শৌৰ্য্য সেনগুপ্ত
এক
পথে নামতেই শুভ্রর মনে হলো সময় যেন উল্টোদিকে বয়ে যাচ্ছে। শহরের ব্যস্ততা, কোলাহল আর আধুনিকতার মাঝখান থেকে হঠাৎই এই গ্রামে ফিরে আসা—একেবারে অন্য এক জগতে পা রাখার মতো। কাঁচা রাস্তার দুইপাশে ছড়িয়ে আছে সবুজ ধানক্ষেত, দূরে তালগাছের মাথায় ভেসে বেড়াচ্ছে পাখিরা। হাওয়ায় ধানগাছের দোল, শস্যগন্ধ মিশে আছে। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেও গ্রামকে ঘিরে আছে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন মানুষজন হাসি-আনন্দ ভুলে গেছে। শুভ্র বহু বছর শহরে থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে এবার চিরচেনা গ্রামে ফিরেছে। ছোটবেলার স্মৃতিগুলো ভেসে উঠছিল মনে—যখন এই গ্রামে সন্ধ্যাবেলায় পূজোর ঢাক বেজে উঠত, ছেলেপিলে মাঠে খেলত, আর উৎসবের কোলাহলে গ্রাম জমে উঠত। কিন্তু আজ যেন অন্য ছবি—হালকা গুমোট হাওয়া, ঘরে ঘরে মুখ ভার করে থাকা মানুষ, আর মন্দিরের দিক থেকে অদ্ভুত এক চাপা অস্বস্তি ছড়িয়ে আসছে। শুভ্র বুঝতে পারছিল, এখানে কিছু একটা বদলেছে।
গ্রামের মোড়ে বসে থাকা বয়স্ক লোকদের সঙ্গে কথা বলতেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারা গল্প করতে করতে জানালেন, বহু বছর আগে এই গ্রামে চামুণ্ডা দেবীর পূজা হতো রক্তবলির মাধ্যমে। প্রতিবার পূজোর আগে একটি পশুকে বলি দেওয়া হতো, তারপর শুরু হতো মহাউৎসব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্ম এই রক্তবলির বিরোধিতা করে। তারা বিশ্বাস করত, দেবীকে সন্তুষ্ট করতে রক্ত নয়, ভক্তিই যথেষ্ট। দীর্ঘ আন্দোলনের পর গ্রামের মানুষ একসাথে সিদ্ধান্ত নেয়—আর কোনো বলি হবে না। সেই সিদ্ধান্তেই থেমে যায় পুরনো রীতি, মন্দিরে শুধু ফুল আর প্রদীপে পূজা শুরু হয়। কিন্তু সেই সময় থেকেই একটি লোককথা ছড়িয়ে পড়ে—দেবী চামুণ্ডা রুষ্ট হয়েছেন। গ্রামে নানা বিপদ ঘটতে থাকে: কখনো ফসল নষ্ট, কখনো রোগ ছড়িয়ে পড়া, আবার কখনো অকারণে অগ্নিকাণ্ড। মানুষ এই ঘটনাগুলোকে দেবীর রোষ বলে ব্যাখ্যা করতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে এগুলো থেমে যায়, জীবন স্বাভাবিক হয়, আর গ্রামবাসী রক্তবলির অতীতকে ভুলে যেতে চেষ্টা করে। শুভ্র ছোটবেলায় এসব কাহিনি শুনেছিল, কিন্তু শহরের শিক্ষায় বড় হয়ে ওঠার ফলে এগুলোকে নিছক গুজব বলেই মনে করত। তবুও এবার গ্রামে ফিরে এসে সে দেখল, সেই ভয়ঙ্কর কাহিনি আবারও ছায়ার মতো গ্রামকে আচ্ছন্ন করেছে।
মন্দিরের সামনে দাঁড়ালে শুভ্রর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভগ্নপ্রায় মন্দির, চারপাশে লতাগুল্মে ঢাকা, অথচ ভিতরে এখনো জ্বলছে প্রদীপ। দেবীর মূর্তির মুখ যেন ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে—এমনটাই গ্রামের মানুষজন বলে। শুভ্র অবশ্য মূর্তিটাকে শিল্পকর্ম ছাড়া আর কিছু ভাবল না। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ, মানুষের গুঞ্জন আর ভয়ভরা দৃষ্টি এক অদ্ভুত আবহ তৈরি করেছিল। বৃদ্ধ সজনী ঠাকরুন এসে ফিসফিস করে বলল, “দেবী খুশি নন রে বাবা। রক্ত ছাড়া তাঁর শান্তি নেই। এ গ্রাম আবার বিপদে পড়বে।” শুভ্র অবাক হয়ে তাকাল, মনে হলো এখনও অন্ধবিশ্বাস গ্রামকে আঁকড়ে আছে। সে প্রতিবাদ করতে চাইলো, কিন্তু বুঝল এই ভীত মানুষগুলোকে একদিনে পাল্টানো সম্ভব নয়। তবে মনের গভীরে প্রশ্ন জেগে উঠল—এখনো কেন এই কুসংস্কার জিইয়ে রাখা হচ্ছে? কে এই ভয় ছড়িয়ে দিচ্ছে?
শুভ্রর মনে পড়ল তার শৈশবের সেই ভয়ের রাতগুলো। তখনও সে ছোট, হঠাৎ মন্দিরের ঘণ্টা বাজত মধ্যরাতে, গ্রামের লোক ছুটে যেত দেবীর নাম জপতে। মা তাকে জড়িয়ে ধরত আর বলত—“চোখ বুজে থাক, দেবীর রোষে যেন চোখ না পড়ে।” আজ এত বছর পরেও একই আতঙ্ক মানুষের মনে বিরাজ করছে। তবে শুভ্র এবার আর সেই ছোট্ট ছেলে নয়—সে যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে সত্য খুঁজে বের করার ক্ষমতা রাখে। গ্রামের অন্ধকারাচ্ছন্ন কাহিনি তার ভেতরে কৌতূহল আর ক্ষোভ দুই-ই জাগিয়ে দিল। সে ঠিক করল, এই রহস্যের ভিত খুঁজে বের করতেই হবে। যদি সত্যিই দেবী রুষ্ট হন, তবে প্রমাণ চাই; আর যদি এটা মানুষের তৈরি ভয়ের কারসাজি হয়, তবে তার মুখোশ খুলে ফেলা জরুরি। গ্রামের পুরোনো অভিশাপ কি সত্যি, নাকি শুধুই অন্ধকারে জন্ম নেওয়া ভ্রান্ত বিশ্বাস—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে শুভ্রর যাত্রা শুরু হলো সেই মুহূর্ত থেকেই।
দুই
সন্ধ্যা নামতেই গ্রাম যেন হঠাৎ অচেনা হয়ে গেল। মন্দির প্রাঙ্গণে অদ্ভুত এক ভিড় জমতে শুরু করেছে। মানুষজনের মুখে আতঙ্ক আর কৌতূহলের ছাপ—কেউ কেউ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ আবার হা-ভয়ে দূর থেকে দেখছে। ধোঁয়া ভেসে আসছে আগুনের চিতার মতো, শঙ্খের গম্ভীর ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। সেই সঙ্গে এক অচেনা পুরুষকণ্ঠে শোনা গেল গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ—“ওঁ হ্রীং চামুণ্ডায়ৈ নমঃ।” গ্রামবাসী চমকে তাকিয়ে দেখল, অন্ধকারের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক মানুষ, লালচে আলখাল্লা পরে, গলায় হাড়ের মালা, হাতে ত্রিশূল, কপালে রক্তমাখা তিলক। তার চোখে এক অদ্ভুত জ্যোতি, যেন শীতল শিখার মতো দগদগ করছে। এ-ই সেই নতুন অতিথি—ভৈরবানন্দ, এক তান্ত্রিক, যে দাবি করছে সে দেবীর দূত। তার প্রতিটি পদক্ষেপে যেন ভয় ছড়িয়ে পড়ছিল; কেউ ফিসফিস করে বলল, “দেবী আবার রক্ত চাইছেন।” সেই মুহূর্তে গ্রামের পুরোনো ভয়ের স্মৃতি যেন আবার জেগে উঠল।
ভৈরবানন্দ মন্দিরের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে এক গর্জন দিয়ে ঘোষণা করল—“যতদিন দেবী চামুণ্ডাকে পশুবলি দেওয়া হয়েছিল, ততদিন এ গ্রামে শান্তি ছিল। তোমরা মানুষরা অজ্ঞতা আর অহংকারে বলি বন্ধ করেছ। দেবী এখন রুষ্ট, তাঁর ক্রোধের আগুনে তোমাদের ঘরবাড়ি, ফসল, সন্তান সব ভস্ম হয়ে যাবে। একমাত্র উপায়—আবার বলি ফিরিয়ে আনা।” তার কণ্ঠে এমন এক নাটকীয়তা ছিল যে, সাধারণ মানুষ ভয়ে কেঁপে উঠল। গ্রামের প্রবীণ মহাদেব মণ্ডল কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। আর সজনী ঠাকরুন হাত জোড় করে কেঁদে উঠলেন—“দেখেছিস, আমি তো আগেই বলেছিলাম। দেবী মানবেন না, রক্ত ছাড়া শান্তি মিলবে না।” ধীরে ধীরে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ল—কেউ বলছে এ তান্ত্রিক সত্যিই দেবীর দূত, আবার কেউ সন্দিহান হলেও প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না। অন্ধকার, আগুনের শিখা আর তান্ত্রিকের গম্ভীর মন্ত্র মিলিয়ে এক ভৌতিক আবহ তৈরি হয়েছিল, যেন গ্রাম নিজেই দেবীর কোপে কাঁপছে।
শুভ্র এ দৃশ্য দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। তার কাছে সবই অভিনয় মনে হলো—একটা চতুর নাটক, যার উদ্দেশ্য মানুষের মনে ভীতি ঢুকিয়ে নিজের প্রভাব বিস্তার করা। কিন্তু সমস্যাটা হলো, সাধারণ মানুষ ভয় আর বিশ্বাসে সহজেই প্রভাবিত হয়। মিতালী তার পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “শুভ্র, তুমি কী ভাবছ? যদি সত্যিই দেবী রুষ্ট হন?” শুভ্র তাকে শান্ত গলায় বলল, “ভয় পেয়ো না। দেবতা কখনো রক্ত চান না। এটা মানুষের তৈরি কুসংস্কার।” তবুও সে বুঝতে পারছিল, শুধু যুক্তি দিলেই হবে না, কারণ গ্রামবাসীর চোখে ভৈরবানন্দ এখন এক অলৌকিক চরিত্র। সমরেশ দাঁত চেপে বলল, “এই লোকটা নাটক করছে। কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে, গ্রামের সবাই এখন ওর কথায় মেতে উঠছে।” রঞ্জিত তখনই একটা ছোট ক্যামেরায় রেকর্ড করতে লাগল, ভৈরবানন্দ কীভাবে ভয় দেখাচ্ছে তার প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখতে। তাদের কিশোর বন্ধু অজিত দূরে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল, চোখেমুখে আতঙ্ক আর বিস্ময়ের মিশ্রণ।
ভৈরবানন্দ মন্ত্রপাঠ শেষে আগুনে একমুঠো লাল গুঁড়ো ছুঁড়ে দিল। আগুন মুহূর্তে উঁচু হয়ে লাফিয়ে উঠল, আর লোকেরা চমকে উঠল। আসলে সেটা সাধারণ রাসায়নিক ছিল, যা আগুনকে হঠাৎ বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, কিন্তু গ্রামের মানুষ তা জানত না। ভয়ে তাদের হাঁটু কেঁপে গেল, অনেকেই দেবীর নাম জপতে শুরু করল। ভৈরবানন্দ আবার গর্জে উঠল—“সাতদিনের মধ্যে বলি না দিলে এই গ্রামে মহাদুর্ভিক্ষ নেমে আসবে। রোগ, মৃত্যু আর অগ্নিকাণ্ডে তোমাদের গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।” তার কথার সঙ্গে সঙ্গেই একদল শকুন উড়ে গেল আকাশের ওপর দিয়ে, যা দেখে গ্রামবাসীর ভয় আরও বেড়ে গেল। শুভ্র দাঁড়িয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “এ সব ভয়ের নাটক। দেবীর নামে মানুষ হত্যা বা পশুবলি একেবারেই ভুল।” কিন্তু তার কথা গলায় আটকে গেল, কারণ ভিড়ের মধ্যে ফিসফিসানি বাড়ছিল—“শুভ্র শহরের ছেলে, দেবীর শক্তি বোঝে না।” এই এক রাতেই গ্রাম যেন আবার অন্ধকার যুগে ফিরে গেল। শুভ্র তখনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল—যে করেই হোক এই তান্ত্রিকের মুখোশ খুলে দেখাতে হবে, না হলে ভয় নামক শৃঙ্খলে বাঁধা থেকে যাবে তার প্রিয় গ্রাম চিরকাল।
তিন
ভৈরবানন্দের নাটকীয় আগমনের পরদিন সকালেই গোটা গ্রামে এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি হলো। মানুষজন নিজেদের কাজে গেলেও চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট ছিল। কেউ শিস বাজাচ্ছে না, কেউ হাসছে না—সবাই যেন ভেতরে ভেতরে আতঙ্কে কুঁকড়ে আছে। চায়ের দোকানে বসা কৃষক থেকে শুরু করে মাঠে কাজ করা শ্রমিক—সবাই একই কথা বলছে, “সাত দিনের মধ্যে বলি না দিলে গ্রাম ধ্বংস হয়ে যাবে।” শুভ্র এসব শুনে ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসছিল। সে জানত, এ একেবারেই মানুষের তৈরি ভয়। দেবী চামুণ্ডার নামে এক ভণ্ড তান্ত্রিক নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে। কিন্তু একা লড়াই করলে কোনো ফল মিলবে না, তার সঙ্গে দরকার শক্ত একটা দল। তাই সেদিন সন্ধ্যায়, অন্ধকার নামতেই, শুভ্র তার ঘনিষ্ঠ তিনজন—মিতালী, সমরেশ আর রঞ্জিতকে নিয়ে পুকুরপাড়ের পুরোনো বটগাছের নিচে ডাকল। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, অন্ধকারে জোনাকির আলো—মিটমিটে পরিবেশে তারা চারজন গোল হয়ে বসলো। শুভ্র শান্ত গলায় বলল, “আমাদের কিছু করতে হবে। যদি চুপ করে থাকি, তবে অন্ধকারই জিতবে।” তার চোখে দৃঢ়তার ঝিলিক দেখে বাকিরাও চুপ করে মনোযোগ দিল।
মিতালী প্রথমেই দ্বিধা প্রকাশ করল। সে বলল, “কিন্তু শুভ্র, সবাই বিশ্বাস করছে ভৈরবানন্দকে। আমি নিজেও বুঝতে পারছি না—হয়তো সত্যিই দেবী রুষ্ট হয়েছেন।” শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে নরম স্বরে বলল, “মিতালী, দেবী মানে শক্তি, দেবী মানে আলো। তিনি কখনো রক্ত চাইতে পারেন না। এটা মানুষের ভয়কে কাজে লাগিয়ে তান্ত্রিক নিজের খেলা খেলছে। যদি আমরা কিছু না করি, তবে আবার রক্ত ঝরবে।” সমরেশ তখনই কথা কেটে দিয়ে বলল, “আমি আছি তোদের সঙ্গে। যতই শক্তিশালী হোক, ওকে আমি দাঁত-নখ দিয়ে প্রতিহত করব।” তার চোখে জ্বলছিল ক্ষোভ। রঞ্জিত একটু ভেবে বলল, “আমরা যদি ওর মুখোশ খুলতে চাই, তবে প্রমাণ লাগবে। শুধু মুখে মুখে তর্ক করে কেউ আমাদের বিশ্বাস করবে না। ভৈরবানন্দ চালাক, সে ভয় দেখিয়ে মানুষকে বশ করছে। তাই আমাদের বুদ্ধি খাটাতে হবে।” শুভ্র মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তার মনে হলো, এই দলটাই হবে তার আসল শক্তি। মিতালীর আবেগ, সমরেশের সাহস, রঞ্জিতের বুদ্ধি—সব মিলিয়ে তারা একে অপরের পরিপূরক।
এমন সময় তাদের আড্ডার মধ্যে এসে হাজির হলো ছোট্ট অজিত। কিশোর বয়স, চোখেমুখে কৌতূহল আর একরাশ দুষ্টুমি, তবে এই মুহূর্তে সে ভীষণ সিরিয়াস। অজিত নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাকেও সঙ্গে নাও। আমি ছোট বলে কিছু পারব না ভেবো না। আমার চোখ ছোট জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে তোরা পারবি না।” সবাই প্রথমে হেসে ফেললেও শুভ্র তার দিকে তাকিয়ে গুরুত্ব দিল। সে জানত, কিশোরদের সাহস আর কৌতূহল অনেক সময় বড়দের চেয়ে বেশি কাজ দেয়। অজিত বলল, “ভৈরবানন্দকে আমি অনেকবার মন্দিরের পেছনে যেতে দেখেছি। ওখানে কিছু একটা লুকিয়ে রাখে। যদি চাই, আমি ওকে গোপনে অনুসরণ করতে পারব।” এই কথায় রঞ্জিত চমকে উঠল, “সেটা হলে তো বেশ হয়! কিন্তু খুব সাবধানে করতে হবে। ও লোকটা বিপজ্জনক।” সমরেশ হেসে বলল, “তুই ভেবো না রে অজিত, তোকে আমরা একা ছাড়ব না। সবাই মিলে থাকলে ওর কিচ্ছু করার সাহস নেই।” শুভ্র গভীরভাবে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বলল, “ঠিক আছে অজিত, তুইও আমাদের দলের সদস্য। তবে আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হবে—ভয় পেয়ে পিছু হটা চলবে না।”
শেষ পর্যন্ত তারা চারজন তরুণ আর এক কিশোর প্রতিজ্ঞা করল—যেভাবেই হোক, ভৈরবানন্দের প্রতারণা ফাঁস করবে। তারা শপথ নিল, গ্রামে আর কোনো বলিদান ফিরতে দেবে না। পুকুরপাড়ের নিস্তব্ধ অন্ধকারে তারা হাত একত্রিত করে প্রতিজ্ঞা করল, “আমরা সত্য খুঁজে বের করব, ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দেব।” সেই মুহূর্তে জোনাকিরা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যেন প্রকৃতিও তাদের সঙ্গে প্রতিজ্ঞায় শামিল হলো। তবে শুভ্র জানত, সামনে পথ সহজ নয়। ভয় দেখিয়ে মানুষকে বশ করা সহজ, কিন্তু যুক্তি দিয়ে মানুষকে বোঝানো কঠিন। ভৈরবানন্দ শুধু একজন তান্ত্রিক নয়, সে ভয়কে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তাই প্রমাণ ছাড়া তাকে হারানো সম্ভব নয়। দলটি সিদ্ধান্ত নিল, তারা ভৈরবানন্দকে গোপনে অনুসরণ করবে, তার কাজকর্ম রেকর্ড করবে, আর গ্রামের মানুষের সামনে সত্যি তুলে ধরবে। সেই রাতেই তাদের যাত্রা শুরু হলো—এক ভীত-সন্ত্রস্ত গ্রামকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার যাত্রা।
চার
রাত তখন অনেক গভীর। অন্ধকারে মোড়া চারপাশে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝে মাঝে রাতের পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ গ্রামের প্রাচীন মন্দিরের দিক থেকে আগুনের লেলিহান শিখা আকাশ ছুঁতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই শাঁখ বাজানো ও আতঙ্কিত চিৎকারে গোটা গ্রাম জেগে উঠল। ঘুম ভেঙে ছুটে এলেন গ্রামবাসীরা। মন্দিরের চূড়ো থেকে আগুন বের হচ্ছে দেখে সবাই ভয়ে কাঁপতে লাগল। কেউ বলল, “দেবী রুষ্ট হয়েছেন!”—আবার কেউ বলল, “এটা অলৌকিক সংকেত, পাপ হয়েছে গ্রামে।” ভিড় জমতে না জমতেই কয়েকজন দাবি করতে লাগল যে তারা মন্দিরের ভেতর থেকে এক নারীর করুণ আর্তনাদ শুনেছে। শিউরে উঠল সবাই, কারণ সেই কণ্ঠস্বর মানুষের হলেও তাতে যেন অদ্ভুত এক পরলোকের সুর মিশে ছিল। একইসাথে দূর থেকে দেখা গেল এক দীর্ঘ কালো ছায়া মন্দিরের দরজা থেকে বেরিয়ে আসছে, তারপর মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। ভিড়ের মধ্যে এক আতঙ্ক ছড়িয়ে গেল—“ছায়ামূর্তি! দেবীর দূত!” অনেকেই প্রণাম করে মাথা ঠেকাল মাটিতে, কেউ আবার উলটোপালটা দৌড়ে নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল।
কিন্তু শুভ্র দাঁড়িয়ে ছিল আলাদা করে। অন্যদের মতো সে ভয় পায়নি। ছেলেবেলা থেকেই সে কুসংস্কারকে চোখ বুজে বিশ্বাস করত না। তার যুক্তিবাদী মন বলল, “কোনো দেবশক্তি নয়, এর পেছনে মানুষের হাত রয়েছে।” সে লক্ষ্য করল, আগুনের শিখা অস্বাভাবিকভাবে এক কোণ থেকে বের হচ্ছে—যেখানে সাধারণত প্রদীপ জ্বালানো হয় না। আগুনের উৎস স্পষ্টতই কৃত্রিম। আবার আর্তনাদ যেটা শোনা গেল, সেটা অনেকটা বাঁশির ভেতর দিয়ে বাতাস ঢোকালে যেমন কণ্ঠস্বর তৈরি হয়, তার মতো শোনাল। তার মানে কেউ সচেতনভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। ছায়ামূর্তি নিয়েও তার সন্দেহ তৈরি হলো—এত বড় ছায়া কেবল চাঁদের আলো ও আগুনের মিলিত প্রতিফলনেই সম্ভব। কিন্তু তার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরছিল—কে এত বড় আয়োজন করছে, আর কেন? মন্দির গ্রামের মানুষের বিশ্বাসের কেন্দ্র, এখানেই তারা দেবীর সামনে প্রার্থনা করে, উৎসব হয়, পুজো হয়। সেই জায়গাটিকেই যদি ভয় ও আতঙ্কের জায়গায় পরিণত করা হয়, তাহলে নিশ্চয় এর পেছনে কোনো গভীর উদ্দেশ্য আছে।
গ্রামের মানুষরা যখন ভয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, তখনই গ্রামের বৃদ্ধ হরিপদ ঘোষ কেঁপে কেঁপে বললেন, “আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এই গ্রামে আছি, কখনো এমন ঘটনা দেখিনি। দেবী যদি সত্যিই রুষ্ট হন, তবে বড় বিপদ আসবে।” তার কথায় ভিড়ের মধ্যে আরও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু শুভ্র সবার সামনে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “এটা দেবীর অলৌকিক শক্তি নয়। কেউ আমাদের ভয় দেখাতে চাইছে। আমরা যদি চোখ বুজে কুসংস্কারে ভেসে যাই, তবে তাদের ফাঁদে পা দেব।” অনেকেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। কারও কারও মনে রাগও হলো—“দেবীর শক্তিকে অস্বীকার করছে।” তবে শুভ্র জানত, সত্য বের করতে হলে এই ভয়ের দেয়াল ভাঙতেই হবে। সে সিদ্ধান্ত নিল, আজ রাতেই সে একাই মন্দিরের ভেতরে ঢুকে সবকিছু খতিয়ে দেখবে। মানুষের ভিড় সরে যেতেই, সে টর্চ নিয়ে ধীরে ধীরে এগোল মন্দিরের ভেতরে। ভিতরে ঢুকতেই এক অদ্ভুত পোড়া গন্ধ পেল, চারদিকে ছাই ছড়িয়ে আছে, আর দেয়ালে কালো দাগ। হঠাৎ তার কানে ভেসে এলো কড়কড়ে শব্দ—কেউ যেন দ্রুত দৌড়ে পালাচ্ছে পিছনের গলি দিয়ে। শুভ্র বুঝল, রহস্যের মূল সূত্রটা এখানেই।
শুভ্র মন্দির থেকে বেরিয়ে আসতেই গ্রামবাসীরা ভিড় করে প্রশ্ন করতে লাগল—“কি দেখলে?” সে শুধু বলল, “রহস্য এখনও বাকি আছে, কিন্তু একদিনেই সব বুঝে ফেলব।” তার চোখে তখন ছিল তীব্র দৃঢ়তা। সে অনুভব করল, এ কেবল কোনো দুষ্টুমি নয়, বরং সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ভয়কে অস্ত্র করে কেউ এই গ্রামকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইছে। গ্রামবাসীদের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে মন্দিরকে আতঙ্কের কেন্দ্র বানানো হচ্ছে। শুভ্রর মন দৃঢ় হলো—যত ভয়ই ছড়ানো হোক না কেন, সে এই ঘটনার আসল সত্য বের করবে। কিন্তু সে জানত, এই লড়াইটা সহজ হবে না। অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা সেই ছায়া এখনো কোথাও ঘুরছে, অপেক্ষা করছে তার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। রাতের নিস্তব্ধতা আবার ফিরে এলো, কিন্তু শুভ্রর মনে অদ্ভুত এক উত্তেজনা কাজ করছিল। সে বুঝতে পারল—এই অদ্ভুত ঘটনার শুরু আসলে এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা মাত্র।
পাঁচ
রাত তখন প্রায় মাঝরাত ছুঁই ছুঁই। মন্দিরের ভেতরে ধূপের ধোঁয়া ধীরে ধীরে চতুর্দিক ঢেকে দিচ্ছিল, আর বাইরে অদ্ভুত নীরবতা। রঞ্জিত লুকিয়ে বসে ছিল এক কোণে, হাতে ছোট্ট রেকর্ডার। তান্ত্রিক কালো পোশাক পরে, গলায় হাড়ের মালা ঝুলিয়ে, মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করল। তার কণ্ঠস্বর ভারী আর কাঁপা কাঁপা, যেন ভয় তৈরি করার জন্যই সাজানো। চারপাশে আগুনের আলো দপদপ করছিল, আর মাঝে মাঝে হঠাৎ হাহাকার করে ওঠা অদ্ভুত শব্দ বাতাসে ভেসে আসছিল। রঞ্জিত বুঝতে পারল, এগুলো আসল নয়—কৃত্রিমভাবে তৈরি। তবে সাধারণ মানুষ সহজেই ভয় পেতে বাধ্য। রেকর্ডারের বোতাম চেপে সে এক এক করে তান্ত্রিকের সমস্ত আচার অনুষ্ঠান ধরে রাখতে লাগল। তান্ত্রিকের মন্ত্র, ঢাকঢোলের শব্দ, আর হঠাৎ ভেসে আসা অচেনা আওয়াজ—সবকিছু সে সযত্নে রেকর্ড করল। তার বুকের ভেতর ধুকপুকানি বাড়ছিল, কারণ সামান্যতম শব্দে যদি ধরা পড়ে যায় তবে জীবন নিয়ে ফিরতে পারবে না। তবু সে জানত, সত্য উদঘাটন করতে গেলে এই ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে।
এদিকে সমরেশ আর শুভ্র মন্দিরের বাইরের অন্ধকার প্রাঙ্গণে খুঁজে ফিরছিল কিছু সূত্র। তারা জানত, অশরীরী শক্তির ভৌতিক উপস্থিতি বলে যে কথাগুলো ছড়িয়ে পড়েছে, তা নিছক প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। দু’জনে টর্চের ক্ষীণ আলোয় এক কোণে কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি দেখতে পেল। ধুলোয় ঢাকা লৌহের বাক্স, ভেতরে তার জটলা, আর একপাশে রাখা ছোট্ট স্পিকার। স্পিকার থেকে ভয়াবহ গর্জনের শব্দ বের হয়, যা দূর থেকে শোনার পর মনে হয় যেন অদৃশ্য দানব চিৎকার করছে। শুভ্র যন্ত্রগুলো পরীক্ষা করে বুঝতে পারল, এগুলো সবই আধুনিক প্রযুক্তির ফাঁদ। এমনকি এক জায়গায় তারা পেল ধোঁয়া ছড়ানোর যন্ত্র, যা ধূপের গন্ধের সাথে মিশে গিয়ে অতিরিক্ত রহস্যময় পরিবেশ তৈরি করে। মন্দিরের দেয়ালের সাথে লাগানো ছোট ছোট আয়না আর লুকোনো প্রোজেক্টরও চোখে পড়ল—যেখানে হঠাৎ আলোর প্রতিফলনে অদ্ভুত ছায়া নড়ে ওঠে। সমরেশ সব যন্ত্রপাতি দেখে অবাক হয়ে বলল, “এ যেন ভৌতিক থিয়েটার!” কিন্তু সাথে সাথেই তার মনে হল—এই প্রমাণগুলো জোগাড় করা গেলেও, আইনের চোখে এগুলো দিয়ে তান্ত্রিককে অভিযুক্ত করা এত সহজ নয়। কারণ প্রতারণার উদ্দেশ্য প্রমাণ করা অনেক কঠিন কাজ।
রঞ্জিত ধীরে ধীরে মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে সমরেশ ও শুভ্রর সাথে মিলিত হল। তার মুখে ঘামের বিন্দু ঝলমল করছিল। কাঁপা গলায় সে বলল, “আমি সব রেকর্ড করেছি। তবে শুনে মনে হচ্ছে লোকটা শুধু ভয় দেখাচ্ছে না—লোকজনকে ভেতর থেকে বিশ্বাস করাতে চাইছে যে এখানে সত্যিই অশুভ শক্তি আছে।” শুভ্র রেকর্ডারটা চালিয়ে শোনাল, আর গম্ভীর কণ্ঠে তান্ত্রিকের মন্ত্রধ্বনি রাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকঢোল, আর্তচিৎকার আর শিসের শব্দ শুনে সমরেশের মুখ শক্ত হয়ে উঠল। সে বলল, “এইসব শব্দ যদি দিনের পর দিন শোনা যায়, তবে সাধারণ মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করানো সম্ভব যে এখানে ভূতপ্রেত ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আমাদের হাতে শুধু রেকর্ডিং আর এই যন্ত্রপাতির প্রমাণ আছে। আমরা কি সরাসরি প্রমাণ করতে পারব যে তান্ত্রিক ইচ্ছে করেই গ্রামবাসীদের ভয় দেখাচ্ছে?” প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলে রইল। কারণ একদিকে প্রমাণ আছে, অন্যদিকে সেই প্রমাণকে আদালতে টিকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট ভিত্তি এখনও পাওয়া যায়নি।
তবুও তারা জানত, এটাই তাদের প্রথম সাফল্য। অন্তত এই পর্যন্ত এসে বোঝা গেল—তান্ত্রিকের অলৌকিক ক্ষমতা নিছক ভেলকি। এখন দরকার তাকে ফাঁসানোর জন্য আরও নির্ভুল প্রমাণ সংগ্রহ করা। শুভ্র বলল, “আমাদের তাকে হাতেনাতে ধরতে হবে। এমন কিছু প্রমাণ চাই, যা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।” সমরেশ ধূমপানের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগল। তাদের চোখে ধরা পড়ছিল ধূসর মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক অদৃশ্য সত্য, যাকে প্রকাশ করতে হলে আরও ঝুঁকি নিতে হবে। রঞ্জিতও সাহসী কণ্ঠে বলল, “আজ রাতে আমার ভয় পেয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু বুঝেছি আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি। আগামী দিনে ওর মুখোশ খুলবই।” তিনজনের চোখে তখন এক দৃঢ়তা ফুটে উঠল। তারা জানত, খেলা এখন আরও জটিল হতে চলেছে। কারণ অশুভ শক্তি নয়, বরং মানুষের লোভ আর প্রতারণাই এখানে আসল আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর সেই আতঙ্ককে উন্মোচন করতেই শুরু হলো তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের পরিকল্পনা।
ছয়
গ্রামের সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে মিতালীর চারপাশে যেন এক অদৃশ্য চাপ তৈরি হচ্ছিল। উঠোনে বসে থাকা কাকিমারা থেকে শুরু করে পাশের বাড়ির বৃদ্ধারা—সবার চোখে একই প্রশ্ন, একই অভিযোগ—“তুই দেবীর পূজা ছেড়ে দিলি? তোর ছেলেপুলে, সংসার, সব ধ্বংস হবে।” এই কথাগুলো প্রতিদিনই তার কানে বাজছিল, যেন শেকলের মতো তাকে বেঁধে ফেলেছে। অথচ বুকের ভেতরটা ফুঁড়ে বেরোতে চাইছিল অন্য এক সত্য—শুভ্রর যুক্তি, তার ব্যাখ্যা, আর নিজের দেখা অভিজ্ঞতা। মন্দিরে যে অলৌকিক ঘটনার গুজব ছড়ানো হয়েছিল, শুভ্র প্রমাণসহ দেখিয়েছে সেগুলো আসলে মানবসৃষ্ট কৌশল। তবু, দেবীর ভক্তি আর শৈশব থেকে গড়ে ওঠা বিশ্বাস সহজে উপড়ে ফেলা যায় না। তাই দ্বিধাগ্রস্ত মন নিয়ে যখন সে মন্দিরের ঘণ্টার ধ্বনি শুনতে পেত, তখন বুকের ভেতরে গভীর দ্বন্দ্ব শুরু হতো—বিশ্বাসের সান্ত্বনা নাকি সত্যের নির্মমতা? ঘরের ভেতর মা যখন বলতেন, “মেয়ে, দেবীকে অস্বীকার করলে সংসার ভেসে যাবে,” তখন মিতালীর গলায় যেন শব্দ আটকে যেত। একদিকে নিজের মায়ের ভয়, অন্যদিকে শুভ্রর দৃঢ় যুক্তি—মাঝখানে পড়ে সে যেন নিজেই নিজের শত্রু হয়ে উঠছিল।
রাতে একা শোবার সময় মিতালী অনুভব করল তার মানসিক ক্লান্তি। ছাদের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে আসছিল, আর সেই আলোয় সে ভাবছিল—মানুষ কি শুধুই অন্ধভাবে বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে? যদি তাই হয়, তবে জীবনের প্রতিটি বিপদ দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেই মিটে যেত, কষ্ট থাকত না। অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলছে—রোগে ভুগে গ্রামে কত মানুষ মরেছে, দেবীর পুজো করেও কৃষকের ঋণ মাফ হয়নি। তবুও এই বিশ্বাস ভাঙা যায় না, কারণ বিশ্বাস মানে শুধু ধর্ম নয়, পরিবার ও সমাজের চাপে গড়া মানসিক শেকলও। মিতালী জানে, যদি সে প্রকাশ্যে বলে বসে যে এসব ভক্তি আসলে ভুল ধারণা, তবে সমাজ তাকে একঘরে করবে। তার স্বামীও হয়তো বিরক্ত হবে, সন্তানদের পড়াশোনায় বাঁধা আসবে। এই ভয়গুলোই তার মনকে বারবার পিছিয়ে দেয়। অথচ গভীরে শুভ্রর যুক্তিগুলো গেঁথে বসেছে—যেখানে দেবীর অলৌকিকত্বকে সে দেখেছে কেবল মানুষের প্ররোচনার ফল। এই দ্বন্দ্ব এতটাই তীব্র হয়ে উঠেছিল যে সে মাঝেমধ্যে মনে করত, যেন বুকের ভেতরে দুই মিতালী বাস করছে—একজন দেবীভক্ত মিতালী, আরেকজন সত্য অনুসন্ধানী মিতালী।
পরদিন সকালে শুভ্র যখন আবার তাকে বোঝাতে এল, তখন আবহাওয়া ছিল অদ্ভুত ভারী। বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধে চারদিক ভিজে ছিল, গ্রামের রাস্তায় কাদা জমে গেছে। শুভ্র বলল, “মিতালীদি, তুমি জানো তো, ভয়ের ওপর দাঁড়িয়ে কোনো মুক্তি নেই। দেবী যদি সত্যিই সর্বশক্তিমান হন, তবে তাঁর প্রমাণ দিতে মানুষের ফাঁদ বা প্রতারণার দরকার কী? তোমার যে দ্বন্দ্ব, তা স্বাভাবিক—কারণ বিশ্বাস ভাঙা মানে শিকড় কেটে ফেলা। কিন্তু ভাবো, অন্ধবিশ্বাস যদি ভাঙো না, তবে তোমার সন্তানও একই শিকলে বাঁধা থাকবে।” শুভ্রর এই কথায় মিতালীর চোখ ভিজে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল, “শুভ্র, তুমি কি জানো, মায়ের চোখের জল আমি কতবার দেখেছি! তিনি বিশ্বাস করেন, আমি যদি দেবীকে অস্বীকার করি তবে তার কপালে দুর্ভাগ্য আসবে। আমি কি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারি যে নিজের মায়ের বিশ্বাস ভেঙে দিই?” শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানাল, “বিশ্বাস ভাঙা নিষ্ঠুরতা নয়, বরং সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানোই সাহসিকতা। অন্ধকারে মশাল ধরলে মানুষ ভয় পায়, কিন্তু সেই আলোই শেষমেশ পথ দেখায়।” কথাগুলো শুনে মিতালীর বুকের ভেতরে আবার ঢেউ তুলল—সে কি পারবে আলোর দিকে এগোতে? নাকি সমাজের শেকলেই বাঁধা পড়বে সারাজীবন?
রাত গভীর হলে মিতালী একা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। গ্রামের পথ নিঝুম, শুধু দূরে পুকুরপাড়ের শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, এই নিস্তব্ধতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার উত্তর। হয়তো সত্যি দেবীর কোনো অলৌকিক শক্তি নেই, হয়তো সবই মানুষের তৈরি ভয়—কিন্তু সেই ভয়ের শেকল ভাঙতে গেলে তাকে লড়তে হবে নিজের পরিবার, সমাজ, এমনকি নিজের ভেতরের মিতালীর সঙ্গেও। বুকের ভেতরে দমচাপা কান্না জমে উঠলেও, কোথাও যেন একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে ধাক্কা দিচ্ছিল—শুভ্রর সেই যুক্তি, যা বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে, “অন্ধবিশ্বাস ভাঙা ছাড়া মুক্তি নেই।” সে জানে, মুক্তির পথ সহজ নয়, কিন্তু অন্তত প্রথম পদক্ষেপটা তাকে নিতে হবেই। আর সেই মুহূর্তেই মিতালী অনুভব করল, তার দ্বন্দ্বই আসলে তার শক্তি হয়ে উঠছে—কারণ দ্বন্দ্ব ছাড়া নতুন সত্যের জন্ম হয় না।
সাত
অন্ধকারে ঢাকা সন্ধ্যাটা যেন অশুভ হয়ে উঠেছিল। গ্রামের আকাশে নামছিল ভারী মেঘ, দূরে বাজের শব্দ, আর বাতাসে কেমন এক অস্থিরতার ছায়া। সেই সময়েই তান্ত্রিক বুঝতে পেরেছিল—শুভ্র আর তার বন্ধুদের দৃঢ় অবস্থান তার দখলে থাকা ভয়ের শাসনকে ভাঙতে চলেছে। এই উপলব্ধি তার মনে হিংস্র প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিল। প্রথমে অজিতকে টার্গেট করা হল। গ্রাম পেরোনো কাঁচা রাস্তার ধারে, যখন অজিত একা ফিরছিল, হঠাৎই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুজন মুখোশ পরা মানুষ। তারা হাতের বাঁশের লাঠি দিয়ে আঘাত করে অজিতকে মাটিতে ফেলে দিল। শরীরে ব্যথা ছড়িয়ে পড়লেও অজিত কোনো মতে উঠে দাঁড়াল। আক্রমণকারীরা তখনই শীতল গলায় ফিসফিস করে বলল—“তান্ত্রিকের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস দেখিও না, নইলে পরের বার লাঠি নয়, আগুনে পুড়ে মরবে।” ভয় আর যন্ত্রণায় কাঁপতে কাঁপতে অজিত ফিরে এলো, কিন্তু চোখে তখনও জেদ—ভয় তাকে থামাতে পারবে না।
কিছুদিনের মধ্যেই সমরেশের ওপর হামলা হয়। এক গভীর রাতে, যখন সে গোরু বেঁধে গোয়াল থেকে ফিরছিল, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ তার মাথায় আঘাত করে। সমরেশ রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু একটা দৃশ্যই সে দেখতে পায়—আঁচলের মতো কালো পোশাকে ঢাকা একজন লম্বা লোক, হাতে কালী মাখা তাবিজ ঝুলছে। গলায় কর্কশ হাসি, যেন মৃত্যুর দূত দাঁড়িয়ে আছে। সমরেশকে মরে গেছে ভেবে লোকটা অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় সমরেশ। যখন ভোর হয়, তখন গ্রামের লোকেরা তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে উদ্ধার করে। এই ঘটনাই গ্রামে আরও ভয়ের বাতাস ছড়িয়ে দিল। সবাই ফিসফিস করতে লাগল—“তান্ত্রিক রুষ্ট হয়েছে, যারা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছে তাদের প্রাণে মেরে ফেলবে।” সেই কথাগুলো শুনে শুভ্রর বুক ভারী হয়ে উঠল। কিন্তু সে জানল, এ ভয় মানে হার মানা, আর হার মানলে তান্ত্রিক চিরদিন গ্রামটাকে শাসন করবে।
শুভ্রকেই এবার সরাসরি নিশানা করা হল। এক বিকেলবেলা, সে যখন গ্রামপ্রান্তের পুরনো মন্দিরে গিয়েছিল, হঠাৎই পিছন থেকে কেউ তার মুখে কাপড় চাপা দিয়ে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। মন্দিরের অন্ধকার কক্ষে চোখ খুলতেই সে দেখল—তান্ত্রিক দাঁড়িয়ে আছে কালো ধোঁয়ার মতো শ্মশানী সাজে। তার চোখ জ্বলছে অগ্নিশিখার মতো, আর ঠোঁটে একরকম নিষ্ঠুর হাসি। শুভ্রর বুক ধকধক করতে লাগল, তবুও সে সাহস হারাল না। তান্ত্রিক ধীর গলায় বলল—“তুই বুঝতে পারছিস না, তুই আগুন নিয়ে খেলছিস। আমার শক্তির বিরুদ্ধে তুই কিছুই করতে পারবি না। যদি তুই থেমে না যাস, তবে শুধু তুই নয়, পুরো গ্রাম আগুনে ভস্ম হয়ে যাবে।” কথা শেষ করে তান্ত্রিক একটা কালী মূর্তির সামনে রক্তমাখা ছুরি চালালো, আর শুভ্রর দিকে তাকিয়ে হুমকির সুরে বলল—“এই ছুরিই একদিন তোর বুক ভেদ করবে।” বাতাসে রক্ত আর ধূপের গন্ধ মিশে গিয়েছিল, যা মুহূর্তেই শিরদাঁড়া ঠান্ডা করে দিল। শুভ্র এক অদ্ভুত শিহরণে বুঝল—এটা শুধু ভয় দেখানো নয়, এ এক প্রকৃত মৃত্যুর হুমকি।
মন্দিরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুভ্রর মনে কেবল একটা কথাই বাজছিল—ভয় দেখানো মানেই তান্ত্রিকের দুর্বলতা ফাঁস হয়ে গেছে। সে জানল, যতই ভয় দেখাক, আসলে তান্ত্রিক ভেতরে ভীত। গ্রাম যদি একসাথে জেগে ওঠে, তার ভুতুড়ে শক্তি আর কাজ করবে না। কিন্তু নিজের শরীর এখনও কাঁপছিল, গলায় শ্বাস আটকে আসছিল। বাইরে এসে সে গভীর রাতে আকাশের দিকে তাকাল। কালো মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা, কিন্তু কোথাও একটা আলোর রেখা ভেসে আসছিল। শুভ্র বুঝল, এই লড়াই তাকে শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। সে জানল—এখন আর শুধু অজিত, সমরেশ বা নিজের জন্য নয়, পুরো গ্রামের অস্তিত্ব রক্ষার দায় তার কাঁধে এসে পড়েছে। আর তাই মৃত্যুর হুমকি যতই প্রবল হোক, সে পিছিয়ে যাবে না। তান্ত্রিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে ভেঙে ফেলতেই হবে। এটা এখন শুভ্রর নিজের শপথ।
আট
নয়
দশ
___
				
	

	


