ঋদ্ধিমান দাশ
পর্ব ১: কাগজের পাতা, ধোঁয়ার রেখা
ক্যাফে কুয়াশার দরজায় টাঙ্গানো পুরনো ঝোলানো ঘণ্টাটা বাজল, আরোহী ঢুকল ধীরে, একহাতে ব্যাগ, অন্য হাতে ফোন। অফিস থেকে সরাসরি আসছে, মাথাটা কেমন যেন ভারী, দিনের ঝাপসা ক্লান্তি তাকে গিলে খেতে চাইছে। কিন্তু এই ক্যাফেটার ভেতরটা যেন অন্যরকম—জানলার কাচ দিয়ে বিকেলের আলো এসে পড়ছে সোনালি ছায়ায়, দেওয়ালে ঝোলানো বইয়ের কভার আর পুরনো বাংলা গানের পোস্টার। তার প্রিয় টেবিলটা—ডান দিকের কোণারটা—আজ খালি।
সে বসে, ব্যাগটা পাশে রাখে। ওয়েটার রাজু এসে জানতে চায়, “দিদি, এক কাপ স্পেশাল দার্জিলিং আর কালচার্ড বিস্কুট দেব?”
“হ্যাঁ, আর একটা গরম জল দিও, মাথা ধরেছে,” বলে সে, চোখ বন্ধ করে চেয়ার পেছনে হেলিয়ে দেয়।
দশ মিনিট পরে রাজু চা আর বিস্কুট দিয়ে যায়। কাপটা তুলতেই আরোহীর চোখে পড়ে—চায়ের তলায় কিছু একটা। কাপ তুলে দেখে, গোল করে কাটা একটা কাগজ, যেন কেকের ডো থেকে গোল টুকরো কেটে নেওয়া হয়েছে। আর তার ওপর লেখা—
“তোমার চোখে সন্ধ্যাবেলা /
অন্ধকার নেমে এলে দেখি /
আলোও হয়ে ওঠে আশ্চর্য কাব্য।”
আরোহী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। নরম হস্তাক্ষরে লেখা, কালো কালিতে। যেন কাগজটার গায়ে আবছা ধোঁয়ার গন্ধ লেগে আছে। সে তাকায় চারপাশে—কেউ কিছু দেখছে না, সবাই ব্যস্ত নিজের বই, ফোন বা প্রেমিক-প্রেমিকার ঝগড়ায়।
সে ভুরু কুঁচকে রাজুকে ডাকে, “এই রাজু, এটা কে দিয়েছে?”
রাজু তাকায়, “কি দিদি?”
“এই কাগজটা… কাপের নিচে ছিল। তুমি রেখেছিলে?”
“আমি না দিদি। কিচেনে থেকে একসাথে কাপ গুলো আসে। অনেক সময় তো টেবিলের নীচে কাগজ পড়ে থাকে, হয়ত… না কি কেউ রেখে গেছে?”
আরোহী চুপ করে যায়। একটা অদ্ভুত অস্থিরতা পাক খায় তার বুকের মধ্যে। সে কবিতা ভালোবাসে, ছোটবেলায় নিজেও লিখত, কিন্তু কখনো এমন করে কেউ তাকে কিছু লিখে দেয়নি। নিজের অজান্তেই সে কবিতার পংক্তিগুলো আবার পড়ে, ফিসফিস করে বলে—“আলোও হয়ে ওঠে আশ্চর্য কাব্য।”
পরের দিন সে আবার আসে ক্যাফেতে। এবার একটু আগে। টেবিলে বসে চা আসে, বিস্কুট আসে। এবার আর কাগজটা পাওয়া যায় না। খানিকটা হতাশ হয় সে। ঠিক তখন, রাজু আবার এসে বলে, “দিদি, কাপটা একটু বদলে দিলাম, আগেরটায় চা পড়ে গেছিল।”
নতুন কাপের তলায় আবার একটা কাগজ।
“যদি একদিন হারিয়ে যাই /
তবু কি থাকবে তোমার খেয়ালে? /
জানালার ধারে রাখা কুয়াশার মত?”
আরোহীর গায়ে কাঁটা দেয়। কবিতাটা যেন তার বুকের ভেতর কেটে যায়। কে লেখে এসব? আর কেন তার জন্য?
সে এবার টেবিল ছেড়ে উঠে চারপাশে হাঁটে। দুটো কলেজ ছাত্র হেসে গল্প করছে, এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক কাগজ পড়ছেন, এক তরুণী ল্যাপটপে টাইপ করছে। আর পেছনের কোণায়, এক ছেলেমানুষ চুপ করে বসে আছেন, ছাইরঙা সোয়েটার পরে, চোখে ভারী ফ্রেমের চশমা। তার সামনে একটা খাতা খোলা, কিন্তু কলম চলছে না। শুধু তাকিয়ে আছেন বাইরে, জানলার কুয়াশার দিকে।
আরোহী সন্দেহ করে। হয়ত তিনিই কবি।
কিন্তু তার সাহস হয় না গিয়ে জিজ্ঞাসা করার। বরং সে আবার নিজের টেবিলে ফিরে আসে, কাগজটায় আঙুল বুলিয়ে বলে, “আচ্ছা, তুমি কে? আর কী চাও আমার থেকে?”
তারপর সে কাগজটা ব্যাগে রাখে—পরে হয়ত লিখে রাখবে নিজের ডায়েরিতে। এখন শুধু জানে, তার জীবনে কিছু একটা বদলাচ্ছে—চায়ের কাপের ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
পর্ব ২: শব্দেরা যা বলতে চায়
আরোহীর দিনগুলো কেমন যেন বদলে যেতে লাগল। সকালটা এখন শুরু হয় আগের দিনের সেই ছোট্ট কবিতাটা আবার পড়ে। রাতটা শেষ হয় একটা নতুন প্রত্যাশায়—পরের কবিতায় কী থাকবে? কেউ কি লিখছে শুধু তার জন্য? না কি এটা একটা খেলা, কাকতাল?
তৃতীয় দিনের বিকেলেও সে এল ক্যাফে কুয়াশায়। আজকের দিনটা ছিল একটু খারাপ—ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে ভুল রিপোর্ট, বসের কড়া ধমক, আর সহকর্মী রোহিতের সেই চিরাচরিত, নির্লজ্জ হাসি। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও তার মন জানে—আজও হয়তো চায়ের কাপের নিচে একটা আশ্বাস থাকবে। শব্দের আশ্বাস।
রাজু এবার আর কিছু না বলেই চা নিয়ে এল। আরোহী কাপটা তুলল—হ্যাঁ, নিচে আছে।
“শব্দেরা আমায় ডাকছে /
তোমার ঠোঁটের ধারে দাঁড়িয়ে /
একটি অব্যক্ত কবিতার আশায়।”
তার নিঃশ্বাস আটকে যায়। চোখ বুজে কবিতাটা বারবার পড়ে। এই যে “তোমার ঠোঁটের ধারে” — এটা কি কেবল শব্দের খেলা, না কি তার মুখের দিকেই তাকিয়ে লেখা?
সে এবার চোখ তুলে দেখে। আজকের ক্যাফেতে তেমন ভিড় নেই। দু-একটা মুখ চেনা মনে হয়, কিন্তু কারো চোখে সেই চাহনি নেই—যে চাহনিতে একটা কবিতা জন্ম নেয়।
তবু সে সিদ্ধান্ত নেয়, এবার কিছু একটা করতে হবে। পরের দিন সে নিজের ব্যাগে নিয়ে আসে একটা ছোট্ট খাতা। আর লেখে—
“আমি প্রতিদিন তোমার পংক্তি পাই,
কিন্তু তুমি কি জানো—
সেই পংক্তি গুলো
আমার একলা দিনের শ্বাস?”
লিখে সে ভাঁজ করে কাগজটা রেখে দেয় টেবিলের নীচে, ঠিক সেই জায়গায় যেখানে কাপটা থাকে। এবার সে অপেক্ষা করে। কিন্তু আজ কবিতা এল না। শুধু চা, বিস্কুট, আর সেই নিঃসঙ্গ জানলা।
পরের দিন আবার আসে সে, আবার অপেক্ষা করে। এবার কাপের নিচে কাগজ নেই, কিন্তু টেবিলের নীচে রাখা নিজের ভাঁজ করা কাগজটাও নেই। সে হঠাৎই অস্থির হয়ে পড়ে। তাহলে কি কেউ পড়ে নিয়েছে? তাহলে কি সেও জানে যে, আরোহী অপেক্ষা করছে?
ঠিক তখনি রাজু এসে বলে, “দিদি, আপনাকে একটা কাগজ দিয়েছেন কেউ। বাইরে গেটের কাছে রেখে গেছেন। আমি রেখে দিয়েছিলাম।”
আরোহী কাগজটা নেয়। খোলা চিঠির মতো। শুধু একটা পংক্তি লেখা—
“তুমি উত্তর দিলে, আমি প্রশ্ন হয়ে থাকি।
তুমি চুপ করলে, আমি কবিতা হয়ে যাই।”
এবার আরোহী আর বসে থাকতে পারে না। গেটের দিকে ছুটে যায়। ক্যাফের বাইরে তখন বিকেলের হালকা আলো, ছায়া ওড়ে গাছের পাতায়। রাস্তায় তিন-চারজন হাঁটছে, কিন্তু কেউ চেনা নয়।
সে জানে, কেউ ছিল এখানে। তাকে দেখেছে। তাকে বুঝেছে। আর শব্দের পেছনে মুখ লুকিয়ে গেছে।
তবে আজ সে ভয় পাচ্ছে না। বরং প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে—সে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, যার প্রতিটি বাক্য নতুন কোনো অনুভবের দুয়ার খুলছে।
চায়ের কাপ, কাগজ, কবিতা—এ সব এখন আর রহস্য নয়, বরং এক গভীর টান। একজন অজানা কবি, যিনি তাকে জানার চেষ্টা করছেন।
আর আজ থেকে, আরোহীও খুঁজবে তাকে—ছায়ার মধ্যের সেই ছায়াকে।
পর্ব ৩: ছায়া ও স্বর
আরোহীর জীবন যেন দুটো ছন্দে ভাগ হয়ে গেছে—একটা তার অফিসের গনগনে বাস্তবতা, যেখানে টাইমশিট আর টার্গেটে জীবন মেপে চলে, আরেকটা ক্যাফে কুয়াশার ছায়াস্নান কবিতাময় বিকেল, যেখানে অদেখা কেউ তার জন্য রেখে যায় বাক্যের প্রজাপতি।
আজ শুক্রবার। অফিস থেকে বেরিয়ে আসার সময় রোহিত হেসে বলে, “চা তো নিশ্চয় আবার সেই কাফেতেই? না কি কারো জন্য অপেক্ষা?”
আরোহী একটা ম্লান হাসি দেয়। সে জানে, রোহিত এসব বলে, কারণ সে বুঝতে পেরেছে আরোহীর কোথাও একটা মন পড়ে আছে।
কিন্তু সে জানে না, মন পড়ে থাকে না—মনের ভিতরে কেউ থাকে।
আজ সে একটু আগে পৌঁছায়। ক্যাফেতে ঢুকে দেখে, তার প্রিয় কোণার টেবিলটা খালি। সে বসে। রাজু জল দেয়, হাসে। আরোহী জিজ্ঞেস করে, “রাজু, যে কাগজটা আমাকে দিয়েছিলে আগের দিন, তার মুখ দেখেছ?”
রাজু মাথা নাড়ে, “না দিদি। কেউ হয়তো গেটের কাছে রেখে গেছে। খেয়াল করিনি।”
“কিন্তু চায়ের কাপের নিচে কাগজগুলো?”
রাজু হেসে বলে, “এখানে সবাই চা খায়, দিদি। আপনি ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেছে বলে মনে হয় না।”
আরোহী মাথা নাড়িয়ে চুপ করে যায়।
আজও চা আসে। আর কাপের নিচে একটুখানি ভেজা কাগজ। সে তুলে নেয়।
“তুমি যদি দেখো একদিন
একটা ছায়া তোমার ছায়ার পাশে হাঁটছে—
জেনো, সে আমি।”
এইবার সে আর চুপ থাকতে পারে না। সে চারপাশে নজর রাখে। সামনে এক বয়স্ক দম্পতি, পাশের টেবিলে দুজন ছাত্রী পড়ছে, আর ক্যাফের সবার পেছনে, পর্দার মতো ঝুলছে কিছু আলো-ছায়া মেশানো নীরবতা।
সে উঠে পড়ে। ধীরে ধীরে হাঁটে জানলার দিকে। জানলার ধারে যেই ছেলেটা প্রায় প্রতিদিন বসে থাকে, ছাইরঙা সোয়েটার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে, আজও সেখানেই। খাতা খোলা, কিন্তু কিছু লেখা হচ্ছে না।
সে কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। ছেলেটা তাকায় না। শুধু চুপ করে খাতায় দৃষ্টিতে আটকে থাকে।
আরোহী ধীরে বলে, “তুমি কি কবিতা লেখো?”
ছেলেটা এবার তাকায়। তার চোখের মধ্যে একটা স্পষ্ট হতচকিত ভাব, তারপর একরকম গম্ভীর মৃদু হাসি। সে মাথা নাড়ে—‘হ্যাঁ’।
“তুমি কি সেই…?” আরোহীর গলা একটু কাঁপে।
সে এবার কলমটা তার খাতার ওপর রাখে। একটা কাগজ ছিঁড়ে নিয়ে কিছু লেখে। আরোহীর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
আরোহী পড়ে—
“তোমার প্রশ্নে আমি জন্ম নেই,
তোমার চাহনিতে ফিরে যাই।”
এই প্রথম সে মুখে শব্দ ফোটায়, “তুমি আমার নাম জানো?”
ছেলেটা মাথা নাড়ে। এবার একটু কথা বলে—গলার স্বর নরম, কিন্তু যেন অভ্যস্ত না শব্দে, “তুমি এলেই ক্যাফেটা বদলে যায়। আর তাই, তোমার নাম জানার দরকার হয় না।”
আরোহীর বুকের ভিতর কি একটু কেঁপে উঠল?
তবু সে বলল, “আমি আরোহী।”
ছেলেটা মৃদু হাসে। “আমি সাগ্নিক।”
ক্যাফের বাইরে তখন সন্ধ্যা নামছে। আলো ছায়ার খেলা জানলার কাচে আঁচড় কাটছে। আর চায়ের কাপটা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসছে।
এই প্রথম তারা দুজন কথা বলল, খুব সামান্য, কিন্তু যেটুকু বলল, তা বাক্যের চেয়ে বেশি ছিল।
পর্ব ৪: পরিচয়ের বাইরে
সেদিনের পর থেকে আরোহীর দিনগুলোর ছন্দ বদলে গেল। অফিসে বসে রিপোর্ট বানানোর ফাঁকেও সে মাঝেমধ্যে সাগ্নিকের মুখ মনে করে—চোখ দুটো যেন নির্জন জানালার মতো, যেখান থেকে কেবল বাইরে তাকানো যায়, কিন্তু ভিতরে কেউ ঢুকতে পারে না।
তারপর আসে সেই বিকেল। ক্যাফে কুয়াশা। আরোহী একটু দেরি করে পৌঁছয়। আজ তার প্রিয় টেবিলটা দখল হয়ে গেছে। সে অন্য কোণায় বসে। রাজু চা নিয়ে আসে, বিস্কুটও। কিন্তু আজ চায়ের কাপের নিচে কিছু নেই।
সে খানিকটা হতাশ হয়। সাগ্নিক কি আজ আসেনি?
ঠিক তখন সাগ্নিক এসে দাঁড়ায় তার টেবিলের পাশে। তার হাতে একটি ছোট্ট খাতা। মুখে সেই চেনা নীরবতা।
“তোমার জন্য কিছু এনেছি,” বলে সে, খাতাটা এগিয়ে দেয়।
আরোহী নরম হাতে খাতাটা নেয়। খুলে দেখে, তাতে লেখা অনেকগুলো কবিতা। কিন্তু সব কবিতার উপরে শুধু একটা নাম—“তুমি”।
“এগুলো সব…?” আরোহীর গলা কাঁপে।
সাগ্নিক মাথা নাড়ে, “তুমি এসেছিলে বলেই লিখতে পেরেছি। তুমি না এলে… এই শব্দগুলো থাকত না।”
আরোহীর বুকের ভেতরে একটা অনুচ্চারিত কৃতজ্ঞতা গড়ে ওঠে। এমন অনুভব সে আগে কখনও পায়নি। কারো কাছে এভাবে শব্দ হয়ে ওঠা, কবিতার বিষয় হয়ে ওঠা—সে যেন নিজেকেও নতুন করে চিনছে।
“তুমি কি জানো, আমি কেন প্রতিদিন আসি এখানে?”
সাগ্নিক একটু চুপ করে থাকে, তারপর বলে, “হয়তো চায়ের জন্য… হয়তো কারো জন্য।”
“তুমি কবে থেকে আমায় লিখছো?”
সে চোখ নামিয়ে বলে, “যেদিন প্রথম তোমায় দেখলাম জানলার ধারে বসে, এক কাপ চা হাতে, একা—সেইদিন থেকে। তুমি কিছু বলোনি, কেউ আসেনি তোমার সাথে, শুধু চা খেতে খেতে বাইরে তাকিয়ে ছিলে। তোমার সেই নিঃশব্দ চোখেই আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম।”
আরোহীর মনে পড়ে যায় সেই দিনটা—একটা বাজে প্রেজেন্টেশনের পর ছুটে এসেছিল সে কাফেতে, কারো সাথে না কথা বলে একা বসেছিল জানলার ধারে। চায়ের কাপের ধোঁয়ার ভেতর চোখ রেখেছিল বহুক্ষণ।
সে বুঝতে পারে, পরিচয়ের বাইরেও কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে—যা শুধু অনুভবের উপর দাঁড়িয়ে থাকে, কোনো নাম, কোনো সংজ্ঞা, কোনো তকমা লাগে না।
আজ সাগ্নিক তার কাছে একটা খাতা দিয়েছে। কিন্তু সত্যি বলতে, সে নিজেই অনেক আগে থেকেই সেই খাতার একটি পৃষ্ঠা—যেখানে সাগ্নিক প্রতিদিন লিখে গেছে, নিঃশব্দে, ভালোবাসা।
ক্যাফের বাতি তখন একটু মৃদু, চায়ের কাপ ঠান্ডা, আর জানলার বাইরে ছায়ারা ঘনিয়ে আসছে।
তারা কেউ কিছু বলে না, শুধু বসে থাকে পাশাপাশি, যেন দুটো পংক্তি—যার মধ্যে কেবল একটি নীরব অলঙ্কার।
পর্ব ৫: দুটি চায়ের গল্প
রবিবারটা কলকাতার গরমে গলছে। আকাশে মেঘ নেই, রোদের কাঁটা যেন চামড়ার ভেতর ঢুকে যায়। তবু বিকেলে বাতাস একটু নরম হয়। আরোহী আজ ছুটির দিনে কোথাও না গিয়ে আবার এসে দাঁড়ায় সেই চেনা কাফের সামনে।
আজ ক্যাফে কুয়াশা খানিকটা বেশি খালি। রবিবার বলে হয়ত কেউ কেউ সিনেমা দেখতে গেছে, কেউ পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু আরোহীর কাছে এই ক্যাফেই এখন পরিবার, সিনেমা, এবং কাব্য।
সে ভেতরে ঢুকে দেখে, সাগ্নিক আজও আগেই এসে বসে আছে। কিন্তু আজ সে জানলার পাশে না বসে, সেই পুরনো কোণার টেবিলে বসেছে—যেখানে প্রথম কাগজ পেয়েছিল আরোহী।
সাগ্নিক তাকে দেখে একটু উঠে দাঁড়ায়। “বসবে?”
আরোহী বসে, চুপচাপ।
রাজু এসে বলে, “দুজনের জন্য চা?”
সাগ্নিক তাকিয়ে বলে, “দু-কাপ, কিন্তু আজ ওরটা একটু মিষ্টি কম। আর আমারটায় অল্প আদা।”
আরোহী অবাক হয়ে তাকায়। “তুমি জানো আমি কম মিষ্টি খাই?”
সাগ্নিক হেসে বলে, “তোমার মুখ দেখে মনে হয় না তুমি মিষ্টি চা খেতে পারো।”
আরোহী এবার হেসে ফেলে। দীর্ঘদিন পরে এমনভাবে কেউ কথা বলছে, যেটা কেবল দেখার অভ্যেস থেকে—not judgment, not flirtation—just observation.
চা আসে। তারা দুজন একসঙ্গে প্রথমবার চা খায়। এতদিন ধরে কবিতা এসেছে, উত্তর এসেছে, খাতা এসেছে—কিন্তু এই প্রথম, চায়ের কাপ একসাথে ঠোঁটে।
চুপ করে বসে থাকতে থাকতে সাগ্নিক বলে, “তুমি কবিতা পড়ো?”
আরোহী বলে, “আগে পড়তাম। এখন শুধু তোমার কবিতাগুলো পড়ি।”
সাগ্নিক একটু লজ্জা পায়। “আমি তো শুধু শব্দ সাজাই। তুমি যেভাবে পড়ে ফেলো, আমি তো বুঝতেই পারি না, এত গভীর করে কেউ দেখছে।”
আরোহী বলে, “তুমি কি জানো, তোমার কবিতা আমার ভিতর একটা আলো জ্বালায়?”
সাগ্নিক চোখ নামিয়ে চা নেড়ে বলে, “আলো তো অনেক সময় ছায়া তৈরি করে।”
কথাটা শুনে আরোহীর গায়ে কাঁটা দেয়। হঠাৎ সে প্রশ্ন করে, “তোমার কেউ নেই?”
সাগ্নিক চুপ করে থাকে। তারপর মাথা নাড়ে। “ছিল। চলে গেছে। অনেক আগেই। তাই আমি শব্দে খুঁজি তাকে। হয়তো ভুল। কিন্তু শব্দই তো আমার হাত।”
আরোহী জানে না সে কী বলবে। একসময়ে সেও ভেঙেছিল—একটা সম্পর্কের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে নতুন করে গড়েছিল। এখন বুঝতে পারছে, আমরা সবাই কবিতা খুঁজি যাদের ভেতরে, তারা কেউ হয়তো ছিল না, কেবল প্রতিচ্ছবি ছিল।
তারা চা শেষ করে। কিন্তু টেবিলে আজ কোনো কাগজ নেই। সাগ্নিক খালি খাতা বের করে আরোহীর দিকে বাড়িয়ে দেয়।
“আজ তুমি একটা পংক্তি লিখবে?”
আরোহী একটু চমকে ওঠে। সে ধীরে কলম নেয়, খাতায় লিখে—
“কখনো যদি তুমি না লেখো আর
তবু আমি কাপের নিচে তোমায় খুঁজে নেবো।”
সাগ্নিক খাতাটা নিয়ে পড়ে। কিছু বলে না। শুধু হাসে—একটা নিঃশব্দ, মৃদু, দীপ্ত হাসি।
এই প্রথম, তারা দুজন একসাথে এক কবিতার লেখক হয়ে উঠল।
পর্ব ৬: এক কাপ কুয়াশার নিচে
বৃষ্টি নামছিল সেইদিন। হালকা টিপটিপ, যেন জানালার কাচে কেউ নরম আঙুলে কবিতা লিখছে। ক্যাফে কুয়াশার জানলার কাচ ঘোলাটে, বাইরে শহরটা যেন কুয়াশার এক স্বপ্নের ভিতর ঢুকে গেছে। আরোহী ছাতাটা বন্ধ করে ক্যাফের ভিতর ঢোকে—জামার কাঁধ ভিজে, চুলে জলের বিন্দু।
সাগ্নিক আগেই এসে বসে আছে, আজ আবার সেই কোণার টেবিলে। তার সামনে দুটি চায়ের কাপ, একটায় ধোঁয়া ওঠে, অন্যটা এখনও ফাঁকা।
“আজ বৃষ্টি আসবে জানতাম,” সে বলে, “তাই আগে এসেছিলাম।”
আরোহী বসে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামায়, চুলটা একটু ঝাঁকে। রাজু চুপ করে গরম জল নিয়ে আসে। তারপর বলে, “আজ আপনার জন্য একটা চমক আছে দিদি।”
আরোহী চমকে ওঠে, “চমক?”
রাজু পকেট থেকে একটা ছোট খাম বের করে দেয়। সাদা খাম, ওপরে কিছু লেখা নেই। আরোহী ধীরে খামে হাত দেয়।
সাগ্নিক বলে, “আমি চাই, তুমি এটা এখানেই পড়ো না। বাড়ি গিয়ে পড়বে। কিন্তু আগে একটা কথা বলি?”
আরোহী তাকায়। তার চোখে কুয়াশা জমেছে কি? না কি আলো পড়ে এমন দেখাচ্ছে?
সাগ্নিক ধীরে বলে, “তুমি জানো, আমি এতদিন যা লিখেছি, তার সবটাই তুমি হয়ে উঠেছিলে। আমি ভাবিনি কোনোদিন কেউ এসে এই খাতার পাতা খুলে দেবে। কিন্তু তুমি এসেছিলে। আর এখন যদি না লিখি, তোমার অভাব হয়।”
আরোহী চুপ করে থাকে। তার বুকের ভিতরে যেন ছোট ছোট ঢেউ খেলে যায়।
সে ধীরে বলে, “তুমি কি জানো, আমি অনেকদিন আগে কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। এক ভাঙনের পর শব্দ কেমন ফাঁকা মনে হয়েছিল। তারপর তোমার পংক্তিগুলো আমাকে আবার ছুঁয়েছিল। আমি যেন আমার মধ্যেকার হারিয়ে যাওয়া কবিকে খুঁজে পেয়েছিলাম।”
সাগ্নিক তার দিকে চেয়ে থাকে। কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে, কিন্তু কথা থেমে গেছে। সেই থেমে যাওয়ার মধ্যেই যেন অনেক কিছু বলা হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর তারা দুজন একসাথে ক্যাফের বাইরের ছাউনিতে দাঁড়ায়। বৃষ্টি এখনও ঝরছে।
আরোহী খামটা ব্যাগে রাখে। “বাড়ি গিয়ে পড়ব,” বলে।
সাগ্নিক মাথা নাড়ে। তারপর বলে, “কাল আমি এখানে থাকব না। একটা ট্রাভেল রাইটিং-এর কাজ পড়েছে, পাহাড়ে যেতে হচ্ছে একমাসের জন্য।”
আরোহীর বুকের ভিতর হঠাৎ ঠাস করে ওঠে। একমাস? তার এই প্রতিদিনের অভ্যেসে কি শূন্যতা তৈরি হবে?
সে বলে না কিছুই। শুধু মাথা নাড়ে। “শুভযাত্রা। পাহাড়ে গিয়ে নতুন কবিতা লিখো।”
সাগ্নিক বলে, “আমি লিখব, কিন্তু জানি, সব কবিতার নিচে থাকব তুমি। যেমন তুমি থাকো চায়ের কাপের নিচে। ঠিক ওইখানে।”
বৃষ্টির মধ্যে তারা আলাদা হয়।
আরোহী বাড়ি ফিরে আসে। ছাতাটা শুকোতে দেয়, কাপড় পাল্টায়, আলো জ্বালে না। শুধু বিছানায় বসে খামটা খুলে। ভিতরে একটা ছোট্ট কাগজ।
লিখে আছে—
“যদি কোনোদিন কোনো কফি শপে
তোমার সামনে রাখা কাপের নিচে
কোনো কবিতা না থাকে,
তবু বুঝে নিও—
আমি তখনও তোমায় লিখে যাচ্ছি।”
আরোহী চোখ বুজে ফেলে। কুয়াশার মতোই ভালোবাসা—ধরা যায় না, কিন্তু টের পাওয়া যায়।
পর্ব ৭: নিঃশব্দের ঠিকানা
এক সপ্তাহ কেটে গেছে। ক্যাফে কুয়াশায় চা ঠিকই আসে, রাজু আগের মতোই হাসে, জানলার পাশে আলোর রেখা পড়ে বইয়ের পাতায়। শুধু সাগ্নিক নেই।
আরোহী প্রতিদিন আসে—একটা চা, একা বসা, পেছনে বাজতে থাকা সলিল চৌধুরীর কোনো পুরোনো গান। সে নিজের খাতা খুলে কবিতা লেখে। একদিন সাদা কাগজে লিখে—
“তুমি না থাকলে, কবিতা কি থামে?
না কি নিঃশব্দই হয়ে ওঠে ঠিকানা?”
তারপর কাগজটা রেখে দেয় নিজের খাতার ভাঁজে। না, আর কাপের নিচে রেখে যায় না। সে জানে, সাগ্নিক নেই—তবু কোথাও আছে।
তিন দিন পর, ক্যাফেতে ঢুকেই সে চমকে ওঠে। রাজু এগিয়ে এসে বলে, “দিদি, আপনার জন্য একটা খাম আছে। ডাকঘর থেকে এসেছে।”
আরোহীর বুক কেঁপে ওঠে। সে খামটা নেয়। ওপরের কোণায় ছোট করে লেখা—“ডার্জিলিং পোস্ট, মাল রোড”। পাঠক—“সাগ্নিক সেন”।
সে হাতে ধরে বসে পড়ে। আজ ক্যাফেটা যেন তার জন্য অপেক্ষা করে ছিল।
খামটা খুলে দেখে, ভেতরে একখানা চিঠি, আর একটি কবিতা।
চিঠিতে সাগ্নিক লিখেছে—
“আরোহী,
পাহাড়ে বসে আমি চায়ের কাপ নিয়ে অনেক ভাবলাম। এখানে কুয়াশা যেন তোমার নামের মতোই উড়ে বেড়ায়। আমি জানি না, তুমি আমাকে ঠিক কতটা পড়েছো, কিন্তু আমি জানি, তুমি আমায় লিখে ফেলেছো। এই শহর থেকে দূরে বসেও, আমি তোমার চোখে প্রতিদিন নিজেকে খুঁজি। এই কবিতাটা শুধু তোমার জন্য—পাহাড়ের মেঘ আর তোমার ছায়া মিশিয়ে লেখা।”
আর কবিতায়—
“তুমি যদি একদিন
এই কবিতা না খুঁজো,
তবু আমি শব্দে তোমায়
ঘর করে রাখব।”
আরোহী চিঠিটা বুকের কাছে চেপে ধরে। তার মনে পড়ে যায় প্রথম চায়ের কাপ, প্রথম পংক্তি, প্রথম বারান্দার আলো, প্রথম ছায়া।
সে জানে না তারা কোথায় পৌঁছবে—এই সম্পর্ক কি প্রেম? না কি কেবল কবিতা?
তবে এটা জানে—এই নিঃশব্দেই সে ভালো থাকে। এই ঠিকানাহীন চিঠিগুলোই তার দিনযাপন।
তবে সে এখন আর খুঁজে বেড়ায় না।
কারণ সে বুঝে গেছে—ভালোবাসা সবসময় সামনে থেকে ডাকে না, কখনো কখনো সে নিঃশব্দে ঠিকানা হয়ে যায়।
পর্ব ৮: কাব্যের অন্তর্বাস
পাহাড়ে সাগ্নিক, শহরে আরোহী।
তবু যেন কবিতার মধ্যে তারা পাশাপাশি হাঁটে।
আরোহীর দিনগুলো এখন কাব্য দিয়ে মোড়া, ঠিক যেন পুরনো কাফের গন্ধ—যেটা একবার গায়ে লেগে গেলে সহজে যায় না।
আজ সে আর একা বসে চা খায় না। সে লিখে চলে। খাতার পর খাতা—কবিতা, কিছু অর্ধেক গল্প, কিছু প্রশ্নবিদ্ধ চিঠি।
বন্ধু শ্রেয়া একদিন দেখে বলে, “তুই বদলে গেছিস রে। মুখটা ঝলমল করে।”
আরোহী কিছু বলে না, শুধু মুচকি হাসে।
ক্যাফেতে বসে সেদিন সে নিজেরই একটা কবিতা পড়ে—
“যদি কেউ তোমায়
শুধু চোখ দিয়ে পড়ে,
তবে তুমি পৃষ্ঠা হয়ে ওঠো।
আর যদি কেউ হৃদয় দিয়ে পড়ে,
তবে তুমি হয়ে যাও কাব্যের অন্তর্বাস।”
এমন সময় রাজু এগিয়ে আসে, “দিদি, মাল রোড থেকে আবার কিছু এসেছে। আগের জনের মতোই খামে প্যাঁচানো।”
আরোহী এবার খামটা খুলে বসে। ভিতরে একটা কবিতা, আর কিছু শুকনো রংচঙে পাহাড়ি ফুল।
কবিতা লেখে—
“তুমি যেভাবে চায়ের কাপ ধরো,
তাতে শব্দেরা বাঁচতে শেখে।
তোমার আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে
আমি কবি হয়ে উঠি।”
আরোহীর চোখে জল আসে না, কিন্তু গলার স্বর বদলে যায়। কেউ যখন এত গভীরভাবে অনুভব করে, তখন সে নিজেও নতুন করে নিজেকে চিনতে শেখে।
সেদিন সে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে একটা কাজ করে।
সে নিজের কবিতার একটা ছোট্ট সংকলন বানায়—হাতে লেখা, নোটবুকে বাঁধা। তার নাম দেয়: “যার জন্য লেখা”।
শেষ পাতায় লেখে—
“শব্দেরা যখন সঙ্গী হয়,
তখন মানুষ আর একা থাকে না।”
খাম বন্ধ করে সে সাগ্নিকের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।
আজ সে কেবল গ্রহণ করে না—সে ফিরিয়ে দেয়।
কারণ প্রতিটি কবিতা কেবল পাঠকের জন্য নয়, প্রেরণার জন্যও।
আর এখন সে জানে—সে কেবল পাঠক নয়, সে একজন কবির অন্তর্বাস।
পর্ব ৯: শেষ পঙক্তির আগে
কলকাতার শরৎকাল এসে গেছে। বাতাসে এখন পাঁপড়ির গন্ধ, সন্ধ্যায় গাছে গাছে ছায়া। আরোহী প্রতিদিন অপেক্ষা করে একটা ডাকপিওনের বেল। মাঝে মাঝে আসে চিঠি, মাঝে মাঝে আসে না। তবু সে অপেক্ষা করে।
আজ দুপুরে সাদা একটা খাম এসে পৌঁছায়। ওপরে ছোট করে লেখা—“সাগ্নিক সেন, শেষ চিঠি।”
আরোহীর বুক ধক করে ওঠে। শেষ চিঠি?
সে থমকে যায় কিছুক্ষণ। তারপরে দরজা বন্ধ করে ধীরে খামটা খোলে।
ভিতরে একটা কবিতা। নিচে লেখা—“আজ আমি ফিরছি। কিন্তু কিছু বলার আছে, শেষ পঙক্তির আগে।”
কবিতা শুরু হয়—
“তুমি কি জানো,
যে চা–দোকানে আমরা বসতাম,
সেখানে এখনও ধোঁয়া ওঠে?
তুমি চলে গেলে,
কেবল আমি বসে থাকতাম
একটা খালি চেয়ারের দিকে চেয়ে।
আজ ফিরছি,
তবে জানি না তুমি ঠিক কেমন করে তাকাবে,
তুমি যে এখন শুধু পাঠিকা নও—
তুমি তো এখন কবি।”
আরোহী খামটা বুকে চেপে ধরে। আজ সাগ্নিক ফিরছে।
সেই বিকেলে সে অনেকটা সময় নিয়ে ক্যাফেতে যায়। তার টেবিলে আগে থেকে রাজু চা সাজিয়ে রেখেছে। আর জানলার পাশে বসে আছে—সাগ্নিক।
সামনাসামনি তাকানো, একটু থমকে যাওয়া, তারপর একটা চুপচাপ হাসি।
আরোহী বসে পড়ে। সাগ্নিক বলে, “তোমার পাঠানো সংকলন পড়েছি। ‘যার জন্য লেখা’—নামটা পড়েই থেমে গেছিলাম।”
আরোহী বলে, “তুমি লিখেছ বলেই আমার লেখা শুরু হয়েছে। আমার কবিতা যদি নদী হয়, তাহলে তুমি তার পাহাড়।”
সাগ্নিক কিছু বলে না। শুধু তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাক্স বার করে।
“এটা তোমার জন্য।”
আরোহী বাক্সটা খোলে। ভিতরে চায়ের কাপে হাতে লেখা—“তোমার নিচে আমি আছি, প্রতিদিন।”
সেই কাপেই তারা চা খায়।
সেদিন ক্যাফে কুয়াশায় আর কোনো কবিতা পড়ে না চায়ের নিচে। কারণ কবিতারা এবার চলে এসেছে চোখে, মুখে, ভালোবাসায়।
আরোহী জানে, সব কবিতার শেষে একটা পঙক্তি থাকে—যা আসলে শুরু।
পর্ব ১০: যেখানে কবিতা থেমে থাকে
আজ ক্যাফে কুয়াশা একটু অন্যরকম। আলোগুলো একটু বেশি উজ্জ্বল, রাজু নতুন একটা পেইন্টিং টাঙিয়েছে—তাতে একটা খালি চায়ের কাপ আর তার নিচে রাখা ছোট কাগজে লেখা, “কবিতারা এখানেই থাকে”।
সাগ্নিক আর আরোহী পাশাপাশি বসে। কোনো কবিতা লেখা নেই টেবিলে, কোনো খাম নেই হাতে। এখন কবিতা আর পঙক্তি নয়, এখন শুধু তারা দুজন—যারা শব্দের মধ্যে দিয়ে পৌঁছেছে স্পর্শের কাছে।
সাগ্নিক চা হাতে নিয়ে বলে, “জানো, আমি এতদিন যা লিখেছি, সবই আসলে একটা মুখ মনে রেখে। কিন্তু এখন তোমাকে দেখে মনে হয়, আর কিছু লেখার দরকার নেই।”
আরোহী বলে, “তা হলে তুমি থেমে যাবে?”
সে মাথা নাড়ে, “না, আমি থামব না। কিন্তু এখন লিখব না তোমার জন্য—লিখব তোমাকে নিয়ে। সেই পার্থক্যটাই সবচেয়ে গভীর।”
আরোহী হেসে বলে, “আমিও এখন আর তোমার কবিতা খুঁজি না কাপের নিচে। আমি জানি, কবিতা থাকলে তা চোখে ওঠে, কণ্ঠে নামে, গায়ে ছুঁয়ে যায়।”
তারা দুজনে চুপ করে বসে থাকে। জানলার বাইরে সন্ধে নামে, আলোগুলো লেগে থাকে কাচে, আর ক্যাফেটার ভিতরে বাজে একটা নরম রবীন্দ্রসংগীত—
“হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে…”
সাগ্নিক বলে, “আমরা কি পরস্পরের শেষ কবিতা হয়ে উঠেছি?”
আরোহী বলে, “হয়তো না। হয়তো আমরা এখন একটা উপন্যাসের শুরু।”
টেবিলে রাখা কাপদুটো ঠান্ডা হয়ে আসে, কিন্তু দুজনের হাত একে অপরের আঙুলে জড়ায়।
আজ আর কবিতা নেই কাপের নিচে। কারণ কবিতারা কোথাও থেমে থাকে না, তারা একসময় মানুষ হয়ে ওঠে।
আর সেই মানুষগুলো…
তারা চুপচাপ পাশাপাশি বসে, জানলার কুয়াশার দিকে তাকিয়ে থাকে,
আর ভিতরে ভিতরে বলে—
“তোমার নিচে আমি আছি, প্রতিদিন।”
সমাপ্ত