অনুরিমা মিত্র
১
কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরে লুকিয়ে থাকা পুরোনো লাইব্রেরিটি যেন সময়ের কোনো থেমে থাকা ঘড়ি। চারপাশে নীরবতা, মাঝে মাঝে কেবল পাতার ওলটানোর শব্দ কিংবা দূর থেকে ভেসে আসা কারো কাশির আওয়াজ শোনা যায়। এই নিস্তব্ধতার মাঝেই অনির্বাণ যেন খুঁজে পায় নিজের আশ্রয়। তার সহপাঠীরা যখন ক্যান্টিনে আড্ডা দিচ্ছে কিংবা মাঠে খেলায় ব্যস্ত, তখন সে লাইব্রেরির কাঠের লম্বা টেবিলে বসে পড়ে ইতিহাসের বই, পুরোনো পত্রিকা আর আর্কাইভ ঘাঁটাঘাঁটি করে। অনির্বাণকে দেখলে অনেকেই বলে—সে যেন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে জানে না, তার জগত অন্য কোথাও। কিন্তু সে জানে, এই নিস্তব্ধতা তাকে শান্তি দেয়, শব্দের বাইরে এক গোপন কথোপকথন তাকে টানে। সেই দিনও ছিল তেমনই এক দুপুর—ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সে এসে বসেছিল লাইব্রেরির কোণে, যেখানে আলোটা একটু ম্লান, কিন্তু বুকশেলফে ঠাসা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপি। বাতাসে পুরোনো কাগজের গন্ধ, কাঠের টেবিলের ওপর সূক্ষ্ম ধুলো জমে আছে—সবকিছু যেন মিলে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করে, যেটা অনির্বাণের কাছে ছিল অমূল্য সম্পদ।
সে যেভাবে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল, হঠাৎ এক পুরোনো, মোটা বাঁধানো বই থেকে কাগজের ভাঁজ মেলে ধরা পড়ল। প্রথমে সে ভেবেছিল বইয়েরই অংশ, কিন্তু ছুঁয়ে বুঝল, ওটা আলাদা। হলুদ হয়ে যাওয়া কাগজের টেক্সচারে সময়ের দাগ লেগে আছে, যেন বছরের পর বছর আলোবাতাস না পেয়ে বন্দি ছিল। কাগজটা হাতে নিয়ে অনির্বাণের মনে হল সে যেন হঠাৎ অন্য এক জগতে পা দিল। কালি ফিকে হয়ে গেলেও শব্দগুলো এখনো স্পষ্ট—কারো হাতের লেখা, কিছুটা কাঁপা কিন্তু অদ্ভুত আবেগভরা। সে বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে, মনে হয় যেন বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কোনো গোপন দরজা খুলে গেছে। পাতা জুড়ে লেখা এক অচেনা ছাত্রের মনের কথা, তার প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত গভীর প্রেম। অনির্বাণের বুক কেঁপে ওঠে—সে আগে কখনো এভাবে কারো ব্যক্তিগত আবেগকে স্পর্শ করেনি। তার চশমার কাঁচে আলো পড়ে চিঠির অক্ষরগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে একবার চারপাশে তাকায়, যেন কেউ তাকে এই নিষিদ্ধ আবিষ্কারের সময় ধরে ফেলবে, কিন্তু লাইব্রেরি তখনও একই রকম নিস্তব্ধ—কেবল তার ভেতরের হৃদস্পন্দন বাড়ছে।
এই হঠাৎ পাওয়া চিঠি অনির্বাণের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন সৃষ্টি করে। সে জানে না কে লিখেছিল, কে পড়েছিল, কিংবা চিঠির ঠিকানা কোথায় ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারে—এটা শুধু একটা কাগজ নয়, এটা এক সময়ের সাক্ষী, এক হৃদয়ের ছাপ। একা বসে পড়তে পড়তে তার মনে হয় যেন অতীত আর বর্তমানের মধ্যে এক সেতু তৈরি হচ্ছে। যে নিস্তব্ধতা তাকে এতদিন ধরে আশ্রয় দিয়েছিল, সেই নিস্তব্ধতার ভেতরেই এবার আরেকটি হৃদয়ের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অনির্বাণ ভাবতে থাকে—চিঠির লেখক কি কখনো তার ভালোবাসার উত্তর পেয়েছিল? নাকি এই কাগজই হলো তার একমাত্র স্বীকৃতি? প্রশ্নগুলো তার মাথায় ঘুরপাক খায়, আর একই সঙ্গে এক অদ্ভুত উষ্ণতা তাকে আচ্ছন্ন করে। সে আগে কখনো প্রেম নিয়ে গভীরভাবে ভাবেনি, নিজের নিঃসঙ্গতাকে স্বাভাবিক ভেবেছিল। কিন্তু এই কাগজ তার ভেতরের কোনো সুপ্ত অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলল। হয়তো এটাই গল্পের সূচনা—এক পুরোনো চিঠি, এক নিস্তব্ধ লাইব্রেরি, আর এক তরুণের হৃদয়ে জন্ম নেয়া অদৃশ্য আলো।
২
চিঠিটিকে হাতে নিয়ে অনির্বাণ যেন ভিন্ন এক সময়ে প্রবেশ করল। কাগজের হলদে রঙ, কালি ঝাপসা হয়ে যাওয়া অক্ষরগুলো, আর কিছুটা কাঁপা হাতের লেখায় এক অদ্ভুত আবেগ লুকিয়ে ছিল। চিঠির শুরুতেই লেখা—“১৯৮০ সালের বসন্তের দিনে তোমাকে না লিখে আর থাকতে পারলাম না।” অনির্বাণ থমকে গেল, মনে হল যেন বইয়ের পাতা নয়, সরাসরি কোনো মানুষের হৃদয় তার সামনে খুলে গেছে। লেখকের নাম অরূপ, এক ছাত্র, যার প্রতিটি শব্দে ধরা পড়ে ব্যাকুলতা। সে লিখেছিল, কিভাবে ক্লাস শেষে প্রেয়সীকে দেখার জন্য লাইব্রেরির করিডোরে অপেক্ষা করত, কিভাবে তার হাসি দিনের সব ক্লান্তি মুছে দিত, আর কিভাবে সমাজ আর পরিবার তাকে বারবার সতর্ক করলেও সে নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারেনি। অনির্বাণ একে একে লাইনগুলো পড়তে থাকে, আর প্রতিটি শব্দ যেন তার ভেতরে অচেনা কোনো দরজা খুলে দেয়। তার বুক ধড়ফড় করতে থাকে, হাতের তালু ঘেমে ওঠে—যেন সে নিজেই সেই চিঠি লিখছে, কিংবা সেই চিঠির পাঠক হয়ে উঠছে।
অরূপের ভাষা ছিল সহজ, কিন্তু আবেগে পূর্ণ। “তোমাকে না জানালে আমার নিঃশ্বাস যেন অর্ধেক থেমে যায়”—এই লাইনটা পড়ে অনির্বাণের চোখ কেঁপে উঠল। সে আগে কখনো এমনভাবে অনুভূতি প্রকাশ দেখেনি, বিশেষ করে পুরুষদের লেখা চিঠিতে। অরূপ লিখেছিল তার ভয়, তার স্বপ্ন, আর তার অদম্য টান—কিভাবে সমাজের চোখ এড়িয়ে তারা হয়তো একদিন হাঁটবে নদীর ধারে, কিংবা কলেজের গোপন কর্নারে হাত ধরে বসবে। অনির্বাণ এক মুহূর্তের জন্য বইয়ের তাক, ধুলো জমা টেবিল, আর বাইরের কোলাহল সব ভুলে গেল; তার চারপাশে শুধু সেই অচেনা হাতের লেখা আর তার ভেতরকার ঝড়। তার মনে হল, এই শব্দগুলো একদিন হয়তো জোরে বলা হয়নি, মুখে উচ্চারণ পায়নি, কিন্তু কাগজে বেঁচে আছে—যেন সময়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক নীরব প্রেমের ঘোষণা। অনির্বাণের চোখের সামনে হঠাৎ একটা চিত্র ফুটে উঠল—এক তরুণ ছাত্র, ধবধবে কাগজে কালি দিয়ে নিজের প্রাণের কথা লিখছে, আর হয়তো বাইরে বসে আছে তার প্রেয়সী, যে জানেই না তার জন্য কেমন তুফান বয়ে যাচ্ছে।
চিঠি পড়তে পড়তে অনির্বাণ বুঝতে পারল, এ কেবল অতীতের কোনো কাহিনি নয়; বরং এটা এক উত্তরাধিকার, যা এখন তার হৃদয়ে এসে পৌঁছেছে। সে অনুভব করল, অরূপের আবেগে শুধু প্রেম নেই, আছে সাহস—নিজেকে নিঃসঙ্কোচে উন্মোচন করার সাহস, যা অনির্বাণের নিজের মধ্যে ছিল না। এতদিন ধরে সে নীরব থেকে গিয়েছে, নিজের একাকীত্বকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছে, কিন্তু এই চিঠি তাকে প্রশ্ন করতে বাধ্য করল—তার জীবনে কি এমন কেউ আছে, যার জন্য সে হৃদয়ের কথা বলতে পারবে? চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন তাকে উস্কে দিচ্ছিল, শেখাচ্ছিল—প্রেম কেবল কোনো কল্পনা নয়, বরং এমন এক বাস্তবতা, যা মানুষকে জীবন্ত করে তোলে। অনির্বাণের বুকের ভেতরে তখন এক অদ্ভুত টান জন্ম নিল, যেন চিঠির কালি তার হৃদয়ে নতুন রঙ ছড়িয়ে দিল। সে হঠাৎই অনুভব করল, অরূপ নামের সেই অচেনা ছাত্র আসলে কেবল অতীতের মানুষ নয়, বরং তার নিজের নিঃশব্দ আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি। নিস্তব্ধ লাইব্রেরির ভেতরে বসে সে প্রথমবার উপলব্ধি করল—কাগজের এই কালি শুধু ইতিহাস নয়, বরং আজকের দিনেও প্রেমের নতুন সূচনা ঘটাতে পারে।
৩
সেদিন বিকেলের আলো লাইব্রেরির বড় জানালা দিয়ে এসে কাঠের মেঝেতে এক অদ্ভুত সোনালি ছায়া ফেলেছিল। অনির্বাণ তখনও সেই পুরোনো চিঠির জগতে ডুবে আছে। তার চোখে এক ধরণের অচেনা উজ্জ্বলতা, যেন কাগজের কালি তার আত্মাকে আলোড়িত করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে নিস্তব্ধতার ভেতর পায়ের শব্দ ভেসে এল—হালকা টপটপ আওয়াজ, যেন মেঝের ধুলো ভেঙে নতুন হাওয়া ঢুকছে। অনির্বাণ তাকাল না, কিন্তু টের পেল কেউ একজন প্রবেশ করেছে। লাইব্রেরির ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে এল ঐশী। সে নিয়মিত পাঠক হলেও অনির্বাণের সঙ্গে তার দেখা–সাক্ষাৎ তেমন হয়নি। কিন্তু ঐশীর পদচারণায় এক ধরনের স্বাভাবিক আত্মবিশ্বাস মিশে থাকে, চোখে থাকে অনুসন্ধিৎসার ঝিলিক। সে সরাসরি বুকশেলফের দিকে এগোতে গিয়েও থেমে গেল—কারণ দূরে বসে থাকা অনির্বাণের হাতে একটি হলদে চিঠি ধরা। সাধারণত বইপত্রের ভিড়ে এমন কিছু দেখা যায় না। কৌতূহল তাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। অনির্বাণ প্রথমে অস্বস্তি বোধ করল—এই চিঠি যেন কেবল তার আর সেই অতীতের গোপন প্রেমিকের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে ভেবেছিল। কিন্তু ঐশীর দৃষ্টিতে কেবল কৌতূহল নয়, অদ্ভুত কোমলতা ছিল।
ঐশী ধীরে ধীরে কাছে এসে বলল, “এটা কী? বইয়ের ভাঁজে চিঠি?” তার কণ্ঠে বিস্ময় আর মৃদু হাসি, যেন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। অনির্বাণ একটু ইতস্তত করে কাগজটা এগিয়ে দিল, যেন নিজের গোপন আবিষ্কার কারও সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া নিয়ে তার ভেতরে দ্বিধা। কিন্তু ঐশী হাতে নিয়ে একবার পড়তেই তার চোখে অন্যরকম ঝিলিক ফুটে উঠল। চিঠির কালি, ম্লান অক্ষর, আর অরূপের সেই আবেগপূর্ণ স্বীকারোক্তি—সবকিছু তাকে এক মুহূর্তে নিঃশব্দ করে দিল। দু’জন পাশাপাশি বসে রইল, চিঠি একসঙ্গে পড়তে পড়তে যেন সময়ের ভেতরে হারিয়ে গেল। তাদের দৃষ্টি মাঝেমধ্যে একে অপরের মুখে পড়ে যাচ্ছিল। অনির্বাণ লক্ষ্য করল, ঐশীর ঠোঁট হালকা কেঁপে উঠছে, চোখে এক অচেনা আবেশ। ঐশীও টের পেল অনির্বাণের নিঃশ্বাস একটু দ্রুত চলছে। লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা তখন আর নিছক নীরব ছিল না—তার ভেতরে জন্ম নিচ্ছিল এক অদ্ভুত টান, যা দু’জনের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছিল।
চিঠির লাইনগুলো পড়তে পড়তে ঐশী ফিসফিস করে বলল, “অবিশ্বাস্য… কতটা সাহস লাগে এরকম লিখতে।” অনির্বাণ চমকে উঠল, কারণ তার নিজের মনের কথা যেন ঐশীর কণ্ঠে বেরিয়ে এল। দু’জনের মধ্যে এক অনুচ্চারিত সংলাপ শুরু হল—চোখের দৃষ্টি, আঙুলের হালকা স্পর্শ, আর একসঙ্গে কাগজের ভাঁজ খুলে রাখার মুহূর্তে জন্ম নেওয়া নিঃশব্দ স্বীকৃতি। ঐশীর মনে হল, এই পুরোনো কাগজ যেন কেবল অতীতের প্রেমের গল্প নয়, বরং তার নিজের হৃদয়েও কোনো এক চাপা আবেগকে জাগিয়ে তুলছে। আর অনির্বাণ অনুভব করল, এতদিন একা একা যে নিস্তব্ধতায় আশ্রয় নিয়েছিল, আজ সেখানে একজন সঙ্গী এসে দাঁড়িয়েছে—যে নিঃশব্দকে বুঝতে পারে, যে কাগজের কালি থেকে আবেগ পড়ে নিতে জানে। তারা কিছু বলেনি, শুধু একসঙ্গে বসে রইল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই প্রথম অদ্ভুত টান জন্ম নিল—যেন পুরোনো চিঠির অক্ষর তাদের আত্মাকে অদৃশ্য সুতোর মতো জড়িয়ে ফেলেছে।
৪
চিঠির প্রতিটি শব্দ তাদের চোখের সামনে যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠল। ঐশীর আঙুলের ডগা যখন কাগজের উপর বুলিয়ে গেল, মনে হল অরূপের নিঃশ্বাস আজও সেই কাগজে রয়ে গেছে। সে ধীরে ধীরে পড়ছিল—“আমি জানি সমাজ আমাদের বাঁধবে, হয়তো তোমার পরিবার আমাকে মেনে নেবে না, কিন্তু আমার হৃদয় যদি একবার বলে তুমি আমার, তবে আমি আর পিছু হটব না।” এই লাইন পড়তে পড়তে ঐশীর চোখ ভিজে এল। তার মনে হল, ভালোবাসা আসলে সময়ের সীমায় আটকে থাকে না; মানুষের ভেতরের গভীর অনুভূতিগুলো যুগ পেরিয়ে অন্য কারো মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নেয়। ঐশী ভাবল, ১৯৮০ সালের অরূপের এই কাগজটা যদি আজও এতটা আবেগ জাগাতে পারে, তবে ভালোবাসা আসলে চিরকালীন, যার কোনো ভৌগোলিক বা সময়ের বেড়াজাল নেই। অনির্বাণ তখন নীরবে তাকিয়ে ছিল ঐশীর মুখের দিকে, তার চোখের কোণে জমে ওঠা সেই কণামাত্র অশ্রু যেন তাকে অদৃশ্য এক সত্যের সামনে দাঁড় করাল। এতদিন যে ছেলেটি বইয়ের পাতা আর ইতিহাসের ধুলোয় ডুবে থেকেছে, সে প্রথমবার অনুভব করল, তার ভেতরে আসলে কতটা অপূর্ণতা ছিল, কতটা চাপা আবেগ দমিয়ে রেখেছিল।
অনির্বাণ চিঠির দিকে ঝুঁকে পড়ল, তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল এক লাইনে—“যদি তুমি উত্তর না দাও, তবে এই চিঠিই হবে আমার একমাত্র স্বীকৃতি।” এই লাইনটা তার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধল। সে হঠাৎ উপলব্ধি করল, তার নিজের জীবনেও কত কথা অউচ্চারিত থেকে গেছে। ঐশীকে নিয়ে সে কখনো স্বপ্ন দেখেনি, কখনো কিছু ভাবেনি, তবুও তার ভেতরে জন্ম নেওয়া টান আজ যেন চিঠির অক্ষরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঐশী হঠাৎ মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, চোখে বিস্ময় আর অদ্ভুত কোমলতা—যেন সে বুঝতে পারছে অনির্বাণের ভেতরে কিছু ভাঙছে, কিছু তৈরি হচ্ছে। তাদের দৃষ্টি মিলতেই এক অদ্ভুত নীরবতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। লাইব্রেরির বাইরে হয়তো ছাত্রছাত্রীদের কোলাহল চলছিল, কিন্তু ভেতরে যেন সময় থমকে গেল। তারা দু’জন কাগজের পাতার ওপরে ঝুঁকে ছিল, অথচ প্রকৃতপক্ষে তাদের মন কথা বলছিল একে অপরের সঙ্গে—কোনো শব্দ ছাড়াই।
ঐশী ধীরে ধীরে বলল, “তুমি কি টের পাচ্ছো, এই চিঠিটা শুধু ওদের নয়, আমাদেরও কিছু বলতে চাইছে?” অনির্বাণ গলায় কথা আটকে গেলেও মাথা নাড়ল। তার মনে হল, এতদিন যেটা সে বইয়ের নিস্তব্ধতায় খুঁজেছে, সেটাই হয়তো সামনে বসে আছে। ভালোবাসা নিয়ে সে কোনোদিন সাহস করে ভাবেনি, কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে—প্রেম আসলে এমনই, যেখানে পুরোনো অক্ষর থেকে নতুন রঙ ফুটে ওঠে। অরূপের অসমাপ্ত অনুভূতি যেন তাদের ভেতরে পূর্ণতা পেতে চাইছে। ঐশীর চোখের দৃষ্টি, অনির্বাণের নীরবতা, আর মাঝখানে রাখা সেই কাগজ—সবকিছু মিলিয়ে যেন নতুন এক গল্প জন্ম নিল। অনির্বাণ বুকের ভেতরে হঠাৎই অচেনা শক্তি অনুভব করল; সে বুঝল, যদি নিজের অনুভূতি না বলে যায়, তবে সেও একদিন অরূপের মতো কেবল কাগজের পাতায় সীমাবদ্ধ হয়ে যাবে। আর ঐশী, যার হৃদয়ে প্রেমের কালি সময়কে অতিক্রম করে পৌঁছে গেছে, বুঝতে পারল—প্রেম কখনো হারায় না, শুধু নতুন রূপে জন্ম নেয়। কাগজের অক্ষরে ধরা সেই আবেগ এভাবেই তাদের জীবনের ভেতরে ঢুকে পড়ল, নিঃশব্দে তাদের হৃদয় রাঙিয়ে দিল।
৫
চিঠির শেষ লাইন পড়ে দু’জনেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। অরূপের সেই আবেগমাখা স্বীকারোক্তি যেন বাতাসে ভেসে ছিল, লাইব্রেরির পুরোনো কাঠের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ঐশী প্রথম নীরবতা ভাঙল। তার চোখে এক অদ্ভুত কৌতূহল—“কে ছিল এই অরূপ? কাকে লিখেছিল চিঠিটা? তাদের কি শেষ পর্যন্ত দেখা হয়েছিল?” অনির্বাণ কাঁধ ঝাঁকালেও তার ভেতরেও একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। চিঠি কেবল একটি আবেগের প্রকাশ নয়, বরং এক অসম্পূর্ণ ইতিহাস, যা জানার জন্য তাদের মনে প্রবল আগ্রহ জন্ম নিল। ঐশী বলল, “চলো না, খুঁজে দেখি। কলেজ তো কত পুরোনো, নিশ্চয়ই রেকর্ড আছে।” অনির্বাণ প্রথমে দ্বিধা করল—সে তো বরাবর বইয়ের পাতায় ডুবে থাকে, বাস্তব অনুসন্ধান তার স্বভাব নয়। কিন্তু ঐশীর কণ্ঠের দৃঢ়তা আর চোখের দীপ্তি তাকে রাজি করিয়ে দিল। মনে হল, তারা দু’জন একসঙ্গে যদি খুঁজে বের করতে পারে অরূপের কাহিনি, তবে এই চিঠি আর নিছক একটি কাগজ থাকবে না; এটি হবে অতীত আর বর্তমানের সেতু।
পরদিন তারা আবার লাইব্রেরির পুরোনো সেকশনে বসে রেজিস্টার ঘাঁটতে শুরু করল। ধুলো জমা পৃষ্ঠাগুলো, হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজ আর হাতের লেখা নামের তালিকা—সব যেন সময়ের কাচে জমে থাকা স্মৃতি। অনির্বাণ নাম ধরে ধরে দেখতে লাগল ১৯৮০ সালের ছাত্রছাত্রীদের তালিকা। ঐশী তার পাশে বসে, একবার অনির্বাণের দিকে তাকায়, একবার খাতার দিকে। হঠাৎ তাদের চোখে পড়ল—“অরূপ ভট্টাচার্য, ইতিহাস বিভাগ, স্নাতকোত্তর ১৯৮০।” নামটা যেন চিঠির অক্ষরগুলো থেকে হঠাৎ লাফিয়ে বেরিয়ে এল। অনির্বাণের বুক কেঁপে উঠল—এই তো সেই মানুষ, যার হাতের লেখা তারা পড়েছে, যার নিঃশব্দ ভালোবাসা আজও জীবন্ত। এরপর তারা খুঁজতে লাগল মেয়েটির নাম। কিন্তু চিঠিতে কোথাও নাম নেই, কেবল আবেগ, কেবল সম্বোধন “তুমি”। ঐশী বলল, “মেয়েটার নাম কি আমরা খুঁজে পাব না?” অনির্বাণ নীরবে তাকিয়ে রইল, মনে মনে ভেবেছিল—হয়তো ভালোবাসা সবসময় নামের প্রয়োজন বোধ করে না। কিন্তু অনুসন্ধান থেমে গেল না। তারা পুরোনো ম্যাগাজিন, বার্ষিকী আর দেওয়ালে ঝুলে থাকা পুরোনো ছবিতে চোখ বোলাতে লাগল। প্রতিটি ছবিতে যেন তারা খুঁজে ফিরছিল সেই অচেনা মুখ, যে একসময় অরূপের হৃদয়ে আলো জ্বেলেছিল।
দিন গড়াতে থাকল, অনুসন্ধান চলতে থাকল। প্রতিদিন ক্লাস শেষে তারা লাইব্রেরির কোণে বসত, পুরোনো রেকর্ড খুলে ফেলত, আর একে অপরের সঙ্গে আবিষ্কার ভাগ করত। এই যৌথ অনুসন্ধানেই দু’জনের মধ্যে দূরত্ব কমতে লাগল। ঐশীর কৌতূহল আর অনির্বাণের ধৈর্য মিলে এক নতুন বন্ধন তৈরি করছিল। মাঝে মাঝে তারা হেসে উঠত—“ভাবো তো, কত বছর আগে লেখা একটা চিঠি আজ আমাদের এইভাবে ব্যস্ত করে রাখবে!” কিন্তু সেই হাসির আড়ালেও ছিল এক গভীর আকর্ষণ। তারা জানত না মেয়েটির নাম তারা পাবে কিনা, অরূপের প্রেমের কাহিনি সম্পূর্ণ হবে কিনা, কিন্তু তারা দু’জনেই বুঝতে পারছিল—এই অনুসন্ধান কেবল অরূপকে খুঁজে পাওয়ার জন্য নয়, বরং নিজেদের আবেগকে চিনে নেওয়ার জন্যও। প্রতিটি ধুলো-ঢাকা খাতা উল্টাতে উল্টাতে তারা বুঝতে পারছিল, অতীতের পদচিহ্ন আসলে বর্তমানের হৃদয়ে ছাপ ফেলে যাচ্ছে। অরূপের অসম্পূর্ণ গল্পের খোঁজে তারা নিজেরাই অজান্তে একটি নতুন গল্পের পথ বেয়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
৬
লাইব্রেরির নীরব কোণায় অরূপের চিঠি পড়তে পড়তে কখন যে অনির্বাণ ও ঐশীর মধ্যে দূরত্ব মুছে যেতে শুরু করেছে, তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। প্রথমে কেবল অরূপ আর তার প্রেমিকার গল্পই তাদের আলোচনার কেন্দ্র ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আলোচনার ফাঁক দিয়ে নিজেদের কথাও বেরিয়ে আসতে লাগল। অনির্বাণ, যে এতদিন চুপচাপ একলা জীবন কাটিয়েছে, হঠাৎ করেই খুঁজে পেল এমন একজনকে, যে তার নীরবতাকে বোঝে। ঐশী একদিন মৃদু হেসে বলল, “তুমি জানো, আমি ছোটবেলা থেকেই লিখতে ভালোবাসি, কিন্তু কাউকে আমার লেখা দেখাতে ভয় পেতাম।” অনির্বাণ অবাক হয়ে তাকাল—সে জানত না ঐশী লেখে। এই স্বীকারোক্তি যেন তাদের মধ্যে অচেনা আরেকটা দরজা খুলে দিল। অনির্বাণও ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের ভয়গুলো উন্মোচন করল—তার একাকীত্ব, মানুষের সঙ্গে মিশতে না পারার কষ্ট, এমনকি নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা। ঐশী মন দিয়ে শুনল, আর বলল, “তুমি হয়তো ভাবছো আমি তোমাকে বুঝব না, কিন্তু আমি তো ঠিক একইরকম অনুভব করি।” সেই মুহূর্তে তাদের চোখের দৃষ্টি যেন এক অদৃশ্য সেতু গড়ে দিল—অতীতের গল্পের খোঁজ আর বর্তমানের আবেগ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল।
এভাবে দিন কাটতে লাগল। প্রতিদিন চিঠি পড়ার অজুহাতে তারা লাইব্রেরিতে আসত, কিন্তু সেই চিঠি কেবল শুরু মাত্র—আসলে তারা নিজেদের খুঁজে পেতে শুরু করেছিল। অনির্বাণ লক্ষ্য করল, ঐশীর উপস্থিতি তার ভেতরের শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলছে। আগে সে লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায় বইয়ের সঙ্গে ডুবে থাকত, আর এখন সেই নীরবতার মাঝেই ঐশীর কণ্ঠস্বর যেন নতুন এক সুর এনে দিয়েছে। অন্যদিকে ঐশীর মনে হচ্ছিল, অনির্বাণের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে তার চাপা ভয়গুলোকে ভেঙে ফেলছে। এতদিন যেটা কাউকে বলেনি, সেটাই অনির্বাণের সামনে অবলীলায় বলে ফেলছে। কখনো তারা স্বপ্নের কথা বলত—অনির্বাণ ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করতে চায়, ঐশী চায় লেখক হতে। কখনো আবার তারা শৈশবের স্মৃতি ভাগ করত—ঐশীর ছোটবেলার গান শেখার অভিজ্ঞতা, অনির্বাণের নিঃসঙ্গ দুপুর। চিঠি পড়ার টেবিলে বসে এভাবে তারা নিজেদের ভেতরকার মানুষটিকে চিনতে শুরু করল, আর প্রতিটি কথোপকথনের শেষে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে উঠতে লাগল।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন লাইব্রেরির আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছিল, ঐশী হঠাৎ বলল, “জানো অনির্বাণ, আমি আগে ভাবতাম লাইব্রেরি মানেই একঘেয়েমি, কিন্তু এখন মনে হয় এখানে একটা নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছি।” অনির্বাণ হেসে উত্তর দিল, “আমিও তো তাই ভাবছি। আগে বইই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু, এখন মনে হচ্ছে বইয়ের পাতার ফাঁক দিয়ে আরেকটা মানুষকে খুঁজে পেলাম।” তাদের কথায় ছিল সরলতা, কিন্তু সেই সরলতার মধ্যেই বোনা হচ্ছিল এক নতুন সম্পর্কের বীজ। অরূপের অসমাপ্ত প্রেমকাহিনি খুঁজতে খুঁজতে তারা নিজেরাই অজান্তে একটা নতুন গল্পের প্রথম অধ্যায় লিখতে শুরু করেছিল। সময়ের স্রোত থেমে গিয়েছিল সেই লাইব্রেরির চার দেওয়ালের ভেতর, যেখানে পুরোনো চিঠির কালি মিশে যাচ্ছিল বর্তমানের আবেগে, আর দুই তরুণ-তরুণী বুঝতে পারছিল—ভালোবাসা সবসময় হঠাৎই আসে, কোনো পূর্বঘোষণা ছাড়াই, ঠিক যেমন তারা দু’জন একে অপরকে খুঁজে পেল।
৭
দিনগুলো যতই এগোতে লাগল, অনির্বাণ ও ঐশীর মধ্যে এক অদ্ভুত নীরবতা জন্ম নিতে শুরু করল। আগের মতো চিঠি পড়া বা নিজেদের কথোপকথনে আর সেই নির্ভার আনন্দ থাকত না। চিঠির প্রতিটি শব্দ যে আবেগ তাদের একসঙ্গে বেঁধেছিল, এখন সেটিই যেন তাদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করছে। ঐশীর মনে হঠাৎ প্রশ্ন জেগে উঠল—এ যে অনুভূতি, সেটা কি সত্যিই ভালোবাসা? নাকি তারা কেবল অরূপের চিঠির গভীর আবেগে ভেসে গিয়ে একে অপরকে ভুলভাবে বোঝার চেষ্টা করছে? রাতে ঘুমোতে গেলেও ঐশী বারবার চিঠির লাইনগুলো মনে করত—“তুমি ছাড়া আমি কিছুই নই।” এই লাইনগুলো তার ভেতরে আলোড়ন তুলত, আবার ভয়ও জাগাত। অনির্বাণের প্রতি তার টান অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু সেই টান কি স্থায়ী? নাকি কেবল পরিস্থিতির প্রভাব? অনির্বাণও এক অদ্ভুত দ্বিধায় পড়ে গেল। সে ঐশীর পাশে থাকলেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, কিন্তু মুখ খুলে কিছু বলতে পারল না। তার মনে হচ্ছিল, যদি সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে আর ঐশী তাকে ভুল বোঝে, তবে এই গড়ে ওঠা সম্পর্কটাই হয়তো ভেঙে যাবে। ফলে দু’জনেই নীরবতা বেছে নিল, আর সেই নীরবতাই তাদের আরও দূরে ঠেলে দিল।
এই নীরব দূরত্ব তাদের প্রতিদিনের সাক্ষাৎকে অন্যরকম করে তুলল। লাইব্রেরির টেবিলে বসা অবস্থায়ও তারা আগের মতো চোখে চোখ রাখত না। ঐশী মাঝে মাঝে কথোপকথন শুরু করার চেষ্টা করলেও, অনির্বাণ শুধু হ্যাঁ-না উত্তর দিত। আর অনির্বাণ চাইলেও তার ভেতরের দ্বিধা প্রকাশ করতে পারছিল না। দু’জনের ভেতরেই যেন এক অদৃশ্য দেওয়াল উঠে দাঁড়িয়েছে। তাদের আলোচনার কেন্দ্রে থাকা অরূপের চিঠিও যেন এখন নিস্তেজ হয়ে গেছে। আগে যেখানে প্রতিটি শব্দ নতুন আলো জ্বালাত, এখন সেগুলো কেবল ধুলো ধরা পাতার মতো মনে হয়। ঐশীর মনে কষ্ট জমতে থাকে—সে ভাবত অনির্বাণ হয়তো তাকে বন্ধু নয়, এর বেশি কিছু ভাবছে, কিন্তু তার নীরবতা ঐশীকে আঘাত দিচ্ছিল। অনির্বাণও একইভাবে ভুগছিল, সে বুঝতে পারছিল না কিভাবে নিজের ভয়গুলো সরিয়ে ঐশীর সামনে দাঁড়াবে। এই দ্বন্দ্ব তাদের দুজনকে একইসঙ্গে কাছে টানছিল আবার দূরে সরাচ্ছিল। প্রতিটি দিন যেন আবেগের এক অদ্ভুত দোলাচলের ভেতর দিয়ে কেটে যাচ্ছিল, যেখানে এক মুহূর্তে তারা একই ছাদের নিচে থেকেও একে অপরকে অচেনা লাগত।
তাদের সম্পর্কের এই অস্বস্তি ধীরে ধীরে গভীর হতে থাকল। ঐশী ভেবেছিল, হয়তো অনির্বাণকে একটু সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু সময় কেবল দ্বিধাকে আরও বড় করে তুলল। অনির্বাণও চুপচাপ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিল। একদিন ঐশী হঠাৎ বলে উঠল, “আমরা কি সত্যিই নিজেদের জন্য এখানে আসি, নাকি শুধু চিঠিটার জন্য?” প্রশ্নটা শুনে অনির্বাণ চমকে গেল, কিন্তু মুখে কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার নীরবতাই যেন উত্তর হয়ে দাঁড়াল, আর ঐশীর চোখ ভিজে উঠল। সেই মুহূর্তে তারা দু’জনেই বুঝল—এ দ্বন্দ্ব তাদের ভেতরের সত্যি। ভালোবাসা কি কেবল অরূপের অসমাপ্ত কাহিনি থেকে আসা এক আবেগ, নাকি সত্যিই তারা একে অপরকে খুঁজে পেয়েছে? উত্তর কেউ জানত না। কিন্তু এই অস্বস্তি, এই অনিশ্চয়তা, এই দ্বিধাই তাদের সম্পর্ককে এক নতুন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করাল। হয়তো এই নীরব সংঘাতই তাদেরকে আরও গভীর করে ভাবতে শিখাবে, কিংবা হয়তো আলাদা করে দেবে। লাইব্রেরির সেই নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এল, তবে এবার তা আর শান্তির নিস্তব্ধতা নয়—বরং এক অমীমাংসিত দ্বন্দ্বের নিস্তব্ধতা, যা তাদের হৃদয়কে ক্রমশ ভারী করে তুলছিল।
৮
অনির্বাণ ও ঐশীর অনুসন্ধান অবশেষে এমন এক সূত্রে পৌঁছাল, যা তাদের অনেক দিন ধরে তাড়া করছিল। কলেজের পুরোনো ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঐশীর চোখ হঠাৎ থেমে গেল এক ছবির ওপর। ছবিতে কয়েকজন ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে, সবার মুখে হাসি, আর নিচে লেখা নামের তালিকায় স্পষ্ট দেখা গেল—“অরূপ ভট্টাচার্য”। ঠিক তার পাশে আরেকটি নাম—“মীরা দত্ত”। নামটি পড়তেই দু’জনের মনে এক অদ্ভুত আলোড়ন জাগল। চিঠির পাতায় যে অচেনা “তুমি” ছিল, সেই কি এই মীরা? তারা আরও খুঁজতে লাগল, এবং পুরোনো নথিতে, এক প্রাক্তন অধ্যাপকের স্মৃতিকথায়, অরূপ আর মীরার নাম পাশাপাশি উল্লিখিত দেখতে পেল। সেখানে ইঙ্গিত ছিল যে দু’জনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাজের বাঁধন আর পারিবারিক চাপ তাদের আলাদা করে দিয়েছিল। চিঠি যে উত্তর পায়নি, সেটি হয়তো সত্যি—মীরা হয়তো কোনোদিন উত্তর পাঠানোর সাহস জোগাড় করতে পারেনি, কিংবা চেয়েও করেনি। অনির্বাণ ও ঐশীর বুক কেঁপে উঠল—একটা প্রেম শুরু হয়েছিল চিঠির কালি দিয়ে, অথচ শেষ হয়েছিল নীরবতায়। অরূপের সেই অদৃশ্য ব্যথা যেন আজও বইয়ের পাতার ভাঁজে আটকে আছে।
এই সত্য জানার পর দু’জনেই দীর্ঘক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। ঐশীর মনে হচ্ছিল, অরূপের অসমাপ্ত প্রেম যেন তাকে গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে। তার চোখে জল ভরে উঠল—“কত কষ্ট পেয়েছিল ওরা, তাই না অনির্বাণ?” অনির্বাণ মাথা নাড়ল, কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না। তারও বুক ভেঙে যাচ্ছিল। তারা দু’জনই বুঝতে পারছিল, ভালোবাসা সবসময় জয়ী হয় না; কখনো কখনো সমাজের প্রাচীর তাকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু একইসঙ্গে তারা এটাও অনুভব করল, অরূপের ব্যথা তাদের জন্য যেন এক নতুন শিক্ষা নিয়ে এসেছে। ঐশী মনে মনে ভাবল, “আমরা কি আমাদের দ্বিধা, ভয় বা সমাজের ভয়ে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাব, নাকি এই অসমাপ্ত প্রেমকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করব?” অনির্বাণেরও মনে হচ্ছিল, তার ভয়গুলো যদি অরূপের মতো সবকিছু শেষ করে দেয়, তবে তাদের গল্পও হয়তো একইভাবে অসমাপ্ত থেকে যাবে। সেই মুহূর্তে চিঠির প্রতিটি শব্দ নতুন করে অর্থ পেল। অরূপের লেখা আসলে কেবল তার প্রেমিকার জন্য ছিল না—সম্ভবত সেটা ছিল এক চিরন্তন আর্তি, যা সময় পেরিয়ে এসে নতুন প্রজন্মকে শিখিয়ে দিল কীভাবে ভালোবাসার কাছে সৎ থাকতে হয়।
এই আবিষ্কার যেন অনির্বাণ ও ঐশীর সম্পর্কের নতুন বাঁক এনে দিল। অরূপের অসমাপ্ত কাহিনি তাদেরকে নিজেদের দ্বিধা আর ভয়কে নতুন করে দেখতে বাধ্য করল। ঐশী মৃদু গলায় বলল, “আমি চাই না আমাদের গল্পও এইভাবে শেষ হোক।” অনির্বাণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সেই দ্বিধার প্রাচীর আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে। তারা উপলব্ধি করল, অরূপ আর মীরার অসমাপ্ত প্রেম আসলে তাদের জন্য এক আয়না—যেখানে তারা নিজেদের ভবিষ্যতের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। যদি তারা নীরব থাকে, যদি তারা অনুভূতিগুলো প্রকাশ না করে, তবে ইতিহাস হয়তো আবারও পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু যদি সাহস করে তারা নিজেদের সত্যিটা মেনে নেয়, তবে অরূপের গল্পের অসমাপ্তি তাদের মধ্যে সম্পূর্ণতা খুঁজে পাবে। সেই লাইব্রেরির নিস্তব্ধতায়, পুরোনো চিঠির গন্ধ আর ম্লান আলোয়, অনির্বাণ ও ঐশী যেন প্রতিজ্ঞা করল—তাদের গল্প আর কোনোদিন অসমাপ্ত থেকে যাবে না। অরূপের শেষ সত্য তাদের হৃদয়ে গভীর দাগ কাটল, আর সেই দাগ থেকেই জন্ম নিল এক নতুন আলোর শপথ।
৯
অরূপের অসমাপ্ত প্রেমের গল্প জানার পর থেকে ঐশীর ভেতরে এক অদ্ভুত আলোড়ন চলছিল। সে উপলব্ধি করল, ভালোবাসা কেবল অতীতের স্মৃতি নয়, বর্তমানকে বাঁচিয়ে রাখার শক্তিও বটে। মীরার নীরবতা, অরূপের ব্যথা—এসব যেন তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করল। এক সন্ধ্যায় লাইব্রেরির জানালার পাশে বসে, সূর্যাস্তের সোনালি আলো বইয়ের পাতায় ছড়িয়ে পড়ছিল, আর সেই আবহে ঐশী সিদ্ধান্ত নিল আর দেরি নয়। সে চাইল নিজের ভেতরের অনুভূতিটা স্পষ্টভাবে জানাতে, নাহলে হয়তো অরূপ-মীরার কাহিনির মতো তারাও হারিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে সে বলল, “জানো, আমি এতদিন ভেবেছিলাম এটা হয়তো কেবল কৌতূহল, হয়তো কেবল পুরোনো চিঠির আবেগে ভেসে যাওয়া। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এটা তার থেকেও অনেক গভীর কিছু। আমি তোমার পাশে থাকলে অন্যরকম শান্তি পাই, যেন আমি নিজের মতো করে বাঁচতে পারি। আমি জানি না এটা কী নামে ডাকা যায়, কিন্তু আমি মনে করি এটা প্রেম।” কথাগুলো বলার সময় ঐশীর চোখে জল চিকচিক করছিল, কিন্তু তার কণ্ঠে ছিল দৃঢ়তা।
অনির্বাণ প্রথমে কিছু বলতে পারল না। এতদিন ধরে বুকের ভেতর যেটা চাপা দিয়ে রেখেছিল, হঠাৎ যেন সব খুলে গেল। ঐশীর স্বীকারোক্তি তাকে ভেতর থেকে কাঁপিয়ে দিল, আবার অদ্ভুত এক মুক্তিও দিল। সে ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে বলল, “তুমি যা বলছো, আমিও ঠিক তাই অনুভব করি। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছিলাম—যদি তুমি আমাকে ভুল বোঝো, যদি ভাবো আমি কেবল এই চিঠির আবেগে ভেসে গেছি? আমি ভেবেছিলাম চুপ থাকাই ভালো। কিন্তু আজ বুঝলাম নীরবতা সব নষ্ট করে দেয়। সত্যিটা হলো, ঐশী, আমি তোমাকে প্রথম দিন থেকেই অন্যরকমভাবে অনুভব করেছি। তোমার চোখের দিকে তাকালেই আমার মনে হয়, আমি একা নই। তুমি আমার শূন্যতা পূর্ণ করো।” কথাগুলো বেরোতেই অনির্বাণের গলা ভারী হয়ে এল। এতদিন যে অনুভূতি তার বুকের গভীরে লুকিয়ে ছিল, আজ সেটাই উচ্চারণ করে সে যেন অদৃশ্য শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেল।
দু’জনেই একে অপরের চোখে তাকিয়ে রইল, আর সেই দৃষ্টির ভেতর ছিল সমস্ত উত্তর। চিঠির কালি, পুরোনো কাহিনির আবেগ—সবকিছু মিলেমিশে তাদের বর্তমানকে রঙিন করে তুলল। ঐশী হেসে বলল, “তাহলে আমরা কি অরূপের গল্পটাকে সম্পূর্ণ করতে পারব?” অনির্বাণ মৃদু হাসল, “হয়তো আমাদের গল্পই তার অসমাপ্ত প্রেমের শেষ উত্তর।” সেই মুহূর্তে লাইব্রেরির নীরবতা আর শূন্য মনে হলো না; বরং প্রতিটি দেওয়াল, প্রতিটি ধুলো ধরা বই যেন তাদের স্বীকারোক্তির সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল। অরূপ ও মীরার অসমাপ্ত কাহিনি নতুন প্রজন্মে পূর্ণতা পেল—এই দুটি তরুণ হৃদয়ের মাধ্যমে। অনির্বাণ ও ঐশী অনুভব করল, প্রেম আসলে সময়ের সীমা মানে না; অতীতের ভাঙন থেকেও বর্তমানের নতুন শুরু হতে পারে। তাদের স্বীকারোক্তি শুধু একে অপরের কাছে নয়, বরং সেই অসমাপ্ত চিঠির কাছেও এক প্রতিশ্রুতি—যা বলছে, এবার প্রেম আর নীরব থাকবে না, এবার প্রেম তার নিজের পূর্ণতা খুঁজে নেবে।
১০
স্বীকারোক্তির সেই মুহূর্তের পর অনির্বাণ ও ঐশীর সম্পর্ক যেন এক অদ্ভুত নতুন আলোয় ভরে উঠল। চিঠির কালি থেকে জন্ম নেওয়া তাদের গল্প এখন আর অতীতের আবেগে বাঁধা নয়, বরং বর্তমানের সাহসী ভালোবাসায় পূর্ণ। তবু ঐশীর মনে হচ্ছিল, তাদের গল্পকে যদি কোনো প্রতীক দিয়ে বাঁধা যায়, তবে তা আরও গভীর হবে। একদিন সন্ধ্যায়, লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার ঠিক আগে, ঐশী তার ব্যাগ থেকে বের করল নিজের পুরোনো ডায়েরি। সেই ডায়েরির ভেতরে লুকিয়ে ছিল তার সব অনুভূতি, অপ্রকাশিত স্বপ্ন আর চাপা কষ্ট। পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে খালি জায়গায় কলম রাখল, আর লেখা শুরু করল এক নতুন চিঠি—তবে এইবার প্রাপক অরূপ নয়, বরং অনির্বাণ। শব্দগুলো তার ভেতর থেকে অবলীলায় বেরিয়ে এল: “পুরোনো চিঠি আমাদের মিলিয়েছে, কিন্তু আমাদের গল্প নতুন। আমরা অতীতের অসমাপ্তি থেকে জন্ম নিয়েছি, তাই আমাদের শুরু আরও দৃঢ়। তুমি আমার প্রতিদিনের নীরবতায় সুর এনে দিয়েছ, তুমি আমার ভয়কে আলোকিত করেছ। আমি চাই, এই চিঠি আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক—যে আমরা আর কখনো নিজেদের গল্প অসমাপ্ত রাখব না।” লিখতে লিখতে ঐশীর চোখ ভিজে এল, তবে সেই অশ্রু দুঃখের নয়—বরং পূর্ণতার।
অনির্বাণ যখন সেই চিঠি হাতে পেল, তার বুক কেঁপে উঠল। চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন নতুন প্রাণ দিচ্ছিল। এতদিন যে পুরোনো চিঠি তাদের জীবনে আলো এনেছিল, সেই আলো এখন রূপ নিচ্ছে নতুন রঙে। অনির্বাণ ধীরে ধীরে ঐশীর দিকে তাকাল, তার চোখে ছিল এক অপরিসীম কৃতজ্ঞতা। সে ফিসফিস করে বলল, “অরূপের চিঠি হয়তো কখনো উত্তর পায়নি, কিন্তু তোমার এই চিঠি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় উত্তর।” লাইব্রেরির সেই ধুলো ধরা কোণায়, যেখানে একদিন অচেনা এক কাগজের ভাঁজে তারা মিলেছিল, আজ সেখানে নতুন ইতিহাস লেখা হলো। ঐশীর ডায়েরির পাতায় লেখা এই চিঠি হয়ে উঠল তাদের প্রেমের প্রথম আনুষ্ঠানিক দলিল। এই চিঠিই জানাল—তাদের গল্প আর কেবল আবেগের টান নয়, বরং এক সচেতন প্রতিজ্ঞা, যা সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকবে। অনির্বাণ অনুভব করল, তার জীবনের একাকীত্ব ভেঙে গেছে; ঐশীর শব্দগুলো তাকে শিকড় গেড়ে থাকা ভয়ের মাটি থেকে তুলে এনে আলোয় দাঁড় করিয়েছে।
সেদিনের পর থেকে লাইব্রেরির নিস্তব্ধতা আর তাদের কাছে আগের মতো ছিল না। প্রতিটি টেবিল, প্রতিটি পুরোনো বই, প্রতিটি কালি-লেখা পাতা যেন তাদের প্রেমের সাক্ষী হয়ে দাঁড়াল। পুরোনো চিঠি তাদের হাতে এনে দিয়েছিল এক অসমাপ্ত গল্প, কিন্তু ঐশীর লেখা নতুন চিঠি সেই গল্পকে পূর্ণতার প্রতীক বানাল। তারা দু’জনেই বুঝল, প্রেম মানে কেবল আবেগে ভেসে যাওয়া নয়; প্রেম মানে একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া, একসঙ্গে পথ চলার সাহস করা। আর সেই প্রতিশ্রুতিই তারা একখণ্ড কাগজে ধরে রাখল—যেন অরূপ আর মীরার গল্প থেকে শেখা শিক্ষা কখনো ভুলে না যায়। সূর্যাস্তের লাল আভা জানালার কাচে প্রতিফলিত হচ্ছিল, যেন প্রকৃতিও তাদের নতুন সূচনার সাক্ষী হলো। অনির্বাণ মৃদু হেসে বলল, “তাহলে আমাদের গল্পটা চিঠির কালিতে নয়, জীবনের রঙে লেখা হবে।” ঐশী মাথা নাড়ল, তার চোখে এক অদম্য দীপ্তি—কারণ সে জানত, এইবার তাদের গল্প আর অসমাপ্ত হবে না; এইবার ভালোবাসা তার সমস্ত রঙ নিয়ে বেঁচে থাকবে।
***
				
	

	


