Bangla - অনুপ্রেরণামূলক গল্প - প্রেমের গল্প

চায়ের কাপের ফাঁকে

Spread the love

সৃজন ঘোষ


পর্ব ১ — শিবু কাকার দোকান

ওরা দুজন দুটো আলাদা অফিসে কাজ করে। আলাদা ভবন, আলাদা ফ্লোর, আলাদা ম্যানেজার, আলাদা টাইমশিট—কিন্তু বিকেল তিনটা পঁচিশে দুজন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ে একটাই জায়গায়—শিবু কাকার চায়ের দোকানে। হ্যারিসন রোড আর ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিটের সংযোগস্থলে ছোট্ট এক টিনের ছাউনি, তিনটে লাল চেয়ার, একটা কেরোসিন স্টোভ, আর একটা চুন-ছোপ খাওয়া কাঠের বেঞ্চ। এখানেই তুলি রোজ বিকেলে আসে মাথার ব্যথা সারাতে, আর রুদ্র আসে… আগে হয়তো কেবল চায়ের জন্যই আসত, এখন সে নিজেও জানে না ঠিক কেন আসে।

তুলির অফিস ‘ইমার্জ ইভেন্টস’-এর তিনতলায়। একঘেয়ে মিটিং, থিম-পিচ, ক্লায়েন্ট ব্রিফ আর ইনস্টাগ্রামের ক্যাপশন নিয়ে সকাল থেকে বেলা পার করে, তারপর যেন শরীর নিজেই শিবু কাকার দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করে। সেদিনও যেমন করছিল। কানে হেডফোন, মনটা অন্য কোথাও। তখনই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটাকে দেখে থমকে যায়। রুদ্র—অন্য অফিসের ছেলেটা। গায়ে হালকা নীল শার্ট, চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, হাতে এক কাপ চা আর ঠোঁটের কোণে একরকম উদাস হাসি।

সে তখনই রুদ্রকে চেনে না। কিন্তু ওই হাসির ভেতরে এমন কিছু ছিল, যা তাকে এক মুহূর্ত দাঁড় করিয়ে দেয়। ওদের প্রথম আলাপ ওই দোকানেই হয়েছিল। খুব সাধারণভাবে, যেভাবে চায়ের দোকানে অচেনা দুই মানুষ কাকতালীয়ভাবে একইসঙ্গে পৌঁছে যায়, আর টাকাজনিত জটিলতায় কথাবার্তা বাধে। রুদ্র সেদিন পকেট ঘেঁটে পাচ্ছিল না খুচরো টাকা। শিবু কাকা বলছিলেন, “চায়ের দাম দুটাকা, পাঁচের উপরে কিছু নাই।” রুদ্র একটু হেসে বলেছিল, “নিশ্চই খুচরো আমার টেবিলেই পড়ে আছে।” তখনই তুলি ব্যাগ থেকে একটা দুটাকার কয়েন বের করে এগিয়ে দিল। বলল, “রাখুন, পরে দিয়ে দেবেন।”

রুদ্র চমকে তাকিয়ে বলেছিল, “এরকম অচেনা সাহায্যেও কি ইনভয়েস আসে?”
তুলি হেসে বলেছিল, “না, কিন্তু চায়ের সঙ্গে গল্প আসে।”

সেই ছিল শুরু। তার পরদিন থেকেই দেখা হতে থাকে রোজ। কেউ কাউকে ডাকেনি, কেউ কারও ফোন নম্বর নেয়নি, কেউ সময় ঠিক করে রাখেনি—তবুও ঠিক বিকেল তিনটা পঁচিশে ওরা পৌঁছে যায় একই জায়গায়। চা খেতে খেতে গল্প হয় অফিস নিয়ে, জীবন নিয়ে, ছোটবেলার পাড়ার ক্রিকেট থেকে শুরু করে মেসের বাজে খাবার পর্যন্ত।

তুলি প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো এটা সাময়িক, একটা নরম দুপুরের ভুল। কিন্তু দু’সপ্তাহ পরে যখন নিজেকে আবিষ্কার করল রুদ্রের গল্পগুলো প্রতীক্ষা করছে, তখন বুঝল, এই প্রতিদিনের দেখা তার কাছে একধরনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিন চা খেতে খেতে রুদ্র বলল, “তুমি কখনো ভেবেছো এইসব ফরমায়েশি অফিসের বাইরে কী হতে পারো?”
তুলি চমকে তাকিয়ে বলেছিল, “মানে?”
“মানে ধরো, তুমি চাইলে একটা ক্যাফে খুলতে পারো। যেখানে চা থাকবে, বই থাকবে, লোকজন এসে গল্প করবে… ঠিক যেমনটা তুমি নিজে পছন্দ করো।”
তুলি একটু হেসে বলেছিল, “তুমি বুঝলে কীভাবে আমি ক্যাফে পছন্দ করি?”
রুদ্র বলেছিল, “তোমার চোখে আমি দেখেছি, তুমি আসলে কোথাও যেতে চাও, কিন্তু কোথাও আটকে আছো।”

এইসব কথা বলার পর দুজনেই কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গিয়েছিল। রুদ্র চায়ে চুমুক দিয়েছিল, আর তুলি তার হাতের মুঠোয় ধরা কাগজের কাপটা কিছুক্ষণ দেখছিল।

এরপর থেকে কথাগুলো একটু একটু করে অন্য দিকে বাঁক নিতে থাকে। অফিসের গল্পের ফাঁকে ঢুকে পড়ে অতীতের সম্পর্ক, পারিবারিক বোঝাপড়া, স্বপ্নভাঙার ইতিহাস। তুলি বলে, “আমি একবার কাউকে খুব বিশ্বাস করেছিলাম। শেষে জানলাম, ওর কাছে আমি কেবল ‘সাময়িক স্বস্তি’ ছিলাম।” রুদ্র তখন চুপ করে থাকে। কিছু বলে না। কিন্তু তার চোখের স্থিরতা বলে দেয়, সে শুনছে, এবং বোঝে।

আরেকদিন তুলি জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি এখনো কারও সঙ্গে আছো?”
রুদ্র একটু ভেবেই উত্তর দেয়, “না, অনেকদিন। ইচ্ছে করে না আর। মনে হয়, যাকে ভালোবাসব, সে যেন আমাকে ভালোবাসার আগে বোঝে। যেমন তুমি বোঝো।”

তুলি আর কিছু বলে না। শুধুই তাকিয়ে থাকে রুদ্রর দিকে। মনে মনে ভাবে, এই ছেলেটাকে কি সে বোঝে? নাকি রোজকার দেখা, চায়ের কাপ আর গল্পের ফাঁকে যা ভাবছে, তা কেবল তার একতরফা অনুভব?

সেদিন সন্ধেবেলা তুলি তার বন্ধু ঈশানীকে ফোন করে বলে, “তোর কখনো হয়েছে এমন—কাউকে খুব অল্প দিনে মনে হয় অনেক পুরনো?”
ঈশানী বলে, “তুই প্রেমে পড়েছিস।”
তুলি বলে, “না রে, এটা প্রেম নয়, এটা কিছু একটা… অন্যরকম। নাম দেওয়া যায় না।”
ঈশানী হেসে বলে, “প্রেম মানেই তো নামহীন অনুভব।”

পরদিন আবার দেখা হয়। আজ রুদ্র একটু দেরি করে আসে। হাতে একটা ছোট প্যাকেট। বলল, “তুই একদিন বলেছিলি না তোর লাল মুড়ির খুব শখ?”
তুলি চোখ বড় করে বলে, “তুমি মনে রেখেছো?”
রুদ্র মাথা নিচু করে বলে, “হ্যাঁ, আরে তোর মতো কেউ যখন গল্প করে, আমার মনে থাকবেই।”

চোখের কোনায় একফোঁটা কিছু এসে পড়ে তুলির। সেটা লুকিয়ে ফেলে সে হেসে বলে, “আজ তাহলে মিষ্টি চা আর লাল মুড়ি।”
রুদ্র বলে, “আহা, আজ তো পুরোটাই তোর পছন্দ।”

তারা দুজনে বসে খায়, গল্প করে, হেসে ফেলে। চায়ের কাপ ফুরোয়, সন্ধের আলো ঝিম ধরে, ব্যস্ত রাস্তার গাড়ির শব্দে একটুখানি ঘোর কেটে যায়।

চলে যাওয়ার সময় রুদ্র বলে, “তুলি, আমি জানি আমরা কেউ কিছু বলিনি… কিন্তু জানিস তো, আমি অপেক্ষা করি…”
তুলি থেমে বলে, “আমি জানি। আমিও।”

তারা চলে যায়, আলাদা রাস্তায়, আলাদা ভবনে, কিন্তু বুকের ভিতর একটা জায়গা এখন থেকে একই।

পর্ব ২ — দু’টাকার গল্প

ভালোবাসা অনেক সময় খুব বড় কিছু নয়—তা হতে পারে দু’টাকার চায়ের কাপ, একজন অচেনা মানুষের মুখে হালকা হাসি, অথবা প্রতিদিন ঠিক একই সময় দেখা হওয়া। তুলি আর রুদ্রর মধ্যে এখনো পর্যন্ত কোনো ‘আই লাভ ইউ’ বা কবিতা লেখা প্রেম নেই, আছে শুধু প্রতিদিন দেখা হওয়া, চোখে চোখ রাখা, আর মাঝেমধ্যে ছোট কিছু উপহার—যার ভিতর থাকে ভালোবাসার অজস্র ইঙ্গিত।

আজও বিকেল তিনটা পঁচিশে তুলি পৌঁছেছে শিবু কাকার দোকানে। হাতে কাজের ফাইল, চোখে ক্লান্তি, কিন্তু মুখে একটা আশার রেখা—আজ রুদ্র কী বলবে, কী আনবে, অথবা কোনো নতুন গল্প শোনাবে কিনা।

শিবু কাকা তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, “আজ একটু আগেই আইছো?”
তুলি হেসে বলল, “হ্যাঁ কাকু, আজ ক্লায়েন্ট মিটিং ক্যানসেল। ভাবলাম, একটু আগে এসে চায়ের স্টলটা দখল করি।”

শিবু কাকা চা বসাতে বসাতে বললেন, “ছেলেটা এখনও আইলো না। তবে আসবে ঠিক। রোজ আসে তো।”
তুলি চুপ করে হাসে। দোকানের চারপাশে ভিড় বাড়ছে, পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু অচেনা মুখ, কেউ কলেজ থেকে, কেউ অফিস থেকে, কেউ বা ট্রেড লাইসেন্সের কাজে এসেছে। কিন্তু তুলি কেবল তাকিয়ে থাকে ওই মোড়টার দিকে—যেখান থেকে রুদ্র হাঁটতে হাঁটতে আসে।

আর ঠিক তখনই আসে রুদ্র। হাঁটছে দ্রুত পায়ে, মুখে হালকা ব্যস্ততা, হাতে একটা মেল ফোল্ডার, আর অন্য হাতে তুলি’কে এক ঝলক দেখে নেওয়ার তাড়াহুড়া।

তুলির দিকে তাকিয়ে বলে, “বড্ড লেট হয়ে গেল আজ। একটা জরুরি কল লেগে গেছিলো—ভেবেছিলাম আজ তুই চলে যাবি।”
তুলি চা হাতে এগিয়ে দেয়, “তোর জন্য তো একটা কাপ রেখেই ছিলাম।”
রুদ্র মুচকি হেসে বলে, “তুই না থাকলে আমি এই শহরটাকেই হারিয়ে ফেলতাম।”

দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে চা খেতে খেতে আজ একদম অন্য রকম আলোচনা শুরু করে। তুলি বলল, “জানিস, আমি ছোটবেলায় ভাবতাম অফিস করা মানে হয়তো বড় কিছু হবে। এখন বুঝি, বড় হবার চেয়ে ছোট সুখটা বেশি দরকার।”
রুদ্র মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়, “আমি ভাবতাম বড় কোম্পানিতে কাজ করব, নিজের টেবিল থাকবে, নিজের চেয়ার, আর কেউ আমাকে স্যালুট দেবে। এখন বুঝি, এক কাপ চায়ের চেয়েও বড় সুখ কিছু নেই।”

তারা দুজনে হেসে ফেলে। পাশে শিবু কাকা কফিতে ড্রাই ফ্রুটস ছড়িয়ে চা বানাতে বানাতে বলে ওঠেন, “তোমরা দুইজন বড্ড মিষ্টি কপোত-কপোতি হয়েছো রে। আর কবে বিয়ে করবা?”

তুলি হেসে ফেলে, রুদ্র কিছু বলে না। শুধু চায়ের কাপটা আরও শক্ত করে ধরে।
তুলি ফিসফিসিয়ে বলে, “কাকু আবার শুরু করলো!”
রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর কি খারাপ লাগল?”
তুলি একটু থেমে বলে, “না… বরং ভালো লাগল।”

চুপচাপ একটা মুহূর্ত কাটে। দুজনেই জানে, এই নীরবতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এইটুকু নীরবতার ভেতরেই হাজার কথা বলা হয়ে যায়।

একটু পর রুদ্র পকেট থেকে ছোট্ট একটা বাক্স বার করে। বলল, “তোর জন্য।”
তুলি অবাক হয়ে বলে, “এটা কী?”
রুদ্র বলল, “আজ অফিসে একটা কেস স্টাডি পড়ছিলাম—‘মিনিমাল গিফটিং’ নিয়ে। মানে, ছোট ছোট জিনিস যা অনেক কিছু বোঝাতে পারে। তখনই ভাবলাম তুই তো এইরকমই—নয় অতিরিক্ত কিছু, কিন্তু ভিতরে একরাশ গভীরতা।”

তুলি বাক্সটা খুলে দেখে একটা ছোট্ট কী-চেইন, কাঠের ওপর তুলি দিয়ে আঁকা একটা চায়ের কাপ। তাতে লেখা—“চা-সঙ্গী”।
তুলির চোখে জল চলে আসে। বলল, “এত সুন্দর কিছু কেউ কখনও দেয়নি আমাকে…”
রুদ্র ফিসফিস করে বলে, “তুইও তো কাউকে এভাবে সময় দিসনি, তাই না?”
তুলি একটুও না ভেবে বলে, “না, তোকে ছাড়া কাউকে না।”

ঠিক তখন, তুলির ফোনে একটা মেসেজ আসে—ঈশানী, তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী, যার সঙ্গে প্রতিদিন কথা হয়। মেসেজে লেখা—“কাল সন্ধ্যায় আয়, তোকে একটা কথা বলার আছে। রুদ্র সম্পর্কে।”

তুলির বুকটা ধড়াস করে ওঠে। রুদ্র? রুদ্র সম্পর্কে কী এমন কথা থাকতে পারে?
সে মুখ তুলে তাকায় রুদ্রর দিকে—যে এখন শিবু কাকার সঙ্গে হাসতে হাসতে গল্প করছে অফিসের গপ্পো নিয়ে। তুলি ভাবে, না, এই ছেলেটা কিছু লুকোতে পারে না। তবে ঈশানী কেন বলল এমন?

সেদিন সন্ধেয় তুলি যায় ঈশানীর বাড়ি। সোফায় বসে কিছু না বলেই ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে দেয় ঈশানী। স্ক্রিনে খোলা রুদ্রর ফেসবুক প্রোফাইল, আর একটা পুরনো ছবি—রুদ্র আর এক মেয়ের সঙ্গে। মেয়েটির গায়ে বিয়ের গয়না, রুদ্রর মুখেও হাসি। ক্যাপশন—“The happiest day of my life with my best friend turned wife.”

তুলি চুপ। গলা শুকিয়ে আসে। ঈশানী বলল, “ছবিটা বছর দুয়েক আগের। তবে কোনো পোস্টে এখন আর ওর স্ত্রীর কোনো ছবি নেই। ডিভোর্স হয়েছে কিনা জানি না, কিন্তু জানতিস তোকে বলার আগে?”
তুলি মাথা নাড়ে।

চুপ করে অনেকক্ষণ বসে থাকে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে চায়ের কাপ, সেই কী-চেইন, আর রুদ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে বলা কথাগুলো—“তুই না থাকলে এই শহরটাই হারিয়ে ফেলতাম।”

রাত দশটায় ফিরেও তুলি রুদ্রকে কিছু লেখে না, কিছু বলে না। কেবল মনে মনে ভাবে—এই শহরে কিছুই চিরকাল একরকম থাকে না। তবে কিছু অনুভব থেকে যায়, যেগুলো দু’টাকার চায়ের চেয়ে দামি, আর একইসঙ্গে ভীষণ দুর্মূল্য।

পর্ব ৩ — না বলা কিছু কথা

রাতটা তুলির জন্য কেমন যেনো পাথর হয়ে ছিল। শুয়ে থেকেও চোখে ঘুম ছিল না। একের পর এক দৃশ্য ভেসে উঠেছে—রুদ্রর মুখ, তার সেই সরল হাসি, কাঠের চাবির রিংটা, সেই লাল মুড়ি আর চায়ের দোকানের বিকেল। একটাও দৃশ্যে কোনো অসততা খুঁজে পায়নি তুলি, কিন্তু ঈশানীর দেখানো ছবিটাও তো মিথ্যে নয়। তাহলে রুদ্র কী লুকোচ্ছে? কেন লুকোচ্ছে? সে কি এখনো বিবাহিত? নাকি ডিভোর্স হয়ে গেছে? আর যদি হয়েও থাকে, তবে কেন এতদিন কিছু বলল না?

সকালে অফিসে পৌঁছে তুলি একদম অন্যরকম হয়ে যায়। মুখে কথা নেই, চোখে ক্লান্তি। মিটিংয়ে বসেও মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে, সহকর্মীরা দু-একবার জিজ্ঞেস করে—”কী রে, অসুস্থ?”—তুলি শুধু হেসে ফেলে, “না, একটু মাথা ব্যথা।” অথচ মাথা নয়, ব্যথা তার মনে। বিকেল হতেই তার শরীর আগের মতো শিবু কাকার দোকানের দিকে হাঁটতে চায়, কিন্তু মন বলে, “আজ না, আজ দেখা না হোক।” কিন্তু চা না খেলে তার অফিসের ভাঁজ খুলে না, এ কথা তো রুদ্রই বলত। তাই, অজান্তেই হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় সেই পরিচিত জায়গায়। শিবু কাকা হাসি মুখে বললেন, “আজ বেশ দেরি করেছো মা, ছেলেটা তো এসে বসে বসে ফোন ঘাঁটছিল। তারপর হাঁটতে হাঁটতে আবার চলে গেলো। একটু মন খারাপ লাগছিল দেখলাম।”

তুলি থমকে দাঁড়ায়। রুদ্র এসেছে, বসে থেকেছে, অপেক্ষা করেছে… কিন্তু সে আসেনি বলে চলে গেছে? তার মনটা আরো ভারী হয়ে যায়। সে চা নেয় না, কেবল মোড়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। চারদিকে ব্যস্ততা, লোকের ভিড়, গাড়ির হর্ন, কিন্তু তুলির কাছে সবই নিঃশব্দ।

পরদিন সকালেই রুদ্রের মেসেজ—“তুই কি খুব রাগ করেছিস? আমি কী এমন করলাম যা বলার যোগ্য না?”

তুলি অনেকক্ষণ ফোনটা হাতে নিয়ে বসে থাকে। একটা উত্তর লিখে মুছে দেয়, আবার নতুন করে লেখে—
“তুই বলবি না, আমি জিজ্ঞেস করব না—এইরকম সম্পর্ক কি সত্যিই টেকে রুদ্র?”

রুদ্রের রিপ্লাই আসে না। সারাদিন কাটে নিশ্চুপে। তুলি বারবার ফোন দেখে, কখনো মনে হয় ব্লক করে দেয়, কখনো মনে হয় একবার ফোন করে বলে, “তুই না বললে আমি ঠিক থাকবো না।” কিন্তু কিছুই করে না। চুপচাপ থাকে।

তৃতীয় দিন বিকেলে সে হঠাৎ চায়ের দোকানে যায়, একদম অপ্রত্যাশিতভাবে। ভাবছিল রুদ্র থাকবে না, কিন্তু রুদ্র অপেক্ষা করছিল। চোখে ক্লান্তি, হাতে সেই চাবির রিংটা বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধরছে। তুলি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রুদ্র তাকিয়ে বলে, “তুই না এলে আজ আমি কিছুতেই যাব না ভাবছিলাম।”

তুলি ধীরে বলে, “তুই আমাকে এখনো কিছু বলিসনি রুদ্র।”
রুদ্র চুপ করে থাকে। তারপর একটু হেসে বলে, “তুই সত্যিই জানতে চাস?”

তুলি মাথা নাড়ে, “হ্যাঁ, আমি সত্যি জানতে চাই। কারণ আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম। ছোট ছোট জিনিসে, নিঃশব্দে।”

রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, “তুই যা দেখেছিস, সেটা ঠিক। আমি একসময় বিবাহিত ছিলাম। রিয়া নাম ছিল ওর। আমরা কলেজে পড়ার সময় প্রেম করতাম। বিয়ে হয়েছিল অনেক বাধার পরে। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই ভেঙে যায় সব কিছু। রিয়া আর থাকতে চায়নি। ওর স্বপ্ন ছিল বিদেশে যাওয়ার, আমার ছিল এখানেই থেকে কিছু গড়ার। সেই পার্থক্য আমাদের দূরে নিয়ে যায়। শেষে ও বলল—তুই আমার স্বপ্নের বাধা। আর আমি… আমি ছেড়ে দিই।”

তুলি কিছু বলে না। কেবল শুনতে থাকে।
রুদ্র বলে, “তুই ভাবছিস, আমি তোকে বলিনি কেন। কারণ আমি ভেবেছিলাম, যদি তুই জেনে ফেলে, তাহলে আমার পেছনের কাঁধগুলো দেখে ভয় পেয়ে যাবি। আমি চেয়েছিলাম তুই আমাকে চায়ের দোকানের মানুষ হিসেবেই দেখিস, একজন যার চোখে তুই হাসিস, আর কিছু নয়।”

তুলি ধীরে ধীরে বলে, “কিন্তু তুই জানতিস না, আমি তোকে ওই দোকানের বাইরে নিয়েই দেখতে শুরু করেছি অনেকদিন আগে।”

রুদ্র তখন কেবল চুপ করে থাকে। চোখে জল এসে যায়। চায়ের কাপ ঠোঁটে নিয়ে বলে, “তুই চাস বল, আমি আবার শুরু করতে পারি?”

তুলি তাকিয়ে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “শুরু যদি করতেই হয়, তবে সৎভাবে কর। কারণ এবার আর হারানোর জায়গা নেই।”

রুদ্র চায়ের কাপটা নামিয়ে বলে, “তুই পাশে থাকলে আমি আবার বিশ্বাস করতে পারি, সম্পর্ক মানেই কষ্ট নয়।”

সেদিন তারা অনেকক্ষণ কথা বলে, অনেক কিছু জানে একে অন্যকে নিয়ে—রুদ্র জানে তুলির স্কুলজীবনে সেই প্রথম প্রেমিককে, যে কবিতা লেখার নামে ওকে প্রতারিত করেছিল; তুলি জানে রুদ্রর বাবা মারা যাওয়ার পর ওর ভিতরে কীভাবে একটা ফাঁপা তৈরি হয়েছিল। দুজনের মাঝে যে দূরত্ব ছিল, তা আজ কেমন ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে।

শেষে তুলি বলে, “তুই কি এখনও চা খাস শুধু আমার জন্য?”
রুদ্র হেসে বলে, “না, এখন খাই নিজের জন্যও। কারণ তোকে ভালবাসা মানেই নিজেকেও ভালোবাসা।”

চায়ের কাপের ভেতর জলের পরিমাণ ফুরিয়ে আসে, কিন্তু মনের ভেতর জমানো জলের ধারা তখনও প্রবাহিত। এক কাপ চা, একদিনের দেরি, আর একটুকরো সাহস—তাদের সম্পর্কের ভিতকে আজ একটু পোক্ত করে দিল।

পর্ব ৪ — ভিজে বিকেলের প্রতিশ্রুতি

শহরের আকাশ আজ ভারী। সকাল থেকেই হাওয়ার গায়ে একরকম গুমোট কষ্ট, যেন বৃষ্টি আসবে বলেই আসছে না, অপেক্ষা করিয়ে যাচ্ছে। তুলি জানে এইরকম দিনে তার মাথাব্যথা বাড়ে। জানে কাজের ফাঁকে বারবার রুদ্রর কথা ভাবতে ইচ্ছে করে। এখন আর তারা অচেনা নয়, শুধু দোকানের আলাপে আটকে নেই। গত দুদিনে রুদ্র সব বলেছে, আর তুলি সেটা শুনেছে মন দিয়ে। এতদিনের প্রশ্নের জবাব পেয়েছে—রুদ্রর অতীত, তার ব্যথা, তার চুপ থাকা। কিন্তু একটা কথা তখনও মুখে আসেনি, সেটা হল—তারা কী এখন প্রেমিক প্রেমিকা?

শিবু কাকার দোকানের ছাউনির নিচে আজ দুজনে বসে ছিল একসঙ্গে, প্লাস্টিকের চেয়ারে, টিনের ছাতার নিচে। বৃষ্টি পড়ছে পাতলা ফোঁটায়, গা ছুঁয়ে হিম লাগিয়ে দিচ্ছে। তুলি হাতে কাপ নিয়ে বসে আছে, আর রুদ্র তাকিয়ে আছে সামনের রাস্তায়, যেখানে ট্রামের রেল ভিজে চকচক করছে।

“তুই বলেছিলি না, তোকে কেউ ভালোবাসার আগে বুঝুক,” তুলি বলল, চায়ের কাপের রিংটা ঘোরাতে ঘোরাতে। “আমি কি তোকে বুঝতে পেরেছি?”
রুদ্র তাকায় না, শুধু বলে, “তুই তো আমাকে দেখে ফেলেছিস। আমি যা, যেমন, যতটা খামতি নিয়ে—তুই তো ঠিক তাই দেখেছিস। এর চেয়ে বেশি আর কিছু চাওয়ার থাকে না।”

তুলি বলে, “তবে তো তোর ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না। প্রথম দিনেই বলে ফেলতে পারতি—তুই বিবাহিত ছিলি। আমি হয়তো অবাক হতাম, হয়তো ভাবতাম… কিন্তু দূরে যেতাম না।”
রুদ্র একটু মাথা নিচু করে বলে, “আমি আসলে ভুলে গেছিলাম ওসব দিনের কথা। তোর সঙ্গে দেখা হওয়া মানে যেন নতুন একটা শুরু। আমি চাইনি আমার পুরনো জীবন আমাদের এই ছোট্ট সম্পর্কটাকে ছায়া ফেলে দিক।”

তুলি মাথা নাড়ে। “এইটুকু জানার পরেও আমি তোর সঙ্গে এখানে বসে আছি। কারণ আমি জানি, আমরা যা শুরু করেছি, সেটা খুব ধীরে গড়ে উঠেছে। আর ধীর জিনিসেই বিশ্বাস থাকে।”

রুদ্র এবার তার দিকে তাকায়। চোখে জল জমেছে কিনা বোঝা যায় না, তবে সে চুপ করে তুলির হাতটা ধরল। এই প্রথম, তাদের শরীর ছুঁল একে অপরকে। তুলি কোনো প্রতিবাদ করল না, বরং হাতটা আলতোভাবে ওর আঙুলের মধ্যে রাখল।

“তুই কি কখনো ভেবেছিস, আমরা একসঙ্গে থাকলে কেমন হতো?” রুদ্র ফিসফিস করে বলে।

তুলি হেসে ফেলে, “তা তো রোজই ভাবি। সকালে ঘুম থেকে উঠে তুই যদি পাশের বালিশে থাকিস, অফিস যেতে যেতে যদি দুজনে একসঙ্গে মেট্রো ধরতে পারি, আর সন্ধ্যেবেলায় চা বানিয়ে যদি তোকে বলি—আজ আর বাইরের দোকানে যাস না…”

রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই তো আমার স্বপ্ন বলে ফেললি।”
তুলি চোখে জল লুকিয়ে বলে, “তুই তো আমার বর্তমান। স্বপ্ন নয়।”

ঠিক তখন, দোকানে একটা বাচ্চা ছেলে এসে পড়ে—ভিজে গায়ে, কাঁপছে। শিবু কাকা চা ঢালছিলেন, বললেন, “আরে রোহিত, আবার তুই? এভাবে ভিজে এলি?”
ছেলেটা বলল, “স্কুল ছুটি ছিল না, রেনকোট ছিল না। এক কাপ চা দেবে কাকু?”

তুলি নিজের চায়ের কাপ এগিয়ে দিল, “এইটা নে। আমি তো শুধু গন্ধটাই নিই।”
ছেলেটা বিস্ময়ে তাকাল, “আপনি নিজে খাবেন না?”
তুলি মাথা নাড়ে, “তুই খা, আমার হয়ে গেল।”
রুদ্র সেই মুহূর্তে তুলির দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই শুধু ভালোবাসা না, তুই ভালোবাসার মানে।”

বৃষ্টির ফোঁটা আরও গাঢ় হয়। দোকানের টিনে ঠকঠক শব্দ, যেন সেই শব্দে লেখা হচ্ছে এক অদ্ভুত কবিতা। তুলি চুপ করে বলে, “রুদ্র, তুই কি এবার সত্যিই চাস আমি তোর জীবনে থাকি?”
রুদ্র জবাব দেয় না, শুধু ব্যাগ থেকে একটা খামে ভাঁজ করা চিঠি বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। তুলি অবাক হয়ে নেয়, খামে কোনো নাম নেই, শুধু কালো কালিতে লেখা—“ভিজে সন্ধ্যার প্রতিশ্রুতি।”

তুলি খুলে পড়ে—
“তুলি,
তুই যদি একদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাস, তাহলে আমি জানব—আমার ভেতরের গলতি হয়তো তোকে আটকে রাখতে পারেনি। কিন্তু আমি যদি চুপ করে তোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকি, তুই কি থেকে যাবি? তুই যদি ভালোবাসা না বোঝাও, আমি চাই তুই আমার সঙ্গে এই চায়ের দোকানের প্রতিটা বিকেলে থাকিস। তুই আছিস বলেই আমি আছি। তুই নেই, আমি নাই।”

তুলির চোখ ছলছল করে ওঠে। সে চুপ করে রুদ্রর দিকে তাকায়। রুদ্র হাত বাড়িয়ে বলে, “এবার যদি বলিস, আমরা প্রেমিক প্রেমিকা, আমি রোজ চায়ের বদলে তোকে নিয়ে স্বপ্ন খাবো।”

তুলি বলে, “প্রেমিক প্রেমিকা নয় রে, আমরা সঙ্গী। জীবনের, প্রতিদিনের, প্রতিটা চায়ের ফোঁটার।”

তারা দুজন পাশাপাশি বসে থাকে, চুপচাপ, ভিজে বিকেলের নিচে, এক চায়ের দোকানে। পেছনে বাজতে থাকে রিকশার ঘণ্টা, সামনে দিয়ে চলে যায় ছাতা হাতে লোকজন, কিন্তু তাদের জন্য সব কিছু থেমে যায়।

বৃষ্টির শব্দের ফাঁকে, ভালোবাসার প্রতিটা অনুচ্চারিত শব্দ খেলা করে বাতাসে, আর তারা চায়ের কাপের ফাঁকে গড়ে তোলে এক জীবন, একসঙ্গে থাকার এক ছোট্ট কিন্তু অমলিন প্রতিশ্রুতি।

পর্ব ৫ — শহরের ভিড়ে এক জোড়া হাঁটা

বৃষ্টি কেটে গেছে তিন দিন হয়ে গেছে। শিবু কাকার দোকানের ছাউনি শুকিয়ে উঠেছে, রাস্তাঘাট আবার আগের মতো ব্যস্ত, শব্দে ভরা, ধুলোয় ধরা। কিন্তু রুদ্র আর তুলির ভেতরের কোনও জিনিস আর আগের মতো নেই। সেই হাতে ধরা মুহূর্তটা, সেই খামভরা চিঠি, সেই চুপচাপ বসে থাকার বিকেল—সব মিলিয়ে তাদের মধ্যেকার সম্পর্কটা যেন একটু নাম পেল, একটু জায়গা পেল, একটু জোর পেল। এখন তারা একে অপরকে দেখে আর চোখ সরাতে চায় না, এখন তাদের গল্প শুধু চায়ের দোকানেই থেমে নেই।

আজ প্রথমবার রুদ্র তুলিকে বলেছে, “চল, আজ তোর অফিস ছুটির পরে হাঁটতে যাই।”
তুলি একটু চমকে গিয়ে বলে, “তুই কখনও জিজ্ঞেস করিসনি এর আগে।”
রুদ্র হেসে বলে, “কারণ তখনও জানতাম না, তুই সঙ্গে থাকলে আমার হাঁটাগুলো আর একলা থাকে না।”

তাদের অফিস ফুরোলে তারা দুজন বেরোল একসঙ্গে, ব্যাগ কাঁধে, হাঁটা পায়ে, একটু লাজুক চাউনি চোখে। প্রথমে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল কলেজ স্ট্রিটের দিকটায়, তুলির প্রিয় জায়গা। সে রুদ্রকে দেখায়—“এই যে, ওখানে বসেই আমি একবার একটা কবিতা লিখেছিলাম স্কুলে থাকতে।”
রুদ্র বলে, “তুই লিখিস কবিতা?”
তুলি হেসে বলে, “আগে লিখতাম। এখন শুধু অনুভব করি।”
রুদ্র বলে, “তাহলে তো তুই একবার আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতেই পারিস।”
তুলি ঠাট্টা করে বলে, “তুই এখনও কবিতার উপযুক্ত নোস।”
রুদ্র ব্যাকুল মুখে বলে, “তাহলে কি আরও কিছু করতে হবে?”
তুলি হেসে ফেলে। সেই হাসির ফাঁকে শহর যেন একটু নরম হয়ে ওঠে।

রাস্তায় তারা গল্প করে—স্কুলে কে কার প্রেমে পড়েছিল, প্রথম ব্রেকআপের কষ্ট, মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে রাতের খাবার না খাওয়া, ছোটবেলার ঠাকুর দেখা, হাওড়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে কথাবলা—সবকিছু যেন একে একে খুলে যাচ্ছে। তুলির কথায় উঠে আসে তার মায়ের অসুস্থতা, ছোটবেলায় বাবা চলে যাওয়া, তার চায়ের প্রতি ভালোবাসা—যেটা শুরু হয়েছিল এক দুঃখের দুপুরে, মায়ের হাঁপানির ওষুধ কিনে না পেরে কান্না থামাতে রাস্তার দোকানে প্রথম এক কাপ চা খেয়েছিল। সেই চায়ের কাপে ছিল সাহস, সেই গন্ধেই সে ধীরে ধীরে নিজেকে গড়েছে।

রুদ্র স্তব্ধ হয়ে শুনছিল। তারপর বলল, “তুই যে এতটা গভীর, আমি জানতাম না।”
তুলি হেসে বলল, “গভীরতা সবসময় মুখে থাকে না রে রুদ্র। অনেক সময় সেটা শুধু একজন মানুষ বুঝতে পারে, যদি সে ঠিকঠাক শুনতে পারে।”
রুদ্র বলল, “আমি শুনতে শিখছি তোর থেকে।”

কলেজ স্ট্রিট থেকে তারা চলে যায় সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে। ভিড়, হর্ন, ঝলমলে আলোয় ভরা শহরের বুক দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজনে এক অদ্ভুত নিঃশব্দে ডুবে যায়। মাঝেমাঝে রুদ্র তুলির দিকে তাকায়—চুল এলোমেলো হাওয়া পেয়ে, চোখে একধরনের শান্তি, আর পায়ের গতিতে কোথাও কোনো তাড়া নেই। যেন সে জানে, ঠিক ঠিক সময়েই গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে।

“তুই কখনো মনে করিস, আমাদের মধ্যে যা চলছে, সেটা খুব বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছে?” তুলি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে।
রুদ্র একটু চমকে যায়, “মানে?”
“মানে, অনেক সময় খুব সুন্দর জিনিসগুলো খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ে। আমার ভয় করে,” তুলি বলে।
রুদ্র থেমে দাঁড়ায়। ট্রামলাইন পেরোতে পেরোতেই বলে, “তুই কি আজকেই ভয় পাচ্ছিস, নাকি আগেও পেতিস?”
তুলি মাথা নিচু করে বলে, “আগেও। কিন্তু আজ ভয়টা বেশি। কারণ তোকে হারানোর ভয়টা আগের চেয়েও বেশি গভীর।”

রুদ্র ধীরে ধীরে তুলির হাত ধরে। প্রথমবার তাদের হাত শহরের রাস্তার মধ্যে ধরা পড়ে, প্রকাশ্যে।
রুদ্র বলে, “তুই জানিস, আমি তোর হাত ধরে হাঁটতে পারার এই অনুভবটা কোনোদিন কল্পনাও করিনি। আমি তো ভেবেছিলাম, আমি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নই। কিন্তু তুই এসে যেন আমার সব ব্যর্থতা মুছে দিলি।”
তুলি তাকিয়ে বলে, “তুই আমাকে নিজের মতো করে জায়গা দিলি, এটুকুই যথেষ্ট।”

তারপর তারা দুজন এক দোকানে বসে সামোসা খায়, চা খায়, গল্প করে। রুদ্র বলে, “তুই কি জানিস, আমি তোর নামটা প্রথম শুনে কেমন অনুভব করেছিলাম?”
তুলি হেসে বলে, “কেমন?”
“ভেবেছিলাম, তুলি নামের মেয়েরা খুব সূক্ষ্ম হয়, রং মাখে জীবনে।”
তুলি বলে, “আর তোর নাম শুনে আমি ভেবেছিলাম, রুদ্ররা বোধহয় শুধু ঝড় নিয়ে আসে।”
রুদ্র বলে, “তাহলে আমি তো তোর জীবনে একটানা বৃষ্টি হয়ে এসেছি।”
তুলি বলে, “না রে, তুই এসেছিস একটা চা-ভেজা বিকেলের মতো, যেখানে ছায়া, শান্তি আর আশ্রয় থাকে।”

রাত হয়ে আসে। শহরের আলো বদলায়, পথচলতি লোকেরা কমে আসে। তারা হাঁটতে হাঁটতে ফিরে আসে হ্যারিসন রোডের কাছে। শিবু কাকার দোকানে আলো নিভে গেছে।
রুদ্র বলল, “আজ শিবু কাকার দোকানে না ঢুকে একটা নতুন চা খাই?”
তুলি একটু অবাক হয়ে বলে, “নতুন?”
রুদ্র বলে, “নতুন দোকান, নতুন জায়গা, কিন্তু আমাদের চা তো একই থাকবে, তাই না?”
তুলি মাথা নাড়ে, “চা বদলালেও গল্প তো আমাদেরই থাকবে।”

তারা দুজনে রাস্তার পাশে এক ছোট্ট দোকানে গিয়ে দাঁড়ায়। দোকানদার বলল, “দু কাপ?”
রুদ্র বলে, “হ্যাঁ, দু কাপ, আর ভালোবাসা যদি ফ্রি দিয়ে থাকো, তবে সেটাও দিতে পারো।”
তুলি হেসে ফেলে। দোকানদার হাসে না, সে জানে না এই ছেলেমেয়েটার জন্য চা আর ভালোবাসা একসঙ্গে কাপে ঢেলে দেওয়া যায় কি না।

কিন্তু তাদের জানা হয়ে গেছে—এক কাপ চা কখনো কখনো অনেক কিছু বলতে পারে, যা গোটা একটা কবিতাও পারে না।

পর্ব ৬ — অপেক্ষার কাপভর্তি নীরবতা

কলকাতা আবার নিজেকে চেনা রূপে ফিরিয়ে এনেছে। ট্রাফিক সিগনালে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা, হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলা ছেলেমেয়েরা, ফুচকার ঠেলা, আর ব্যস্ত অফিস টাইমে একটুকরো চায়ের দোকান—সব যেন নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক। শুধু তুলি আর রুদ্রের মনে জমে উঠেছে একটুখানি সংশয়। কারণ আজ পাঁচদিন, তুলি আসেনি চায়ের দোকানে। কোনও বার্তা নয়, কোনও ফোন নয়, কোনও নোটও নয়। হঠাৎ করেই সে অদৃশ্য হয়ে গেছে, ঠিক যেমন কোনও বইয়ের পৃষ্ঠা মাঝপথে ছিঁড়ে গেলে কাহিনি থেমে যায়।

রুদ্র প্রথম দুইদিন ভেবেছিল কাজের চাপ, হয়তো অসুস্থ, হয়তো বাড়ির কেউ কিছু বলেছে। কিন্তু এরপরের তিনদিনে তার ভেতরের শান্ত ধৈর্য কেমন গলে যায়। সে মেসেজ করেছিল—“তুই ঠিক আছিস তো?”
কোনও রিপ্লাই আসেনি।
ফোন করেছিল—রিং হয়, কিন্তু কেউ ধরে না।

পঞ্চম দিনের বিকেলে, সে ঠিক করল কিছু একটা করতে হবে। শিবু কাকার দোকানে গিয়ে বসে রইল এক কাপ চা হাতে। দোকানের পুরনো রেডিওতে বেজে চলেছে “যদি কাকেও ভুলি, তবু তোকে ভুলি না…” রুদ্র চুপচাপ শুনছে, চোখে একধরনের ক্লান্তি, মুখে একরাশ ভাঙা আশা।

ঠিক তখনই একটা চেনা পায়ের শব্দ শুনতে পেল সে। পেছন থেকে কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, প্লাস্টিকের চেয়ারের শব্দে বুঝে গেল, তুলি এসে বসেছে পাশে। কিন্তু সে চুপ। রুদ্রও চুপ।

অনেকটা সময় চুপচাপ কাটে। তারপর রুদ্র বলে, “তুই ফিরে এলি।”
তুলি ধীরে বলে, “ফেরার জন্যই তো যাওয়া।”
রুদ্র তাকায় না। তার চায়ের কাপে কিছুটা ধোঁয়া উঠছে, সে তাকিয়ে দেখে আর নিজেকে সামলায়।

“তুই কোথায় ছিলি?”
তুলি উত্তর দেয় না সোজাসুজি। বরং বলে, “একটু দূরে, একটু ভিতরে। নিজেকে যাচাই করছিলাম। ভাবছিলাম, তোকে নিয়ে যা অনুভব করছি, সেটা আসলেই কি ভালোবাসা? নাকি শহরের মধ্যে একাকীত্বের সাময়িক ভরাট?”

রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে বলে, “আমি তো তোকে কোনদিন দাবিও করিনি। আমি শুধু পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। তুই থাকলে ভাল লাগত। তুই না থাকলে অপেক্ষাটাও খারাপ লাগেনি। কারণ আমি জানতাম, তুই একদিন ফিরবি। ঠিক যেমন আজ ফিরলি।”

তুলি বলে, “আমি ভয় পেয়েছিলাম রুদ্র। তোর অতীতকে না, বরং আমাদের বর্তমানকে। ভাবছিলাম, এমন সহজে কেউ কারও হয়ে উঠতে পারে না। আমার ভিতরে যে সমস্ত দেওয়াল ছিল, তোকে দেখে মনে হচ্ছিল সেগুলো খুব দ্রুত ভেঙে পড়ছে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম নিজেকেই।”

রুদ্র এবার তুলির চোখের দিকে তাকায়। বলে, “ভয় তো হতেই পারে। কিন্তু ভয় পেয়ে দূরে চলে গেলে, যা কিছু তৈরি হচ্ছিল, সেটাও ভেঙে যায়। আমি তো তোর হাত ধরার সাহস করেছিলাম শুধু তখনই, যখন তোর চোখে সাহস দেখেছিলাম। এখন তুই ফিরে এসেছিস, আবার সব তৈরি হবে, যদি তুই চাস।”

তুলি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বার করে রুদ্রর হাতে দেয়। সেখানে লেখা—“আমি ফিরে এসেছি। যদি তুমি এখনো অপেক্ষা করো, তবে আজ থেকে আমি আর পালাবো না।”

রুদ্র লেখাটা পড়ে কাগজটা ভাঁজ করে বুকের পকেটে রাখে। বলে, “আমি আজ শুধু অপেক্ষা করিনি, আমি বিশ্বাস রেখেছিলাম।”

তারা আবার সেই চেনা দোকানের চেনা কোণে বসে, এবার একটুখানি কাছাকাছি। রুদ্র চুপ করে তুলির হাতটা ধরে। বলল, “চল, আজ আমি তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
তুলি অবাক হয়ে বলল, “কোথায়?”
রুদ্র বলল, “শহরের ঠিক মাঝখানে একটা ছাদ আছে, যেখানে কেউ যায় না। আমি একাই যাই, চুপ করে বসে থাকি। আজ তোকে নিয়ে যেতে চাই।”

তারা দুজনে হেঁটে চলে যায় পুরনো এক পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের ওপরে। লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ভাঙা জানালা পেরিয়ে তারা পৌঁছায় ছাদে। ওপরে শহর দেখা যায়—দূরে হাওড়া ব্রিজের আলো, কাছেই বাজছে কোনো দুর্গার গান, নিচে ট্রাম চলার শব্দ।

তুলি বলে, “এখানে তুই একা বসে থাকিস?”
রুদ্র বলে, “হ্যাঁ। যখন চারপাশের শব্দে নিজেকে চিনতে পারি না, তখন এখানে এসে চুপ করে থাকি। আজ তুই আছিস, তাই শব্দগুলোও নতুন লাগছে।”

তুলি ছাদে বসে পড়ে, রুদ্র পাশে।
তুলি ফিসফিস করে বলে, “রুদ্র, আমি তোর সঙ্গে থেকে ভয়টাকে পেরোতে চাই। আমি সত্যিই চাই তুই আমায় ধরে রাখিস। কখনও যদি আমি আবার চুপ করে যাই, তোকে কিছু না বলি—তাহলেও তুই আমায় ছেড়ে যাস না। পারবি তো?”

রুদ্র তার দিকে তাকিয়ে বলে, “তোর চুপ থাকাও আমার কাছে ভাষা, তুলি। আমি তোর হাসি বুঝি, কাঁদা বুঝি, না বলা কথাও বুঝব।”

ছাদের ওপর বাতাস বয়ে যায়। আকাশে একফালি চাঁদ, দূরের জানালায় জ্বলছে হলুদ আলো। রুদ্র আর তুলি পাশাপাশি বসে থাকে। কোনও কথা নেই, শুধু আছে বিশ্বাস, আর আছে ফিরে আসার নির্ভরতা।

এক কাপ চায়ের গল্প এই শহরের বুক পেরিয়ে আজ ছাদে এসে পৌঁছেছে। তারা জানে, সামনে আরও দিন আসবে—ভুলবোঝাবুঝি, দুঃখ, ক্লান্তি। কিন্তু তারা এইটুকু জেনেছে—যদি কেউ অপেক্ষা করে, আর কেউ ফিরে আসে, তবে পৃথিবীর সব চায়ের দোকান একদিন ঘর হয়ে ওঠে।

পর্ব ৭ — টিনের ছাউনি আর সত্যের শব্দ

ছাদের সেই সন্ধেটা যেন তুলির মনের ভিতর গেঁথে রইল। সেদিন চুপ করে বসে থাকার অভিজ্ঞতা, রুদ্রর কাঁধে মাথা রাখার নিঃশব্দ অনুমতি, আর একসঙ্গে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে ভবিষ্যৎ ভাবা—সব মিলিয়ে সম্পর্কটা একটা নতুন দিক পেয়ে গেল। পরদিন অফিসে বসেই তুলি ফোনে নোট খুলে একটি কবিতা লিখল—“এক কাপ চা, একফোঁটা ভয়, আর একজোড়া বিশ্বাস—এই দিয়ে একটা বিকেল তৈরি হয়।”

কয়েকদিন পরে রুদ্র বলল, “তোর সেই কবিতাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। তুই চাইলে আমি আমাদের স্টার্টআপের ব্লগে পোস্ট করতে পারি।”
তুলি অবাক হয়ে বলল, “আমার নাম দিয়ে?”
রুদ্র হেসে বলল, “তুলির নামে যদি কিছু না হয়, তাহলে পৃথিবীটা অচেনা লাগবে।”

তারা এখন রোজ দেখা করে। তবে সেটা শুধু চায়ের দোকানে সীমাবদ্ধ নেই। কোনওদিন বইমেলায়, কোনওদিন রবীন্দ্র সরোবরে, কোনওদিন পুরনো সিনেমার এক সন্ধেয়। তুলি বলেছিল একদিন—“রুদ্র, আমি ভাবতে পারিনি তোকে ছাড়া কোনও দিন শুরু করতে পারি না এমন হবে।”
রুদ্র হেসে বলেছিল, “তুই আমার ক্যালেন্ডার হয়ে গেছিস, তুলি। যে তারিখ ভুলে গেলে দিনটাই খালি লাগে।”

কিন্তু এই স্বাভাবিক, শান্ত, মিষ্টি দিনগুলোর ফাঁকে হঠাৎ একদিন কিছু অস্বাভাবিক ঢুকে পড়ে।
সেদিন বিকেলে রুদ্র আসে না। তুলি প্রথমে ভাবে ফোন করেছে, রেস্পন্স পায়নি—হয়তো ব্যস্ত। তারপর আধঘণ্টা পেরিয়ে যায়, একঘণ্টা। কোনও মেসেজ নেই, কল ধরছে না। চিন্তা গা ছমছম করিয়ে তোলে। শিবু কাকাকেও জিজ্ঞেস করে—“রুদ্র এল?”
তিনি বলেন, “না মা, আজ তো একবারও এল না।”

তুলি ফোন করে রুদ্রর ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনির্বাণকে। রুদ্র একবার বলেছিল, “আমি ছোটবেলা থেকে শুধু অনিকে সব বলি।”
অনির্বাণ ফোন ধরেই বলে, “তুলি তো? আমি ভাবছিলাম তোকে জানাবো কিনা…”
তুলি আঁতকে ওঠে, “কী হয়েছে?”
“রুদ্রর মা হাসপাতালে ভর্তি। হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার ক্র্যাশ করেছে, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। সকাল থেকে রুদ্র ভীষণ ব্যস্ত। ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।”

তুলি স্তব্ধ হয়ে যায়। রুদ্র কিছু বলেনি তাকে, কিছুই জানায়নি। এতদিন ধরে তারা একে অন্যের সব কথা জানে, ভালোবাসা জানে, ভয় জানে, কিন্তু এইটুকু দুঃসময়েও সে কিছু বলেনি?

রাত দশটার সময় রুদ্রের মেসেজ আসে—
“তুই রাগ করিস না প্লিজ। সবকিছু এত দ্রুত ঘটছিল, তোকে ফোন করার মতো অবস্থায় ছিলাম না। মা এখন স্ট্যাবল, ওয়ার্ডে শিফট হয়েছে। আমি খুব ক্লান্ত, কিন্তু তুই থাকিস আমার পাশে—এটাই চাই।”

তুলি উত্তর দেয়—
“রুদ্র, আমি তো তোকে ছেড়ে যাইনি। কিন্তু যখন তুই একা যুদ্ধ করিস, তখন মনে হয়, তুই আমাকে এখনও পুরোটা বিশ্বাস করিস না।”

পরদিন সকালে তুলি নিজে গিয়ে হাজির হয় নার্সিং হোমে। হাতে ফুলের ছোট্ট একটা তোড়া, সঙ্গে নিজের বানানো নিম-পাতার চা। রুদ্র তাকে দেখে চোখে জল ধরে রাখতে পারে না। চুপ করে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
তুলি বলে, “তুই ভাবিস আমি তোর পাশে দাঁড়াতে পারব না?”
রুদ্র বলে, “না, তুই তো ঠিকই বলেছিলি—আমার ভিতরের দেওয়ালগুলো এখনো পুরোটা ভাঙেনি। আমি ভয় পাই, তুই যদি কখনও এই সব দেখে ক্লান্ত হয়ে যাস।”
তুলি বলে, “তুই যদি আমায় ছায়া দেখাস, তাহলে আমি তোদের আলো নিয়ে আসব। আমরা একসঙ্গে থাকলে ভয় আসলেও সেটা চলে যাবে।”

তারা দুজনে মায়ের বিছানার পাশে বসে থাকে। রুদ্রর মা প্রথমে অবাক হয়ে তাকান, তারপর হালকা হেসে বলেন, “এই মেয়েটাই কি তোমার চায়ের দোকানের সঙ্গী?”
তুলি লজ্জা পায়, রুদ্র হেসে বলে, “হ্যাঁ মা, তুমিও তাহলে শুনেছো?”
মা বলেন, “তোমার মুখে তো তুলি তুলি করে শব্দটাই বুনে ফেলেছো। আমি চাই ও যেন সত্যিই তোমার জীবনে থাকে। কোনও দিন একা হয়ে যেও না।”

বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়। জানালার কাচে ছোট ছোট ফোঁটা জমে। তুলি আর রুদ্র চুপ করে বসে থাকে হাসপাতালের করিডোরে, একে অপরের দিকে তাকিয়ে।

“তুই জানিস রে তুলি, আজ যদি তুই না আসতিস, আমি বুঝতেই পারতাম না, ভালোবাসা শুধু হাঁসির দিনে নয়—সবচেয়ে বেশি দরকার কষ্টের দিনগুলোয়।”
তুলি বলে, “ভালোবাসা মানেই পাশে থাকা নয় রে রুদ্র, ভালোবাসা মানে—কেউ পাশে না থেকেও জানে, সে আছে।”

সেই দিন থেকে তাদের সম্পর্ক আরও একধাপ এগিয়ে গেল। এখন আর কোনও অজুহাত নেই, কোনও ভয় নেই, নেই না বলা কিছু। তারা জানে—জীবন শুধু চায়ের দোকানে বসে গল্প নয়, বরং হাসপাতালের করিডোরেও একসঙ্গে বসে থাকার নাম ভালোবাসা।

শহর জানে না তাদের এই অভিমান, ক্ষমা আর আলতো ছোঁয়ার গল্প। কিন্তু একদিন শিবু কাকার দোকানে দুটো চায়ের কাপ ধোঁয়া উঠিয়ে বলে উঠবে—”এই শহরে এখনো কেউ আছে, যারা ভালোবাসাকে যত্ন করে বানায়।”

পর্ব ৮ — প্রেম, প্ল্যান আর পুরনো পাতা

হাসপাতালের সেই সন্ধে, করিডোরের নিরবতা আর চোখের চেয়ে বেশি বলিয়ে দেওয়া স্পর্শের মধ্য দিয়ে রুদ্র আর তুলি এক নতুন বন্ধনে বাঁধা পড়ল। এবার আর সে বাঁধন শুধু বিকেলের চা, শিবু কাকার দোকান বা ছাদের নিচে বসে থাকা নয়—এটা অনেক বেশি দৃঢ়, অনেক বেশি অন্তর থেকে তৈরি। রুদ্র জানে এখন, তুলি শুধুই প্রেমিকা নয়, জীবনসঙ্গী। আর তুলি নিশ্চিত, রুদ্র শুধু একটা ভালোবাসার মুখ নয়, ওর নিজের হয়ে উঠেছে।

রুদ্রর মা সুস্থ হয়ে ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরলেন। রুদ্র সেদিন তুলিকে বলল, “তুই যদি না এসে দাঁড়াতিস, তাহলে আমি বুঝতেই পারতাম না, আমি তোকে ভালোবাসি শুধুই চা আর কথার জন্য নয়, আমি তোকে ভালোবাসি কারণ তুই আমার সব কিছুর পাশে দাঁড়ানোর সাহস।”
তুলি বলল, “ভালোবাসা মানে দাঁড়িয়ে থাকা নয়, পাশে বসে থাকা। তুই যদি পড়ে যাস, আমি প্রথমে বসব তোর পাশে। তারপর উঠতে বলব।”

তাদের জীবন যেন নতুন ছকে চলতে শুরু করল। বিকেলে দেখা, কিন্তু এখন শুধু চা নয়—এখন তারা শহরের নানা কোণে একসঙ্গে হাঁটে, সিনেমা দেখে, বই পড়ে, ভবিষ্যতের কথা ভাবে।

একদিন রুদ্র বলল, “তুই না একটা ক্যাফের স্বপ্ন দেখতিস? যদি আমি এখন বলি, চল শুরু করি, তাহলে তুই ভয় পাস?”
তুলি বিস্ময়ে তাকিয়ে বলল, “মানে?”
“মানে, আমি ভাবছিলাম, আমার স্টার্টআপ এখন একটা বিনিয়োগ পেয়েছে। আর আমি চাইছি তোর স্বপ্নটা এবার একটু রঙ পেয়ে যাক। আমি চাই, তুই নিজের ক্যাফে চালাস, আর আমি পাশে থাকি। শুধু রাত্রে অফিস করে টাকা তোলার দিন শেষ হোক।”

তুলি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর বলে, “তুই আমার স্বপ্নে হাঁটতে চাস?”
রুদ্র মাথা নেড়ে বলে, “আমি তো সেই প্রথম চায়ের কাপ থেকে তোর পাশে হাঁটছি।”

পরের কয়েক সপ্তাহ কেটে যায় নতুন উদ্যোগের পরিকল্পনায়। তুলি নামে জায়গা খোঁজা হয়—প্রথমেই পছন্দ হয়ে যায় উত্তর কলকাতার এক পুরনো বাড়ির একতলার বড় ঘর, যেখানে কাঠের দরজা, লালমাটির মেঝে আর দেয়ালে জলছাপ। তুলি বলে, “এই ঘরটাই তো আমার কবিতার মত।”
রুদ্র বলে, “এই ঘরেই হবে ‘চায়ের কাপের ফাঁকে’—তোর ক্যাফের নাম।”
তুলি হেসে বলে, “তুই তো আমার গল্পটা নাম করে দিলি।”

তারা দুজন মিলে ক্যাফের জন্য প্ল্যান করে—কাঠের টেবিল থাকবে, দেয়ালে থাকবে পুরনো বইয়ের পাতা, যে কেউ চাইলে পড়তে পারবে, চাইলে লিখে রেখে যেতে পারবে একটা ডায়েরিতে।
তুলি বলল, “এই ক্যাফে শুধু চায়ের জায়গা নয়, এটা হবে অনুভবের আড্ডা।”
রুদ্র যোগ করল, “তবে একটা শর্ত আছে—প্রতি বিকেল তিনটা পঁচিশে এক কাপ চা আমি আর তুই একসঙ্গে খাবো। ক্যাফে যত বড়ই হোক, এই সময়টা শুধু আমাদের।”

তারা লেগে পড়ে যায় কাজের মধ্যে—মিস্ত্রি ডাকা, ইন্টিরিয়র ডিজাইনার খোঁজা, পুরনো চেয়ার পালিশ করানো, একটা পুরনো গ্রামোফোন নিয়ে এসে সাউন্ড সিস্টেম বানানো। তুলি বলে, “এই ক্যাফেতে কোনও র‍্যাপ গান চলবে না, শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত, সলিল চৌধুরী আর কিছু মেঘলা বিকেলের গান।”
রুদ্র বলে, “আর চায়ের মেনু তুইই বানাবি—লাল চা, আদা চা, দার্জিলিং, মালাই চা, আর তোকে স্পেশালি বানাতে হবে সেই ‘ভিজে সন্ধ্যার চা’। আমার প্রিয়।”
তুলি হেসে গড়িয়ে পড়ে, “তুই তো ক্যাফের থেকে আমার ওপরই বেশি ইনভেস্ট করছিস।”
রুদ্র চোখ সরিয়ে বলে, “তুই তো আমার সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট।”

খুব অল্প সময়ের মধ্যে তারা নিজেদের হাতে গড়া ছোট্ট ক্যাফের মধ্যে একটা জগত বানিয়ে নেয়। উদ্বোধনের দিন তারা চেয়েছিল ছোট করে কিছু হবে, কিন্তু হঠাৎ করে শিবু কাকাই একদিন দোকানে পোস্টার লাগিয়ে দিলেন—“তুলির ক্যাফে খুলছে! তিনটা পঁচিশে গিয়ে চা খেয়ে এসো।”

রুদ্র বলল, “তুই না বলেছিলি কেউ জানুক চাইিস না?”
তুলি হাসে, “এখন চাই সবাই জানুক। কারণ আমি তো শুধু ক্যাফে খুলিনি, আমি তোকে আমার জীবনে জায়গা দিয়েছি। সেই গল্পটাই এখন সকলের হোক।”

উদ্বোধনের দিন ক্যাফে ভর্তি লোক। পুরনো বন্ধুরা, রুদ্রর সহকর্মীরা, তুলির মা, রুদ্রর মা, অনির্বাণ, আর এমনকি শিবু কাকাও এসে বললেন, “তোমরা দুজন আমার দোকানের চা খেয়ে যা গড়েছো, সেটা আমি কোনওদিন ভুলব না।”

চায়ের কাপের ফাঁকে লেখা ছিল একটি লাইন—“এখানে চা শুধু পানে নয়, অনুভবেও হয়।”
দেয়ালে ঝোলানো ছিল সেই প্রথমদিনের দুটাকার বিল, আর নিচে লেখা—“প্রথম দেখা।”

সন্ধে নামলে ক্যাফে একটু ফাঁকা হয়। রুদ্র তুলির হাত ধরে বলে, “তুই জানিস, এই ক্যাফে তোকে ভালোবেসে তৈরি করেছি। কিন্তু আমি চাই, এটা শুধু প্রেমের স্মৃতি না হোক—এটা হোক আমাদের সাহসের প্রতীক।”
তুলি তার দিকে তাকায়, বলে, “তুই থাকলে, আমি কোনওদিন থামব না রুদ্র।”

তারা দুজনে সেই পুরনো কাঠের টেবিলের পাশে বসে চা খায়, স্মৃতির গন্ধে ভরে ওঠে দোকান। আর বাইরে তখন, একজোড়া ছেলে-মেয়ে হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে—হয়তো তাদের গল্পও শুরু হতে চলেছে।

পর্ব ৯ — শহরের রাস্তায় লেখা কবিতা

তুলি এখন আর শুধু অফিসে যাওয়া-আসার ক্লান্ত মুখ নয়। ক্যাফে খুলে যাওয়ার পর তার ভেতর যেন নতুন আলো ফুটেছে। চোখে আগুন নেই, আছে আলো—যে আলো নিজেকে জ্বালিয়ে অন্যকে আলোকিত করে। সে এখন সকালবেলা উঠে নিজের বানানো মেনু চেক করে, ফ্ল্যাভারগুলো ঠিকঠাক আছে কি না দেখে, ডায়েরির পাশে বসে চায়ের গল্প লেখে। আর বিকেল তিনটা পঁচিশে হলে রুদ্র এসে হাজির হয়, দু কাপ চায়ের গন্ধে ভিজিয়ে দেয় তাদের প্রতিদিনের প্রেম।

তাদের ক্যাফের নাম “চায়ের কাপের ফাঁকে” শহরে আলাদা জায়গা করে নিচ্ছে। কেউ বলে এখানে এসে নিজের পুরনো প্রেমিকার কথা মনে পড়ে, কেউ এসে বলে—এখানেই বসে চাকরির ইন্টারভিউর প্রস্তুতি নিয়েছিল, কেউ কেউ আবার চুপ করে এসে বসে, একটা চা খায়, আর একটা চিরকুট রেখে যায় দেওয়ালে ঝোলানো খোলা নোটবুকে।

তুলি সেই চিরকুটগুলো পড়ে। কিছু কবিতা, কিছু গল্প, কিছু অশ্রু। রুদ্র বলে, “তুই জানিস? তোর এই ক্যাফে শহরের প্রেমিকদের শেষ আশ্রয় হয়ে উঠছে।”
তুলি হেসে বলে, “তাদের প্রেম ভাঙলেও, আমি চাই ওদের গল্প রয়ে যাক। চা যেমন ঠান্ডা হয়ে গেলেও গন্ধ থাকে, ভালোবাসাও তেমনি।”

একদিন ক্যাফেতে বসেই তুলি একটা কবিতা লিখছিল—হঠাৎ রুদ্র এসে বলল, “তুই যদি আজ একটা সাদা পৃষ্ঠায় শুধু ‘চলবোই’ শব্দটা লেখ, তাহলেও আমি সেটা কবিতা বলে মেনে নেব।”
তুলি অবাক হয়ে বলল, “কেন?”
রুদ্র হাসল, “কারণ আমি জানি, তুই যদি বলে ‘চলবোই’, তাহলে আমি সেই পথে নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারি।”

তাদের মধ্যে এখন আর মুচকি হাসির পর্দা নেই, এখন সম্পর্কটা অনেকটাই খুলে গেছে, অনেকটা বেড়েছে, অনেক বেশি নরম, সাহসী ও স্পষ্ট।

একদিন দুপুরে ক্যাফেতে এক বুড়ো ভদ্রলোক এলেন, হাতে পুরনো টাইপ করা এক চিঠি। বললেন, “আমি প্রতিদিন এই রাস্তা দিয়ে যাই। আজ হঠাৎ ঢুকলাম। এই জায়গাটা আমাকে আমার স্ত্রীকে মনে করিয়ে দিল, যিনি আর নেই। আমি তার জন্য লিখে রেখেছিলাম একটা চিঠি, কেউ কোনওদিন পড়েনি। আজ এখানে রেখে যাচ্ছি।”

তুলি স্নিগ্ধ হেসে চিঠিটা নিয়ে বলল, “এই ক্যাফেতে যা লেখা হয়, তা আর ফেলে দেওয়া হয় না। আমরা রাখি। আমরা সাজিয়ে রাখি।”

তারা এখন ক্যাফের দেওয়ালে প্রতিদিন নতুন কোটেশন লিখে—আজকের কোটেশন ছিল:
“এক কাপ চা, এক চিমটে গল্প, আর একজন অপেক্ষা—এই দিয়েই সম্পর্ক তৈরি হয়।”

কিন্তু ভালোবাসার গল্পে যেমন আলো থাকে, তেমনি মাঝেমধ্যে ছায়াও নামে।
সেদিন বিকেলে রুদ্র এল না। এটা নতুন কিছু না, এমন হয়েছে আগেও। কিন্তু এবার ফারাক ছিল—মেসেজ করেও রিপ্লাই নেই, ফোনেও সুইচড অফ।

তুলি প্রথমে ভাবল, কোনও ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে ব্যস্ত হবে। কিন্তু রাত গড়াতে শুরু করল, এবং তার সঙ্গে তার মনেও অজানা ভয় ঢুকে পড়ল।

সকালবেলা রুদ্রর মা এসে দাঁড়াল ক্যাফেতে। চোখে উদ্বেগ, কপালে চিন্তার রেখা। বললেন, “রাত থেকে রুদ্র বাড়ি ফেরেনি। ফোন বন্ধ। কোথাও গেছে বলেও জানায়নি।”

তুলির বুক ধড়াস করে উঠল। সে শুধু বলল, “আমি খুঁজে বের করব। আমি জানি কোথায় যেতে পারে।”

সে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে গেল সেই ছাদে—যেখানে তারা একদিন চুপ করে বসে ছিল শহরের ওপরে। কিন্তু ছাদ ফাঁকা। বাতাসও স্তব্ধ।

তারপর সে গেল কলেজ স্ট্রিটের পেছনের গলিতে, সেই পুরনো দোকানে যেখানে তারা প্রথম একসঙ্গে বসে ছিল সামোসা খেতে। দোকান বন্ধ।

শেষে সে গেল হ্যারিসন রোডের সেই শিবু কাকার দোকানে। দোকান খোলা, কিন্তু চেয়ার খালি। শিবু কাকা বললেন, “কাল রাত দশটায় এসেছিল। কিছু বলেনি। শুধু বসে ছিল। তারপর উঠে গেল।”

তুলি দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা কাজ করছে না। তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে, দোকানের একপাশে একটা ছোট্ট সাদা চিরকুট পড়ে আছে। তুলির কাঁপা হাত তুলে নেয় সেটা।

তাতে লেখা:
“তুই যদি বুঝিস আমি কেন হারিয়ে গেছি, তাহলে তুইই আমায় খুঁজে পাবি। আমি তোর বিশ্বাসে কোথাও আছি, কোথাও লুকিয়ে, যেখানে শুধু তুই পৌঁছতে পারিস। তুই যদি সত্যিই আমার হয়ে থাকিস, তাহলে আসবি—সেই ট্রামলাইন পেরিয়ে, সেই পুরনো লাইব্রেরির পিছনের বেঞ্চে। আমি তোর জন্য অপেক্ষা করব, যতক্ষণ না তুই আসিস।”

তুলি দৌড় দেয়। সে ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যায় সেই জায়গায়—রাস্তায় ট্রামের লাইন পেরিয়ে, পুরনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির পিছনের বেঞ্চে।

সেখানে বসে আছে রুদ্র। চোখে অদ্ভুত ক্লান্তি, হাতে একটা পুরনো নোটবুক।

তুলি কিছু বলে না। গিয়ে পাশে বসে।

রুদ্র ধীরে বলল, “আমি মাঝে মাঝে ভয় পাই রে তুলি। ভাবি, এই যা পাচ্ছি, তা কি আমার প্রাপ্য? আমি কি সত্যিই তোকে ধরে রাখতে পারি? যদি একদিন তুই হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যাস?”

তুলি তার হাত ধরে বলে, “তুই তো দেখলি, তুই হারিয়ে গেলেও আমি খুঁজে নিই। আমি থাকব। আমি সবসময় থাকব। কারণ আমরা শুরু করেছি এক কাপ চা দিয়ে, কিন্তু শেষটা লিখব ভালোবাসায়।”

তারা দুজন পাশাপাশি বসে থাকে, শহরের ভিড়ের মধ্যে, চুপচাপ, কিন্তু হৃদয়ের প্রতিটি শব্দে শব্দতরঙ্গ বেজে চলেছে—একসঙ্গে থাকার।

পর্ব ১০ — চায়ের কাপে ভেসে থাকা সকাল

রুদ্র আর তুলির সম্পর্ক আজ আর শুধুমাত্র চায়ের দোকানের গল্প নয়, সেটি এখন শহরের রাস্তায় লেখা এক চলমান কবিতা—যার প্রতিটি চরণ জীবনের নানান ছায়া ছুঁয়ে গেছে। তারা হারিয়েছে, খুঁজেছে, ভুল বোঝে আবার ক্ষমা করেছে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—তারা একে অপরকে ধরে রেখেছে। আজ তাদের ক্যাফে “চায়ের কাপের ফাঁকে” এক বছরের হয়ে গেল। এক বছর আগে এক বিকেলে তারা যেখানে বসে ছিল শিবু কাকার দোকানে, সেখান থেকে আজ এই ছোট্ট ক্যাফেটা হয়ে উঠেছে কতগুলো মানুষের আড্ডার ঠিকানা, চুপ থাকা প্রেমের আশ্রয়, কিংবা একলা মানুষদের সাহস জোগানোর চুপচাপ দেয়াল।

সকাল সকাল তুলি আজ ক্যাফেতে এসেছে। হাতে লাল গোলাপ, একটা পুরনো খাতা আর একটা ছোট্ট কাঠের বাক্স। সে জানে রুদ্র আজ দেরি করবেই, কারণ সে পরিকল্পনা করছে কিছু। গত রাতেও সে মেসেজ করেছিল—“কাল তো আমাদের এক বছর। কিন্তু আমি ভাবছি, আমরা কি শুধু প্রেম করছি? না আমরা একসঙ্গে বাঁচার চেষ্টাও করছি?”

তুলি মনে মনে হাসে। এই “প্রেম না বাঁচা”—এই দ্বন্দ্বই তো তাদের গল্পের সৌন্দর্য।

সে ক্যাফের টেবিলগুলো একে একে সাজায়। দেওয়ালে নতুন কোটেশন লেখে—
“ভালোবাসা মানেই চা খাওয়া নয়, সেটা মানে চুপ করে চায়ের কাপে চোখ রেখে পাশে বসে থাকা।”

কয়েকটা পরিচিত মুখ একে একে আসতে থাকে। অনির্বাণ আসে হাতে একটা সাদা কাগজ, তাতে লেখা—“তোমাদের প্রেমে আমি বিশ্বাস করেছি আবার।”
শিবু কাকা এসে বলেন, “আজ তোমাদের চায়ের কাপ আমি নিজে বানিয়ে দিলাম।”
রুদ্রর মা আর তুলির মা একসঙ্গে বসেন, মুখে হাসি, চোখে গর্ব।

কিন্তু রুদ্র আসে না।

তুলি জানে ও আসবেই। কিন্তু এই প্রতীক্ষার মধ্যেও এক অদ্ভুত কম্পন কাজ করে। এতদিনের প্রেম, এত বাঁক, এত অনিশ্চয়তা—সব কিছুর শেষে আজকের দিন যেন তার জীবনের সবচেয়ে ধীর সকালে পরিণত হয়েছে।

হঠাৎ দরজা খোলে। রুদ্র ঢোকে। গায়ে হালকা শার্ট, হাতে গিটার, কাঁধে ব্যাগ, আর মুখে সেই একই নরম হাসি।
তুলি অবাক হয়, “তুই গিটার আনলি?”
রুদ্র বলে, “হ্যাঁ। কারণ আজ তোর জন্য একটা গান লিখেছি।”

সে বসে পড়ে, চারপাশটা নিঃশব্দ হয়ে যায়।
তার গলার আওয়াজ ভেসে ওঠে—

“তুই যখন চুপ থাকিস, আমি বুঝি
তুই যখন তাকাস, আমি লিখি
তুই যখন হাত ধরি, আমি বাঁচি
তুই যখন থাকিস, আমি কেবল থাকি না—আমি হই।”

গান শেষ হলে সবাই তালি দেয়। তুলি কিছু বলে না, শুধু চোখে জল নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
রুদ্র এগিয়ে এসে বলে, “আজ আমি তোর সামনে দাঁড়িয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই।”
তুলি অবাক হয়ে বলে, “প্রশ্ন?”
রুদ্র ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট বক্স বার করে। খোলার পর দেখা যায়—একটা রিং। কিন্তু সেটা কোনও দামি হিরে-জহরত নয়, বরং ক্যাফের কাঠের পুরনো চায়ের কাপে থেকে তৈরি একখানা কাঠের রিং, যার ওপরে ছোট করে খোদাই করা—“চলবোই”।

রুদ্র হাঁটু গেড়ে বসে বলে, “তুলি, আমি তোকে কোনো রকম আড়ম্বর দিতে পারি না। আমি তোকে প্রমিস করতে পারি না এক ঝলমলে ভবিষ্যৎ। কিন্তু আমি তোকে কথা দিতে পারি, প্রতিদিন তিনটা পঁচিশে আমরা এক কাপ চা খেতে বসব। তুই আমার পাশে থাকবি তো?”

তুলি ফুপিয়ে ওঠে। মাথা নাড়ে। “হ্যাঁ, আমি পাশে থাকব। প্রতিদিন, প্রতি সন্ধে, প্রতিটি চায়ের কাপে।”
রুদ্র আঙুলে রিং পরিয়ে দেয়। সবাই উচ্ছ্বাসে ভরে যায়।

সন্ধেবেলা ক্যাফে একটু ফাঁকা হয়ে গেলে, তুলি আর রুদ্র জানালার পাশে বসে থাকে। শহরের আলো কমছে, ট্রামের লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে মানুষ, ছাতা হাতে, ব্যাগ কাঁধে। রুদ্র বলে, “তুই জানিস, আমরা তো এই শহরেরই প্রেম। কেউ আমাদের দেখে না, কিন্তু আমরা আছি।”
তুলি বলে, “আর আমরা যারা থাকি, তারা চুপচাপ থেকেই গল্প বানিয়ে যাই। যেমন আমরা লিখেছি—চায়ের কাপের ফাঁকে।”

সেই মুহূর্তে বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়।
রুদ্র কাপ তুলে বলে, “তোর সেই প্রথমদিনের লাল মুড়ি চাস?”
তুলি বলে, “হ্যাঁ। আর তোর ‘ভিজে সন্ধ্যার চা’?”
রুদ্র হেসে বলে, “চাই-ই চাই। কারণ এই চা-ই আমার প্রপোজালের সঙ্গী ছিল।”

চায়ের কাপ ধোঁয়া তোলে। শহর চুপ হয়ে যায়। ক্যাফের ভিতর প্রেম জমে, কবিতা ফোটে, আর একটি সম্পর্ক, অনেক ভাঙাগড়ার পর, এসে দাঁড়ায় এক চা-ভেজা সকালের সামনে।

[শেষ] – ধন্যবাদ, পাঠক –
“চায়ের কাপের ফাঁকে” গল্পের সঙ্গে কাটানো সময়ের জন্য। ভালোবাসা থাকুক, প্রতিদিন, প্রতিটি চায়ের কাপে।

 

1000025139.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *