১
পশ্চিমবঙ্গের অন্তঃস্থলে, নদীর ঘাট ছুঁয়ে যাওয়া আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তার শেষে দাঁড়িয়ে আছে রাজবাড়ি—এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি, যার গাঢ় লাল ইঁটগুলো সময়ের আঘাতে ফেটে গেছে, দেয়ালের চুনকাম খসে পড়েছে, আর শ্যাওলা জমে অন্ধকার হয়ে উঠেছে প্রতিটি কোণ। এককালে এখানে আলো ঝলমলে উৎসব হতো, রথযাত্রার দিন প্রাসাদের প্রাঙ্গণে ভিড় জমত হাজার হাজার মানুষ, আর মহিষাসুরমর্দিনীর বিসর্জনকালে শোনা যেত ঢাক-ঢোলের কর্ণভেদী শব্দ। আজ সেই জমকালো ঐতিহ্য কেবল স্মৃতির কুয়াশায় ঝাপসা হয়ে গেছে। রাজবাড়ির প্রধান ফটকটি অনেক আগেই ভেঙে পড়েছে, জায়গায় জায়গায় ঘাসে ঢাকা পথ আর ঝোপঝাড় দাঁড়িয়ে আছে অনাহূত প্রহরীর মতো। বাতাসে যেন এক শীতলতা ভেসে বেড়ায়, যে শীতলতা গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরেও চামড়া ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে যায়। গ্রামের ছেলেরা খেলার ছলে কখনও রাজবাড়ির দিকে যায় না, কেউ কেউ সাহস করে গিয়েও রাতভর জ্বর নিয়ে শুয়ে থাকে—কারণ তাদের চোখে লেগে থাকে কিছু অদ্ভুত ছায়া, কিছু অচেনা চোখের দৃষ্টি।
বাড়িটির অন্তরে রয়েছে এক কালীমন্দির, যা বহুদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে। গ্রামের প্রবীণরা বলে, শেষবার পূজা হয়েছিল প্রায় একশো বছর আগে। তখনকার জমিদার দেবী চামুণ্ডীর বিশেষ সাধনায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই পূজা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে কারও সাহস হয়নি মন্দিরের দরজা খোলার। মন্দিরের বিশাল কালো পাথরের গায়ে শ্যাওলা জমে আছে, সিঁড়ির উপর ঝরা শুকনো পাতা বছরের পর বছর জমে থেকেছে, আর ভাঙা সিংহদ্বার দিয়ে ভেতরে উঁকি দিলেই দেখা যায় বিশাল এক প্রতিমা—কালীমায়ের সেই রুদ্ররূপ, চোখ যেন এখনও রক্তমাখা আগুনে জ্বলছে, আর জিভ লাল শিখার মতো বেরিয়ে আছে। প্রতিমার পায়ের নিচে যেন অদ্ভুত এক শক্তি বন্দি হয়ে আছে, যার অস্তিত্ব গ্রামের মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পায়। বৃদ্ধা মহিলারা শিশুদের শাসন করতে গিয়ে বলে—“ওই মন্দিরের কাছে যাস না, চামুণ্ডী তোর আত্মা কেড়ে নেবে।” শিশুদের ভয় দেখানোর জন্য বলা সেই কথার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে এক প্রাচীন আতঙ্কের বাস্তবতা। কেউ জানে না কী ঘটেছিল, শুধু মনে রাখে—মন্দিরটি অভিশপ্ত, আর সেই অভিশাপ আজও জীবিত।
কথিত আছে, রাজবাড়ির ছায়া আজও গ্রামজুড়ে অশুভ প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। গ্রীষ্মের রাতে যখন বাতাস থেমে যায়, পোকামাকড়ের শব্দ বন্ধ হয়ে যায়, তখন হঠাৎ করেই বাজে ভাঙা ঘন্টার আওয়াজ, যেন কেউ ভিতর থেকে পূজার ডাক দিচ্ছে। কেউ কেউ শপথ করে বলে, ভোরের আলো ফোটার আগেই মন্দিরের চারপাশে অগ্নিশিখার মতো লাল আলো দেখা যায়, আর দূর থেকে শোনা যায় করুণ আর্তনাদ, যা মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, আবার সম্পূর্ণ নীরবতাও নয়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা এসব শোনালেও বাইরের কেউ বিশ্বাস করে না, তারা ভাবে—এ কেবল গ্রামীণ কুসংস্কার। অথচ, যারা একবার মন্দিরের ভিতরে উঁকি দিয়েছে, তাদের মুখ আর কখনও আগের মতো ছিল না। যেন তারা ভিতরে গিয়ে এমন কিছু দেখেছে, যার কথা মুখ ফুটে বলতে পারেনি। রাজবাড়ি আর তার অন্ধকার মন্দির তাই দাঁড়িয়ে আছে এক অচল কালচক্রের মতো—সময় তার ভেতরে থেমে গেছে, কেবল চারপাশে ছড়িয়ে আছে ভয়ের ছায়া। এই ছায়াই হল চামুণ্ডীর অভিশাপের প্রথম প্রকাশ, যার আভাস পেয়েও কেউ ভিতরে প্রবেশের সাহস করে না।
২
মন্দিরের ভেতরটা যেন এক চিরস্থায়ী গহ্বর—অন্ধকারে মোড়ানো, যেখানে সূর্যের আলো দিনের বেলাতেও প্রবেশ করতে সাহস পায় না। চূড়ার ভাঙা ফাঁক দিয়ে কেবল এক চিলতে আলোর রেখা ঢুকে পড়ে, কিন্তু সেই আলোও এখানে এসে গাঢ় কালো অন্ধকারে মিশে যায়। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সেই কালীপ্রতিমা, যার দৃষ্টিতে যেন রক্তাক্ত বজ্রপাত জমে আছে। দেবীর চারটি হাত, প্রতিটি হাতে শৃঙ্খলিত অস্ত্র, গলায় ঝুলছে করোটি-মালা, আর পদতলে শায়িত এক মৃতদেহের মূর্তি—যেন জীবন্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষায়। তবে এই প্রতিমার সবচেয়ে অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে বামপায়ের নিচে। বহু বছর আগে রাজবাড়ির তান্ত্রিক সাধনার সময় গোপনে খোদাই করা হয়েছিল এক অদ্ভুত গর্ত, যেখানে রাখা হয় এক নিষিদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠরা বলে, এই গ্রন্থটি কেবল কাগজে লেখা কিছু শ্লোক নয়; এর প্রতিটি অক্ষর জীবন্ত, প্রতিটি মন্ত্র এক একটি শিকল, যা মৃত্যু আর জীবনের মধ্যবর্তী সীমা ভেদ করতে পারে। অনেকে বিশ্বাস করে, এই গ্রন্থটিই রাজবাড়ির পতনের আসল কারণ—কারণ একসময় জমিদার পরিবার চেষ্টা করেছিল মৃত্যুকে অতিক্রম করার, আর তার ফলশ্রুতিতেই নেমে এসেছিল অভিশাপ।
তন্ত্রগ্রন্থটির নাম ইতিহাসে খুব কমই পাওয়া যায়, কারণ এটি ছিল রাজপরিবারের গোপন সম্পদ। কাহিনী আছে, জমিদার পুত্র রাজেন্দ্রনারায়ণ শ্মশানের এক অঘোরী সাধকের কাছ থেকে এই তন্ত্র সংগ্রহ করেছিলেন। সাধক সতর্ক করেছিলেন—“এই জ্ঞান ঈশ্বর প্রদত্ত নয়, এটি মৃত্যুর অস্বীকার। যে এটি হাতে নেবে, সে হয় অমরত্ব পাবে, নয়তো অভিশপ্ত হয়ে যাবে।” কিন্তু লোভে অন্ধ জমিদারপুত্র শোনেনি। প্রতিমার পায়ের নিচে গ্রন্থ লুকিয়ে রাখার কারণও ছিল রহস্যময়। বলা হয়, দেবী চামুণ্ডীর রুদ্ররূপ ছাড়া আর কেউ এই গ্রন্থের অশুভ শক্তি দমন করতে পারবে না। তাই একদিকে দেবীর পদতলে পিশাচের মূর্তি, অন্যদিকে গ্রন্থ বন্দি—এ যেন প্রতিমা নিজেই এক প্রহরী, যিনি চিরকাল এই গ্রন্থকে আড়াল করে রেখেছেন। যখনই কেউ ভেতরে প্রবেশ করে, এক অদৃশ্য শক্তি তার চোখে ধুলো ফেলতে থাকে, যাতে সেই গোপন খাজানার অবস্থান তার নজরে না আসে। তবুও, যারা কৌতূহলবশত গ্রন্থ খুঁজতে চেয়েছে, তারা আর ফিরে আসেনি। তাদের দেহ মন্দির প্রাঙ্গণে মেলেনি, কিন্তু রাতের আঁধারে গ্রামের আঙিনায় ভেসে বেড়াতে দেখা গেছে তাদের ছায়া।
কেন এই তন্ত্র নিষিদ্ধ হয়েছিল, তার উত্তর লুকিয়ে আছে এর ভয়ঙ্কর ক্ষমতায়। কাহিনী অনুযায়ী, তন্ত্রটি এমন এক মন্ত্র ধারণ করে, যা মানুষকে মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করতে দেয়। কিন্তু মৃত্যুর সীমানা ভাঙা মানেই প্রকৃতির শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা। ফলে যে-ই এই তন্ত্র ব্যবহার করেছে, সে জীবিত থেকেও মৃতের মতো হয়ে গেছে, আর মৃত হলেও কখনও মুক্তি পায়নি। অনেক সময় বলা হয়, জমিদার পরিবারের সবাই রহস্যময়ভাবে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল, আসলে তারা কেউ মরেনি—বরং অদৃশ্য অস্তিত্বে বন্দি হয়ে আছে চিরন্তন যন্ত্রণায়। গ্রামের মানুষ যখন মন্দিরের পাশে দাঁড়ায়, হঠাৎ করেই কানে বাজে ফিসফিসানি, যা আসলে সেই হারিয়ে যাওয়া আত্মাদের চিৎকার। এই কারণেই এই তন্ত্রকে “নিষিদ্ধ” বলে ঘোষণা করা হয়েছিল—কারণ এটি অমরত্ব দেয় না, বরং মৃত্যুকেও কেড়ে নেয়, জীবনের স্বাভাবিক প্রবাহকে থামিয়ে দেয়। প্রতিমার পায়ের নিচে তাই শুয়ে আছে শুধু একটি বই নয়, বরং সময়ের বিরুদ্ধে মানুষের অহংকারের প্রতীক, যা দেবী চামুণ্ডীর ক্রোধে অভিশপ্ত হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। আর এই রহস্যই রাজবাড়ির ছায়াকে আরও গভীর করে তোলে, যেন প্রতিটি ইট, প্রতিটি ফাটল থেকে ভেসে আসছে একটি অদৃশ্য সতর্কবাণী—“এ পথে যেয়ো না, এই জ্ঞান গ্রহণ করলে মুক্তি আর নেই।”
৩
শহরের মানুষ অনির্বাণ মুখার্জি—চেহারায় পড়াশোনার ছাপ, হাতে পুরোনো নোটবুক আর চোখে চশমা। ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণাই তার জীবন, আর অজানাকে জানার অদম্য কৌতূহলই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু বছর ধরে প্রাচীন মন্দির স্থাপত্য ও লোককথার ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছে সে, কিন্তু যখন রাজবাড়ি ও তার অভিশপ্ত কালীমন্দির সম্পর্কে খবর পায়, তখন আর নিজেকে আটকে রাখতে পারে না। বহুবার শুনেছে—এখানে রয়েছে এক অমীমাংসিত রহস্য, যা কেউ খুঁজতে সাহস করে না। তবে অনির্বাণের কাছে এসব কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়। সে বিশ্বাস করে, প্রতিটি কিংবদন্তির পিছনে থাকে ইতিহাসের অজানা কোনো তথ্য, কোনো সামাজিক প্রেক্ষাপট, বা হয়তো প্রাকৃতিক কোনো কারণ। তাই এক গরম দুপুরে ট্রেন থেকে নেমে, কাঁচা রাস্তা ধরে, ধুলো উড়িয়ে, গ্রামের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সে পৌঁছায় রাজবাড়ির সামনে। চারপাশে ঝোপঝাড়ে ঢাকা ধ্বংসপ্রায় স্থাপত্য দেখে তার গবেষণামন উৎসাহে ভরে ওঠে। মনে হয়, সে যেন এক অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যার গায়ে শতাব্দীর পর শতাব্দীর ইতিহাস জমে আছে।
কিন্তু গ্রামের মানুষ তার এই উত্তেজনা ভাগ করে নিতে রাজি নয়। গ্রামের মোড়ের চায়ের দোকানে যখন সে রাজবাড়ি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে শুরু করে, তখন সবাই থমকে যায়। বৃদ্ধ চাষিরা মাথা নাড়িয়ে বলে, “ওই জায়গায় যেও না বাবু, ওখানে কেউ টিকে থাকতে পারে না।” কেউ কেউ ঠোঁট চেপে হাসে, যেন শহরের ছেলেরা কুসংস্কারের ভয় মানবে না জেনে আগেই নিরাশ। তবে যখন অনির্বাণ বলে যে সে প্রত্নতত্ত্ববিদ, তখন গ্রামের একজন বৃদ্ধা হেমাঙ্গ নামের পূজারির কথা বলে ওঠে। এই হেমাঙ্গ নাকি রাজবাড়ির শেষ জীবিত সাক্ষী, যিনি একসময় দূর থেকে মন্দিরে পূজার দৃশ্য দেখেছিলেন। তবে সেই বৃদ্ধও অভিশাপের ভয়ে কাউকে কাছে যেতে দেয় না। অনির্বাণ এসব শুনে মৃদু হেসে নেয়—তার চোখে এ সবই হলো গ্রামীণ বিশ্বাস, ভয় আর অলৌকিকতার গল্প, যা বিজ্ঞানের পরীক্ষায় টেকে না। তবুও এক অদ্ভুত শীতলতা সে টের পায় যখন রাজবাড়ির ভাঙা দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। চারদিকের অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ, ভেঙে পড়া দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারা বাদুড়ের চোখ তাকে অস্বস্তি দেয়, কিন্তু তার গবেষণার তৃষ্ণা সেই অস্বস্তির ওপর জয়ী হয়।
মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করতেই অনির্বাণ যেন অন্য এক জগতে ঢুকে পড়ে। চারদিকে ঘন অন্ধকার, কেবল ভাঙা ছাদের ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে আলো পড়েছে কালীপ্রতিমার উপর। মূর্তিটি এত বিশাল আর জীবন্ত মনে হয় যে অনির্বাণ কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মনে হয়, প্রতিমার চোখ দুটি সরাসরি তার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে আবার সতর্কও করছে। বুকের ভেতর হঠাৎ করেই অজানা শীতল স্রোত বয়ে যায়, কিন্তু সে নিজেকে বোঝায়—এ কেবল ভয়ের অনুভূতি, বাস্তবে কিছু নয়। তবুও তার ভেতরে এক অদ্ভুত টান কাজ করতে শুরু করে। সে বুঝতে পারে না কেন, কিন্তু প্রতিমার বামপায়ের কাছে যেতে তার অদ্ভুত আকর্ষণ বোধ হয়। অদৃশ্য কোনো শক্তি যেন তাকে কাছে টেনে নিচ্ছে। তার হাত অনিচ্ছাসত্ত্বেও ডায়েরির ভেতরে কাগজে আঁকা চিহ্ন আর নকশার সঙ্গে মূর্তির ভিত্তি মিলিয়ে দেখতে শুরু করে। গ্রামের মানুষের ভয় আর কুসংস্কার তার কানে বাজতে থাকে, তবুও সে জানে—এখানে এমন কিছু লুকানো আছে যা কেবল ইতিহাস নয়, মানবসভ্যতারও নতুন অধ্যায় লিখতে পারে। আর সেই রহস্যের দিকে পা বাড়াতেই শুরু হয় এক অদৃশ্য বন্ধন, যেখানে অনির্বাণের যুক্তিবাদী মন ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়তে থাকে চামুণ্ডীর অভিশাপে।
৪
সন্ধ্যার আলো গাঢ় হতে শুরু করলে, অনির্বাণকে ডেকে পাঠান গ্রামের প্রবীণ পূজারি হেমাঙ্গ। সত্তরের বেশি বয়স হলেও তার চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি, কণ্ঠে অচল দৃঢ়তা। বাঁশের লাঠি ঠুকে তিনি অনির্বাণকে রাজবাড়ির সামনের পুরনো পাথরের সিঁড়িতে বসান। বাতাসে তখন শীতলতা জমতে শুরু করেছে, গাছের ডালপালা কাঁপছে অদৃশ্য ছোঁয়ায়। হেমাঙ্গ ধীরে ধীরে বলেন, “বাবা, তুমি শহরের মানুষ, পড়াশোনা করেছ, জানো বিজ্ঞানের অনেক ব্যাখ্যা। কিন্তু কিছু জিনিস আছে যেগুলো বিজ্ঞানের সীমার বাইরে। এই রাজবাড়ি আর এর মন্দির তারই প্রমাণ। বহু বছর আগে চামুণ্ডীর আরাধনা হয়েছিল এখানে। জমিদার পরিবার ভেবেছিল দেবীকে জাগিয়ে তারা অলৌকিক শক্তি অর্জন করবে। কিন্তু ফল হয়েছিল উল্টো। দেবী তখন চিরকালীন নিদ্রায় চলে যান, আর তাঁর ক্রোধ এই মন্দিরে বন্দি হয়ে থাকে। সেই থেকে অভিশাপ। তাই আমি তোমাকে বলছি—চামুণ্ডীকে ঘুম থেকে জাগিও না।” তার কণ্ঠে ভয় নয়, বরং এক অভিজ্ঞতার ভার, যা বহু বছর ধরে নিজের চোখে দেখা অশুভ ঘটনার প্রতিধ্বনি বহন করে।
কিন্তু অনির্বাণের মনে এসব কথা কুসংস্কারের মতোই ঠেকে। তার চোখে হেমাঙ্গ একজন ভীত, গ্রামীণ মানুষ, যিনি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলে আসা গল্পকে সত্যি বলে ধরে নিয়েছেন। সে বিনয়ের সঙ্গে মাথা নাড়িয়ে কথা শুনলেও ভেতরে ভেতরে ভাবে, “যদি সত্যিই কিছু ভয়ঙ্কর থাকত, তবে এত বছর ধরে এখানে কেউ কেন বেঁচে আছে?” তার যুক্তিবাদী মন বারবার ফিসফিস করে—প্রতিটি অভিশাপের পিছনে লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের অপব্যাখ্যা, বা কোনো লুকানো ষড়যন্ত্র। তাই সে দৃঢ় সংকল্প নেয় মন্দিরকে আরও গভীরে খুঁজে দেখার। রাতের আঁধারে মন্দির প্রাঙ্গণে ফিরে গিয়ে, সে কালি প্রতিমার সামনে দাঁড়ায়। প্রদীপের ক্ষীণ আলো প্রতিমার চোখে প্রতিফলিত হয়ে অদ্ভুত লাল আভা তৈরি করে। অনির্বাণ সেই চোখের দিকে তাকিয়ে এক অদৃশ্য চাপে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে, কিন্তু তবুও সে পিছু হটে না। বরং খুঁজতে শুরু করে প্রতিমার ভিত্তি আর পদতলের প্রতিটি কোণ। হঠাৎই তার নজরে আসে প্রতিমার বামপায়ের নিচে খোদাই করা অদ্ভুত সব চিহ্ন, যেগুলো আগে ম্লান আলোয় স্পষ্ট হয়নি।
চিহ্নগুলো ছিল জটিল—কোনোটা সর্পিল রেখার মতো, কোনোটা ত্রিকোণ, আবার কোনোটা এমন অক্ষর যা কোনো পরিচিত ভাষার সঙ্গে মেলে না। অনির্বাণ এগুলো নোটবুকে টুকে নেয়, কিন্তু লিখতে লিখতে তার মনে হয় অক্ষরগুলো যেন কাগজে নেমে আসতে চাইছে না, যেন কালি শুকিয়ে যাচ্ছে নিজে নিজেই। আরও অদ্ভুত লাগে যখন সে টের পায়, প্রতিটি চিহ্ন থেকে এক অচেনা শীতল স্রোত বেরিয়ে তার আঙুল বেয়ে শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। মুহূর্তে মন্দিরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, বাদুড়েরা একযোগে ডানা ঝাপটায়, আর বাইরে হঠাৎ করেই শূন্যে ভেসে ওঠে মন্ত্রোচ্চারণের মতো গুঞ্জন। অনির্বাণ নিজেকে সামলে নিয়ে বোঝায়, “না, এগুলো নিছক কাকতালীয়।” কিন্তু ভেতরের কোথাও অদৃশ্য আতঙ্ক জন্ম নিতে শুরু করে। সে হেমাঙ্গের সতর্কবার্তা মনে করে—“চামুণ্ডীকে ঘুম থেকে জাগিও না।” তবে একই সঙ্গে তার মনের গভীরতর কণ্ঠ আরেকটি কথা বলে ওঠে—“যদি সত্যিই ঘুম ভাঙানো যায়, তবে হয়তো এখানেই লুকিয়ে আছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কার।” আর সেই দ্বন্দ্বের মাঝেই অনির্বাণ অজান্তে অভিশাপের প্রথম দরজা খুলে দেয়।
৫
রাতটা ছিল ভয়াল ঝড়ের। আকাশে মেঘের গর্জন, বিদ্যুৎ চমকালেই মাটির ভাঙা দেওয়ালগুলো এক মুহূর্তের জন্য রক্তাভ আলোয় ঝলসে উঠছিল। গ্রামে সবাই আগেই দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়েছে, কেবল রাজবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকার আকাশের নিচে এক বিরাট ছায়ার মতো। অনির্বাণ মন্দিরের ভিতরে বসে তখনও প্রতিমার পায়ের নিচে খোদাই করা চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বহুদিনের গবেষণা তাকে শিখিয়েছে, এই ধরনের জটিল প্রতীক কোনো না কোনো গোপন দিকচিহ্ন বহন করে। তার হাতের টর্চ আলোয় সে দেখতে পেল, প্রতিমার বামপায়ের পাথরের ফাঁক আসলে এক ক্ষুদ্র গোপন দরজা, যা কেবল সঠিক চাপে খোলা যায়। ঝড়ের তাণ্ডব আর বৃষ্টির শব্দে বাইরের পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে, আর অনির্বাণ এক অদ্ভুত উত্তেজনায় শিহরিত। সে হাত বাড়িয়ে চিহ্নগুলোর ওপর চাপ দেয়, আর মুহূর্তেই প্রতিমার পায়ের নিচের অংশে এক ক্ষীণ ফাঁক খুলে যায়। বাতাসে সঙ্গে সঙ্গে শোঁ শোঁ শব্দ ওঠে, যেন বহু শতাব্দীর আবদ্ধ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসে এক পুঁথি—কালো, ক্ষয়ে যাওয়া, তবু অদ্ভুতভাবে অক্ষত। অনির্বাণের বুক ধড়ফড় করে ওঠে; এটাই সেই নিষিদ্ধ তন্ত্রগ্রন্থ, যার কথা হেমাঙ্গ আর গ্রামের মানুষ শপথ করে বলেছে।
গ্রন্থটি হাতে তুলতেই তার ভেতর দিয়ে এক শীতল শিরশিরে স্রোত বয়ে যায়। পৃষ্ঠাগুলো বয়সের ভারে হলদেটে হয়ে গেছে, কিন্তু মন্ত্রগুলো এখনও গাঢ় কালো অক্ষরে লেখা, যেন সেদিনই কলম ছোঁয়া হয়েছিল। মন্দিরে তখন হাওয়া বিক্ষিপ্ত হতে শুরু করেছে, প্রদীপের শিখা কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ নিভে গেল, আর চারদিকে নেমে এলো এক ঘন অন্ধকার। অনির্বাণ বই খুলতেই এক অদ্ভুত গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে—না মাটি, না ছাপা কালি, বরং পচা মাংস আর ধূপের মিশ্রিত গন্ধ। হঠাৎই তার মনে হলো প্রতিমার চোখ যেন নড়ে উঠল। মূর্তির রক্তাভ জ্যোতি যেন এক লাল শিখার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, বিদ্যুতের ঝলকের সঙ্গে মিশে পুরো মন্দিরকে ভাসিয়ে দিল রক্তরঙা আলোয়। অনির্বাণ ভয় আর কৌতূহলের মাঝামাঝি অবস্থায় পড়ে যায়। তার একাংশ চায় বই বন্ধ করে পালিয়ে যেতে, কিন্তু গবেষকসুলভ কৌতূহল তাকে আটকায়। সে মন্ত্র পড়তে শুরু করে, আর প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মন্দির কেঁপে ওঠে। মনে হলো যেন প্রতিটি অক্ষর বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়ে শূন্যে অদৃশ্য আগুন জ্বালিয়ে তুলছে।
প্রথম কয়েকটি লাইন পড়তেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মনে হয় তার চারপাশে অসংখ্য ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। কারও মুখ নেই, কেবল গভীর অন্ধকার আর ফাঁপা চোখ। বাতাসে মন্ত্রোচ্চারণের মতো গুঞ্জন শোনা যায়, কিন্তু সে বুঝতে পারে না শব্দগুলো আসছে তার ঠোঁট থেকে, না চারপাশ থেকে। হঠাৎই কালীপ্রতিমার চার হাত নড়ে উঠেছে বলে তার মনে হয়; মন্দিরের গায়ে খসে পড়া ধুলো যেন ঝড়ে উড়তে শুরু করে। এক অজানা আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে, তবুও সে বই বন্ধ করতে পারে না—যেন অদৃশ্য কোনো শক্তি তার আঙুলগুলোকে জোর করে ধরে রেখেছে। প্রতিমার চোখ তখন আগুনের মতো দপদপ করছে, আর সে চোখের দৃষ্টি অনির্বাণের বুক ভেদ করে প্রবেশ করছে। মনে হলো, দেবী নিজেই যেন চেতন হয়ে উঠেছেন, আর তার সামনে দাঁড়ানো মানুষটির মধ্যে কিছু জাগ্রত করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ এক মুহূর্তে সব বাতাস থেমে যায়, ঝড়ের গর্জন থেমে যায়, এমনকি তার নিজের শ্বাসও থেমে আসে—শুধু শোনা যায় বুকের ভেতর তীব্র ধুপধুপানি। তখনই অনির্বাণ টের পায়, বইটি কেবল এক নিষিদ্ধ পুঁথি নয়; এটি আসলে এক দরজা, যার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করলে আর ফিরে আসা যায় না। আর সেই দরজা সে অজান্তেই খুলে দিয়েছে।
৬
তন্ত্রগ্রন্থটি পড়ার সেই রাতের পর থেকেই অনির্বাণের জীবনে যেন এক ভয়াল ছায়া নেমে এলো। প্রথম রাতে সে দেখল, ঘন অন্ধকারের ভেতর থেকে এক বিশাল ছায়া তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের দিকে। সেই ছায়ার মুখ নেই, চোখ নেই—শুধু এক অন্তহীন শূন্যতা। স্বপ্নে সে দৌড়াতে থাকে, কিন্তু পায়ের নিচে মাটি নেই, চারপাশে শুধু গাঢ় কালো অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে ওঠে এক ভয়ঙ্কর মুখ—চামুণ্ডীর কালো প্রতিমার মতো, কিন্তু তার চোখ জ্বলছে লাল আগুনে। দেবীর চাহনি তার মনের গভীরে প্রবেশ করে, আর অনির্বাণ অনুভব করে, সে যেন নিজের ভেতরের সমস্ত আলো হারিয়ে ফেলছে। দমবন্ধ আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেলে দেখা যায়, তার বুক ভিজে আছে ঘামে, আর শরীর কাঁপছে অকারণ শীতে। সে ভাবে হয়তো অতিরিক্ত কল্পনার প্রভাব, কিন্তু যখন একই দুঃস্বপ্ন দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাতে ফিরে আসে, তখন সে বুঝতে পারে—এ কেবল সাধারণ স্বপ্ন নয়, এ এক অভিশাপের শুরু। প্রতিটি রাত আরও ভীতিকর হয়ে ওঠে; কখনো সে দেখে মন্দিরের ভাঙা দেয়ালের আড়ালে লাল জিভ বার করা ছায়ারা তাকে ডেকে নিচ্ছে, কখনো শুনতে পায় ঘণ্টার টং-টং শব্দ, যা তার ঘুম ভাঙার পরও কানে বাজতে থাকে।
দিনের আলোতেও তার মনে হয়, সে যেন সেই অভিশপ্ত মন্দিরের ভেতরেই বন্দি। সকালের সূর্য উঠলেও তার চারপাশে অদ্ভুত এক অন্ধকার ভাসতে থাকে। গ্রামের পথে হাঁটতে হাঁটতে সে স্পষ্টভাবে শুনতে পায় মন্দিরের ঘণ্টা বাজছে, যদিও গ্রামের মানুষ শপথ করে বলে, বহু বছর ধরে ওই ঘণ্টা কেউ বাজায়নি। অনির্বাণ কপালের ঘাম মুছে বোঝানোর চেষ্টা করে, এগুলো নিশ্চয়ই মানসিক চাপের ফল। কিন্তু শীঘ্রই সে টের পায়, তার শরীরে অদ্ভুত পরিবর্তন শুরু হয়েছে। প্রথমে তার হাতে ছোট ছোট আঁচড়ের দাগ দেখা যায়, যেন অদৃশ্য নখ দিয়ে কেউ টেনে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বুক, পিঠ, এমনকি কপালেও সেই দাগ ফুটে ওঠে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, দাগগুলো ঠিক মন্দিরের প্রতিমার পায়ের নিচে দেখা খোদাই করা চিহ্নগুলোর মতো। প্রতিবার নতুন দাগ বেরোলে তার গায়ে তীব্র জ্বালা শুরু হয়, আর সেই জ্বালা তার কানে আবারও ঘণ্টার শব্দ তোলে। গ্রামের বৃদ্ধ পূজারি হেমাঙ্গ যখন এই চিহ্ন দেখে, তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। সে আর কোনো কথা না বলে শুধু অনির্বাণকে এক পাত্র গঙ্গাজল দেয় এবং বলে, “এই দাগ দেবীর ইঙ্গিত। পালাও, এখনই পালাও।” কিন্তু অনির্বাণের মনে তখনও যুক্তির অহংকার—সে ভাবে, সবই মানসিক বিভ্রম।
কিন্তু বাস্তবের সীমা ভাঙতে বেশি দেরি লাগল না। এক দুপুরে সে বই নিয়ে নোট লিখছিল, তখন হঠাৎই বইয়ের পৃষ্ঠা নিজে থেকেই উল্টে যেতে লাগল। বাতাস নেই, জানালা বন্ধ, তবুও পৃষ্ঠাগুলো উন্মত্তের মতো ওলট-পালট হচ্ছে। অনির্বাণ থামাতে গেলে তার আঙুল কেটে যায় পাতার ধারালো প্রান্তে। সঙ্গে সঙ্গেই তার রক্ত বইয়ের ওপর পড়তেই শব্দ ওঠে—মন্ত্রোচ্চারণের মতো কর্কশ, ভাঙা কণ্ঠস্বর, যা চারদিক থেকে ভেসে আসে। তার বুকের ওপর এক ভারী ওজন অনুভব হয়, শ্বাস আটকে আসে, আর চোখের সামনে ভেসে ওঠে কালো ছায়া। সে শপথ করে বলতে পারত, সে ছায়া কোনো কল্পনা নয়, বরং স্পষ্টভাবে প্রতিমার জ্বলন্ত চোখ আর লাল জিভ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই মুহূর্তে অনির্বাণ টের পায়, তার জীবন আর স্বাভাবিক রইল না। যে গবেষণার নেশায় সে অভিশপ্ত বই হাতে নিয়েছিল, তা এখন তাকে প্রতিটি নিশ্বাসে মৃত্যুর ভয়ে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। রাত-দিনের বিভাজন তার জীবনে ভেঙে পড়েছে—স্বপ্নে বা জাগরণে, চামুণ্ডীর অভিশাপ সর্বত্র তাকে ঘিরে ফেলেছে। তার শরীর, মন, আর আত্মা ধীরে ধীরে এক অন্তহীন দুঃস্বপ্নের দাসে পরিণত হতে শুরু করে।
৭
হেমাঙ্গ পূজারির চোখে সেই রাতের আতঙ্ক এখনও স্পষ্ট, যদিও তার জন্মের বহু আগে এই ঘটনা ঘটে। তিনি মৃদু কণ্ঠে অনির্বাণকে শোনাতে শুরু করেন সেই ইতিহাস, যা আজও গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ঘোরে। শতাধিক বছর আগে, এই রাজবাড়ি ছিল অপার ঐশ্বর্যের প্রতীক। জমিদার রুদ্রনারায়ণ ছিলেন প্রজাদের কাছে একাধারে দয়ালু ও ভয়ঙ্কর, কিন্তু তার একমাত্র পুত্র, দারুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী দেবনারায়ণ, পিতার ছায়া ছাপিয়ে যেতে চাইত। অল্প বয়স থেকেই তার মধ্যে ছিল মৃত্যু ও অমরত্ব নিয়ে অদ্ভুত এক কৌতূহল। সে গোপনে তান্ত্রিকদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে, এবং একদিন জানতে পারে রাজবাড়ির কালীমন্দিরে একটি নিষিদ্ধ তন্ত্র লুকিয়ে আছে, যা সক্রিয় করলে মানুষ মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করতে পারে। হেমাঙ্গ বললেন, দেবনারায়ণ সেই তন্ত্র অর্জনের জন্য নিজের ছায়াকেও বিক্রি করতে রাজি হয়েছিল। পূর্ণিমার রাতে, গোপনে সে প্রতিমার পায়ের নিচ থেকে তন্ত্রগ্রন্থ বের করে, এবং নিষিদ্ধ মন্ত্রপাঠ শুরু করে। প্রথমে কিছুই ঘটেনি, কিন্তু যখন তার রক্ত বইয়ের পাতায় পড়ল, তখন মন্দিরের চারদিকে হাহাকার উঠেছিল। গ্রামবাসীরা বলেছিল, সেই রাতে ঘণ্টা না বাজলেও পুরো গ্রাম জুড়ে বাজনার শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, যেন দেবী নিজেই জেগে উঠেছিলেন।
এরপর থেকে শুরু হয় অদ্ভুত সব ঘটনা। দেবনারায়ণের শরীর দিন দিন পাল্টাতে থাকে—তার চেহারা ফ্যাকাশে, চোখ লালচে, আর দেহে অদ্ভুত দাগ ফুটে ওঠে। প্রথমে লোকেরা ভেবেছিল কোনো ব্যাধি, কিন্তু ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো, এ ছিল তন্ত্রের প্রভাব। জমিদার রুদ্রনারায়ণ ভয়ে পড়ে গিয়ে সমস্ত পুঁথি ধ্বংস করতে চান, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। দেবনারায়ণের অদ্ভুত আচরণ গ্রামে আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে। রাতের বেলা তাকে দেখা যেত শ্মশানের ধারে, আগুন নিভে আসা চিতার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে মন্ত্র জপতে। গৃহস্থালির ভেতর থেকেও অদ্ভুত শব্দ শোনা যেত—মৃত মানুষের চিৎকারের মতো। অল্পদিনের মধ্যেই জমিদারের স্ত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান, এবং একে একে পরিবারের সদস্যরা অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হতে লাগলেন। কারও মৃত্যু হলো ঘুমের ভেতর, কারও মৃত্যু হলো শ্বাসরোধ হয়ে, আবার কারও শরীর পাওয়া গেল রাজবাড়ির পুকুরে। গ্রামবাসীরা বলল, এ মৃত্যুগুলো কেবল দুর্ভাগ্য নয়, বরং দেবীর অভিশাপ। তারা বুঝল, দেবনারায়ণের অমরত্বের লোভের কারণে গোটা পরিবার রক্তে ভেসে গেল।
অবশেষে সেই রাত এল, যেদিন দেবনারায়ণ নিজেই প্রাণ হারাল। পূর্ণিমার আলোয় রাজবাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছিল মন্ত্রোচ্চারণের শব্দ। গ্রামের সাহসী কয়েকজন লোক হাতে প্রদীপ নিয়ে এগিয়ে যায়। তারা দেখে, মন্দিরের ভেতরে দেবনারায়ণ দাঁড়িয়ে আছে প্রতিমার সামনে, তার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, আর তার ঠোঁটে ফিসফিসে মন্ত্র। হঠাৎই প্রতিমার চোখ লাল আগুনে জ্বলে ওঠে, আর দেবনারায়ণ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার দেহ অগ্নিদগ্ধ চিতার মতো ছটফট করে ছাই হয়ে যায়, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, ছাইয়ের ভেতর কোনো হাড় বা চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সেদিনের পর থেকেই রাজপরিবারের উত্তরাধিকার শেষ হয়ে যায়, আর মন্দিরকে গ্রামবাসীরা অচল ঘোষণা করে। তারা বলল, দেবনারায়ণের আত্মা এখনও ওই মন্দিরের ভেতর ঘুরে বেড়ায়, আর চামুণ্ডীর অভিশাপ জীবিত। হেমাঙ্গ পূজারি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “যে তন্ত্রকে মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করার শক্তি বলা হয়, তা আসলে মৃত্যু-কেই ডেকে আনে। যে একে স্পর্শ করে, তার পরিণতি দেবনারায়ণের মতো হয়।” অনির্বাণ সেই গল্প শোনার পরও অবিশ্বাসের হাসি চাপতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার বুকের গভীরে ইতিমধ্যেই ভয়ের বীজ বপন হয়ে গেছে—কারণ সে জানে, দেবনারায়ণের মতো তার শরীরেও সেই দাগ ফুটে উঠছে।
৮
অনির্বাণের ভেতরকার অশান্তি এখন ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে। যে মানুষটি এতদিন যুক্তিবাদী হিসেবে গর্ব করত, সে বুঝতে পারছে—তার নিজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। রাতের ঘুম যেন হারিয়ে গেছে, আর যখনই সে চোখ বন্ধ করে, অদ্ভুত সব দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কোনো রাতের শেষে ঘুম ভাঙলে দেখে, টেবিলের ওপর তার নিজের হাতের লেখা ভরা আছে অদ্ভুত অক্ষরে—অপরিচিত, অথচ শক্তিশালী মন্ত্রের ছাপ। বিস্ময়ের সঙ্গে আতঙ্কও তাকে গ্রাস করে, কারণ সে মনে করতে পারে না কখন লিখেছে। কালি এখনো ভেজা, অথচ তার মনে হয়, সেই শব্দগুলো যেন তার নিজের চিন্তা নয়। একদিন রাতে ঘুম ভেঙে দেখে, তার হাত কাঁপতে কাঁপতে নিজে থেকেই খাতায় লিখছে। সে প্রাণপণে হাত থামাতে চাইলেও অদৃশ্য শক্তি যেন তার আঙুলগুলোকে চালাচ্ছে। চোখের সামনে প্রতিমার আগুনমাখা চোখ ভেসে উঠল, আর বুকের ভেতর শোনা গেল ঘণ্টার বজ্রনিনাদ। আতঙ্কে খাতা ছুঁড়ে ফেললেও তাতে লেখা রয়ে যায়—“চামুণ্ডীর ত্যাগ ছাড়া মুক্তি নেই।” ধীরে ধীরে সে টের পায়, মন্দিরের অন্ধকার থেকে যে অভিশাপ ছড়িয়ে পড়েছিল, তা এখন তার নিজের ভেতরে গভীর শিকড় গেঁথে ফেলেছে।
শুধু অনির্বাণই নয়, গোটা গ্রাম যেন অদ্ভুত এক অশুভ শক্তির কবলে পড়ছে। দিনদুপুরে গ্রামের পথে দেখা যায়, অচেনা ছায়ারা ছুটে যাচ্ছে। গ্রামের বৃদ্ধারা বলে, এমন ছায়া আগে কেবল কালীপূজার রাতে দেখা যেত, এখন তা প্রতিদিনের দৃশ্য হয়ে উঠেছে। বাচ্চারা কান্নাকাটি করে বলে, রাতে ঘরে অচেনা কালো মানুষ ঢুকে তাদের ডাক দেয়। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা শুরু হয়, যখন একে একে গ্রামে মানুষ নিখোঁজ হতে থাকে। প্রথমে এক রাখাল ছেলে, তারপর দুইজন মাঝবয়সী চাষি, এমনকি মন্দিরের কাছাকাছি যারা যেত, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসেনি। গ্রামের মানুষ আতঙ্কে রাজবাড়ির দিকেই অভিযোগ তোলে, কারণ সবাই জানে, অনির্বাণ ওই অভিশপ্ত গ্রন্থকে জাগিয়েছে। হেমাঙ্গ পূজারি প্রকাশ্যে অনির্বাণকে দোষারোপ করে বলেন, “তুমি যা মুক্ত করেছো, তা এখন কেবল তোমাকেই নয়, আমাদের সবাইকে গ্রাস করবে।” কিন্তু তখন আর অনির্বাণের হাতে কোনো উত্তর থাকে না। তার নিজের মনই যেন তাকে ছেড়ে দিয়েছে। মাঝরাতে সে নিজেকে দেখতে পায় মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে, অথচ মনে করতে পারে না কীভাবে সেখানে এসেছে।
এক রাতে হঠাৎ গ্রাম কেঁপে ওঠে তীব্র বজ্রপাতে। সবাই নিজেদের ঘরে শিউরে ওঠে, আর সেই সময় গ্রামসংলগ্ন মাঠ থেকে ভেসে আসে এক অদ্ভুত গুঞ্জন—যেন শত শত কণ্ঠে একসঙ্গে মন্ত্রপাঠ চলছে। অনির্বাণ ঘুম ভেঙে দেখে, তার খাতার পৃষ্ঠাগুলো উড়ছে, বাতাসে ঝলসে যাচ্ছে আগুনে। সে টের পায়, তার দেহের ভেতর আরেকটা অস্তিত্ব জায়গা করে নিয়েছে। আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকাতেই দেখে, সেগুলো আর তার নয়—লাল আগুনের ঝিলিক সেখানে জ্বলছে। চারপাশের অন্ধকারে তখন ভেসে ওঠে অগণিত ছায়া, যাদের মুখ নেই, কেবল শূন্য গহ্বর। তারা অনির্বাণকে ঘিরে ধরে, আর সে শুনতে পায় একই কথা—“তুমি আমাদের ডাক দিয়েছো।” সেই রাতে গ্রামে আবারো দু’জন মানুষ নিখোঁজ হয়, আর ভোরে সবাই খুঁজে পায় মন্দিরের চৌকাঠে রক্তের দাগ। গ্রামের ভয় তখন সীমাহীন। অনির্বাণের মনে হয়, সে ধীরে ধীরে নিজের মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলছে। যুক্তির জায়গা দখল করছে অন্ধকারের টান, আর তার প্রতিটি নিশ্বাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অভিশাপের শব্দ। সে আর জানে না, সে গবেষক অনির্বাণ নাকি চামুণ্ডীর অভিশপ্ত এক যন্ত্র—যে শুধু ধ্বংস ডেকে আনতে জন্মেছে।
৯
অনির্বাণ যখন সিদ্ধান্ত নিলেন তন্ত্রকে ধ্বংস করার, তখন গ্রামের অন্ধকার আর তার নিজস্ব অন্তরেকার মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হল তা ছিল শূন্যর চেয়ে ভীতিকর; কারণ সে জানত—এ কাজ জাস্টবাতেই নয়। হেমাঙ্গের মুখে থাকা কুড়ানো উলের মতো স্পষ্ট সতর্কবার্তা ছিল—“যজ্ঞ যদি করতে চাও, তবেই করো সঠিক নিয়মে, নয়তো তন্ত্র তোমাকে নয়, তুমি তন্ত্রকে দাস করে ফেলবে।” কিন্তু ওই সতর্কতার আশ্রয় নেয়া মানে আর একুশ শতকের প্রত্নতত্ত্ববিদের গর্ব ত্যাগ করা। তাই অনির্বাণ নিজের হাতে প্রস্তুতি নিল—প্রাচীন যজ্ঞপাত্র, হরিতকী, গঙ্গাজল, কপালের চিরুনি, এবং সেই তন্ত্রগ্রন্থকে নিপাতিত করার জন্য যা যা প্রয়োজন তা সব জোগাড় করল, হাতে হাত গোপন পুঁথির পাতায় থাকা মন্ত্রের শব্দও আঁকে নিতেই লেগে রইল। গ্রামের কাঁঠালবন ও প্রাচীরের ফাটল থেকে লুকিয়ে থাকা ধূপ-শেকড় ও কাঁঠালগুঁড়ো আনিয়েছিল সে; হেমাঙ্গ, যদিও দ্বিধাগ্রস্ত, তবু কিছু প্রাচীন মন্ত্র জপ করে তাকে সহায়তা করলেন—একভাবে অনির্বাণকে শেষবার সতর্ক করলেন, আর একভাবে ইতিহাসের নাম করে তাকে এই যজ্ঞে অনুমোদন দিলেন, যেন ইতিহাসও এক ধাপ পথ ছেড়ে সামনে দাঁড়ালো। রাত বেলায় মন্দির প্রাঙ্গণে প্রদীপ জ্বালিয়ে তারা সাজালেন যজ্ঞমঞ্চ—চৌরঙ্গী মেঝে, চারপাশে লাল কাঁট-মালোর রেখা, চারদিকে খোদাই করা চিহ্নগুলো পরিষ্কার করে ছোটখাট আঁচ দিয়েই চিহ্নিত করল অনির্বাণ; প্রতিটি চিহ্নের উপরেই তার দৃষ্টি ছিল, কারণ আগে যাতে তন্ত্রের কোনো লাইন ভুলে না পড়ে।
কিন্তু যজ্ঞ শুরু হতেই দেখল পৃথিবীর নিয়ম আর বদলে যাচ্ছে—যেমন কেউ প্রতিটি শব্দ কানে কানে ঘুরে এনে বসে। প্রথম দিনটা জমে উঠল—অনির্বাণ মন্ত্রপাঠ করল, হেমাঙ্গ কল্পিত ছায়া থেকে বধূবেশ করে দেবীর আভাসকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, ও জোড় করে রক্তের কসারতি চালালেন বলাৎকারে নয়, বরং প্রাণোদ্যানমূলক আত্মসামর্পণ হিসাবে। কিন্তু যখন নিজের আঙুলে ক্ষত তুলতে গিয়েই অনির্বাণ দেখল, রক্ত আসে না—তার বদলে কালো কালো শীতল তরল ঝরছে, যা মাটিতে পড়লেই ভাং করে ঘ্রাণ বের হয়; সেই তরলটা বইয়ের পাতায় পড়লেই পাতাগুলো আগুনের মতো জ্বলতে শুরু করল, অথচ আগুন না—এক রকম নীরব, ঠাণ্ডা জ্বলন। প্রথম চেষ্টায় যজ্ঞ ব্যর্থ হল, কারণ প্রতিমার সামনে থেকে কোনো অদৃশ্য ঢেউ এসে তাদের মন্ত্রকে আলোকহীন করে দিল; মন্ত্র শব্দগুলো কানে পৌঁছল না, বরং বাতাসে ভেসে থাকা কণ থেকে সব স্মৃতি মুছে যায়। প্রতিমার চোখ তখন লাল জ্বলে ওঠে, আর অনির্বাণ অনুভব করে, যেন প্রতিটি বলার শব্দ তার ভিতরে ফিরে এসে স্থবিরতা তৈরি করছে—তন্ত্রই প্রতিশোধ নিচ্ছে। গ্রামে প্রথমবার শোনার মতো ঘটনা ঘটল—রাতের মধ্যে তিনটি দিকের কক্ষেই মানুষের নিখোঁজ হওয়া রিপোর্ট উঠল; কেউ দেখেনি কাকে নিয়ে গেছে, কেউ শুনেনি কোনো চিৎকার—কেবল মাটিতে অদ্ভুত ঠাণ্ডা দাগ রয়ে গেছে। অনির্বাণের ভিতরে দ্বন্দ্ব তীব্র হল—সে বুঝতে পারছিল যে তাকে কেবল পুঁথি ধ্বংস করলেই হবে না; সাথে দরকার সেই শক্তিকে যা তন্ত্রকে ধরে রেখেছে, তাকে খুঁজে বের করা এবং মীমাংসা করা।
পরের রাতে, অনির্বাণ আবার যজ্ঞ শুরু করল—এবার তার মনোনিবেশ ছিল আত্মত্যাগে। সে সিদ্ধান্ত নিল নিজের রক্ত দান করে মন্ত্রকে সম্পূর্ণ শেষ করবেন; কারণ হেমাঙ্গ বলেছিলেন, “তন্ত্রের সমাধান হয় তন্ত্রেরই রক্তে, কিন্তু তা যে কাকে খেয়ালি করে দিতে হবে, তা দেবীই বলে দেবেন।” তাই সে নিজের বাহুর মাংস কেটে নিল, কাঁধে রক্ত ঢেলে মন্ত্রপাঠ শুরু করল—প্রতিটি শব্দে তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছিল। কিন্তু প্রতিবারই, যখন শব্দগুলো সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছত, একটি অভিশপ্ত কণ্ঠ ভিতর থেকে যেন বলত—“পরে নয়, আগে তোর আত্মাকে দাও।” এবং তখনই অনির্বাণ নিজেকে দেখতে পেত মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে, অথচ স্মৃতি পূর্ণভবে ফাঁকা। কেবল হেমাঙ্গের কণ্ঠেই ভেসে আসল—“তুমি যজ্ঞ করতে এসেছিস না, তুমি তন্ত্রকে ডেকে নিয়ে এসেছিস।” অনুভব হল, প্রতিমা নিজেই যজ্ঞকে একটি পরীক্ষা বানিয়েছিল—যে পর্যন্ত অনির্বাণ নিজের আত্মার সর্বশেষ সুর ছিঁড়ে দিতে রাজি নয়, ততদিন তন্ত্র ভাঙবে না। এইভাবে একের পর এক চেষ্টা ব্যাহত হল—কখনো বাতাস ছিল বন্ধ, কখনো শব্দগুলো গলে গিয়ে অদৃশ্য ধল ধুলো হয়ে গেল; প্রতিটি ব্যর্থতার সঙ্গে অনির্বাণের শরীরে নতুন দাগ ফোটে উঠল, আর গ্রামের নিখোঁজ মানুষের তালিকা লম্বা হতে লাগল। এর মধ্যেই অনির্বাণ ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে লাগল—এই যজ্ঞ কেবল এক ব্যক্তি-চেষ্টা নয়; এটা ছিল দেবীর সঙ্গে একটা গুজবিত চুক্তি—যদি কেউ নিজেকে সম্পূর্ণ উৎসর্গ করে, তখন দেবী হয়তো শান্ত হবে, নইলে অভিশাপ গভীরতর হবে।
শেষপর্যন্ত, তৃতীয় রাতে, অনির্বাণ যখন মন্ত্রের উচ্চারিত শব্দে তার রক্ত ঢালল, তখন ঘটল এমন কিছু যা সে আগে কল্পনাও করেনি। প্রতিমার পায়ের নিচ থেকে এক গভীর শ্বাস বেরিয়ে এলো—এটা ছিল মুক্তির শ্বাস না, বরং শত কণার আর্তনাদ। মন্দিরের দেয়ালগুলো কাঁপতে লাগল, কিন্তু একই সঙ্গে কণ্ঠে নতুন এক শান্তি স্পষ্ট হল—যেন দুর্ভাগ্যের চেনা গহ্বর নিশ্বাস ছাড়ছে। তিনি অনুভব করলেন, মন্ত্র যখন শেষ বারণ পর্যন্ত গেঁথে, তখন তার কণ্ঠ থেকে বের হওয়া শব্দগুলো মন্দিরের প্রাচীরের ভেতর ঢুকে এক এক করে সব নোংরা স্মৃতি ধুয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক সে মুহূর্তেই, এক অদৃশ্য কণ্ঠ বলে উঠল—“তুই যা দিয়েছিস, তা ফিরবে না।” অনির্বাণ তখন চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল; সে বুঝল, তন্ত্র পুরোপুরি ধ্বংস হলো কি না — তা নিশ্চিত নয়। মনের এক গভীর অংশ বলে উঠল—“তুই মুক্তি পেছিস, কিন্তু কীসের দামে?” ভোরের আলো ফোটা মাত্রই গ্রামে অদ্ভুত নিরবতা নেমে এলো; নিখোঁজদের কেউ কেউ ফিরে এল, তবে তাদের চোখগুলো আগের মতো ছিল না—এক রকম ফাঁপা, দূরবর্তী এবং অচেনা ভঙ্গিতে। অনির্বাণ দেখল, তার নিজের হাতেও সেই তন্ত্রচিহ্ন গভীর হয়ে আছে, আর বুকের ভেতর একটি স্থির শুন্য নীরবতা ছেয়ে গেছে। ਹেমাঙ্গের কাছে যখন সে গেল, সে শুধু বলল—“এবার মন্দিরে ফেরত যাও—প্রতিমার আর কেউ ডাকবে না।” হেমাঙ্গ চুপ করে রইলেন, তার চোখে বেদনাও ছিল আর প্রশান্তিও—কারণ তিনি জানতেন, কখনও কখনও চিরস্থায়ী শান্তির জন্য বড় ক্ষতি দিতেই হয়। কিন্তু অনির্বাণ জানতেন, এই যজ্ঞ শেষ হয়েছিল, তবে তার ফল কী হবে—মুক্তি না অভিশাপ—সময়ই বলে দেবে।
১০
শেষ যজ্ঞের রাতটি ছিল কালো আকাশে ভাসমান ভয়ার্ত অমাবস্যা। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে যেন কারও কান্না মিশে আছে। অনির্বাণ রক্তমাখা হাত নিয়ে প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে, তন্ত্রগ্রন্থটি ধ্বংস করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তার চারপাশে লালচে প্রদীপের আলো বারবার কেঁপে উঠছে, যেন শিখাগুলোও আতঙ্কে কাঁপছে। হঠাৎ প্রতিমার পায়ের নিচ থেকে গর্জে উঠল এক অদ্ভুত শব্দ, আর তারপরেই দেখা দিল এক কালো আগুন—যার শিখা ধোঁয়ার মতো আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তাতে কোনো আলো নেই, শুধু নিঃশেষ করার ক্ষমতা। অনির্বাণ কাঁপা হাতে নিজের রক্ত তন্ত্রগ্রন্থের পাতায় ঢেলে দিল। রক্ত যেন গ্রন্থ শুষে নিতে লাগল, আর সাথে সাথে মন্দিরের মেঝে কাঁপতে শুরু করল। দেওয়ালের ফাটল দিয়ে বাদুড়ের ঝাঁক বেরিয়ে এল, প্রতিমার চোখে জ্বলে উঠল রক্তমাখা আগুন, আর যেন আকাশ কেঁপে উঠল এক অতল চিৎকারে।
সে মুহূর্তে অনির্বাণ অনুভব করল, অদৃশ্য কোনো শক্তি তার হাত চেপে ধরছে, তাকে যজ্ঞ অসম্পূর্ণ রাখার জন্য প্রতিটি মুহূর্তে ঠেকাচ্ছে। তার দেহ শিরদাঁড়া পর্যন্ত জমে গেল, যেন রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সে মন্ত্র উচ্চারণ করতেই বাতাসের গতি বেড়ে গেল, প্রদীপের আলো নিভে গেল একে একে। হঠাৎ প্রতিমার ছায়া যেন ভেঙে বেরিয়ে এলো, আর সেই ছায়া অনির্বাণকে জড়িয়ে ধরল, যেন তাকে গ্রাস করার জন্য উঠে এসেছে। তবুও শেষ মুহূর্তে সে তন্ত্রগ্রন্থকে কালো আগুনে নিক্ষেপ করল। আগুন মুহূর্তের মধ্যে বইটিকে গ্রাস করল, কিন্তু গ্রন্থ ছাই হয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আগুনে মিলিয়ে এক অদৃশ্য ধোঁয়ায় রূপ নিল। মন্দিরে এক অদ্ভুত শব্দ প্রতিধ্বনিত হল, যেন শ’য়ে শ’য়ে আত্মা হাহাকার করছে। অনির্বাণের চোখের সামনে ঘুরে উঠল জমিদার পরিবারের মৃত্যুর দৃশ্য, হেমাঙ্গের সতর্কবার্তা, আর সেই মুহূর্তগুলো যখন প্রথমবার প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়েছিল সে। তার কান্নার শব্দ মিশে গেল সেই হাহাকারের সাথে, আর চারদিক অন্ধকারে তলিয়ে গেল।
ভোর হওয়ার সাথে সাথে গ্রামবাসীরা মন্দিরের দিকে ছুটে গেল। কিন্তু তারা দেখতে পেল, মন্দিরের দরজা খোলা, ভেতরে কোনো প্রদীপ জ্বলছে না, আর অনির্বাণের কোনো চিহ্ন নেই। প্রতিমা আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে আছে, তার পায়ের নিচে আবারও তন্ত্রগ্রন্থ রাখা, অটুট এবং অক্ষত। গ্রামের মানুষজন ভয় আর বিভ্রান্তি নিয়ে একে অপরের দিকে তাকাল, তারপর ধীরে ধীরে গুজব ছড়িয়ে পড়ল—এইবার চামুণ্ডী তার নতুন শিকার পেয়েছে। রাতের অন্ধকারে যারা মন্দিরের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল, তারা বলল প্রতিমার চোখে লাল আগুন জ্বলতে দেখেছে, আর মন্দিরের ভেতর থেকে শোনা গেছে অনির্বাণের ফিসফিসানি, যা ক্রমে কণ্ঠরোধী আর্তনাদে পরিণত হয়েছে। সেই দিন থেকে গ্রাম আবার আতঙ্কে তলিয়ে গেল। কেউ আর মন্দিরের দিকে সাহস করে তাকাত না, কিন্তু প্রত্যেকের মনে গেঁথে গেল এক ভয়ঙ্কর সত্য—চামুণ্ডীর অভিশাপ চিরন্তন, আর প্রতিবারই সে তার শিকারকে বেছে নেয়। এইবার সেই শিকার অনির্বাণ, আর পরেরবার কে হবে, তা কেউ জানে না।
শেষ