Bangla - কল্পবিজ্ঞান

চাঁদের সোনার খনি

Spread the love

রণজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


পর্ব ১ : যাত্রার ডাক

অভিজিৎ গ্রামের মাটির উঠোনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। শরৎকালের আকাশ—নীল, স্বচ্ছ, তারার মেলা সাজিয়ে রেখেছে। চাঁদটা যেন হাতের নাগালে ঝুলে আছে, অথচ কত দূরে, কত অচেনা। জীবনে কখনও ভাবে নি যে তাকে ওখানে যেতে হবে। সে ছিল একেবারেই সাধারণ ছেলে—পিতা ছিলেন ক্ষেতমজুর, মা চাষের ধান বেঁধে ঘরে আনতেন, সে নিজে কখনও কখনও ইলেকট্রিকের কাজ করত, কখনও বাজারে খালাসির। শহরে কাজের খোঁজে যাওয়া হয়নি, কারণ সংসার ছেড়ে যাওয়া তার পক্ষে সহজ ছিল না।

কিন্তু একদিন ডাক এলো—আন্তর্জাতিক মহাকাশ খনি সংস্থা, নাম লুনার মাইনিং কর্পোরেশন, নতুন শ্রমিক নিয়োগ করছে। প্রথমে কেউ বিশ্বাসই করতে পারল না। গ্রামে এত লোক, অথচ বেছে নিল এই অভিজিৎকেই। তার নাম কোথায় যেন নথিভুক্ত হয়েছিল—একটা পুরোনো বৃত্তিমূলক পরীক্ষার ফর্মে। সে জানতও না যে তার নাম চূড়ান্ত তালিকায় থেকে গেছে। কাগজে সই করার আগেই একদিন কালো রঙের গাড়ি এসে দাঁড়াল গ্রামের রাস্তার ধুলোয়। দু’জন অফিসার নেমে এলেন, গায়ে নীল ইউনিফর্ম, হাতে ল্যাপটপ। তারা জানালেন, নির্বাচিত প্রার্থীদের মধ্যে অভিজিৎও আছে।

মা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। “ওরা তোকে কোথায় নিয়ে যাবে রে? চাঁদে গিয়ে আবার ফিরে আসবি তো?”—চোখ ভিজে উঠল তার। পিতা চুপচাপ বিড়ি ধরালেন, কিছু বললেন না। অভিজিৎ নিজেও দ্বিধায় ছিল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে এক অদ্ভুত টান তাকে টেনে নিচ্ছিল। চাঁদ মানে শুধু আকাশের আলোর দাগ নয়—এখন ওটা কাজ, টাকা, ভবিষ্যৎ। এতদিনের দারিদ্র্য হয়তো একটু হলেও কেটে যাবে।

গ্রাম তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু করল। কারও চোখে হিংসে, কারও চোখে ভয়। অনেকে বলল, এ তো অভিশাপ—মানুষকে পশুর মতো খাটাতে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ ফিসফিস করে বলল, ভাগ্যিস বাছা, তুই ভাগ্যবান—আকাশ ছুঁয়ে দেখতে পাবি।

দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। কলকাতায় আগে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখান থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে, তারপর বিশেষ মহাকাশযানে। সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো এগোতে লাগল।

বিদায়ের আগের রাতে গ্রামের পুকুরপাড়ে বসেছিল অভিজিৎ। চারপাশে জোনাকি ভেসে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, এই মাটির গন্ধ, এই জোনাকির আলো হয়তো সে আর দেখতে পাবে না। বুকের ভেতর একটা চাপা কষ্ট জমল, কিন্তু সে কারও কাছে প্রকাশ করল না।

সকালে বেরোনোর সময় মা কপালে সিঁদুর মাখানো হাত ঠেকিয়ে দিলেন ছেলের মাথায়। বললেন—
“যেখানে যাচ্ছিস, ভালো হয়ে যা। কিছু হোক, মাটির কথা ভুলে যাস না।”

অভিজিৎ গলায় শুকনো স্বর নিয়ে উত্তর দিল—
“আসব মা, ফিরে আসব।”

কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে জানত, চাঁদের যাত্রা থেকে ফেরা সহজ নয়।

 

কলকাতায় প্রথম পৌঁছে সে হতবাক হয়ে গেল। বিশাল এয়ারপোর্ট, উড়োজাহাজের গর্জন, কাচের দেওয়াল, যান্ত্রিক গেট—গ্রামের ছেলে অভিজিৎ যেন অন্য জগতে এসে পড়েছে। সংস্থার লোকজন তাকে নিয়ে গেল নির্দিষ্ট ক্যাম্পে, যেখানে আরও বিশজন শ্রমিক ছিল। কেউ কেরালা থেকে, কেউ বিহার থেকে, কেউ আবার রাশিয়া আর আফ্রিকা থেকে এসেছে। সবাইকে নতুন পোশাক দেওয়া হলো, নীল রঙের স্যুটে প্রত্যেককে একইরকম লাগছে।

ওখানেই প্রথম পরিচয় হলো এক মহিলার সাথে—তার নাম ইরিনা। রাশিয়ান ভূতত্ত্ববিদ, চশমার ভেতর দিয়ে তীক্ষ্ণ চোখ, সবসময় নোটবুক হাতে। অভিজিৎ বুঝল, ওরা সবাই শুধু শ্রমিক নয়, কেউ কেউ বিজ্ঞানীও এসেছে। কিন্তু কেন বিজ্ঞানীরা খনির কাজে নামছে, সেটা এখনো রহস্য।

প্রশিক্ষণের সময় দেওয়া হলো বিশেষ মাস্ক, হেলমেট, ওজনহীনতার অনুশীলন। প্রথমবার যখন অভিজিৎকে ঝুলন্ত চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হলো, শরীর ভেসে উঠল। আতঙ্কে সে হাত-পা ছুঁড়ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে শিখল কিভাবে বাতাসে সাঁতরে চলতে হয়। অন্যরা হাসছিল, কিন্তু ইরিনা নিঃশব্দে দেখছিল তাকে।

রাতের বেলায় ডরমিটরিতে শুয়ে থাকলে জানালার বাইরে দেখা যেত আকাশের বিশাল আলোকিত পথ—মহাকাশযাত্রার সিমুলেশন ভিডিও। অভিজিৎ জানত, আসল যাত্রা শুরু হবে শিগগিরই। কিন্তু তার ঘুম আসত না। বারবার মায়ের মুখ, গ্রামের মাঠ, বন্ধুদের সঙ্গে খেলার দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠত।

 

অবশেষে সেই দিন এল। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও ভিড় করল উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে। উল্কাপিণ্ডের মতো বিশাল মহাকাশযান দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে লাল আলো, ধোঁয়া আর উত্তেজনা। শ্রমিকরা সারিবদ্ধভাবে ঢুকছে ভেতরে। অভিজিৎও গাম্ভীর্যের সঙ্গে সেই সারিতে পা বাড়াল।

পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল কয়েকজন গ্রাম থেকে আসা মানুষ। মা আসতে পারেননি, শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পিতার চোখ সে স্পষ্ট দেখল—কোনও আবেগ নেই, শুধু এক দীর্ঘশ্বাস।

যখন যানের দরজা বন্ধ হলো, হঠাৎ অভিজিৎ কানে এক অদ্ভুত সুর শুনল। যেন দূর থেকে কেউ ডাকছে—মৃদু, সোনালি ঝংকারের মতো সুর। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, কিন্তু আশেপাশে শুধু লোহার দেওয়াল। সুরটা মিলিয়ে গেল মুহূর্তেই।

“শুনলে?” ইরিনার কণ্ঠস্বর কানে এল। সে তাকিয়ে দেখল, মহিলা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে।
“কি?”
“একটা শব্দ… এক ধরনের গান।”

অভিজিৎ চমকে উঠল। তাহলে শুধু সে নয়, আর কেউও শুনেছে?

 

মহাকাশযানের ইঞ্জিন গর্জে উঠল। সারা দুনিয়া নিঃশ্বাস আটকে দেখল মানুষদের চাঁদের পথে রওনা হতে। আর সেই যাত্রার শুরুতেই অভিজিৎ টের পেল—এটা শুধু খনির কাজ নয়, এর ভিতর লুকিয়ে আছে আরও কিছু, এক রহস্য, যেটা তাকে ডাকছে।

পর্ব ২ : মহাকাশযাত্রা

 

মহাকাশযানের ভেতর ঢোকার পর অভিজিৎ যেন এক নতুন দুনিয়ায় পা রাখল। সাদা আলোয় মোড়া করিডর, চারদিকে ধাতব দেওয়াল, আর মৃদু গুঞ্জনের মতো যন্ত্রের শব্দ। যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট কেবিনে তাকে বসতে বলা হলো। একে একে সবাইকে সিটবেল্ট বাঁধতে বলা হলো, আর কম্পিউটারিক কণ্ঠস্বর বারবার ঘোষণা করছিল—“লঞ্চের জন্য প্রস্তুত হোন।”

অভিজিৎ প্রথমে ভেবেছিল, সিনেমায় যেমন দেখা যায়, রকেট উঠলে বুক ফেটে যাবে—এখানেও তাই হবে। কিন্তু বাস্তবটা ছিল আলাদা। যানের শরীর কেঁপে উঠল, গর্জন ধ্বনিতে চারদিক কাঁপল, আর মুহূর্তের মধ্যে তারা মাটির মায়া ছিঁড়ে আকাশে উঠে গেল। জানালার বাইরে দেখা গেল পৃথিবী দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে—সবুজ, নীল আর সাদা রঙের গোলক, যার ভেতরেই তার সব শিকড়। বুক কেঁপে উঠল—এটাই কি বিদায়?

কিছুক্ষণ পর শরীর ভেসে উঠল। সিটবেল্ট খুলতেই সে বুঝল, এখন ওজন নেই। হাতটা তুলতে গিয়ে দেখল, হাত নিজের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। গা ছমছম করে উঠল, কিন্তু আশেপাশে অন্যরা যেন অভ্যস্ত। কেউ হাসছে, কেউ হাত দিয়ে উড়ন্ত কলম ধরছে।

ইরিনা পাশেই ভেসে ছিল। ঠোঁটে হালকা হাসি, বলল—
“প্রথমবার? ভয় পেয়ো না। এই ভাসা শিখলে মনে হবে যেন পাখা গজিয়েছে।”

অভিজিৎ হেসে ফেলল, কিন্তু ভিতরে ভিতরে আতঙ্ক রয়ে গেল। পা মাটিতে না ঠেকলে কি মানুষ সত্যিই মানুষ থাকে?

 

মহাকাশযানের করিডরে ভেসে ভেসে সবাই একত্র হলো। এক আমেরিকান প্রশিক্ষক খাবার এনে দিল—প্যাকেট খুলতেই ছোট ছোট রঙিন বলের মতো খাবার ভেসে উঠল। একেকজন মুখ খুলে বলটা ধরছে। অভিজিৎ প্রথমে অস্বস্তিতে ছিল, কিন্তু পরে ধীরে ধীরে শিখে গেল কিভাবে ভেসে থাকা পানির ফোঁটা বা খাবার গিলে ফেলতে হয়।

খাবার খেতে খেতে পরিচয় হলো আরও কিছু মানুষের সঙ্গে। একজন কেরালার রাজীব—মাছধরার ছেলে, টাকাপয়সার জন্য যোগ দিয়েছে। একজন আফ্রিকান, নাম স্যামুয়েল—সে বলল, নিজের গ্রামের স্কুল খোলার স্বপ্ন নিয়ে এসেছে। সবাই একই রকম পোশাক পরে আছে, সবাই একই ভাগ্যের যাত্রী।

কিন্তু ইরিনার চাহনি অন্যরকম। সে কারও সঙ্গে সহজে মেশে না, কেবল মাঝে মাঝে নোটবুক খুলে কিছু লিখে যায়। অভিজিৎ সাহস করে জিজ্ঞেস করল—
“আপনি কি শুধু খনির কাজ করতে যাচ্ছেন?”
ইরিনা ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—
“না, আমি গবেষক। এই চাঁদের মাটিতে যা আছে, সেটা শুধু খনিজ নয়। অনেক পুরোনো ইতিহাস চাপা আছে ওখানে।”

অভিজিৎ ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। “ইতিহাস? কিন্তু আমরা তো সোনা খুঁড়তে যাচ্ছি।”
“সোনা?” ইরিনার চোখে ঝলক উঠল। “তুমি ভাবছ শুধু সোনা? না, তার চেয়েও অদ্ভুত কিছু আছে।”

অভিজিৎ আর কিছু বলতে পারল না। মনে হলো, ওর কথায় এমন কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে যেটা বোঝা এখনই সম্ভব নয়।

 

যাত্রার দ্বিতীয় দিন। জানালার বাইরে দেখা গেল পৃথিবী আর নেই, শুধু অসংখ্য তারা, যেন কালো আকাশে গর্তের মতো। দূরে ছোট্ট আলোর বিন্দু—চাঁদ। কিন্তু সেই বিন্দু ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল।

রাতের বেলা (যদিও মহাকাশে রাত-দিন বলে কিছু নেই, কৃত্রিম আলোতেই সময় চলে) অভিজিৎ ঘুমোতে পারছিল না। শূন্যতার ভেতরে হঠাৎ আবার সেই সুর শুনল—মৃদু, ধাতব, কিন্তু সোনালি ঝংকারের মতো। চোখ মেলতেই দেখল, চারপাশ নিস্তব্ধ। যন্ত্রের শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। তবু কানে বাজছে যেন দূরের গান।

সে উঠে পড়তে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই দরজার পাশে দেখা গেল ইরিনাকে। সে ভেসে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ বন্ধ করে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
“তুমিও শুনছ?” অভিজিৎ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
ইরিনা চোখ মেলল, ধীরস্বরে বলল—
“হ্যাঁ। এই গান আমাদের ডাকছে।”

অভিজিৎ কেঁপে উঠল। ডাকছে? কে ডাকছে? কেনই বা ডাকছে?

 

তৃতীয় দিন। মহাকাশযানের স্পিকার বেজে উঠল—“আমরা চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করতে চলেছি।” সবাই জানালার পাশে ভিড় করল। এবার সেই সাদা-ধূসর গোলক ভেসে উঠল চোখের সামনে। গহ্বর, গর্ত, পাহাড়—চাঁদের শরীর যেন খসখসে, ক্ষতবিক্ষত।

যান ধীরে ধীরে নামতে শুরু করল নির্দিষ্ট ঘাঁটির দিকে। ভেতরে সবাই নিঃশ্বাস আটকে তাকিয়ে রইল। অভিজিৎ অনুভব করল বুকের ভেতর কেমন চাপা উত্তেজনা জমে উঠছে। এতদিনের স্বপ্ন, ভয় আর প্রত্যাশা মিলেমিশে এক অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করেছে।

তখনই আবার সেই গান বাজল কানে—এইবার অনেক স্পষ্ট।
“শোনো… শোনো…”

সে চমকে উঠল। এবার সে একা নয়—চারপাশের আরও কয়েকজন শ্রমিক মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। যেন সবাই শুনছে কিছু।

কিন্তু স্পিকারে হঠাৎ ঘোষণা এল—“প্রস্তুত হোন, আমরা অবতরণ করছি।”
গান থেমে গেল মুহূর্তেই।

 

মহাকাশযান ধীরে ধীরে নামল চাঁদের বুকে। জানালার বাইরে দেখা গেল গম্বুজ-ঘেরা এক বিশাল শিবির—চন্দ্রশিবির। সেখানে আলো জ্বলছে, যন্ত্রপাতি নড়ছে, রোবটরা হাঁটছে। মানুষ যেন চাঁদের বুকেও শহর বানিয়েছে।

অভিজিৎ নিঃশ্বাস ফেলল। এটাই তার নতুন পৃথিবী।
কিন্তু বুকের ভিতরে একটা গোপন ভয় জমে উঠল—যে গান বারবার তাকে ডাকছে, সেটা আসলে কোথা থেকে আসছে?

পর্ব ৩ : চন্দ্রশিবির

 

চাঁদের বুকের মাটি ছুঁতেই মহাকাশযান সামান্য কেঁপে উঠল। জানালার বাইরে নিঃশব্দ আলো। কোনো বাতাস নেই, তাই ধুলো একবার উঠলে অনেকক্ষণ ভেসে থাকে। অভিজিৎ তাকিয়ে দেখল, দূরে এক বিশাল গম্বুজ ঝকঝক করছে। সেই গম্বুজের ভেতরেই তৈরি হয়েছে মানুষের বাঁচার জায়গা—চন্দ্রশিবির

নেমেই সবার মাথায় চাপানো হলো হেলমেট। স্বচ্ছ কাচের ভেতর দিয়ে শ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়—হাঁপানির মতো ফুঁ ফুঁ। মাটিতে পা রাখতেই অভিজিৎ বুঝল, শরীর হালকা হয়ে গেছে। পা যতদূর ছোঁড়ে, ততদূর লাফিয়ে ওঠে। সে আঁকড়ে ধরল পাশের হাতল, যেন হাওয়ায় উড়ে না যায়।

চন্দ্রশিবিরের ভেতর ঢোকার সময় কঠোর পরীক্ষা হলো। রোবটেরা স্ক্যান করে দেখল শরীরে কোনো ভাইরাস বা বিকিরণ আছে কি না। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল সবাই।

ভেতরে ঢুকতেই মনে হলো যেন আরেকটা পৃথিবী—কৃত্রিম বাতাস, কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ, সবুজ আলোয় মোড়া করিডর। কিন্তু কোথাও জানালা নেই, সবই লোহার দেয়াল আর কাচের ছাদ। মানুষজন চলাফেরা করছে, কিন্তু সবার মুখ গম্ভীর। হাসি নেই, উচ্ছ্বাস নেই। যেন সবাই এক যান্ত্রিক জীবনে আটকে আছে।

অভিজিৎ আর রাজীবের জন্য নির্দিষ্ট ডরমিটরি বরাদ্দ হলো। ছোট্ট ঘর, দুটো বেড, একটা টেবিল, আর দেয়ালে ঝোলানো নির্দেশিকা—“শৃঙ্খলা মানো, নিয়ম ভাঙো না।”

রাতের বেলা শুয়ে থাকতে থাকতে অভিজিৎ লক্ষ্য করল, শিবিরটা আসলে এক প্রকার কারাগার। বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই, প্রতিটি দরজায় স্ক্যানার, প্রতিটি করিডরে ক্যামেরা। মানুষ শুধু খাটতে এসেছে, মনের ইচ্ছে মতো বাঁচতে নয়।

 

প্রথম কর্মদিবসেই ওদের নিয়ে যাওয়া হলো খনির দিকে। বিশাল লিফটে নামতে নামতে অভিজিৎ বুকের ভেতর চাপা ভয় টের পেল। নীচে নেমেই চোখে পড়ল অন্ধকার সুড়ঙ্গ, যার ভেতরে আলো ঝলকাচ্ছে। রোবট আর মানুষ মিলে খনন করছে মাটি।

মাটির গভীর থেকে অদ্ভুত চকচকে কণা বেরিয়ে আসছে। দেখতে সোনার মতো, কিন্তু আসল সোনা নয়। যেটা বেরোচ্ছে, সেটা কেবল আলো ছড়ায় না, হালকা কম্পনও তোলে।

অভিজিৎ যখন হাতে নিল, হঠাৎ কানে বাজল সেই সুর। এবার অনেক স্পষ্ট। যেন ভেতর থেকে গান গাইছে কেউ। সে চমকে পাথরটা ফেলে দিল। রাজীব হাসল—
“কী হলো? ভয় পাচ্ছিস?”
অভিজিৎ কিছু বলল না। চোখে ভয় লুকিয়ে রাখল।

 

সন্ধেবেলা কাজ শেষে ওরা ফিরে এলো ডরমিটরিতে। কিন্তু অভিজিৎ টের পেল, তার মাথার ভেতর সেই সুর বাজছে এখনও। ঘুম আসছে না। কান চাপলেও সুর থামছে না।

ঠিক তখনই দরজা খুলে ঢুকল ইরিনা। সে চুপচাপ টেবিলে বসে খাতা বের করল। চোখ না তুলেই বলল—
“আজ তুমি কণাগুলো হাতে নিয়েছিলে, তাই না?”
অভিজিৎ চমকে উঠল। “হ্যাঁ… তুমি কিভাবে জানলে?”
ইরিনা মুখ তুলল। চোখে গম্ভীর দৃষ্টি।
“কারণ আমিও শুনেছি সেই গান।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। এতদিন ভেবেছিল শুধু সে একাই পাগল হচ্ছে। কিন্তু ইরিনার গলায় কোনো বিভ্রম নেই। বরং দৃঢ় বিশ্বাস।

“এই খনিজ শুধু সোনা নয়,” ইরিনা ধীরে ধীরে বলল। “এটা এক ধরনের ভাষা। অনেক পুরোনো, হয়তো ভিনগ্রহী সভ্যতার। আমরা সেটা খুঁড়ে আনছি, অথচ বুঝতেই পারছি না কাকে জাগিয়ে তুলছি।”

অভিজিৎ হঠাৎ কাঁপল। সে জানত, চন্দ্রশিবিরে মানুষ খাটতে এসেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারা এক ভয়ংকর খেলায় নামছে—যেখানে মাটির ভেতরে ঘুমিয়ে আছে অচেনা শক্তি।

 

সেই রাতে ঘুম ভাঙল এক অদ্ভুত শব্দে। বাইরে সাইরেন বাজছে, লাল আলো জ্বলছে। সবাই দৌড়ে বেরোলো করিডরে। ঘোষণা ভেসে এলো—
“এক শ্রমিক আচমকা অচেতন হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে স্মৃতিভ্রংশ ঘটেছে।”

অভিজিৎ আতঙ্কে ইরিনার দিকে তাকাল। মহিলা ধীরে মাথা নেড়ে ফিসফিস করল—
“এটা শুরু মাত্র।”

পর্ব ৪ : সোনার খনিজ আবিষ্কার

 

অভিজিৎ ভোরে চোখ মেলতেই দেখল চারপাশে নিস্তব্ধতা। ডরমিটরির দেয়ালে আলো নিভু নিভু করছে। মাথার ভেতর যেন এখনও গত রাতের সাইরেন বাজছে। সে উঠে দাঁড়াল, জানালার মতো ছোট্ট ভেন্টিলেটর দিয়ে বাইরে তাকাল। দূরে দেখা গেল লাল আলো এখনও জ্বলছে খনিশিবিরের দিকটায়।

রাজীব তখনও ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু তার মুখ শান্ত নয়—কপালে ভাঁজ, ঠোঁটে অস্পষ্ট শব্দ। যেন স্বপ্নেও কেউ তাকে ডাকছে। অভিজিৎ ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকল, “রাজীব?” কিন্তু কোনো সাড়া নেই। ছেলেটা কেবল নিঃশ্বাসের সঙ্গে ভাঙা ভাঙা শব্দ করছে—যেন গান গাইছে অন্য ভাষায়।

সকালে ঘোষণা এলো—আজ সবাইকে আবার খনিতে নামতে হবে। অভিজিৎ ভিতরে ভিতরে আতঙ্কে কুঁকড়ে গেল। যে খনিজটা হাতে নেওয়ার পর মাথায় সুর বাজতে শুরু করেছে, আবার সেটার সাথেই মুখোমুখি হতে হবে।

 

লিফট দিয়ে নামতে নামতে চারপাশের শ্রমিকদের মুখ সে লক্ষ্য করল। কারও চোখ নিস্তেজ, কারও ঠোঁট অকারণে নড়ছে। মনে হলো, গান কেবল তার কানে নয়, অন্যদের মনেও ঢুকে পড়ছে ধীরে ধীরে।

খনির গভীর অন্ধকারে পৌঁছেই দেখা গেল মেশিনগুলো গর্জে চলছে। খনিশ্রমিকরা ধাতব যন্ত্র দিয়ে মাটি কেটে তুলছে। সেই মাটি থেকে আবার বেরোচ্ছে অদ্ভুত সোনালি কণা, যেন ভিতর থেকে আলো ছড়াচ্ছে।

আজ অভিজিৎকে বলা হলো সরাসরি সেই খনিজ সংগ্রহ করতে। সে গ্লাভস পরা হাত বাড়িয়ে মাটি সরাতেই দেখতে পেল, নিচে যেন এক রঙিন স্তর তৈরি হয়েছে। আলো ঝলকাচ্ছে, কম্পনও হচ্ছে। মনে হলো যেন মাটি নিজেই গান গাইছে।

সে হাত দিয়ে একটা টুকরো তুলতেই কানে আবার বাজল সেই সুর। এবার অনেক স্পষ্ট। শব্দ যেন মানুষের ভাষার মতো গড়ে উঠছে—
“আমাদের জাগাও… আমাদের মনে রেখো…”

অভিজিৎ কেঁপে উঠল। টুকরোটা মুঠোয় রাখতে পারল না, হাত কেঁপে ফেলে দিল। মাটি ছুঁতেই খনিজটা ভেঙে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু মাথার ভেতর সুর রয়ে গেল।

 

ইরিনা তখন পাশেই কাজ করছিল। সে চুপচাপ অভিজিতের দিকে তাকাল, তারপর বলল—
“শোনো, এটা কেবল খনিজ নয়। এটা এক ধরনের স্মৃতির ফাঁদ।”
অভিজিৎ বিভ্রান্ত হয়ে তাকাল। “মানে?”
ইরিনা চোখ সরু করে বলল—
“যে এটা শুনবে, তার নিজের স্মৃতি ধীরে ধীরে মুছে যাবে। সেই জায়গায় ভরে যাবে ওদের গান।”

অভিজিৎ স্তব্ধ। মনে পড়ল গত রাতের সেই শ্রমিকের কথা—যে হঠাৎ অচেতন হয়ে স্মৃতি হারিয়েছে।

 

হঠাৎ চিৎকার শোনা গেল। সামনের লেনে কাজ করা এক শ্রমিক হঠাৎ যন্ত্র ফেলে দু’হাত কানে চেপে ধরেছে। সে উন্মাদের মতো চিৎকার করছে—“থামাও, থামাও!” তারপর মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে সাইরেন বেজে উঠল, রোবটরা দৌড়ে এসে তাকে স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে গেল। বাকিরা ভয়ে চুপ করে রইল। শুধু ইরিনা মৃদুস্বরে বলল—
“দেখলে তো? গান ওদের ভেতর ঢুকছে। শিবির এই বিপদ লুকোচ্ছে। তারা চায় কেবল খনিজ নিয়ে যেতে।”

অভিজিৎ হঠাৎ অনুভব করল, এই কাজের আড়ালে বিশাল ষড়যন্ত্র আছে। সোনা নয়, অন্য কিছুর খোঁজ চলছে।

 

সন্ধ্যায় ফিরে এসে ডরমিটরিতে বসে সে ভাবছিল। জানালার বাইরে চাঁদের ধূসর সমুদ্রভূমি, চারদিকে নৈঃশব্দ। কিন্তু মাথার ভেতর এখনও সেই গান বাজছে।

তখন ইরিনা টেবিলে একটা ছোট্ট কণ্ঠযন্ত্র রাখল। বলল—
“আমি রেকর্ড করেছি। শোনো।”

যন্ত্র থেকে ভেসে এলো সেই ঝংকারময় সুর—কিন্তু এবার অভিজিৎ শুনল স্পষ্ট শব্দে:
“আমাদের মুক্ত করো।”

তার বুক কেঁপে উঠল।
“কে এরা?”—অভিজিৎ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।

ইরিনা উত্তর দিল না। শুধু দৃষ্টিতে বোঝাল—এটাই তাদের পরবর্তী অনুসন্ধানের শুরু।

 

পর্ব ৫ : ভিনগ্রহী গানের রহস্য

 

চন্দ্রশিবিরের রাত ছিল এক অদ্ভুত নৈঃশব্দে ভরা। বাইরে শূন্য মহাকাশ, ভেতরে কৃত্রিম আলো আর যন্ত্রের গুঞ্জন। কিন্তু অভিজিৎ আর ইরিনার কানে সেই নৈঃশব্দের ভেতর দিয়ে ভেসে আসছিল অন্য সুর—অচেনা, অথচ স্পষ্ট।

যন্ত্রে রেকর্ড করা গান বারবার চালাচ্ছিল ইরিনা। প্রতিবারই শোনার সময় অভিজিতের মনে হচ্ছিল, এই সুর তার ভেতরের কোনো লুকোনো দরজা খুলে দিচ্ছে। শব্দগুলো ভাঙা ভাঙা, তবু যেন বোঝা যায়—
“আমরা আছি… আমরা বন্দী… আমাদের জাগাও…”

অভিজিৎ গলা শুকনো হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এরা কারা? মানুষ নাকি অন্য কিছু?”
ইরিনা ঠান্ডা গলায় উত্তর দিল, “এরা মানুষ নয়। এরা ভিনগ্রহী। চাঁদের বুকের ভেতরে বহু হাজার বছর আগে ওরা আশ্রয় নিয়েছিল। এই খনিজ আসলে ওদের স্মৃতির সঞ্চয়। আমরা যত খুঁড়ছি, ততই ওদের স্মৃতি জেগে উঠছে।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। ভিনগ্রহী সভ্যতা—যেটা এখন পর্যন্ত শুধুই কল্পকাহিনি ছিল—হয়তো সত্যিই এখানে আছে। কিন্তু যদি সত্যি থাকে, তাহলে এই গানের ভয়াবহতা কী?

 

পরের দিন খনিতে আবার নেমে সবাই কাজ শুরু করল। অভিজিৎ ইচ্ছে করে খনিজের কাছে কান পাতল। সত্যিই সুরটা যেন বদলে যাচ্ছে। আজ সে শুনল অন্য শব্দ—
“তোমরা আমাদের ভুলে গেছ… আমরা ফিরে আসব…”

হঠাৎই পাশেই থাকা শ্রমিক এক ঝটকায় যন্ত্র ফেলে দিয়ে গলা ছিঁড়ে চিৎকার করে উঠল। চোখ লাল হয়ে গেছে, মুখে ফেনা, তারপর আচমকা সব শান্ত। লোকটা নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে রইল। তার চোখে কোনো চেতনা নেই—শূন্য, নিথর।

সবাই আতঙ্কিত হয়ে গেল। রোবট এসে তাকে তুলে নিয়ে গেল মেডিক্যাল ইউনিটে। ঘোষণা ভেসে এলো—“অস্থায়ী স্নায়ুজনিত সমস্যা। আতঙ্কিত হবেন না।”

কিন্তু অভিজিৎ বুঝল, এটা মিথ্যে। শ্রমিকের ভেতর থেকে কিছু মুছে গেছে। তার নিজের সত্তা নেই, কেবল ফাঁকা খোলস।

 

রাতে ডরমিটরিতে বসে ইরিনা বলল, “তুমি কি লক্ষ্য করেছ, এই গান শুধু সুর নয়—এটা এক অস্ত্র। যেই শুনবে, তার স্মৃতি মুছে যাবে।”
অভিজিৎ স্তব্ধ। “কিন্তু কেন? কার লাভ এতে?”
ইরিনা নিচু গলায় বলল, “কোম্পানি সেটা জানে। তারা এই গানকে পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চায়। মানুষের স্মৃতি মুছে গেলে তারা নতুন শাসন চাপিয়ে দেবে। ভিনগ্রহীদের গান হয়ে যাবে মানুষের কারাগার।”

অভিজিৎ শিউরে উঠল। এত বড় ষড়যন্ত্র! সে তো এসেছিল কেবল শ্রমিক হয়ে সোনা খুঁড়তে, অথচ এখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়াবহ যুদ্ধের প্রান্তে।

 

একদিন খনির গভীর সুড়ঙ্গে কাজ করতে করতে অভিজিৎ হঠাৎ দেখতে পেল এক অদ্ভুত দেয়াল। অন্য মাটির থেকে আলাদা, যেন চকচকে স্ফটিক দিয়ে তৈরি। কাছে যেতেই সেই দেয়াল থেকে তীব্র ঝংকার উঠল।

তার মাথার ভেতর হঠাৎ যেন অচেনা দৃশ্য ভেসে উঠল—অজানা শহর, সোনালি আলোয় ভরা মন্দির, উঁচু উঁচু প্রাণী, যাদের চোখে গলিত ধাতুর মতো ঝিলিক। তারা হাত তুলে গান গাইছে, আর সেই গান কাঁপিয়ে দিচ্ছে আকাশ।

অভিজিৎ হাঁপিয়ে উঠল। দেয়াল থেকে দূরে সরে এলো। ইরিনা দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেলল।
“দেখেছ?”—সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল।
অভিজিৎ মাথা নেড়ে বলল, “ওরা… ওরা জীবিত নয়, কিন্তু ওদের স্মৃতি বেঁচে আছে। গান হয়ে।”

ইরিনা গম্ভীর গলায় বলল, “ঠিক তাই। এই দেয়ালের ভেতরেই আছে ওদের সমাধি। আমরা ভুল করে সমাধি খুঁড়ে ফেলছি।”

 

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর অভিজিৎ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তাহলে আমরা কী করব? কাজ থামিয়ে দেব?”
ইরিনা ঠোঁট কামড়ে বলল, “এত সহজ নয়। কোম্পানি আমাদের হাতে বন্দুক ধরাবে, কিন্তু কাজ থামাতে দেবে না। আমাদের বাঁচতে হলে প্রথমে জানতে হবে, এই গান কোথা থেকে শুরু হয়েছে।”

অভিজিতের বুকের ভিতর অদ্ভুত এক দৃঢ়তা জমল। ভয় এখনও আছে, কিন্তু তার চেয়ে বড় হয়ে উঠছে কৌতূহল।

সে জানল, এই গান শুধু খনিজের সুর নয়। এটা এক ভিনগ্রহী সভ্যতার শেষ চিৎকার।

 

রাতের নিস্তব্ধতায় শিবির যখন ঘুমোচ্ছে, অভিজিৎ বিছানায় শুয়ে বারবার শুনতে লাগল সেই সুর—
“আমাদের জাগাও… আমাদের মনে রেখো…”

এবার মনে হলো, গানটা সরাসরি তার নাম ধরে ডাকছে।
“অভিজিৎ…”

সে শিউরে উঠল।

পর্ব ৬ : বিদ্রোহের সূচনা

 

চন্দ্রশিবিরে দিনগুলো ক্রমে ভারী হয়ে উঠছিল। প্রতিটি সকাল একই রকম—রোবটের সাইরেন বাজে, সবাই লিফটে নেমে যায় খনির অন্ধকারে, যন্ত্রের শব্দের ভেতর গুঁড়ো মাটি আর ঝলমলে খনিজ কুড়িয়ে আনা। কিন্তু অভিজিৎ টের পাচ্ছিল, প্রতিদিনই কারও না কারও চোখ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে, কারও ঠোঁটে ভেসে উঠছে অচেনা শব্দ, যেন তাদের আত্মা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে।

কোম্পানির ঘোষণা সবসময় একই—“স্বাভাবিক চিকিৎসা চলছে, আতঙ্কিত হবেন না।” কিন্তু অভিজিৎ আর ইরিনা জানত সত্যি কী। গান মানুষের ভেতর ঢুকে তাদের স্মৃতি মুছে দিচ্ছে।

এক রাতে ডরমিটরির আলো নিভে যাওয়ার পর অভিজিৎ চুপচাপ বেরিয়ে এল করিডরে। সেখানে দেখল, আরও কয়েকজন শ্রমিক জড়ো হয়েছে। রাজীবও তাদের মধ্যে আছে। মুখে আতঙ্ক, চোখে প্রশ্ন।

“আমাদের বাঁচতে হবে,” রাজীব বলল। “প্রতিদিনই কেউ না কেউ হারিয়ে যাচ্ছে। কাল স্যামুয়েলকে দেখেছ? পুরো নামটাই ভুলে গেছে। নিজের গ্রাম চিনতেও পারছে না।”

অভিজিৎ নিঃশ্বাস ফেলল। “হ্যাঁ। এইভাবে চলতে পারে না। আমাদের কিছু করতে হবে।”

ঠিক তখনই ইরিনা এগিয়ে এল। তার হাতে নোটবুক। সবাইকে ফিসফিস করে বলল—
“আমি প্রমাণ পেয়েছি। কোম্পানি জানে এই খনিজ বিপজ্জনক। তারা এটাকে পৃথিবীতে নিয়ে যেতে চাইছে অস্ত্র বানানোর জন্য। মানুষের স্মৃতি মুছে দিয়ে নতুন শাসন চাপাবে। আমাদের আটকাতে হবে।”

শ্রমিকরা স্তব্ধ হয়ে গেল। ভয় তাদের চোখে, কিন্তু তার চেয়েও গভীরে জ্বলছে রাগ।

 

পরের দিন খনিতে কাজের সময় অভিজিৎ চুপচাপ নজর রাখছিল। কোম্পানির সেনারা সবসময় বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের চোখ ঠান্ডা, মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। শ্রমিকদের যেন পশুর মতো খাটানো হয়।

অভিজিৎ খনির দেয়ালে হাত রেখে হঠাৎ আবার সেই ঝংকার শুনল। এবার গানটা যেন তার ভেতরে এক শপথ জাগিয়ে তুলল—
“আমাদের মুক্ত করো…”

তার মনে হলো, এ শুধু ভিনগ্রহীদের ডাক নয়, এ তার নিজের হৃদয়েরও ডাক।

 

রাতে সবাই আবার জড়ো হলো। এবার সিদ্ধান্ত নিল তারা।
১. খনিজ সংগ্রহ যতটা সম্ভব কম করবে।
২. কোম্পানির যোগাযোগ ব্যবস্থায় হ্যাক করে পৃথিবীতে বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করবে।
৩. সুড়ঙ্গের ভেতরে গোপনে অনুসন্ধান চালাবে, যেখানে আসল রহস্য চাপা আছে।

ইরিনা বলল, “আমি কোড ভাঙতে পারি। কিন্তু আমার সঙ্গে কেউ থাকতে হবে। অভিজিৎ, তুমি থাকবে?”
অভিজিৎ মাথা নেড়ে বলল, “থাকব।”

 

পরদিন খনির কাজের সময় তারা গোপনে সুড়ঙ্গের একপাশে সরে গেল। করিডরের পাথরের নিচে ছোট্ট ফাঁক, যেটা রোবটদের নজরে আসে না। সেখানে ঢুকতেই তারা আবিষ্কার করল অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা—অপরিচিত অক্ষর, যেগুলো অন্ধকারেও ঝলমল করছে।

অভিজিৎ আঙুল দিয়ে ছুঁতেই মাথার ভেতর ছবি ভেসে উঠল—প্রাচীন ভিনগ্রহীরা গান গাইছে, আলোয় ভেসে থাকা মন্দিরে নক্ষত্রের মানচিত্র আঁকছে।

ইরিনা স্তব্ধ হয়ে গেল। “এটাই আসল প্রমাণ। কোম্পানি এটা জানে, তবু লুকোচ্ছে।”

ঠিক তখনই পেছন থেকে আলো পড়ল। দু’জন সশস্ত্র প্রহরী দাঁড়িয়ে।
“এখানে কী করছ তোমরা?”

অভিজিৎ আর ইরিনা একে অপরের দিকে তাকাল। মুহূর্তের ভেতরেই অভিজিতের ভেতর জমে থাকা ভয় ছিঁড়ে গেল। সে জানত, পালানোর পথ নেই।

সে ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমরা জানি তোমাদের ষড়যন্ত্র। আর চুপ করে থাকব না।”

 

প্রহরীরা বন্দুক তুলতেই রাজীব আর আরও দু’জন শ্রমিক ছুটে এসে তাদের আটকানোর চেষ্টা করল। মুহূর্তের মধ্যেই ধস্তাধস্তি শুরু হলো। আলো ঝলকানি, ধাতব আওয়াজ।

প্রথম রক্তপাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল চন্দ্রশিবিরে।

এভাবেই শুরু হলো বিদ্রোহ।

পর্ব ৭ : চাঁদের অন্ধকার গুহা

 

প্রহরীদের সঙ্গে সংঘর্ষের পর শিবিরে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ল। লাল সাইরেন বাজতে লাগল, রোবটরা দৌড়ে এলো, আর শ্রমিকদের উপর কড়া নজরদারি বসানো হলো। কিন্তু তাতে অভিজিৎ আর ইরিনার মনোবল ভাঙল না। বরং বিদ্রোহী দলে আরও কয়েকজন যোগ দিল। সবার চোখে একটাই প্রশ্ন—যদি আমরা চুপচাপ মরে যাই, তবেই বা বাঁচার মানে কী?

সেই রাতেই, যখন ক্যামেরার নজরদারি কিছুক্ষণের জন্য ঝাপসা হলো, ইরিনা ফিসফিস করে বলল—
“আমাদের গভীর সুড়ঙ্গে নামতে হবে। ওখানেই আসল রহস্য লুকানো।”

অভিজিৎ, রাজীব আর আরও দু’জন সাহসী শ্রমিক প্রস্তুত হলো। ছোট্ট টর্চ আর অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে তারা ঢুকে পড়ল নিষিদ্ধ খনির পথে।

 

গভীর সুড়ঙ্গটা ক্রমশ সরু হতে হতে এমন জায়গায় পৌঁছল, যেখানে দেয়াল ঝকঝক করছে সোনালি খনিজে। চারপাশে এক অদ্ভুত আলো, যেন মাটির ভেতর দিয়েই গান বেরোচ্ছে। প্রতিটি পাথর যেন ধ্বনিত হচ্ছে—ঝংকার, প্রতিধ্বনি, সুর।

অভিজিৎ অনুভব করল, তার মাথার ভেতর সেই গান তীব্র হয়ে উঠছে। চোখ বন্ধ করতেই সে দেখতে পেল অদ্ভুত দৃশ্য—এক বিশাল মন্দির, যার স্তম্ভ সোনালি ধাতুর তৈরি, আর প্রতিটি স্তম্ভে খোদাই করা অচেনা প্রতীক।

“ওখানেই আমাদের যেতে হবে,” ইরিনা ফিসফিস করে বলল, যেন গান শুনে পথ পাচ্ছে।

তারা এগোতে লাগল, আর কয়েক মিনিটের মধ্যে সুড়ঙ্গ খুলে গেল এক বিশাল গুহায়।

 

অন্ধকার গুহার ভিতরে প্রবেশ করতেই সবাই স্তব্ধ হয়ে গেল। গুহার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল প্রতিমা—মানুষের মতো, আবার সম্পূর্ণ মানুষ নয়। লম্বা, উজ্জ্বল, চোখে গলিত ধাতুর মতো আগুন। প্রতিমার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য সোনালি খনিজ, যেন ভক্তদের অর্ঘ্য।

গুহার ছাদে তারা দেখতে পেল অদ্ভুত নক্ষত্রচিত্র আঁকা। সেগুলো পৃথিবীর মানচিত্রের মতো নয়। মনে হলো অন্য কোনো গ্যালাক্সির মানচিত্র।

অভিজিৎ হঠাৎ অনুভব করল, প্রতিমার চোখ তার দিকে তাকাচ্ছে। অচেনা অথচ পরিচিত দৃষ্টি—যেন তাকে চিনে নিয়েছে বহুদিনের পুরোনো কোনো বন্ধুর মতো।

তার মাথার ভেতর ভেসে এলো গম্ভীর সুর—
“তুমি আমাদের উত্তরাধিকারী…”

সে শিউরে উঠল। চারপাশে অন্যরা শুধু ঝংকার শুনছে, কিন্তু কথা কেবল সে-ই শুনছে।

 

রাজীব বিস্ময়ে হাঁ করে বলল, “এ যেন দেবতার আসন!”
ইরিনা ঠান্ডা গলায় বলল, “এটা দেবতা নয়। এটা ভিনগ্রহী সভ্যতার স্মৃতিস্তম্ভ। ওরা চাঁদে এসেছিল, আর এখানে রেখে গেছে নিজেদের অস্তিত্ব।”

অভিজিৎ কিছু বলতে পারল না। তার বুক কাঁপছিল। প্রতিমার চোখে যে দৃষ্টি পড়ল, তা কেবল মূর্তি নয়—জীবন্ত যোগাযোগ।

 

হঠাৎই গুহার ভেতরে আলো ঝলসে উঠল। শিবিরের প্রহরীরা তাদের খুঁজে পেয়ে গেছে। বন্দুক তাক করা হলো বিদ্রোহীদের দিকে।

কিন্তু গুলি ছোড়ার আগেই গুহা কেঁপে উঠল। প্রতিমার চোখ থেকে ঝলসে বেরোল সোনালি আলো। সেই আলোয় প্রহরীরা কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে পড়ে গেল, যেন তাদের মাথার ভেতর কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছে।

ইরিনা বিস্ময়ে ফিসফিস করল, “দেখছ? এই প্রতিমাই গান জাগিয়ে তুলছে।”

অভিজিৎ স্তব্ধ দাঁড়িয়ে রইল। তার কানে বাজছিল শুধু একটাই শব্দ—
“মুক্ত করো…”

 

গুহার ভেতরের প্রতিটি দেয়ালে ঝংকার বাড়তে লাগল। শ্রমিকরা আতঙ্কিত হয়ে উঠল, কেউ কাঁদছে, কেউ প্রার্থনা করছে।

কিন্তু অভিজিৎ অনুভব করল, গান তার ভেতরে প্রবেশ করছে না, বরং তাকে বাঁচিয়ে রাখছে। যেন তার শরীরের কোথাও লুকোনো আছে প্রতিরোধের সুর।

সে বুঝল, চাঁদের অন্ধকার গুহায় কেবল খনিজ নয়, লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের যুদ্ধের বীজ।

পর্ব ৮ : গান ও স্মৃতির যুদ্ধ

 

চাঁদের গুহায় প্রতিমার চোখ থেকে যে আলো ঝলসে উঠেছিল, তা যেন পুরো শিবিরকেই কাঁপিয়ে দিল। প্রহরীরা একে একে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, কারও মুখে হাহাকার, কারও চোখে নিস্তেজ শূন্যতা। গান তাদের ভেতরে ঢুকে মুছে দিচ্ছে সব স্মৃতি।

কিন্তু অভিজিৎ দাঁড়িয়ে রইল অটল। তার কানে গান বাজছিল, তবু সেটা তাকে গ্রাস করতে পারছিল না। বরং মনে হচ্ছিল, ভেতরে কোথাও একটা সুর তাকে রক্ষা করছে।

ইরিনা বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি কেমন করে টিকছো?”
অভিজিৎ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আমি জানি না… কিন্তু মনে হচ্ছে, আমার শরীরে অন্যরকম সুর আছে। যেন বাংলার লোকগানের মতো, যেটা আমাকে ধরে রেখেছে।”

ইরিনা স্তব্ধ হয়ে গেল। “তাহলে তুমি-ই একমাত্র পারবে।”

 

শিবির থেকে আরও সেনা ঢুকল গুহায়। তারা বিশেষ যন্ত্র এনেছে, যাতে শব্দ আটকানো যায়। কিন্তু প্রতিমার ঝংকার এত প্রবল যে যন্ত্র ভেঙে গেল মুহূর্তেই। সেনারা একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

তখন শিবিরের কমান্ডার সামনে এল। তার হাতে অদ্ভুত ধাতব অস্ত্র। সে গর্জে উঠল,
“এই গান আমাদের সম্পত্তি। পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে আমরা নতুন বিশ্ব তৈরি করব। কেউ আমাদের থামাতে পারবে না।”

অভিজিৎ চিৎকার করে বলল, “তুমি পাগল! এটা অস্ত্র নয়, এটা স্মৃতির অভিশাপ। পুরো পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।”
কমান্ডার হেসে উঠল। “ধ্বংস নয়, নিয়ন্ত্রণ। মানুষ স্মৃতি ভুললে নতুন শাসন মানতে বাধ্য হবে।”

 

তখনই গুহা ভেঙে পড়তে শুরু করল। প্রতিমার চোখ থেকে আরও প্রবল আলো বেরোলো, যেন হাজার বছরের দমিত ক্রোধ ফেটে বেরোচ্ছে।

শ্রমিকরা একে একে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, কারও মুখে শিশুর মতো হাসি, কেউ আবার নিজের নাম ভুলে গিয়ে চিৎকার করছে। ইরিনা অভিজিতকে আঁকড়ে ধরল।
“আমাদের কিছু করতে হবে, না হলে সবাই শেষ।”

অভিজিৎ সাহস সঞ্চয় করে প্রতিমার দিকে এগোল। তার মাথার ভেতর বাজছিল দুটো সুর—একটা ভিনগ্রহীর ঝংকার, অন্যটা তার গ্রামের মাঠের ভাটিয়ালি গান।

সে বুক চেপে এগোল, ঠোঁট খুলে নিজের কণ্ঠে গাইতে শুরু করল।
“ও নদীরে… ফিরে আয়…”

গান মিশে গেল প্রতিমার ঝংকারের সঙ্গে। হঠাৎ আশ্চর্য হলো—ভিনগ্রহীর গান থমকে গেল এক মুহূর্তের জন্য, যেন অবাক হয়েছে। তারপর প্রতিধ্বনির ভেতর দিয়ে ভেসে এল শব্দ—
“তুমি প্রতিরোধ করছ… তোমার সুর আমাদের থামাচ্ছে…”

 

কমান্ডার গর্জে উঠল, বন্দুক তুলল অভিজিতের দিকে। কিন্তু তখন ইরিনা ঝাঁপিয়ে পড়ল, অস্ত্র ছিনিয়ে নিল। ধস্তাধস্তির মধ্যে গুলি ছুটল, কমান্ডার মাটিতে পড়ে গেল।

গুহার ভেতর তীব্র আলোয় সবার চোখ ঝলসে যাচ্ছিল। প্রতিমা যেন ক্রোধে কাঁপছে। অভিজিৎ দাঁড়িয়ে গাইতে লাগল গ্রামের লোকগান, একটার পর একটা—ভাটিয়ালি, বাউল, জারি।

গান তার বুক ফাটিয়ে বেরোচ্ছে, অথচ তার কণ্ঠে ছিল না কোনো ভয়—ছিল কেবল প্রতিরোধ।

ভিনগ্রহীর সুর ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো। প্রতিধ্বনি আর আতঙ্ক নয়, যেন এক ধরনের শান্তি ভেসে উঠল।

ইরিনা কেঁপে উঠে বলল, “তুমি পেরেছো… তুমি ওদের গান বদলে দিয়েছো।”

 

কিন্তু শিবির তখনও থামেনি। বাইরে থেকে শেষ রকেট প্রস্তুত হচ্ছিল খনিজ বোঝাই করে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য। যদি সেটা পৌঁছে যায়, তবে সারা পৃথিবী গান-অস্ত্রের কবলে চলে যাবে।

অভিজিৎ প্রতিমার দিকে তাকাল। তার কানে ভেসে এলো শেষ শব্দ—
“এখন সিদ্ধান্ত তোমার। মুক্তি দাও, না হলে গান পৃথিবী গ্রাস করবে।”

 

সে জানত, সামনে আসছে শেষ যুদ্ধ—স্মৃতির, অস্তিত্বের, আর মানবতার।

 

পর্ব ৯ : প্রত্যাবর্তন না অন্তর্ধান?

 

চন্দ্রশিবিরের ভেতর তখন দমবন্ধ করা অস্থিরতা। গুহার আলো কিছুটা শান্ত হলেও বাইরে সাইরেন বাজছে, রোবটরা ছুটোছুটি করছে, আর কোম্পানির বিজ্ঞানীরা আতঙ্কে ছুটে বেড়াচ্ছে। তবু তারা শেষ চেষ্টায় রকেট প্রস্তুত করছে—যাতে খনিজ বোঝাই করে পৃথিবীতে পাঠানো যায়।

ইরিনা অভিজিতের কাঁধ ধরে ফিসফিস করে বলল, “যদি ওটা পৌঁছায়, সব শেষ। কোটি কোটি মানুষ গান শুনে স্মৃতি হারাবে।”

অভিজিৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিমার চোখ থেকে আসা সোনালি আলো এখনও তার উপর পড়ছে, আর তার ভেতরে প্রতিধ্বনির মতো বাজছে সেই ডাক—
“তুমি-ই পারো। আমাদের মুক্ত করো।”

সে জানত, এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে—নিজেকে বাঁচানো নয়, পৃথিবীকে বাঁচানো।

 

বিদ্রোহীরা গোপনে শিবিরের নিয়ন্ত্রণকক্ষে ঢুকে পড়ল। ভেতরে অসংখ্য স্ক্রিন জ্বলছে, রকেটের কাউন্টডাউন শুরু হয়ে গেছে। দশ মিনিটের মধ্যেই উৎক্ষেপণ হবে।

রাজীব চিৎকার করে বলল, “আমরা সিস্টেম ভাঙতে পারব না। সব কোড লক করা।”
ইরিনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “একটাই পথ আছে। শক্তি উৎস ধ্বংস করতে হবে।”

অভিজিৎ তাকিয়ে রইল স্ক্রিনের দিকে। পৃথিবীর ছবি ফুটে উঠেছে—নীল সবুজ গোলক, যেটা তার জন্মভূমি। মা, পিতা, গ্রাম, মাঠ, নদী—সব ওই গোলকের ভেতর। যদি গান সেখানে পৌঁছায়, তবে সবকিছু হারিয়ে যাবে।

 

সে হঠাৎ শান্ত গলায় বলল, “আমিই যাব। শক্তি উৎস ধ্বংস করব।”

সবাই চমকে তাকাল। রাজীব চিৎকার করে উঠল, “না! ওখানে প্রবল বিকিরণ, কেউ বাঁচবে না।”
অভিজিৎ দৃঢ় গলায় বলল, “কেউ না কেউ তো মরবেই। যদি আমি যাই, অন্তত পৃথিবী বেঁচে থাকবে।”

ইরিনার চোখ ভিজে উঠল। “তুমি বুঝতে পারছ, ফিরে আসবে না?”
অভিজিৎ মৃদু হাসল। “হয়তো আমি ফিরে আসব অন্যভাবে। গান হয়ে।”

 

সে একা এগিয়ে গেল শিবিরের কেন্দ্রে, যেখানে শক্তি উৎস জ্বলছে নীল আলোয়। চারপাশে রোবট পাহারা দিচ্ছিল, কিন্তু গুহার প্রতিমার আলো এখনও তাকে ঘিরে রেখেছিল। রোবটরা একে একে বিকল হয়ে পড়ে গেল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের থামিয়ে দিল।

অভিজিৎ কাছে গিয়ে শক্তি উৎসের প্যানেলে হাত রাখল। মুহূর্তে কানে বাজল প্রবল গান। মাথার ভেতর অন্ধকার আলোয় ভেসে উঠল কোটি কোটি স্মৃতি—অচেনা প্রাণী, তাদের সভ্যতা, তাদের পতন।

তারা একসাথে বলল—
“আমাদের মুক্ত করো, তোমার আত্মা আমাদের সঙ্গে মিলিয়ে দাও।”

অভিজিৎ চোখ বন্ধ করল। ঠোঁটে আবার ভেসে উঠল তার গ্রামের গান—
“ও নদীরে… ফিরে আয়…”

সে হাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ ছিঁড়ে ফেলল।

 

আলো বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ল। পুরো শিবির কেঁপে উঠল। রকেট থেমে গেল, কাউন্টডাউন নিস্তব্ধ হলো। খনিজগুলো ভেঙে ভস্ম হয়ে গেল, কিন্তু সেই আলোয় অভিজিৎ অদৃশ্য হয়ে গেল।

বিদ্রোহীরা সজল চোখে তাকিয়ে রইল—সে আর নেই।

 

ইরিনা ফিসফিস করে বলল, “সে বাঁচল না, কিন্তু আমাদের বাঁচাল।”

রাজীব কাঁপা কণ্ঠে বলল, “তাহলে কি সে শেষ হয়ে গেল?”
ইরিনা দূরের আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদের নিস্তব্ধতার ভেতর হঠাৎ ভেসে এলো মৃদু সুর।
“আমাদের মনে রেখো…”

অভিজিৎ যেন গান হয়ে রয়ে গেল চাঁদের বুকেই।

পর্ব ১০ : শেষ গান

 

চন্দ্রশিবিরে আলো নিভে গিয়েছিল বিস্ফোরণের পর। ধুলো, ভাঙা ধাতব কাঠামো, মৃত রোবট ছড়িয়ে ছিল চারদিকে। কিন্তু রকেট আর ওঠেনি। পৃথিবীর দিকে যে বিপদ এগোচ্ছিল, তা থেমে গেছে।

বিদ্রোহীরা নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সবাই জানত—অভিজিৎ আর ফিরবে না। সে নিজের জীবন দিয়েই শক্তি উৎস ধ্বংস করেছে।

ইরিনা টলতে টলতে বাইরে বেরোল। গম্বুজের কাচের ওপারে কালো আকাশ, তাতে ঝুলছে নীল-সবুজ পৃথিবী। তার চোখ ভিজে উঠল।
“সে বেঁচে নেই… অথচ এখনও যেন আছে।”

ঠিক তখনই বাতাস কেটে মৃদু সুর ভেসে এলো। যেন কোথাও দূরে বসে কেউ গান গাইছে। ভাটিয়ালি সুর, বাংলার নদীর গানের মতো।

রাজীব কেঁপে উঠল। “তুমি শুনছো?”
ইরিনা চোখ মুছে ফিসফিস করে বলল, “হ্যাঁ… এ ওর শেষ গান।”

 

কয়েকদিন পর, পৃথিবীতে সংবাদ পৌঁছল—চন্দ্রশিবিরে ভয়ংকর দুর্ঘটনা, কিন্তু বিপজ্জনক খনিজ নষ্ট হয়ে গেছে। পৃথিবী নিরাপদ।

কেউ জানল না আসলে কী হয়েছিল। কোম্পানি সব চাপা দিল। সংবাদে অভিজিতের নাম এল না। সে থেকে গেল এক অচেনা শ্রমিক হিসেবেই।

কিন্তু গ্রামের মাঠে, তার মায়ের কানে হঠাৎ মাঝরাতে ভেসে আসে মৃদু সুর—
“ও নদীরে… ফিরে আয়…”

মা চোখ মুছে আকাশের দিকে তাকান। দূরে চাঁদ ঝলমল করছে। মনে হয়, ছেলেটা হয়তো সত্যিই গান হয়ে আকাশে রয়ে গেছে।

 

ইরিনা ফিরে গেল পৃথিবীতে। কিন্তু তার ভেতর বদলে গেল অনেক কিছু। গবেষণার কাগজে সে লিখল—
“ভিনগ্রহীরা আমাদের দখল করতে আসেনি, তারা শুধু তাদের স্মৃতি বাঁচাতে চেয়েছিল। আর সেই স্মৃতির সুরে একজন মানুষ নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে।”

সে নাম লিখতে পারেনি। কেবল শেষ লাইনে লিখল—
“সে আমাদের গান হয়ে গেছে।”

 

পৃথিবীর মানুষ জানে না, কিন্তু চাঁদের নিস্তব্ধতায় এখনও মাঝে মাঝে শোনা যায় সেই সোনালি ঝংকার। না, সেটা আর ভয়ংকর নয়। সেটা শান্ত, মধুর, যেন কারও আত্মা আকাশ ছুঁয়ে গান গাইছে।

এবং সেই গান সবাইকে মনে করিয়ে দেয়—
কোনো একসময়, এক সাধারণ ছেলে নিজের গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করে হয়ে উঠেছিল মহাকাশের শেষ প্রতিরোধ।

শেষ

WhatsApp-Image-2025-08-25-at-1.51.43-AM.jpeg

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *