Bangla - সামাজিক গল্প

চিঠির ভাঁজে সমাজ

Spread the love

সৌমিত্র চৌধুরী


শ্যামল সাঁতরা জীবনের অধিকাংশ সময়টাই কাটিয়েছেন চাঁদিপুরের ছোট্ট পোস্ট অফিসের কাঠের কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে। প্রতিদিন সকাল নয়টার আগে তিনি পৌঁছে যেতেন, সেই পরিচিত ঘন্টা বাজিয়ে খোলার সঙ্কেত দিতেন, আর দুপুর পর্যন্ত চিঠি ছাঁটা, ডাকসেবকের ব্যাগ সাজানো, খামে ডাকটিকিট লাগানো, টাকা জমা নেওয়া আর বাকি সময়টুকু গ্রামের মানুষের সুখদুঃখের শ্রোতা হয়ে উঠতেন। অবসরের পর প্রথম সকালে তাঁর ঘুম ভাঙে একটি অস্পষ্ট, বিষণ্ণ নীরবতায়। আর কোনও অফিস নেই, আর কোনও চিঠি নেই, আর কোনও হাঁকডাক নেই। দরজার বাইরে রোদ পড়েছে, পাখির ডাক এসেছে, কিন্তু তাঁর মনে এক ধরণের বর্ণহীন শূন্যতা জমে। সকালের চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়ে, তাঁর হাতে কত অজস্র মানুষের অজানা গল্প ঘুরে গেছে—কারও প্রেমপত্র, কারও চাকরির ইন্টারভিউর ডাকে ভরা খাম, আবার কারও আদালতের সমন। অথচ তিনি নিজে কোনওদিন তেমন করে কোনও চিঠি লেখেননি, কিংবা পাঠাননি।

ঘরের এক কোণে বহু পুরনো আলমারি—যেটি শ্যামলবাবু চাকরি জীবনের শুরুতে বানিয়েছিলেন কাঁঠাল কাঠ দিয়ে—তাঁর অবসরের প্রথম দিনটিকে যেন এক নতুন দিক দেখায়। আলমারির নিচের দিকে একটি পেছনের খোপ ছিল, যেখানে বহুদিন কিছু রাখা হয়নি। অবসরকালীন দীর্ঘ সময়কে ভরাট করার আশায় তিনি সেই খোপে হাত দেন, আর বেরিয়ে আসে এক আস্ত স্তূপ—চিঠির বান্ডিল, হলদে হয়ে যাওয়া খাম, ফিরিয়ে দেওয়া অপ্রাপ্ত চিঠি, এমনকি ডাক বিভাগ থেকে ভুল করে ফেরত আসা রেজিস্ট্রার্ড পত্রও। হাতে তুলে নেন একটি চিঠি—মিহি হাতের লেখা, উর্দুতে লেখা কয়েকটি বাক্য, নাম ঠিকানা অস্পষ্ট। কে লিখেছিল, কাকে পাঠিয়েছিল, কেন ফিরল—এসবের উত্তর পাওয়া হয়তো অসম্ভব। কিন্তু এইসব চিঠিগুলো কি শুধুই কাগজ? নাকি জীবনের একেকটা টুকরো, যেগুলো হারিয়ে গেছে সময়ের সমুদ্রে? এই ভাবনাতেই ডুবে যান শ্যামল। তিনি বুঝতে পারেন—এই চিঠিগুলো শুধু নাম বা ঠিকানা নয়, বরং সমাজের নিঃশব্দ কোলাহল, যেগুলোর ভাষা নেই, কিন্তু ভার আছে, রক্তমাংসের চেয়েও বেশি জীবন্ত।

সে রাতেই তিনি আলো নেভানোর আগে একটি কেরোসিন ল্যাম্প জ্বেলে টেবিলে বসেন, চিঠিগুলোর উপরে হাত বুলিয়ে যান এক এক করে। প্রথম চিঠিটি খুলে পড়তে শুরু করেন—তাতে লেখা আছে “প্রিয় দীপেন, জানি তুমি কখনো এ চিঠি পড়বে না, তবুও লিখছি…”। বাকিটুকু পড়তে পড়তে তাঁর মনে পড়ে যায় বহু আগের এক মেয়ে, পোস্ট অফিসে প্রায়ই আসত, কিন্তু কখনও চোখে চোখ পড়ত না। সেই চিঠিটা হয়তো তারই লেখা। এত বছর পর, অবসরের এই নির্জন সন্ধ্যায় শ্যামল প্রথমবার বোঝেন, কী অমূল্য এক ভাণ্ডারের প্রহরী ছিলেন তিনি এতকাল—কেবল অফিসের কেরানী ছিলেন না, ছিলেন সমাজের না বলা কথার, অপূর্ণ ভালোবাসার, রাজনৈতিক কূটচালের এক নীরব সাক্ষী। তিনি ঠিক করেন, পরের দিন থেকে প্রতিদিন পড়বেন একটি করে চিঠি। সময়কে ভরাট করবেন কাগজে বন্দি সময় দিয়েই। সমাজকে বুঝবেন সমাজেরই না-পড়া ভাষায়। অবসরের প্রথম দিনটি শেষ হয়, কিন্তু এক নতুন পাঠযাত্রার সূচনা হয়—যেখানে প্রতিটি চিঠি হয়ে উঠবে একটি দরজা, যা খুলবে একেকটি লুকোনো সত্যের দিকে।

পরদিন সকালে শ্যামলবাবুর ঘুম ভাঙল এক ঝলক ঠান্ডা আলোয়, জানলার কাঁচে ধুলো জমে থাকলেও বাইরের আকাশ ছিল নির্মল। বালিশের পাশে রাখা ছিল আগের রাতে পড়া চিঠিটা, খামের ভাঁজে সময় থমকে আছে যেন। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আজ তিনি স্থির করলেন আরেকটি চিঠি পড়বেন, এই অভ্যাস যেন দিনে দিনে নেশায় পরিণত হচ্ছে। কাঠের আলমারির নিচ থেকে বের করে আনলেন আরেকটি খাম—এবারও কিছুটা বিবর্ণ, কিন্তু তাতে স্পষ্ট বাংলা হস্তাক্ষর, কালি কিছুটা ঝাপসা, প্রেরক “বীণাপানি সেন”, প্রাপক “সেনা অফিসার দীপ্তিমান মিত্র (১৮ রাজপুত রেজিমেন্ট), চিঠির ওপর লাল কালি দিয়ে বড় করে লেখা ‘প্রাপক পাওয়া যায়নি, ফেরত পাঠানো হয়েছে’। শ্যামল সাবধানে খামটি ছিঁড়ে খুললেন, যেন একটি মন ছিঁড়ে যাচ্ছিল হাতে।

চিঠিটি শুরু হয়েছে, “তুমি যখন এই চিঠিটা পাবে, আমি হয়তো আগুনে মুখ ঢেকে বসে থাকব বারান্দায়…”। প্রতিটি শব্দে এক অজানা দুঃখ, এক চাপা প্রেমের যন্ত্রণা। বীণাপানি, শহরের এক ব্রাহ্মণ বিধবা, যিনি প্রথার বেড়াজালে বন্দি হয়েও মন দিয়েছিলেন দীপ্তিমান নামের এক সৈনিককে, যিনি প্রতিরাতে পোস্ট অফিসে তাঁর জন্য চিঠি লিখতেন। কিন্তু কোনও চিঠি কখনও পাঠানো হয়নি। কেবল একটি চিঠি—সাহস করে লেখা হয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর ঠিকানায়—এটাই। এবং সেটাই ফিরিয়ে এসেছে। শ্যামলের মনে পড়ে যায় মেয়েটিকে—পোস্ট অফিসের পেছনের বেঞ্চে বসে থাকত, হাতে খামে মোড়া ছোট কাগজ, কিন্তু কখনও ডাকবাক্সে ফেলত না। সেই চিঠিটিই এখন তাঁর হাতে। চিঠিতে লেখা ছিল—“তুমি বলেছিলে, বিধবা মেয়েরা যুদ্ধজয়ী সৈনিকদের আশীর্বাদ করে। আমি চাইনি আশীর্বাদ দিতে, আমি শুধু পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। তবুও সমাজ আমাকে দাঁড়াতে দেয়নি।” সেই প্রেম না বলা থেকে গেছে, সমাজ তাকে নীরব করেছিল নিয়ম, ধর্ম আর লোকচক্ষুর তীব্র জালে।

শ্যামল চিঠিটা পড়ে শেষ করেন, চোখের কোণে অদ্ভুত ভার অনুভব করেন। এত বছর পর একটি মানুষের না বলা ভালোবাসার গল্প কেবল তাঁর কাছেই পৌঁছেছে, যেমন অনেক কথাই সমাজের ভয়ে আড়ালে থাকে, তেমনি এই চিঠিটিও আড়ালেই রয়ে গেছে। সন্ধ্যাবেলায় কাজলিনী মুখার্জি এলেন—চা খেতে খেতে শ্যামল তাঁকে চিঠিটার কথা বললেন। কাজলিনী চুপ করে শুনলেন, তারপর বললেন—“একটা সময় ছিল, নারী যদি ভালোবাসতে চাইত, তাকে বলা হত চরিত্রহীন। আর সেই ভালোবাসা যদি হয় বিধবা হয়ে, তবে তাকে বলা হত অভিশপ্ত।” তিনি জানালেন, এই বীণাপানি সেন একসময় তাঁর মা’য়ের পরিচিত ছিলেন—যার নামে বহু গুজব রটেছিল। সমাজ তাকে ঠেলে দিয়েছিল একা থাকার দিকে, অথচ আজ বোঝা যাচ্ছে—সে কেবল ভালোবেসেছিল, নিজের মত করে। শ্যামল বুঝতে পারলেন, এই চিঠিগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয়, এগুলো একেকটা সমাজের মুখোশ খুলে দেখায়। আর এই মুখোশ খুলে দেখাই তাঁর নীরব দায়িত্ব হয়ে উঠছে দিন দিন।

তৃতীয় দিন সকালে শ্যামল সাঁতরা যখন চিঠির বান্ডিলটি আবার হাতে তুলে নিলেন, তখন তাঁর মনে হচ্ছিল—প্রতিটি খাম যেন তাঁর দিকে তাকিয়ে কিছু বলছে। আগের দিনের বীণাপানির চিঠির পর থেকে তাঁর মনে কেমন একটা ভার জমে আছে, যেন সমাজের সেই অতীত অবিচারের দায় তাঁর নিজের ঘাড়ে এসে পড়েছে। আজ তিনি একটু ছোট এক খাম বেছে নিলেন—হালকা নীল রঙের খাম, সামান্য ছেঁড়া কোণ, তাতে ছোট ছোট হস্তাক্ষরে লেখা নাম—“দীপক সাহা, ছাত্র, রবীন্দ্র কলেজ, চাঁদিপুর।” প্রাপক—“সুদীপ ভট্টাচার্য, ৮ নম্বর, পাটুলি রোড, কলকাতা।” খামের পেছনে ডাক বিভাগের সিল, “ঠিকানা ভুল – ফেরত পাঠান হয়েছে।” শ্যামল নিঃশব্দে চিঠিটা বের করলেন।

চিঠিটি লেখা হয়েছিল ২০০৮ সালের জুন মাসে। দীপক নামের এক কলেজছাত্র তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে জানাচ্ছে কেমন করে শহরের কলেজে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, এক স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ কীভাবে ছাত্রদের সচেতন করতে চাইছে, আর কেমন করে স্থানীয় এক শক্তিশালী নেতা কলেজের ছাত্র সংসদ দখল করতে চাইছে ভয় দেখিয়ে, প্রলোভন দিয়ে। চিঠিতে দীপক স্পষ্ট লিখেছে—“তুই বলেছিলিস প্রতিবাদ করতে সাহস লাগে। আমি বুঝতে পারছি সাহস আসলে একরকম জ্বরের মতো—যখন ওঠে তখন কিছুই ঠেকাতে পারে না। আমরা ঠিক করেছি, এইবারের ভোট আমরা লড়ব। যত ভয় দেখাক, যতই ছেলেপুলে মার খাক—আমরা রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকব না।” চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিল, “এই চিঠি যদি না পৌঁছায়, জানবি, আমরা তবুও থামিনি।” শ্যামলের হাতে চিঠিটা কাপতে থাকে—চোখের সামনে যেন একদল কাঁচা বয়সের প্রতিবাদী তরুণ উঠে আসে, যারা অন্ধকারের ভেতরে আলো জ্বালাতে চেয়েছিল।

এই সময়েই ঘরে ঢোকে নবীন—শ্যামলের ভাড়াটে, স্থানীয় কলেজের ছাত্র, যার সঙ্গে মাঝেমধ্যেই সমাজ আর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা হয়। শ্যামল তাকে চিঠিটা পড়ে শুনান। নবীন শুনে বিস্ময়ে বলে—“স্যার, এই দীপকদা যদি এখন থাকতেন, উনি হয়তো ফেসবুকে লিখতেন, টুইটারে ট্রেন্ড চালাতেন। কিন্তু এই হাতে লেখা চিঠিতে যে স্পর্ধা, যে সাহস—এটা আজকের প্রজন্মে কোথাও যেন হারিয়ে গেছে।” শ্যামল ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলেন, “প্রতিটি সময়ের প্রতিবাদ তার নিজের ভাষা খোঁজে, কিন্তু সাহসের মূলে সেই আগুনটা এক, যা ভেতর থেকে জ্বলে ওঠে।” চিঠির কাগজে তাঁর আঙুল চলে যায়, যেন দীপকের লিপিতে ছাপা সেই আগুনের উত্তাপ এখনও তাঁর তালুতে রয়ে গেছে। চিঠিগুলো শুধু অতীত নয়, বর্তমানেরও আয়না—যেখানে সাহস, ভয়, সংগ্রাম আর বিশ্বাস অক্ষরে অক্ষরে বেঁচে থাকে, অপেক্ষায় থাকে এক পাঠকের। শ্যামল বুঝলেন, সমাজের সত্য জানতে গেলে কেবল সংবাদপত্র নয়, কখনো কখনো সেই চিঠির হস্তাক্ষরই হয়ে ওঠে সবচেয়ে স্পষ্ট সাক্ষ্য।

আলমারির খুঁটিনাটি ঘেঁটে শ্যামল সাঁতরা চতুর্থ চিঠিটি খুঁজে বের করলেন এক রোদেলা দুপুরে, যখন জানলার ওপাশে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে শালবনে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল। আজকের চিঠিটি একটু মোটা খামে ভরা, ভিতরে একাধিক পৃষ্ঠা, এবং খামের ওপরে লেখা এক নাম দেখে শ্যামলের শিরদাঁড়ায় যেন ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল—‘বিশ্বজিৎ মণ্ডল, প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য।’ প্রাপক—“শ্রী শিবরাম ঘোষাল, বিধায়ক, চাঁদিপুর বিধানসভা, পার্টি অফিস।” শ্যামলের চোখের সামনে ভেসে উঠল শিবরাম ঘোষালের মুখ—সেই রাশভারী নেতা, যাঁর ছবি এখনও পাড়ার মোড়ে টাঙানো আছে। তিনি জানতেন, এই চিঠিটি কেবল ব্যক্তিগত নয়, সমাজের গভীরে গাঁথা ক্ষমতার রাজনীতির অন্তর্গত একটি গোপন ইতিহাস ধারণ করে রেখেছে।

চিঠিটির ভাষা ছিল ক্ষতবিক্ষত, যেন বিশ্বাসঘাতকতায় রক্তাক্ত এক সৈনিকের কণ্ঠ। বিশ্বজিৎ মণ্ডল এই চিঠিতে শিবরাম ঘোষালের কাছে নিজের ক্ষোভ আর আক্ষেপ উগরে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “আপনি আমাদের বলেছিলেন—এই জমি অধিগ্রহণ হবে মানুষের উন্নয়নের জন্য। আমরা বিশ্বাস করেছি, মিটিং করেছি, গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। কিন্তু আজ দেখছি সেই জমি গেছে এক বিদেশি কোম্পানির হাতে, স্থানীয় কৃষকরা কেউ টাকা পায়নি, বরং পুলিশ তাদের পিটিয়েছে। আপনি জানতেন, তবু চুপ ছিলেন। আপনি জানতেন, তবু আমাদের দিয়ে বক্তৃতা করিয়েছেন।” পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে আরও খোলামেলা কথা—দলের ভেতরের দুর্নীতি, অর্থ লেনদেন, আর নিজের ‘ব্যবহার’ হয়ে ওঠার অপমান। শেষে বিশ্বজিৎ লিখেছেন—“এই চিঠি হয়তো আপনি পড়বেন না, কিংবা পড়ে পুড়িয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমি লিখলাম, কারণ আমি দল ছেড়েছি, আর নিজেকে ফিরিয়ে আনতে চাই।” চিঠির কোনায় কালো কালি ছড়িয়ে আছে—হয়তো লেখা সময়েই চোখের জল পড়েছিল।

শ্যামল চিঠিটি পড়তে পড়তে একবারের জন্য থমকে গেলেন। এত বছর ধরে শিবরাম ঘোষালকে তিনি চেনেন একজন প্রতিষ্ঠিত, সম্মানীয় রাজনীতিক হিসেবে—গ্রামে স্কুল বানিয়েছেন, রাস্তা পাকা করেছেন। কিন্তু এই চিঠি যেন দেখাল তাঁর মুখোশের ফাঁকফোকর। বিকেলে কাজলিনী এলেন, আর শ্যামল তাঁকে চিঠির কথা বললেন। কাজলিনী কাগজে চোখ বুলিয়ে বললেন, “আমরা ভাবি ইতিহাস তৈরি হয় বড় বড় নীতিবাক্যে। কিন্তু এই চিঠিটাই প্রমাণ যে ইতিহাস গড়ে ওঠে বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষত দিয়ে। শিবরাম ঘোষালের মতো মানুষদের নাম বইয়ে থাকবে, কিন্তু বিশ্বজিতের নাম থাকবে না। অথচ কষ্ট, ক্ষোভ, সত্য—সবটা বহন করেছে এই বিশ্বজিৎ।” নবীন, পাশে বসে, ফোনে কিছু রেকর্ড করছিল—হয়তো এই গল্পটাই সে অনলাইন পডকাস্টে বলবে। শ্যামল ভাবলেন, এই চিঠিগুলো কেবল সংবেদন নয়, এগুলো ভবিষ্যতের চোখে বাস্তব সমাজচিত্রের রূপরেখা। চিঠির এই দলত্যাগ যেন কাগজে লেখা এক রাজনৈতিক স্বীকারোক্তি—যেখানে ক্ষমতার কৌশল, বিশ্বাসের ভাঙন, আর এক সাধারণ মানুষের ক্ষোভ চিরকাল রয়ে গেল কেবল একটি ফেরত আসা খামে।

পঞ্চম দিন সকালে শ্যামল সাঁতরা নিজেই যেন আর শুধু এক অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার নন, হয়ে উঠেছেন এক পাঠক—সময়ের, সমাজের, আর নিঃশব্দ কণ্ঠস্বরের। আজ তাঁর মন টানল একটি কুয়াশাচ্ছন্ন খাম—ধূলিধূসরিত, কোণ ছেঁড়া, আর ঠিকানার জায়গায় স্পষ্ট করে লেখা—“গোবিন্দ হাজরা, গ্রাম: শিলদা, জেলা: পশ্চিম মেদিনীপুর।” প্রাপক—“সঞ্জীব হাজরা, সি/ও স্বপন হাজরা, তৃতীয় তলা, বস্তি লেন, ঘাটকোপার (পূর্ব), মুম্বাই।” চিঠিটির ওপরে তিনবার ‘অজানা প্রাপক – ফেরত’ সিল মারা হয়েছে, তারিখগুলি তিনটি আলাদা মাসে—২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬। শ্যামলের মনে হল—এই চিঠিটি কেবল ফেরত আসেনি, বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। হাতে তুলে নিয়ে তিনি খাম খুললেন, ভিতরে ছিল একটি চার পাতার দীর্ঘ চিঠি, পরিষ্কার হাতের লেখা, কোনো সাহিত্যিক ছোঁয়া নেই, কেবল নিখাদ বর্ণনা—এক পিতার আর্তনাদ, যিনি তাঁর ছেলেকে চিঠি লিখেছিলেন সময় ধরে, আশায় আশায়।

চিঠির শুরুতে লেখা—“সঞ্জীব, তুমি মুম্বাই গেছ তিন বছর হয়ে গেল। প্রথমদিকে ফোন করতিস, এখন তাও বন্ধ। আমি তো জানি না, তুই ভালো আছিস কি না, খাচ্ছিস কি না। তোর মা রোজ কাঁদে। আমি এই চিঠিটা লিখছি, তুই যদি একবারও হাতে পাস, জানিস আমরা এখনও অপেক্ষা করছি।” পরের পাতায় গোবিন্দ লিখেছেন, কেমন করে তাঁর এক একর জমি ব্যাঙ্কের কৃষিঋণ না শোধ করায় নিলামে উঠেছে। লিখেছেন—“তুই বলেছিলি, শহরে কাজ করবি, টাকা পাঠাবি। কিন্তু আমরা এখনও ভাতের চাল কিনি বাকিতে। জমিতে ধান ছিল, এখন ঘাস হয়।” তিনি ভেঙে পড়েছেন প্রশাসনের সামনে, ব্লকে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, সাহায্য চাননি—শুধু চান তাঁর ছেলেটি জানুক, তার শেকড় কোথায় ছিল। তৃতীয় পাতায় মায়ের অসুস্থতার কথা, বোনের বিয়ের ব্যর্থতা, আর শেষে গোবিন্দ লিখেছেন—“তুই যদি বাড়ি ফিরে আসিস, জমি পাবি না। কিন্তু তোদের ঘরের বারান্দাটা এখনও আছে। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওখানে বসি, হয়তো তুই কখনো হঠাৎ সামনে আসবি।” এই পর্বে এসে শ্যামলের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে—তিনি কল্পনা করেন, গোবিন্দ যেন তাঁর বুকের ভিতর কথা বলছেন।

সন্ধ্যাবেলায় শ্যামল কাজলিনী ও নবীনকে ডেকে চিঠিটি পড়ে শোনান। কাজলিনী থেমে বলেন—“এটা কেবল একজন পিতার চিঠি নয়। এটা গোটা কৃষিজীবী ভারতের করুণ দলিল। জমি হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষও হারিয়ে যায়—তার আত্মপরিচয়, শেকড়, বিশ্বাস সবকিছু। আর শহরও সেই হারিয়ে যাওয়া সন্তানদের গিলে খায়, ঠিক যেন এই চিঠির মতো—পাঠানো হয়, পৌঁছায় না।” নবীন চুপ করে বসে থাকে, চোখ নামিয়ে। সে বলে, “স্যার, আমরা শহরে থাকি, কিন্তু এই চিঠিগুলো পড়ার পর মনে হয়, যেন কোথাও কেউ আমাদের জন্য এখনও জানালায় দাঁড়িয়ে থাকে, যার কাছে আমাদের ফেরার কথা ছিল।” শ্যামল অনুভব করেন—এই চিঠিটি শুধু বাবার লেখা ছেলের কাছে নয়, এটা গোটা গ্রামীণ সমাজের লেখা শহরমুখী প্রজন্মের কাছে—এক কান্নাভেজা আহ্বান, এক ক্ষীণ আশার আলো, আর ইতিহাসে লেখা এক অনুচ্চারিত প্রস্থান। চিঠিটির শেষ বাক্য যেন তাঁর কানে দীর্ঘক্ষণ অনুরণন করে—“তুই না ফিরলে চলবে, কিন্তু আমার এই চিঠি যদি একবারও তোর হাতে পড়ে, জানিস, আমরা তোকে ভুলিনি।”

দিনের আলো ম্লান হয়ে আসছিল, জানলার কাঁচে লালচে সূর্য ডুবে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। শ্যামলবাবু চিঠির স্তূপে হাত রাখতে গিয়েও আজ আর একটি নতুন চিঠি টানলেন না। তাঁর মনে আজ ঘুরপাক খাচ্ছে অন্য এক প্রশ্ন—এই চিঠিগুলোর মধ্যে কি এমন কোনোটা আছে, যা সরাসরি তাঁর পরিচিত, তাঁর অতীত, এমনকি তাঁর হৃদয়েরও অংশ হয়ে উঠতে পারে? ঠিক তখনই কাজলিনী মুখার্জি এলেন হাতে একটি পুরনো খাম নিয়ে—চিঠিটি পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর নিজের পুরনো বইয়ের ভাঁজে। তা শ্যামলকে দেখাতে এসেছেন, কারণ চিঠিটা কখনও পাঠানো হয়নি। শ্যামল খামটি হাতে নিয়ে কিছুটা চমকে ওঠেন—এই নামটা তো চেনা: “রূপম সেনগুপ্ত, সি/ও কালিন্দী হোস্টেল, শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯২”।

কাজলিনী ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলেন, “শ্যামল, তুমি জানো না, আমি একবার একটা চিঠি লিখেছিলাম, যা কোনোদিন পাঠাতে পারিনি। সে ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী। খুব সাধারণ ছেলে, কিন্তু চোখে স্বপ্ন ছিল। আমরা একসাথে নাটক করতাম, কবিতা পড়তাম, ঝগড়া করতাম, কিন্তু তখনকার সমাজ বা আমার পরিবার আমাকে কখনও ‘ভালোবাসা’ শব্দটি উচ্চারণ করতেও দেয়নি। আমি চিঠিটি লিখে পকেটে রেখেছিলাম, ঠিক করেছিলাম ওকে দেব। কিন্তু যেদিন দেব ভেবেছিলাম, সেদিনই শুনি, ওর বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় রূপম ফিরে গেছে অসমে। তারপর আর দেখা হয়নি।” শ্যামল চিঠিটি খুলে পড়তে পড়তে দেখলেন, কী অপূরণীয় নীরবতায় ভরা এক প্রেমের গলিপথ এঁকেছেন কাজলিনী—“তুই জানিস না রূপম, তুই আমার সেই পংক্তি, যা আমি মনে মনে বারবার পড়ি, কিন্তু কারো সামনে কখনও বলতে পারিনি।” চিঠির কালি কিছু জায়গায় ঝাপসা হয়ে আছে, হয়তো চোখের জলেই।

শ্যামলের চোখে কাজলিনীর এই স্বীকারোক্তি এক নতুন আলো এনে দিল। এতদিন ধরে তিনি যে চিঠিগুলো পড়ছিলেন, সেগুলো শুধুই অন্যদের লেখা ছিল। কিন্তু আজ তাঁর সম্মুখে এক পরিচিত মানুষ, যার জীবনেও ছিল এক অপ্রকাশ্য ভালোবাসার চিঠি—এক অপূর্ণতার উপাখ্যান। তিনি চুপ করে কিছুক্ষণ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলেন, তারপর বললেন, “তুমি কি এখন ওকে চিঠিটা পাঠাতে চাও?” কাজলিনী একটু হাসলেন, তিক্ততা মেশানো সেই হাসি যেন, “না, এখন আর না। এখন আর পাঠানোর অর্থ নেই। কিন্তু ভালো লাগে জানো, যে কেউ একজন সেটা পড়ল। কেউ একজন জানল, আমিও ভালোবেসেছিলাম, চুপিচুপি, সমাজের চোখ বাঁচিয়ে।” শ্যামল বুঝতে পারলেন—এই চিঠিগুলো কেবল সম্পর্কের নয়, এরা আত্মপরিচয়েরও দলিল। চিঠি লেখা এক ধরণের সাহস, যা শব্দের আড়ালে বলে দেয় সেই সত্য, যা মুখে বলা যায় না। চিঠির পাতায় মানুষ নিজেকে রেখে যায়, একভাবে যা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। শ্যামল ভাবলেন, তিনি এখন কেবল পাঠক নন—এই সব না-পাওয়া চিঠিগুলোর একমাত্র সাক্ষী, যার চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সমাজের ব্যক্তিগত ইতিহাস, অশ্রুত প্রেম, চুপিসারে গড়ে ওঠা এক ব্যক্তিগত বিপ্লব।

আকাশে আজ মেঘ জমেছে, বাতাসে যেন এক অচেনা উদাসীনতা। শ্যামল সাঁতরা বারান্দায় বসে, চায়ের কাপ হাতে ভাবছিলেন—এই কয়েকদিনের চিঠিগুলি যেন তাঁর বুকের ভেতরে কিছু একটা নড়ে দিয়েছে। প্রতিটি চিঠি একজন মানুষ, একটি সময়, একটি সমাজের মুখ—যা হয়তো ইতিহাসের পাতায় নেই, কিন্তু বাস্তবতার চেয়ে বেশি জীবন্ত। হঠাৎ ভিতর ঘর থেকে নবীন বেরিয়ে এসে বলল, “স্যার, আজ একটা কথা বলব? একটা চিঠি লিখেছি… কিন্তু এটা কারও জন্য নয়, এটা ভবিষ্যতের জন্য।” শ্যামল একটু চমকে গেলেন। নবীনের হাতে ছিল একটি খোলা পত্র—হাতের লেখা কাঁচা, কিছু জায়গায় কাটাকাটি, কিছুটা জেদ, কিছুটা আশা, অনেকখানি প্রশ্ন। তিনি বললেন, “তুমি কি আমাকে পড়তে দেবে?” নবীন মাথা নোয়াল—“আপনার চিঠিগুলোর কাছে এটা হয়তো কিছুই না… কিন্তু আমি চাই আপনি পড়ুন।”

শ্যামল চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলেন—“প্রিয় ভবিষ্যতের মানুষ, জানি তুমি আমাকে চিনবে না, তবুও লিখছি। কারণ আমাদের সময়টা বড় অদ্ভুত। আমরা ফোনে কথা বলি, কিন্তু মন খুলে কথা বলতে ভয় পাই। আমরা খবর পড়ি, কিন্তু সত্যটা বুঝি না। আমরা প্রতিবাদ করতে চাই, কিন্তু ভয় পাই চাকরি হারানোর। আমরা ভাবি, পরিবর্তন হবে কেউ একজন এসে… কিন্তু সেই কেউ কি আর আসে?” নবীন লিখেছে, কেমন করে আজকের ছাত্ররা শুধু পরীক্ষার চাপে নয়, চুপ করে থাকার চাপে দমবন্ধ হয়ে আছে। সে লিখেছে—“আমি একদিন ভেবেছিলাম সমাজকে পাল্টাব, কিন্তু এখন দেখি, সমাজ আমাকে পাল্টে দিচ্ছে। তারপরে ভাবি—হয়তো লিখে যেতে পারি। যেমন এখন লিখছি।” চিঠির শেষে নবীন লিখেছে—“তুমি যদি ভবিষ্যতে এই চিঠিটা পাও, জানবে কেউ একজন চেষ্টা করেছিল। কেউ একজন শুধু মুখ বুজে থাকেনি।”

শ্যামল চিঠিটা পড়ে চুপ করে বসে থাকলেন। মনে হচ্ছিল, এই চিঠিটি যেন পূর্ববর্তী সব চিঠির বিপরীত—এটি অতীত নয়, এটি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লেখা। আর এই নবীন, সে কেবল ছাত্র নয়, যেন সমাজের সেই স্পন্দন, যা এখনো মরেনি—যে বিশ্বাস করে, লেখা মানে প্রতিবাদ, প্রশ্ন মানে সাহস, আর চিঠি মানে জীবনের সম্ভাবনা। কাজলিনী এসে পাশে বসলেন। নবীনের চিঠি তিনিও পড়লেন। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “এই ছেলেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরা যেগুলো বলতে পারিনি, ওগুলো ওরা লিখবে।” শ্যামল মাথা নাড়লেন, তাঁর চোখে জল ঝিকমিক করছিল। এই চিঠিগুলোর মাঝে নবীনের লেখা যেন একটা নতুন দরজা খুলল—যেখানে কেবল অতীত নয়, ভবিষ্যতের আশা, সংশয় আর সংগ্রামও উঠে এল অক্ষরে অক্ষরে। শ্যামল বুঝলেন, তাঁর কাজ এখন শুধুই চিঠি পড়া নয়—এই না-পাওয়া, না-পাঠানো চিঠিগুলোর কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেওয়া সেই ভবিষ্যতের কানে, যাকে জানিয়ে যেতে হবে—আমরা চুপ থাকিনি।

রাত্রি গভীর হয়েছিল, জানালার বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকার কান্না আর দূর থেকে শোনা ট্রেনের হুইসেল যেন শ্যামল সাঁত্রার মনটাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অনেক দূরে, সেই সময়ের দিকে, যাকে তিনি বহু বছর ধরে ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন। নবীনের চিঠি পড়ে তিনি যতই ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলেন, ততই যেন অতীত তাঁকে টানছিল নিজের অন্ধকারে। চিঠির স্তূপে ফের হাত বাড়িয়ে আজ আর অন্যের লেখা কিছু খুঁজলেন না—তিনি টেনে বের করলেন এক খাম, যার ওপর লেখা তাঁর নিজের হাতের লেখা—“স্নেহাশিস বিশ্বাস, হাসপাতাল ওয়ার্ড নম্বর ৪, চন্দনগর।” তারিখ: ১৯৮৭ সালের জুন মাস। খামটি কখনো পাঠানো হয়নি, কিংবা হয়তো পাঠিয়ে পরে ফেরত এসেছে। পেছনে স্পষ্ট সিল—“প্রাপক মারা গেছেন।”

চিঠিটি খুলতেই পুরনো গন্ধ একঝলকে ছুঁয়ে গেল তাঁর বুক—একসাথে লজ্জা, অপরাধবোধ, আর অনুশোচনায় বুক চেপে বসে গেল। এই চিঠি তিনি লিখেছিলেন তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্নেহাশিসকে, যাঁর সঙ্গে একসময় কাজের সূত্রেই সম্পর্ক, তারপর আদর্শগত সংঘর্ষ, আর শেষে অপমানজনক দূরত্ব। চিঠিতে লেখা ছিল—“তুই জানিস, আমি তোকে শেষ দেখে আসিনি। আমি তোর অসুস্থতার খবর পেয়েও আসিনি। কারণ তোর চোখে চোখ রাখতে পারিনি। আমি সেই পোস্টমাস্টার, যে বিশ্বাস করত চিঠি পৌঁছায়, কিন্তু এই একটা চিঠি… আমার ভেতরের সত্য, তা আর পাঠানো হয়নি। তোকে বিশ্বাসঘাতক বলেছিলাম, কিন্তু এখন বুঝি, তোকে আমি বুঝিনি। তুই আমাকে বন্ধুর মতো চিঠি দিয়েছিলি, আর আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।” শ্যামলের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। এই চিঠি যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত স্বীকারোক্তি—এক অসমাপ্ত সম্পর্কের, এক অনুশোচনার আত্মপ্রকাশ।

সকালে, তিনি কাজলিনী ও নবীনকে ডাকেন। হাতে করে সেই চিঠি তুলে দেন। বলেন, “এই চিঠিটা আমি লিখেছিলাম, কিন্তু পৌঁছায়নি। যেমন আমার অনেক অনুভব, অনেক সম্পর্ক পৌঁছায়নি যাদের কাছে পৌঁছানো উচিত ছিল।” কাজলিনী বলেন, “কিন্তু তুমি এখন সেটা পড়ালে, মানে তুমি এখন পৌঁছে দিলে।” নবীন তখন বলে ওঠে, “স্যার, এইসব চিঠিগুলোর একটা সংগ্রহ করা যায় না? একটা আর্কাইভ… একটা এমন জায়গা যেখানে এই না-পাওয়া চিঠিগুলো থাকবে।” শ্যামলের চোখে জল চলে আসে—তিনি মাথা নাড়েন। বলেন, “হ্যাঁ, এসব চিঠি সমাজের দস্তাবেজ—যেখানে ইতিহাস নেই, আছে জীবন।”

সেই দিন সন্ধ্যায় শ্যামল তাঁর পুরনো আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি চিঠি যত্ন করে আলাদা আলাদা খামে ভরে রাখেন। তাঁর টেবিলের ওপর রাখা থাকে একটি পেন আর একটি খাতা—যেখানে তিনি লিখবেন প্রতিটি চিঠির পাশে একটি করে মন্তব্য, একটি করে প্রতিচ্ছবি, যেন পাঠকের মনে চিঠিটি কেবল পড়া নয়, অনুভব করা যায়। বাইরে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, কিন্তু ভেতরে এক নতুন আলো জ্বলছে। “চিঠির ভাঁজে সমাজ” তাঁর কাছে আর কেবল কাগজের গল্প নয়, হয়ে উঠেছে তাঁর জীবনের সত্য। আর সেই সত্য পৌঁছে দেবে আগামী দিনের পাঠকের কাছে—যেখানে শব্দই সাক্ষ্য, অক্ষরই ইতিহাস, আর এক একখানা চিঠিই হয়ে উঠবে সমাজের নিরব ডায়েরি।

1000041945.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *