মেঘলা দাশগুপ্ত
পর্ব ১
কলকাতার গরমটা জুনে এসে যেভাবে গায়ে লেগে থাকে, মেঘলার কাছে সেটা অস্বস্তিকর নয়, বরং একধরনের আশ্বাসের মতো। সে ভালোবাসে বিকেলের ছায়া যেভাবে জানালার পাল্লা ফুঁড়ে ঘরে ঢোকে, সেই রকম নিঃশব্দ আলো, যেটা কারও চোখে পড়ে না, কিন্তু মনটা একটু একটু করে ধুয়ে দেয়। এই বাড়িটা সে ভাড়া নিয়েছে এক মাসের জন্য—লেখালেখির কাজে মন বসবে ভেবেছিল। দক্ষিণ কলকাতার এই পুরনো বাড়িটা, কাঠের জানালা, ধুলো জমে থাকা বারান্দা, দেওয়ালে ধস নামা চুন—সব মিলিয়ে একটা একাকীত্বের ঠিকানা। মালকিন, বৃদ্ধা মৃণালিনী দেবী বলেছিলেন, “ঘরটা আগে এক কবি মেয়ের ছিল, নাম ছিল রত্না। বড় অন্যরকম মেয়ে ছিল, কবিতা লিখত সারাদিন। তখনকার দিনে মেয়েরা এসব করলে লোকে কেমন কথা বলত জানো তো? এখন আর কেউ লেখে না—তুমি তো লেখো, না?”
মেঘলা শুধু মুচকি হেসেছিল। লেখে সে, কবিতাও লেখে, কিন্তু নিজেকে এখনো কবি ভাবতে পারেনি। প্রথম দিনেই ঘরটায় ঢুকে সে শুধু চুপচাপ বসে ছিল জানালার পাশে, বাইরে তাকিয়ে থেকেছিল। একটা শালিক এসে বসেছিল দাওয়ায়, হঠাৎ কী ভয়ে যেন উড়ে গিয়েছিল। ঘরের ভেতর কেমন যেন একটা গন্ধ—ধুলোর, পুরনোর, হারানোর গন্ধ। মনে হয়েছিল, এই দেওয়ালের ফাঁকে কিছু শব্দ আটকে আছে, কিছু স্বর, যা হয়তো এখনো কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
ঘর গোছাতে গোছাতে সন্ধে নামল। খাটের নিচে একটা পুরনো কাঠের বাক্স পাওয়া গেল, তালা নেই, তবে অনেক ধুলো জমে আছে। কৌতূহল সামলাতে না পেরে মেঘলা সেটার ঢাকনা তুলতেই চমকে গেল। ভেতরে সারি সারি চিঠি। হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজ, কালি কিছু জায়গায় মুছে গেছে, কিছু জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে জল রঙের মতো। হাতের লেখাগুলো মেয়েলি, কখনো স্পষ্ট, কখনো থেমে থেমে লেখা, যেন খুব আবেগ চেপে রাখা আছে প্রত্যেক লাইনে। চিঠিগুলোর উপরে উপরে একটা নাম বারবার ঘুরে ফিরে এসেছে—নীলা।
মেঘলা ধীরে ধীরে একটা চিঠি তুলে নিল। কাগজটা স্পর্শ করতেই মনে হলো কারো বুকের ভেতরের কষ্ট সে ছুঁয়ে ফেলেছে। লেখা—“নীলা, আজ দুপুরে তুই বললি আমি যেন আর লিখি না। কিন্তু তুই জানিস না, আমার কবিতা শুরুই হয় তোর চোখ থেকে। তুই যখন সাদা শাড়িতে মাথায় বেনি বেঁধে কলেজে ঢুকিস, আমি মনে মনে তোর নামে ছন্দ খুঁজে পাই। কেউ বুঝবে না, কেউ জানবে না—এই প্রেম, এই আত্মা, এই ভেতরের নরম কাপুনি… কেবল তুই বুঝিস। তুই কি ভুলে যেতে পারবি সব? তুই কি পারবি আমাকে না দেখে থাকতে? আমি তো পারি না রে, নীলা।”
চিঠিটা নামিয়ে রাখার পর মেঘলা অনুভব করল বুকটা ভারী হয়ে আছে। এই প্রেমের ভাষা, এই অনুভূতির রঙ, এই আকুলতার জড়ানো শব্দ—এসব আজ আর দেখা যায় না। সমাজে লুকিয়ে থাকা এমন প্রেম, যেটা উচ্চারণ করাই পাপ ছিল, সেই প্রেম আজ তার হাতে এসে ধরা দিয়েছে। কেমন ছিল তাদের সময়? সমাজ কি কখনো মেয়েদের এই রকম ভালোবাসা মেনে নিয়েছিল?
সে আরেকটা চিঠি খুলল। লেখা—“আজ কলেজের দোতলার করিডোরে তুই দাঁড়িয়ে ছিলি, আমি দেখেছিলাম। তুই তাকাসনি আমার দিকে। আমিও তাকাইনি। কিন্তু আমি জানি, আমার ডান হাতটা কেঁপে উঠেছিল, মনে হয়েছিল তোকে ছুঁয়ে ফেলি, একবার চোখে চোখ রাখি। অথচ কতজন পাশে দাঁড়িয়ে, কত ছেলে, কত শিক্ষক, কে জানে কে কেমন দেখবে। তুই জানিস? আমি স্বপ্নে তোকে দেখি। তুই হাসিস, বলিস—‘রত্না, তুই কবিতা হ, আমি হই তোর লাইন।’ আমি ঘুম ভেঙে কাঁদি। এই কাঁদাটুকু তুই জানিস না। জানলে হয়তো তুই লিখতি—‘আমি হই তোর চোখ, তুই হ হিয়া।’”
চিঠিগুলো কেবল ভাষা নয়, একেকটা যেন জীবন্ত অনুভব। মেঘলার মনে হলো যেন কোনো গভীর নদী তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, যে নদী সে কখনো নামেনি, শুধু তার শব্দ শুনেছে দূর থেকে। কে ছিল রত্না? কেমন ছিল সে? আর নীলাঞ্জনা—সে কি এখনো আছে কোথাও? কোথাও কি সে এখনো এই চিঠিগুলো মনে করে?
বাইরে হালকা বৃষ্টি নামছিল। জানালায় জলধারা পড়ছিল টুপটাপ। ঘরের ভেতর আলো নিভু নিভু হয়ে উঠেছিল। মেঘলা চিঠিগুলো আর বাক্সে রাখল না, খাটের ওপরে ছড়িয়ে দিল। তার চারপাশে যেন এক প্রেমের জগত গড়ে উঠেছে—যেখানে ভাষা নেই, কেবল চোখ, চিঠি, আর অচেনা টান।
সেই রাতে ঘুম আসেনি মেঘলার। তার ঘুমে এসেছিল এক সাদা শাড়ি পরা মেয়ে, চোখে দীপ্তি, ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি। সে এগিয়ে এসে বলেছিল, “তুই কি আমাদের কথা লিখবি, মেঘলা?”
মেঘলা কোনো উত্তর দিতে পারেনি—শুধু জানালার বাইরের বৃষ্টির শব্দ শুনে গেছে।
পর্ব ২
কলকাতার সকালে অদ্ভুত রকমের একটা নিঃশব্দতা থাকে, বিশেষ করে পুরনো পাড়াগুলোতে। চারদিকে ঘুমচোখে হেঁটে চলা মানুষ, দোকানের শাটার তোলার শব্দ, দূরে বাজতে থাকা আজানের ধ্বনি—সবকিছু একসঙ্গে মিলেমিশে একটা ধীর চলার মতো সকাল গড়ে তোলে। মেঘলা ঘুম ভাঙার পর এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিল কোথায় আছে। তারপর জানালার ফাঁক দিয়ে এসে পড়া আলো দেখে মনে পড়ে গেল—সে এখন দক্ষিণ কলকাতার এক পুরনো বাড়ির ঘরে, যেখানে দেয়ালের ফাঁকে লুকিয়ে আছে প্রেম, আর খাটের নিচের বাক্সে গুটিশুটি মেরে বসে আছে অনেকগুলো অক্ষর, যেগুলো এখন তার চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, মুখ চেপে বলছে—শোনো আমাদের, লিখো আমাদের। ব্রাশ করতে করতে আয়নায় নিজের চোখে তাকায় মেঘলা। সে ভাবে, কেউ যদি এখন তার চোখ দেখে, বুঝবে কি সে কত গভীরে ডুবে গেছে এই চিঠির পৃথিবীতে? সারাটা সকাল সে কিছুতেই মন বসাতে পারে না লেখায়। বারবার চোখ চলে যায় চিঠির দিকে। কী ছিল সেই ভালোবাসায়, যা এতদিন পরে এসেও কাউকে এইভাবে গ্রাস করে ফেলে? দুপুর গড়িয়ে আসে। খাওয়ার পর একটু শুয়ে ছিল, ঘুমিয়ে গিয়েছিল কি না জানে না, কিন্তু একটা স্বপ্ন তার মনে গেঁথে যায়—সাদা জামা পরা একটা মেয়ে, ছাদের কিনারে দাঁড়িয়ে, তার হাতে একটা কাগজ, আর সে বলছে—“আমি আর পারি না, রত্না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।” চমকে উঠে বসে মেঘলা। জানালার বাইরে তখন আকাশ রোদে ঝলমল করছে, অথচ তার বুকের মধ্যে যেন কেউ বসে আছে। সে ধীরে ধীরে বাক্সটা টেনে আনে, আরও কিছু চিঠি বের করে।
“নীলা, আমি জানি না কবে শেষ চিঠি লিখব তোকে। হয়তো তুই আর কোনোদিন আমার কাছে ফিরবি না। হয়তো তুই বিয়ের পর তোর স্বামীকে বলবি—‘আমি তো প্রেম করেছি কখনো, কিন্তু বিয়েটা ঠিক করেই করেছি।’ হয়তো তুই তোর মেয়ে বা ছেলেকে একদিন গল্প করবি কলেজ লাইফের, কিন্তু কখনো বলবি না—রত্না নামে একটা মেয়ে ছিল, যার জন্য তুই এক সন্ধ্যায় পুরো শহর হাঁটছিলি, শুধু একটা কবিতা খুঁজে পেতে। আমি এসব জানি, তাও লিখি। কারণ এটা আমার শেষ প্রতিবাদ, শেষ ভালোবাসা, শেষ স্বীকারোক্তি। আমি তোকে ভালোবেসেছি, তুই ভালোবাসিস বা না বাসিস—সেটা এখন আর আমার অধিকার নয়। শুধু জানিস, এই বাড়িটার জানালায় আমি তোর পথ চেয়ে থাকি এখনো।”
চিঠির শেষে কোনো তারিখ নেই। কেবল নিচে লেখা—“রত্না”। মেঘলা জানে না, কেন তার বুকের মধ্যে এই নামটা এমনভাবে গেঁথে যাচ্ছে। রত্না যেন একজন না, বরং একটা অনুভব, একটা নামহীন সম্পর্ক, যে প্রেমের কথা উচ্চারণ করার অধিকার তাদের ছিল না, শুধু ভেতরে গুমরে গুমরে মরে যেতে হতো। সে ভাবে, এই চিঠিগুলো কীভাবে একাকী থেকে গেছে এতদিন! কেউ কি কখনো পড়েছিল এগুলো? কেউ কি জানে রত্নার গল্প?
বিকেলের দিকে বাড়ির মালকিনের সঙ্গে তার দেখা হয়। মেঘলা জিজ্ঞেস করে, “রত্না দিদি—তাঁর কথা আপনি জানেন?” বৃদ্ধা একটু চুপ করে থাকেন। তারপর বলেন, “ও তো অন্যরকম ছিল রে মা। চুপচাপ থাকত, কলেজে পড়ত, কবিতা লিখত। কেউ বুঝত না কী ভাবে, কোথায় থাকে। পরে শোনা গেল প্রেম ছিল ওর—কিন্তু কোনো ছেলের সঙ্গে নয়, একটা মেয়ের সঙ্গে। এই কথা শুনে পরিবার ওকে ত্যাগ করে। বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল, আমি তখন কিনে নিই। ওর অনেক বই, অনেক কাগজ ফেলে যাওয়া। তুই যে ঘরে আছিস, সেখানেই থাকত ও। ওর চোখে এমন কিছু ছিল, যেটা কেবল গভীর দুঃখে ভরা প্রেমে দেখা যায়।”
মেঘলা ধীরে ধীরে বুঝে নেয়, সে কেবল এক লেখক নয়, বরং এখন সে এক ইতিহাসের সাক্ষী, এক অনুচ্চারিত প্রেমের উত্তরাধিকার। সেদিন রাতে সে চিঠিগুলো সাজায় তার খাটে। যেন একে একে সেগুলো একটা গল্প বলছে তাকে, একটা অসমাপ্ত প্রেমের ধারাবাহিকতা, যা সমাজের চোখ এড়িয়ে বেঁচে থেকেছে কাগজের ভাঁজে, বাক্সের গোপন চুপে।
চোখের সামনে শেষ চিঠিটা সে ধরে রাখে। লেখা—“তুই কি জানিস, কত বছর পরে কেউ যদি এগুলো খুঁজে পায়, তবে কী ভাববে আমাদের নিয়ে? তুই কি তখনও আমাকে মনে রাখবি? না কি হারিয়ে যাব আমি শুধু কিছু হলুদ কাগজে, যেখানে নাম লেখা নেই, ঠিকানা নেই—কেবল তোর নামে লেখা একটা জগত আছে, যার বাইরেটা কেউ বোঝে না?”
মেঘলা জানালার ধারে বসে থাকে। বাইরে তখন কলকাতার ট্রাম পেরিয়ে যায় ঘণ্টা বাজিয়ে। সে জানে, সেই বাইরের পৃথিবী বুঝবে না এই চিঠিগুলোর ভাষা। কিন্তু সে বুঝেছে। আর সেই বোঝাটুকুর দায় সে আর ফেলে রাখতে পারে না।
পর্ব ৩
সন্ধের আলোর রং বদলাতে শুরু করেছে জানালার গায়ে। বেগুনি আর কমলার মিশেল, যেন কোনও চুপ করে থাকা প্রেমিকের মুখ, যার গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে বিদায়ের আলো। মেঘলা বসে আছে খাটের কিনারে, পায়ের কাছে বিছানো ছড়িয়ে থাকা চিঠিগুলো এখন তার কাছে কেবল নথিপত্র নয়, তারা যেন নিজেরাই শব্দে শব্দে গড়ে তুলছে এক সমান্তরাল জীবন। একটা চিঠি আজকের এই আলোয় খানিক বেশি জ্বলজ্বল করছে, কাগজে যেন রোদের আঁচ থেকে গলে যাওয়া সোনালি আভা। সে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় চিঠিটা, পেছনে তার ছায়া পড়ে দেয়ালের ওপর, যেন অতীত ও বর্তমান হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে।
“নীলা, তুই বিয়েতে রাজি হয়েছিস শুনে মনে হচ্ছিল আমি যেন একটা ছোট জানালার বাইরে থেকে দেখছি, ভিতরে আলো, অতিথি, হাসি, কিন্তু জানালার কাঁচে আমার ছায়া পড়ে আছে। তোর মুখ মনে পড়ছে—প্রতিবার আমার কবিতার শেষে তুই যেভাবে বলতিস, ‘আরও একটু লিখিস না রে, রত্না’, সেই গলায় যদি আজও শুনতে পাই—‘আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে’, তাহলে কি আর বেঁচে থাকা যায়, বল? আমি তোকে কিছু বলব না। শুধু এইটুকু বলি, তুই যে জামদানি শাড়িটা পরিস, যার আঁচলে নীল ফুল, আমি সেই শাড়িটার কথা আজও লিখে যাই। লিখি, যেন তুই একদিন আমার কবিতা পড়ে নিজেই বুঝে যাস, আমি কখনও তোর বাইরে ছিলাম না।”
মেঘলার চোখ ফেটে জল আসে। এতখানি নিঃশব্দ যন্ত্রণার মধ্যেও যে ভাষা থাকে, এতটা হারানোর মধ্যেও যে মমতা থাকতে পারে, এই চিঠিগুলো না পড়লে সে হয়তো বুঝত না। তার মনে হয় সে যেন ধীরে ধীরে এক প্রেমিক কবির ভূত হয়ে উঠছে, যে তার প্রেয়সীর অভাবে বেঁচে থেকেও কোথাও আটকে গেছে—সময়, স্মৃতি আর শোকের মধ্যে।
সে বইয়ের তাক ঘাঁটতে শুরু করে, যদি রত্নার কোনও হাতে লেখা কবিতার খাতা পায়। ধুলোমাখা কিছু কাগজের গায়ে কালচে ছোপ, কিছু কবিতার ছেঁড়া ছেঁড়া পাতা সে তুলে নেয়। পড়তে পড়তে চোখ আটকে যায় একটিতে—“আমি হই ছায়া, তুই যদি হস আলো। আমি হই অভিমান, তুই যদি হস স্বপ্ন। আমি হই নিষেধ, তুই যদি হস বাঁধন ভেঙে আসা প্রেম।” শব্দগুলোর গায়ে ধরা আছে যেন একজোড়া আঙুলের চাপ, যে আঙুল একদিন প্রেম লিখেছিল, আবার সেই প্রেমকে গোপন করে রেখেছিল কবিতার ছায়ায়।
রাত বাড়তে থাকে। মেঘলা আর চিঠির বাইরে বেরোতে পারে না। সে ভাবে, যদি নীলাকে খুঁজে পাওয়া যেত! কোথায় আছে এখন সে? বেঁচে আছে? কিছু মনে রেখেছে রত্নার? হয়তো না। হয়তো নীলা এখন নিজের জীবনের ভিড়ে ভুলে গেছে সব। কিন্তু কেউ ভুলে গেলেই কি সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়? যদি প্রেম একতরফা হয়, তবু কি তার গভীরতা কমে যায়?
সেই রাতে প্রথমবার মেঘলা নিজের ডায়েরি খুলে লিখে—“আমি মেঘলা, আর আজ আমি একটা গল্প লিখতে বসছি, যে গল্প আমার নয়, কিন্তু আমার হৃদয়ের রক্ত দিয়ে সে লেখা হতে চলেছে।” সে জানে এই গল্পের নাম লেখা যাবে না সোজাসুজি। ‘রত্না ও নীলা’র নাম হয়তো চাপা পড়ে যাবে, কিন্তু তারা রয়ে যাবে প্রতিটি শব্দে, প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি সেইসব চোখে যারা সমাজের ভয়ে, নিয়মের খাঁচায় নিজের সত্যি চেপে রেখে হাঁসফাঁস করে চলেছে।
সকালের আলো এখনও আসেনি, কিন্তু মেঘলার ঘরে বসে থাকা একজোড়া আগুনমাখা চোখ যেন তাকে ঘুমোতে দিচ্ছে না। হয়তো সেটা রত্নার, হয়তো সে বলছে—“তুই আমার গল্পটা লিখিস, মেঘলা। কেউ তো একদিন আমাদের কথা বলবেই। তোকে দিয়েই হোক না কেন।”
পর্ব ৪
মেঘলা এবার আর শুধু পাঠক নয়, সে যেন হয়ে উঠছে চিঠিগুলোর উত্তর। এই বাড়ির দেয়ালের ভেতর, ঘরের বাতাসে, পুরনো কাঠের গন্ধে এমন কিছু জমে আছে যেগুলোর ভাষা হয়তো ইতিহাসে নেই, কিন্তু হৃদয়ের ডায়েরিতে লিখে রাখা থাকে। সকালবেলা মালকিন মৃণালিনী দেবী এসে চা দিয়ে বলে গেলেন—“রাত জেগে লেখো দেখছি, ভালোই তো। তবে সাবধানে থেকো, পুরনো জিনিস বেশি মনে রাখলে মনে ছিদ্র হয়।” মেঘলা হাসল, কিন্তু জানে তার ভিতরটা ধীরে ধীরে চৌচির হয়ে যাচ্ছে—অথচ তা কষ্টে নয়, বরং ভালোবাসার ভারে।
আজ সে অনেকক্ষণ বসেছিল রত্নার ঘরের আয়নার সামনে। একসময় এই আয়নার সামনে হয়তো রত্না দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখত—চোখে ক kajal, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, আর ভিতরের ভয় লুকিয়ে রাখার অভ্যাস। মেঘলা নিজের মুখে সেই ছায়া খোঁজার চেষ্টা করে, বারবার মনে হয়, কোনও এক অন্য জীবন তাকে ধরে ফেলেছে। বিকেলের দিকে খুঁজতে খুঁজতে সে পায় একটা লাল রঙের নোটবুক, ভাঁজে ভাঁজে রত্নার কবিতা। প্রতিটা কবিতা যেন একরকম দহন। একটি পাতায় লেখা—“নীলা, আজ তুই বলেছিস আমি যেন ভুলে যাই সব। আমি পারি না। আমি ভুলতে জানি না। আমি তোকে রোজ লিখি আমার অশ্রু দিয়ে। প্রতিবার চিঠির শেষে বলি—আসবি? তুই আসিস না। তোর না-আসাটুকুই আমি পড়ে যাই।”
মেঘলার মাথা ঘুরে ওঠে। এই প্রেম, এই আকুলতা, এই অপেক্ষা—তাকে কাঁপিয়ে দেয়। সে ভাবে, এই রকম চিঠি পেলে কেউ কীভাবে চলে যেতে পারে? সে খুঁজে পেতে চায় সেই জায়গাগুলো, যেখানে রত্না হয়তো নীলার সঙ্গে দেখা করত। হয়তো পুরনো কলেজ, হয়তো রবীন্দ্র সরোবর, হয়তো বইয়ের দোকান, হয়তো নিঃশব্দ কোনও করিডোর। অথচ এসবের কোনও ঠিকানা নেই এই চিঠিগুলোতে—আছে কেবল অনুভব, যেগুলো ছুঁয়ে ফেলা যায়, চেনা যায় না।
রাতে সে ছাদে যায়। শহর জেগে আছে, কিন্তু নিঃশব্দে। বাতাসে নাম না জানা গানের সুর ভেসে আসে কোনও দূরের বাসা থেকে। ছাদে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মনে পড়ে যায় রত্নার সেই স্বপ্নের মেয়েটির কথা—যে বলেছিল, “আমি আর পারি না, রত্না।” মেঘলা ভাবে, তবে কি সে লাফ দিয়েছিল এখান থেকেই? ছাদের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। নয়, এটা মৃত্যু নয়—এটা সেই স্তব্ধতা, যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না, শুধু অপেক্ষার চিহ্ন রেখে যায় দেয়ালের ভেতর।
তলপেটে কেমন একটা মোচড় দেয়। এই অনুভূতিটা নতুন। সে বোঝে, রত্নার গল্পে ঢুকতে ঢুকতে সে আর নিজের গল্প থেকে আলাদা নেই। একটা পুরনো চিঠির কোণে কেউ লিখেছিল—“তুই যদি অন্য কারও হয়ে যাস, আমি তোকে আর ডাকব না। শুধু আমার কবিতার ভিতরে তোর একটা নাম রেখে দেব, কেউ যদি সেটা পড়ে ভালোবেসে ফেলে, সেটা তোর দোষ নয়, ও আমার হয়ে যাবে।”
মেঘলা এবার জানে, এই গল্প তার হাত দিয়ে শেষ হবে না। সে রত্নাকে খুঁজে বের করতে চায়, না শুধু তার নাম নয়, আসল রত্না—সে কোথায় গিয়েছিল, বেঁচে আছে কিনা, কিছু লিখে গিয়েছিল কিনা, কেউ তাকে ভালোবেসেছিল কিনা। এবং সবশেষে, সে খুঁজে পেতে চায় নীলাকে—কে জানে, হয়তো সে এই শহরেরই কোথাও বেঁচে আছে, কোনও পার্কে হাঁটে, কাউকে নিয়ে রিকশায় বাড়ি ফেরে, জানালায় দাঁড়িয়ে গোধূলি দেখে। মেঘলা তার কবিতা খুলে লেখে—“একদিন যদি নীলা আমার সামনে আসে, আমি তাকে কিছু বলব না, শুধু হাতে রাখব এই চিঠিগুলো, বলব—তোমার নামে লেখা, পড়ে দেখো।”
পর্ব ৫
কলকাতার সেই পুরনো বৃষ্টির গন্ধ মেঘলার ঘরে এসে ভিড়েছে যেন, বারান্দার বাইরে মেঘের ছায়া পড়ছে ভাঙা টাইলসের ওপর। ছাদের এক কোণে সে বসে আছে, হাতে নীলা ও রত্নার লেখা চিঠিগুলো। বাতাসে বয়ে চলা ঠাণ্ডা বাতাস মুড়ে ফেলছে তার গায়ের ওপর সেই দিনের স্মৃতি, যখন তার হাতে প্রথম চিঠিটি এসে পৌঁছেছিল। মনে পড়ে, কেমন অদ্ভুত লাগছিলো তখন, যেন কেউ দূর থেকে চেঁচিয়ে বলছে, “এই গল্পটা লিখো, জানো না আমাদের কথা।” কিন্তু সে ঠিক বুঝতে পারছিল না সেই শব্দগুলো কেমন ভাসছে তার মনকে ছুঁয়ে।
সেই থেকে মেঘলার জীবন আর আগের মতো নেই। চিঠিগুলো যেন ধীরে ধীরে তার রক্তের সঙ্গে মিশে গিয়েছে, তার আত্মার অংশ হয়ে গেছে। রত্না আর নীলার প্রেমের অতীত যেন এখন তার নিজের হৃদয়ে একটি গভীর জায়গা দখল করে নিয়েছে। রাতের গভীরে, ঘরের এক কোনায় বসে সে ভাবত, কীভাবে এই দুই নারী নিজেদের প্রেমের জন্য লড়াই করেছিল, কতো বাধা পার করতে হয়েছিল তাদের। সমাজের চোখ, পরিবার, সময়—সব কিছু ছিল তাদের বিরুদ্ধে। অথচ তারা হার মানেনি। তাদের প্রতিটি চিঠি যেন চিৎকার করত, ‘আমরা ছিলাম, আমরা আছি, আমরা বলব।’
মেঘলার হাতে থাকা চিঠিগুলোতে এমন অনেক গোপন কথা লুকিয়ে আছে যা সে যতই পড়ে, ততই হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। “নীলা, তুই জানিস? আমি কখনো তোর চোখের দিকে তাকাতে পারতাম না। আমি ভয় পেতাম, কারণ আমি জানতাম আমাদের ভালোবাসা এই শহরের জন্য অপরাধ। কিন্তু তোর হাসি, তোর স্পর্শ আমাকে বাঁচিয়ে রাখত।” এই কয়েক লাইন পড়ে মেঘলার চোখ ভিজে যায়। সে বুঝতে পারে, ভালোবাসা কখনো স্বাভাবিক বা সাধারণ হয় না। তা হয় লুকানো, চাপা, গোপন, অনেক সময় গোপনীয়তায় ডুবে থাকা।
সে দিনগুলো সে ভাবত, কতো অসহায়তা নিয়ে বসেছিল এই দুই নারী। রত্নার সেই চিঠি যেখানে লেখা, “আমি জানি, এই প্রেম আমাদের শেষ হবে না, শুধু সমাজ বলেছে আমরা থাকার জায়গা পাবে না। তবুও আমি লিখব, যতক্ষণ না পৃথিবী আমাদের নাম জানে।” মেঘলা মনে করে, এমন প্রেমের জন্য সময় যেন যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন ছিল সাহস, এমন সাহস যা অনেক সময় মানুষ পায় না। সে বুঝতে পারে, এই প্রেম শুধু রত্না আর নীলার নয়, বরং প্রতিটি এমন প্রেমিকের, যারা সমাজের বিধি ভাঙতে চেয়েছে।
একদিন মেঘলা নীলা সম্পর্কে আরও খোঁজ করতে রাস্তায় বের হয়। সে চলে যায় দক্ষিণ কলকাতার সেই পুরনো কলেজ ক্যাম্পাসে, যেখানে অনেক বছর আগে রত্না ও নীলা পড়াশোনা করত। কলেজের পুরনো লাইব্রেরির দরজায় ঢুকে সে দেখতে পায় অনেক পুরনো বই, তক্তা, এবং দেয়ালে গুমটিয়ে থাকা কিছু স্মৃতি। লাইব্রেরিয়ান তাকে জানায়, নীলা নামের একটা ছাত্রী ছিল, তবে সে অনেক আগে চলে গিয়েছিল। কেউ তার ঠিকানা বা খবর জানতো না। মেঘলা বুঝে ওঠে, নীলা হয়তো আজ আর এখানে নেই, কিন্তু তার গল্প এখনো কলেজের দেওয়ালে ঝকঝক করছে।
সে কলেজ ক্যাম্পাসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবতে থাকে, হয়তো রত্না আর নীলা একসঙ্গে বসে ছিলো এই বেঞ্চে, হয়তো হাত ধরে হেঁটে গেছে এই গাছেদের নিচ দিয়ে, হয়তো একসঙ্গে স্বপ্ন দেখেছিলো একটা এমন সমাজের যেখানে তাদের ভালোবাসা অপরাধ হবে না। মেঘলার চোখে দেখা যায় এক অদ্ভুত নস্টালজিয়া, আর মনে হয় যেন সে নিজেই সেই ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
রাতের বেলা ফিরে এসে সে আবার চিঠি পড়তে বসে। এবার যেন শব্দগুলো নতুন গা ছমছমে অনুভূতি নিয়ে আসে। “নীলা, আজ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর চুপ থাকব না। আমি বলতে চাই, আমি তোমাকে ছাড়তে পারি না। তুমি যদি আমাকে না চাও, আমি তবুও থাকব তোমার জীবনের এক কোণে, যতদিন বাঁচব।” এই শব্দগুলো পড়ে মেঘলা বুঝতে পারে, এই প্রেম কোনও সাধারণ প্রেম নয়, এটি সংগ্রামের নাম, এটি আত্মত্যাগের নাম।
মেঘলার নিজের ভেতর একটা পরিবর্তন আসতে থাকে। সে ভাবতে শুরু করে, তার লেখার মাধ্যমে এই প্রেমের কাহিনী যেন একটা সঙ্গীত হয়ে ওঠে, যেন এই শব্দগুলো যাদের শুনতে চায়, তাদের হৃদয়ে পৌঁছায়। সে জানে, এই কাজ সহজ নয়, কিন্তু করতেই হবে। সে হাতের কালি নিয়ে নতুন খাতা খুলে লেখে—“রত্না ও নীলা—তোমাদের প্রেমের গল্প আজ আমার হৃদয়ের কথা। আমি লিখব তোমাদের কথা, যতদিন পর্যন্ত কেউ না পড়ে।”
আগামী দিনের জন্য সে অনেক পরিকল্পনা করে। সে ভাবছে, এই গল্পকে শুধু চিঠির ভেতর সীমাবদ্ধ রাখবে না, বরং প্রকাশ করবে, জানাবে, বোঝাবে সমাজকে, যারা আজও বিভিন্ন কারণে নিজেকে গোপন রাখতে বাধ্য হয়। মেঘলা ভাবছে, একদিন হয়তো নীলা ও রত্নার মতো অনেক প্রেমিকের গল্প সামনে আসবে, তারা বাঁচবে, কথা বলবে।
তার হাতের খাতায় ভেসে ওঠে নতুন কবিতা—“ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, আমি অপরাধী হতে চাই। কারণ ভালোবাসা ছাড়া জীবন নিঃস্ব।”
রাত শেষ হচ্ছে, কাকতালীয়ভাবে বারান্দার জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া মৃদু বাতাস মেঘলার পৃষ্ঠাগুলো ছুঁয়ে যায়। সে জানে, তার যাত্রা শুরু হয়েছে। সে আর একা নয়—রত্না, নীলা আর তাদের মতো বহু ভালোবাসার ছায়া তার সঙ্গে রয়েছে। তারা তাকে বলছে, “লেখো, বলো, বাঁচো।”
পর্ব ৬
রাতের নিস্তব্ধতায় মেঘলা একাকী বসেছিল তার ছোট ঘরের জানলার পাশে। বাইরে শহরের আলোগুলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, আর কেবল কিছু দূরের বাতাসের সুর বাজছিল তার কান্নার মতো। আজ সে নীলা ও রত্নার সেই অচেনা প্রেমের গভীরে ডুব দিয়েছে নতুন করে, চিঠিগুলো আরও গাঢ় করে পড়েছে, যেন তার নিজের হৃদয় থেকে ঝরে আসছে। প্রতিটি শব্দ যেন একেকটা জীবন্ত মানুষ হয়ে উঠছে, যার যন্ত্রণা, আশা, ভালোবাসা মিশে আছে পৃষ্ঠাগুলোতে। সে ভাবল, এই প্রেমের গল্প যেন শুধু দুজন মানুষের নয়, বরং সমাজের, সংস্কারের, এবং মানুষের হৃদয়ের এক লুকানো যুদ্ধে অংশীদার।
মেঘলার মনে পড়ে সেই দিনগুলো, যখন রত্না ও নীলা কলেজের বাগানে বসে একে অপরের হাত ধরে স্বপ্ন দেখত। স্বপ্ন, যেখানে তারা আর গোপনীয়তায় বাঁধা নয়, যেখানে তারা মুখোমুখি হয়ে হাসবে, ভালোবাসার কথা বলবে সমাজের ভয় ছাড়াই। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি কখনো পূরণ হয়েছে? চিঠিগুলোতে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে সে চেষ্টা করে। রত্নার লেখা, “নীলা, তুই আমার জীবনের আলো, কিন্তু আমি জানি আমাদের প্রেমের জন্য পৃথিবী এখনো প্রস্তুত নয়। তবু আমি চাই, একদিন সবাই জানুক, আমরা ছিলাম।”
সেইসব দিনগুলোকে মনে করে মেঘলার চোখে জল এসে ঝরে। সে জানে, এই প্রেমের জন্য তাদের কত যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়েছে, কত সমাজের অবজ্ঞা, কত নিষেধাজ্ঞা। তবু তাদের ভালোবাসা ছিল স্রোতের মতো প্রবল, যেমন বৃষ্টি পড়ে শহরের রাস্তা ভিজিয়ে দেয়, তেমনি তারা একে অপরের হৃদয় ভিজিয়ে দিয়েছে। মেঘলার মনে হয়, এই ভালোবাসা যেন কেবল ভালোবাসা নয়, বরং এক প্রতিবাদ, এক যুদ্ধ।
সে ভাবতে থাকে, আজকের সমাজ কি এই প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? নীলা আর রত্নার মতো বহু মানুষের প্রেম আজও গোপনে লুকিয়ে থাকে, অনেক সময় ভয়ে, অনেক সময় লজ্জায়। মেঘলা তার লেখার মাধ্যমে এই গোপন প্রেমের কথা সবাইকে জানাতে চায়। সে চায়, এই গল্প যেন ভবিষ্যতের একটি বার্তা হয়ে ওঠে, যেখানে সবাই ভালোবাসতে পারে স্বাধীনভাবে, লুকোনো নয়।
রাত বাড়তে থাকে, মেঘলা তার ল্যাপটপ খুলে নতুন নতুন পৃষ্ঠায় লিখতে শুরু করে। সে লিখছে তাদের প্রেমের গল্প, তাদের সংগ্রামের গল্প, তাদের স্বপ্নের কথা। শব্দগুলো কীবোর্ডে ছুটে যাচ্ছে যেন নদীর স্রোত। মাঝে মাঝে সে থেমে যায়, চোখের জল মুছতে মুছতে, আবার লিখতে থাকে। এই কাজটা তার জন্য যেন এক ধরনের মুক্তি, এক ধরনের প্রার্থনা।
সে লেখে, “নীলা আর রত্নার ভালোবাসা শুধুই একটি গল্প নয়, এটি একটি আন্দোলন। এটি জানিয়ে দেয়, ভালোবাসা যেকোনো রঙের হতে পারে, যেকোনো পরিচয়ের হতে পারে, কিন্তু তা সবার জন্য সম্মান ও অধিকার পাবে। এই প্রেমকে সমাজ কখনো নির্যাতন করতে পারে না, কখনো বন্ধ করতে পারে না।”
মেঘলা জানে, তার এই লেখা শুধু একটি বইয়ের গল্প নয়, এটি হবে অনেকের জন্য আশা ও সাহসের উৎস। সে ভাবছে, এই গল্প পড়ে যারা নিজেদের মতো হতে পারে না, তারা যেন খুঁজে পায় তাদের নিজের পরিচয়, তাদের নিজের ভালোবাসার স্বীকৃতি। সে জানে, এই যাত্রা সহজ নয়, অনেক বাধা আসবে, অনেক বিতর্ক হবে। কিন্তু সে সাহস পায় এই প্রেমের শক্তি থেকে, যা এত বছর ধরে লুকোনো থেকেও ঝলমল করছে।
আগামী সপ্তাহে সে পরিকল্পনা করে একটি ছোট প্রদর্শনী করার, যেখানে এই প্রেমের গল্প, চিঠি, কবিতা আর ছবি সবাইকে দেখানো হবে। সে চায়, এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে মানুষ বুঝুক, ভালোবাসার কোনো সীমা নেই, কোনো শর্ত নেই। সে ভাবছে, হয়তো তার লেখা বইটি একদিন অনেকের জীবন বদলে দেবে।
মেঘলা আবার জানলার পাশে বসে চিঠিগুলো পড়তে থাকে। এইবার চোখ আটকে যায় রত্নার একটি শব্দে—“আমরা হয়তো একসঙ্গে থাকতে পারিনি, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা কখনো মরে না। সেটাই আমার একমাত্র আশ্রয়।” এই শব্দগুলো পড়ে মেঘলার হৃদয় যেন ধুকধুক করতে থাকে, সে বুঝতে পারে, এই প্রেমের শক্তি সত্যিই অবিনশ্বর।
সে নিজেকে কথা দেয়, এই গল্প শেষ করার পরও এই প্রেমের কথা সে জানাবে, যতদিন বাঁচবে, যতদিন কেউ শুনবে। সে জানে, এই গল্প একদিন বড় হবে, একদিন সমাজ বদলাবে, একদিন ভালোবাসার নাম আর অপরাধ হবে না।
রাত গভীর হচ্ছে, মেঘলা জানে, সে আর ফিরে যেতে পারবে না তার পুরনো জীবনযাত্রায়। এই প্রেমের গল্প তার জীবনের নতুন অধ্যায়, নতুন যাত্রা। সে মৃদু হাসে, জানে তার লেখার প্রতিটি শব্দ হবে সেই আগুনের মতো, যা অন্ধকার কাটিয়ে আলো জ্বালাবে।
পর্ব ৭
সকাল ধীরে ধীরে উঠে আসছিল কলকাতার সরু গলিগুলোতে। মেঘলা তার ছোট্ট ঘরের জানালা থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখছিল, দূরে সোনার বাংলার মিশ্র আলো আর মেঘলা শহরের ঘামের গন্ধ মিশিয়ে নিয়ে আসছে এক নতুন দিনের বাণী। তার মনে একটা অদ্ভুত তড়িত বেজে উঠছিল। গত কয়েক মাস ধরে রত্না আর নীলার চিঠি নিয়ে কাজ করার পর, সে বুঝতে পারছিল তার জীবনের মানে বদলাতে শুরু করেছে। শুধু নিজের জন্য নয়, এই গল্প যে অনেকের জীবনে আলোর পথ দেখাবে — সেটাই তার সবচেয়ে বড় প্রেরণা।
সকাল চা নিয়ে বসে সে ভাবতে লাগল, কীভাবে এই প্রেমের গল্প শুধু দুজন নারীর প্রেমের চিঠির বাইরে গিয়ে বৃহত্তর এক সামাজিক আন্দোলনের রূপ নেবে। সে জানত সমাজের চোখ আজও অনেক দূর, অনেক অন্ধকারে ডুবে আছে এই বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু এই অন্ধকার কাটিয়ে আলো জ্বালাতে হলে সাহসী হতে হবে। তাই সে ঠিক করল, তার লেখা শুধু একটি বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং সে চাইবে সিনেমা, নাটক, আর অন্যান্য মাধ্যমেও এই গল্প ছড়িয়ে পড়ুক।
মেঘলা তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলল, যিনি একজন তরুণ নির্মাতা। সে তাকে পুরো গল্পটা শুনিয়ে দিল। বন্ধুটি বলল, “এই গল্প তো বড় একটা প্রকল্পের মত, আমরা যদি এটাকে সিনেমার আকার দিতে পারি, তাহলে সমাজের অনেক মানুষের মনে সচেতনতা আসবে।” মেঘলার মুখে অদ্ভুত এক আশার আলো ফুটল। হয়তো রত্না আর নীলার ভালোবাসা শুধু লেখা থাকবে না, সঙ্গীত, ছবি, চিত্রনাট্যের মাধ্যমে সারা দেশের কাছে পৌঁছাবে।
তারপর সে শহরের সেই পুরনো কলেজে গিয়েছিল, যেখানে রত্না ও নীলা একসঙ্গে পড়াশোনা করত। কলেজের লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে কথা বলে সে জানতে পারল, অনেক পুরনো ছবি, নোট, এমনকি কিছু চিঠিও সংরক্ষিত আছে, যেগুলো হয়তো তাদের প্রেমের প্রমাণ। মেঘলা ওইসব জিনিস সংগ্রহ করে নতুন লেখার জন্য ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিল। তার মনে হচ্ছিল, এই ছোট ছোট স্মৃতিগুলো একদিন বড় এক ইতিহাসের অংশ হবে।
কাজ করতে করতে অনেক সময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু ভালোবাসার গল্প তাকে শক্তি দেয়। সে লিখতে বসে, “আমাদের সমাজ যদি এই ভালোবাসাকে মেনে নিতে না পারে, তবে আমাদেরই বদলাতে হবে সমাজকে। আমরা যেন এমন এক পৃথিবী গড়ি, যেখানে ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা হয়, কোনো শর্ত ছাড়াই।” এই কথাগুলো যখন সে লিখে, মনে হয় যেন তার হৃদয় থেকে সঙ্গীতের মত শব্দ ঝরে পড়ে।
মেঘলা জানত, এই যাত্রা কঠিন, অনেক বাধা আসবে। সে অনেক সময় চিন্তা করত, এই প্রেমের গল্প প্রকাশ করলে তার নিজের জীবন কি নিরাপদ থাকবে? কিন্তু তার সাহস ছিল বেশি। সে জানত, আজকের সময় অন্যরকম, আজ সমাজের অনেক মানুষ এই প্রেমকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। সেই মানুষগুলোর জন্য, এই গল্প হবে একটি সেতু, একটি শক্তির উৎস।
তার জীবনে নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠতে শুরু করে। এক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, যিনি এই প্রেমের বিষয় নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন করতে চান। মেঘলা তার সকল তথ্য, চিঠি, এবং অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। সাংবাদিকের কাছ থেকে সে শুনল, “এই গল্প যদি ভালোভাবে প্রকাশ পায়, তবে আমাদের সমাজ অনেকটাই বদলে যাবে।” মেঘলা মনে মনে ভাবল, এই কথাগুলো তার জীবনযাত্রাকে আরও অর্থবহ করে তুলেছে।
দিন কাটছিল, মেঘলার লেখার কাজ চলছিল অবিরত। সে মাঝে মাঝে বাইরে বের হয়ে শহরের রাস্তায় হাঁটত, মানুষদের মুখ দেখে ভাবত, কে জানে তাদের কত জন এমন ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছে। সে অনুভব করত, তার গল্প অনেকেরই জীবন থেকে নেওয়া, অনেকেরই কথা বলা। সে তাদের জন্য লড়াই করছিল, তাদের জন্য কথা বলছিল।
এক সন্ধ্যায় মেঘলা তার ঘরে বসে হঠাৎ এক অদ্ভুত চিন্তায় ডুবে গেল। সে ভাবল, কত মানুষ এই প্রেমের কারণে হারিয়েছে নিজেকে, কত মানুষ আজও ভয়ে ভয়ে থাকে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে। সে সিদ্ধান্ত নিল, এই গল্প শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সমাজের সমস্ত বঞ্চিত ভালোবাসার কাহিনী তুলে ধরবে। সে লিখল, “আমাদের ভালোবাসা যেন হয় সাহসের প্রতীক, যেন হয় মুক্তির গান।”
মেঘলা আর একবার চিঠিগুলো খুলে পড়ল। চোখ ভিজে গেল রত্নার শেষ চিঠি থেকে, যেখানে লেখা ছিল, “আমরা হয়তো কখনো একসঙ্গে থাকতে পারিনি, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা কখনো মরে না।” এই কথা তার হৃদয় ছুঁয়ে গেল গভীরভাবে। সে বুঝল, ভালোবাসা কখনো হারায় না, শুধু রূপ বদলায়, নতুন আকার নেয়।
রাত বাড়তে থাকল। মেঘলা তার ল্যাপটপে লেখা শেষ করে একটি ফোল্ডারে সংরক্ষণ করল, নাম দিল “রত্না ও নীলা: ভালোবাসার নাম”। সে জানত, এই নামটি তার জন্য একটি প্রতিজ্ঞা, একটি দায়িত্ব। প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য তার জীবনের নতুন অংশ হয়ে উঠেছে।
সেদিন রাতে সে ঘুমানোর আগে ভাবল, “যে ভালোবাসা এত বছর লুকানো ছিল, আজ তার কথা সবাই জানবে। যারা ভয় পায়, যারা লজ্জিত, তারা যেন আমার লেখায় সাহস পায়।” সে জানল, এই যাত্রা দীর্ঘ এবং কঠিন, কিন্তু তার হৃদয় ভরে উঠছে অটুট আশা আর ভালোবাসার শক্তিতে।
পর্ব ৮
নতুন সকাল। কলকাতার গলিগুলোতে সূর্যের প্রথম কিরণ নরমভাবে নামছিল। মেঘলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবছিল, কত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে সে এই ভালোবাসার গল্পের জন্য। এখন তার হাতে শুধু রত্না আর নীলার চিঠি নয়, সেই ভালোবাসার ইতিহাস, সেই সংগ্রামের গল্প, আর নতুন দিনের জন্য এক অনবদ্য আশা। জীবনের অনেক দুঃখ, যন্ত্রণার মাঝেও এই ভালোবাসা যে অটুট থেকে গেছে, তা যেন এক জীবন্ত প্রমাণ। সে জানত, এই যাত্রা শেষ নয়, বরং নতুন এক অধ্যায়ের শুরু।
গত কয়েক মাসে তার লেখা বইয়ের খসড়া বেশ উন্নত হয়েছে। সে ভাবছে, বইটি প্রকাশের পর সমাজের মানুষের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে। অনেকেই হয়তো এই প্রেমের গল্পে ভাববে, হয়তো কেউ বিতর্কও করবে, কিন্তু মেঘলার কাছে এটা বড় কথা নয়। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল যে, এই গল্প যেন মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে, তাদের চিন্তা বদলে দেয়। সে জানে, ভালোবাসা মানুষের জীবনের সবচেয়ে গভীর অনুভূতি, আর সেটার সম্মান পেতে হবে।
মেঘলা তার বন্ধু নির্মাতার সঙ্গে মিটিং করছিল। তারা ভাবছিল, বইয়ের পাশাপাশি একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণ করা যায়, যেখানে রত্না ও নীলার সত্য ঘটনা এবং সেই সময়কার সমাজের প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হবে। নির্মাতা বলল, “এই ডকুমেন্টারি দেখিয়ে আমরা তরুণ প্রজন্মকে জানাতে পারি, ভালোবাসার কোনো সীমা নেই। ভালোবাসা সবসময়ই স্বাধীন।” মেঘলা সারা শরীরে এক উত্তেজনা অনুভব করল, তার লেখার কাজ আরেক মাত্রা পেতে চলেছে।
একদিন মেঘলা একটি ছোটো অনুষ্ঠানে গিয়েছিল যেখানে সমকামী ও কুইর সম্প্রদায়ের মানুষরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছিল। সে শুনল অনেকের কাহিনী, যাদের জীবনে প্রেম ছিল লুকোনো, যাদের ভালোবাসা আজও সমাজের ভয় পেয়ে ভাসছে। সে ভাবল, তার লেখা গল্পগুলো যেন তাদের জন্য সাহসের বার্তা হয়ে ওঠে। সে নিজের লেখার উদ্দেশ্য আরও স্পষ্ট করল — শুধু রত্না আর নীলার প্রেম নয়, এই গল্প যেন বহু মানুষের জীবনের গল্প।
সন্ধ্যার দিকে সে যখন তার ঘরে ফিরে এল, তখন একটি চিঠি পেল। চিঠিটা ছিল এক তরুণীর কাছ থেকে, যিনি তার লেখা পড়ে প্রথমবার নিজের পরিচয় প্রকাশ করার সাহস পেয়েছেন। চিঠিটা পড়তে পড়তে মেঘলার চোখ ভিজে গেল। তরুণী লিখেছিল, “আপনার লেখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আজ প্রথমবার সবাইকে জানিয়েছি আমি কুইর। এটা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিল। আপনার গল্প আমাকে সাহস দিয়েছে।” মেঘলা বুঝল, তার লেখা শুধু শব্দ নয়, তা জীবনের বাস্তব পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
তখন মেঘলা ভাবল, এই গল্প নিয়ে আরও কাজ করতে হবে। সমাজের মানুষের মানসিকতা বদলাতে লেখার পাশাপাশি আরো অনেক উদ্যোগ নিতে হবে। সে সিদ্ধান্ত নিল, তার প্রকাশনা সংস্থার আওতায় একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করবে, যেখানে কুইর ও এলজিবিটি+ সম্প্রদায়ের মানুষের গল্প, চিত্রকলার মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। এই প্ল্যাটফর্ম হবে নিরাপদ, মুক্ত ও সৃজনশীল।
কয়েক মাস পর মেঘলার বইটি প্রকাশিত হলো। বইয়ের নাম রাখা হলো “অন্তরের ডাক: রত্না ও নীলার প্রেমকাহিনী”। বইটি বাজারে আসার পর থেকেই আলোচিত হয়। অনেকেই প্রশংসা করে, অনেকে বিতর্কে জড়ায়, কিন্তু মেঘলা জানত, এই সবই পরিবর্তনের স্বাভাবিক অংশ। সে তার আত্মবিশ্বাস হারায়নি। বইটি অনেক স্কুল, কলেজে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়, যেখানে নতুন প্রজন্ম এই গল্প থেকে শেখে প্রেম ও স্বাধীনতার মূল্য।
একবার এক শিক্ষক তাকে বলেছিলেন, “আপনার লেখাগুলো পড়ে অনেক ছাত্র-ছাত্রী তাদের নিজস্ব পরিচয় সম্পর্কে খোলামেলা কথা বলতে পারছে।” মেঘলা জানত, তার লেখার আসল সাফল্য এখানেই। মানুষের মনে পরিবর্তন আনা, তাদের চিন্তা প্রসারিত করা — এই কাজের জন্যই সে এত চেষ্টা করেছে।
তার জীবনেও এক ধরনের শান্তি আসে। অনেক বছর লুকোনো প্রেমের গল্প প্রকাশ পেয়ে, অনেকের জন্য আশার আলো হয়ে ওঠায় সে গর্বিত। সে অনুভব করল, এই গল্প যেন তার নিজের জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, আর এই যাত্রা চলবে বহু বছর।
মেঘলা জানল, ভালোবাসা যে শক্তি, তা সব বাধা পার করতে পারে। সে নিজের জীবনে সেটাই দেখতে পেয়েছে। আর তাই সে ভাবল, সমাজে যতই প্রতিবন্ধকতা থাকুক, মানুষ ভালোবাসার জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে। কারণ ভালোবাসা মানে স্বাধীনতা, আর স্বাধীনতা মানে জীবনের পূর্ণতা।
সেদিন রাত মেঘলা তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ভাবল, এই শহর, এই দেশ, এই পৃথিবী একদিন এমন হবে যেখানে সবাই ভালোবাসবে মুক্তভাবে। আর তার লেখা সেই পরিবর্তনের একটি ছোটো অংশ হবে। সে জানল, রত্না ও নীলার ভালোবাসা সেই আলো হয়ে থাকবে, অন্ধকার কেটে যাবে তাদের গল্পের আলোয়।
সে তার ল্যাপটপ খুলে নতুন কাগজে লিখতে শুরু করল, “আমাদের ভালোবাসা কখনো নিভে যাবে না, আমরা সবাই একদিন ভালোবাসার জন্য মুক্ত হবো।” তার হাতের শব্দ গড়াতে লাগল নতুন এক দিনের গান।
				
	

	


