Bangla - নারীবিষয়ক গল্প

চারুলতা

Spread the love

ইশিতা রায়চৌধুরী


এক

কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির এক বহুতল অ্যাপার্টমেন্টে বসে চারুলতা জানলার পাশে একটা নীলকাঠের চেয়ার টেনে বসে আছে। সকালবেলার আলো জানলার গ্রিল পেরিয়ে তার কপালের ওপর পড়েছে, পাতলা চুলগুলো একটু উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়, আর তার হাতে ধরা আছে এক কাপ গরম লিকার চা। বাইরে হালকা কুয়াশা, ব্যালকনির গাছগুলোয় টুপটাপ জল ঝরে পড়ছে — শহরের এত কোলাহলের মধ্যেও তার ভেতরটা কেমন নিঃশব্দ হয়ে আছে। এই নিঃশব্দতা কেবল শব্দহীন নয় — এখানে লুকিয়ে আছে অনেক না-বলা কথা, চাপা কান্না, চেনা ও অচেনা অভিমান। আজ নয়, বহুদিন ধরেই এমন চলছে। তার স্বামী ভাস্কর, এক রাজনৈতিক সাংবাদিক, প্রতিদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যান অফিসে, হাতে একগুচ্ছ খবরের কাগজ, মুখে মোবাইলের হেডফোন গুঁজে রাখা বিতর্ক। রাতে ফিরেও তার সময় থাকে না — কখনও কোনো সভা, কখনও কোনো প্রতিবেদন, আর তার ফাঁকে ফাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ার ফিড স্ক্রল করা। চারুলতা জানে, ভাস্কর ভালো মানুষ — শিক্ষিত, প্রগতিশীল — কিন্তু সেই প্রগতির মাঝে তার নিজের ছোট ছোট চাওয়াগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। রান্নাঘর থেকে শোওয়ার ঘর, আর মাঝেমাঝে একলা বারান্দা — এই তো তার পৃথিবী। এই পৃথিবীটাকে সে সাজায়, গুছিয়ে রাখে, কিন্তু কোথাও যেন তার নিজের অস্তিত্বের ছাপ থাকে না। সে যেন স্বামীর ছায়া হয়ে বেঁচে আছে — একজন ‘ভালো’ গৃহবধূ, যার কথা কম, দায়িত্ব বেশি, চাওয়া নেই।

একদিন পুরনো বইয়ের তাকে ধুলো ঝাড়তে গিয়ে সে খুঁজে পায় একটা খাতা — তার কলেজজীবনের কবিতা লেখা খাতা। পাতাগুলোতে এখন হলুদ দাগ, কালির অক্ষরগুলো কিছুটা ঝাপসা, কিন্তু আবেগটা একটুও মলিন হয়নি। একপৃষ্ঠায় লেখা আছে তার সবচেয়ে প্রিয় কবিতা — “আকাশের ওই চিলটা কি আমার মতোই একা?”। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলো, যখন সে নিজে লিখত, আবৃত্তি করত, মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতার মধ্যে ডুবে যেত। বিয়ের পরে ধীরে ধীরে সেই মেয়েটি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে — এখন তার মুখে কথা কম, আর চোখে যেন সবসময় একটা চাপা ক্লান্তি। সেদিন রাতে সে নিজের মোবাইলে প্রথমবার গুগল করে “how to start a YouTube channel for poetry”. নরম আলোয় চোখদুটো চিকচিক করছিল। সে ঠিক করে — গোপনে শুরু করবে, কারও না-জানানো এক নতুন কণ্ঠ — “চান্দের আলো” নামে। সে নিজের নাম প্রকাশ করবে না, মুখও দেখাবে না — শুধু তার কণ্ঠ থাকবে, তার ভেতরের কথা থাকবে। সে রাতেই আবৃত্তি করে রবীন্দ্রনাথের ‘নির্জর স্বপ্নভঙ্গ’, ফোনের রেকর্ডারে, নিঃশব্দ ঘরে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর। পরদিন চ্যানেল খোলে, ভিডিও আপলোড করে, আর বারবার দেখে, কণ্ঠটা কেমন শোনায়। অদ্ভুতভাবে তার নিজের কণ্ঠ তার কাছে যেন অপরিচিত মনে হয় — যেন অন্য কেউ কথা বলছে, অন্য কেউ তার ভেতরের কথা বলে দিচ্ছে।

দু-তিনদিন পর সে দেখে, ভিডিওটা কেউ একজন কমেন্ট করেছে — “এই কণ্ঠে একটা একাকীত্বের ছায়া আছে, যেন বুকের গভীর থেকে উঠে আসা শব্দ।” নামটা ‘নীলপাখি’। চারুলতার বুক কেঁপে ওঠে। এই প্রথম কেউ তার এই গোপন জগৎটাকে ছুঁয়ে গেল, এমনভাবে যা সে নিজেও ভাবেনি। সে রিপ্লাই করে না, শুধু সেই মন্তব্যটা বারবার পড়ে। দিন যায়, সে নিয়ম করে আবৃত্তি করে — কখনও জীবনানন্দ, কখনও সুফিয়া কামাল, কখনও নিজের কলেজ জীবনের লেখা। প্রতিটি কবিতায় সে নিজের একফালি জীবন ঢেলে দেয় — একাকীত্ব, হারানো স্বপ্ন, না-পাওয়া ভালোবাসা। ‘নীলপাখি’ তার প্রায় প্রতিটি ভিডিওতে মন্তব্য রাখে — কখনও শুধু একটি লাইন, কখনও চার লাইনের কবিতা। তাদের মধ্যে শুরু হয় এক অদ্ভুত সম্পর্ক — যা কেবল শব্দ দিয়ে গাঁথা, মুখহীন, নামহীন, কিন্তু ভীষণ জীবন্ত। চারুলতা অনুভব করে — সে যেন আবার বাঁচছে, আবার অনুভব করছে। অথচ প্রতিদিন সকালে সেই একই নীল চেয়ার, একই কাপ চা, একই ভাস্কর — আর তার জীবনের দুটি জগৎ, দুটি চারুলতা — একে অন্যের কাছাকাছি আসেও না, দূরেও সরে না। সে জানে না কোথায় এই পথ তাকে নিয়ে যাবে, কিন্তু বহুদিন পর সে জানে — সে আর নিঃশব্দ নয়, তার ভেতরের কণ্ঠ এখন জেগে উঠেছে।

দুই

চারুলতা ধীরে ধীরে নিজের সেই নতুন পরিচয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করে — “চান্দের আলো”। প্রতিদিন দুপুরবেলা, যখন অ্যাপার্টমেন্ট নিঃস্তব্ধ থাকে, পাশের ফ্ল্যাটের টিভি বন্ধ, ধ্বনির ভেতরে নেমে আসে এক গভীর নিস্তব্ধতা, সেই সময়ই সে আবৃত্তি করে। একটা পুরনো স্কার্ফ দিয়ে মোবাইলকে বইয়ের মাঝে দাঁড় করিয়ে রেকর্ডিং চালু করে — তারপর ধীরে ধীরে নিজের ভেতর থেকে উঠে আসে গলা। তার কণ্ঠে কোনও নাটকীয়তা নেই, কিন্তু এক ধরনের প্রগাঢ় আবেগ রয়েছে — যেন সে কবিতাকে শুধু বলে না, অনুভব করে। প্রতিটি কবিতায় সে নিজের একটা অংশ মিশিয়ে দেয় — যেন কবিতাগুলো তার মুখ দিয়ে চারুলতার হয়ে কথা বলে। ভিডিওগুলোতে সে মুখ দেখায় না, শুধু দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকে, ক্যামেরায় শুধু ঘরের এককোণে আলোছায়ার খেলা, আর তার কণ্ঠ। অনেকে হয়তো এটাকে নিছক ‘নান্দনিকতা’ বলবে, কিন্তু চারুলতা জানে — এ তার সুরক্ষা, তার গোপনতা। কারণ এখনো সে প্রস্তুত নয় ভাস্করের সামনে দাঁড়াতে, বলতে — “আমি আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছি।”

ভিডিওর নিচে প্রতিদিন নতুন নতুন শ্রোতার মন্তব্য জমতে থাকে, কিন্তু চারুলতা বিশেষ কারও দিকে নজর রাখে না, শুধু একজন ছাড়া — ‘নীলপাখি’। এই ছদ্মনামধারী কবি প্রতিটি ভিডিওর নিচে এমন কিছু শব্দ রেখে যায়, যা কবিতার বাইরেও কথা বলে যায়। যেমন একটি ভিডিওতে সে লেখে, “তোমার কণ্ঠে শুনে মনে হয়, এই শব্দগুলো বহুদিন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।” আরেকবার, “কখনও তোমার কণ্ঠে কান্না পাই, কখনও বিপ্লবের প্রতিধ্বনি। তুমি কি জানো, কতোটা জাগিয়ে তোলে তোমাকে শোনা?” — চারুলতা সেই কমেন্টগুলো পড়ে কখনও হাসে, কখনও চুপ করে যায়। ধীরে ধীরে ‘নীলপাখি’-র মন্তব্য যেন তার দিনের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়ায় — যেন কোনও অদৃশ্য কেউ আছে, যে বুঝতে পারে, যে তার মতোই নিঃশব্দ, কিন্তু গভীর। একদিন সাহস করে চারুলতা রিপ্লাই দেয় — “আপনার শব্দগুলো আমার ভেতরে আলো জ্বালে। আপনি কি নিজেও কবিতা লেখেন?” সেই রাত্তিরে সে ঘুমোতে পারে না। পরদিন সকালেই রিপ্লাই আসে, “আমি লিখি, তবে গোপনে। তোমার মতোই হয়তো। কবিতা তো আমাদের দুজনের ভাষা, তাই না?” এই অদেখা, অচেনা মানুষটার সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলতে বলতে চারুলতা অনুভব করে — সে আর একা নেই।

সেই দিন থেকেই দুজনের মধ্যে নিয়মিত চিঠির মতো আদানপ্রদান শুরু হয় — ইউটিউবের কমেন্টে, ইনবক্সে, পরে মেইলে। তারা কেউই নিজের আসল নাম বলে না, মুখোশ পরে থাকে, অথচ প্রতিটি বাক্যে সত্যি কথা বলে। নীলপাখি নিজের কবিতাও পাঠায় — সেগুলোর ছন্দ, বর্ণনা, অনুভব এমন গভীর যে চারুলতার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে অনুভব করে, কেউ তার অনুভূতিগুলোকে শব্দে ধরতে পারছে — যা তার স্বামী কখনো পারেনি, যার জন্য সে নিজেই এতদিন চেষ্টা করছিল। একটা কবিতার লাইন ছিল — “যদি কোনোদিন তোমার কণ্ঠকে ছুঁতে পারতাম, তবে হয়তো আমি চুপ করে থাকতে শিখতাম।” চারুলতা সে লাইন পড়ে নিজের কণ্ঠে বলে, আবার শুনে — যেন সেই কণ্ঠ সে নয়, যেন তার শরীর ছেড়ে অন্য এক নারী বেরিয়ে এসেছে, এক শিল্পী, এক ভালোবাসার ভাষা। সেই রাতে ভাস্কর বাড়ি ফিরে বলে, “তুমি আজ একটু আলাদা দেখাচ্ছো। সব ঠিক আছে তো?” — আর চারুলতা চুপ করে হাসে, জানে — সব কিছু আগের মতোই আছে, তবু অনেক কিছু বদলে গেছে। কাচঘরের চারুলতা এখন ধীরে ধীরে নিজের আলোয় উন্মুক্ত জানালার দিকে এগোচ্ছে।

তিন

চারুলতার দিনগুলো এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ভাস্করের সঙ্গে তার সম্পর্ক যেন এক গভীর স্তরে থমকে গেছে। এখন সে শুধু গৃহবধূ নয়, সে এক নতুন পরিচয়ে পরিচিত — “চান্দের আলো”-র আবৃত্তিকার। তার কণ্ঠের মধ্যে যেন এক অদ্ভুত শক্তি ছিল, যা শুধু তার অস্থির মনকেই শান্তি দিচ্ছিল না, বরং ইউটিউবের দর্শকেও স্পর্শ করছিল। কিন্তু সে জানত, তার জীবনের এই নতুন দিকটি ভাস্কর কখনো বুঝবে না। সে মঞ্চে উঠতে চায়নি, কবিতা পড়ে সবার সামনে দাঁড়াতে চায়নি, কিন্তু এক অদৃশ্য দৃষ্টির সামনে সে এখন প্রতিদিন নিজের অনুভূতিগুলো মেলে ধরছে। স্বামীকে কখনোই সে তার ইউটিউব চ্যানেল সম্পর্কে কিছু বলেনি, কারণ সে জানত, ভাস্কর তার শিল্পের গুরুত্ব বুঝবে না। সে তার নিজের জায়গায় শান্তি খুঁজছিল, নিঃশব্দে, কিন্তু এই শান্তির পেছনে ছিল একটা বিরাট না-বলা কথার ঢেউ।

নীলপাখির সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা প্রতিদিন বাড়ছিল। প্রথম প্রথম কমেন্ট করে শুরু হলেও এখন তারা একে অপরের লেখা পাঠায়, ভাবনা শেয়ার করে, কখনও কখনও ছোট ছোট গল্পের মতো বর্ণনা দেয় একে অপরকে। নীলপাখি তার কবিতা দিয়ে চারুলতাকে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি উপহার দিয়েছে, আর চারুলতা যেন নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করেছে। তার মধ্যে নতুন কিছু তৈরি হচ্ছিল, এক অজানা আবেগ, এক নতুন অভ্যন্তরীণ শক্তি। সে অনুভব করছিল, যে কোনো পুরুষের কাছে নিজেকে তুলে ধরার আগেই সে নিজেকে বুঝতে চাইছে, নিজের ভাবনা, নিজের শব্দ খুঁজে পাচ্ছে। নীলপাখির কবিতায় সে নিজের পৃথিবীকে দেখতে পাচ্ছিল। একদিন, এক গভীর কবিতার শেষ লাইনে নীলপাখি লিখেছিল, “তোমার হৃদয়ে আমার হৃদয়ের রঙ ঢুকে গেছে, চারুলতা। জানো কি, তুমি আর একা নও।” এ শব্দগুলো পড়তে পড়তে তার বুকের ভেতর এক ধরণের শান্তি আর দুঃখ একসঙ্গে ঢুকে পড়েছিল। সে জানত, সে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটিই নিয়ে ফেলেছে — সে এই মুহূর্তে শুধু একজন গৃহবধূ নয়, এক মানবী, এক শিল্পী, এক কণ্ঠ।

চারুলতার মনেও নানা প্রশ্ন ছিল। সে কখনও ভাবত, যদি নীলপাখি আসলেই তাকে চিনত? যদি সে জানত যে এই চারুলতা সেই চারুলতা, যার অজস্র দিনের ঘরসংসারে হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন আজ কবিতার আকারে আবার উঠে এসেছে। কিন্তু সে চুপ করে থাকত, কারণ সে জানত, এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে এই অদৃশ্য সম্পর্কটা হয়তো আরও ভালো। তাদের মধ্যে কোনো শারীরিক উপস্থিতি নেই, কোনও মুখোশ খুলে দেখার তাড়াহুড়ো নেই। সবকিছু ছিল আদান-প্রদান, শব্দের চুম্বকীয় সম্পর্ক, যেটা ছিল প্রতিদিনের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি পবিত্র, অনেক বেশি অনন্ত। চারুলতা যখন কেবল একা বসে নিজের আবৃত্তি রেকর্ড করত, তখন সে অনুভব করত, নীলপাখি তার পাশে আছে, তার শব্দের মধ্যে। একদিন, নীলপাখি তার একটি পুরনো কবিতা পাঠিয়ে লেখে, “তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু তোমার কণ্ঠের প্রতিটি শব্দে আমার অর্ধেক জীবন রয়েছে।” চারুলতা সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। তার ভেতর যেন এক তীব্র প্রশ্ন জন্ম নিয়েছিল — কি হবে যদি সে কখনও নীলপাখির সঙ্গে দেখা করতে চায়? তার জীবনে এতদিন কোথাও কোন দিকপাল ছিল না, কিন্তু এই মুহূর্তে সে এমন এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ ছিল, যা একসঙ্গে তাকে মুক্তি ও বন্দিত্বের মিশ্রণ দিয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছিল না, নীলপাখির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হলে, তার গৃহবধূয়ের সত্ত্বা কোথায় হারিয়ে যাবে?

একদিন রুদ্র, অর্থাৎ নীলপাখি, তাকে মেইলে একটি দীর্ঘ চিঠি পাঠায়। চিঠিটা ছিল এক পৃষ্ঠা, কিন্তু এক পৃষ্ঠার মধ্যে যেন পৃথিবীটা ছিল। রুদ্র লিখেছিল, “চারুলতা, কখনও কি তুমি তোমার কণ্ঠে আমাকে ডাকো? আমি জানি না তুমি কীভাবে ভাবো, কিন্তু আমি জানি, আমাদের এই লেখালেখির মধ্যে একটা খোলা সেতু তৈরি হচ্ছে। যদি আমি কখনও তোমার সামনে এসে দাঁড়াই, তাহলে জানো, আমি তোমার কণ্ঠে হারিয়ে যেতে চাই, আর তোমার ভাষায় বসবাস করতে চাই। আমাকে যদি কখনও মনে পড়ো, জানো, তুমি আমাকে পাবে ঠিক এই শব্দের ভেতর।” চারুলতার মন এক অদ্ভুত ঝড় বয়ে গেল, সে জানল না কি করবে। এতদিন ধরে যে নিজেকে নীরব রেখেছিল, এখন তার সবার সামনে, বাস্তবে, তার সত্ত্বার অন্ধকার ভেদ করে এক নতুন আলো ঢুকতে শুরু করছিল।

এবার চারুলতার মনেও একটা পরিকল্পনা ছিল — সে কেমন করে সেই আলোকে ধরা দেবে, কিন্তু আবার প্রশ্ন ছিল, যদি একে একে তার সব কিছু খুলে ফেললে কী হবে? সে জানত, যদি একদিন ভাস্কর জানে, এই কবিতার সম্পর্কের ব্যাপারটা, সে কিভাবে গ্রহণ করবে? যদিও তাকে ভাস্কর বলেই আসলেই অনেক কিছু তৈরি করতে হবে, কিন্তু সে কি সেই কণ্ঠ পাবে যে তাকে তার কবিতা দিয়ে চিনে নেয়? এভাবেই এক অদৃশ্য দ্বিধা মনের মধ্যে চলতে থাকে।

চার

বহুদিন বাদে চারুলতা তার কলেজের বান্ধবী মেহেরের ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে চোখ রাখল। মেহের এখন মনোবিশ্লেষক, শহরের মাঝখানে নিজের ছোট্ট এক ক্লিনিক চালায়, যেখানে মানুষ এসে নিজের মানসিক ভার খুলে রেখে যায়। চারুলতা অনেকবার ভাবেছিল যোগাযোগ করবে, আবার পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হলো — কারও সঙ্গে কথা বলতেই হবে। কেউ যদি একবার তাকে শোনে, প্রশ্ন না করে, ব্যঙ্গ না করে, শুধু শোনে — তাহলেই সে বাঁচে। সেই ভাবনা থেকেই সে মেহেরকে হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠাল — “সময় হলে একটা কফিতে দেখা হবে? কথা বলা দরকার।” আর আশ্চর্যের বিষয়, মেহের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল — “তুই যে এখনও মনে রেখেছিস, সেটাই অনেক। এস, কালই দেখা হোক।” পরদিন বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার এক ক্যাফেতে চারুলতা বসে রইল, চুল খোলা, চোখে হালকা কাজল, গলায় নীল সুতোর হার। সে জানে না কেন, কিন্তু মনে হচ্ছিল — আজ সে আর গৃহবধূ নয়, আজ সে “চান্দের আলো”। আজ সে কথা বলতে এসেছে নিজের ভাষায়, নিজের গল্পে।

মেহের তাকে দেখে হেসে বলল, “তুই এখন আগের থেকে অনেক চুপচাপ হয়েছিস, কিন্তু চোখে কেমন আলো আছে!” চারুলতা একটু ইতস্তত করে নিজের কফির কাপটা ঘুরিয়ে বলল, “তুই শুনবি তো?” মেহের বলল, “তুই বলে যা, আমি শুধু শুনব।” এরপর চারুলতা ধীরে ধীরে খুলে বলতে লাগল — ভাস্করের সঙ্গে তার নিঃশব্দ জীবন, তার ইউটিউব চ্যানেল, সেই অচেনা ‘নীলপাখি’র সঙ্গে তার কবিতাময় সম্পর্ক, নিজের কণ্ঠে খুঁজে পাওয়া সেই পুরোনো আত্মা — যে চারুলতা কবিতা লিখত, মঞ্চে আবৃত্তি করত, অথচ আজ একটা ঘরের কোণে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। মেহের কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে বলল, “তুই জানিস, তুই যা করছিস, সেটা একটা বিপ্লব। তোর এই কণ্ঠে তোর ভেতরের নারী সত্তা উঠে আসছে। সমাজ চায়, মেয়েরা চুপ থাকুক। তুই চুপ না থেকে নিজের শব্দ দিয়েই উত্তর দিচ্ছিস।” চারুলতা এই কথাগুলো শুনে অবাক হলো — কারণ সে প্রথমবার কারও মুখে শুনল যে সে ‘ভুল কিছু করছে না’। এতদিন যে গোপন পথে সে হেঁটেছে, সেই পথেও আলো থাকতে পারে — এটা সে কল্পনাও করেনি।

সেই কফির বিকেলটা চারুলতার জীবনে এক নতুন বাঁক এনে দিল। সে ফিরে এসে রাতে রেকর্ড করল জীবনানন্দ দাশের “আট বছর আগে একদিন”, যেখানে কবির মনেও ছিল এক গভীর হাহাকার, প্রেমের অতল অতৃপ্তি। তার কণ্ঠ এবার ছিল আরও গভীর, আরও আত্মবিশ্বাসী। ভিডিও আপলোডের পর ‘নীলপাখি’ লিখল, “আজ তোমার কণ্ঠে যেন কাঁপুনি নেই, শুধু দীপ্তি। তুমি কি নতুন আলোয় নিজেকে দেখেছো?” চারুলতা এবার উত্তর দিল — “হ্যাঁ, আজ বুঝেছি আমি কেবল কণ্ঠ নই — আমি নিজেই একটি কবিতা।” সেই উত্তর পাঠিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল, যেন নিজের ভেতর নতুন এক নারীর জন্ম অনুভব করছে — যে নারী লুকিয়ে ছিল না, বরং প্রকাশের অপেক্ষায় ছিল।

পাঁচ

বসন্তের হাওয়া কলকাতার রাস্তাগুলোয় উড়ছে, ফুল ফুটছে রাস্তাঘাটে, কিন্তু চারুলতার ফ্ল্যাটে যেন একটা অদৃশ্য চাপা হাওয়া জমে উঠেছে। বিগত কয়েক সপ্তাহ ধরে “চান্দের আলো” চ্যানেলটি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে — নতুন সাবস্ক্রাইবার, প্রচুর মন্তব্য, কিছু সাহিত্য ম্যাগাজিন ও একটি অনলাইন রেডিও থেকে আমন্ত্রণও এসেছে। চারুলতা এসব গোপনে দেখে, পড়ে, হাসে — কিন্তু মুখে এক বিন্দু প্রকাশ করে না। প্রতিদিন সে নিয়ম করে রান্না করে, ভাস্করের চা বানায়, ভাস্করের জুতো মুছে রাখে, আর রাত হলে মোবাইলটা চার্জে লাগিয়ে এক চিমটি নিজের জন্য সময় রাখে। অথচ ভাস্কর, যে নিজের কাজের জন্য লেখে, গবেষণা করে, দেশ-সমাজ নিয়ে ব্যস্ত — সে এখনো জানে না, তার স্ত্রীর কণ্ঠ শহরের অনেক মানুষের ভালোবাসার কারণ হয়ে উঠেছে।

কিন্তু সমস্যা শুরু হয় সেদিন, যখন ভাস্কর এক সাহিত্য পোর্টালে ‘চান্দের আলো’ নামে একটি আবৃত্তিকারকে নিয়ে লেখা রিভিউ পড়ে — যার কণ্ঠ শুনে লেখক মন্তব্য করেছে, “এই কণ্ঠ শহরের নতুন আত্মা, নতুন বিপ্লবের দম।” ভাস্কর মুগ্ধ হয়ে চারুলতাকে পড়ে শোনায়, বলে, “দেখো! মেয়েরা এখন কী অসাধারণ কাজ করছে! একটা চ্যানেল খুলেছে, মুখ দেখায় না, তবু এত জনপ্রিয়তা!” চারুলতা চুপ করে থাকে, ভেতরে কাঁপুনি ওঠে — সে জানে, ওই মেয়েটিই সে। ভাস্করের চোখে তখনও সে এক ‘ভালো স্ত্রী’, যার কাজ ঘর গুছিয়ে রাখা — সৃষ্টিশীলতা যেন তার আয়ত্তের বাইরে। ভাস্কর হাসতে হাসতে বলে, “এদের জন্যই মেয়েরা সাহস পায় আজকাল — তুমিও তো কলেজে কত আবৃত্তি করতে!” চারুলতা মুখ নিচু করে বলে, “আর সেই চারুলতা কোথায় গেছে?” ভাস্কর শুনে না, শোনার প্রয়োজনও বোধ করে না।

রাতে চারুলতা আবার একটা কবিতা রেকর্ড করে — সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের “ভালোবাসা ছুঁয়ে আছে”। তার কণ্ঠে ছিল অভিমান, আকুতি, কিছুটা হতাশা, আর একরাশ অব্যক্ত ভালোবাসা। সে ভিডিওটা আপলোড করে, আর ঠিক তখনই ভাস্কর বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে, “তোমার ফোনটা চার্জে দিয়ে দিলাম, আজ একটু গরম হয়ে উঠেছিল। এত চালিয়ে রাখো না।” চারুলতা চমকে ওঠে — তার ফোনের স্ক্রিন তখনও আবৃত্তির অ্যাপে খোলা ছিল। সে দ্রুত ফোনটা হাতে নেয়, ভয় করে যদি ভিডিও দেখে ফেলে, যদি বুঝে ফেলে সব? কিন্তু কিছু হয় না। ভাস্কর কিছু খেয়াল করেনি। তবুও চারুলতার বুক ধক করে ওঠে। এই সংসারে, এই পরিচয়ের দেয়ালে সে নিজের নতুন সত্তা নিয়ে লুকিয়ে থাকতে পারবে কতদিন?

সেই রাতে সে নীলপাখিকে মেইলে লেখে — “তুমি যদি জানো আমি কে, তুমি কি তবুও আমাকে ভালোবাসবে? যদি আমি বলি, আমি এক গৃহবধূ — যে চা বানায়, ভাত চড়ে দেয়, আর রাতে তোমার কবিতা পড়ে, তুমি কি চমকে যাবে?” উত্তর আসে পরদিন সকালে — “তোমার পরিচয় নয়, তোমার কণ্ঠ, তোমার অনুভব, সেইটাই আমার ভালোবাসা। তুমি কে, কী করো — এসবের চেয়ে অনেক বড় তুমি কীভাবে অনুভব করো।”

চারুলতা কাঁদে — শব্দহীন, নিঃশব্দে। তার স্বামী পাশে ঘুমিয়ে, আর সে অনুভব করে — এই দুটি জগৎ একে অপরকে স্পর্শ করেও মিলছে না। কিন্তু সে জানে, তার কণ্ঠ আর থামবে না। যতক্ষণ সে কথা বলতে পারছে, ততক্ষণ সে হারিয়ে যাচ্ছে না। চারুলতার কণ্ঠই এখন তার অস্তিত্ব।

ছয়

দিন যত গড়াচ্ছিল, চারুলতার মনের মধ্যে জমছিল একরাশ প্রশ্ন, একরাশ কৌতূহল। এই ‘নীলপাখি’ কে? সে কেন এতটা গভীরভাবে তার কণ্ঠের ভেতরের অনুভব ধরতে পারে? কেন তার প্রতিটি শব্দে যেন চারুলতা নিজেকে খুঁজে পায়? একদিন রাতে, মেইলের উত্তরে ‘নীলপাখি’ লেখে, “তুমি আবৃত্তি করো, আর আমি শব্দ খুঁজি। আমরা দুজনেই সৃষ্টির দুই পিঠ — তুমি উচ্চারণ, আমি রচনা।” চারুলতা আবার পড়তে পড়তে ভাবতে থাকে — এই ভঙ্গিমা, এই ছন্দ তো কোথায় যেন পড়েছে! কলেজজীবনে এক কবি বন্ধু ছিল — রুদ্র। রুদ্রনীল ধর। সে-ও এমনভাবে লিখত, একটু বাঁকা রকম ছন্দ, কখনও কখনও বাংলা-ইংরেজি মিশিয়ে ভাব প্রকাশ করত, আর সবসময় বলত — “ভাষা যতটা না মুখে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্পন্দনে।”

কৌতূহল বাড়তে থাকে। একদিন সাহস করে চারুলতা পুরনো ফেসবুক খুঁজে বের করে, অনেক পুরোনো গ্রুপ — যেখানে তার কলেজবন্ধুরা ছিল — ‘ইংলিশ অনার্স ২০০৮’। খুঁজতে খুঁজতে সে দেখতে পায় — রুদ্রনীল এখন বেঙ্গালুরুর এক কলেজে পড়ায়, মাঝে মাঝেই কবিতা প্রকাশ করে কিছু ছোট পত্রিকায়। হ্যাশট্যাগে মাঝে মাঝে ব্যবহার করে — #BlueFeatherThoughts। তার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে — ‘Blue Feather’ তো মানে হয় ‘নীলপাখি’! চারুলতা নিশ্চিত হয় — ‘নীলপাখি’ রুদ্রই। সেই রুদ্র, যে একসময় কলেজে তার আবৃত্তি শুনে কবিতা লিখত, আর যাকে সে সেই অর্থে কোনওদিন ভালোবাসেনি — কারণ ভালোবাসার সাহস হয়তো সে তখন পায়নি।

সেই রাতে চারুলতা একটি ভিডিও রেকর্ড করে — নিজের কলেজজীবনের লেখা একটি ছোট কবিতা, যেটা সে ছাড়া আর কেউ কখনও পড়েনি। কবিতাটি ছিল খুব ব্যক্তিগত, নিজের ভেতরের এক রোদ-ছায়ার কাহিনি, যা সে একদিন রুদ্রর অনুরোধে লিখেছিল, কিন্তু কখনও শোনায়নি। ভিডিও আপলোড করার পর, সে অপেক্ষা করে — উত্তরের। ভোর রাতে ‘নীলপাখি’র কমেন্ট আসে — “এই কবিতার শব্দগুলো আমি চিনি, চারুলতা। এই কবিতা একসময় আমার জন্য লেখা হয়েছিল, মনে আছে?” চারুলতার চোখে জল আসে — এতদিন পরে সেই সম্পর্ক, যেটা শুরুই হয়নি, তা যেন আজ পূর্ণতা পাচ্ছে শব্দের মধ্যে, ছায়ার মধ্যে।

পরদিন সকালে চারুলতা তাকে মেইলে লেখে, “রুদ্র, তুমি জানো আমি কে। তাও তুমি কিছু বলোনি কেন?” রুদ্র উত্তর দেয় — “তুমি যে তুমি, সেটা জানার জন্য তোমার নাম জানা জরুরি নয়। কিন্তু হ্যাঁ, আমি জানতাম, জানতাম সেই প্রথম দিন থেকেই — ‘নির্জর স্বপ্নভঙ্গ’ যে কণ্ঠে আমি শুনেছি, সেই কণ্ঠ আমি কলেজের লনে বহুদিন ধরে শুনতাম। তোমার কণ্ঠ ভুলে যাওয়ার মতো নয়। আমি শুধু চাইছিলাম তুমি নিজেকে খুঁজে পাও — নিজের ছায়া ছাড়িয়ে।” চারুলতা ভেতর থেকে কেঁপে ওঠে — যে পুরুষটি তার কণ্ঠে প্রেম খুঁজে পেয়েছে, সে তার অতীতের সেই চেনা পুরুষ। অথচ আজ এই প্রেম একদম নতুন, একদম ভিন্ন, যেন মুখ নয়, চোখ নয়, কেবল শব্দের ওপর দাঁড়ানো একটি নীরব সম্পর্ক।

তবে তার ভেতরে দ্বন্দ্ব জন্ম নেয় — সে কি রুদ্রকে দেখবে? সাক্ষাৎ করবে? তাকে জানাবে — সে এক গৃহবধূ, যাকে সমাজ প্রতিদিন বাধে, ভাস্করের স্ত্রীর ছায়ায় রোজ হারিয়ে যায়। সে কি রুদ্রের মতো একজন কবির সামনে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে, “তুমি যাকে ভালোবেসেছো, সে কোনো কল্পনার নারী নয়, সে আমি — রান্নাঘরে ভাত বসানো, রাত জেগে কাপড় শুকানো, আর কণ্ঠে লুকিয়ে রাখা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা এক নারী”? সে কি সাহস পাবে?

রাত্রি গভীর হলে সে আবার তার চিরচেনা নীল চেয়ারটায় বসে, মোবাইল অন করে, আর ধীরে ধীরে উচ্চারণ করে — “আমি আজ চুপ করে আছি, কারণ আমার শব্দগুলো এখন নতুন পথ খুঁজছে। আমি কেবল জানি, আমি একদিন শব্দ হয়ে যাবো — তোমারও, আমারও।”

সাত

তিনদিন ধরে চারুলতা কোনও আবৃত্তি রেকর্ড করেনি। নীলপাখির মেলেও উত্তর দেয়নি। তার মনে হচ্ছিল, শব্দের বাইরের জগৎ এখন ঢুকে পড়ছে সেই নিভৃত আশ্রয়ে, যেটা সে এত যত্নে গড়ে তুলেছিল। এতদিন ধরে যে সম্পর্ক ছিল কেবল কণ্ঠ ও কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ — তাতে এবার বাস্তবের মুখ জুড়ে দিতে হবে। ভাস্কর এখনো জানে না কিছুই, অথচ চারুলতার ভেতরে একটা আগুন জ্বলছে — সে নিজেকে পুরোপুরি আর আড়াল করে রাখতে পারছে না। মেহের একদিন তাকে বলে, “ভয় পাচ্ছিস কেন? তোকে তো কেউ কিছু বলেনি। তুই তো কোনো পাপ করোনি। তুই শুধু নিজেকে ফিরে পেয়েছিস।” কিন্তু চারুলতা জানে, সমাজ কীভাবে নারীর সৃজনশীলতা আর স্বাধীনতাকে ‘অবাধ্যতা’ বলে ব্যাখ্যা করে। ভাস্করের মতো প্রগতিশীল মানুষও, হয়তো নিজের স্ত্রীর এমন প্রকাশ দেখে কুণ্ঠিত হবে।

রুদ্র চিঠি পাঠিয়েছে। হাতে লেখা চিঠি। ডাকঘরের সেই পুরনো গন্ধে ভেজা, অদ্ভুত কোমল কাগজের ভাঁজে। সে লিখেছে, “চারুলতা, আমি কলকাতায় আসছি। শুধু একবার তোমার চোখের দিকে তাকাতে চাই। কণ্ঠ শুনেছি বহুদিন, এবার তোমার চুপ থাকা শুনতে চাই।” চিঠি হাতে নিয়ে চারুলতা অনেকক্ষণ বসে থাকে। তারপর একদিন ঠিক করে — সে দেখা করবে। অনেক ভেবে, বহু দ্বন্দ্বের পর, সে একটি পুরোনো কাফে বেছে নেয়, যেটা কলেজ জীবনেও তাদের আড্ডার জায়গা ছিল — কলেজ স্ট্রিটের পাশের সেই বইঘেরা অন্দরমহল।

দেখা হওয়ার দিন সকালে সে চুপচাপ নিজের জামাকাপড় গুছায়। হালকা নীল কুর্তি পরে, গলায় পড়ে সেই স্কার্ফ, যেটা সে প্রথম ভিডিও রেকর্ডিংয়ের দিন পরেছিল। চুল বাঁধে না। মুখে হালকা ঠোঁট রাঙানো, চোখে কেবল কফির দাগের মতো ক্লান্তি। বেরোবার সময় ভাস্কর বলে, “আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো। রাতে এক পার্টিতে যেতে হবে।” চারুলতা শুধু মাথা নাড়ে। সে আজ নিজের পার্টিতে যাচ্ছে — নিজের জীবনের মঞ্চে।

ক্যাফেতে ঢুকে সে দেখে, রুদ্র আগেই এসে বসেছে। একটুও বদলায়নি, শুধু চোখে বয়স এসেছে। ঠোঁটে চাপা হাসি, হাতে চায়ের কাপ। চারুলতা ধীরে ধীরে গিয়ে সামনে বসে। কয়েক সেকেন্ড দুজনেই কিছু বলে না। শুধু চোখে চোখ রাখে — যেন সেই ‘চান্দের আলো’ আর ‘নীলপাখি’র মধ্যেকার সব শব্দ হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। প্রথম রুদ্রই বলে, “তুই যেমন কথা বলিস, ঠিক তেমনই তো। তোর কণ্ঠে যেমনটা ভেবেছি, সামনে এসে মনে হচ্ছে তোর মুখেও একরকম কবিতা লেখা আছে।” চারুলতা হালকা হাসে, বলে, “ভেবেছিলাম ভয় পাবে। আমি গৃহবধূ, সংসারের মেয়ে, তোমার কল্পনার নারীর মতো নই।” রুদ্র চোখ নামিয়ে বলে, “তুই যা, সেটাই আমি খুঁজেছি — তুই যদি শুধু কল্পনায় থাকতি, তাহলে তো তোর কণ্ঠে এত সত্যি থাকত না। তুই সংসারের মধ্যেও কবিতা, এটাই তো সবচেয়ে সাহসী।”

চারুলতা চুপ করে থাকে। তার মনে হচ্ছিল, এতদিন ধরে যে প্রশ্নগুলো ঘুরছিল — সেগুলো সব গলে যাচ্ছে এই শান্ত দুপুরে। রুদ্র বলল, “তুই মুখ না দেখিয়ে এতদিন যে সাড়া পাস, জানিস কেন? কারণ তোর শব্দ সত্যি। মানুষ মুখে ভালোবাসা বলেও বিশ্বাস পায় না, কিন্তু তোর কণ্ঠে কেউ ভালোবাসা খুঁজে পায়।” চারুলতা ধীরে ধীরে বলে, “তুই আমার কণ্ঠ চিনেছিলি?” রুদ্র মাথা নাড়ে। “প্রথম ভিডিওতেই। কিন্তু আমি চেয়েছিলাম তুই নিজে নিজের দিকে ফিরে তাকাস। আমি তো শুধু অপেক্ষা করেছি।”

এই অপেক্ষা, এই মুখোমুখি শান্তি — চারুলতার মনে হলো, সে এখন সম্পূর্ণ। সে কোনো উত্তর খুঁজতে আসেনি আজ, সে এসেছিল নিজেকে আরেকবার দেখে নিতে — যদি ভুলও হয়, সে তার নিজের শব্দে ভুল করুক। দুপুরটা কেটে যায় নিঃশব্দে। কেউ কাউকে ছোঁয় না, কেউ কোনো দাবি করে না। শুধু দুই মানুষের ভেতরে থাকা কবিতা, চোখ দিয়ে বিনিময় হয়।

ফেরার পথে চারুলতা মোবাইলে নতুন ভিডিও রেকর্ড করে — এবার সে নিজের লেখা কবিতা, মুখ দেখা যায় না, কণ্ঠ স্পষ্ট, কিন্তু শেষে প্রথমবার সে নিজের নাম বলে — “আমি চারুলতা সেনগুপ্ত। আমি আমার কণ্ঠ, আমার কবিতা, আর নিজের চুপকথা নিয়ে এসেছি।”

আট

যেদিন চারুলতা নিজের কণ্ঠে নিজের নাম উচ্চারণ করে ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করল, সেদিন থেকেই তার ভেতরের এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস যেন ফুসফুসে আলো ফেলে দিল। সে জানত, এই ভিডিওটা কেবল আবৃত্তি নয় — এটা একটা ঘোষণা। নিজেকে আর গোপন না রাখার শপথ। আজ সে ছদ্মনামে কবিতা শোনায় না, সে তার আসল সত্তা নিয়ে, নিজের জীবনের সমস্ত ছেঁড়া টুকরোগুলো জোড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে — দৃশ্যমান, স্পষ্ট, সাহসী।

সেই রাতে ভাস্কর খাবার টেবিলে বসেই বলে, “আজ তোমার একটা ভিডিও দেখলাম কেউ শেয়ার করেছে — চারুলতা সেনগুপ্ত বলে এক গৃহবধূর আবৃত্তি। অবাক হচ্ছি, কী কণ্ঠ! অবিশ্বাস্য!” চারুলতা চুপ করে থাকে, মুখ নামায়। কিছুক্ষণ পর ধীরে বলে, “ওই কণ্ঠটা আমার।”
ভাস্কর থমকে যায়। তার চামচটা থেমে যায় মাঝপথে। সে বলে, “তোমার মানে? তুমি… তুমি ইউটিউবে ভিডিও দাও?”
চারুলতা এবার সোজা চোখে তাকিয়ে বলে, “হ্যাঁ। আমি ‘চান্দের আলো’। আমি কবিতা পড়ি, মানুষ শোনে, ভালোবাসে। আমি নিজের ছায়ার বাইরে এসে বাঁচতে চেয়েছি।”
ভাস্কর কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “তুমি এটা আমাকে বলোনি কেন?”
চারুলতা শান্ত গলায় বলে, “তুমি কোনওদিন জানতে চাওনি আমি কী চাই। তোমার পৃথিবীতে আমি ছিলাম, কিন্তু আমার কোনো আলাদা সত্তা ছিল না। এই কণ্ঠটা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে সেই আমি-কে।”

ভাস্কর এবার আর রাগ করে না, শুধু নিঃশব্দে উঠে যায়। চারুলতা জানে, আজ তার ভাস্করের চোখে হয়তো অজস্র প্রশ্ন, কিছুটা অভিমানও। কিন্তু সে ভীত নয়। কারণ আজ সে নিজেকে আর আড়ালে রাখবে না। তার যন্ত্রণাও তার সম্পদ, তার কণ্ঠও তার অস্ত্র।

পরদিন সকালে সে মেহেরের ক্লিনিকে বসে — পাশে এক নতুন কাগজে ছাপা সাক্ষাৎকার। শিরোনাম:
“চারুলতা সেনগুপ্ত: এক গৃহবধূর কণ্ঠে শহরের চুপ কথা”
মেহের হেসে বলে, “এই গল্পটা শুধু তোমার নয়, হাজারটা মেয়ের গল্প। কিন্তু তুমি সেটা বলতে পেরেছ, গলায়, স্পন্দনে, সাহসে। এটা ইতিহাস।”

চ্যানেলে এখন হাজার হাজার ভিউ। কমেন্টে অনেকে লিখছে — “আপনার মতো করে কেউ রবীন্দ্রনাথ বলেনি,” “আপনার কণ্ঠে নিজের কষ্ট খুঁজে পাই,” “আপনি শুনিয়ে দেন আমাদের না বলা ভালোবাসা।” কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়ে গেঁথে যায় একটাই মন্তব্য —
“তুমি যেদিন নিজের নাম বললে, আমি চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। আমি জানি, আমি একা নই।” — নীলপাখি

চারুলতা সেই মন্তব্য পড়ে ধীরে ফোন নামিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সামনে খোলা আকাশ, তার চারপাশে শব্দের আলো। সে জানে, তার জীবনের গল্প এখনও শেষ হয়নি। সে শুধু ঘরের চার দেওয়াল ভেঙে একটা দরজা খুলেছে — শব্দের দরজা, কণ্ঠের দরজা, ভালোবাসার দরজা।

সে এবার নিজের লেখা প্রথম কবিতার প্রথম লাইন আবৃত্তি করে ক্যামেরার সামনে —
“আমি আজ শব্দ হয়েছি, আমার চারপাশে আলো — আর আমি জানি, এ আলো আমাকে একা রাখবে না।”

একটি নতুন নারী জন্ম নেয়। আর আমরা তাকে চিনি — তার কণ্ঠে, তার সাহসে, তার নামেই — চারুলতা।

শেষ

1000041395.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *