজেই তার কণ্ঠ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন? একজন নারীর কণ্ঠ, যা কেবল সংগীত নয়, বরং প্রতিবাদের ভাষা?

সন্ধ্যে নামছিল। ঈশা কফির কাপ হাতে ফিরে এল ডেস্কে। তখন হঠাৎ একটা পৃষ্ঠা যেন নিজে থেকেই খুলে গেল — বাতাসের হালকা ধাক্কায়।

তাতে লেখা: “আমি তার কণ্ঠ আঁকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শব্দে নয়, রঙে। আমি বুঝেছিলাম, এই বাড়ির দেওয়াল চায় তাকে চুপ করাতে। তার গলায় ছিল বিদ্রোহ, যা রক্ত ছাড়া থামবে না।”

“তাকে বলেছিলাম পালিয়ে যেতে। কিন্তু সে বলেছিল, ‘আমি গান থামালে, তারা জিতবে।’ সেদিন রাতে সে গেয়েছিল শেষ গান… তারপর আর কেউ তাকে দেখেনি।”

এই লেখাগুলো ঈশার ভিতরে কোনো আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছিল। এই গল্প এখন শুধুমাত্র একটি শিল্পীর রোমান্স নয়, বরং এক বিপ্লবীর অন্তর্ধানের কাহিনি।

তবে প্রশ্ন রয়ে গেল — বিনয় কোথায় গেলেন?

তিনি কি তার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলেন?

নাকি তাকে… থামানো হয়েছিল?

ঈশা এবার এক দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিল — সে যাবে টাওয়ার ঘরে। হরিপদ তাকে বারবার সাবধান করেছিল।

“ওখানে অনেকদিন কেউ যায়নি। মই নড়বড়ে, সাপও থাকতে পারে!”

কিন্তু সত্য জানতে হলে ভয় পেলে চলে না।

চাবি খুঁজে বের করে ঈশা উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে রাজবাড়ির পূর্বদিকের টাওয়ারে। করিডোর পেরিয়ে সে পৌঁছাল এক ছোট দরজার সামনে — ক্ষয়প্রাপ্ত, কড়িকাঠ থেকে পোকা খসে পড়ছে।

চাবি ঘোরাতেই দরজাটা বিকট শব্দে খুলে গেল।

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিন্তু UV লাইট জ্বালাতেই সে দেখতে পেল ধুলো জমা ছোট্ট ঘর — এক পাশে কাঠের স্ট্যান্ডে রাখা একটি ক্যানভাস, কাপড় দিয়ে ঢাকা।

সে ধীরে ধীরে কাপড়টা সরাল। সম্মুখে প্রকাশ পেল সেই চিত্র — এক অসমাপ্ত প্রতিচ্ছবি।

অনুর মুখ — কেবল চোখ পর্যন্ত আঁকা, ঠোঁট আঁকা হয়নি, অথচ তার চোখে গান থমকে আছে। রং শুকিয়ে খসে পড়েছে, কিন্তু চোখে সেই একই প্রশ্ন — আমি কি ফিরে আসব?

চিত্রটির পেছনে লেখা:

“আমি আঁকিনি শেষরেখা, কারণ সে আজও অধরা।” — বিনয়

ঈশা বোঝে, এই ছবি এক অসমাপ্ত গান, যার শেষ কলি কখনও লেখা হয়নি।

হঠাৎ সে লক্ষ্য করে — টাওয়ার ঘরের ঠিক ওপরে ছাদে কাঠের একটি প্যানেল ঢিলে। খুঁচিয়ে খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা ছোট টিনের বাক্স। তার ভেতরে একটি চিঠি — লেখা বিনয়ের হাতে।

“যদি কেউ এই ছবি দেখে, জেনে রেখো — আমি তাকে লুকিয়ে রাখতে পারিনি। আমি পালাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে থেকে গেল। আমি শুধু তার মুখ ধরে রাখতে পেরেছি, তার কণ্ঠ নয়। সে গান থামাল না। আর তাই… তাকে তারা থামিয়ে দিল।”

“কিন্তু একদিন কেউ আসবে — যে তাকে আবার গাইতে দেবে। ততদিন সে এই ছবিতে থাকবে। অপূর্ণ। প্রতীক্ষায়।”

ঈশার চোখে জল এসে গেল। এই বাড়ি কেবল এক ইতিহাস নয় — এটি এক নারীর কণ্ঠরুদ্ধ যন্ত্রণা, এক শিল্পীর ব্যর্থতা, এবং এক প্রজন্মের অপরাধবোধ।

নীচে নামার আগে, ঈশা ছবিটির স্পষ্ট ডিজিটাল কপি তুলল, UV আলোতে প্রতিটি দাগ স্ক্যান করল। সে জানে — সত্যকে প্রকাশ করতে হলে তার প্রমাণ চাই। সে ঠিক করে, আগামী অধ্যায়ে সে অনুসন্ধান শুরু করবে অনুরাধার প্রকৃত পরিচয় ও নিখোঁজ হওয়ার রাতের রহস্য। কিন্তু নিচে নামতেই সে হঠাৎ শুনতে পেল — লাউডস্পিকারে বাজছে পুরনো হর্মোনিয়ামের রেকর্ডেড গান, যেন কেউ প্লে করে দিয়েছে লাইব্রেরির গ্রামোফোন।

কিন্তু হরিপদ তো বলেছিল, ওগুলো বন্ধ। গলার সেই সুর — কাঁপা, করুণ, অথচ প্রতিবাদী।

“আমি ফিরব, জানি আমি ফিরব…”

চার

চিত্রকূটের রাজবাড়িতে রাত যেন আলাদা রকম এক অস্তিত্ব। অন্ধকার এখানে নিছক অনুপস্থিতি নয় — বরং একটা সজীব, নিঃশব্দ সত্তা, যা চারপাশে ঘুরে বেড়ায়, ফিসফিস করে দেয়ালে, দরজায়, বাতাসে।

ঈশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল লাইব্রেরির দরজার সামনে। ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল একটি গান। হর্মোনিয়ামের করুণ সুরে কাঁপা গলা, যেন বহুদিনের অপেক্ষার পরে কেউ তার বেদনার ভার খুলে দিয়েছে।

“আমি ফিরব, জানি আমি ফিরব…

তোমার আঁকা চোখে,

আমার কণ্ঠ থামবে না…”

ঈশার কাঁধে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই গানের কথা কোথাও সে পড়েনি। কিন্তু এই সুর, এই কণ্ঠ… যেন তার শিরায় শিরায় ঢুকে পড়ছে। সে সাহস করে দরজা খুলল। ঘর ফাঁকা। গ্রামোফোনের পাশে পড়ে থাকা ভাঙা ডিস্ক কভারে ধুলো জমেছে বহু বছরের। কিন্তু অল্প আগেই তো গান চলছিল?

তখনই হরিপদ ছুটে এল। “দিদিমণি! আপনি লাইব্রেরিতে?”

“হ্যাঁ, আমি গান শুনছিলাম—”

হরিপদ থমকে গেল। তার মুখে এক অদ্ভুত শূন্যতা।

“কিন্তু এই ঘরে তো বিদ্যুৎই নেই দিদিমণি। আপনি কী শুনলেন?”

ঈশা বুঝল, সে যা শুনেছে তা বাস্তব এবং অবাস্তবের সীমান্তে দাঁড়িয়ে। হয় সে ধোঁকা খাচ্ছে, না হয় অতীত তার সঙ্গে কথা বলছে। পরদিন সকালবেলা, ঈশা শুরু করল অনুরাধার জীবনের অনুসন্ধান।

পুরাতন নাগরিক রেজিস্টার ঘাঁটতে গিয়ে সে খুঁজে পেল ১৮৭৬ সালের এক বিবরণ — গিরীশচন্দ্র রায়ের তৃতীয় কন্যা অনুরাধা দেবী, জন্ম: ১৮৬০, কলকাতা। গানে প্রতিভাবান, বাল্যবিবাহ না করে বাবার অনুমতি সত্ত্বেও সংগীত শিক্ষায় ব্রতী হন। উল্লেখ ছিল — “আধুনিক নারীশিক্ষার প্রবক্তা সঞ্জীব সেন-এর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।”

ঈশা আনন্দে অভিভূত হয়ে উঠল। এতদিন অনুরাধা ছিল কেবল এক রহস্যময় প্রতিচ্ছবি — আজ সে রক্তমাংসের এক নারীতে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এরপরেই আসে ধাক্কা।

১৮৮০ সালের পরে সমস্ত সরকারি নথি থেকে অনুরাধার নাম অদৃশ্য। না আছে মৃত্যুর তারিখ, না আছে বিবাহ, না আছে স্থানান্তরের রেকর্ড। যেন কেউ তাকে সম্পূর্ণভাবে মুছে দিয়েছে। ঈশা এরপর গেল স্থানীয় রেজিস্ট্রি অফিসে। পুরনো একজন কর্মচারী, বিনোদ দা, তাকে দেখাল দালিলিক মানচিত্র ও জমিদারি রেকর্ডের পুরোনো বই।

“অনুরাধা?” তিনি চশমা ঠিক করতে করতে বললেন, “ওই নামে একটা পুরনো জমির রেকর্ড ছিল, উত্তর বাগানে। তবে সেটা এখন পতিত জমি। লোকেরা বলে ‘অনুর বাগান’। কেউ যেত না।”

“আপনি কী জানেন, কেন?”

বিনোদ দা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন, “বলা হয়, ওখানে এক রাতে গান শোনা যায় — কোনও নারী কাঁদতে কাঁদতে গান গায়। কেউ আবার বলেছে, একটা পাথরের নীচে কারও গলার হার পাওয়া গেছিল।”

ঈশা ঠিক করল, সে অনুর বাগান ঘুরে দেখবে।

বিকেলে সে হরিপদকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছাল রাজবাড়ির উত্তর প্রান্তে — ধানক্ষেত পেরিয়ে একটা গাছঘেরা পরিত্যক্ত জায়গা। জায়গাটা ঘিরে ছিল জঙ্গলে ভর্তি, আর ভেতরে ঢুকতেই একরকম শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগল।

হরিপদ বলল, “এই বাগান একসময় খুব সুন্দর ছিল। অনুরাধা দেবী নিজে রোপন করেছিলেন বলেই নাম হয় ‘অনুর বাগান’। কিন্তু তার পর… সবাই ছেড়ে দেয়।”

গাছের ছায়া এত ঘন ছিল যে দুপুরেও সন্ধ্যার মতো লাগছিল। ঈশা ঘাস ও পাথরের ভেতর দিয়ে এগোতে এগোতে একটা ছোট পাথরের চাতাল দেখতে পেল। ওপরটা চকচকে, যেন সদ্য পরিষ্কার।

সে সেখানে দাঁড়াতেই পায়ের নিচে মাটি একটু দুলে উঠল — যেন কিছু আলগা।

সে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। কয়েক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এল একটি ছোট, সিসার বাক্স।

তার ভিতর ছিল:

১. একটি মেহগনি কাঠের ছোট গলার হার — তাতে ঝোলানো ছোট সোনা-মুড়োনো পেনডেন্ট

২. একটি খণ্ড পাণ্ডুলিপি, লেখা: “অনুরাধার গান”

৩. একটি কাচের পাতায় আঁকা ক্ষুদ্র প্রতিকৃতি — বিনয় ও অনুরাধার।

হরিপদ মুখ ঢাকল, “এগুলো… কেউ লুকিয়ে রেখেছিল।”

ঈশা জানত, এই বাক্সের জিনিসগুলো একদা পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিল কেউ। কিন্তু কেউ একজন… একজন বিশ্বাসী… অনুর জন্য রেখে গিয়েছিলেন সময়ের কাছে।

রাতে রাজবাড়িতে ফিরে সে সেই পাণ্ডুলিপি খুলল।

“আমার কণ্ঠ, আমার অস্তিত্ব। তারা বলেছিল, মেয়েদের গান প্রকাশ্যে বাজবে না। আমি বলেছিলাম, যতদিন আমি বাঁচব, গান থামবে না। বিনয় বলেছিল, আমি তোমার কণ্ঠ আঁকব, যাতে কেউ কণ্ঠ কেটে ফেললেও তুমি রয়ে যাও।“

“আমি জানি, ওরা আসবে আমাকে থামাতে। কিন্তু আমি গান গেয়ে যাবো। যদি আমি না ফিরি, কেউ একদিন এই গান খুঁজে পাবে। সে বুঝবে — কণ্ঠরোধে সত্যি থামে না।“

ঈশার চোখ ছলছল করছিল। সে বুঝে গিয়েছিল — অনুরাধা কেবল একজন জমিদার কন্যা ছিলেন না। তিনি ছিলেন প্রতিরোধের প্রতীক। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে এই প্রমাণগুলো প্রকাশ করবে।

তবে তার আগে দরকার স্থানীয় ইতিহাসবিদ, সংবাদপত্র, এবং এক ভালো করে লেখা প্রতিবেদন। এটুকু নিশ্চিত — সত্য চাপা থাকে না। এবং গান, একবার শুরু হলে, কখনও থেমে যায় না। ঈশা জানত, অনুরাধার গান তার মধ্য দিয়ে আজ আবার ধ্বনিত হতে শুরু করেছে।

পাঁচ

ঈশার মনে হচ্ছিল, সে আর একটি গল্প পড়ছে না — সে গল্পের ভেতরেই ঢুকে গেছে।

চিত্রকূটের এই রাজবাড়ি কেবল মৃত ইতিহাস নয়, বরং এক জীবন্ত সাক্ষী — যেখানে চিত্র, গান ও প্রতিবাদ মিলে এক অদ্ভুত সংকেত সৃষ্টি করেছে। অনুরাধা নামটি এখন কেবল এক নারী নয়, এক প্রতীক, এক চিৎকার, এক রুদ্ধ কণ্ঠের অভিমান।

রাতে সে তার নোটপ্যাড খুলে সব কিছু সাজিয়ে লেখে—

অনুরাধা দেবী — গিরীশচন্দ্র রায়ের কন্যা, সঙ্গীতশিল্পী, সমাজসংস্কারক, সঞ্জীব সেন-এর সত্যবিমার্শ পরিষদের সদস্য, ১৮৮০ সালে হঠাৎ অন্তর্ধান।

বিনয় মিত্র: চিত্রশিল্পী, প্রেমিক, রাজবাড়ির অতিথি, অনুর বাগানে লুকোনো স্মৃতিচিহ্ন ও গান, ‘প্রতিচ্ছবি’ নামক অসমাপ্ত ছবি, গানের পাণ্ডুলিপি, এবং একটি বাক্সে সংরক্ষিত প্রেম ও প্রতিবাদের চিহ্ন।

তবে প্রশ্ন রয়ে যায় — কি ঘটেছিল সেই রাতটিতে?

অনুরাধা কি সত্যিই ‘থামিয়ে’ দেওয়া হয়েছিল?

বিনয় কি তার মৃত্যুর সাক্ষী? না কি অপরাধী?

ঈশা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে আরও গভীরে যেতে হবে — শুধু ইতিহাস খুঁজে নয়, বরং চিত্রে প্রতিরোধের ছায়া অনুসন্ধান করে। সকালবেলা সে লাইব্রেরিতে বসে বিনয়ের আঁকা বাকি প্রতিচিত্রগুলো পুনরায় বিশ্লেষণ করতে থাকে। কোনো একটি ছবির নিচে লেখা ছিল—

“তিনি বলেছিলেন, আমাকে দেখে কেউ বুঝতে পারবে না, আমি কাঁদছিলাম।”

অন্য ছবিটিতে, অনুর মুখ ছিল অর্ধেক আলো-ছায়ায় ঢাকা। হালকা কালো প্যাস্টেলের ছায়ায় গালে একটি রেখা, যেন চুপিসারে ঝরে পড়া অশ্রু। ঈশা ছবিগুলো ডিজিটালি স্ক্যান করে জুম করতে করতে হঠাৎ লক্ষ্য করে—

একটি ছবির পেছনে হালকা চিহ্নিত ছাপ, কাগজের সূক্ষ্ম ফাইবারের গায়ে একটি অদ্ভুত চিহ্ন — তিনটি গোল বৃত্ত, একটির কেন্দ্রে পাঁপড়ির নকশা। সে বুঝে যায় — এই চিহ্নই ছিল ‘সত্যবিমার্শ পরিষদ’-এর প্রতীক।

এই ছবিগুলো শুধু শিল্প নয়, এগুলো সাংকেতিক বার্তা — চিত্রের মধ্যে প্রতিরোধের ছাপ। সে কলকাতায় তার মেন্টর, ইতিহাসবিদ ড. অমিতাভ গুহ-কে ফোন করে সব বলে।

“তুমি যা বলছ ঈশা, সেটা শুধু সাংস্কৃতিক নয় — রাজনৈতিক আন্দোলনের নিদর্শন। রেনেসাঁ যুগে নারীদের কণ্ঠ খুঁজে পাওয়া, শিল্পের মাধ্যমে প্রতিবাদ, এগুলো আর্কাইভে প্রায় অনুপস্থিত। অনুরাধা যদি সত্যিই আন্দোলনের মুখ হয়ে থাকেন এবং তাকে নিখোঁজ করে দেওয়া হয়, সেটা প্রমাণ করলে তুমি ইতিহাসকে নতুন করে লিখবে।”

“তবে বিপদও থাকবে,” ড. গুহ বললেন নিচু গলায়, “যারা তখন তাকে থামাতে চেয়েছিল, তাদের বংশধরেরা আজও প্রভাবশালী।”

ঈশা থেমে গেল। এই কাজ কি শুধুই অ্যাকাডেমিক? না কি সে এমন কিছু উন্মোচন করতে চলেছে যা দীর্ঘদিনের চেপে রাখা অন্যায়কে নগ্ন করে দেবে? ঈশা আবার ফিরে গেল রাজবাড়ির টাওয়ার ঘরে, সেই অসমাপ্ত প্রতিচ্ছবির সামনে। সে এবার ভালোমতো দেখল — কেবল চোখ নয়, অনুর পেছনের ব্যাকগ্রাউন্ডেও কিছু লুকোনো আছে।

UV ল্যাম্প জ্বালাতেই দেখা গেল — খুব হালকা করে আঁকা, কিন্তু এখনো স্পষ্ট — একটি দরজা, আর সেই দরজার পাশে লেখা: “যদি গলা থামাও, পায়ের শব্দ থামবে না।”

কোন দরজা?

সে হরিপদকে জিজ্ঞেস করল, “এই বাড়ির কোনো গোপন দরজা বা বেসমেন্ট আছে?”

হরিপদ একটু ইতস্তত করল।

“দিদিমণি, ছোটবেলায় দাদু একটা পুরনো গুদামের কথা বলত — যেখানে রাজা সাহেব মদের বোতল লুকিয়ে রাখতেন। সিঁড়ি ছিল সিংহদ্বারের ডানদিকে, এখন সেটা ইঁট দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া।”

ঈশার মনে হলো, এই দরজা হয়তো সেই-ই।

সে ল্যাম্প নিয়ে গেল সেই প্রাচীন সিংহদ্বারের পাশে। ধুলো-মোড়া ইঁটের দেয়াল চাপা দেওয়া একটি সরু অংশে UV আলো ফেলতেই সে দেখল — দেওয়ালে আঁকা সেই তিনটি বৃত্তের প্রতীক।

তার মানে এই দরজা জানত অনুরাধা এবং বিনয় —

এবং এখানে কিছু লুকোনো আছে।

সে পুরনো হাতুড়ি দিয়ে ইঁটগুলো একটু একটু করে ভাঙে। সন্ধ্যার আলো কমে আসছিল, কিন্তু তার মধ্যে পাওয়া গেল একটি সরু সিঁড়ি, যা নেমে গেছে মাটির নিচে।

পঁচা মাটির গন্ধ, আর ধুলোয় ভরা সিঁড়ি। ঈশা নেমে গেল নিচে — একা।

নিচে নেমে দেখতে পেল একটা ছোট ঘর —

ঘরের ভেতর একটি চেয়ার, এক আলমারি, কিছু পুরনো বোতল, আর একটা কাঠের বাক্স।

সে খোলার চেষ্টা করল। ঢাকনা খুলতেই দেখা গেল ভিতরে রাখা—

কয়েকটি হাত লেখা স্ক্রিপ্ট — নাটকের পাণ্ডুলিপি, অনুর হাতে লেখা গানের সুর, একটি পুরনো ছবি — গিরীশচন্দ্র, অনুরাধা ও অন্য কিছু অচেনা মুখ, একটি মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে এবং একটি দিনলিপি: “সত্যবিমার্শের নাট্য সন্ধ্যা – ১৮৭৯, চিত্রকূট”

এতদিন ধরে ইতিহাস যাকে ভেবেছে ‘নিখোঁজ’, সে আসলে ছিল আন্দোলনের পরিচালক, স্রষ্টা, ও নেপথ্য কণ্ঠস্বর।

ঈশা বুঝে গেল, এই গোপন কক্ষ ছিল অনুর স্বপ্ন ও সংগ্রামের আঁতুড়ঘর। সে উঠে এসে দোতলার নিজের ঘরে ফিরে সমস্ত প্রমাণ একত্র করল — প্রতিচিত্র, চিঠি, গানের সুর, সাংগঠনিক রেকর্ড, ফটোগ্রাফ, গোপন কক্ষের নথি।

ড. গুহকে সব পাঠাতে সে স্ক্যান করে ফোল্ডারে রাখল:

“Anuradha_Renaissance_Papers”

এবং একটি শেষ লাইন টাইপ করল— “এই কণ্ঠ রোধ করা হয়েছিল। আজ সেই কণ্ঠ ইতিহাস হয়ে ফিরল।”

সে জানত, পরের অধ্যায় হবে আরও তীব্র — প্রকাশ, বিতর্ক, সত্য ও ক্ষমতার লড়াই। কিন্তু ঈশা প্রস্তুত। কারণ সে শুধু একজন আর্কাইভিস্ট নয়, আজ সে এক কণ্ঠের উত্তরাধিকারী।

ছয়

কলকাতায় ফিরেই ঈশা বুঝতে পারল, তার জীবন আর আগের মতো নেই।

তার হার্ডড্রাইভে ছিল সেই সত্যের দলিল, যা একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে মাটি চাপা পড়ে ছিল — জমিদার রাজনীতির, সামাজিক নিপীড়নের, এবং এক নির্ভীক নারীর আত্মত্যাগের ইতিহাস। অনুরাধা দেবী এখন কেবল অতীত নন — তিনি হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের অমীমাংসিত প্রশ্ন।

ঈশা প্রথমেই যোগাযোগ করল ড. অমিতাভ গুহ-র সঙ্গে।

“এই প্রমাণগুলো,” তিনি বললেন, “তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না, এগুলো কেবল আর্কাইভের বিষয় নয়। এগুলো এক সামাজিক বিপ্লবের দলিল, যেটাকে সযত্নে চেপে রাখা হয়েছে।“

“আমরা কি এগুলো প্রকাশ করতে পারি?” ঈশা জিজ্ঞেস করল।

ড. গুহ মাথা নেড়ে বললেন, “পারো, অবশ্যই পারো। কিন্তু বাধা আসবে। রাজবাড়ির বর্তমান উত্তরসূরিরা এখনো প্রভাবশালী। এবং তারা চাইবে না তাদের পূর্বপুরুষদের দোষ প্রকাশ্যে আসুক।”

তবুও ঈশা পিছিয়ে গেল না। সে প্রথমে একটি গবেষণা-পত্র তৈরি করল: “The Silenced Voice: Anuradha Devi and the Forgotten Revolution of Bengal Renaissance”

তারপর সেই প্রবন্ধ পাঠাল দেশ-বিদেশের ইতিহাসজ্ঞানীদের, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, এবং কিছু প্রগতিশীল সাংবাদিকদের।দু’সপ্তাহের মধ্যেই প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করল।

Scroll, EPW, The Wire— সব জায়গায় অনুরাধার নাম ফিরে এল আলোচনায়। কেউ বলছে, “ঈশা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবিষ্কার একটি নয়া দিগন্ত,”

আবার কেউ প্রশ্ন তুলছে, “কীভাবে এতদিন এই তথ্য আড়ালে ছিল?”

কিন্তু সবার আগে খবরটি পৌঁছাল চিত্রকূট রাজবাড়ির বর্তমান মালিক, রাজশেখর রায়-এর কাছে। ঈশা তখন এক সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে কাজ করছিল, হঠাৎ ফোন এল।

এক কড়া কণ্ঠ: “আমি রাজশেখর রায় বলছি। আপনি কি ঈশা বন্দ্যোপাধ্যায়?”

“জি, আমি। কীভাবে—?”

“আপনি যে কাজ করছেন, তা আমাদের পারিবারিক সম্মানহানিকর। আমরা আইনি ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হব।”

ঈশার হাত জমে গেল। কিন্তু সে শান্তভাবে বলল, “আমি কেবল প্রমাণ সংগ্রহ করেছি। সত্য আপনার পারিবারিক ইতিহাসকে নাড়িয়ে দিচ্ছে, সেটার দায় আমি নিতে পারি না।”

রাজশেখর ফোন রেখে দিলেন। ঈশা জানত — যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তারপর থেকেই শুরু হলো মিডিয়া হুমকি, বৈধ নোটিশ, এবং ‘ঐতিহ্য রক্ষার’ নামে আপত্তি। তবে এরই মধ্যে কিছু সংবাদপত্র ও সমাজকর্মী এগিয়ে এলেন ঈশার পাশে।

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সোমনাথ দে একটি বিবৃতি দিলেন— “ঐতিহাসিক সত্য প্রকাশে যদি ভয় থাকে, তবে আমরা এখনও ঔপনিবেশিক মানসিকতার শৃঙ্খলে বন্দি।”

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ ঈশার গবেষণা প্রবন্ধকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং প্রস্তাব তোলে, অনুরাধা দেবীকে “Bengal Renaissance” ক্যাননের অন্তর্ভুক্ত করার।

এরপরে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের হয় — “চিত্রকূট রাজবাড়ির সাংস্কৃতিক দলিলসমূহ জাতীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণার জন্য।”

এখন আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে — অনুরাধার কণ্ঠ ইতিহাসে ফিরবে, না আবার একবার স্তব্ধ হবে?

আদালতের দিন এল। বিচারপতির সামনে দুই পক্ষ।

একদিকে রাজশেখর রায়ের উকিল বলছে, “এই তথাকথিত প্রমাণ গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো আইনত সংরক্ষিত নথি নয়, ব্যক্তিগত সংগ্রহ।”

অন্যদিকে ঈশার দল, নেতৃত্বে ড. গুহ, প্রমাণ পেশ করল — অনুরাধার হাতে লেখা গান, সনাক্তযোগ্য চিত্র, আন্দোলনের প্রতীক, এবং গোপন কক্ষ থেকে উদ্ধারকৃত চিঠি।

সবার নজর কাড়ল একটি ছোট ভিডিও ক্লিপ: ঈশা নিজে চিত্রকূটের বেসমেন্টে গিয়ে অনুরাধার বাক্স উন্মোচন করছে।

বিচারপতি মৃদু হেসে বললেন, “তাহলে ইতিহাস আজ নিজেই সাক্ষী দিচ্ছে।”

রায় ঘোষিত হলো:

“অনুরাধা দেবীর সাংস্কৃতিক অবদান এবং তার গোপন আন্দোলনের প্রমাণগুলি যথাযথ মূল্যায়নযোগ্য। রাজবাড়ির সংশ্লিষ্ট দালিলিক সংগ্রহ সংরক্ষণের জন্য একটি বিশেষ ট্রাস্ট গঠন করা হবে, যেখানে ঈশা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পর্যবেক্ষণে গবেষণা চলবে। চিত্রকূটের গোপন ইতিহাস জাতির সামনে উন্মুক্ত করা হবে।”

ঈশার চোখে জল চলে এল। অবশেষে, ইতিহাসের বিচারসভায় সত্য জয়ী হল। কিছুদিন পর চিত্রকূটে ফিরে ঈশা একটা ছোট অনুষ্ঠানের আয়োজন করল। রাজবাড়ির সেই পুরনো হলঘরে এক সন্ধ্যা —

আলোকসজ্জা খুব বেশি নয়, কেবল এক টুকরো আলো, একটুকরো প্রতিধ্বনি। অভিনেত্রী পারমিতা অনুরাধার লেখা সেই গান গাইলেন —

“আমি ফিরব, জানি আমি ফিরব…

তোমার আঁকা চোখে,

আমার কণ্ঠ থামবে না…”

চারপাশ নিঃশব্দ। কিন্তু সেই নিঃশব্দতাতেই অনুরাধার গলা ভেসে বেড়ায়। ঈশা জানত — অনুরাধা ফিরে এসেছেন। এবার কেউ তাকে মুছে ফেলতে পারবে না।

সাত

রাত তখন প্রায় দশটা। চিত্রকূটের রাজবাড়ির সিংহদ্বার সুনসান, শুধু দূরের বাঁশবাগানে ঝিঁঝিঁর ডাক। ঈশা, সেই গোপন ঘরের নথি সংরক্ষণের কাজ শেষ করে বেরোতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পায়ের নিচে ঠোক্কর খেল একটা পাতলা ধাতব বাক্সে।

বাক্সটা আগেও চোখে পড়েনি। ধুলো ঝেড়ে সে খোলার চেষ্টা করল — একটা ছোট ব্রোঞ্জের লক, এক পাশে অদ্ভুত শৈলীতে খোদাই করা একটি অক্ষর: “অ”।

লকটা সহজেই খুলে গেল, যেন কারও অপেক্ষায় ছিল। ভিতরে রাখা ছিল শুধু একটা জিনিস — একটা চিঠি।

সাদা কাগজে, হালকা হলদে হয়ে আসা, হাতে লেখা… অদ্ভুতভাবে পরিচিত সেই একই কাব্যময় ভাষা। ঈশার হাত কেঁপে উঠল। চিঠির উপরে লেখা ছিল:

“বিনয়,

যখন আমি আর থাকব না…”

ঈশা জানত, এই চিঠি কোনো ইতিহাসবিষয়ক দলিল নয় — এই চিঠি হৃদয়ের দলিল। সে চুপচাপ বসে পড়তে শুরু কর — চিত্রকূট, ১৮৮০ সালের শ্রাবণ

বিনয়,

জানি, তুমি আর একদিন ফিরবে না। না ফিরলেই ভালো।এখানে যে অন্ধকার জমে উঠেছে, তার মধ্যেই আমার কণ্ঠ চাপা পড়েছে। বাবা আজকাল শুধু চোখে ভয় নিয়ে ঘোরেন, যেন আমার গান তার সর্বনাশ ডেকে আনবে। তুমি যখন প্রতিচ্ছবি আঁকছিলে, আমি তখন জানতাম, আমার মুখের রেখাগুলো তুমি শুধু ভালোবাসা দিয়ে নয়, ভয় আর বিদ্রোহ দিয়ে আঁকছ। কাল রাতে সত্যবিমার্শের সেই গান তোমায় গেয়ে শুনালাম, সেটাই আমার শেষ গান। জানি, ওরা আর সহ্য করবে না। বাবা আমাকে ‘চিকিৎসার জন্য’ পাঠাতে চান বহরমপুরের এক আশ্রমে। মায়ের মুখে অশ্রু, কিন্তু সে চুপ। আমি যদি যাই, ফিরে আসব না। তাই এই চিঠি রেখে যাচ্ছি। বাক্সে গানগুলো, কবিতাগুলো, আর আমাদের নাটকের পাণ্ডুলিপি রেখেছি। জানি না, তুমি কখনো এগুলো খুঁজে পাবে কিনা। যদি পারো, এগুলোকে বাঁচিও। আমার গান যেন কেবল কণ্ঠের মধ্যে আটকে না থাকে — যেন মানুষের মঞ্চে ওঠে। যেন কেউ বলে, আমি ছিলাম। তোমার প্রতিচ্ছবির সেই চোখের রেখাগুলোই আমার প্রতিরোধ।

– অনুরাধা

চিঠিটা পড়ার পর ঈশা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল।হাওয়া থেমে গেছে যেন। বাইরে রাত আরও গাঢ়। এই ছিল তার — শেষ চিঠি। না, শুধু বিনয়ের জন্য নয়। এই চিঠি লেখা হয়েছিল ভবিষ্যতের কারও জন্য — যে অনুর কণ্ঠ আবার শোনাবে।

সে বুঝে গেল, আজ এই রাতেই ইতিহাসের আরেক স্তর খুলে গেছে। পরের দিন ঈশা একটি সংবাদ সম্মেলনে এই চিঠিটি পড়লেন। তাঁর গলায় কাঁপুনি ছিল, কিন্তু শব্দ ছিল দৃঢ়। জার্নালিস্টরা নিঃশব্দে শুনছিলেন। শেষে ঈশা বলল:

“এই চিঠি আমাদের ইতিহাসের সেই দিক, যা পাঠ্যবইতে নেই। আমরা শুধু রাজাদের কথা জানি, কিন্তু কণ্ঠরুদ্ধ রাজকন্যার কথা জানি না। আজ থেকে জানব।”

চিঠির একটি ফ্যাক্সিমাইল স্ক্যান জাতীয় আর্কাইভে জমা দেওয়া হলো।

“Anuradha’s Last Letter” নামে একটি স্থায়ী প্রদর্শনী তৈরি হলো চিত্রকূট-সেন্টারে। বিনয়ের অসমাপ্ত প্রতিচিত্র তার পাশে স্থান পেল।

সেই রাতে ঈশা তার ডায়েরিতে লিখল: “আমি ইতিহাস খুঁজতে এসেছিলাম। কিন্তু পেয়েছি একটি চিঠি, যা আঁধারে লেখা হয়েছিল — আলোয় ফেরার জন্য। এই আলো আর কেউ নেভাতে পারবে না।”

আট

চিত্রকূট রাজবাড়ির প্রাচীন হলঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। ঈশা হাত ধরে বসল সেই পুরনো, অসমাপ্ত প্রতিচিত্রটির সামনে— যা বহুদিন ধরে চোখ ফোটেনি তার গভীরে লুকিয়ে থাকা রহস্যের।

ঈশার নজর পড়ল ক্যানভাসের এক কোণে, যেখানে রংয়ের স্তর তুলনামূলক পাতলা। সে নড়েচড়ে বসল।

“এখানে তো রংয়ের নিচে কিছু লুকানো আছে,” সে ফিসফিস করে বলল। ঈশা তার হাতে থাকা ছোট আঠালো টেপের স্লাইডার তুলল এবং আলোর নিচে সেই অংশটা পরীক্ষা করতে লাগল। কিছুক্ষণ পর সে দেখতে পেল—ছায়াপথের মতো অদ্ভুত একটা নকশা। রংয়ের স্তর খসে পড়ার কারণে দেখা যাচ্ছিল, এক ফাঁকা জায়গার নিচে কিছু হাতের লেখা শব্দ। ঈশা তার ব্যাগ থেকে ইনফ্রারেড স্ক্যানার বের করল এবং ক্যানভাসের ওপর প্রয়োগ করল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল অক্ষরগুলো—

বাংলায় লেখা: “সত্যের পৃষ্ঠা খুঁজে পাওয়া কঠিন, কিন্তু চোখের বাইরে চোখ রেখো।”

ঈশা কপালে ভাঁজ ফেলল। “কেউ চেয়েছে এই ছবির মাধ্যমে একটা বার্তা পাঠাতে।”

তার হাতে ক্যানভাসটা একটু ঝুলে গেল, তখন মনে হলো— ক্যানভাসের পেছনের কাঠের ফ্রেমে কিছুটা অস্বাভাবিক। ঈশা যত্ন করে ক্যানভাসের ফ্রেম থেকে মসৃণ কাঠের প্যানেল তুলতে শুরু করল। বহুবার চেষ্টা করেও কাঠের প্যানেলে অদ্ভুত এক ছোট তালা ধরা পড়ল। তালা, যার ডিজাইন একেবারে ভিন্নরকম — রাজবাড়ির প্রাচীন শাসক পরিবারের প্রতীক দিয়ে খোদাই করা। ঈশার মনে হলো, এই তালা খুললেই মিলবে আরও বড় রহস্য। তালাটা খুলতে, ঈশা তার ব্যাগ থেকে ছোট পাঞ্চ টুল বের করল, আর অল্প চেষ্টা করেই খোলার সক্ষম হল। তালা খুলতেই মুকুটের মতো একটি পাতলা কাগজের বান্ডিল বেরিয়ে এল। কাগজগুলো পুরনো, সেদিনের কাগজের গন্ধ এখনও ধরে আছে।

ঈশা আস্তে আস্তে এক এক করে খুলে পড়তে শুরু করল—

কাগজগুলো ছিল একাধিক:

চিঠি: জমিদার রাজবাড়ির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম দিয়ে লেখা।

ডায়েরি পৃষ্ঠা: যেগুলোতে লেখা ছিল বেশ কিছু রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কথা।

একটি মানচিত্র: যেখানে চিত্রকূট ও তার আশেপাশের অঞ্চল চিহ্নিত।

চিঠিগুলোতে লেখা ছিল, কীভাবে সেই সময়ের প্রভাবশালী পরিবার গোপনে স্বাধীনতা আন্দোলন দমনে রাজ্য প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়েছিল। সেই সঙ্গে আছে একটি বিশেষ পরিকল্পনার কথা — “অদৃশ্য হাত” নামের একটি গোপন বাহিনী, যারা নীরবে স্বাধীনতাবিরোধীদের কার্যক্রম চালাতো।

ঈশার মাথায় এক নতুন প্রশ্ন জন্ম নিল— অনুরাধা দেবী কি এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন?

তার আগের আবিষ্কারগুলো এখন নতুন অর্থ পেল। তারপরেই চোখ পড়ল মানচিত্রের ওপর, যেখানে একটি ছোট কালো বিন্দু অতি স্পষ্ট।

ঈশা বড্ড উৎসাহী হয়ে সেই বিন্দুটির অবস্থান ঠিক করল। “চিত্রকূট রাজবাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, এক প্রাচীন বটগাছের নিচে…”

ঈশা ঠিক করল, পরের দিন সে সেই জায়গায় যাবে। পরদিন সকালে ঈশা সেই বটগাছের কাছে পৌঁছালো। জমি খুঁড়তে শুরু করল এবং বেশ দ্রুতই পেল একটি ছোট ধাতব বাক্স। বাক্সটি খুলতেই বের হলো — একগুচ্ছ পুরনো দলিল, সিল করা মোমের ছাপ সহ, আর একটি ছোট ডায়েরি।

ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই দেখা গেল, লেখা: “এই ডায়েরি লেখা হয়েছে আমার জীবনের শেষ সময়কালে, যাদের ওপর বিশ্বাস করতে পারি না, তারা আমাকে ধ্বংস করতে চাইছে। এই সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু একটাই প্রার্থনা, সত্যের জ্বলন্ত প্রদীপ যেন নিভে না যায়।”

ঈশা আবেগে কাঁদতে লাগল। সে বুঝতে পারল— ইতিহাসের এই স্তর গুলো এমন নয় যা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা দেয়। এগুলি খুঁজে পাওয়া কঠিন, এবং যারা খুঁজে পায়, তাদের অনেক সময় বিপদ নিতে হয়। ঈশা ঠিক করল, এই নতুন তথ্য সুরক্ষিত রাখতে হবে। সে আবারও তার ল্যাপটপ খুলে গেল এবং ডকুমেন্টগুলো স্ক্যান করতে শুরু করল। চিত্রকূট রাজবাড়ির প্রাচীন দেয়ালগুলো যেন আবারও গোপন কথা বলে উঠল। রাতের দিকে যখন ঈশা ফিরে আসল, সে তার ডায়েরিতে লিখল:

“প্রতিচিত্র শুধু ছবি নয়, সে ইতিহাসের দরজা। আজ সেই দরজার অন্তরালে যাওয়া হয়েছে, যেখানে লুকিয়ে আছে গোপন ষড়যন্ত্র, আর এক নারীর সাহসিকতা। ইতিহাস শুধু পাণ্ডুলিপি নয়— সে অনুভবের মধ্যেও লুকিয়ে আছে।”

ঈশার সামনে এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল— কিভাবে এই তথ্যগুলোকে প্রকাশ করা হবে, যাতে কেউ ক্ষতি না করে? তবে সে জানত, এটাই তার জীবনকাজ।

নয়

চিত্রকূটের বাতাস ভারী হয়ে উঠছিল। রাজবাড়ির পুরোনো দেয়ালগুলো যেন কোনো গোপন কষ্ট পুষে রাখছিল। ঈশার হাতে সেগুলো স্পর্শ করলে মনে হচ্ছিল ইতিহাসের অন্ধকার পাতা যেন ছেঁড়া হবে। ঈশা জানত, প্রতিচিত্রের অন্তরালে পাওয়া দলিলগুলো শুধু ইতিহাসের নয়, তারা এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথচলার সূচনা। ঈশা ফিরে গেল কলকাতায়।

সে বদ্ধদ্বারে বসে একদিনে ডকুমেন্টগুলো পুনঃপাঠ করছিল। তার চোখে ভেসে উঠল সেই চিঠি, যার স্বাক্ষর ছিল – রাজশেখর রায়ের এক পূর্বপুরুষ, জমিদার বিষ্ণুপ্রসাদ রায়।

চিঠিতে লেখা ছিল, এক গোপন দলিল নিয়ে পরিকল্পনা, যেটা ছিল স্বৈরশাসক শাসকদের সঙ্গী হতে রাজবাড়ির এক ‘অদৃশ্য হাতের’ ষড়যন্ত্র।

ঈশা বুঝতে পারল, এটা শুধু ঐতিহাসিক দলিল নয় — একটু একটু করে একটি বিষাক্ত মায়া বুনিয়াদ তৈরি করছে। ঈশার মনে পড়ল, রাজশেখর রায়ের হুমকির দিনগুলো। সে জানত, রাজবাড়ির লোকেরা আজও আগের মতো প্রভাবশালী। ঈশার মন বলল, এদের সাম্রাজ্য ভাঙতে গেলে প্রচণ্ড সাবধানতা দরকার। এক বিকেলে ঈশা ড. গুহের সঙ্গে দেখা করল।

“আমাদের সামনে একটা বড় ষড়যন্ত্র,” ঈশা বলল।

“যার ছায়া আজও রাজবাড়ির রাজনীতির ওপর পড়ে আছে।”

ড. গুহ মাথা নেড়ে বললেন, “আমাদের উচিত এগুলো যাচাই করে প্রকাশ করা।”

তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি দল গঠন করবে — ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, আইনজীবী মিলে। কয়েকদিন পর, তারা রাজবাড়ির পুরোনো মাটির তলায় খোঁজ চালাতে শুরু করল। ঈশার হাত ধরে দলটি পেয়েছিল সেই ‘অদৃশ্য হাতের’ মুল দলিল, যেখানে লেখা ছিল কত মানুষকে নিরীহভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল ষড়যন্ত্রের জেরে। ঈশার জানালা দিয়ে বিকেলের সূর্য ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ দরজার শব্দ শুনে সে ঘুরে দেখল, রাজবাড়ির একজন পরিচিত লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে।

“ঈশা, তুমি সাবধানে থাকতে হবে,” সে ফিসফিস করে বলল।

“রাজশেখর রায় জানে তোমার কাজের কথা। ওরা তোমাকে থামাতে চাইবে।”

ঈশার মনে হলো, তার কাজ এখন শুধু গবেষণা নয় — আত্মরক্ষা। রাতের আধারে ঈশা তার ল্যাপটপে দলিলগুলো আপলোড করছিল, যাতে তথ্য গোপন না থাকে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল, অপরিচিত নম্বর।

“তুমি থেমো না,” এক কণ্ঠ বলল, “তুমি জানোই না, তোমার সামনে কী আছে।”

ঈশার হাতে কাঁপুনি উঠল, কিন্তু সে শক্ত মন নিয়ে বলল, “সত্যের পথেই আছি আমি।”

পরদিন সংবাদমাধ্যমে বড় খবর বেরল — “চিত্রকূট রাজবাড়ির গোপন ষড়যন্ত্র উন্মোচিত, জাতীয় তদন্ত শুরু।” ঈশার কাজ আজ শুধু ইতিহাস লেখা নয়, দেশের ইতিহাসকে পুনর্লিখনের দায়িত্ব নিয়েছে।

দশ

ঈশার চোখ বেজে উঠছিল অল্পনিদ্রায়। চিত্রকূটের সেই পুরনো জমিদার বাড়ির রহস্য এখন তার হাতের মুঠোয়। সেই অদৃশ্য হাতের ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে অনুরাধার শেষ চিঠি, সবকিছু আজ দেশের সামনে এসেছে।

তার দলিল ও প্রমাণাদি প্রকাশিত হবার পর, একদিকে রাজনীতি সরগরম, অন্যদিকে জনমানসে ইতিহাসের নতুন দৃষ্টিভঙ্গি জন্ম নিয়েছে। ঈশার কাছে সবকিছু যেন নতুন আলোয় ভেসে উঠছিল।

ঈশা ভাবছিল, ইতিহাস কখনো কেবল অতীতের গল্প নয়, সে জীবন্ত, বাঁচানো যায় এবং আবার লেখানো যায়। তার কাজ আর শেষ হয়নি, তবে সে জানত— এবার থেকে তার পথে থাকবে সততা ও সাহসের আলোকস্তম্ভ। এক বিকেলে, ঈশা চিত্রকূট রাজবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে, পুরনো বটগাছের ছায়ায় ভাবছিল— যে গাছের তলায় সে প্রথম সেই লুকানো দলিল পেয়েছিল, সে গাছ যেন বলছিল, “তুমি চলেছ সঠিক পথে।”

ঈশার হৃদয়ে শান্তি নেমে এসেছে। সে বুঝল, অতীতের অন্ধকারে যতই ষড়যন্ত্র লুকানো থাক, সত্য একদিন আলো ছুঁয়ে যায়ই। ঈশার জীবন এখন নতুন এক যাত্রার শুরু, যেখানে ইতিহাস আর রহস্য একসঙ্গে বেঁধে রাখবে সত্যের ডোর। রাজবাড়ির সেই পুরনো দেয়ালগুলো আজ আর গোপন কথা চাপা রাখে না।

ঈশার সংগ্রহ করা দলিল আর দল তার নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে দিচ্ছে ইতিহাসের সত্য চিরন্তন। সেই সন্ধ্যায় ঈশা ফিরে এল তার ঘরে। তার ল্যাপটপ খুলে নতুন এক দলিল তৈরি করল, যা হবে তার জীবনের সর্বশেষ কাজ: “চিত্রকূট রহস্য: এক ইতিহাসের পুনর্জন্ম”

ঈশা জানত, এই গল্প কখনো শেষ হয় না— কারণ ইতিহাস কখনো থামে না। তবে আজ সে আনন্দে হাসল, কারণ সত্যের আলো কখনো নিভে না।

 

শেষ

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

1000023354.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *