ঐশী মুখার্জী
পর্ব ১
কলকাতার দুপুরটা ছিল সেই রকম একটা দুপুর, যেটা চুলের গোড়া দিয়ে মাথা গরম করে দেয়। ফ্লাইওভারের নিচে বাস দাঁড়াতে দাঁড়াতে হাঁপিয়ে ওঠে, ছেলেমেয়েরা অফিসের জামা-প্যান্টের নিচে ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে পড়ে। এমনি একটা দুপুরে রোদ্দুর প্রথম পা রাখে তার নতুন অফিসে—এই শহরের এক মাঝারি রকমের আইটি কোম্পানি, নাম ‘টেকমাইন্ড’।
নতুন চাকরি, নতুন পরিবেশ, নতুন মুখ। রোদ্দুরের বয়স পঁচিশ, সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে প্র্যাকটিকাল লাইফে প্রবেশ করেছে। সে স্বপ্ন দেখে—অফিস মানে হবে বন্ধুত্ব, চা, হাসি, হয়তো কোথাও গিয়ে প্রেম।
কিন্তু বাস্তব চুপচাপ থাকে। সকালটা গিয়েছিল ইন্ট্রোডাকশনের মাঝে, কেউ কারও দিকে তাকায়নি ঠিক করে, শুধু HR বলেছিল, “Meet your buddy. He’ll guide you through the process.”
বাডি নামের লোকটা ফাইল খুলে দেখে বলে, “তুমি বসো, আমি টিম লিডারকে ডাকি।”
বাকি সকলে কম্পিউটারের দিকে মুখ গুঁজে বসে। কেউ যেন মুখ তুলেও বলে না, “হাই, নতুন এসেছ?” এইসবের মাঝে রোদ্দুর বাঁচার উপায় খোঁজে।
তাই দুপুর গড়াতেই সে নিজের মতো বেরিয়ে পড়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে। এককাপ চা, সামান্য আলো, কিছু চুপচাপ সময়—এইটুকুই তো দরকার তার।
ক্যাফেটেরিয়া বেশ ছোট, কিন্তু জানালাটা অসাধারণ। বাইরের রোদের আলো এসে একদম কোণের ওই জায়গাটাকে আলাদা করে তোলে। সেখানে গিয়ে বসে রোদ্দুর।
“একটা লাল চা, কম চিনি,” বলতেই পাশ থেকে গলা আসে—
“তুমি এখানে বসো না।”
সে চমকে তাকায়। এক মহিলা, বয়স আনুমানিক ত্রিশ-চত্রিশের মধ্যে, পরনে হালকা হলুদ শাড়ি আর গলায় ছোট্ট একটা লকেট। মুখে কড়া রঙের লিপস্টিক, চোখে সোজাসাপটা চাহনি।
রোদ্দুর একটু কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। “সরি দিদি, আমি জানতাম না—”
মহিলা থামিয়ে দিয়ে বলে, “না না, আমি মানে…এটা আমার জায়গা। মানে, রোজ দুপুরে আমি এখানেই বসি। বই পড়ি। চা খাই।”
রোদ্দুর একটু হেসে বলে, “বাহ! জায়গার মালিকানা?”
মহিলা মুখে আলগা হাসি এনে বলে, “না, আসলে অফিসে একটাই জায়গা যেটা আমার নিজের মনে হয়। এখান থেকে বাইরের গাছটা দেখা যায়। ওটা আমার খুব প্রিয়।”
রোদ্দুর এবার চেয়ার না ছাড়িয়ে বসে পড়ে। “তাহলে ভাগাভাগি করি। আমি নতুন এসেছি। আজকেই জয়েন করেছি। চা খেয়ে চলে যাবো।”
মহিলা এবার মৃদু হেসে চেয়ে থাকে। “তুমি চা-টা কেমন খাও?”
“লাল চা। কম চিনি। টু দ্য পয়েন্ট।”
“সেই তো! আমিও।”
এভাবেই তাদের প্রথম পরিচয়। কোনও হ্যান্ডশেক নয়, কোনও ইনস্টাগ্রাম ফলো নয়। শুধু দুইজন মানুষ, একটাই চায়ের স্বাদ।
তারপর আস্তে আস্তে জানা যায় মহিলার নাম—অনিন্দিতা রায়। তিনি এই কোম্পানির লিগাল টিমে, সাত বছর ধরে কাজ করছেন। বিয়ে করেছেন বছর ছয়েক আগে, শ্বশুরবাড়ি বারুইপুরে। এখন সল্টলেকে ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন।
রোদ্দুর বলে, “আপনি তো পুরনো, আমি একদম কাঁচা। টিপস দিন।”
অনিন্দিতা মাথা নেড়ে বলে, “এখানে খুব একটা কিছু শেখার নেই। সময় গেলে নিজেই বুঝবে, অফিসে কাজ কম, রাজনীতি বেশি। আর সবচেয়ে ভালো হলো—এই জানালার ধারে চুপচাপ বসা। চা খাওয়া।”
সেই থেকে প্রতিদিন দুপুরে দুটো থেকে আড়াইটার মধ্যে দু’জনের দেখা হয় ক্যাফেটেরিয়ায়। কেউ কাউকে না ডাকলেও দু’জন জানে—এই সময়টুকু শুধু ওদের।
একদিন রোদ্দুর হঠাৎ বলে ওঠে, “আপনি গল্প লেখেন?”
“না তো! কেন?”
“আপনার চুপ করে তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হয় আপনি অনেক গল্প জমিয়ে রাখেন, শুধু লেখেন না।”
অনিন্দিতা হেসে বলে, “তুমি বড্ড বেশি পড়ে ফেলো মানুষকে। সাবধানে থেকো। সবাই পছন্দ করে না।”
কিন্তু তার মুখে কোনও বিরক্তি থাকে না। বরং চোখে একটা প্রশ্রয় মেশানো কৌতূহল।
রোদ্দুর মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরেও ভাবে এই মহিলা নিয়ে—কে তিনি? কেন তিনি এত নিঃসঙ্গ? কেন দুপুরবেলা জানালার ধারে বসে এমনভাবে চা খান যেন সেটা কোনও ধর্মীয় আচার?
কিন্তু প্রশ্ন জাগে, উত্তর চায় না।
সেদিন অনিন্দিতা শেষ চা চুমুক দিয়ে বলে, “জানো, এখানে বসলে আমার কলেজের স্মell আসে। তখনও এরকমই জানালার ধারে বসতাম। একা একা।”
রোদ্দুর মনে মনে ভাবে, “তাই তো। কেউ যদি নিজেকে একা রাখে, তবে তার কাছে যাওয়া যায় কি?”
কিন্তু এইসব ভাবনার মাঝেই ক্যাফেটেরিয়ার দেয়ালে ঘড়ি টিক টিক করে চলে। সময় পেরোয়। আর দুইজন মানুষ একসঙ্গে বসে থাকে, এক কাপ লাল চায়ের পাশে।
আজকে ওরা নাম জানে, মুখ চেনে, কিন্তু হৃদয় এখনো মুখ খুলেনি। তবু প্রতিদিন দুপুরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে, দুই অচেনা চা-প্রেমী ফিরে আসে জানালার ধারে।
অফিসের ব্যস্ততার মাঝে ওটাই তাদের ছোট্ট নিজস্ব জগৎ।
চায়ের কাপে প্রথম পরিচয়ের সেই গন্ধটা এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু কেউ এখনো চুমুক দিয়ে বলেনি—“এই যে, আমি তোমাকে একটু ভালোবাসি।”
পর্ব ২
ঘড়ির কাঁটা দুটো ছুঁলেই রোদ্দুর যেন শরীরের ভিতর থেকেই টের পায়—সময় হয়ে গেছে। সকালটা যতই হোক ক্লায়েন্ট কল, স্ট্যান্ড-আপ মিটিং, Jira টিক্টিকানি—দুপুরবেলা ঠিক একটা জানালার ধারে বসে এক কাপ লাল চা খাওয়ার আশাটুকুই তাকে ঠেলে রাখে।
সেই জানালাটা যেন রোদ্দুরের ব্যক্তিগত আকাশ। আর যেদিন অনিন্দিতা পাশে বসে থাকে, তার আকাশে একটা নীলচে আলো পড়ে। কেউ কিছু বলে না, কেউ কিছু চায় না, শুধু চুপচাপ থাকাটা একধরনের আশ্বাস হয়ে যায়।
আজকে অনিন্দিতা আগে এসেছেন। পরনে অফ হোয়াইট একটা জামদানি, খুব হালকা সিঁদুর, একমাথা ক্লান্তি। রোদ্দুর জানে, অফিসে অনিন্দিতা কখনো খুব বেশি কথা বলেন না, টিমের সঙ্গে খুব একটা মেশেন না। কিন্তু এখানে, এই ক্যাফেটেরিয়ার জানালার ধারে, যেন তার ভিতরের আর একটা রূপ বেরিয়ে আসে।
রোদ্দুর এসে বসে। মুখে হাসি।
“আজ আমি দেরি করিনি,” বলে সে।
অনিন্দিতা এক চুমুকে চায়ের কাপ ঠোঁটে রেখে বলে, “আজ তোমার চায়ের অর্ডার আমি দিয়ে দিয়েছি।”
“সত্যি? মনে করে রাখেননি তো!”
“তুমি প্রতিদিন এক জিনিস খাও, মনে রাখা কি খুব কঠিন?”
রোদ্দুর হাসে। কিন্তু সেই হাসির ভিতর একরকম কৃতজ্ঞতা। এমন কেউ, যে ওর চায়ের অর্ডার মনে রাখে, এই শহরে এরকম একজন থাকাটাও তো আশ্চর্যের।
“আপনার তো বই পড়ার অভ্যাস আছে,” বলে রোদ্দুর, “কিন্তু আমি এখন গল্প শুনতে চাই। আজ আপনি কথা বলুন।”
অনিন্দিতা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর জানালার দিকে চেয়ে বলে, “আমার গল্প খুব নির্লজ্জ রকমের সোজাসাপটা। কলেজে পড়তে পড়তে এক ছেলেকে ভালো লাগল। বাবার পছন্দ হয়নি। শেষে ওই ছেলেটাই বাবাকে রাজি করিয়ে বিয়ে করল। তারপর চাকরি, সংসার, শাশুড়ির অশান্তি, বাচ্চা না হওয়ায় ঘর আলাদা, আর আমি এই টেকমাইন্ডের ‘লিগাল’ বিভাগে।”
রোদ্দুর শান্তভাবে চা চুমুক দেয়। তারপর বলে, “কখনো পালাতে ইচ্ছে করে না?”
অনিন্দিতা হেসে ফেলে। “কোথায় পালাবো? পালিয়ে গিয়ে কী করবো? আরও এক কাপ চা খাবো?”
“আপনার মনে হয় না আপনি এখনো অসম্পূর্ণ?”
“আমরা সবাই কি কোনও না কোনওভাবে অসম্পূর্ণ নই রোদ্দুর?”
এই কথাটা এতখানি শান্তির সঙ্গে বলা যে রোদ্দুর আর কিছু বলে না। ও জানে, জীবনে কিছু মানুষ থাকে, যাদের সঙ্গে আপনি কোনও প্রশ্ন না করেই বোঝেন—এই মানুষটা আসলে অনেক কথা না বলেই সবচেয়ে বেশি বলে।
আজ বাইরের গাছে একজোড়া দোয়েল ডানা ঝাপটাচ্ছে। আলোটা নরম, বাতাসটা অলস। অনিন্দিতা সেই আলোয় যেন একটা জলছবির মতো লাগে।
“আপনার নাম রোদ্দুর কেন রেখেছিলেন জানেন?” হঠাৎ জানতে চায় অনিন্দিতা।
“আসলে আমার মা খুব রোদ ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, ‘রোদ্দুর সবসময় দরকার, মানুষটাকে গরম রাখে।’ সেই জন্য। পরে বুঝলাম, মানুষ হয়তো ছায়ায় বাঁচে, কিন্তু একটা রোদ্দুর দরকার, চোখের ভেতর আলো রাখার জন্য।”
অনিন্দিতা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ।
তারপর বলে, “তুমি যদি একদিন না আসো, আমি কফি খাবো।”
রোদ্দুর চমকে তাকায়। “মানে?”
“মানে এই যে অভ্যেসটা, সেটাকে ভাঙতে হবে। আজ না হোক, কাল—তুমি বদলি হবে, আমি হয়তো রিটায়ার করবো। তখন এই জানালাটা খালি হয়ে যাবে।”
“তবু জানালাটা থাকবে।”
“হয়তো। কিন্তু জানালায় তখন শুধু রোদ থাকবে, কথা থাকবে না।”
রোদ্দুর আজ প্রথমবার খেয়াল করে, এই মহিলা তার চেয়ে অনেক পরিণত। জীবনের দুঃখকে মুখে না এনে যেন হৃদয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। আর রোদ্দুর, যাকে সবাই বলে ‘ইমোশনালি ইনটেলিজেন্ট’, সে বুঝেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না—এই মহিলার ভিতরে কতটা শূন্যতা জমে আছে।
চা ঠান্ডা হয়ে আসে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দুই।
দু’জনেই বোঝে, এবার ওঠা উচিত। কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়ায় না।
“কাল দেখা হবে তো?” জিজ্ঞেস করে রোদ্দুর।
“হবে না কেন? আমি তো জানালাটাকে ছেড়ে যেতে পারবো না।”
রোদ্দুর মনে মনে ভাবে, জানালাটা তো এক অজানা প্রেমের আড়াল। যেখানে দু’জন মানুষ চুপচাপ বসে থাকে। প্রেম বলে না, কিন্তু অনুভব করে।
জানালাটা দাঁড়িয়ে থাকে। রোদে ভিজে। চায়ের গন্ধে ভরে ওঠে দুপুরের সময়। আর অনিন্দিতা আর রোদ্দুর একসঙ্গে বসে, একটুকরো নিঃশব্দ ভালোবাসার নাম দেয়—বন্ধুত্ব। অথবা, হয়তো একটু বেশি কিছু।
পর্ব ৩
রোদ্দুর আজ একটু দেরি করে অফিসে ঢুকল। ব্যাগটা চেয়ার-এ ছুঁড়ে রেখে চোখ ঘোরাতেই বোঝা গেল—আজ টিমের কারও মেজাজ ভালো না। ম্যানেজার সকাল সকাল একটা মেইল পাঠিয়েছেন: “তিনটা টার্গেট মিস হয়েছে, পরের সাতদিন কেউ ছুটি চাইবে না।”
সবাই মুখ গুঁজে আছে স্ক্রিনে। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না। রোদ্দুর বুঝতে পারে—এই অফিসের একটা অলিখিত নিয়ম আছে: সকালে কেউ হাসে না। আর দুপুরে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়েই যদি একটু প্রাণ পাওয়া যায়, সেটাই যথেষ্ট।
তাই দুপুর দেড়টা বাজতেই সে সোজা উঠে পড়ে।
আজ জানালার ধারে এখনও কেউ বসেনি।
চোখ টিপে দেখে নিল—না, অনিন্দিতা আসেননি এখনো।
ওই জায়গাটা ফাঁকা থাকলে রোদ্দুরর মনে অদ্ভুত এক হালকা চাপ পড়ে। কে যেন কানে ফিসফিসিয়ে বলে, “তুমি কি আসবে না?”
সে দুটো চা অর্ডার দেয়। একটাই অর্ডার, দুটো কপি—লাল চা, কম চিনি।
মাঝে মাঝে ভাবতে থাকে—এটা কি অভ্যাস? না কি অভ্যেসের নামে কোনো না বলা টান?
ঠিক তখনই পায়ের আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে অনিন্দিতা আসছেন। আজ পরনে নেভি ব্লু একটা শাড়ি, চোখে কাজল। মুখে আজ একটু হাসি কম।
চুপচাপ এসে বসে পড়েন।
“আজ খুব মুড নেই মনে হচ্ছে,” বলে রোদ্দুর।
অনিন্দিতা মাথা নেড়ে বলেন, “না, মুড না। মন।”
“মন?”
“মনটা আজ কথা বলছে না। মনে হচ্ছে সব শব্দ হারিয়ে গেছে।”
রোদ্দুর একটু চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, “তাহলে আমরা আজ কথা বলব না। শুধু বসে থাকব। চা খাব। জানালার দিকে তাকাবো। শব্দ ছাড়া। কি বলেন?”
অনিন্দিতা তাকান না, শুধু মাথা ঝাঁকান হালকাভাবে।
ওরা দু’জন আজ চুপ করে বসে থাকে। একেবারে একটানা। শুধু মাঝে মাঝে চা চুমুক দেওয়ার শব্দ, আর বাইরে পাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ।
এই নীরবতা অস্বস্তির নয়। এইটা যেন একধরনের শান্তি, একটানা নিঃশ্বাস ফেলার মতো।
রোদ্দুর জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখে—বাইরের ছোট গাছে একজোড়া দোয়েল বসে। একটার গায়ে অন্যটা ঠোকর মারছে। যেন ভালোবাসারই কোনো অদ্ভুত রকম প্রকাশ।
“আপনি কোনোদিন কাউকে এমন ভালোবেসেছেন যে শুধু পাশে বসে থাকলেই হতো?” হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসে রোদ্দুর।
অনিন্দিতা চমকে তাকান।
“মানে?”
“মানে, ভালোবাসা যেখানে স্পর্শ বা চুমু বা শব্দ কিছুই নয়, শুধু একটা উপস্থিতি। যেমন আপনি আছেন, আমি আছি। কিছু বলি না, শুধু থাকি।”
অনিন্দিতা এবার একটু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
“একটা সময় ছিল, যখন মনে হতো, ভালোবাসা মানে ছোঁয়া, ঘ্রাণ, কথা। এখন বুঝি, সেটা একটা কাঁচা বয়সের ভালোবাসা ছিল। এখন আমি যা খুঁজি তা নিঃশব্দ।”
“তাহলে তো আমরা কিছুটা একরকম।”
“তুমি এত কম বয়সে এত অনুভব করো কেমন করে রোদ্দুর?”
“হয়তো, আমি জীবনে অনেক কথা শুনেছি কিন্তু কোনো কথার মানে পাইনি। তাই চুপ করে থাকাটাই আমার ভাষা হয়ে গেছে।”
অনিন্দিতা একটু হাসেন। ঠোঁটের কোণে, খুব হালকা একটা হাসি।
“তোমার এই বয়েসে আমি ঠিক বিপরীত ছিলাম। হইচই, কথা, প্রেম, নাটক—সব চাইতাম। কিন্তু শেষমেশ বুঝলাম, যে বেশি চায়, সে সবকিছু হারায়।”
রোদ্দুর বলে, “তবে আপনি এখন যা, সেটাই তো আসল অনিন্দিতা।”
“হয়তো। হয়তো এই জানালার ধারে বসে চা খাওয়া অনিন্দিতা-টাই আমি। বাকি অফিস, সংসার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম—সবই বাইরের মুখোশ।”
চা শেষ হয়ে আসে।
হঠাৎ অনিন্দিতা বলে ওঠেন, “আজকে একটু আগে উঠতে হবে আমাকে। একটা ক্লায়েন্ট মিটিং আছে। একটু সিরিয়াস কেস। আমি হয়তো কাল আসতেও পারবো না।”
রোদ্দুরর মনে হালকা একটা শূন্যতা খোঁচা দেয়।
কিন্তু মুখে হাসি রেখে বলে, “কোনো চিন্তা নেই। আমি জানালার পাশে চা খেতে থাকবো। আপনি না এলেও ঠিক অপেক্ষা করবো। হয়তো আপনি না এলেও আপনার গন্ধ থাকবে এখানে।”
অনিন্দিতা তাকিয়ে থাকেন খানিকক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ান।
চেয়ার থেকে ওঠার সময় বলেন, “এই যে চুপচাপ বসে থাকাটা, এটাই আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল। কেউ এমন হোক, যার সঙ্গে কিছু না বললেও একটা সম্পর্ক জন্মায়। হয়তো সেটাই তুমি। অথবা, হয়তো আমি কল্পনা করছি। যাই হোক…ভালো থেকো।”
তিনি চলে যান।
রোদ্দুর চুপ করে বসে থাকে জানালার পাশে। এক কাপ ঠান্ডা লাল চা হাতে নিয়ে সে বুঝতে পারে—সব কথার উত্তর কথা দিয়ে হয় না। কখনো কখনো চুপ করে থাকাটাই ভালোবাসার সবচেয়ে খাঁটি প্রকাশ।
আর সেই চুপচাপ প্রেমের মধ্যেই একটা অদ্ভুত, গভীর, কোমল বন্ধন তৈরি হয়।
কথা যত কম, অনুভব তত বেশি।
পর্ব ৪
রোদ্দুর সকাল থেকে অস্থির। আজ বৃহস্পতিবার, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন রোববারের মতো সময় থমকে গেছে। অনিন্দিতা বলেছিলেন, “হয়তো কাল আসতে পারবো না”—এই কথাটা কাল থেকেই তার মাথার মধ্যে গেঁথে বসেছে।
সকালবেলা মেইল চেক করতে করতেই সে বারবার চোখ রাখছে ডেস্কের কোণায় রাখা ঘড়িটার দিকে। প্রতিবার সাঁই করে সেকেন্ড হ্যান্ডটা যখন একবার করে ঘোরে, মনে হয় কোনো এক ছায়ামূর্তি তার দিকে এগিয়ে আসছে—কিন্তু ধরা দিচ্ছে না।
সাড়ে বারোটার সময়েই সে উঠে পড়ে। টিম লিডারের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমি একটু ব্রেক নিচ্ছি। মাথাটা কেমন যেন ভার হয়ে আছে।”
নিমেষে সে নিচে নামে। আজ হাতে একটাও ফাইল নেই, মাথায় একটাও ক্লায়েন্ট কল নেই—শুধু একটা অদৃশ্য টান নিয়ে সে ক্যাফেটেরিয়ায় পৌঁছায়।
জানালার ধারে সেই চিরচেনা টেবিল। চেয়ারের উপর আলো পড়ে আছে, যেন কেউ একটু আগে উঠে গেছেন।
রোদ্দুরর বুকের মধ্যে একটা আশার আলো জ্বলে ওঠে। হয়তো এসেছিলেন… হয়তো মাত্র কিছুক্ষণ আগেই…
কিন্তু চেয়ারের গায়ে কোনও ভাঁজ নেই, কাপে চায়ের দাগ নেই।
সে জানে, আজ অনিন্দিতা আসেননি।
তবু সে দুটো চা অর্ডার দেয়। লাল চা, কম চিনি।
একটা নিজের জন্য। আর একটা, না আসা সেই নারীর জন্য, যার অভাব আজ এতটা তীব্র যে রোদ্দুর বুঝতে পারছে না সে বসে আছে কি দাঁড়িয়ে আছে।
চায়ের কাপ এসে যায়। ভাপ ওঠা সেই লালচে জল দেখে তার মনে পড়ে যায় অনিন্দিতার ঠোঁট ছুঁয়ে থাকা সেই শেষ চুমুক। মুখে কিছু না থাকলেও চোখে লেগে থাকত ক্লান্তির পাশাপাশি একটা অদ্ভুত প্রশান্তি।
রোদ্দুর চোখ বন্ধ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ। বাইরে গাছের পাতাগুলো আজও দোল খাচ্ছে, কিন্তু মনে হয় যেন দোয়েল দুটোও আজ অনুপস্থিত।
তার মনে পড়ে, একবার মায়ের সঙ্গে ছেলেবেলায় যখন দিঘা বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানেও এমন অনুভব হয়েছিল—সব কিছু আছে, শুধু কেউ নেই। সেই শূন্যতা, সেই অভাব তখন তার ছিল না বোঝার বয়স, কিন্তু আজ বুঝতে পারছে—এই অনুভূতিই আসলে ‘প্রতীক্ষা’।
হঠাৎ মোবাইলটা ভাইব্রেট করে ওঠে। দেখে—একটা নাম্বার, সেভ করা নেই।
সে রিসিভ করে।
ওপাশ থেকে ভেসে আসে খুব চেনা গলা—“চা খাচ্ছো?”
রোদ্দুর একটু চমকে উঠে বলে, “আপনি?”
“হ্যাঁ। অফিস আসতে পারিনি। সকালে একটু ব্লাডপ্রেশার লো হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে বিশ্রাম নিতে।”
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
“হ্যাঁ। একটু ক্লান্ত লাগছে শুধু। জানালার ধারে আজ তুমি একা হয়তো।”
“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি তো রয়েছেন… গলায়। ফোনে। চায়ের কাপের পাশে।”
ওপাশে খানিকটা চুপচাপ।
তারপর অনিন্দিতা বলেন, “তুমি জানো, আজ সকাল থেকে বারবার মনে হচ্ছিল, যেন কিছু একটা ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি চা খেতে গেলাম, কিন্তু আমার চায়ের সেই টেস্টটাই নেই। মনে হলো, হয়তো তোমার সঙ্গে না বসলে চা আর চা থাকে না।”
রোদ্দুরর গলা শুকিয়ে আসে।
সে আস্তে করে বলে, “আপনি জানেন, আমি আজও আপনার জন্য একটা চা অর্ডার করেছি? সেটা এখনও ঠান্ডা হয়ে আছে। আমি খাবো না ওটা। থাক।”
“রেখে দাও। আমি কাল এলে খাবো।”
এই কথাটুকু শুনে রোদ্দুরর চোখে পানি এসে যায় কিনা সে নিজেও বুঝতে পারে না।
সেদিন চুপচাপ বসে থেকে সে শুধু চায়ের কাপ দুটোকে সামনে রেখে ভাবে—মানুষে মানুষে যতরকম সম্পর্ক হয়, তার মধ্যে কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে একদম নিজের মতো।
এই সম্পর্কের কোনও নাম নেই। না বন্ধুত্ব, না প্রেম, না সহানুভূতি।
এটা একধরনের টান—যেখানে মানুষ ছুঁয়ে থাকে দূর থেকে, শব্দ ছাড়াই।
হাতে থাকা গরম চা ঠান্ডা হয়ে আসে। রোদ্দুর সেই কাপটা সরিয়ে রাখে না। বরং চোখ বন্ধ করে রাখে যতক্ষণ না বাইরের আলো ম্লান হয়ে আসে।
সে জানে, এই অপেক্ষাটা ছুটি নয়—এই ছোঁয়াটা স্পর্শ নয়।
তবু এটা প্রেম। তার মতো করে, নীরব ভালোবাসা।
পর্ব ৫
সোমবার সকালে রোদ্দুর অফিসে ঢোকার আগেই বুকের ভেতর একরকম ব্যাকুলতা। শুক্রবারের ফোনালাপের পর শনিবার-রবিবার কাটেনি, যেন ঝুলে ছিল। ঘুমের ভেতরেও বারবার চায়ের কাপ, জানালার ধারে অনিন্দিতার মুখ, আর তার ভাঙা গলায় বলা—”রেখে দাও, আমি কাল এলে খাবো”—এই কথাগুলো ফিরে ফিরে এসেছে।
রোদ্দুর অফিসের লিফটে চেপে বারবার নিজের জামা ঠিক করে, চুল হাত বুলিয়ে দেখে। এমনটা সে আগে কখনও করেনি।
দুপুর সাড়ে বারোটা। সে নিচে নেমে দেখে, আজ জানালার ধারে আগেভাগেই কেউ বসে পড়েছে।
হ্যাঁ, অনিন্দিতা।
চুলটা আজ খোলা। পরনে হালকা মেরুন রঙের কুর্তা, চোখে আবার সেই কাজলের রেখা। তবে মুখে একধরনের নরম ক্লান্তি আজও রয়ে গেছে।
রোদ্দুর সামনের চেয়ারে বসে পড়ে।
“ফিরলেন?”
“ফিরলাম। জানালার টান যে ছাড়ে না রোদ্দুর।”
সে হেসে বলে, “আপনার চা অর্ডার আগেই দিয়েছি। ওটাই তো আমার একমাত্র রুটিন।”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আজ দুজনেই যেন জানে—আজ কিছু একটা হবে, আজ কথা এগোবে।
অনিন্দিতা চা চুমুক দিয়ে বলেন, “তুমি জানো, তুমি আসার আগে আমি কাউকে কিছু বলতাম না এখানে। এই ক্যাফেটেরিয়া ছিল আমার একান্ত জায়গা।”
“তাহলে আমাকে কেন জায়গা দিলেন?”
“হয়তো তুমি এমন একটা প্রশ্ন করেছিলে, যেটা বহুদিন কেউ করেনি।”
“কোনটা?”
“আমাকে ছুঁতে না এসে আমার গল্প জানতে চেয়েছিলে।”
রোদ্দুর মাথা নিচু করে। “আপনার গল্পটা বলবেন? সেই কলেজ, সেই প্রেম, সেই সংসার… আমি শুনতে চাই। আপনি চাইলে, চুপ করে বসেও শুনবো।”
অনিন্দিতা জানালার বাইরে তাকিয়ে বলেন, “তখন আমার বয়স ছিল একুশ। প্রেসিডেন্সিতে ইংরেজি অনার্স পড়ি। আমার ব্যাচে একটা ছেলে ছিল—তিলক। প্রচণ্ড স্মার্ট, গিটার বাজাতো, আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ছিল। আমি তিলকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। অনেকটা তোমার মতো ছিল ছেলেটা, হাসিখুশি, বোকা, অনুভবী।”
রোদ্দুর চোখ নিচু করে হাসে।
“তিলক বলতো, সে বড় হবে, থিয়েটার করবে, গল্প লিখবে, কিন্তু কখনও একঘেয়ে চাকরি করবে না। আমি তখনই জানতাম, ওর সঙ্গে সংসার হবে না। তবু ভালোবাসলাম।”
“তারপর?”
“তারপর বাবা খুঁজে দিলেন সুব্রত। ব্যাংকের চাকরি, গাড়ি, ফ্ল্যাট। মা বললেন, মেয়ের ভবিষ্যৎ এরকম ছেলের সঙ্গেই হবে। আমি কিছু বলিনি। বাবার মুখের দিকে চেয়ে তিলককে ছেড়ে দিলাম। শেষদিন তিলক বলেছিল—‘তুমি চলে গেলে আমার গল্প থেমে যাবে।’ আমি বলেছিলাম—‘তোমার গল্প তো শুধু তুমিই।’ কিন্তু আমি জানতাম, আমি ওর গল্প থেকে হারিয়ে যাচ্ছি।”
রোদ্দুর চোখ তুলে তাকায়। “এখনো যোগাযোগ আছে?”
“না। তিলক হয়তো কোনও পাহাড়ে নাটক করছে, হয়তো কোনো মেয়েকে নিয়ে নতুন জীবন শুরু করেছে। বা হয়তো শুধু একলা।”
“আপনি কখনও খোঁজ নেননি?”
“নিইনি। কারণ আমি ভয় পাই। আমি ভয় পাই, যদি ও খুব সুখে থাকে, তাহলে নিজেকে দোষী মনে হবে। আবার যদি খুব কষ্টে থাকে, তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”
চুপচাপ কিছুক্ষণ দুজনেই বসে থাকে।
রোদ্দুর আস্তে করে বলে, “আপনি কি এখনো ওকে ভালোবাসেন?”
অনিন্দিতা চা শেষ করে রাখেন। তারপর বলেন, “ভালোবাসা একটা সময়ের মতো। পেরিয়ে গেলে সে রয়ে যায় স্মৃতি হয়ে। আর কিছু স্মৃতি কখনো স্পর্শ করা উচিত নয়। তুমি কি বুঝতে পারো?”
রোদ্দুর বলে, “হয়তো। কিন্তু আমি বুঝি, কেউ কেউ শুধু মুছে ফেলার জন্য আসে না। কেউ কেউ আসে থেকে যাওয়ার জন্য।”
অনিন্দিতা তাকিয়ে থাকে রোদ্দুরের চোখে। সেই চোখে কোনো দাবি নেই, কোনো কষ্ট নেই—শুধু একরকম নিঃশব্দ উপলব্ধি।
সে বলে, “তুমি জানো, তিলকের পরে আর কখনও কেউ আমার কাছে এভাবে আসেনি। কেউ না। তুমি সেই দ্বিতীয় মানুষ, যে আমার গল্প জানতে চেয়েছে, আমাকে ছুঁতে না এসেও ছুঁয়েছে। জানো, এই ছোঁয়াটা সবচেয়ে সত্যি।”
রোদ্দুরের চোখে জল আসে।
“তবে একটা কথা বলবো অনিন্দিতা দি?”
“বলো।”
“আপনার গল্প আপনি আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন। আর আমি সেই গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায় হতে চাই, যদি আপনি চান।”
অনিন্দিতা কিছু বলেন না। শুধু হাতটা চায়ের কাপে রাখেন। কাপ ঠান্ডা। তবু সেই গন্ধটা আজও একই রকম—একটা পুরোনো ভালোবাসার মতো, যেটা এখনও হৃদয়ে ঝিমিয়ে পড়ে থাকে।
পর্ব ৬
সকালবেলার ঘুমটা আজ একটু হালকা হয়েছিল রোদ্দুরের। মোবাইল স্ক্রিনে ঘড়ির সময় দেখতে দেখতে প্রথমেই চোখে পড়ে একটা নোটিফিকেশন—Facebook reminders: Happy Birthday Roddur! Hope you have a wonderful day.
সে চোখ কুঁচকে হাসে। জন্মদিন… এখন আর জন্মদিনে উচ্ছ্বাস থাকে না। ছোটবেলায় যেমন থাকত মা’র হাতে লুচি-আলুর দম, পাড়ার পিসিদের কাছে একরাশ আশীর্বাদ আর বিকেলে কাগজে মোড়া বইয়ের গিফট—সেই দিনগুলো এখন শুধু ফোনের স্মৃতিতে জমা পড়ে থাকে। এখন জন্মদিন মানে কয়েকটা “HBD bro”, কিছু ওয়ার্ক মিটিং এড়ানোর অছিলা, আর যদি ভাগ্য ভালো থাকে তো কারও একটা “তুই এখনও একাই আছিস?” টাইপ প্রশ্ন।
সে অফিসে পৌঁছে খুব বেশি আড়ম্বর না করে ডেস্কে বসে পড়ে। মাথার মধ্যে কিন্তু একটা কৌতূহল খচখচ করছে—অনিন্দিতা কি মনে রেখেছেন?
সকালটা কাটে রুটিনমাফিক। ক্লায়েন্ট মিটিং, একগাদা ইনবক্স, আর টিম লিডার বারবার রিমাইন্ডার পাঠাচ্ছে—“রিপোর্ট ডান করে দাও।”
রোদ্দুর ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে বারোটা বাজতে না বাজতেই সে নিচে নেমে যায়। আজ একটু তাড়াহুড়ো যেন।
ক্যাফেটেরিয়ার দরজার কাছে এসেই তার বুকটা ধক করে ওঠে।
জানালার ধারে বসে আছেন অনিন্দিতা। টেবিলের উপর একটা ছোট্ট প্যাকেট রাখা, তার পাশে রাখা দুটো চায়ের কাপ। একটাতে এখনও ভাপ উঠছে।
সে চুপচাপ গিয়ে বসে।
“আপনি এসেছেন?”
“আমি আসি না এমন দিন কখনো হয়েছে?”
রোদ্দুর একটু ইতস্তত করে বলে, “আপনি জানলেন কিভাবে?”
“কি?”
“আজ আমার জন্মদিন।”
অনিন্দিতা হালকা হেসে বলেন, “আমি তো সেই প্রথম দিনেই বলেছিলাম—আমি যতটা চা খাই, ততটাই মানুষের মন পড়ি। তোমার মেনশন, তোমার কথা, আর গতকাল অফিসের HR-এর ফরম দেখেই বুঝে গেছি।”
রোদ্দুর অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।
“এই নাও,” অনিন্দিতা প্যাকেটটা এগিয়ে দেন। “তেমন কিছু না, ছোট একটা ডায়েরি। আমার প্রিয় জিনিস। আমি ভাবলাম, তোমারও কাজে লাগতে পারে।”
রোদ্দুর প্যাকেট খুলে দেখে—একটা সাদা কাভারের হার্ডবাউন্ড ডায়েরি, মসৃণ পাতা, আর প্রথম পাতায় লেখা—
“লেখো, যতটা চাও। শব্দ না থাকলেও, নীরবতা হোক ভাষা।”
তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
“আপনি জানেন, এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় গিফট আজ পর্যন্ত?”
“তাই তো ভাবছিলাম। বাকিদের কাছে হয়তো ব্র্যান্ডেড কিছু ভালো, কিন্তু তোমার কাছে হয়তো একটা অনুভূতিই যথেষ্ট।”
চা আসতেই দুজনেই কাপ তুলে নেয়। রোদ্দুর চোখ বন্ধ করে বলে, “আজ সকালে উঠে প্রথম যেটা ভাবছিলাম, তা হলো—এই দিনটা যদি কেউ একটু নিজের মতো করে ছুঁয়ে দেয়, তাহলেই অনেক কিছু ফিরে আসে। আপনি সেটা করলেন।”
অনিন্দিতা মুচকি হাসেন।
“তুমি জানো, আমি এত বছর পরে কারো জন্মদিন মনে রেখেছি?”
“তিলকের?”
“না। তিলকেরটা ইচ্ছা করেই ভুলে গেছি। কিন্তু তোমারটা ভুলিনি। কারণ তুমি আমাকে একটা জানালার পাশে বসতে শিখিয়েছ, শব্দ ছাড়া কথা বলতে শিখিয়েছ, আর এমনভাবে চেয়ে থাকতে শিখিয়েছ, যেন কেউ না বলেও অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়।”
রোদ্দুর একটু চুপ করে থাকে।
তারপর বলে, “আপনি কি জানেন, আপনার সঙ্গে প্রতিদিন দুপুরে চা খাওয়ার এই ছোট্ট সময়টুকুই আমার সবচেয়ে প্রিয় সময়? এই সময়টা আমার জীবনের সেই একমাত্র মুহূর্ত যেখানে আমি নিজে হয়ে থাকতে পারি। কোনো মুখোশ নেই, কোনো অফিস-ভাব নেই।”
অনিন্দিতা মাথা হেঁট করে বলেন, “তোমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার মনে হয়, আমি এখনও বাঁচি। আমি এখনও সেই অনিন্দিতা, যে একদিন বই পড়তো, কবিতা লিখতো, জানালার পাশে বসে স্বপ্ন দেখতো।”
রোদ্দুর আস্তে করে অনিন্দিতার হাতে রাখা কাপের পাশে নিজের আঙুল রাখে। ছুঁয়ে না গিয়ে, ঠিক পাশে। যেন শুধু জানিয়ে দেয়—“আমি এখানে আছি।”
এক মুহূর্ত—কোনো শব্দ নেই।
তারপর অনিন্দিতা বলেন, “রোদ্দুর, একটা কথা বলি? যদি কখনো কোনো একদিন আর না দেখা হয়, যদি জীবন আবার নতুন মোড় নেয়, এই জানালাটা ভুলে যেয়ো না। এখানে আমাদের গল্প লেখা আছে।”
রোদ্দুর মৃদু কণ্ঠে বলেন, “যেদিন আপনি থাকবেন না, সেদিন আমি এই জানালার ধারে দাঁড়িয়ে এক কাপ লাল চা খাবো। আপনার গল্প আবার করে পড়বো, ডায়েরির পাতায়।”
অনিন্দিতা চোখের কোণে একটু জল চাপা দেন।
রোদ্দুর হাসে। “আজ জন্মদিনে আপনার থেকে বড় উপহার আর কিছু হতে পারে না। আপনি আছেন, সেটাই অনেক।”
বাইরে সূর্য খানিকটা ঢলে পড়েছে। জানালার ফ্রেমে হালকা সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছে।
চায়ের কাপ ফাঁকা হয়ে আসে। কথা থেমে যায়। কিন্তু অনুভব থেকে যায়, স্পর্শ ছাড়াও।
একটা জন্মদিন… আর একটুকরো ভালোবাসা—যা বলেও বলা হয়নি, তবু থেকে গেছে নীরবতার ভিতরে।
পর্ব ৭
পরদিন দুপুরটা অন্যরকম। আজ রোদ্দুর চুপচাপ বসে থাকে ডেস্কে। মাথার মধ্যে একটা শব্দ বারবার ঘুরছে—“যদি কখনো আর না দেখা হয়…” অনিন্দিতা যা বলেছিলেন গতকাল, জন্মদিনের দিনে, সেই কথাটা যেন একেবারে ঘাঁ করে বসেছে হৃদয়ের ভেতর।
রোদ্দুর বুঝে উঠতে পারে না—ওটা কি শুধু এক রকমের কাব্যিক কথা ছিল? না কি কোনও পূর্বাভাস?
এমন ভাবনার মধ্যেই দুপুর হয়, আর সে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে এগোয়।
আজ একটু আগে গিয়েও সে অবাক হয়। জানালার ধারে চা পড়ে আছে, কিন্তু চেয়ারে কেউ নেই।
সে কাছে গিয়ে দেখে—একটা কাপ খালি, আরেকটায় চা অর্ধেক, ঠান্ডা হয়ে আছে।
অদ্ভুত একটা কষ্ট ঢুকে যায় বুকের ভেতর। সে চারপাশে তাকায়—অনিন্দিতা কোথাও নেই।
কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে। মিনিট দশেক। তারপর পেছনে ফিরে চলে আসতে যাচ্ছিল, এমন সময় শোনে পেছন থেকে গলা—“তুমি আজ একটু দেরি করেছিলে।”
সে ফিরে তাকায়। অনিন্দিতা। মুখে একটা আলগা ক্লান্তি, চোখে অস্বস্তির ছাপ।
রোদ্দুর বলে, “আমি সাড়ে বারোটাতেই বেরিয়েছিলাম। আপনি হয়তো একটু আগে এসেছেন।”
“হ্যাঁ, আজ ক্লায়েন্ট মিটিং ক্যান্সেল হয়ে গেল হঠাৎ। ভেবেছিলাম একটু আগে এসেই বসি।”
রোদ্দুর ধীরে ধীরে বসে পড়ে। তবু যেন মনে হয়, কোথাও একটা অদৃশ্য দূরত্ব ঢুকে পড়েছে।
চা এনে দেয় ক্যাফেটেরিয়ার বয়। দুজনেই চুপচাপ চা চুমুক দেয়, কিন্তু আজ সে নৈঃশব্দ্য আর আগের দিনের মতো নরম নয়। আজ সেটা কেমন যেন ঠান্ডা, টানটান।
রোদ্দুর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?”
“মানে?”
“মানে, কাল আপনি যা বললেন—‘যদি আর দেখা না হয়’—আপনি কি সেটা বললেন কারণ আপনি কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন?”
অনিন্দিতা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলেন, “না, আমি আসলে…”
তিনি থেমে যান। কথা আটকে যায় গলায়।
রোদ্দুর আরও কাছে এসে বলে, “আপনি কি কারও কাছ থেকে চাপ অনুভব করছেন?”
“তোমার সঙ্গে বসা নিয়ে?”
“হ্যাঁ।”
“না রোদ্দুর, চাপ না। কিন্তু… মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা দুজনেই এই জানালার পাশে একটা গল্প গড়ে তুলেছি, যেটা হয়তো বাস্তবের সঙ্গে খুব বেশি খাপ খায় না।”
“কেন মনে হয়?”
“কারণ এই অফিসটা খুব ছোট। এখানে গল্প বানাতে সময় লাগে না। আর আমি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, যেখানে একটা মিসস্টেপ আমার ব্যক্তিগত জীবনেও ধাক্কা দিতে পারে।”
রোদ্দুর এবার চুপ করে যায়।
সেই চুপ করে যাওয়ার মধ্যে একটা অজানা দুঃখ জমে। মনে পড়ে, কতবার তারা একসঙ্গে চা খেয়েছে, নীরবে বসে থেকেছে, জানালার দিকে তাকিয়ে থেকেছে।
সেইসব মুহূর্ত কি মিথ্যে ছিল?
সে আস্তে করে বলে, “আপনি কি চান আমি আর না আসি?”
অনিন্দিতা চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপর বলে, “আমি চাই তুমি ভালো থাকো। তুমি এই অফিসে নতুন, তোমার জীবন সামনে। আমার জন্য তোমার সম্পর্কে ফিসফাস হোক, সেটা আমি চাই না।”
রোদ্দুর বলেই ফেলে, “আপনি আমার জন্য চিন্তা করছেন না, আপনি আপনার চারপাশের জন্য ভয় পাচ্ছেন। তাই তো?”
অনিন্দিতা একটু গলা চড়া করে বলেন, “তুমি বুঝতে পারছো না রোদ্দুর, আমি একজন বউ, একজন পেশাদার মহিলা—আমার স্বাধীনতা আছে, কিন্তু তার একটা দায়ও আছে। আমি চাই না, আমার জীবনে আর একবার ভুল বোঝাবুঝির জন্ম হোক।”
এই গলার ঝাঁঝ রোদ্দুর কখনও শোনেনি। সে চমকে ওঠে।
আর সেই মুহূর্তে, হাতে ধরা চায়ের কাপটা টেবিল থেকে পড়ে যায়।
ছ্যাঁৎ করে শব্দ হয়। কাপ ভেঙে পড়ে যায়। লাল চা ছড়িয়ে পড়ে জানালার ফ্রেমে।
দুজনেই চুপ।
এক মুহূর্ত—দীর্ঘ নিঃশব্দ।
রোদ্দুর কাপের দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাঙা কাপটাও ঠিক আমাদের মতো। চা পড়ে গেছে, অথচ গন্ধটা রয়ে গেছে।”
অনিন্দিতা চোখ নামিয়ে বলেন, “তুমি যদি কিছুদিন এই টেবিল থেকে দূরে থাকো, আমার ভালো লাগবে। আমি একটু গুছিয়ে নিতে চাই নিজেকে।”
রোদ্দুর দাঁড়িয়ে যায়। মাথা নিচু।
সে কিছু বলে না। শুধু বলে, “চা এবার আমি একাই খাবো।”
সে হেঁটে চলে যায়।
অনিন্দিতা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে। জানালা আজও খোলা, গাছের পাতা দুলছে।
কিন্তু কেমন যেন জানালা আজ খুব একা হয়ে গেছে।
চায়ের গন্ধও আজ কেমন নিস্তেজ।
ভুল বোঝাবুঝি, ভাঙা কাপ… আর এক কাপ নিঃশব্দ চা।
পর্ব ৮
পরদিন রোদ্দুর ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যায় না।
দুপুর সাড়ে বারোটা পার হয়, জানালার আলো পড়ে ডেস্কের ওপর। চায়ের জন্য মন উথালপাথাল করে, কিন্তু সে জানে—আজ সেখানে যাওয়ার মানে হবে আবার মুখোমুখি হওয়া, আবার কিছু না বলা অনুভব গিলে ফেলা।
সে জানে, অনিন্দিতা চেয়েছিলেন সে না যাক। এবং সে সেটা মেনে নিচ্ছে।
কিন্তু ভিতরে ভিতরে গাঢ় হচ্ছে কিছু প্রশ্ন—কেন? কেন এতদিনের চুপচাপ বোঝাপড়ার পর হঠাৎ এতটা দূরত্ব?
দিন কাটে ভারী হয়ে।
পরের দিনও রোদ্দুর ক্যাফেটেরিয়ার ধারে যায় না। সহকর্মীরা কিছু বলেন না, কেউ খেয়ালও করে না। কেবল রোদ্দুর জানে, কী একটা হারিয়েছে।
তৃতীয় দিন দুপুরবেলা অফিসে লিফট থেকে নেমে রোদ্দুর যখন ডেস্কের দিকে ফিরছে, তখন কানে আসে এক সহকর্মীর আওয়াজ—
“আরে রোদ্দুর, এই যে, আপনাকে কেউ খুঁজছে।”
সে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে—অনিন্দিতা দাঁড়িয়ে আছেন একটু দূরে। হাতে দুটো চায়ের কাপ, চোখে আগের মতো কোনো ক্লান্তি নেই—বরং এক ধরনের সংকল্প।
রোদ্দুর এগিয়ে যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে কিছুটা দূরে।
অনিন্দিতা বলেন, “তুমি তিনদিন ধারে কাছে এলে না। চায়ের টেবিল ফাঁকা লাগছিল। জানালার কাছে আজ আলো অনেক বেশি তীক্ষ্ণ মনে হচ্ছিল।”
রোদ্দুর সংযত স্বরে বলে, “আপনি তো বলেছিলেন, আমি যেন না আসি। আপনি সময় চেয়েছিলেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে।”
“হ্যাঁ, কিন্তু আমি বুঝে গেছি—আমি যা গুছিয়ে নিতে চেয়েছিলাম, সেটা আসলে ছিল একটা ভয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম তুমি আমার জীবনে একটা অনুভূতির জন্ম দিচ্ছো যেটা আমি চেপে রাখছিলাম বহুদিন।”
“আর এখন?”
“এখন আমি জানি, সেই অনুভূতিটা ভয় নয়, বরং আলো। তুমি যেমন নাম রোদ্দুর, তেমনি তুমি আমার মনের জানালায় প্রতিদিন আলো ফেলছিলে। আমি সেটা বুঝতেই চাইনি।”
রোদ্দুর চুপ করে থাকে।
অনিন্দিতা বলেন, “তুমি কি জানো, এই তিনদিন আমি একাই চা খেয়েছি, কিন্তু প্রতিবার মনে হয়েছে আমার পাশে কেউ নেই। অথচ আগে তুমিও তেমন কিছু বলতে না, তবু মনে হতো, পাশে কেউ আছে।”
“আমি তো ছিলামই।”
“হ্যাঁ, ছিলে। আর তুমি থাকবে কিনা, সেটা আজ তোমার উপর।”
রোদ্দুর একটু এগিয়ে আসে। ধীরে ধীরে হাতে থাকা চায়ের কাপটা নেয়।
“আপনি জানেন, এই কাপে আরেকটা শব্দ ছিল, যেটা আমরা কখনো উচ্চারণ করিনি?”
“কোনটা?”
“‘আমরা’—এই শব্দটা। আমরা একসঙ্গে চা খাই, আমরা জানালার পাশে বসি, আমরা কথা না বলেও বোঝাপড়া করি। কিন্তু আমরা কখনও বলিনি—‘আমরা’। বললে হয়তো ভয় পেতাম।”
অনিন্দিতা আস্তে করে বলেন, “তুমি কি আজ বলতে পারো সেই শব্দটা?”
রোদ্দুর মাথা নেড়ে বলে, “আজ আমি বলতে চাই—আমরা আছি।”
দুজনেই একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আবার সেই পুরোনো জানালার ধারে ফিরে আসে। চেয়ারগুলো ঠিক জায়গাতেই আছে, আলোও ঠিক আগের মতোই ঝলমলে, শুধু ভাঙা কাপটার দাগটা পরিষ্কার করে ফেলা হয়েছে।
তারা বসে।
রোদ্দুর এবার প্রথমবার অনিন্দিতার দিকে তাকিয়ে বলে, “আপনি যদি একদিন এই শহর ছেড়ে যান, আমি কি জানালার পাশে বসে থাকবো?”
অনিন্দিতা হেসে বলেন, “হয়তো তখন আমি দূরে থেকেও ‘আমাদের’ হয়ে থাকবো।”
চা চুমুক দিতে দিতে তারা চুপ করে থাকে। কিন্তু আজ সেই চুপচাপটা আর কষ্টের নয়, বরং এক গভীর নিশ্চয়তা।
আজ ‘আমি’ আর ‘তুমি’ নেই।
আজ কেবল—আমরা।
পর্ব ৯
সকালটা খুব স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছিল। রোদ্দুর জানত না, ঠিক এই দিনে তার বুকের ভিতর হঠাৎ করে একটা ফাঁকা মাঠ তৈরি হবে, যার মধ্যে ঘাস গজাবে না, বাতাস বইবে না, কেবল একটানা নিঃশব্দতা।
অফিসে ঢুকে সে চুপচাপ ডেস্কে বসে। মনে হচ্ছিল, আজ কিছু একটা নতুন হবে। হয়তো অনিন্দিতা একটা অন্য গল্প বলবেন, হয়তো জানালার পাশে বসে তারা প্রথমবার স্পর্শের বদলে হাতের পাশে হাত রাখবে, নিঃশব্দে।
তাই সে দুপুর সাড়ে বারোটা বাজতেই উঠে পড়ে। আজ যেন তার গলায় একটা হালকা সুর বাজছে—অন্তত আজকের দিনে তো অনিন্দিতা আসবেনই।
ক্যাফেটেরিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে সে দেখে, টেবিল খালি।
চেয়ারটাও সরানো হয়নি। জানালার ওপাশে গাছের পাতা দুলছে আগের মতোই।
সে ধীরে ধীরে গিয়ে বসে পড়ে। চায়ের অর্ডার দেয় একটুখানি থেমে—“লাল চা, কম চিনি। একটাই।”
কিছু বলতেই গলা শুকিয়ে আসে।
দু’চোখ বারবার দরজার দিকে চলে যায়।
১৫ মিনিট… ৩০ মিনিট… ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগিয়ে যায়, অথচ কাউকে দেখা যায় না।
আজ প্রথমবার এই ফাঁকা চেয়ারটাকে ওর চোখে অসম্ভব শূন্য লাগছে। একটা অভ্যেস যখন অভ্যাস হয়ে ওঠে, তখন তার অনুপস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় অভিশাপের মতো।
মোবাইল বার করে রোদ্দুর। WhatsApp খুলে দেখে—শেষ মেসেজ কাল রাত ১১:১৭-এ।
অনিন্দিতা দি: “কাল হয়তো কিছু একটা জানাবো, আজ আর কিছু না। ঘুমোও।”
রোদ্দুর লেখে—
“আপনি আসছেন তো?”
সেন্ড করে। টিক টিক হয়। কিন্তু কোন ‘Seen’ আসে না।
চা এসে যায়। সে ধীরে ধীরে হাতে তুলে নেয় কাপ। ঠোঁটে লাগায়। হঠাৎ যেন মনে হয়—চায়ের স্বাদ একেবারে আলাদা। যেন গন্ধে অভাব লেগে আছে।
সে চুপচাপ চুমুক দিতে দিতে জানালার বাইরে তাকায়। হালকা মেঘ জমেছে আকাশে। বাতাসে আজ একটা অদ্ভুত হাহাকার।
হঠাৎ মনে পড়ে যায়, প্রথম দিন এই টেবিলে বসে সে বলেছিল—“চা মানেই সময়। আর সময় মানেই একসঙ্গে থাকা।”
আর আজ সেই সময় থেমে গেছে।
চা ফুরিয়ে আসে।
রোদ্দুর উঠতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে এক কণ্ঠ—“Excuse me, are you Roddur?”
সে চমকে তাকায়। একজন অফিস স্টাফ—HR টিমের জুনিয়র, মেয়েটার মুখ চেনা।
“আপনার জন্য অনিন্দিতা ম্যামের একটা লেটার এসেছে।”
সে অবাক হয়ে চিঠিটা হাতে নেয়।
হাত কাঁপে। ছেঁড়া না হলেও চিঠির ভাঁজে আবেগ জমাট বেঁধে আছে।
চিঠিটা খুলে পড়ে—
রোদ্দুর,
যেদিন প্রথম তোমাকে এই জানালার ধারে বসতে দেখেছিলাম, বুঝেছিলাম—তুমি এমন একজন, যার চুপচাপ তাকিয়ে থাকাও একটা গল্প।
আমি সেই গল্পের পাশে একটু বসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বসতে বসতেই আবিষ্কার করলাম, আমি সেই গল্পের ভেতর ঢুকে পড়েছি। হয়তো তুমি বুঝে গেছো, আমার ভিতরে একটা যুদ্ধ চলছিল।
তোমাকে নিয়ে নয়। আমার নিজের সঙ্গে।
তুমি যদি জানতে, প্রতিদিন দুপুরে আমি নিজের যন্ত্রণা ভুলে শুধুমাত্র তোমার চায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম—তবে বুঝতে পারতে, সেই কাপগুলো ছিল আমার মুক্তি।
কিন্তু, একটা সময় আসে যখন জানালা আর আলো একা হয়ে পড়ে। আমি আজ যাচ্ছি। কোথায়, কেন—তা বলা যাবে না।
শুধু এইটুকু জানিও—তুমি একমাত্র মানুষ, যার সঙ্গে আমি ‘আমরা’ শব্দটা কল্পনা করেছিলাম।
আমি জানি, তুমি প্রতিদিন চা খাবে। হয়তো জানালার পাশে বসে আমার জন্য একটা কাপ রেখেও দেবে।
আর আমি?
আমি দূর থেকে বসে তোমার হাতে ধরা কাপের ভেতরে নিজের ছায়া খুঁজবো।
ভালো থেকো, রোদ্দুর। তুমি নিজের মতো করেই একটা আলো।
– অনিন্দিতা
চিঠি ফেলে রোদ্দুর জানালার ধারে ফিরে আসে। আবার সেই একই জায়গা।
চুপচাপ বসে।
এবার সে দুটো চা অর্ডার দেয়। একটাতে চুমুক দেয়, আরেকটা ঠান্ডা হতে দেয়—চুপচাপ।
চুপ করে চা খেতে খেতে সে জানে—আজ অনিন্দিতা নেই। কিন্তু গল্পটা এখনো রয়ে গেছে।
পর্ব ১০
আজ আট দিন হয়ে গেল।
রোদ্দুর প্রতিদিন একইভাবে ক্যাফেটেরিয়ার জানালার ধারে বসে। সকাল থেকে কাউন্টডাউন চলে—সাড়ে বারোটা বাজলেই ও উঠে যায়, ওই এক কাপ লাল চা নিয়ে বসে পড়ে।
প্রতিদিন দুটো কাপ অর্ডার করে। একটাতে চুমুক দেয়, আরেকটা ফাঁকা রেখে দেয়—অনিন্দিতার জন্য। প্রথম দুদিন কেউ কিছু বলেনি, তারপর লোকজন ফিসফিস শুরু করেছিল। কিন্তু তৃতীয় দিন থেকে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
“ও তো সেই ছেলেটা, যার সঙ্গী হাওয়া হয়ে গেছে।”
রোদ্দুর এসব শোনে না।
চিঠিটার কাগজ প্রায় ছিঁড়ে গেছে যতবার সে ভাঁজ খুলেছে, যতবার সে নিজের বুকের কাছে এনে বলেছে—“তুমি বলেছিলে, আমি রোদ্দুর, আমি আলো—কিন্তু কেন আমায় অন্ধকারে রেখে চলে গেলে?”
অনিন্দিতা আর আসেননি।
তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। HR বলেছে, তিনি ইমেইল পাঠিয়েছেন, সব ডকুমেন্ট দিয়ে দিয়েছেন, আর ফোন নম্বরও বন্ধ হয়ে গেছে।
রোদ্দুর বুঝে গেছে, এই চলে যাওয়াটা শুধুই শারীরিক নয়, এটা এক ধরনের আত্মরক্ষা।
অনিন্দিতা পালিয়েছেন। তার অতীত, তার অনুভব, তার অসমাপ্ত অনুভূতিকে একা ফেলে রেখে।
তবু রোদ্দুর রোজ জানালার ধারে বসে থাকেন।
আজও সে চা এনেছে। আজও দুটো কাপ।
আজ জানালার বাইরে রোদ নেই, হালকা মেঘ। বাতাস একটু গাঢ়। কলকাতার শরৎকাল। গাছের পাতাগুলো কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে সবুজ।
রোদ্দুর চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজও তুমি এলে না।”
তারপর সে ধীরে ধীরে বলে যেতে থাকে—
“জানো, অনিন্দিতা দি, তুমি যখন চলে গেলে, প্রথম দুদিন আমি ভেবেছিলাম—তুমি ফিরবে। হঠাৎ করে এসে বলবে, ‘এই যে, আমি তো ছিলামই।’ কিন্তু না, তুমি নিজেকেই গুটিয়ে ফেলেছো। আমি জানি, তুমি সাহস হারিয়ে ফেলেছিলে। হয়তো আমি চাইছিলাম, আমরা একটা নতুন পথ তৈরি করি—কিন্তু তুমি সেই জানালার ধারে বসেই থাকতে চেয়েছিলে, ঠিক জানালার বাইরে যেতে চাওনি।
কিন্তু আমি তো যেতে চেয়েছিলাম—তোমার সঙ্গে। আমি চেয়েছিলাম, আমাদের গল্পটা জানালার গণ্ডি পেরিয়ে হেঁটে বেড়াক শহরের রাস্তায়।
তুমি গেলে। হয়তো নিজের মতো করে ভালো থেকো। হয়তো আমার চায়ের কাপ তোমার স্মৃতিতে নেই। কিন্তু তুমি তো বলেছিলে—‘তুমি একমাত্র যে আমাকে বোঝে।’
তবে তুমি চলে গেলে কেন?”
রোদ্দুর চায়ের কাপ তুলে নেয়। ঠোঁটে ঠান্ডা চা লাগে।
আজ চা ঠান্ডা হয়ে গেছে।
কিন্তু আজ তার মনে হয়, এটাই আসল।
ভালোবাসা যেমন চুপ করে আসে, তেমনি চুপ করেই চলে যায়। চা যেমন গরম থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়—তারপরও তার রঙ আর ঘ্রাণ রয়ে যায়।
সেই ঘ্রাণটুকু নিয়েই তো জীবন চলে।
রোদ্দুর আজ প্রথমবার খালি কাপটা হাতে নেয়। যেটা সে অনিন্দিতার জন্য রাখত। চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সেই কাপে।
তারপর আস্তে করে চোখ বন্ধ করে কাপটা ঠোঁটে তোলে।
এমনভাবে যেন একজন চলে যাওয়া মানুষের স্পর্শ তুলে আনছে স্মৃতির ভেতর থেকে।
তারপর কাপটা নামিয়ে রাখে।
একবার জানালার বাইরে তাকায়। আকাশটা ধূসর, কিন্তু কোথাও একটা আলো ফুটছে। হয়তো ভোরের আলোর মতো—কিছু একটা নতুন শুরু হবে, তার অপেক্ষা।
রোদ্দুর উঠে দাঁড়ায়। পেছনে ঘুরে চায়ের দোকানিকে বলে, “কাল থেকে একটাই কাপ করো ভাই। কম চিনি, লাল চা।”
দোকানি অবাক হয়ে বলে, “আরেকটা দিতেন তো সবসময়?”
রোদ্দুর মৃদু হাসে। “সেই মানুষটা আজকাল শুধু স্মৃতিতে আসে। তার জন্য চা আর গরম হয় না।”
সে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে।
জানালাটা পেছনে পড়ে থাকে—ঠিক যেমন থাকে কোনো বন্ধ দরজা, যার ওপাশে একটুকরো নরম আলো আর এক কাপ ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের গন্ধ।
সমাপ্ত