Bangla - রহস্য গল্প

চিত্রকরের শেষ ছবি

Spread the love

দীপক সাহা


শহরের নিস্তব্ধ সকালের আলোয় যখন পত্রিকার পাতায় পাতায় ছাপা হচ্ছিল গত রাতের নানা খবর, তখনই মানুষের চোখে ধরা দিল এক অস্বাভাবিক শিরোনাম—“বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর অরিন্দম রায় হঠাৎ নিখোঁজ।” খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই সারা শহরে আলোড়ন। যে মানুষটি তার তুলি আর রঙের যাদু দিয়ে বিশ্বকে বারবার অবাক করেছে, যার চিত্রকর্ম একেকটা প্রদর্শনীতে কোটি টাকারও বেশি দামে বিক্রি হয়, তিনি নাকি হঠাৎ করেই উধাও! অরিন্দম ছিলেন শুধু শিল্পী নন, তিনি ছিলেন এক ধরনের দর্শন—রঙের ভেতরে মানুষের অজানা ভয়, দুঃখ, ভালোবাসা আর মৃত্যুর প্রতিচ্ছবি তিনি এমনভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, যেন প্রতিটি ছবিই জীবন্ত হয়ে ওঠে। এমন এক মানুষ হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেলে তা সাধারণ নিখোঁজের ঘটনা বলে কেউই মানতে রাজি ছিল না। সংবাদমাধ্যম তার পুরোনো ছবি, সাক্ষাৎকার আর প্রদর্শনীর ভিডিও বারবার দেখাতে লাগল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভরে উঠল প্রশ্নে—“অরিন্দম কোথায় গেলেন?” পুলিশও প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি, ভেবেছিল হয়তো শিল্পী আবারও কোনো নির্জন জায়গায় চলে গেছেন, কারণ তিনি মাঝেমধ্যেই এমন করতেন—হপ্তার পর হপ্তা অচেনা গ্রামে, পাহাড়ের কোণে কিংবা সমুদ্রতটে একা একা ছবি আঁকতেন। কিন্তু এবার বিষয়টা ভিন্ন ছিল, কারণ তার স্টুডিওর দরজা খোলা অবস্থায় পাওয়া যায়, ভেতরে রাখা ছিল না কোনো ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, আর মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ—সবই টেবিলের ওপরে গুছিয়ে রাখা। যেন ইচ্ছে করেই তিনি চলে গেছেন, অথবা কেউ তাকে নিয়ে গেছে।

স্টুডিওটিকে তল্লাশি করার সময় পুলিশ প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্যানভাস আর রঙের টিউবগুলিকে, কারণ এগুলো ছিল শিল্পীর দৈনন্দিন জগতের স্বাভাবিক উপাদান। কিন্তু কক্ষের একেবারে মাঝখানে রাখা একটি বড় ক্যানভাস সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আলো-অন্ধকারের খেলা আর অদ্ভুত অসমাপ্ত ছায়ারেখা দিয়ে আঁকা ছবিটি দেখামাত্র সবার শরীরে কাঁটা দেয়। ছবির কেন্দ্রে আঁকা ছিল একজন মানুষের ছায়া—তীক্ষ্ণ, অচেনা, অথচ ভয়ংকরভাবে বাস্তব মনে হওয়া সেই অবয়বটি চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাল রঙের রেখায় আচ্ছন্ন, যা রক্তের দাগের মতো দেখাচ্ছিল। ছবিটি অসমাপ্ত হলেও এর ভেতরে এমন এক চাপা অস্থিরতা কাজ করছিল যে মনে হচ্ছিল, এটি শুধুই শিল্পকর্ম নয়—বরং কোনো অশুভ ইঙ্গিত। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ অফিসার অরিজিৎ মুখার্জি অস্বস্তিতে কপালে ভাঁজ ফেললেন, তিনি শিল্পপ্রেমী মানুষ নন, কিন্তু এত বছর কাজের অভিজ্ঞতায় তার চোখে এই প্রথম কোনো ছবিকে অপরাধের সম্ভাব্য ক্লু বলে মনে হলো। তিনি ছবির আশেপাশে ঘুরলেন, তুলির টাটকা দাগ স্পর্শ করে বুঝলেন, অরিন্দম খুব সম্প্রতি এটি আঁকছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করেই কাজ থেমে গেছে। কোনো জোরপূর্বক ঢোকার চিহ্ন নেই, কোনো লড়াইয়ের দাগ নেই, তবে বাতাসে যেন এক ধরনের শীতল ভয় ভাসছিল। বাইরে ভিড় জমেছে সংবাদকর্মী আর শিল্পীর ভক্তদের, সবাই জানতে চাইছিল ভিতরে কী পাওয়া গেছে। পুলিশ আপাতত ছবিটির কথা প্রকাশ করেনি, কারণ তারা নিশ্চিত ছিল না—এটি কি নিছক শিল্পীর কল্পনা, নাকি বাস্তবের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত কোনো ইঙ্গিত।

এদিকে, শহরের মানুষজন গুজব ছড়াতে শুরু করল। কেউ বলল অরিন্দম নাকি মৃত্যুর আগে থেকেই কিছু অদ্ভুত আঁকছিলেন, যেন তার ক্যানভাসে ভবিষ্যৎ ধরা দিচ্ছিল। কেউ বলল তিনি শয়তানের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন, আর এখন সেই চুক্তির শেষ সময় এসে গেছে। শিল্পীর কাছের কিছু মানুষ আবার বলল তিনি হয়তো মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, কারণ তার সাম্প্রতিক কয়েকটি ছবিতে শুধু অন্ধকার, ছায়া আর রক্তের মতো লাল রেখাই দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু যে-ই যাই বলুক, সত্য হলো—অরিন্দম নেই, তার স্টুডিওতে পড়ে আছে একটি ভয়ংকর অসমাপ্ত ছবি, আর সেই ছবি শহরের ওপর নেমে আনছে এক অদৃশ্য আতঙ্ক। অরিজিৎ ঠিক করলেন ছবিটিকে আপাতত প্রমাণ হিসেবে জব্দ করবেন, কিন্তু মনের গভীরে তিনি জানতেন—এটি কোনো সাধারণ প্রমাণ নয়, বরং হয়তো এই রহস্যের কেন্দ্রবিন্দু। আর সেখান থেকেই শুরু হলো চিত্রকরের অন্তর্ধানকে ঘিরে অদ্ভুত এক অনুসন্ধান, যা ধীরে ধীরে প্রমাণ করবে মানুষের বিশ্বাসের সীমারেখা কতটা ভঙ্গুর হতে পারে, আর শিল্প কখনো কখনো কতটা ভয়ংকর সত্যকে জীবন্ত করে তুলতে পারে।

__

স্টুডিওর ভেতরে ঢোকার পর যে পরিবেশের মুখোমুখি হলো পুলিশ দল, তা শুধু একটি শিল্পীর কর্মক্ষেত্র নয়, বরং এক রহস্যের গুহা। দেওয়াল জুড়ে ঝুলছে পুরোনো এবং সাম্প্রতিক আঁকা ছবি, যেগুলোর বেশিরভাগেই মানুষের মুখ নেই, বরং মুখের জায়গায় ছায়া বা শূন্যতা। কিছু ছবিতে নিস্তব্ধ শহর, শূন্য রাস্তা আর একাকী মানুষ আঁকা, যা দেখলে মনে হয় যেন সময় থেমে গেছে। রঙের গন্ধ, পুরোনো তুলি আর শুকনো ক্যানভাসের ধুলো মিলেমিশে এক ধরনের চাপা ভারী আবহ তৈরি করেছে। অফিসার অরিজিৎ কক্ষের প্রতিটি কোণ খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন—টেবিলের ওপর রাখা খোলা নোটবুক, কিছু অসমাপ্ত স্কেচ, পাশে রাখা একগাদা চিঠি যেগুলো কারও কাছে পাঠানো হয়নি। প্রতিটি জিনিসই যেন কিছু বলতে চাইছে, অথচ সরাসরি কিছুই বলছে না। এর মাঝেই মাঝখানে রাখা বিশাল ক্যানভাসটি বারবার তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। অসমাপ্ত ছবিতে আঁকা ছায়া আর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাল রেখা দেখে অরিজিৎ বুঝলেন, এটা নিছক কোনো রঙের খেলা নয়। তিনি ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই মনে হলো ছবির ভেতরের ছায়ামূর্তি যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে, যেন শূন্য চোখে তাকিয়ে অদ্ভুত এক বার্তা দিচ্ছে। অফিসারের মেরুদণ্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল, অথচ তিনি মুখে কিছু বললেন না, কারণ তিনি জানতেন তার দল যদি তাকে ভীত বলে ধরে, তাহলে তদন্ত দুর্বল হয়ে যাবে।

অরিজিৎ ছবির পাশেই রাখা কাঠের একটি পুরোনো টেবিলের ড্রয়ার খুললেন। ভেতরে পাওয়া গেল অনেকগুলো ছোট ছোট কাগজ, যেখানে অরিন্দম দ্রুত হাতে কিছু শব্দ লিখে রেখেছিলেন—“আমি যা দেখি, কেউ বিশ্বাস করে না”, “তুলি আমার হাত ছাড়ে না”, “ছবির ভেতরে আটকে যাচ্ছে মানুষ।” এই লাইনগুলো পড়ে মনে হলো শিল্পী হয়তো মানসিক বিভ্রমে ভুগছিলেন, অথবা তিনি সত্যিই এমন কিছু দেখতেন যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। কাগজগুলোর মধ্যে একটি আধভাঙা পেন্সিল দিয়ে আঁকা স্কেচে দেখা গেল একটা মানুষের দেহ মাটিতে লুটিয়ে আছে, চারপাশে অদ্ভুত ঘূর্ণি, আর উপরে লেখা—“আগামীকাল।” শব্দটা দেখে অরিজিৎ থমকে গেলেন। কি অর্থ এর? আগামীকাল কাকে ইঙ্গিত করছে? তিনি স্কেচটি সাবধানে ভাঁজ করে রাখলেন। এদিকে, দলের আরেক সদস্য জানাল, জানালার পাশে ছেঁড়া কাপড়ের মতো কিছু পাওয়া গেছে, হয়তো অরিন্দমকে জোর করে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু আবার কোনো লড়াইয়ের চিহ্ন নেই, কোনো রক্ত নেই, ভাঙা আসবাব নেই। যেন অদৃশ্য কোনো হাত তাকে টেনে নিয়ে গেছে। চারদিকে ছড়ানো রঙের টিউবগুলোর কিছুতে শুকনো রক্তের মতো গাঢ় লাল রঙ জমাট বেঁধেছে। এগুলো দেখে মনে হলো ছবির রঙ আর বাস্তবতার সীমারেখা এখানে মিলেমিশে গেছে।

তদন্তের মাঝেই বাইরে থেকে বারবার শব্দ আসছিল—সংবাদকর্মী, প্রতিবেশী আর শিল্পপ্রেমীরা স্টুডিওর বাইরে দাঁড়িয়ে জটলা করছে, প্রত্যেকে জানতে চাইছে কী হচ্ছে ভেতরে। কেউ বলছে অরিন্দমকে অপহরণ করা হয়েছে, কেউ আবার বলছে তিনি নিজেই পালিয়ে গেছেন নিজের ভবিষ্যদ্বাণী থেকে বাঁচতে। অফিসার অরিজিৎ তাদের কিছু না জানিয়ে পুলিশ ব্যারিকেড বসানোর নির্দেশ দিলেন। তিনি জানতেন এই রহস্যের সমাধান সময়সাপেক্ষ হবে এবং যেকোনো ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়লে শহরজুড়ে আতঙ্ক নেমে আসবে। কিন্তু তার নিজের ভেতরেও একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। তিনি সারাজীবন অপরাধীদের মুখোমুখি হয়েছেন, লাশ দেখেছেন, খুনের রহস্য উন্মোচন করেছেন—কিন্তু কোনো ছবিকে এরকম ভয়ংকরভাবে জীবন্ত হতে তিনি কখনো দেখেননি। সেই অসমাপ্ত ক্যানভাসে যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে অজানা এক শক্তি। হঠাৎ তার মনে হলো, যদি সত্যিই অরিন্দম এমন কিছু আঁকতেন যা ভবিষ্যৎকে বলে দেয়? আর যদি সেই ভবিষ্যৎ মৃত্যু হয়? তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, চারপাশে তাকালেন, এবং শেষমেশ ছবিটির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বললেন—“এটাই হয়তো এই নিখোঁজের রহস্যের একমাত্র চাবি।” কিন্তু অরিজিৎ তখনও জানতেন না, এই ছবির ভেতরে লুকিয়ে থাকা ছায়া শুধু তার জন্য অপেক্ষা করছে, আর খুব শিগগিরই সে বুঝতে পারবে, ক্যানভাস আর বাস্তবের সীমারেখা একবার ভেঙে গেলে তা আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না।

__

শহরের ব্যস্ত দিনটা শেষ হতে না হতেই এক শিহরণ জাগানো খবর ছড়িয়ে পড়ল—গোটা শহর কেঁপে উঠল এক রহস্যজনক খুনের ঘটনায়। রাতের আঁধারে রেলস্টেশনের কাছাকাছি একটি পরিত্যক্ত গুদামঘর থেকে পাওয়া গেল এক অচেনা যুবকের দেহ। তার বুকের ভেতর রক্তে ভিজে গেছে, চোখ খোলা, আর দেহের ভঙ্গিটা অদ্ভুতভাবে অচেনা হলেও কারও কারও মনে হলো কোথায় যেন আগে দেখা। পুলিশ এসে মৃতদেহের ছবি তুলতে শুরু করলে অফিসার অরিজিৎ হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। তার মনে পড়ল অরিন্দম রায়ের অসমাপ্ত ছবির ছায়ামূর্তির ভঙ্গিমা। ছবিতে যে ছায়া ছিল, মাথা একটু ঝুঁকে, হাত পাশেই ঝুলে থাকা, আর চারপাশে লাল রেখা—এই দেহটিও হুবহু একই ভঙ্গিতে পড়ে আছে। মুহূর্তে তাঁর শরীর কেঁপে উঠল। এটি কি নিছক কাকতালীয়, নাকি সত্যিই চিত্রকরের ছবিতে আঁকা ভবিষ্যতের ইঙ্গিত? অরিজিৎ চারপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলেন গুদামের দেওয়ালে ঝুলে থাকা ভাঙাচোরা পোস্টার, ভেতরে জমে থাকা ধুলো, আর বাতাসে লুকোনো স্যাঁতসেঁতে গন্ধ—সবই যেন ছবির পটভূমির সঙ্গে মিলে যায়। তিনি অনুভব করলেন, অরিন্দমের আঁকা ক্যানভাস কেবল রঙের খেলা নয়, বরং অজানা শক্তির এক আয়না, যেখানে মৃত্যু আগেভাগেই নিজেকে প্রকাশ করে।

ঘটনাস্থল থেকে ফিরে এসে পুলিশ সদর দফতরে বৈঠক বসানো হলো। অরিজিৎ প্রমাণগুলো টেবিলে সাজালেন—ছবির কপি, মৃতদেহের ছবি, স্কেচ করা নোটবুকের কাগজপত্র। অন্য অফিসাররা বিষয়টিকে এখনও সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। তারা বলল, “একজন শিল্পীর ছবি আর খুনের ঘটনার মধ্যে সম্পর্ক খোঁজা মানে তদন্তকে অযথা রহস্যময় করা।” কিন্তু অরিজিৎ চুপ করে রইলেন। তিনি জানতেন, চোখে যা দেখেছেন তা এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এদিকে, সংবাদমাধ্যম বিষয়টিকে অন্যভাবে রঙ চড়াতে শুরু করেছে। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বলছে, “অরিন্দম রায়ের ছবি খুনের ঘটনা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল।” সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে নানারকম ভয়ের গল্প—কেউ বলছে অরিন্দম কোনো অশুভ শক্তির কবলে পড়েছিলেন, কেউ বলছে তিনি এমন এক গোপন সংস্থার সঙ্গে জড়িত যারা মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এসবের ভিড়ে আসল তদন্ত আরও জটিল হয়ে উঠছিল। তবু অরিজিৎ সিদ্ধান্ত নিলেন ছবিটিকেই সূত্র ধরে এগোতে হবে। তিনি ছবির ভেতরে যে লাল রেখাগুলো দেখা যায়, সেগুলোর অদ্ভুত বাঁক খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। যেন এগুলো স্রেফ রঙের দাগ নয়, বরং কোনো মানচিত্র বা সংকেত।

রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অরিজিতের মনে একটা চাপা আতঙ্ক দানা বাঁধতে লাগল। তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে একা গাড়ি চালিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন। রাস্তা ফাঁকা, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ছায়াগুলো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হলো পেছনের সিটে কেউ বসে আছে। তিনি আয়নায় তাকালেন—খালি। কিন্তু বুকের ভেতরে ধকধক করা অনুভূতি থামল না। মনের ভেতর এক অদ্ভুত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—অরিন্দম কি সত্যিই নিখোঁজ, নাকি তিনি কোথাও থেকে এই মৃত্যুগুলো পরিচালনা করছেন? আর যদি ছবির ছায়া পরবর্তী মৃত্যুর ইঙ্গিত হয়, তবে কার পালা আসছে? তিনি আবার ছবিটির দিকে মনে মনে তাকালেন। ছায়ার চারপাশে যেন আরও কয়েকটা রেখা ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে—যেন ছবিটি নিজে থেকেই বদলাচ্ছে। অরিজিৎ আঁতকে উঠলেন, কিন্তু তবুও তিনি জানতেন, সত্যকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। চিত্রকরের এই রহস্যময় ছবির ভেতরে লুকিয়ে আছে এমন কিছু, যা শুধু খুন নয়, হয়তো গোটা শহরের জন্য আসন্ন ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে। আর এই ভয়ংকর সত্যের দরজা একবার খোলা হলে আর ফিরে আসার পথ থাকবে না।

__

পরদিন সকাল থেকেই শহরের পত্রিকার শিরোনামে ছাপা হলো গুদামঘরে পাওয়া মৃতদেহের খবর। সঙ্গে যুক্ত হলো রহস্যময় এক গুজব—অরিন্দম রায়ের অসমাপ্ত ছবিতে আঁকা ছায়ামূর্তি নাকি হুবহু মিলেছে নিহত ব্যক্তির ভঙ্গিমার সঙ্গে। মানুষজন চায়ের দোকান থেকে অফিস, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে থিয়েটার—সব জায়গায় একটাই আলোচনা, “চিত্রকরের ছবিতে কি তবে ভবিষ্যৎ লেখা থাকে?” সাধারণ মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠলেও শিল্পীর ভক্তরা একে অলৌকিক প্রতিভা বলে আখ্যা দিল। তবে পুলিশের ভেতরে চাপা টানাপোড়েন শুরু হয়ে গেল। অনেকেই অরিজিতের মতামত নিয়ে প্রশ্ন তুলল, বলল তিনি কুসংস্কারে ভুগছেন। অরিজিৎ তবু স্থির থাকলেন। তিনি জানতেন এই ঘটনার সঙ্গে ছবির সংযোগকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনি বারবার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে দেখলেন, ছায়ামূর্তির ভঙ্গিমা আর নিহত যুবকের দেহের ছবি—দুটো যেন একে অপরের প্রতিবিম্ব। অদ্ভুত কাকতাল হলেও এর গভীরে লুকিয়ে আছে এমন এক সত্য যা এখনও ধরা দেয়নি। কিন্তু এই সত্য যত দেরি হবে উন্মোচনে, তত বাড়বে আতঙ্কের বিস্তার।

এদিকে, অরিন্দমের স্টুডিওর ভেতর থেকে উদ্ধার হওয়া ডায়েরির পাতাগুলো পড়ে অরিজিৎ চমকে উঠলেন। সেখানে লেখা ছিল, “আমি কাউকে বাঁচাতে চাই, কিন্তু প্রতিবার ক্যানভাসে যা আঁকি, তা-ই বাস্তবে ঘটে। রঙ আমার হাতকে ছাড়ে না, ছায়া আমাকে তাড়া করে।” লাইনগুলো যেন এক অসহায় স্বীকারোক্তি। তিনি যেন নিজের প্রতিভার বোঝা বইতে পারছিলেন না। অরিজিতের মনে হলো হয়তো অরিন্দম ছবির মাধ্যমে যা আঁকতেন, তা শুধু তাঁর কল্পনা ছিল না—বরং কোনো অজানা শক্তি তাঁকে ভবিষ্যতের ভেতরে টেনে নিয়ে যেত। হয়তো তিনি যা দেখতেন, তা-ই ফুটিয়ে তুলতেন, কিন্তু সেই দৃশ্যই বাস্তবে ঘটে যেত। এক পর্যায়ে মনে হলো চিত্রকর হয়তো পালিয়ে গেছেন, কারণ তিনি জানতেন তাঁর ছবিতে পরবর্তী যে মৃত্যু আঁকা হচ্ছে তা আর ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু যদি তা-ই হয়, তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—নতুন শিকার কে? অরিজিৎ ডায়েরির শেষ পাতায় একটি হিজিবিজি আঁকা খুঁজে পেলেন, যেখানে এক জটিল রেখার ভেতরে এক ব্যক্তির মাথার ছায়া স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তিনি ভালো করে তাকাতেই চমকে উঠলেন—ছায়াটা অনেকটা তাঁর নিজের মতো! বুকের ভেতর হিমশীতল স্রোত বয়ে গেলেও তিনি কারও কাছে কিছু বললেন না।

সন্ধ্যার পর শহরে আরেকটি ঘটনা ঘটল, যা রহস্যকে আরও জটিল করে তুলল। এক শিল্পকলা প্রদর্শনী থেকে হঠাৎ আগুন লেগে গেল, ভেতরে থাকা কয়েকজন আহত হলো। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলল আগুন লাগার আগে দেয়ালে ঝুলন্ত অরিন্দমের একটি ছবির রঙ অস্বাভাবিকভাবে গাঢ় হয়ে উঠেছিল, যেন ছবির ভেতরে কেউ নড়ছে। এই ঘটনার পর মানুষজন নিশ্চিত হলো—চিত্রকরের আঁকাগুলো নিছক শিল্প নয়, এগুলো ভবিষ্যৎবাণী, বরং মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ। পুলিশের ওপর চাপ বাড়তে লাগল—একদিকে খুনের মামলা, অন্যদিকে জনতার আতঙ্ক, আর সবকিছুর মাঝখানে অরিন্দমের অনুপস্থিতি। অরিজিৎ জানতেন সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তিনি স্টুডিওর অসমাপ্ত ছবির দিকে শেষবার তাকালেন। সেখানে ছায়ার চারপাশে নতুন এক রেখা যেন ভেসে উঠেছে—যা আগে ছিল না। ছবিটি কি নিজেই বদলাচ্ছে? নাকি কেউ রাতে এসে গোপনে রঙ দিচ্ছে? অরিজিৎ বুঝতে পারলেন, উত্তর যাই হোক, এটা নিছক কাকতাল নয়। বরং এর পেছনে এমন এক সত্য লুকিয়ে আছে, যা শীঘ্রই তাঁর নিজের জীবনকেও গ্রাস করতে পারে।

__

অরিন্দম রায়ের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তাঁর স্টুডিওতে যতবার পুলিশ ঢুকেছে, প্রতিবারই নতুন কিছু পাওয়া গেছে, যা রহস্যকে আরও গভীর করেছে। প্রথমে পাওয়া গেল সেই অসমাপ্ত ক্যানভাস, পরে এলোমেলো কিছু স্কেচ, আর এবার অরিজিৎ পেলেন একটি লুকানো তাকের ভেতর থেকে ভারী চামড়ার বাঁধানো একটি ডায়েরি। ধুলো জমে থাকা খাতাটি যখন তিনি খুললেন, তখন বাতাস যেন হঠাৎ শীতল হয়ে উঠল। পাতাগুলোর গায়ে শুকনো রঙের দাগ, কিছু জায়গায় কালি ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু প্রতিটি লাইনেই যেন অরিন্দমের যন্ত্রণার আর্তনাদ গুঞ্জন করছে। সেখানে লেখা ছিল, “আমি যা দেখি, তা আঁকি; কিন্তু আমি যা আঁকি, তা-ই বাস্তব হয়ে ওঠে। আমি আর নিয়ন্ত্রণে নেই। তুলি আমার হাত ছাড়ে না, ক্যানভাসে যে ছায়া ফুটে ওঠে, তা-ই হয় মৃত্যুর আভাস।” পাতার পর পাতায় ছড়িয়ে ছিল মৃত্যুর বর্ণনা, এমন সব দুর্ঘটনার কথা যা ঘটার আগেই অরিন্দম লিখে রেখেছিলেন। আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর নোটের সঙ্গে মিল পাওয়া গেল শহরের পুরোনো কয়েকটি অমীমাংসিত ঘটনার সঙ্গে। এই মিল দেখে অরিজিৎ শিউরে উঠলেন। এটা নিছক কাকতালীয় নয়, বরং এমন কিছু যা যুক্তিকে ভেঙে দেয়। ডায়েরি পড়ে মনে হচ্ছিল অরিন্দম যেন অভিশপ্ত প্রতিভার শিকার, যিনি তাঁর শিল্পের মধ্য দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মৃত্যু ডেকে আনতেন।

ডায়েরির মাঝামাঝি অংশে এসে আরও অদ্ভুত কিছু ধরা দিল। অরিন্দম লিখেছেন, “আমি পালাতে চাই। কিন্তু যেখানে যাই, ক্যানভাস আমার পিছু নেয়। আঁকতে না চাইলে স্বপ্নে দেখি। চোখ বন্ধ করলেই রক্তের রেখা, ছায়ার মুখ। আমি যে আঁকি, সে-ই মরে যায়। আমি কি খুনি? নাকি আমি কেবল এক যন্ত্র?” এই লাইনগুলো পড়ার পর অরিজিতের মাথায় অদ্ভুত এক অস্বস্তি চেপে বসল। তিনি ভাবলেন, যদি অরিন্দমের লেখা সত্য হয়, তবে তাঁর নিখোঁজ হওয়াটা হয়তো আত্মরক্ষার চেষ্টা। হয়তো তিনি এমন এক জায়গায় পালিয়ে গেছেন যেখানে নিজের ছবির প্রভাব থেকে মুক্তি পাবেন। কিন্তু ডায়েরির শেষ দিকের পাতাগুলো ভয়ঙ্করভাবে ইঙ্গিত করছিল অন্য কিছু। সেখানে তিনি লিখেছেন, “আমি বুঝতে পারছি না ছবির ভেতরের ছায়াটা আমি কিনা। আমার মুখ আঁকতে গেলে তা বদলে যায় অন্য কারও মুখে। হয়তো আমিই পরের শিকার।” এই স্বীকারোক্তি পড়ে মনে হচ্ছিল অরিন্দম নিজের মৃত্যুর পূর্বাভাসও আঁকছিলেন। ডায়েরির এক কোণে কাঁপা হাতে আঁকা একটি প্রতিকৃতি দেখে অরিজিৎ চমকে উঠলেন। ছবির অবয়বটা ঝাপসা হলেও ভীষণ পরিচিত—যেন সেটি তাঁকেই আঁকা হয়েছে। বুকের ভেতর ধপ করে কিছু নেমে এলো, কিন্তু তিনি তা কাউকে জানালেন না।

ডায়েরির শেষ পাতায় লেখা ছিল একটি রহস্যময় লাইন—“আমার শেষ ছবি অসমাপ্ত, কারণ আমি তাকে শেষ করলে সব শেষ হয়ে যাবে।” এই বাক্যটি মাথায় নিয়ে অরিজিৎ বুঝতে পারলেন, স্টুডিওর সেই ক্যানভাস কেবল অসমাপ্ত ছবি নয়, বরং এমন এক দরজা যা খুললে ভয়াবহ কিছু ঘটতে বাধ্য। তাঁর মনে হলো, যদি ছবিটা কেউ শেষ করে দেয়, তবে তা-ই হয়তো নতুন মৃত্যুর সূচনা করবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—কে সেই ছবি শেষ করবে? অরিন্দম নিজেই কি নিজের মৃত্যুকে থামাতে পারেননি? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে ছবিতে রঙ ছুঁইয়ে যাচ্ছিল? একদিকে পুলিশ তাঁকে চাপ দিচ্ছিল খুনের তদন্তে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দিতে, অন্যদিকে ডায়েরির পাতাগুলো তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এক অদ্ভুত অচেনা জগতে যেখানে শিল্প, মৃত্যু আর নিয়তির সীমারেখা এক হয়ে গেছে। তিনি জানতেন, এই ডায়েরি তাঁর হাতে এসে পড়া কাকতালীয় নয়। বরং এই ডায়েরির প্রতিটি শব্দ যেন তাঁকে সতর্ক করছে, তাঁকেই বেছে নিচ্ছে পরবর্তী ঘটনার সাক্ষী হিসেবে। বাইরে তখন রাত ঘনিয়ে এসেছে, বাতাসে অদ্ভুত এক শীতলতা ভাসছে, আর টেবিলের ওপরে খোলা ডায়েরির পাতায় ল্যাম্পপোস্টের আলো পড়ে ছায়া তৈরি করছে—একটা ছায়া, যা অরিজিতের মুখের সঙ্গে ভয়ংকরভাবে মিলে যাচ্ছে।

__

অরিন্দম রায়ের ডায়েরি হাতে পাওয়ার পর থেকে অরিজিতের চারপাশে অদ্ভুত চাপা এক আতঙ্ক নেমে এসেছিল। অফিসে ফিরে এসে যখন তিনি টেবিলে প্রমাণগুলো সাজালেন, সহকর্মীরা অনেকে মুচকি হেসে বলল, “একজন শিল্পীর মানসিক বিভ্রমকে মামলার সঙ্গে জড়ানোটা কি ঠিক হচ্ছে?” কিন্তু অরিজিৎ জানতেন, এই কেস সাধারণ নয়। তবু তিনি একা হয়ে যাচ্ছিলেন, কারণ পুলিশ সদর দফতরের অনেকেই বিশ্বাস করতে চাইছিল খুনের সঙ্গে অরিন্দমের শিষ্য বা কাছের মানুষদের যোগসাজশ আছে। তদন্তের তালিকায় উঠে এলো অরিন্দমের ঘনিষ্ঠ শিষ্য রুদ্রর নাম। শহরের আর্ট স্কুলে পড়া তরুণ রুদ্রকে অনেকে বলত প্রতিভাবান, আবার কেউ কেউ বলত তিনি অরিন্দমের ছায়ার নিচে চাপা পড়ে আছেন। রুদ্রের সঙ্গে মাসখানেক আগে অরিন্দমের ঝগড়ার কথা অনেকেই জানত—শোনা যায়, রুদ্র নিজের আঁকা একটি ছবি প্রদর্শনীতে নিতে চাইলে অরিন্দম সেটি অস্বীকার করেছিলেন। পুলিশ বলল, রুদ্রের কাছে হয়তো প্রতিশোধ নেওয়ার কারণ আছে। অরিজিৎ তবু দ্বিধায় ভুগছিলেন, কারণ তিনি জানতেন এই রহস্য শুধু প্রতিশোধ বা হিংসায় সীমাবদ্ধ নয়।

তদন্তের অংশ হিসেবে রুদ্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। যুবকটির চোখে ক্লান্তি, মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল, “স্যার, আমি স্যারকে (অরিন্দমকে) শেষ কয়েক সপ্তাহ ধরে দেখেছি ভীষণ অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে। তিনি মাঝরাতে স্টুডিওতে একা একা কথা বলতেন, ক্যানভাসে আঁকতে আঁকতে হঠাৎ থেমে গিয়ে চোখ মেলে চেয়ে থাকতেন—যেন কারও সঙ্গে লড়াই করছেন। আমি ভয় পেয়ে যাই, তাই আস্তে আস্তে দূরে সরে আসি।” রুদ্র কেঁপে ওঠা গলায় যোগ করল, “আমি জানি না স্যার কোথায়, কিন্তু আমি তাঁকে খুন করিনি। আমার কোনো কারণ নেই।” অরিজিৎ রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন ছেলেটির চোখে সত্যি আতঙ্ক আছে। তবু তার কথার ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসছিল এমন কিছু যা তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না—অরিন্দমের চারপাশে সত্যিই কিছু অস্বাভাবিক ঘটছিল। পুলিশ যদিও রুদ্রকে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিল না, কিন্তু অরিজিৎ অনুভব করলেন প্রকৃত রহস্য আরও গভীরে।

অন্যদিকে সন্দেহ ঘনীভূত হতে লাগল অরিন্দমের এক প্রাক্তন বান্ধবী মায়ার ওপর। তিনি একসময় অরিন্দমের জীবনে ঘনিষ্ঠ ছিলেন, কিন্তু কয়েক বছর আগে সম্পর্ক ভেঙে যায়। প্রতিবেশীরা বলল, নিখোঁজ হওয়ার কয়েকদিন আগে মায়াকে স্টুডিওর আশেপাশে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে। মায়াকে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো, তিনি হেসে বললেন, “অরিন্দম সবসময়ই ভিন্ন জগতের মানুষ ছিলেন। আমি তাঁকে ছেড়ে আসি কারণ আমি বুঝেছিলাম তিনি শুধু রঙের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন, বাস্তবতা ভুলে যাচ্ছেন।” তবু তার চোখে এক অদ্ভুত ঝলক দেখা গেল, যা অরিজিৎকে ভাবিয়ে তুলল—মায়া কি সত্যিই শুধু স্মৃতির টানে ফিরেছিলেন, নাকি ছবির ভেতরের রহস্য জানার জন্য? সন্দেহের জাল যত ছড়াতে লাগল, অরিজিৎ ততই অনুভব করলেন আসল খুনিকে খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ছবিটি এখনও অসমাপ্ত, আর এর ভেতরে ছায়ার চারপাশে যে নতুন রেখাগুলো ভেসে উঠছে, তা ইঙ্গিত দিচ্ছিল ভবিষ্যতের আরেকটি মৃত্যুর। কিন্তু কে হবে সেই পরবর্তী শিকার? অফিসে আলো-আঁধারিতে বসে তিনি মনে মনে একটাই কথা ভাবলেন—এই রহস্যের গভীরে যেতে হলে তাঁকে ছবির ভাষা পড়তে শিখতে হবে, কারণ মানুষের ওপর ভরসা করার মতো সময় আর তাঁর হাতে নেই।

__

রাত তখন অনেক গভীর, থানার বাইরে ফাঁকা রাস্তায় কেবল ল্যাম্পপোস্টের আলো। অরিজিৎ একা বসে আছেন তাঁর অফিসকক্ষে, সামনে টেবিলে ছড়িয়ে আছে অরিন্দমের ডায়েরি, স্কেচ আর সেই ক্যানভাসের বড় ফটোগ্রাফ। তিনি এতক্ষণ ধরে ছবিটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন যে চোখ ভারী হয়ে আসছে। কিন্তু ঠিক তখনই হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি আটকে গেল ছবির এক কোণে। অন্ধকার ছায়ার ভেতর থেকে যেন একটি মুখ ভেসে উঠছে—একটি মুখ, যা স্পষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বুক কেঁপে উঠল। এ তো তাঁরই মুখ! ছবির ভেতরে ধীরে ধীরে রেখাগুলো ঘনীভূত হয়ে এক জীবন্ত প্রতিকৃতি হয়ে উঠছে। ঘামে ভিজে গেল তাঁর কপাল, হাত কাঁপতে লাগল। ছবির ভেতর থেকে যেন তিনি নিজেই তাকিয়ে আছেন নিজের দিকে, এক অদ্ভুত ফাঁদে আবদ্ধ। তিনি বুঝতে পারলেন, ক্যানভাসের ছায়ামূর্তি হয়তো আগেই অন্যদের মৃত্যু ঘোষণা করেছে, আর এবার পালা এসেছে তাঁর।

পরদিন সকালে অফিসার অরিজিৎ ছবির আসল ক্যানভাসটি স্টুডিও থেকে আবার নিয়ে আসেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এটিকে একা একা পরীক্ষা করবেন, অন্য কাউকে জানাবেন না। ক্যানভাসটিকে এক নির্জন কক্ষে রেখে তিনি আলো নিভিয়ে দিলেন, কেবল একটি টেবিল ল্যাম্প জ্বালালেন। ছবির ওপর আলো পড়তেই মনে হলো ছায়াগুলো নড়ছে, রেখাগুলো কাঁপছে, যেন ক্যানভাস শ্বাস নিচ্ছে। তিনি চোখ ঘষে আবার তাকালেন, কিন্তু বিভ্রম ভাঙল না। তাঁর মনে হলো কেউ হয়তো ছবিটিকে গোপনে শেষ করছে—কোনো অদৃশ্য হাত রাতে এসে তুলির টান দিচ্ছে। তিনি ছবির খুব কাছে গিয়ে খেয়াল করলেন, রঙ শুকনো নয়, টাটকা। অথচ স্টুডিওর দরজা সবসময় সিল করা ছিল, তালা ভাঙা হয়নি। তবে কে এই ছবিকে এগিয়ে নিচ্ছে? তিনি হাত বাড়িয়ে ছবির গায়ে আঙুল রাখলেন, আর মুহূর্তে সারা শরীর দিয়ে বিদ্যুতের মতো স্রোত বয়ে গেল। মনে হলো তিনি ছবির ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল গুদামের সেই মৃতদেহ, আগুনে পুড়ে যাওয়া প্রদর্শনীর দৃশ্য, আর অজানা কিছু মুখ—সবই ছবির ভেতরে একে একে ধরা দিচ্ছে। তিনি আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে নিলেন। তাঁর মনের ভেতরে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—অরিন্দম কি এই ক্যানভাসের ভেতরে বন্দি হয়ে গেছেন? নাকি তিনি নিজেই নিজের মৃত্যুকে আঁকার পর এই জগৎ থেকে হারিয়ে গেছেন?

সেই রাতে বাড়ি ফিরে অরিজিৎ ঘুমোতে পারলেন না। জানালার বাইরে ঝড়ো হাওয়া বইছিল, খোলা পাতার মতো দুলছিল পর্দা। টেবিলের ওপর রাখা ছবির ফটোগ্রাফে আলো পড়ছিল আর তাতে তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তিনি টের পেলেন, যেই মুহূর্তে ছবির মুখ পুরোপুরি সম্পূর্ণ হবে, সেই মুহূর্তেই তাঁর জীবন শেষ হয়ে যাবে। বুক ধড়ফড় করতে লাগল, তবু তিনি পিছু হটলেন না। বরং মনে মনে শপথ করলেন, যতদিন বাঁচবেন ততদিন এই রহস্যের শেষ খুঁজে বের করবেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি জানতেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। ছবির ভেতরে ছায়ার রঙ যত গাঢ় হচ্ছে, ততই মৃত্যু এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে। আর তিনি যেই দরজা খুলে দিয়েছেন, তা বন্ধ করার উপায় নেই—ক্যানভাস আর বাস্তবের সীমারেখা চিরতরে ভেঙে গেছে।

__

অরিজিৎ কয়েকদিন ধরে ছবির সঙ্গে লড়াই করে বুঝতে পারলেন, এই ক্যানভাস কেবল একটি শিল্পকর্ম নয়, বরং অরিন্দম রায়ের আত্মার বন্দিশালা। তিনি ডায়েরির শেষ কয়েকটি লাইন বারবার পড়ছিলেন—“আমি আমার মৃত্যুকেও এঁকেছি, তাই পালানো যায় না।” শব্দগুলো যেন মনের ভেতরে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। স্টুডিওর বাতাস ভারী, বাইরে টানা বৃষ্টি পড়ছে। ঠিক তখনই ক্যানভাসের সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ অরিজিৎ বুঝলেন ছবির ছায়ার ভেতরে এক নতুন অবয়ব ভেসে উঠছে। তিনি চোখ কুঁচকে তাকাতেই দেখলেন অরিন্দম নিজেই দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে—দীর্ঘকেশ, ক্লান্ত চোখ, আর এক অদ্ভুত দৃষ্টি। ছবির ভেতরের অরিন্দম ঠোঁট নাড়লেন, অথচ কোনো শব্দ বের হলো না। তবু অরিজিৎ যেন তাঁর মনের ভেতরে শুনতে পেলেন, “আমাকে বাঁচানো সম্ভব ছিল না, কিন্তু তুমি এখনও পার।” সেই মুহূর্তে তাঁর গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠল। তিনি বুঝলেন, অরিন্দম নিজেকে রক্ষা করতে না পারলেও শেষ ছবিতে নিজের মৃত্যুকে আটকে রেখে অন্যদের সতর্ক করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই অসমাপ্ত ক্যানভাসই এখন অরিজিতের জীবনকে গ্রাস করছে।

রাত তখন গভীর। থানার অন্ধকার কক্ষে ক্যানভাসকে সামনে রেখে বসে ছিলেন অরিজিৎ। হঠাৎ বাতাস ভারী হয়ে উঠল, জানালার কাচ কেঁপে উঠল। ছবির ভেতরের ছায়া ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ হতে শুরু করল, রেখাগুলো জুড়ে গিয়ে তৈরি হলো স্পষ্ট একটি মুখ—অরিজিতের। তিনি বুঝলেন ছবিটি শেষ হয়ে গেলে তাঁর জীবনও শেষ। ভেতরে এক তীব্র লড়াই শুরু হলো—তাঁকে কি ছবিটি ধ্বংস করতে হবে? কিন্তু তাঁর মনে পড়ল অরিন্দমের লেখা—“শেষ ছবি অসমাপ্ত থাকতে হবে, কারণ সম্পূর্ণ হলে সব শেষ হয়ে যাবে।” এই সত্যি তাঁকে থামিয়ে দিল। তিনি এক মুহূর্তে টের পেলেন ছবিটি শুধু মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী করে না, বরং তা-ই মৃত্যুকে ডেকে আনে। যদি ছবিটি ধ্বংস করেন, হয়তো সব থেমে যাবে, হয়তো সবকিছু ভেঙে পড়বে। তিনি কাঁপা হাতে আগুন ধরালেন, শিখা ধীরে ধীরে ছবির কিনারা গ্রাস করল। আঁকা ছায়াগুলো কেঁপে উঠল, ভেতর থেকে অদ্ভুত আর্তনাদ ভেসে এল, যেন শত মানুষের কণ্ঠ একসঙ্গে বিলীন হচ্ছে। কিন্তু ঠিক আগুনে ভস্ম হওয়ার আগে ছবির ভেতরের মুখ শেষবারের মতো তাঁকে তাকিয়ে বলল—“তুমি মুক্ত নও।”

ছবিটি ভস্ম হয়ে যাওয়ার পর কক্ষ নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি থেমেছে, আকাশে ম্লান চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু অরিজিৎ আয়নায় তাকিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তাঁর নিজের প্রতিচ্ছবি স্বাভাবিক নয়—চোখে গভীর ছায়া, ঠোঁটে অদ্ভুত এক টান। যেন ছবির ভেতর থেকে ছায়াটি মুক্তি পেয়ে তাঁর শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। তিনি ভেঙে পড়া ক্যানভাসের দিকে তাকালেন—সেখানে কিছুই নেই, কেবল ছাই। কিন্তু সেই ছাইয়ের ভেতরে যেন এখনও নড়াচড়া করছে অদৃশ্য কোনো রঙ। অরিজিৎ ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন সত্যি—অরিন্দমের শেষ ছবিটি তাঁর নিজের মৃত্যু নয়, বরং এক অভিশপ্ত উত্তরাধিকার। ছবির অসমাপ্ত রেখার মধ্য দিয়ে অরিন্দম নিজের পরিণতি তাঁর হাতে তুলে দিয়েছেন। এখন থেকে যে ক্যানভাসে তিনি চোখ রাখবেন, হয়তো সেখানে ফুটে উঠবে পরবর্তী মৃত্যুর পূর্বাভাস। অরিজিৎ জানলেন, খেলা এখানেই শেষ নয়—এটা কেবল শুরু। আর শহরের বুকজুড়ে নতুন এক ভয় ছড়িয়ে পড়বে, কারণ চিত্রকরের শেষ ছবি আরেকজনের হাতে বেঁচে আছে—তাঁর নিজের হাতে।

____

 

1000063459.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *