Bangla - তন্ত্র - ভূতের গল্প - রহস্য গল্প

চামড়ার দস্তানা

Spread the love

অভিষেক দাশগুপ্ত


১:

মেটিয়াবুরুজের গলিগুলো ভোরবেলা সবচেয়ে বেশি কথা বলে—হলুদ আলোয় ভিজে থাকা চায়ের দোকান, ঠেলাগাড়িতে করে পাঁউরুটি বয়ে নিয়ে চলা কিশোর, আর কুকুরের দল ঘুম থেকে উঠে একে অপরকে চেনার জন্য ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয়। সৌভিক ঘোষ, শহরের এক ক্ষুদ্র কুরিয়ার কর্মী, প্রতিদিন এই জীবনের মধ্যেই নিজেকে খুঁজে ফেরে। মাথায় হেলমেট, পিঠে বড় ডেলিভারি ব্যাগ, আর মুখে একরকম নির্লিপ্ত ভাব নিয়ে, সে বাইকে চড়ে চুপচাপ চলে যায় অজানা ঠিকানার খোঁজে। সেদিন সকালটাও তেমনই ছিল—সৌভিক মেটিয়াবুরুজের কুরিয়ার হাব থেকে ডেলিভারির জন্য তিনটি পার্সেল হাতে পায়। দুইটা ছিল সাধারণ—একটা ফুড প্রসেসরের বাক্স, আরেকটা একটা নতুন মোবাইল ফোন। কিন্তু তৃতীয় প্যাকেটটা আলাদা—ছোট, মোটা, পুরনো টাইপের কালো কার্ডবোর্ডে মোড়ানো, যার গায়ে প্রেরকের নাম লেখা নেই। শুধু লেখা: “ডেলিভার টু ‘S.H. Basri’, 37/5, নয়ারহাট লেন, মেটিয়াবুরুজ, কলকাতা – ৭০০০২৪।” মোড়কের গায়ে একটাও কোম্পানির লোগো নেই, এমনকি কুরিয়ার স্ক্যান কোডটাও অস্পষ্ট। কেমন যেন একটা ধোঁয়াশা, ঘোলাটে গন্ধ বের হচ্ছিল প্যাকেট থেকে—চামড়া পচা পুরনো ঘ্রাণ, যেন বহু পুরোনো কোনও গুদামের জিনিসপত্র। সৌভিক একটু কুঁচকে গেলেও, কাজের খাতিরে সে এটাকে ব্যাগে রেখে বাইকে উঠে পড়ল।

নয়ারহাট লেন বরাবর সৌভিক বাইক নিয়ে পৌঁছতেই বোঝা গেল, ঠিকানাটা শহরের অভ্যন্তরে হলেও আলাদা ধাঁচের—একটা পুরনো কুঠিবাড়ি, যার দরজার উপর নীলচে রং উঠে গেছে, আর জানালাগুলো লোহার গ্রিল দিয়ে ঢাকা। আশেপাশে মানুষের চলাফেরা কম, রাস্তার ওপরে একটি প্রাচীন গামলা গাছ, যার ডালে ডালে শকুনের মতো চড়ে আছে কয়েকটা বড় কাক। সৌভিক দোতলার বারান্দায় একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল—একটি সাদা ধুতি ও ফিকে নীল শার্ট পরা বৃদ্ধ, যার মুখে সাদা দাড়ি ও পুরু চশমা। “S.H. Basri?” জিজ্ঞেস করতেই লোকটা মাথা নাড়ল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসে সে প্যাকেটটা সৌভিকের হাতে থেকে নিল। কোনও সাইন চাইলো না, কনফার্মেশনও না। শুধুই নিচু গলায় বলল, “তুমি আজ ভুল ঠিকানায় এসেছো… কিন্তু সেটা ভুল না-ও হতে পারে।” কথা শেষ করে প্যাকেটটা নিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির ভিতরে চলে গেল, দরজাটা জোরে বন্ধ করে দিল। সৌভিক কিছুটা বিস্মিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ—কুরিয়ারের নিয়ম অনুযায়ী তো রিসিভার সাইন না দিলে ডেলিভারি কমপ্লিট হয় না, কিন্তু লোকটা এমন ভঙ্গিতে বলল যেন অনেক কিছু সে আগেই জানে। বাইকে চড়ে ফিরে যেতে গিয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করল—তার ব্যাগে তখনও সেই প্যাকেটটা রয়েছে, হুবহু একই, শুধু গায়ে এবার একটা ছাপ যুক্ত হয়েছে: “Don’t deliver unless asked again”—কালো কালিতে ছাপা, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন লেখা গুলো ঘোলাটে হয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।

কুরিয়ার হাবে ফিরে এসে সৌভিক সুপারভাইজার রবিনকে সবটা খুলে বলল। রবিন প্রথমে হেসে উড়িয়ে দিল, “তুই বেশি হরর সিনেমা দেখিস বোধহয়! প্যাকেট বদলায়! আবার নিজে থেকেই লেখা আসে! ঘোর কাট, ঘোর কাট।” সৌভিকও প্রথমে নিজেকে মনের ভুল বলেই ভেবেছিল, কিন্তু রাতে বাড়ি ফিরে সেই প্যাকেটটাই আবার নিজের ব্যাগের পাশে পড়ে থাকতে দেখে তার মাথা ঘুরে গেল। এবার আর চামড়ার ঘ্রাণ নয়—এবার ব্যাগের ভেতর থেকে যেন হাড় পোড়া, ধোঁয়ার মত গন্ধ আসছিল। ভয় আর কৌতূহল মিলিয়ে সে প্যাকেটটা খুলল। ভিতরে ছিল একজোড়া চামড়ার দস্তানা—পুরনো, ফেটে যাওয়া, কিন্তু রঙটা অদ্ভুত রকমের গাঢ়। সৌভিক একটিবারের জন্য সেই দস্তানাগুলো হাতে পড়ল—মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। হঠাৎ করেই তার চারপাশের আলো নিভে গেল, আর ঘরের আয়নায় সে দেখতে পেল, পেছনে এক ছায়া, কালো মুখ, চোখে আগুনের মত আলো—এবং তার নিজের হাতদুটি যেন আর নিজের নয়, বরং সেগুলো দানবীয়ভাবে শক্ত হয়ে গেছে, নখগুলো লম্বা ও তীক্ষ্ণ। সে আতঙ্কে দস্তানা খুলে ছুঁড়ে দিল মেঝেতে, আর পরমুহূর্তেই সব কিছু আবার স্বাভাবিক। আয়নায় কেবল নিজের ক্লান্ত মুখ, আর মেঝেতে পড়ে থাকা সেই চামড়ার হাতজোড়া। কিন্তু সেই রাতেই পাশের ফ্ল্যাটের বৃদ্ধ রামচরণ মজুমদার রহস্যজনকভাবে মারা যান—ডাক্তার জানালেন, “শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু, গলার চারপাশে চিহ্ন ছিল, কিন্তু কেউ ছোঁয়নি”—আর সৌভিক জানে, আগের রাতে তার জানালার পাশ দিয়ে সেই বৃদ্ধ হেঁটে যাচ্ছিল, আর সে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল, পরনে সেই দস্তানা।

২:

পরদিন সকালটা যেন কোনোভাবেই স্বাভাবিক হয়ে উঠছিল না সৌভিকের কাছে। মাথার ভিতর যেন একটা গুঞ্জন চলছে—রাতে যে ঘটনা ঘটেছে, তা কি নিছক কাকতালীয়? বৃদ্ধ রামচরণবাবুর মৃত্যু কি স্বাভাবিক, নাকি সত্যিই তার অজান্তে তার হাত… না, দস্তানার হাতেই…? হাজার প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল, কিন্তু জবাবের একটা ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাচ্ছিল না সে। তখনই মনে পড়ল, স্কুলজীবনে একবার সে মেটিয়াবুরুজের এক পুরনো জুতোর দোকানে গিয়েছিল, যেখানে বৃদ্ধ এক মুচি কাকু, সবাই যাকে “জয়নাল কাকা” বলে ডাকত, নাকি আজও সেই পুরনো স্টাইলেই জুতো তৈরি করেন, পুরনো চামড়ার গন্ধে ঘেরা দোকানে বসে। চামড়ার দস্তানা, তার অদ্ভুত গন্ধ, অস্বাভাবিক ওজন—এসব কিছু জয়নাল কাকা বুঝতে পারেন কি না, এই আশায় সে দোকানটা খুঁজে বের করল, পুরনো গোল বাজারের দিকটায়, এক ভাঙাচোরা চায়ের দোকান পেরিয়ে বাঁদিকে মোড় ঘুরে।

দোকানটা ঠিক যেমনটা মনে ছিল, তেমনই—ছোট, কাঠের পাটাতনের ওপর রাখা কিছু পুরনো চামড়ার টুকরো, সেলাই মেশিন, পুরনো স্টিলের পেটিকেস, আর মাথার উপর ঝোলানো হলুদ আলো। ভিতরে বসে আছেন জয়নাল কাকা—চামড়ার মতই কুঁচকে যাওয়া মুখ, পাতলা চুল, আর চোখে গোল ফ্রেমের চশমা। সৌভিক দস্তানাগুলো হাতে তুলে দেখাল, আর বলল, “কাকা, একটু দেখবেন এগুলো? কী চামড়া, কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে…” কাকা প্রথমে নীরব ছিলেন, তারপর চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলেন অনেকক্ষণ, যেন কোনও পুরনো স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে গেছেন। ধীরে ধীরে বললেন, “তুই এটা কোথায় পেলি, বাপ?” সৌভিক ঘটনাটা গোপন না রেখে খুলে বলল সব—কুরিয়ারে ভুল ঠিকানা, প্যাকেট ফেরত আসা, আর রাতে দস্তানা পরে দেখা দানবীয় প্রতিচ্ছবি। কাকা চুপ করে শুনলেন, তারপর ধীরে ধীরে বললেন, “এই দস্তানা আমি একবার দেখেছিলাম, আজ থেকে অনেক বছর আগে। আমার বাবা বলত, ব্রিটিশ আমলে এক ঠিকা শ্রমিক ছিল, নাম ছিল হাশিম আলী। লোকটা রাতে খুন করত, কিন্তু কেউ প্রমাণ পেত না—কারণ, তার হাতে ছিল ‘কালো জোড়া’, একজোড়া দস্তানা, যার স্পর্শ ছাড়াও সে কাউকে হত্যা করতে পারত। শুনেছি সেই চামড়াগুলো তৈরি হয়েছিল মৃত মানুষের চামড়া দিয়ে। অভিশপ্ত বলত সবাই, ব্রিটিশরাও ভয় পেত।”

সৌভিকের শরীরটা যেন হিম হয়ে গেল, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল নিচে। জয়নাল কাকা মাথা নাড়লেন, “আমি জানি না তুই এটা কোথা থেকে পেয়েছিস, কিন্তু এটা রক্ত খায়। যে পরবে, সে বুঝবেও না—তার হাত দিয়েই সে খুন করবে, অথচ সে নিজেই জানবে না সে খুনি। এটা কুড়িয়ে পাওয়ার জিনিস না রে, এটা খুঁজে নিজেকে ছাড়াতে হয়।” সৌভিক ভয় পেয়েও যেন অদ্ভুতভাবে উৎসাহিত বোধ করছিল—এতো বছর ধরে তার নিরাসক্ত, একঘেয়ে জীবন, একদিনেই যেন এক রহস্যময় কাহিনির কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে। কাকা বললেন, “তুই যদি বাঁচতে চাস, তাহলে কারও সাহায্য লাগবে, এমন একজন, যে ইতিহাস জানে, অতীত পড়ে, দৃষ্টিভঙ্গি খুলতে পারে। নায়াবাগান লাইব্রেরিতে এক মেয়ের কথা শুনেছি—নাবিলা রহমান, ইতিহাস পড়ে, আর এমন সব রহস্য নিয়ে পড়াশোনা করে। তার সঙ্গে দেখা কর।” দোকানের বাইরে বেরিয়ে এসে সৌভিক শেষবার পেছনে তাকিয়ে দেখল, জয়নাল কাকা মাথা নিচু করে আবার সেই পুরনো চামড়া সেলাই করছেন, যেন একটা অতীত যুগের প্রেত হয়ে বেঁচে আছেন শুধুই স্মৃতি আর গন্ধে।

৩:

নায়াবাগান লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে সৌভিক একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। বাইরের থেকে দেখতে এই লাইব্রেরিটা মোটেও রহস্যে ভরা কোনও স্থানের মতো মনে হয় না—বরং পুরনো দিনের কাঠের জানালা, লোহার গেট, আর একপাশে বিবর্ণ নেমপ্লেট: “নায়াবাগান পাবলিক লাইব্রেরি, প্রতিষ্ঠিত ১৯০২।” অথচ ভেতরে এক গভীর নীরবতা ও ইতিহাসের স্তর জমে আছে, যেন প্রতিটি বুকশেলফের মাঝখানে একেকটা মৃত কাহিনির কঙ্কাল লুকিয়ে। দরজায় ঘণ্টা বাজাতেই একজন মহিলা দরজা খুললেন। বয়স বেশি নয়—চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, মুখে নির্লিপ্ত এক অভিব্যক্তি, আর গলায় লাল স্কার্ফ। “আপনি নাবিলা রহমান?” প্রশ্নটা শুনেই তিনি কিছুটা অবাক হলেও মাথা নাড়লেন। সৌভিক নিজের পরিচয় দিয়ে বলল, “আমি একটা ব্যাপারে সাহায্য চাই… কিছু অদ্ভুত জিনিস নিয়ে… ইতিহাস, খুন, আর একটা পুরনো দস্তানা।” কথাটুকু বলতেই নাবিলার চোখে এক ঝলক আগ্রহ ফুটে উঠল। “ভেতরে আসুন,” বলে তিনি দরজাটা খুলে দিলেন। ঘরটা ছিল বইয়ে ভর্তি, কিন্তু দেয়ালের একপাশে ঝুলছিল একটি বিশাল ম্যাপ—পুরনো কলকাতা শহরের, ১৮৫৬ সালের, যেখানে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত ছিল মেটিয়াবুরুজ, লালবাজার, টালিগঞ্জ, আর আরও কিছু ‘অপ্রয়োজনীয়’ জায়গা, যেগুলো শহরের মূল স্রোত থেকে সরে গেছে বহু আগেই।

সৌভিক দস্তানার গল্প খুলে বলতেই, নাবিলা একটু থেমে গেলেন, তারপর ধীরে ধীরে কিছু বই টেনে বের করতে লাগলেন। “তুমি জানো, ব্রিটিশ আমলে কলকাতায় একটা ছায়া চরিত্রের গল্প চালু ছিল—‘The Man with the Black Hands’ নামে। এমনকি ১৮৮৫ সালে ‘Calcutta Gazette’ এ তার নাম উঠে আসে। ব্রিটিশ পুলিশ বলেছিল, ‘ভিক্টিমদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু শরীরে কোনও বাহ্যিক আঘাতের চিহ্ন নেই।’ আর সবার গলা ঘিরে থাকত ছাপ—চামড়ার গ্লাভসের মতো চাপের দাগ।” তিনি একটি হলুদ হয়ে যাওয়া পত্রিকা দেখালেন, যেখানে একটি ছোট প্রতিবেদন: “Another merchant found dead in Metiabruz. Police suspect strangulation. Locals whisper the return of ‘Kala Hath’.” নাবিলা বললেন, “তুমি যা বলছো, সেটা এই কাহিনিরই আধুনিক ছায়া হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে—তুমি কেন? কেন তুমি সেই দস্তানা হাতে পেলে?” সৌভিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ভুল ডেলিভারি, বলা হয়েছিল ‘S.H. Basri’—কিন্তু এমন কেউ নেই ও ঠিকানায়।” নামটা শুনেই নাবিলা চমকে উঠলেন। “S.H. Basri? That’s not a person—it’s a code. পুরনো ব্রিটিশ রেকর্ডে ‘Basri’ ছিল এক ধরনের কোড, যারা ব্যতিক্রমী মানুষজন নিয়ে কাজ করত—Occult tracking division, British India Secret Registry।”

ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ ভারী হয়ে এল। বাইরে হালকা বৃষ্টি পড়ছে, জানালার কাঁচে বিন্দু বিন্দু জল জমে মুছে যাচ্ছে। নাবিলা বললেন, “এই দস্তানা কোনও জিনিস নয়, এটা একটা মাধ্যম। এটা বেছে নেয়। এবং তুমি হয় তার বাহক, না হয় তার শিকার। তুমি যদি সত্যিই বুঝতে চাও এটা কী, তবে আমাদের যেতে হবে পুরনো রেকর্ড রুমে—কলকাতা হাই কোর্টের নিচে, যেখানে ব্রিটিশ আমলের ফৌজদারি ফাইল জমা পড়ে আছে আজও। এমন অনেক নাম মুছে গেছে ইতিহাস থেকে, কিন্তু দস্তানা তাদের ভুলতে দেয় না।” সৌভিক বোঝে, সে এমন এক যাত্রায় পা রেখেছে, যার গন্তব্য কোনো বস্তু নয়, বরং নিজেকে বাঁচানোর লড়াই, না-হলে হয়তো তাকে দিয়ে আরও কোনও নিরীহ মানুষকে মেরে ফেলা হবে। দুজনে ঠিক করল, পরদিন ভোরেই বেরোতে হবে রেকর্ড রুমের উদ্দেশ্যে—অতীতের ছায়ার পিছু নিতে, যেখানে হয়ত ধরা দেবে ‘কালো হাতে’র শেষ চিহ্ন, কিংবা তার ফিরে আসার নিদান।

৪:

সকাল সাতটা। কলকাতা হাই কোর্টের পেছনের গেট দিয়ে ঢোকার সময় সৌভিকের বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক চেপে ধরা অনুভূতি হচ্ছিল। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছিল হালকা করে, আর শহরের প্রাচীন গথিক স্থাপত্যের ছায়া যেন আরও গাঢ় লাগছিল ওই স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায়। নাবিলা আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে রেখেছিল—তার লাইব্রেরি রিসার্চার আইডেন্টিটিই ছিল প্রবেশপত্র। দুজনে ঢুকে পড়ল নিচের একটি পুরনো সিঁড়ি দিয়ে, যা আদালতের মূল ভবনের নিচতলার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছে দেয় আর্কাইভ রুমে। এই রুমটি জনসাধারণের জন্য খোলা নয়, বরং গবেষক, ইতিহাসবিদ বা তদন্ত সংস্থার অনুমোদিত কিছু মানুষ ছাড়া এই জায়গায় প্রবেশের অনুমতি মেলে না। সৌভিক চারদিকে তাকিয়ে দেখল—পাথরের দেয়াল, লোহার র‍্যাক, পোকায় কাটা পুরনো কাগজের গন্ধে ভরা কক্ষ, আর একপাশে একমাত্র আলো হিসেবে একটি ফ্লুরোসেন্ট টিউব। রক্ষক, একজন বৃদ্ধ লোক, নাম তার কেষ্টবাবু, কপালে তিনটি ভাঁজ নিয়ে বললেন, “১৮৮৫ সালের রেকর্ড খুঁজছেন বললেন তো? Hmm… সেটা হবে 3B শেলফে, ‘Unsolved’ ট্যাগের ফোল্ডার গুলোয়। সেদিকে আজকাল কেউ যায় না।”

তারা যখন পুরনো কেসফাইল ঘাঁটতে লাগল, হঠাৎই নাবিলা একটিতে আঙুল দিয়ে থামাল। ফাইলে লেখা ছিল: Case No. 1885/22 – “Unknown assailant, serial deaths, Metiabruz sector.” ভিতরে থাকা রিপোর্টে লেখা ছিল ব্রিটিশ পুলিশ আধিকারিক এডওয়ার্ড হেইসের বক্তব্য—“Victims found with bruises consistent with strangulation. No signs of forced entry. Locals attribute killings to folklore: ‘Kala Hath.’” এই রিপোর্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল একটি হাতে আঁকা চিত্র—একজন লোক, যার মুখ অস্পষ্ট, কিন্তু হাতে স্পষ্টভাবে কালো দস্তানা। পাশাপাশি নোটে লেখা: “Item recovered: One pair of gloves, material unknown, sent to Calcutta Forensic Lab. Evidence never returned.” সৌভিক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ছবিটার দিকে—চিত্রটা যেন তারই হাতে থাকা সেই দস্তানার ছায়া! নাবিলা চোখ নামিয়ে বলল, “দেখেছো, প্রমাণ ছিল, কিন্তু সেটা ফিরল না। তার মানে হয় এটাকে গোপন করা হয়েছিল, নয়তো এটা হারায়নি, বরং কারও হেফাজতে থেকে গেছে—কারও, যে জানে এর ক্ষমতা।”

তারা যখন আরও খোঁজ করছিল, তখন এক পুরনো চিঠির খাম হাতে আসে, যার গায়ে লেখা: To Officer E. Hayes — confidential — do not open unless instructed by Basri Office. চিঠিটা খুলতেই তার ভিতরে এক অদ্ভুত ছবি পাওয়া যায়—একটা রক্তে ভেজা দস্তানা, পাশে লেখা: “It chooses its bearer. And it does not stop unless fed.” এইবার নাবিলা ফিসফিস করে বলল, “তুমি কি বুঝতে পারছো? দস্তানাটা যেন কোনও সাধারণ অভিশপ্ত বস্তু নয়—এটা যেন এক অদৃশ্য সত্তা, যেটা শরীর না, বাহক খোঁজে। আর তুই সেই বাহক হয়ে উঠেছিস।” ঠিক তখনই রুমের বাতি একবার নিভে গেল। শীতল হাওয়া বইল চারদিক থেকে, আর সৌভিক অনুভব করল, তার ব্যাগের ভিতর দস্তানাটা যেন নড়ছে, কেঁপে উঠছে—জীবন্ত কোনও প্রাণীর মতো। কেষ্টবাবু বাইরে থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, “বেরিয়ে আসুন, আলো যাচ্ছে পুরো ভবনে! আর্কাইভ লকডাউন হবে!” দুজনে তাড়াতাড়ি সব কিছু তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল, কিন্তু তাদের সঙ্গে তখন কেবল তথ্য নয়, বরং ইতিহাসের গর্ভ থেকে বেরিয়ে আসা এক অদৃশ্য ভয় তাদের পিছু নিচ্ছে। নাবিলা গাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, “এই দস্তানা এখন আর পুরনো অস্ত্র নয়, এটা আবার সক্রিয়। আর তার পরবর্তী শিকার কে, সেটা সে-ই ঠিক করবে।”

৫:

কলকাতার গ্রীষ্মকালীন রাতগুলো শহরের চেনা ছায়াগুলোকেও অচেনা করে তোলে—রাস্তার আলো ঝিমোয়, ছাদে ঝুলে থাকা পোশাকের ছায়া জানালায় নড়ে, আর স্যাঁতসেঁতে বাতাসে শব্দগুলো কেমন বিকৃত হয়ে শোনায়। এমন এক রাতে, নিজের একতলা ভাড়া বাড়ির ঘরে বসে সৌভিক দস্তানার দিকে তাকিয়ে ছিল—টেবিলের উপর রাখা, যেন নিজের ইচ্ছাতেই পড়ে থাকা। এখন আর সেটা নিছক জিনিস বলে মনে হয় না, বরং একটা জীবন্ত কিছু, অপেক্ষায় আছে পরবর্তী কোনও আদেশের। গত ক’দিনে তিনজন মানুষ রহস্যজনকভাবে মারা গেছে—প্রথমে পাশের ফ্ল্যাটের রামচরণ মজুমদার, তারপর সেই পিওন যার সাথে সৌভিক ঝগড়া করেছিল কুরিয়ারে, আর তৃতীয় জন, এক পথশিশু যে সৌভিকের বাইকের পেছনের টুলে হাত রেখেছিল হঠাৎ। প্রতিটা মৃত্যুই যেন তাকে ঘিরে—ঠিক তখনই হয়েছে, যখন সে পরেছিল বা কাছে রেখেছিল সেই অভিশপ্ত দস্তানাগুলো। পুলিশ সন্দেহ করছে না ঠিকই, কিন্তু ইনস্পেক্টর প্রবীর মৈত্র একবার এসে বলেই গেছেন, “আপনি কুরিয়ার কর্মী তো? তিনজন মৃত মানুষ কিন্তু আপনার রুটের আশেপাশে ছিল, মিস্টার ঘোষ। সাবধানে থাকবেন।”

নাবিলা প্রতিদিন ফোনে যোগাযোগ রাখছে, এবং স্পষ্টভাবে জানিয়েছে—“তুমি যতক্ষণ এই দস্তানাটা রাখবে, মৃত্যুর শিকার হবে নিরীহ লোকজন। এটা তোমাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছে—তুমি ভাবছো তুমি কিছু করছো না, কিন্তু ওর স্পর্শে, তুমি হয়ে যাচ্ছো তার হাত।” অথচ সৌভিক নিজেই জানে না—সে খুন করছে কি না। প্রতিটা রাতে ঘুম ভেঙে যায়, শরীরে ঘাম, দম আটকে আসা অনুভব, আর মাঝে মাঝে হাতে জ্বালা—যেন কেউ ভেতর থেকে চামড়া ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। একদিন রাতে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চোখে দেখল—সে ঘুমোচ্ছে না, অথচ হাত উঠে যাচ্ছে নিজে থেকে, আঙুলের ডগায় কালচে ছাপ, আর চামড়া যেন লোহার মতো শক্ত। সে বুঝতে পারছে, নিজের শরীরের ওপর তার আর নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। দস্তানাগুলো যতদিন তার কাছেই থাকবে, ততদিন সে কেবল বাহক নয়—একটা প্রাণঘাতী অস্ত্র, যার হ্যান্ডেল সে নিজে না, কেউ বা কিছু অন্য। একরাতে হঠাৎ দরজায় শব্দ হয়, সে খুলে দেখে, কুরিয়ার অফিস থেকে রবিন দাঁড়িয়ে, হাতে কিছু কাগজ—“তুই ঠিক আছিস তো? আজকাল তোকে খুব অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তুই কি ঠিকঠাক খাচ্ছিস, ঘুমাচ্ছিস?” সৌভিক কোনও উত্তর দেয় না, শুধু চেয়ে থাকে ওর দিকে—কিন্তু রবিন কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, “তোর চোখ… ওরে বাবা, তোর চোখে ওইরকম আলো আসছে কেন?” এবং সেই মুহূর্তে সৌভিক বুঝে যায়—দস্তানা সে পরেনি, তবু এটা এখন ওর ভিতরে ঢুকে পড়েছে।

পরদিন সকালে রবিনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়—ঘাড় মচকে যাওয়া, চোখ খোলা, মুখে আতঙ্কের ছাপ। পুলিশের রিপোর্টে আবারও সেই চিহ্ন—“No signs of assault. Strangulation marks consistent with unseen pressure.” এবার ইনস্পেক্টর প্রবীর সরাসরি সৌভিকের কাছে এসে বলে, “তোমার আশেপাশে কিছু তো হচ্ছে, মিস্টার ঘোষ। তুমি চাইলে আমায় বলো, নইলে আমি নিজেই খুঁজে বের করব।” কিন্তু সৌভিক তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—এবার পালাতে হবে। এই দস্তানার হাত থেকে না হয় নিজের হাত থেকেই। সে ফোন করে নাবিলাকে জানায়, “তুমি বলেছিলে, এটা বেছে নেয়। এবার আমি এটা ছাড়তে চাই। কোথাও নিয়ে যেতে হবে, যেখানে এটা আর কাউকে ছুঁতে পারবে না।” নাবিলা একটিই কথা বলে, “তাহলে প্রস্তুত হও। আমাদের যেতে হবে সেই জায়গায়, যেখানে এটা তৈরি হয়েছিল। যেখানে প্রথম রক্ত ঝরেছিল। পুরনো কসাইখানার ধ্বংসস্তূপে—মেটিয়াবুরুজের সেই জায়গায়, যেখানে ‘কালো হাতে’র অভিশাপ শুরু হয়েছিল।”

৬:

মেটিয়াবুরুজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ঘেঁষে যে পুরনো খালের ধারে এক সময় কসাইখানা ছিল, এখন সেখানে কেবল ধ্বংসস্তূপ, কচুরিপানায় ঢেকে থাকা জলের গর্ত আর চুন-সাদা পাথরের ভাঙা স্তম্ভ। গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে কিছু ধূসর দেয়াল দেখা যায়, যেগুলো এখন কেবল বটগাছের শিকড়ে মোড়া। সৌভিক আর নাবিলা ঠিক সকালবেলায় পৌঁছায় সেই জায়গায়, বাইকের জ্বালানি ফুরিয়ে যাবার আগে। কুয়াশায় ভেজা জায়গাটা দেখে প্রথমেই মনে হয়, কিছু একটা এখানে অপেক্ষা করছে—কোনও মানুষ নয়, কোনও ইচ্ছা। নাবিলা বলল, “এই জায়গায় এক সময় ছিল হাশিম আলীর কর্মক্ষেত্র—‘বসরি অ্যান্ড সন্স কসাইখানা’, যেখানে গরু কাটা হতো, আর শোনা যায় প্রথম হত্যাটা এখানেই হয়েছিল, একটা অমানবিক রাগের ঘূর্ণিতে।” সৌভিক পেছনে তাকিয়ে বলল, “তুমি বিশ্বাস করো, এই দস্তানাটা এখনও ‘ওর’ সঙ্গে যুক্ত?” নাবিলা মাথা হেঁট করে বলল, “বিশ্বাস না করলেও এটা ঘটছে। এটাই বাস্তব।” এরপর তারা দুজনে একসাথে প্রবেশ করল কসাইখানার ভিতরের দিকে, ভাঙা দরজা ঠেলে। ভিতরে একটা সিঁড়ি দেখা গেল, যেটা নিচের গুদামঘরের দিকে যায়। সেখানে ঢুকতেই অনুভব হল, তাপমাত্রা যেন হঠাৎ কমে গেল, নিঃশ্বাস জমাট বাঁধে, বাতাসে ভাসে পুরনো রক্তের গন্ধ।

গুদামঘরের একপাশে কয়েকটি কাঠের বাক্সে পুরনো সরঞ্জাম পড়ে ছিল—ধারালো ছুরি, লোহার শিক, আর কিছু চামড়ার টুকরো। এক কোণে মাটির নিচে একটা অদ্ভুত চিহ্ন দেখা গেল—দু’টো উলটো হাতের ছাপ, যেন পাথরের ভিতরেই ঢুকে গেছে। নাবিলা হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “এখানেই দস্তানাগুলো শেষবার রাখার কথা ছিল। এখানে ব্রিটিশরা এক তান্ত্রিককে দিয়ে এগুলো নষ্ট করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়, কারণ যারা এই দস্তানা বানিয়েছিল, তারা প্রাণের বিনিময়ে বানিয়েছিল। এটাই ছিল তাদের অভিশাপের কারখানা।” হঠাৎই বাতি নিভে গেল—যেটুকু আলো ছিল, তা-ও অদৃশ্য। অন্ধকারে সৌভিক অনুভব করল, তার ব্যাগের ভিতর দস্তানাগুলো যেন নড়ে উঠেছে—এবার আর ধাতব শব্দ নয়, বরং মানুষের নিঃশ্বাসের মতো একটা আওয়াজ। সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে দস্তানাগুলো বার করল। তখনই চারপাশের দেয়াল যেন কেঁপে উঠল, আর এক বিকট গর্জনের মতো আওয়াজ শোনা গেল—“তুই আমার বাহক, আমাকে পূর্ণ কর।” সৌভিক কাঁপা হাতে দস্তানাগুলো তুলে নিল, এবার শেষবারের মতো। গায়ে পরতেই শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল, চোখের সামনে অন্ধকারের ভেতর এক ছায়ামূর্তি জেগে উঠল—এক খোলা বুক, কালো মুখ, আর হাতে সেই একই দস্তানা। নাবিলা চেঁচিয়ে উঠল, “এটাই ‘কালো হাতে’—এটাই সেই আত্মা, যে দস্তানার ভিতর বাস করে।”

তখনই সৌভিক অনুভব করল, তার নিজের শরীরের উপর আর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তার হাত উঠে যাচ্ছে, সামনে থাকা নাবিলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ঠিক তখন, নাবিলা নিজের ব্যাগ থেকে এক পুরনো পুঁথির বই বার করল, যার পৃষ্ঠায় লেখা ছিল এক প্রাচীন বন্দনামন্ত্র। সে জোরে পাঠ করতে লাগল সেই শব্দগুলো—“Prān nāhi jey shorīr dhare, tu nash ho chorom andhokāre!” দস্তানাগুলো কাঁপতে লাগল, সৌভিকের হাত থেকেও বিদ্যুৎ ছুটে বেরিয়ে এলো, আর হঠাৎ করে এক চিৎকারে চারপাশ থরথর করে কেঁপে উঠল। ছায়ামূর্তিটা ধীরে ধীরে গলে যেতে লাগল, পাথরের মেঝেতে পড়ে থাকা দস্তানাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেল এক বিকট গন্ধ ছড়িয়ে। সৌভিক মাটিতে পড়ে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কিন্তু ঠিক সময়ে নাবিলা তাকে তুলে ধরল—তার চোখ খুলে গেলে সে দেখল, চারপাশে আবার আলো এসেছে, আর সেই চিহ্ন—উলটো হাতদুটি—এখন আর নেই।

৭:

সেই রাতটার পর তিনদিন কেটে গেছে। মেটিয়াবুরুজে বর্ষা একটু বেশি জাঁকিয়ে বসেছে, চারপাশ কাদা আর বৃষ্টির গন্ধে ঢেকে গেছে, কিন্তু সৌভিকের জীবনে যেন এক অদৃশ্য চাঁদ ওঠে নি। দস্তানাগুলো ছাই হয়ে গেছে—চোখের সামনে পুড়ে মিশে গেছে মাটিতে, ছায়ামূর্তিটাও গলে গিয়েছে প্রাচীন মন্ত্রের ঘূর্ণিতে, তবু তার ভিতরে যেন একটা কাঁপুনি থেকে গিয়েছে। কলকাতার কোলাহল, বাইকের হর্ণ, কুরিয়ারের প্যাকেট—সব কিছু আগের মতো হলেও সৌভিক আগের মতো নয়। রাতে ঘুমোতে গেলে সে এক অদ্ভুত নিঃশ্বাস অনুভব করে ঘাড়ের কাছে, যেন কেউ বা কিছু তার কাছাকাছি আসে, আর আবার হারিয়ে যায়। তার আঙুলের ডগায় মাঝে মাঝে কালচে দাগ পড়ে, সকালে উঠে গলার আশেপাশে লালচে দাগ, অথচ সে কারো সঙ্গে ঝগড়া করে নি, কারো দিকে হাত তোলেও নি। এক রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেল, তার ছায়া নিজে থেকে মাথা ঘোরাচ্ছে, তার না নাড়ানো হাত আয়নায় উঠছে এক সেকেন্ড আগে—এইসব ঘটনার মধ্যে কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছিল না সে। কুরিয়ার হাব-এ গিয়ে কাজ করার সময় লোকেরা পেছনে ফিসফিস করে, “ওই না সেই ছেলেটা… যার ডেলিভারির পরে সবাই মারা যায়?” যদিও পুলিশ বা অফিসিয়ালি কেউ তাকে কিছু বলেনি, তবু সৌভিক জানে—সবাই জানে কিছু একটা এখনও ঠিক নেই।

নাবিলা যতবার ফোন করেছে, ততবার সে বলেছে, “সব শেষ হয়ে গেছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।” কিন্তু একদিন সে নিজেই কল করে বলল, “আজ সকালে আমার লাইব্রেরিতে একটা চিঠি এসেছে। প্রেরক নেই, খাম কালো। ভিতরে একটা একগাছি চুল, আর একটা লেখা—‘You can burn the gloves, not the hand that wore them.’” সৌভিক স্তব্ধ হয়ে যায়। তখনই মনে পড়ে যায় সেই ছায়ামূর্তির শেষ শব্দগুলো—”আমি থামি না, আমি খুঁজে নিই।” সে বুঝতে পারে, দস্তানাগুলো ছিল বাহ্যিক আবরণ, কিন্তু সত্যিকারের অভিশাপ তো সেই আত্মা, সেই প্রতিশোধপরায়ণ সত্তা—যে একসময় হাশিম আলী ছিল, এখন সে কেবল আকৃতি বদলে যাচ্ছে। সে হয়তো এখনও সৌভিকের ভিতরে ঢুকে আছে, কোনো কোষে, কোনো স্পর্শে, কোনো দৃষ্টিতে। একরাতে সৌভিক ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে আবিষ্কার করে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে, হাতে কিছু নেই, কিন্তু সামনে পড়ে থাকা একটি মৃত কুকুরের দেহ দেখে বুঝতে পারে—তার হাতের ছোঁয়া ছাড়াও আজ কিছু হয়েছে।

পরদিন সকালে সৌভিক এক খাম হাতে নাবিলার দরজায় দাঁড়িয়ে। চিঠিটা তার হাতে দিয়ে শুধু বলল, “তুমি লাইব্রেরিতে এই ফাইলটা রাখো। যদি আমি কিছু করি, যদি আমার হাত আবার কারো রক্তে ভিজে যায়—এই ফাইল খুলো, আর সবাইকে জানাও… এটা শুধু দস্তানার গল্প নয়, এটা এমন এক বীজ, যা জন্মায় চুপিচুপি, ছড়ায় হাত থেকে ছায়ায়। অভিশাপ ছাই হয় না।” নাবিলা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার দিকে—সে বোঝে, এই যুদ্ধ শেষ হয়নি। সৌভিক চলে যায় একা—হয়তো অন্য কোনো শহরে, হয়তো নিজের ভিতরের যুদ্ধে নামার জন্য। কিন্তু তার ছায়া তখনো যেন একটু বেশি লম্বা, একটু বেশি বেঁকে যাওয়া, আর রাস্তার বাতির আলোয় তার হাতের আঙুলগুলো ছায়ায় ঝুলে থাকে… চামড়ার মতো ঘন।

৮:

পাঁচ বছর পর। কলকাতার বুকে ততদিনে বদল এসেছে। মেটিয়াবুরুজের পুরনো গলিগুলোতে এখন ছোট ক্যাফে, সিসিটিভি, আর ওলা-স্বিগির ধোঁয়া। কিন্তু শহরের চেহারা যতই পাল্টাক, ছায়া পাল্টায় না—ছায়া শুধু ছায়া খুঁজে ফেরে। দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজাত আবাসনে, এক কিশোর ডেলিভারি নিচ্ছে কুরিয়ার থেকে। ছেলেটির নাম রুদ্রজিত, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। প্যাকেটটা ছোট—কালচে বাদামি, গায়ে কোনও প্রেরকের নাম নেই, শুধু লেখা: “For R.J. Only — Touch to Inherit.” কৌতূহলী হয়ে সে প্যাকেট খুলে দেখে—এক জোড়া দস্তানা, চামড়ার নয়, বরং দেখে মনে হয় কোনো জৈব পদার্থে গঠিত, কিন্তু হালকা চকচকে, ঘন রঙের ছাপ। সে হেসে ফেলে, “ভাই, কে যে আজকাল এত সিরিয়াস প্র্যাঙ্ক পাঠায়…” বলে গ্লাভসটা তুলে নেয় হাতে। কিন্তু গ্লাভস পরার সাথে সাথেই তার চোখের দৃষ্টি ধোঁয়ায় ভরে যায়, আর তার ভিতরে যেন কেঁপে ওঠে পুরনো এক নরকের স্মৃতি। আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে ওঠে—তিনটে ছায়া তার পেছনে, একজন একহাত তুলে হাসছে, চোখে আগুনের মতো আলো। কেউ একজন গলা নিচু করে ফিসফিস করছে, “তুই এখন আমার বাহক… আবার শুরু হোক।”

অন্যদিকে, হিমাচলে এক পাহাড়ি গ্রামে নিঃসঙ্গ সৌভিক ঘর বাঁধা এক কাঠের কুঁড়ে ঘরে। পাঁচ বছর ধরে সে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকেছে, কারো সঙ্গে দেখা করেনি। গাছের নিচে বসে থাকা সে অনুভব করে, তার দেহ এখন অনেক শান্ত, অনেক স্থির। তবে সেই শান্তি একদিনে আসেনি—প্রতি রাতের আতঙ্ক, প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে মনে হওয়া, এখনও কিছু রয়ে গেছে শরীরে, তাকে গ্রাস করবে। কিন্তু আজ বহুদিন পর প্রথম সে স্বপ্ন দেখে না। সকালে উঠে খাম পায় দরজায়—একই রকম পুরনো চামড়ার খাম, শুধু লেখা: “It has found another. You’re not free. You’re the Witness.” তার মুখ শক্ত হয়ে যায়। এবার সে বোঝে, লড়াইটা নিজের জন্য না, আরেকজনের জন্য। আবার নামতে হবে, আবার ফিরতে হবে শহরের বুকে, ছায়ার ঠিক পাশে।

নায়াবাগান লাইব্রেরির পুরনো ঘরে নাবিলা এখনও অপেক্ষা করে। তার টেবিলের ওপর সেই পাঁচ বছর আগের ফাইল—”S.H. Basri: The Leather Curse” এখন একটি সম্পূর্ণ অধ্যয়ন। কিন্তু ফাইলটা হঠাৎ নিজের থেকে খোলা পড়ে যায়, যেন বাতাস নয়, কারো হাত লাগল। ভিতরে নতুন এক পৃষ্ঠা, লাল কালি দিয়ে লেখা: “The Glove is no longer an object. It is a will. And a will never dies.” নাবিলা বুঝতে পারে—সব জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও কিছু অভিশাপ কখনও শেষ হয় না, বরং বাহক পাল্টায়, ইতিহাসের পাতায় নতুন ছাপ ফেলে।

এভাবেই ‘চামড়ার হাতজোড়া’ আবার নতুন করে রক্তে রঙিন হয়—নতুন হাত, নতুন শহর, নতুন মৃত্যু। আর দূরে পাহাড়ের পাথরের গায়ে বসে, সৌভিক চোখ বন্ধ করে শুধুই ফিসফিস করে, “শেষ নয়… শুধু পর্বত পরিবর্তন।”

শেষ

1000036407.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *